অত্রি সংহিতা ও জাতিভেদ

জাতিভেদ

ভূমিকা

ধর্মশাস্ত্রগুলির মধ্যে অত্রি সংহিতা অন্যতম। ঋষি অত্রি এর রচয়িতা। এতে তিনি ‘চতুর্বর্ণের সনাতন ধর্ম’ ব্যক্ত করেছেন। বিভিন্ন বর্ণের কাজ সম্বন্ধে অত্রি বলেন-

“ব্রাহ্মণের ছয়টি কাজ । তার মধ্যে যজন (যজ্ঞ, পূজা-অর্চনা প্রভৃতি), দান ও অধ্যয়ণ , এই তিনটি তপস্যা , আর প্রতিগ্রহ (ভিক্ষা গ্রহণ) , অধ্যাপন ও যাজন (পৌরোহিত্য) এই তিনটি জীবিকা। ক্ষত্রিয়ের পাঁচটি কাজ। তার মধ্যে যজন, দান ও অধ্যয়ণ এই তিনটি তপস্যা ; আর অস্ত্রব্যবহার ও প্রাণীরক্ষা এই দুইটি জীবিকা। বৈশ্যেরও যজন, দান ও অধ্যয়ণ – এই তিনটি তপস্যা ; আর বার্তা অর্থাৎ কৃষি, বাণিজ্য , গোরক্ষা ও কুসীদ – এই চারটি জীবিকা। শূদের দ্বিজসেবাই (অর্থাৎ, উচ্চ তিন বর্ণের সেবা) তপস্যা এবং শিল্পকর্ম জীবিকা“

তিনি বলেন,  চার বর্ণের লোকেরা তার কথিত ধর্মের অনুগামী হলে ইহকালে বহুমান প্রাপ্ত হয়ে পরকালে সদগতি লাভ করেন।  কিন্তু বিভিন্ন বর্ণ তার নির্ধারিত স্ব স্ব কাজ না করে অন্য বর্ণের কাজ করলে তিনি রাজাকে তাদের শাস্তি প্রদান করতে বলেছেন এবং এর ফলে রাজা স্বর্গে গমন করবেন এমনও বলেছেন।  তার কথায়, ‘স্বধর্মে থাকলে শূদ্রও স্বর্গ লাভ করে’ ‘ পরধর্ম অন্যের সুন্দরী স্ত্রীর মতই সর্বতোভাবে ত্যাজ্য’।  

শূদ্রকে তিনি দ্বিজদের (অর্থাৎ, উচ্চ তিন বর্ণের) কাজ করতে নিষেধ করেছেন। তিনি বলেছেন-

“জপ, হোম প্রভৃতি দ্বিজোচিত কর্মে নিযুক্ত শূদ্রকে রাজা বধ করবেন; কারণ জলধারা যেমন অনলকে বিনষ্ট করে , তেমনি ঐ জপ-হোম তৎপর শূদ্র সমস্ত রাজ্যকে বিনষ্ট করে ।“

এছাড়া বৈশ্যদেরও তিনি ব্রাহ্মণোচিত কার্য করতে নিষেধ করে বলেছেন, “প্রতিগ্রহ , অধ্যাপন, অবিক্রেয়-বিক্রয় বা যাজন এই চারটি কাজ করলে ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য পতিত হয়।“

ব্রাহ্মণদেরও অন্য বর্ণের কাজ করতে নিষেধ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, “ব্রাহ্মণও মাংস, লাক্ষা (গালা) ও লবণ বিক্রি করলে সদ্য পতিত হয় এবং দুধ বিক্রি করলে তিনদিনে শূদ্রের মত হয়।“

ব্রাহ্মণ

ব্রাহ্মণেরা মূলত পুরোহিত সম্প্রদায়। বিধাতা ব্রাহ্মণদের নাকি বিশেষ উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করেছিলেন। অত্রির ভাষায়,“স্বর্গ, পৃথিবী ও পাতাল এই তিন লোক; ঋক, যজুঃ ও সাম এই তিনবেদ, ব্রহ্মচর্য, গার্হস্থ, বানপ্রস্থ ও ভৈক্ষব এই চার আশ্রম ; দক্ষিণ , গার্হপত্য ও আহবনীয় এই তিন অগ্নি; এই সমস্তের রক্ষার জন্য বিধাতা ব্রাহ্মণ সৃষ্টি করেছেন।“  

ব্রাহ্মণ কিভাবে হয়? এই প্রশ্নের উত্তর ঋষি অত্রির শাস্ত্র হতে পাওয়া যায়। এ থেকে এটাও বোঝা যায় কেবল কর্মের ভিত্তিতে বর্ণ নির্ধারিত হত না, এক্ষেত্রে জন্মেরও গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব থাকতো।  তিনি বলেন-

“ব্রাহ্মণবংশে জন্ম হলে ব্রাহ্মণ হয় ; সংস্কার (উপনয়ন) হলে  তাকে দ্বিজ বলা হয়ে থাকে ; বিদ্যা দ্বারা বিপ্রত্ব লাভ এবং উক্ত জন্ম ,সংস্কার ও বিদ্যা এই তিন দ্বারা ‘শ্রোত্রিয়’ পদবাচ্য হয়।“

সর্ব বর্ণের উপরে অবস্থিত ব্রাহ্মণেরা যাতে বেশ সুখেই থাকতে পারেন ঋষি অত্রি সেরূপ বিধান দিয়ে বলেন-

“ যে রাজ্যে রাজা বেদজ্ঞ ও সর্বশাস্ত্রবিশারদ ব্রাহ্মণদের সমাদর করেন, সেখানে ভালো বৃষ্টি হয়ে থাকে।“

এছাড়া সাধারণের ঘরে ব্রাহ্মণের ভোজনে যাতে কোনো অসুবিধা না হয় তাই মুনিবর বলেছেন-

“যে সমর্থ ব্যক্তির গৃহে পক্ষের মধ্যে (অন্তত) মাসের মধ্যে ব্রাহ্মণ ভোজন না করে অর্থাৎ ব্রাহ্মণভোজন না হয় ; দ্বিজ তার অন্ন ভোজন করলে চান্দ্রায়ণ (প্রায়শ্চিত্ত) করবে।“

ব্রাহ্মণদের যাতে মাটির পাত্রে ভোজন করানো না হয়, তা স্পষ্ট ভাবে বলে দেওয়া হয়েছে-

“যে ব্যক্তি শ্রাদ্ধে পিতৃ গণের তৃপ্তির উদ্দেশ্যে মাটির পাত্রে ব্রাহ্মণভোজন করাবে , সেই অন্নদাতা এবং ভোক্তা উভয়েই নরকে গমন করবে। অন্য পাত্রের নিতান্ত অভাব হলে ঐ সকল শ্রাদ্ধীয় ব্রাহ্মণের অনুমতি নিয়ে মাটির পাত্রেও দিতে পারবে; কেননা শুদ্ধ ব্রাহ্মণদের সত্যমিথ্যা সকল বাক্যই প্রামাণিক।“

ব্রহ্মহত্যা

ব্রাহ্মণের জীবনকে অধিকতর মূল্যবান দেখিয়ে ব্রাহ্মণের মৃত্যুর জন্য ‘ব্রহ্মহত্যা’ নামে একটি বিশেষ শব্দ হিন্দু শাস্ত্রে ব্যবহৃত হতে দেখা যায়। অন্য বর্ণের মানুষকে হত্যা করার চাইতে ব্রাহ্মণকে হত্যা করা ছিল অধিকতর পাপজনক। তাই অত্রি সংহিতাতে বলা হয়েছে-

  • “প্রথম ব্রহ্মহত্যা, দ্বিতীয় বিমাতৃগমন , তৃতীয় সুরাপান, চতুর্থ স্তেয় , পঞ্চম এই সকল পাপীদের সাথে গুরুতর সংসর্গ – এগুলো মহাপাতক। এইসকল পাপ হতে শুদ্ধ হবার জন্য যথাক্রমে তিন বৎসর ব্রত আচরণ করবে; তাতে অনিচ্ছাকৃত ব্রহ্মহত্যার পাপ হতে মুক্তি লাভ করবে। ব্রহ্মহত্যা পাপের অর্ধেক পাপ ক্ষত্রিয় হত্যায় , ১/৬ ভাগ বৈশ্য হত্যায় এবং ১/১২ ভাগ পাপ শূদ্র হত্যায়। “
  • “গায়ত্রী জপ দ্বারা সকল পাপ বিনষ্ট হলেও,  ব্রহ্মহত্যার পাপ বিনষ্ট হয় না।“

পতিত ব্রাহ্মণ

চতুর্বর্ণের সর্বোচ্চ স্থানে ব্রাহ্মণেরা অবস্থান করলেও স্বকর্মত্যাগী ব্রাহ্মণকে অত্রি ভালো চোখে দেখেননি। ব্রত ও অধ্যয়ণ শূণ্য ব্রাহ্মণের প্রসঙ্গে বলা হয়েছে-

“ব্রত ও অধ্যয়ণ শূণ্য ব্রাহ্মণ যে গ্রামে ভিক্ষা লাভ করে জীবনধারণ করতে পারে ; রাজা সেই চোরপালক গ্রামবাসীদের হত্যা করবেন। যে রাজ্যে পণ্ডিতভোগ্য বস্তু মূর্খে ভোগ করে সেখানে অনাবৃষ্টি বা অন্যকোনো মহাভয় উপস্থিত হয়।“

বর্ণাশ্রম ধর্ম না মানলে ব্রাহ্মণকে ব্রাহ্মণত্ব হতে বঞ্চিত করার কথা বলা হয়েছে অত্রি সংহিতায়-

“কৃষিকার্যের গো প্রতিপালক, এবং বাণিজ্য তৎপর ব্রাহ্মণ বৈশ্য বলে উক্ত হন। যে লাক্ষা, লবণ, কুসুম্ভ , দুধ, ঘি, মধু বা মাংস বিক্রি করে সেই ব্রাহ্মণকে শূদ্র বলা হয়। চোর, তস্কর (বল পূর্বক পরধন অপহরণকারী ) , সূচক , কুপরামর্শ দাতা , দংশক (কটূভাষী) এবং সবসময় মাছ-মাংসলোভী ব্রাহ্মণকে নিষাদ বলা হয়। যে ব্রাহ্মণ বেদ এবং পরমাত্মতত্ত্ব কিছুই জানেনা অথচ কেবল যজ্ঞোপবীতের বলে অতিশয় গর্ব প্রকাশ করে , এই পাপে সেই ব্রাহ্মণকে পশু বলা হয়। যে নিঃশঙ্ক ভাবে (পাপের ভয় না করে) কূপ, তড়াগ, সরোবর এবং আরাম (সাধারণভোগ্য উপবন) রুদ্ধ করে, ( সেই স্থলের ব্যবহার বন্ধ করে ) সেই ব্রাহ্মণকে ম্লেচ্ছ বলা হয়। ক্রীয়াহীন ( সন্ধ্যা প্রভৃতি নিত্য নৈমিত্তিক কর্মহীন) , মূর্খ, সর্বধর্ম (সত্যবাদীতা প্রভৃতি) রহিত সকল প্রাণীর প্রতি নির্দয় ব্রাহ্মণকে চণ্ডাল বলা হয়।“

বর্ণবৈষম্য

ব্রাহ্মণ প্রভৃতি চার বর্ণের কর্মের ক্ষেত্রে যেমন ভিন্নতা রয়েছে, তেমনি তাদের সকলের সামাজিক অবস্থানও সমান নয়। ব্রাহ্মণ হতে শূদ্র পর্যন্ত সামাজিক মর্যাদা ক্রমান্বয়ে হ্রাস পেতে দেখা যায়। এর নজির অত্রির বিধানে রয়েছে-

  • “যদি কোনো ব্রাহ্মণ না জেনে কোনো ব্রাহ্মণের উচ্ছিষ্ট অন্ন ভোজন করে , তাহলে দুইদিন গায়ত্রী জপ করে শুদ্ধ হবে। ব্রাহ্মণ যদি না জেনে ক্ষত্রিয় বা বৈশ্যের উচ্ছিষ্ট অন্ন ভোজন করে, তাহলে তিন দিন গায়ত্রী জপ করে শুদ্ধ হবে। অভোজ্য অন্ন , স্ত্রীশূদ্রের উচ্ছিষ্ট বা অভক্ষ মাংস ভোজন করলে সাতদিন যবমণ্ড পান করবে।“ 
  • “ব্রাহ্মণের স্রোতোজল, ক্ষত্রিয়ের সরোবরজল, বৈশ্যের বাপীকূপজল, শূদ্রের ভাণ্ডজল সাধারণত স্নানের উপযোগী কিংবা এই বচন অনুযায়ী ঐ সকল জলের পার্থক্য নির্ণয় দ্বারা বুঝা যাচ্ছে – স্রোতোজল সর্বোৎকৃষ্ট , সরোবরজল তাহতে অপকৃষ্ট, ভাণ্ডজল সব চাইতে অপকৃষ্ট। “
  • “ব্রাহ্মণের দেওয়া অন্ন অমৃত ( অমৃতের মত তৃপ্তিজনক) ক্ষত্রিয়ের দেওয়া অন্ন দুগ্ধ ( দুধের মত তৃপ্তিজনক) , শূদ্রের দেওয়া অন্ন রক্ত ( রক্তের মত অভক্ষ হবে) ,এই সকল আমি বললাম, তাৎপর্য এই যে তিন বর্ণ সিদ্ধ অন্ন দ্বারা কার্য করবে , শূদ্র আমান্ন দ্বারা। যেহেতু বিপ্রের অন্ন ( ব্রাহ্মণের অন্ন) ঋগ্, যজুঃ, সাম মন্ত্র দ্বারা শোধিত , সেইজন্য তা অমৃত, ক্ষত্রিয়ের অন্ন বিচারানুগত – ধর্ম এবং ধর্মকর দ্বারা সংগৃহীত বলে তা দুগ্ধ; বৈশ্যের অন্ন পশুপালন দ্বারা সংগৃহীত বলে তা অন্নমাত্র।“
  • “ক্ষত্রিয়ের অন্ন তেজ, শূদ্রান্ন ব্রাহ্মণ্য নষ্ট করে ( সুতরাং অভোজ্য)।“
  • “শঙ্খ বলেন,- ব্রাহ্মণ ভোজন বা প্রস্রাব করার সময় , কোনো উচ্ছিষ্ট যুক্ত ব্রাহ্মণ তাকে স্পর্শ করলে , স্নান; তেমন ক্ষত্রিয় স্পর্শ করলে জপ, হোম , তেমন বৈশ্য স্পর্শ করলে নক্তব্রত এবং তেমন শূদ্র স্পর্শ করলে উপবাস করবে।“
  • “রজঃস্বলা ব্রাহ্মণীকে, রজঃস্বলা ব্রাহ্মণী স্পর্শ করলে একরাত উপবাস করে পঞ্চগব্য পান করে শুদ্ধ হবে। রজঃস্বলা ক্ষত্রিয়া রজঃস্বলা ব্রাহ্মণীকে স্পর্শ করলে ঐ ব্রাহ্মণী তিন রাত উপবাস করে (পঞ্চগব্য পান করে) শুদ্ধ হবে। রজঃস্বলা শূদ্রা রজঃস্বলা ব্রাহ্মণীকে স্পর্শ করলে ঐ ব্রাহ্মণী ছয়দিন উপবাস করে পঞ্চগব্য পান করে শুদ্ধ হবে। ব্রাহ্মণী জেনে স্পর্শ করলে এই নিয়ম। ব্রাহ্মণী না জেনে তাদের স্পর্শ করলে তার অর্ধেক প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে।“  
  • “শ্লেষ্মা, চর্মপাদুকা , বিষ্ঠা, মুত্র, রজঃশোণিত বা মদ দ্বারা দূষিত কূপের জল পান করলে , কেমন প্রায়শ্চিত্ত হবে? এর উত্তরে বলা হয়,  ব্রাহ্মণ তিনদিন, ক্ষত্রিয় দুইদিন এবং বৈশ্য একদিন উপবাস ও শূদ্র নক্তব্রত করলে শুদ্ধ হবে। “

এছাড়া, “যে ব্যক্তি অজ্ঞানবশত হীন বর্ণকে (নিজ হতে অধম জাতিকে) অভিবাদন করে , সে স্নান ও ঘৃত ভোজন করে শুদ্ধ হবে। “ এই উক্তিতেও বর্ণ বৈষম্যের নজির পাওয়া যায়।

অশৌচের ক্ষেত্রে ও বিভিন্ন বর্ণের ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন নিয়ম দেখায় যায় এই শাস্ত্রে। অশৌচের যে নিয়ম ধর্মশাস্ত্রে উল্লেখিত আছে, তা আজও হিন্দু সমাজ মেনে চলে। বিভিন্ন বর্ণের লোকেরা ভিন্ন ভিন্ন দিন পর্যন্ত অশৌচ পালন করে। অত্রি অশৌচের নিয়ম সম্বন্ধে বলেছেন-  

“ব্রাহ্মণ দশদিনের পর , ক্ষত্রিয় বারো দিনের পর ও শূদ্র একমাসের পর শুদ্ধ হয়। “

মৃত সন্তান ভূমিষ্ঠ হলে যে অশৌচ হয় তার ক্ষেত্রে তিনি বলেন-

“গর্ভমৃত বালক ভূমিষ্ঠ হলে যে অশৌচ হয় তাতে সূতিকা স্পর্শ না করলে শুদ্ধ আচমনের দ্বারা ব্রাহ্মণের অঙ্গাস্পৃশ্যতাজনক অশৌচ যাবে। ক্ষত্রিয় পঞ্চম দিনে, বৈশ্য সপ্তম দিনে এবং শূদ্র দশম দিনে স্পৃশ্য হবে… “

শূদ্র

শাস্ত্রের শুরুতেই অত্রি ‘অসদ্বংশীয়, অসচ্চরিত্র, মূর্খ, শূদ্র এবং খলস্বভাব দ্বিজ’ এই পাঁচ ধরণের লোককে তার এই শাস্ত্র না শেখাতে বলে দিয়েছেন।

উচ্চ তিন বর্ণের লোকেরা যেসকল কার্যের অধিকারী ছিলেন, অধিকাংশ সময়েই শূদ্র সে সকল অধিকার থেকে বঞ্চিত ছিল।  শূদ্রকে বৈদিক ধর্ম হতে বঞ্চিত করে অত্রি বলেছেন –

“অগ্নিহোত্র, তপস্যা, সত্যপরতা, বেদাজ্ঞা-প্রতিপালন, অতিথি সৎকার ও বৈশ্বদেব , এদের নাম ইষ্ট। বাপী, কূপ, তড়াগ প্রভৃতি জলাশয় উৎসর্গ, দেব মন্দির প্রতিষ্ঠা, অন্নদান ও আরাম (উপবন) প্রতিষ্ঠার নাম পুর্ত্ত। ব্রাহ্মণ যত্নপূর্বক ইষ্ট ও পুর্ত্ত করবে । ইষ্টদ্বারা স্বর্গ ও পুর্ত্ত দ্বারা মোক্ষ লাভ হবে। এই ইষ্ট ও পুর্ত্ত কার্যে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যের তুল্য অধিকার । শূদ্র পুর্ত্ত কার্যের অধিকারী বটে কিন্তু তার অন্তর্গত বৈদিক কর্ম নিজে করবেন না।“

স্ত্রী ও শূদ্রকে জপ, তপস্যা, তীর্থযাত্রা, সন্ন্যাস প্রভৃতি হতে বঞ্চিত করে বলা হয়েছে-

“স্ত্রীশূদ্রদের পাতিত্যজনক কার্যের বিবরণ দিচ্ছি । হে মহর্ষিগণ! শ্রবণ কর। জপ, তপস্যা, তীর্থযাত্রা, সন্ন্যাস , মন্ত্রসাধন, দেবতার আরাধনা এই ছয়টি কার্য স্ত্রী শূদ্রদের পাতিত্যজনক।“ 

এছাড়া শূদ্রার স্বামীকে শ্রাদ্ধে ভোজন না করানোর কথা বলা হয়েছে-

“বৃষলী পতিকে শ্রাদ্ধে ভোজন করাবে না।  (শূদ্রা, বন্ধ্যা, মৃতবতসা এবং কন্যাকালে ঋতুমতীর নাম বৃষলী)

গরু থেকে প্রাপ্ত পাঁচটি উপাদান- গোবর, গোমূত্র,ঘি, দুধ ও দধি মিশিয়ে পঞ্চগব্য তৈরি করা হত। পাপকর্ম করলে এই পঞ্চগব্য খেয়ে আর্যরা পাপমুক্ত হত-

“ব্রাহ্মণ অজ্ঞান পূর্বক শূদ্রের স্পর্শ করা জল পান করলে , স্নান শেষে পঞ্চগব্য পান করে একদিন উপবাস করে শুদ্ধ হবে।“

পঞ্চগব্য নামক উদ্ভট ও উৎকট পদার্থটি মহান আর্যদের কাছে অতীব মূল্যবান ছিল। শূদ্রকে বিভিন্ন অধিকার থেকে বঞ্চিত করার যে প্রবণতা দেখা যায়, তারই ধারাবাহিকতায় শূদ্রকে পঞ্চগব্য হতেও বঞ্চিত করে বলা হয়-

“পঞ্চগব্যে গোবরের দ্বিগুণ গোমূত্র, চারগুণ ঘি, দুধ এবং দধি আটগুণ। পঞ্চগব্যপায়ী শূদ্র এবং সুরাপায়ী ব্রাহ্মণ উভয়েই তুল্য পাপী ; এই দুই ব্যক্তি চিরদিন নরকে বাস করে।“ 

শূদ্র বা অস্পৃশ্যদের ছুঁতে বিষম আপত্তি থাকা সত্ত্বেও উচ্চ তিন বর্ণের তাদের কাছ থেকে অপক্ক দ্রব্য নিতে কোনো আপত্তি ছিল না। এই প্রসঙ্গে বলা হয়েছে-

“আরনাল ( কাঁজি ) , দুধ খই, প্রভৃতি , দধি, শক্তু, স্নেহপক্ক (পক্কতেল বা তেল প্রভৃতি দ্বারা পক্ক) ও তক্র (ঘোল) শূদ্রকৃত হলেও ( তা ভক্ষণ করলে ব্রাহ্মণ প্রভৃতির) দোষ হবে না। আর্দ্রমাংস ( অপক্ক মাংস) , ঘি, তেল এবং ফলজাত তেল ( ঈঙ্গুদীতেল প্রভৃতি) চণ্ডাল প্রভৃতি ইতর জাতির ভাণ্ডে থাকলেও তা হতে নিঃসৃত হওয়া মাত্র শুচি হবে। “

বর্ণ ব্যবস্থায় শূদ্রকে বিভিন্ন বৈষম্যের শিকার হতে বারংবার দেখা যায় কিন্তু শূদ্রহত্যার বিচারের ক্ষেত্রে অত্রি  চরম নির্মম বাক্য উচ্চারণ করে বলেছেন-

“শরভ ( অষ্টচরণ মৃগবিশেষ) , উট, ঘোড়া, হাতি , সিংহ, বাঘ বা গাধা হত্যা করলে শূদ্র বধের প্রায়শ্চিত্ত করবে।

এই কি চতুর্বর্ণ ব্যবস্থা? এই ব্যবস্থায় ব্রাহ্মণের জীবনকে সর্বাপেক্ষা মূল্যবান দেখানো হয়েছে, ব্রাহ্মণহত্যার নাম দেওয়া হয়েছে ‘ব্রহ্মহত্যা’ বলে।  কিন্তু এর বিপরীতে দেখা যাচ্ছে শূদ্রের হত্যার প্রায়শ্চিত্ত আর পশুহত্যার প্রায়শ্চিত্ত সমান। এমন ব্যবস্থার সমর্থন করতে আমাদের বিবেকে বাধে।

 অন্ত্যজ বর্ণ

চার বর্ণের শেষে অবস্থানকারী শূদ্রের সামাজিক মর্যাদার অবনমন আমরা বারবার দেখতে পেয়েছি। কিন্তু আরও একদল লোক ছিল, যাদের শূদ্রের চাইতেও অধম বলে বিবেচনা করা হত। কোনো বর্ণের মধ্যেই তাদের ধরা হত না। তারা ছিল বর্ণবাহ্য বা অন্ত্যজ। এই অন্ত্যজদের অত্যন্ত অমানবিক দৃষ্টিতে দেখতো আর্যসমাজ। অন্ত্যজদের পরিচয় দিতে গিয়ে অত্রি বলেছেন, “রজক, চর্মকার, নট ( নাটক , যাত্রা করে জীবিকানির্বাহকারী ) , বরুড়, কৈবর্ত , মেদ ও ভিল্ল এই সাতটি জাতিকে অন্ত্যজ বলা হয়।“ অন্ত্যজদের সম্বন্ধে বলা হয়েছে-

  • “জ্ঞান পূর্বক এদের স্ত্রীগমন, অন্নভোজন বা প্রতিগ্রহ করলে , তার প্রায়শ্চিত্ত কৃচ্ছ্রাব্দ ( এক বৎসর একাদিক্রমে প্রাজাপত্যব্রত ৩০ প্রাজাপত্য) করতে হবে; অজ্ঞান পূর্বক করলে চান্দ্রায়ণদ্বয় ।“
  • “চর্মকার , রজক, বেণুজীবি (ডোম) , কৈবর্ত এবং শৈলুষ এদের না জেনে স্পর্শ করলে , পবিত্র থাকলেও আচমন করবে। ব্রাহ্মণ এদের (জেনে স্পর্শ করলে ) একদিন জলপান করবে এবং উচ্ছিষ্টযুক্ত এইসকল ব্যক্তির স্পর্শে তিন রাত উপবাস করে ঘি ভোজন করে শুদ্ধ হবে। যে ব্রাহ্মণ শ্বপাক (অন্ত্যাবসায়ী ) জাতির ছায়া স্পর্শ করেন , তিনি স্নান শেষে ঘি ভোজন করে শুদ্ধ হবেন।
  • “রজক, শৈলুষ ( নাটকাদিতে সাজিয়া যারা জীবিকা নির্বাহ করে) , বেণুকর্মোপজীবি (ডোম) এদের অন্ন ভোজন করলে ব্রাহ্মণ , চান্দ্রায়ণ ব্রত করবে। সকল অন্ত্যজাগমনে, তাদের দ্রব্য ভোজনে ও সম্প্রবেশনে (একত্র শয়নে) পরাকব্রত দ্বারা শুদ্ধ হবে- এটা ভগবান অত্রি বলেছেন।  ব্রাহ্মণ চণ্ডাল ভাণ্ডস্থিত জল পান করলে ৩৭ দিন গোমূত্রসিদ্ধ যাবক আহার করে থাকবে।“
  • “রজঃস্বলা , সূতিকা বা অন্ত্যজা স্পর্শ করলে তিনরাত উপবাস করে শুদ্ধ হবে , এটা পুরাতন বিধি। যে রজঃস্বলা ও অন্ত্যজার সাথে সংসর্গ করে , সে ব্যক্তি প্রায়শ্চিত্তার্হ এবং প্রায়শ্চিত্ত করার পূর্বে স্নান করবে। “   
  • “ব্রাহ্মণ অজ্ঞানত অন্ত্যজ বা রজঃস্বলার স্পর্শ করা পক্কান ভোজন করলে প্রাজাপত্যার্দ্ধ করবে। চণ্ডালের অন্ন  ভোজী চতুর্বর্ণের বক্ষ্যমাণ প্রকারে শুদ্ধি , যথা- ব্রাহ্মণ চান্দ্রায়ণ ; ক্ষত্রিয়,- সান্তপন , বৈশ্য,- ষড়রাত্র ব্রত এবং শূদ্র ত্রিরাত্র ব্রত করে যৎকিঞ্চিত দান করলে শুদ্ধ হবে।“

অন্ত্যজদের সাথে এত বৈষম্যমূলক আচরণ করার পরেও নির্লজ্জের মত অত্রির শাস্ত্রে বলা হয়েছে-

“অন্ত্যজের বহু পুষ্প-ফুল শোভিত বৃক্ষ থাকলে সেই সকল বৃক্ষের পুষ্প এবং ফল সকলেরই উপভোগ্য ।“

চণ্ডাল

অন্ত্যজদের মধ্যে চণ্ডালদের যে আর্যরা অতিরিক্ত দমন পীড়ন করেছেন তা অত্রির বিধান হতে স্পষ্টই বোঝা যায়।অত্রি বলেছেন-

  • চণ্ডালের স্পর্শ করা জল পান করলে ব্রাহ্মণ ‘কৃচ্ছ্রপাদ’ অনুষ্ঠান করলে শুদ্ধ হবে, এটা আপস্তম্ভ মুনি বলেছেন।  
  • শাতাতপ মুনি বলেন , পতিতান্ন বা চণ্ডাল গৃহে ভোজন করলে ১৫ দিন জলপান করে থাকবে ।
  • দ্বিজ তেল বা ঘি মেখে বিষ্ঠামুত্র ত্যাগ বা চণ্ডাল স্পর্শ করলে পঞ্চগব্য পান করে অহোরাত্র উপবাস করলে শুদ্ধ হবে।
  • ভোজন করতে করতে চণ্ডাল, পতিত ,ম্লেচ্ছ , মদ্যপাত্র এবং রজঃস্বলা স্পর্শ করলে আর ভোজন করবে না। অন্ন পরিত্যাগ করে স্নান করে সেদিন আর ভোজন করবে না এবং ব্রাহ্মণদের অনুমতিক্রমে তিনদিন উপবাস করবে , তার পর দিন ঘি এর সাথে যাবক ভোজন করে ব্রত সমাপ্ত করবে।
  • যে দ্বিজ কামমোহিত হয়ে চণ্ডালীগমন করে , সে প্রাজাপত্য রীতিক্রমে তিনটি ব্রত করলে শুদ্ধ হবে।
  • চণ্ডাল প্রভৃতি অন্ত্যজাতির হাত হতে শবের উপরে পতিত কাঠ , লোষ্ট্র ও তৃণ এবং ঐ জাতির হস্তভ্রষ্ট উচ্ছিষ্ট স্পর্শ করবে না,  করলে তবে একদিন উপবাস করবে।
  • চণ্ডাল স্পর্শ করলে স্নান করবে , উচ্ছিষ্টাবস্থায় (অজ্ঞানত) স্পৃষ্ট হলে তিন রাত্রি উপবাস করে শুদ্ধ হবে।
  • চণ্ডাল, ম্লেচ্ছ, শ্বপচ , কপালব্রতধারী , – অজ্ঞানত এদের স্ত্রীগমন করলে পরাকব্রতানুষ্ঠান দ্বারা শুদ্ধ হবে;  জ্ঞানপূর্বক ঐ সকল স্ত্রীগমন করলে বা গমন দ্বারা সন্তান উৎপন্ন করলে , ঐ উপভোক্তা পুরুষ , ঐ স্ত্রীর সমজাতি হইবে ; সেই পুরুষই সেই স্ত্রীর সন্তান হয়ে জন্মগ্রহণ করে।
  • চণ্ডাল স্পৃষ্ট, বিষ্ঠামূত্র সংসৃষ্ট বা নিজের উচ্ছিষ্ট ভোজন করলে ত্রিরাত্র উপবাস করে শুদ্ধ হবে।
  • ব্রাহ্মণ বৃক্ষে উঠে ফল খাচ্ছে , এমন সময় যদি চণ্ডাল সেই বৃক্ষের মূল স্পর্শ করে থাকে, তাহলে ঐরূপ ব্রাহ্মণের কেমন প্রায়শ্চিত্ত হবে? এর উত্তরে বলা হয়েছে- ব্রাহ্মণদের অনুমতিক্রমে ঐ ব্রাহ্মণ সবস্ত্র হয়ে (অন্য বস্ত্র না পড়ে) স্নান এবং ঘি খেয়ে একদিন নক্তব্রত করলে শুদ্ধ হবে। চণ্ডাল ও ব্রাহ্মণ এক বৃক্ষে চড়ে  তার ফল খেলে ব্রাহ্মণের কেমন প্রায়শ্চিত্ত হবে? এর উত্তরে বলা হয়েছে- ঐ ব্রাহ্মণ ব্রাহ্মণদের অনুমতিক্রমে সবস্ত্র হয়ে স্নান ও একদিন কেবল পঞ্চগব্য পান করবে এবং একদিন উপবাসী হবে, তাতে শুদ্ধ হবে।
  • ব্রাহ্মণ ও চণ্ডাল এক শাখায় চড়ে ঐ শাখার ফল খেলে ব্রাহ্মণের কেমন প্রায়শ্চিত্ত হবে? এর উত্তরে বলা হয়েছে-  তিন রাত উপবাস করে পঞ্চগব্য পান করলে শুদ্ধ হবে।
  • পান গৃহ, বনের অজানা জলাশয় , জল তোলার ঘট, অজানা কূপ, দ্রোণির (স্নানপাত্রবিশেষের) জল এবং খড়্গাদিকোষ হতে নির্গত জল বা শ্বপাক-চণ্ডালাদি-নীচ-জাতি-স্পৃষ্ট জল পান করলে ( পূর্ব দিন উপবাস করে) পঞ্চগব্য পান করলে শুদ্ধ হবে।
  • যদি গুরু শিষ্যকে একটি মাত্র অক্ষরও শিখিয়ে থাকেন , তারপরেও পৃথিবীতে এমন কোনো দ্রব্য নেই , যা তাকে অর্পণ করে ঐ শিষ্য ঋণ মুক্ত হতে পারে। এক অক্ষর শিক্ষক ব্যক্তিকেও যে ব্যক্তি সম্মান না করে, সে শতবার কুকুরজন্ম ভোগ করে অবশেষে চণ্ডাল হয়ে জন্মগ্রহণ করে।
  • ব্রাহ্মণ উচ্ছিষ্ট অবস্থায় প্রতিলোমজাত – চণ্ডাল প্রভৃতি কর্তৃক স্পৃষ্ট হলে  পঞ্চগব্য পান করে পঞ্চরাত্র উপবাস করলে শুদ্ধ হবে।

এছাড়া স্ত্রী ও চণ্ডালকে কাক, কুকুরের সাথে তুলনা করে বলা হয়েছে-

রজঃস্বলা, স্ত্রী, কুকুর, চণ্ডাল বা কাক কর্তৃক স্পৃষ্টা হলে , ঐ স্পর্শ দিন হইতে চতুর্থ দিন যাবত সংখ্যক দিন হইবে , স্নানান্তে ঋতু পঞ্চম দিন হতে তাবৎ সংখ্যক দিন নিরাহারা হয়ে শুদ্ধি লাভ করবে।

ম্লেচ্ছ

ম্লেচ্ছদের প্রতিও মুনিবরেরা খুব একটা সুহৃদ ছিলেন না। তাই বলা হয়েছে-

  • ম্লেচ্ছস্ত্রীতে উপগত হলে , সান্তপন (প্রায়শ্চিত্ত) করলে শুদ্ধ হবে এবং ম্লেচ্ছোপভুক্ত ভার্যার সাথে ব্যবহার করলে সবস্ত্র স্নান , ঘৃত ভোজন ও তপ্তকৃচ্ছ করতলে শুদ্ধ হবে।
  • যে নারী একবার মাত্র ম্লেচ্ছ বা (তার তুল্য)  পাপিষ্ঠ ( চণ্ডাল প্রভৃতি বা অতি পাতকী প্রভৃতি ) কর্তৃক উপভুক্ত হয়েছে , সে প্রাজাপত্য ব্রতানুষ্ঠান ও রজোনির্গম দ্বারা শুদ্ধ হবে।

তাদের প্রতি বৈষম্যমূলক বিধির প্রচলন করেও তাদের কাছ থেকে অন্ন প্রভৃতি গ্রহণ করতে অত্রির আপত্তি ছিল না। তাই তিনি বলেছেন-

যতি, ম্লেচ্ছ গৃহ হতেও মাধুকরী বৃত্তি অবলম্বন করবে ( অর্থাৎ, নানাস্থান হতে খাওয়ার উপযুক্ত অন্ন সংগ্রহ করবে)

সহায়ক গ্রন্থ-

পঞ্চানন তর্করত্ন কর্তৃক অনূদিত ঊনবিংশতি সংহিতার অন্তর্গত অত্রি সংহিতা

বইটি ডাউনলোড করে পড়তে পারেন এই লিংক থেকে।

আরও পড়ুন-

Leave a Comment