অমুসলিমরা জাহান্নামী?
একটি ছোটগল্প
ছোটবেলা একটা মসজিদে আমপারা পড়তে যাইতাম। এলাকার কয়েকজন বন্ধু একসাথে সকাল বেলা বাইর হইতাম, নামাজের পরে মসজিদের বড় হুজুর আমাদের আমপারা পড়াইতো। আরবী ভাষা অতি পবিত্র ভাষা, তাই শীতের মধ্যেও সকাল বেলা ওজু করতাম। বেজায় কষ্ট হইলেও করতাম। আরবী ভাষা বইলা কথা। নবী রাসুল পীর পয়গম্বরদের ভাষা। ফেরেশতা আর আল্লাতালাহর ভাষা। এমন পবিত্র ভাষারে তো অসম্মান করা যায় না।
তবে শুধু যে আরবীই পড়তাম তাই না। ক্যামনে ক্যামনে জানি কিছু রাশিয়ান বইও পাইয়া গেছিলাম। রাদুগা প্রকাশনীর এক একটা মারমার কাটকাট বই। ছবিওয়ালা বইগুলাতে লেখা থাকতো পৃথিবীর ইতিহাস, আদিম যুগ কেমন ছিল, কীভাবে ভাষা তৈরি হইলো, সমাজ কীভাবে গঠন হইছে, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কিভাবে ধর্মের উৎপত্তি হইছে, কীভাবে ধীরে ধীরে রাষ্ট্র ব্যবস্থা কায়েম হইলো, মানুষ কীভাবে ধীরে ধীরে সভ্য হইলো, দেবদেবী গুলা কীভাবে বিবর্তিত হইলো। এগুলা থেকে শুরু কইরা অর্থনীতি সমাজনীতি রাষ্ট্রনীতি অনেক কিছুই থাকতো সেইসব বইতে। আমি কিছু বুঝতাম কিছু বুঝতাম না। তারপরেও অনেক পড়তাম। আমপারা সিপারা থেকে সেই বইগুলা বেশি ভাল লাগতো। এক একটা নতুন বই পাইলে মনে হইতো এক একটা সোনার খনি হাতে পাইলাম। বইয়ের দামও ছিল কম, আবার পাতাগুলা এত সুন্দর যে আমি সাজাইয়া রাখতাম। রাত্রে বেলা কোলের ভিতরে নিয়া ঘুমাইতাম। আস্তে আস্তে হাতে আসলো বাঙলাদেশের ইতিহাস, প্রাচীন বাঙলা, ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক কিছু বই। সেগুলাও পড়া শুরু করলাম। আর নানা জনরে জিজ্ঞেস করতে লাগলাম এইটা সেইটা হ্যান ত্যান। বেশিরভাগ লোকজনই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারতো না, তাই আরো বেশি বই পড়তাম। কিন্তু নানা প্রশ্নের উত্তর পাইতাম না। মনের মধ্যে প্রশ্নের পাহাড়, দিনে দিনে বাড়তেই আছে।
একদিন মসজিদের বড় হুজুর কোরআনের সুরা পইড়া শুনাইয়া কইলো, কোন অমুসলিম কোনদিন বেহেশতে প্রবেশ করতে পারবো না। একমাত্র আল্লাহপাকের মনোনীত দ্বীন গ্রহণ না করলে কাউরে বেহেশতের চাবি দেয়া হইবো না। ইসলামই হইলো সেই মনোনীত দ্বীন, একমাত্র সত্য ধর্ম। বাদবাকি সব মিথ্যা। যারা মিথ্যা ধর্ম পালন করে তাদের উপরে আল্লাহপাকের লানত। আল্লাহপাক তাদের কঠোর শাস্তি দিবেন। অনন্তকাল দোজখের আগুনে পুড়াইবেন। সেইখানে নানান জাতের শাস্তি। সাপ কুমির আগুন সবই আছে। তবে মুসলমানদের মধ্যে যার ভিতরে আল্লাহর প্রতি এক বিন্দুও ঈমান আছে সে এক সময় না এক সময় বেহেশতে যাইবো। পাপ করলে শাস্তি হবে তবে শাস্তি শেষে সে বেহেশতে যাবে। বেহেশত হইলো অতি উত্তম স্থান। সেইখানে সব আলেম ওলামা নবী রাসুলরা থাকেন।
এই কথা শোনার পরে জিজ্ঞেস করলাম, হুজুর, আমাদের মুক্তিযুদ্ধে অমুসলিম শহীদদের তাইলে কী হবে? তারা কি দোজখে যাবে?
হুজুর মাথা ঝাঁকাইয়া বলল, হ। হিন্দুরা তো দোজখেই যাইবো। মুক্তিযুদ্ধ করছে তো কী হইছে? আল্লা নবীরে তো আর মানে নাই। তাইলে লাভ কী?
আমি জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা তাইলে ভ্যাক্সিন আবিষ্কার করে কোটি কোটি মানুষের জীবন রক্ষা করা লুই পাস্তুর, লক্ষ লক্ষ মানুষের সেবা করা মাদার তেরেসা, ভারতের স্বাধীনতার জন্য সারাজীবন লড়াই করা মহাত্মা গান্ধী, মানব সভ্যতার অভিশাপ দাসপ্রথা বিলুপ্ত করার আইন করা আব্রাহাম লিংকন, মহান বিজ্ঞানী আইনস্টাইন বা সারাজীবন নিঃস্বার্থভাবে মানুষের উপকার করা আমাগো ইস্কুলের নিবারণ কাকা এরা কি সব দোজখে যাবে?
হুজুর বলল হ। তারা সব দোজখবাসী হবে। যারা দ্বীন ইসলাম কবুল করে নাই আল্লাহরে মানে নাই রাসুলের আনুগত্য করে নাই সবার ঠিকানা দোজখ।
অনেকক্ষণ মাথা চুলকাইয়া জিজ্ঞেস করলাম, হুজুর, তাইলে গোলাম আজম, ইয়াহিয়া, রাজাকার আলবদর, একাত্তরে এই দেশে গণহত্যাকারী ধর্ষণকারী পাকবাহিনী, তারা তো সব মুসলমান। এরা আল্লাও মানে নবীও মানে। নামাজ রোজা হজ্জও করে। এরা পাপী ঠিক আছে, তবে এরা কী তাদের শাস্তি শেষে একসময় বেহেশতে যাইতে পারবে?
প্রশ্ন করার সাথে সাথে চোখে আন্ধার দেখলাম। বড় হুজুর কষায়া রাম থাবর দিছে। এলাকার পোলাপান বলাবলি শুরু করলো, রাশিয়ান বই পইড়া আমি নাকি কমুনিস্ট হয়া গেছি!
দলিল প্রমাণ
সূনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত)
অধ্যায়ঃ ৩৮/ ঈমান
২৬৪৪৷ আবূ যার (রাযিঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ জিবরীল (আঃ) আমার নিকট এসে এই সুসংবাদ দেন যে, যে ব্যক্তি আল্লাহ তা’আলার সাথে কিছু শারীক না করে মারা যাবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। আমি প্রশ্ন করলাম, সে যদি ব্যভিচার করে থাকে, সে যদি চুরি করে থাকে? তিনি বললেনঃ হ্যাঁ (তবুও সে জান্নাতে যাবে)।
সহীহঃ সহীহাহ (৮২৬), বুখারী ও মুসলিম।
আবূ ঈসা বলেন, এ হাদীসটি হাসান সহীহ। এ অনুচ্ছেদে আবূদ দারদা (রাযিঃ) হতেও হাদীস বর্ণিত আছে।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
সহীহ বুখারী (ইফাঃ)
অধ্যায়ঃ ৮৬/ জাহ্মিয়াদের মতের খণ্ডন ও তাওহীদ প্রসঙ্গ
৭০০১। ইউসুফ ইবনু রাশিদ (রহঃ) … আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে আমি বলতে শুনেছি যে, কিয়ামতের দিন যখন আমাকে সুপারিশ করার অনুমতি দেওয়া হবে তখন আমি বলব, হে আমার প্রতিপালক! যার অন্তরে এক সরিষা পরিমাণ ঈমান আছে, তাকে তুমি জান্নাতে দাখিল করো। তারপর তাদেরকে জান্নাতে দাখিল করা হবে। তারপর আমি বলব, তাকেও জান্নাতে প্রবেশ করাও, যার অন্তরে সামান্য ঈমানও আছে। আনাস (রাঃ) বলেনঃ আমি যেন এখনো রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর হাতের আঙুলগুলো দেখছি।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
সহীহ মুসলিম (ইফাঃ)
অধ্যায়ঃ ১/ কিতাবুল ঈমান
পরিচ্ছদঃ ৩৯. অহংকারের বিবরণ ও তা হারাম হওয়া
১৬৮। মিনজাব ইবনু হারিস আত তামীমী ও সুয়ায়দ ইবনু সাঈদ (রহঃ) … আবদুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেন যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যার অন্তরে সরিষার দানা পরিমান ঈমান থাকবে সে জাহান্নামে প্রবেশ করবে না। আর যে ব্যাক্তির অন্তরে এক সরিষার দানা পরিমাণ অহমিকা থাকবে সেও জান্নাতে প্রবেশ করবে না।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
আল্লাহ মুনাফিক পুরুষ, মুনাফিক নারী ও কাফিরদের জন্য জাহান্নামের আগুনের ওয়া‘দা দিয়েছেন, তাতে তারা চিরদিন থাকবে, তা-ই তাদের জন্য যথেষ্ট। তাদের উপর আছে আল্লাহর অভিশাপ, আর আছে তাদের জন্য স্থায়ী ‘আযাব।
— Taisirul Quran
আল্লাহ মুনাফিক পুরুষ ও নারীদের এবং কাফিরদের সাথে জাহান্নামের আগুনের অঙ্গীকার করেছেন, তাতে তারা চিরকাল থাকবে, ওটাই তাদের জন্য যথেষ্ট। আর আল্লাহ তাদেরকে লা’নত করেছেন এবং তাদের জন্য রয়েছে চিরস্থায়ী শাস্তি।
— Sheikh Mujibur Rahman
আল্লাহ মুনাফিক পুরুষ, মুনাফিক নারী ও কাফিরদেরকে জাহান্নামের আগুনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তাতে তারা চিরদিন থাকবে, এটি তাদের জন্য যথেষ্ট। আর আল্লাহ তাদের লা‘নত করেন এবং তাদের জন্য রয়েছে স্থায়ী আযাব।
— Rawai Al-bayan
মুনাফেক পুরুষ, মুনাফেক নারী ও কাফেরদেরকে আল্লাহ্ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন জাহান্নামের আগুনের, যেখানে তারা স্থায়ী হবে, এটাই তাদের জন্যে যথেষ্ট। আর আল্লাহ তাদেরকে লা’নত করেছেন এবং তাদের জন্য রয়েছে স্থায়ী শাস্তি;
— Dr. Abu Bakr Muhammad Zakaria
Allah has promised the hypocrite men and hypocrite women and the disbelievers the fire of Hell, wherein they will abide eternally. It is sufficient for them. And Allah has cursed them, and for them is an enduring punishment.
— Saheeh International
সূরা তওবা, আয়াত ৬৮
আহলে-কিতাব ও মুশরেকদের মধ্যে যারা কাফের, তারা জাহান্নামের আগুনে স্থায়ীভাবে থাকবে। তারাই সৃষ্টির অধম।
কুরআন ৯৮ঃ৬
সমস্ত জীবের মাঝে আল্লাহর নিকট তারাই সবচেয়ে নিকৃষ্ট, যারা অস্বীকারকারী হয়েছে অতঃপর আর ঈমান আনেনি।
কোরআন ৮:৫৫
নিশ্চয় যারা কুফরী করে এবং কাফের অবস্থায়ই মৃত্যুবরণ করে, সে সমস্ত লোকের প্রতি আল্লাহর ফেরেশতাগনের এবং সমগ্র মানুষের লা’নত।
কোরআন ২-১৬১
বস্তুতঃ এহেন কাফেরদের উদাহরণ এমন, যেন কেউ এমন কোন জীবকে আহবান করছে যা কোন কিছুই শোনে না, হাঁক-ডাক আর চিৎকার ছাড়া বধির মুক, এবং অন্ধ। সুতরাং তারা কিছুই বোঝে না।
কোরআন ২-২৫৭
কাফেরদিগকে বলে দিন, খুব শিগগীরই তোমরা পরাভূত হয়ে দোযখের দিকে হাঁকিয়ে নীত হবে-সেটা কতই না নিকৃষ্টতম অবস্থান।
কোরআন ৩-১২
বলুন, আল্লাহ ও রসূলের আনুগত্য প্রকাশ কর। বস্তুতঃ যদি তারা বিমুখতা অবলম্বন করে, তাহলে আল্লাহ কাফেরদিগকে ভালবাসেন না।
কোরআন ৩-৩২
আর আমি সৃষ্টি করেছি দোযখের জন্য বহু জ্বিন ও মানুষ। তাদের অন্তর রয়েছে, তার দ্বারা বিবেচনা করে না, তাদের চোখ রয়েছে, তার দ্বারা দেখে না, আর তাদের কান রয়েছে, তার দ্বারা শোনে না। তারা চতুষ্পদ জন্তুর মত; বরং তাদের চেয়েও নিকৃষ্টতর। তারাই হল গাফেল, শৈথিল্যপরায়ণ।
কোরআন ৭:১৭৯
অতএব যারা কাফের হয়েছে, তাদেরকে আমি কঠিন শাস্তি দেবো দুনিয়াতে এবং আখেরাতে-তাদের কোন সাহায্যকারী নেই।
কোরআন ৩-৫৬
যাতে ধবংস করে দেন কোন কোন কাফেরকে অথবা লাঞ্ছিত করে দেন-যেন ওরা বঞ্চিত হয়ে ফিরে যায়।
কোরআন ৩-১২৭
খুব শীঘ্রই আমি কাফেরদের মনে ভীতির সঞ্চার করবো। কারণ, ওরা আল্লাহ্র সাথে অংশীদার সাব্যস্ত করে যে সম্পর্কে কোন সনদ অবতীর্ণ করা হয়নি। আর ওদের ঠিকানা হলো দোযখের আগুন। বস্তুত: জালেমদের ঠিকানা অত্যন্ত নিকৃষ্ট।
কোরআন ৩-১৫১
প্রখ্যাত বাংলাদেশের আলেম এবং ইসলামী ফিকাহ শাস্ত্রের অন্যতম পণ্ডিত ড. আবু বকর মুহাম্মদ যাকারিয়ার সম্পাদনায় প্রকাশিত মো আব্দুল কাদেরের বই বাংলাদেশে প্রচলিত শির্ক বিদ‘আত ও কুসংস্কার পর্যালোচনা গ্রন্থে পরিষ্কারভাবেই বলা আছে যে, শিকর হচ্ছে হত্যাযোগ্য অপরাধ। যারা শিরক করে, তাদের রক্ত মুসলিমদের জন্য হালাল [1]।
সরাসরি বই থেকে হাদিসগুলো দেখে নিই [2] [3] [4] –
ইসলামের বিধান হচ্ছে, অমুসলিমদের সাথে কোন ধরণের অন্তরঙ্গ বন্ধুত্বপূর্ণ [5] সম্পর্ক করা যাবে না। এই বিষয়ে বাঙলাদেশের প্রখ্যাত আলেমগণ কী বলেছেন সেটি আগে দেখে নিই,
এবারে আসুন সারা পৃথিবীর সর্বোচ্চ ইসলামিক আলেম শায়েখ সালিহ আল-ফাওযান কী বলেছেন সেটি দেখে নিই [6] –
তথ্যসূত্র
- বাংলাদেশে প্রচলিত শির্ক বিদ‘আত ও কুসংস্কার পর্যালোচনা ২. শির্কের পরিণতি, পৃষ্ঠা ৭ [↑]
- তিরমিযী শরীফ, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, পঞ্চম খণ্ড, পৃষ্ঠা ১০৬ [↑]
- সহীহ বুখারী, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, দশম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৬০৪, হাদিস নম্বরঃ ৭০০১ [↑]
- সহীহ মুসলিম, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৩৬, হাদিস নম্বরঃ ১৬৮ [↑]
- ইসলাম কি অমুসলিমদের সাথে বন্ধুত্বের অনুমোদন দেয়? [↑]
- আল ইরশাদ-ছ্বহীহ আক্বীদার দিশারী, মাকতাবুস সুন্নাহ প্রকাশনী, পৃষ্ঠা ৪৩৩-৪৩৪ [↑]
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত © ২০২৪ "সংশয় - চিন্তার মুক্তির আন্দোলন"