মাংসে পচন ধরা কবে থেকে শুরু হয়েছিল?
সূচিপত্র
ভূমিকা
প্রায় প্রতিদিনই বিভিন্ন ইসলামিক ওয়াজ বা ইসলামিক আলোচনায় ইসলামিক আলেম ওলামাগণ নানা ধরণের ভুল এবং মিথ্যা কথাবার্তা বলে থাকেন। যেই কথাবার্তার অধিকাংশই অবৈজ্ঞানিক এবং নিতান্তই মূর্খতাপ্রসূত বক্তব্য। যদিও সেই সব উনারা কোরআন হাদিস থেকেই বলেন, কিন্তু কোরআন হাদিসেই তো অসংখ্য ভুল, অবৈজ্ঞানিক এবং হাস্যকর কথাবার্তা লেখা রয়েছে। এই ওয়েবসাইটটিতে সেই বিষয়ে অসংখ্য লেখা রয়েছে। আজকে শুধুমাত্র আলোচনা করা হবে, রান্না করা মাংসের পচন ধরা সম্পর্কিত হাদিস নিয়ে।
সহিহ হাদিস
আলোচনার শুরুতেই জেনে নেয়া যাক, এই সম্পর্কে ইসলামের দাবীটি আসলে কী। এখানে শুধু মুফতি ইব্রাহীমের বক্তব্যই নয়, সহিহ বুখারী হাদিস থেকেও রেফারেন্স দেয়া হবে। যেন কেউ এক কথায় মুফতি ইব্রাহীমকে সহি ইসলাম নয় বলে উড়িয়ে দিতে না পারেন। কারণ মুমিনদের খুব স্বাভাবিক আচরণ হচ্ছে, কোথাও আটকে গেলে উনারা অমুকে সহি নহে, তমুকে সহি নহে এইসব বলে ইসলামের ইজ্জত রক্ষা করতে সচেষ্ট হন। ঠোঁট উল্টে কোরআন হাদিস অস্বীকার করতে তাদের কোন জুড়ি নেই।
ইসলাম খুব পরিষ্কারভাবেই ঘোষণা করছে, মাংস পঁচনের জন্য দায়ী আসলে ইহুদিরা। ইহুদিরা আল্লাহর নাফরমানি করার আগে রান্না করা মাংস কখনো পঁচতো না, দুর্গন্ধ বের হতো না। ইহুদিরা আল্লাহর কাছ থেকে সালওয়া নামক পাখির মাংস পেতো। কিছু ইহুদিরা ভবিষ্যতের কথা ভেবে মাংস জমা করে রেখেছিল। সেই কারণে আল্লাহ ক্ষিপ্ত হয়ে গজব নাজিল করেন যে, এখন থেকে মাংস পচন ধরা শুরু হবে। অর্থাৎ এর আগে রান্না করা মাংসে কখনো পচন ধরতো না। ইহুদিরা ঐদিন ঐ কাজটি না করলে একবার রান্না করা মাংস হাজার বছর পরেও মানুষ খেতে পারতো। কোন ফ্রিজ বা খাদ্য সংরক্ষণাগারের দরকার হতো না। শুধু একবার রান্না করে ফেলে রাখলেই, আর কোন চিন্তা থাকতো না।
মুফতি ইব্রাহীমের বক্তব্য
বাঙলাদেশের প্রখ্যাত ইসলামিক আলেম মুফতি ইব্রাহীম জানাচ্ছেন, রান্না করা মাংসে কেন পচন ধরে তার ইতিহাস। সরাসরি বুখারী হাদিস থেকে। উল্লেখ্য, ইসলাম অনুসারে উনার কথা মিথ্যা নয়।
সহিহ বুখারী
এবারে এই সম্পর্কিত সহিহ হাদিস এবং হাদিসের সাথে ব্যাখ্যা তুলে দেয়া হলো।
সহীহ বুখারী (ইফাঃ)
অধ্যায়ঃ ৫০/ আম্বিয়া কিরাম (আঃ)
পরিচ্ছদঃ ২০০০. আদম (আঃ) ও তাঁর সন্তানদের সৃষ্টি।
৩০৯৫। বিশ্র ইবনু মুহাম্মদ (রহঃ) … আবূ হুরায়রা (রাঃ) সূত্রে নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে অনুরূপ বর্ণিত আছে। অর্থাৎ নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, বনী ইসরাঈল যদি না হত তবে গোশত দুর্গন্ধযুক্ত হতো না। আর যদি হাওয়া (আলাইহিস সালাম) না হতেন তবে কোন নারীই তাঁর স্বামীর খেয়ানত করত না।
Narrated Abu Huraira: The Prophet (ﷺ) said, “But for the Israelis, meat would not decay and but for Eve, wives would never betray their husbands.”
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
সহীহ বুখারী (ইফাঃ)
অধ্যায়ঃ ৫০/ আম্বিয়া কিরাম (আঃ)
পরিচ্ছদঃ ২০২৩. মহান আল্লাহর বাণীঃ আর আমি ওয়াদা করেছিলাম মুসার সাথে ত্রিশ রাতের … আর আমিই মু’মিনদের মধ্যে সর্বপ্রথম। (৭ঃ ১৪২-৪৩) বলা হয়, دكة অর্থ ভুকম্পন। আয়াতে উল্লেখিত فَدُكَّتَا দ্বিবচন বহুবচন অর্থে ব্যবহৃত। এখানে الْجِبَالَ শব্দটিকে এক ধরে নিয়ে الأَرْضَ সহ দ্বিবচনরূপে دُكَّتَا বলা হয়েছে। যেমন মহান আল্লাহর বাণীঃ كَانَتَا رَتْقًا এর মধ্যে سمَوَاتِ এক ধরে দ্বিবচনে উল্লেখ করা হয়েছে। كُنَّ رَتقا বহুবচন বলা হয়নি। رَتْقًا অর্থ পরস্পর মিলিত। أُشْرِبُوا অর্থাৎ তাদের হৃদয়ে গোবৎস প্রীতি নিশ্চিত করেছিল। বলা হয় ثَوْبٌ مُشَرَّبٌ অর্থ রঞ্জিত কাপড়। ইবন আব্বাস (রাঃ) বলেন, انْبَجَسَتْ অর্থ প্রবাহিত হয়েছিল। نَتَقْنَا الْجَبَلَ অর্থ আমি পাহাড়কে তাদের উপর উপচিয়ে ছিলাম।
৩১৬০। আবদুল্লাহ ইবনু মুহাম্মদ জু‘ফী (রহঃ) … আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যদি বনী ইসরাঈল না হত, তবে গোশ্ত পচন ধরত না। আর যদি (মা) হাওয়া (আলাইহিস সালাম) না হতেন, তাহলে কোন সময় কোন নারী তাঁর স্বামীর খেয়ানত করত না।
Narrated Abu Huraira: The Prophet (ﷺ) said, “Were it not for Bani Israel, meat would not decay; and were it not for Eve, no woman would ever betray her husband.”
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা
এই কথাটি অত্যন্ত হাস্যকর যে, বনি ইজরাইলি বা ইহুদিরা কোন একটি “অন্যায়” করার কারণে রান্না করা মাংসে পচন ধরা শুরু হয়! অবশ্যই যেদিন থেকে মানুষ রান্না করা শুরু করেছে, সেইদিন থেকেই রান্না করা মাংস বা শাকসবজিতে পচন ধরতো। মাংসে কেন পচন ধরে, সেটি জানার জন্য খুব বেশি জ্ঞানবুদ্ধির প্রয়োজন হয় না। রান্না করা মাংসে পচন ধরার সম্ভাবনা কিছুদিনের জন্য কেন কমে, সেটিও খুব সহজেই জানা যায়। কিন্তু কিছুদিনের জন্য সম্ভাবনা কমে যাওয়া মানেই যে তা অনন্তকাল ধরে অক্ষত থাকবে- সেটি নয়, তা বোঝার জন্য আমাদের মাংস কেন পঁচে তা ভালভাবে বোঝা প্রয়োজন। উল্লেখ্য, এই হাদিসটি যে শুধু হাস্যকর তাই নয়, রীতিমত অবৈজ্ঞানিক এবং এরকম হাদিস কৌতুক হিসেবে শুধুমাত্র গ্রহণ করা যেতে পারে।
মানুষ কবে থেকে রান্না করে
আগুন দিয়ে খাবার রান্না করা প্রাণি হিসেবে শুধুমাত্র মানুষের এক অনন্য কাজ। প্রাপ্ত তথ্যপ্রমাণ থেকে ধারণা করা হয়, প্রায় ২ মিলিয়ন বছর আগে মানুষ প্রথম রান্না করা শুরু করেছিল। তবে প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ পাওয়া যায় প্রায় ১ মিলিয়ন বছর আগের। সেখান থেকে জানা যায়, এই সময়ে মানুষ আগুন নিয়ন্ত্রণ করতে শিখেছিল [1] [2]। এছাড়াও ফাইলোজেনেটিক বিশ্লেষণ থেকে জানা যায় যে মানব পূর্বপুরুষরা রান্নার কাজটি প্রায় ১.৮ মিলিয়ন থেকে ২.৩ মিলিয়ন বছর আগে আবিষ্কার করেছিলেন [3]। এমন প্রমাণ প্রাওয়া গিয়েছে যে, হোমো ইরেক্টাসরা প্রায় ৫০০০০০ বছর আগে তাদের খাবার রান্না করতো [4]। প্রায় ৪০০০০০ বছর আগে হোমো ইরেক্টাসরা আগুনের সাহায্য খাবার রান্না করতো, এই ধারণাকে অধিকাংশ স্কলারই সমর্থন করেন [5] [6]। এবং যেই প্রমাণগুলো পাওয়া গেছে, তাতে এরকম ধারণা করার বিন্দুমাত্র সম্ভাবনা নেই যে, পুর্বে রান্না করা মাংসগুলো পঁচতো না। সেই ১ মিলিয়ন বছর আগে রান্না শুরু হয়ে থাকলে, ইহুদিদের ওপর আল্লাহর গজবের আগ পর্যন্ত, এই সময়টুকু রান্না করা মাংস যে পঁচতো না, সেরকম কিছু হলে তার খুবই স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যেতো। কারণ প্রচুর ফসিল পাওয়া গেছে, যেখানে প্রাচীন মানুষ মাংস রান্না করে খেয়ে হাড় ফেলে দিয়েছে, সেগুলোতে পচন ধরেছে, এবং পরবর্তীতে সেগুলো ফসিলে পরিণত হয়েছে।
মাংস পচার কারণ
কোন প্রাণীকে হত্যা করা হলে, কিংবা প্রাণীটি মারা গেলে তার মাংসের কোষগুলো খুব দ্রুত ভেঙে যেতে শুরু করে। সেই সময়ে নতুন কোষ দ্বারা পুরনো কোষগুলো প্রতিস্থাপিত আর হয় না। ফলস্বরূপ, মাংসটি দ্রুত খেয়ে না ফেললে বা সঠিকভাবে সংরক্ষণ করা না গেলে পচন ধরা শুরু হয়। এর সাথে যুক্ত হয় ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক, পানি ও বাতাসের সংস্পর্শ যা মাংসের পঁচনকে ত্বরান্বিত করে। রান্না করা মাংসেও একইভাবে এগুলো আক্রমণ করে। তবে রান্না করা মাংসে পচন একটু দেরিতে ধরে। তবে দেরিতে হলেও, সেই আদিকাল থেকে, রান্না করা মাংসে অবশ্যই পচন ধরে এবং ভবিষ্যতেও ধরবে।
হাদিসের সাথে বিরোধ
কিন্তু সহিহ হাদিস বলছে, মাংস পচার প্রধানতম কারণ হচ্ছে, ইহুদিদের ওপর আল্লাহর অভিশাপ। যার আগে রান্না করা মাংসে পচন ধরতো না। এরকম হাস্যকর অসংখ্য দাবী কোরআন হাদিসে অসংখ্য পরিমাণ রয়েছে। এবং এগুলো প্রতিদিন ইসলামি ওয়াজ মাহফিলের নামে মূর্খ জনগোষ্ঠীর কাছে বারবার বলে বলে অপবিজ্ঞান ছড়ানো হচ্ছে।
উপসংহার
যেকোন শিক্ষিত এবং সভ্য মানুষই বুঝবেন, ধর্মের এই সকল গালগপ্প কতটা হাস্যকর এবং মিথ্যা। কিন্তু এই কথাগুলোর জবাব প্রায় প্রতিদিনই আমাদের দিতে হয়, যা জাতি হিসেবে আমাদের জন্য লজ্জাজনক। কারণ লক্ষ লক্ষ মানুষ এইসব কাল্পনিক হাস্যকর কথাগুলোকে ধর্মের কারণে বিশ্বাস করে। একটু সাধারণ জ্ঞান, আর একটু নির্মোহ নিরপেক্ষ চিন্তা, আর কিছু প্রয়োজন নেই। কিন্তু সেইটুকুই প্রচণ্ড অভাব আমাদের সমাজে। তাই এইসব ওয়াজকারী আর এইসব হাদিস আমাদের দেশে এখনো স্কুল কলেজ মাদ্রাসায় শেখানো হয়। যা খুবই দুঃখজনক।
তথ্যসূত্র
- Rupp, Rebecca (2 September 2015). “A Brief History of Cooking With Fire”. National Geographic. Retrieved 29 May 2019 [↑]
- Pringle, Heather (2 April 2012), “Quest for Fire Began Earlier Than Thought”, ScienceNOW, archived from the original on 15 April 2013, retrieved 4 April 2012 [↑]
- Organ, Chris (22 August 2011). “Phylogenetic rate shifts in feeding time during the evolution of Homo”. PNAS. 108 (35): 14555–14559. Bibcode:2011PNAS..10814555O. doi:10.1073/pnas.1107806108. PMC 3167533. PMID 21873223 [↑]
- Pollard, Elizabeth (2015). Worlds Together, Worlds Apart. New York: Norton. p. 13. ISBN 978-0-393-92207-3. [↑]
- Luke, Kim. “Evidence That Human Ancestors Used Fire One Million Years Ago”. Retrieved 27 October 2013.
An international team led by the University of Toronto and Hebrew University has identified the earliest known evidence of the use of fire by human ancestors. Microscopic traces of wood ash, alongside animal bones and stone tools, were found in a layer dated to one million years ago
[↑] - “Archaeologists Find Earliest Evidence of Humans Cooking With Fire – DiscoverMagazine.com” [↑]
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত © ২০২৪ "সংশয় - চিন্তার মুক্তির আন্দোলন"
srostay jara Osikarkari tara khokono believe korbe na. Atai sotto. Allah chaile sob paren.
ফেরাউন কে আল্লাহ যুগ যুগ ধরে কোন মেডিসিন ছাড়াই সংরক্ষন করে আসছেন। তার মাংস পচে যায়নি। বিজ্ঞানের কাছে এর কোন ব্যাখ্যা নেই। সুতরাং আল্লাহ চাইলে সবই সম্ভব।
পবিত্র কুরআনুল কারিমে বলা হয়েছে, ফেরাউন ডুবে মারা গেছে, মৃত্যুর পরও তার শরীর অক্ষত রাখা হবে এবং তা পরবর্তি সীমালংঘনকারীদের জন্য সতর্কবার্তা হিসেবে রয়ে যাবে।
আল্লাহ বলেন, ‘আজ আমি তোমার (ফেরাউন) দেহ রক্ষা করব, যাতে তুমি তোমার পরবর্তীদের জন্য নিদর্শন হয়ে থাকো। অবশ্যই মানুষের মধ্যে অনেকে আমার নিদর্শন সম্পর্কে উদাসীন।’ (সুরা : ইউনুুস, আয়াত : ৯২)
আলোচ্য আয়াতে আল্লাহ তাআলা এই ঘোষণা দিয়েছেন যে পরবর্তীদের জন্য ফেরাউনের লাশ সংরক্ষিত রাখা হবে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, আল্লাহর এই ঘোষণা সত্য প্রমাণিত হয়েছে।
ফেরাউন এর লাশ নিয়ে গবেষনা করতে গিয়ে ফ্রান্সের একজন গবেষক মরিস বুকাইলি ইসলাম ধর্মের সত্যতা অনুধাবন করে মুসলিম হয়েছেন।
ফেরাউন বা ফারাওন সম্পর্কিত প্রশ্নের উত্তর।
এই লেখাটি পড়ে দেখতে পারেন।