প্রাচীন পূর্বপুরুষের করোটি দিচ্ছে বিবর্তনীয় ইতিহাস সম্পর্কে নতুন ধারণা
২০১৬ সালে ইথিওপিয়ার গোদায়া উপত্যকায় একটা মাথার খুলি উদ্ধার করা হয়েছিল, পরে জানা যায় এটি Australopithecus anamensis প্রজাতিটির। গবেষকগণ এটা দেখে তো অবাক। কেন অবাক হবেন না বলুন, আজ পর্যন্ত যে প্রজাতির ভাঙ্গা কিছু হাড়, ভাঙ্গা দাত, আর চোয়ালের হাড়ের টুকরো ছাড়া আর কিছুই পাওয়া যায় নি, এবারে কিনা পাওয়া গেল তার আস্ত একটা মাথার খুলি! গবেষকরা তো সব হুমরি খেয়ে পড়লেন সেই খুলিটির উপর। শুরু হল গবেষণা, তো এই ২৮ তারিখ এটি নিয়ে দু-দুটো গবেষণাপত্র নেচার জার্নালে এলো। আর সেটা দেখে সবাই আরও অবাক? কেন হবেনা বলুন? এটা মানুষের বিবর্তনের ইতিহাসের একটি অন্যতম অজানা অধ্যায়ের উন্মোচন করেছে যে…
আচ্ছা, বিস্তারিত বলছি শুনুন। সম্প্রতি প্রাচীন মানব পূর্বপুরুষের একটি মাথার খুলি বা করোটি আবিষ্কার হয়েছে, যা মানব বিবর্তন সম্পর্কে সঠিক ধারণা পাবার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই মাথার খুলিটি হচ্ছে এর প্রজাতির অবশেষ থেকে পাওয়া মাথার খুলিগুলোর মধ্যে সবচাইতে বেশি পূর্ণাঙ্গ।
২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে, ইথিওপিয়া এর ওরানসো-মিলে এর ধূলিময় গোদায়া উপত্যকায় ইয়োহানেস হাইলে-সেলাসি এবং নৃতাত্ত্বিকদের একটি আন্তর্জাতিক দল একটি প্রাথমিক হোমিনিন প্রায়-পূর্ণাঙ্গ করোটি মাটি খুড়ে উদ্ধার করেছিল। Nature জার্নালে এই ২৮ তারিখে এই নিয়ে দুটো গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে।(১)(২) আর এগুলোতে গবেষকগণ দেখান যে, এই করোটিটি Australopithecus anamensis নামক প্রজাতির, এবং এরা আজ থেকে ৪২ থেকে ৩৮ লক্ষ বছর পূর্বে পৃথিবীতে বর্তমান ছিল। উল্লেখ্য, ৩৮ লক্ষ বছরের ব্যাপারটা জানা গেছে এই করোটিটি নিয়ে গবেষণা করার পর, কেননা এটা ৩৮ লক্ষ বছর পুরনো। এর আগে বিজ্ঞানীদের ধারণা ছিল না যে এরা ৩৮ লক্ষ বছর পূর্বেও ছিল, বিজ্ঞানীদের জন্য এই ৩৮ লক্ষ বছর পূর্বের হওয়াটা বেশ অবাকের, কারণ এটা বলছে যে এই প্রজাতি তাদের ধারণার চেয়েও অনেক পরে বিলুপ্ত হয়েছে। কেন সেটা একটু পরে বলছি।
এই নমুনাটি ঘিরে যে কারণে উত্তেজনা রয়েছে তা হল এর পূর্ণাঙ্গ অবস্থা। এই আবিষ্কারটির আগ পর্যন্ত এই প্রজাতিটির শরীরের কেবল ছড়ানো ছিটানো চোয়ালের হাড়, ভাঙ্গা দাঁত, এবং খুব কম পরিমাণে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ভাঙ্গা হাড় পাওয়া গিয়েছিল। এখন গবেষকদের হাতে আমাদের এই দুঃসম্পর্কের আত্মীয়ের একটি প্রায়-পূর্ণাঙ্গ করোটি রয়েছে, তারা এখন ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যাবহার করে বের করতে পারবেন যে, এরা কিরকম দেখতে ছিল।
এই ২৭ তারিখ মঙ্গলবার ক্লিভল্যান্ড মিউজিয়াম অফ ন্যাচারাল হিস্টোরি এর ফিজিকাল এনথ্রোপলজি এর প্রধান ইয়োহানেস হাইলে-সেলাসি বলেন, “এই নমুনাটি আমাদেরকে প্রথমবারের মত আভাস দিচ্ছে যে আসলে Australopithecus anamensis দেখতে কিরকম ছিল। এটি আমাদের দেখাচ্ছে যে, Homo গণের আবির্ভাবের পূর্বে মানুষের পূর্বপুরুষ দেখতে খুবই “আদিম” ছিল। তখনও তাদের মধ্যে এপ বা বনমানুষদের মত মুখমণ্ডল এবং করোটিসংক্রান্ত অঙ্গসংস্থানও বনমানুষদের মতই ছিল।”
এই করোটির আকার ছোট, কিন্তু তাও এটি একটি প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষের করোটি, এবং এই করোটিটি যার ছিল সে শুষ্ক গুল্মভূমিতে (dry shrubland) বাস করত, কিন্তু তৃণভূমি (grassland), জলাভূমি (wetland) এবং নদীর পার্শ্ববর্তী বনাঞ্চলে সময় কাটাতো। Australopithecus হচ্ছে একটি প্রাথমিক দ্বিপদ হোমিনিন এর একটি গণ যারা আজ থেকে ৪ মিলিয়ন বছর পূর্বে পৃথিবীতে বাস করত। তাদের এই অস্ট্রালোপিথেকাস নামটি হচ্ছে ল্যাতিন ও রোমান ভাষার মিশ্রণ যার অর্থ হচ্ছে “দক্ষিণাঞ্চলীয় বনমানুষ” (“southern ape”), যদিও এরা প্রায় ২ মিলিয়ন বছর পূর্বে বিলুপ্ত হবার পূর্বে দক্ষিনাঞ্চলীয়, পূর্বাঞ্চলীয় এবং উত্তর-মধ্য আফ্রিকার বিভিন্ন স্থানেই বাস করত।
তবে তাদের বিলুপ্তির ঘটনা কেবলই গল্পটির শুরু। এই অস্ট্রালোপিথেকাস প্রজাতিটি মানব বিবর্তনের নাটকের একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। আমাদের অর্থাৎ Homo sapien এর যে Homo গণটি রয়েছে তা এই অস্ট্রালোপিথেকাস থেকেই ৩০ লক্ষ বছর পূর্বের কিছু সময় পর আবির্ভূত হয়েছিল। এই রহস্যময় পূর্বপুরুষ নিয়ে গবেষকগণ পূর্বে যে পূর্বানুমানগুলো করেছিল এই নতুন করোটিটি সেগুলোর অনেক কিছুকেই চ্যালেঞ্জ করছে। এই অস্ট্রালোপিথেকাস গণের সবচাইতে সেলিব্রিটি সদস্যটি হচ্ছে Australopithecus afarensis, যাকে বিখ্যাত “লুসি” নামক ফসিলটি প্রতিনিধিত্ব করে।(৩) লুসি কেন গুরুত্বপূর্ণ তা নিয়ে পরে কিছু লেখার ইচ্ছা আছে। যাই হোক, পূর্বের গবেষণাগুলোর বিরুদ্ধে গিয়ে এই নতুন প্রাপ্তিটি আমাদের বলছে যে A. afarensis এর সাথে এই নতুন পাওয়া A. anamensis এর চেহারার মধ্যে বেশ পার্থক্য রয়েছে।
একসময় মনে করা হয়েছিল যে Australopithecus anamensis থেকেই একটি একক বিবর্তনগত বংশধারায় Australopithecus afarensis এর আবির্ভাব ঘটে। কিন্তু এই নতুন পাওয়া নমুনাটি আমাদের বলছে, এই দুটো প্রজাতি অন্ততপক্ষে এক লক্ষ বছর ধরে একই সাথে পৃথিবীতে বর্তমান ছিল। আগেই বলেছিলাম A. anamensis এর অস্তিত্ব এখন পাওয়া গেল অন্তত ৪২ থেকে ৩৮ লক্ষ বছর পূর্বের সময়কালের মধ্যে। এদিকে A. afarensis পৃথিবীতে বিচরণ করেছে ৩৯ থেকে ২৯ লক্ষ বছর পূর্ব পর্যন্ত। মানে এই দুই প্রজাতি অন্তত এক লক্ষ বছর ধরে একসাথে পৃথিবীতে ছিল। তারমানে পূর্বে এদের বিবর্তন যতটা সরল ধরা হয়েছিল, আসলে তেমনটা ঘটে নি। বরং এই দুই প্রজাতির বিবর্তনে উপরিপাতন, ক্রিস ক্রসের ঘটনা ঘটেছে। মানুষের বিবর্তনের ইতিহাসে অস্ট্রালোপিথেকাসের বিবর্তন নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ। আর এই আবিষ্কারের কারণে আমরা অস্ট্রালোপিথেকাস নিয়ে নতুন করে ভাবছি বলেই এই নতুন করোটিটি এতটা গুরুত্বপূর্ণ।
ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডন এর হিউম্যান ইভোল্যুশন এনাটমি এর অধ্যাপক ফ্রেড স্পুর(৪) কী বলছেন তাও একটু বলে নেই। ফ্রেড স্পুর এই গবেষণাটির সাথে যুক্ত নন, কিন্তু এই প্রসঙ্গে তিনি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ লিখেছেন, যা রেফারেন্সে অংশে দিয়ে দিয়েছি।(৫) তিনি বলছেন, “এই করোটিটি মানব বিবর্তনের আরেকটি সেলিব্রিটি চরিত্র তৈরি করতে যাচ্ছে। Australopithecus গণটির উদ্ভব নিয়ে আমাদের যে চিন্তাধারাটি রয়েছে, এই আবিষ্কারটি তাকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে প্রভাবিত করবে।”
যাই হোক, এবারে একটা মজার খবর শুনুন। বাংলাদেশের ইন্ডিপেন্ডেন্ট টেলিভিশন এই ব্যাপারটির উপর ভিত্তি করে সম্প্রতি একটি সংবাদ প্রতিবেদন তৈরি করেছে, আর তাদের ইউটিউব চ্যানেলে সেই অংশটি আপলোডও দিয়েছে, রেফারেন্স অংশে লিংকটা পাবেন।(৬)। তো তার কমেন্ট সেকশনে পেলাম মজার সব বক্তব্য। কয়েকটি নমুনা এখানে তুলে দিচ্ছি।
Manik Khan নামে একজন লিখছেন, “হায়রে নাস্তিকের দল, আর কি ভাবে মানুষের ঈমান নষ্ট করবি, মানুষের জন্ম বিষয়ে জানতে হলে কোরআন+হাদিস দেখো। তাহলে সব সত্য জানতে পারবা।” Jamal Sakib নামে একজন লিখেছেন, “এগুলা যে বিশ্বাস করবে তার ঈমান-আমল সব চলে যাবে।” Sabbir Hossain নামে একজন লিখছেন, “আজ পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা একটাও বানর অথবা বনমানুষের মাথা আবিষ্কার করতে পারলো না। তারা খালি মানুষের মাথাই পায়। আবার, ৩৮ লক্ষ বছর আগে, ১ হাজার বছর হলে মানতাম। এগুলা সবই তাদের মন গড়া বানানো তথ্য।”
লিংকটিতে ঢুকলে এরকম আরও অনেক নমুনা পাবেন। পুরো কমেন্ট সেকশনই প্রায় এইসবে ভরা। তবে আমি এগুলো বিনোদনের জন্য দেখিনি বা এখানেও বলছি না। এইসব মন্তব্য আমাদের দেশের সাধারণ মানুষের চিন্তাধারার প্রতিফলন করে। আর এসব কমেন্ট থেকে এও বোঝা যায় যে তারা এইসব নিউজ দেখে এফেক্টেড হয়, তাদের বদ্ধমনে আঘাত লাগে। বারবার এরকম গবেষণা সংবাদ তাদের সামনে উন্মুক্ত করা হলে এই বদ্ধমন একসময় মুক্ত হবে। তাই এইসব সংবাদ বেশি বেশি করে তাদের সামনে নিয়ে আসার প্রয়োজন। কী বলেন আপনারা?
চিত্রে আবিষ্কৃত মাথার খুলি এবং তার রিকনস্ট্রাকশন বা পুনর্কাঠামোগঠন দেখানো হল।
তথ্যসূত্র –
১। A 3.8-million-year-old hominin cranium from Woranso-Mille, Ethiopia
২। Age and context of mid-Pliocene hominin cranium from Woranso-Mille, Ethiopia
৩। Five Things You May Not Have Known About Lucy The Australopithecus
৪। Prof Fred Spoor
৫। Elusive cranium of early hominin found
৬। ৩৮ লক্ষ বছর আগে কেমন ছিল মানুষ? || Early Human Ancestor