ইসলামপ্রতিক্রিয়াহাদিসের ভুল

হাদিসে ভ্রূণ বিকাশের পর্যায়সমূহের সময়কাল

সহিহ হাদিস সমূহেও মানব ভ্রূণের পর্যায়ক্রমিক বর্ণনা এসেছে। কুরআনের আয়াত সমূহে মানব ভ্রূণের বিকাশের যেমন বর্ণনা দেওয়া হয়েছে, হাদিস সমূহেও তেমন বর্ণনাই এসেছে। তবে হাদিস সমূহে আরও বিস্তারিত কিছু তথ্য দেওয়া হয়েছে। নিচে এ-বিষয়ক হাদিস সমূহ তুলে ধরা হলোঃ

গ্রন্থঃ সহীহ বুখারী (তাওহীদ)
অধ্যায়ঃ ৫৯/ সৃষ্টির সূচনা (كتاب بدء الخلق)
হাদিস নম্বরঃ ৩২০৮
৫৯/৬. ফেরেশতাদের বর্ণনা।
৩২০৮. যায়দ ইবনু ওয়াহব (রহ.) হতে বর্ণিত। ‘আবদুল্লাহ (রাঃ) বলেন, সত্যবাদী হিসেবে গৃহীত আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের নিকট হাদীস বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন, নিশ্চয় তোমাদের প্রত্যেকের সৃষ্টির উপাদান নিজ নিজ মায়ের পেটে চল্লিশ দিন পর্যন্ত বীর্যরূপে অবস্থান করে, অতঃপর তা জমাট বাঁধা রক্তে পরিণত হয়। ঐভাবে চল্লিশ দিন অবস্থান করে। অতঃপর তা গোশতপিন্ডে পরিণত হয়ে (আগের মত চল্লিশ দিন) থাকে। অতঃপর আল্লাহ একজন ফেরেশতা প্রেরণ করেন। আর তাঁকে চারটি বিষয়ে আদেশ দেয়া হয়। তাঁকে লিপিবদ্ধ করতে বলা হয়, তার ‘আমল, তার রিয্ক, তার আয়ু এবং সে কি পাপী হবে না নেককার হবে। অতঃপর তার মধ্যে আত্মা ফুঁকে দেয়া হয়। কাজেই তোমাদের কোন ব্যক্তি ‘আমল করতে করতে এমন পর্যায়ে পৌঁছে যে, তার এবং জান্নাতের মাঝে মাত্র এক হাত পার্থক্য থাকে। এমন সময় তার ‘আমলনামা তার উপর জয়ী হয়। তখন সে জাহান্নামবাসীর মত আমল করে। আর একজন ‘আমাল করতে করতে এমন স্তরে পৌঁছে যে, তার এবং জাহান্নামের মাঝে মাত্র এক হাত তফাৎ থাকে, এমন সময় তার ‘আমলনামা তার উপর জয়ী হয়। ফলে সে জান্নাতবাসীর মত ‘আমল করে। (৩৩৩২, ৬৫৯৪, ৭৪৫৪) (মুসলিম ৪৭/১ হাঃ ৩৬৪৩, আহমাদ ৩৬২৪) (আধুনিক প্রকাশনীঃ ২৯৬৮, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ২৯৭৮)
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)

উপরে উল্লেখিত হাদিসটি বলছে, মাতৃগর্ভে মানব ভ্রূণ ৪০ দিন পর্যন্ত বীর্য অবস্থায় থাকে এবং তারপর জমাট বাঁধা রক্তে পরিণত হয়। জমাট বাঁধা রক্ত অবস্থায় ৪০ দিন থাকে এবং তারপর মাংসপিণ্ডে পরিণত হয়। আবার, মাংসপিণ্ড অবস্থায় ৪০ দিন বিরাজ করে। এই হাদিসটি খুব পরিষ্কারভাবেই বলে যে ৪০ দিন থেকে ৮০ দিন অব্দি মানব ভ্রূণ কেবলই একটি জমাট বাঁধা রক্ত এবং ৮০ দিন থেকে ১২০ দিন অব্দি কেবলই একটি মাংসপিণ্ড, যা ভুল। কেননা, ভ্রূণ নবম সপ্তাহ অথবা ৬০তম দিন নাগাদ দৃঢ়রূপে বাচ্চার রূপ লাভ করতে শুরু করে। বিস্তারিত জানতে এই ভিডিওটি দেখতে পারেনঃ

(su_youtube_advanced url=”https://youtu.be/h82ltr84_Yg”)

ইসলাম প্রচারকরা হাদিসের এই ভুলটি ভুল নয় প্রমাণ করতে অন্য আরেকটি হাদিস তুলে ধরেন যেখানে ৪০ দিনের বদলে ৪২ দিনের কথা বলা হয়েছে। তাদের দাবি মতে, এই হাদিসটিই উপরে উল্লেখিত হাদিসটি দ্বারা আসলে কি বুঝানো হয়েছে সেটি তুলে ধরে। তাদের ব্যাখা অনুযায়ী, এই হাদিসটি প্রমাণ করে যে উপরে উল্লেখিত হাদিসটি দ্বারা বোঝায় যে, “নুতফা পর্যায়”, “আলাকাহ পর্যায়” এবং “মুদগাহ পর্যায়” একই ৪০ দিনে ঘটে। হাদিসটি নিচে তুলে ধরছি:

গ্রন্থঃ সহীহ মুসলিম (ইফাঃ)
অধ্যায়ঃ ৪৮/ তাকদীর (كتاب القدر)
হাদিস নম্বরঃ ৬৪৮৫
১. মাতৃ উদরে মানুষ সৃষ্টির অবস্থা (ক্রমধারা), তার রিযক, তার মৃত্যু, তার আমল এবং তার দুর্ভাগ্য ও তার সৌভাগ্য লিপিবদ্ধকরণ
৬৪৮৫। আবূ তাহির আহমাদ ইবনু আমর ইবনু সারহ (রহঃ) … আমির ইবনু ওয়াসিলা (রহঃ) আবদুল্লাহ ইবনু মাসউদ (রাঃ) কে বলতে শুনেছেন যে, তিনি বলেছেন, হতভাগ্য সেই ব্যক্তি, যে তার মাতৃ উদর থেকে হতভাগ্য (রূপে জন্মগ্রহণ করেছে)। আর ভাগ্যবান ব্যক্তি সে, যে অন্যের কাছ থেকে উপদেশ লাভ করে। এরপর তিনি (আমির ইবনু ওয়াসিলা (রহঃ)) রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাহাবী হুযায়ফা ইবনু আসাদ গিফারী (রাঃ) এর কাছে এলেন। তখন তিনি তার কাছে আবদুল্লাহ ইবনু মাসউদ (রাঃ) এর উক্তি বর্ণনা করলেন এবং বললেন, আমল ব্যতীত একজন মানুষ কিভাবে দুর্ভাগা (গুনাহগার) হতে পারে?
এরপর তিনি (হুযায়ফা (রাঃ)) তাকে বললেন, তুমি কি এতে বিস্ময়বোধ করছ? আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে বলতে শুনেছি যে, তিনি বলেছেনঃ যখন বীর্যের উপর বিয়াল্লিশ রাত (দিন) অতিবাহিত হয়ে যায় তখন আল্লাহ তাআলা একজন ফিরিশতা পাঠান। সে সেটিকে একটি আকৃতি দান করে, তার কান, চোখ, চামড়া, গোশত ও হাড় সৃষ্টি করে দেয়। এরপর সে বলে, হে আমার প্রতিপালক! সে কি পুরুষ, না স্ত্রীলোক হবে? তখন তোমার রব যা চান নির্দেশ দেন এবং ফিরিশতা (নির্দেশ মুতাবিক) লিপিবদ্ধ করেন।
এরপর সে বলতে থাকে, হে আমার প্রতিপালক! তার বয়স কত হবে? তখন তোমার রব যা চান তাই বলেন এবং সেই মুতাবিক ফিরিশতা লিখেন। এরপর সে বলতে থাকে, হে আমার প্রতিপালক! তার জীবিকা কি হবে, তখন তোমার রব তার মর্জি মাফিক মীমাংসা করেন এবং ফিরিশতা তা লিপিবদ্ধ করেন। এরপর ফিরিশতা তাঁর হাতে একটি লিপি নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। সে তাতে বাড়ায়ও না এবং কমায়ও না।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)

এটা বুঝতে পারাটা কঠিন কিছু নয় যে ৪২ দিন অতিবাহিত হওয়ার পর একজন ফেরেশতার ভ্রূণটাকে একটি আকৃতি দান করাটা কোনোভাবেই নির্দেশ করে না যে “নুতফা পর্যায়”, “আলাকাহ পর্যায়” এবং “মুদগাহ পর্যায়” ৪২ দিনের আগেই ঘটে। তাছাড়াও, “আলাকাহ পর্যায়” (রক্তপিণ্ড) এবং “মুদগাহ পর্যায়” (মাংসপিণ্ড) এর ভ্রূণেরও আকৃতি আছে।

উপরে উল্লেখিত হাদিসটি খুব পরিষ্কারভাবেই ১২০ দিনের সময়কাল নির্দেশ করছে। হাদিসটি খুব পরিষ্কারভাবেই বলছে যে মানব ভ্রূণ মাতৃগর্ভে ৪০ দিন বীর্য অবস্থায় থাকে, তারপর জমাট বাঁধা রক্তের জন্যেও আবার আলাদাভাবে ৪০ দিনের কথা বলছে, তারপর মাংসপিণ্ডের জন্যেও আবার আলাদাভাবে ৪০ দিনের কথা বলছে।

কেবল নুতফা পর্যায়ই যে ৪০ দিন পর্যন্ত স্থায়ী থাকে সেটা আমরা সহিহ হাদিস সমূহ থেকেই জানতে পারি। নিচে এরকম দুটি হাদিস তুলে ধরছি:

গ্রন্থঃ সহীহ মুসলিম (হাঃ একাডেমী)
অধ্যায়ঃ ৪৭। তাকদীর (كتاب القدر)
হাদিস নম্বরঃ ৬৬১৭
১. মায়ের উদরে মানুষের সৃষ্টি রহস্য, তার ভাগ্যের রিয্‌ক, মৃত্যুস্থান, আমাল, হতভাগ্য ও সৌভাগ্য লিপিবদ্ধকরণ
৬৬১৭-(…/…) উসমান ইবনু আবূ শাইবাহ, ইসহাক ইবনু ইবরাহীম, আবু সাঈদ আল আশাজ্জ ও উবাইদুল্লাহ ইবনু মুআয (রহঃ) ….. জারীর ইবনু আবদুল হামীদ, ঈসা ইবনু ইউনুস, ওয়াকী ও শুবাহ ইবনুল হাজ্জাজ (রহঃ) সকলে আ’মাশ (রহঃ) হতে এ সূত্রে হুবহু হাদীস বর্ণনা করেছেন। তিনি (আ’মাশ) ওয়াকী বর্ণিত হাদীসে বলেছেন, নিশ্চয়ই তোমাদের কারো সৃষ্টি (বীর্য) তার মায়ের গর্ভে চল্লিশ রাত্রি একত্রিত রাখা হয়। আর তিনি শু’বার সানাদে মুআয বর্ণিত হাদীসে বলেছেন, চল্লিশ রাত কিংবা চল্লিশ দিন। কিন্তু জারীর ও ঈসা (রহঃ) এর হাদীসে কেবলমাত্র أَرْبَعِينَ يَوْمًا (চল্লিশ দিবসের) কথা উল্লেখ রয়েছে। (ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৬৪৮৩, ইসলামিক সেন্টার ৬৫৩৫)
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)

গ্রন্থঃ সহীহ মুসলিম (হাঃ একাডেমী)
অধ্যায়ঃ ৪৭। তাকদীর (كتاب القدر)
হাদিস নম্বরঃ ৬৬২১
১. মায়ের উদরে মানুষের সৃষ্টি রহস্য, তার ভাগ্যের রিয্‌ক, মৃত্যুস্থান, আমাল, হতভাগ্য ও সৌভাগ্য লিপিবদ্ধকরণ
৬৬২১-(৪/…) মুহাম্মাদ ইবনু আহমাদ ইবনু আবু খালাফ (রহঃ) …. আবু তুফায়ল বলেন, আমি আবূ সারীহাহ হুযাইফাহ ইবনু আসীদ আল গিফারী (রাযিঃ) এর নিকট গেলে তিনি বলেন, আমি আমার এ কান দিয়ে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে বলতে শুনেছি যে, তিনি বলেন, বীর্য জরায়ুতে চল্লিশ রাত স্থির থাকে। তারপর একজন ফেরেশতা তাকে আকৃতি প্রদান করেন। রাবী যুহায়র (রহঃ) বলেন, আমার ধারণা তিনি বলেছেন, “যাকে তিনি তৈরি করেন” তখন তিনি বলতে থাকেন, হে আমার প্রভু! সে-কি পুরুষ না মহিলা? তারপর আল্লাহ তাকে পুরুষ কিংবা মহিলা সৃষ্টি করেন। অতঃপর তিনি (ফেরেশতা) বলতে থাকেন, হে আমার রব। আপনি তাকে পূর্ণ সৃষ্টি করবেন না অপূর্ণ? তখন আল্লাহ তাকে পূর্ণ অথবা অপূর্ণ সৃষ্টি করেন। তারপর তিনি বলেন, হে আমার প্রভু! তার জীবনোপকরণ, মৃত্যুক্ষণ, চরিত্র কি হবে? তারপর আল্লাহ তা’আলা তাকে হতভাগ্যবান কিংবা সৌভাগ্যবান বানিয়ে দেন। (ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৬৪৮৭, ইসলামিক সেন্টার ৬৫৩৯)
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)

নিঃসন্দেহেই উপরের হাদিস দুটো বৈজ্ঞানিকভাবে ভুল।

হাদিসটি আরও অনেক কারণেই বৈজ্ঞানিকভাবে ভুল। যেমন: হাদিসটি বলে যে, ৪০ দিনের পর একজন ফেরেশতা এসে ভ্রূণটিকে আকৃতি দান করে, যার মানে দাঁড়ায় ৪০ দিনের আগ অব্দি ভ্রূণটি আকৃতিহীন অবস্থায় থাকে আর সেটা বৈজ্ঞানিকভাবে ভুল। হাদিসটি বলে যে, মানব ভ্রূণ ৪০ দিন পর্যন্ত বীর্য অবস্থায় থাকে যা আরও একটি ভুল। এই হাদিস অনুযায়ী ৪০ দিনের আকৃতিহীন ভ্রূণকে একটি অতিপ্রাকৃত সত্ত্বা কান, চোখ, চামড়া, মাংস ও হাড় সৃষ্টি করে দেয় আর সেটা চামড়া, হাড় ও পেশীর প্রাকৃতিক এবং ক্রমিক বিকাশ ও গঠনের বিরুদ্ধে যায়, যা ৪০ দিনের পূর্বেই শুরু হয়ে যায়।

আরও পড়ুনঃ

Marufur Rahman Khan

Marufur Rahman Khan is an Atheist Blogger from Bangladesh.

3 thoughts on “হাদিসে ভ্রূণ বিকাশের পর্যায়সমূহের সময়কাল

  • এ ব্যাপারে এই লেখাটি পড়া যেতে পারেঃ
    “কুরআন কি মানুষের সৃষ্টিতত্ত্ব ও ভ্রূণবিদ্যা সম্পর্কে সঠিক তথ্য দেয়?”
    https://www.muslimmedia.info/2017/07/28/skepticism-sries-does-quran-give-correct-info-about-creation-and-embryology

    Reply
  • মুশফিকুর রহমান মিনার
    আপনার দেওয়া লিংকের জবাব ই হলো উপরে দেওয়া প্রবন্ধ

    Reply
  • Masranga Kingfisher

    নারীরা ইসলামে শস্য ক্ষেত্র হিসেবে বলা হয়েছে। পুরুষেরা ইচ্ছামতো হাল চাষ করবে এবং তাতে বীজ (বীর্য)বপন করবে। বীজ যেমন শস্যক্ষেত্র থেকে পুষ্টি নিয়ে বৃক্ষে/শস্যে পরিণত হয় তেমনি বীর্য ৪০ দিন ঘুমন্ত অবস্থায় থাকার পর মাতৃগর্ভ থেকে পুষ্টি নিয়ে (বিভিন্ন পর্যায় শেষে) মানব শিশুতে পরিণত হয়। বিষয়টি মোটেই এমন নয়। মানব শিশুর ভ্রুণ তৈরিতে শুক্রাণু এবং ডিম্বাণু দুটোরই সমান প্রয়োজন। মার থেকে আসার ডিম্বাণু এবং বাবার থেকে আসা শুক্রাণু নিষেকের পরেই ভ্রুণ তৈরি হয়। কিন্তু ইসলামে বারবারই শুধুমাত্র বীর্যকেই মানব শিশুর মূল উপাদান হিসেবে ধরা হয়েছে আর মাতৃগর্ভ কে শস্যক্ষেত্রের সাথে তুলনা করা হয়েছে

    Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *