আমরা কি মনুসংহিতা নিয়ে অপপ্রচার করছি?

Print Friendly, PDF & Email

হিন্দুদের মনুসংহিতা নামে একটি গ্রন্থ আছে। একে হিন্দুদের প্রধান ধর্মশাস্ত্র হিসেবে গণ্য করা হয়। এই গ্রন্থের পাতায় পাতায় কেবল দেখা যায়  শূদ্র বিদ্বেষী, নারী বিদ্বেষী কথা; আর দেখা যায় ব্রাহ্মণের মাহাত্ম্য। বুঝতে বাকি থাকে না কারা কার স্বার্থে এসব বিধান তৈরি করেছিল!
মনুসংহিতার জঘন্যতম শ্লোকগুলি নিয়ে আমি কয়েকটি লেখা লিখেছিলাম; সেগুলো ‘সংশয়’ ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছিল’। আমার ব্যবহার করা শ্লোকগুলি থেকে দুই তিনটি শ্লোক উদ্ধৃত করে, এগুলোতে ভুল ধরার চেষ্টা করেছে হিন্দুদের একটি ওয়েবসাইট। সেখানে দেখানোর চেষ্টা করা  হয়েছে যে মনুসংহিতা ৯/১১৮ এর যে শ্লোকটি আমি ব্যবহার করেছি সেটি ভুল এবং নাস্তিকদের অপব্যাখ্যামাত্র। ওয়েবসাইটটি মনু ৯/১১৮ এর একটি অন্যরকমের অনুবাদ দেখিয়েছেন। সেই অনুবাদটি হলঃ ভ্রাতৃগণ নিজ নিজ অংশ থেকে চতুর্থ ভাগ কন্যাগণকে দেবে, যারা দিতে চায় না তারা পতিত হবে। 

ওনার উক্ত শ্লোকের অনুবাদ এখানেই শেষ কিন্তু আমি যে অনুবাদটি দিয়েছিলাম, তাতে আরও কিছু কথা রয়েছে।

মনু ৯/১১৮ এর ক্ষেত্রে আমি যে অনুবাদটি ব্যবহার করেছিলাম সেটি চৈতালী দত্তের অনুবাদ। সেই অনুবাদটির স্ক্রিনশট দেওয়া হচ্ছে।  

মনুসংহিতা 2

বসুমতি শাস্ত্র প্রচার হতে প্রকাশিত মনুসংহিতার ৯/১১৮ নং শ্লোকে যা আছে তার স্ক্রিনশটও দেওয়া হচ্ছে-

মনুসংহিতা 4

এই দুটি  অনুবাদই মোটামুটি একই ধরণের।  মনুসংহিতার বিখ্যাত টীকাকার কুল্লুকভট্টের টীকা অনুসরণ করেই এই অনুবাদ করা হয়েছে। মনুসংহিতার কুল্লুক ভট্টের টীকাই সবচেয়ে বেশি প্রচলিত এবং জনপ্রিয়।

তবে সমালোচক যে অনুবাদ দেখিয়েছেন, কুল্লুকভট্টের টীকা বাদ দিয়ে আলোচ্য শ্লোকের তেমন অনুবাদও করা যায়।

অনুবাদ নিয়ে অনেকসময় ভিন্নতা দেখা যায় বলেই আমার প্রতিটা লেখার নিচে অনুবাদকের নাম, প্রকাশনী, সংস্করণ এইসব উল্লেখ করা হয়। আর এই অনুবাদটি আমি আবিষ্কার করিনি। 

সমালোচক সাইটটি সমালোচনার শেষের দিকে মনু ৯/১৫০-১৫১ এই শ্লোকগুলি যা আমি ব্যবহার করেছি তা নিয়েও প্রশ্ন তুলে  লিখেছে, ” সংশয় ওয়েব সাইটে নবম অধ্যায়ের ১৫০ এবং ১৫১ নং শ্লোকটিতে সম্পত্তি ব্যবস্থাপনার এই ব্যাখ্যা কে প্রতিবেদক বর্ণ বিভাগের নামে চালিয়ে দিয়েছে। এখানে ব্রাহ্মণের ভিন্ন ভিন্ন বর্ণের স্ত্রীদের পুত্র সন্তানের সম্পত্তির ভাগের কথা বলা হয়েছে। এবং পূর্বে আমরা জেনেছি জ্যেষ্ঠ পুত্র পিতৃতুল্য। কনিষ্ঠ ভ্রাতাদের লালন পালনের দায়িত্ব বড় ভাইয়ের হওয়ায় সম্পত্তির বড় ভাগটিবড় ভাইকেই দেওয়া হয়। ”

মনুসংহিতার ৯/১৫০-১৫১ শ্লোকসমূহে আসলে যা আছে- 

“ব্রাহ্মণের গর্ভজ সন্তানকে বিভাগের পূর্বে একটি কৃষক, একটি বৃষ, একটি যান, অলঙ্কার ও বাসভবন এবং অন্য বিষয়ের যত অংশ হবে তার মধ্যে একটি প্রধান অংশ উদ্ধার হিসেবে দেবেন। তারপর ব্রাহ্মণী পুত্র তিন অংশ, ক্ষত্রিয়া পুত্র দুই অংশ, বৈশ্য পুত্র দেড় অংশ এবং শূদ্রা পুত্র একাংশ পাবে।” 

সমালোচক বলছেন, বড় ভাইয়ের দায়িত্ব বেশি হওয়ার ফলে বড় ভাইকে বেশি সম্পত্তি দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। ব্রাহ্মণীর পুত্র বড় ভাই বলে স্বাভাবিকভাবেই সে বেশি সম্পত্তি পাবে।

বড় হওয়ার কারণে বড় ভাই হিসাবে ব্রাহ্মণীর পুত্রকে  যদি  বেশি সম্পত্তি দেওয়া হয়ে থাকে তাহলে শুধু ব্রাহ্মণীপুত্র বড় হওয়ার কারণে তার অধিক সম্পত্তি পাওয়ার কথা কিন্তু এখানে কেন ক্ষত্রিয়াপুত্র দুইভাগ, বৈশ্যা পুত্র দেড়ভাগ এবং শূদ্রাপুত্র এক ভাগ পাচ্ছে ? তাহলে বিষয়টি কি বর্ণগত নয়? এই ব্যাপারটিকে আড়াল করে আসলে কে অপপ্রচার করছে? 

সমালোচক অপরকে অপব্যাখ্যাকারী বলে বারবার চেঁচালেও শাক দিয়ে মাছ ঢাকতে তার তুলনা নেই।  উনি বুদ্ধি করে মনুসংহিতার নবম অধ্যায়ের ১৫২শ্লোক অবধিই দেখালেন। কিন্তু ওই অধ্যায়ের  ১৫৪ শ্লোক দেখলেই ঝোলার বেড়াল বেড়িয়ে পড়বে।

১৫৪ শ্লোকে কি আছে দেখা যাক-

মনুসংহিতা 6
মনুসংহিতা 8

ব্রাহ্মণের ব্রাহ্মণী, ক্ষত্রিয়া, বৈশ্যা এই তিন স্ত্রীর গর্ভে অর্থাৎ উপরের তিন বর্ণের স্ত্রীর গর্ভে পুত্র হোক বা না হোক শূদ্রার গর্ভের সন্তান দশম ভাগের অধিক পাবে না অর্থাৎ একভাগের বেশি অংশ শূদ্রার পুত্র পাবে না। 

উপরে ৯/১৫৪ এর যে অনুবাদটি দেওয়া হল, এটা পঞ্চানন তর্করত্ন কর্তৃক সম্পাদিত মনুসংহিতা থেকে নেওয়া হয়েছে।

 এবার এই শ্লোকের চৈতালী দত্তের অনুবাদ দেওয়া হচ্ছে- 

মনুসংহিতা 10

৯/১৫৪ এর বসুমতি শাস্ত্র প্রচার প্রকাশনার অনুবাদ-

মনুসংহিতা 12

এখানে একটু আলাদাভাবে অনুবাদ করা হলেও শূদ্রার পুত্র দশমভাগের অধিক যে পাবে না তা নিশ্চিত করে দেওয়া হয়েছে।

আরেকটি অনুবাদ দেওয়া হচ্ছে। এর অনুবাদক শ্রীজীব ন্যায়তীর্থ।

মনুসংহিতা 14

সমালোচক উপরের দিক থেকে কয়েকটি শ্লোক দেখিয়ে ৯/১৫০-১৫১ এ বর্ণবাদ নেই বোঝাতে চাইলেন। কিন্তু নিচের একটি দুটি শ্লোক দেখলেই আসল ব্যাপার বোঝা যায়।

এই যে বর্ণ ভেদে সম্মান ও মর্যাদার তারতম্য, সুযোগ সুবিধায় তারতম্য এসব সম্পূর্ণ মনুসংহিতা জুড়েই রয়েছে। মনুসংহিতা বিষয়ক লেখাগুলোতে এর উল্লেখ অহরহ পাওয়া যাবে।

মনুসংহিতার অধিকাংশই নারী বিদ্বেষী, শূদ্রবিদ্বেষী, জাতিবাদী, অযৌক্তিক কথা বার্তায় ভর্তি। এই কারণেই প্রতি  বছর নির্দিষ্ট দিনে ভারতে মনুসংহিতা পোড়ানো হয়। ভারতের সংবিধান রচয়িতা ড.বি.আর. আম্বেদকর মনুসংহিতা  পোড়ানোর সূত্রপাত করেছিলেন।  কোনো সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ মনুসংহিতা নামক এই আবর্জনাকে ডিফেন্ড করতে পারে না। যে ব্যক্তি ওই সাইটটিতে ছোট্ট লেখাটি লিখলেন, তার পদ্ধতি বেশ ভালো! উনি কেবল দুই তিনটি  শ্লোক দেখিয়ে সকল তথ্যপ্রমাণকে ভুয়া বলে চালিয়ে দিতে পারেন। একটি শ্লোকের অন্য রকম অনুবাদ উনি দেখিয়েছেন । কিন্তু আমি যার অনুবাদ ব্যবহার করেছি , আমার লেখার নিচেই তার অনুবাদকের নাম দিয়ে দেওয়া হয়েছিল। আর ওই অনুবাদ কুল্লুক ভট্টের টীকা অনুসরণ করে করা হয়েছে। কুল্লুকের মনুসংহিতার টীকাকে সবচাইতে ভালো ব্যাখ্যা বলে মনে করা হয়, অপব্যখ্যা বলে মনে করা হয় না। কিন্তু হাস্যকর ব্যাপার হল ৯/১৫০-১৫১ শ্লোক নিয়ে উনি খুবই নিম্নমানের চালাকি করেছেন। কিন্তু ওই শ্লোকের নিচের একটি-দুটি শ্লোক দেখলেই বোঝা যায় এখানে উনি নিজেই অপব্যখ্যা করছেন, শাক দিয়ে মাছ ঢাকতে চাইছেন। 

কিন্তু ওনার একটি অপব্যখ্যা ধরার মানে কিন্তু এই নয়, উনি যা বলবেন ভবিষ্যতে বা যা ইতিমধ্যেই বলেছেন তার সবই অপব্যখ্যা । একজন যুক্তিবাদী হিসাবে আমি  এতটাও বুদ্ধিবিকল নই। 

অজিত কেশকম্বলী II

"মানুষ ছাড়া ক্ষ্যাপারে তুই মূল হারাবি, মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি।"

12 thoughts on “আমরা কি মনুসংহিতা নিয়ে অপপ্রচার করছি?

  • August 4, 2020 at 3:18 PM
    Permalink

    মনুসংহিতা হিন্দু ধর্মশাস্ত্র নয়। এক আদি হিন্দু শাসক মনু দ্বারা রচিত হিন্দু শাসন বা আইন প্রণালী ।

    Reply
    • August 4, 2020 at 4:08 PM
      Permalink

      বৃহস্পতি তার স্মৃতিশাস্ত্রে বলেছেন, “বেদার্থো পনিবন্ধৃ ত্বাৎ প্রাধান্যাং হি মনোঃ স্মৃতম্। মন্বর্থবিপরীতা যা সা স্মৃতিন প্রশস্যতে।।“ অর্থাৎ, মনুর স্মৃতিই প্রধান, এতেই বেদের অর্থমাহাত্ম্য সন্নিবেশিত হয়েছে- ভগবান মনুর প্রামাণ্য সিদ্ধান্তের সাথে যে সকল স্মৃতি নিবন্ধের অর্থ-বিরোধ, মতবৈষম্য হয় , সেই সকল স্মৃতিসিদ্ধান্ত প্রশস্ত নয় – প্রামাণ্য নয়।

      Reply
    • August 4, 2020 at 5:34 PM
      Permalink

      মনুসংহিতা নিয়ে হিন্দুদের খুব একটা বর্তমানে ভক্তি আছে বলে মনে হয় না। আর প্রধান (ধর্ম)গ্রন্থ হিসাবে মূলত বেদ ও গীতা মানা হয়। গ্রন্থগুলি ঠিক set of instructions ও বলা যায় না। বহুযুগ ধরে কিছু ধারণা থাকলে তাতে প্রচুর আবর্জনা জন্মায় । বাগান পরিস্কার করার মতন তা নিয়ামত করা উচিত। যেটা চাই তা হলো আমাদের বিচার করার স্বাধীনতা না খর্ব হয়।

      Reply
      • August 4, 2020 at 7:02 PM
        Permalink

        মনুসংহিতা নিয়ে ভক্তি কম থাকাই হিন্দু সমাজের জন্য মঙ্গলকর। এখনো কিছু লোক আছে, যাদের মনু বাবাজির প্রতি একটু টান কাজ করে, এই আরকি!

        Reply
  • August 5, 2020 at 6:54 PM
    Permalink

    মনুসংহিতা কোন বৈদিক সনাতন হিন্দু ধর্ম গ্রন্থ নয়। ইহা জলের মতো পরিস্কার কিন্তু মনুসংহিতা বৈদিক সনাতন হিন্দু ধর্মের আইন শাস্ত্র, আর ধর্মের মূল হচ্ছে আইন । আইন যদি না থাকে, তাহলে ধর্মের কোন অস্তিত্ব নেই। আর মনুসংহিতা একা আইন শাস্ত্র নয় । তবে মনুসংহিতা প্রধান
    এবং বৈদিক সনাতন হিন্দু ধর্মে স্মৃতি সংহিতা

    (সমাজ ব্যবস্থাপক শাস্ত্র) ২০টি
    ১.মনু সংহিতা
    ২.অত্রি সংহিতা.
    ৩.বিষ্ণু সংহিতা.
    ৪.হরিত সংহিতা.
    ৫.যাজ্ঞবল্ক্য সংহিতা.
    ৬.পরাশর সংহিতা.
    ৭.ব্যাস সংহিতা.
    ৮.উশনা সংহিতা.
    ৯.অঙ্গিরা সংহিতা.
    ১০.যম সংহিতা.
    ১১.অপস্তম্ভ সংহিতা
    ১২.সম্বর্ত সংহিতা.
    ১৩.কাত্যায়ন সংহিতা.
    ১৪.বৃহস্পতি সংহিতা.
    ১৫.শঙ্খ সংহিতা
    ১৬.লিখিত সংহিতা.
    ১৭.দক্ষ সংহিতা.
    ১৮.গৌতম সংহিতা.
    ১৯.শতাতপ সংহিতা.
    ২০.বশিষ্ট সংহিতা.

    Reply
  • August 7, 2020 at 12:43 AM
    Permalink

    মনুসংহিতা!!! এসব আজকাল ছাপা হয় নাকি? কোথায় পেলেন বইটি? এ যদি হিন্দুদের তেমন কিছু ধর্ম গ্রন্থ হতো তবে দোকানে দোকানে পাওয়া যেত ও ছাপা হতো প্রতি বছর । কয়টা মানুষ চোখে দেখেছে সেটা নিয়ে সন্দেহ আছে। তবে ঐ সব জাত পাত রাবিশ থাকতে পারে ওতে।

    Reply
    • August 7, 2020 at 8:02 PM
      Permalink

      অধিকাংশ হিন্দুরা বেদও চোখে দেখেনি। কিন্তু বেদ হিন্দুদের প্রধান ধর্মগ্রন্থ নামে পরিচিত। মনুসংহিতা বাংলায় দুষ্প্রাপ্য নয়। কলেজস্ট্রিটে যান নিশ্চিতভাবে পেয়ে যাবেন মনুসংহিতার অনেক অনুবাদকের অনুবাদ। রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণ, ধর্মশাস্ত্র পড়লে সেসবে মনুসংহিতার প্রভাব দেখতে পাবেন।

      রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণ সহ অধিকাংশ ধর্মগ্রন্থেই কিন্তু ওই জাতপাতের রাবিশ বর্তমান, শুধু মনুসংহিতাতে নয়।

      Reply
  • January 23, 2021 at 4:24 PM
    Permalink

    মুসলিম দের sadayantra… মুসলিম দের চক্রান্ত চলছে…. যার তার অনুবাদ উল্লেখ করে, হিন্দু ধর্ম ভুল প্রমাণ করার… আর এখানে এত কোরান হাদিস সাপোর্ট আলোচনার কারণ….? এর মানে… চক্রান্ত চলছে…. এটা পুরোপুরি মুসলমান ওয়েবসাইট আছে……

    Reply
  • February 14, 2021 at 6:45 AM
    Permalink

    mohavarot daken srikrisna e bolca aksomoy buddhe ar komrmo onujaie manus ar jat kora hoto.kintu akon ta jonmonirvor hoia gaca.sri krisna bolca jatpat ,manus manus a bived kora moha pap.aisob faltu law kolijug a aisha hoica.ar law poriborton sil.ar hindu dormo onujaie dormo aktae ja religion noi.

    Reply
  • February 27, 2021 at 2:53 PM
    Permalink

    Sir, I want to learn about veda where it says ” Burn in to ashes who do not follow this”. I talked to someone but they ask me for the written document/ proof. So is it possible to sent me the specific document , book name , montra number or what ever to identify specifically. I appreciate all you are doing for the humanity. Thank you for your cooperation.

    Thanks ,

    Sincerely ,
    Bijay debnath.

    Reply
  • May 24, 2021 at 10:09 AM
    Permalink

    মনুসংহিতা কোন ধর্মগ্রন্থ নয়

    Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *