আল্লামা শফীর জান্নাতী খোয়াব

Print Friendly, PDF & Email

আল্লামা শাহ আহমদ শফী হুজুর দেখলেন, তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন। যেহেতু দীর্ঘদিন জান্নাত-গমনের আশায় তিনি আল্লাহের গুণকীর্তনে এবং আল্লাহর আইন প্রতিষ্ঠা করার সংগ্রামে জীবন অতিবাহিত করেছেন, তিনি অতি সহজেই বেহেস্তের দরজায় উপস্থিত হলেন। বেহেস্তের দরজায় পাহারাদারকে বোকাসোকা ফেরেস্তা মনে হল। ফেরেস্তা তাকে কী সব আলতু ফালতু প্রশ্ন করতে শুরু করলেন।
– কী চাই এখানে?
– আমি বেহেস্তে প্রবেশ করতে চাই। আমি একজন ভালো মানুষ। সারা জীবন মুসলমান হিসেবে আল্লাহর এবাদত-বন্দেগিতে জীবন অতিবাহিত করেছি। আল্লাহর মহিমা, গুণকীর্তন প্রচার করার পাশাপাশি আল্লাহর আইন প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম করেছি।
– আরে থামেন, থামেন। আগে বলেন “মানুষ” জিনিষটা কী? আর এই রকম হাস্যকর প্রজাতি কীভাবে মহান আল্লাহতায়ালার মহিমা প্রচার বা প্রতিষ্ঠা করতে পারে?
আল্লামা শাহ আহমদ শফী হুজুর একটু অবাক হলেন। ফেরেস্তারা সরল-সোজা বোকা-সোকা হওয়ার কথা, তবে এত বোকা (বেক্কৈল্লা ফেরেস্তা) হবে তিনি ভাবতে পরেননি। সারা জীবন বাঙালিদের ওয়াজ-নসীহত করে এসেছেন, আজকে ফেরেশতাদেরকে বোঝাতে হবে মনে হচ্ছে।
– হে নির্বোধ ফেরেস্তা, মানবজাতি তোমার কাছে অপরিচিত হওয়ার কথা না। মানুষ হইল আল্লাহর সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি।
– দেখুন, আমি আপনাকে অনুভূতিকে আহত করতে চাইনি। আমি শুধু সন্দেহ পোষণ করেছি, এখানকার কেউ আদৌ “মানুষ” নামের কোনোকিছুর কথা শুনেছে কি না? আপনি যেহেতু মর্মাহত হচ্ছেন, আমি আপনাকে আমাদের গ্রন্থাগারিকের সাথে কথা বলার সুযোগ করে দিতে চাই। তিনি হয়তো আপনাকে সাহায্য করতে পারবেন ।
হুজুর মনে মনে বললেন, এই কারণেই হয়ত আল্লাহ ফেরেস্তাদের শ্রেষ্ঠ জীব ঘোষণা করেননি। পৃথিবীতে সবাই তাকে হুজুর-হুজুর বলে দূর থেকে সালাম দিত, আর এখানে কিনা তাঁকে তো দূরের কথা, মানবজাতিকে অচেনা বলছে। অনেক অপমান বোধ হওয়া সত্ত্বেও তিনি গ্রন্থাগারিকের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন। গ্রন্থাগারিক হয়তো এই নির্বোধ ফেরেস্তাকে উচিত শিক্ষা দেবে।
অতিকায় গোলাকার সহস্র চক্ষু এবং একটা মুখ বিশিষ্ট গ্রন্থাগারিক এসে তাঁর দিকে ঝুকে বললেন, “এইটা আবার কী?”
দারোয়ান পরিচয় করিয়ে দিলেন, “তিনি একটা প্রজাতির সদস্য, যার নাম মানুষ। এবং তিনি বললেন, এই মানুষেরা নাকি পৃথিবী নামক গ্রহে বসবাস করে। আমাদের সৃষ্টিকর্তা নাকি এই প্রজাতির প্রতি বিশেষভাবে আগ্রহী। আমি ভাবলাম, আপনি হয়তো বিজ্ঞ বিধায় এই সংক্রান্ত কিছু আলোকপাত করতে পারবেন।”
গ্রন্থাগারিক কৌতূহলের সাথে আল্লামা সফি হুজুরকে প্রশ্ন করলেন, “ঠিক আছে, তবে আপনি পৃথিবী নামক জায়গাটা কোথায়, তা যদি একটু বুঝিয়ে বলতেন…”
হুজুর নাস্তিকদের সাথে সংগ্রাম করতে করতে এক পর্যায়ে কিছু বিজ্ঞানের বইয়ের শরণাপন্ন হয়েছিলেন, তাই বললেন, “পৃথিবী হলো সৌরজগতের একটা অংশ।”
“সৌরজগত কি জিনিস?”
গ্রন্থাগার বেটার অজ্ঞতা দেখে তিনি বিরক্ত হলেন।
– দেখুন, আমি হজুর মানুষ, কোরান-কিতাব নিয়া আমি দিন কাটাতাম। তবে আপনি যে প্রশ্ন করেছেন, তা বেশরিয়তী জ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত। তবে আমি জানতে পেরেছি যে, সৌরজগৎ হলো মিল্কি ওয়ে (‘আকাশ গঙ্গা’ বললে মালোওয়ান মালোওয়ান শোনায়, তাই ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করলেন) গ্যালাক্সি বা ছায়াপথের অন্তর্ভুক্ত।
– মিল্কি ওয়ে-টা কী জিনিস? – গ্রন্থাগারিক প্রশ্ন করলেন।
– ওহ, মিল্কি ওয়ে হলো একটা ছায়াপথ। এরকম ১০০০,০০০,০০০,০০০ (এক হাজার বিলিয়ন) ছায়াপথের মধ্যে এটা হলো একটা।
– ঠিক আছে, কিন্তু আপনি তো আশা করতে পারেন না যে, আমি হাজার বিলিয়ন ছায়াপথের সব খবর রাখতে পারব। তবে আমি, সম্ভবত, একবার গ্যালাক্সি শব্দটা শুনেছি, তবে দুশ্চিন্তার কিছু নেই। আমার মনে হয়, আমার অধঃস্তন একজন উপগ্রন্থাগারিক আছেন, যিনি গ্যালাক্সি বিষয়ে বিশেষজ্ঞ। দেখি, তাকে ডেকে আনছি আপনার কাছে, হয়তো সে আপনাকে সাহায্য করতে পারবে।
কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর গ্যালাক্টিক সাব-লাইব্রেরিয়ান সফি হুজুরের সামনে হাজির হলেন। শারীরিক আকারে তিনি দ্বাদশতলক। তাঁর চেহারা দেখলে অনুমান করা যায়, তিনি উজ্জ্বল বর্ণের হওয়া সত্ত্বেও দীর্ঘকাল ধুলো-পড়া পুস্তকাদি আর শেলফের মাঝে থাকতে থাকতে তাঁর ওপরে ধুলোর আস্তরণ পরে গেছে।
“স্যার, আমারে ডেকেছেন?”
গ্রন্থাগারিক তাঁকে বললেন যে, সফি হুজুর তাঁর জন্মস্থানের অবস্থান বলতে গিয়ে সৌরজগতের কথা বলেছেন এবং তাই তাঁরা আশা করছেন গ্যালাক্সি সংক্রান্ত লাইব্রেরির অংশে এই সংক্রান্ত তথ্য পাওয়া যাবে।
উপগ্রন্থাগারিক বললেন, “দেখুন, আমার মনে হয়, তা সম্ভব, কিন্তু আমাদের সংগ্রহে আছে ১০০,০০০,০০০,০০০ (একশত বিলিয়ন) গ্যালাক্সি সংক্রান্ত তথ্য এবং প্রতিটার জন্য রয়েছে আলাদা আলাদা সংকলন। এখন নির্দিষ্ট একটা সংকলনের বিষয়ে তথ্য খুঁজে পেতে কিছু সময় লাগবে। কিন্তু এই ক্ষুদ্র পদার্থটা কোন গ্যালাক্সির কথা জানতে চায়?”
সফি হুজুর মিনমিন করে বললেন, “আমার গ্যালাক্সির নাম মিল্কি ওয়ে।”
উপগ্রন্থাগারিক বিরক্তির সঙ্গে গ্রন্থাগারিকেকে বললেন, “ঠিক আছে, স্যার, আমি চেষ্টা করে দেখবো। যদি সম্ভব হয়, তাহলে পাব।”
প্রায় তিন সপ্তাহ যাবত অত্যন্ত দক্ষ গ্যালাক্টিক সেকশনের কর্মচারীরা দিবারাত্রি খোঁজার পর মিল্কি ওয়ের সন্ধান পেলেন, যার নাম্বার QX 321,762. উপগ্রন্থাগারিক এই তথ্য নিয়ে আসার সময় সাথে করে ওই গ্যালাক্সি সংক্রান্ত কেরানিকে সাথে করে নিয়ে এলেন এবং বললেন, “আমরা আমাদের পুরো পাঁচ হাজার কেরানিকে এই খোঁজাখুজির কাজে লাগিয়েছিলাম। আপনারা হয়ত এই কেরানির সাথে কথা বলতে চাইবেন, যিনি বিশেষ করে এই গ্যালাক্সি সংক্রান্ত বিষয়ে নিয়োজিত।”
যে কেরানি এসে হাজির হল, সে দেখতে অষ্টতলক আকৃতির, যাঁর একদিকে চোখ, আর অন্য দিকে মুখ। সে তার গতানুগতিক কর্মস্থল থেকে বাইরে এসে বিব্রত বোধ করছিল। একটু জড়তার সঙ্গে বলল, “আমার গ্যালাক্সি সম্পর্কে কী জানতে চান?”
সফি হুজুর বললেন, “আমি জানতে চাইছি একটা সৌরজগৎ সম্পর্কে, যেখানে কয়েকটা গ্রহ একটা নক্ষত্রকে প্রদক্ষিণ করছে এবং ওই নক্ষত্রের নাম সূর্য।”
কেরানি বলল, “হুম! দেখুন, সঠিক গ্যালাক্সি খুঁজে পাওয়া যথেষ্ট হয়রানির বিষয়, আর সঠিক নক্ষত্রকে খুঁজে পাওয়া তার চেয়ে অনেক কঠিন। কারণ এখানে আছে ৪০০,০০০,০০০,০০০ (চার শত বিলিয়ন) নক্ষত্র। আমার জানা নেই, কীভাবে একটা নক্ষত্রকে অন্য নক্ষত্রের থেকে পার্থক্য করব। তবে আমার মনে পড়ে, একবার প্রশাসনিক বিভাগ থেকে পুরো ৪০০,০০০,০০০,০০০ (চার শত বিলিয়ন) নক্ষত্রের তালিকা জানতে চাওয়া হয়েছিল। আমার মনে হয়, কোনো একটা স্টোর রুমের কথাও তা খুঁজে পাওয়া যেতে পারে। এটা পাওয়া যদি এতই জরুরি হয়, তাহলে আমি অতিরিক্ত কর্মী নিয়োগ করব, যাতে ওই নক্ষত্র খুঁজে পাওয়া যায়।”
যাহোক, সফি হুজুরের মর্মপীড়ার কথা বিবেচনা করে ওই নক্ষত্রের সন্ধান করার সিদ্ধান্ত নেয়া হলো। তারপর কয়েক বছর পর কেরানি এসে উপগ্রন্থাগারের সামনে উপস্থিত হল।
“আমি আগেই বলেছিলাম, এই কাজ সহজ হবে না। আর যে-নক্ষত্রকে আপনারা খুঁজে বেড়াচ্ছেন, তার সাথে অন্য কোনো নক্ষত্রের তেমন কোনো তারতম্য নেই যে, বিশেষভাবে পার্থক্য করা যাবে। একটা গড়পড়তা আকৃতি, গড়পড়তা উত্তাপ এবং তার চারপাশে কিছু ছোট ছোট জ্যোতিষ্ক ঘুরে বেড়াচ্ছে। এই জ্যোতিষ্কগুলোকে গ্রহ বলা হয়। অনেক অনুসন্ধানের পরে আমরা অন্তত একটা গ্রহের মধ্যে কিছু কীটপতঙ্গের উপস্থিতি লক্ষ্য করেছি। আমার মনে হয়, সফি সাহেব, সম্ভবত, ওখানকার কোনো প্রজাতির অংশ বিশেষ।”
এই মুহুর্তে সফি হুজুর নিজের কান্না আর সামাল দিতে পারলেন না। কেন কেন এমন হলো? আমরা অসহায় পৃথিবীর বাসিন্দারা ভেবে বসে আছি, আমাদের জন্য সমগ্র মহাবিশ্ব সৃষ্টি করা হয়েছে। সারা জীবন আল্লার এবাদত করেছি। এক রাকাত নামাজ কাজা করিনি এই আশায় যে, তিনি আমার এবাদত শুনতে পাবেন এবং আমাকে অনন্তকালের শান্তির হুরী সমেত বেহেস্ত দিবেন। কিন্তু এ কী শুনলাম? আমি কিনা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র পরমাণু আকারের প্রজাতি, যে কিনা ঘটনাচক্রে জন্ম নিয়েছে এক ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র গ্রহে, যা কিনা ঘুরে বেড়াচ্ছে একটা নক্ষত্রের চারপাশে, যা কিনা একই রকম চার হাজার বিলিয়ন নক্ষত্রের গ্যালাক্সির একটা, আর এই রকম গ্যালাক্সির সংখাও নাকি ১০০,০০০,০০০,০০০ (একশত বিলিয়ন)-এর চেয়ে বেশি। আমি আর আল্লার অবজ্ঞার কষ্ট সইতেই পারছিনা।
তখন দারোয়ান বললেন, “তাহলে আপনি অন্য কথাও চলে যান।”
এই পর্যায়ে সফি হুজুরের ঘুম ভাঙল। হুজুর বললেন, “ঘুমের মধ্যে শয়তান যে যত্তোসব আজে বাজে স্বপ্ন দেখায়!” এই বলে হুজুর ফজর নামাজের জন্য প্রস্তুতি নিলেন।

* Bertrand Russell রচিত Fact and Fiction (1961) নামক বইয়ের The Theologian’s Nightmare-এর ছায়া অবলম্বনে

প্রথম প্রকাশ ধর্মকারী ৪ ডিসেম্বর, ২০১৫

নরমপন্থী

আমি মূলত একজন নরমপন্থী নাস্তিক। http://facebook.com/noromponthir

2 thoughts on “আল্লামা শফীর জান্নাতী খোয়াব

  • February 12, 2020 at 2:18 PM
    Permalink

    খুবই ভালো লাগলো ভাইয়া।

    Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *