ইসলাম এবং আমার অবিশ্বাস (পর্ব দুই)

অবিশ্বাস

খুব ছোটবেলা যখন ইসলাম সম্পর্কে কোরআন সম্পর্কে বেশ ভালো ভালো কথা শুনতাম এদিক সেদিক থেকে যা শুনতে খুবই ভালো লাগতো। কোরআনে লুকিয়ে আছে জ্ঞান বিজ্ঞানের সকল উৎস, ইংগিত দেওয়া আছে এমন এমন ঘটনার যা বিজ্ঞান হাজার বছর পর জানতে পেরেছে। খুব গর্ব হতো এসব ভেবে যে আমার ধর্মই একমাত্র সত্য ধর্ম নাহলে হাজার বছর আগেকার বই এতো তথ্য কিভাবে জানতে পারে। তো ছোটবেলা থেকেই শুনে বড় হলাম যে কোরআনে ১৪০০ বছর আগেই বলা হয়েছে যে সূর্য স্থির নয় বরং নির্দিষ্ট কক্ষপথে গতিশীল যা আধুনিক বিজ্ঞান জানতে সক্ষম হয়েছে এইতো কয়েকদিন আগে। কি আশ্চর্যকথা তাইনা? ঈশ্বরের পাঠানো ধর্ম না হলে ইহা কিভাবে সম্ভবপর হতে পারে? এসব কথা ভেবে খুব গর্ববোধ করতাম। এইযে গর্ববোধ এ এক অন্যরকম গর্ববোধ যে গর্ববোধ শুধু গর্ববোধেই আটকে রাখে। এই গর্ববোধ গভীর ভাবে বিশ্বাস করতে বলে, গভীর ভাবে ভাবতে উৎসাহ দেয় না। এই গর্ববোধ এক অন্ধত্বের ওপর জোর নিয়ে আসে, নিজের মস্তিষ্ক ব্যবহার করে সিদ্ধান্ত গ্রহণের শিক্ষা দিতে পারে না। আর এসব বুঝতে শুরু করলাম তখন যখন জানলাম অন্যান্য ধর্মের ধর্মগুরুরাও তাদের ধর্মগ্রন্থের বানী গুলোকে আধুনিক বিজ্ঞানের সাথে মিলিয়ে দেখায় যে তাদের ধর্মই একমাত্র সত্য ধর্ম। সনাতন ধর্মের অনুসারী বেদের ভুল গুলা যেভাবেই হোক সঠিক দেখানোর চেষ্টা করে আবার, আধুনিক বিজ্ঞানের সাথে মিল খুঁজে বের করে। খ্রিষ্টান ধর্মের অনুসারীও একইভাবে বাইবেলের ভুল গুলা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে যেভাবেই হোক সঠিক দেখানোর আপ্রাণ চেষ্টা করে আবার, আধুনিক বিজ্ঞানের সাথে মিলও খুঁজে বের করে। তাহলে কি সব ধর্মই সঠিক? সব ধর্মই কি ঈশ্বরের পাঠানো ধর্ম? অবশ্যই নাহ। ধর্মগুরুদের দাবিতে যে সত্য খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয় তা তো পরিষ্কার। বরং সত্য খুঁজে পেতে দ্বিমত হতে হবে, নিজের মস্তিষ্ক নিজের ব্যবহার করতে হবে। ধর্মগুরুদের মস্তিষ্কের ওপর ভরসা করে নিজেদের মস্তিষ্কহীন প্রাণীতে পরিণত করে সত্যের নাগাল পাওয়া কখনোই সম্ভব নয়। এভাবেই আমি দ্বিমত হতে শুরু করলাম, সত্য অনুসন্ধান করার প্রয়োজন বোধ করলাম। সনাতন ধর্মের অনুসারীদের কিছু দাবির উত্তর খুঁজতে লাগলাম যা পেয়েও গেলাম এবং দেখলাম তাদের দাবি গুলা খুব শিশুসুলভ। তারপর খ্রিষ্টানদের কিছু দাবিদাওয়া নিয়ে ঘাটাঘাটি করলাম এবং দেখলাম তাদের অবস্থাও খুব একটা উন্নত না। বিজ্ঞানের এযুগে বিজ্ঞানকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা ছাড়া ধর্মের টিকে থাকা সম্ভব নাহ তা ধর্মগুরুরা জানেন এবং ভবিষ্যৎ পরিণতি নিয়েও চিন্তায় থাকেন। সেকারণেই তারা হাজার হাজার বছর আগেকার বইতে জ্ঞান বিজ্ঞানের উৎস খুঁজে পান। তারপর ভাবলাম, অন্যান্য ধর্মে ও ধর্মগুরুদের দাবিতে যদি অসারতা থাকতে পারে তাহলে আমার ধর্ম ও ধর্মগুরুদের দাবিতে যে কোনোরকম অসারতা নেই তা কিভাবে ধরে নেই? কেউ আমাদের কাছে সনাতন ধর্মের বানী প্রচার করলে আমরা হেসে উড়িয়ে দেই, নিজের প্রচলিত বিশ্বাসে অটুট থাকি নয়তো নিজের মস্তিষ্কের সঠিক ব্যবহার করে জানার চেষ্টা করি সেই ধর্মের সত্যতা। আমি বুঝতে শিখেছিলাম, অন্যান্য ধর্মের বেলায় সেসব ধর্মের ধর্মগুরুদের কথা যেমন অন্ধভাবে বিশ্বাস করিনা বরং নিজের মাথা খাটাই তেমনি উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া ধর্মের বেলায়ও নিজের মাথাই খাটানো উচিৎ, তথ্য প্রমাণ ও যুক্তির পথ অনুসরণ করা উচিৎ। “কোরআনে ১৪০০ বছর আগেই বলা হয়েছে সূর্য স্থির নয় ও নির্দিষ্ট কক্ষপথে ঘুরে যা দ্বারা প্রমাণ হয় কোরআনে ১৪০০ বছর আগেই সূর্যের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিতে গতিশীল থাকার কথা বলা হয়েছে যা আধুনিক বিজ্ঞান জেনেছে মাত্র কয়েকদিন আগে” মুসলিম সমাজে প্রচলিত এসব কথা আর অন্ধভাবে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না, নিজের মস্তিষ্কের ওপর ভরসা করতে ইচ্ছা হলো। কোরআনে বার বার খুঁজে পেলাম সূর্যের নির্দিষ্ট কক্ষপথে পরিভ্রমণের কথা বলা হয়েছে এবং বুঝতে পারলাম কোরআন অনুযায়ী আমাদের সূর্য মামা আসলেই স্থির নয়। খুব খুশি হয়েও খুশি হতে পারলাম না। কেননা সূর্য মামা কিসের চারিদিকে নির্দিষ্ট কক্ষপথে পরিভ্রমণ করে বা কিসের ভেতর পরিভ্রমণ করে সেব্যাপারে একটাও আয়াত খুঁজে পেলাম না। তাহলে কিভাবে এবং কেন ভেবে নিবো কোরআনে সূর্যের নির্দিষ্ট কক্ষপথে পরিভ্রমণ বলতে মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির কেন্দ্রের চারিদিকে পরিভ্রমণ বুঝানো হয়েছে? সূর্যের নির্দিষ্ট কক্ষপথে পরিভ্রমণ বলতে পৃথিবীর চারিদিকে পরিভ্রমণ বোঝানো হয় নি তা কিভাবে নিশ্চিত হবো? কিন্তু বুঝতে পারলাম কোরআনে সূর্যের পরিভ্রমণ বলতে পৃথিবীর চারিদিকে পরিভ্রমণের কথাই বলা হয়েছে। কেননা সমস্ত কোরআন হাদিস তন্নতন্ন করে খুঁজেও পাওয়া যাবে না যেখানে বলা হয়েছে, পৃথিবী নিজের অক্ষের ওপর ঘুরে বা পৃথিবী সূর্যের চারিদিকে ঘুরে বা পৃথিবী স্থির নয়! “সূর্যের নির্দিষ্ট কক্ষপথে পরিভ্রমণ” এবং “পৃথিবী ঘুরছে” এমন তথ্য বা তথ্যের ইঙ্গিত না থাকা বলে দেয় কোরআন অনুযায়ী সূর্য পৃথিবীর চারিদিকে ঘুরে। কোরআন অনুযায়ী সূর্য পৃথিবীর চারিদিকে না ঘুরা ছাড়া দিনরাত হওয়া কোরআন অনুযায়ী সম্ভব নয়। কেননা দিন মানে আমরা পৃথিবীর ওপর সূর্যের আলো পড়ে আলোকিত অবস্থাকে বুঝি এবং রাত মানে সূর্যের আলোর অনুপস্থিতিতে অন্ধকার অবস্থা। কোরআন অনুযায়ী সূর্য নির্দিষ্ট কক্ষপথে পরিভ্রমণ করছে আবার পৃথিবীও স্থির তাই পৃথিবীর চারিদিকে সূর্য ঘুরলেই কোরআন অনুযায়ী দিনরাত সম্ভব হবে নয়তো নয়।

পৃথিবীর আহ্নিকগতি ও বার্ষিকগতি সম্পর্কে জানার পূর্বে মানুষ আকাশের দিকে তাকিয়ে সূর্যকে পূর্ব থেকে পশ্চিম দিকে চলতে দেখে ভাবতো সূর্য বুঝি পূর্ব থেকে পশ্চিম দিকে পৃথিবীর চারিদিকে পরিভ্রমণ করে। সূর্য যে সৌরজগতের কেন্দ্রে স্থির এবং পৃথিবীর আহ্নিকগতির কারনেই দিনরাত হয় বা মনে হয় সূর্য পূর্ব থেকে পশ্চিম দিকে চলে তা সেসময়কার মানুষজন জানতো না। শুধু সূর্য নয়, মধ্যযুগের মানুষ ধারনা করতো সূর্য, চন্দ্র এবং তাদের জানা পাঁচ গ্রহ সব পৃথিবীকে কেন্দ্র করে পরিভ্রমণ করে। সূর্য চন্দ্র গ্রহ সবই সময়ের সাথে পরিভ্রমণ করে, তবে কে কার চারিদিকে পরিভ্রমণ করে তা নিয়ে যে ভুল ধারনা প্রচলিত ছিলো তা কেটে গেছে সময়ের পরিবর্তনে। মানুষ জেনেছে পৃথিবী মহাবিশ্বের কেন্দ্র নয় সৌরজগতের ছোট্ট একটা গ্রহ মাত্র। যে গ্রহের মতো আরও অনেক গ্রহ রয়েছে সৌরজগতে। যারা সূর্যের চারিদিকে ঘুরে নির্দিষ্ট কক্ষপথে পরিভ্রমণ করে। সূর্য বা সৌরজগতও মহাবিশ্বের কেন্দ্র নয়, আকাশগঙ্গার মধ্যে থাকা বিলিয়ন বিলিয়ন নক্ষত্রের মতো একটা নক্ষত্র মাত্র। আকাশগঙ্গাও মহাবিশ্বের কেন্দ্র নয় মহাবিশ্বের বিলিয়ন বিলিয়ন গ্যালাক্সির মতো একটা গ্যালাক্সি মাত্র। সময়ের পরিবর্তনে অনুসন্ধিৎসু মানুষরা সত্য জেনেছে এবং প্রচলিত বিশ্বাস ও ধারণার সামনে তা প্রতিষ্ঠা করতে সহ্য করেছে নানা অত্যাচার ও লাঞ্ছনা। সময়ের পরিবর্তনেই মানুষ সত্য মেনে নিয়েছে যুগ যুগ ধরে। মানুষের জ্ঞানের পরিবর্তন হলেও সব ধর্মের পরিবর্তন হয়নি। ধর্মগ্রন্থের শব্দে বাক্যে সেই পুরনো মধ্যযুগীয় মানুষের ভুল ধারনা গুলা চলে আসে। কোরআনও তার ব্যতিক্রম নয়। কোরআন সেইসব ভুলভাল ধারনাই ধারণ করেছে যা ইসলাম প্রতিষ্ঠার সময়ে প্রচলিত ছিলো এবং বর্তমানে যা একদম ভুল বলে প্রমাণিত।

কোরআনে ঠিক যেখানে যেখানে দিনরাতের কথা এসেছে ঠিক সেখানে সেখানেই সূর্য ও চন্দ্রের নির্দিষ্ট কক্ষপথে বিচরণ করার কথা এসেছে। বার বার দিন ও রাতের সাথে সূর্য ও চন্দ্রের নির্দিষ্ট কক্ষপথে বিচরণ করার কথা উল্লেখ্য থাকা ইংগিত দেয় যে সূর্যের নির্দিষ্ট কক্ষপথে বিচরণ করার কারণেই দিন এবং রাত হয়। বাস্তবে সূর্যের গতিশীলতার সাথে পৃথিবীতে দিন রাত হওয়ার কোনো সম্পর্ক নেই। অথচ কোরআনে বার বার দিন ও রাত হওয়ার সাথে সূর্য ও চন্দ্রের পরিভ্রমণের কথা এসেছে। সবচেয়ে বড় কথা হলো, সূর্য একা একা কোনো কক্ষপথে পরিভ্রমণ করছে না। পুরো সৌরজগত আকাশগঙ্গা ছায়াপথে নির্দিষ্ট কক্ষপথ ধরে চলছে। অর্থাৎ সূর্য যে কক্ষপথ ধরে চলছে সেই কক্ষপথ ধরেই সূর্যের সাথে চলছে তার পরিবার। কোরআনে সূর্য ও চন্দ্রের আলাদা আলাদা কক্ষপথ ধরা হয়েছে। বাস্তবে চন্দ্র থেকে আলাদাভাবে সূর্যের কোনো কক্ষপথ ধরা যায় নাহ। চন্দ্র যে পথে চলছে সেই পথে সূর্য না চললেও সূর্য যে পথে চলছে সেই পথে চন্দ্রও চলছে, চলছে পুরো সৌরজগত।

সূরা আল-আম্বিয়া আয়াত ৩৩

وَهُوَ ٱلَّذِى خَلَقَ ٱلَّيْلَ وَٱلنَّهَارَ وَٱلشَّمْسَ وَٱلْقَمَرَ كُلٌّ فِى فَلَكٍ يَسْبَحُونَ

ওয়াহুয়াল্লাযী খালাকাল লাইলা-ওয়ান্নাহা-রা ওয়াশ শামছা ওয়াল কামারা কুল্লুন ফী ফালাকিইঁ ইয়াছবাহূন।

তিনিই সৃষ্টি করেছেন রাত্রি ও দিন এবং সূর্য ও চন্দ্র। সবাই আপন আপন কক্ষপথে বিচরণ করে।

সূরা ইবরাহীম আয়াত ৩৩

وَسَخَّرَ لَكُمُ ٱلشَّمْسَ وَٱلْقَمَرَ دَآئِبَيْنِ وَسَخَّرَ لَكُمُ ٱلَّيْلَ وَٱلنَّهَارَ

ওয়া ছাখখারা লকুমুশশামছা ওয়াল কামারা দাইবাইনি ওয়া ছাখখারা লাকুমুল লাইলা ওয়ান নাহা-র।

এবং তোমাদের সেবায় নিয়োজিত করেছেন সূর্যকে এবং চন্দ্রকে সর্বদা এক নিয়মে এবং রাত্রি ও দিবাকে তোমাদের কাজে লাগিয়েছেন।

দৌড় প্রতিযোগিতায় আমরা দেখে থাকি খেলোয়াড়রা একটা গোল মাঠের চারিদিকে দৌড়ে থাকেন। প্রত্যেক খেলোয়াড় আবার আলাদা আলাদা লাইন ধরে দৌড়ান। তো ধরা যাক, আপনি এবং আপনার বন্ধু কোনো এক গোল মাঠের চারিদিকে নির্দিষ্ট লাইন ধরে দৌড় প্রতিযোগিতা করছেন নিজেদের মধ্যে। ধরা যাক, আপনাদের চলার গতি এমন যে একজন আরেকজনের নাগাল পাচ্ছেন নাহ। আপনি মাঠের যেদিকে অবস্থান করছেন, আপনার বন্ধু সেদিক থেকে বিপরীত দিকে অবস্থান করছে। আপনি এপাশে তো আপনার বন্ধু সেই পাশে। আপনি সেই পাশে তো আপনার বন্ধু এপাশে। তো আসল কথা হলো, এই “নাগাল” পাওয়া বা না পাওয়ার প্রশ্ন কেন আসছে? সেটা খুব সহজেই আমরা বুঝতে পারি। কারণ আপনি এবং আপনার বন্ধু একই জিনিস (মাঠ) কেন্দ্র করে দৌড়াচ্ছেন আর তাই একজন আরেকজনের নাগাল পাওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়। সেজন্যই নাগাল পাওয়া বা না পাওয়ার প্রশ্ন এখানে এসে যায়। কোরআনের বক্তা ইয়াসিনে বলেছেন, সূর্য চন্দ্রের “নাগাল” পেতে পারে না। মূলত সেখানে প্রকাশ পেয়েছে, আল্লাহ্‌ সূর্য এবং চন্দ্র খুব নিখুঁত ভাবে নিয়ন্ত্রণ করেন যার দরুন সূর্য ও চন্দ্র একে অপরের “নাগাল” পায় না। সূর্য আর চন্দ্রের মধ্যে “নাগাল” পাওয়া বা না পাওয়ার সম্পর্ক কি তা বুঝা কঠিন কিছু নয়। সূর্য ও চন্দ্রের নাগাল পাওয়ার প্রশ্ন ঠিক তখনই আসবে যখন সূর্য ও চন্দ্র কোনো একই বস্তুকে কেন্দ্র করে পরিভ্রমণ করবে। তাছাড়া সূর্য ও চন্দ্রের একে অপরের “নাগাল” পাওয়া বা না পাওয়ার প্রশ্নই আসেনা। অর্থাৎ কোরআন অনুযায়ী, সূর্য ও চন্দ্র যাকে কেন্দ্র করে নির্দিষ্ট কক্ষপথে পরিভ্রমণ করে তা হচ্ছে পৃথিবী। কেননা, সূর্যের আলোয় দিন এবং সূর্যের আলোর অনুপস্থিতিতে রাত হয়। সুতরাং, কোরআন মতে, সূর্য এমনভাবে পৃথিবীর চারিদিকে পরিভ্রমণ করে যে সূর্য নাগাল পেতে পারে নাহ চন্দ্রের। সূর্য ও সূর্যের আলোয় দিন যেখানে অবস্থান করে সেখানে চন্দ্র ও “সূর্যের আলোর অনুপস্থিতি” অর্থাৎ রাত অবস্থান করে না। আবার, যেখানে চন্দ্র ও “সূর্যের আলোর অনুপস্থিতি” রাত অবস্থান করে সেখানে সূর্য ও সূর্যের আলো অর্থাৎ দিন অবস্থান করে নাহ।

সূরা ইয়া সিন আয়াত ৪০

لَا ٱلشَّمْسُ يَنۢبَغِى لَهَآ أَن تُدْرِكَ ٱلْقَمَرَ وَلَا ٱلَّيْلُ سَابِقُ ٱلنَّهَارِ وَكُلٌّ فِى فَلَكٍ يَسْبَحُونَ

লাশশামছুইয়ামবাগী লাহাআন তুদরিকাল কামারা ওয়ালাল্লাইলুছা-বিকুন্নাহা-রি ওয়া কুল্লুন ফী ফালাকিইঁ ইয়াছবাহূন।

সূর্য নাগাল পেতে পারে না চন্দ্রের এবং রাত্রি অগ্রে চলে না দিনের প্রত্যেকেই আপন আপন কক্ষপথে সন্তরণ করে।

আমরা জানি পুরো সৌরজগত আকাশগঙ্গা ছায়াপথে নিজস্ব কক্ষপথ ২২৫ মিলিয়ন বছরে একবার অতিক্রম করে। সূর্যের ২২৫ মিলিয়ন বছরের পথ অতিক্রম করা মানুষের দেখা সম্ভব নয়। মানুষের আয়ু সেই ২২৫ মিলিয়নের বছরের তুলনায় তুচ্ছ। অর্থাৎ সূর্যের নির্দিষ্টকাল পর্যন্ত পরিভ্রমণ করা কোনো প্রতিদিনকার ঘটনা নয় যা মানুষ দেখতে পারবে। এদিকে লুকমানের আয়াত ২৯ এ কোরআনের বক্তা কিছু নিদর্শন দেখে আল্লাহ্‌র সত্যতা উপলব্ধি করতে বলেছেন। সেখানে দিন ও রাতের মতো সূর্য ও চন্দ্রের নির্দিষ্টকাল পর্যন্ত পরিভ্রমণের কথা এসেছে।

“তুমি কি দেখ না” বলে তিনি প্রশ্ন রেখেছেন, আল্লাহ্‌ রাত্রিকে দিবসে এবং দিবসকে রাত্রিতে প্রবিষ্ট করেন তা কি আমরা দেখি না? আল্লাহ্‌র নিদর্শনের বর্ণনায় আরও বলেন, আল্লাহ্‌ চন্দ্র ও সূর্যকে কাজে নিয়োজিত করেছেন। প্রত্যেকেই নির্দিষ্টকাল পর্যন্ত পরিভ্রমণ করে। “তুমি কি আরও দেখ না” বলে আবার প্রশ্ন করেন, আমরা কি দেখি না যে, আমরা যা করি আল্লাহ্‌ তার খবর রাখেন। “তুমি কি দেখ না” অংশ দ্বারা যে কিছু দেখার কথা বলা হয়েছে তা তো পরিষ্কার। তারপর এসেছে কিছু নিদর্শনের নাম যেখানে দিন রাত্রি ও চন্দ্র সূর্যের পরিভ্রমণ স্থান পেয়েছে। চন্দ্র সূর্যের এই পরিভ্রমণ আলাদাভাবে নেওয়ার সুযোগ নেই। কেননা তারপর আবার “তুমি কি আরও দেখ না” বলে প্রশ্ন করা হয়েছে। “তুমি কি দেখ না” এবং “তুমি কি আরও দেখ না” এ দুই অংশ উক্ত আয়াতে একসাথে সম্পর্ক স্থাপন করেছে। তাছাড়া কোরআনে সূর্য ও চন্দ্রের নির্দিষ্টকাল পর্যন্ত পরিভ্রমণের কথা অনেকবার এসেছে। সুতরাং এ আয়াতে যে সূর্য ও চন্দ্রের নির্দিষ্টকাল পর্যন্ত পরিভ্রমণের ঘটনা আল্লাহ্‌র নির্দশন প্রকাশে ব্যবহার করা হয়েছে তা নিয়ে সন্দেহ থাকার কথা নয়। অথচ আমরা জানি সূর্যের ২২৫ মিলিয়ন বছরের পথ পরিভ্রমণ মানুষের দেখার বিষয় নয়। কোনো লোক যদি ধারনা করে যে, সূর্যের কক্ষপথ পৃথিবী কেন্দ্রিক তবেই সে ভাববে সূর্যের নির্দিষ্টকাল পর্যন্ত পরিভ্রমণ মানুষ দেখতে পারবে।

সূরা লুকমান আয়াত ২৯

أَلَمْ تَرَ أَنَّ ٱللَّهَ يُولِجُ ٱلَّيْلَ فِى ٱلنَّهَارِ وَيُولِجُ ٱلنَّهَارَ فِى ٱلَّيْلِ وَسَخَّرَ ٱلشَّمْسَ وَٱلْقَمَرَ كُلٌّ يَجْرِىٓ إِلَىٰٓ أَجَلٍ مُّسَمًّى وَأَنَّ ٱللَّهَ بِمَا تَعْمَلُونَ خَبِيرٌ

আলাম তারা আন্নাল্লা-হা ইঊলিজুল লাইলা ফিন্নাহা-রি ওয়া ইঊলিজুন্নাহা-রা ফিল্লাইলি ওয়া ছাখখারাশশামছা ওয়ালা কামারা কুলুলইঁইয়াজরীইলাআজালিম মুছাম্মাওঁ ওয়া আন্নাল্লা-হা বিমা-তা‘মালূনা খাবীর।

তুমি কি দেখ না যে, আল্লাহ রাত্রিকে দিবসে প্রবিষ্ট করেন এবং দিবসকে রাত্রিতে প্রবিষ্ট করেন? তিনি চন্দ্র ও সূর্যকে কাজে নিয়োজিত করেছেন। প্রত্যেকেই নির্দিষ্টকাল পর্যন্ত পরিভ্রমণ করে। তুমি কি আরও দেখ না যে, তোমরা যা কর, আল্লাহ তার খবর রাখেন?

ছায়া কেন সময়ের সাথে সাথে বড় হয় কিংবা ছোট হয় তা আমরা সবাই জানি। আলো কোন বস্তুতে পড়লে সেই বস্তুর দ্বারা আলো বাধাগ্রস্ত হওয়ায় বস্তুর বিপরীত পাশে কোনো দেয়াল বা পৃষ্ঠের যে অংশ অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে যায় তাই আমরা ছায়া নামে জানি। তো ছায়ার ছোট বড় হওয়া বা নড়াচড়া করা কখনো আলোক উৎসের অবস্থান পরিবর্তনের ওপর নির্ভর করে আবার কখনো বস্তুর অবস্থান পরিবর্তনের ওপর নির্ভর করে। আলোক উৎস যদি গতিশীল হয় তাহলে আলোক উৎস হবে ছায়ার নির্দেশক। বস্তুর অবস্থান যদি গতিশীল হয় তাহলে বস্তুর অবস্থান হবে ছায়ার নির্দেশক। আমরা জানি পৃথিবীর আহ্নিকগতির কারণেই দিনরাত হয় আবার আহ্নিকগতির কারনেই ছায়া ছোটবড় হয়। পৃথিবীর আহ্নিকগতি নাহ থাকলে ছায়া স্থির হয়েই থাকতো। অর্থাৎ পৃথিবীতে অবস্থিত কোনোকিছুর ছায়ার নির্দেশক সৌরজগতের কেন্দ্রে থাকা স্থির সূর্য নয় বরং ঘূর্ণনশীল পৃথিবী। অথচ কোরআনের বক্তা বলছেন, তিনি সূর্যকে ছায়ার নির্দেশক করেছেন। হ্যা সূর্যকে ছায়ার নির্দেশক বলা যেত যদি সূর্যের কক্ষপথ পৃথিবী কেন্দ্রিক হতো। সুতরাং “ছায়ার নির্দেশক” সম্পর্কে কোরআনের মতামত পৃথিবী কেন্দ্রিক মহাবিশ্বকেই সামনে আনে।

সূরা আল-ফুরকান আয়াত ৪৫

أَلَمْ تَرَ إِلَىٰ رَبِّكَ كَيْفَ مَدَّ ٱلظِّلَّ وَلَوْ شَآءَ لَجَعَلَهُۥ سَاكِنًا ثُمَّ جَعَلْنَا ٱلشَّمْسَ عَلَيْهِ دَلِيلًا

আলাম তারা ইলা-রাব্বিকা কাইফা মাদ্দাজজিল্লা ওয়ালাও শাআ লাজা‘আলাহূছাকিনান ছু ম্মা জা‘আলনাশশামছা ‘আলাইহি দালীলা-।

তুমি কি তোমার পালনকর্তাকে দেখ না, তিনি কিভাবে ছায়াকে বিলম্বিত করেন? তিনি ইচ্ছা করলে একে স্থির রাখতে পারতেন। এরপর আমি সূর্যকে করেছি এর নির্দেশক।

কিতাবের পৃথিবীকেন্দ্রিক মহাবিশ্বের অন্যতম প্রমাণ হচ্ছে স্থির পৃথিবী এবং সে ব্যাপারে কোরআনে অনেক প্রমাণ মিলে। কোরআনের বক্তা আমাদের বলেছেন, তিনি আসমান ও পৃথিবীকে স্থির রাখেন যাতে এসব টলে না যায়। প্রথমত, আসমান কোনো টলে যাওয়ার মতো পদার্থে গঠিত কিছু নয়। আসমান আমাদের চোখের প্রান্তসীমা যা স্থির বা গতিশীল থাকার প্রশ্ন আসেনা! দ্বিতীয়ত, পৃথিবী স্থির নয়, সূর্যের চারিদিকে গতিশীল। যে সূর্য আবার তার সৌরজগত নিয়ে আকাশগঙ্গা ছায়াপথে গতিশীল এবং আকাশগঙ্গা ছায়াপথও এই সম্প্রসারণশীল মহাবিশ্বে প্রতি মুহূর্তে স্থান পরিবর্তন করছে। অর্থাৎ পৃথিবী তার উৎপত্তি থেকেই মহাবিশ্বের নির্দিষ্ট কোনো স্থানে নেই। প্রতি মুহূর্তে স্থান পরিবর্তন করছে এবং নতুন স্থানে প্রবেশ করছে যে স্থানে আগে কখনো আসেনি। প্রতি মুহূর্তে স্থান পরিবর্তন করা একটা বস্তুকে স্থির বলে দাবি করা মধ্যযুগীয় সাধারণ মানুষের দ্বারা সম্ভব কোনো ঈশ্বর দ্বারা নয়। তৃতীয়ত, “টলে যাওয়া” বিষয়টা কোনো গতিশীল বস্তুর সাথে সামঞ্জস্য নয়। বরং স্থির বস্তুর সাথেই পুরোপুরিভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ। উদাহরণ দিয়ে পরিষ্কার করা যাক, আমি যদি একটা ফুটবলে লাথি দেই তাহলে সেটা গতিশীল হবে এবং যতক্ষণ গতি থাকবে ততক্ষণ সেটা গতির দিক বরাবর চলতে থাকবে। গতিশীল অবস্থায় ফুটবলে এদিকওদিক সরে যাবে না। আবার যদি সেই ফুটবল আঙুলে নেই তাহলে গতিহীন অবস্থা বিরাজ করায় ভারসাম্যহীন হয়ে সরে যাবে। আর সেজন্যই সূর্যের চারিদিকে প্রতিনিয়ত গতিশীল পৃথিবীর সাথে সরে যাওয়া বা টলে যাওয়া বা ঢোলে পড়া ইত্যাদি শব্দ একদম অর্থহীন।

সূরা আল-ফাতির আয়াত ৪১

إِنَّ ٱللَّهَ يُمْسِكُ ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلْأَرْضَ أَن تَزُولَا وَلَئِن زَالَتَآ إِنْ أَمْسَكَهُمَا مِنْ أَحَدٍ مِّنۢ بَعْدِهِۦٓ إِنَّهُۥ كَانَ حَلِيمًا غَفُورًا

ইন্নাল্লা-হা ইউমছিকুছ ছামা-ওয়া-তি ওয়াল আরদা আন তাঝূলা- ওয়ালাইন ঝালাতাইন আমছাকাহুমা-মিন আহাদিম মিম বা‘দিহী ইন্নাহূকা-না হালীমান গাফূরা-।

নিশ্চয় আল্লাহ আসমান ও পৃথিবীকে স্থির রাখেন, যাতে টলে না যায়। যদি এগুলো টলে যায় তবে তিনি ব্যতীত কে এগুলোকে স্থির রাখবে? তিনি সহনশীল, ক্ষমাশীল।

কোরআনে আরও বলা হয়েছে, আল্লাহ্‌ পৃথিবীকে স্থির রাখার জন্য পর্বত স্থাপন করেছেন। প্রথমত, পর্বতমালা আমাদের তুলনায় অনেক বিশাল হলেও বিশাল এ পৃথিবীর তুলনায় পর্বতমালা তুচ্ছ। পৃথিবী এতো এতো পর্বতমালা নিয়েই সূর্যের চারিদিকে অনায়াসে গতিশীল। ভূমিকম্প হলে পর্বতমালা নিয়েই কম্পিত হয় পৃথিবী। দ্বিতীয়ত, শূন্যে ভেসে থাকা ও গতিশীল পৃথিবীকে ছোট্টছোট্ট পাহাড় পর্বত ঠিক কিভাবে স্থির রাখে? একটা ফুটবলের ওপর কিছু পিপড়া ছেড়ে দিলে পিপড়া গুলা কি স্থিরতা বা গতিশীলতায় কোনোরূপ ভূমিকা রাখতে পারে? উত্তরটা নিশ্চয় আমরা সবাই বুঝতে পারি।

সূরা আন-নমল আয়াত ৬১

أَمَّن جَعَلَ ٱلْأَرْضَ قَرَارًا وَجَعَلَ خِلَٰلَهَآ أَنْهَٰرًا وَجَعَلَ لَهَا رَوَٰسِىَ وَجَعَلَ بَيْنَ ٱلْبَحْرَيْنِ حَاجِزًا أَءِلَٰهٌ مَّعَ ٱللَّهِ بَلْ أَكْثَرُهُمْ لَا يَعْلَمُونَ

আম্মান জা‘আলাল আরদা কারা-রাওঁ ওয়া জা‘আলা খিলা-লাহাআনহা-রাওঁ ওয়া জা‘আলা লাহা রাওয়া-ছিয়া ওয়া জা‘আলা বাইনাল বাহরাইনি হা-জিঝান আ ইলা-হুম মা‘আল্লাহি বাল আকছারুহুম লা-ইয়া‘লামূন।

বল তো কে পৃথিবীকে বাসোপযোগী করেছেন এবং তার মাঝে মাঝে নদ-নদী প্রবাহিত করেছেন এবং তাকে (পৃথিবী) স্থির রাখার জন্যে পর্বত স্থাপন করেছেন এবং দুই সমুদ্রের মাঝখানে অন্তরায় রেখেছেন। অতএব, আল্লাহর সাথে অন্য কোন উপাস্য আছে কি? বরং তাদের অধিকাংশই জানে না।

কোরআন পড়ে আমরা জানতে পারি, আল্লাহ্‌ পৃথিবীতে পর্বত মালা স্থাপন করেছেন যাতে পৃথিবী আমাদেরকে নিয়ে ঢলে না পরে। আচ্ছা শূন্যে ভাসমান এবং প্রতিনিয়ত গতিশীল একটা গ্রহ কেন ঢলে পরবে? মহাবিশ্বে এমন অসংখ্য গ্রহ আছে যেসব গ্রহে পাহাড় পর্বত নেই। সেসব গ্রহ তাহলে কেন ঢলে পড়ছে না? আর বিশাল আয়তনের একটা গ্রহকে ছোট্টছোট্ট পাহাড় পর্বত কিভাবে ঢলে পরা থেকে বাঁচাবে? পৃথিবী কোনোদিকে ঢলে পরলে পর্বতমালা নিয়েই ঢলে পরতে পারে! বাস্তবতা হলো আদিম মানুষদের মতো কোরআনের বক্তাও বিশ্বাস করতেন আমাদের পৃথিবীর স্থির যা বিশাল বিশাল পর্বতমালার কারণে ঢলে পরে না।

সূরা লুকমান আয়াত ১০

خَلَقَ ٱلسَّمَٰوَٰتِ بِغَيْرِ عَمَدٍ تَرَوْنَهَا وَأَلْقَىٰ فِى ٱلْأَرْضِ رَوَٰسِىَ أَن تَمِيدَ بِكُمْ وَبَثَّ فِيهَا مِن كُلِّ دَآبَّةٍ وَأَنزَلْنَا مِنَ ٱلسَّمَآءِ مَآءً فَأَنۢبَتْنَا فِيهَا مِن كُلِّ زَوْجٍ كَرِيمٍ

খালাকাছছামা-ওয়া-তি বিগাইরি ‘আমাদিন তারাওনাহা-ওয়া আলাকা-ফিল আরদিরাওয়াছিয়া আন তামীদা বিকুম ওয়া বাছছা ফীহা-মিন কুল্লি দাব্বাতিওঁ ওয়া আনঝালনামিনাছছামাই মাআন ফাআমবাতনা-ফীহা-মিন কুল্লি ঝাওজিন কারীম।

তিনি খুঁটি ব্যতীত আকাশমন্ডলী সৃষ্টি করেছেন; তোমরা তা দেখছ। তিনি পৃথিবীতে স্থাপন করেছেন পর্বতমালা, যাতে পৃথিবী তোমাদেরকে নিয়ে ঢলে না পড়ে এবং এতে ছড়িয়ে দিয়েছেন সর্বপ্রকার জন্তু। আমি আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করেছি, অতঃপর তাতে উদগত করেছি সর্বপ্রকার কল্যাণকর উদ্ভিদরাজি।

সূরা আন-নাহল আয়াত ১৫

وَأَلْقَىٰ فِى ٱلْأَرْضِ رَوَٰسِىَ أَن تَمِيدَ بِكُمْ وَأَنْهَٰرًا وَسُبُلًا لَّعَلَّكُمْ تَهْتَدُونَ

ওয়া আলকা-ফিল আরদি রাওয়া-ছিয়া আন তামীদাবিকুমওয়াআনহা-রাওঁ ওয়া ছুবুলাল লা‘আল্লাকুম তাহতাদূন।

এবং তিনি পৃথিবীর উপর বোঝা রেখেছেন যে, কখনো যেন তা তোমাদেরকে নিয়ে হেলে-দুলে না পড়ে এবং নদী ও পথ তৈরী করেছেন, যাতে তোমরা পথ প্রদর্শিত হও।

ঋতু পরিবর্তন যে পৃথিবীর বার্ষিকগতির কারণে হয় তা আমরা সবাই জানি। পৃথিবী গতিশীল না থাকলে ঋতু পরিবর্তন হতো না তাও আমরা জানি। কিন্তু আমরা কি জানি, ইসলাম ঋতু পরিবর্তন সম্পর্কে যেভাবে ব্যাখ্যা করে তা বাস্তবতার সাথে একেবারেই মিলে না? হাদিস অনুসারে, জাহান্নাম দুটো নিঃশ্বাস ফেলে। একটা শীতকালে এবং আরেকটা গ্রীষ্মকালে এবং জাহান্নামের নিশ্বাসের প্রভাবেই আমরা গরমের তীব্রতা ও শীতের তীব্রতা অনুভব করি। হ্যা মোহাম্মদ মনে করতেন এভাবেই শীতগ্রীষ্ম আসে! এবার কেউ দাবি করে বসতে পারে সূর্য বা তাপের উৎস জাহান্নামের অংশ তাই হাদিসে সূর্যকে ইংগিত করা হয়েছে। এভাবে নয়কে ছয় বানিয়েও আসলে সুবিধা করা যায় না। কারন পৃথিবীতে একইসাথে কোনো অংশে গ্রীষ্মকাল বিরাজ করে আবার কোনো অংশে শীতকাল বিরাজ করে। অর্থাৎ শুধু কোরআনে পৃথিবীকে স্থির দাবি করা হয়েছে তা নয়, যেখানে পৃথিবীকে গতিশীল বলতে হবে সেখানেও জাহান্নামের নিঃশ্বাসের গালগল্প বলা হয়েছে।

আবূ হুরাইরাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘জাহান্নাম তার রবের নিকট অভিযোগ করে বলেছে, হে রব! আমার এক অংশ অপর অংশকে খেয়ে ফেলেছে। তখন তিনি তাকে দু’টি নিঃশ্বাস ফেলার অনুমতি প্রদান করেন। একটি নিঃশ্বাস শীতকালে আর একটি নিঃশ্বাস গ্রীষ্মকালে। কাজেই তোমরা গরমের তীব্রতা এবং শীতের তীব্রতা পেয়ে থাক।’ ( সহীহ বুখারী (তাওহীদ) : হাদিস নং ৩২৬০ )

হাদিস অনুসারে, সূর্য আসলে কোথায় যায়? আহ্নিকগতির কারণে আমরা সূর্যকে পূর্ব থেকে পশ্চিমে যেতে দেখি। তারপর কি হয়? তারপর সূর্য কি হারিয়ে যায়? রাতের বেলা সূর্য কি বিশেষ কাজে ব্যস্ত হয়ে পরে? না সেরকম কিছুই হয় না। পৃথিবী প্রতিনিয়ত আহ্নিকগতিতে ঘুরতে থাকে এবং সূর্য তার নিজের অবস্থানেই থাকে। সন্ধ্যার পর সূর্য কোথাও হারিয়ে যায় না বা বিশেষ কাজে ব্যস্ত হয়ে যায় না বরং প্রতিনিয়ত পৃথিবী থেকে দৃশ্যমান থাকে। যে অংশে দিন বিরাজ করে সে অংশে দৃশ্যমান থাকে এবং যে অংশে রাত বিরাজ করে সে অংশ সূর্য থেকে বিপরীত দিকে থাকে। সূর্য প্রতিনিয়ত চলছে, নির্দিষ্ট কক্ষপথ অতিক্রম করছে। থেমে যাচ্ছে না, আবার চলছে। এদিকে হাদিস পড়লে আমরা জানতে পারি, সূর্য চলতে চলতে যায় বলেই দিনরাত হয় এবং সন্ধ্যার পর সিজদারত অবস্থায় পরে থাকে এবং আল্লাহ্‌র অনুমতি প্রাপ্ত হলে আবার চলতে শুরু করে। প্রথমত, সূর্যের গতিশীলতা দিনরাত হওয়ায় ভূমিকা রাখে না। দ্বিতীয়ত, সূর্য কখনোই সিজদায় পড়ে থাকেনা না এবং কারো অনুমতি পেয়ে আবার চলতে শুরু করে না। সূর্য প্রতিনিয়তই চলছে! পরিষ্কার ভাবেই, হাদিস গ্রন্থে পৃথিবী কেন্দ্রিক মহাবিশ্বের ধারনা প্রকাশ পেয়েছে।

ইসলামপন্থীরা যেভাবেই হোক, নয় কে ছয় বানিয়েই হোক একটা সমাধান খুঁজে ধর্মের অসারতা ঢেকে দেওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করে থাকেন! আজকাল কিছু ধার্মিক বলেন, হাদিসে সূর্যের সিজদা বলতে নির্দিষ্ট কক্ষপথে পরিভ্রমণ করা বুঝানো হয়েছে। আদৌ কি তাই? সূর্য বা শূন্যে ভেসে থাকা গ্রহ উপগ্রহ নক্ষত্রের সিজদা বলতে কক্ষপথে পরিভ্রমণ করা বুঝায় সেব্যাপারে কোরআন হাদিসে কোনো আলোকপাত করা হয়েছে? না হয়নি। তাছাড়া কক্ষপথে পরিভ্রমণ করা সিজদা হলে “সিজদাবনত হয়ে পরে থাকা” এবং “আল্লাহ্‌র অনুমতি প্রাপ্ত হয়ে আবার চলতে থাকা” কথা দুটো অর্থহীন হয়ে দাঁড়ায়! “সিজদাবনত হয়ে পরে থাকা” এবং “আল্লাহ্‌র অনুমতি প্রাপ্ত হয়ে আবার চলতে থাকা” কথা দুটো পরিষ্কার ভাবেই স্থিরতা প্রকাশ করে! প্রতিনিয়ত চলতে থাকা সূর্য তার চলার পথে কখন স্থির হয়?

ইয়াহইয়া ইবনু আইউব ও ইসহাক ইবনু ইবরাহীম (রহঃ) … আবূ যার (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন, একদিন নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ তোমরা কি জানো, এ সূর্য কোথায় যায়? সাহাবীগণ বললেন, আল্লাহ ও তাঁর রাসুলই ভাল জানেন। তিনি বললেনঃ এ সূর্য চলতে থাকে এবং (আল্লাহ তা’আলার) আরশের নিচে অবস্থিত তার অবস্থানস্থলে যায়। সেখানে সে সিজদাবনত হয়ে পড়ে থাকে। শেষে যখন তাকে বলা হয়, ওঠ এবং যেখান থেকে এসেছিলে সেখানে ফিরে যাও! অনন্তর সে ফিরে আসে এবং নির্ধারিত উদয়স্থল দিয়েই উদিত হয়। তা আবার চলতে থাকে এবং আরশের নিচে অবস্থিত তার অবস্থানস্থলে যায়। সেখানে সে সিজদাবনত অবস্থায় পড়ে থাকে। শেষে যখন তাকে বলা হয়, ওঠ এবং যেখান থেকে এসেছিলে সেখানে ফিরে যাও। তখন সে ফিরে আসে এবং নির্ধারিত উদয়লে হয়েই উদিত হয়।

সে আবার চলতে থাকে এবং আরশের নিচে অবস্থিত তার অবস্থান স্থলে যায়। সেখানে সে সিজদাবনত অবস্থায় পড়ে থাকে। শেষে যখন তাকে বলা হয়, ওঠ এবং যেখান থেকে এসেছিলে সেখানে ফিরে যাও। তখন সে ফিরে আসে এবং নির্ধারিত উদয়স্থল হয়েই সে উদিত হয়। এমনিভাবে চলতে থাকবে; মানুষ তার থেকে অস্বাভাবিক কিছু হতে দেখবে না। শেষে একদিন সূর্য যথার্রীতি আরশের নিচে তার নিদৃষ্টস্থলে যাবে। তাকে বলা হবে, ওঠ এবং অস্তাচল থেকে উদিত হও। অনন্তর সেদিন সূর্য পশ্চিম গগনে উদিত হবে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ কোন দিন সে অবস্থা হবে তোমরা জানো? সে দিন ঐ ব্যাক্তির ঈমান কোন কাজে আসবে না, যে ব্যাক্তি পুর্বে ঈমান আনে নাই কিংবা যে ব্যাক্তি ঈমানের মাধ্যমে কল্যাণ অর্জন করে নাই। ( সহীহ বুখারী (ইফাঃ) : হাদিস নং ২৯৬ )

এযুগের ইসলামিক স্কলার সাহেবরা কোরআন অনুযায়ী ‘পৃথিবী গতিশীল’ প্রমাণের ব্যর্থ চেষ্টা করে আয়াতের অর্থ বদলে দুইএকটা আয়াত উপস্থাপন করেন। যেমন, অনেকেই সূরা আম্বিয়ার আয়াত ৩৩ তুলে ধরে দাবি করে বসেন, সেই আয়াতে গতিশীল পৃথিবীকে ইংগিত করা হয়েছে। সেই আয়াত বলে, “আল্লাহ্‌ সৃষ্টি করেছেন রাত্রি ও দিন এবং চন্দ্র ও সূর্য। প্রত্যেকে আপন আপন কক্ষপথে বিচরণ করে।” তাদের দাবি, যেহেতু এ আয়াতে বলা হয়েছে, ‘প্রত্যেকে’ আপন আপন কক্ষপথে বিচরণ করে সেহেতু এ আয়াতে রাত্রি ও দিনের আপন আপন কক্ষপথে বিচরণ করার কথাও বলা হয়েছে। যেহেতু রাত্রি ও দিন কোনো পদার্থ নয় সেহেতু রাত্রি ও দিনের কক্ষপথে বিচরণ করার অর্থ পৃথিবীর তার আপন কক্ষপথে বিচরণ করা। রাত্রি দ্বারা রাত্রি বিরাজ করা পৃথিবীর অর্ধেক বুঝানো হয়েছে এবং দিন দ্বারা আলোকিত পৃথিবীর বাকি অর্ধেক বুঝানো হয়েছে।

সূরা আল-আম্বিয়া আয়াত ৩৩

وَهُوَ ٱلَّذِى خَلَقَ ٱلَّيْلَ وَٱلنَّهَارَ وَٱلشَّمْسَ وَٱلْقَمَرَ كُلٌّ فِى فَلَكٍ يَسْبَحُونَ

ওয়াহুয়াল্লাযী খালাকাল লাইলা-ওয়ান্নাহা-রা ওয়াশ শামছা ওয়াল কামারা কুল্লুন ফী ফালাকিইঁ ইয়াছবাহূন।

তিনিই সৃষ্টি করেছেন রাত্রি ও দিন এবং সূর্য ও চন্দ্র। সবাই আপন আপন কক্ষপথে বিচরণ করে।

দিন রাত্রির অর্থ পৃথিবী বানিয়ে ফেলা এধরনের যুক্তি যে একেবারে অগ্রহণযোগ্য তা আমার উপরের আলোচনা থেকেই পরিষ্কার হয়! তারপরও এধরনের যুক্তি কি গ্রহণ করা যায় কিনা সেটা একটু যাচাই করে নেওয়া প্রয়োজন। কোরআনে বার বার দিন ও রাত্রিকে গতিশীল অবস্থায় উপস্থাপন করা হয়েছে। বলা হয়েছে, “আল্লাহ্‌ দিনকে রাতের ওপর পরিয়ে দেন।” আরও বলা হয়েছে, “দিন দৌড়ে রাতের পেছনে আসে।” এসব বানী দ্বারা মূলত আহ্নিকগতি প্রকাশ পায় না। প্রকাশ পায় পৃথিবী নিজের অবস্থানে স্থির থাকে এবং রাতের পেছনে দিন গতিশীল অবস্থায় থাকে এবং দিনের পেছনে রাত গতিশীল অবস্থায় থাকে। বাস্তবে আলো বা দিন এবং আলোর অনুপস্থিতি বা রাত তাদের নিজের অবস্থানে স্থির থাকে। পৃথিবী দিন ও রাত্রির মধ্যে ঘূর্ণনশীল অবস্থায় থাকে। সূর্যের কক্ষপথ পৃথিবী কেন্দ্রিক হলেই দিন রাতের পেছনে গতিশীল অবস্থায় থাকবে এবং রাত দিনের পেছনে গতিশীল অবস্থায় থাকবে। অর্থাৎ কোরআন অনুযায়ী সূর্যের কক্ষপথ পৃথিবীর কেন্দ্রিক এবং দিনরাত গতিশীল!

সূরা আল-আরাফ আয়াত ৫৪

إِنَّ رَبَّكُمُ ٱللَّهُ ٱلَّذِى خَلَقَ ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلْأَرْضَ فِى سِتَّةِ أَيَّامٍ ثُمَّ ٱسْتَوَىٰ عَلَى ٱلْعَرْشِ يُغْشِى ٱلَّيْلَ ٱلنَّهَارَ يَطْلُبُهُۥ حَثِيثًا وَٱلشَّمْسَ وَٱلْقَمَرَ وَٱلنُّجُومَ مُسَخَّرَٰتٍۭ بِأَمْرِهِۦٓ أَلَا لَهُ ٱلْخَلْقُ وَٱلْأَمْرُ تَبَارَكَ ٱللَّهُ رَبُّ ٱلْعَٰلَمِينَ

ইন্না-রাব্বাকুমুল্লা-হুল্লাযী খালাকাছছামা-ওয়া-তি ওয়াল আরদা ফী ছিত্তাতি আইইয়া-মিন ছু ম্মাছ তাওয়া-‘আলাল ‘আরশি ইউগশিল লাইলান নাহা-রা ইয়াতলুবুহূহাছীছাওঁ ওয়াশশামছা ওয়াল কামারা ওয়ান নুজূমা মুছাখখারা-তিম বিআমরিহী আলা-লাহুল খালকুওয়াল আমরু তাবা-রাকাল্লা-হু রাব্বুল ‘আ-লামীন।

নিশ্চয় তোমাদের প্রতিপালক আল্লাহ। তিনি নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলকে ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর আরশের উপর অধিষ্টিত হয়েছেন। তিনি পরিয়ে দেন রাতের উপর দিনকে এমতাবস্থায় যে, দিন দৌড়ে রাতের পিছনে আসে। তিনি সৃষ্টি করেছেন সূর্য, চন্দ্র ও নক্ষত্র দৌড় স্বীয় আদেশের অনুগামী। শুনে রেখ, তাঁরই কাজ সৃষ্টি করা এবং আদেশ দান করা। আল্লাহ, বরকতময় যিনি বিশ্বজগতের প্রতিপালক।

অর্থাৎ সূরা আম্বিয়া আয়াত ৩৩ এ রাত্রি ও দিন দ্বারা পৃথিবী নয় বরং রাত্রি ও দিনকে গতিশীল বুঝানো হয়েছে।

( কিবোর্ড চলবে…)

ইসলাম এবং আমার অবিশ্বাস (পর্ব এক)

Leave a Comment