লীলাবতার শ্রীকৃষ্ণ গোলোকধাম এবং মর্ত্যলোকে বিবিধ লীলা করে গিয়েছেন। তার এইসব লীলাখেলা মনুষ্যসমাজে বহুল আলোচিত এবং সমালোচিত। গোলোকধামে কৃষ্ণ অসংখ্য গোপিনীদের সাথে রাসলীলা করেছেন। পৃথিবীতেও তার অনেক স্ত্রী ছিল। অনেক গ্রন্থ মতে তার স্ত্রীদের সংখ্যা ষোলো হাজার একশ আট। [1] আবার অনেক গ্রন্থ মতে তার স্ত্রীর সংখ্যা ষোলো হাজার। [2] যাইহোক হিন্দু ধর্মগ্রন্থ অনুসারে, তার যে অসংখ্য স্ত্রী ছিল এতে সন্দেহ নেই। এছাড়া গোপিনীদের সাথে লীলাখেলা করতে গিয়ে তাদের কাপড় চুরি করতেও শ্রীকৃষ্ণ দ্বিধাবোধ করেননি।
এসব ছাড়াও কৃষ্ণ এক বৃদ্ধা কুব্জার সাথে সহবাস করেছিলেন। কৃষ্ণের এই লীলার কাছে অন্য সকল লীলা কিছুই নয়। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ মতে, এই বৃদ্ধা কুব্জা পূর্বে রাবণের বোন শূর্পণখা ছিলেন। শূর্পণখা রামকে আকাঙ্ক্ষা করে তপস্যা করেছিলেন। শূর্পণখার সেই আকাঙ্ক্ষা রামের পরবর্তী অবতার কৃষ্ণ পূরণ করেছিলেন।
ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ থেকে ঘটনাটির পূর্ণ বিবরণ দেওয়া হচ্ছে। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের শ্রীকৃষ্ণজন্মখণ্ডের ৭২ অধ্যায়ে আছে,
“কমললোচন শ্রীকৃষ্ণ মথুরার এইরূপ শোভা দর্শন করতে করতে গমনকালে পথের মধ্যে অতি জরাতুরা বৃদ্ধা কুব্জাকে দর্শন করলেন। দেখলেন, সেই রুক্ষাঙ্গী বিকৃতাকার কুব্জা লাঠির সাহায্যে অতি নম্র হয়ে গমন করছে। সেই সময়ে তার গায়ের সকল লোলমাংস চলিত হচ্ছে। …সেই বৃদ্ধার হাতের সোনার পাত্রে কস্তূরীকুমকুমাক্ত চন্দনদ্রব এবং মকরন্দ গন্ধযুক্ত মনোহর সুগন্ধী দ্রব্য ছিল। তখন সেই বৃদ্ধা কুব্জা সহসা ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে দেখে হাসিমুখে হাতজোড় করে ভক্তিবিনত মস্তকে প্রণাম করে তার শ্যামবর্ণ দেহে স্বর্ণপাত্রে থাকা চন্দন বিলেপন করল। পরে তার সঙ্গীগণের গায়েও ঐ রকম চন্দন দিয়ে শ্রীকৃষ্ণকে প্রদক্ষিণ করে বারবার প্রণাম করতে লাগল। পরে কুব্জা শ্রীকৃষ্ণের দৃষ্টিমাত্রে রূপ ও যৌবনে লক্ষ্মীর সমান সৌন্দর্যশালীনি হল। তখন সে বহ্নিশুদ্ধবসন ও রত্নভূষণে ভূষিত মনোহর ধন্যা বারো বছর বয়সের কন্যায় রূপান্তরিত হল। তার ওষ্ঠ বিম্বফলতুল্য, বর্ণ গলন্ত সোনার মত , শ্রোণি ও দন্তপঙক্তি অতি মনোহর এবং পয়োধরযুগল বিল্বফল সদৃশ হল। তখন তার বদনমণ্ডলে নিরন্তর ঈষৎ হাস্য বিকাস পেতে লাগল। সেইসময় কুব্জার গলায় অমূল্য রত্ননির্মিত মনোহর হার বিরাজ করতে লাগল এবং পা দুটি রত্নমঞ্জিরে রঞ্জিত ও গমন গজেন্দ্ররাজের গমনের ন্যায় মন্থর হল। তখন সে মালতীমালা বেষ্টিত বামবঙ্কিম বর্তুলাকার মনোহর কবরীভার ধারণ করল। সেই সীমান্তিনীর সীমান্তের উপরিভাগে কস্তূরীবিন্দু ও চতুর্দিকে চন্দনবিন্দুর সাথে দাড়িম্ব কুসুমাকার সিন্দুরবিন্দু শোভা পেতে লাগল। তখন সেই রতিকর্মনিপুণা রত্নদর্পণহস্তা কুব্জা চঞ্চলকটাক্ষ বিক্ষেপ করে শ্রীকৃষ্ণের প্রীতি সম্পাদন করতে লাগল। সেই সময় শ্রীকৃষ্ণ তাকে আশ্বাস দিয়ে অন্য স্থানে গমন করলে, সেই সতী কুব্জা কৃতার্থ হয়ে কমলার ন্যায় নিজের ভবনে গমন করল। পরে কুব্জা দেখল, তার ভবন কমলার আলয়ের মত রত্নসার নির্মিত ও রত্ন শয্যায় শোভিত হয়েছে। সেই ভবনে প্রদীপ্ত রত্ন-প্রদীপ-শ্রেণী এবং চতুর্দিকে রত্নময় দর্পণ সমূহ বিরাজ করছে। অসংখ্য দাস দাসীতে সেই ভবন পরিপূর্ণ হয়েছে এবং দাসীদের মধ্যে কেউ সিন্দুর , কেউ বস্ত্র, কেউ তাম্বুল, কেউ শ্বেত চামর ও কেউ বা মাল্য ধারণ করে আছে। কুব্জা সেখানে গিয়ে সুমনোহর মিষ্টান্ন ভোজন করে রত্ন নির্মিত খাটে শুয়ে দাসীগণ কর্তৃক সেবিত হতে লাগল। সেই সময় সেই কুব্জা কৃষ্ণের জন্য নিজের কাছে শয্যার উপর সকর্পূর তাম্বূল, কস্তূরী, কুঙ্কুমান্বিত চন্দন, মালতীমাল্যযুগল, কর্পূর প্রভৃতি সুবাসিত শীতল সলিল ও স্বাদু মিষ্টান্ন সকল সংস্থাপিত করে রাখল। তখন কুব্জা কায়মনোবাক্যে কৃষ্ণের চরণ এবং কৃষ্ণের আগমন ও মনোহর মুখচন্দ্র চিন্তা করতে লাগল। … সেইসময় কুব্জা কামাসক্ত হয়ে নিরন্তর কোটি কামদেবের সমতুল্য মনোহর কামুক কৃষ্ণের রূপ চিন্তাতেই নিমগ্ন হল। এমন কি তার চোখে সমস্ত জগত কৃষ্ণময় বলে মনে হতে লাগল।”
এরপরে আমাদের মূল ঘটনার সাথে অপ্রাসঙ্গিক কিছু ঘটনার বিবরণ আছে। সেই সব বিবরণ বাদ দিয়ে প্রাসঙ্গিক বিবরণ তুলে ধরা হলঃ-
“ … এরপর সকলে উত্তম মিষ্টান্ন ভোজন করে খাটে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। এদিকে কুব্জাও নিদ্রিত হলে নিদ্রেশ্বর শ্রীকৃষ্ণ তার কাছে গিয়ে দেখলেন কমলার মত সুন্দরী কুব্জা দাসীগণে পরিবৃতা হয়ে রত্নশয্যায় নিদ্রিত আছেন। তখন জগন্নাথ কৃষ্ণ দাসীগণের ঘুম না ভাঙ্গিয়ে কেবল কুব্জারই নিদ্রা ভঙ্গ করে বলতে লাগলেন, মহাভাগে নিদ্রা ত্যাগ করে আমায় শৃঙ্গার দান কর। সুন্দরী, তুমি পূর্বে রাবণ ভগিনী শূর্পণখা ছিলে। কান্তে, তুমি রামাবতার কালে আমাকে লাভ করবার জন্য তপস্যা করেছিলে। এখন আমি কৃষ্ণরূপে জন্ম গ্রহণ করেছি। তুমি সেই তপঃপ্রভাবে আমাকে কান্তরূপে ভজনা কর। সুন্দরি! এখন তুমি আমার সাথে সুখ সম্ভোগ করে জন্ম-মৃত্যু-জরাশূণ্য সুদুর্লভ আমার গোলোকে গমন কর। শ্রীনিবাস শ্রীকৃষ্ণ এই বলে সেই কামুকী কুব্জাকে বুকে জড়িয়ে নগ্ন করে শৃঙ্গার ও চুম্বন করতে লাগলেন। তখন নবসঙ্গম সঙ্গতা সেই কুব্জা কমলার মত শ্রীকৃষ্ণকে কোলে নিয়ে তার গণ্ডস্থল চুম্বন করতে লাগলেন।… সেই দম্পতি রতিবিষয়ে বিশেষ অভিজ্ঞ, এজন্য ক্ষণকালও তাদেরর সুরতক্রীড়ার বিরাম রইল না, নিরন্তর নানাপ্রকার শৃঙ্গার হতে লাগল। সেইসময়ে ভগবান কৃষ্ণ তীক্ষ্ণ নখাঘাতে কুব্জার স্তনযুগল ও শ্রোণিমন্ডল এবং দাঁত দিয়ে কামড়ে তার ঠোঁট ক্ষত বিক্ষত করলেন।এরপর শ্রীকৃষ্ণ রাত্রি অবসানকালে বীর্যাধান করলে সুন্দরী কুব্জা সম্ভোগসময়ে মূর্ছাপন্ন হলেন। তখন কৃষ্ণের বক্ষে থাকা সেই কুব্জা দিন কি রাত, স্বর্গ কি মর্ত্য, কি স্থল কি জল কিছুই বোধ করতে পারলেন না। পরে সকাল হলে রজনীপতি যেন শ্রীকৃষ্ণের ব্যতিক্রম দর্শনেই লজ্জায় মলিন হলেন। এরপর গোলোক হতে রত্ন নির্মিত রথ উপস্থিত হলে কুব্জা বহ্নিশুদ্ধ বসনধারণ করে রত্নভূষণে ভূষিত হয়ে গলন্ত স্বর্ণের মত নিত্য জন্মাদিবিবর্জিত দিব্য দেহ ধারণ করে সেই রথে চড়ে গোলোকে গমন করলেন। সেই কব্জা গোলোকধামে চন্দ্রমুখী নামে গোপিকা হয়ে অবস্থান করতে লাগিলেন এবং কতিপয় গোপিকা তার পরিচর্যা কার্যে নিযুক্ত হল। …”
শ্রীকৃষ্ণ জন্মখণ্ডের ১২৬ তম অধ্যায়ে কুব্জা এবং কৃষ্ণের এই কাহিনীর উল্লেখ মেলে। এখানে রাধা কৃষ্ণকে বলেন, “আপনি বৃদ্ধা অধিকাঙ্গী, অপুত্রী, যুবাদের অস্পৃশ্যা ক্ষত্রিয়কামিনী কুব্জাকে তার প্রাক্তন পুণ্যবলে ভোগ করেছেন।” একথা বলতে বলতেই রাধা অজ্ঞান হয়ে পড়ে গিয়েছিলেন।
কৃষ্ণের কুব্জার সাথে সহবাসের কথা ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের শ্রীকৃষ্ণ জন্মখণ্ডের ১১৫ তম অধ্যায়েও আছে। এখানে অনিরুদ্ধের সাথে যুদ্ধকালে বাণ অনিরুদ্ধকে বলেন, “ তোর পিতা বাসুদেব মথুরাতে ক্ষত্রিয় আর গোকুলে বৈশ্য। সেখানে তার নাম নন্দনন্দন। নন্দের পশুরক্ষক পরম লম্পট দুষ্ট গোপাল তোর পিতামহ বৃন্দাবনে গোপিদের উপপতি। সেই অধার্মিক পুতনাকে সদ্য বধ করে স্ত্রীহত্যাপাপে লিপ্ত হয়েছে; আবার মথুরায় এসে মৈথুনের মাধ্যমে কুব্জাকে বিনাশ করেছে। অতি নিষ্ঠুর যোনিলোলুপ কৃষ্ণ দুর্বল নরকাসুরকে পুত্রসমেত বধ করে তার মনোহর স্ত্রী সমূহ হরণ করেছে।”
অনিরুদ্ধ বাণের কথার প্রত্যুত্তরে বলেন ,“কুব্জা পূর্বজন্মে দুরাত্মা রাবণের ভগিনী ছিল; তার নাম শূর্পণখা। সে কামবশে শ্রীরামের প্রতি অভিলাষবতী হয়। ধার্মিক প্রধান লক্ষ্মণ তার নাসিকা ছেদন করেছিলেন। পরে শূর্পণখা সেই পরমেশ্বর তার স্বামী হবেন , তপস্যাপ্রভাবে ব্রহ্মার কাছে এই বর লাভ করে। কুব্জারূপে উৎপন্না সেই শূর্পণখা সেই পুণ্যবলে শ্রীকৃষ্ণকে প্রাপ্ত হয়ে গোলোকে গমন করেছে; কৃষ্ণের আলিঙ্গন বলে গোলোকে গিয়ে একজন গোপী হয়েছে। “ [3]
ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে শ্রীকৃষ্ণ জন্মখণ্ডের ১০৬ অধ্যায়ে শিশুপাল কৃষ্ণের বিরুদ্ধে কিছু অভিযোগ করেছেন। সেই সব অভিযোগের মধ্যে কৃষ্ণের কুব্জা সম্ভোগের কথাও মেলে। শিশুপাল বলেছেন- কৃষ্ণ সম্ভোগের মাধ্যমে কুব্জার প্রাণ সংহার করেছেন এবং বস্ত্রের জন্য রজককে হত্যা করেছেন।
শিশুপালের বিবরণ এবং বাণের অভিযোগ অর্থাৎ কৃষ্ণ সম্ভোগের মাধ্যমে কুব্জাকে হত্যা করেছেন এই অভিযোগ, সত্য নাকি অন্য বিবরণ সত্য তা নিশ্চিতভাবে বলা আমাদের সম্ভব নয়। তবে সম্ভোগশেষে দিব্য দেহ ধারণ করে গোলোকে গমন করা কোনো বাস্তবসম্মত কথা বলে মনে হয়না।
যাইহোক, কুব্জা এবং কৃষ্ণের কাহিনী পড়ার পর একটি প্রশ্ন মনে উদিত হয়। প্রশ্নটি হলঃ রামের পরবর্তী জন্মে কৃষ্ণ হয়ে যদি শূর্পণখার সাথে সহবাস করতে কৃষ্ণের আপত্তি না থাকে, তবে পূর্ববর্তী জন্মে কৃষ্ণ যখন রাম ছিলেন, তখন শূর্পণখার প্রস্তাব মানতে তার আপত্তি কেন হল? প্রথম ক্ষেত্রে যদি আপত্তি হয়ে থাকে, তবে দ্বিতীয় ক্ষেত্রে কেন আপত্তি হল না? কেন শূর্পণখার নাক কান কেটে দেওয়া হল?
এই ধরণের সকল জটিল প্রশ্নেরই একটি সরল উত্তর অনেকে দিয়ে থাকেন- এ সবই লীলা। সত্যই ‘নিজের বেলা লীলাখেলা, পাপপূণ্য পরের বেলা’। হিন্দু ধর্মগ্রন্থসমূহে লীলাবতার কৃষ্ণ লীলার নামে যে সকল কাজ করে গিয়েছেন, তা যদি কোনো সাধারণ মানুষ করতো , তাহলে কি এসবকে শুধুই লীলা বলে উড়িয়ে দেওয়া হত? এখনো যদি কেউ কৃষ্ণের মত লীলাখেলা করে বেড়ায়, তাহলে সমাজ তাকে কেমন দৃষ্টিতে দেখবে? যদি তাকে খারাপ দৃষ্টিতে দেখা হয়, তাহলে তথাকথিত লীলাবতারদের কেন ভালো দৃষ্টিতে দেখা হয়? এটা এক প্রকারের হিপোক্রেসি নয়?
বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ এই লেখাটিতে নবভারত পাবলিশার্স হতে প্রকাশিত পণ্ডিতবর শ্রীযুক্ত পঞ্চানন তর্করত্ন সম্পাদিত ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের বাংলা অনুবাদ ব্যবহার করা হয়েছে।
তথ্যসূত্র
- কৃষ্ণের ১৬ হাজার স্ত্রীর দিব্য ভবন এবং ১০৮ পটরমণীর জন্য পরিখা। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ, শ্রীকৃষ্ণজন্মখণ্ড, ১০৩ অধ্যায়[↑]
- ষোলো হাজার কন্যার পাণিগ্রহণ। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ, শ্রীকৃষ্ণ জন্মখণ্ড, ১১২ অধ্যায়[↑]
- কৃষ্ণজন্মখণ্ড, ১১৫ অধ্যায়[↑]
Leave a Comment