সূচনা
ইসলাম প্রচারকগণের মধ্যে অনেকেই ইসলামকে সত্য এবং কোরআনকে একটি বিজ্ঞানময় বিষ্ময়কর গ্রন্থ হিসেবে প্রমাণ করতে দাবি করেছেন যে, কোরআন ১৪০০ বছর আগেই আমাদের জানিয়েছে যে, লোহা মহাকাশ থেকে পৃথিবীতে এসেছে, যা আধুনিক বিজ্ঞান কিছুদিন আগেই জানতে পেরেছে। অনেক ইসলামিক ওয়েবসাইট, ইসলামিক ইউটিউব চ্যানেল, নিউজ পোর্টালে দাবিটি প্রচার করা হয়েছে। হারুন ইয়াহিয়া, জাকির নায়েক এবং তাদের মতো অনেক ইসলাম প্রচারকই এই দাবিটি প্রচার করেছেন। বাংলাদেশের অনেক ইসলাম প্রচারকও ওয়াজ-মাহফিলে দাবিটি উপস্থাপন করে উপস্থিত সাধারণ মানুষকে বুঝিয়েছেন কুরআন কতো বিজ্ঞানময়! কিন্তু, একটি নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে দাবিটি যাচাই করা হলে জানা যায় যে, দাবিটি যথেষ্ট অসংগতিপূর্ণ। কেনো এবং কিভাবে অসংগতিপূর্ণ তা পাঠকদের উদ্দেশ্যে তুলে ধরাই এই প্রবন্ধটির উদ্দেশ্য।
ইসলাম প্রচারকগণের দাবি
তুর্কী ধর্মীয় নেতা, সৃষ্টিবাদী, ষড়যন্ত্র তাত্ত্বিক হারুন ইয়াহিয়া, যাকে গত ১১ জানুয়ারি ২০২১ তারিখে অপরাধমূলক উদ্যোগ, আর্থিক জালিয়াতি এবং যৌন নির্যাতনের দায়ে ১০৭৫ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়, [1] এই দাবিটির একজন প্রবক্তা।
হারুন ইয়াহিয়া লিখেছেন:
কোরআনে যেসকল প্রাকৃতিক উপাদানের কথা বর্ণনা করা হয়েছে তার মধ্যে লোহা অন্যতম একটি উপাদান। সূরা আল-হাদীদে, যে সূরার নামের অর্থ ‘লোহা’, আমাদেরকে জানানো হয়েছে:
“আমরা আরও নাযিল করেছি লোহা যাতে রয়েছে প্ৰচণ্ড শক্তি এবং রয়েছে মানুষের জন্য বহুবিধকল্যাণ।” (কোরআন ৫৭:২৫)
আলোচ্য আয়াতে ব্যবহৃত ‘আনঝালনা’ শব্দটিকে ‘নাযিল করেছি’ অর্থে অনুবাদ করা হয়েছে, যা লোহার জন্য আয়াতটিতে ব্যবহৃত হয়েছে। হয়তো শব্দটি দ্বারা রূপক অর্থে এটা বুঝানো হয়েছে যে, উপকারের জন্য মানুষকে লোহা দান করা হয়েছে। কিন্তু, আক্ষরিক অর্থের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই, আয়াতটি খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি বৈজ্ঞানিক মিরাকল প্রকাশ করে। কারণ, আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ক আবিষ্কারসমূহ থেকে জানা যায় যে, আমাদের পৃথিবীর লোহা, মহাকাশের দানব নক্ষত্রসমূহ থেকে আমাদের পৃথিবীতে এসেছে।
কেবল পৃথিবীর লোহা নয়, পুরো সৌরজগতের লোহাও সৌরজগতের বাইরে থেকে এসেছে। কেননা সূর্যের তাপমাত্রা লোহা গঠনের জন্য যথোপযুক্ত নয়। সূর্যের পৃষ্ঠতলের তাপমাত্রা ৬,০০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং কেন্দ্রস্থলের তাপমাত্রা ২০ মিলিয়ন ডিগ্রি সেলসিয়াসের কাছাকাছি। লোহা সৃষ্টির জন্য সূর্যের চেয়েও আরও অনেক বড় নক্ষত্র প্রয়োজন, যেখানে তাপমাত্রা কয়েকশো মিলিয়ন ডিগ্রির পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে। যখন একটি নক্ষত্রে লোহা একটি নির্দিষ্ট পরিমানের চেয়ে বেশি হয়ে যায় তখন নক্ষত্রটি আর স্বাভাবিক থাকতে পারে না এবং একসময় সেটি বিস্ফোরিত হয়, যাকে ‘নোভা’ বা ‘সুপারনোভা’ বলা হয়। এসকল বিস্ফোরণের কারণেই লোহা মহাশূন্যে ছড়িয়ে পড়ে।
এবিষয়ে একটি বৈজ্ঞানিক উৎস থেকে নিম্নোক্ত তথ্য পাওয়া যায়:
There is also evidence for older supernova events: Enhanced levels of iron-60 in deep-sea sediments have been interpreted as indications that a supernova explosion occurred within 90 light-years of the sun about 5 million years ago. Iron-60 is a radioactive isotope of iron, formed in supernova explosions, which decays with a half life of 1.5 million years. An enhanced presence of this isotope in a geologic layer indicates the recent nucleosynthesis of elements nearby in space and their subsequent transport to the earth (perhaps as part of dust grains)
Source: Priscilla Frisch, “The Galactic Environment of the Sun” American Scientist, January-February 2000
অর্থ্যাৎ, লোহা পৃথিবীতে গঠিত হয়নি, বরং সুপারনোভা থেকে এসেছে এবং পৃথিবীতে নাযিল করা হয়েছে, যেমনটি সূরা আল-হাদীদের ২৫ নং আয়াতে বর্ণিত হয়েছে। এটা পরিষ্কার যে, এই তথ্যটি সপ্তম শতাব্দীতে জানা সম্ভব ছিলো না, যখন কোরআন নাযিল হয়েছিলো। [2]
সারাবিশ্বে বিখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ, ইসলাম প্রচারক, বক্তা ও লেখক ডাঃ জাকির নায়েকও একটি প্রশ্নের উত্তরে একই কথা বলেছেন। তার বক্তব্যটি দেখে নেওয়া যাক:
বাংলাদেশের বর্তমান সময়ের অত্যন্ত জনপ্রিয় একজন ইসলামিক বক্তা মিজানুর রহমান আজহারিও কোনো এক ওয়াজ মাহফিলে দাবিটি প্রচার করেছিলেন।
জবাব
যে আরবি শব্দটিকে কেন্দ্র করে হারুন ইয়াহিয়ার মতো ইসলাম প্রচারকগণ তাদের দাবিটি উপস্থাপন করেন সেই শব্দটি কোরআনে লোহা ছাড়াও আরো অনেকক্ষেত্রেই ব্যবহৃত হয়েছে। ‘আনযালনা/আনযালা’ শব্দটি কোরআনে ৮৮ বার ব্যবহৃত হয়েছে। লোহা ছাড়াও শব্দটি চতুষ্পদী জন্তু, [3] পোশাক-আশাক, [4] খাদ্যদ্রব্য, [5] [6] [7] [8] পানি/বৃষ্টি [9] [10] [11] [12] [13] [14] [15] [16] [17] [18] [19] [20] [21] [22] [23] [24] এবং আহলে কিতাবদের [25] জন্যও ব্যবহৃত হয়েছে।
চতুষ্পদ জন্তু, পোশাকআশাক, খাদ্যদ্রব্য, পানি/বৃষ্টি কিংবা আহলে কিতাব কোনোটাই মহাকাশ থেকে পৃথিবীতে আসে না। আমরা যদি এটা ধরে নিই যে, সূরা আল-হাদীদের ২৫ নং আয়াতে লোহা নাযিল করার কথা বলে কোরআনের লেখক এটা বুঝিয়েছেন যে, লোহা মহাকাশ থেকে পৃথিবীতে এসেছে, তাহলে আমাদের এটাও ধরে নিতে হবে যে, কোরআন অনুযায়ী, চতুষ্পদ জন্তু, পোশাকআশাক, খাদ্যদ্রব্য, বৃষ্টি এবং আহলে কিতাবদের লোকেরাও মহাকাশ থেকে পৃথিবীতে এসেছে। যদি আমরা এমনটা ধরে না নিই তাহলে আমরা কেনো এমনটা ধরে নিবো যে, সূরা আল-হাদীদের ২৫ নং আয়াতে আক্ষরিক অর্থে বলা হয়েছে যে, লোহা মহাকাশ থেকে পৃথিবীতে এসেছে? আমরা কেনো কেবল লোহার ক্ষেত্রেই আক্ষরিক অর্থের অনুমান করবো, কেনো অন্য সবকিছুর জন্য নয়? অন্য সবকিছু এড়িয়ে কেবল লোহার ক্ষেত্রে আক্ষরিক অর্থ গ্রহণ করার কোনো অর্থ নেই। অন্য সকল ক্ষেত্রে রূপক অর্থ গ্রহণ করে কেবল একটি নির্দিষ্ট ক্ষেত্রেই আক্ষরিক অর্থ গ্রহণ করাটা অসাধুতা ছাড়া কিছুই না, যদি না সেই নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে আক্ষরিক অর্থ গ্রহণ করার পেছনে কোনো যৌক্তিক কারণ থাকে।
উপসংহার
ইসলামকে সত্য বলে প্রমাণ করার উদ্দেশ্যে ইসলাম প্রচারকগণ যা দাবি করেন তার গ্রহণযোগ্যতা যাচাই করতে গেলে দেখা যায় যে, তাদের দাবিটি আসলে ইসলামের পক্ষে নয়, বরং ইসলামের বিপক্ষেই যায়। সেইসাথে তাদের অসাধুতাও বেরিয়ে আসে।
তথ্যসূত্র
- Turkish televangelist sentenced to 1,075 years for sex crimes, The Guardian [↑]
- THE MIRACLE OF IRON [↑]
- কোরআন ৩৯:০৬ [↑]
- কোরআন ৭:২৬ [↑]
- কোরআন ১০:৫৯ [↑]
- কোরআন ৪৫:০৫ [↑]
- কোরআন ২:৫৭ [↑]
- কোরআন ৭:১৬০ [↑]
- কোরআন ১৬:১০ [↑]
- কোরআন ৩৫:২৭ [↑]
- কোরআন ১৪:৩২ [↑]
- কোরআন ২৫:৪৮ [↑]
- কোরআন ৬:৯৯ [↑]
- কোরআন ১৬:৬৫ [↑]
- কোরআন ৩৯:২১ [↑]
- কোরআন ২০:৫৩ [↑]
- কোরআন ৪১:৩৯ [↑]
- কোরআন ৩১:১০ [↑]
- কোরআন ১৩:১৭ [↑]
- কোরআন ২২:৬৩ [↑]
- কোরআন ২:২২ [↑]
- কোরআন ২৭:৬০ [↑]
- কোরআন ২৩:১৮ [↑]
- কোরআন ৭৮:১৪ [↑]
- কোরআন ৩৩:২৬ [↑]
Leave a Comment