ধর্মতত্ত্ব , ঈশ্বরই কি পৃথিবীর একমাত্র সমস্যা?

Print Friendly, PDF & Email

অনেকেই প্রশ্নটা করেন। ” ধর্মতত্ত্ব , ঈশ্বরই কি পৃথিবীর একমাত্র সমস্যা? ইশ্বর, ধর্ম ছাড়াই কি সবকিছু শুভ্রসুন্দর হয়ে উঠবে? ঈশ্বরহীন পৃথিবী গড়ে কি লাভ? থাকুক না যার যার বিশ্বাস নিয়ে।”

– না, ঈশ্বর বা ধর্মই মুল সমস্যা নয়, তবে সমস্যাগুলোর একটি তো অবশ্যই। এবং সেটা সম্পর্কিত আরও অনেকগুলো সমস্যার সাথে।

আধুনিক বিশ্ব যুক্তি প্রমাণ গবেষনা তথ্য উপাত্তের বিশ্ব। জ্ঞানভিত্তিক সমাজই সভ্যতার মুল শক্তি। ফ্যাক্ট এন্ড এনালাইসিস, বুদ্ধিশানিত করার প্রতিযোগীতা, ক্রমাগত ভুল সংশোধন, এটাই সভ্যতার চাকা, টিকে থাকার শক্তি। যে যতবেশি যুক্তি প্রমাণ তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করে তা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে এনালাইসিস করতে পারছে, সেই সামনে এগুচ্ছে, বাকিরা তাদের অনুসরণ করছে মাত্র। অথচ আমাদের সমাজের সাথে বিস্তর ফারাক সেই মূল স্রোতের। আমরা ক্রমশ উল্টা দিকে হাটছি। আমাদের সমাজ জ্ঞানভিত্তিক নয়, বিশ্বাসভিত্তিক। যেটা অবশ্যই সমস্যার শেকড় বলেই আমি মনে করি।

সকল বিশ্বাসকে শ্রদ্ধা করতে হলে, যার যার বিশ্বাস তাকে নিয়ে থাকতে দিতে হলে জামাত শিবিরে বিশ্বাসী, বর্নবাদে বিশ্বাসী, সাম্প্রদায়িকতায় বিশ্বাসী, মৌলবাদীতায় বিশ্বাসীদেরও ছাড় দিতে হয়। বিশ্বাস যেহেতু কোন যুক্তিতর্ক প্রমাণ বা তথ্য উপাত্তের ওপর নির্ভরশীল নয়, তাই এটি বিপদজনক। যেকোন বিষয়, যা নিয়ে বস্তুনিষ্ঠ আলোচনা করা যাবে না, সমালোচনা করা যাবে না, যুক্তিতর্ক করা যাবে না, মেনে নিতে হবে, সেটা ক্ষতিকর হতে বাধ্য।

যে ভাবে “মুখ দিছে আল্লায় খাওনো দিবো আল্লায়”-তার বিশ্বাসকেও সম্মান দিতে হয়! যারা বিশ্বাস করে আল্লার আইন কায়েম না হলে বোমা মেরে সব উড়িয়ে দেয়া উচিৎ, বা নাস্তিকদের ধরে ধরে জবাই করা উচিত, তাদের বিশ্বাসকেও সম্মান জানিয়ে তাদের বিশ্বাস নিয়ে তাদের থাকতে দেয়া উচিৎ। তাদের বিশ্বাস অনুসারে কল্লা কাটতে দেয়া উচিত। সম্মান করলে সব বিশ্বাসকেই সম্মান করবো। বিশ্বাসকে যদি আমরা যুক্তিতর্ক দিয়ে পরিমাপ করতে বসই, সেটা তো আর বিশ্বাস থাকলো না। আর তা নাহলে সকল বিশ্বাসকেই প্রশ্ন করবো, যাচাই করে দেখবো তা কতটা কল্যাণকর, কতটা যৌক্তিক। এখানে বিবেচ্য হচ্ছে, যেই বিশ্বাস যত মানবতাবিরোধী, যত ভয়ঙ্কর, সেটা প্রশ্নের সম্মুখীন হলেতত বেশি বিব্রতবোধ করে। সেটা নিয়ে প্রশ্ন করতে, তা যাচাই করে দেখতে নিরুৎসাহিত করে। নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।

আমাদের রাজনীতি, অর্থনীতি এখনও বিশ্বাসনির্ভর। আমরা নষ্ট রাজনীতিবিদদের এখনও বিশ্বাস করি, তাদের মেকি কান্না আর তসবি হিজাব দেখে আমাদের যুক্তিবুদ্ধি লোপ পায়। আমাদের মাথা খাটিয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতাই তৈরি হতে দেয়া হয় নি, বিশ্বাস করতে শেখানো হয়েছে। আমরা তাদের অতীত কর্মকান্ড যুক্তি দিয়ে বিচার বিশ্লেষণ করি না, আমাদের যুক্তিবোধ দলীয় আদর্শ আর নানান প্রপাগান্ডায় পথ হারায়। আমরা কখনও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা লালন করি, কখনও আবার ইসলামী চেতনা আমাদের দখল করে। কিন্তু এদুটোকেই যৌক্তিক উপায়ে গ্রহণ বা বর্জন করতে আমরা শিখিনি।
আমাদের অর্থনীতিও বিশ্বাস নির্ভর। আমরা এই শতাব্দীতেও সুদকে হারাম মনে করি! আবার আমরাই ভিটেমাটি বিক্রি করে শেয়ার মার্কেটে টাকা খাটিয়ে নামাজে বসে লাভের আশায় প্রার্থনা করি। ডেসটিনির মত চকচকে চামারদের হাতে সবকিছু তুলে দেই। এখনও আমরা দেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠী নারীদেরকে আমরা দাসী ভাবি। ভাবি, তাদের যেটুকু অধিকার রয়েছে সেটুকুই অনেক বেশি। আর প্রয়োজন নেই। তাদের বেঁচে থাকতে দিয়ে ভাবি অনেক অধিকার দিয়ে ফেললাম। খেয়ে পরে প্রাচীন ক্রীতদাসীদের মত বেঁচে থাকতে দিয়ে আমরা প্রতিযোগীতায় নামি- প্রতিযোগীতার বিষয়, “আমরাই নারীকে দিয়েছি সর্বোচ্চ অধিকার এবং সুমহান মর্যাদা!”

এরপরে আমরা প্রতিযোগীটায় নামি। আমার বিশ্বাসের সুপারম্যান বেশি শক্তিশালী নাকি পাশের বাসার লোকটির বিশ্বাসের স্পাইডারম্যান বেশি শক্তিশালী। কার কাল্পনিক ঈশ্বর বেশি দয়ালু তা প্রমাণ করতে আমরা একে অন্যের গলায় ছুরি চালিয়ে দিই। একবার ভাবিও না যে, দয়ালু ঈশ্বরের প্রমাণ অন্যের গলায় ছুরি চালিয়ে হয় না। শান্তিপূর্ণ ধর্মের দাবী অন্য ধর্মের মানুষের বাড়িতে আগুণ দিয়ে হয় না।

এইসব বিশ্বাসমনস্কতার ফলাফল, জ্ঞান ও যুক্তিহীনতার কুফল, প্রথাগত জীবন আর সামাজসংস্কারের অভাব। আমাদের শিক্ষিত সমাজও মোটাদাগে প্রতিক্রিয়াশীল। তারা জেনেটিক ইন্জিনিয়ারিং পড়ে সৃষ্টিতত্বকে বিশ্বাস করে, বিজ্ঞান পড়ে নুহের নৌকায় শান্তি খুঁজে পায়। প্রযুক্তি এবং বিজ্ঞানের ফলাফল প্রতিদিন ব্যবহার করেও আমাদের জ্ঞান আর আমাদের বিশ্বাসের এই ফারাকটা আমাদের বিজ্ঞানবিমুখ করে তোলে। বিজ্ঞানকে আমরা পাশ্চাত্যের ষড়যন্ত্র ভাবতে শুরু করি, এবং আমাদের বিশ্বাসের আবর্জনা দুর্গন্ধে ভরা হলেও আমরা ভাবি, এটা আমাদের নিজস্ব। পশ্চিমা বিশ্বকে প্রতিদিন গালাগালি করে, পশ্চিমা বিশ্বের ওপর আল্লাহর গজব নাজিল হোক বলে প্রতিদিন দোয়া করে শেষমেশ সেই আমেরিকান ডিভির লটারিই আমাদের ধরতে হয়। বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তি ব্যবহার করে তাই আমরা প্রতিদিনই ইহুদী নাসারাদের গালাগালি করি। তাদের সাম্রাজ্যবাদই বলি। অথচ আমাদের এই সকল বিশ্বাস মধ্যপ্রাচ্যের সাম্রাজ্যবাদের অংশ।

একজন প্রতিক্রিয়াশীল কুসংস্কারাচ্ছন্ন রাজনৈতিক কর্মী কখনই মানবসেবায় কাজে আসবে না। উগ্র জাতীয়তাবাদ আর গোয়েবলসীয় প্রপাগান্ডা দিয়ে ফায়দা লোটার দিন শেষ, এগুলো শুধু আবর্জনাই উত্‍পাদন করে। এই বিশ্ব তথ্য প্রযুক্তির, এই বিশ্ব বাক-স্বাধীনতার আর জ্ঞানের। সকলের সমান অধিকারের।

সকলকে নাস্তিক হতে হবে না, সকলকে রাজনীতি করতে হবে না। তবে যুক্তিমনস্কতা এবং রাজনৈতিক সচেতনতা থাকতেই হবে। সমাজের মূলে সেগুলো প্রোথিত থাকতে হবে। এগুলো ছাড়া বারবার খালি প্রতারিতই হতে হবে। মূর্খ মানুষেরা জানে না, তারা প্রতিদিনই প্রতারিত হচ্ছে। তারা আশায় আছে, পরকালে তারা এই দুঃখকষ্টের জীবন শেষে স্বর্গে যাবে। সেই কারণে তারা সব দেখেশুনেও সব মেনে নিচ্ছে। কারও কিছু যাচ্ছে আসছে না।

এখন পৃথিবী এগিয়ে যাচ্ছে তীব্র গতিতে। মানুষ মহাবিশ্বের সৃষ্টিরহস্য ক্রমশ বুঝতে চেষ্টা করছে। এখন আর ওয়াজ মাহফিলে এক একটা ইহুদী নিধনে কয়টা হুর আর ঢিলা কুলুকের ছহি উপায় নিয়ে বিস্তর গবেষনার প্রয়োজন নেই। সোমবার পশ্চিমদিকে মুখ করে স্ত্রীগমনে পুত্রসন্তান লাভ হবে কিনা, তা নিয়ে মূর্খ আলোচনার উপযোগ নাই। বিজ্ঞান কোথায় চলে যাচ্ছে, কৃত্রিম জীবন পর্যন্ত এসে গেছে, আর আমরা এখনও আরবী আবর্জনা হাদিস কোরানের সাথে বিজ্ঞানের কি কি মিলেছে না তা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছি। টিভিতে রোজ দেখি, ইসলামী ছাগলদের ডেকে এনে ফোনে জিজ্ঞেস করা হয়, “হুজুর, আমার বিবির পরদা করে না, আবার কাজ করে, উহাকে কিরুপে তালাক দিয়া নতুন বিবি আনিবো?”

আমরা ভাবছি পুরনো বইপত্র কেতাবে সব জ্ঞান দেয়া আছে, ওটা পড়তে পারলেই জ্ঞানী! কিন্তু সত্য হচ্ছে, বর্তমান সময়ে সেগুলো আবর্জনা ছারা আর কিছু নয়। ওগুলো প্রাচীন সাহিত্য হিসেবে পড়া যায়, কিন্তু সারাজীবন, আধুনিক সভ্যতার সর্বত্র ওটাই মাথায় ঘুরপাক খেলে আর কিছুই বেরুবে না। একবইয়ের পাঠক সর্বদাই ভয়ঙ্কর প্রতিক্রিয়াশীল।

আমরা প্রয়োজন একটি জ্ঞানভিত্তিক সমাজ। প্রতিটি মোড়ে ব্যাঙের ছাতার মত গজানো মসজিদ মন্দিরগুলো ভেঙ্গে সেখানে গড়তে চাই লাইব্রেরী, গবেষনাগার আর তর্কবিতর্কের আড্ডা। আমরা সমূলে উত্‍খাত করতে চাই ধর্মব্যাবসা, কুসংস্কার আর প্রতিক্রিয়াশীলতা। মোড়ে মোড়ে পীরের ব্যবসা আর মাজার ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিয়ে সেখানে গড়ে তুলতে হবে বিদ্যালয়। আমাদের শিশুরা হোক গণিত আর পদার্থবিজ্ঞানে পারদর্শি, আমাদের তরুণরা হোক দর্শন আর শিল্পকলায় শ্রেষ্ট, আমাদের মধ্যবয়সীরা সারাজীবন দুর্নীতি করে শেষ বয়সে হজ্জ্বে না গিয়ে সারাজীবন সৎ থেকে শেষ বয়সে নীতিশিক্ষা দেক, আমাদের বৃদ্ধরা দলবেধে মসজিদে উপুর না হয়ে স্কুলে ছেলেমেয়েদের পড়াক, তাদের সাথে তর্কবিতর্কে অংশ নিক।

সমাজের আনাচে কানাচে ঘুঁঁনে ধরা প্রথা আর সংস্কার, সংস্কৃতির নামে আহাম্মকি, নৈতিকতার নামে দুর্নীতি। এই সবের মূলে আঘাত করতে হবে। এই সবের মূলে আঘাত না করলে একসময় আমরাও মধ্যযুগীয় বর্বর মধ্যপ্রাচ্যে পরিণত হবো।

খুব পরিষ্কারভাবে আলাদা করে বুঝতে হবে যে, ধর্মের সমালোচনা আর ধার্মিকদের ঘৃণা করা এক নয়।  ইসলাম এবং মুসলমানও এক নয়। ইসলামের সমালোচনা মানে মুসলমানের বিরুদ্ধতা নয়, কিংবা মুসলমানের সমালোচনা মানেই ইসলামের বিরুদ্ধতা নয়। বর্তমান বিশ্বে মুসলিম সম্প্রদায়ের দিকে তাকালে বুঝতে অসুবিধা হয় না, কোথাও কোন একটা গণ্ডগোল হয়েছে। কিছু একটা সমস্যা নিশ্চিতভাবেই আছে, নইলে বোকো হারাম, আল কায়দা, আইসিস, আমাদের দেশে বাঙলা ভাই, আনসারুল্লাহ বাঙলা টিম, হিজবুত তাহরির, শিবির, জেএমবি, ক’দিন পরে পরে নতুন নতুন নামে অসংখ্য সন্ত্রাসী মৌলবাদী গোষ্ঠী এভাবে মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে কেন? আইসিস বোকো হারাম এরা এমন কুত্তা পাগল হয়ে উঠেছে কেন? পাকিস্তানে ধরে ধরে বাচ্চা মেয়েদের স্কুলে বোমা মারছে কেন? মানুষ জবাই করছে কেন? সমস্যা কী মুসলমানের, নাকি ইসলামের?

মুসলমানদের জ্ঞান বিজ্ঞান, শিক্ষাদীক্ষার অবস্থা বর্তমান সময়ে শোচনীয় রকমের খারাপ। দারিদ্র, অশিক্ষা, কুশিক্ষা, ধর্মান্ধতা ইত্যাদির জাঁতাকলে মুসলমানরা নিষ্পেষিত দীর্ঘ সময় ধরেই। সৌদি আরবের ওয়াহাবীরা দীর্ঘসময় ধরে ক্রমাগত প্রচার চালিয়ে সাধারণ মুসলমানের মধ্যে এই ধারনাটি ঢুকিয়ে দিয়েছে যে, তারা মধ্যযুগের ইসলামী ঈমান আকিদা থেকে দূরে সরে গেছে বলেই তাদের এই দুরবস্থা! তাদের আবার আগের জীবনে ফিরে যেতে পারলেই সমাধান! তাদের কথা শুনলে মনে হয়, পশ্চিমা বিশ্ব মনে হয় পুরনো ইসলাম কায়েম করেই উন্নতি করছে!

আবার মুসলমানরা বিধর্মীদের জবাই করলে বলতে শোনা যায়, সেটা সহিহ ইসলাম নয়। অর্থাৎ ইসলাম আসলে ভাল, মুসলমানরা ইসলামকে ভুলভাবে ব্যবহার করছে বলেই যত বিপত্তি। তাহলে দায়ী কী মুসলমানরা? নাকি দায়ী ইসলাম?

অনলাইনের মুক্তমনা নাস্তিকরা ইসলামের সমালোচনা করেন। তাদের মতে, মুসলমানদের এই দুরবস্থার জন্য দায়ী তাদের মতাদর্শ, তাদের বিশ্বাস ব্যবস্থা, তাদের কোরান-হাদিস-শরীয়া আইন-সর্বোপরি ইসলাম। যারা এই মতাদর্শ লালন পালন করেন, তাদের এগুলো সংস্কারের সময় এসছে। নতুবা বর্জনের সময় এসেছে।

তাহলে ধর্মান্ধ মৌলবাদীদের বর্বরতার জন্য দায়ী আসলে কে? ইসলাম, নাকি মুসলমানরা? নাকি সব আসলে ইহুদী নাসারা নাস্তিকদের ষড়যন্ত্র? অপপ্রচার? আইসিস বোকো হারাম আল কায়দা তালেবান বলে আসলে কিছুই নেই? এখন চারটি বিষয়ের একটি সত্য হতে পারে।
১) ইসলাম এবং মুসলমান সবই ভাল, সবই আসলে মুসলমানদের বিরুদ্ধে পশ্চিমাদের অপপ্রচার। (ষড়যন্ত্রতত্ত্ব)
২) ইসলাম আসলে খুব ভাল কিছু, কিন্তু মুসলমানরা খারাপ, তাই মুসলমানদের এই দুর্দশা। (মডারেট মুসলমানের বক্তব্য)
৩) ইসলামের ভেতরেই আসলে গলদ, তাই যারা ইসলামকে অর্থাৎ কোরআন হাদিসকে আক্ষরিকভাবে পালন করে, তাদের জন্যেই মুসলমানদের এই দুর্দশা। তাই ইসলামকে হয় পাল্টাতে হবে, নতুবা বিলুপ্ত করতে হবে। (মুক্তমনা নাস্তিকদের বক্তব্য)
৪) ইসলাম এবং মুসলমান উভয়ই খারাপ, সে কারণেই এই দুরবস্থা। ওদের বোমা মেরে উড়িয়ে দেয়া দরকার। (ডোনাল্ড ট্রাম্পের বক্তব্য)

ইসলাম কোন জাতি নয়, মুসলমানও কোন জাতি নয়-একটি সম্প্রদায়। ইসলাম হচ্ছে একটি মতাদর্শ। ঠিক যেমনটা পুঁজিবাদ, সাম্যবাদ, নাৎসিবাদ, গণতন্ত্র, ফ্যাসিবাদ, সেরকম। পুঁজিবাদী বিশ্বে সকলেই যে খারাপ এবং নোংরা তা নয়। তাদের মধ্যে ভাল মানুষ আছেন, খারাপ মানুষও আছেন। সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোতে বসবাসকারী, সুখে শান্তিতে কারো কোন ক্ষতি না করে জীবনযাপন করা মানুষেরা যে সকলেই খারাপ, অন্য মানুষের জন্য ক্ষতিকর তাও নয়। ক্ষতিকর হতে পারে তাদের মতাদর্শ, যা অন্যের ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অন্যের অধিকার ক্ষুণ্ণ করে। পুঁজিবাদ সাম্যবাদ নাৎসিবাদ গণতন্ত্র কিংবা ফ্যাসিবাদের যেরকম সমালোচনা হতে পারে, ইসলামেরও সেরকম সমালোচনা হবে। তাতে আঁতকে উঠে ইসলাম বিদ্বেষী বলে কান্নাকাটির কিছু নেই। সকল মতাদর্শই সমালোচনার উপযুক্ত। কিছুই সমালোচনার উর্ধ্বে নয়। আর যারা সেই মতাদর্শ পালন করে, এবং তা রক্ষণাবেক্ষণ করে, তাদের সমালোচনাও জরুরী।

বরঞ্চ ইসলামের সমালোচনা জরুরী মুসলমানদের স্বার্থেই। কারণ ধর্মের প্রধান ভুক্তভোগী ধার্মিকরাই। আজ যেই ছেলেটা সিরিয়ায় জিহাদে গেছে কাফের কতল করে বেহেশতে যাবার উদ্দেশ্যে, ইসলামের প্রথম শিকার তো সেই।  যারা শিক্ষিত, যারা ধর্মীয় কুসংস্কারমুক্ত, তারা ধর্মকে ব্যবহার করেই অশিক্ষিত মূর্খ মানুষদের নিয়ন্ত্রণ করে। তাই মুসলমানদের স্বার্থেই ইসলামের সমালোচনা করতে হবে। কারণ অধিকাংশ মুসলমানই জঙ্গি মুসলমান নয়। সেই সাথে এটাও সত্য, ভারতে মসজিদ ভেঙে দেয়া হয়েছে শুনলে নিপাট ভদ্রলোক ভালমানুষ মুসলমানটিও ঈমানী জোশে পাশের বাড়ির হিন্দু মেয়েটিকে ধর্ষণ করে আসতে পারে। ধর্ম মানুষকে দিয়ে এরকম কাজ করিয়ে নিতে পারে, ধর্মবোধ মানুষকে এরকম ভয়ঙ্কর করে তুলতে পারে, তা আমরা নিজেরাই দেখেছি বহুবার।

একটা কথা প্রায়ই আজকাল শুনতে পাচ্ছি। পৃথিবীর একশ ষাট কোটি মুসলমানের মধ্যে শতকরা ৮০ জনই তো শান্তিপ্রিয় মুসলমান। তারা কারো সাতেও নেই, পাঁচেও নেই। তারা বোমা মারে না, বিধর্মীদের কতল করে না, বিধর্মীদের স্ত্রীদের মালে গনিমত বানিয়ে ভোগ করে না, তাদের অসম্মান করে জিজিয়া কর আরোপ করে না, তাদের ঘৃণা করে না, নাস্তিকদের জবাই করে না, নারী পুরুষের ভালবাসার সম্পর্কের অভিযোগে পাথর ছোড়ে না, সমকামীদের প্রকাশ্যে হত্যা করে না, চুরি করলে হাত কেটে দেয় না, ধর্ষিতাকেই উল্টা ধরে দোররা মারে না। তারা শিক্ষা চায়, বাসস্থান চায়, চিকিৎসা চায়, অন্ন চায় বস্ত্র চায়। ভালভাবে পরিবার পরিজন নিয়ে সুখে শান্তিতে ইহলৌকিক জীবন যাপন করতে চায়। তাহলে আল কায়েদা তালেবান বোকো হারাম আইসিস জামাত ইসলাম শিবিরের জন্য কি সকল মুসলমানদের দোষ দেয়া যায়? তারা তো কোন অপরাধ করেন নি। মুসলিম পরিবারে জন্ম নেয়া নিশ্চয়ই কোন অন্যায় হতে পারে না। তাহলে জঙ্গি মুসলমানদের পাপের দায়ভার তাদের কেন নিতে হবে?

অবশ্যই না। একজন মানুষ মুসলিম পরিবারে জন্মেছে তা তার অপরাধ নয়। এবং ব্যক্তিগত বিশ্বাস সে অন্য কারোর ক্ষতি না করে পালন করবে, এতেও আপত্তির কিছু নেই। কিন্তু কিছু মুসলমান এরকম ভয়ঙ্কর উগ্র জিহাদি আর বেশিরভাগ মুসলমান শান্তিপ্রিয় সাধারণ মানুষ কেন?

কারণ হচ্ছে, বেশিরভাগ মুসলমানই আসলে জানে না, তাদের ধর্মগ্রন্থে কী লেখা আছে। আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি, ব্লগে ফেইসবুকে যারা ইসলাম সম্পর্কে আলোচনা করতে আসে, ইসলামের পক্ষে সাফাই গাইতে আসে, ঈমানী জোশে আমার স্ট্যাটাসে ছবিতে গালাগালি জিহাদ চালায়, তাদের ৯৯ শতাংশ কোনদিন অর্থ বুঝে একটা সুরাও পড়ে দেখে নি। তাদের কোন কোন ক্ষেত্রে এক একটি সুরার নাম বললেও তারা বলতে পারে না, এমন কোন সুরা কোরানে আছে কী নেই। অধিকাংশ মুসলমান মুসলিম পরিবারে জন্ম নেয়, এবং কোন সফটওয়্যার লাইসেন্স এগ্রিমেন্টের মতই কিছু না পড়েই “আই একসেপ্ট” এ ক্লিক করে। তারা যেহেতু জন্মসূত্রে ধর্মটি পেয়েছে এবং দ্বিধাহীনভাবে যা কিছুই কোরানে লেখা থাকুক না কেন, তা না জেনেই তারা তা সত্য বলে মানে। তারা জানে না ওখানে কী লেখা, তবে যাই লেখা থাকুক তা সত্য প্রমাণের জন্য গালাগালি তারা চালিয়ে যাবে। পরবর্তীতে কোরান হাদিসের মধ্যে আপত্তিকর বিষয়াদি আবিষ্কার করলে নানাভাবে অনুবাদ ভুল, কন্টেক্সট ভুল, পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনা করতে হবে, ঐটা রূপকার্থে বলা হয়েছে ইত্যাদি বলে বলে নিজেকেই নিজে এক ধরণের বুঝ দিতে থাকে। বাঙালি ধার্মিকেরা ফেসবুকে এসে একটা বড় ধরণের ধাক্কা খায়। ধর্ম নিয়ে এত ক্রিটিক্যাল আলোচনা সম্ভবত তারা আগে কখনো কল্পনাও করতে পারতো না। যখন কোনকিছুতেই আর পেরে ওঠা যায় না, তখন দোজখের ভয় দেখানো, গালাগালি আর কতলের হুমকি দেয়া ছাড়া তাদের আর কোন পথ থাকে না। তাদের জন্য সমবেদনা ছাড়া আর কিছু দেয়ার নেই।

তাই বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, কেন ৮০ ভাগ মুসলমানই আসলে শান্তিপ্রিয় সাধারণ মানুষ। কারণ তারা জানেই না তাদের পবিত্র কেতাবে কী লেখা আছে। তাদের অনেকেই শতভাগ মুসলমান হবার পরেও কোনদিন কোরানের একটা সুরাও অর্থসহ পড়ে দেখে নি। যদিও তারা এটা বিশ্বাস করে যে, কোনদিন একটা প্যারাও পড়ে না দেখা সেই পবিত্র কেতাব অক্ষরে অক্ষরে সত্য। আর যেই ২০ শতাংশ কোরান হাদিস বুঝে পড়ে, ইসলামের ইতিহাস এবং নবীর জীবন ভালভাবে জানে, তারা হয় জিহাদিতে পরিণত হয়, ধর্মান্ধ মৌলবাদীতে পরিণত হয়, নতুবা ধর্মত্যাগী নাস্তিক হয়ে যায়। সে আর শান্তিপূর্ণ সাধারণ মুসলমান থাকে না। দুঃখজনক হলেও এটাই সত্য।

আসিফ মহিউদ্দীন

আসিফ মহিউদ্দীন সম্পাদক সংশয় - চিন্তার মুক্তির আন্দোলন [email protected]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *