বনু কুরাইজার গণহত্যা

গণহত্যা 49

সূচিপত্র

ভূমিকা

মানব ইতিহাসে সবচাইতে ভয়াবহ অভিশাপ হচ্ছে যুদ্ধ, গণহত্যা, ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা এবং বিধর্মী বা অন্য জাতির মানুষকে দাসে পরিণত করে তাদের স্বাধীনতা কেড়ে নেয়ার ভয়াবহ অমানবিক প্রথা। যুগে যুগে কোটি কোটি মানুষকে এই নির্মম গণহত্যার শিকার হতে হয়েছে। ধর্ষিত হওয়া কিংবা কারো দাস হিসেবে বেঁচে থাকা যে কী ভয়াবহ ব্যাপার, তা হয়তো আমরা আধুনিক সভ্য সমাজে বসবাস করে অনেকেই অনুধাবন করতে পারবো না। কিন্তু নির্মম সত্য হচ্ছে, মানব সভ্যতার ইতিহাস তৈরি হয়েছে এগুলোর ওপর ভিত্তি করেই। মন্দের ভাল ব্যাপার হচ্ছে, আমরা সেগুলো অনেকটাই পেছনে ফেলে এসেছি। এখন আমরা আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য শান্তিপূর্ণ একটি পৃথিবী কামনা করি। তাই আধুনিক মানবিক মানুষ মাত্রই যুদ্ধ বিরোধী, গণহত্যা কিংবা যুদ্ধবন্দীদের দাস বানানো, ধর্ষণ কিংবা যেকোন ধরণের যুদ্ধাপরাধের বিরোধী। আমাদের এখন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সনদ রয়েছে, জেনেভা কনভেনশন এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক চুক্তি দ্বারা আমরা যুদ্ধের সময় যেন যুদ্ধরত পক্ষগুলো বিপক্ষের মানুষের সাথে মানবিক আচরণ করে, তার জন্য চাপ সৃষ্টি করতে পারি। সবসময় যে তা সম্ভব হয় তা নয়, এখনো অনেক দেশেই যুদ্ধে পরাজিত সৈন্য এবং জনগণকে নির্যাতন করা হয়। কিন্তু আমরা সেগুলো বন্ধ করার জন্য এবং নির্যাতনকারী গোষ্ঠীগুলোকে বিচারের সম্মুখীন করার জন্য আন্দোলন করতে পারি। যে কারণে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের যুদ্ধাপরাধীদের আমরা বিচার করতে পেরেছি, বাঙলাদেশে পাক আর্মি এবং রাজাকার আলবদরদেরও আমরা বিচারের সম্মুখীন করতে পেরেছি। তারপরেও অনেক সময় আমরা অপরাধীদের বিচারের সম্মুখীন করতে পারি নি, কিন্তু সেটি কোন অবস্থাতেই অন্য কোন অপরাধের জাস্টিফিকেশন হতে পারে না। আমরা এভাবে বলতে পারি না যে, অমুক দেশে যুদ্ধবন্দীদের রেইপ করা হয়েছে, গণহত্যা চালানো হয়েছে, তাই আরেকটি যুদ্ধে যুদ্ধবন্দীদের রেইপ করা বা গণহত্যা চালানো জাস্টিফায়েড!

সেই যুদ্ধ যদি ধর্মীয় কারণে হয়, তাহলে সেটির ভয়াবহতা আরো বৃদ্ধি পায়। কারণ স্বাভাবিকভাবেই কাউকে হত্যা করলে মানুষের ভেতরে অপরাধবোধের সৃষ্টি হয়। কিন্তু ধর্মীয় কারণে মানুষ হত্যা করলে কারো মনে সেই অনুশোচনাটি সৃষ্টি হয় না, বরঞ্চ সেই কাজের জন্য সে গর্বিত হয়। বিধর্মীর গলা কাটলে আমার ঈশ্বর খুশি হবে, আমার ঈশ্বর আমার কাছে চাইছে যে, আমি যেন বিধর্মীকে জবাই করি, এর বিনিময়ে আমাকে স্বর্গ দেবে, স্বর্গে উঁচু স্তন্যের হুর দেবে, গেলমান আর মদ দেবে, এগুলো মানুষকে বিধর্মী হত্যার অনুপ্রেরণা দেয়, তাদের প্রতি ঘৃণা সৃষ্টি করে এবং মানুষে মানুষে ভেদাভেদ বৃদ্ধি করে। ধর্মীয় অনুপ্রেরণা মানুষ হত্যার নৈতিক ভিত্তি তৈরি করলে মানুষকে আর সে কাজটি করতে বাধা দেয়া যায় না। সে মনে করে, এই কাজটিই ভাল, যেহেতু এটিই ঈশ্বরের নির্দেশ।

বাঙলাদেশের মুক্তমনা নাস্তিক, সংশয়বাদী, অজ্ঞেয়বাদীদের একটি অভিযোগ বরাবরই শোনা যায়, সেটি হচ্ছে, ইহুদী গোত্রগুলোর ওপর নবী মুহাম্মদের বেশ কয়েকটি ভয়াবহ গণহত্যা, এথনিক ক্লিনজিং, আত্মসমর্পন করা গোত্রগুলোর অপ্রাপ্তবয়ষ্ক শিশুদের ক্রিতদাসে পরিণত করা, তাদের ক্রিতদাস হিসেবে বাজারে বিক্রি করা, নারীদের গনিমতের মাল হিসেবে তাদের ধর্ষণ করা, যৌনদাসীতে পরিণত করা, তাদের নিজ ভূমি থেকে উচ্ছেদ করা, জমিজমা দখল করা ইত্যাদি। নবী মুহাম্মদের মদিনার প্রাথমিক সময়ে ইহুদিদের সাথে সুসম্পর্ক থাকলেও পরবর্তীতে নবী মুহাম্মদের সাথে তাদের সম্পর্কের অবনতি ঘটে। নবী মুহাম্মদ মদিনায় হিজরতের সময় বেশ আশা নিয়েই ছিলেন যে, ইহুদিরা তার নতুন ধর্মকে গ্রহণ করবে এবং দলে দলে ইসলাম গ্রহণ করবে। ইহুদিদের কাছ থেকে আশানরুপ সাড়া না পাওয়ায় তিনি ইহুদিদের প্রতি ক্ষুব্ধ হওয়া শুরু করেন, যার ফলশ্রুতিতে এই সমস্যাগুলোর উদ্ভব ঘটে। এইসব কারণে বর্তমান সময় পর্যন্ত ইসলামের ভেতর ইহুদিদের প্রতি বিদ্বেষের একটি মনোভাব পরিলক্ষিত হয়। কিছু হলেই বলতে শোনা যায়, এগুলো ইহুদিদের ষড়যন্ত্র। বর্তমান সময়ের মুসলিম জনগোষ্ঠী সবকিছুতেই ইহুদিদের ষড়যন্ত্র খুঁজে পায়, যা তাদের এক মানসিক বিকারে পরিণত হয়েছে। নিজেদের অক্ষমতা ঢাকতে কিছু হলেই ইহুদিদের ওপর দায় চাপিয়ে দেয়ার এই মানসিকতা অত্যন্ত লজ্জাজনক।

তবে সেই সাথে এটি স্বীকার করাও জরুরি যে, ইসলামি খিলাফতের সময় ইহুদিরা মুসলিমদের সাথে মুসলিমদের শাসনে অপেক্ষাকৃত স্বাধীন এবং মর্যাদাপূর্ণ জীবনই পেয়েছে, যা খ্রিষ্টান শাসনের সময় ইহুদিরা পায় নি। খ্রিষ্টানদের দ্বারা ইহুদিরা যুগে যুগে আরো অনেক বেশি নির্যাতনের শিকার হয়েছে, সেই সবের তুলনায় ইসলামি শাসনামল ইহুদিদের জন্য অপেক্ষাকৃত ভাল ছিল। সেই নিয়ে আরেকদিন আলোচনা করা যাবে। আজকের আলোচনা শুধুমাত্র নবী মুহাম্মদের শাসনামল নিয়ে।

গণহত্যা ও জাতিগত নির্মূল

যুদ্ধ

যুদ্ধ কাকে বলে? যুদ্ধ হচ্ছে রাষ্ট্রীয় বা অরাষ্ট্রীয় পক্ষগুলোর মধ্যে সুসংগঠিত এবং কখনও কখনও দীর্ঘস্থায়ী সশস্ত্র সংঘর্ষ। কোন পক্ষ একতরফাভাবে সশস্ত্র আক্রমণাত্মক কার্যকলাপ চালিয়ে গেলে এবং তার প্রত্যুত্তরে অপর পক্ষ কোন পদক্ষেপ না নিলে তাকে যুদ্ধ বলা যায় না। সেই হিসেবে, বনু কুরাইজা গোত্রের ওপর নবী মুহাম্মদের সেনাবাহিনীর অবরোধ এবং আত্মসমর্পনে বাধ্য করা সরাসরি যুদ্ধ নামে সংজ্ঞায়িত করা যায় না। বরঞ্চ, আক্রমন হিসেবেই সংজ্ঞায়িত করা যায়।

জেনোসাইড বা গণহত্যা

গণহত্যা বলতে নির্দিষ্ট একটি ভূখণ্ডে বা ভৌগোলিক অংশে কোন জাতি, বর্ণ, নাগরিকত্ব বা ধর্মীয় বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করে একযোগে বা অপেক্ষাকৃত অল্প সময়ে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ হত্যা করাকে বোঝায়। এফবিআই এর মতে গণহত্যা হল সেই হত্যাকান্ড যখন কোন একটা ঘটনায় চার বা তার অধিক সংখ্যক মানুষ মারা যায় এবং হত্যাকান্ডের মাঝে কোন বিরতি থাকে না। গণহত্যা সাধারণত একটি নির্দিষ্ট স্থানে ঘটে, যেখানে এক বা একাধিক মানুষ অধিকাংশ সময় উপরে বর্ণিত কারণ বশত অন্যদের মেরে ফেলে।

Genocide is intentional action to destroy a people (usually defined as an ethnic, national, racial, or religious group) in whole or in part.

The United Nations Genocide Convention, which was established in 1948, defines genocide as “acts committed with intent to destroy, in whole or in part, a national, ethnic, racial or religious group, as such” including the killing of its members, causing serious bodily or mental harm to members of the group, deliberately imposing living conditions that seek to “bring about its physical destruction in whole or in part”, preventing births, or forcibly transferring children out of the group to another group. [1] [2] [3]

কোন কোন ক্ষেত্রে গণহত্যাটি হয় সেনাপ্রধানের নির্দেশে, কোন কোন ক্ষেত্রে বিচারের নামে প্রহসন করে কোন গোত্র বা জনগোষ্ঠীর সবাইকে ঢালাওভাবে কোন শাস্তি দিয়ে হত্যা করা হয়, কোন কোন ক্ষেত্রে আবার কোন ধরণের দোষারোপ করে তাদের গণহারে মেরে ফেলা হয়। আবার কখনো কখনো জবরদস্তিমূলক ধর্মান্তকরণের চেষ্টা করা হয়, সেটি করা না গেলে তাদের হত্যা করে ফেলা হয়। এগুলো সবই বিভিন্ন গণহত্যার উদাহরণ।

জাতিগত নিধন বা ‘এথনিক ক্লিনজিং’

ধর্মীয় বা জাতিগত কারণে কোনো অঞ্চলে একটি ধর্মীয় গোষ্ঠী বা জাতি অন্য একটি ধর্মীয় গোষ্ঠী বা জাতিকে অযাচিত মনে করতে পারে। এক ধর্ম বা জাতির মানুষ মনে করতে পারে, এই ভূমির ওপর শুধুমাত্র এবং কেবলমাত্র তাদেরই অধিকার (প্রায়শই সেই অধিকার ইশ্বরের দেয়া বলে দাবী করা হয়ে থাকে) , এবং বহু বছর ধরে বসবাস করা অন্যান্য ধর্ম বা জাতিগোষ্ঠীকে তারা উচ্ছেদ করতে পারে কিংবা তাদের ওপর নিধনযজ্ঞ চালাতে পারে। ধর্ম বা জাতিগত পার্থক্যের জন্য একটি জনগোষ্ঠী বা গোত্রকে সম্পূর্ণরূপে উচ্ছেদ করাকে জাতিগত নিধন বা ‘এথনিক ক্লিনজিং’ বলা হয়।

Ethnic cleansing is the systematic forced removal of ethnic, racial and/or religious groups from a given territory by a more powerful ethnic group, often with the intent of making it ethnically homogeneous. [4] The forces which may be applied may be various forms of forced migration (deportation, population transfer), intimidation, as well as genocide and genocidal rape.

ধর্মের ভিত্তিতে সংঘটিত একটি বিশেষ ধর্মীয় সম্প্রদায়ের ওপর জাতিগত নিধন মানবতার বিরুদ্ধে সবচেয়ে জঘন্য অপরাধগুলোর একটি। এটি একটি নির্দিষ্ট অঞ্চল বা দেশ থেকে একটি সম্পূর্ণ জাতি বা ধর্মীয় গোষ্ঠীকে অপসারণ বা নির্মূল করার একটি ইচ্ছাকৃত এবং পদ্ধতিগত প্রচেষ্টা। এই ভয়ঙ্করতম অপরাধ শুধুমাত্র মৌলিক মানবাধিকারের লঙ্ঘনই নয়, এটি সভ্যতার মৌলিক নীতি ও মানবিক মর্যাদার বিরুদ্ধেও একটি গুরুতর অপরাধও বটে।

ঐতিহাসিকভাবে বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের ওপরই জাতিগত নিধন চালানো হয়েছে। এই কাজগুলি সাধারণত ধর্মীয় মৌলবাদী বা চরমপন্থী গোষ্ঠী দ্বারা সংঘটিত হয়, যারা তাদের লক্ষ্য অর্জনের জন্য সহিংসতা, ত্রাস এবং ভয় ব্যবহার করে। জাতিগত নিধন চালাবার সময় অপরাধী সম্প্রদায় প্রায়শই দাবি করে যে, তারা আত্মরক্ষার স্বার্থে এই অপরাধ করছে কিংবা তাদের ধর্ম বা জাতিগত পরিচয় রক্ষা করছে, নিজেদের অন্যায়কে ন্যায্যতা দেয়ার উদ্দেশ্যেই তারা এগুলো বলে থাকে। একটু পর্যালোচনা করলেই দেখা যায় যে, এই ধরনের দাবিগুলো ভিত্তিহীন এবং শুধুমাত্র তাদের অপরাধমূলক কার্যকলাপকে ন্যায্যতা প্রদানের উদ্দেশ্যেই একটি অজুহাত হিসাবে তারা এইধরণের আত্মরক্ষার দাবিকে ব্যবহার করে, যা আদৌ আত্মরক্ষামূলক নয়।

ধর্মের ভিত্তিতে জাতিগত নিধনের শিকার হওয়া, নির্যাতন নিপীড়নের শিকার হওয়া শুধুমাত্র আক্রান্ত জনগোষ্ঠীকেই নয়, এতে সামগ্রিকভাবে সমাজের উপর বিধ্বংসী প্রভাব পড়ে। এটি বেঁচে থাকা মানুষদের জন্য শারীরিক এবং মানসিক সমস্যার কারণ হয়। যারা প্রায়শই তাদের বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে যেতে, তাদের ভিটামাটি বাড়িঘর বিষয় সম্পত্তি রেখে যেতে এবং তাদের বহুদিন ধরে চলে আসা জীবনযাত্রা ত্যাগ করতে বাধ্য হয়।

এটি সমাজের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী বিভাজনও তৈরি করে, কারণ সম্প্রদায়গুলির মধ্যে বিভাজন এবং নির্যাতন প্রায়শই স্থায়ী হয় এবং সমাজের মানুষেরা একে অপরের প্রতি অবিশ্বাসী হয়ে ওঠে। অধিকন্তু, এটি ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলের সামাজিক কাঠামোকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, কারণ এটি এলাকার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং বৈচিত্র্যকে ধ্বংস করে।

ধর্মের ভিত্তিতে জাতিগত নিধন প্রতিরোধ করার দায়িত্ব আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের। জাতিসংঘ স্বীকার করেছে যে জাতিগত নির্মূল মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ এবং এটি আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে শাস্তিযোগ্য। তবে এ ধরনের নৃশংসতা প্রতিরোধে আন্তর্জাতিক আইনের কার্যকারিতা সত্যিকার অর্থে সীমিত। তাই জাতিগত নির্মূল প্রতিরোধ এবং মানবাধিকার ও মামুষের বৈচিত্র্যের প্রতি সম্মান বৃদ্ধির জন্য জাতিগুলোর একত্রে কাজ করা অপরিহার্য।

ধর্মের ভিত্তিতে জাতিগত নির্মূল প্রতিরোধে প্রতিটি সভ্য সরকারকে সক্রিয় পদক্ষেপ নিতে হয়। এর মধ্যে রয়েছে সংঘাতের মূল কারণগুলিকে মোকাবেলা করার জন্য পদক্ষেপ নেওয়া, আন্তঃধর্ম এবং আন্তঃজাতিক সংলাপের প্রচার, এবং বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে সহনশীলতা ও বোঝাপড়ার প্রচার। যারা এই ধরনের অপরাধ করে তাদের জবাবদিহির ব্যবস্থা করা, এই ধরণের বিভাজনে যেসকল ধর্মগুরু বা ধর্মীয় মতাদর্শ বা ধর্মীয় গ্রন্থ উস্কানীমূলক বক্তব্য প্রচার করে তাদের বিচারের আওতায় আনা এবং তাদের কর্মের জন্য শাস্তি নিশ্চিত করাও এতে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।

ধর্মের ভিত্তিতে জাতিগত নির্মূল করা মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন এবং মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ। এটি সামগ্রিকভাবে ব্যক্তি এবং সমাজের জন্য বিধ্বংসী পরিণতি বহন করে। এই ধরনের নৃশংস ঘটনা যাতে না ঘটে তার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে অবশ্যই শক্তিশালী পদক্ষেপ নিতে হবে এবং সরকারগুলিকে অবশ্যই মানুষের ধর্মীয়, লৈঙ্গিক, বুদ্ধিবৃত্তিক, সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের প্রতি সম্মান বৃদ্ধি করতে এবং দুর্বল সম্প্রদায়ের সুরক্ষার জন্য সক্রিয় পদক্ষেপ নিতে হবে। শুধুমাত্র একসাথে কাজ করার মাধ্যমে আমরা এমন একটি পৃথিবী তৈরি করতে পারি যেখানে প্রতিটি ব্যক্তি ভয় ও নিপীড়ন থেকে মুক্ত, মানবিক মর্যাদার সাথে বসবাস করতে পারে।

যুদ্ধাপরাধ

এবারে যুদ্ধাপরাধ কাকে বলে তা আমাদের জেনে নিতে হবে। যুদ্ধাপরাধ হচ্ছে, কোন যুদ্ধ বা সামরিক সংঘাত চলাকালীন সময়ে কোন ব্যক্তি কর্তৃক বেসামরিক জনগণের বিরুদ্ধে সংগঠিত, সমর্থিত নির্দিষ্ট সংজ্ঞায়িত অপরাধমূলক কর্মকান্ডসমূহ। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন অনুসারে যুদ্ধকালিন সংঘাতের সময় বেসামরিক জনগণকে খুন, তাদের ওপর লুন্ঠন, ধর্ষণ, কারাগারে অন্তরীন ব্যক্তিকে হত্যা, এগুলো সবই যুদ্ধাপরাধের অন্তর্ভূক্ত। সেই সাথে হাসপাতাল, উপাসনালয় ইত্যাদিকে ধ্বংস করাকেও যুদ্ধাপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়।

যুদ্ধাপরাধকে জায়েজ করার জন্য যুদ্ধাপরাধীগণ প্রায়শই কিছু কৌশলী কথাবার্তা বলে থাকেন। যেমন, যুদ্ধাপরাধী গোষ্ঠী বেসামরিক শিশু কিশোরদের হত্যাকে জায়েজ করার জন্য বলে থাকে যে, শিশুকিশোরদের হত্যা না করলে বড় হয়ে তারা যুদ্ধ করতো, বা সন্ত্রাসী হতো। অথবা, নির্যাতিত গোষ্ঠীকে তারা সন্ত্রাসী বা জঙ্গি হিসেবে প্রমাণ করার চেষ্টা করে। অনেক সময় নারীদের হত্যা করার কারণ হিসেবে তারা বলে, এই নারীদের হত্যা না করলে এই নারীরা পরবর্তীতে জঙ্গি সন্তান জন্ম দিতো, এই ধরণের নানা নোংরা এবং বাজে কথা। সাধারণত যুদ্ধাপরাধকে জায়েজ করতে তারা এসব অত্যন্ত বর্বর এবং অমানবিক কথা বলে থাকে। কিছু উদাহরণ দেয়া যেতে পারে।

১) দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মান নাৎসি বাহিনী ইহুদীদের ওপর ধর্মীয় বিশ্বাসের কারণে নৃশংস নির্যাতন এবং গণহত্যা চালায়। ইতিহাসে এই গণহত্যাকে হলোকাস্ট বলে। ইহুদিদেরকে ঐসময় নানাভাবে দোষী সাব্যস্ত করা হয়, তাদের ওপর অনেক কিছুর দায় চাপানো হয়। এমনও বলা হয় যে, শিশু ইহুদিরা বড় হয়ে বিশ্বাসঘাতক হবে, তাই তাদের মেরে ফেলাই উত্তম।
২) ১ম বিশ্বযুদ্ধের সময় ১৯১৫ সালে রুশ ককেসাস সেনাবাহিনী পূর্ব আনাতোলিয়ায় অগ্রসর অব্যাহত রাখলে, তুরস্কের তৎকালীন উসমানীয় সরকার স্থানীয় জাতিগত আর্মেনীয়দের স্থানান্তর এবং উচ্ছেদ শুরু করে। ফলশ্রুতিতে প্রায় ১৫ লক্ষের মত আর্মেনীয় মৃত্যুবরণ করেছিল যা আর্মেনীয় গণহত্যা বলে পরিচিত। সে সময় তারা নারী, শিশু ও বয়স্ক লোকজনদেরকে পাঠিয়ে দেয় মরুভূমিতে, যেখানে তারা পরে মারা যান।
৩) ১৯৭১ এ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান, বর্তমানে বাংলাদেশে পাকিস্তান রাষ্ট্রের সাথে গাদ্দারির অভিযোগে অভিযুক্ত করে পাকিস্তান সেনাবাহিনী নৃশংস গণহত্যা চালায়। ধারণা করা হয়, এই গণহত্যায় প্রায় ৩০ লক্ষ বাঙালি হত্যা করা হয়েছিল।

উপরের যেই তিনটি উদাহরণ দিলাম, এই তিনটি ইতিহাসে অন্যতম বড় তিনটি গণহত্যা। এর সাথে আরও বড় গণহত্যার লিস্ট করা যেতে পারে, যেমন ইউরোপীয়দের আমেরিকা যাওয়ার পরে সেখানে কোটি কোটি নেটিভ আমেরিকানদের ওপর শত শত বছর ধরে চলা নৃশংস গণহত্যা এবং উচ্ছেদ। বা এখনকার মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর চলা নৃশংস গণহত্যা। লক্ষ্য করার বিষয় হচ্ছে, প্রতিটি গণহত্যার সময়ই গণহত্যাকারীরা নানাধরণের প্রেক্ষাপট, পরিপ্রেক্ষিত, ইতিহাস বিকৃতি এবং মিথ্যাচারের অভিযোগ আনে।

আশাকরি কাকে গণহত্যা বলে, কাকে যুদ্ধাপরাধ বলে, কাকে যুদ্ধ বলে সেই বিষয়গুলো এখন পরিষ্কার।

জেনেভা কনভেনশন কাকে বলে

১৮৬৪ খ্রিষ্টাব্দে সুইজারল্যান্ডের জেনেভা নগরীতে একটি সভা বসে। এরপর ১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ৪টি সভা হয়। বর্তমানে জেনেভা কনভেনশন বলতে বুঝায় এই চারটি সভায় গৃহীত সিদ্ধান্তসমূহের সম্মিলিত রূপ। অবাক বিষয় হচ্ছে, মহাবিশ্বের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী এবং অসীম দয়ালু আল্লাহ পাক এবং তার নবী দুইজন মিলেও, মানবিক মানুষের তৈরি করা এই জেনেভা কনভেনশনের খুব সাধারণ শর্তগুলো পূরণ করতে সক্ষম হন নি। তাহলে, আধুনিক মানবিক মানুষের মানবিক বোধ তো আল্লাহর চাইতেও বেশি বলেই মেনে নিতে হয়। অনেকেই বলতে পারেন, সেই সময়ে এরকমই পরিস্থিতি ছিল। কিন্তু আল্লাহ পাক তো সময় বা স্থান দ্বারা সীমাবদ্ধ নন। উনি সময় ও স্থান কালের উর্ধ্বে। হয়তো সেই সময়ের আরবের বর্বর মানুষ মানবিকতার কিছুই জানতো না, সেই কারণে তারা অনেক আজেবাজে কাজই করেছে। কিন্তু আল্লাহ পাকের তো সেই সীমাবদ্ধতা ছিল না। তিনিও কেন এগুলো তার নবীকে করতে বললেন? পাঠকগণ জেনেভা কনভেনশনের কিছু ধারা পড়ে দেখুন-

  • প্রথম জেনেভা কনভেনশন, ১৮৬৪ খ্রিষ্টাব্দ। যুদ্ধক্ষেত্রে আহত, যুদ্ধবন্দী, রোগাক্রান্ত সৈন্যদের জীবনের নিরাপত্তা এবং শারীরিক অবস্থার উন্নতির লক্ষ্যে প্রথম জেনেভা কনভেনশন অনুষ্ঠিত হয়।
  • দ্বিতীয় জেনেভা কনভেনশন, ১৯০৬ খ্রিষ্টাব্দ। সমুদ্রস্থ যুদ্ধক্ষেত্রে আহত, রোগাক্রান্ত সৈন্যদের জীবনের নিরাপত্তা এবং শারীরিক অবস্থার উন্নতির লক্ষ্যে ২য় জেনেভা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।
  • তৃতীয় জেনেভা কনভেনশন, ১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দ। যুদ্ধবন্দীদের চিকিৎসা ও নিরাপত্তা নিশ্চিতের লক্ষ্যে ৩য় জেনেভা কনভেনশন অনুষ্ঠিত হয়। চতুর্থ জেনেভা কনভেনশন ১৯৪৯ সালের ২১ এপ্রিল থেকে ১২ আগষ্ট।
  • চতুর্থ জেনেভা কনভেনশনে যুদ্ধকালীন বেসামরিক জনগণকে রক্ষার বিষয়টি গুরুত্ব পায়। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের অনুমোদনক্রমে ১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে জেনেভা কনভেনশন কার্যকর হয়। এ কনভেনশন পূর্ববর্তী তিনটি কনভেনশনের সংশোধিত রূপ।

জেনেভা কনভেনশনের উল্লেখযোগ্য দিকসমূহ হচ্ছে,

পার্ট-১ : জেনারেল প্রোভিশান্স

  1. প্রথম অংশে জেনেভা কনভেনশনের সামগ্রিক গঠনপ্রণালী তথা আওতা বর্ণনা করা হয়েছে।
  2. ধারা ২ এ ধারায় বলা হয়েছে, স্বাক্ষরভূক্ত দেশ সমূহ এ কনভেনশন দ্বারা বাধ্য হয়েছে যে যুদ্ধকালীন এবং অস্ত্র সংঘাতের সময় যেখানে যুদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে, এমনকি অন্য রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে অবস্থান কালীন সময় জেনেভা কনভেনশনকে মেনে নেবে।
  3. ধারা ৩ বলা হয়েছে, যখন কোনো সংঘর্ষ আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে স্বীকৃত হবে না, তখন প্রত্যেকটি দলের ন্যূনতম নিরাপত্তার অধিকার থাকবে। যেমন :- বেসামরিক ব্যক্তি বা যারা যোদ্ধা নয়, অস্ত্র পরিত্যাগকারী সৈন্য এবং ঐ সমস্ত সৈন্য যারা আহত বা রোগাক্রান্তের কারণে যুদ্ধ হতে বিরত।

এছাড়া অন্যান্য কারণে যুদ্ধবন্দীদের প্রতি মানবীয় আচরণ প্রদর্শন করতে হবে। এবং নিম্ন বর্নিত বিষয় সমূহ হতে মুক্ত রাখতে হবে-

  • (ক) ব্যক্তি এবং জীবনের প্রতি সহিংসতামূলক আচরণ: বিশেষ ধরনেরসহ সকল ধরনের হত্যা, শারীরিক নির্যাতন, অমানবিক চিকিৎসা পদ্ধতি এবং নির্যাতন।
  • (খ) জিম্মি করে রাখা
  • (গ) ব্যক্তি মর্যাদার ওপর অমানবিক আচরণ, অমানবিক চিকিৎসা প্রদান।
  • (ঘ) মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা এবং বিচার বহির্ভূত অবস্থায় শাস্তি কার্যকর করা।

পার্ট-২ : বিশেষ যুদ্ধকালীন অবস্থায় সাধারণ জনগণের নিরাপত্তা বা রক্ষণ।

ধারা ১৩ কনভেনশনের দ্বিতীয় অংশে যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে একটি দেশের সমগ্র জনগণের নিরাপত্তা সংরক্ষণের উপর গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে বিশেষ কোনো জাতি, বর্ণ, ধর্ম, গোষ্ঠীর প্রতি বৈষম্য প্রদর্শন করা যাবে না।

পার্ট-৩ : নিরাপত্তা প্রদানকৃত ব্যক্তিদের মর্যাদা ও চিকিৎসা

  1. ধারা ৩২ : নিরাপত্তা সহকারে আশ্রিত বা নিরাপত্তা প্রদানকৃত কোনো ব্যক্তি/ ব্যক্তিদেরকে শারীরিক নির্যাতন, গণহত্যা, হত্যা, শারীরিক ক্ষয়ক্ষতি প্রভৃতি ধরনের অমানবিক নির্যাতন থেকে মুক্ত রাখতে হবে। এই নিষেধাজ্ঞার আওতায় হত্যা, নির্যাতন, দৈহিক শাস্তি, শারীরিক অপব্যবহার, শারীরিক ক্ষয়ক্ষতি বা বিনাশ সাধনও করা যাবে না।
  2. ধারা ৩৩ : সমন্বিত শাস্তি ১৯৪৯ সালের জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী সমন্বিত শাস্তি একটি যুদ্ধাপরাধ। এ কনভেনশনে বলা হয়েছে- “কোন আশ্রিত ব্যক্তিকে সামষ্ঠিক অপরাধ এমনকি ব্যক্তিগত অপরাধের জন্যও শাস্তি প্রদান করা যাবে না। সমন্বিত শাস্তি, এবং এর মধ্যে ত্রাস সৃষ্টি ও সন্ত্রাসীমূলক আচরণ তাদের সাথে করা যাবেনা। লুটতরাজ নিষিদ্ধ এবং জীবন ও সম্পত্তির বিরুদ্ধে প্রতিশোধমূলক আচরণ করা যাবে না।”
  3. ধারা ৩৯ : ফিরে পাবার অধিকার ”যুদ্ধকালীন সময়ে যে সমস্ত জনগণ তাদের বাস্তু, দেশ ও সম্পদ ত্যাগ করে অন্যত্র স্থানান্তরিত হয়েছে, অস্ত্র বিরতি বা স্থিতিশীলতার পরিবেশ সৃষ্টির পর তাদেরকে তাদের স্ব-অবস্থানে ফেরত নেয়া তাদের অধিকার।”

পার্ট-৪ : কনভেনশনের বাস্তবায়ন

এ অংশে আন্তর্জাতিক মানবহিতৈষী আইনের প্রাতিষ্ঠানিক বা কূটনীতিক অধ্যায়ের সংযোজন রয়েছে, সেই সাথে পারমানবিক, রাসায়নিক ও জৈব অস্ত্রের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞার কথাও বলা হয়েছে।

জাতিবিদ্বেষ এবং বর্ণবাদ

একটি বিষয় সম্পর্কে আমাদের সকলেরই একমত হতে হবে যে, কোন জনগোষ্ঠীর কয়েকজন মানুষের কর্মকাণ্ডের জন্য গোটা সম্প্রদায়কে অভিযুক্ত করা বা শাস্তি দিতে চাওয়া কিংবা হত্যা করা অন্যায়। ধরুন, কাল ইউরোপে কোন বাঙালি একটি বোমা বিস্ফোরণের সাথে জড়িত ছিল বলে জানা গেল। এর প্রতিশোধ নিতে ইউরোপে যদি এখন বলা শুরু হয়, যেখানেই বাঙালি পাও হত্যা করো, তাহলে ব্যাপারটা হবে ভয়াবহ অপরাধ। কারণ অপরাধ যদি করেও থাকে, করেছে একজন বা কয়েকজন মাত্র বাঙালি। তার জন্য সমস্ত বাঙালি, সেই সাথে নারী শিশু বৃদ্ধা প্রতিবন্ধী সমস্ত বাঙালিকে দোষারোপ করা যায় না। যদি কেউ তা করে, তাকে আমরা জাতিবিদ্বেষ বা বর্ণবাদ বলতে পারি।

কোন বাঙালি যদি অপরাধ করেও থাকে, আইন অনুসারে সেই অপরাধীকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিয়ে শাস্তি দেয়া যেতে পারে। কিন্তু একজনার অপরাধে পুরো বাঙালি জাতি ধরে কেউ হত্যা ধর্ষণ বা আক্রমণের হুমকি বা নির্দেশ দিতে পারে না। যদি বলা হয়, শেখ হাসিনা চুক্তি ভঙ্গ করেছে সেই কারণে বাঙালি পুরুষদের হত্যা করে তাদের স্ত্রী কন্যাদের গনিমতের মাল বানাও, তা হবে মানবতার চরম অবমাননা। একই কথা প্রযোজ্য সব ক্ষেত্রেই। কোন মুসলমান যদি জঙ্গি হয়, তার জন্য ঢালাও ভাবে সকল মুসলমানকে কেউ হত্যা করতে বলতে পারে না। কোন রোহিঙ্গা যদি ইয়াবা ব্যবসায়ী হয়, তার জন্য জাতি ধরে কেউ বলতে পারে না, “রোহিঙ্গারা সবাই ইয়াবা ব্যবসায়ী! তাদেরকে হত্যা করা উচিত!” – বললে তা হবে বর্ণবাদী আচরণ। এবং তা হবে খুবই ভয়াবহ অপরাধ।

সেই সাথে, কেউ ইহুদী বা বৌদ্ধ বা হিন্দু বা খ্রিস্টান বা শিখ বা আহমদিয়া বা শিয়া বা সুন্নি বা নাস্তিক বা আস্তিক বা সমকামী বা বিষমকামী বা নারী বা পুরুষ কাউকেই হত্যা করতে বলতে পারে না। ধরুন আমার এক খ্রিস্টান বন্ধু আমার টাকা ধার নিয়ে ফেরত দিচ্ছে না। আমি এই অবস্থায় বলতে পারি না, খ্রিস্টানরা খারাপ, তাদের হত্যা করো। যদি বলি, তা হবে চরম সাম্প্রদায়িক বক্তব্য। যা শাস্তিযোগ্য অপরাধ এবং ঘৃণিত। কোন বা কিছু ব্যক্তির অপরাধের কারণে ধর্ম বর্ণ গোত্র সম্প্রদায় ধরে ঐ ধর্ম বর্ণ গোত্র সম্প্রদায়ের সকলের বিরুদ্ধে উস্কানি দেয়া, হত্যা করতে চাওয়া, নারী শিশুদের গনিমতের মাল বানাবার চেষ্টা করা অবশ্যই বর্ণবাদী এবং সাম্প্রদায়িক আচরণ। এটি সকলের ক্ষেত্রে সত্য। ধর্মের ওপর ভিত্তি করে কোন জনগোষ্ঠী বা সম্প্রদায়কে কোন অপরাধে অপরাধী সাব্যস্ত করা, তাদের নিচু বা অপবিত্র ভাবা, নির্যাতন বা তাদের উচ্ছেদ করা, এগুলো সবই জাতিবিদ্বেষের উদাহরণ।

নবী মুহাম্মদের পরিকল্পনা

ধর্মের ভিত্তিতে কোন জনগোষ্ঠীকে ভূমি থেকে উচ্ছেদ করা, বিতাড়িত করা, এগুলো যুগে যুগে অসংখ্যবার হয়েছে। এই বর্তমান সময়েও মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের উচ্ছেদ, ফিলিস্তিনীদের উচ্ছেদ, কাশ্মীরীদের উচ্ছেদ, এই ঘটনাগুলোর কথা আমরা সকলেই জানি, এবং ধর্মের ভিত্তিতে অস্ত্র-সামরিক বাহিনী দিয়ে ভয় দেখিয়ে-জোরপূর্বক কোন জনগোষ্ঠীকে উচ্ছেদ করার এই প্রক্রিয়া মানব ইতিহাসে সবচাইতে হৃদয় বিদারক এবং ভয়াবহ ঘটনা বলেই বিবেচিত হয়। এই বাঙলাদেশ থেকেও ১৯৪৭ সালে এবং ১৯৭১ সালে অসংখ্য হিন্দুদের দেশত্যাগে বাধ্য করা হয়, এরপরেও অসংখ্য হিন্দুদের এই দেশ থেকে ভারতে চলে যেতে বাধ্য করা হয়। এই সাম্প্রদায়িকতা, এই ধর্মান্ধতা মানব সভ্যতার অন্যতম প্রধান শত্রু। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এগুলো কী নবী মুহাম্মদেরও শিক্ষা?

নবী মুহাম্মদ মক্কায় যখন প্রথম ধর্ম প্রচার শুরু করেন, তখন শুধুমাত্র কয়েকজনকে তার ধর্মে আনতে তিনি সক্ষম হয়েছিলেন। সেই সময়ে তার না ছিল দলবল, না ছিল যুদ্ধ করার সামর্থ্য। মদিনায় হিজরত করেই নবীর ভাগ্যের পরিবর্তন হতে শুরু করলো। তিনি নিয়মিত বানিজ্য কাফেলা আক্রমণ করে বানিজ্য কাফেলার মালামাল লুট করতে শুরু করলেন, যা তার শক্তিসামর্থ্য বৃদ্ধি করছিল। মদিনায় ইহুদিদের কাছে সাহায্য সহযোগিতা পেয়ে নবীও ধীরে ধীরে শক্তিশালী হয়ে উঠছিলেন। এরপরে তিনি ধীরে ধীরে ইহুদি গোত্রগুলোকে আক্রমণ করতে শুরু করেন। তবে তার বৃহৎ পরিকল্পনা এরকমই ছিল যে, তিনি মদিনা থেকে তার অপছন্দের গোত্র ও মানুষগুলোকে ধীরে ধীরে বিতাড়িত করবেন। যার প্রমাণ মেলে হাদিস থেকেই [5] [6]

সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)
২৯/ মদীনার ফাযীলাত
পরিচ্ছেদঃ ২৯/২. মদীনার ফযীলত। মদীনাহ (অবাঞ্ছিত) লোকজনকে বহিষ্কার করে দেয়।
১৮৭১. আবূ হুরাইরাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ আমি এমন এক জনপদে হিজরত করার জন্য আদিষ্ট হয়েছি, যে জনপদ অন্য সকল জনপদের উপর জয়ী হবে। লোকেরা তাকে ইয়াসরিব বলে থাকে। এ হল মদিনা। তা অবাঞ্ছিত লোকদেরকে এমনভাবে বহিষ্কার করে দেয়, যেমনভাবে কামারের অগ্নিচুলা লোহার মরিচা দূর করে দেয়। (মুসলিম ১৫/৮৮, হাঃ ১৩৮২, আহমাদ ৮৯৯৪) (আধুনিক প্রকাশনীঃ ১৭৩৬, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ১৭৪৭ )
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
বর্ণনাকারীঃ আবূ হুরায়রা (রাঃ)

সহীহ মুসলিম (ইসলামিক ফাউন্ডেশন)
১৬/ হাজ্জ (হজ্জ/হজ)
পরিচ্ছেদঃ ৮৫. মদীনা নিজের মধ্য থেকে নিকৃষ্ট জিনিস বের করে দিবে এবং মদীনার অপর নাম ‘তাবা’ ও ‘তায়বা’
৩২২৩। কুতায়বা ইবনু সাঈদ (রহঃ) … আবূ হুরায়রা (রাঃ) বলেন যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আমি এমন একটি জনপদে (হিজরতের) জন্য আদিষ্ট যা সমস্ত জনপদ খেয়ে ফেলবে (আধিপত্য বিস্তার করবে)। লোকেরা তাকে ইয়াসরীব নামে অভিহিত করেছে। আর এটা হল মদিনা। তা লোকদের এমনভাবে বের করবে যেমনিভাবে হাপর লোহার ময়লা বের করে।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
বর্ণনাকারীঃ আবূ হুরায়রা (রাঃ)

আরো খুব দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, ইসলাম ধর্মের নবী মুহাম্মদ খুব পরিষ্কারভাবেই ঘোষণা দিয়েই বলেছিলেন, তিনি ধীরে ধীরে আরবের সমস্ত ইহুদি, খ্রিস্টান, পৌত্তলিক, সবাইকে আরব উপদ্বীপ থেকে বিতাড়িত করবেন। অর্থাৎ তার মূল লক্ষ্যই ছিল, আরব উপদ্বীপের সবাইকে ইসলামে ধর্মান্তরিত করা, নতুবা তাদের উচ্ছেদ করা। এই বিষয়ে তিনি কখনো কোন রাখঢাকও করেন নি। সহি হাদিসে এই সম্পর্কে অসংখ্য প্রমাণ পাওয়া যায়। [7] [8]

সুনানে ইবনে মাজাহ
ভূমিকা পর্ব
পরিচ্ছেদঃ ৯. ঈমানের বিবরণ
১৪/৭১। আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলূল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আমি লোকেদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে আদিষ্ট হয়েছি যতক্ষণ না তারা সাক্ষ্য প্রদান করে যে, আল্লাহ ব্যতীত আর কোন ইলাহ নাই, নিশ্চয়ই আমি আল্লাহ্‌র রাসূল এবং তারা সালাত কায়িম করে এবং যাকাত দেয়।
তাখরীজ কুতুবুত সিত্তাহ: বুখারী ১৪০০, ২৯৪৬, ৬৯২৪, ৭২৮৫; মুসলিম ২০, ২১/১-৩; তিরমিযী ২৬০৬-৭, নাসায়ী ২৪৪৩, ৩০৯০-৯৩, ৩০৯৫, ৩৯৭০-৭৮; আবূ দাঊদ ২৬৪০, আহমাদ ৬৮, ১১৮, ৩৩৭, ২৭৩৮০, ৮৩৩৯, ৮৬৮৭, ৯১৯০, ২৭২১৪, ৯৮০২, ২৭২৮৪, ১০১৪০, ১০৪৪১, ১০৪৫৯।
তাহক্বীক্ব আলবানী: সহীহ মুতাওয়াত্বির। তাখরীজ আলবানী: সহীহাহ ৪০৭। উক্ত হাদিসের রাবী আবু জা’ফার সম্পর্কে ইয়াহইয়া বিন মাঈন বলেন, মুগীরাহ থেকে হাদিস বর্ণনায় সংমিশ্রণ করেছেন। আহমাদ বিন হাম্বল বলেন, হাদিস বর্ণনায় নির্ভরযোগ্য নন। বু হাতিম আর-রাযী ও আলী ইবনুল মাদীনী এবং ইয়াহইয়া বিন মাঈন বলেন, তিনি সিকাহ।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
বর্ণনাকারীঃ আবূ হুরায়রা (রাঃ)

সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী)
১। ঈমান (বিশ্বাস)
পরিচ্ছেদঃ ৮. লোকেদের বিরুদ্ধে জিহাদের নির্দেশ যতক্ষণ না তারা স্বীকার করে যে, আল্লাহ ছাড়া প্রকৃত কোন ইলাহ নেই, মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল এবং সালাত কায়িম করে, যাকাত দেয়, নাবী যে শারীআতের বিধান এনেছেন তার প্রতি ঈমান আনে, যে ব্যক্তি এসব করবে সে তার জান মালের নিরাপত্তা লাভ করবে; তবে শারীআত সম্মত কারণ ব্যতীত, তার অন্তরের খবর আল্লাহর কাছে; যে ব্যক্তি যাকাত দিতে ও ইসলামের অন্যান্য বিধান পালন করতে অস্বীকার করে তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার এবং ইসলামের বৈশিষ্ট্যসমূহ প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে ইমামের গুরুত্বারোপ করার নির্দেশ।
৩৭-(৩৭/২৩) সুওয়াইদ ইবনু সাঈদ আবূ উমর (রহঃ) ….. আবূ মালিক তার পিতার সূত্রে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তি আল্লাহ ছাড়া প্রকৃত কোন ইলাহ নেই, এ কথা স্বীকার করে এবং আল্লাহ ছাড়া অন্যান্য উপাস্যকে অস্বীকার করে, তার জান-মাল নিরাপদ? আর তার হিসাব নিকাশ আল্লাহর নিকট। (ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ৩৭, ইসলামিক সেন্টারঃ ৩৮)
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
বর্ণনাকারীঃ আবূ মালিক আল আশ্‘আরী (রাঃ)

উপরের সহিহ হাদিসগুলো থেকে স্পষ্টভাবেই বোঝা যায়, নবী মুহাম্মদ এই পৃথিবীতে জন্মই নিয়েছিলেন কাফেররা যতক্ষণ পর্যন্ত না ইসলাম কবুল করে, ততক্ষণ পর্যন্ত তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে। কাফেররা হয় ইসলাম গ্রহণ করবে, নতুবা অপমানিত অবস্থায় জিজিয়া কর দিবে, এই হচ্ছে ইসলামের সরাসরি বিধান [9] [10]। এবারে আসুন, আরো কয়েকটি হাদিস পড়ি, যেখান থেকে জানা যায়, নবী মুহাম্মদের লক্ষ্যই ছিল ইহুদি নাসারা পৌত্তলিক সকলকে আরব উপদ্বীপ থেকে বিতাড়িত করে সেখানে ইসলামের একচ্ছত্র আধিপত্য কায়েম করা। [11] [12] [13]

সহীহ মুসলিম (ইফাঃ)
অধ্যায়ঃ ৩৩/ জিহাদ ও এর নীতিমালা
পরিচ্ছদঃ ২১. ইয়াহুদী ও নাসারাদের আরব উপ-দ্বীপ থেকে বহিস্কার
৪৪৪২। যুহায়র ইবনু হারব ও মুহাম্মাদ ইবনু রাফি (রহঃ) … জাবির ইবনু আবদুল্লাহ (রাঃ) বলেন, আমার কাছে উমর ইবনু খাত্তাব (রাঃ) বর্ণনা করেন যে, তিনি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে বলতে শুনেছেন যে, নিশ্চয়ই আমি ইয়াহুদী ও খ্রীষ্টান সম্প্রদায়কে আরব উপ-দ্বীপ থেকে বহিস্কার করবো। পরিশেষে মুসলমান ব্যতীত অন্য কাউকে এখানে থাকতে দেবো না।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)

সহীহ মুসলিম (হাঃ একাডেমী)
অধ্যায়ঃ ৩৩। জিহাদ ও সফর
পরিচ্ছদঃ ২১. ইয়াহুদী ও নাসারাদের আরব উপ-দ্বীপ থেকে বের করে দেয়া
৪৪৮৬-(৬৩/১৭৬৭) যুহায়র ইবনু হারব ও মুহাম্মাদ ইবনু রাফি’ (রহঃ) ….. জাবির ইবনু ‘আবদুল্লাহ (রাযিঃ) বলেন, আমার কাছে উমর ইবনু খাত্তাব (রাযিঃ) বর্ণনা করেন যে, তিনি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে বলতে শুনেছেন যে, নিশ্চয়ই আমি ইয়াহুদী ও খ্ৰীষ্টান সম্প্রদায়কে আরব উপ-দ্বীপ থেকে বের করে দেবো। তারপর মুসলিম ব্যতীত অন্য কাউকে এখানে থাকতে দেবো না। (ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৪৪৪২, ইসলামিক সেন্টার ৪৪৪৪)
যুহায়র ইবনু হারব ও সালামাহ্ ইবনু শাবীব (রহঃ) ….. উভয়েই আবূ যুবায়র (রহঃ) থেকে এ সানাদে অনুরূপ বর্ণনা করেন। (ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৪৪৪২, ইসলামিক সেন্টার ৪৪৪৫)
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)

সূনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত)
অধ্যায়ঃ ১৯/ যুদ্ধাভিযান
পাবলিশারঃ হুসাইন আল-মাদানী‏
পরিচ্ছদঃ ৪৩. আরব উপদ্বীপ হতে ইয়াহুদী-নাসারাদের বের করে দেওয়া প্রসঙ্গে
১৬০৭। উমার ইবনুল খাত্তাব (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে, তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছেনঃ আমি ইহুদী ও নাসারাদের আরব উপদ্বীপ হতে অবশ্যই বহিষ্কার করব। মুসলমান ব্যতীত অন্য কাউকে সেখানে বসবাস করতে দিব না।
সহীহ, সহীহা (১১৩৪), সহীহ আবূ দাউদ, মুসলিম
এ হাদীসটিকে আবূ ঈসা হাসান সহীহ বলেছেন।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)

অর্থাৎ, এই কথাটি খুব পরিষ্কারভাবেই বোঝা যায়, আরব উপদ্বীপের ইহুদি খ্রিষ্টান কিংবা পৌত্তলিক যারাই সেই সময়ে ছিলেন, তাদের কোন না কোন সময়ে অবশ্যই উচ্ছেদ করা হতো। যার পরিকল্পনাই থাকবে এমন যে, সেই অঞ্চল থেকে মুসলিম ছাড়া অন্য সবাইকে উচ্ছেদ করবে, তিনি ছলে বলে কৌশলে নানা অজুহাতে এই চেষ্টাই করবেন যে, কোনভাবে তাদের ওপর কোন অভিযোগ আরোপ করে তাদের যেন হত্যা কিংবা উচ্ছেদ করা যায়। কারণ নবী মুহাম্মদের সবসময়ই এই সুপ্ত ইচ্ছাটিই ছিল যে, তিনি মুসলিম ছাড়া অন্য সবাইকেই সেখান থেকে তাড়িয়ে দেবেন। আসুন এই বিষয়ে নবী মুহাম্মদের আরো কয়েকটি হাদিস দেখে নিই। নবী বলেছেন যে, মানুষ যে পর্যন্ত না “আল্লাহ তা’আলা ব্যতীত আর কোন প্ৰভু নেই” এই কথার স্বীকৃতি দিবে সেই পর্যন্ত আমি(নবী) তাদের বিরুদ্ধে কিতাল বা সশস্ত্র যুদ্ধ করতে আদিষ্ট হয়েছি [14] [15]

সূনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত)
৩৮/ ঈমান
পরিচ্ছেদঃ ১. যতক্ষণ পর্যন্ত মানুষ “লা-ইলা-হা ইল্লাল্লা-হ’ না বলবে ততক্ষণ পর্যন্ত তাদের বিরুদ্ধে কিতাল করতে আমি আদেশপ্রাপ্ত হয়েছি
২৬০৭। আবূ হুরাইরাহ (রাযিঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর মৃত্যুর পর আবূ বকর (রাযিঃ) যখন খলীফা নির্বাচিত হন, তখন আরবের কিছু সংখ্যক লোক কাফির হয়ে যায়। উমার ইবনুল খাত্তাব (রাযিঃ) আবূ বাকর (রাযিঃ)-কে বললেন, আপনি এদের বিরুদ্ধে কিভাবে অস্ত্ৰধারণ করবেন, অথচ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ মানুষ যে পর্যন্ত না “আল্লাহ তা’আলা ব্যতীত আর কোন প্ৰভু নেই” এই কথার স্বীকৃতি দিবে সেই পর্যন্ত আমি তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে আদিষ্ট হয়েছি। আর যে ব্যক্তি বললো, “আল্লাহ ব্যতীত আর কোন প্ৰভু নেই” সে আমার থেকে তার মাল ও রক্ত (জীবন) নিরাপদ করে নিল। তবে ইসলামের অধিকার সম্পর্কে ভিন্ন কথা। আর তাদের প্রকৃত হিসাব-নিকাশ রয়েছে আল্লাহ তা’আলার দায়িত্বে।
আবূ বকর (রাযিঃ) বললেনঃ আল্লাহর শপথ নামায ও যাকাতের মধ্যে যে ব্যক্তি পার্থক্য করে আমি তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবোই। কেননা যাকাত সম্পদের হাক্ক। কেউ উটের একটি রশি দিতেও যদি অস্বীকার করে, যা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -কে দিত, আল্লাহর কসম! আমি তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবোই। তারপর উমার ইবনুল খাত্তাব (রাযিঃ) বলেন, আল্লাহর শপথ! আমি দেখতে পেলাম আল্লাহ যেন যুদ্ধের জন্য আবূ বাকরের অন্তর উন্মুক্ত করে দিয়েছেন। অতঃপর আমি বুঝতে পারলাম যে, তার সিদ্ধান্তই যথার্থ।
সহীহঃ সহীহাহ (৪০৭), সহীহ আবূ দাউদ (১৩৯১-১৩৯৩), বুখারী ও মুসলিম।
আবূ ঈসা বলেন, এই হাদীসটি হাসান সহীহ। শু’আইব ইবনু আবী হামযা (রহঃ) যুহরী হতে, তিনি উবাইদুল্লাহ ইবনু আবদিল্লাহ হতে, তিনি আবূ হুরাইরাহ (রাযিঃ)-এর সূত্রে একই রকম বর্ণনা করেছেন। এই হাদীস মামার-যুহরী হতে, তিনি আনাস (রাযিঃ) হতে, তিনি আবূ বাকর (রাযিঃ) হতে এই সূত্রে ইমরান আল-কাত্তান বর্ণনা করেছেন। এ বর্ণনাটি ভুল। ‘ইমরানের ব্যাপারে মা’মার হতে বর্ণিত বর্ণনাতে বিরোধিতা করা হয়েছে।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
বর্ণনাকারীঃ আবূ হুরায়রা (রাঃ)

সূনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত)
৩৮/ ঈমান
পরিচ্ছেদঃ ২. আমি লোকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে আদিষ্ট হয়েছি যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা “লা-ইলা-হা ইল্লাল্লা-হ’ বলবে এবং নামায আদায় করবে
২৬০৮। আনাস ইবনু মালিক (রাযিঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আমি লোকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য আদিষ্ট হয়েছি যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা সাক্ষ্য দিবে যে, আল্লাহ তা’আলা ব্যতীত আর কোন প্ৰভু নেই এবং মুহাম্মাদ আল্লাহ তা’আলার বান্দা ও তার রাসূল এবং আমাদের কিবলামুখী হয়ে নামায আদায় করবে, আমাদের যবেহকৃত পশুর গোশত খাবে এবং আমাদের মতো নামায আদায় করবে। তারা এগুলো করলে তাদের জান ও মালে হস্তক্ষেপ করা আমাদের জন্য হারাম হয়ে যাবে। কিন্তু ইসলামের অধিকারের বিষয়টি ভিন্ন। মুসলিমদের প্রাপ্য সুযোগ-সুবিধা তারাও পাবে এবং মুসলিমদের উপর অর্পিত দায়-দায়িত্ব তাদের উপরও বর্তাবে।
সহীহঃ সহীহাহ (৩০৩) ও (১/১৫২), সহীহ আবূ দাউদ (২৩৭৪), বুখারী অনুরূপ।
মুআয ইবনু জাবাল ও আবূ হুরাইরাহ (রাযিঃ) হতেও এই অনুচ্ছেদে হাদীস বর্ণিত আছে। আবূ ঈসা বলেন, এই হাদীসটি হাসান সহীহ এবং উপরোক্ত সূত্রে গারীব। ইয়াহইয়া (রাহঃ) হুমাইদ হতে, তিনি আনাস (রাযিঃ)-এর সূত্রে একই রকম হাদীস বর্ণনা করেছেন।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)

যুদ্ধবন্দী সম্পর্কে ইসলামের বিধান

ইসলামিক জিহাদের পরে অমুসলিম যুদ্ধবন্দীদের সাথে মুসলিমদের আচরণ কীরকম হবে, ইসলামে রয়েছে সে সম্পর্কে সুস্পষ্ট দিক নির্দেশনা। আসুন সে সম্পর্কে শুরুতেই পড়ি ইবনে কাসীর থেকে, কোরআনের একটি আয়াতের তাফসীরে কী বলা হয়েছে [16]

তাফসীরঃ উল্লেখিত আয়াতসমূহে আল্লাহ পাক কাফিরদের প্রতি তাঁহার ঘৃণা এবং তাহাদের অপকর্মের বর্ণনা দিয়া বলিতেছেন যে, ভূপৃষ্ঠে জীবকুলের মধ্যে বেঈমান কাফিরগণই হইল আল্লাহর নিকট অতি নিকৃষ্ট জীব। উহাদের মধ্যকার যাহাদের সাথে তুমি যখনই কোন চুক্তিতে আবদ্ধ হও, তখনই উহারা সেই চুক্তি লঙ্ঘন করে। যখন উহাদিগকে বিশ্বাস করিয়া আস্থা স্থাপন কর, তখন বিশ্বাস ভঙ্গ করিয়া তোমার আস্থা নষ্ট করিয়া ফেলে। উহারা আল্লাহকে আদৌ কোনরূপ ভয়ই করে না। নির্ভয় দাম্ভিকতার সহিত পাপাচারে লিপ্ত হয়। আলোচ্য আয়াতাংশের মর্ম হইলঃ তুমি যদি উহাদের যুদ্ধে পরাস্ত করিয়া বিজয় লাভ করিতে পার, তবে কঠোরভাবে বন্দী করিয়া জ্বালা-যন্ত্রণা দিবে। এই ব্যাখ্যা প্রদান করেন ইবন আব্বাস (রা)।
হাসান বসরী, যাহহাক, সুদ্দী, আতা খুরাসানী ও ইবন উআয়না (র) ইহার ব্যাখ্যায় বলেনঃ যুদ্ধে উহাদিগকে পরাস্ত করিতে পারিলে অতি কঠোরভাবে শাস্তি দিবে এবং নির্দয়ভাবে উহাদিগকে হত্যা করিবে যেন ইহাদের ছাড়া আরবের অন্যান্য শত্রুগণ এই শাস্তির কথা শুনিয়া ভীত হয় এবং নসীহত ও শিক্ষা গ্রহণ করে। তাহাদের মধ্যে লজ্জা ও অনুশোচনার সৃষ্টি হয়।

এই বিষয়ে কোরআনের আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ আয়াত নিয়ে আলোচনা না করলেই নয়। বদর যুদ্ধের সময় একটি আয়াত নাজিল হয়, যেই আয়াতে খুব পরিষ্কারভাবে আল্লাহ ঘোষণা দিয়ে দেন যে, যুদ্ধের পরে কাফের যুদ্ধবন্দীদের ওপর যথেষ্ট পরিমাণ হত্যাকাণ্ড এবং রক্তপাত ঘটানো না পর্যন্ত তাদেরকে মুক্তিপণের জন্য বন্দী করা নবীর জন্য জায়েজ নেই। অর্থাৎ আল্লাহ খুব পরিষ্কারভাবে নির্দেশ দিচ্ছেন, যুদ্ধে যেসকল কাফের পরাজিত এবং বন্দী হবে, তাদের যথেষ্ট পরিমাণ রক্তপাত ঘটানো জরুরি! [17]

কোন নবীর সাথে যুদ্ধরত কাফিরদের মাঝে প্রচুর হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে তাদেরকে ভালোভাবে পর্যুদস্ত না করা পর্যন্ত নিজের কাছে বন্দী রাখা তাঁর জন্য উচিৎ হবে না। যেন তাদের অন্তরে ভীতি সঞ্চারিত হয় এবং তারা তাঁর সাথে দ্বিতীয়বার যুদ্ধ করতে না আসে। হে মু’মিনরা! তোমরা মূলতঃ বদরের কাফিরদেরকে বন্দী করে তাদের থেকে মুক্তিপণ নিতে চাও। অথচ আল্লাহ তা‘আলা আখিরাত চাচ্ছেন যা ধর্মের বিজয় ও তার পরাক্রমশীলতার মাধ্যমে হাসিল করা সম্ভব। বস্তুতঃ আল্লাহ তা‘আলা তাঁর সত্তা, গুণাবলী ও ক্ষমতায় অপ্রতিদ্ব›দ্বী। তাঁকে কেউ পরাজিত করতে পারে না। তেমনিভাবে তিনি তাঁর শরীয়ত প্রণয়নে ও তাক্বদীর নির্ধারণে অতি প্রজ্ঞাময়।
— Bengali Mokhtasar
কোন নাবীর জন্য এটা সঠিক কাজ নয় যে, দেশে (আল্লাহর দুশমনদেরকে) পুরোমাত্রায় পরাভূত না করা পর্যন্ত তার (হাতে) যুদ্ধ-বন্দী থাকবে। তোমরা দুনিয়ার স্বার্থ চাও আর আল্লাহ চান আখিরাত (এর সাফল্য), আল্লাহ প্রবল পরাক্রান্ত, মহাবিজ্ঞানী।
— Taisirul Quran
কোন নাবীর পক্ষে তখন পর্যন্ত বন্দী (জীবিত) রাখা শোভা পায়না, যতক্ষণ পর্যন্ত ভূ-পৃষ্ঠ (দেশ) হতে শক্র বাহিনী নির্মূল না হয়, তোমরা দুনিয়ার ক্ষণস্থায়ী সম্পদ কামনা করছ, অথচ আল্লাহ চান তোমাদের পরকালের কল্যাণ, আল্লাহ মহা পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।
— Sheikh Mujibur Rahman
কোন নবীর জন্য সঙ্গত নয় যে, তার নিকট যুদ্ধবন্দি থাকবে (এবং পণের বিনিময়ে তিনি তাদেরকে মুক্ত করবেন) যতক্ষণ না তিনি যমীনে (তাদের) রক্ত প্রবাহিত করেন। তোমরা দুনিয়ার সম্পদ কামনা করছ, অথচ আল্লাহ চাচ্ছেন আখিরাত। আর আল্লাহ পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাবান।
— Rawai Al-bayan
কোনো নবীর জন্য সংগত নয় যে [১] তার নিকট যুদ্ধবন্দি থাকবে, যতক্ষণ না তিনি যমীনে (তাদের) রক্ত প্রবাহিত করেন [২]। তোমরা কামনা কর পার্থিব সম্পদ [৩] এবং আল্লাহ্‌ চান আখেরাত; আর আল্লাহ্‌ পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।
— Dr. Abu Bakr Muhammad Zakaria

এই আয়াতটির অনুবাদ তাফসীরে জালালাইন থেকে পড়ে নিই [18]

৬৭. বদর যুদ্ধে বন্দীদের নিকট হতে মুক্তিপণ গ্রহণ করলে এই আয়াত নাজিল হয় যে, পৃথিবীতে ভালোভাবে রক্ত প্রবাহিত না হওয়া পর্যন্ত অর্থাৎ সম্পূর্ণরূপে কাফের-বধ না হওয়া পর্যন্ত [প্রথমপুরুষ, পুংলিঙ্গ) ও [প্রথমপুরুষ, স্ত্রীলিঙ্গ) উভয়রূপেই পঠিত রয়েছে। বন্দী রাখা কোনো নবীর জন্য সঙ্গত নয়। হে মুমিনগণ! মুক্তিপণ গ্রহণ করে তোমরা পার্থিব সম্পদ তার তুচ্ছ সামগ্রী কামনা কর,

এবারে আসুন তাফসীরে মাযহারী থেকে আয়াতটির ব্যাখ্যা পড়ে দেখা যাক [19]

সুরা আনফাল : আয়াত ৬৭ ما كان النبي أن يكون له أثرى حتى يثخن في الأرض تريدون عرض الدنيا والله يريد الأخرة والله عزيز حكيم → দেশে সম্পূর্ণভাবে শত্রু নিপাত না করা পর্যন্ত বন্দী রাখা কোন নবীর জন্য সংগত নহে; তোমরা কামনা কর পার্থিব সম্পদ এবং আল্লাহ্ চাহেন পরলোকের কল্যাণ; আল্লাহ্ পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়। ‘মা কানা লিনাবিয়্যিন আঁয়্যাকুনা লাহু আস্সা হাত্তা ইউছখিনা ফিল আরদ্ধা অর্থ— দেশে সম্পূর্ণভাবে শত্রু নিপাত না করা পর্যন্ত বন্দী রাখা কোনো নবীর জন্য সংগত নয়। জ্ঞাতব্যঃ কাযী আবুল ফজল আয়ায তাঁর আশ শিফা গ্রন্থে লিখেছেন ‘দেশে সম্পূর্ণরূপে শত্রু নিপাত না করা পর্যন্ত বন্দী রাখা কোনো নবীর জন্য সংগত নয়’ কথাটির মাধ্যমে রসুল স. এর বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ উত্থাপন করা হয়নি। বরং এ কথাটির মাধ্যমেই ফুটে উঠেছে রসুল স. এর অনন্য সাধারণ মর্যাদা। যেমন অন্যান্য নবীগণের জন্য গণিমতের মাল গ্রহণ করা হালাল ছিলো না। কিন্তু রসুল স. এর জন্য তা হালাল করা হয়েছে। তাই তিনি স. বলেছেন, যুদ্ধলব্ধ- সম্পদ অন্য নবীদের জন্য হালাল ছিলো না। কিন্তু আমার জন্য হালাল। কাযী আয়ায আরো লিখেছেন, ‘তোমরা কামনা করো পার্থিব সম্পদ’ এ কথাটিও রসুল স. কিংবা তাঁর সাহাবীগণকে লক্ষ্য করে বলা হয়নি। বলা হয়েছে ওই সকল লোককে লক্ষ্য করে, যারা পৃথিবীর বিত্ত-বৈভবের প্রতি লালসাপরায়ণ। জুহাকের বর্ণনায় এসেছে, বদর যুদ্ধের দিন যখন অংশীবাদী সৈন্যরা পালিয়ে যাচ্ছিলো, তখন বিজয় নিশ্চিত জেনে কেউ কেউ তাদের ফেলে যাওয়া জিনিসপত্র সংগ্রহ করতে শুরু করেছিলো। হজরত ওমর তখন আশংকা করেছিলেন, এ রকম করলে অংশীবাদীরা হয় তো পুনরাক্রমণের উদ্যোগ নিতে পারে। ‘ইউছখিনা’ অর্থ নিপাত করা, নিশ্চিহ্ন করা, পরাভূত করা, হত্যা করা অথবা পরাস্ত করা। এখানে মূল কর্ম বা হত্যা করার কথাটি রয়েছে অনুক্ত। এভাবে আয়াতে এই নির্দেশনাটি দেয়া হয়েছে— শত্রুকে সম্পূর্ণরূপে পর্যুদস্ত না করা পর্যন্ত বন্দীদেরকে ছেড়ে দেয়া যাবে না। হত্যা করতে হবে তাদেরকে। এ রকম দৃষ্টান্ত রয়েছে অনেক। যেমন— ‘আছখানা ফলানা’ অর্থ অমুক ব্যক্তিকে নিপাত করা হয়েছে, ‘আছখানা ফিল আদুবি’ অর্থ শত্রুকে যথেষ্ট পরিমাণে আঘাত করা হয়েছে ইত্যাদি। এরপর বলা হয়েছে ‘তুরিদুনা আরদ্বাদ দুন্‌ইয়া’ (তোমরা কামনা করো পার্থিব সম্পদ)। এ কথার অর্থ- হে মুসলমানেরা! তোমরা চাও ধ্বংসশীল পার্থিব বৈভব। শেষে বলা হয়েছে- ‘ওয়াল্লহু ইউরিদুল আখিরা’ ওয়াল্লহু আযিযুন্ হাকীম’ (এবং আল্লাহ্ চান পরলোকের কল্যাণ; আল্লাহ্ পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়)। এ কথার অর্থ— আল্লাহ্তায়ালা পরাক্রমশালী ও প্রজ্ঞাময়। তাই তিনি চান তাঁর অপার পরাক্রমের অধীনে এবং অতুলনীয় প্রজ্ঞাময়তার অনুসরণে তোমরা পরকালাভিমুখী হও। অংশীবাদীদেরকে হত্যা করে সাহায্যকারী হও সত্যধর্মের। অর্জন করো পুণ্য এবং আল্লাহ্তায়ালার সন্তুষ্টি। হজরত ইবনে আব্বাস বলেছেন, ঘটনাটি ঘটেছিলো বদর যুদ্ধের সময়। তখন মুসলমান সৈন্যের সংখ্যা ছিলো অল্প। পরবর্তী সময়ে যখন মুসলমানদের সংখ্যা বৃদ্ধি ঘটলো তখন অবতীর্ণ হলো— ‘ফাইম্মা মান্না বা’দু ওয়া ইন্না ফিদাআন্ (এরপর হয় অনুগ্রহ করবে নয়তোবা রক্তপণ নেবে)। এই আয়াতের মাধ্যমে রসুল স. কে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকার দেয়া হলো। যুদ্ধবন্দীকে হত্যা, অথবা তাদেরকে ক্রীতদাস ও ক্রীতদাসীতে পরিণত করা কিংবা মুক্তিপণ গ্রহণের মাধ্যমে তাদেরকে ছেড়ে দেয়া যে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকার তখন থেকে রসুল স. কে এবং মুসলমানদেরকে দেয়া হয়েছে। মাসআলাঃ আলেমগণের ঐকমত্য এই যে, মুসলমানদের শাসক বা অধিনায়ককে এই আয়াতের মাধ্যমে যুদ্ধবন্দীদেরকে হত্যা করার অধিকার দেয়া হয়েছে। তাই রসুল স. বনী কুরায়জার পুরুষদেরকে হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন। বন্দী করার পর হত্যা করিয়েছিলেন নজর বিন হারেস, তাইমিয়া বিন আদী এবং উকবা বিন আবী মুঈতকে। সাবিলুর রাশাদ গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে, উকবা বিন আবী মুঈত তখন বলেছিলো, মোহাম্মদ শিশুদেরকে দেখবে কে? রসুল স. বলেছিলেন, আগুন। ইবনে ইসহাক বলেছেন, উকবাকে হত্যা করেছিলেন হজরত ইবনে আবীল আফলা। ইবনে হিশাম বলেছেন, হজরত আবী ইবনে আবী তালেব । মাসআলাঃ বন্দীদেরকে ক্রীতদাসে পরিণত করা সিদ্ধ। আলেমগণ এ ব্যাপারে একমত। এর মাধ্যমে অংশীবাদীতা নিপাত করা হয় এবং সম্মানিত করা হয় ইসলামকে। এ কথার পরিপ্রেক্ষিতে ইমাম আবু হানিফা বলেছেন, শাসক বা অধিনায়ক ছাড়া বন্দীকে হত্যা করার অধিকার অন্য কারো নেই। প্রয়োজনবোধে কেবল শাসকই যুদ্ধবন্দীকে হত্যার নির্দেশ দিতে পারেন। তবে কেউ যদি অতর্কিতে কোনো যুদ্ধবন্দীকে হত্যা করে ফেলে তবে এর জন্য তাকে রক্তপণ দিতে হবে না।

এবারে আসুন দেখি, ইসলামের বিধান অনুসারে যুদ্ধবন্দীদের হত্যা করাটি উত্তম আমল নাকি তাদের মুক্তিপণের বিনিময়ে ছেড়ে দেয়া উত্তম আমল সেটি [20]

অথবা ফিদিয়া— যে কোনো একটিকে আপনি গ্রহণ করতে পারবেন। কিন্তু ফিদিয়া গ্রহণ করলে প্রতি বন্দীর পরিবর্তে আপনার দলের একজন মৃত্যুবরণ করবে। রসুল স. এ কথা সাহাবীগণকে জানালেন। সাহাবীগণ বললেন, হে আল্লাহর রসুল! বন্দীরা আমাদেরই স্বজন। তাদেরকে ফিদিয়ার বিনিময়ে মুক্ত করে দিলে ফিদিয়ার অর্থে আমরা সমর-সরঞ্জাম বৃদ্ধি করতে পারবো। আর তাদের একজনের বদলে আমাদের একজন যদি শহীদও হয়, তবুও তা আমাদের নিকট অপছন্দনীয় নয়। তাই হয়েছিলো। বদরের সত্তরজন যুদ্ধবন্দীর বদলে উহুদ যুদ্ধে শহীদ হয়েছিলেন সত্তরজন সাহাবী। জ্ঞাতব্যঃ কাযী আবুল ফজল আয়ায তাঁর আশিফা গ্রন্থে লিখেছেন, হত্যা ও মুক্তিপণ গ্ৰহণ— দু’টোই ছিলো বৈধ। তবে হত্যা ছিলো উত্তম এবং মুক্তিপণ গ্রহণের মাধ্যমে বন্দী মুক্তির ব্যাপারটি ছিলো অনুত্তম। রূপকার্থে তাই মুক্তিপণ গ্রহণ করাকে অন্যায় বলা হয়েছে। নির্দেশনাটি ছিলো এ রকম- উত্তম আমল গ্রহণ করাই সমীচীন। তিবরানীও এ রকম বলেছেন। হজরত ওমর এবং হজরত সা’দ গ্রহণ করেছিলেন উত্তম আমলটি। তাই রসুল স. বলেছিলেন, আযাব এলে ওমর ও সা’দ ছাড়া আর কেউ বাঁচতে পারতো না। কিন্তু তকদীরের নির্ধারণ ছিলো আযাব আসবে না। তাই আযাব আসেনি। দাউদ জাহেরী বলেছেন, পূর্বাহ্নে ফিদিয়াকে নিষেধ করা হয়নি। নিষেধ করা হলেও এ কথা বলা যেতো না যে রসুল স. আল্লাহ্র নিষেধের বাইরে কোনো কাজ করেন। এ রকম করা তাঁর পক্ষে অসম্ভব। তাই বলা হয়েছে ‘আল্লাহ্র পূর্ব বিধান না থাকলে’। এভাবে বলে বরং রসুল স. কে সম্মানিতই করা হয়েছে। প্রকাশ করা হয়েছে আল্লাহ্র প্রতি রসুল স. এর একনিষ্ঠ আনুগত্যকে। বাগবী লিখেছেন, এই আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার পর থেকে সাহাবীগণ ফিদিয়ার অর্থ গ্রহণের প্রতি তাঁদের আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। তখন অবতীর্ণ হয় নিম্নের আয়াত। সুরা আনফালঃ আয়াত ৬৯ فكلوا مماغيمة حللاطباء واتقوا الله إن الله غفورة حيم b → যুদ্ধে যাহা তোমরা লাভ করিয়াছ তাহা বৈধ ও উত্তম বলিয়া ভোগ কর ও আল্লাহ্কে ভয় কর, আল্লাহ্ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। আলোচ্য আয়াতের মর্মার্থ হচ্ছে– হে বিশ্বাসীগণ! গণিমত ও ফিদিয়া হিসাবে যুদ্ধের মাধ্যমে তোমাদের যা কিছু অর্জিত হয়, তা তোমরা ভক্ষণ করতে এবং ব্যবহার করতে পারবে। এটা তোমাদের জন্য মোবাহ্ (বৈধ)। তবে তোমাদের অন্তরে সর্বদা জাগরুক রাখতে হবে আল্লাহর ভয়। এ কথাও মনে রাখতে হবে যে আল্লাহ্ ক্ষমাপরবশ ও পরম দয়ার্দ্র। তাফসীরে মাযহারী/২০৭

মদিনার তিনটি ইহুদি গোত্র

মদিনার আশেপাশে সেই সময়ে বেশ কয়েকটি ইহুদি গোত্র ছিল, যাদের মধ্যে প্রধান ছিল বনু কায়নুকা, বনু নাদির এবং বনু কুরাইজা। মুহাম্মদ প্রথমে বনু কায়নুকা গোত্রকে আক্রমণ করে, এরপর বনু নাদির এবং এরপরে বনু কুরাইজা গোত্রকে। এই সময়ক্রম বা টাইমলাইনটি বোঝা অত্যন্ত জরুরি এই কারণে যে, বনু নাদির গোত্রকে আক্রমণের মাঝখানে মুহাম্মদ হুট করে কোন কারণ ছাড়াই বানু কুরাইজা গোত্রকেও আক্রমণ করে বসেছিল। আসুন এই আক্রমণগুলোর সময়ক্রম দেখে নেয়া যাকঃ

ঘটনাসময়কালদলিল
নবী মদিনায় আগমন করলেন৬২২ সালের ২১ জুন হতে ২ জুলাইয়ের মধ্যে। নবী মুহাম্মাদ মক্কা থেকে মদীনায় হিজরত করলেন
ইহুদিদের সাথে চুক্তিমদিনার ইহুদি গোত্রগুলোর সাথে চুক্তি সম্পাদন। ইহুদি গোত্রগুলো ছিল মূলত আল খাজরাজ এবং আল আউস ভুক্ত। আল খাজরাজ ভুক্ত গোত্রগুলো হচ্ছে বনু আউফ, বনু সাইদা, বনু আল-হারিস, বনু জুশাম, বনু আল নাজ্জার। এবং আল আউসভুক্ত গোত্রগুলো হচ্ছে, বনু আমর ইবনে আউফ, বনু আল নাবিত, বনু আল আউস। এছাড়া আরও চুক্তি করেছিল বনু সালাবা, সালাবার আরেকটি গোত্র জাফনা, বনু আল শুতায়বা।[21] [22]
বদরের যুদ্ধ১৭ মার্চ ৬২৪ খ্রিষ্টাব্দ। বদরের যুদ্ধে বিজয় লাভের পরেই মুসলিমদের আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি পায় এবং তারা ইহুদিদের ইসলাম গ্রহণের আহবান জানিয়ে বলে, দ্রুত ইসলাম গ্রহণ না করলে বদরের মত বিপর্যয় ইহুদিদের ভাগ্যেও ঘটবে।[23]
বনু কায়নুকা আক্রমণএপ্রিল ৬২৪ খ্রিষ্টাব্দ। পেশায় কর্মকার, স্বর্ণকার ও তৈজসপত্র নির্মাতা বনু কায়নুকা গোত্রকে মুহাম্মদ ও মুসলিম বাহিনী আক্রমণ করে একজন মুসলিম নারীকে লাঞ্ছিত করার অভিযোগে।[24]
বানু নাদিরের নিমন্ত্রণবনু নাদির গোত্রের প্রধানগণ নবী মুহাম্মদ ও তার সাহাবীদের নিমন্ত্রণ করেছিল আলোচনার উদ্দেশ্যে, যেন নবী সেখানে গিয়ে তার নবী হওয়ার প্রমাণ দেন। অর্থাৎ নবীর পরীক্ষা নেবেন, তাদের পক্ষের তিশজন ইহুদি রাবাইকে নিয়ে এসে। নবী সেখানে গেলেন তার সাহাবীগণ সহ। রাতের বেলা হঠাৎ তিনি সেখান থেকে উঠে কাউকে কিছুই না বলে চলে আসলেন। অর্থাৎ ইহুদিদের রাবাইদের কাছে নবী হওয়ার পরীক্ষা তিনি দিলেন না। অন্য সাহাবীগণ অনেকক্ষণ অপেক্ষা করলেন, এরপরে আরেকজনার কাছ থেকে শুনলেন নবী মদিনা চলে গেছেন। তারা মদিনা ফিরে আসলেন। ফিরে আসার পরে জানতে পারলেন, নবীকে নাকি জিব্রাইল এসে বলেছে, তারা যেখানে বসে ছিল সেই ঘরের ছাদে কিছু লোক নবীকে হত্যা করার জন্য বসে ছিল। কিন্তু সেই লোকগুলো কেন নবীর সাহাবীদের হত্যা করলো না, কেন সাহাবীদের কেউই এরকম কাউকে দেখতে পেলেন না, নবীও বা কাউকে কিছু না বলে একা একা চলে আসলেন কেন, তার সম্পর্কে কিছুই জানা যায় না। অর্থাৎ এই বিশ্বাসঘাতকতার কথা শুধুমাত্র নবী একাই জানেন, যার কোন বাস্তব প্রমাণ নেই। [25]
বানু নাদির আক্রমণমে ৬২৫ খ্রিষ্টাব্দ বানু নাদির আক্রমণ। ইহুদি রাবাইদের কাছে নবী হওয়ার পরীক্ষা না দিয়ে রাতের বেলা আচমকা ফেরত চলে এসে তার পরেই নবী মুহাম্মদ তাদের ওপর আক্রমণ চালান।
বনু কুরাইজাকে আচানক আক্রমণএই সময়ে বনু নাদিরের সাথে নবী মুহাম্মদ ও তার সেনাবাহিনীর যুদ্ধ চলছিল। যুদ্ধের মধ্যেই তিনি বনূ নযীরকে বাদ দিয়ে বনূ কুরাইযার উপর আক্রমণ করেন এবং তাদের অঙ্গীকারবদ্ধ হতে বলেন। ফলে বনু কুরাইজা নবী মুহাম্মদের সাথে অঙ্গীকারবদ্ধ হতে বাধ্য হয় যে, তারা নবীকে সাহায্য করবে। এই অঙ্গীকার মোটেও ইচ্ছাকৃতভাবে ছিল না, জোরপুর্বক আচমকা আক্রমণের মাধ্যমে বাধ্য করা হয়েছিল।[26]
খন্দকের যুদ্ধজানুয়ারি – ফেব্রুয়ারি ৬২৭ খ্রিষ্টাব্দ। নবী মুহাম্মদ খন্দকের যুদ্ধ করেন।
বনু কুরাইজার দুর্গ অবরোধ এবং আক্রমণজানুয়ারি ৬২৭ খ্রিষ্টাব্দ। নবী মুহাম্মদ খন্দকের যুদ্ধে থেকে ফেরত এসে অস্ত্র ত্যাগ না করেই বনু কুরাইজা আক্রমণ করেন, কারণ সেই সময় নাকি জিব্রাইল এসে তাকে খবর দিয়েছে যে, বনু কুরাইজা বিশ্বাসঘাতকতা করেছে! যার বাস্তব কোন প্রমাণ নেই। তারা কাউকে হত্যাও করেনি, কাউকে আক্রমণও করেনি। ২৫ দিন তাদের দুর্গ অবরোধ করে রাখার পরে তারা আত্মসমর্পনে বাধ্য হয়।
মদিনা আগমন থেকে বনু কুরাইজা ঘটনাবলী

এবারে আসুন মানচিত্রটি আরেকবার দেখে নেয়া যাক,

বনু কায়নুকার ঘটনা

নবী মুহাম্মদ বনু কুরাইজা গোত্রে আক্রমণের আগে বেশ কিছুদিন ধরেই অজুহাত খুঁজছিলেন, একটি বড় ধরণের গণহত্যা চালাবার, যাতে তিনি ঐ অঞ্চলে ত্রাস সৃষ্টি করতে পারেন এবং সমস্ত আরব উপদ্বীপে যেন তার নাম আতঙ্ক হয়ে ছড়িয়ে যায়। তার অংশ হিসেবেই তিনি বেশ কয়েকটি ইহুদি গোত্রকে আক্রমণ করেন, উচ্ছেদ এবং বিতাড়িত করেন। এই ইহুদি গোত্রগুলোর একটি হচ্ছে বনু কায়নুকা গোত্র। এই বিষয়ে আলোচনার আগে আবদুল্লাহ ইবনে উবাই সম্পর্কে বলে নেয়া জরুরি। উবাই ছিলেন বনু খাজরাজ গোত্রের প্রধান এবং মদিনার একজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি, যিনি গোত্রে গোত্রে শত্রুতা মেটানোর জন্য তার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেন। কিন্তু নবী মুহাম্মদের মদিনায় আগমনে আবারো গোত্রে গোত্রে শত্রুতা বৃদ্ধি পায়। ইসলামের ইতিহাসেতাকে একজন মুনাফিক (ভণ্ড, প্রতারক) এবং মুনাফিকদের সর্দার হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।

ইহুদিদের বনু কাইনুকা গোত্র ছিল পেশায় কর্মকার, স্বর্ণকার ও তৈজসপত্র নির্মাতা। বদর যুদ্ধের কিছুদিন পর তাদের বাজারে এক মুসলিম মেয়ে এক ইহুদি স্বর্ণের দোকানে একটি কাজে গিয়েছিল। ঐ মুসলিম মহিলা যখন ঐ দোকানে গিয়েছিলেন তখন ঐ ইহুদি কর্মচারী মুসলিম মহিলাটির মুখ খুলতে বলে। কিন্তু মহিলাটি তার মুখ খুলতে রাজি না হওয়ায় মহিলাটি যখন স্বর্ণের দোকানের একটি চেয়ারে বসে, তখন ইহুদি কর্মচারীটি ওই মহিলার পোশাকে পেরেক মেরে চেয়ারের সাথে আটকে দেয়, ফলে উঠতে গিয়ে ঐ মহিলার জামা ছিঁড়ে সারা শরীর অনাবৃত হয়ে যায়। মুসলিম মহিলার আর্তনাদ শুনে এক মুসলিম পথচারী এটা দেখে খেপে গিয়ে ঐ ইহুদি কর্মচারীকে হত্যা করেন, এরপর ইহুদি কর্মচারীর পক্ষের কয়েকজন ইহুদি মিলে ঐ মুসলমানকে হত্যা করে ফেলে। এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে নবী মুহাম্মদ বনু কায়নুকা গোত্র আক্রমণ করেন। তার ইচ্ছে ছিল, এই অজুহাতে সমস্ত বনু কায়নুকা গোত্রকেই নিশ্চিহ্ন করে ফেলবেন। কিন্তু ঐ অপরাধটি যারা করেছে, তারা ছাড়া অন্যদের ওপর এই অপরাধের দায় চাপানো কতটা মানবিক ও যৌক্তিক, নাকি নৃশংসা এক যুদ্ধনেতার গণহত্যা চালাবার অজুহাত, তা পাঠকই সিদ্ধান্ত নেবেন। কিন্তু একজন মানবিক মানুষ মাত্রই বুঝবেন, কোন অপরাধ ঘটে থাকলে সেই অপরাধীদের চিহ্নিত করা, তাদের যথাযোগ্য শাস্তি দেয়া যেতে পারে। কিন্তু কিছু মানুষের অপরাধে গোটা গোত্রের ওপর নিধনযজ্ঞ, নারী শিশুদের গনিমতের মাল বানানো, সম্পত্তি সব দখল করা, এগুলো বড় ধরনের অন্যায় এবং অন্যায্য কাজ।

৬২৪ খ্রিস্টাব্দে নবী মুহাম্মদ ইহুদি গোত্র বানী কাইনুকার উপরে ১৫ দিন ব্যাপী একটি অবরোধ চালিয়েছিলেন। উপায় না দেখে বনু কাইনুকা গোত্রটি নিঃশর্তভাবে মুহাম্মদের বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছিল। মুহাম্মদ সেই গোত্রের সমস্ত প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষদের শিরশ্ছেদ করে তাদের নারী ও শিশুদের দাস বানাতে চেয়েছিলেন, যেন সমস্ত আরব উপদ্বীপে ত্রাস সৃষ্টি করা যায়। বনু কায়নূকার ঘটনার সময় মদিনার শক্তিশালী স্থানীয় নেতা ছিলেন খাজরাজ বংশের প্রধান আবদুল্লাহ বিন উবাই। তিনি ছিলেন অত্যন্ত উচ্চ মর্যাদার অধিকারী এবং মুহাম্মদের হিজরতের সময় মদিনার নেতা। মুহম্মদের উত্থানের সাথে তার প্রভাব ধীরে ধীরে হ্রাস পেতে থাকে। বনু কায়নুকার অবরোধের সময় আবদুল্লাহ বিন উবাই মুহাম্মদের গণহত্যার ইচ্ছেটি বুঝতে পারেন, এবং রক্তপিপাসু এই নবীকে জামার কলার ধরে এই গণহত্যা থেকে নিবৃত করেন। মুহাম্মদ রেগেমেগে প্রায় কালো হয়ে যান, কিন্তু আবদুল্লাহ বিন উবাই প্রায় জোর করেই মুহাম্মদকে বাধ্য করেন, যেন বনু কায়নুকাকে মুহাম্মদ নৃশংসভাবে জবাই করতে না পারে। এর থেকে বোঝা যায়, নবী মুহাম্মদের ইচ্ছে ছিল, বনু কায়নুকার সমস্ত পুরুষকে হত্যা করা এবং মেয়ে ও শিশুদের গনিমতের মাল বানানো। যার প্রমাণ পাওয়া যায় ইবনে হিশামের সীরাত গ্রন্থ থেকেই [27] [28]

আসিম ইবনে উমর ইবনে কাতাদার ভাষ্য অনুযায়ী ইহুদিদের মধ্যে বনু কায়নুকা প্রথম রাসুলের(সা.) সঙ্গে চুক্তি ভঙ্গ করে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। সেটি ঘটে বদর ও উহুদের মধ্যবর্তী সময়ে। রাসুল(সা.) তাদের অবরোধ করেন ও তারা আত্মসমর্পণ করে। আল্লাহ রাসুলকে (সা.) এমনি করে ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত করলে আবদুল্লাহ ইবনে উবাই তাঁর কাছে গিয়ে বলেছিল, ‘আমার লোকজনের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করবেন, হে মুহাম্মদ।’
রাসুল(সা.) তাকে পাত্তা দিলেন না। লোকটা আবার একই অনুরোধ করল। রাসুল(সা.) মুখ ফিরিয়ে নিলেন। তখন
লোকটা রাসুলের(সা.) কোর্তার কলার চেপে ধরল। রাগে রাসুলের(সা.) চেহারা কালো হয়ে গেল।
তিনি বললেন, ‘ছাড়ো বলছি, যেতে দাও আমাকে।’
‘না,
আল্লাহর কসম, যেতে দেব না, আগে বলুন তাদের সঙ্গে ভালো আচরণ করবেন, চার শ লোকের বর্ম নেই, তিনজন বর্মধারী, আমাকে আমার সব দুশমনের হাত থেকে রক্ষা করেছে। এক সকালে সবাইকে কেটে ফেলবেন আপনি?’
রাসুল(সা.) বললেন, “ঠিক আছে, আপনি নিয়ে যান ওদের।“

সিরাতে ইবনে হিশাম [29] গ্রন্থে এই বর্ণনাটি একটি ভিন্নভাবে পাওয়া যায় –

ফলে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে অবরোধ করে অনুকূল শর্তে আত্মসমর্পণে বাধ্য করেন। এভাবে আল্লাহর সাহায্যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে নতজানু করলে, আবদুল্লাহ ইবনে উবাই ইবনে সুলুল তাঁর কাছে এসে বললো, “হে মুহাম্মাদ, আমার মিত্রদের প্রতি সহৃদয় আচরণ করুন।” রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার এ কথার কোন উত্তর দিলেন না। সে আবার বললো, “হে মুহাম্মাদ, আমার মিত্রদের সাথে সদয় আচরণ করুন।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুখ ফিরিয়ে নিলেন। এবার সে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বর্মের পকেটে হাত ঢুকিয়ে দিলে তিনি বললেন, “আমাকে ছাড়।” এই সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এত ক্রুদ্ধ হন যে, তাঁর মুখমণ্ডল রক্তিম হয়ে যায়। অতঃপর তিনি তাকে বললেন, “আরে আমাকে ছাড় তো! ” সে বললো, “না, আমার মিত্রদের সাথে সদয় আচরণের নিশ্চয়তা আগে দিন, তারপর ছাড়বো। বিশ্বাস করুন, চারশো নাঙ্গামাথা যোদ্ধা এবং তিনশো বর্মধারী যোদ্ধা আমাকে সারা দুনিয়ার মানুষ থেকে নিরাপদ করে দিয়েছে। আর আপনি কিনা একদিনেই তাদেরকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে চাচ্ছেন। আমি তাদের ছাড়া এক মুহূর্তও নিরাপদ নই”। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “আচ্ছা, বেশ। ওদেরকে তোমার মর্জির ওপর ছেড়ে দিলাম।”

ইসলামের ইতিহাসে আবদুল্লাহ ইবনে উবাই একজন অত্যন্ত ঘৃণিত চরিত্র হিসেবে বিভিন্ন গ্রন্থে বর্ণিত আছে। কিন্তু যেই কাজের জন্য উবাইকে মুসলিমগণ আজ পর্যন্ত ঘৃণা করে, সেটি কিন্তু ছিল খুব মানবিক একটি কাজ। নবীর সামনে দাঁড়িয়ে নবীর একটি গণহত্যার বিরোধিতা করা এবং নবীকে গণহত্যা বন্ধ করতে থামানো সহজ কাজ ছিল না। কিন্তু ফলাফল হিসেবে তার ভাগ্যে জোটে মুনাফিকদের সর্দার নাম [30]

উপরের আলোচনা থেকে এটি স্পষ্ট যে, নবী মুহাম্মদ আসলে বনু কায়নুকা গোত্রের সকল পুরুষকে হত্যা করে তাদের জায়গাজমি দখল, নারী ও শিশুদের দাস বানাবার পরিকল্পনাই করেছিল। কিন্তু আবদুল্লাহ বিন উবাইয়ের কারণে মুহাম্মদের এই ইচ্ছাটি অপূর্ণই থেকে যায়। কিন্তু বনু কুরাইজা গোত্রের সময় তিনি আর ভুল করেন নি। তিনি দায়িত্ব এমন একজনকেই দিয়েছিলেন, যিনি আগে থেকেই বনু কুরাইজার প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করতেন। যার প্রমাণ আমরা কিছুক্ষণ পরেই পাবো।

বনু কুরাইজার বিশ্বাসঘাতকতা?

১৯৭১ সালে বাঙলাদেশে যখন পাক আর্মী গণহত্যা চালায়, তখন তারা এই গণহত্যাকে এই বলে জায়েজ করার চেষ্টা করেছিল যে, বাঙালি তাদের দ্বিজাতিতত্ত্বের ওপরে গঠিত পাকিস্তান রাষ্ট্রের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। তারা পাকিস্তানের সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে ভারতীয় চক্রান্তে কাজ করছে। সেই সময়ে পাক আর্মী যখন বাঙালি নিধনে যেতো, তাদের প্রিয় গালিই ছিল গাদ্দার বাঙালি! কিংবা গাদ্দার মুজিব! গণহত্যাকে জাস্টিফাই করার জন্য বেশিরভাগ সময়ই আসলে গণহত্যার শিকার জনগোষ্ঠী বা গোত্রটিকে জঙ্গি বা বিশ্বাসঘাতক হিসেবে চিহ্নিত করার চেষ্টা হয়। লক্ষ্য করলে দেখবেন, প্যালেস্টাইনে কিংবা কাশ্মীরে কিংবা মিয়ানমারেও যখন গণহত্যা চালানো হয়, সেখানেও ক্ষমতাসীনরা অন্যদের গাদ্দার বা বিশ্বাসঘাতক বলে, কিংবা জঙ্গি বা টেরোরিস্ট নাম দিয়ে হত্যা শুরু করে।

মুসলিম এপোলোজিস্টরাও সেই শুরু থেকেই, বনু কুরাইজা গণহত্যাকে জায়েজ করতে ঠিক একই কৌশল অবলম্বন করে গেছে। বনু কুরাইজা গোত্রকে গাদ্দার, বিশ্বাসঘাতক, জঙ্গি, রাষ্ট্রবিরোধী ইত্যাদি নানা অভিযোগে অভিযুক্ত করে গণহত্যাকে জাস্টিফাই করতে চেষ্টা করেছে। অথচ, প্যালেস্টাইনের নাগরিকদেরও কিন্তু ইসরাইল আর্মী ঠিক একই অভিযোগে অভিযুক্ত করে তাদের ভূমি দখল করে, তাদের হত্যা করে, সেই সময়ে মুসলিমরা তার ঠিকই প্রতিবাদ করে।

সবচাইতে দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, বনু কুরাইজা আসলে কী এমন বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল যে, তাদের সমূলে উচ্ছেদ করতে হলো, নারী এবং শিশুদের ক্রিতদাস বানাতে হলো, সেই বিশ্বাসঘাতকতাটি কী, এর দ্বারা মুসলিমরা কতখানি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, কতজন মুসলিম তাদের জঙ্গি হামলায় নিহত বা আহত হয়েছে, এর ঠিক কোন সদুত্তর তারা দিতে পারে না।

উল্টোদিকে দেখা যায়, মুহাম্মদের বিরোধী গ্রুপের নেতা আবু সুফিয়ান বনু কুরাইজা গোত্রে মুহাম্মদের আক্রমণের কিছুদিন আগেই বনু কুরাইজার কাছে সাহায্যের কামনা করেছিল, এবং বনু কুরাইজা আবু সুফিয়ানের বাহিনীকে সাহায্য করতে চায় নি। বনু কুরাইজা যদি মুহাম্মদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতাই করে থাকবে, তাহলে তাদের তো উচিৎ ছিল, আবু সুফিয়ানকে সাহায্য করা। নিচের রেফারেন্সটি ইবনে ইসহাকের গ্রন্থ থেকে নেয়া [31]

তারপর আবু সুফিয়ান বলল, ‘হে কোরাইশগণ, আমাদের শিবির পাকা নয়। ঘোড়া – উট সব মরে যাচ্ছে। বনু কুরাইজা ওয়াদা খেলাপ করেছে। তাদের সম্পর্কে গোলমেলে খবর কানে আসছে। এদিকে দেখতেই পাচ্ছ, প্রবল বাতাসে হাঁড়ি- পাতিল, আগুন, তাঁবু সব লন্ডভন্ড করে দিচ্ছে। তোমরা সব ভাগো, আমি চললাম। ‘

সেইসাথে, বনু কুরাইজা গোত্র কীভাবে কুরাইশদের সাহায্য করেছিল সেটিও এক বিরাট প্রশ্ন। নিচের মানচিত্রটি দেখুন। খন্দকের যুদ্ধের সময় যেই পরিখা খনন হয়, তা ভেদ করে বনু কুরাইজা গোত্র কুরাইশদের কীভাবে সাহায্য করলো? আবার সাথে সাথেই, নিজ দুর্গে ফিরেও গেল? যেখানে নবী মুহাম্মদ যুদ্ধ থেকে ফিরেই, কোন বিরতি না দিয়েই বনু কুরাইজা আক্রমণ করে? [32]

বিশ্বাসঘাতকতার প্রমাণ কী?

বনু কুরাইজা এবং বনু নাদিরের ওপর নবী মুহাম্মদ তার সৈন্যবাহিনী নিয়ে আক্রমণ পরিচালনা করেছিল বিশ্বাসঘাতকতার বদলা স্বরূপ। কিন্তু সেই বিশ্বাসঘাতকতার আসলে কি কোন বাস্তব প্রমাণ ছিল? নাকি শুধুমাত্র ফেরেশতা জিব্রাইল এসে নবীকে সেই বিশ্বাসঘাতকরার কথা জানিয়ে দিয়েছিল, যা আর কেউই দেখেনি বা শোনেনি! ইসলামের পক্ষের লোক নির্লজ্জের মত অনেকেই দাবী করেন যে, এই গোত্রগুলো বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল! অথচ এইসব গোত্রের বিশ্বাসঘাতকতার কোন বাস্তব প্রমাণই নেই। সবই ফেরেশতা জিব্রাইলের কাছ থেকে জানা, যেগুলোর সত্যতা যাচাই করার কোন উপায় নেই। এই গোত্রগুলো সেই আক্রমণের আগে না কোন মানুষ মেরেছিল, না নবীর কোন শারীরিক ক্ষতি করেছিল! আসুন প্রথমে বনু নাদিরের ওপর আক্রমণের কারণটি দেখি। বনু নাদির গোত্রের প্রধানগণ নবী মুহাম্মদ ও তার সাহাবীদের নিমন্ত্রণ করেছিল আলোচনার উদ্দেশ্যে। নবী সেখানে গেলেন তার সাহাবীগণ সহ। কিন্তু হঠাৎ তিনি সেখান থেকে উঠে চলে আসলেন। অন্য সাহাবীগণ অনেকক্ষণ অপেক্ষা করলেন, এরপরে আরেকজনার কাছ থেকে শুনলেন নবী মদিনা চলে গেছেন। তারা মদিনা ফিরে আসলেন। ফিরে আসার পরে জানতে পারলেন, নবীকে নাকি জিব্রাইল এসে বলেছে, তারা যেখানে বসে ছিল সেই ঘরের ছাদে কিছু লোক নবীকে হত্যা করার জন্য বসে ছিল। কিন্তু সেই লোকগুলো কেন নবীর সাহাবীদের হত্যা করলো না, কেন সাহাবীদের কেউই এরকম কাউকে দেখতে পেলেন না, নবীও বা কাউকে কিছু না বলে একা একা চলে আসলেন কেন, তার সম্পর্কে কিছুই জানা যায় না। অর্থাৎ এই বিশ্বাসঘাতকতার কথা শুধুমাত্র নবী একাই জানেন, যার কোন বাস্তব প্রমাণ নেই। এরপরেই বনু নাদিরের ওপর আক্রমণ চালানো হয় [33]

রাসূলুল্লাহ (সা) তখন তাদের একটি ঘরের দেয়ালের পাশে বসা ছিলেন। তারা বলল, কে আছে যে, ছাদে উঠে ওখান থেকে একটি পাথর ফেলে দিয়ে মুহাম্মাদকে হত্যা করে আমাদেরকে তাঁর হাত থেকে নিষ্কৃতি দেবে? আমর ইবন জাহহাশ এগিয়ে এসে বলল, আমি এ জন্যে প্রস্তুত আছ। সে মতে পাথর নিক্ষেপের উদ্দেশ্যে সে স্থানে উঠে । রাসূলুল্লাহ্ (সা) তখনও সেখানে একদল সাহাবীসহ বসা ছিলেন। তাদের মধ্যে ছিলেন হযরত আবু বকর (রা) উমর (রা) এবং আলী (রা)। ওদের দুরভিসন্ধি সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নিকট আসমানী সংবাদ এসে যায়। তিনি কাউকে কিছু না বলে উঠে পড়েন এবং মদীনার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। দীর্ঘক্ষণ ঘটনাস্থলে ফিরে না আসায় সাহাবীগণ তাঁর খোঁজে বের হন, মদীনার দিক থেকে আগত এক লোককে দেখে তাঁরা রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর কথা তাকে জিজ্ঞেস করে। সে ব্যক্তি বলেছিল যে, আমি তো তাঁকে মদীনায় প্রবেশ করতে দেখেছি। এ সংবাদ পেয়ে সাহাবীগণ সকলে মদীনায় ফিরে এলেন এবং রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নিকট সমবেত হলেন। তিনি ইয়াহুদীদের বিশ্বাসঘাতকতার কথা তাঁদেরকে অবহিত করলেন।

উপরের দলিলে দেখতে পালেন যে, মুহাম্মদ হুট করে তার নবুয়্যতের প্রমাণ না দিয়ে সেখান থেকে চলে আসেন। এবারে আসুন দেখা যাক, এর আগে পরে কী ঘটেছিল [26]

সুনান আবূ দাউদ (ইসলামিক ফাউন্ডেশন)
১৪/ কর, খাজনা, অনুদান ও প্রশাসনিক দায়িত্ব সম্পর্কে
পরিচ্ছেদঃ ১৬১. বনূ নযীরের ঘটনা সম্পর্কে।
২৯৯৪. মুহাম্মদ ইবন দাঊদ ইবন সুফইয়ান (রহঃ) ……. আবদুর রহমান ইবন কা’ব ইবন মালিক (রাঃ) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জনৈক সাহাবী হতে বর্ণনা করেছেন যে, কুরায়শ কাফিররা আবদুল্লাহ ইবন উবাই এবং তার মূর্তি-পূজক সাথীদের, যারা আওস ও খাযরাজ গোত্রের লোক, এ মর্মে পত্র লেখে, যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বদর যুদ্ধের আগে মদীনায় অবস্থান করছিলেনঃ তোমরা আমাদের সাথী (মুহাম্মদ) কে জায়গা দিয়েছ। এ জন্য আমরা আল্লাহ্‌র নামে শপথ করে বলছি, হয়তো তাঁর সাথে যুদ্ধ কর, নয়তো তাঁকে বের করে দাও। অন্যথায় আমরা সম্মিলিতভাবে আক্রমণ করে তোমাদের যোদ্ধাদের হত্যা করব এবং তোমাদের স্ত্রীদের আমাদের দখলে আনব।
আবদুল্লাহ ইবন উবাই এবং তার মূর্তিপূজারী সাথীরা এ খবর পাওয়ার পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সংগে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়। এ খবর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে পৌছবার পর তিনি তাদের সাথে সাক্ষাত করেন এবং বলেনঃ তোমরা কুরায়শদের নিকট হতে উত্তেজনা সৃষ্টিকারী চিঠি পেয়েছ, কিন্তু তা তোমাদের জন্য এত মারাত্মক নয়, যত না ক্ষতি তোমরা নিজেরা নিজেদের করবে। কেননা, তোমরা তো তোমাদের সন্তান-সন্ততি ও ভাইদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার সংকল্প করছ।
তারা যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে এরূপ কথা শুনলো, তখন তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লো। এ খবর কুরায়শ কাফিরদের কাছে পৌছলে তারা বদর যুদ্ধের পর ইয়াহুদীদের নিকট লিখলোঃ তোমরা ঘরবাড়ী ও দুর্গের অধিকারী। কাজেই তোমাদের উচিত আমাদের সাথী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে যুদ্ধ করা। অন্যথায় আমরা তোমাদের সাথে এরূপ করব, সেরূপ করব। আর আমাদের ও তোমাদের স্ত্রীদের মাঝে কোন পার্থক্য থাকবে না।
যখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে তারা এরূপ চিঠি পেল, তখন বনূ নযীরের ইয়াহুদীরা বিদ্রোহ ঘোষণা করলো এবং তারা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এ মর্মে অবহিত করে যে, আপনি আপনার সাথীদের থেকে ত্রিশজন নিয়ে আমাদের কাছে আসুন এবং আমাদের ত্রিশজন আলিম আপনার সংগে এক আলাদা স্থানে দেখা করবে। তারা আপনার কথা শুনবে, যদি তারা আপনার উপর ঈমান আনে এবং বিশ্বাস স্থাপন করে, তবে আমরা আপনার উপর ঈমান আনব।
পরদিন সকাল বেলা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদল সেনাবাহিনী নিয়ে তাদের উপর হামলা করেন এবং তাদের অবরোধ করে বলেনঃ আল্লাহ্‌র শপথ! তোমরা যতক্ষণ অঙ্গীকার না করবে, ততক্ষণ আমি তোমাদের ব্যাপারে নিশ্চিত নই। তখন তারা (ইয়াহুদীরা) অঙ্গীকার করতে অস্বীকার করে। ফলে তিনি সেদিন তাদের সাথে দিনভর যুদ্ধে রত থাকেন। পরদিন তিনি বনূ নযীরকে বাদ দিয়ে বনূ কুরাইযার উপর আক্রমণ করেন এবং তাদের অঙ্গীকারবদ্ধ হতে বলেন। ফলে তারা তাঁর সংগে অঙ্গীকারবদ্ধ হয়। তখন তিনি তাদের নিকট হতে প্রত্যাবর্তন করে পুনরায় বনূ নযীরকে অবরোধ করেন এবং তাদের সাথে ততক্ষণ যুদ্ধ করেন, যতক্ষণ না তারা দেশত্যাগে বাধ্য হয়।
বনূ নযীরের লোকেরা তাদের উটের পিঠে ঘরের দরজা, চৌকাঠ ইত্যাদি যে পরিমাণ মালামাল নেওয়া সম্ভব ছিল, তা নিয়ে যায়। এবার বনূ নযীরের খেজুরের বাগান রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অধিকারে আসে, যা আল্লাহ্‌ তা’আলা বিশেষভাবে প্রদান করেন। যেমন আল্লাহ্‌ বলেনঃ
وَمَا أَفَاءَ اللَّهُ عَلَى رَسُولِهِ مِنْهُمْ فَمَا أَوْجَفْتُمْ عَلَيْهِ مِنْ خَيْلٍ وَلاَ رِكَابٍ
অর্থাৎ আল্লাহ্‌ কাফিরদের মাল হতে যে সস্পদ তাঁর রাসূলকে প্রদান করেন, তা হাসিলের জন্য তোমরা তোমাদের ঘোড়া অথবা উট হাঁকাও নি, অর্থাৎ ঐ সম্পদ বিনা যুদ্ধে হাসিল হয়।
অতঃপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঐ মালের অধিকাংশই মুহাজিরদের মাঝে বণ্টন করে দেন এবং অভাবগ্রস্ত দু’জন আনসারকে তা হতে অংশ প্রদান করেন। এ দু’জন ছাড়া অন্য আনসার সাহাবীদের মাঝে এ মাল বিতরণ করা হয়নি। অবশিষ্ট মাল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জন্য সাদকা স্বরূপ ছিল, যা বনূ ফাতিমার নিয়ন্ত্রণে ছিল।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)

এবারে আসুন বনু কুরাইজার বিশ্বাসঘাতকতার প্রমাণ দেখি! এইখানেও একই ঘটনা। নবীকে জিব্রাইল এসে বনু কুরাইজার বিশ্বাসঘাতকতার কথাটি জানিয়ে দেয়, যার কারণে নবী তাদের ওপর আক্রমণ পরিচালনা করে! অর্থাৎ বাস্তব কোন প্রমাণ নেই, আছে শুধু জিব্রাইল নামক এক অলৌকিক ফেরেশতা, যাকে আর কেউ দেখে না বা যার কথা আর কেউ শোনে না, তার বক্তব্য [34]

এই প্রসঙ্গে আয়েশার একটি অতি বিখ্যাত হাদিস রয়েছে, যা পড়া সকলের জন্য জরুরি [35]

সহীহ বুখারী (ইসলামিক ফাউন্ডেশন)
অধ্যায়ঃ ৫২/ তাফসীর
পরিচ্ছেদঃ আল্লাহ্‌ তা’আলার বাণীঃ ترجئ من تشاء منهن وتؤوي إليك من تشاء ومن ابتغيت ممن عزلت فلا جناح عليك “তুমি তাদের মধ্যে যাকে ইচ্ছা তোমার কাছ থেকে দূরে রাখতে পার এবং যাকে ইচ্ছা তোমার কাছে স্থান দিতে পার। আর তুমি যাকে দূরে রেখেছ, তাকে কামনা করলে তোমার কোন অপরাধ নেই। ইবন আব্বাস (রাঃ) বলেন ترجئ দূরে রাখতে পার। أرجئه তাকে দূরে সরিয়ে দাও, অবকাশ দাও।
৪৪২৫। যাকারিয়া ইবনু ইয়াহ্ইয়া (রহঃ) … আয়িশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, যেসব মহিলা নিজকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে হেবাস্বরূপ ন্যাস্ত করে দেন, তাদের আমি ঘৃণা করতাম। আমি (মনে মনে) বলতাম, মহিলারা কি নিজেকে অর্পণ করতে পারে? এরপর যখন আল্লাহ্ তা’আলা এ আয়াত নাযিল করেনঃ “আপনি তাদের মধ্য থেকে যাকে ইচ্ছা আপনার কাছ থেকে দূরে রাখতে পারেন এবং যাকে ইচ্ছা আপনার নিকট স্থান দিতে পারেন। আর আপনি যাকে দূরে রেখেছেন, তাকে কামনা করলে আপনার কোন অপরাধ নেই।” তখন আমি বললাম, আমি দেখছি যে, আপনার রব আপনি যা ইচ্ছা করেন, তা-ই পূরণ করেন।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
বর্ণনাকারীঃ আয়িশা (রাঃ)

আদৌ কী কোন চুক্তি ছিল?

ইসলামের সপক্ষের লেখকগণ নানাভাবে ইনিয়ে বিনিয়ে বলার চেষ্টা করেন যে, বনু কুরাইজা চুক্তিভঙ্গকারী, বিশ্বাসঘাতক, তাই নবী তাদের উপযুক্ত শাস্তিই দিয়েছিল! অথচ, বনু কুরাইজার সাথে আদৌ নবীর কোন চুক্তি ছিল, সেরকম কোন শক্তিশালী প্রমাণই পাওয়া যায় না। যাদের সাথে চুক্তিই নেই, তারা কীভাবে চুক্তি ভঙ্গ করলো সেটিই প্রশ্ন। মুহাম্মদ মদিনা যাওয়ার পরে কয়েকটি ইহুদি গোত্রের সাথে চুক্তি করেছিল, এ কথার প্রমাণ মেলে। কিন্তু সর্বাধিক প্রাচীন সিরাত গ্রন্থগুলোতে চুক্তিবদ্ধ গোত্রগুলোর মধ্যে বনু কুরাইজার নাম পাওয়া যায় না। হাজার বছর পরে লিখিত কিছু সিরাত গ্রন্থে ( যেমন আল্লামা ইদ্রিস কান্ধলভি রচিত সিরাতুল মুস্তফা, যিনি ১৮৯৯ সালে জন্ম নেয়া একজন দেওবন্দ আলেম ) দাবী করা হয়, বনু কুরাইজা গোত্রের সাথে নাকি নবীর চুক্তি ছিল! অথচ প্রাচীন কোন সিরাত গ্রন্থে বনু কুরাইজার সাথে চুক্তির কোন দলিল মেলে না। আসুন দেখে, মদিনা যাওয়ার পরে যেই চুক্তিটি হয়েছিল এবং যাদের সাথে চুক্তি হয়েছিল তাদের বিবরণ দেখি সর্বাধিক প্রাচীন সিরাত গ্রন্থ ইবনে ইসহাকের সিরাত থেকে [21]

আসুন Alfred Guillaume অনূদিত The Life Of Muhammad, by Ibn Ishaq গ্রন্থ থেকেও এই অংশটি পড়ি [22]

তাহলে কিসের চুক্তি ছিল?

উপরের আলোচনা থেকে এটি স্পষ্ট যে, মুহাম্মদ মদিনায় আসার পরে বানু কুরাইজা গোত্র তার সাথে কোন ধরণের চুক্তি করেছিল, এরকম কোন প্রমাণ নেই। তাহলে বানু কুরাইজার সাথে কিসের অঙ্গীকার হয়েছিল? আসুন আমরা সেই প্রশ্নের উত্তর হাদিস থেকে খুঁজে দেখি। হাদিস থেকে জানা যায়, মুহাম্মদকে বনূ নযীর গোত্র নিমন্ত্রণ জানায়, তার নবুয়্যেত প্রমাণ দিয়ে যেতে। তারা মুহাম্মদকে এ মর্মে অবহিত করে যে, আপনি আপনার সাথীদের থেকে ত্রিশজন নিয়ে আমাদের কাছে আসুন এবং আমাদের ত্রিশজন আলিম আপনার সংগে এক আলাদা স্থানে দেখা করবে। তারা আপনার কথা শুনবে, যদি তারা আপনার উপর ঈমান আনে এবং বিশ্বাস স্থাপন করে, তবে আমরা আপনার উপর ঈমান আনব। মুহাম্মদ তাদের কাছে নিজের নবুয়্যতের প্রমাণ দিতে গিয়ে রাতের বেলা কোন কারণ ছাড়াই সেখান থেকে হুট করে চলে আসে। সেটার প্রমাণ আগে দেয়া হয়েছে। এরপরেই মুহাম্মদ বনূ নযীর বা বানু নাদির গোত্রকে আক্রমণ করে। তাদের সাথে যখন মুহাম্মদের সৈন্যরা পারছিল না, সেই সময়ে তারা আচানক কোন কারণ ছাড়াই বনু কুরাইজাকেও আক্রমণ করে বসে। বনু কুরাইজা গোত্র এই আক্রমণ থেকে নিজেদের রক্ষার জন্য অঙ্গীকার করে যে, মুহাম্মদের সৈন্যদের তারা আক্রমণ করবে না। আসুন হাদিস থেকে দেখে নেয়া যাক [26]। পাঠক লক্ষ্য করে পড়ুন, বানু কুরাইজাকে আচানক আক্রমণের কিন্তু কোন কারণই ছিল না।

সুনান আবূ দাউদ (ইসলামিক ফাউন্ডেশন)
১৪/ কর, খাজনা, অনুদান ও প্রশাসনিক দায়িত্ব সম্পর্কে
পরিচ্ছেদঃ ১৬১. বনূ নযীরের ঘটনা সম্পর্কে।
২৯৯৪. মুহাম্মদ ইবন দাঊদ ইবন সুফইয়ান (রহঃ) ……. আবদুর রহমান ইবন কা’ব ইবন মালিক (রাঃ) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জনৈক সাহাবী হতে বর্ণনা করেছেন যে, কুরায়শ কাফিররা আবদুল্লাহ ইবন উবাই এবং তার মূর্তি-পূজক সাথীদের, যারা আওস ও খাযরাজ গোত্রের লোক, এ মর্মে পত্র লেখে, যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বদর যুদ্ধের আগে মদীনায় অবস্থান করছিলেনঃ তোমরা আমাদের সাথী (মুহাম্মদ) কে জায়গা দিয়েছ। এ জন্য আমরা আল্লাহ্‌র নামে শপথ করে বলছি, হয়তো তাঁর সাথে যুদ্ধ কর, নয়তো তাঁকে বের করে দাও। অন্যথায় আমরা সম্মিলিতভাবে আক্রমণ করে তোমাদের যোদ্ধাদের হত্যা করব এবং তোমাদের স্ত্রীদের আমাদের দখলে আনব।
আবদুল্লাহ ইবন উবাই এবং তার মূর্তিপূজারী সাথীরা এ খবর পাওয়ার পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সংগে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়। এ খবর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে পৌছবার পর তিনি তাদের সাথে সাক্ষাত করেন এবং বলেনঃ তোমরা কুরায়শদের নিকট হতে উত্তেজনা সৃষ্টিকারী চিঠি পেয়েছ, কিন্তু তা তোমাদের জন্য এত মারাত্মক নয়, যত না ক্ষতি তোমরা নিজেরা নিজেদের করবে। কেননা, তোমরা তো তোমাদের সন্তান-সন্ততি ও ভাইদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার সংকল্প করছ।
তারা যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে এরূপ কথা শুনলো, তখন তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লো। এ খবর কুরায়শ কাফিরদের কাছে পৌছলে তারা বদর যুদ্ধের পর ইয়াহুদীদের নিকট লিখলোঃ তোমরা ঘরবাড়ী ও দুর্গের অধিকারী। কাজেই তোমাদের উচিত আমাদের সাথী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে যুদ্ধ করা। অন্যথায় আমরা তোমাদের সাথে এরূপ করব, সেরূপ করব। আর আমাদের ও তোমাদের স্ত্রীদের মাঝে কোন পার্থক্য থাকবে না।
যখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে তারা এরূপ চিঠি পেল, তখন বনূ নযীরের ইয়াহুদীরা বিদ্রোহ ঘোষণা করলো এবং তারা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এ মর্মে অবহিত করে যে, আপনি আপনার সাথীদের থেকে ত্রিশজন নিয়ে আমাদের কাছে আসুন এবং আমাদের ত্রিশজন আলিম আপনার সংগে এক আলাদা স্থানে দেখা করবে। তারা আপনার কথা শুনবে, যদি তারা আপনার উপর ঈমান আনে এবং বিশ্বাস স্থাপন করে, তবে আমরা আপনার উপর ঈমান আনব।
পরদিন সকাল বেলা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদল সেনাবাহিনী নিয়ে তাদের উপর হামলা করেন এবং তাদের অবরোধ করে বলেনঃ আল্লাহ্‌র শপথ! তোমরা যতক্ষণ অঙ্গীকার না করবে, ততক্ষণ আমি তোমাদের ব্যাপারে নিশ্চিত নই। তখন তারা (ইয়াহুদীরা) অঙ্গীকার করতে অস্বীকার করে। ফলে তিনি সেদিন তাদের সাথে দিনভর যুদ্ধে রত থাকেন। পরদিন তিনি বনূ নযীরকে বাদ দিয়ে বনূ কুরাইযার উপর আক্রমণ করেন এবং তাদের অঙ্গীকারবদ্ধ হতে বলেন। ফলে তারা তাঁর সংগে অঙ্গীকারবদ্ধ হয়। তখন তিনি তাদের নিকট হতে প্রত্যাবর্তন করে পুনরায় বনূ নযীরকে অবরোধ করেন এবং তাদের সাথে ততক্ষণ যুদ্ধ করেন, যতক্ষণ না তারা দেশত্যাগে বাধ্য হয়।
বনূ নযীরের লোকেরা তাদের উটের পিঠে ঘরের দরজা, চৌকাঠ ইত্যাদি যে পরিমাণ মালামাল নেওয়া সম্ভব ছিল, তা নিয়ে যায়। এবার বনূ নযীরের খেজুরের বাগান রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অধিকারে আসে, যা আল্লাহ্‌ তা’আলা বিশেষভাবে প্রদান করেন। যেমন আল্লাহ্‌ বলেনঃ
وَمَا أَفَاءَ اللَّهُ عَلَى رَسُولِهِ مِنْهُمْ فَمَا أَوْجَفْتُمْ عَلَيْهِ مِنْ خَيْلٍ وَلاَ رِكَابٍ
অর্থাৎ আল্লাহ্‌ কাফিরদের মাল হতে যে সস্পদ তাঁর রাসূলকে প্রদান করেন, তা হাসিলের জন্য তোমরা তোমাদের ঘোড়া অথবা উট হাঁকাও নি, অর্থাৎ ঐ সম্পদ বিনা যুদ্ধে হাসিল হয়।
অতঃপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঐ মালের অধিকাংশই মুহাজিরদের মাঝে বণ্টন করে দেন এবং অভাবগ্রস্ত দু’জন আনসারকে তা হতে অংশ প্রদান করেন। এ দু’জন ছাড়া অন্য আনসার সাহাবীদের মাঝে এ মাল বিতরণ করা হয়নি। অবশিষ্ট মাল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জন্য সাদকা স্বরূপ ছিল, যা বনূ ফাতিমার নিয়ন্ত্রণে ছিল।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)

চুক্তি ভঙ্গ কী গণহত্যাকে জায়েজ করে?

বাঙলায় একটি প্রবাদ আছে যে, দুষ্টের ছলের অভাব হয় না। ইসলামিক এপোলোজিস্টরা বনু কুরাইজা গোত্রের ওপর যেই গণহত্যা চালায়, তাকে জায়েজ করতে বনু কুরাইজা গোত্রের চুক্তি ভঙ্গের কথা বারবার ব্যবহার করেন। তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নিই, বনু কুরাইজা চুক্তি ভঙ্গ করেছিল, কিন্তু সেটিও কী একটি গোটা গোত্রের সকল সাবালক পুরুষকে হত্যা, নারী ও শিশুদের যৌনদাসী এবং ক্রীতদাস বানানোকে জায়েজ করতে পারে?

কাশ্মীরে যখন ভারতীয় সেনাবাহিনী হত্যাকাণ্ড চালায়, ভারতীয় সংবিধান লঙ্ঘন কিংবা চুক্তি ভঙ্গের নাম দিয়ে, সেটিও তো তাহলে জায়েজ হয়ে যায়। কিংবা ধরুন, ততকালীন পূর্ব পাকিস্তান বা আধুনিক বাঙলাদেশে পাক আর্মি যখন গণহত্যা চালায়, দেশের স্বার্বোভৌমত্ব রক্ষার নাম দিয়ে, কিংবা পাকিস্তানের সাথে আমাদের চুক্তি ভঙ্গের নাম দিয়ে, তাহলে তো সেটিও জায়েজ হয়ে যায়। সত্য হচ্ছে, এগুলো খুবই সস্তা এবং খোড়া অজুহাত, যা একইসাথে অমানবিকও বটে। এই ধরণের অজুহাত কোন অবস্থাতেই এই ধরণের কাজকে জায়েজ করতে পারে না।

নারী ও শিশুদের হাহাকার

বনু কুরাইজা গোত্রের সাথে সাথে নবী মুহাম্মদের কী করার পরিকল্পনা, সেটি নবী মুহাম্মদেরই এক অনুসারী আবূ লূবাবা ফাঁস করে দিয়েছিলেন। বনু কুরাইজা গোত্রকে ২৫ দিন অবরোধ করে রাখার পরে আবূ লূবাবাকে তিনি পাঠিয়েছিলেন বনু কুরাইজার দূর্গে। সেখানে ঢোকার পরেই বুকফাটা কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। তারা আবূ লূবাবার কাছে নিজেদের অসহায়ত্বের কথা জানাতে থাকে। নবী মুহাম্মদের অনুসারী হওয়ার পরেও নারী শিশুদের সেই কান্না দেখে মন গলে যায় আবূ লূবাবার। তিনি ইঙ্গিতে তাদের জানিয়ে দেন, আত্মসমর্পন করলে তাদের হত্যা করা হবে। নবী মুহাম্মদ সেই পরিকল্পনা করেই এসেছেন। [36] [37]

যখন আবূ লুবাবা সেখানে উপস্থিত হল তখন পুরুষগণ তাকে দেখে দৌঁড়ে তার নিকট এল এবং শিশু ও মহিলাগণ করুন কণ্ঠে ক্রন্দন শুরু করল। এ অবস্থা প্রত্যক্ষ করে আবূ লুবাবার অন্তরে ভাবাবেগের সৃষ্টি হল। ইহুদীগণ বলল, ‘আবূ লুবাবা! আপনি কি যুক্তিযুক্ত মনে করেছেন যে, বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য আমরা মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর নিকট অস্ত্রশস্ত্র সমর্পণ করি?’
বলল, ‘হ্যাঁ’, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে হাত দ্বারা কণ্ঠনালির দিকে ইঙ্গিত করল, যার অর্থ ছিল হত্যা। 

পূর্বেই নেয়া নবীর গোপন সিদ্ধান্ত

ক্ষমতাশালী হলেই যে নবী মুহাম্মদ ইহুদিদের কচুকাটা করবেন, সেই ইঙ্গিত নবী ও তার সাহাবীগণ বহু আগে থেকেই দিয়ে আসছিলেন। বদর যুদ্ধের পরে নবীর সাহাবীগণ ইহুদিদের বলে, দ্রুত ইসলাম গ্রহণ না করলে তাদের অবস্থাও পৌত্তলিকদের মতই হবে। এই তথ্যটি জানা যায় ইবনে কাসীরের তাফসীর গ্রন্থ থেকে। একইসাথে আবু লুবাবা যে নবীর পুর্ব থেকে নেয়া গোপন সিদ্ধান্ত ইহুদিদের বলে দিয়েছিল, সেই সম্পর্কেও আয়াত নাজিল হয় [23]

উপরে আল্লামা সফিউর রহমান মোবারকপুরী এর লিখিত আর-রাহীকুল মাখতূম এবং ইবনে হিশামের সীরাতুন নবী (সা.) থেকে যেই দলিল দেয়া হয়েছে, যেখানে আবূ লুবাবা নবী মুহাম্মদের গোপন সিদ্ধান্তটি যে আগেই ইহুদিদের বলে দিয়েছিল, সেটি মুয়াত্তা মালিকের হাদিস গ্রন্থেও উল্লেখ রয়েছে। এ থেকে স্পষ্টভাবেই প্রমাণ হয় যে, বনু কুরাইজা গোত্রের ওপর গণহত্যা চালাবার সিদ্ধান্ত মুহাম্মদ আগেই নিয়ে রেখেছিলেন [36] [37] [38] [39]

মুয়াত্তা মালিক
২২. মানত ও কসম সম্পর্কিত অধ্যায়
পরিচ্ছেদঃ ৯. কসম সম্পৰ্কীয় বিবিধ আহকাম
রেওয়ায়ত ১৬. ইবন শিহাব (রহঃ) জ্ঞাত হইয়াছেন, আবু লুবাবা ইবন আবদুল মুনজির (রাঃ) এর তওবা যখন আল্লাহ্ তা’আলা কবুল করেন তখন তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামের নিকট আসিয়া আরয করিলেনঃ হে আল্লাহর রাসূল! আমার আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে আমি যেইখানে বাস করি, আমার যেই বাড়িটিতে আমি গুনাহ করিয়াছিলাম, যেইখানে আমার এই গুনাহ হইয়াছিল, উহা ত্যাগ করিয়া আপনার নিকট আসিয়া থাকিব কি? আর আল্লাহ ও তাহার রাসূলের ওয়াস্তে এই বাড়িটি সদকা করিব কি? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলিলেনঃ তোমার ধন-সম্পদের এক-তৃতীয়াংশ সদকা দিয়া দিলেই যথেষ্ট হইবে।[1]
[1] আবু লুবাবা (রাঃ) মদীনার ইহুদী বসতি বনু কুরায়যায় বসবাস করিতেন। ইহাদের সহিত মুসলিমদের যুদ্ধ শুরু হইলে ইনি মুসলিমদের তরফ হইতে আলোচনা করিতে যান এবং ইহাদের সহানুভূতিতে ইশারায় ইহাদের সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর গোপন সিদ্ধান্ত জানাইয়া দেন। পরে এই জন্য অত্যন্ত অনুতপ্ত হন এবং মসজিদে নববীর একটি স্তম্ভের সহিত নিজেকে বাঁধিয়া রাখেন ও বলেনঃ যতদিন আল্লাহ আমার এই গুনাহু মাফ না করিবেন ততদিন এই অবস্থায়ই আমি থাকিব। শুধু প্রশ্ৰাব-পায়খানার সময় তাহার স্ত্রী বাঁধন খুলিয়া দিতেন, পরে আবার বাঁধিয়া রাখিতেন। শেষে আল্লাহ তা’আলা তাহার ক্ষমার ঘোষণা করেন। তখন তিনি আনন্দে সকল কিছু সদকা করিয়া দিতে চাহিয়াছিলেন।
হাদিসের মানঃ তাহকীক অপেক্ষমাণ
বর্ণনাকারীঃ ইবনু শিহাব আয-যুহরী (রহঃ)

সা’দ ইবনু মুআয কে ছিলেন?

মুসলিমদের মধ্যে অনেকেই দাবী করেন, সা’দ ইবনু মুআয তো ইহুদিদেরই লোক ছিল! এই কথাটি সম্পুর্ণভাবেই মিথ্যা কথা। কে ছিলেন এই সা’দ? সা’দ ইবনু মুআয ছিলেন ইহুদি থেকে ধর্মান্তরিত একজন মুসলিম। তিনি কী ইহুদি গোত্র বনু কুরাইজার প্রতি সহানুভূতুশীল ছিলেন? নাকি শত্রুভাবাপন্ন ছিলেন? মুহাম্মদ তাকে এই কাজের দায়িত্ব কী জেনে বুঝে দিয়েছিলেন যে, একে দায়িত্ব দিলেই সা’দ সর্বোচ্চ নৃশংসতা দেখাবে? আসুন নিচের হাদিসগুলো পড়ি [40]

সূনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত)
১৯/ যুদ্ধাভিযান
পরিচ্ছেদঃ ২৯. সালিশ মেনে আত্মসমর্পণ
১৫৮২। জাবির (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, সা’দ ইবনু মুআয (রাঃ) আহযাব যুদ্ধের দিন তীরবিদ্ধ হয়ে আহত হন। এতে তার বাহুর মাঝখানের রগ কেটে যায়। তার ক্ষতস্থানে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আগুনের সেক দিয়ে রক্তক্ষরণ বন্ধ করেন। তারপর তার হাত ফুলে যায়। আগুনের সেঁক দেওয়া বন্ধ করলে আবার রক্তক্ষরণ হতে থাকে। আবার তিনি তার ক্ষতস্থানে আগুনের সেঁক দেন। তার হাত পুনরায় ফুলে উঠে। তিনি (সাদ) নিজের এ অবস্থা দেখে বলেন, ‘হে আল্লাহ। আমার জীবনকে কেড়ে নিও না বানু কুরাইযার চরম পরিণতি দেখে আমার চোখ না জুড়ানো পর্যন্ত।” তার জখম হতে সাথে সাথে রক্তক্ষরণ বন্ধ হয়ে গেল। এরপর আর একটি ফোটাও বের হয়নি।
সা’দ ইবনু মুআয (রাঃ)-কে তারা (বানু কুরাইযা) সালিশ মানতে রাজী হয়। তিনি (রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তার (সাদের) নিকট লোক পাঠালেন (সমাধানের জন্য)। তিনি সমাধান দিলেন যে, বানু কুরাইযা গোত্রের পুরুষদেরকে মেরে ফেলা হবে এবং মহিলাদেরকে বাচিয়ে রাখা হবে। মুসলমানগণ তাদের দ্বারা বিভিন্ন রকম কাজ আদায় করতে পারবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ তাদের ব্যাপারে তোমার মত সম্পূর্ণ আল্লাহ্ তা’আলার মতের অনুরূপ হয়েছে। তারা (পুরুষগণ) সংখ্যায় ছিল চার শত। লোকেরা তাদেরকে মেরে ফেলা সমাপ্ত করলে, তার ক্ষতস্থান হতে আবার রক্ত পড়া আরম্ভ হল এবং তিনি মৃত্যু বরণ করলেন।
সহীহ, ইরওয়া (৫/৩৮-৩৯)
আবূ সাঈদ ও আতিয়া আল-কুরায়ী (রাঃ) হতেও এ অনুচ্ছেদে হাদীস বর্ণিত আছে। এ হাদীসটিকে আবূ ঈসা হাসান সহীহ বলেছেন।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
বর্ণনাকারীঃ জাবির ইবনু আবদুল্লাহ আনসারী (রাঃ)

এখানে আরেকটি প্রশ্ন আসতে পারে যে, এই ঘটনার বিচারক কে নির্ধারণ করেছিলেন? বনু কুরাইজা গোত্র স্বেচ্ছায় তাকে বিচারক নির্বাচিত করেছিল, নাকি নবী মুহাম্মদ নিজেই বিচারক নির্ধারণ করেছেন? ইহুদি গোত্র বনু কুরাইজার কী মুহাম্মদ কর্তৃক নির্ধারিত এই বিচারককে মেনে নেয়া ছাড়া আর কোন উপায় ছিল? [41] [42]

সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)
৬৪/ মাগাযী [যুদ্ধ]
পরিচ্ছেদঃ ৬৪/৩১. আহযাব যুদ্ধ থেকে নাবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রত্যাবর্তন এবং তাঁর বনূ কুরাইযাহ অভিযান ও তাদেরকে অবরোধ।
৪১২২. ‘আয়িশাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, খন্দকের যুদ্ধে সা‘দ (রাঃ) আহত হয়েছিলেন। কুরাইশ গোত্রের হিববান ইবনু আরেকা নামক এক ব্যক্তি তাঁর উভয় বাহুর মধ্যবর্তী রগে তীর বিদ্ধ করেছিল। নিকট থেকে তার সেবা করার জন্য নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদে নাববীতে একটি তাঁবু তৈরি করেছিলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম খন্দকের যুদ্ধ থেকে ফিরে এসে যখন হাতিয়ার রেখে গোসল শেষ করলেন তখন জিব্রীল (আঃ) নিজ মাথার ধূলাবালি ঝাড়তে ঝাড়তে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে হাজির হলেন এবং বললেন, আপনি হাতিয়ার রেখে দিয়েছেন, কিন্তু আল্লাহর কসম! আমি এখনো তা রেখে দেইনি। চলুন তাদের দিকে। নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন কোথায়? তিনি বানী কুরাইযা গোত্রের প্রতি ইশারা করলেন। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বনু কুরাইযার মহল্লায় এলেন। অবশেষে তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ফায়সালা মান্য করে দূর্গ থেকে নিচে নেমে এল। কিন্তু তিনি ফয়সালার ভার সা‘দ (রাঃ)-এর উপর ন্যস্ত করলেন। তখন সা‘দ (রাঃ) বললেন, তাদের ব্যাপারে আমি এই ফায়সালা দিচ্ছি যে, তাদের যোদ্ধাদেরকে হত্যা করা হবে, নারী ও সন্তানদেরকে বন্দী করা হবে এবং তাদের ধন-সম্পদ বণ্টন করা হবে। বর্ণনাকারী হিশাম (রহ.) বলেন, আমার পিতা ‘আয়িশাহ (রাঃ) থেকে আমার কাছে বর্ণনা করেছেন যে, সা‘দ (রাঃ) আল্লাহর কাছে দু‘আ করেছিলেন, হে আল্লাহ! আপনি তো জানেন, আপনার সন্তুষ্টির জন্য তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ করার চেয়ে কোন কিছুই আমার কাছে অধিক প্রিয় নয়। যে সম্প্রদায় আপনার রাসূলকে মিথ্যাচারী বলেছে এবং দেশ থেকে বের করে দিয়েছে হে আল্লাহ! আমি মনে করি (খন্দক যুদ্ধের পর) আপনি তো আমাদের ও তাদের মধ্যে যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটিয়েছেন। যদি এখনো কুরায়শদের বিরুদ্ধে কোন যুদ্ধ বাকী থেকে থাকে তাহলে আমাকে বাঁচিয়ে রাখুন, যাতে আমি আপনার রাস্তায় তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ করতে পারি। আর যদি যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটিয়ে থাকেন তাহলে ক্ষত হতে রক্ত প্রবাহিত করুন আর তাতেই আমার মৃত্যু দিন। এরপর তাঁর ক্ষত থেকে রক্তক্ষরণ হয়ে তা প্রবাহিত হতে লাগল। মসজিদে বানী গিফার গোত্রের একটি তাঁবু ছিল। তাদের দিকে রক্ত প্রবাহিত হতে দেখে তারা বললেন, হে তাঁবুবাসীগণ! আপনাদের দিক থেকে এসব কী আমাদের দিকে আসছে? পরে তাঁরা জানলেন যে, সা‘দ (রাঃ)-এর ক্ষতস্থান থেকে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। এ জখমের কারণেই তিনি মারা যান, আল্লাহ তাঁর উপর সন্তুষ্ট থাকুন। [৪৬৩; মুসলিম ৩২/২২, হাঃ ১৭৬৯, আহমাদ ২৪৩৪৯] (আধুনিক প্রকাশনীঃ ৩৮১৬, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ৩৮২০)
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
বর্ণনাকারীঃ আয়িশা বিনত আবূ বাকর সিদ্দীক (রাঃ)

সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী)
৩৩। জিহাদ ও সফর
পরিচ্ছেদঃ ২২. যে ব্যক্তি চুক্তি ভঙ্গ করে তাকে হত্যা করা বৈধ হওয়া এবং দুর্গের অধিবাসীদের কোন ন্যায়পরায়ণ ক্ষমতা প্রদত্ত বিচারকের নির্দেশে অবতরণ বৈধ হওয়া
হাদিস একাডেমি নাম্বারঃ ৪৪৮৯, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ১৭৬৯
৪৪৮৯-(৬৫/১৭৬৯) আবূ বাকর ইবনু আবূ শাইবাহ ও মুহাম্মাদ ইবনু ‘আলা হামদানী (রহঃ) ….. আয়িশাহ (রাযিঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, খন্দকের যুদ্ধের দিন সা’দ (রাযিঃ) আঘাতপ্রাপ্ত হন। কুরায়শের ইবনুল আরিকা নামক এক ব্যক্তি তার শিরায় তীর নিক্ষেপ করেছিল। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সা’দ (রাযিঃ) এর জন্যে মসজিদে একটি তাবু স্থাপন করে দিলেন, যেন নিকট থেকে তাকে দেখাশোনা করা যায়। যখন তিনি (রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) খন্দকের যুদ্ধ থেকে ফিরে অস্ত্র রেখে সবেমাত্র গোসলের কাজ সমাপ্ত করেছেন এমন সময় জিবরাঈল (আঃ) স্বীয় মাথা থেকে ধূলিবালি ঝাড়তে ঝাড়তে আগমন করলেন।
এরপর বললেন, আপনি অস্ত্র রেখে দিয়েছেন? আল্লাহর শপথ! আমরা তো অস্ত্র রাখিনি। তাদের দিকে গমন করুন। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, কোন দিকে? তখন তিনি বানু কুরাইযার দিকে ইঙ্গিত করলেন। এরপর রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের সাথে যুদ্ধ করলেন। তারা রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নির্দেশে দূর্গ থেকে অবতরণ করলো। তারপর রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের বিচারের ভার (তাদের নেতা) সা’দ (রাযিঃ) এর উপর অর্পণ করলেন। সা’দ (রাযিঃ) বললেন, আমি নির্দেশ দিচ্ছি যে, তাদের মধ্যে যুদ্ধের উপযুক্ত (যুবক) লোকদেরকে হত্যা করা হোক, নারী ও শিশুদেরকে বন্দী করা হোক এবং তাদের সম্পদগুলো ভাগ করা হোক। (ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৪৪৪৬, ইসলামিক সেন্টার ৪৪৪৮)
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
বর্ণনাকারীঃ আয়িশা বিনত আবূ বাকর সিদ্দীক (রাঃ)

আল-লুলু ওয়াল মারজান
৩২/ জিহাদ
পরিচ্ছেদঃ ৩২/২২. চুক্তিবদ্ধ হওয়ার পর তা ভঙ্গকারীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা এবং ন্যায়নিষ্ঠ ব্যক্তির মধ্যস্থতায় দূর্গের লোকদের আত্মসমর্পণ করানো জায়িয।
১১৫৬. ‘আয়িশাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, খন্দকের যুদ্ধে সা’দ (রাঃ) আহত হয়েছিলেন। কুরাইশ গোত্রের হিব্বান ইবনু ইরকা নামক এক ব্যক্তি তার উভয় বাহুর মধ্যবর্তী রগে তীর বিদ্ধ করেছিল। নিকট থেকে তার সেবা করার জন্য নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদে নববীতে একটি তাঁবু তৈরি করেছিলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খন্দকের যুদ্ধ থেকে ফিরে এসে যখন হাতিয়ার রেখে গোসল শেষ করলেন তখন জিহ্বীল (আঃ) তার মাথার ধূলাবালি ঝাড়তে ঝাড়তে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে হাজির হলেন এবং বললেন, আপনি হাতিয়ার রেখে দিয়েছেন, কিন্তু আল্লাহর কসম! আমি এখনো তা রেখে দেইনি। চলুন তাদের প্রতি। নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন কোথায়? তিনি বানী কুরাইযা গোত্রের প্রতি ইশারা করলেন। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বনু কুরাইযার মহল্লায় এলেন। অবশেষে তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ফয়সালা মান্য করে দুর্গ থেকে নিচে নেমে এল। কিন্তু তিনি ফয়সালার ভার সা’দ (রাঃ)-এর উপর ন্যস্ত করলেন। তখন সা’দ (রাঃ) বললেন, তাদের ব্যাপারে আমি এই ফায়সালা দিচ্ছি যে, তাদের যোদ্ধাদেরকে হত্যা করা হবে, নারী ও সন্তানদেরকে বন্দী করা হবে এবং তাদের ধন-সম্পদ বণ্টন করা হবে।
সহীহুল বুখারী, পৰ্ব ৬৪ : মাগাযী, অধ্যায় ৩০, হাঃ ৪১২২; মুসলিম, পর্ব ৩২ ; জিহাদ, অধ্যায় ২২, হাঃ ১৭৬৯
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
বর্ণনাকারীঃ আয়িশা (রাঃ)

বিচারের নামে প্রহসন

ইবনে হিশামের প্রখ্যাত সীরাত গ্রন্থ থেকে জানা যায়, বনু কুরাইজার সাথে কী করা হবে তা ছিল পূর্ব নির্ধারিত। বিচার আগেই ঠিক করা হয়েছিল, কোন তথ্য প্রমাণ যাচাই বাছাই ছাড়াই। ৬০০-৯০০ মানুষের বিচার, চুলচেরা বিশ্লেষণ, কে অপরাধী কে নিরাপরাধ, এগুলো একই দিনে বিচার করে ফেলা অসম্ভব ব্যাপার। বিচার যেভাবে হয়, তা হচ্ছে, একপক্ষ থাকে অভিযোগকারী, আরেকপক্ষ অভিযুক্ত। অভিযোগকারী অভিযোগ করে, অভিযুক্ত তা খণ্ডন করে। এরপরে প্রাপ্ত তথ্য প্রমাণের ওপর ভিত্তি করে বিচারক সমস্ত তথ্যপ্রমাণের আলোকে বিচারিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। অথচ, এই ক্ষেত্রে বিচার আগে থেকেই নির্ধারিত হয়েছিল। কোন তথ্য প্রমাণ সাক্ষ্য যাচাই বাছাই ছাড়াই। আবু লুবাবার বক্তব্য থেকে যা একদমই পরিষ্কার। [43]

রাসুলুল্লাহ (সা) আবূ লুবাবাকে তাদের কাছে পাঠালেন। তাকে দেখামাত্র পুরুষগণ তাকে অভিভাদন জানাতে ছুটে আসল, আর নারী ও শিশুরা তার সামনে গিয়ে কেঁদে কেঁদে ফরিয়াদ জানাল। তাদের সে বুকফাটা কান্না দেখে তাঁর অন্তর গলে গেল। তারা বললঃ ‘হে আবূ লুবাবা। আপনি কি বলেন, আমরা কি মুহাম্মাদের নির্দেশমত দুর্গ থেকে নেমে আসব? তিনি বললেন, হ্যাঁ, সে সাথে গলদেশের দিকেও ইঙ্গিত করলেন, অর্থাৎ পরিণাম যবাই।

প্রহসনের বিচারের রায়

একটি বিচার প্রক্রিয়ায় সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, অভিযুক্ত গোষ্ঠী আত্মপক্ষ সমর্থনের যথেষ্ট সুযোগ পাচ্ছে কিনা, এবং বিচারের সিদ্ধান্ত সাক্ষ্য ও তথ্য প্রমাণ উপস্থাপন- সেগুলো যাচাই বাছাই করে তার ওপর ভিত্তি করে নেয়া নাকি সিদ্ধান্ত আগেই নিয়ে ফেলা! যদি এমন হয় যে, সিদ্ধান্ত আগেই নিয়ে তারপরে বিচারের প্রক্রিয়া শুরু করা হয়, তাহলে এই ধরণের বিচারকে প্রহসনের বিচারই বলতে হবে। একে কোন অবস্থাতেই সুবিচার বলা সম্ভব নয়। বনু কুরাইজা গোত্রের যেই বিচারের নামে প্রহসন হয়, তাতে বিচারের সিদ্ধান্ত আগেই নিয়ে নেয়া হয়েছিল। তাই একে কোনভাবেই বিচার বলা যায় না, বরঞ্চ সিদ্ধান্ত বলা যেতে পারে। নবী মুহাম্মদ এবং সা’দ ইবনু মুআয সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে, গোপনাঙ্গে যাদের চুল উঠেছে, সেই সকল পুরুষকে হত্যা করা হবে। এবং তাদের জায়গা জমি দখল করা হবে, তাদের নারী ও শিশুদের গনিমতের মাল হিসেবে ভাগাভাগি করে নেয়া হবে।

অর্থাৎ, বিচারের নামে যা হয়েছিল, সিদ্ধান্তটি এমন হয় নি যে, যারা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে যুক্ত আছে, তাদের শাস্তি দেয়া হবে! বরঞ্চ এটি হয়েছিল যে, গণহারে সকলকেই হত্যা করা হবে, এবং তা নির্ধারিত হবে কার গোপনাঙ্গে চুল উঠেছে তার ওপর ভিত্তি করে। যেই বাচ্চা ছেলেটির গোপনাঙ্গে মাত্র চুল ওঠা শুরু করেছে, সে কীভাবে এমন কোন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে যুক্ত থাকতে পারে? ইসলামিক এপোলোজিস্টরা প্রায়শই বলেন, এই বাচ্চারা বড় হলে মুসলিমদের সাথে হয়তো শত্রুতা করতো। তাই তাদের হত্যা করা জায়েজ বলেই তারা দাবী করেন। কিন্তু এক ধরণের কথা কতটা বর্বর এবং অসভ্য, তা নিশ্চয়ই বলে বোঝাতে হবে না। ইসরাইলের এক রাজনিতিবিদ একসময়ে বলেছিলেন, “প্যালেস্টাইনের সমস্ত মাকে হত্যা করা উচিৎ, যেন সেই মায়েরা টেরোরিস্ট জন্ম দিতে না পারে।” তার মানে, ঐ রাজনীতিবিদ ধরেই নিয়েছেন, প্যালেস্টাইনের মায়েরা বাচ্চা জন্ম দিলেই বাচ্চাগুলো বড় হয়ে জঙ্গি হবে! এবং সেই কারণে তাদের জন্মের আগেই মেরে ফেলতে হবে! কী ভয়াবহ অমানবিক কথা! [44] [45]

“They should die and their houses must be destroyed so that they do not give birth to terrorists.”

একজন মানুষ যতক্ষণ পর্যন্ত সরাসরি কোন অপরাধ না করে, ততক্ষণ পর্যন্ত তাদের শাস্তি দেয়া যায় না। এটি সকল স্থান কাল প্রেক্ষাপটে সরাসরি মানবতা বিরোধী। কোন শিশু বড় হলে অপরাধ করতে পারে, এরকম চিন্তা করে তাদের শাস্তি দেয়ার মত অমানবিক চিন্তা আর কিছু সম্ভবত নেই। কিন্তু এই কথাগুলো কেন যেন ধর্মীয় চিন্তার মানূষদের মাথায় ঢোকে না!

ইসরাইলের এই রাজনীতিবিদ Ayelat Shaked সেই সাথে বলেছিলেন, প্যালেস্টাইনের মায়েরা ছোট ছোট সাপের বাচ্চা জন্ম দিচ্ছে! তিনি সেই সাথে প্যালেস্টাইনের শিশুদেরও ছোট সাপ বলেও আখ্যায়িত করেছিলেন! এই কথাগুলো বলার পরে আমরা এই ধরণের বর্বর কথার তীব্র বিরোধীতা করেছিলাম। সেই সাথে মুসলিম বিশ্বও এই কথার প্রতিবাদ জানিয়েছিল। আসলেই, এই ধরনের কথা অত্যন্ত বর্বর, বর্বরতার সকল সীমা অতিক্রম করে ফেলা। কিন্তু এই একই ধরণের যুক্তি কিন্তু মুসলিম এপোলোজিস্টরাও দেন, তাদের গণহত্যাকে জায়েজ করতে! বলুন তো, প্যালেস্টাইনের শিশুরা ছোট ছোট বিষাক্ত সাপের মত, প্যালেস্টাইনের মায়েরা জঙ্গি জন্ম দেয়, তাই প্যালেস্টাইনের শিশু ও গর্ভবতী মায়েদের মেরে ফেলা উচিৎ, এই কথার সাথে, বনু কুরাইজা গোত্রের শিশুরা বড় হলে মুসলিমদের সাথে যুদ্ধ করবে, তাই গোপনাঙ্গে চুল গজানো সকল শিশু কিশোরকে হত্যা করতে হবে, এই কথা দুইটির মধ্যে পার্থক্য কী? আসুন নিচের হাদিসগুলো পড়ি [46] [47] [48] [49] [50]

সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত)
৩৩/ অপরাধ ও তার শাস্তি 
পরিচ্ছেদঃ ১৭. নাবালকের অপরাধের শাস্তি
৪৪০৪। আতিয়্যাহ আল-কুরাযী (রহঃ) সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি বনী কুরাইযার বন্দীদের অন্তর্ভুক্ত ছিলাম। তারা দেখতো, যার নাভীর নীচে চুল উঠেছে তাকে হত্যা করা হতো; আর যার উঠেনি, তাকে হত্যা করা হতো না। আর আমি তাদের অন্তর্ভুক্ত ছিলাম, যাদের তা উঠেনি।(1)
সহীহ।
(1). তিরমিযী, নাসায়ী, ইবনু মাজাহ।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
বর্ণনাকারীঃ আতিয়্যা কুরাযী (রাঃ)

সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত)
৩৩/ অপরাধ ও তার শাস্তি
পরিচ্ছেদঃ ১৭. নাবালকের অপরাধের শাস্তি
৪৪০৫। আব্দুল মালিক ইবনু উমাইর (রহঃ) সূত্রে অনুরূপ হাদীস বর্ণিত। আতিয়্যাহ (রাঃ) বলেন, তারা (মুসলিমরা) আমার নাভীর নীচ অনাবৃত করে দেখলো যে, চুল উঠেনি। সুতরাং তারা আমাকে বন্দীদের অন্তর্ভুক্ত করলো।(1)
সহীহ।
(1). এর পূর্বেরটি দেখুন।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)

সূনান আবু দাউদ (ইসলামিক ফাউন্ডেশন)
৩৩/ শাস্তির বিধান
পরিচ্ছেদঃ ১৭. নাবালেগ ছেলে শাস্তিযোগ্য অপরাধ করলে।
৪৩৫২. মুহাম্মদ ইবন কাছীর (রহঃ)….আতিয়া কুরাযী (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেনঃ আমি কুরায়যা গোত্রের বন্দীদের অন্তর্ভুক্ত ছিলাম, (যাদের হত্যার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল). সে সময় লোকেরা তদন্ত করে দেখছিল এবং যাদের নাভীর নীচে চুল উঠেছিল, তাদের হত্যা করা হচ্ছিল। আর আমি তাদের দলভুক্ত ছিলাম, যাদের তখনো নাভীর নীচে পশম উঠেনি। ফলে আমাকে হত্যা করা হয় নি।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
বর্ণনাকারীঃ আতিয়্যা কুরাযী (রাঃ)

সূনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত)
১৯/ যুদ্ধাভিযান
পরিচ্ছেদঃ ২৯. সালিশ মেনে আত্মসমর্পণ
১৫৮৪। আতিয়া আল-কুরায়ী (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, আমাদেরকে বানূ কুরাইযার যুদ্ধের দিন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে আনা হল। যাদের লজ্জাস্থানের লোম উঠেছে (বালেগদের) তাদেরকে হত্যা করা হল, আর যাদের তা উঠেনি (নাবালেগদের) তাদেরকে মুক্ত করে দেওয়া হল। আমার লজ্জাস্থানে তখনও লোম উঠেনি। একারণে আমাকে মুক্ত করে দেওয়া হল।
সহীহ, ইবনু মা-জাহ (২৫৪১)
এ হাদীসটিকে আবূ ঈসা হাসান সহীহ বলেছেন। এ হাদীস মোতাবিক একদল অভিজ্ঞ আলিম আমল করেছেন। তাদের মতে, যে লোকের বয়স এবং বীর্যপাতের ব্যাপারে সঠিকভাবে অনুমান করা না যাবে- তার নাভির নীচের লোম উঠাই বয়ঃপ্রাপ্তির লক্ষণ বলে গণ্য হবে। এই অভিমত দিয়েছেন ইমাম আহমাদ এবং ইসহাকও।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
বর্ণনাকারীঃ আতিয়্যা কুরাযী (রাঃ)

সুনানে ইবনে মাজাহ
১৪/ হদ্দ (দন্ড)
পরিচ্ছেদঃ ১৪/৪. যার উপর হদ্দ কার্যকর করা আবশ্যিক নয়
১/২৫৪১। আতিয়্যা আল-কুরাজী (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, বনূ কুরায়জাকে হত্যার দিন আমাদেরকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সামনে উপস্থিত করা হলো। যার (লজ্জাস্থানের) লোম গজিয়েছিল, তাকে হত্যা করা হলো এবং যার লোম গজায়নি তাকে রেহাই দেয়া হলো। আমি ছিলাম লোম না গজানোদের অন্তর্ভুক্ত, তাই আমাকে রেহাই দেয়া হয়।
হাদিসটি ইমাম ইবনু মাজাহ এককভাবে বর্ণনা করেছেন। বায়হাকী ফিস সুনান ৭/২৩৯, আল-হাকিম ফিল মুসতাদরাক ৪/৩৬৫, মিশকাত ৩৯৭৪। 
তাহকীক আলবানীঃ সহীহ।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
বর্ণনাকারীঃ আতিয়্যা কুরাযী (রাঃ)

আনন্দের সাথে জবাই উৎসব

সহিহ হাদিস থেকেই জানা যায় যে, নবী নিজে সেই এতগুলো মানুষের জবাইয়ের ঘটনা নিজে উপস্থিত থেকে তত্ত্বাবধান করেছেন গলা কেটেছেন। নবী মুহাম্মদের মিত্র বনু খাযরাজ গোত্রের লোকেরা সেই সময়ে খুব আনন্দের সাথে উদ্ভাসিত চেহারা নিয়ে মানুষ জবাইতে মেতে উঠেছিল। নবী সেটি লক্ষ্যও করেন যে, বনু খাযরাজ গোত্রের চেহারা আনন্দে উদ্ভাসিত! [51]

রায়ে নবী ও আল্লাহর প্রতিক্রিয়া

অনেক মুসলিমই বনু কুরাইজার ওপর চালানো গণহত্যাকে জায়েজ করার জন্য বলে থাকেন যে, “এই বিচারটি তো ইহুদিদের বিধান অনুসারে হয়েছিল! তাই এই গণহত্যায় মুসলিমদের কোন দায় নেই!” এরকম হাস্যকর কথা বলে যখন তারা এই গণহত্যাকে জায়েজ করতে চায়, তখন আসলে এরকম দাবী করা মানুষের সাথে আলোচনাটিও নিরর্থক হয়ে যায়। কারণ এসব যারা বলেন, তারা নিজেরাও ভালভাবেই জানেন, এগুলো একদমই মিথ্যা কথা। প্রথমত, এই শাস্তি এবং বিচার প্রক্রিয়া পুরোটাই মুসলিমদের তত্ত্বাবধানেই হয়েছিল। দ্বিতীয়ত, কোরআনেই আল্লাহ নবীকে নাজিলকৃত কিতাব অনুসারেই ফয়সালা করতে নির্দেশ দিয়েছেন। সেই অনুসারে ইহুদিদের সেই বিধানটিও আল্লাহরই বিধান। ইহুদিদের কিতাবের ঐ অংশটি যদি বিকৃত হয়ে থাকে, অর্থাৎ আল্লাহর নির্দেশ না হয়ে থাকে, তাহলে নবী কেন সেই বিকৃত কিতাবের অনুসরণ করবেন? [52]

আর আমি তোমার প্রতি কিতাব নাযিল করেছি যথাযথভাবে, এর পূর্বের কিতাবের সত্যায়নকারী ও এর উপর তদারককারীরূপে। সুতরাং আল্লাহ যা নাযিল করেছেন, তুমি তার মাধ্যমে ফয়সালা কর এবং তোমার নিকট যে সত্য এসেছে, তা ত্যাগ করে তাদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করো না। তোমাদের প্রত্যেকের জন্য আমি নির্ধারণ করেছি শরীআত ও স্পষ্ট পন্থা এবং আল্লাহ যদি চাইতেন, তবে তোমাদেরকে এক উম্মত বানাতেন। কিন্তু তিনি তোমাদেরকে যা দিয়েছেন, তাতে তোমাদেরকে পরীক্ষা করতে চান। সুতরাং তোমরা ভাল কাজে প্রতিযোগিতা কর। আল্লাহরই দিকে তোমাদের সবার প্রত্যাবর্তনস্থল। অতঃপর তিনি তোমাদেরকে অবহিত করবেন, যা নিয়ে তোমরা মতবিরোধ করতে।

এর চাইতে বড় কথা হচ্ছে, এই রায়ে আসলে নবী মুহাম্মদ এবং আল্লাহর সম্পূর্ণ সায় ছিল। এই রায়কে আল্লাহ বা নবী কেউই অমানবিক বলে মনে করেন নি, বরঞ্চ সমর্থন দিয়েছেন। আমরা ছোটবেলা থেকেই বিভিন্ন ইসলামিক বক্তার মুখে নবীর দয়া এবং করুনার যেসমস্ত কাল্পনিক গল্প শুনি, তার সাথে এই ঘটনার একেবারেই কোন মিল পাওয়া যায় না। বরঞ্চ এতবড় একটি গণহত্যার সিদ্ধান্ত নেয়ায় আল্লাহ এবং তার নবী খুবই খুশী ছিলেন [53]

সূনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত)
১৯/ যুদ্ধাভিযান
পরিচ্ছেদঃ ২৯. সালিশ মেনে আত্মসমর্পণ
১৫৮২। জাবির (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, সা’দ ইবনু মুআয (রাঃ) আহযাব যুদ্ধের দিন তীরবিদ্ধ হয়ে আহত হন। এতে তার বাহুর মাঝখানের রগ কেটে যায়। তার ক্ষতস্থানে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আগুনের সেক দিয়ে রক্তক্ষরণ বন্ধ করেন। তারপর তার হাত ফুলে যায়। আগুনের সেঁক দেওয়া বন্ধ করলে আবার রক্তক্ষরণ হতে থাকে। আবার তিনি তার ক্ষতস্থানে আগুনের সেঁক দেন। তার হাত পুনরায় ফুলে উঠে। তিনি (সাদ) নিজের এ অবস্থা দেখে বলেন, ‘হে আল্লাহ। আমার জীবনকে কেড়ে নিও না বানু কুরাইযার চরম পরিণতি দেখে আমার চোখ না জুড়ানো পর্যন্ত।” তার জখম হতে সাথে সাথে রক্তক্ষরণ বন্ধ হয়ে গেল। এরপর আর একটি ফোটাও বের হয়নি।
সা’দ ইবনু মুআয (রাঃ)-কে তারা (বানু কুরাইযা) সালিশ মানতে রাজী হয়। তিনি (রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তার (সাদের) নিকট লোক পাঠালেন (সমাধানের জন্য)। তিনি সমাধান দিলেন যে, বানু কুরাইযা গোত্রের পুরুষদেরকে মেরে ফেলা হবে এবং মহিলাদেরকে বাচিয়ে রাখা হবে। মুসলমানগণ তাদের দ্বারা বিভিন্ন রকম কাজ আদায় করতে পারবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ তাদের ব্যাপারে তোমার মত সম্পূর্ণ আল্লাহ্ তা’আলার মতের অনুরূপ হয়েছে। তারা (পুরুষগণ) সংখ্যায় ছিল চার শত। লোকেরা তাদেরকে মেরে ফেলা সমাপ্ত করলে, তার ক্ষতস্থান হতে আবার রক্ত পড়া আরম্ভ হল এবং তিনি মৃত্যু বরণ করলেন।
সহীহ, ইরওয়া (৫/৩৮-৩৯)
আবূ সাঈদ ও আতিয়া আল-কুরায়ী (রাঃ) হতেও এ অনুচ্ছেদে হাদীস বর্ণিত আছে। এ হাদীসটিকে আবূ ঈসা হাসান সহীহ বলেছেন।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
বর্ণনাকারীঃ জাবির ইবনু আবদুল্লাহ আনসারী (রাঃ)

সা’দ ইবনু মু’আয এই গণহত্যার রায় দেয়ায় আল্লাহ ও নবীর এতটাই প্রিয় হয়ে গিয়েছিলেন যে, তার মৃত্যুতে সেই কারণে আল্লাহর আরশ পর্যন্ত কেঁপে উঠেছিল!

সহীহ বুখারী (ইফাঃ)
অধ্যায়ঃ ৫০/ আম্বিয়া কিরাম (আঃ)
পরিচ্ছদঃ ২১২২. স্বাদ ইবন মু’আয (রাঃ) এর মর্যাদা
৩৫৩১। মুহাম্মদ ইবনু মূসান্না (রহঃ) … জাবির (রাঃ) বলেন, আমি নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে বলতে শুনেছি সা’দ ইবনু মু’আয (রাঃ) এর মৃত্যুতে আল্লাহ্ ত’আলার আরশ কেঁপে উঠে ছিল। আমাশ (রহঃ) … নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে অনুরূপ বর্ণিত হয়েছে, এক ব্যাক্তি জাবির (রাঃ) কে বলল, বারা ইবনু আযিব (রাঃ) তো বলেন, জানাযার খাট নড়েছিল। তদুত্তরে জাবির (রাঃ) বললেন, সা’দ ও বারা (রাঃ) এর গোত্রদ্বয়ের মধ্যে কিছুটা বিরোধ ছিল, (কিন্তু এটা ঠিক নয়) কেননা, আমি নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে عَرْشُ الرَّحْمَنِ অর্থাৎ আল্লাহর আরশ সা’দ ইবনু মু’আযের (মৃত্যুতে) কেঁপে উঠল বলতে শুনেছি।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)

সা’দ ইবনু মুআয এর মৃত্যুতে মুহাম্মদ এটিও বলেন যে [54]

‘আল্লাহর ফিরিশতাগণ তাঁর লাশ উত্তোলন করেছিলেন’

গনিমতের মাল বণ্টন

নবী মুহাম্মদের পরোক্ষ নির্দেশেই বনু কুরাইজা গোত্রের সকল সাবালক পুরুষকে হত্যা এবং নারী ও শিশুদের দাস বানাবার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। কিন্তু সেইসব দাসদের ভাগ্যে কী ঘটেছিল? তাদের কিছু অংশ নবী মুহাম্মদের নির্দেশেই বিক্রি করে সেই মূল্য দিয়ে অস্ত্র এবং ঘোড়া কিনেছিলেন নবী মুহাম্মদের অনুসারীরা- [55]

ইবনে ইসহাকের সিরাতে রাসুলাল্লাহ গ্রন্থে গনিমতের মাল ভাগাভাগির আরো পরিষ্কার বিবরণ পাওয়া যায়। সেখান থেকে জানা যায়, নবী মুহাম্মদ নিজের জন্য এক পঞ্চমাংশ রেখেছিলেন, এবং একজন নারীও নিয়েছিলেন [56]

[ ছাবিত ইবনে কায়েস এ সম্পর্কে বলেছেন:
আমার কর্তব্য শেষ, আমি উদারতা দেখিয়েছি,
অনেক চেষ্টা করেছি
অথচ বাকি সব ধৈর্যহারা হয়েছে
আমার ওপর জাবিরের সকলের চেয়ে বেশি দাবি
দড়ি দিয়ে হাত বাঁধা ছিল তার
তাকে মুক্ত করার জন্য রাসুলের (সা.) কাছে গেছি আমি।
তিনি ছিলেন আমাদের দয়ার সাগর । ]
রাসুলের (সা.) হুকুম ছিল, ওদের প্রাপ্তবয়স্ক সবাইকে যেন হত্যা করা হয়।
আতিয়া আল-কুরাজি সূত্রে আবদুল মালিক ইবনে উমায়র এবং তাঁর সূত্রে শুবা ইবনে আল-হাজ্জাজ আমাকে বলেছেন, বনু কুরাইজার সব প্রাপ্তবয়স্ক সদস্যকে হত্যা করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। আমি তখন নাবালক ছিলাম, কাজেই আমাকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল ।
আল-মুনজিরের জননী এবং সালিত ইবনে কায়েসের বোন সালমা বিনতে কায়েস ছিলেন রাসুলের
(সা.) খালা। রাসুলের (সা.) সঙ্গে তিনি জেরুজালেম ও মক্কা উভয় দিকে মুখ করে নামাজ পড়েছেন। বনু আদি ইবনে আল-নাজ্জারের ভাই আইউব ইবনে আবদুর রহমান আমাকে বলেছেন, সালমার আশ্রিত রিফা ইবনে সামাওয়াল প্রাপ্তবয়স্ক ছিলেন। তিনি রাসুলের (সা.) কাছে তাঁর প্রাণ ভিক্ষা চান। তিনি বলেন, সেই লোক কসম খেয়েছে, সে নামাজ পড়বে, উটের মাংস খাবে। রাসুল (সা.) তাঁর প্রার্থনা মঞ্জুর করেন।
বনু কুরাইজার সম্পত্তি ও স্ত্রী-ছেলেমেয়েদের রাসুল (সা.) মুসলমানদের মধ্যে ভাগবণ্টন করে দেন। উট ও মানুষের অংশ সেদিনই স্থির হয়। তিনি গ্রহণ করেন এক-পঞ্চমাংশ। একজন ঘোড়াওয়ালা তিন অংশ পেয়েছিল, ঘোড়ার জন্য দুই আর আরোহীর জন্য এক। বনু কুরাইজার দিকে মোট ঘোড়ার সংখ্যা ছিল ছত্রিশ। এই প্রথম যুদ্ধ-সম্পদের ওপর লটারি হয় এবং এক-পঞ্চমাংশ আলাদা রাখা হয়। এই নজির পরবর্তী সময়ের অন্যান্য যুদ্ধে অনুসরণ করা হয়।
রাসুল (সা.) নিজের জন্য নির্বাচিত করেছিলেন বনু আমর ইবনে কুরাইজার এক নারীকে। তার নাম রায়হানা বিনতে আমর ইবনে খুনাফা। তিনি আমৃত্যু তাঁর কর্তৃত্বের অধীন ছিলেন। রাসুল (সা.) তাঁকে বিয়ে করে পর্দানশিন করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু রায়হানা বলেছিলেন, ‘তার চেয়ে বরং আপনি আমাকে আপনার কর্তৃত্বের আওতায় রাখুন। সেটা আপনার-আমার উভয়ের জন্য সহজ হবে।’ বন্দী হওয়ার সময় তিনি ইসলামের প্রতি অশ্রদ্ধা প্রকাশ করেন এবং ইহুদি ধর্ম আঁকড়ে থাকেন। এতে রাসুল (সা.) নারাজ হন এবং তাঁকে আলাদা করে রাখেন। একদিন সাহাবিদের সঙ্গে বসে ছিলেন তিনি, তখন পেছনে চপ্পলের আওয়াজ হলো। তিনি বললেন, ‘ছালাবা ইবনে সাইয়া আসছে, রায়হানা ইসলাম গ্রহণ করেছে সেই সুখবর নিয়ে। ছালাবা সত্যিই সেই সুসংবাদ জ্ঞাপন করল। তিনি প্রীত হলেন। খন্দক ও বনু কুরাইজা বিষয়ে আল্লাহ সুরা আহজাবে তাদের বিচার, তাদের প্রতি অনুগ্রহ প্রদর্শন ও সাহায্যের কথা বলেছেন। তিনি বলেন, ‘হে বিশ্বাসীগণ, তোমরা তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহের কথা স্মরণ করো, যখন শত্রুবাহিনী তোমাদের বিরুদ্ধে সমাগত হয়েছিল এবং আমি তাদের বিরুদ্ধে বাতাস এবং অদৃশ্য সৈন্যবাহিনী প্রেরণ করেছিলাম। তোমাদের সব কাজের দ্রষ্টা আল্লাহ।’ শত্রুবাহিনী হচ্ছে কোরাইশ, গাতাফান ও বনু কুরাইজা। বাতাসের সঙ্গে প্রেরিত আল্লাহর বাহিনী ছিল ফেরেশতারা।
– ১. সুরা ৩৩।
– ৫০৬ ● সিরাতে রাসুলুল্লাহ (সা.)

রায়হানার গল্প

রায়হানা বিনতে শামউন বিন যায়িদ ছিলেন ইহুদি সম্প্রদায়ভূক্ত একজন নারী। তিনি পিতার দিক থেকে বনু নাদ্বীর গোত্রের এবং স্বামীর দিক থেকে বনু কুরায়জা গোত্রের মহিলা ছিলেন। বনু কুরায়জা গোত্রের আল-হাকাম ছিল উনার স্বামী। নবী মুহাম্মদ উনার পরিবারকে হত্যার পরে উনাকে দেখে মুগ্ধ হন এবং যথারীতি বিবাহের প্রস্তাব দেন। রায়হানা অত্যন্ত আত্মমর্যাদা সম্পন্ন নারী ছিলেন, তিনি উক্ত প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে বন্দীদশাকেই স্বেচ্ছায় গ্রহণ করেন বলেই জানা যায়। পরবর্তীতে তিনি ইসলাম গ্রহণ করে মুহাম্মদকে বিবাহ করেন বলেও কিছু কিছু সূত্র থেকে জানা যায়। তবে তিনি মুহাম্মদের যৌনদাসী বা রক্ষিতা হিসেবে ছিলেন বলেই অধিকাংশ আথেনটিক তথ্যসূত্র নিশ্চিত করে।

স্বজনশোকে পাগল এক নারীর গল্প

মুহাম্মদ যখন বাজারে শত শত মানুষকে লাইন ধরে দাড় করিয়ে জবাই করছিলেন, সেই সময়ে একজন নারী সম্ভবত, স্বজন হারাবার বেদনাতেই, পাগল হয়ে গিয়েছিলেন। তিনি অট্টহাসিতে ফেটে পড়ছিলেন আর নবীকে গালি দিচ্ছিল। সে জানতো, এই কারণে তাকেও হত্যা করা হবে, কিন্তু হাসতে হাসতেই তিনি মৃত্যুকে বেছে নিয়েছিলেন। যা দেখে আয়িশা নিতান্তই অবাক হয়ে যায়।

সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত)
৯/ জিহাদ
পরিচ্ছেদঃ ১২১. নারী হত্যা সম্পর্কে
২৬৭১। ‘আয়িশাহ (রাঃ) সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন, বনী কুরাইযার কোনো মহিলাকে হত্যা করা হয়নি। তবে এক মহিলাকে হত্যা করা হয়। সে আমার পাশে বসে কথা বলছিল এবং অট্টহাসিতে ফেটে পড়ছিলো। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বাজারে তাদের পুরুষদেরকে হত্যা করছিলেন। এমন সময় এক ব্যক্তি তার নাম ধরে ডেকে বললো, অমুক মহিলাটি কোথায়? সে বললো, আমি। আমি (‘আয়িশাহ) বললাম, তোমরা কি হলো, (ডাকছো কেন)? সে বললো, আমি যা ঘটিয়েছি সেজন্য (সে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে অশ্লীল ভাষায় গালি দিয়েছিলো)। ‘আয়িশাহ (রাঃ) বলেন, তাকে নিয়ে গিয়ে হত্যা করা হরো। আমি ঘটনাটি আজও ভুলতে পারিনি। আমি তার আচরণে অবাক হয়েছিলাম যে, তাকে হত্যা করা হবে একথা জেনেও সে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ছিলো।(1)
(1). হাসান।
হাদিসের মানঃ হাসান (Hasan)
বর্ণনাকারীঃ আয়িশা (রাঃ)

সূনান আবু দাউদ (ইসলামিক ফাউন্ডেশন)
৯/ জিহাদ
পরিচ্ছেদঃ ১৫. মহিলাদের হত্যা সম্পর্কে।
২৬৬২. ‘আবদুল্লাহ্ ইবন মুহাম্মদ নুফায়লী (রহঃ) ….. আয়িশাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, বনূ কুরাইযার মহিলাদের থেকে কোন মহিলাকে হত্যা করা হয়নি, কিন্তু একজন মহিলাকে (হত্যা করা হয়), যে আমার পাশে বসে কথা বলছিল এবং অট্টহাসিতে ফেটে পড়ছিল। এ সময় রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের পুরুষদের এক বাজারে হত্যা করেছিলেন। তখন জনৈক আহবানকারী সে মহিলার নাম ধরে ডাকে যে, অমুক মহিলা কোথায়? তখন সে বলে, এই তো আমি। আমি (আয়িশা) তাকে জিজ্ঞাসা করিঃ তোমার ব্যাপার কি? তখন সে বলেঃ আমি একটা ঘটনা ঘটিয়েছি, (অর্থাৎ সে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে গালি দেয়)। আয়িশাহ (রাঃ) বলেনঃ তখন সে (আহবানকারী) তাকে নিয়ে যায় এবং তার শিরচ্ছেদ করে। তিনি বলেনঃ আমি সেই ঘটনাটি এখনো ভুলতে পারিনি। কেননা তার আচরণে তাজ্জবের ব্যাপার এই ছিল যে, সে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ছিল, অথচ সে জানত যে, তাকে হত্যা করা হবে।
হাদিসের মানঃ হাসান (Hasan)
বর্ণনাকারীঃ আয়িশা (রাঃ)

উপসংহার

উপরের আলোচনা থেকে এটি মোটামুটি পরিষ্কার যে, বনু কায়নুকা গোত্রের কিছু মানুষের অপরাধের কারণে নবী মুহাম্মদ তাদের গোত্রের সকল সাবালক পুরুষকে হত্যা করতেই চেয়েছিলেন। কিন্তু আবদুল্লাহ বিন উবাইয়ের কারণেই নবী এই কাজটি করতে সক্ষম হন নি। তাই নবী মুহাম্মদের পরিকল্পনা, যা ছিল আরব উপদ্বীপ থেকে মুসলিম বাদে সবাইকে উচ্ছেদ করা, নিশ্চিহ্ন করার প্রকল্পের অংশ হিসেবে তারা বনু কুরাইজা গোত্রকে আক্রমণ করে, এবং আগে থেকেই তাদের কী শাস্তি দেয়া হবে সেটি ঠিক করে রাখে। এরপরে বিচারের নামে যা হয়েছে তা নিয়ে উপরে সবকিছুই বর্ণনা করা হলো। পাঠক পুরো বিষয়টি বিচার বিবেচনা এবং বিশ্লেষণ করে বুঝবেন, এই গণহত্যা এবং এথনিক ক্লিনজিং কতটা মানবিক এবং কতটা নৈতিক। আল্লাহ এবং তার প্রেরিত নবীর পক্ষে এই ধরনের কাজ করা কতটা সঠিক ছিল, এবং এখন পর্যন্ত মুসলিমদের এই রকম কাজকে অনুসরণ, অনুকরণ করা কতটা সভ্য আচরণ!



তথ্যসূত্র

  1. “Legal definition of genocide” (PDF). United Nations. Retrieved 22 February 2017 []
  2. News, VOA. “What Is Genocide?”. Voice of America. Retrieved 22 October 2017 []
  3. Convention on the Prevention and Punishment of the Crime of Genocide art. 2, 78 U.N.T.S. 277, 9 December 1948 []
  4. Rubenstein, James M. (2008). The Cultural Landscape: An Introduction to Human Geography. Pearson. ISBN 9780131346819 []
  5. সহীহ বুখারী, তাওহীদ পাবলিকেশন্স, হাদিস নম্বরঃ ১৮৭১[]
  6. সহীহ মুসলিম, ইসলামিক ফাউন্ডেশ, হাদিস নম্বরঃ ৩২২৩ []
  7. সুনানে ইবনে মাজাহ, ১৪/৭১ []
  8. সহীহ মুসলিম, হাদীস একাডেমী, হাদিস নম্বর- ৩৭-(৩৭/২৩) []
  9. অপদস্থতার নিদর্শন জিযিয়া | তাফসীরে মাযহারী []
  10. লাঞ্ছিত অবস্থায় জিযিয়া |তাফসীরে ইবনে কাসীর []
  11. সহীহ মুসলিম, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, হাদিস নম্বরঃ ৪৪৪২ []
  12. সহীহ মুসলিম, (হাদিস একাডেমী, হাদিস নম্বরঃ ৪৪৮৬ []
  13. সূনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত), হুসাইন আল-মাদানী‏ পাবলিকেশন্স, হাদিস নম্বরঃ ১৬০৭ []
  14. সূনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত), হাদিস নম্বরঃ ২৬০৭ []
  15. সূনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত), হাদিস নম্বরঃ ২৬০৮ []
  16. তাফসীরে ইবনে কাসীর, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, খণ্ড ৪, পৃষ্ঠা ৪৮১ []
  17. কোরআন, সূরা আনফাল, আয়াত ৬৭ []
  18. তাফসীরে জালালাইন, ইসলামিয়া কুতুবখানা প্রকাশনী, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৬০১ []
  19. তাফসীরে মাযহারী, পঞ্চম খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৯৯-২০০ []
  20. তাফসীরে মাযহারী, পঞ্চম খণ্ড, পৃষ্ঠা ২০৭ []
  21. সিরাতে রাসুলাল্লাহ (সাঃ)- ইবনে ইসহাক, অনুবাদঃ শহীদ আখন্দ, প্রথমা প্রকাশনী, পৃষ্ঠা ২৭১, ২৭২ [][]
  22. The Life Of Muhammad, by Ibn Ishaq : Alfred Guillaume, পৃষ্ঠা ২৩২, ২৩৩ [][]
  23. তাফসীরে ইবনে কাসীর, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, খণ্ড ৩, পৃষ্ঠা ৫৭৩ [][]
  24. সিরাতে রাসুলাল্লাহ (সাঃ)- ইবনে ইসহাক, অনুবাদঃ শহীদ আখন্দ, প্রথমা প্রকাশনী, পৃষ্ঠা ৪০১ []
  25. আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, চতুর্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৪৮ []
  26. সুনান আবূ দাউদ, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, হাদিস নম্বরঃ ২৯৯৪ [][][]
  27. সিরাতে রাসুলাল্লাহ (সাঃ)- ইবনে ইসহাক, অনুবাদঃ শহীদ আখন্দ, প্রথমা প্রকাশনী, পৃষ্ঠা ৪০১ []
  28. Ibn Ishaq, The Life of Muhammad, Oxford University Press, 2007, p. 363 []
  29. সিরাতে ইবনে হিশাম, অনুবাদঃ আকরাম ফারুক, বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার []
  30. তাফসীরে ইবনে কাসীর, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, খণ্ড ৩, পৃষ্ঠা ৫৭৩-৫৭৪ []
  31. সিরাতে রাসুলাল্লাহ (সাঃ)- ইবনে ইসহাক, অনুবাদঃ শহীদ আখন্দ, প্রথমা প্রকাশনী, পৃষ্ঠা ৫০০ []
  32. ছবিঃ উইকিপিডিয়া []
  33. আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, চতুর্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৪৮ []
  34. আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, চতুর্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা ২২৪ []
  35. সহীহ বুখারী, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, হাদিস নম্বরঃ ৪৪২৫ []
  36. আর-রাহীকুল মাখতূম, আল্লামা সফিউর রহমান মোবারকপুরী [][]
  37. সীরাতুন নবী (সা.), ইবনে হিশাম, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, তৃতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৩৩ [][]
  38. মুয়াত্তা মালিক, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, হাদিস নম্বরঃ ১০২৪ []
  39. মুয়াত্তা মালিক, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৭১ []
  40. সূনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত), হাদিস নম্বরঃ ১৫৮২ []
  41. সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন), হাদিস নম্বরঃ ৪১২২ []
  42. সহীহুল বুখারী, তাওহীদ পাবলিকেশন্স, চতুর্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা ৯৪, ৯৫ []
  43. সীরাতুন নবী (সা.)- ইবনে হিশাম, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, তৃতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৩৩ []
  44. Mothers of all Palestinians should also be killed,’ says Israeli politician []
  45. Israeli MP says mothers of all Palestinians should be killed []
  46. সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত), হাদিস নম্বরঃ ৪৪০৪ []
  47. সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত), হাদিস নম্বরঃ ৪৪০৫ []
  48. সুনান আবূ দাউদ, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, হাদিস নম্বরঃ ৪৩৫২ []
  49. সূনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত), হাদিস নম্বরঃ ১৫৮৪ []
  50. সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস নম্বরঃ ২৫৪১ []
  51. সীরাতুন নবী (সা), ইবনে হিশাম, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, তৃতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩৬ []
  52. কোরআন, সূরা মায়িদা, আয়াত ৪৮ []
  53. সূনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত), হাদিসঃ ১৫৮২ []
  54. জামে তিরমিযী, ২য় খন্ড, পৃষ্ঠা ২২৫ []
  55. সীরাতে ইবনে হিশাম, মূলঃ ইবনে হিশাম, অনুবাদঃ আকরাম ফারুক, বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার, পৃষ্ঠা ২২৭ []
  56. সিরাতে রাসুলাল্লাহ (সাঃ), ইবনে ইসহাক, অনুবাদঃ শহীদ আখন্দ, প্রথমা প্রকাশনী, পৃষ্ঠা ৫০৬ []
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত © সংশয় - চিন্তার মুক্তির আন্দোলন

View Comments (9)

  • চমৎকার লেখা। অত্যন্ত প্রাঞ্জল ও ঝরঝরে ভাষায় অমানবিক এই ঘটনার বিরুদ্ধে একটি অকাট্য দলিল। পুরো ঘটনার খুঁটিনাটি হাদীস ও সীরাত গ্রন্থ দ্বারা প্রমাণিত সত্য অবলম্বনে লেখা হয়েছে। লেখাটি পড়ে বনু কুরাইজার সেইসব হতভাগ্য মানুষদের কথা ভাবলাম। তাদের স্ত্রীদের কথা ভাবলাম। এই নিষ্ঠুরতার কোন ক্ষমা ইতিহাস অন্তঃত করবে না, সেই প্রত্যাশা রাখি।

  • এরকম সব ঘটনা গুলো সম্পর্কে লিখবেন আশা করি

  • (১) কোরআন এবং হাদিসে থাকা অজস্র ভুল এবং
    অসংগতির কথা এখানে বলা হয়। আরো বলা হয় নবীর অমানবিক সব কর্মকাণ্ডের কথা। প্রশ্ন হল, লক্ষ লক্ষ মুসলিম দার্শনিক, মুফাসসিরে কোরআন-যারা কোরআন এবং হাদিস নিয়ে কাজ করেছেন, তাদের কাছে কেন এই অসংগতি গুলো ধরা পড়লো না? যদি ধরা পড়ে ও থাকে, কিসের আশায় তারা এগুলো তুলে ধরলেন না? আর যদি তুলে ধরে থাকেন, সেরকম কোন প্রখ্যাত মুফাসসিরে কোরআনের লেখার রেফারেন্স দেওয়া যাবে?
    (২) আমাদের দেশে করোনার পিক টাইমে ধর্মকে অনেকটাই কোনঠাসা অবস্থায় দেখতে পেয়েছিলাম। অনেককেই প্রকাশ্যে ধর্মের বিরুদ্ধে কথা বলতে দেখা গিয়েছিল, জনমনেও ধর্ম নিয়ে কিছুটা সংশয়ের সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু, এখন খেয়াল করছি, ধর্ম নিয়ে বাংলাদেশে অন্যরকম একটা উন্মাদনার সৃস্টি হয়েছে। ফ্রান্সের ঘটনায় ৯৯℅ মানুষকে দেখছি কতলকারির সমর্থক হিসেবে, ধর্ষণের জন্য সরাসরি দায়ী করা হচ্ছে পোষাককে, ধর্ষণ প্রতিরোধে শরিয়া আইন প্রনয়নের দাবি জানানো হচ্ছে। হুজুররা করলে ঠিক ছিল, সাধারণ পাবলিকের ও দেখি একই দাবী! আপনাদের কাছে কি মনে হয়, এই দেশের জনগন হঠাৎ করেই কেন এত ধর্মপ্রাণ হয়ে উঠলো?

  • "আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন অনুসারে যুদ্ধকালিন সংঘাতের সময় বেসরকারী জনগণকে খুন"
    it should be "বেসামরিক"

  • চমৎকার এই লেখাটির জন্য ধন্যবাদ আসিফ ভাই।

  • মুহম্মদ সর্বকালের সর্বনিকৃষ্ট মানুষ, সবচেয়ে বড় গণহত্যাকারী।

  • সাধারণভাবে কোনো গণহত্যাই সমর্থন যোগ্য নয় মানবিকতার মানদন্ডে ! মনে রাখতে হবে যে যুদ্ধ অনেক সময় একটি জটিল প্রেক্ষাপট রচনা করে | যেক্ষেত্রে নিরীহ সাধারণ বেসামরিক মানুষ যুদ্ধের সঙ্গে এবং যুদ্ধের পেছনের রাজনীতি ও কোনো ধরণের ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িত নয় , চুক্তির সঙ্গে জড়িত নয়, যাদের কোনো মতামত কিংবা ভোটাভোটি চুক্তি বা যুদ্ধ এর সিদ্ধান্তের সময় নেওয়া হয়নি , তাদেরকে গণহত্যার শিকার বানানো কতটা যুক্তিযুক্ত এটা সত্যি ভেবে দেখার বিষয় !
    ২) সমাজ পারফেক্ট না , জীবন পারফেক্ট না | সাধারণ মানুষের কি স্বার্থ থাকবে না , মতামত ও অধিকার থাকবে না ? তাহলে কি বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ মুক্তি যুদ্ধ করে কিংবা তাতে পরোক্ষ সহায়তা দিয়ে ভুল করেছিল ? তাহলে তো পাকিস্তানিদের করা জেনোসাইড ন্যায্যতা পেয়ে যায় |
    ৩) তথাকথিত উদারপন্থী মানববাদীরা ১৫০০ বছর আগের ৯০০ জন নিরীহ বেসামরিক গণহত্যা নিয়ে চিন্তিত --সেটি ভালো কথা, কিন্তু ফিলিস্তিনি জনগণের উপর যে গণহত্যা চালানো হয়েছে চল্লিশের দিকে ব্রিটিশ বাহিনীর সহায়তায় , হাজার হাজার নিরীহ ফিলিস্তিনি গ্রামবাসীকে হত্যা করা হলো , নারীদেরকে ধর্ষণ করা ও তাদের অন্ত্র কেটে নেওয়া হলো ,
    পরোক্ষভাবে সেই নৃশংস গণহত্যাকে সমর্থন দেওয়া কোন ধরণের মানববাদ ?
    উদার মানববাদীরা ভিয়েতনামের গণহত্যা ও নৃশংসতা , চিলি, গুয়াতেমালা মেক্সিকো জ্যামাইকা ইত্যাদি ল্যাটিন আমেরিকান দেশগুলিতে সিআইএর পরিচালিত গণহত্যা (massacre ), বাসা থেকে উঠিয়ে নিয়ে গুম করে ফেলা --লক্ষ লক্ষ মানুষ হত্যা নিয়ে একেবারেই নীরব ! এটা কি দ্বিচারিতা নয় ? তাহলে ধর্মবাদীদের সঙ্গে মানববাদের দাবিদারদের কি পার্থক্য ? ধর্মবাদীরা কি আকাশ থেকে পড়ে হঠাৎ করে ধর্মবাদী ও অমানবিক হয়েছে ? নাকি material conditions , that is, means of production, উৎপাদিকা শক্তির স্তর , socio-economic structure এগুলি এবং সাম্রাজ্যবাদের আরোপিত বিশ্ব ব্যাপী নব্য ঔপনিবেশিক অর্থ ব্যবস্থা এগুলি নির্ধারণ করে থাকে ? কেবল ব্যক্তির ইচ্ছায় এমন সাংস্কৃতিক বিপর্যয় ঘটে বলে ভাবাটা ভাববাদী চিন্তা পদ্ধতি |
    আর উদার মানববাদীরা কিভাবে নিজেদেরকে "মানববাদী" বলে দাবি করে সাম্রাজ্যবাদী ও লুটেরা দেশগুলির সমস্ত দানবীয় কার্যকলাপকে পরোক্ষভাবে সমর্থন দিয়ে ( ওই দেশগুলিকে "সভ্য" দেশ বলে মহিমান্বিত করে !)
    তথাকথিত "সভ্য" ইউরোপীয় দেশগুলির গণতন্ত্র , ওয়েলফেয়ার ইত্যাদির জন্য আফ্রিকা ও লাতিন amerikaকে লুন্ঠন করতে হয়েছে, রক্ত ঝরাতে হয়েছে | অতএব এই ওয়েলফেয়ার ও সভ্যতা তৈরী হয়েছে অনেক হাহাকার ও কান্নার মূল্যে ! আলোর
    নিচে থাকে অন্ধকার ! আফ্রিকার মানুশের রক্ত শোষণ করে তারা শিল্প কারখানা , এবং এর উপর ভিত্তি করে গণতন্ত্র পুঁজিবাদ সাম্রাজ্যবাদ ও কল্যাণ ব্যবস্থা তৈরী করেছে |

Leave a Comment