বাইবেলের ভূকেন্দ্রিক মহাবিশ্ব এবং চার্চ-গ্যালিলিওর সংঘাত

Print Friendly, PDF & Email

১৬৩৩ সালে বাইবেল বিরোধী বক্তব্য রাখার অভিযোগে রোমান ক্যাথলিক চার্চ গ্যালিলিওকে দোষী সাব্যস্ত করে। সেসময় সকলেই টলেমির পৃথিবীকেন্দ্রিক মহাবিশ্ব মডেলকে ধ্রুব সত্য মনে করতো। তাছাড়া তখন পর্যবেক্ষণের সীমাও ছিলো সীমিত। সেই যুগের মানুষ যখন পদব্রজে দূরদূরান্তে যেতো তখন তারা দেখতো, সূর্য পূর্ব দিগন্ত থেকে সাঁতার দিয়ে পশ্চিমে গোধূলিতে মিলিয়ে যাচ্ছে। পর্যবেক্ষণগত সীমাবদ্ধতার কারণে, আপাত দৃষ্টিতে সূর্য্যোদয় এবং সূর্যাস্ত দেখে টলেমি পৃথিবীকেন্দ্রিক মহাবিশ্ব অনুকল্প প্রস্তাব করেন। টলেমির জিওসেন্ট্রিক ইউনিভার্স মডেল অনুযায়ী, সূর্য সহ সকল গ্রহ-নক্ষত্র পৃথিবীর চারিদিকে মন্দবৃত্তাকার কক্ষপথে পরিভ্রমণ করে। আপাত পর্যবেক্ষণ এবং বাইবেলের আক্ষরিক ব্যাখ্যার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়ায় তৎকালিন রোমান ক্যাথলিক চার্চ টলেমির জিওসেন্ট্রিক ইউনিভার্স মডেলকে দাপ্তরিক পদ-মর্যাদা দেয় এবং ঈশ্বরপ্রদত্ত সত্য বলে প্রচার করে। কিন্তু এতে বাঁধ সাধলো গ্যালিলিওর টেলিস্কোপ। গ্যালিলিও নিজের বানানো দূরবীন দিয়ে দেখতে পেলেন গ্রহগুলি সূর্যের চারিদিকে ঘুরছে, অমনি তিনি বুঝতে পারলেন চার্চের ধারণার উল্টোটাই সত্য। সৌরজগতের অন্যান্য গ্রহের মতোই পৃথিবীও সূর্যের চারিদিকে ঘুরছে। গ্যালিলিওর কথা বাইবেলের বিরুদ্ধে যাওয়ায়, চার্চ তাঁর ওপর ঈশনিন্দার আরোপ লাগায়, তাঁর লেখা নিষিদ্ধ করে এবং তাঁকে আমৃত্যু গৃহবন্দি করে রাখে।

গ্যালিলিও’র ওপর চার্চের এরূপ নিষেধাজ্ঞার জন্য বর্তমান যুগের খ্রীষ্টানরা রোমান ক্যাথলিক চার্চকে দায়ী করলেও, তারা বাইবেলে বর্ণিত জিওসেন্ট্রিসিজমের কথা বেমালুম এড়িয়ে যায়। এমনকি বাইবেলে এধরণের কথা লেখা নেই বলে অনেক সময় মিথ্যাচারও করা হয়। এবার আসুন, দেখা যাক এব্যাপারে বাইবেল কি বলে।

‎וְזָרַ֥ח הַשֶּׁ֖מֶשׁ וּבָ֣א הַשָּׁ֑מֶשׁ וְאֶ֨ל־מְקוֹמ֔וֹ שׁוֹאֵ֛ף זוֹרֵ֥חַֽ ה֖וּא שָֽׁם׃”
‎‮‮קהלת‬ ‭1:5‬ ‭WLC‬‬qq

“ওয়াযারাখ হাশেমেশ উওয়া হাশেমেশ ওয়া’এল মাক্বোমো শো‘এপ যোরেআখ হু শাম”
ক্বোহেলেথ ১:৫

“সূর্য ওঠে ও অস্ত যায় এবং তাড়াতাড়ি সেই জায়গায় ফিরে আসে যেখান থেকে সে আবার উঠবে।”
‭‭উপদেশক‬ ‭১:৫‬ ‭BENIRV‬‬

এবার এখানে বর্ণিত প্রতিটি শব্দের পৃথক অর্থ বের করা যাক।

ওয়াযারাখ (וְזָרַ֥ח) (H2224) = এবং উদয় হয়
হাশেমেশ (הַשֶּׁ֖מֶשׁ) (H8121) = সূর্য
উওয়া (וּבָ֣א) (H935) = এবং অস্ত যায়
হাশেমেশ (הַשֶּׁ֖מֶשׁ) (H8121) = সূর্য
ওয়া’এল (וְאֶ֨ל־) (H413) = আর আসে
মাক্বোমো (מְקוֹמ֔וֹ) (H4725) = সেই জায়গায়
শো‘এপ (שׁוֹאֵ֛ף) (H7602) = দ্রুত ফিরে
যোরেআখ (זוֹרֵ֥חַֽ) (H2224) = (আবার) উদয় হবে
হু (ה֖וּא) (H1931) = সে
শাম (שָֽׁם) (H8033) = যেখানে

এই পদটিতে ব্যবহৃত וְאֶ֨ל־מְקוֹמ֔וֹ שׁוֹאֵ֛ף (এবং তাড়াতাড়ি সেই জায়গায় ফিরে আসে) শব্দবন্ধ থেকে এটা পরিস্কার যে, হিব্রু তানাখের অন্তর্গত ক্বোহেলেথ (Ecclesiastes) গ্রন্থের লেখক (শলোমন ?) মনে করতেন যে, সূর্য পৃথিবীর ওপর ঘুরপাক খাচ্ছে, যা নিঃসন্দেহে একটি বৈজ্ঞানিক ত্রুটি।

আসুন, এবারে আমরা বাইবেলের আরও কিছু পদ তুলে ধরি।

“তুমি পৃথিবীকে তার নিজের ভিত্তির উপর স্থাপন করেছ; তা কখনও নড়বে না।”
‭‭গীতসংহিতা‬ ‭104:5‬ ‭SBCL‬‬

“সদাপ্রভুই রাজা; তিনি মহিমার রাজপোশাক পরেছেন, তিনি শক্তিতে কোমর বেঁধেছেন; পৃথিবী অটলভাবে স্থাপিত হয়েছে, তা কখনও নড়বে না।”
‭‭গীতসংহিতা‬ ‭93:1‬ ‭SBCL‬‬

“পৃথিবীর সমস্ত লোক, তোমরা তাঁর সামনে কেঁপে ওঠো। পৃথিবী অটলভাবে স্থাপিত হল, তা কখনও নড়বে না।”
‭‭১ বংশাবলি‬ ‭16:30‬ ‭SBCL‬‬

“বিভিন্ন জাতির মধ্যে ঘোষণা কর, “সদাপ্রভুই রাজা। পৃথিবী অটলভাবে স্থাপিত হল, তা কখনও নড়বে না; তিনি ন্যায়ভাবে সব জাতিকে শাসন করবেন।””
‭‭গীতসংহিতা‬ ‭96:10‬ ‭SBCL‬‬

“…পৃথিবীর থামগুলো সদাপ্রভুরই, তিনি সেগুলোর উপরে জগতকে স্থাপন করেছেন।”
‭‭১ শমূয়েল‬ ‭2:8b‬ ‭SBCL‬‬

“যেদিন সদাপ্রভু ইস্রায়েলীয়দের হাতে ইমোরীয়দের তুলে দিলেন সেই দিন ইস্রায়েলীয়দের সামনেই যিহোশূয় সদাপ্রভুকে বললেন, “হে সূর্য, গিবিয়োনের উপর তুমি স্থির হয়ে দাঁড়াও, হে চাঁদ, অয়ালোন উপত্যকায় তুমি গিয়ে দাঁড়াও।” তাই সূর্য স্থির হয়ে দাঁড়াল আর চাঁদের গতি থেমে গেল, যে পর্যন্ত না ইস্রায়েল তার শত্রুদলের উপর শোধ নিল।” এই কথা যাশেরের বইতে লেখা আছে। তখন সূর্য আকাশের মাঝখানে গিয়ে থেমে রইল এবং অস্ত যেতে প্রায় পুরো একটা দিন দেরি করল।”
‭‭যিহোশূয়‬ ‭10:12-13‬ ‭SBCL‬‬

“তবুও তাদের ডাক সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ছে; তাদের কথা ছড়িয়ে পড়ছে জগতের শেষ সীমা পর্যন্ত। মহাকাশে সূর্যের জন্য তিনি একটা তাম্বু খাটিয়েছেন; সে বরের মত করে বাসর-ঘর থেকে বেরিয়ে আসে, নির্দিষ্ট পথে দৌড়াবে বলে খেলোয়াড়-বীরের মত খুশী হয়ে ওঠে; সে আকাশের এক দিক থেকে ওঠে আর ঘুরে অন্য দিকে যায়; তার তাপ থেকে কিছুই রেহাই পায় না।”
‭‭গীতসংহিতা‬ ‭19:4-6‬ ‭SBCL‬‬

“তোমার উড়ন্ত তীরের ঝল্‌কানিতে আর বিদ্যুতের মত তোমার বর্শার চম্‌কানিতে আকাশে সূর্য ও চাঁদ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।”
‭‭হবক্‌কূক‬ ‭3:11‬ ‭SBCL‬‬

“পৃথিবী ও বিশ্বচরাচর যদিও হয় বিকম্পিত, তবু আমি তার ভিত্তিমূল রাখব সুদৃঢ়। সেলা”
‭‭গীতসংহিতা‬ ‭75:3‬ ‭BCL‬‬

উপরিউক্ত পদগুলিতে একদিকে পৃথিবীকে স্থির এবং মহাবিশ্বের কেন্দ্রবিন্দু, অন্যদিকে সূর্যকে পৃথিবীর উপরে পূর্ব হতে পশ্চিমে ভ্রমণরত হিসেবে বর্ননা করা হয়েছে। এগুলি নিঃসন্দেহে বৈজ্ঞানিক ত্রুটি। এখন সমস্যা হলো, নতুন নিয়মের ২য় তীমথিয় ৩:১৬a মতে, “পবিত্র শাস্ত্রের প্রত্যেকটি কথা ঈশ্বরের কাছ থেকে এসেছে…” যদি তাই হয়, তাহলে এটা বললে অত্যুক্তি হয়না যে, বাইবেলে বর্ণিত বৈজ্ঞানিক ত্রুটিগুলোও যিহোবা দ্বারা অনুপ্রাণিত। ঠিক একারণেই মধ্যযুগীয় রোমান ক্যাথলিক চার্চ গ্যালিলিওর বিরুদ্ধে বাইবেল বিরোধী বক্তব্য রাখার অভিযোগ আনতে সক্ষম হয়েছিলো। গ্যালিলিওর অপরাধ এটাই ছিলো যে, তাঁর দূরবীন চার্চের চোখরাঙানিকে উপেক্ষা করে ঈশ্বরের বাক্যকে ভুল এবং সর্বাপরি মিথ্যা প্রমাণ করেছিলো। চার্চের শত বিধিনিষেধও পৃথিবীর ঘূর্ণন থামিয়ে রাখতে পারেনি। গ্যালিলিওকে নিজের বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণ নস্যাৎ করে জনসমক্ষে মাফিনামা পাঠ করতে বাধ্য করা হয়। কথিত আছে, মাফিনামা পাঠ করার পরেও গ্যালিলিও আকাশের দিকে তাকিয়ে স্বগতোক্তি করে বলেছিলেন, “পৃথিবী কিন্তু এখনও ঘুরছে!”

লিখেছেন – জিশান উল হক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *