বেদবিরোধী বুদ্ধকে কেন বিষ্ণুর অবতার বানানো হল?

Print Friendly, PDF & Email

ভূমিকা

গৌতম বুদ্ধ যিনি বৌদ্ধ ধর্মের প্রবর্তক, হিন্দুরা তাকে বিষ্ণুর অবতার হিসেবেও জানেন।  গরুড় পুরাণের প্রথম অধ্যায়ে বিষ্ণুর অবতার সমূহের বিবরণ দেওয়ার সময় একাদশ অবতার হিসেবে বুদ্ধের উল্লেখ করা হয়-

“একবিংশতি অবতারে ভগবান কলিযুগের সন্ধ্যা প্রবৃত্ত হইলে দেবদ্বেষীদিগের মোহনারথ কীকটে (মগধ দেশে) জিনসুত বুদ্ধনামে আবির্ভূত হইবেন। কলিযুগের সন্ধ্যার অবসান কালে রাজবরগ নষ্টপ্রায় হইলে, জগৎপতি কল্কি নামে বিষ্ণুযশা নামক ব্রাহ্মণের ভবনে অবতীর্ণ হইবেন”। [1]


গরুড় পুরাণ/ উত্তরখন্ড / ৩০ অধ্যায়ে বলা আছে-

“মৎস্য, কূর্ম, বরাহ, নৃসিংহ, বামন, শ্রীরাম, পরশুরাম, কৃষ্ণ, বুদ্ধ ও কল্কি পন্ডিতগণ সর্বদা এই দশ নাম স্মরণ করিবেন”।


বৃহন্নারদীয় পুরাণের ২য় অধ্যায়ে বুদ্ধকে বিষ্ণুর অবতার বলা হয়েছে-

“…স্বীয় বুদ্ধিতে ভূম্যাদি ত্রিলোক এবং আত্মাকে বিলীন করিয়া অবস্থিত যে পুরুষকে যোগিগণ অবলোকন করেন, সেই বুদ্ধাবতারকে ভজনা করি।”

বিভিন্ন পুরাণে বুদ্ধকে বিষ্ণুর নবম অবতার বলা হয়েছে। গরুড় পুরাণের প্রথম অধ্যায়ে বিষ্ণুর অবতার সমূহের বিবরণ দেওয়ার সময় একাদশ অবতার হিসেবে বুদ্ধের উল্লেখ করা হয়েছে-

“একবিংশতি অবতারে ভগবান কলিযুগের সন্ধ্যা প্রবৃত্ত হইলে দেবদ্বেষীদিগের মোহনারথ কীকটে (মগধ দেশে) জিনসুত বুদ্ধনামে আবির্ভূত হইবেন। কলিযুগের সন্ধ্যার অবসান কালে রাজবরগ নষ্টপ্রায় হইলে, জগৎপতি কল্কি নামে বিষ্ণুযশা নামক ব্রাহ্মণের ভবনে অবতীর্ণ হইবেন”। [1]

গরুড় পুরাণ/ উত্তরখন্ড / ৩০ অধ্যায়ে বলা আছে-

“মৎস্য, কূর্ম, বরাহ, নৃসিংহ, বামন, শ্রীরাম, পরশুরাম, কৃষ্ণ, বুদ্ধ ও কল্কি পন্ডিতগণ সর্বদা এই দশ নাম স্মরণ করিবেন”।

বৃহন্নারদীয় পুরাণের ২য় অধ্যায়ে বুদ্ধকে বিষ্ণুর অবতার বলা হয়েছে-

“…স্বীয় বুদ্ধিতে ভূম্যাদি ত্রিলোক এবং আত্মাকে বিলীন করিয়া অবস্থিত যে পুরুষকে যোগিগণ অবলোকন করেন, সেই বুদ্ধাবতারকে ভজনা করি।”

কিন্তু হিন্দুরা কি আসলেই জানেন বুদ্ধ অবতার সম্বন্ধে তাদের ধর্মগ্রন্থে কি বলা আছে? হিন্দুদের ধর্মগ্রন্থে বলা হয়েছে অসুরদের বৈদিক ধর্ম হতে ভ্রষ্ট করতেই বিষ্ণু বুদ্ধ অবতার নিয়ে বৌদ্ধ ধর্মের প্রবর্তন করেন। বৌদ্ধ ধর্মকে আসুরিক ধর্ম হিসাবে দেখানো হয়েছে। হিন্দু শাস্ত্র রচয়িতারা কেন এই কাজটি করেছিলেন তা জানার জন্য আমাদের খুঁজে দেখতে হবে অতীতে হিন্দুদের সাথে বৌদ্ধদের সম্পর্ক কেমন ছিল।এখন বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে যেমন বিদ্বেষ-সহিংসতা দেখা যায়, তেমনি অতীতেও হিন্দু ও বৌদ্ধদের মধ্যেও হিংসা-দ্বেষ ছিল।

হিন্দুদের বৌদ্ধ বিদ্বেষ

নীলকান্ত তার প্রায়শ্চিত্ত ময়ুখ এ মনু হতে একটি শ্লোক উদ্ধৃত করেন। তাতে বলা হয়েছে,

“ যদি কোনো ব্যক্তি কোনো বৌদ্ধকে বা পশুপাতের ফুলকে,লোকায়তিককে,নাস্তিককে এবং মহাপাতকীকে স্পর্শ করে তবে সে স্নান করে শুদ্ধ হবে।“ [2]
অপরার্কও তার স্মৃতিতে একই ধরণের মতবাদ প্রচার করেন। বৃদ্ধ হারিত বৌদ্ধ মন্দিরে প্রবেশ করার ফলে হওয়া পাপ শুদ্ধিকারক স্নানের মাধ্যমে দূর করতে বলেন। [2]


রামায়ণে রামচন্দ্র বনবাসে গেলে তাকে ফেরাতে ভরত জাবালি প্রভৃতি মুনিদের সাথে নিয়ে যান। জাবালি রামকে চার্বাক মত অনুযায়ী উপদেশ দিয়ে রাজ্যে ফিরতে বললে রাম জাবালিকে ভর্ৎসনা করতে গিয়ে বলেন,

यथा हि चोर: स‌ तथा हि बुद्धस्तथागतं नास्तिकमत्र विद्धि।
तस्माद्धि य: श‌ङ्क्यतमः प्रजानाम् न नास्तिकेनाभिमुखो बुध: स्यात्।। 2.109.34।।
— চোর যেমন বুদ্ধও তেমন। জানবেন যে তথাগতেরা নাস্তিক। তারা মানুষের মধ্যে সবচাইতে অবিশ্বাসযোগ্য। জ্ঞানী মানুষদের নাস্তিকদের পরিত্যাগ করা উচিত।

কল্কি পুরাণে দেখানো হয়েছে, বিষ্ণুর অবতার কল্কি বৌদ্ধদের হত্যা করার জন্য কলিযুগে অবতীর্ণ হবেন। কল্কি অনেক বৌদ্ধ,জৈন,নাস্তিকদের হত্যা করবেন। কল্কি কিকটপুরে আক্রমণ করবেন বৌদ্ধদের ধ্বংস করার জন্য। কল্কি পুরাণের বিবরণ অনুযায়ী-

“পরে তিনি (কল্কি) সেনাসমূহে পরিবৃত্ত হইয়া প্রথমত কীকটপুর (জয় করিবার নিমিত্ত) বহির্গত হইলেন। এই কীকটপুর অতীব বিস্তীর্ণ নগর।ইহা বৌদ্ধদিগের প্রধান আলয়।এই দেশে বৈদিক ধর্মের অনুষ্ঠান নাই। এখানকার লোকেরা পিতৃ অর্চনা বা দেব অর্চনা করে না, এবং পরলোকের ভয়ও রাখে না। এই দেশের অনেকেই শরীরে আত্মাভিমান করে। তাহারা দৃশ্যমান শরীর ভিন্ন অন্য আত্মা স্বীকার করে না। তাহাদের কুলাভিমান বা জাত্যাভিমান কিছুমাত্র নাই। তাহারা ধনবিষয়ে, স্ত্রীপরিগ্রহ বিষয়ে বা ভোজন বিষয়ে সকলকে সমান জ্ঞান করে, কাহাকেও উচ্চ নীচ বোধ করে না।”

(কল্কির বৌদ্ধদের হত্যা করার বিষয়টি সবিস্তারে এখান থেকে পড়ুন)

সংস্কৃত নাটকেও বৌদ্ধদের প্রতি হিন্দুদের বিদ্বেষ ফুটে উঠেছে। মৃচ্ছকটিকের সপ্তম অঙ্কে নায়ক চারুদত্ত ও তার বন্ধু মৈত্রেয়ের সাথে শম্ভক নামে এক বৌদ্ধ সন্ন্যসীর দেখা হয়। চারুদত্ত বলে,

“ বন্ধু মৈত্রেয়, আমি বসন্তসেনার সাথে দেখা করার জন্য উদগ্রীব…চল আমরা যাই (কিছুক্ষণ হাটার পর)আহ! অশুভ দৃশ্য, এক বৌদ্ধ সন্ন্যাসী আমাদের দিকে আসছে। (কিছুক্ষণ ভাবার পর), ঠিক আছে তাকে এ পথে আসতে দাও, আমরা অন্য পথে যাচ্ছি। (প্রস্থান)” [2]


শম্ভক নামক বৌদ্ধ সন্ন্যাসীকে আমরা মৃচ্ছকটিকের অষ্টম অঙ্কে আবারো দেখি। এইবার বৌদ্ধ সন্ন্যাসীটি রাজার শ্যালক শকরদের উদ্যানে গেলে তাকে নিগৃহীত করা হয়।নিচে নাটকটির সংলাপের অনুবাদ দেওয়া হল-

শকর- দাঁড়া! দুষ্ট সাধু।
বৌদ্ধ সন্ন্যাসী- ওহ! এখানে দেখছি রাজার শ্যালক! তাকে কিছু সন্ন্যাসী রাগিয়েছে বলে তিনি এখন যে সন্যাসীকে দেখেন তাকেই পেটান।
শকর- দাঁড়া! সরাইখানায় যেভাবে মূলা ভাঙ্গা হয় সেভাবে আমি তোর মাথা ভেঙ্গে ফেলব। (তাকে প্রহার করতে থাকে)
ভিত- বন্ধু! জগতের প্রতি বিতশ্রদ্ধ গেরুয়াধারী সন্ন্যাসীকে প্রহার করা উচিত নয়।
বৌদ্ধ সন্ন্যাসী- (স্বাগতম জানিয়ে) প্রসন্ন হও, পার্থিব ভ্রাতা।
শকর- দেখ বন্ধু, সে আমাকে গালাগাল দিচ্ছে।
ভিত- সে কি বলেছে?
শকর- সে আমাকে পার্থিব ভ্রাতা (উপাসক) বলছে। আমি কি নাপিত?
ভিত- আচ্ছা। সে তোমাকে বুদ্ধের ভক্ত বলে প্রশংসা করেছে।
শকর- সে এখানে কেন এসেছে?
বৌদ্ধ সন্ন্যাসী- এই কাপড় গুলো ধোয়ার জন্য।
শকর- ওরে দুষ্ট সন্ন্যাসী! এমনকি আমি এই পুকুরে স্নান করিনা। তোকে এক ঘায়ে মেরে ফেলব। [2]

এছাড়া ইতিহাসেও বৌদ্ধদের প্রতি হিন্দুদের বিদ্বেষের সাক্ষ্য পাওয়া যায়।

চীনা পরিব্রাজক য়ুয়ান চোয়াঙ শশাঙ্কের বৌদ্ধ বিদ্বেষ প্রসঙ্গে রীতিমত অভিযোগ করেছেন। হিন্দু রাজা শশাঙ্ক কুশিনগরে এক বিহারের ভিক্ষুদের বহিষ্কার করেছিলেন। পাটলীপুত্রে বুদ্ধ পদাঙ্কিত একখণ্ড প্রস্তরখণ্ড গঙ্গায় নিক্ষেপ করেছিলেন। বুদ্ধগয়ার বোধিবৃক্ষ কেটে তার মূল পর্যন্ত ধ্বংস করে পুড়িয়ে ফেলেছিলেন। একটি বুদ্ধ মূর্তি সরিয়ে সেখানে শিব মূর্তি প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। শশাঙ্কের মৃত্যু সম্বন্ধেও য়ুয়ান চোয়াঙ একটি অলৌকিক কাহিনী লিপিবদ্ধ করেছেন; সেই প্রসঙ্গেও শশাঙ্কের বৌদ্ধ বিদ্বেষ এবং তার ফলে শশাঙ্কের শাস্তির প্রতি ইঙ্গিত আছে। বোধিদ্রুম ধ্বংস ও এই মৃত্যু কাহিনীর প্রতিধ্বনি মঞ্জুশ্রীমূলকল্প গ্রন্থেও আছে। [3]

এমনকি সোমপুরের বৌদ্ধ বিহারের একাংশও পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। ঐতিহাসিক নীহার রঞ্জন তার বাঙ্গালীর ‘ইতিহাস আদিপর্ব’ -এ বলেন-

“ বৌদ্ধ ধর্ম এই সময় বিলীন হইয়া গিয়াছিল , সংঘ বিহার ইত্যাদি ছিল না, একথা বলা চলে না; অথচ রাষ্ট্রের কোনো অনুগ্রহই সেদিকে বর্ষিত হইল না। শুধু যে বর্ষিত হয় নাই, তাহা নয়; বৌদ্ধ ধর্ম ও সংস্কৃতির প্রতি একটা বিরোধীতাও বোধহয় আরম্ভ হইয়াছিল, এবং রাষ্ট্রের সমর্থনও এই বিরোধীতার পশ্চাতে ছিল। বর্মণ রাজ রাজবর্মার রাজত্বকালেই সম্ভবত বর্মণ রাষ্ট্রের বঙ্গাল সৈন্যদল সোমপুরের বৌদ্ধ মহাবিহারের অন্তত একাংশ পুড়াইয়া দিয়াছিল; নালন্দার একটি লিপিতে এই ঐতিহাসিক ঘটনার স্মৃতি উল্লিখিত আছে।“

তিনি বৌদ্ধদের প্রতি বিদ্বেষ প্রসঙ্গে আরও বলেন,

“… বৃন্দাবন দাসের চৈতন্য-ভাগবতের উক্তি সত্য হইলে স্বীকার করিতে হয়, বৌদ্ধদের প্রতি গৌড়ীয় বৈষ্ণবেরা অত্যন্ত বিদ্বিষ্টই ছিলেন। অবধুত নিত্যানন্দের তীর্থ ভ্রমণ উপলক্ষে প্রভু যেসকল বৌদ্ধ দেখিয়াছিলেন, তাহাদের প্রতি ‘ক্রুদ্ধ হই প্রভু লাথি মারিলেন শিরে’। যে চূড়ান্ত অবমাননাটুকু বাকি ছিল এবার তাহা হইল! লাথি মারা সত্য সত্যই হউক বা না হউক, মনোভাবটা এইরূপই ছিল। মহাপ্রভুর দাক্ষিণাত্য ভ্রমণ কালে ত্রিপতি (তিরুপতি) ও বেঙ্কটগিরিতে যেসব বৌদ্ধদের সঙ্গে সাক্ষাৎ লাভ ঘটিয়াছিল তাহাদের কথা বলিতে গিয়া বৃদ্ধ কৃষ্ণদাস কবিরাজ তাহার চৈতন্য চরিতামৃতে সেই সব বৌদ্ধদের বলিয়াছেন পাষণ্ডী, পাষণ্ডীগণ, এবং এই গ্রন্থেরই অন্যত্র বৌদ্ধদিগকে শবর, ম্লেচ্ছ ও পুলিন্দের সঙ্গে এক পর্যায়ে উল্লেখ করিয়াছেন। …কবি কঙ্কণ মুকুন্দরাম চক্রবর্তী চণ্ডীমঙ্গল কাব্যে বুদ্ধাবতার বর্ণনা প্রসঙ্গে বলিয়াছেন , ‘ধরিয়া পাষণ্ডমত, নিন্দা করি বেদপথ , বৌদ্ধরূপী লেখে নারায়ণ।‘ বেশ বুঝা যাইতেছে পঞ্চদশ শতক নাগাদ বাংলাদেশে বৌদ্ধ ধর্ম ও সম্প্রদায় প্রায় নিশ্চিহ্নই হইয়া গিয়াছিল, দুই চারিজন যাহারা তখনও এই ধর্ম আকড়াইয়া ছিলেন, ব্রাহ্মণ্য ধর্মাবলম্বীরা তাহাদের খুব নীচু স্তরের জীব বলিয়াই মনে করিতেন।“ [3]

নীহার রঞ্জন রায় সেন-বর্মণ রাজবংশের শাসনকালে বৌদ্ধদের দুরবস্থা সম্বন্ধে বলেন,

“… সাধারণভাবে সেন ও বর্মণ রাজবংশ বৌদ্ধ ধর্ম ও সংঘের উপর খুব শ্রদ্ধিত ও সহানুভূতিসম্পন্ন ছিলেন না এবং প্রত্যক্ষ অত্যাচারে না হউক পরোক্ষ নিন্দায় এবং অশ্রদ্ধায় বৌদ্ধদের উৎপীড়িত করিবার চেষ্টায় ত্রুটি হয় নাই। ভোজবর্মার বেলাব লিপিতে বলা হইয়াছে, ত্রয়ী বা তিন বেদবিদ্যাই হইতেছে পুরুষের আবরণ এবং তাহার অভাবে পুরুষেরা নগ্ন। এই উক্তিতে বেদবাহ্য বা বেদবিরোধী বৌদ্ধ, নাথ, জৈন প্রভৃতি ধর্মের প্রতি যে প্রচ্ছন্ন শ্লেষ তাহা আরও প্রকট হইয়া উঠিয়াছে হরিবর্মার মন্ত্রী ভট্ট-ভবদেবকে যখন বলা হইয়াছে ‘বৌদ্ধাম্ভনিধি-কুম্ভ-সম্ভব-মুনিঃ’ এবং ‘পাষণ্ডী-বৈতণ্ডিক-প্রজ্ঞা-খণ্ডন-পণ্ডিত’। বেদবাহ্য বৌদ্ধদের পাষণ্ড বলিয়া অভিহিত করা যেন এই পর্বে পর্ব হইতেই ক্রমশ রীতি হইয়া দাঁড়াইল। বল্লাল সেন তাহার দানসাগর গ্রন্থের উপক্রমণিকায় বলিতেছেন পাষণ্ড (অর্থাৎ বৌদ্ধ) কর্তৃক প্রক্ষিপ্ত দোষে দুষ্ট বলিয়া বিষ্ণু ও শিবপুরাণ দানসাগর গ্রন্থে উপেক্ষিত হইয়াছে। অন্য আর একটি শ্লোকে তিনি বলিতেছেন, একই কারণে দেবীপুরাণও ঐ গ্রন্থে নিবন্ধ হয় নাই। এই গ্রন্থেরই উপসংহারে একটি শ্লোকে বলা হইয়াছে কলিযুগে বল্লালসেন নামা শ্রী ও সরস্বতী পরিবৃত্ত প্রত্যক্ষ নারায়ণের আবির্ভাবই হইয়াছিল ধর্মের অভ্যুদয়ের জন্য এবং নাস্তিকদের (বৌদ্ধদের, নাথপন্থিদের প্রভৃতিদের ) পদোচ্ছেদের জন্য…” [3]

বৌদ্ধদের হিন্দু বিদ্বেষ

বৌদ্ধদের মনেও যে হিন্দুদের প্রতি বিদ্বেষ ছিল না এমনটা নয়। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয় তার ‘বৌদ্ধ ধর্ম’ গ্রন্থে বলেন,

“… তাহারা বলেন, হিন্দু ধর্ম ও বৌদ্ধ ধর্মে কিছু মাত্র দ্বেষভাব ছিল না। কিন্তু সম্প্রতি চন্দ্রকীর্তির টীকার সহিত আর্যদেবের চতুঃশতিকার কিয়দংশ ছাপা হইয়াছে , তাহাতে আচার্য সংঘসেন একজন বালকের সেবায় অত্যন্ত তুষ্ট হইয়া তাঁহাকে বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষা লইবার জন্য জিদ করিতে লাগিলেন। তখন সে বলিল, “আর কিছুদিন মাত্র যাক, আমি দীক্ষা লইব।“ মাসখানেক পরে সে আসিয়া বলিল, “আচার্য আমি এখন দীক্ষিত”। আচার্য জিজ্ঞাসা করেন, “কীসে তোমার দীক্ষা হইল?” সে বলিল,”এখন ব্রাহ্মণ দেখিলেই আমার ইচ্ছা হয় যে আমি তাঁহাকে মারিয়া ফেলি, সুতরাং আমি বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষিত।“ [4]

বৌদ্ধদের হিন্দু বিদ্বেষ প্রসঙ্গে নীহার রঞ্জন রায় বলেন,

“ এই দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষের কিছু প্রমাণ একধরণের বজ্রযানী দেবদেবী কল্পনার মধ্যেও আছে। বজ্রযানী প্রসন্নতারা, বজ্রজালানলার্ক, বিদ্যুজ্বালাকরালী প্রভৃতি দেবতার সাধনমন্ত্রে ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিব ও ইন্দ্র প্রভৃতিকে বলা হইয়াছে মার। শিব দশভুজা মারীচির পদতলে পৃষ্ট; তাঁহাকে এবং গৌরিকে একত্র পদদলিত করিতেছেন ত্রিলোক্যবিজয়। ইন্দ্র অপরাজিতার ছত্রধর; ইন্দ্রানী পরমশ্ব দ্বারা অপদস্ত। ইন্দ্র আবার উভয়বরাহাননা মারীচির কৃপা প্রার্থী, তিনি আবার অষ্টভূজা মারীচী, পরমশ্ব ও প্রসন্নতারার পদতলে পিষ্ট। সিদ্ধিদাতা গণেশ অপরাজিতা , পর্ণ শবরী এবং মহাপ্রতিসরার পদদলিত। অবলোকিতেশ্বরের অন্যতম রূপ হরিবাহনোদ্ভব অবলোকিতেশ্বর গরুড়োপরি আসীন বিষ্ণুর স্কন্ধে আরোহণ করিয়া ব্রাহ্মণ্য ধর্মের উপর জয়ঘোষণা করিয়াছেন।সন্দেহ নাই, ব্রাহ্মণ্য ধর্মের দেবদেবীদের কিছুটা লাঞ্ছিত ও অপমানিত করিবার জন্যই এইরূপ করা । [3]

বিনয়তোষ ভট্টাচার্য তার ‘বৌদ্ধদের দেবদেবী’ গ্রন্থে বিভিন্ন বৌদ্ধ দেবদেবীদের মূর্তির বিবরণ দিয়েছেন। এসব বিবরণ হতে দেখা যায়, বৌদ্ধরা এমনভাবে তাদের অনেক দেবতার রূপ কল্পনা করেছিল, যার মাধ্যমে হিন্দু দেবদেবীদের অপমান করা যায়। বিনয়তোষ ভট্টাচার্যের গ্রন্থ হতে সরাসরি কিছু অংশের উদ্ধৃতি দেওয়া যাক-

হরিহরিহরিবাহনোদ্ভব অবলোকিতেশ্বরঃ অবলোকিতেশ্বরের এই মূর্তিটির নামও যেমন অদ্ভুত, কল্পনাও তেমনি অদ্ভুত। তিনটি হরি রূপ বাহন হইতে যাঁহার উদ্ভব তিনিই হরি হরি হরি বাহনোদ্ভব। সংস্কৃতে হরি মানে সিংহ হয়, গরুড়ও হয় ও বিষ্ণুও হয়। যে অবলোকিতেশ্বরের নিম্নতম বাহন সিংহ, সিংহের উপরে গরুড় ও গরুড়ের উপর বিষ্ণু বাহনরূপে বিরাজ করে তাহাকেই হরি হরি হরি বাহন লোকেশ্বররূপে অভিহিত করা হয়। এই লোকেশ্বরের বর্ণ সাদা, মুখ একটি এবং হাত ছয়টি। দক্ষিণ প্রথম করে সাক্ষীমুদ্রা অর্থাৎ এই কর দিয়া তিনি শূণ্য ভগবানকে সাক্ষী করেন, দ্বিতীয় করে অক্ষমালা ধারণ করেন এবং তৃতীয় করে লোকদের উপদেশ করেন। বামে প্রথম করে দণ্ড, দ্বিতীয় করে কৃষ্ণাজিন এবং তৃতীয়ে কমন্ডলু ধারণ করেন।
এইরূপ অদ্ভুত মূর্তি প্রস্তরে এবং ধাতুতে কেবল নেপালেই দেখিতে পাওয়া যায়।
বিঘ্নান্তকঃ অক্ষোভ্যকুলের এই দেবতা প্রধানত দ্বারপালরূপে পরিগণিত হন। বিঘ্ন অর্থ বাধা, কিন্তু বজ্রযানে বিঘ্ন বলিতে হিন্দু দেবতা গণেশকে বুঝায়। যেহেতু গণেশ সিদ্ধিদাতারূপে পূজিত হইয়া থাকেন, সেইজন্য বৌদ্ধেরা তাহাকে বিঘ্নরূপী মনে করেন এবং বিঘ্নান্তকের কল্পনা করেন। বিঘ্নান্তক মূর্তিতে গণেশকে দেবতার পদতলে নিষ্পেষিত অবস্থায় দেখা যায়।
বিঘ্নান্তক নীলমূর্তি, একমুখ, দ্বিভুজ ও ভীষণদর্শন। দক্ষিণ করে উদ্যত বজ্র এবং বাম করে পাশযুক্ত তর্জনী-মুদ্রা প্রদর্শন করেন। প্রত্যালীঢ় পদে ইনি গণেশকে পদদলিত করেন। ইহার আরও অনেক প্রকার রূপ আছে, গ্রন্থবিস্তার ভয়ে তাহা আর এখানে দেওয়া সম্ভব হইল না।
বজ্রজ্বালানলার্কঃ আক্ষোভ্যকুলের এই দেবতার বর্ণ নীল, আকৃতি ভীতিপ্রদ ও জ্বালামালাকুল, চতুর্মুখ ও অষ্টভুজ। ইনি আলীঢ় পদে সপত্নীক বিষ্ণুকে পদদলিত করিয়া থাকেন। চারিটি মুখে শৃঙ্গার, বীর, বীভৎস ও করুণ রস অভিব্যঞ্জিত হইয়া থাকে। চারিটি দক্ষিণভুজে বজ্র, খড়্গ, চক্র ও বাণ ধারণ করেন। চারিটি বাম করে ঘণ্টা, ধনু, পাশ এবং বিচিত্র পতাকাযুক্ত খট্বাঙ্গ ধারণ করেন।
ত্রৈলক্য বিজয়ঃ এই দেবতার কুলেশ অক্ষোভ্য। ইহার বর্ণ নীল ও মূর্তি ভীতিপ্রদ। ইনি চতুর্মুখ ও অষ্টভুজ। প্রত্যালীঢ় পদে ইনি শিব ও গৌরীকে পদদলিত করেন। ইহার প্রথম মুখ সক্রোধশৃঙ্গার রস, দ্বিতীয় রৌদ্র রস, বাম মুখ বীভৎস রস এবং পশ্চাতের মুখ বীররস প্রদর্শন করিয়া থাকে। প্রধান ভুজদ্বয়ে ঘণ্টা ও বজ্র ধারণ করিয়া হস্তদ্বয়ের অঙ্গুলিসংযুক্ত করিয়া হৃদয়দেশে বজ্রহুঙ্কার মুদ্রা ধারণ করেন। দক্ষিণ করত্রয়ে খট্বাঙ্গ, অঙ্কুশ ও বাণ এবং বাম করত্রয়ে ধনু পাশ ও বজ্র ধারণ করেন। বজ্রহুঙ্কার মুদ্রার আর একটি নাম ত্রৈলোক্যবিজয়-মুদ্রা। এই দেবতার দুই-একটি মূর্তি পাওয়া গিয়াছে। তাহার মধ্যে একটি আছে বুদ্ধগয়ার মোহন্তের মন্দিরে।
পরমাশ্বঃ অক্ষোভ্যকুলের এই দেবতাটির মুরতি অদ্ভুত প্রকারের। ইহার নাম পরমাশ্ব অর্থ শ্রেষ্ঠ ঘোড়া। নাম হইতে মনে হয় ইহার সহিত হয়গ্রীবের কিছু সম্বন্ধ আছে। ইহার রঙ লাল এবং ইনি চতুর্মুখ ও অষ্টভুজ এবং অশ্বের ন্যায় চতুষ্পদ। চারিটি মুখের একটি অশ্বমুখ, একটি ব্রহ্মমুখ অর্থাৎ ব্রহ্মার চতুর্মুখযুক্ত একটি কাটামাথা বসানো। মূলমুখ রক্ত সক্রোধশৃঙ্গার, দক্ষিণ রৌদ্র, বাম মুখ ব্রহ্মমুখ এবং ঊর্ধ্বমুখ হরিত অশ্বমুখ।চারিটি দক্ষিণ হস্তের একটি বিশ্ববজ্র সহিত ‘উত্তিষ্ঠ’ অভিনয় করেন, দ্বিতীয়টিতে ত্রিপতাকা-মুদ্রা ধারণ করিয়া ওইরূপ ‘উত্তিষ্ঠ’ অভিনয় করেন। তৃতীয়ে খড়্গ ও চতুর্থে বাণ থাকে। বামের প্রথমে ছড়ির সহিত বিশ্বপদ্ম, দ্বিতীয়ে শক্তি, তৃতীয়ে দণ্ড ও চতুর্থে ধনু ধারণ করেন। প্রত্যালীঢ় পদে দাঁড়াইয়া প্রথম দক্ষিণ পদে ইন্দ্রাণী ও লক্ষ্মীকে ও দ্বিতীয় দক্ষিণ পদে রতি ও প্রীতিকে দলন করেন। বামে প্রথম পদদ্বারা ইন্দ্র ও মধুকরকে এবং দ্বিতীয় চরণ দ্বারা জয়কর ও বসন্তকে দলিত করিয়া থাকেন। এইরূপ চতুষ্পদবিশিষ্ট অদ্ভুত রূপে দেবতা আবির্ভূত হইয়া থাকেন।
কালচক্রঃ কালচক্র আদিবুদ্ধ যান বা আদি যানের প্রধান দেবতা। এই যানকে দেবতার নাম অনুসারে কালচক্র যানই বলা হইয়া থাকে। কালচক্রের উপর একখানি পৃথক তন্ত্র লেখা হইয়াছিল। বৌদ্ধদিগের ইহা একখানি মৌলিক তন্ত্র এবং বিশেষ প্রয়োজনীয় গ্রন্থ। অদ্যাবধি ইহা ছাপা হয় নাই। কালচক্র তন্ত্রের একখানি বিশেষ দামি টীকা আছে, তাহার নাম বিমলপ্রভা। এই টীকাখানি ইতালির বিশ্বপণ্ডিত Giuseppe tucci ছাপাইতেছেন এবং নিপুনভাবে কালচক্র যানের তথ্যাদি অনুসন্ধান করিতেছেন। তাহার নিকট হইতে অনেক বহুমূল্য ঐতিহাসিক সত্যের সন্ধান পাওয়া যাইবে বলিয়া আশা করা যায়।
কালচক্র দেবতার একটি মূর্তির বিশদ পরিচয় নিষ্পন্নযোগাবলীতে পাওয়া যায়। কালচক্রমণ্ডলে প্রাপ্ত বিবরণ হইতে দেখা যায় তাহার মূর্তি অক্ষোভ্যের ন্যায় নীলবর্ণ। তাহার মুখ চারিটি এবং হাত চতুর্বিংশতি । তিনি আলীঢ় আসনে অনঙ্গ এবং রুদ্রদেবতার শয়ান দেহের উপর নৃত্য করিতে থাকেন। তাহার পরিধানে ব্যাঘ্রচর্ম এবং চারিটি মুখে বারোটি চক্ষু থাকে। তাহার গ্রীবা তিনটি এবং স্কন্ধ ছয়টি। প্রধান হাত চব্বিশটি, তাহার বারোটি দক্ষিণে আর বারোটি বামে । প্রধান হাতের পর অনেকগুলি গৌণ হাত আছে। সর্বশুদ্ধ প্রধান ও অপ্রধানে মিলাইয়া তাহার হাত চব্বিশ সহস্র। মূল হাত অবশ্য চব্বিশটি, এক এক দিকে বারোটি করিয়া। এই হাতের রঙ আবার ভিন্ন ভিন্ন। দক্ষিণ দিকে নীল বর্ণের চারিটি হাতে বজ্র , অসি, ত্রিশুল ও কর্ত্রি থাকে; চারিটি রক্তবর্ণের হাতে অগ্নি, শর, বজ্র এবং অঙ্কুশ থাকে; এবং শুক্ল বর্ণের চারিটি হাতে চক্র, ছুরিকা, দণ্ড এবং পরশু থাকে। সেইরূপ বামদিকে নীলবর্ণ চারিটি হাতে ঘণ্টা, পাত্র, খট্বাঙ্গ ও কপাল থাকে; চারটি রক্তবর্ণ হস্তে ধনু, পাশ, রত্ন এবং পদ্ম থাকে; এবং চারিটি শুক্লবর্ণ হস্তে দর্পণ, বজ্র, শৃঙ্খল এবং ব্রহ্মমুন্ড থাকে। সংক্ষেপে ইহাই কালচক্রের বিচিত্র মূর্তির বিবরণ। আশ্চর্যের বিষয়, যদিও তাহার ধাতু বা প্রস্তুর মূর্তি বেশি দেখা যায় না, কাপড়ে আঁকা প্রাচীরচিত্র প্রচুর নেপালে ও তিব্বতে পাওয়া যায়।
প্রসন্নতারাঃ পীতবর্ণের প্রসন্নতারা দেখিতে অতি ভয়ঙ্কর। তাহার বদনমণ্ডল ক্রোধোদ্ভাসিত, অগ্নিশিখার ন্যায় তাহার পিঙ্গল কেশরাজি মস্তকের উপর উত্থিত হয়। তিনি অষ্টমুখা ও ষোড়শভুজা। আটটি দক্ষিণ হস্তে খট্বাঙ্গ, উৎপল, বাণ, বজ্র, অঙ্কুশ, মুদ্গর, কর্ত্রি এবং অভয়মুদ্রা প্রদর্শন করেন। আটটি বাম হস্তে পাশযুক্ত তর্জনী, কপাল, ধনু, খট্বাঙ্গ, বজ্র, পাশ, ব্রহ্মমুণ্ড এবং রত্নপূরিত ঘট ধারণ করিয়া থাকেন। দেবী প্রত্যালীঢ় পদে দাঁড়াইয়া বাম পদে ইন্দ্রকে এবং দক্ষিণ পদ দ্বারা উপেন্দ্রকে দলিত করেন এবং দুই পদের মধ্যে রুদ্র, ব্রহ্মা ও অপরাপর মারগণকে নিষ্পেষিত করিয়া থাকেন। ইহার মূর্তি অতীত দুষ্প্রাপ্য। [5]

বুদ্ধ অবতার

এমন দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষ-বিদ্বেষের পটভূমিতেই বুদ্ধকে বিষ্ণুর অবতার বলে ঘোষণা করা হয়।সেটা শাস্ত্রকারদের একটা ছলনা ছাড়া অন্য কিছু ছিল না। পৌরাণিক কাহিনীতে বলা হয়েছে, অতীতে অসুরেরা বৈদিক ধর্ম অবলম্বন করে অপরাজেয় হয়ে উঠলে বিষ্ণু বুদ্ধ রূপে অবতীর্ণ হয়ে বৌদ্ধ ধর্ম প্রচার করে অসুরদের বিভ্রান্ত করেন। যার ফলে দেবতারা অসুরদের পরাজিত করতে সমর্থ হয়।

অগ্নিপুরাণে বলা হয়েছে,

“ অগ্নি বললেন, সম্প্রতি বুদ্ধাবতার বর্ণনা করছি। এটা পাঠ বা শ্রবণ করিলে অর্থ লাভ হয়ে থাকে। পুরাকালে দেবাসুর সংগ্রামে দেবতারা দানবগণ কর্তৃক পরাজিত হয়ে ঈশ্বরের কাছে গিয়ে তার শরণাগত হন এবং আমাদের রক্ষা করুন, রক্ষা করুন বলে দীনভাব প্রকাশ করেন। তখন মায়ামোহস্বরূপ ভগবান শুদ্ধোধনের পুত্ররূপে অবতীর্ণ হয়ে বুদ্ধ নামে প্রসিদ্ধ হলেন। তার মায়ায় দানবেরা বেদ ধর্ম পরিত্যাগ করে বৌদ্ধ হল, এই প্রকারেই বেদ ধর্ম বিবর্জিত পাষণ্ডদের সৃষ্টি হয়, তারা সর্বদাই নরকার্হ কর্মের অনুষ্ঠান করত। কলিযুগের অবস্থানে সকল ব্যক্তিই ঐরুপ বেদাচারবিহীন সঙ্কর ধর্ম কুঞ্চকধারী, দস্যু ও অধর্ম লিপ্সু হবে। তখন ম্লেচ্ছগণ রাজরূপী হয়ে মানুষদের ভক্ষণ করবে। পরে ভগবান কল্কি বিষ্ণুযশার পুত্ররূপে অবতীর্ণ হয়ে অস্ত্রশস্ত্র গ্রহণ পূর্বক তাদের উৎসাদিত করবেন। মহর্ষি যাজ্ঞবল্ক্য তার পুরোহিত হবেন। তখন পুনরায় বর্ণাশ্রমাচার আগের মত সংস্থাপিত হবে এবং প্রজাগণ সৎ কর্মানুষ্ঠান ও ধর্মাচরণে আস্থা প্রদর্শন করবে। অবশেষে ভগবান কল্কিরূপ পরিত্যাগ করে স্বর্গ ধামে প্রস্থান করবেন। এরপর পুনরায় সত্যযুগের উদয় হবে তখন সব রকম বর্ণ; আশ্রম ও ধর্ম স্বপদে প্রতিষ্ঠিত থাকিবে। (১-১০) “
[6]

ভাগবতেও একই কথা বলা হয়েছে-

“তারপর কলিযুগ প্রবৃত্ত হইলে।
জন্মিবেন বুদ্ধরূপে অবনীমণ্ডলে।।
বুদ্ধরূপে হয়ে প্রভু অঞ্জন নন্দন।
দুষ্টগণে বিমোহিত করিবে তখন।।
এরূপে কলিযুগে জন্মি গয়াদেশে।
প্রচার করিবে বৌদ্ধ ধর্ম প্রভু বিংশে।।”
[7]

এবং ২য় স্কন্ধের সপ্তম অধ্যায়ে বলা হয়েছে,

“অসুরেরা হয় যবে বেদ অনুগত।
বুদ্ধরূপে করিলেন সবে মোহাগত।।
কলিশেষ হবে যবে ওহে মতিমান।
যাগ, যজ্ঞ, স্বাহা নাহি রবে বিদ্যমান।।
ম্লেচ্ছ হবে ধরা পতি জানিবে অন্তরে।
তাহারে নাশিবে প্রভু কল্কি অবতারে।।”
[8]

সারদা তীলক তন্ত্রে (১৭/১৫৮) দশাবতার স্তোত্রে বুদ্ধ বন্দনায় বলা হয়েছে ,

“পুরাকালে দেবতাদের অসুর বিজয় সম্ভব করতে যিনি চীবর পরিধান করেছিলেন, সেই মূলকারণ বুদ্ধকে প্রণাম করি।“

বিষ্ণু পুরাণেও অসুরেরা বৈদিক ধর্ম ও বর্ণাশ্রম ধর্ম পালন করে ও তপস্যার দ্বারা শক্তিশালী হয়ে উঠে দেবতাদের পরাজিত করে ত্রিলোক দখল করে। দেবতারা তখন বিষ্ণুর কাছে উপস্থিত হয়ে তাকে সব কিছু জানান। তখন বিষ্ণু তার শরীর থেকে মায়ামোহকে উৎপন্ন করেন-

“দেবগণ কর্তৃক এইরূপে উক্ত হয়ে ভগবান বিষ্ণু নিজ শরীর হতে মায়ামোহ উৎপাদন করে সুরশ্রেষ্ঠগণকে প্রদান করলেন। শ্রীভগবান বললেন,- এই মায়ামোহ সমুদায় দৈত্যকে মোহিত করবে, পরে তারা বেদ মার্গহীন হলে, তোমরা অনায়াসে তাদের বিনাশ করতে পারবে।…”

নর্মদা তীরে মায়ামোহ ‘দিগম্বর (উলঙ্গ) , মুণ্ডিতমস্তক (ন্যাড়া) ও বহির্পত্রধারী’ হয়ে উপস্থিত হয়ে অসুরদের বিভ্রান্ত করেন-

“হে দ্বিজ! তখন মায়ামোহ দিগম্বর, মুণ্ডিতমস্তক ও বহিরপত্রধারী হয়ে অসুরদের এইরূপ মধুর বাক্য বলতে আরম্ভ করলেন,- হে দৈত্যপতিগণ! তোমরা কেন তপস্যা করছ, তা বল। এই তপস্যা দ্বারা তোমরা ঐহিক না পরলৌকিক ফল ইচ্ছা কর? অসুরগণ বলল, – হে মহামতে, পারত্রিক ফল লাভের জন্য আমরা তপস্যা করতে আরম্ভ করেছি, এ বিষয়ে তুমি কি বলতে ইচ্ছা কর? মায়ামোহ বললেন, – যদি তোমরা মুক্তির ইচ্ছা কর , তাহলে আমার বাক্যানুসারে কর্ম কর এবং , মুক্তির অসংবৃত দ্বার স্বরূপ আমার কথিত ধর্মের অনুষ্ঠান কর। এই ধর্মই মুক্তির উপযোগী, এটা হতে শ্রেষ্ঠ অন্য কোনো ধর্মই নেই। এই ধর্মে অবস্থান করলে স্বর্গ বা মুক্তি যাহাতে অভিরুচি হয় তাহা পেতে পারবে। তোমরা সকলেই মহাবল, তোমরা এই ধর্ম গ্রহণ কর। পরাশর বললেন, এইরূপে মায়ামোহ নানাপ্রকার যুক্তি প্রদর্শন দ্বারা এবং পরিবর্ধিত বাক্য সমূহ দ্বারা দৈত্যগণকে বেদ মার্গ হতে বিচ্ছিন্ন করলেন। এতে ধর্ম হয়, এতে অধর্ম হয়, এটি সৎ, এটি অসৎ, এটা মুক্তির কারণ, এতে মুক্তিলাভ হয় না, এটা অত্যন্ত পরমার্থ, এই কাজ পরমার্থ নয়, এটা স্পষ্ট এই প্রকার, এটা দিগম্বরদের ধর্ম, এটা বহুবস্ত্র মানুষের ধর্ম, হে দ্বিজ এরূপ অনেকপ্রকার সংশয় জনক বাক্য বলে মায়ামোহ দৈত্যদের স্বধর্ম পরিত্যাগ করালেন।
মায়ামোহ দৈত্যদের বলেছিলেন যে, তোমরা এই মহাধর্ম মান্য কর। এই জন্য যারা এই ধর্ম গ্রহণ করে, তাহারা আর্হত নামে বিখ্যাত হয়।…” (এখানে জৈনদের কথা বলা হয়েছে)

এরপর মায়ামোহ গেরুয়া কাপড় পড়ে অন্য অসুরদের বৈদিক ধর্ম হতে বিচ্যুত করেন-

“এরপর মায়ামোহ রক্তাম্বর পরিধান করে চক্ষুতে অঞ্জন রাগ করে অন্য অসুরদের কাছে গিয়ে মৃদু মধুর বাক্যে বলতে আরম্ভ করলেন,- হে অসুরেরা ! যদি নির্বাণ, মুক্তি বা স্বর্গ তোমাদের কামনা থাকে, তাহলে পশুহিংসা প্রভৃতি দুষ্ট ধর্মে কোন ফল হবে না- এটা জানবে, জগত বিজ্ঞানময় বলে অবগত হও। আমার বাক্য ভাল করে বোঝ, এই বিষয়ে পণ্ডিতেরা এরূপ বলেছেন যে, এই জগত অনাধার, ভ্রমজ্ঞানগোচর, অর্থান্বেষণে তৎপর ও রাগাদিদ্বেষ সাতিশয় দূষিত। এটা ভবসংকটে নিয়ত পরিভ্রমণ করছে। পরাশর বললেন,- মায়ামোহ এরূপ জ্ঞাত হও, এরূপ বুঝবে এবং এরূপ বুঝে রাখ- এই বলে দানবদের নিজ ধর্ম পরিত্যাগ করালেন। মায়ামোহ দৈত্যদের নিকট এরূপ নানাপ্রকার যুক্তিযুক্ত বাক্য বলতে লাগলেন যে, তারা সেই বাক্যানুসারে স্ব স্ব ধর্ম পরিত্যাগ করল। ধর্ম ত্যাগীরা অন্যের নিকট বলল,- অন্যেও পরের নিকট প্রচার করতে লাগল।…” (এখানে বৌদ্ধদের কথা বলা হয়েছে)

“এভাবে মায়ামোহের মোহপ্রভাবে অসুরেরা অল্পকালে বেদমার্গাশ্রিত সকল কথা পরিত্যাগ করল। হে দ্বিজ ! তাদের মধ্যে কেউ কেউ বেদের নিন্দা করল, কেউ কেউ দেবতাদের নিন্দা আরম্ভ করল; কেউ বা যজ্ঞাদি কর্ম কলাপের, কেউ বা ব্রাহ্মণের নিন্দা করতে লাগল।যে কার্যে কোনো প্রাণীর হিংসা হয়, তেমন কার্যে ধর্ম হয়- এই বাক্য কখনোই যুক্তিসঙ্গত নয়। ঘৃত সমূহ অনলে দগ্ধ হলে ফল প্রদান করে-তা বালকের যোগ্য বাক্য। অনেক যজ্ঞ দ্বারা দেবতা হয়ে ইন্দ্রের সাথে যদি শমী প্রভৃতি কাঠ ভোজন করতে হয়, তবে দেবতা অপেক্ষা পশুও শ্রেষ্ঠ; যেহেতু পশু সরস পত্র ভক্ষণ করে। যজ্ঞ স্থলে পশুবধ করলে যদি সেই পশু স্বর্গে গমন করে, তবে যজমান কেন আপনার পিতাকে বধ করেনা? শ্রাদ্ধকালে এক ব্যক্তি ভোজন করলে যদি অন্য ব্যক্তির তৃপ্তি হয়, তাহলে প্রবাস গমনকালে খাদ্যদ্রব্য সঙ্গে নেওয়ার কি প্রয়োজন? (পুত্ররা শ্রদ্ধার সাথে গৃহে আহার করলেই প্রবাসীর তৃপ্তি হতে পারে) অতএব এটা কেবল লোকের বিশ্বাসের উপর নির্ভর করছে। তোমরা এটা বিবেচনা করে দেখ, এসব উপেক্ষা করাই শ্রেয় হচ্ছে। আমি যা বললাম, তাতে তোমাদের রুচি হোক।হে অসুরেরা! আপ্তবাক্য সকল আকাশ হতে পতিত হয় না। তোমরা, আমি বা অন্য ব্যক্তি সকলেরই যুক্তি সঙ্গত বাক্য গ্রহণ করা উচিত। মায়ামোহ এরূপ অনেক উপায় দ্বারা দৈত্যদের এমন বিকৃত ভাবাপন্ন করে দিলেন যে, তাদের মধ্যে কোনো ব্যক্তিরই আর বেদে রুচি রইল না।” (এখানে চার্বাকদের কথাগুলো পাওয়া যায়)

এভাবে অসুরেরা বেদ ধর্ম হতে বিচ্যুত হলে দেবতারা সহজেই তাদের পরাজিত করেন। [9]

হিন্দু ধর্মে বুদ্ধের মর্যাদা

অবতার ঘোষিত হওয়ার পরে বুদ্ধ অবশ্য হিন্দু ধর্মে খানিকটা সম্মানও পেয়েছিলেন।
কবি জয়দেব তার গীতগোবিন্দে বলেন,

“যিনি বৈদিক যাগযজ্ঞের নিন্দা করলেন, যজ্ঞে বলি প্রদত্ত পশুদের প্রতি করুণা প্রকাশ করলেন , সেই মহাপুরুষের প্রভাব এমনই অনতিক্রমণীয় হয়ে পড়েছিল যে তিনি বিষ্ণুর প্রকাশরূপে স্বীকৃতি পেলেন।

বৃহন্নারদীয় পুরাণের ২য় অধ্যায়ে বলা হয়েছে-

“…নিজ বুদ্ধিতে ভূমি প্রভৃতি ত্রিলোক এবং আত্মাকে বিলীন করে অবস্থিত যে পুরুষকে যোগিরা অবলোকন করেন, সেই বুদ্ধাবতারকে ভজনা করি।”

হিন্দুদের বৌদ্ধ ধর্মস্থান জবর দখল

শুধুমাত্র বুদ্ধের হিন্দুকরণ নয়, বৌদ্ধ ধর্মের অবনতিকালে হিন্দুরা বৌদ্ধদের অনেক ধর্মীয় স্থান দখল করে নিজেদের বলে প্রচার করেছিল। বুদ্ধগয়ার একটি দেবালয়ে গোল পাথরে দুইটি পদচিহ্ন রয়েছে। তার নাম বুদ্ধপদ। কনিং হেম দেখেছেন, অমর দেবের খোদিত লিপিতে তা বিষ্ণু পদ বলে লিখিত। তাই তিনি অনুমান করেন, আগে তা বুদ্ধপদ ছিল, পরে হিন্দুরা তাকে বিষ্ণুপদ বলে প্রচার করে। গয়াও পূর্বে বৌদ্ধ ধর্মস্থল ছিল। গয়ার অনেক হিন্দু মন্দিরে আজও বুদ্ধদেবের খোদিত লিপি বিদ্যমান রয়েছে। [10]
পুরির বিখ্যাত জগন্নাথ মন্দিরও আগে বৌদ্ধদের মন্দির ছিল বলে অক্ষয় কুমার দত্ত মত প্রকাশ করেন। অক্ষয়কুমার দত্ত বলেন,

“জগন্নাথের ব্যাপারটিও বৌদ্ধ ধর্ম মূলক বা বৌদ্ধ ধর্ম মিশ্রিত বলিয়া প্রতীয়মান হয়। জগন্নাথ বুদ্ধাবতার এইরূপ একটি জনশ্রুতি সর্বত্র প্রচলিত আছে। চীন দেশের তীর্থ যাত্রী ফা হিয়েন ভারত বর্ষে বৌদ্ধ তীর্থ পর্যটন যাত্রা করিয়া পথিমধ্যে তাতার দেশের অন্তর্গত খোটান নগরে একটি বৌদ্ধ মহোৎসব সন্দর্শন করেন। তাহাতে জগন্নাথের রথযাত্রার ন্যায় অবিকল এক রথে তিনটি প্রতিমূর্তি দৃষ্টি করিয়া আইসেন। মধ্যস্থলে বুদ্ধ মূর্তি ও তাহার দুই পার্শে দুইটি বোধিসত্ত্বের প্রতিমূর্তি সংস্থাপিত ছিল। খোটানের উৎসব যেই সময়ে ও যতদিন ব্যাপিয়া সম্পন্ন হইত, জগন্নাথের রথযাত্রাও প্রায় সেই সময়ে ও ততদিন ব্যাপিয়া অনুষ্ঠিত হইয়া থাকে। মেজর জেনেরল কনিংহম বিবেচনা করেন, ঐ তিনটি মূর্তি পূর্বোক্ত বৌদ্ধ ত্রিমূর্তির অনুকরণ বই আর কিছুই নয়। সেই তিনটি মূর্তি বুদ্ধ, ধম্ম ও সংঘ। বৌদ্ধেরা সচরাচর ঐ ধর্মকে স্ত্রীরূপ বলিয়া বর্ণন করিয়া থাকে। তিনি জগন্নাথের সুভদ্রা। শ্রীক্ষেত্রে বর্ণ বিচার পরিত্যাগ প্রথা এবং জগন্নাথের বিগ্রহ মধ্যে বিষ্ণু পঞ্জরের অবস্থিতি প্রবাদ এ দুটি বিষয় হিন্দু ধর্মের অনুগত নয়; প্রত্যুত নিতান্ত বিরুদ্ধ। কিন্তু এই উভয়ই সাক্ষাৎ বৌদ্ধমত বলিলে বলা যায়। দশাবতারের চিত্রপটে বুদ্ধাবতারের স্থলে জগন্নাথের প্রতিরূপ চিত্রিত হয়। কাশি এবং মথুরার পঞ্জিকাতেও বুদ্ধাবতার স্থলে জগন্নাথের রূপ আলেখিত হইয়া থাকে। এই সমস্ত পর্যালোচনা করিতে করিতে , জগন্নাথের ব্যাপারটি বৌদ্ধ ধর্ম মূলক বলিয়া স্বতই বিশ্বাস হইয়া উঠে। জগন্নাথ ক্ষেত্রটি পূর্বে একটি বৌদ্ধ ক্ষেত্রই ছিল এই অনুমানটি জগন্নাথ বিগ্রহ স্থিত উল্লিখিত বিষ্ণু পঞ্জর বিষয়ক প্রবাদে একরূপ সপ্রমাণ করিয়া তুলিতেছে। যে সময়ে বৌদ্ধেরা অত্যন্ত অবসন্ন হইয়া ভারতবর্ষ হইতে অন্তর্হিত হইতেছিল সেই সময়ে অর্থাৎ খ্রিষ্টাব্দের দ্বাদশ শতব্দীতে জগন্নাথের মন্দির প্রস্তুত হয়, ইহা পূর্বে সুস্পষ্ট প্রদর্শিত হইয়াছে। এই ঘটনাটিতেও উল্লিখিত অনুমানের সুন্দররূপ পোষকতা করিতেছে। চীন দেশীয় তীর্থ যাত্রী হিউয়েন সাং উৎকলের পূর্ব দক্ষিণ প্রান্তে সমুদ্র তটে (অর্থাৎ উড়িষ্যার যে অংশে পুরি সেই অংশে ) চরিত্রপুর নামে একটি সুপ্রসিদ্ধ বন্দর দেখিয়া যান। ঐ চরিত্রপুরই এক্ষণকার পুরী বোধহয়। তাহার নিকটে পাঁচটি অত্যুন্নত স্তূপ ছিল।শ্রীমান এ, কনিং হেম অনুমান করেন, তাহারই একটি অধুনাতন জগন্নাথ মন্দির। স্তূপের মধ্যে বুদ্ধাদি অস্থি কেশাদি সমাহিত থাকে। এই নিমিত্তই জগন্নাথের বিগ্রহ মধ্যে বিষ্ণু পঞ্জরের অবস্থিতি বিষয়ক উল্লিখিত প্রবাদ প্রচলিত হইয়াছে। “ [10]

বুদ্ধ বিষ্ণুর অবতার একথা যারা স্বীকার করে না

আম্বেদকর বুদ্ধের বিষ্ণুর অবতার হবার বিষয়টি অস্বীকার করেন। তার দলিত আন্দোলনের ২২ টি সঙ্কল্পের মধ্যে ৫ম সংকল্প হল, “আমি বিশ্বাস করি না এবং করবো না যে ভগবান বুদ্ধ বিষ্ণুর অবতার। আমি বিশ্বাস করি এটা নিছক পাগলামি এবং মিথ্যা প্রচার।“ [11]

শ্রীলঙ্কার জনপ্রিয় ভিক্ষু কে. শ্রী ধম্মানন্দ অভিযোগ করেছেন, কিছু গোঁড়া ধার্মিকেরা বুদ্ধের উদার শিক্ষার জন্য তার নিন্দা করার চেষ্টা করেন কিন্তু যখন তারা তাদের লক্ষ্যে সফল হল না, তারা তাকে তাদের ভগবানের অবতার বলে পরিচয় দিয়ে তার মর্যাদা খর্ব করার চেষ্টা করলো। তাদের উদ্দেশ্যে ছিল তাদের ধর্মে বৌদ্ধ ধর্মের আত্মীকরণ। তিনি আরও বলেন, এই পন্থা ভারতে বৌদ্ধ ধর্মের উৎসস্থল হতে বৌদ্ধ ধর্মকে উৎখাত করতে কাজ করেছিল। [12]

১৯৯৯ সালে সারনাথের মহাবোধী সমাজ, জয়েন্দ্র সারস্বত কাঞ্চী কামাকোটি পীঠম এবং এস.এন গোয়েঙ্কা, আলোচনা করার পর নিম্নোক্ত তিনটি বিষয়ে সহমত হয়ে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করেন। তাতে বলা হয়,

১. যেকোনো কারণে হোক অতীতের কিছু ভারতীয় সাহিত্যে বুদ্ধকে বিষ্ণুর অবতার বলে ঘোষণা করা হয়েছে এবং তার সম্বন্ধে বিভিন্ন কথা লেখা হয়েছে। প্রতিবেশি দেশের কাছে এটা খবই দুঃখজনক। বৌদ্ধ এবং হিন্দুদের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখার জন্য আমরা ঘোষণা করছি অতীতে যাই হয়ে থাকুক ভবিষ্যতে তা প্রচার করা হবে না।
২. আরেকটি ভ্রান্তি প্রতিবেশি দেশগুলোতে ছড়িয়ে পড়েছে যে ভারতের হিন্দু সমাজ বৌদ্ধদের উপর প্রভাব বিস্তার করার জন্য বৈঠকের আয়োজন করছে। চিরদিনের জন্য এই ভ্রান্তি দূর করতে আমরা ঘোষণা করছি, বৈদিক এবং শ্রমণ উভয়ই ভারতের প্রাচীন ঐতিহ্য। ( বিষ্ণু বৈদিক ঐতিহ্যের অন্তর্গত এবং বুদ্ধ শ্রমণ ঐতিহ্যের অন্তর্গত।) এক সম্প্রদায়ের উপর অন্য সম্প্রদায়ের আধিপত্য করার প্রচেষ্টা উভয়ের মধ্যে ঘৃণা ও অশুভের সৃষ্টি করবে। তাই ভবিষ্যতে এমন কাজ করা উচিত নয় এবং উভয় ঐতিহ্যকেই সমান সম্মান প্রদর্শন করা উচিত।
৩. ভালো কাজের দ্বারা যে কেউ সমাজে উচ্চ স্থান লাভ করতে পারে। খারাপ কাজের দ্বারা সমাজের চোখে নীচ ব্যক্তিতে পরিণত হতে হয়। তাই যে কেউ ভালো কাজের মাধ্যমে এবং কলুষ যেমন কাম, ক্রোধ, অহংকার,অজ্ঞতা,লোভ,হিংসা দূর করার মাধ্যমে সমাজে উচ্চ স্থান লাভ করতে পারে এবং সুখ ও শান্তি উপভোগ করতে পারে।

আমরা উপরোক্ত তিনটি নির্দিষ্ট বিষয়ে সহমত পোষণ করি এবং কামনা করি ভারতের সকল ঐতিহ্যের মানুষদের মধ্যে সৌহার্দ্য বজায় থাকবে এবং প্রতিবেশি দেশগুলোরও ভারতের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বর্তমান থাকবে। [13]


তথ্যসূত্র

  1. গরুড় পুরাণ / পূর্ব খন্ড / ১ম অধ্যায় | অনুবাদক- পঞ্চানন তর্করত্ন, নবভারত পাবলিশার্স [][]
  2. Untouchables- B.R Ambedkar [][][][]
  3. বাঙ্গালীর ইতিহাস আদিপর্ব- নীহার রঞ্জন রায় [][][][]
  4. বৌদ্ধ ধর্ম- হরপ্রসাদ শাস্ত্রী []
  5. সূত্রঃ বৌদ্ধদের দেবদেবী ; লেখক- বিনয়তোষ ভট্টাচার্য []
  6. অগ্নিপুরাণ/১৬ অধ্যায়, অনুবাদক- পঞ্চানন তর্করত্ন, নবভারত পাবলিশার্স, প্রথম সংস্করণ ১৯৯৯ []
  7. ভাগবত ১ম স্কন্ধ ,৩য় অধ্যায়(অবতার কথন দ্বারা ভগবানের চরিত্র বর্ণন) |বেণীমাধব শীলস কর্তৃক সম্পাদিত, অক্ষয় লাইব্রেরী []
  8. ভাগবত/ ২য় স্কন্ধ/ ৭ম অধ্যায়ে (ব্রহ্মা কর্তৃক নারদের নিকটে ভগবানে লীলাবতার কথন এবং তত্তদবতারের কর্ম ও গুণ বর্ণন) []
  9. বিষ্ণু পুরাণ/৩/ ১৭-১৮ অধ্যায় []
  10. ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়- অক্ষয় কুমার দত্ত [][]
  11. Ucko, Hans (2002) The People of the God. LIT verlang Munster, p 101, ISBN 978-3-8258-5564-2 []
  12. Dhammananda, K shri (2002) What Buddhists believe ( Expanded 4th edition) Kuala lampur ,Malaysia; Buddhist Missionary Society []
  13. Fostering Friendly Relations. Vridharamma.org Retrieved 2012-08-14. The Maha Bodhi Society Office, Saenath, Varanasi, 3.30 pm , 11th November 1999 []
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত © সংশয় - চিন্তার মুক্তির আন্দোলন

অজিত কেশকম্বলী II

"মানুষ ছাড়া ক্ষ্যাপারে তুই মূল হারাবি, মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি।"

2 thoughts on “বেদবিরোধী বুদ্ধকে কেন বিষ্ণুর অবতার বানানো হল?

  • May 30, 2020 at 2:09 PM
    Permalink

    ড. বি আর আম্বেদকর বলেছেন, ‘ভারতের মূল ইতিহাস বৌদ্ধদের উপর ব্রাহ্মণ্যবাদিদের আক্রমনের ইতিহাস।’ লেখাটি সেই কথাই প্রতিষ্ঠিত করল। ধন্যবাদ। এমন লেখা আরো চাই।

    Reply
  • September 29, 2023 at 4:32 PM
    Permalink

    বুদ্ধ একমাত্র ব্যক্তি যিনি আড়াই হাজার পূর্বেই ব্রাহ্মণদের শাসন শোষনের বিরোদ্ধে এককভাবে প্রতিবাদ-প্রতিরোধ করে শাসক, রাজা, প্রজা সকলকে জাত বর্ণ ঊর্ধে একটি আদর্শ দর্শন ও আলোর পথ দেখিয়েছ্লেন।
    পৃথিবীতে একমাত্র বুদ্ধই এমন ব্যক্তি যিনি হত্যা যুদ্ধ বিভাজন বৈষম্য ঊর্ধে সাম্য মৈত্রী করুনা ও ক্ষান্তির বাণী প্রচার করেছিলেন।
    পর্বতীতে ব্রাহ্মণরা নানা ষড়যন্ত্রে বৌদ্ধ ভিক্ষু- বৌদ্ধ বিহার একে একে ধ্বংস করে, দখল করে নিজেদের মনগড়া নতুন ইতিহাস তৈরী করে তা প্রচার করেন।
    তৎসর্ত্বেও সত্য কখনো চাপা থাকে না। বুদ্ধের আলো যুগে যুগে প্রতীয়মান হচ্ছে হবে পুরো বিশ্বে।
    স্বামী বিবেকানন্দও বুদ্ধের নাম বিক্রি করে আমেরিকায় শিকাগো বক্তব্যে ভারতকে উপস্থাপন করেছিলেন। স্বামীজী ছিলেন স্ববিরোধী ধূর্ত প্রতারক , বহিবিশ্বে গিয়ে বুদ্ধকে আশ্রয় করা ছাড়া তার দ্বিতীয় বিকল্প ছিল না, কিন্তু ভারতে এসে আবার বুদ্ধ বিদ্বেষী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে ছিলেন।
    বুদ্ধই একমাত্র ব্যক্তি যাক দর্শন যুগে যুগে কালে কালে মানব সভ্যতার তথা সকল প্রাণীর জন্যে প্রাসঙ্গিক হয়ে থাকবে।

    Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *