মমি, ফেরাউনের গল্প এবং বিজ্ঞান

Print Friendly, PDF & Email

মমি কি?

মমি হল প্রাকৃতিক বা কৃত্রিমভাবে সংরক্ষিত মৃতদেহ। এই সংরক্ষনের প্রক্রিয়াকে বলা হয় মামিফিকেশন (mummification)। এখানে আমরা আলোচনা করব মিশরের মমি (কৃত্রিম মমি) সম্পর্কে বিশেষত ফেরাউন সম্পর্কে।

মমির ইতিহাস

প্রাগৈতিহাসিক সময় থেকেই মিশরে মৃতদেহ মমি করার প্রচলন ছিল। খৃষ্ট জন্মের ২৬০০ বছর আগে প্রথম মমির মাধ্যমে মৃতদেহ সংরক্ষণ শুরু হয় বলে মনে করা হয়। এবং সেটা দু হাজারেও বেশি বছর ধরে চালু ছিল। (1)

কাদের দেহ মমি করা হত?

সাধারণত মিশরের ফারাওদের (ফেরাউন) দেহ মমি করা হত। (1) তবে ফারাও ছাড়াও রাজপরিবারের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের এমনকি সাধারন মানুষের দেহও মমি করার নজির আছে। তবে যেহেতু এটা একটা ব্যয়বহুল প্রক্রিয়া তাই এটা সাধারন মানুষের সাধ্যের বাইরে ছিল। এছাড়া ধর্মীয় কারনে মানুষ ছাড়াও বানর,পাখি,বিড়াল এবং কুমিরের দেহ মমি করা হত। (2) (3)

মমি তৈরির প্রক্রিয়া

একজন প্রধান পুরোহিতের নেতৃত্বে মমি বানানো হত যার ধর্মীয় এবং মানুষের শরীরের এনাটমি সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা থাকত। প্রথম ধাপে মৃতের শরীর থেকে সব পচনশীল অংগ বের করে ফেলা হত যেগুলো সহজে পচে যায়। মাথার ঘিলু বের করা হত নাকের ফুটো দিয়ে বিশেষভাবে তৈরি হুক দিয়ে। (এখনকার দিনেও ব্রেনের অনেক অপারেশন নাকের ফুটো দিয়ে যন্ত্র ঢুকিয়ে করা হয়)। এটা করতে যথেষ্ট সতর্কতা এবং দক্ষতার প্রয়োজন,নাহলে সহজেই লাশের মুখ বিকৃত হতে পারে। এরপর পেটের বাদিক কেটে পেটের সব নাড়ি পাকস্থলী লিভার কিডনি বের করা হত। পেট দিয়েই ফুসফুস বের করা হত। শুধু হৃদপিন্ড রেখে দেয়া হত। কেননা তখনকার ধারনা ছিল হৃদপিণ্ড হল মানুষের ভাবনা বা বুদ্ধির কেন্দ্র। নাড়িভুঁড়ি বা অন্য অংগ যেগুলো বের করা হত সেগুলোও আলাদা পাত্র (Canopic Jar)করে মমির সাথেই সমাধিস্থ করা হত। অনেক মমিতে এই অংগগুলো মমির সাথেই আলাদা সংরক্ষণ প্রক্রিয়ার রাখা হয়েছে বিশেষত পরের দিকে মমির ক্ষেত্রে।
দ্বিতীয় ধাপে মৃতদেহ শুকানো হত ন্যাট্রন লবন (4) দিয়ে। ন্যাট্রন লবনের তাড়াতাড়ি শুকানোর অসাধারণ ক্ষমতা আছে তাই এটা দিয়ে দেহ ঢেকে রাখা হত আদ্রতা দূর করার জন্য। কিছু প্যাকেটে ন্যাট্রন লবন শরীরের মধ্যেও ঢুকিয়ে রাখা হত। পুরোপুরি শুকিয়ে যাবার পর ভেতর থেকে লবনের প্যাকেট বের করে নিয়ে হালকা করে ধুয়ে নেয়া হত। কিছু কিছু জায়গাতে কাপড়ের টুকরো গুজে দেয়া হত যেখানে কুকড়ানো থাকত। এরপর কাপড় জড়ানো হত। শতশত হাত কাপড়ের প্রয়োজন হত একটা মমিকে পুরোপুরি কাপড়ে মোড়ার জন্য। প্রতিটা আঙুল আলাদা কাপড়ে জড়ানো হত। বিভিন্ন গয়না রত্ন সামগ্রী দেয়া হত স্তরের মধ্যে এটা ভেবে যে এগুলো মৃতদেহকে খারাপ হওয়া থেকে বাচাবে। গাছের রেজিন স্তরে স্তরে ঢালা হত বিভিন্ন ধাপে। সবশেষে শেষ স্তরের কাপড় পেচিয়ে মমিকে সম্পূর্ণ করা হত। মমিকে আসল দেখানোর জন্য নকল চোখ বসিয়ে দেয়া হত।
একদিকে যেমন পুরোহিত মৃতদেহকে তৈরি করত অন্যদিকে অসংখ্য মানুষ মমির জন্য সমাধি তৈরির কাজে ব্যস্ত থাকত। (1)

মমি নিয়ে কিভাবে গবেষণা হয়েছে?

মমি এবং সমাধির গায়ে লেখা লিপি উদ্ধার করে যেমন মৃতের সম্পর্কে অনেক তথ্য আবিষ্কৃত হয়েছে তেমনি এক্স রে সিটি স্ক্যান ইমেজ থেকে মমিকে কাটাছেঁড়া না করেই সে কবে মারা গেছিল, কত বয়সে মারা গেছিল সব জানা যায়। দেহের টিস্যু পরীক্ষা করে মৃত্যুর কারন জানা গেছে বেশিরভাগ মমির। থ্রিডি ইমেজ ব্যভার করে মমি কেমন দেখতে ছিল সেটাও এখন পুনর্গঠন করে দেখা সম্ভব হয়েছে। (5)

দ্বিতীয় রামেসিস কি কোরানে বর্ণিত ফেরাউন?

প্রথমত ফেরাউন কারো নাম নয় এটা মিশরের রাজাদের উপাধি (নবাব বা মুঘল সম্রাট যেমন উপাধি)। দ্বিতীয় রামেসিস মিশরের ফারাওদের মধ্যে সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ রাজা ছিলেন এজন্য তাকে বলা হয় রামেসিস দ্যা গ্রেট। ৬৬ বছর শাসন করে ৯০ বছর বয়সে উনি মারা গেছিলেন। মানে বৃদ্ধ বয়সে দ্বিতীয় রামেসিসের মৃত্যু হয় যেটা কোরানের সাথে মেলে না। মৃত্যুর কারন কি ছিল? মমি পরীক্ষায় জানা গেছে উনি মারা গেছিলেন বার্ধক্যজনিত আরথ্রাইটিস এবং আরট্রাইটিস সাথে খারাপ দাঁতের সংক্রমণজনিত কারনে। যেটা কোরানের সাথে অমিল। দ্বিতীয় রামেসিসের উচ্চতা ছিল পাচফুট সাত ইঞ্চি। (6)

দ্বিতীয় রামেসিসের মমি কোথায় পাওয়া গেছিল?

উনাকে প্রথমে KV7 নামের সমাধিতে রাখা ছিল। ডাকাতির (রত্ন সামগ্রীর লোভে প্রচুর চুরি ডাকাতি হত) জন্য সেখান থেকে উনার মমি আরেক সমাধিতে নিয়ে যায় হয়। ৭২ ঘন্টা পর সেখান থেকে আবার TT320 নামের সমাধিতে নিয়ে যাওয়া হয়। এসব ঘটনা দ্বিতীয় রামেসিসের গায়ে জড়ানো কাপড়ে লেখা হায়ারোগ্লিফিক্স লিপি থেকে জানা গেছে। এই তথ্যো কোরানের বিপরীত। (6)

দ্বিতীয় রামেসিস এর মমি ফ্রান্সে কেন নেওয়া হয়েছিল?

১৯৭৪ সালে ইজিপ্টোলজিস্টরা বুঝতে পারেন যে মমিটি তাড়াতাড়ি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে তাই সেটাকে পরীক্ষা এবং সংরক্ষণের জন্য ফ্রান্সে নিয়ে যাওয়া হয়। (7)
১৯৭৫ সালে মমির ফরেন্সিক পরীক্ষা করেন ফরবন্সিক বিভাগের প্রধান পিয়ারে ফার্নাড সিকাল্ডি। দ্বিতীয় রামেসিসের মৃত্যুর কারন সেই পরীক্ষাতেই উঠে আসে।

রামেসিসের মমিতে লবন কি সমুদ্রে ডুবে মৃত্যুর জন্য?

আগেই বলা হয়েছে সব মমি ন্যাট্রন লবন দিয়েই শুকানো হত (নোনা মাছ যেমন লবন দিয়ে সংরক্ষণ করা হয়)। দ্বিতীয় রামেসিসের মৃত্যু কি সমুদ্রে ডুবে হবার কোন সম্ভাবনা আছে? এক কথায় না। মিশরের শ্রেষ্ঠ সম্রাট যদি এভাবে মারা যেতেন তাহলে তার দলিল থাকত। ৯০ বছরের বৃদ্ধ রাজা যার আরথরাইটিস এবং আর্ট্রাইটিস ছিল তিনি যুদ্ধ করতে করতে মারা যাবেন সমুদ্রে ডুবে সেটা নেহাত গল্পে সম্ভব।

তথ্যসূত্রঃ

(1) Egyptian Mummies
(2) Mummied Ibis
(3) Falcon-Shaped Wooden Coffin, With Falcon Mummy
(4) Natron
(5) Egyptian mummy CT scan video, Smithsonian’s National Museum of Natural History
(6) Ramesses II
(7) Ramesses the Great By John Ray

View Comments (1)

  • ভাই একটা সাইটে দেখলাম মূসা আঃ এর জীবন কাল নাকি খ্রীষ্টপূর্ব 1392~1272 পর্যন্ত এটা কি সত্যি

Leave a Comment