রামায়ণে জাতিভেদ

রামায়ণ

রামায়ণ ও মহাভারত হিন্দুদের দুটি বিখ্যাত মহাকাব্য। শুধু মহাকাব্য নয় ধর্মগ্রন্থ হিসেবেও হিন্দুসমাজে এর যথেষ্ট সমাদর আছে। কিন্তু এই দুটি গ্রন্থেই  ভীষণভাবে জাতিভেদের প্রভাব বিদ্যমান। রামায়ণের উত্তরকাণ্ডে তপস্যা করার অপরাধে রাম শম্বুক নামে এক শূদ্রকে হত্যা করেন। রামের এই কুকীর্তি এখন অনেকেই জানেন। শম্বুক হত্যা হিন্দু সমাজের বর্ণবাদী রূপটিকে নগ্নভাবে ফুটিয়ে তুলেছে। কিন্তু পূর্বপুরুষের অপকর্ম ঢাকার জন্য এবং হিন্দু সমাজের এই কলঙ্কটিকে ধামাচাপা দেওয়ার জন্য অনেকেই রামায়ণের উত্তরকাণ্ডকে বারবার প্রক্ষিপ্ত বলেন; তারা রামায়ণের জাতিবাদী রূপটিকে আড়াল করতে চান। কিন্তু শুধুমাত্র উত্তরকাণ্ডে যে এসব জাতপাত রয়েছে তা কিন্তু নয়, রামায়ণের অনেকস্থানেই  এই বর্ণবাদ তার কালো থাবা  ফেলেছে । এই লেখাটিতে রামায়ণের নানাস্থান হতে বর্ণ এবং জাতপাত সম্বন্ধে যা জানা যায়, তা নিয়ে আলোচনা করা হবে।

বর্ণ

অরণ্যকাণ্ডের ১৪ তম সর্গে চার বর্ণের উল্লেখ পাওয়া যায়-

মনুর্ম্মনুষ্যান জনয়ৎ কাশ্যপস্য মহাত্মনঃ।

ব্রাহ্মণান্ ক্ষত্রিয়ান্ বৈশ্যান্ শূদ্রাংশ্চ মনুজর্ষভ।। ৩/১৪/২৯

অর্থাৎ, নরশ্রেষ্ঠ! মনু মহাত্মা কশ্যপের ঔরসে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র এই চারবর্ণে বিভক্ত মনুষদের উৎপন্ন করেন।

(এই মনু কিন্তু মনুসংহিতার মনু নন, মনু বলতে এখানে এক নারীকে বোঝানো হয়েছে।)

চার বর্ণের উপত্তি প্রসঙ্গে এর পর বলা হয়েছে –

মুখতো ব্রাহ্মণা জাতা উরসঃ ক্ষত্রিয়াস্তথা।

ঊরুভ্যাং জজ্ঞিরে বৈশ্যাঃ পদ্ভ্যাং শূদ্রা ইতি শ্রুতিঃ।। ৩/১৪/৩০

অর্থাৎ, কথিত আছে যে ব্রাহ্মণেরা মুখ হতে, ক্ষত্রিয়েরা বক্ষঃস্থল হতে বৈশ্যেরা ঊরুদ্বয় হইতে এবং শূদ্রেরা পাদদ্বয় হতে জন্মগ্রহণ করেন।

চার বর্ণের মধ্যে কে কার সেবা করে এই প্রসঙ্গে বালকাণ্ডের ৬ষ্ঠ সর্গে বলা হয়েছে-

ক্ষত্রং ব্রহ্মমুখং চাসীৎ  বৈশ্যাঃ ক্ষত্রমনুব্রতাঃ।

শূদ্রাঃ স্বকর্মনিরতাঃ ত্রীন বর্ণানুপচারিণঃ।। ১/৬/১৯

অর্থাৎ, ক্ষত্রিয়েরা ব্রাহ্মণের ও বৈশ্যেরা ক্ষত্রিয়ের অনুবৃত্তি করত এবং শূদ্রজাতি ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যের সেবায় নিযুক্ত থাকত। 

বালকাণ্ডের প্রথম সর্গে বলা হয়েছে রাম সকল বর্ণকে তাদের বর্ণানুমোদিত কাজে নিযুক্ত করেন-

রাজবংশান্ শতগুণান্ স্থাপয়িষ্যতি রাঘবঃ।

চাতুর্ব্বণ্যঞ্চ লোকেহস্মিন্ স্বে স্বে ধর্মে নিয়োক্ষ্যতি।। ১/১/৯৭

অর্থাৎ, তিনি ব্রাহ্মণ প্রভৃতি বর্ণ চতুষ্টয়কে স্ব স্ব ধর্মে নিয়োগ করে শতগুণ রাজবংশ স্থাপন করবেন।

বালকাণ্ডের প্রথম সর্গের শেষ শ্লোকে রয়েছে রামায়ণ পাঠের ফল। কিন্তু এতে দেখা যায়, রামায়ণ পাঠের ফলে একেক বর্ণের একেক ফল লাভ হবে-

পঠন্ দ্বিজো বাগৃষভত্বমীয়াৎ

স্যাৎ ক্ষত্রিয়ো ভূমিপতিত্বমীয়াৎ।

বণিগ্জনঃ পূণ্যফলত্বমীয়াৎ

জনশ্চ শূদ্রোহপি মহত্ত্বমীয়াৎ।। ১/১/১০১

অর্থাৎ, ব্রাহ্মণ এই উপাখ্যান পাঠ করলে বাকপটুতা, ক্ষত্রিয় রাজ্য, বণিক বাণিজ্যে বহু অর্থ ও শূদ্র মহত্ব লাভ করবেন।“

একই উপাখ্যান পাঠ করে মানুষের আলাদা আলাদা ফল কিভাবে প্রাপ্ত হয় তা বোধগম্য হচ্ছে না।

ব্রাহ্মণ

রামায়ণের নানা স্থানে ব্রাহ্মণদের মহিমা প্রচার করা হয়েছে।  

অরণ্যকাণ্ডের ২১ তম সর্গে স্বয়ং রাম বলছেন-

সংশ্রুত্য চ পিতুর্বাক্যং মাতুর্বা ব্রাহ্মণস্য বা।

ন কর্ত্তব্যং বৃথা বীর ধর্ম্মমাশিত্য তিষ্ঠতা।। ৩/২১/৪২

অর্থাৎ, পিতা, মাতা ও ব্রাহ্মণের বাক্য এবং প্রতিজ্ঞাত বিষয়ের অন্যথা করা ধার্মিকদের কর্তব্য নয়, সুতরাং আমি পিতৃশাসন অতিক্রম করতে পারিনা।

অযোধ্যাকাণ্ডের ১০০ তম সর্গে রাম ভরতকে বলছেন-

কচ্চিদ্দেবান্ পিতৃন্ ভৃত্যান্ গুরুন্ পিতৃসমানপি।

বৃদ্ধাংশ্চ তাত বৈদ্যাংশ্চ ব্রাহ্মণাংশ্চাপি মন্যসে।।  ২/১০০/ ১৩

অর্থাৎ, ভ্রাতা, তুমি দেবগণ, পিতৃগণ, গুরুগণ, ভৃত্যগণ, পিতৃতুল্য  বৃদ্ধগণ, বৈদ্যগণ ও ব্রাহ্মণগণকে সর্বতোভাবে মান্য করছো তো?

অরণ্যকাণ্ডের ১০ম সর্গে রাম সীতাকে বলছেন-

অপ্যহং জীবিতং জহ্যাং ত্বাং বা সীতে সলক্ষ্মণাম্।

ন তু প্রতিজ্ঞাং সংশ্রুত্য ব্রাহ্মণেভ্যো বিশেষতঃ।। ৩/১০/১৮

অর্থাৎ, বরং অকাতরে প্রাণত্যাগ করতে পারি , লক্ষ্মণের সাথে তোমাকেও পরিত্যাগ করতে পারি,  কিন্তু ব্রাহ্মণের কাছে প্রতিশ্রুত হয়ে তার ব্যতিক্রম করতে পারি না।

অরণ্যকাণ্ডের ২৩ তম সর্গে বিশেষত গো আর ব্রাহ্মণের  মঙ্গল কামনা করা হয়েছে-

সমেয়ুশ্চ মহাত্মানো যুদ্ধদর্শনকাঙ্ক্ষিণঃ।

ঋষয়ো দেবগন্ধর্ব্বাঃ সিদ্ধাশ্চ সহ চারণৈঃ।। ৩/২৩/১৭

সমেত্য চোচুঃ সহিতাস্তেহন্যেন্যং পুণ্যকর্মনঃ।

স্বস্তি গোব্রাহ্মণেভ্যস্তু লোকানাং যে চ সম্মতাঃ।। ৩/২৩/২৮

 অর্থাৎ, ঐ সময় দেবতা, গন্ধর্ব, সিদ্ধ ও চারণগণ সেখানে বিমানে আরোহণ করে  বিমানে অবস্থান করছিলেন । তারা পরস্পর মিলিত হয়ে বলতে  লাগলেন – গো, ব্রাহ্মণ ও লোকসম্মত মহাত্মাদের মঙ্গল হোক।“

ব্রাহ্মণেরা প্রচুর দান পেত তার প্রমাণ অযোধ্যাকাণ্ডের ৭৭ তম সর্গ থেকে পাওয়া যায়-

ততো দশাহেহতিগতে কৃৎশৌচো নৃপাত্মজঃ।

দ্বাদশেহহনি সম্প্রাপ্তে শ্রাদ্ধকর্মাণ্যকারয়ৎ।। ২/৭৭/১

ব্রাহ্মণেভ্যো ধনং রত্নং দদাবন্নঞ্চ পুষ্কলম্।

বাস্তিকং বহু শুক্লঞ্চ গাশ্চাপি বহুশস্তদা।। ২/৭৭/২

দাসীদাসাংশ্চ যানানি বেশ্মানি সুমহান্তি চ।

ব্রাহ্মণেভ্যো দদৌ পুত্রো রাজ্ঞস্তস্যৌর্দ্ধদেহিকম্।। ২/৭৭/৩

অর্থাৎ,  এরপর দশ দিন শেষ হলে ভরত শ্রাদ্ধ  করে পবিত্র হলেন এবং বারো দিনে দ্বিতীয় মাসিক প্রভৃতি সপিণ্ডীকরণ পর্যন্ত সমস্ত অনুষ্ঠান করে পিতার পরলৌকিক ফল আকাঙ্ক্ষায় ব্রাহ্মণদেরকে ধনরত্ন, প্রচুর ভক্ষ্য-ভোজ্য ছাগ,  বহুসংখ্যক গো,  দাসী, দাস,বাসভবন ও যান প্রদান করতে লাগলেন।“

শ্রাদ্ধে ব্রাহ্মণদের সবার আগে ভোজন করানো হত সাধারণত কিন্তু কিছু কিছু লোক ব্রাহ্মণদের খাওয়ানোর আগে তার বন্ধুবান্ধবদের খাওয়াতেন। এই প্রসঙ্গে অরণ্যকাণ্ডের ৬১ তম সর্গে বলা হয়েছে-

ভোজয়ন্তি কিল শ্রাদ্ধে কেচিৎ স্বানেব বান্ধবান্। ৩/৬১/ ১২

ততঃ পশ্চাৎ সমীক্ষন্তে কৃতকার্য্যা দ্বিজোত্তমান্।।

তত্র যে গুণবন্তশ্চ বিদ্বাংসশ্চ দ্বিজাতয়ঃ।

ন পশ্চাৎ তেহপি মন্যন্তে সুধামপি সুরোপমাঃ।। ৩/৬১/ ১৩

অর্থাৎ,  শ্রাদ্ধকালে কোন কোন ব্যক্তি আগে বন্ধুদের খাইয়ে কৃতার্থমন্য হয়ে পরে শ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণদেরকে  খাওয়াতে চেষ্টা করে। কিন্তু তাদের মধ্যে যারা বিশিষ্ট গুণবান ও বিদ্বান, সেই দেবতুল্য ব্রাহ্মণেরা অমৃতের মত সুস্বাদু অন্ন ভক্ষণেও ইচ্ছা করেন না।

বিশ্বামিত্র এবং বশিষ্টের মধ্যকার দ্বন্দ্বের কথা অনেক ধর্মগ্রন্থেই পাওয়া যায়। বিশ্বামিত্র তার অসংখ্য সৈন্য নিয়ে বশিষ্ঠকে আক্রমণ করলে, বশিষ্ট কেবলমাত্র তার ব্রহ্মদণ্ড দিয়েই তা প্রতিহত করেছিলেন। ব্রহ্মদণ্ড শব্দটি বেশ ভারী ভারী শোনালেও এটা  হল ব্রাহ্মণের সামান্য লাঠি। ব্রাহ্মণের এই সামান্য লাঠিকেও ব্রাহ্মণেরা অত্যন্ত শক্তিশালী হিসেবে প্রচার করতো। সংখ্যায় স্বল্প হলেও এই ধরণের প্রচার করেই বোধহয় ব্রাহ্মণেরা তাদের ক্ষমতা ধরে রেখেছিল। ব্রহ্মদণ্ডের উল্লেখ লঙ্কাকাণ্ডের ১৫ তম সর্গে আছে। রামের শরকে এখানে ব্রহ্মদণ্ডের সাথে তুলনা করা হয়েছে-

কো ব্রহ্মদণ্ডপ্রতিমপ্রকাশনরচ্চিষ্মতঃ কালনিকাশরূপান্।

সহেত বাণান্ যমদণ্ডকল্পান্ সমীক্ষ্য মুক্তান্ যুধি রাঘবেণ।। ৬/১৫/ ১৩

 অর্থাৎ, রামের শর ব্রহ্মদণ্ডের মত উগ্র ও উজ্জ্বল এবং তা প্রলয় বহ্নির মত ভীষণ করাল , সেই যমদণ্ডতুল্য শরদণ্ড উন্মুক্ত হলে কে তা সহ্য করতে পারবে?

প্রাচীনকালে হিন্দুসমাজে ব্রাহ্মণেরা যত বড় অপরাধই করুক না কেন, তাদের তেমন কোনো বড় শাস্তি দেওয়া হত না । এক অপরাধী ব্রাহ্মণকে কি শাস্তি দেবেন একথা রাম তার সভাসদদের জিজ্ঞেস করলে বসিষ্ঠ, কশ্যপ, ভৃগু প্রভৃতি ঋষিরা একবাক্যে রামকে বলেন, ব্রাহ্মণকে ‘বধ দণ্ড’ দেওয়া উচিত নয়-

ভৃগ্বঙ্গিরসকুৎসাদ্যা বসিষ্ঠশ্চ সকাশ্যপঃ।

ধর্ম্মপাঠকমুখ্যাশ্চ সচিবা নৈগমাস্তথা।। ৭/৭১/ ৩৩

এতে চান্যে চ বহবঃ পণ্ডীতাস্তত্র সঙ্গতাঃ।

অবধ্যো ব্রাহ্মণো দণ্ডৈরিতি শাস্ত্রবিদো বিদুঃ।। ৭/৭১/৩৪

অর্থাৎ, সেই সভায় রাজকার্য বিশারদ বসিষ্ঠ, কশ্যপ, ভৃগু, অঙ্গিরস এবং কুৎস্য প্রভৃতি ঋষিগণ, প্রধান ধর্মপাঠকগণ, নৈগম সচিবগণ এবং অন্যান্য অনেক পণ্ডিতেরা উপস্থিত ছিলেন। তারা সকলে একবাক্যে রামকে বললেন- ব্রাহ্মণ দণ্ডদ্বারা বধ্য নন, এটা শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিতেরা বলেছেন।

ব্রহ্মহত্যা

সুতরাং আমরা দেখতে পেলাম, ব্রাহ্মণদের বড়সড় শাস্তি থেকে প্রায়শই মুক্তি দেওয়া হত। ব্রাহ্মণের প্রাণের মূল্য যেন অন্যদের চাইতে বেশি! এর প্রমাণ হিসাবে আমরা ব্রহ্মহত্যা নামে একটি শব্দ বারংবার দেখতে পাই। অনেক ধর্মগ্রন্থেই এই শব্দটি পাওয়া যায়। ব্রাহ্মণকে হত্যা করাই হল ব্রহ্মহত্যা। অন্য  কাউকে হত্যা করার চাইতে ব্রাহ্মণকে হত্যা করা অধিক শাস্তিযোগ্য অপরাধ ছিল। অযোধ্যাকাণ্ডের ২১ সর্গে, অরণ্যকাণ্ডের ১১ সর্গে ব্রহ্মহত্যার কথা পাওয়া যায়।

অযোধ্যাকণ্ডের ৬৩ তম সর্গে একটি কাহিনীপ্রসঙ্গে ব্রহ্মহত্যার উল্লেখ পাওয়া যায়, সেই  ঘটনাটিরই অবতারণা করতে চাইছি।

রামের পিতা দশরথ ভুলবশত শব্দভেদী বান দ্বারা এক তপস্বী যুবককে হত্যা করেন। সেই তপস্বী মারা যাওয়ার আগে দশরথের সাথে কিছুক্ষণ কথা বলেন। তপস্বী দশরথকে তার মৃত্যু সংবাদ তার মাতাপিতার কাছে পৌঁছে দিতে বলেন। তপস্বীর কথা মত দশরথ তার মৃত্যুসংবাদ তার মাতা পিতার কাছে পৌঁছে দিতে যান। সেই তপস্বীর মাতা পিতাকে দশরথ সব কিছু খুলে বলেন। এইসময় তপস্বীর পিতা দশরথকে এই বলে অভিশাপ দিয়েছিলেনঃ

পুত্রব্যসনজং দুঃখং যদেত্ন্মম সাম্প্রতম্।

এবং ত্বং পুত্রশোকেন রাজন্কালং করিষ্যসি।। ২/৬৪/৫৫

অর্থাৎ, আমি যেমন পুত্রশোকে ভুগছি, তোমারও তেমনি পুত্রশোকেই মৃত্যু হবে।

এই তপস্বীর পিতা ছিলেন বৈশ্য এবং মাতা ছিলেন শূদ্র বর্ণের। সেই হিসাবে মুনিকুমার অনুলোমজ (যখন পিতা উচ্চবর্ণের ও মাতা নিম্নবর্ণের) সঙ্কর বর্ণের ছিলেন।  তবে তার পিতা-মাতা উভয়কেই অবশ্য তপস্যা করতে দেখা যায়। এমনকি তপস্বীর মৃত্যুর পর তার বৈশ্য পিতার সাথে সাথে তার শূদ্রা মাতাও স্বর্গে গমন করেন। এতটুকু পড়ে মনে হতে পারে যে এই কাহিনীটি সম্পূর্ণভাবে বর্ণবাদের বিপরীতে যায় কিন্তু আসলে তা নয়।  মুনিকুমার মৃত্যুর আগে দশরথকে বলেছিলেন-

সংস্তভ্য শোকং ধৈর্যেণ স্থিরচিত্তো ভবাম্যহম্।

ব্রহ্মহত্যাকৃতং পাপং হৃদয়াদপনীয়তাম্।। ২/৬৩/৫০

নদ্বিজাতিরহং রাজন মা ভূৎ তে মনসো ব্যথা।

শূদ্রায়ামস্মি বৈশ্যেন জাতো নরবরাধিপ।। ২/৬৩/৫১

অর্থাৎ, আমি ধৈর্যের সাথে চিত্তের স্থৈর্য সম্পাদন এবং শোক সংবরণ করে  বলছি , শ্রবণ কর। ব্রহ্মহত্যা করলাম বলে তোমার মনে যে সন্তাপ উপস্থিত হয়েছে , তুমি এখন তা পরিত্যাগ কর। আমি ব্রাহ্মণ নই , বৈশ্যের ঔরসে শূদ্রার গর্ভে আমার জন্ম হয়েছে।

এখানে ‘ব্রহ্মহত্যাপাপ’ বলে আমাদের আলোচ্য শব্দটি পাওয়া যাচ্ছে। এখানে আমরা স্পষ্টভাবে বুঝতে পারছি , অন্যান্য বর্ণের প্রাণের চাইতে ব্রাহ্মণের প্রাণকে অধিক মূল্যবান দেখিয়ে ব্রাহ্মণের হত্যাকে ‘ব্রহ্মহত্যা’ নাম দেওয়া হয়েছিল। অন্যান্য বর্ণের মানুষকে হত্যা করার চাইতে ব্রহ্মহত্যা করা একটি বড় অপরাধ ছিল। তাই এখানে মুনিকুমার দশরথকে বলছেন তিনি বৈশ্যার ঔরসে শূদ্রার গর্ভে জন্মেছেন, তাই দশরথ ‘ব্রহ্মহত্যা’ করেছেন ভেবে তার সন্তাপ করা উচিত নয়।  

মনু

হিন্দুদের মনুসংহিতা নামে একটি বর্ণবাদের আকরগ্রন্থ রয়েছে।  এতে স্থানে স্থানে রয়েছে বর্ণবৈষম্য এবং শূদ্রের উপর শোষণ। মনু নামের এক ব্যক্তি এই গ্রন্থের রচনা করেন। এই  মনুর উল্লেখ রামায়ণেও রয়েছে।  

রামায়ণে রামচন্দ্র বালীকে হত্যা করার জন্য আড়াল থেকে তীর নিক্ষেপ করলে বালী তাকে ভর্ৎসনা করেন। বালীর নানা অভিযোগের উত্তর দিতে গিয়ে রাম মনুর উল্লেখ করে মনুসংহিতা হতে দুটি শ্লোক উদ্ধৃত করেন। রাম বলেন,

শক্যম্ ত্বয়া অপি তত্ কার্যম্ ধর্মম্ এব অনুবর্ততা।। ২৯

শ্রুয়তে মনুনা গীতৌ শ্লোকৌ চারিত্র বৎসলৌ।

গৃহীতৌ ধর্ম কুশলৈঃ তথা তত্ চরিতম্ ময়া ।। ৪/১৮/৩০

অর্থাৎ,  আর তুমিও যদি ধর্মের অপেক্ষা রাখতে , তাহলে তোমায় স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে এই দণ্ড ভোগ করতে হত। মহর্ষি মনু চরিত্র শোধক দুইটি শ্লোক বলেছেন , ধার্মিকেরা তাতে আস্থা প্রদর্শন করেন , আমিও সেই ব্যবস্থাক্রমে এমন করলাম।

রাজভিঃ ধৃত দণ্ডাঃ চ কৃত্বা পাপানি মানবাঃ।

নির্মলা স্বর্গম্ আয়ান্তি সন্তঃ সুকৃতিনো যথা।। ৪/১৮/৩১

শাসনাত্ বা অপি মোক্ষাত্ বা স্তেনঃ পাপাত্ প্রমুচ্যতে।

রাজা তু অশাসন্ পাপস্য তদ্ অপ্নোতি কিল্বিষম্।। ৪/১৮/৩২

অর্থাৎ, মনু বলেছেন, মানুষেরা পাপাচরণ করে রাজদণ্ড ভোগ করলে বীতপাপ হয় এবং পূণ্যশীল সাধুর মত স্বর্গে গমন করে থাকে । নিগ্রহ বা মুক্তি যেরূপে হোক , পাপী শুদ্ধ হয় কিন্তু যে রাজা দণ্ডের পরিবর্তে মুক্তি দিয়ে থাকেন , পাপ তাকেই স্পর্শ করে।

রামচন্দ্র মনুর যে কথার উদ্ধৃতি দিলেন তা মনুসংহিতায় (৮/৩১৬-৩১৮) রয়েছে।  সুতরাং দেখা যায়, রাম মনুকে চেনেন এবং মান্যও করেন। রাম যে মনুর মতোই জাতিবাদী তা রামের শম্বুক বধে ফুটেও ওঠে। বাল্মীকি রামায়ণে বর্ণিত রামের চরিত্রের সাথে শম্বুক বধ একদমই অসামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। ( মনুর ব্রাহ্মণ্যবাদ, শূদ্রের প্রতি দমনপীড়নমূলক আইন এবং নারীদের প্রতি বৈষম্যমূলক বিধান এখান থেকে পড়ুন। )

রামায়ণের বালকাণ্ডের পঞ্চম সর্গে বলা হয়েছে মনু অযোধ্যা নগরীর নির্মাণ করেছিলেন-

কোশলো নাম মুদিতঃ স্ফীতো জনপদো মহান্।

নিবিষ্টঃ সরযূতীরে প্রভূতধনধান্যবান্।। ১/৫/৫

অযোধ্যা নাম নগরী তত্রাসীল্লোকবিশ্রুতা।

মনুনা মানবেন্দ্রেণ যা পুরী নির্ম্মিতা স্বয়ম্।।১/৫/৬

অর্থাৎ,  সরযূতীরে নিবিষ্ট, প্রমোদান্বিত, প্রচুরধনধান্যশালী, অতিবৃহৎ ও ক্রমশঃ বর্ধমান কোশলনামক দেশে সর্বলোক বিখ্যাতা অযোধ্যা নামে এক নগরী আছে। যে নগরীকে মানবেন্দ্র মনু স্বয়ং নির্মাণ করেছিলেন।


এছাড়াও রামায়ণের উত্তরকাণ্ডেও মনুর উল্লেখ মেলে। উত্তরকাণ্ডের ৯২ তম সর্গে আছে-

পুরা কৃতযুগে রাম মনুরদণ্ডোধরঃ প্রভুঃ।

তস্য পুত্রো মহানাসীদিক্ষ্বাকুঃ কুলনন্দন।। ৭/৯২/৫

অর্থাৎ,  সত্যযুগে মনু নামে এক রাজা ছিলেন। তার পুত্র ছিলেন ইক্ষ্বাকু। (পঞ্চানন তর্করত্নের সংস্করণ)

নিম্ন বর্ণ

এবার আমরা মূল কথায় আসি। এই অংশে কিছু তথ্য দেওয়া হবে, যার মাধ্যমে পরিস্কার হয়ে যাবে রামায়ণে নিম্নবর্ণের স্থান ঠিক কেমন।

রামায়ণের অরণ্যকাণ্ডের ৫৬ তম সর্গে রামের স্ত্রী সীতার মুখে ভীষণ বর্ণবাদী একটি কথা শোনা যায়। এখানে সীতা রাবণকে বলছেন-

ন শক্যা যজ্ঞমধ্যসথা বেদিঃ স্রুগ্ভাণ্ডমণ্ডিতা।

দ্বিজাতিমন্ত্রসম্পূতা চণ্ডালেনাবমর্দ্দিতুম্।। ৩/৫৬/১৮

তথাহং ধর্মনিত্যস্য ধর্মপত্নী পতিব্রতা।

ত্বয়া স্পৃষ্টুং শক্যাস্মি রাক্ষসাধম পাপিনা।। ৩/৫৬/১৯

অর্থাৎ, পবিত্রীকৃতা স্রুক্ প্রভৃতি ভাণ্ডসমূহে বিভূষিতা যজ্ঞবেদি চণ্ডালের স্পৃশ্য নয়, তেমনি আমিও তোর স্পর্শযোগ্যা নই; কারণ আমি নিয়তধর্ম নিরত রামের ধর্মপত্নী এবং আমার সংকল্পও অতিশয় দৃঢ়।  (অনুবাদক- পঞ্চানন তর্করত্ন)

হেমচন্দ্র ভট্টাচার্য এর অনুবাদ করেছেন এইভাবে-  “ যজ্ঞমধ্যস্থ শ্রুকভাণ্ডভূষিত মন্ত্রপূত বেদী কখনও  চণ্ডাল স্পর্শ করতে পারে না। আমি ধর্মশীল রামের পতিব্রতা ধর্মপত্নী , তুই পাপী হয়ে কখনো আমায় স্পর্শ করতে পারবি না।“

সুন্দরকাণ্ডের ২৮ সর্গে সীতা বলছেন ব্রাহ্মণেরা  শূদ্রকে মন্ত্র দান করতে পারে না-

নৈবাস্তি নূনং মম দোষমত্র

বধ্যাহমস্যাপ্রিয়দর্শনস্য।

ভাবং ন চাস্যহমনুপ্রদাতু

মলং দ্বিজো মন্ত্রমিবাদ্বিজায়।।  ৫/২৮/৫

অর্থাৎ,  যদিও একে আত্মসমর্পণ করলে প্রাণ রক্ষা হয়, কিন্তু ব্রাহ্মণগণ যেমন শূদ্রকে মন্ত্র দান করতে পারেন না, তেমনি আমিও অনুকূল হয়ে একে আমার হৃদয় প্রদান করতে পারি না। ( অনুবাদক- পঞ্চানন তর্করত্ন)

হেমচন্দ্র অনুবাদ করেছেন এভাবে-  ব্রাহ্মণ যেমন অব্রাহ্মণকে মন্ত্রে দীক্ষিত করতে পারেন না তেমনি আমিও ঐ দুরাচারকে মন সমর্পণ করতে পারব না।

নিষাদ

এছাড়া, রামায়ণে নিষাদ জাতিকেও খুব একটা ভালো দৃষ্টিতে দেখা হয়নি। বাল্মীকি রামায়ণের অযোধ্যাকাণ্ডে গুহ নামের এক নিষাদরাজার উল্লেখ পাওয়া যায়। রাম বনবাসে গমনের সময় গুহের সাক্ষাৎ পান। গুহ রামকে নানা খাবার এনে দিলে রাম সেসব খাবার গ্রহণ করেন না, রাম কেবল ঘোড়ার জন্য আনা খাদ্য গ্রহণ করেন। রাম গুহকে বলেন, “তুমি প্রীতিবশত যে সকল আহারদ্রব্য উপহার দিলে, আমি কিছুতেই প্রতিগ্রহ করতে পারি না। এক্ষণে চীরচর্ম ধারণ ও ফলমূল ভক্ষণপূর্বক তাপসব্রত অবলম্বন করে অরণ্যে ধর্মসাধন করতে হবে, সুতরাং কেবল অশ্বের ভক্ষ ভিন্ন অন্য কোনো দ্রব্যই নিতে পারি না।“ (২/৫০ সর্গ ) রাম বলেন, তিনি ফলমূল ভক্ষণ করে তাপসব্রত অবলম্বন করবেন। কিন্তু গুহের কাছ থেকে বিদায় নিয়েই রাম লক্ষ্মণ মাংসের জন্য পশু হত্যা করেন। অযোধ্যাকাণ্ডেই দেখা যায় রাম লক্ষ্মণ মাংসের জন্য পশুহত্যা করছেন-

তৌ তত্র হত্বা চতুরো মহামৃগান্

বরাহমৃশ্যম্ পৃষতম্ মহারুরুম্।

আদায় মেধ্যং ত্বরিতং বুভিক্ষিতৌ

বাসায় কালে যযতুর্বন্সপতিম্।। ২/৫২/১০২

অর্থাৎ, অনন্তর রাম সুসমৃদ্ধ শস্যবহুল বৎস্যদেশে উপস্থিত হইয়া লক্ষ্মণের সহিত বরাহ, ঋষ্য, পৃষৎ ও মহারুরু এই চারিপ্রকার মৃগ বধ করিলেন এবং উহাদের পবিত্র মাংস গ্রহণ পূর্বক সায়ংকালে অত্যন্ত ক্ষুধার্ত হইয়া বনমধ্যে প্রবিষ্ট হইলেন। (অনুবাদক হেমচন্দ্র ভট্টাচার্য)   

এছাড়া রামায়ণে অনেক স্থানেই রাম-লক্ষ্মণকে পশু শিকার করতে দেখা যায়। 

সুতরাং দেখা যায় রাম নিষাদরাজ গুহকে মিথ্যা বললেন। নিষাদ বলেই কি রাম তার খাদ্য গ্রহণ করলেন না? রাম কেনই বা গুহকে মিথ্যা বললেন এই প্রশ্ন থেকেই যায়!

এখানে আমাদের মনে একটি প্রশ্ন উদিত হলেও, পরবর্তীতে আমাদের কাছে পরিষ্কার হয়ে যাবে নিষাদকে কেমন দৃষ্টিতে দেখা হয়েছে রামায়ণে।

নিষাদরাজ গুহ ছাড়াও বাল্মীকি রামায়ণের অরণ্যকাণ্ডে (৩৫ সর্গ) আরেকবার নিষাদের প্রসঙ্গ আসে। রাবণ যখন সীতা হরণের জন্য যাচ্ছিলেন তখন তিনি এক বৃহৎ বট বৃক্ষ দেখতে পান। এরপর রামায়ণে বলা হয়েছে এই বৃক্ষের শতযোজন দীর্ঘ এক শাখায় এক হাতি ও কচ্ছপকে গ্রহণ করে একসময় গরুড় বসেছিল । সেই বট গাছের নিচে তখন অনেক মুনিরা তপস্যা করছিলেন। গরুড়ের দেহের ভারে বট গাছের শাখা ভেঙ্গে গেলে গরুড় সেই মুনিদের রক্ষা করার জন্য শত যোজন ব্যাপী শাখা, হাতি ও কচ্ছপকে গ্রহণ করে গমন করতে থাকে। কিছুটা দূরে গিয়ে সেই হাতি ও কচ্ছকে গরুড় খেয়ে ফেলে এবং সেই বিশাল বট গাছের শাখা দ্বারা নিষাদ দেশের উচ্ছেদ সাধন করে। এই কাজ করে বিষ্ণুর বাহন গরুড়  অত্যন্ত খুশি হয়-

তেষাং দয়ার্থাং গরুড়স্তাং শাখাং শতযোজনাম্।

ভগ্নামাদায় বেগেন তৌ চোভৌ গজকচ্ছপো।। ৩১

একপাদেন ধর্ম্মাত্মা ভক্ষয়িত্বা তদামিষম্।

নিষাদবিষয়ং হত্বা শাখয়া পতগোত্তমঃ।। ৩২

প্রহর্ষমতুলং লেভে মোক্ষয়িত্বা মহামুনীন্।।

স তু তেন প্রহর্ষেণ দ্বিগুণীকৃতবিক্রমঃ।

অমৃতানয়নার্থং বৈ চকার মতিমান্ মতিম্।। ৩৪

অর্থাৎ,  পক্ষিশ্রেষ্ঠ বুদ্ধিমান ধর্মাত্মা গরুড় তাদের প্রতি দয়াপরবশ হয়ে একপদে সেই শতযোজনবিস্তৃত ভগ্নশাখা এবং অন্য পদে সেই হস্তী ও কচ্ছপকে ধারণ করে তাদের মাংস ভক্ষণ করে মহর্ষিগণকে রক্ষা করেছিলেন এবং তার দ্বারা নিষাদরাজ্য ধংস করে ভীষণ আনন্দিত হন। গরুড় আনন্দে দ্বিগুনবিক্রমশালী হয়ে অমৃতহরণে কৃতসংকল্প হয়েছিলেন।

৩/৩৫/৩১-৩৪ | পঞ্চানন তর্করত্ন ; পাবলিশার- বেণীমাধব শীলস লাইব্রেরী)  

তাহলে দেখা যায় রামায়ণেও নিষাদদের প্রতি সুস্পষ্ট বিদ্বেষের প্রমাণ রয়েছে। গরুড়ের এই নিষাদধংসের কাহিনী শুধু রামায়ণে নয় মহাভারতেও পাওয়া যায়। মহাভারতে গরুড় অমৃত আহরণ করতে যাওয়ার সময় তার মাকে জিজ্ঞেস করে রাস্তায় সে কি খাবে। তার মা বিনতা তখন উত্তর দেন-

“ বৎস! সমুদ্রমধ্যে বহু সহস্র নিষাদ বাস করে, তুমি তাহাদিগকে ভোজন করিয়া অমৃত আনয়ন কর, কিন্তু হে বৎস! দেখিও যেন ব্রাহ্মণবধে কদাচ তোমার বুদ্ধি না জন্মে। অনল সমান ব্রাহ্মণগণ সর্ব জীবের অবধ্য।ব্রাহ্মণ কুপিত হইলে অগ্নি, সূর্য, বিষ ও শস্ত্রতুল্য হয়েন। ব্রাহ্মণ সর্ব জীবের গুরু। এই নিমিত্ত ব্রাহ্মণ সর্ব ভূতের আদরণীয়। অতএব হে বৎস, তুমি অতিশয় কুপিত হইয়াও যেন কোনক্রমে ব্রাহ্মণের হিংসা বা তাহাদিগের সহিত বিদ্রোহাচরণ করিও না। নিত্য নৈমিত্তিক জপ হোমাদি ক্রিয়াকলাপে নিরত, বিশুদ্ধ ব্রাহ্মণ ক্রুদ্ধ হইলে যেরূপ দগ্ধ করিতে পারেন , কি অগ্নি, কি সূর্য কেহই সেরূপ পারেন না। ব্রাহ্মণ সর্ব জীবের অগ্রজাত, সর্ব বর্ণের শ্রেষ্ঠ  এবং সর্ব ভূতের পিতা ও গুরু।“ (কালিপ্রসন্নের মহাভারত/ আদিপর্ব /২৮ অধ্যায়)

গরুড় তার মায়ের কথা মত নিষাদদের সংহার করে-

” গরুড় মাতৃবাক্য শ্রবণান্তর পক্ষদ্বয় বিস্তার পূর্বক গগণ মার্গে উড্ডীন হইয়া বুবুক্ষাপ্রযুক্ত সাক্ষাৎ কৃতান্তের ন্যায় নিষাদপল্লীতে উপনীত হইলেন এবং নিষাদ সংহারের নিমিত্ত ধূলিরাশি দ্বারা নভোমন্ডল আচ্ছন্ন ও সমুদ্রের জল শোষণ করিয়া সমীপস্থ সমস্ত মহীধরগণকে বিচলিত করিতে লাগিলেন। পরিশেষে বিহঙ্গরাজ প্রকাণ্ড মুখ ব্যাদান পূর্বক নিষাদ নগরীর পথ রুদ্ধ করিয়া বসিলেন । বিষাদসাগরে নিমগ্ন নিষাদগণ প্রবল-বাত্যাহত ধূলিপটলে অন্ধপ্রায় হইয়া ভুজঙ্গভোজী গরুড়ের অতি বিস্তীর্ণ আননাভি মুখে ধাবমান হইল। যেমন প্রবল বায়ুবেগে সমস্ত বন ঘূর্ণিত হইলে পক্ষীগণ আকাশ মার্গে উঠে, সেইরূপ নিষাদেরাও গরুড়ের অতি বিশাল মুখ বিবরে প্রবিষ্ট হইল। পরিশেষে ক্ষুধার্ত বিহগরাজ মুখ মুদ্রিত করিয়া বহুসংখ্যক নিষাদ ভক্ষণ করিলনে।” (কালিপ্রসন্নের মহাভারত/ আদিপর্ব /২৮ অধ্যায়)

এছাড়াও মহাভারতে আমরা দেখতে পাই নিষাদরাজ হিরণ্যধনুর পুত্র একলব্যকে নিষাদ হওয়ার কারণে কৌরব ও পাণ্ডবদের অস্ত্রগুরু দ্রোণ শিক্ষা হতে বঞ্চিত করেন। এই বিষয়টি বিস্তার পড়তে পারেন আমার অন্য একটি লেখা থেকে। (লেখার লিংক)

শূদ্র শম্বুক বধ

রামায়ণের উত্তরকাণ্ডে একটি কাহিনী আছে। একবার রামের রাজদ্বারে এক ব্রাহ্মণ তার মৃত পুত্রকে নিয়ে উপস্থিত হন। ব্রাহ্মণ তার পুত্রের মৃত্যুর জন্য রামকে দায়ী করেন। ব্রাহ্মণ বলেন, কোনো রাজা যদি অধর্মী না হন, তাহলে তার রাজ্যে এভাবে অকালে ব্রাহ্মণের পুত্রের মৃত্যু হয় না;  অথবা রামের রাজ্যে কোনো অধর্ম হয়ে চলেছে, রাম যার কোনো প্রতিকারও করছেন না,  তাই তার রাজ্যে অকালে ব্রাহ্মণের পুত্র মারা গেল। ব্রাহ্মণের কথা শুনে  রাম চিন্তিত হয়ে পরামর্শের জন্য নানা ঋষিদের ডাকিয়ে আনেন। দেবর্ষি নারদ তাকে জানান, সত্যযুগে ব্রাহ্মণেরা তপস্যা করতে পারে, ত্রেতা যুগে ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়েরা , দ্বাপর যুগে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য এই তিন বর্ণ তপস্যা করতে পারেন আর কলিযুগে শূদ্রও তপস্যা করতে পারে। কিন্তু ত্রেতা যুগে  রামের রাজ্যে কোনো এক শূদ্র অসময়ে তপস্যা করার মত অধর্ম করছে। এই অধর্মের ফলেই ব্রাহ্মণের পুত্র মারা গেল। একথা শুনে রাম সেই শূদ্রকে খুঁজতে বেড়িয়ে পড়েন। অনেক খোঁজার পর রাম একজন তপস্বীকে দেখতে পান। সেই তপস্বী একটি বৃক্ষে পা ঝুলিয়ে মাথা নিচের দিকে রেখে অগ্নিকুণ্ডের সামনে কঠোর তপস্যা করছিলেম। রাম সেই তপস্বীর কঠোর তপস্যা দেখে অত্যন্ত সন্তুষ্ট হন। রাম সেই তপস্বীর পরিচয় জানতে চান। সেই তপস্বী রামকে বলেন, আমার নাম শম্বুক, জাতিতে আমি শূদ্র। শম্বুকের এই কথা শোনার সাথে সাথেই রাম তার হাতের খড়্গ দিয়ে শম্বুকের মাথা কেটে ফেলেন। রামের এই কাজ দেখে দেবতারা অন্ত্যন্ত খুশি হন। তারা রামের উপর পুষ্পবৃষ্টি করতে থাকেন। আর অন্যদিকে শূদ্রের মৃত্যুতে ব্রাহ্মণের পুত্র আপনাআপনিই বেঁচে ওঠে।

শূদ্র শম্বুক হত্যা সম্বন্ধে বিস্তারিত জানতে নিচের লেখাগুলো পড়তে পারেনঃ

বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ এখানে যত রকমের তথ্য দেওয়া হয়েছে সবই বাল্মীকি রামায়ণ থেকেই দেওয়া হয়েছে।  আর অনুবাদের ক্ষেত্রে মূলত পঞ্চানন তর্করত্ন এবং হেমচন্দ্র ভট্টাচার্যের অনুবাদ ব্যবহার করা হয়েছে।

View Comments (1)

Leave a Comment