শিবলিঙ্গের কাহিনী-লিঙ্গ মানে কি লিঙ্গ নয়?-১ম পর্ব

Print Friendly, PDF & Email

নাম লিঙ্গ হলেও জিনিসটি ঠিক লিঙ্গ নয়- এমনই দাবী দাওয়া আজকের হিন্দুদের। শিবলিঙ্গ যে জননাঙ্গের প্রতীক তারা তা মানতে নারাজ, যেহেতু এই আদিম পূজা পদ্ধতির সাথে তাদের বর্তমান মানসিকতা খাপ খায় না। শিবলিঙ্গের জননাঙ্গ হওয়াকেই কেবল অস্বীকার নয়, তার পাশাপাশি অপবিজ্ঞানের সাহায্যে শিবলিঙ্গকে প্রাচীন ভারতের পারমাণবিক চুল্লী, এজাতীয় কিছু প্রমাণ করতে উঠে পড়ে লেগেছে তারা। প্রথমেই হিন্দুরা যে কাজটি করে থাকে শিবলিঙ্গ-র ক্ষেত্রে তা হল- লিঙ্গ শব্দটির মানে যে জননাঙ্গ তা অস্বীকার করা। তাদের কথায়, ”বাংলায় লিঙ্গ শব্দের অর্থ, শিশ্ন, পুংজননেন্দ্রিয় প্রভৃতি হলেও, বাংলায় লিঙ্গ মানে জননাঙ্গ বোঝালেও সংস্কৃতে এর অর্থ একেবারেই আলাদা।” সুতরাং সংস্কৃতে ‘লিঙ্গ মানে লিঙ্গ কিনা’ তা-ই আগে বিচার করা যাক, এর জন্য আমরা কিছু সংস্কৃত অভিধানের সাহায্য নেব।

লিঙ্গার্থ বিচার

মনিয়র উইলিয়মস এর সংস্কৃত-ইংরেজি অভিধান থেকে দেখা যায়, লিঙ্গ শব্দের একটি সুস্পষ্ট অর্থ পুং জননাঙ্গ। অভিধানটিতে অর্থ দেওয়া আছে, “the sign of gender or sex, organ of generation, the male organ or Phallus (esp. that of Siva worshipped in the form of a stone or marble column which generally rises out of a yoni, and is set up in temples dedicated to Siva; formerly 12 principal Siva-lingas existed, of which the best known are Soma-natha in Gujarat, Mahi-kala at Ujjayini, Visvesvara at Benares &c. ; but the number of Lingas in India is estimated at 30 millions.); gender” অভিধানটিতে লিঙ্গ শব্দের অর্থ যে জননাঙ্গ হিসাবে দেওয়া আছে তা- ই নয়, বরং স্পষ্টভাবে শিবলিঙ্গকে পুং জননাঙ্গ বলা হয়েছে। নিচে মনিয়র উইলিয়মস এর অভিধান থেকে স্ক্রিনশট দেওয়া হল-

শিবলিঙ্গ

এছাড়া, অভিধানটিতে ‘Lingagra’ শব্দের অর্থ ‘the end or glans of the penis’, ‘Iingarcana’ শব্দের অর্থ ‘worship of the Phallus of Siva’, ‘lingoddhara’ শব্দের অর্থ  ‘the excision or removal of the male organ’ 

নিচের স্ক্রিনশটটি দেখুন-

শিবলিঙ্গ 3

The Crown Sanskrit-English Dictionary থেকে লিঙ্গ শব্দের অর্থ মেলে ‘A sign, gender, the male organ’ হিসাবে।

নিচের স্ক্রিনশটটি দেখুন-

শিবলিঙ্গ 5

Vaman Shivram Apte এর The Practical Sanscrit Dictionary থেকেও লিঙ্গ শব্দের অর্থ মেলে- ‘The sign Of gender or sex, The male organ of generation, The genital organ of Siva worshipped in the form of a phallus’

নিচের স্ক্রিনশটটি দেখুন-

শিবলিঙ্গ 7

সুতরাং সংস্কৃতে লিঙ্গ শব্দের একটি জনপ্রিয় ও নিশ্চিত অর্থ যে পুং জননাঙ্গ, এ বিষয়ে তেমন সন্দেহ থাকে না। উপরন্তু মনিয়র উইলিয়মস ও আপ্তে এর অভিধানে স্পষ্টভাবেই শিবের জননাঙ্গকে লিঙ্গ বলা হয়েছে।

আর্য ও অনার্য সভ্যতা

শিবলিঙ্গ নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে প্রাসঙ্গিক ভাবেই আর্য-অনার্য তত্ত্ব এবং সিন্ধু ও বৈদিক সভ্যতার কথা চলে আসে। প্রায় ১৫০০ খ্রিষ্ট পূর্বাব্দে আর্যরা পশ্চিম দিক হয়ে ভারতে প্রবেশ করে। তাদের আদি বাসস্থান হিসেবে মধ্য এশিয়ার স্টেপ অঞ্চলকে ধারণা করে থাকেন ঐতিহাসিকগণ। স্টেপ থেকে আর্যরা ইউরোপ ও ভারতীয় উপমহাদেশে ছড়িয়ে পড়েছিল।
সিন্ধু সভ্যতা আবিষ্কারের পূর্বে বৈদিক সভ্যতাকেই ভারতের প্রাচীনতম সভ্যতা বলে গণ্য করা হত কিন্তু সিন্ধু সভ্যতার আবিষ্কারের পর ভারতের ইতিহাসের একটি প্রধান দিক উন্মোচিত হয়, বৈদিক নয়, সিন্ধু সভ্যতাই ভারতের প্রাচীনতর সভ্যতা বলে গণ্য হয়।

সিন্ধু সভ্যতা ও বৈদিক সভ্যতা স্পষ্টতই ভিন্ন সভ্যতা ছিল এবং এই দুটির মধ্যে অত্যন্ত পার্থক্য বিদ্যমান ছিল। ড.অতুল সুর তার ‘ভারতের নৃতাত্ত্বিক পরিচয়’ পুস্তকে এই পার্থক্য স্পষ্ট ভাবে ব্যক্ত করেন-

“অনেকেই বলেন যে সিন্ধু সভ্যতা ও বৈদিক আর্য সভ্যতা অভিন্ন। কিন্তু এটা যে ভ্রান্ত মত সে-বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। এই দুই সভ্যতার মৌলিক বৈশিষ্ট্যগুলি আলোচনা করলেই এটা বুঝতে পারা যাবে। দুই সভ্যতার মূলগত পার্থক্যগুলি নীচে দেওয়া হল:
১. সিন্ধু সভ্যতার বাহকরা শিশ্ন-উপাসক ছিল ও মাতৃকাদেবীর আরাধনা করত। আর্যরা শিশ্ন-উপাসক ছিল না ও শিশ্ন-উপাসকদের ঘৃণা ও নিন্দা করত। আর্যরা পুরুষ-দেবতার উপাসক ছিল। মাতৃকাদেবীর পূজার কোন আভাসই আমরা ঋগ্বেদে পাই না।
২. আর্যরাই প্রথম ঘোড়াকে পোষ মানিয়েছিল। ঘোড়াই ছিল তাদের সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ জন্তু। এখানে বলা দরকার যে, ঘোড়ার কোন অশ্মীভূত (fossilized) অস্থি আমরা সিন্ধু সভ্যতার কোনও কেন্দ্রে পাইনি। সিন্ধু সভ্যতার বাহকদের কাছে বলীবর্দই প্রধান জন্তু ছিল। এটা সীলমোহরসমূহের ওপর পুনঃ পুনঃ বলীবর্দের প্রতিকৃতি ক্ষোদন থেকে বুঝতে পারা যায়। পশুপতি শিব আরাধনার প্রমাণও মহেঞ্জোদারো থেকে পাওয়া গিয়েছে। বলীবর্দ শিবেরই বাহন। সুতরাং সিন্ধু সভ্যতার কেন্দ্রসমূহে বলীবর্দের প্রাধান্য সহজেই অনুমেয়।
৩. সিন্ধু সভ্যতার বাহকরা নগরবাসী ছিল। আর্যরা নগর নির্মাণ করত না। তারা নগর ধ্বংস করত। সেজন্য তারা তাদের প্রধান দেবতা ইন্দ্রের নাম পুরন্দর রেখেছিল।
৪. আর্যরা মৃতব্যক্তিকে দাহ করত। সিন্ধু সভ্যতার ধারকরা মৃতকে সমাধিস্থ করত।
৫. আর্যদের মধ্যে লিখন-প্রণালীর প্রচলন ছিল না। কিন্তু সিন্ধু সভ্যতার ধারকদের মধ্যে লিখন-প্রণালী সুপ্রচলিত ছিল।
৬. সিন্ধু সভ্যতা যে আর্য সভ্যতা নয়, তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ হচ্ছে মৃৎপাত্র। কুরু-পাঞ্চাল দেশ অর্থাৎ যেখানে আর্য সভ্যতা বিস্তারলাভ করেছিল, সেখানকার বৈশিষ্ট্যমূলক মৃৎপাত্রের রঙ ছিল ধূসর বর্ণ। সিন্ধু সভ্যতার কেন্দ্রসমূহ থেকে যে-সব মৃৎপাত্র পাওয়া গিয়েছে সেগুলির রঙ ‘কালো-লাল’।
৭. সিন্ধু সভ্যতা ছিল কৃষিভিত্তিক সভ্যতা। আর্যরা প্রথমে কৃষিকার্য জানত না। এটা আমরা শতপথ-ব্রাহ্মণের এক উক্তি থেকে জানতে পারি।
৮. সিন্ধু সভ্যতার লোকেরা হাতির সঙ্গে বেশ সুপরিচিত ছিল। আর্যদের কাছে হাতি এক নতুন জীববিশেষ ছিল। সেজন্য তারা হাতিকে ‘হস্তবিশিষ্ট মৃগ’ বলে অভিহিত করত। বস্তুত হাতিকে প্রাচ্য ভারতের পালকাপ্য নামে এক মুনিই প্রথম পোষ মানিয়েছিলেন।
এসব প্রমাণ থেকে সহজেই বোঝা যায় যে, আর্য সভ্যতা ও সিন্ধু সভ্যতা এক নয়।”

আর্যদের রচিত আদিমতম গ্রন্থের নাম ঋগ্বেদ। এই ঋগ্বেদ থেকে অনার্য দাস-দস্যুদের সাথে আর্যদের সংঘর্ষের কথা জানা যায়। আর্যরা অনার্যদের অসুর,রাক্ষস,দাস,দস্যু প্রভৃতি নামে অভিহিত করতো।

শিব বৈদিক দেবতা নয়

সিন্ধু সভ্যতা থেকে উদ্ধার করা একটি সিলমোহরের বিশেষ বিশেষত্ব রয়েছে, এই সিলমোহরটিতে ত্রিমুখবিশিষ্ট, মাথায় পশুর শিং ধারণ করা,চারপাশে নানান পশু পরিবেষ্টিত, যোগমুদ্রায় উপবেশনকারী, উত্থিত লিঙ্গ এক পুরুষের অবয়ব পাওয়া যায়।

এই পুরুষটিকে আদি শিব বা পশুপতি বলে চিহ্নিত করেছেন পণ্ডিতগণ। বৈদিক দেবতা রুদ্র এই আদিশিবের রূপেই কল্পিত হয়েছিল।

শিবলিঙ্গ 9
শিবলিঙ্গ 11

(পশুপতি সিল)

এই সিলমোহরের একটি লক্ষণীয় দিক হল এটি উত্থিত লিঙ্গ।

ড. অতুল সুর তার ‘সিন্ধু সভ্যতার স্বরূপ ও সমস্যা’ গ্রন্থে বলেন-

” রুদ্র যে আর্যদের অর্বাচীন দেবতা ছিলেন তা বুঝতে পারা যায়, সমস্ত ঋগ্বেদে তার উদ্দেশ্যে মাত্র তিনটি স্তোত্র রচিত হয়েছিল এবং অগ্নিদেবের সঙ্গে তার সমীকরণ করা হয়েছিল। আর্যরা যখনই তাদের দেবমণ্ডলে কোনো নতুন দেবতার পত্তন করতেন, তখনই অগ্নির সঙ্গে তার সমীকরণ করে নিতেন।এটা কালী ও করালীর অনুপ্রবেশের সময়ও করা হয়েছিল,অথচ আমরা জানি কালি ও করালি অনার্য দেবতা।

শিবলিঙ্গ 13

এখানে উল্লেখযোগ্য যে, সংস্কৃতে রুদ্র শব্দের অর্থ রক্তবর্ণ এবং দ্রাবিড় ভাষাতেও শিব শব্দের অর্থ হচ্ছে রক্তবর্ণ।এছাড়া শতপথ ব্রাহ্মণে বলা হয়েছে যে শর্ব ও ভব এই দেবতাগণ প্রাচ্যদেশীয় অসুরগণ ও বাহিকগণ কর্তৃক পূজিত হন। কিন্তু বাজসেনীয় সংহিতায় এই দুটি দেবতা অশনি,পশুপতি,মহাদেব,ঈশান,উগ্রদেব প্রভৃতির সঙ্গে আর্য দেবমণ্ডলীতে স্থান পেয়ে অগ্নি দেবতার সঙ্গে সমীকৃত হয়েছেন।অগ্নি দেবতার সাথে সমীকরণের ফলে শেষের দিকের বৈদিক সাহিত্যে আমরা হর, মৃদ,শর্ব,ভব,মহাদেব,উগ্র,পশুপতি,শঙ্কর,ঈশান প্রভৃতি দেবতাকে শিবের সঙ্গে অভিন্ন হিসাবে দেখি। বৈদিক রুদ্রাগ্নির উপাসনাই এটাকে সম্ভবপর করেছিল।”

শিশ্নদেব

এছাড়াও, সিন্ধু সভ্যতার কেন্দ্র গুলো থেকে অনেক লিঙ্গ, যোনি সদৃশ অবয়ব পাওয়া গিয়েছে। নিচের চিত্রটি লক্ষণীয়-

শিবলিঙ্গ 15

আর্যদের বহুপূর্বেই যে, সিন্ধুসভ্যতা ও উপমহাদেশে লিঙ্গ,যোনি প্রভৃতির পূজা প্রচলিত ছিল তা ধারণা করা যায়।

শিব যে বৈদিক দেবতা নন এবং লিঙ্গ পূজা যে আর্যদের কাছে নিন্দনীয় ছিল,তার প্রমাণ তাদের রচিত ঋগ্বেদ থেকেই মেলে। লিঙ্গোপাসকদের বিদ্বেষবশত তারা ‘শিশ্নদেব’ বলে ডাকতো।

ঋগ্বেদে উল্লেখিত আছে-

‘ন যাতব ইন্দ্র জুজুবুর্নো ন বন্দনা শবিষ্ঠ বেদাভ্যিঃ।
স শর্ধদর্যো বিষুণস্য জন্তোর্মা শিশ্নদেবা অপি গুর্ঋৃতং নঃ’।। (ঋগ্বেদ ৭/২১/৫)
অর্থাৎ: হে ইন্দ্র! রাক্ষসগণ (যাতুগণ) যেন আমাদের হিংসা না করে। হে বলবত্তম ইন্দ্র!রাক্ষসগণ যেন প্রজাগণ হতে আমাদের পৃথক না করে। স্বামী ইন্দ্র যেন বিষম জন্তুর বধে উৎসাহান্বিত হন। শিশ্নদেবগণ যেন আমাদের যজ্ঞ বিঘ্ন না করে।  (রমেশ চন্দ্র দত্তের অনুবাদ)

এবং,

‘স বাজং যাতাপদুষ্পদা সন্ত্স্বর্ষাতা পরি ষদৎসনিষ্যন্ ।
অনর্বা যচ্ছতদুরস্য বেদো ঘ্নঞ্ছিশ্নদেবা অতি বর্পসা ভূৎ’।। (ঋগ্বেদ-১০/৯৯/৩)
অর্থাৎ:” … অন্নের প্রাপয়িতা (সেই ইন্দ্র) শত্রুদের ধনবিভাগ করিতে ইচ্ছুক হইয়া দুষ্ট পতন হইতে রক্ষার্থে নিকটে বসিয়া আছেন; সংগ্রামে বলপূর্বক শিশ্নদেবগণকে হত্যা করিতে করিতে (তিনি) শতদ্বারবিশিষ্ট ধন (শত-দুরস্য বেদঃ) অভিভূত করেন।” (৩)

ঋগ্বেদের এই সাক্ষ্য থেকে জানা যায়, আর্যরা লিঙ্গোপাসক ছিল না, তারা জননাঙ্গের পূজকদের ‘শিশ্নদেব’ বলে তিরস্কৃত করতো এবং ইন্দ্র ‘শিশ্নদেবদেরকে হত্যা করতে করতে, পরাভূত করে শতদ্বারবিশিষ্ট শত্রুপুরী হতে ধন অপহরণ করেন। সিন্ধু সভ্যতার অধিবাসীরা যে  লিঙ্গ ও যোনি মূর্তির আরাধনা করতো প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ হতে তা জানা যায় (সিন্ধু সভ্যতার জননাঙ্গের অবয়বের ছবিটি লক্ষণীয়)। এই শিশ্নদেব, যাদের প্রতি আর্যরা বিদ্বেষ পোষণ করেন, তারা যে সিন্ধুসভ্যতারই অধিবাসী, এই অনুমান খুব অসঙ্গত হবে না।

কিন্তু পরবর্তীতে, আর্যরা অনার্যদের সাথে আপোস করতে বাধ্য হয়, তারা তাদের দেবদেবীদের গ্রহণ করে এবং নিজেরাই তাদের পূজন করতে শুরু করে। পুরানাদিতে শিব প্রধান হয়ে ওঠেন, শিবলিঙ্গ পূজা অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।

পুরানগুলিতে এমন অনেক সাক্ষ্য মেলে যার দ্বারা শিবলিঙ্গ যে পুরুষ-জননাঙ্গ তা পরিষ্কার হয়ে যায়। বামনপুরাণ, শিবপুরাণ, স্কন্দ পুরাণ,পদ্মপুরাণ,কূর্ম পুরাণ প্রভৃতিতে শিবলিঙ্গের নানান উপাখ্যান আছে যা শিবলিঙ্গের জননাঙ্গ হওয়া প্রমাণ করে।

লিঙ্গ পুরাণ ও শিবপুরাণে শিবলিঙ্গ

পুরাকালে মহাদেবের দারুবনে প্রবেশ পুরানাদিতে বেশ স্মরণীয় হয়ে রয়েছে। শিব পুরাণ ও লিঙ্গ পুরাণ, উভয় পুরাণেই শিব শঙ্করের দারুবনে প্রবেশের কথা মেলে-

বউ, ছেলেমেয়েদের নিয়ে দারুবনে ঋষিরা তপস্যা করছিলেন। মুনিরা শ্রদ্ধাভরে তপস্যা করছেন কিনা তা পরীক্ষা করার জন্য মহাদেব দিগম্বর অর্থাৎ উলঙ্গ হয়ে দারু বনে প্রবেশ করেন। অতি সুদর্শন মহাদেব ঋষি পত্নীদের আকৃষ্ট করার কামোদ্দীপক ভ্রুবিলাশ করলেন এবং গান গাইলেন।মহাদেব ঋষি পত্নীদের যতটা সম্ভব উত্তেজিত করলেন। ঋষিপত্নীরাও শিবের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে বিবস্ত্র অবস্থায় তাকে অনুসরণ করলেন। কেউ কেউ গান গাইতে লাগলেন, কেউ নাচতে লাগলেন, কেউ মাটিতে লুটিয়ে পড়্লেন, কোনো কোনো রমনীরা একে অপরকে আলিঙ্গন করতে লাগলেন, কেউ আবার মহাদেবকে নানা কৌশল দেখাতে শুরু করলেন, কেউ তার সামনে বসে পড়লেন, কেউ জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি কে? আমাদের প্রতি প্রসন্ন হউন।”

মহাদেব ঋষি পত্নীদের এরূপ আচরণ দেখে কিছু বললেন না। ঋষিরা নগ্ন মহাদেব ও তাদের পত্নীদের দেখে মহাদেবকে গালাগালি করতে আরম্ভ করলেন। মুনিদের কটু কথা শুনে শিব অন্তর্হিত হলেন।

শিবলিঙ্গ 17
শিবলিঙ্গ 19

( লিঙ্গ পুরাণ / পূর্ব ভাগ / অধ্যায় ২৯|অনুবাদক- শ্রী পঞ্চানন তর্করত্ন)

লিঙ্গ পুরাণে এখানেই এই ঘটনাটি শেষ হয়।

শিব পুরাণেও একই ধরণের গল্প মেলে, তবে শিবপুরাণে দারুবনে শিব তার লিঙ্গ হারান।

শিবপুরাণের কাহিনীটি এরূপ-

দারুবনে ঋষিরা বাস করতেন। একদিন শিব ঋষিদের কোনোরূপ পরীক্ষা করার জন্য গায়ে ছাই-ভস্ম মেখে নগ্ন হয়ে,বনের মধ্যে প্রবেশ করেন ,বিকৃত মনোবৃত্তি নিয়ে হাতে নিজ লিঙ্গ ধরে ঋষিপত্নীদের মোহিত করতে থাকেন। কোনো কোনো ঋষিপত্নী ব্যাকুল হয়ে শিবের সামনে উপস্থিত হন। কেউ কেউ শিবের হাত ধরে তাকে জড়িয়ে ধরলেন। ঋষিরা এসব দেখে অত্যন্ত রেগে যান। তারা শিবকে তার এমন আচরণের কারণ জিজ্ঞাসা করেন। তারা শিবকে অভিশাপ দেন- “তোমার লিঙ্গ ভূতলে পতিত হউক।” অভিশাপ মাত্রই শিবের লিঙ্গ মাটিতে খসে পড়ে যায়। ওই লিঙ্গ সামনে যা কিছু পেল তাই দগ্ধ করে। স্বর্গ, মর্ত, পাতালে তুলকালাম কাণ্ড বাধিয়ে দেয় মহাদেবের লিঙ্গ।

এই পরিস্থিতিতে লোকেরা ও ঋষিরা দুঃখিত হন। নিরূপায় হয়ে তারা ব্রহ্মার শরণ নেন। ব্রহ্মা বলেন, “যে পর্যন্ত লিঙ্গ স্থিরভাবে অবলম্বন না করিতেছে, সে পর্যন্ত ত্রিজগতের কোথাও শুভ হইবে না, ইহা সত্য কহিতেছি।” এরপর ব্রহ্মা দেবতা- ঋষিগণকে উপদেশ দেন, ” মঙ্গলদায়িনী গিরিজাদেবীর আরাধনা কর, তিনি যদি প্রসন্না হইয়া যোনিরূপ ধারণ করেন, তাহা হইলে নিয়ম এই প্রকার করিবে।” এরপর ব্রহ্মা বলেন কিভাবে যোনিতে লিঙ্গ স্থাপন করে কোন কোন উপাচারের মাধ্যমে তার আরধনা করতে হবে, “…হে দেবেশ! প্রসন্ন হও, হে জগদলাদায়ক… শান্ত হও। এই প্রকারে করিলে নিশ্চয় স্বাস্থ্য হইবে।”

তারপর শিবের শরণাপন্ন হয়ে দেবতা, ঋষিরা তার আরাধনা করতে থাকেন। আরাধনায় শিব সন্তুষ্ট হন। পার্বতী ছাড়া অন্য কেউ শিবের লিঙ্গ ধারণে সমর্থ হবে না ভেবে দেবতা-ঋষিরা পার্বতীকে সন্তুষ্ট করেন। পার্বতী লিঙ্গ ধারণ করেন। লিঙ্গ স্থাপিত হলে জগতে সুখ হয়।

(শিবপুরাণ/জ্ঞানসংহিতা/অধ্যায় ৪২|অনুবাদক- শ্রী পঞ্চানন তর্করত্ন)

বামনপুরাণে শিবলিঙ্গ

“এদিকে যক্ষ তনয় চলিয়া যাইবার পর ভগবান ত্রিলোচন স্বর্গ হইতে বিন্ধ্যাচলে গমন করিলেন। কিন্তু মদন তাহাকে তখনও ছাড়িল না, সে সেস্থানে গিয়াও তাহাকে দেখিবামাত্র প্রহার করিতে উদ্যত হইল। শঙ্কর সেই স্থান হইতে পলায়ন করিলেন। তারপর হর ঘোর দারুবনে প্রবিষ্ট হইলেন। মদন সেখানেও তাহার অনুসরণ করিল। ঐ দারুবনে বহু ঋষি সস্ত্রীক বাস করিতেছিলেন। তাহারা হর দর্শনে সকলেই মস্তক অবনত করিলেন। শঙ্কর তাহাদিগকে বলিলেন, আমাকে আপনারা ভিক্ষা প্রদান করুন। মহর্ষিরা এই প্রার্থনায় কোনো কথাই কহিলেন না, সকলেই মৌনী হইয়া রহিলেন। তখন শঙ্কর পূণ্যাশ্রম সকল পরিভ্রমণ করিতে লাগিলেন। হে নারদ তাহাকে আশ্রমে প্রবিষ্ট দেখিয়া ভৃগু এবং অত্রি পরিবারের যাবতীয় রমণীর চিত্ত বিক্ষুব্ধ হইল। তাহারা যেন অবশাঙ্গ হইয়া সকলেই চারিদিকে ঢলিয়া পড়িল। কিন্তু একমাত্র ভাবিনী অরুন্ধতী এবং অনসূয়ার মন অটল রহিল। তাহাঁদিগের মন তখন নিজ নিজ স্বামী শুশ্রুষায়ই নিবিষ্ট, অন্যচিন্তা তাহাদের মনে একেবারেই ছিল না; সুতরাং তাহারা ব্যতিত মহেশ্বর যে যে দিকে যাইতে লাগিলেন, সেই সেই স্থানের রমণীবৃন্দই সংক্ষোভিত হইতে লাগিল। তাহারা মদ বিহ্বল হইয়া অনঙ্গ তাড়নায় মহাদেবের দিকে ছুটিয়া চলিল, মুনিপত্নীগণ তখন স্ব স্ব আশ্রমের কথা ভাবিল না, তাহারা সে সকল শূণ্য ফেলিয়া মহাদেবের অনুসরণ করিল। তখন মনে হইলো,করিণীগণ যেন মত্ত কুঞ্জরের দিকে ছুটিয়া চলিল। ৫০-৫৪ হে মুনে! অনন্তর ভৃগু এবং অঙ্গীরোবংশীয় মুনীগণ এই ব্যাপার দেখিয়া ক্রুদ্ধ হইলেন এবং সকলেই একবাক্যে বলিলেন, এইক্ষণই দেবদেবের লিঙ্গ ভূতলে পতিত হউক। তাহারা এই কথা বলিবামাত্র সেই দেবলিঙ্গ ভূতল বিদারণ করিয়া পতিত হইল। তখন শূলপাণি শঙ্করও অন্তর্ধান করিলেন। অনন্তর সেই ভূপতিত লিঙ্গ বসূধা ভেদ করিয়া রসাতলে প্রবেশ করিল এবং ঊর্ধে ব্রহ্মাণ্ড ভেদ করিতে লাগিল। তখন পৃথিবী বিচলিত হইয়া উঠিল। সঙ্গে সঙ্গে গিরি নদী পাদপ, এমনকি পাতলতল পর্যন্ত চরাচর সমস্তই ক্ষুব্ধ হইয়া পড়িল। পিতামহ ব্রহ্মা ভূলোকাদি সমস্ত সংক্ষুব্ধ দেখিয়া ক্ষিরোদচারী মাধবের নিকট গমন করিলেন। সেখানে গিয়া ভক্তিভরে হৃষীকেশকে প্রণাম করিয়া বলিলেন- দেব! এই সমস্ত ভূবন কিজন্য ক্ষুব্ধ হইল? শ্রীহরি ব্রহ্মার প্রশ্নের উত্তরে বলিলেন, ব্রহ্মন্, দারুবনবাসী মহর্ষিগণ শম্ভুর লিঙ্গ পতিত করিয়াছেন, তাহারই ভারে বসুধা বিচলিত হইয়াছে। ব্রহ্মা এই অদ্ভুত কথা শুনিয়া বারবার বলিতে লাগিলেন, দেবেশ, চলুন একবার আমরা সেই স্থানে যাই। তখন ব্রহ্মা এবং হরি উভয়েই সেই শিবলিঙ্গ উদ্দেশে যাত্রা করিলেন এবং অবিলম্বে সেই স্থানে আসিয়া উপনীত হইলেন। তখন উভয়েই লিঙ্গ দর্শনে বিস্মিত। অনন্তর হরি, শিবলিঙ্গের অনন্ত অবধি দেখিয়া গরুড়ারোহনে তাহার শেষ সীমা দেখিবার জন্য সবিস্ময়ে পাতালে প্রবেশ করিলেন। এদিকে ব্রহ্মাও হংসারোহনে লিঙ্গের ঊর্ধ সীমা দেখিবার জন্য উত্থিত হইলেন। কিন্তু ব্রহ্মা তাহার অন্ত পাইলেন না, অগত্যা চক্রপাণিও ফিরিয়া আসিলেন। হে মহামুনে! তখন ব্রহ্মা এবং বিষ্ণু উভয়ে হরলিঙ্গ সমীপে সমাগত হইয়া কৃতাঞ্জলিপুটে স্তব করিতে লাগিলেন। ৬৫-৭৭ হরি ও ব্রহ্মা বলিলেন, হে বৃষবাহন, হে শূলপাণে, আমরা তোমায় নমস্কার করি। তুমি জীমূতবাহন, কবি, ত্র্যম্বক, শর্ব, শঙ্কর, মহেশ্বর এবং বৃষাকপি। তোমার প্রভাবে দক্ষযজ্ঞ ধংস হইয়াছে, তুমি কালরূপে বিরাজ করিতেছ। তোমায় আমাদের নমস্কার। এই জগতের আদি, মধ্য এবং অন্ত সকলই তুমি । সর্বত্র তোমার গতি, তুমি সকলের অন্তর্যামী। তোমাকে আমরা নমস্কার করি। পুলস্ত বলিলেন- ব্রহ্মা ও হরি সেই দারুবনে থাকিয়া এইরূপ স্তব করিতেছেন, এই সময় বাগ্মীবর হর নিজরূপে আবির্ভূত হইয়া  কহিলেন, হে দেবনায়কদ্বয়, তোমরা কিজন্য আমায় স্তব করিতেছ? আমার মন একান্ত অসুস্থ, দেহ কামশরে জর্জরিত , আমি একপদ চলিতে পারি এমন শক্তি আমার নাই। হরি ও ব্রহ্মা বলিলেন শঙ্কর, আপনার এই লিঙ্গ ভূতলে পতিত হইয়াছে , আপনি ইহা পুনরায় গ্রহণ করুন, এই জন্যই আমরা স্তব করিতেছি। হর বলিলেন, হে সুরবরদ্বয়, যদি দেবগণ আমার এই লিঙ্গ অর্চনা করেন , তাহা হইলে আমি ইহা আবার গ্রহণ করিতে পারি, অন্যথা আমার উহা অগ্রাহ্য। তখন ভগবান হরি বলিলেন, তাহাই হইবে। পরে ব্রহ্মা স্বয়ং সেই কনকপিঙ্গল শিবলিঙ্গ অর্চনার্থ গ্রহণ করিলেন। অনন্তর লিঙ্গ অর্চনার জন্য চতুর্বর্ণ সৃষ্টি হইল। ঐ সকল বর্ণের নিকট নানা সদুক্তিপূর্ণ শাস্ত্রবাক্যই প্রধানতঃ প্রামাণ্য। উহাদিগের মধ্যে আদ্য বর্ণ শৈব সংজ্ঞায় অভিহিত। দ্বিতীয় পাশুপত, তৃতীয় কালদমন এবং চতুর্থ কাপালিক। … “

শিবলিঙ্গ 21
শিবলিঙ্গ 23
শিবলিঙ্গ 25

(শিবপুরাণ/ ৬ষ্ঠ অধ্যায়; আচার্য পঞ্চানন তর্করত্ন কর্তৃক সম্পাদিত, নবভারত পাবলিশার্স)

পদ্মপুরাণে শিবলিঙ্গ

পদ্মপুরাণের উত্তরখণ্ডে,রাজা দিলিপ ঋষি বশিষ্টকে জিজ্ঞাসা করেন, “কোন কারণে শিব ও পার্বতীর নিন্দনীয় রূপ দেখা যায়? সেই প্রসিদ্ধ রূপটিতে (শিবলিঙ্গে)  কেন লিঙ্গ ও যোনি দেখা যায়?  শিবের এই নিন্দনীয় রূপের কারণ কি?”

বশিষ্ট বলেন,

পূর্বে স্বায়ম্ভূব মনু মন্দার নামক শ্রেষ্ঠ পর্বতে ঋষিদের সাথে নিয়ে এক দীর্ঘ চমৎকার যজ্ঞ করেছিলেন। কোন দেবতা ব্রাহ্মণের পূজনীয় এটা নিয়ে তর্ক বেধেছিল। কোনো কোনো ঋষি বললেন শিব শ্রেষ্ঠ। কেউ বললেন ব্রহ্মা একাই পূজনীয়। কেউ আবার বিষ্ণুর কথা বললেন। ঋষিরা ভৃগু ঋষিকে বললেন, ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বরকে দেখে  আসতে। এদের মধ্যে যার মধ্যে শুদ্ধ সত্ত্ব গুণ বিরাজ করে তিনিই পূজনীয় হবেন।…

ঋষিদের কথামত ভৃগু, বামদেবের সাথে দেবতাদের দর্শন করতে যান। প্রথমে তারা শিবের আবাসস্থল কৈলাসে গিয়ে উপস্থিত হন। শিবের বাড়ির দরজার কাছে গিয়ে প্রহরারত নন্দীকে দেখে ভৃগু বলেন-

“আমি শ্রেষ্ঠ দেব শিবের সাথে দেখা করতে এসেছি। তাকে খবর দাও।“

ভৃগুর কথা শুনে নন্দী রুষ্ট কণ্ঠে বলে ওঠে, “ প্রভু এখন ব্যস্ত আছেন। তিনি পার্বতীর সাথে সম্ভোগ করছেন। হে মুনি, প্রাণের মায়া থাকলে, এখান থেকে চলে যাও।“

ভৃগু বহুদিন অপেক্ষা করেও শিবের দেখা পান না। অবশেষে রেগে গিয়ে তিনি শিবকে অভিশাপ দেন-

“ স্ত্রী সংসর্গে মত্ত হয়ে মহাদেব আমাকে অবজ্ঞা করছে। অতএব তাদের উভয়ের শরীর লিঙ্গ ও যোনিরূপ হবে। আমি ব্রাহ্মণ, শিব পাপাচ্ছন্ন হয়ে আমাকে জানতে পারল না। অতএব সে অব্রাহ্মণ হয়ে দ্বিজদের অপূজ্য হবে। আর যারা শিবভক্ত হয়ে অস্থিভস্ম, লিঙ্গমূর্তি ধারণ করবে তারা পাষণ্ড হয়ে বৈদিক ধর্ম হতে বহিষ্কৃত হবে।“

(পদ্মপুরাণ/উত্তরখণ্ড/২৫৫/১-৩৪ | publishers:- MOTILAL BANARSIDASS PUBLISHERS PRIVATE LIMITED)

স্কন্দ পুরাণে শিবলিঙ্গ

স্কন্দ পুরাণে শিবলিঙ্গের কাহিনী এরূপ বলা আছে-

একদিন শিব নগ্ন হয়ে ভিক্ষা করার জন্য দারুবনে গমন করেন।দারুবনের ঋষিরা স্নান করার জন্য অন্য জায়গায় গিয়েছিলেন,কেবলমাত্র ঋষি পত্নীরাই সেইসময়ে আশ্রমে ছিলেন, এমন সময় শিব দারুবনের আশ্রমের দিকে নগ্নভাবে অগ্রসর হন। মহাদেবকে দেখে মুনিপত্নীরা বলেন,” কে এই অপূর্ব দর্শন ভিক্ষুক এখানে আগমণ করিলেন? যাহা হউক আমরা সখীগণ সমভিব্যহারে ইহাকে ভিক্ষা প্রদান করিব।” তারপর তারা শিবকে মনমত ভিক্ষা দেন। এরপর মুনিপত্নীদের শিব জানান ,”আমি ঈশ্বর।”। তখন মুনিপত্নীরা অনুমান করেন, তিনি নিশ্চয় মহাদেবই হবেন। তারপর ঋষি পত্নীরা শিবের কাছে তার  ভিক্ষা করার কারণ জানতে চান। তখন শিব জানান,” পত্নী দাক্ষায়ণীর সহিত আমার বিচ্ছেদ ঘটিয়াছে,তাই আমি দিগম্বর হইয়া বিচরণ করি।” শিব আরো বলেন, তার সতী ভিন্ন অপর কোনো নারীতে তার রুচি নেই।

শিব ভিক্ষা গ্রহণ করে চলে যেতে থাকলে, ঋষিদের পত্নীরাও কামপরবশ হয়ে তাকে অনুসরণ করতে থাকেন। তারা ঘরের সকল কাজ ছেড়ে শিবের পেছন পেছন চলতে শুরু করেন।
এদিকে ঋষিরা আশ্রমে এসে দেখেন তাদের স্ত্রীরা সেখানে নেই। তখন তারা আশঙ্কা করে বলেন, “আমাদের পত্নীসকল কোথায় গেল, কিছুই জানিতেছি না। কোনো নষ্ট লোক কি তাহাদের সকলকে হরণ করিল?” ঋষিরা আশ্রমের চারদিকে তাদের স্ত্রীদের খুজতে থাকেন। কিছুক্ষণ পর তারা দেখতে পেলেন, তাদের স্ত্রীরা শিবের পেছন পেছন চলে যাচ্ছেন। তা দেখে তারা সকলেই খুব রেগে যান এবং শিবের কাছে গিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করেন, মহাদেব কেন তাদের পত্নীদের চুরি করে নিয়ে যাচ্ছেন। ঋষিদের কথা শুনেও শিব কিছু না বলে কৈলাশের দিকে চলতে থাকেন। শিবের এমন আচরণ দেখে ঋষিরা অত্যন্ত রেগে যান, তারা শিবকে অভিশাপ দেন ,

“যেহেতু তুমি অব্যয় মহাদেব হইয়াও আমাদের কলত্রাপহরত্তা (স্ত্রী অপহরণকারী) , এইজন্য সত্ত্বর তোমাকে ক্লীব হইতে হইবে।”

মুনিদের অভিশাপের সাথে সাথে শিবের লিঙ্গ মাটিতে পড়ে যায়। ঐ লিঙ্গ মাটিতে পরে বাড়তেই থাকে, স্বর্গ-মর্ত্য-পাতাল সবই লিঙ্গ দ্বারা আবৃত হয়।শিবের লিঙ্গে সকল কিছুই লীন হয়ে যায়। যেহেতু শিবের লিংগে সব কিছু লীন হয়ে যায়, তাই তার নাম হয় লিঙ্গ। ব্রহ্মা ও বিষ্ণু এই লিঙ্গের আদি ও অন্ত জানার জন্য পাতাল ও স্বর্গাভিমুখে যাত্রা করেন। কিন্তু কেউই তার আদি ও অন্ত দেখতে পান না।

ঋষি-দেবতাগন সকলেই ভয় বিহ্বল হয়ে শিবলিঙ্গের স্তুতি করতে থাকেন। বীরভদ্র, দেব ঋষিগণ শিবলিঙ্গের পূজা করে তাকে শান্ত করেন।

শিবলিঙ্গ 27
শিবলিঙ্গ 29
শিবলিঙ্গ 31
শিবলিঙ্গ 33
শিবলিঙ্গ 35
শিবলিঙ্গ 37
শিবলিঙ্গ 39

(স্কন্দ পুরাণ/মাহেশ্বরখণ্ডে-কেদারখণ্ডম/৬-৭ অধ্যায়)

কূর্ম পুরাণে শিবলিঙ্গ

কূর্ম পুরাণের উত্তর ভাগেও শিবের লিঙ্গচ্ছেদের কাহিনী দেখা যায়-

“পূর্বকালে দেবদারু বনে হাজার হাজার মুনি স্ত্রী পুত্রদের নিয়ে তপস্যা করেছিলেন। ঐ মহর্ষিরা নানা প্রকার কাম্য কর্ম করতে প্রবৃত্ত হয়ে বিবিধ যজ্ঞ  আর তপস্যা করতে লাগলেন। তখন কামনাসক্ত চিত্ত মুনিদের দোষ দেখিয়ে দেবার জন্য ভগবান মহাদেব দেবদারু বনে উপস্থিত হলেন।” মহাদেব বিষ্ণুকে সাথে করে দেবদারু বনে গিয়েছিলেন। মহাদেব ২০ বছর বয়সী অত্যন্ত সুঠাম, সুদর্শন পুরুষের রূপ ধারণ করলেন। আর বিষ্ণুও এক সুন্দরী নারীর মূর্তি ধারণ করলেন।নগ্ন মহাদেব ও স্ত্রীবেশধারী বিষ্ণু সবাইকে মোহিত করতে করতে জঙ্গলে বিচরণ করতে লাগলেন। ঋষিদের পতিব্রতা স্ত্রীরাও মহাদেবকে দেখে কামার্ত হয়ে পড়লেন। “তাদের বস্ত্র ও আভরণ খুলে পড়ে যেতে লাগল। এইভাবে বারাঙ্গনার মত নির্লজ্জ হয়ে তারা শিবের সঙ্গে সঙ্গে ভ্রমণ করতে লাগলেন। ঋষিদের তরুণ পুত্রেরা জিতেন্দ্রিয় ছিলেন কিন্তু এখন কামার্ত হয়ে স্ত্রী বেশধারী হৃষীকেশের (বিষ্ণুর) পেছনে পেছনে যেতে লাগলেন। বিলাসিনী নারীরা পত্নীর সঙ্গে অদ্বিতীয় মহাদেবকে অতি সুন্দর ও অদ্বিতীয় নায়করূপে দেখে নাচতে গাইতে শুরু করলেন আর মাঝে মাঝে ইচ্ছার বশে আলিঙ্গনও করতে লাগলেন… রুদ্র নারীদের আর কেশব (বিষ্ণু) পুত্রদের মোহিত করছেন দেখে মুনিরা ক্রুদ্ধ হলেন।“ অসন্তুষ্ট মুনিদের সাথে এক পর্যায়ে শিবের ঝগড়া বেধে গেল। “ঋষিরাও আবার তাকে দণ্ড, যষ্টি ও মুষ্টির দ্বারা  তাড়না করতে লাগলেন। তারপর শিবকে উলঙ্গ ও বিকৃত চিত্তযুক্ত হয়ে ভ্রমণ করতে দেখে ঋষিরা বললেন, রে দুর্মতি, তুই এই লিঙ্গ উপড়ে ফেল। মহাযোগী শঙ্কর তাদের বললেন, যদি আমার এই লিঙ্গের উপর তোমাদের এতই রাগ , তবে না হয় উপড়েই ফেলছি। এই বলে ভগদেবতার নেত্র উৎপাটনকারী ভগবান লিঙ্গ উপড়ে ফেললেন।“ তারপর শিব ও বিষ্ণু অদৃশ্য হয়ে গেলেন। এরপরেই নানা প্রকার দুর্যোগ দেখা দিতে শুরু করে। পৃথিবী কাঁপতে থাকে,সমুদ্র ফুলে উঠতে থাকে। এর পরে ঋষিরা ব্রহ্মার কাছে গিয়ে সব খুলে বলে তার কাছ থেকে পরামর্শ নিলেন-

ব্রহ্মা বললেন, “তার (শিবের) যে লিঙ্গকে তোমরা ভূমিতে পড়ে যেতে দেখেছিলে , সেই লিঙ্গের মত দেখতে আরেকটি লিঙ্গ নির্মাণ কর, তারপর স্ত্রী পুত্রের সঙ্গে ব্রহ্মচর্য অবলম্বন করে সযত্নে নানা প্রকার বৈদিক নিয়মে পূজা কর। তোমরা বন্ধু আর পুত্রদের সঙ্গে মিলে শতরুদ্রিয় পাঠ আর পরম তপস্যা অবলম্বন করে ঋক,যজুঃ, সামবেদস্থিত শাঙ্কর মন্ত্রে প্রতিষ্ঠা করে সমাহিতভাবে পূজা কর এবং সকলেই কৃতাঞ্জলিপুটে ভগবান শূলপানির শরণাপন্ন হও। তাহলেই অসংস্কৃতাত্ম পুরুষেরা যাকে সহজে দেখতে পায় না সেই দেবাধিপতি মহাদেবকে দেখতে পাবে।”

শিবলিঙ্গ 41
শিবলিঙ্গ 43
শিবলিঙ্গ 45
শিবলিঙ্গ 47

(কূর্ম পুরাণ /উত্তরভাগ/ ৩৭ অধ্যায় । অনুবাদঃ দেবার্চনা সরকার । নবপত্র প্রকাশন)  ( Kurma Purana/uttar-bhaga/ 38-39 chapter)

দেবীভাগবত পুরাণে শিবলিঙ্গ

দেবীভাগবত অনুসারে ভৃগুর অভিশাপের ফলে শিব তার লিঙ্গ হারিয়েছিলেন-

“রাজন! মহাদেব যৎকালে কামার্ত ও নগ্ন হইয়া ভৃগুর বনে গমন পূর্বক রমণ করিতে থাকেন সেই সময় তপোধন ভৃগু তাহাকে তদবস্থ দর্শন করিয়া , তুমি অতিশয় নির্লজ্জ,  অতএব ‘এখনিই তোমার লিঙ্গ পতিত হউক ‘ এই বলিয়া তাহার প্রতি দারুণ অভিসম্পাত করেন, তখন মহাদেব আনন্দ উপভোগের নিমিত্ত দানবগণের বিনির্মিত অমৃত দির্ষিকা সলিল পান করিতে থাকেন।”

শিবলিঙ্গ 49

(দেবী ভাগবত/ চতুর্থ স্কন্দ/ ২০ অধ্যায়/ শ্লোক ৩৬-৩৭; শ্রী হরিচরণ বসু কর্তৃক সম্পাদিত)

মহাভারতে শিবলিঙ্গ

মহাভারতের অনুশাসন পর্বে শিবলিঙ্গ সম্বন্ধে যা বলা হয়েছে তাতে শিবলিঙ্গকে জননাঙ্গ বলেই মনে হয়। অনুশাসন পর্বে বলা হয়েছে,

” দেবগণ সেই মহেশ্বরের লিঙ্গ ব্যতিরেকে আর কাহারও লিঙ্গ পূজা করেন নাই ও করিতেছেন না। ব্রহ্মা, বিষ্ণু, আপনি ও অন্যান্য দেবগণ আপনারা সকলেই সেই দেবাদিদেবের লিঙ্গ পূজা করিয়া থাকেন, সুতরাং তিনিই সকল দেবতার অগ্রগণ্য। ব্রহ্মার চিহ্ন পদ্ম, বিষ্ণুর চিহ্ন চক্র ও আপনার চিহ্ন বজ্র বিদ্যমান রহিয়াছে। কিন্তু প্রজারা আপনাদিগের কাহারই চিহ্নে চিহ্নিত নহে। তাহারা হরপার্বতীর চিহ্নানুসারে লিঙ্গ ও যোনি চিহ্ন ধারণ করিয়াছে । সুতরাং উহারা যে শিব ও শিবা হইতে উদ্ভূত, তাহার আর সন্দেহ নাই। স্ত্রীজাতি পার্বতীর অংশে সম্ভূত হইয়াছে বলিয়া যোনিচিহ্নে চিহ্নিত আর পুরুষেরা মহাদেবের অংশে জন্মগ্রহণ করিয়াছে বলিয়া লিঙ্গচিহ্নিত হইয়াছে; যাহারা উহাদের উভয়ের চিহ্নেই চিহ্নিত তাহারা ক্লীবপদবাচ্য হইয়া জনসমাজ হইতে বহিষ্কৃত হয় এই জীবলোকে পুংলিঙ্গধারীরে শিবের ও স্ত্রীলিঙ্গধারীরে পার্বতীর অংশ বলিয়া অবগত হইবে। এই চরাচর বিশ্ব হরপার্বতী দ্বারাই ব্যাপ্ত রহিয়াছে। “

শিবলিঙ্গ 51
(কালিপ্রসন্নের মহাভারত/ অনুশাসন পর্ব/ চতুর্দশ অধ্যায়)

পৃথিবীর অন্যান্য স্থানে লিঙ্গোপাসনা

জননাঙ্গের পূজা যে কেবল হিন্দুদের মধ্যেই প্রচলিত ছিল এমনটা নয়। বিশ্বের নানা সভ্যতা, নানা ধর্মেই এই পূজা দেখা যায়।

  • ২৮ হাজার বছর পুরোনো Hohle Fels এ প্রাপ্ত লিঙ্গকে সবচেয়ে পুরোনো লিঙ্গ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়।
  • গ্রীক পুরাণে হারমিসকে লিঙ্গ দ্বারা চিহ্নিত করা হত। গ্রীক গড প্রায়াপাস ছিলেন উর্বরতার দেবতা। তার প্রতীক ছিল একটা বিশাল লিঙ্গ। তিনি গাছ,বাগান, ফল ও পুং জননেন্দ্রিয়ের রক্ষক। গ্রীসের শহর ট্রায়ারনাভাসে প্রতিবছর লিঙ্গ উৎসব পালিত হয়।
 
শিবলিঙ্গ 53
Polyphallic wind chime from Pompeii; a bell hung from each phallus
  • মিশরের দেবতা ওসাইরাসের সাথেও লিঙ্গের কাহিনী জড়িত। ওসাইরাসের দেহকে যখন ১৪ টুকরো করা হয়েছিল তখন সেট তার দেহাংশগুলোকে সমগ্র মিশরে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। ওসাইরাসের স্ত্রী আইসিস ওসাইরাসের দেহের সমস্ত অংশকে একত্রিত করতে পেরেছিলেন, কেবল তার লিঙ্গ ছাড়া। ওসাইরাসের লিঙ্গটি একটা মাছ খেয়ে ফেলেছিল। তাই ওসাইরাসের লিঙ্গের স্থানে একটি কাঠের লিঙ্গ স্থাপন করা হয়। এই লিঙ্গটি উর্বরতার প্রতীক ছিল।
  • ভুটানের পেইন্টিং এ অনেক লিঙ্গের ছবি দেখা যায়।
  • প্রাচীন স্কেন্ডেনেভিয়াতে নরস গড ফ্রাইর একজন ফ্যালিক দেবতা ছিলেন। তিনি পুরুষের উর্বরতা ও প্রেমের প্রতীক ছিলেন।
  • জাপানেও ভীষণভাবে জননাঙ্গের আরাধনা লক্ষ করা যায়। ‘কানামারা মাতসুরি’ নামক অনুষ্ঠানে লিঙ্গের আরাধনা ও লিঙ্গ নিয়ে শোভাযাত্রা দেখা যায়।

ড. অমলেন্দু মিত্র তার ‘রাঢ়ের সংস্কৃতি ও ধর্মঠাকুর’ পুস্তকে বহির্ভারতের বিভিন্ন স্থানে লিঙ্গ উপাসনা অথবা লিঙ্গকে পবিত্র ভাবার বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন। সেখান থেকে কিছু তথ্য তুলে ধরা হল-

শিবলিঙ্গ 55
Mural of Priapus depicted with the attributes of Mercury in a fresco found in Pompeii
  • এশিরিয়াতে প্রধান দেবতার নাম ছিল Bel । তার স্ত্রীর নাম ছিল Mylitta। ইনি ছিলেন উর্বরতার প্রতীক। তাদের আর একটি দেবতা ছিলেন , নাম হল Vul। ইনি ছিলেন প্রকৃতির অধিপতি। এই দেবতার প্রতীক ছিল লিঙ্গ। সেন্ট অগাস্টিন লিখে গেছেন, মনুষ্য লিঙ্গকে পবিত্র বস্তু মনে করে Liber এর মন্দিরে রক্ষা করা হয়েছে এবং স্ত্রী অঙ্গ রক্ষিত হয়েছে Liberia তে । এই দুই বস্তুকেই পিতা এবং মাতা বলা হয়েছে। (স্মরণীয় আমাদের শিবলিঙ্গ ও গৌরিপট্ট এবং শিবের অপর নাম বিশ্বনাথ।)
  • এপ্রিল মাসে বসন্ত ঋতুর আবির্ভাব দরুণ প্রকৃতির রাজ্য যখন পত্র পুষ্পে সঞ্জীবিত হয়ে উঠত, তখন রোমে ভেনাসের সম্মানার্থে উৎসবের আয়োজন করা হত। এই উৎসবে এক লিঙ্গ মূর্তিকে গাড়িতে বসিয়ে মেয়েরা ভেনাসের মন্দিরে টেনে নিয়ে যেত এবং দেবীর স্ত্রী অঙ্গে সেটিকে উপহার স্বরূপ উৎসর্গ করত।আমাদের লিঙ্গ পুরাণে অনুরূপ ইঙ্গিত আছে। অনার্য শিবের রূপে ঋষি পত্নীরা বিকারগ্রস্ত হলে ঋষিরা শিবের জননাঙ্গ ছেদন করেন। ঋষি পত্নীরা কর্তিত জননাঙ্গ টিকে সমাদরের সঙ্গে পূজার্চনা শুরু করে দেন। এই কাহিনী হাস্যকর ও চরম বিকৃতির নিদর্শন বলা চলে না যদি আমরা রোমের পূর্ব কথিত উৎসবের সঙ্গে তুলনা করি।
শিবলিঙ্গ 57
Herm
  • কবি ভার্জিল জরজিকাশ কাব্যে অনুরূপ বিশ্বাসের কথা ব্যক্ত করে গেছেন। আমেরিকা ও প্রশান্ত মহাসাগরের দূরবর্তী অঞ্চলে দ্বীপসমূহের মানুষের মধ্যেও এইরকম ধারণা ও বিশ্বাস বজায় ছিল। অহিতির অধিবাসীরা বিশ্বাস করত, দুইজন দেবদেবীর ক্রমাগত মিলনের ফলে পার্থিব সমস্ত কিছুর সৃষ্টি হয়েছে।
  • টলেমি লিখে গেছেন যে, এশিরিয়া ও পারসিকদের ধর্মীয় উপাসনার অঙ্গ ছিল, লিঙ্গ পূজা। ইহুদিরাও এই ধারণার অনুবর্তী ছিল। Ezekiel XVL 17 গ্রন্থে দেখতে পাই, মেয়েরা স্বর্ণের অথবা রৌপ্যের লিঙ্গ মূর্তি নির্মাণ করাচ্ছে।
  • ক্যাপ্টেন কুক তার First voyage গ্রন্থে প্রশান্ত মহাসাগরের আদিম অধিবাসী অধ্যুষিত এক দ্বীপে জনতার সম্মুখে প্রকাশ্যে ধর্মীয় রীতির অঙ্গ স্বরূপ যৌন সঙ্গম অনুষ্ঠিত হতে দেখেছিলেন। তার ভাষায়, “ A young man, near six feet high, performed the right of venus with a little girl about eleven or twelve years of age, before several of our people and great number of the natives without the least sense of being indecent or improper, but as appeared in perfect conformity to the custom of the place. Among the spectators were several woman of superior rank , particularly oberea who may properly be said to have assisted at the ceremony”
  • Genesis গ্রন্থে দেখা যায়, আব্রাহাম যখন তার পরিচারকদের কোনও শপথ নেবার জন্য আদেশ দিচ্ছেন, সে তার জননেন্দ্রিয় স্পর্শ করে শপথ গ্রহণ করছেন। এই দৃষ্টান্ত থেকে সহজেই অনুমান করা যায়, লিঙ্গ বস্তুটিই পবিত্রতার প্রতীক স্বরূপ সমগ্র পৃথিবীতে স্বীকৃতি লাভ করেছিল। Memories Sur I’ Egypte Partie deuxieme গ্রন্থের ১৯৬ পৃষ্ঠায় উল্লেখিত হয়েছে যে কোনও আরবীয়কে পবিত্র শপথ গ্রহণ করতে হলে জননেন্দ্রিয় স্পর্শ করে করতে হত।
  • পম্পেই এর ধ্বংসাবশেষ থেকে একটি স্বর্ণ অঙ্গুরীয়ক পাওয়া যায়। সেই অঙ্গুরীয়কে লিঙ্গ চিহ্ন খোদাই করা আছে। পণ্ডিতেরা অনুমান করেছেন কোনও বন্ধ্যা স্ত্রীলোক ঐ আংটি একদা ধারণ করত।
শিবলিঙ্গ 59
ওসাইরাসের লিঙ্গ
  • আধুনিক কালে পর্যন্ত চিনের বুদ্ধ মন্দিরে, বুদ্ধ দেবের নিকট লিঙ্গ মূর্তি উপহার দেবার রীতি পালিত হয়ে থাকে।
  • অনেক দেশে স্ত্রী সমাজের মধ্যে রীতি, সন্তান কামনায় তারা কোনও জড়বুদ্ধি সম্পন্ন ব্যক্তির অথবা পুণ্যাত্মা সাধুর লিঙ্গ চুম্বন করে থাকে। ষোড়শ শতকে St. Ters (এন্টিওয়ারপ) এবং অষ্টাদশ শতকে St. Cosmo এবং Damiano (নেপলস), অনুরূপ কারণে কুমারী ও বন্ধ্যা নারীদের দ্বারা উপাসিত হতেন।
  • Sir Gardner Wilkson লিখেছেন, আধুনিক কালে পর্যন্ত মিশরের Ekhmim এর মেয়েরা কোনো এক শেখের সমাধিক্ষেত্রে এক প্রস্তর লিঙ্গে অর্ঘ্য নিবেদন করে থাকে।
  • বিবাহের সময় কনের আঙুলে আংটি পরানোর রীতি সারাবিশ্বে পরিব্যপ্ত। অনেক পণ্ডিত মনে করেন, এই বিবাহ অঙ্গুরীয় পরানোর রীতি লিঙ্গ উপাসনার আদিম রীতির সঙ্গে সংযুক্ত। এই প্রসঙ্গে Hooder M. westroop C C Staniland Wake (1170) লিখেছেন, “The symbolism we have ourselves retained to the present day in the wedding ring which must have had phallic organ, as appears probable , it originated in the Samotheacian Mysteries.” Mr. Ennemoser’s Hist of Magic গ্রন্থেও এই মত দেখা যায়।

কামাখ্যায় যোনিপুজা

প্রত্নতাত্ত্বিক খনন কার্যের ফলে সিন্ধু সভ্যতার কেন্দ্রগুলি থেকে বিভিন্ন লিঙ্গমূর্তির পাশাপাশি, স্ত্রী জননাঙ্গের মূর্তি আবিষ্কৃত হওয়ার কথা আগেই বলেছি। শিবলিঙ্গের নিম্নভাগে যে যোনির উপস্থিতি দেখা যায়, এ যেন পুরাণাদিতে দেবী পার্বতী কর্তৃক শিবের লিঙ্গ ধারণ করার কাহিনীরই অনুরূপ।
নানা স্থানে শিবলিঙ্গকে শিব ও নিচের বেদিটিকে ভগবতী বা শক্তি এরূপ বলা হয়েছে-

“ লিঙ্গ বেদী মহাদেবী ভগবতী স্বরূপ। আর লিঙ্গ সাক্ষাৎ মহাদেব স্বরূপ। এই লিঙ্গ ও বেদীর পূজাতে শিব ও শক্তি উভয়ের পূজা হয়।“ (প্রাণতোষিণী ধৃত লিঙ্গপুরাণ বচন) (২)

এবং

“ মহেশানি! শক্তি যুক্ত না থাকিলে শিব নিশ্চিত শব স্বরূপ হন এবং শক্তি যুক্ত হইলেই কর্মক্ষম হইয়া উঠেন। অতএব শক্তির সহিত শিবলিঙ্গের পূজা করিবে।“ (লিঙ্গার্চন তন্ত্র) (২)

লিঙ্গ যে শিব এবং লিঙ্গের পিঠ যে শক্তি তা সিদ্ধান্তসারভলী থেকে আমরা জানতে পারি। (১)
অঘোর শিবাচার্য লিঙ্গার্চন প্রতিষ্ঠা বিধিতে একটি মন্ত্র বলেন-

Umaya bhaga-rupinyai linga-rupadharya cha sankaraya namastubhyam…….” যার অর্থ হল- আমি নমস্কার করি উমাকে, যিনি ভগ রূপে বিরাজিতা এবং শঙ্করকে যিনি লিঙ্গ রূপে বিরাজ করেন। (১)

তবে শিবলিঙ্গ ছাড়া স্বতন্ত্র যোনি পূজাও ভারতে প্রচলিত। কামরূপ কামাখ্যায় দেবীর যোনি-পূজা অত্যন্ত বিখ্যাত।কামাখ্যায় যোনি পূজার কথা পুরাণের সতীর উপাখ্যানের মধ্যে পাওয়া যায়-
পুরাণে সতী হলেন শিবের পত্নী, দক্ষরাজার কন্যা। দক্ষরাজা সতীর পতি হিসাবে শিবকে পছন্দ করতেন না। একবার তিনি এক মহাযজ্ঞের আয়োজন করেন।তাতে সকল দেবতাদের আমন্ত্রণ জানালেও শিবকে আমন্ত্রণ জানান না। পতির প্রতি পিতার এরূপ অপমানে ক্রুদ্ধ হয়ে সতী আগুনে ঝাপ দিয়ে আত্মহত্যা করেন। সতীর মৃত্যুতে শোকাহত হয়ে শিব সতীর দেহকে কাঁধে ধারণ করে তাণ্ডব নৃত্য করতে থাকেন। শিবের প্রলয় নৃত্যে দেবতারা ভীত হয়ে পড়েন। তারা বিষ্ণুর শরণাপন্ন হন। বিষ্ণু তার সুদর্শন চক্র দ্বারা সতীর মৃতদেহ খণ্ড খণ্ড করে দেন। সতীর সকল দেহাংশ শিব হতে বিচ্যুত হলে, শিব শান্ত হন এবং তপস্যায় রত হন। পুরাণ অনুসারে, সতীর দেহের ৫১ টি অংশ যে যে জায়গায় পড়েছিল সেখানে শক্তিপিঠ তীর্থের সৃষ্টি হয়। বলা হয়, কামরূপ কামাখ্যায় সতীর যোনি পড়েছিল।
এই পৌরাণিক ব্যাখ্যা ঐতিহাসিকভাবে কাল্পনিক হলেও এর মধ্যে জননাঙ্গের আরাধনার একটি ইঙ্গিত বর্তমান, যা কোনোমতেই উপেক্ষণীয় নয়। যাই হোক, কামাখ্যায় স্ত্রী জননাঙ্গ যে পূজিত হয়, এটা আপাতত মাথায় রাখা যাক।

নিচে কামাখ্যার যোনি পূজার  ছবি দেওয়া হল-

শিবলিঙ্গ 61

দ্বিতীয় পর্ব পড়ুন 

সম্পূর্ণ লেখাটির পিডিএফ ডাউনলোড করুন

অজিত কেশকম্বলী II

"মানুষ ছাড়া ক্ষ্যাপারে তুই মূল হারাবি, মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি।"

2 thoughts on “শিবলিঙ্গের কাহিনী-লিঙ্গ মানে কি লিঙ্গ নয়?-১ম পর্ব

  • March 4, 2019 at 4:49 PM
    Permalink

    আজকের দিনে এটা দরকার ছিল।আরও লিখুন।

    Reply
  • July 6, 2020 at 5:38 PM
    Permalink

    ধন্যবাদ অজিত কেশকম্বলী। হিন্দু ধর্মের বহুল বিতর্কিত বিষয় “শিব লিঙ্গ” সম্পর্কে আজ মোটামুটি একটা ধারণা পেলাম, আপনার এই লেখাটি পড়ে। আমার মনে হয় সব হিন্দু ভাইদের এই লেখাটি পড়া উচিত। কারণ এই “শিব লিঙ্গ” বিষয়টি বিতর্কিত ।

    Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *