রাতে আরশের নিচে সূর্যের যাওয়ার হাদিসটি কেন বৈজ্ঞানিকভাবে ভুল?

আরশ

সূচনা

কুরআনের মতো হাদিস সমূহেও বেশকিছু বৈজ্ঞানিক ভুল খুঁজে পাওয়া যায়। ইসলামের সমালোচকরা অবৈজ্ঞানিক হাদিস হিসেবে যেসকল হাদিস চিহ্নিত করেছেন তাদের মধ্যে সূর্যের আল্লাহর আরশের নিচে সিজদাহ্য়ে পড়ে যাওয়ার হাদিসটিই সম্ভবত সবচেয়ে বেশি আলোচিত। ইসলামিস্টরা এই হাদিসটি বৈজ্ঞানিকভাবে ভুল নয় প্রমাণ করতে কিছু ব্যাখ্যা দিয়ে থাকেন এবং সেসব খুব সহজেই খণ্ডন করা যায়। তাদের ব্যাখ্যা সমূহ পড়ে আমি যা উপলব্ধি করতে পারি তা হচ্ছে, তাদের ধর্মগ্রন্থ সমূহ সঠিক বলছে নাকি ভুল বলছে সেটা তারা মুক্ত মনে যাচাই করতে পারে না বা করে না। বরং তারা আগে থেকেই ধরে নেয়, তাদের ধর্মগ্রন্থ কোনোভাবেই ভুল বলতে পারে না, কোনোভাবেই ভুল হতে পারে না এবং সেই অন্ধবিশ্বাস থেকেই তাদের ধর্মগ্রন্থ ভুল নয় বলে নিজেদের মনকে বুঝ দিতে তারা নিজেদের অনুমাননির্ভর কিছু ব্যাখ্যার আশ্রয় নেয়।

হাদিস

যাইহোক, এবার মূল আলোচনায় যাওয়া যাক। প্রথমেই পাঠকদের জন্য সূর্যের আল্লাহর আরশের নিচে সিজদাহ্য়ে পড়ে যাওয়ার হাদিসটি তুলে ধরবোঃ

গ্রন্থঃ সহীহ মুসলিম (ইফাঃ)
অধ্যায়ঃ ১/ কিতাবুল ঈমান (كتاب الإيمان)
হাদিস নম্বরঃ ২৯৬
৭১. যে সময়ে ঈমান কবুল হবে না
২৯৬। ইয়াহইয়া ইবনু আইউব ও ইসহাক ইবনু ইবরাহীম (রহঃ) … আবূ যার (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন, একদিন নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ তোমরা কি জানো, এ সূর্য কোথায় যায়? সাহাবীগণ বললেন, আল্লাহ ও তাঁর রাসুলই ভাল জানেন। তিনি বললেনঃ এ সূর্য চলতে থাকে এবং (আল্লাহ তা’আলার) আরশের নিচে অবস্থিত তার অবস্থানস্থলে যায়। সেখানে সে সিজদাবনত হয়ে পড়ে থাকে। শেষে যখন তাকে বলা হয়, ওঠ এবং যেখান থেকে এসেছিলে সেখানে ফিরে যাও! অনন্তর সে ফিরে আসে এবং নির্ধারিত উদয়স্থল দিয়েই উদিত হয়। তা আবার চলতে থাকে এবং আরশের নিচে অবস্থিত তার অবস্থানস্থলে যায়। সেখানে সে সিজদাবনত অবস্থায় পড়ে থাকে। শেষে যখন তাকে বলা হয়, ওঠ এবং যেখান থেকে এসেছিলে সেখানে ফিরে যাও। তখন সে ফিরে আসে এবং নির্ধারিত উদয়লে হয়েই উদিত হয়।
সে আবার চলতে থাকে এবং আরশের নিচে অবস্থিত তার অবস্থান স্থলে যায়। সেখানে সে সিজদাবনত অবস্থায় পড়ে থাকে। শেষে যখন তাকে বলা হয়, ওঠ এবং যেখান থেকে এসেছিলে সেখানে ফিরে যাও। তখন সে ফিরে আসে এবং নির্ধারিত উদয়স্থল হয়েই সে উদিত হয়। এমনিভাবে চলতে থাকবে; মানুষ তার থেকে অস্বাভাবিক কিছু হতে দেখবে না। শেষে একদিন সূর্য যথার্রীতি আরশের নিচে তার নিদৃষ্টস্থলে যাবে। তাকে বলা হবে, ওঠ এবং অস্তাচল থেকে উদিত হও। অনন্তর সেদিন সূর্য পশ্চিম গগনে উদিত হবে।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ কোন দিন সে অবস্থা হবে তোমরা জানো? সে দিন ঐ ব্যাক্তির ঈমান কোন কাজে আসবে না, যে ব্যাক্তি পুর্বে ঈমান আনে নাই কিংবা যে ব্যাক্তি ঈমানের মাধ্যমে কল্যাণ অর্জন করে নাই।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)

হাদিসটি কেন ভুল?

আমরা সূর্যকে প্রতিদিন পূর্ব দিক থেকে ধীরে ধীরে পশ্চিম দিকে যেতে দেখি। প্রতিদিন পূর্ব থেকে পশ্চিমে সূর্য কোথায় যায় বা রাতের বেলা সূর্য কোথায় থাকে সেই প্রশ্নের উত্তরই আলোচ্য হাদিসটি দিচ্ছে। হাদিসটি বলছে, সূর্য প্রতিদিন চলতে চলতে তার গন্তব্যে যায় যেখানে গিয়ে সে সিজদাহ্য়ে পড়ে যায়, তাকে যখন উঠতে এবং আবার চলতে বলা হয় তখন সে আবার চলতে থাকে।

আমরা সবাই জানি, সূর্যকে প্রতিদিন পূর্ব দিক থেকে ধীরে ধীরে পশ্চিম দিকে যেতে দেখা গেলেও সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘোরে না, বরং সূর্য সৌরজগতের কেন্দ্রে স্থির থাকে এবং পৃথিবীর আহ্নিকগতির কারণেই সূর্য পূর্ব থেকে ধীরে ধীরে পশ্চিমে যায় বলে মনে হয়। তারপরও আমরা বলি, সূর্য পূর্ব দিক থেকে উঠে এবং পশ্চিম দিকে অস্ত যায়। আমরা যখন বলি, ‘সূর্য উঠেছে’ বা ‘সূর্য ডুবেছে’ বা ‘সূর্য পূর্ব থেকে পশ্চিমে যায়’ তখন আমরা এটা নির্দেশ করি না যে, সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘুরছে। সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘোরে না জেনেও আমরা বলি, ‘সূর্য পূর্ব দিক থেকে উঠে এবং পশ্চিম দিকে অস্ত যায়’, কারণ পৃথিবীর আহ্নিকগতির কারণে পৃথিবীর সাপেক্ষে সূর্য পূর্ব দিক থেকে উঠে এবং পশ্চিম দিকে অস্ত যায় বলে মনে হয়। সেইজন্য কি আমরা এটা ধরে নিতে পারি যে, আলোচ্য হাদিসটিতে এটা বোঝানো হয়নি যে, সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘোরে, বরং এটা বোঝানো হয়েছে যে, পৃথিবীর আহ্নিকগতির কারণে পৃথিবীর সাপেক্ষে সূর্যকে গতিশীল বলে মনে হয়? তাহলে আমাদের এটাও ধরে নিতে হবে যে, আলোচ্য হাদিসটিতে ‘সূর্যের চলতে চলতে নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছে সিজদাহ্য়ে পড়ে যাওয়া’ এবং আল্লাহর হুকুম পেয়ে ‘সিজদাহ্ থেকে উঠে আবার চলতে থাকা’ বলতে ‘পৃথিবীর আহ্নিকগতির কারণে সূর্য নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছে সিজদাহ্য়ে পড়ে যায় এবং আল্লাহর হুকুম পেলে আবার চলতে থাকে বলে মনে হয়’ বুঝানো হয়েছে। আর এমনটা আমরা কোনোভাবেই ধরে নিতে পারি না। কারণ, পৃথিবীর আহ্নিকগতির কারণে সূর্য উঠে, সূর্য ডুবে, পূর্ব থেকে পশ্চিমে যায় বলে মনে হলেও সূর্য নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছে সিজদাহ্য়ে পড়ে যায় এবং আল্লাহর হুকুম পেলে আবার চলতে থাকে বলে কোনোভাবেই মনে হয় না। আলোচ্য হাদিস অনুযায়ী, সূর্য সিজদাহ্য়ে পড়ে যায়, সূর্যকে আল্লাহ্ হুকুম দেয়, পৃথিবী সিজদাহ্য়ে পড়ে না, পৃথিবীকে আল্লাহ্ কোনো হুকুম দেয় না।

অতএব, এটা পরিষ্কার যে আলোচ্য হাদিস অনুযায়ী, সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘোরে।

ইসলামিস্টদের ব্যাখ্যা

ইসলামিস্টরা এই হাদিসকে বৈজ্ঞানিকভাবে নির্ভুল প্রমাণ করার উদ্দেশ্যে বলেনঃ আল্লাহর আরশ সবকিছুর ঊর্ধ্বে, সবকিছুই আল্লাহর আরশের নিচে। অর্থ্যাৎ, সূর্য সবসময়ই আল্লাহর আরশের নিচে থাকে, আল্লাহর আরশের নিচে থেকেই সে প্রতিনিয়ত তার নির্দিষ্ট কক্ষপথে চলতে থাকে। সূর্যকে আল্লাহর উদ্দেশ্যে সিজদাহ্ করার জন্য কোথাও থামতে হয় না, সূর্য তার নির্দিষ্ট কক্ষপথে চলতে চলতেই আল্লাহর উদ্দেশ্যে সিজদাহ্ করে এবং আল্লাহ্ সিজদাহ্ থেকে উঠতে বলে। এভাবে সূর্য প্রতিনিয়তই তার নির্দিষ্ট কক্ষপথে চলতে চলতে আল্লাহর উদ্দেশ্যে সিজদাহ্ করতে থাকে।

জবাব

হাদিসটি নির্ভুল প্রমাণ করতে এই ব্যাখাটিই আমি ইসলামিস্টদের সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করতে দেখেছি। দুঃখজনকভাবে, ব্যাখাটি কোনো সমাধান দিতে পারে না। কেন? কারণসমূহ নিচে তুলে ধরছিঃ

১) এটা আমাদের অস্বীকার করার কোনো প্রয়োজন নেই যে, ইসলাম অনুযায়ী আল্লাহর আরশ সবকিছুর ঊর্ধ্বে, সূর্য আল্লাহর আরশের নিচেই তার কক্ষপথে চলে। আমি কখনোই এমনটি দাবি করিনি আর এখনো করছি না যে, আলোচ্য হাদিস অনুযায়ী, সূর্য দিনের বেলা আল্লাহর আরশের উপর দিয়ে চলে এবং সন্ধ্যার সময় আল্লাহর আরশের নিচে চলে যায়। এখানে মজার বিষয় হলো, আল্লাহর আরশ সবকিছুর ঊর্ধ্বে হওয়াটা হাদিসটিকে নির্ভুল প্রমাণ করতে একটুও সাহায্য করতে পারে না।

২) আমরা সবাই জানি, সূর্যও পৃথিবীর মতো গতিশীল, সূর্যও একটি কক্ষপথ ধরে প্রতিনিয়ত চলছে। সূর্য মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির কেন্দ্রের চতুর্দিকে একটি কক্ষপথ ধরে অবিরাম চলছে। এখন কথা হলো, আলোচ্য হাদিসটি কি সূর্যের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির কেন্দ্রের চতুর্দিকে গতিশীল থাকার কথা প্রকাশ করছে? অবশ্যই না। হাদিসটিতে আমরা দেখতে পাই, একজন ব্যক্তি অন্যদের উদ্দেশ্যে জিজ্ঞেস করছেন যে, “তোমরা কি জানো, এই সূর্য কোথায় যায়?” সূর্যের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির কেন্দ্রের চতুর্দিকে গতিশীল থাকার কারণে কি সূর্যকে পৃথিবী থেকে কোথাও যেতে দেখা যায়? অবশ্যই না। হাদিসটি সূর্যের উদয়স্থল হয়ে উদয় হওয়ার কথা বলছে। সূর্যের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির কেন্দ্রের চতুর্দিকে গতিশীল থাকার কারণে কি সূর্যকে প্রতিদিন পূর্ব দিক থেকে উদয় হতে দেখা যায়? অবশ্যই না। আপনি ভালো করেই জানেন, পৃথিবীর আহ্নিকগতির কারণেই সূর্য প্রতিদিন পূর্ব দিক থেকে উদয় হয় বলে মনে হয়, পূর্ব থেকে পশ্চিমে কোথাও যায় বলে মনে হয়। সূর্যের তার কক্ষপথ ধরে চলতে থাকার কথাটি এখানে আসবে কেন?


আরও পড়ুন

View Comments (12)

  • পর্যটন কেন্দ্র কুয়াকাটা গেলে সূর্য উদয় এবং অস্ত দেখা যায় এটাকে কিভাবে ব্যাখ্যা দিবেন।

    • বোকার মতো প্রশ্ন করেন কেন?
      পর্যটন কেন্দ্র কুয়াকাটাকি পৃথিবীর বাইরের কোন স্থান নাকি? যেহেতু এটা পৃথিবীতে অবস্থিত সুতরাং এখান থেকে এমন দেখা যাওয়াটাই স্বাভাবিক ব্যাপা।

  • Patients, knowledge & impartial mind can take us to the truth. Blame game, it's so pathetic everytime we lose our wisdom when we see that something going against us. I am a pious Muslim but I dare to say we "Muslims" should be more practical. On the other hand, other Religions & Beliefs are also needed to study & research by the same way what my non Muslim brothers ask from us.

  • ভাই, এই হাদিসে ''চলতে থাকে'' এই কথাটির মাধ্যমেই প্রমাণিত হয় যে সূর্য নিজ কক্ষে সর্বদা ঘুরতে থাকে।
    আর আরশের নিচে সাজদাবনতো হওয়ার বিষয়টি আজকে হাস্যকর মনে হলেও ভবিষ্যতে এটা প্রমাণিত হয়ে যাবে। কারণ মহাবিশ্ব সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান এখনো ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর।

    • যেদিন প্রমান হবে সেদিন এসে এই প্রলাপ বকিয়েন । এখন এসব বলে লাভ নেই। বিজ্ঞান সম্পর্কে যে কোন জ্ঞান আপনার নেই সেই প্রমানটাই দিলেন।

  • নাস্তিকরা বলে ,বাংলাদেশে যখন রাত আমেরিকায় তখন দিন ঐ সূর্যটা কোথা থেকে আসলো?
    ওরা কত বোকা! আমেরিকা তো আল্লাহর আরশের নিচেই, সূর্য ওখানে তাপ ও আলো বিকিরণ করতে করতে আল্লাহকে সেজদা করতে থাকে।
    কেউ যদি আল্লাহর আরশের খোঁজ করেন তো আমেরিকায় গিয়ে খুঁজে দেখতে পারেন।।

  • শুধু বিজ্ঞান জানলেই হবে এমন না। বরং আরবী ভাষা ও তাফসীরের দিকে লক্ষ করলে হাদীস শরীফটি ভুল না সঠিক তা সঠিকভাবে বুঝতে পারা যাবে। নয়তো আপনার এই সামান্য প্রলাপ, আল্লাহর কালাম ও হাদীসের কথা মিথ্যা প্রমাণ করতে পারে না।

  • সূর্যের নিজ কক্ষপথ একবার অতিক্রম করতে 23 কোটি বছর লাগে।
    সে হিসাবে সূর্য 23 কোটি বছর পর পর উদিত হয়।????????

  • যার বিজ্ঞানের জ্ঞান নাই তার ধর্ম নিয়া অন্ধের মতো তর্ক করা মূর্খতার পরিচয়! ????

Leave a Comment