সৃজনশীলতার জন্য দরকার মুক্তচিন্তা বা উন্মুক্ততা

Print Friendly, PDF & Email

ভূমিকা

২০১৬ সালের ইন্ডিয়া টুডে এর একটি সংবাদ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, অ্যাপলের কো-ফাউন্ডার স্টিভ ওজনিয়াক বলছেন “ভারতীয়রা কঠিন পড়াশোনা করে এবং এমবিএ পায়, মার্সিডিজ কিনতে পারে, কিন্তু তাদের মধ্যে সৃজনশীলতার অভাব রয়েছে”। প্রতিবেদনটির প্রথম অনুচ্ছেদটির অনুবাদ করলে দাঁড়ায়, “ভারতীয়রা সৃজনশীল হতে পারে না। ভারতেও অনেক মানুষ এই সন্দেহ করেছে। এখন এটা অ্যাপলের আরেক স্টিভ, স্টিভ ওজনিয়াকেরও মতামত। ওজনিয়াক ওরফে ওজ, যিনি অ্যাপলের প্রথম কম্পিউটার অ্যাপল ১ এর পেছনে ছিলেন এবং স্টিভ জবসের সাথে কোম্পানির সহ-প্রতিষ্ঠাতা, তিনি বলেন যে ভারতীয় শিক্ষা ব্যবস্থা অধ্যয়নশীলতা-ভিত্তিক ( based around studiousness), কিন্তু তা সৃজনশীলতাকে উৎসাহিত করে না।”(১)

মুক্তচিন্তা 2
সৃজনশীল চিন্তা, বুদ্ধিমত্তা ও অভিজ্ঞতায় উন্মুক্ততার সম্পর্ক

সোশ্যাল-পারসোনালিটি অ্যাপ্রোচ

যাই হোক, সৃজনশীলতার এই অভাবের বিষয়টি কেবল ভারতের ক্ষেত্রে সত্য নয়, দক্ষিণ এশিয়ার সকল রাষ্ট্রের ক্ষেত্রেই সত্য, হয়তো সকল অনুন্নত ও উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের ক্ষেত্রেই সত্য। কেন ইন্ডিয়া সহ দক্ষিণ এশিয়ার লোকেদেরকে কম সৃজনশীল বলা হচ্ছে সেই বিষয়ে সৃজনশীলতার সোশ্যাল-পারসোনালিটি অ্যাপ্রোচ কিছু অন্তর্দৃষ্টি দান করতে পারে। কিন্তু এই আলোচনায় যাবার আগে প্রথমেই আমাদেরকে জেনে নিতে হবে বিগ ফাইভ পারসোনালিটি ট্রেইট বা বৃহৎ পাঁচ ব্যক্তিত্ব বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে। এটি পারসোনালিটি সম্পর্কিত একটি মনোবৈজ্ঞানিক তত্ত্ব, যা অনুসারে মানুষের পারসোনালিটি বা ব্যক্তিত্বের ক্ষেত্রে ফ্যাক্টর মোট ৫টি।(২) এরা হচ্ছে –

১। অভিজ্ঞতায় উন্মুক্ততা বা উন্মুক্ততা (openness to experience) (উদ্ভাবক / কৌতূহলী বনাম ধারাবাহিক / সতর্ক )
২। বিবেকবোধ (conscientiousness) (কার্যকরী / সংগঠিত বনাম অমিতব্যায়ী /অযত্নশীল )
৩। বহির্মুখিতা (extraversion) (বহির্গামী /কর্মশক্তিপূর্ণ বনাম একাকী / সংরক্ষিত )
৪। সম্মতিযোগ্যতা (agreeableness) (বন্ধুত্বপূর্ণ /দয়াশীল বনাম চ্যালেঞ্জিং / অনুভূতিহীন)
৫। স্নায়ুবিকতা (neuroticism) (সংবেদনশীল / উদ্বিগ্ন বনাম স্থিতিশীল/আত্মবিশ্বাসী )

এই পরিভাষাগুলো আমারই তৈরি। এগুলো নিয়ে একটু আলোচনা করা যাক। উন্মুক্ততার মধ্যে রয়েছে ছয়টি ফ্যাসেট বা মাত্রা আছে। ফ্যাসেট বলতে বোঝায় একটি ট্রেইটের মধ্যকার বিভিন্ন একক বৈশিষ্ট্যকে যেগুলো একে অপরের সাথে সম্পর্কিত। এই ছয়টি হচ্ছে – সক্রিয় কল্পনা (active imagination বা ফ্যান্টাসি), নান্দনিক সংবেদনশীলতা (aesthetic sensitivity), অভ্যন্তরীণ অনুভূতির প্রতি মনোযোগ (ttentiveness to inner feelings,) বৈচিত্র্যের জন্য অগ্রাধিকার, (reference for variety )এবং বৌদ্ধিক অনুসন্ধিৎসা (intellectual curiosity)। (৩) মানে বুঝতেই পারছেন, উন্মুক্ততা আসলে মুক্তচিন্তাকেই নির্দেশ করে, অধিক পরিমাণে উন্মুক্ততা থাকে যাদের, তাদেরকেই আসলে মুক্তমনা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। বিবেকবোধ (conscientiousness) হচ্ছে যত্নশীল বা অধ্যবসায়ী হবার ব্যক্তিত্ব বৈশিষ্ট্য। বিবেকবোধ কাউকে একটি কাজ ভাল করে সম্পাদন করার ইচ্ছা এবং কাজ করার বাধ্যবাধকতাকে আন্তরিকভাবে নেবার আগ্রহ তৈরি করে। বিবেকবোধসম্পন্ন ব্যক্তিদের মধ্যে যত্নহীন এবং বিশৃঙ্খল হবার বিপরীতে দক্ষ এবং সংগঠিত হওয়ার প্রবণতা থাকে।(৪) সম্মতিযোগ্যতা (Agreeableness) হচ্ছে দয়া, সহানুভূতিশীলতা, সহযোগিতা, উষ্ণতা এবং বিবেচনাপূর্ণতা সংক্রান্ত ব্যক্তিত্ব বৈশিষ্ট্য। (৫) কোন ব্যক্তির মধ্যে সম্মতিযোগ্যতা কতখানি আছে তার উপর নির্ভর করবে ব্যক্তি সমাজে কতটা সহযোগিতামূলক, সহানুভূতিশীল হবে। (৬) বহির্মুখিতা বা এক্সট্রাভারশন খুব পরিচিত টার্ম। কার্ল ইয়াং এর কৃপায় আমরা সবাই মোটামুটি ইন্ট্রোভার্ট আর এক্সট্রোভার্ট মানে বুঝি। এক্সট্রোভার্ট বা বহির্মুখীরা অধিকতর প্রকাশমূলক, বহির্গামী, সক্রিয় আচরণ করে, যেখানে ইন্ট্রোভার্ট বা অন্তর্মুখীরা তুলনামূলকভাবে কম প্রকাশমূলক, একাকী আচরণ করে।(৭) স্নায়ুবিকতা বা নিউরোটিজম নিয়ে আপাতত কিছু বলার প্রয়োজন নেই।

এবারে আসল পয়েন্টে আসা যাক। কিছু গবেষক সৃজনশীলতা পরিমাপের একটি সামাজিক-ব্যক্তিত্ব দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেছেন। এই গবেষণায়, বিভিন্ন ব্যক্তিত্ব বৈশিষ্ট্য যেমন বিচারের স্বাধীনতা (independence of judgement), আত্মবিশ্বাস (self-confidence), জটিলতার প্রতি আকর্ষণ (attraction to complexity), নান্দনিক অভিমুখ (aesthetic orientation), এবং ঝুঁকি গ্রহণকে (risk-taking) ব্যক্তির সৃজনশীলতার পরিমাপ হিসেবে ব্যবহার করা হয়।(৮) গ্রেগরি ফেইস্টের একটি মেটা-বিশ্লেষণ দেখিয়েছে যে সৃজনশীল ব্যক্তিরা “নতুন অভিজ্ঞতার জন্য অধিক পরিমাণে উন্মুক্ত, কম প্রচলিত ভাবধারাবিশিষ্ট (traditional) এবং কম বিবেকবোধসম্পন্ন (conscientious); অধিক আত্মবিশ্বাসী, আত্মস্বীকারমূলক (self-accepting), চালিত (driven), উচ্চাভিলাষী, প্রভাবশালী, শত্রুভাবাপন্ন এবং উদ্বুদ্ধতামূলক (impulsive)” হন। উন্মুক্ততা (openness to experience), বিবেকবোধ (conscientiousness), আত্মগ্রহণযোগ্যতা (self-acceptance), শত্রুভাবাপন্নতা, এবং উদ্বুদ্ধতা (impulsivity) এর প্রভাব ছিল তালিকাভুক্ত বৈশিষ্ট্যসমূহের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী।(৯) ব্যক্তিত্বের বৃহৎ পাঁচ মডেলের কাঠামোর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়, এমন বৈশিষ্ট্যসমূহ এখানে পাওয়া গেছে।(১০) অভিজ্ঞতায় উন্মুক্ততাকে সৃজনশীলতার বিভিন্ন মূল্যায়নের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হিসেবে দেখানো হয়েছে।(১১) অন্যান্য বিগ ফাইভ বৈশিষ্ট্য সৃজনশীলতার বিভিন্ন ক্ষেত্রে সেভাবে প্রভাব ফেলে না। অ-শিল্পীদের তুলনায়, শিল্পীদের অভিজ্ঞতায় উন্মুক্ততা অধিক থাকে, এদিকে তাদের বিবেকবোধ কম থাকে। অন্যদিকে বিজ্ঞানীদের মধ্যে অভিজ্ঞতায় উন্মুক্ততা এবং বিবেকবোধ উভয়ই অধিক পরিমাণে থাকে, সেই সাথে অ-বিজ্ঞানীদের তুলনায় তাদের বহির্মুখিতার (extraversion) আত্মবিশ্বাস-আধিপত্যের (confidence-dominance) ফ্যাসেটটি বেশি থাকে।(৯)

আরও কিছু প্রয়োজনীয় ব্যক্তিত্ব বৈশিষ্ট্য

আমরা বুঝতে পারলাম সৃজনশীলতার সাথে উন্মুক্ততা নামে ব্যক্তিত্ব বৈশিষ্ট্যের একটি প্রত্যক্ষ সম্পর্ক রয়েছে। এবার আমরা উন্মুক্ততার রাজনৈতিক ও সামাজিক সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করব। কেন ভারত বা দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য রাষ্ট্রের লোকেদের সৃজনশীলতা কম হচ্ছে তা বোঝার জন্য এই আলোচনাটা দরকার। কিন্তু সেটার আগে আমাদেরকে আরও কয়েকটি বিষয় সম্পর্কে জানতে হবে। এগুলোও পারসোনালিটি ট্রেইট বা ব্যক্তিত্ব বৈশিষ্ট্য, কিন্তু এরা বিগ ফাইভ পারসোনালিটি ট্রেইটের মডেলের বাইরের পারসোনালিটি ট্রেইট। এদের একটি হচ্ছে জাতিকেন্দ্রিকতা (Ethnocentrism), যার দ্বারা ব্যক্তির এমন বৈশিষ্ট্যকে বোঝায় যার কারণে ব্যক্তি অন্যের সংস্কৃতি, আচার, আচরণ, বিশ্বাস এবং জনগোষ্ঠীকে বিচার করার জন্য তার নিজের সংস্কৃতিকে প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করে। যেহেতু এই বিচার প্রায়ই নেতিবাচক হয়, কেউ কেউ এই শব্দটির দ্বারা নিজ সংস্কৃতির বিষয়বস্তু (বিশেষ করে ভাষা, আচরণ, রীতিনীতি ও ধর্ম সম্পর্কিত) অন্য সংস্কৃতির বিষয়বস্তুসমূহের তুলনায় অধিকতর শ্রেষ্ঠ, সঠিক ও স্বাভাবিক – এই বিশ্বাসকে বোঝাতে ব্যবহার করে। (১২)

দক্ষিণপন্থী স্বৈরতন্ত্র (Right-wing authoritarianism বা RWA) নামে একটি পারসোনালিটি ট্রেইট আছে। দক্ষিণপন্থী স্বৈরতান্ত্রিকরা হচ্ছে সেই সব ব্যক্তি যাদের মধ্যে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠিত ও বৈধ কর্তৃত্বের প্রতি সমর্পিত করার উচ্চমাত্রার সদিচ্ছা থাকে, যারা সামাজিক রীতিনীতি এবং আদর্শ মেনে চলে, এবং যারা তাদেরকে অনুসরণ না করা লোকেদের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন ও শাস্তিমূলক আচরণ করেন। তারা বৈচিত্র‍্যের তুলনায় অভিন্নতা বা একরূপতাকে অধিক মূল্য দান করে, দলীয় কর্তৃত্বকে বেশি পছন্দ করে, এবং কোন কিছু অর্জন করতে প্রয়োজনে জোরপূর্বক আচরণকে সমর্থন করেন।(১৩) একটা বিষয় উল্লেখ্য, এই দক্ষিণপন্থী বলতে প্রচলিত অর্থে দক্ষিণপন্থীকে বোঝায় না, বরং প্রচলিত অর্থে যারা বামপন্থী, তাদের অনেকেও দক্ষিণপন্থী স্বৈরতান্ত্রিক হতে পারেন।(১৪)

সামাজিক আধিপত্য অভিমুখিতা (Social dominance orientation বা SDO)(১৫) নামে একটি পারসোনালিটি ট্রেইট আছে। এই পারসোনালিটি ট্রেইট যাদের মধ্যে বেশি থাকে তারা বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যকার সামাজিক মর্যাদার পার্থক্য এবং সেই সাথে একটি গোষ্ঠীর মধ্যকার সদস্যদের মধ্যে সামাজিক মর্যাদার পার্থক্যকে বজায় রাখতে চায় এবং অনেক ক্ষেত্রে তা বৃদ্ধি করতে চায়। সাধারণত, তারা প্রভাবশালী এবং ক্ষমতার অনুসন্ধানকারী হন। প্রায়ই, যারা এসডিও তে উচ্চ স্কোর করে তারা “উচ্চস্তরে ওঠার জন্য কাউকে ক্ষতি করা সঙ্গত”-ধরণের জগতে বিশ্বাস করে।(১৬) গবেষণায় দেখা গেছে যে স্বৈরাচারী এবং বর্ণবাদী বিশ্বাসের সাথে এসডিও এর একটি শক্তিশালী ইতিবাচক সম্পর্ক রয়েছে।(১৭)

পূর্বসংস্কার (Prejudice)-ও একটি পারসোনালিটি ট্রেইট।(১৮) এটি হচ্ছে একজন ব্যক্তির গোষ্ঠীর উপর ভিত্তি করে সেই ব্যক্তি সম্পর্কিত অনুভূতি, মানে আমি একজন বার্সেলোনা হেটার বলে বারসেলোনা ফ্যান বল্টুকে তার বারসেলোনার ফ্যান হবার জন্য একটি বজ্জাত, অনভিজ্ঞ বা অন্যান্য নেতিবাচক মূল্যায়ন করি তাহলে আমি পূর্বসংস্কারে আক্রান্ত। শব্দটি প্রায়ই একজন ব্যক্তির রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা, সেক্স, জেন্ডার, বিশ্বাস, মূল্যবোধ, সামাজিক শ্রেণী, বয়স, প্রতিবন্ধকতা (disability), ধর্ম, যৌনতা, বর্ণ, জাতি, ভাষা, জাতীয়তা, সৌন্দর্য, পেশা, শিক্ষা, অপরাধিত্ব (criminality), পছন্দের ক্রীড়া দল প্রভৃতি ব্যক্তিগত বিষয়ের উপর ভিত্তি করে তার পূর্বকল্পিত (সাধারণত প্রতিকূল) মূল্যায়নের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়।(১৯)

উন্মুক্ততার সাথে এদের সম্পর্ক

বৃহৎ পাঁচ পারসোনালিটি ট্রেইটের বাইরে এখানে আরও ৪টি পারসোনালিটি ট্রেইটের কথা বললাম। মজার কথা হল এই চারটের সাথেই অভিজ্ঞতায় উন্মুক্ততা পারসোনালিটি ট্রেইটের সম্পর্ক নেতিবাচক। মানে গবেষণা বলছে, যাদের উন্মুক্ততা বেশি হয় তাদের জাতিকেন্দ্রিকতা, দক্ষিণপন্থী স্বৈরতন্ত্র, সামাজিক আধিপত্য অভিমুখিতা,(২০) এবং পূর্বসংস্কার (২১) কম থাকে। সেই সাথে তারা হয় উদার এবং বৈচিত্র্যের প্রতি সহনশীল। (২২) (২৩) পাঁচ-ফ্যাক্টর মডেলের অন্যান্য বৈশিষ্ট্যগুলোর তুলনায় উন্মুক্ততার সাথে দক্ষিণপন্থী স্বৈরতন্ত্রের সম্পর্ক অধিক পরিমাণে শক্তিশালী, এবং তা নেতিবাচক (একটি বেশি হলে আরেকটি কম হয়)। অন্য চারটি বৈশিষ্ট্যের মধ্যে বিবেকবোধের (conscientiousness) সাথে দক্ষিণপন্থী স্বৈরতন্ত্রের ইতিবাচক সম্পর্ক রয়েছে (একটি বেশি হলে অন্যটিও বেশি হয়), বাকি তিনটি বৈশিষ্ট্যের সাথে দক্ষিণপন্থী স্বৈরতন্ত্রের সম্পর্ক নগন্য।(২৪) এখানে একটা কথা বলি, অনুন্নত বা উন্নয়নশীল দেশের মানুষের মধ্যে দক্ষিণপন্থী স্বৈরতন্ত্র বেশি, তাই তাদের শিক্ষকদের মধ্যেও সেটা বেশিই। আর শিশুদের সামাজিকীকরণে শিক্ষকদের একটা বড় প্রভাব থাকে। শিক্ষকরা এইরকম পারসোনালিটি ট্রেইট ধারণের ফলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে কর্তৃত্বের প্রতি অতিশয় শ্রদ্ধা-ভক্তি করতে শেখায়, প্রশ্ন করতে ও বিরোধিতা করতে নিরুৎসাহিত করে, এমনকি মুখে উৎসাহিত করলেও। এদের প্রভাবে শিশুদের মধ্যেও দক্ষিণপন্থী স্বৈরতন্ত্রের বিকাশ ঘটে, যা উন্মুক্ততার বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করে তার সৃজনশীলতার বিকাশকেও বাধা দেয়। সামাজিক আধিপত্য অভিমুখিতার সাথে সম্মতিযোগ্যতার (agreeableness) এর সম্পর্ক সবচেয়ে বেশি, দ্বিতীয় স্থানেই রয়েছে উন্মুক্ততা (নেতিবাচক সম্পর্ক), অন্য বৈশিষ্ট্যগুলোর সাথে সামাজিক আধিপত্য অভিমুখিতার সম্পর্ক নগন্য। পাঁচ-ফ্যাক্টর মডেল বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে উন্মুক্ততার সাথেই পূর্বসংস্কারের সম্পর্ক সবচেয়ে বেশি শক্তিশালী, এবং তা নেতিবাচক (একটি বেশি হলে আরেকটি কম হয়)। পাঁচ-ফ্যাক্টর মডেল বৈশিষ্ট্যগুলোর বাকি বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে সম্মতিযোগ্যতার সাথে পূর্বসংস্কারের মোটামুটি নেতিবাচক সম্পর্ক আছে, কিন্তু বাকিগুলোর সাথে সম্পর্ক নগন্য। তবে, দক্ষিণপন্থী স্বৈরতন্ত্র এবং সামাজিক আধিপত্য অভিমুখিতার সাথে পূর্বসংস্কারের সম্পর্ক (ইতিবাচক) উন্মুক্ততা সহ অন্যান্য পাঁচ-ফ্যাক্টর মডেল বৈশিষ্ট্যগুলোর থেকে শক্তিশালী। (২৫)

রাজনৈতিক মতাদর্শ ও উন্মুক্ততা

এবার মতাদর্শের কথায় আসি। রক্ষণশীলতাবাদ বা কনজারভেটিজম নিয়ে আপনারা সবাই জেনে থাকবেন। এই কনজারভেটিজমকে দুই ভাগে ভাগ করা যায় – একটি হচ্ছে সামাজিক বা সাংস্কৃতিক রক্ষণশীলতাবাদ (cultural conservatism ও social conservatism, দুটো এক না, কিন্তু অনেক উপরিপাতন রয়েছে দুটোর মধ্যে), আরেকটি হচ্ছে অর্থনৈতিক বা রাজস্ব রক্ষণশীলতাবাদ (economic or fiscal conservatism)। সামাজিক রক্ষণশীলতাবাদ মতবাদটি বলে, সমাজকে ঐতিহ্যগত মূল্যবোধ এবং প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বজায় রাখা প্রয়োজন,(২৬) এবং ঐতিহ্যগত মূল্যবোধ বা আচরণকে উৎসাহিত বা বলবৎ করতে সরকারের একটি ভূমিকা আছে, প্রায়ই এরা দেওয়ানি আইন বা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে ঐতিহ্যগত নৈতিকতা এবং সামাজিক রীতিনীতিকে অধিক মাত্রায় সংরক্ষণ করতে চায়। এরা এটি সামাজিক পরিবর্তনকে নিয়ে সন্দিহান থাকে,, এবং বিভিন্ন সামাজিক বিষয় যেমন পারিবারিক জীবন, যৌন সম্পর্ক এবং দেশপ্রেমের মত সামাজিক বিষয়ের পূর্বতন মর্যাদা বজায় রাখতে হবে বিশ্বাস করে।(২৭) উত্তর আমেরিকায়, বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে বিংশ শতাব্দীর শেষ থেকে, সামাজিক সমস্যা যেমন ধর্মের স্বাধীনতা, অপরাধের শাস্তির হ্রাস, বিবেকের স্বাধীনতা এবং গর্ভপাতের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় পদক্ষেপের প্রতিক্রিয়া হিসেবে সামাজিক রক্ষণশীলতাবাদের উদ্ভব ঘটে, কেননা এই বিষয়গুলোকে রক্ষণশীলতাবাদীগণ তাদের রক্ষণশীল মূল্যবোধ এবং সামাজিক শৃঙ্খলার জন্য হুমকি হিসেবে বিবেচনা করে। এদিকে অর্থনৈতিক বা রাজস্ব রক্ষণশীলতাবাদ হচ্ছে রাজস্ব নীতি এবং রাজস্ব দায়বদ্ধতা সম্পর্কে একটি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দর্শন যা সরকারী ব্যয় হ্রাস, ন্যূনতম সরকারী ঋণ, বিনিয়ন্ত্রণ (deregulation), মুক্ত বাণিজ্য, বেসরকারিকরণ এবং কর হ্রাস সমর্থন করে।(২৮) এটি আসলে ধ্রুপদী উদারনীতিবাদ (classical liberalism) এর দর্শনকেই সমর্থন করে।(২৯) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সামাজিক উদারতাবাদী বা সোশ্যাল লিবারালরা ১৯৩০ সালের দিকে তাদের পক্ষে যেসব আইন পাস করে (ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্টের “নিউ ডিল” এর আন্ডারে) তাকে এরা মেনে নিতে পারেনি, আর তখন তারা নিজেদের পরিচয়ে আর “লিবারাল” কথাটাও রাখতে চায়নি, ফলে পরিচয় চেঞ্জ করে “কনজারভেটিভ” হওয়া, এদিকে ক্লাসিকাল লিবারালদের মধ্যে যারা অধিকতর সাংস্কৃতিক উদারনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিকে সমর্থন করত তারা “লিবার্টিয়ান” বা স্বাতন্ত্র্যবাদী পরিচয় গ্রহণ করে।(৩০) এভাবে সামাজিক উদারনীতিবাদীরা সামাজিক কল্যাণ রাষ্ট্রের নীতি গ্রহণ করার পর এই ক্লাসিকাল লিবারালরা ফিসকাল কনজারভেটিভ বা লিবারটিয়ান পরিচয় গ্রহণ করেছিল।(৩১)

এবারে এই মতাদর্শের সাথে উন্মুক্ততার সম্পর্কের বেলায় আসা যাক। রক্ষণশীলতাবাদের ক্ষেত্রে, গবেষণায় দেখা গেছে যে সাংস্কৃতিক বা সামাজিক রক্ষণশীলতা নিম্ন উন্মুক্ততা এবং এর সকল ফ্যাসেটের সাথে সম্পর্কিত, কিন্তু অর্থনৈতিক রক্ষণশীলতাবাদের সাথে উন্মুক্ততার কোন সম্পর্ক নেই, উন্মুক্ততার নান্দনিকতা ও মূল্যবোধের ফ্যাসেটের সাথেই কেবল অর্থনৈতিক রক্ষণশীলতাবাদের দুর্বল ও নেতিবাচক সম্পর্ক রয়েছে। (৩২) অর্থনৈতিক রক্ষণশীলতাবাদের সাথে সবচেয়ে বেশি সম্পর্ক আছে সম্মতিযোগ্যতার (r=-.23, সম্পর্কটি নেতিবাচক, অর্থাৎ একটি বেশি হলে আরেকটি কম হয়)। অর্থনৈতিক রক্ষণশীলতাবাদ মতাদর্শের সাথে অধিক পরিমাণে সম্পর্কিত, যেখানে সাংস্কৃতিক বা সামাজিক রক্ষণশীলতাবাদ মতাদর্শের চাইতে অধিকতর মনস্তাত্ত্বিক, এবং এটির সাথে সরল, স্থিতিশীল ও পরিচিত রীতিনীতির প্রতি আকর্ষণ সম্পর্কিত। (৩২)

এই লেখার প্রথমে আমরা দেখতে পেলাম সৃজনশীলতা সম্পর্কিত উন্মুক্ততা নামক একটি পারসোনালিটি ট্রেইটের সাথে। তারপর আমরা দেখতে পেলাম এই উন্মুক্ততার বিকাশ আসলে সম্পর্কিত জাতিকেন্দ্রিকতা, দক্ষিণপন্থী স্বৈরতন্ত্র, সামাজিক আধিপত্য অভিমুখিতা, পূর্বসংস্কার, সামাজিক রক্ষণশীলতাবাদ – এসবের সাথে। যে সমাজে এই বৈশিষ্ট্যগুলো অধিক পরিমাণে থাকবে, তাদের মানুষের মধ্যে এসব বিষয় অধিক পরিমাণে প্রভাবিত করবে, তাদের উন্মুক্ততা কম হবে, আর তারফলে কম হবে সৃজনশীলতাও। সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনের মাধ্যমে এসব সামাজিক-রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্যকে পরিবর্তিত না করতে পারলে, পরিবেশের উন্নয়ন ঘটাতে না পারলে এখানকার শিশুরা সৃজনশীল হয়ে উঠবে তা আর আশা করা যায়না।

তথ্যসূত্রঃ

১। DelhiFebruary 26, Priya Pathak New; February 27, 2018UPDATED:; Ist, 2018 10:30। “Indians study hard and get MBA, may be buy Mercedes but lack creativity: Apple co-founder Steve Woz”। India Today (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৮-৩১।
২। Rothmann S, Coetzer EP (২৪ অক্টোবর ২০০৩)। “The big five personality dimensions and job performance”। SA Journal of Industrial Psychology। 29। doi:10.4102/sajip.v29i1.88 অবাধে প্রবেশযোগ্য।
৩। Costa, P. T. & McCrae, R. R. (1992). NEO personality Inventory professional manual. Odessa, FL: Psychological Assessment Resources.(পৃষ্ঠা নম্বর প্রয়োজন)
৪। Thompson, E.R. (অক্টোবর ২০০৮)। “Development and Validation of an International English Big-Five Mini-Markers”: 542–548। doi:10.1016/j.paid.2008.06.013।
৫। Thompson, E.R. (অক্টোবর ২০০৮)। “Development and Validation of an International English Big-Five Mini-Markers”: 542–548। doi:10.1016/j.paid.2008.06.013।
৬। Graziano, W.G., & Eisenberg, N. (1997). Agreeableness; A dimension of personality. In R. Hogan, S. Briggs, & J. Johnson, (1997). Handbook of Personality Psychology. San Diego, CA: Academic Press.
৭। Thompson, Edmund R. (২০০৮)। “Development and Validation of an International English Big-Five Mini-Markers”। Personality and Individual Differences। 45 (6): 542–8। doi:10.1016/j.paid.2008.06.013।
৮। Sternberg, R. J.; Lubart, T. I. (১৯৯৯)। “The Concept of Creativity: Prospects and Paradigms”। Sternberg, R. J.। Handbook of Creativity। Cambridge University Press। আইএসবিএন 978-0-521-57285-9।
৯। Feist, G. J. (১৯৯৮)। “A meta-analysis of the impact of personality on scientific and artistic creativity”। Personality and Social Psychology Review। 2 (4): 290–309। doi:10.1207/s15327957pspr0204_5। PMID 15647135। অজানা প্যারামিটার |s2cid= উপেক্ষা করা হয়েছে (সাহায্য)
১০। Batey, M.; Furnham, A. (২০০৬)। “Creativity, intelligence and personality: A critical review of the scattered literature”। Genetic, Social, and General Psychology Monographs। 132 (4): 355–429। doi:10.3200/mono.132.4.355-430। PMID 18341234। অজানা প্যারামিটার |s2cid= উপেক্ষা করা হয়েছে (সাহায্য)
১১। Batey, M.; Furnham, A. F.; Safiullina, X. (২০১০)। “Intelligence, General Knowledge and Personality as Predictors of Creativity”। Learning and Individual Differences। 20 (5): 532–535। doi:10.1016/j.lindif.2010.04.008।
১২। McCornack, Steven; Ortiz, Joseph (২০১৭)। Choices and Connections: An Introduction to Communication। Bedford/St.Martin’s। পৃষ্ঠা 109। আইএসবিএন 978-1-319-20116-6। ওসিএলসি 1102471079।
১৩। Stenner, Karen (২০০৯)। “Three Kinds of “Conservatism” (PDF): 142–159। doi:10.1080/10478400903028615। ২০১৩-০৫-১২ তারিখে মূল (PDF) থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২ জুন ২০১২।
১৪। Altemeyer, Bob (২০০৬)। The Authoritarians। পৃষ্ঠা 9–10।
১৫। Sidanius, Jim; Pratto, Felicia (২০০১)। Social Dominance: An Intergroup Theory of Social Hierarchy and Oppression। Cambridge University Press। আইএসবিএন 978-0-521-80540-7।
১৬। Levin, S.; Federico, C. M. (২০০২)। “Social Dominance Orientation and Intergroup Bias: The Legitimation of Favoritism for High-Status Groups”: 144–57। doi:10.1177/0146167202282002।
১৭। Duriez, Bart; Van Hiel, Alain (২০০২)। “The march of modern fascism. A comparison of social dominance orientation and authoritarianism” (PDF): 1199–1213। CiteSeerX 10.1.1.1005.399 অবাধে প্রবেশযোগ্য। doi:10.1016/s0191-8869(01)00086-1। ২০১৫-০২-০৩ তারিখে মূল (PDF) থেকে আর্কাইভ করা।
১৮। Wedgwood, Hensleigh (১৮৫৫)। “English Etymologies”: 113–116।
Dovidio, J. F., & Gaertner. S. L. (2010). “Intergroup bias”. In S. T. Fiske, D. T. Gilbert, & G. Lindzey (Eds.), The Handbook of Social Psychology (5th ed., Vol. 2). New York: Wiley.
২০। Butler, J. C. (২০০০)। “Personality and emotional correlates of right-wing authoritarianism”: 1–14। doi:10.2224/sbp.2000.28.1.1।
২১। Sibley, Chris G.; Duckitt, John (২০০০)। “Personality and prejudice: a meta-analysis and theoretical review”: 248–279। doi:10.1177/1088868308319226। PMID 18641385।
২২। McCrae R. R. (১৯৯৬)। “Social consequences of experiential openness”: 323–337। doi:10.1037/0033-2909.120.3.323। PMID 8900080।
২৩। Jost John T (২০০৬)। “The end of the end of ideology”: 651–670। doi:10.1037/0003-066X.61.7.651। PMID 17032067।
২৪। Sibley, Chris G.; Duckitt, John (২০০০)। “Personality and prejudice: a meta-analysis and theoretical review”: 248–279। doi:10.1177/1088868308319226। PMID 18641385।
২৫। Sibley, Chris G.; Duckitt, John (২০০০)। “Personality and prejudice: a meta-analysis and theoretical review”: 248–279। doi:10.1177/1088868308319226। PMID 18641385।
২৬। Hall, Peter A.; Lamont, Michèle (২২ এপ্রিল ২০১৩)। Social Resilience in the Neoliberal Era (ইংরেজি ভাষায়)। Cambridge University Press। পৃষ্ঠা 166। আইএসবিএন 9781107034976।
২৭। Smith, Robert B. (২০১৪)। Social Conservatism, Distractors, and Authoritarianism: Axiological versus instrumental rationality। Mediations of Social Life in the 21st Century (ইংরেজি ভাষায়)। Emerald Group Publishing। পৃষ্ঠা 101। আইএসবিএন 9781784412227।
২৮। The Oxford companion to American politics। Coates, David, 1946-। New York: Oxford University Press। ২০১২। পৃষ্ঠা 392। আইএসবিএন 978-0-19-976431-0। ওসিএলসি 758244331।
২৯। Johnston, Larry, 1955-। Politics : an introduction to the modern democratic state (Fourth edition সংস্করণ)। North York, Ontario, Canada। পৃষ্ঠা 210। আইএসবিএন 978-1-4426-0533-6। ওসিএলসি 808924360।
৩০। Grigsby, Ellen. (২০০৫)। Analyzing politics : an introduction to political science (3rd ed সংস্করণ)। Belmont, CA: Thomson Wadsworth। পৃষ্ঠা 99। আইএসবিএন 0-534-63077-4। ওসিএলসি 70130912।
৩১। Grigsby, Ellen. (২০০৫)। Analyzing politics : an introduction to political science (3rd ed সংস্করণ)। Belmont, CA: Thomson Wadsworth। পৃষ্ঠা 100। আইএসবিএন 0-534-63077-4। ওসিএলসি 70130912।
৩২। Robert McCrae; Angelina R. Sutin (২০০৯)। “Chapter 17. Openness to Experience”। Handbook of Individual Differences in Social Behavior। The Guildford Press। পৃষ্ঠা 257–273। আইএসবিএন 978-1-59385-647-2।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *