সূচিপত্র
ভূমিকা
মুসলিমদের মধ্যে একটি অত্যন্ত বহুল প্রচলিত দাবী হচ্ছে, তাদের নবী ছিলেন একজন নিরক্ষর মানুষ। মূলত কোরআন যে একটি অলৌকিক গ্রন্থ, সেই দাবীর পক্ষে প্রমাণ হিসেবেই এই দাবীটি উত্থাপিত হয়। মানে হচ্ছে, মুহাম্মদকে নিরক্ষর এবং নিতান্তই অশিক্ষিত মূর্খ প্রমাণ করা গেলে এটি প্রমাণ করা সহজ হয় যে, কোরআনের মত একটি গ্রন্থ তার পক্ষে কিছুতেই লেখা সম্ভব নয়। অর্থাৎ, এর দ্বারা তারা কোরআনকে একটি অলৌকিক গ্রন্থ বলে প্রমাণ করার চেষ্টা করেন। এই দাবীটি তারা প্রতিষ্ঠা করতে পারলে, এই দাবীটিকে পরে তারা কোরআনের অলৌকিকত্ব প্রমাণের প্রমাণ হিসেবে উল্লেখ করে।
অথচ, ইতিহাসে এরকম মানুষের সংখ্যা খুব কম নয়, যারা নিরক্ষর ছিলেন, এবং অসংখ্য কথা মুখে মুখে বলে গেছেন। সেগুলো পরবর্তীতে গ্রন্থাকারে সংরক্ষিত হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে সহজেই বলা যায়, মহাকবি হোমারের নাম। ধ্রুপদি কিংবদন্তি অনুযায়ী, হোমার ছিলেন এক প্রাচীন গ্রিক মহাকাব্যিক কবি। জনশ্রুতি থেকে জানা যায়, তিনি ছিলেন অন্ধ। তিনি ইলিয়াড ও ওডিসি মহাকাব্য এবং হোমারীয় স্তোত্রাবলির রচয়িতা। হোমারের মহাকাব্যগুলো থেকেই পাশ্চাত্য সাহিত্যধারাটির সূচনা হয়েছিল। কথাসাহিত্য ও সাহিত্যের সাধারণ ইতিহাসে এই দুই মহাকাব্যের প্রভাব অপরিসীম।
হেরোডোটাসের মতে, হোমার হেরোডোটাসের জন্মের চারশো বছর আগে অর্থাৎ ৮৫০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ নাগাদ জীবিত ছিলেন।কিন্তু অন্যান্য প্রাচীন সূত্রে তাঁকে ট্রয় যুদ্ধের অনেক নিকটবর্তী সময়ের (১১৯৪-১১৮৪ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ) মানুষ মনে করা হয়। তাঁর কবিতাগুলো বহু শতাব্দী ধরে মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছিল, পরবর্তীতে তা মহাকাব্য হিসেবে অমর হয়ে যায়।
আমাদের দেশের লালন ফকির কিংবা আরজ আলী মাতুব্বরও ছিলেন প্রথাগত শিক্ষায় অনেক পিছিয়ে। এরপরে কাজী নজরুল ইসলাম থেকে শুরু করে আরো অনেকেই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় খুব বেশি শিক্ষিত ছিলেন না। ইতিহাসে এরকম অসংখ্য মানুষই খুঁজে পাওয়া যায়, যারা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত নন, কিন্তু তাদের নিজস্ব ভাষায় কাব্য রচনা করে গেছেন। আমরা এরকম অনেক বাউল গায়ক, সাধক কিংবা লোককবি পাই যারা শিক্ষিত না হলেও অসংখ্য কবিতা বা গান রচনা করে গেছেন।
সেইসাথে, এমন তো নয় যে, সেই সময়ে আরবে সব লোক খুব উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত ছিল! মুসলিমদের দাবী শুনলে মনে হয়, ১৪০০ বছর আগে মক্কায় সব মানুষ পিএইচডি ধারী এবং ইউনিভার্সিটি পড়া শিক্ষিত ছিলেন, শুধুমাত্র নবী মুহাম্মদ একলাই নিরক্ষর ছিলেন! প্রাচীন আমলে তো সেরকম স্কুল কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় আরব অঞ্চলে থাকার কথা না। শুধু আরবেই কেন, গোটা পৃথিবীতেই থাকার কথা না। আজকের দিনেই বাঙলাদেশের অধিকাংশ মানুষ যেখানে নিরক্ষর, সেখানে মুহাম্মদের আমলে মক্কার আশেপাশে কে-ই বা এতো শিক্ষিত ছিল!
পড়ো, তোমার প্রভুর নামে
হযরত মুহাম্মদের কাছে সেই কথিত ওহী আসার সুচনা হয়েছিল স্বপ্নের মাধ্যমে। হেরা পর্বতের গুহায় মুহাম্মদ যখন যেতেন, সেখানে ফেরেশতার আগমন ঘটে বলে মুহাম্মদ বলেছিলেন। সেই ফেরেশতা একদিন হুট করে এসে মুহাম্মদকে কিছু পড়তে বলে। প্রশ্ন হচ্ছে, আল্লাহ পাক যদি ফেরেশতা জিব্রাইলকে পাঠিয়েই থাকেন, আল্লাহ এবং ফেরেশতা জিব্রাইলের তো জানার কথা যে, মুহাম্মদ পড়তে জানেন না। আল্লাহ পাক এবং তার ফেরেশতা সেই শুরুতেই এমন ভুল কীভাবে করেন যে, একজন নিরক্ষর লোককে তারা পড়তে বলবেন!
সেইসাথে, মুহাম্মদ যখন বললেন সে পড়তে জানে না, তখন তো তাকে পড়তে শেখানো প্রয়োজন ছিল। বুকে জড়িয়ে ধরে চাপাচাপি করাতে কোন নিরক্ষর লোক পড়তে শিখে যায়, এরকম কখনো শুনি নি। এরকম হলে, স্কুল কলেজে তো এই পদ্ধতিতে পড়তে শেখানো যায়। যারাই স্কুলে পড়তে আসবেন, শিক্ষকগণ তাদের ধরে ধরে বুকে তিনবার চাপ দিলেই কেল্লাফতে! এগুলো কী কোন কাজের কথা! জিব্রাইলের উচিৎ ছিল মুহাম্মদকে কিছুটা পড়তে শেখানো। আরবি ভাষার আদর্শলিপি নিয়ে ধরে ধরে শেখানো। তা না করে বুকে জড়িয়ে চাপাচাপি করলে তাতে আসলে পড়া শেখা সম্ভব বলে মনে হয় না।
এই বিষয়টি জানা যায় সহিহ বুখারীতে বর্ণিত আয়শার হাদিসের মাধ্যমে [1] [2] –
সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)
৯১/ স্বপ্নের ব্যাখ্যা করা
পরিচ্ছেদঃ ৯১/১. রসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর ওয়াহীর শুরু হয় ভালো স্বপ্নের মাধ্যমে।
৬৯৮২. ’আয়িশাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ওয়াহীর শুরু হয় ঘুমের ঘোরে ভালো স্বপ্নের মাধ্যমে। তিনি যে স্বপ্নই দেখতেন তা ভোরের আলোর মত উদ্ভাসিত হতো। তিনি হেরা গুহায় গিয়ে সেখানে বেশ কয়েক রাত ’ইবাদাতে কাটিয়ে দিতেন এবং এজন্য খাদ্য দ্রব্যও সঙ্গে নিয়ে যেতেন। এরপর খাদীজাহ (রাঃ)-এর কাছে ফিরে আসতেন এবং তিনি তাকে এরূপ খাদ্য দ্রব্য তৈরি করে দিতেন। শেষে তাঁর কাছে সত্যের বাণী (ওয়াহী) আসল। আর এ সময় তিনি হেরা গুহায় ছিলেন।
সেখানে ফেরেশতা এসে তাঁকে বলল, আপনি পড়ুন, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আমি বললামঃ আমি তো পাঠক নই। তখন তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরে শক্ত করে চেপে ধরলেন। এমনকি এতে আমার খুব কষ্ট হল। তারপর তিনি আমাকে ছেড়ে দিলেন এবং বললেন, আপনি পড়ুন। আমি বললাম, আমি পাঠক নই। তিনি দ্বিতীয়বার আমাকে শক্ত করে চেপে ধরলেন। এবারেও এতে আমার খুব কষ্ট হল। অতঃপর তিনি আমাকে ছেড়ে দিয়ে বললেন, আপনি পড়ুন। আমি বললাম, আমি তো পাঠক নই। এরপর তিনি তৃতীয়বার আমাকে শক্ত করে এমন চেপে ধরলেন যে, এবারেও এতে আমার খুব কষ্ট হল। তারপর তিনি আমাকে ছেড়ে দিয়ে বললেন, পাঠ করুন, আপনার প্রতিপালকের নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন……যা সে জানত না (সূরাহ আল-আলাক ৯৬/১-৫) এ আয়াত পর্যন্ত।
…
(আধুনিক প্রকাশনী- ৬৪৯৮, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৬৫১১)
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
বর্ণনাকারীঃ আয়িশা বিনত আবূ বাকর সিদ্দীক (রাঃ)
কোরআনের বিবরণ
মুহাম্মদ পড়ে নিয়েছে?
আল্লাহ পাক কোরআনে উল্লেখ করেছেন, মুহাম্মদের পড়ে নেয়ার কথা। এই কথাটি আল্লাহ বলেছেন কাফেরদের এইটি জবাব দেয়ার জন্য, যেন কাফেররা মনে না করে যে, মুহাম্মদ এগুলো আগেই পড়ে নিয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, আরবের পৌত্তলিক কাফেরদের তো জানা থাকার কথা যে, মুহাম্মদ নিরক্ষর। তাহলে, তারা কেন মনে করবে, মুহাম্মদ আগেই কিছু একটা পড়ে নিয়েছে [3]?
এমনি ভাবে আমি নিদর্শনাবলী ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বর্ণনা করি যাতে তারা না বলে যে, আপনি (মুহাম্মদ) তো পড়ে নিয়েছেন এবং যাতে আমি একে সুধীবৃন্দের জন্যে খুব পরিব্যক্ত করে দেই।
কোরআন, সূরা আন আম, আয়াত ১০৫
মুহাম্মদ লিখে রেখেছে?
মুহাম্মদ সম্পর্কে কাফেরদের অভিযোগ ছিল, মুহাম্মদ পুরাকালের রূপকথাগুলো লিখে রেখেছে। এই কথাটি আবার কোরআনেও চলে এসেছে, কাফেরদের অভিযোগের বিবরণ হিসেবে। ধরে নিচ্ছি, কাফেরদের অভিযোগ মিথ্যা। কিন্তু মক্কার কাফেরদের তো জানার কথা যে, মুহাম্মদ পড়তে বা লিখতে জানেন না। তাহলে তারা কেন মুহাম্মদের ওপর এই অভিযোগ আরোপ করবে যে, মুহাম্মদ পুরাকালের রূপকথাগুলো লিখে রেখেছে? তাদের তো বলা উচিৎ ছিল, মুহাম্মদ পুরাকালের রূপকথাগুলো মুখস্ত করে রেখেছে [4]!
তারা বলে, এগুলো তো পুরাকালের রূপকথা, যা তিনি (মুহাম্মদ) লিখে রেখেছেন। এগুলো সকাল-সন্ধ্যায় তাঁর কাছে শেখানো হয়।
কোরআন, সূরা ফুরকান আয়াত ৫
কানসর্বস্ব নবী
এই বিষয়ে আলোচনার শুরুতেই, কোরআনের একটি আয়াত আমাদের খুব মনোযোগ দিয়ে পড়া প্রয়োজন। আয়াতটিতে বলা হচ্ছে, মক্কার লোকেরা নবী মুহাম্মদকে কান সর্বস্ব লোক বলে ঠাট্টাতামাশা করতো। আচ্ছা, সবকিছু বাদ দিয়ে কান সর্বস্ব লোক বলবার কারণ কী? এমন কী কারণ থাকতে পারে, যার কারণে চোখ নাক মুখ বাদ দিয়ে তাকে কান সর্বস্ব লোক বলে ডাকা হতো [5]?
আর তাদের মধ্যে কেউ কেউ নবীকে ক্লেশ দেয়, এবং বলে, এ লোকটি (মুহাম্মদ) তো কানসর্বস্ব। আপনি বলে দিন, কান হলেও তোমাদেরই মঙ্গলের জন্য, আল্লাহর উপর বিশ্বাস রাখে এবং বিশ্বাস রাখে মুসলমানদের কথার উপর। বস্তুতঃ তোমাদের মধ্যে যারা ঈমানদার তাদের জন্য তিনি রহমতবিশেষ। আর যারা আল্লাহর রসূলের প্রতি কুৎসা রটনা করে, তাদের জন্য রয়েছে বেদনাদায়ক আযাব।
কোরআন, সূরা তওবা আয়াত ৬১
ইসলামে বিশ্বাসীগণ নানাভাবে এই আয়াতটির ব্যাখ্যা এভাবে দেয়ার চেষ্টা করেন যে, এইখানে কান বলতে বোঝানো হয়েছে, নবী মুহাম্মদ নিজের কানে না শুনলে কোন কান কথাতে বিশ্বাস করতেন না। কিন্তু সেটি সত্য হিসবে ধরে নিলেও, মুহাম্মদকে যে কান সর্বস্ব মানুষ বলা হতো, কাফেররা মুহাম্মদের নিন্দায় যে এই শব্দটি ব্যবহার করতো, এই কথাটি তো সত্য। আমাদের ভেবে দেখা প্রইয়োজন যে, মুহাম্মদকে কান সর্বস্ব লোক বলে ব্যঙ্গ করার কী কারণ থাকতে পারে। এই বিষয়টি পাঠকদের জন্য একটি ধাঁধা হিসেবে থাকুক।
হাদিসের বিবরণ
নবী মুহাম্মদ একবার নিজ হাতে একটি চুক্তির একটি বিশেষ অংশ, যে অংশ লেখা ছিল “মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ”, এই অংশটুকু মুছে দেন। প্রশ্ন হচ্ছে, মুহাম্মদ পড়তে না জানলে কীভাবে বুঝলেন যে, কোন অংশে “মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ” এই কথাটি লিখিত আছে [6]?
সহীহ বুখারী (তাওহীদ) ৫৩/ বিবাদ মীমাংসা
পরিচ্ছেদঃ ৫৩/৬. কিভাবে সন্ধিপত্র লেখা হবে? অমুকের পুত্র অমুক এবং অমুকের পুত্র অমুক লিখাতে হবে। গোত্র বা বংশের উল্লেখ না করলেও ক্ষতি নেই।
২৬৯৮. বারা’ ইবনু ‘আযিব (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) হুদায়বিয়াতে (মক্কাবাসীদের সঙ্গে) সন্ধি করার সময় ‘আলী (রাঃ) উভয় পক্ষের মাঝে এক চুক্তিপত্র লিখলেন। তিনি লিখলেন, মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)। মুশরিকরা বলল, ‘মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’ লিখবে না। আপনি রাসূল হলে আপনার সঙ্গে লড়াই করতাম না?’ তখন তিনি আলীকে বললেন, ‘ওটা মুছে দাও’। ‘আলী (রাঃ) বললেন, ‘আমি তা মুছব না।’ তখন আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) নিজ হাতে তা মুছে দিলেন এবং এই শর্তে তাদের সঙ্গে সন্ধি করলেন যে, তিনি এবং তাঁর সঙ্গী-সাথীরা তিন দিনের জন্য মক্কা্য় প্রবেশ করবেন এবং জুলুববান جُلُبَّانُ السِّلَاحِ ব্যতীত অন্য কিছু নিয়ে প্রবেশ করবেন না। তারা জিজ্ঞেস করল, جُلُبَّانُ السِّلَاحِ মানে কী? তিনি বললেন, ‘জুলুববান’ মানে ভিতরে তরবারীসহ খাপ।’ (১৭৮১) (মুসলিম ৩২/৩৪ হাঃ ১৭৮৩, আহমাদ ১৮৬৫৮) (আধুনিক প্রকাশনীঃ ২৫০২, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ২৫১৫)
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
বর্ণনাকারীঃ বারা’আ ইবনু আযিব (রাঃ)
আরেকটি সহিহ হাদিসে বর্ণিত রয়েছে যে, মুহাম্মদ নিজেই চুক্তিপত্রটি নিলেন এবং লিখলেন। উনি লিখতে পড়তে না জানলে লিখলেন কীভাবে[7] [8]?
সহীহ বুখারী (তাওহীদ) ৫৩/ বিবাদ মীমাংসা
পরিচ্ছেদঃ ৫৩/৬. কিভাবে সন্ধিপত্র লেখা হবে? অমুকের পুত্র অমুক এবং অমুকের পুত্র অমুক লিখাতে হবে। গোত্র বা বংশের উল্লেখ না করলেও ক্ষতি নেই।
২৬৯৯. বারা‘ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, যিলকাদ মাসে নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ‘উমরাহর উদ্দেশ্যে বের হলেন। কিন্তু মক্কাবাসীরা তাঁকে মক্কা প্রবেশের জন্য ছেড়ে দিতে অস্বীকার করল। অবশেষে এই শর্তে তাদের সঙ্গে ফয়সালা করলেন যে, তিনদিন সেখানে অবস্থান করবেন। সন্ধিপত্র লিখতে গিয়ে মুসলিমরা লিখলেন, এ সন্ধিপত্র সম্পাদন করেছেন, ‘আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)।’ তারা (মুশরিকরা) বলল, ‘আমরা তাঁর রিসালাত স্বীকার করি না। আমরা যদি জানতাম যে, আপনি আল্লাহর রাসূল তাহলে আপনাকে বাধা দিতাম না। তবে আপনি হলেন, ‘আবদুল্লাহর পুত্র মুহাম্মদ।’ তিনি বললেন, ‘আমি আল্লাহর রাসূল এবং ‘আবদুল্লাহর পুত্র মুহাম্মদ।’
অতঃপর তিনি আলীকে বললেন, আল্লাহর রাসূল শব্দটি মুছে দাও। তিনি বললেন, ‘না। আল্লাহর কসম, আমি আপনাকে কখনো মুছব না।’ আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তখন চুক্তিপত্রটি নিলেন এবং লিখলেন, ‘এ সন্ধিপত্র মুহাম্মদ ইবনু ‘আবদুল্লাহ্ সম্পন্ন করেন- খাপবদ্ধ অস্ত্র ব্যতীত আর কিছু নিয়ে তিনি মক্কায় প্রবেশ করবেন না। মক্কাবাসীদের কেউ তাঁর সঙ্গে যেতে চাইলে তিনি বের করে নিবেন না। আর তাঁর সঙ্গীদের কেউ মক্কায় থাকতে চাইলে তাঁকে বাধা দিবেন না।’ তিনি যখন মক্কায় প্রবেশ করলেন এবং নির্ধারিত সময় অতিবাহিত হয়ে গেল, তখন তারা এসে আলীকে বলল, ‘তোমার সঙ্গীকে আমাদের এখান হতে বের হতে বল। কেননা নির্ধারিত সময় অতিবাহিত হয়ে গেছে।’
নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) রওয়ানা হলেন। তখন হামযাহর কন্যা হে চাচা, হে চাচা, বলে তাদের পেছনে পেছনে চলল। আলী (রাঃ) তাকে হাত ধরে নিয়ে এলেন এবং ফাতিমাহকে বললেন, ‘এই নাও, তোমার চাচার মেয়েকে। আমি ওকে তুলে এনেছি।’ ‘আলী, যায়দ ও জা‘ফর তাকে নেয়ার ব্যাপারে বিতর্কে প্রবৃত্ত হলেন। ‘আলী (রাঃ) বললেন, ‘আমি তার অধিক হক্দার। কারণ সে আমার চাচার মেয়ে। জা‘ফর (রাঃ) বললেন, সে আমার চাচার মেয়ে এবং তার খালা আমার স্ত্রী।’ যায়দ (রাঃ) বললেন, ‘সে আমার ভাইয়ের মেয়ে।’ অতঃপর নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) খালার পক্ষে ফয়সালা দিলেন এবং বললেন, ‘খালা মায়ের স্থান অধিকারিণী।’ আর ‘আলীকে বললেন, ‘আমি তোমার এবং তুমি আমার।’ জা‘ফরকে বললেন, ‘তুমি আকৃতি ও প্রকৃতিতে আমার সদৃশ। আর যায়দকে বললেন, ‘তুমি তো আমাদের ভাই ও আযাদকৃত গোলাম।’ (১৭৮১) (আধুনিক প্রকাশনীঃ ২৫০৩, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ২৫১৬)
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
বর্ণনাকারীঃ বারা’আ ইবনু আযিব (রাঃ)
আরো একটি সহিহ হাদিসে বর্ণিত রয়েছে, নবী মুহাম্মদ একখানা পত্র লিখলেন কিংবা পত্র লিখতে ইচ্ছা পোষণ করলেন। প্রশ্ন হচ্ছে, যিনি লিখতে পড়তে জানেন না, তিনি কীভাবে পত্র লিখলেন বা লিখতে ইচ্ছা পোষন করলেন [9] [10]?
সহীহ বুখারী (তাওহীদ)
অধ্যায়ঃ ৩/ আল-ইলম (ধর্মীয় জ্ঞান)
পরিচ্ছদঃ ৩/৭ শায়খ কর্তৃক ছাত্রকে হাদীসের কিতাব প্রদান এবং ‘আলিম কর্তৃক ‘ইলমের কথা লিখে বিভিন্ন দেশে প্রেরণ।
৬৫. আনাস ইবন মালিক (রাযি.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একখানা পত্র লিখলেন অথবা একখানা পত্র লিখতে ইচ্ছা পোষণ করলেন। তখন তাঁকে বলা হল, তারা (রোমবাসী ও অনারবরা) সীলমোহর ব্যতীত কোন পত্র পাঠ করেনা। অতঃপর তিনি রূপার একটি আংটি (মোহর) তৈরি করিয়ে নিলেন যাতে খোদিত ছিল (মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ)। আমি যেন তাঁর হাতে সে আংটির শুভ্রতা দেখতে পাচ্ছি (শু‘বা (রহ.) বলেন) আমি কাতাদাহ (রহ.) কে বললাম, কে বলেছে যে, তার নকশা (মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ) ছিল? তিনি বললেন, ‘আনাস (রাযি.)। (২৯৩৮, ৫৮৭০, ৫৮৭২, ৫৮৭৪, ৫৮৭৫, ৫৮৭৭, ৭১৬২; মুসলিম ৩৭/১২ হাঃ ২০৯২, আহমাদ ১২৯৪০) (আধুনিক প্রকাশনীঃ ৬৫, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ৬৫)
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
আরেকটি হাদিস পড়ুন, সবচেয়ে পুরনো হাদিস গ্রন্থগুলোর অন্যতম মুয়াত্তা মালিক হাদিস থেকে, যেখানে বলা হচ্ছে, যে চুক্তিপত্র রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে লিখে দেন [11] [12] –
সূনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত)
অধ্যায়ঃ ১২/ ক্রয়-বিক্রয় ও ব্যবসা-বাণিজ্য
পরিচ্ছেদঃ ৮. লেনদেনের শর্তাবলী লিপিবদ্ধ করা
১২১৬। আবদুল মাজীদ ইবনু ওয়াহব (রহঃ) হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, আল-আদ্দা ইবনু খালিদ ইবনু হাওযা (রাঃ) আমাকে বললেন, যে চুক্তিপত্র রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে লিখে দেন তা কি তোমাকে পড়ে শুনাব? আমি বললাম, হ্যাঁ। আমার সামনে তিনি একটি পত্র বের করলেন। তাতে লিখা ছিলঃ “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট হতে আল-আদ্দা ইবনু খালিদ ইবনু হাওযা একটি গোলাম বা দাসী কিনলো (এটি তার দলীল), যার কোন অসুখ নেই, যা পলায়নপর নয় এবং চরিত্রহীনও নয়। এ হলো এক মুসলমানের সাথে অন্য মুসলমানের ক্রয়-বিক্রয়”। – হাসান, ইবনু মা-জাহ (২২৫১)
এ হাদীসটিকে আবু ঈসা হাসান গারীব বলেছেন। আমরা এই হাদীসটি শুধু আব্বাদ ইবনু লাইসের সূত্রেই জেনেছি। একাধিক হাদীস বিশারদ তার নিকট হতে এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।
হাদিসের মানঃ হাসান (Hasan)
আরো একটি সহিহ হাদিসে বর্ণিত রয়েছে যে, নবী মুহাম্মদ মৃত্যুর সময় কিছু লেখার জিনিস নিয়ে আসতে বলেছিলেন, সেখানে তিনি কিছু লিখে যেতে চেয়েছিলেন। প্রশ্ন হচ্ছে, উনি লিখতে পড়তে না জানলে কেন লেখার জিনিস চাইবেন? উনি নিরক্ষর হয়ে থাকলে বলার কথা ছিল, কেউ একজন এই কথাগুলো লিখে রাখো। তা না বলে উনি লেখার জিনিস আনতে বললেন এবং লিখে দেয়ার কথা কেন বললেন?
সহীহ বুখারী (ইফাঃ)
অধ্যায়ঃ ৩/ ইলম বা জ্ঞান
পরিচ্ছেদঃ ৮১। ইলম লিপিবদ্ধ করা
১১৫। ইয়াহইয়া ইবনু সুলায়মান (রহঃ) … ইবনু আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর রোগ যখন বেড়ে গেল তখন তিনি বললেনঃ আমার কাছে কাগজ কলম নিয়ে এস, আমি তোমাদের এমন কিছু লিখে দিব যাতে পরবর্তীতে তোমরা ভ্রান্ত না হও। ‘উমর (রাঃ) বললেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর রোগ যন্ত্রণা প্রবল হয়ে গেছে (এমতাবস্থায় কিছু বলতে বা লিখতে তাঁর কষ্ট হবে)। আর আমাদের কাছে তো আল্লাহর কিতাব রয়েছে, যা আমাদের জন্য যথেষ্ট। এতে সাহাবীগণের মধ্য মতবিরোধ দেখা দিল এবং শোরগোল বেড়ে গেল। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তোমরা আমার কাছ থেকে উঠে যাও। আমার কাছে ঝগড়া-বিবাদ করা উচিত নয়। এ পর্যন্ত বর্ণনা করে ইবনু আব্বাস (রাঃ) (যেখানে বসে হাদীস বর্ণনা করছিলেন সেখান থেকে) এ কথা বলতে বলতে বেরিয়ে গেলেন যে, ‘হায় বিপদ, সাংঘাতিক বিপদ! রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং তাঁর লেখনীর মধ্যে যা বাধ সেধেছে।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
বর্ণনাকারীঃ আবদুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রাঃ)
এই সহিহ হাদিস থেকে জানা যায়, মৃত্যুশয্যায় রোগে কাতরাতে কাতরাতে মুহাম্মদ তার উম্মতদের উদ্দেশ্যে কিছু লিখে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু উমরের নির্দেশে তাকে লিখতে দেয়া হয় নি। এই নিয়ে সাহাবীদের মধ্যে তীব্র অসন্তোষও ছিল। রীতিমত ঝগড়া এবং মারামারির উপক্রমও হয়ে যাচ্ছিল। মৃত্যুশয্যায় শুয়ে শেষবেলায় কী বলতে চেয়েছিল মুহাম্মদ? তা আর জানা যায় নি [13] –
উপসংহার
এই কথা শতভাগ নিশ্চিত করে বলবার উপায় নেই যে, মুহাম্মদ নিরক্ষর ছিলেন, কিংবা তিনি লিখতে পড়তে জানতেন। উনি নিরক্ষর ছিলেন বলেও যেমন বেশ কিছু বিবরণ পাওয়া যায়, আবার একই সাথে, উনি লিখতে পড়তে পারতেন বলেও অনেক প্রমাণ মেলে। তাই আমিও শতভাগ নিশ্চয়তার সাথে কিছু দাবী করছি না। শুধুমাত্র মুহাম্মদ নিরক্ষর ছিলেন, এই দাবীর বিপরীতে কোরআন হাদিস থেকেই তথ্য প্রমাণ দিচ্ছি। এখন নানাধরণের গোঁজামিল দিয়ে এই তথ্যপ্রমাণ গুলোকে ভুল প্রমাণের চেষ্টা যদি মুমিনগণ করেন, তাতেই আমার লেখাটির উদ্দেশ্য সফল হবে। পাঠকই সিদ্ধান্ত নেবেন, আমার দেয়া রেফারেন্সগুলো কতটা যৌক্তিক।
তথ্যসূত্র
- সহিহ বুখারী, তাওহীদ পাবলিকেশন্স, হাদিস নম্বরঃ ৬৯৮২ [↑]
- সহীহুল বুখারী, তাওহীদ পাবলিকেশন্স, ষষ্ঠ খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৮৬, হাদিস নম্বরঃ ৬৯৮২ [↑]
- কোরআন, সূরা আন আম, আয়াত ১০ [↑]
- কোরআন, সূরা ফুরকান আয়াত ৫ [↑]
- কোরআন, সূরা তওবা আয়াত ৬১ [↑]
- সহীহ বুখারী, তাওহীদ পাবলিকেশন্স, হাদিস নম্বর- ২৬৯৮[↑]
- সহীহ বুখারী, তাওহীদ পাবলিকেশন্স, হাদিস নম্বর- ২৬৯৯[↑]
- সহীহ বুখারী, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, হাদিস নম্বর- ২৫১৮, ২৫১৯ [↑]
- সহীহ বুখারী, তাওহীদ পাবলিকেশন, প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৫৪, হাদিস নম্বরঃ ৬৫ [↑]
- সহীহ বুখারী, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৪৭, হাদিস নম্বরঃ ৬৫ [↑]
- সূনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত), হাদিস নম্বর- ১২১৬ [↑]
- তিরমিযী শরীফ, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, তৃতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৫০২, হাদিস নম্বর- ১২১৯ [↑]
- সহিহ বুখারী, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৮০-৮১, হাদিস নম্বরঃ ১১৫ [↑]
Leave a Comment