হিজড়াদের সম্পর্কে ইসলাম

Print Friendly, PDF & Email

ভূমিকা

আমাদের সমাজে এই বর্তমান সভ্য পৃথিবীতেও কিছু মানুষকে তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়, তাদের অসম্মান করা হয়, তাদের জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলা হয়, তাদের হিজড়া নাম দিয়ে সমাজ ও পরিবার থেকে দুর করে দেয়া হয়, যা অত্যন্ত অমানবিক এবং দুঃখজনক। তথাকথিত এই হিজড়াদের সমাজ থেকে বের করে দেয়ার পেছনে ইসলাম ধর্মের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে, যা আমরা এই লেখাটিতে আলোচনা করবো। কিছুদিন আগে ফেইসবুকে বুখারী শরীফ থেকে একটি হাদিস পোস্ট করেছিলাম, যেখানে কয়েকজন ইসলামিস্ট এসে দাবী করলেন, হাদিসটির বাঙলা অনুবাদে ভুল রয়েছে। হাদিসটি ছিল হিজড়া সম্পর্কে, তাদের বিতাড়িত করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন নবী মুহাম্মদ। পরবর্তীতে বিষয়টি ভুলে যাওয়ায় এই বিষয়ে আর আলোচনা হয় নি। বেশ কিছুদিন পরে আবার হাদিসটির কথা মনে হলো, তাই ভাবলাম, হাদিসটি নিয়ে একটু ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। তার আগে আমাদের জেনে নেয়া জরুরি, হিজড়া কাকে বলে। উল্লেখ্য, এই প্রবন্ধে হিজড়া শব্দটি দিয়ে তাদের নির্দেশ করা হলেও, আমি কোন অবস্থাতেই এই শব্দটির সাথে একমত নই। আমার ইচ্ছে হচ্ছে, মানুষ আর এই শব্দটি তাদের জন্য ব্যবহার না করুক। কিন্তু তাদের প্রতি ঘটে যাওয়া অমানবিকতা বোঝাতেই আমি এই শব্দটি এখানে ব্যবহার করছি।

হিজড়া কাকে বলে

“হিজড়া” শব্দটি একটি উর্দু শব্দ, যা সেমেটিক আরবি ধাতুমূল হিজর থেকে “গোত্র হতে পরিত্যাক্ত” অর্থে এসেছে [1]। পরবর্তীতে তা বাঙলা এবং হিন্দি ভাষায় বিদেশী শব্দ হিসেবে প্রবেশ করেছে। শব্দটির ভারতীয় ব্যবহারকে প্রথাগতভাবে ইংরেজিতে “ইউনাক” (Eunuch, অর্থঃ খোজা) বা “হারমাফ্রোডাইট” (hermaphrodite, অর্থঃ উভলিঙ্গ) হিসেবে অনুবাদ করা হয়, যেখানে “পুং জননাঙ্গের অনুপস্থিতি” বোঝানো হয়। সাধারণত অধিকাংশ হিজড়াই স্বাভাবিক পুরুষের শারীরিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে জন্মগ্রহণকারী, তবে এদের মধ্যে আন্তঃলিঙ্গ বৈচিত্র্য নিয়ে জন্মানো অল্পসংখ্যক সদস্যও রয়েছে।

হিজড়া

চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় ক্রোমোজোমের ত্রুটির কারণে জন্মগত যৌন প্রতিবন্ধী ব্যক্তি, যাদের জন্মপরবর্তী লিঙ্গ নির্ধারণে জটিলতা দেখা দেয়, তাদেরকে হিজড়া বলে। বাঙলাদেশ ভারত পাকিস্তানে সাধারণত এই ত্রুটি যুক্ত শিশু জন্ম নিলে বাবা মা সন্তানকে হিজড়াদেরকে দিয়ে দেয়। একটি সদ্য জন্ম নেয়া শিশুর জন্য পৃথিবীতে সবচাইতে নিরাপদ জায়গা মায়ের বুক, মায়ের গন্ধ, মায়ের আদর, একজন মানব শিশুর একদম মৌলিক অধিকারটুকু এদের ভাগ্যে জোটে না। বাবা মা ছাড়া এই সন্তানগুলো লালিত পালিত হয় হিজড়াদের সমাজে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাদের কোন শিক্ষাদীক্ষার সুযোগ থাকে না, চাকরিবাকরি সহ সাধারণ মানবিক অধিকারটুকু তারা পায় না। শেষমেশ অধিকাংশ হিজড়াকেই যৌনকর্মী হয়ে, নাচগান করে নতুবা ভিক্ষা করে, চাঁদাবাজি, ছিনতাই, বকশিশ তোলার মতো কাজ করে জীবন ধারণ করতে হয়। বিষয়টির অমানবিক দিক আমরা সবাই জানি, কিন্তু তারপরেও আমরা এদের দেখেও না দেখার ভান করি।

ভেবে দেখুন, কোন ধরণের অন্যায় অপরাধ না করেই সেই জন্ম থেকে শুধুমাত্র সামান্য একটি কারণে তাদের পুরো জীবনটি ধ্বংস করে ফেলা হয়। কোন ধরণের অধিকার, সামাজিক মর্যাদা কিংবা সম্মান তারা পান না। সর্বত্র হাসাহাসি, লজ্জা দেয়া, অবহেলা করা, একজন আত্মমর্যাদাশীল আত্মনির্ভরশীল মানুষ হয়ে উঠতে প্রতিটি স্তরে বাধা সৃষ্টি করা, এইভাবেই তাদের কোনরকমে বেঁচে থাকতে হয়। এরকম অমানবিক জীবন আপনারও হতে পারতো। একটু ভেবে দেখবেন, আপনার জীবনটি এরকম হলে কেমন লাগতো?

যারা হিজড়াদের জীবন সম্পর্কে আরো জানতে চান, তারা এই ভিডিওগুলো দেখতে পারেন-

এই বিষয়ে পাকিস্তানের একটি বিখ্যাত সিনেমা রয়েছে, সিনেমাটির নাম বোল। একটি বৈচিত্র্যময় লিঙ্গের অধিকারী শিশুর জীবনের ওপর নির্মিত। অত্যন্ত সুন্দর এই সিনেমাটি আপনারা দেখতে পারেন। সিনেমাটি এখানে যুক্ত করে দিচ্ছি-

নবী মুহাম্মদের হিজরত

আরবি هِجْرَة শব্দের বা হিজরত অর্থ হলো— দেশান্তর বা মাতৃভূমি ত্যাগ বা পরিত্যাক্ত হওয়া। মুহাম্মদ বাপ দাদার ধর্ম, রীতিনীতি, প্রচলিত বিশ্বাস ত্যাগ করেছিল, সেই সব ধর্মের সে সমালোচনা, কটূক্তি এবং অবমাননা শুরু করায় তাকে মক্কা থেকে পালিয়ে মদিনায় গিয়ে আশ্রয় নিতে হয়। স্বাভাবিকভাবেই, আমাদের মনে হয়, দেশত্যাগের যন্ত্রণা, আপনজনদের হারাবার বেদনা, এইসবই নবী মুহাম্মদ খুব ভালভাবেই বুঝবেন। শুধুমাত্র নিজের মতাদর্শ প্রচার এবং অন্য মতাদর্শের সমালোচনার জন্য কারো নিজ ভূমি ত্যাগ করে গোত্র থেকে পরিত্যাক্ত হতে হলে, সেটি খুবই মর্মান্তিক বিষয় বলেই ধরতে হয়। নবী মুহাম্মদ নিজেই যেখানে ভুক্তভোগী ছিলেন, উনারই এই বিষয়টি সবচেয়ে ভালভাবে বোঝার কথা। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, নবী মুহাম্মদ নিজ গোত্র থেকে পরিত্যাক্ত হওয়ার এই বেদনা নিজের ক্ষেত্রে ঠিকই বুঝেছেন, অন্যের ক্ষেত্রে বোঝেন না।

হিজড়াদের জন্ম কীভাবে হয়

ইসলামের রেফারেন্সে হিজড়াদের জন্ম কীভাবে হয়, সেই সম্পর্কে বলা হয়েছে, স্ত্রীলোকের মাসিকের সময় সঙ্গম করলে শয়তান দ্বারা মহিলাটি গর্ভবতী হয়ে যায়, অর্থাৎ হিজড়ারা আসলে শয়তানের সঙ্গমে জন্ম নেয়! [2]

হিজড়া 3
হিজড়া 5
হিজড়া 7

সহিহ হাদিসে হিজড়াদের নির্বাসন

সহীহ বুখারী হাদিসে বর্ণিত রয়েছে, হিজড়াদেরকে নির্বাসিত করতে হবে। নবী নিজেই তাদের ঘর থেকে বের করে দিতেন। কেন? শুধুমাত্র তারা হিজড়া হয়ে জন্ম নিয়েছে, এই কারণে [3] [4]

সহীহ বুখারী (ইসলামিক ফাউন্ডেশন)
অধ্যায়ঃ ৭৫/ কাফের ও ধর্মত্যাগী বিদ্রোহীদের বিবরণ
পরিচ্ছেদঃ ২৮৫২. গুনাহগার ও হিজড়াদের নির্বাসিত করা
৬৩৭৩। মুসলিম ইবনু ইবরাহীম (রহঃ) … ইবনু আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম লা’নত করেছেন নারীরূপী পুরুষ ও পুরুষরূপী নারীদের উপর এবং বলেছেনঃ তাদেরকে বের করে দাও তোমাদের ঘর হতে এবং তিনি অমুক অমুককে বের করে দিয়েছেন।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
বর্ণনাকারীঃ আবদুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রাঃ)

হিজড়াদের সম্পর্কে হাদিস

সহজ নসরুল বারী, শরহে সহীহ বুখারী অর্থাৎ বুখারী হাদিসের ব্যাখ্যা গ্রন্থে কী বলা রয়েছে, সেটিও দেখে নিই [5],

হিজড়াদের নির্বাসন

পাঠক লক্ষ্য করুন, উপরে নসরুল বারী থেকে যেই ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে, সেখানে কবিরা গুণাহে লিপ্ত কথাটির পরে “ও” যুক্ত রয়েছে। এর মানে হচ্ছে, কবিরা গুণাহে লিপ্ত এবং একই সাথে, হিজড়াদের কথা এখানে বলা হয়েছে। যদি “ও” অক্ষরটি না থাকতো, তাহলে অর্থটি হতে পারতো, শুধুমাত্র কবিরা গুণাহে লিপ্ত হিজড়াদের কথা এখানে বোঝানো হচ্ছে। যা অনেক ইসলামিস্টই আজকাল দাবী করে বিষয়টি লুকাবার চেষ্টা করেন। তারা বোঝাবার চেষ্টা করেন, এখানে হিজড়াদের সম্পর্কে নয়, শুধুমাত্র নাকি অপরাধী হিজড়াদের কথা বোঝানো হয়েছে। কিন্তু কথাটি যে সম্পূর্ণ মিথ্যা, তা ঐ “ও” অক্ষরটি দ্বারাই প্রমাণ হয়। সেইসাথে, নবী মুহাম্মদ শুধু যে নির্দেশই দিতেন সেটিই নয়, তিনি নিজেও হিজড়াদের গোত্র ত্যাগে বাধ্য করতেন [6]

সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত)
অধ্যায়ঃ ২৭/ পোশাক-পরিচ্ছদ
পরিচ্ছেদঃ ৩৫. মহান আল্লাহর বাণীঃ ‘‘যৌন কামনা রহিত পুরুষ’’
৪১০৯। আয়িশাহ (রাঃ) সূত্রে অনুরূপ হাদীস বর্ণিত। এতে আরো রয়েছেঃ ‘‘তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাকে আল-বায়দা নামক স্থানে পাঠিয়ে দিলেন। এরপর সে (হিজড়া) প্রতি শুক্রবার খাদ্যের জন্য শহরে আসতো।(1)
সহীহ।
(1). ইরওয়াউল গালীল (৬/২০৫)।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
বর্ণনাকারীঃ আয়িশা (রাঃ)

আসুন আরো একটি হাদিস পড়ি যেখানে পরিষ্কার যে, হিজড়াদের গৃহ থেকে বহিষ্কার করাই ইসলামের বিধান [7]

হাদীস সম্ভার
২৪/ বিবাহ ও দাম্পত্য
পরিচ্ছেদঃ পর্দার বিধান
(২৬৬৫) ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেছেন, আল্লাহর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খোজা পুরুষ এবং পুরুষসুলভ আচরণ-কারিণী নারীর উপর অভিসম্পাত করেছেন এবং বলেছেন, তোমাদের গৃহ হতে ওদেরকে বের করে দাও। তিনি স্বয়ং এক খোজাকে বহিষ্কার করেছেন এবং উমার (রাঃ) এক হিজড়ে নারীকে গৃহ হতে বহিষ্কার করেছেন।
(আহমাদ ২০০৬, ২১২৩, বুখারী ৫৮৮৬)
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
বর্ণনাকারীঃ আবদুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রাঃ)

একইসাথে, নবী মুহাম্মদ হিজড়াদের ঘৃণা করতেন, যার প্রমাণ পাওয়া যায় আরো কিছু সহিহ হাদিস থেকে [8] [9] [10]

সহীহ বুখারী (ইসলামিক ফাউন্ডেশন)
অধ্যায়ঃ ৫১/ মাগাযী (যুদ্ধাভিযান)
পরিচ্ছেদঃ ২২২০. তায়েফের যুদ্ধ। মুসা ইবন উকবা (রাঃ) এর মতে এ যুদ্ধ অষ্টম হিজরীর শাওয়াল মাসে সংগটিত হয়েছে
৩৯৮৮। হুমাইদী (রহঃ) … উম্মে সালামা (রাঃ) থেকে বর্ণিত যে, আমার কাছে এক হিজড়া ব্যাক্তি বসা ছিল, এমন সময়ে নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার ঘরে প্রবেশ করলেন। আমি শুনলাম, সে (হিজড়া ব্যাক্তি) আবদুল্লাহ ইবনু আবূ উমাইয়া (রাঃ)-কে বলছে, হে আবদুল্লাহ! কি বলো, আগামীকাল যদি আল্লাহ্ তোমাদেরকে তায়েফের উপর বিজয় দান করেন তা হলে গায়লানের কন্যাকে অবশ্যই তুমি লুফে নেবে। কেননা সে (এতই স্থুলদেহ ও কোমল যে), সামনের দিকে আসার সময়ে তার পিঠে চারটি ভাঁজ পড়ে আবার পিঠ ফিরালে সেখানে আটটি ভাঁজ পড়ে। (উম্মে সালামা (রাঃ) বলেন) তখন নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ এদেরকে (হিজড়াদেরকে) তোমাদের কাছে প্রবেশ করতে দিও না। ইবনু উয়াইনা (রাঃ) বর্ণনা করেন যে, ইবনু জুরায়জ (রাঃ) বলেছেন, হিজড়া লোকটির নাম ছিলো হীত।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
বর্ণনাকারীঃ উম্মু সালামাহ (রাঃ)

সহীহ বুখারী (ইসলামিক ফাউন্ডেশন)
অধ্যায়ঃ ৫৪/ বিয়ে-শাদী
পরিচ্ছেদঃ ২৫৩৭. যে পুরুষ মহিলার মত সাজ-গোজ করে, তার সাথে কোন নারীর চলাফেরা নিষেধ
৪৮৫৫। উসমান ইবনু আবূ শায়বা (রহঃ) … উম্মে সালামা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার কাছে থাকাকালে সেখানে একজন মেয়েলী ভাবাপন্ন পুরুষ ছিল। ঐ মেয়েলী পুরুষটি উম্মে সালামার ভাই আবদুল্লাহ‌ ইবনু আবূ উমাইয়াকে বলল, যদি আগামীকাল আপনাদেরকে আল্লাহ তায়েফ বিজয় দান করেন, তবে আমি আপনাকে গায়লানের মেয়েকে গ্রহন করারা পরামর্শ দিচ্ছি। কেননা, সে এত মেদবহুল যে, সে সম্মুখ দিকে আগমন করলে তার পেটের চামড়ায় চার ভাঁজ পড়ে আর পিছু ফিরে যাওয়ার সময় আট ভাঁজ পড়ে। একথা শোনার পর নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, (এ মেয়েলী পুরুষ হিজড়া) সে যেন কখনো তোমাদের কাছে আর না আসে।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
বর্ণনাকারীঃ উম্মু সুলায়ম (রাঃ)

সূনান আবু দাউদ (ইসলামিক ফাউন্ডেশন)
অধ্যায়ঃ ৩৬/ আদব
পরিচ্ছেদঃ ৫৯. নপুংসকদের হুকুম সম্পর্কে।
৪৮৪৬. আবূ বকর ইবন আবূ শায়বা (রহঃ) …. উম্মু সালামা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেনঃ একদা নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার কাছে এমন সময় প্রবেশ করেন, যখন আমর কাছে একজন নপুংসক (হিজড়া) উপস্থিত ছিল। আর সে তার ভাইকে বলছিল। আগামীকাল মহান আল্লাহ্‌ যদি তায়েফের উপর (মুসলমানদের) বিজয় দান করেন, তবে আমি তোমাকে এমন এক স্ত্রীলোকের খবর দেব, যার আসার সময় তার পেটে চারটি ভাঁজ দেখা যায়; আর যখন সে চলে যায় তখন তার পেটে আটটি ভাঁজ দেখা যায়। একথা শুনে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে ঘর থেকে বের করে দেয়ার নির্দেশ দেন।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
বর্ণনাকারীঃ উম্মু সালামাহ (রাঃ)

নামাজি হিজড়াদের হত্যা করা যাবে না

সহিহ হাদিসে এটিও পরিষ্কারভাবে বর্ণিত রয়েছে, নবী মুহাম্মদ হিজড়াদের আসলে হত্যাই করতেন, শুধুমাত্র মুসলিম নামাজি হিজড়ারা নামাজ পড়ার কারণে তাদেরকে হত্যা করতে নিষেধ করেছেন। অর্থাৎ তারা আসলে হত্যারই যোগ্য, শুধুমাত্র নামাজ আদায়কারীদের আল্লাহ হত্যা করতে নিষেধ করেছেন বলে নবী তাদের হত্যা করেন নি। বাদবাকি যারা নামাজ পড়ে না, তাদের ক্ষেত্রে কী বিধান সেটি পাঠকই বুঝে নেবেন [11]

সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত)
অধ্যায়ঃ ৩৬/ শিষ্টাচার
পরিচ্ছেদঃ ৬১. হিজড়া সম্পর্কে বিধান
৪৯২৮। আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) সূত্রে বর্ণিত। কোনো একদিন এক হিজড়াকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট আনা হলো। তার হাত-পা মেহেদী দ্বারা রাঙ্গানো ছিলো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ এর এ অবস্থা কেন? বলা হলো, হে আল্লাহর রাসূল! সে নারীর বেশ ধরেছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে আন-নকী নামক স্থানে নির্বাসন দেয়ার নির্দেশ দিলেন। সাহাবীগণ বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমরা কি তাকে হত্যা করবো না? তিনি বললেনঃ সালাত আদায়কারীকে হত্যা করতে আমাকে নিষেধ করা হয়েছে। আবূ উসামাহ (রহঃ) বলেন, আন-নাফী‘ হলো মদীনার প্রান্তবর্তী একটি জনপদ, এটা বাকী নয়।(1)
সহীহ।
(1). দারাকুতনী।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
বর্ণনাকারীঃ আবূ হুরায়রা (রাঃ)

সরাসরি বই থেকেও দেখে নিই [12]

হিজরা সম্পর্কে বিধান

এই হাদিসটি আরো বেশ কয়েকজায়গাতেই পাওয়া যায় [13]

মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত)
অধ্যায়ঃ পর্ব-২২ঃ পোশাক-পরিচ্ছদ
পরিচ্ছেদঃ ৩. তৃতীয় অনুচ্ছেদ – চুল আঁচড়ানো
৪৪৮১-(৬৩) আবূ হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদিন রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে এক হিজড়াকে আনা হলো, সে তার হাতে এবং পায়ে মেহেদী লাগিয়ে রেখেছিল। তখন রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিজ্ঞেস করলেন, এটার এ অবস্থা কেন? সাহাবীগণ বললেনঃ সে নারীদের বেশ ধারণ করেছে। তখন তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাকে শহর হতে বের করে দেয়ার নির্দেশ দিলেন। সুতরাং তাকে শহরের বাইরে নাক্বী‘ নামক স্থানে নির্বাসিত করা হলো। অতঃপর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে জিজ্ঞেস করা হলো, হে আল্লাহর রসূল! আমরা কি তাকে কতল করে দেব? তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেনঃ সলাত আদায়কারী ব্যক্তিদেরকে কতল করতে আমাকে নিষেধ করা হয়েছে। (আবূ দাঊদ)(1)
(1) সহীহ : আবূ দাঊদ ৪৯২৮, সহীহুল জামি‘ ২৫০৬, সিলসিলাতুস্ সহীহাহ্ ২৩৭৯, শু‘আবুল ঈমান ৪৬০৬, দারাকুত্বনী ৯, আল মু‘জামুল আওসাত্ব ৫০৫৮, আস্ সুনানুল কুবরা লিল বায়হাক্বী ১৭৪৪২, আস্ সুনানুস্ সুগরা ৫৯৭।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
বর্ণনাকারীঃ আবূ হুরায়রা (রাঃ)

হিজড়াদের স্বভাবগত বিষয়াদি

হিজড়া মানুষরা স্বভাবগতভাবেই নারীর পোষাক পড়তে এবং সাজসজ্জা করতে পছন্দ করে। এটি অনেক হিজড়ার মধ্যেই খুবই স্বাভাবিক ইচ্ছা। একজন মানুষের স্বাধীনতা থাকা উচিৎ, উনি যেভাবে ইচ্ছা যেভাবে পোষাক পড়বেন এবং সাজসজ্জা করবেন। কিন্তু ইসলাম খুব কঠিনভাবে এই কাজে নিষেধাজ্ঞা দেন। নবী মুহাম্মদ পুরুষ হিজড়াদের এবং নারীর বেশ ধারী পুরুষদের লানত করেছেন। অর্থাৎ অভিশাপ দিয়েছেন [14] [15]

সহীহ বুখারী (তাওহীদ)
অধ্যায়ঃ ৭৭/ পোশাক
পরিচ্ছেদঃ ৭৭/৬১. পুরুষের নারীর বেশ ধারণ এবং নারীর পুরুষের বেশ ধারণ প্রসঙ্গে।
৫৮৮৫. ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঐ সব পুরুষকে লা’নত করেছেন যারা নারীর বেশ ধরে এবং ঐসব নারীকে যারা পুরুষের বেশ ধরে। (আধুনিক প্রকাশনী- ৫৪৫৭, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৫৩৫৩)
‘আমরও এরকমই বর্ণনা করেছেন। আমাদের কাছে শু‘য়বা এ সংবাদ দিয়েছেন।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
বর্ণনাকারীঃ আবদুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রাঃ)

সহীহ বুখারী (তাওহীদ)
অধ্যায়ঃ ৭৭/ পোশাক
পরিচ্ছেদঃ ৭৭/৬২. নারীর বেশধারী পুরুষদের ঘর থেকে বের করে দেয়া প্রসঙ্গে।
৫৮৮৬. ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পুরুষ হিজড়াদের উপর এবং পুরুষের বেশধারী মহিলাদের উপর লা’নত করেছেন। তিনি বলেছেনঃ ওদেরকে ঘর থেকে বের করে দাও। ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ) বলেছেনঃ নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অমুককে বের করেছেন এবং ‘উমার (রাঃ) অমুককে বের করে দিয়েছেন। (আধুনিক প্রকাশনী- ৫৪৫৮, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৫৩৫৪)
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
বর্ণনাকারীঃ আবদুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রাঃ)

এমনকি, পরচুলা পড়া মানুষকেও নবী লানত করেছেন [16]

সহীহ বুখারী (তাওহীদ)
অধ্যায়ঃ ৭৭/ পোশাক
পরিচ্ছেদঃ ৭৭/৮৩. পরচুলা লাগানো প্রসঙ্গে।
৫৯৩৪. ‘আয়িশাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত। এক আনসারী নারী বিয়ে করে। এরপর সে রোগে আক্রান্ত হয়। ফলে তার সব চুল পড়ে যায়। লোকজন তাকে পরচুলা লাগিয়ে দিতে ইচ্ছে করে। আর তারা নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে এ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করল। তিনি বললেনঃ আল্লাহ লা‘নত করেছেন ঐসব নারীকে যারা নিজেরা পরচুলা লাগায় এবং যারা অন্যদেরকে তা লাগিয়ে দেয়। (৫২০৫) (আধুনিক প্রকাশনী- ৫৫০১, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৫৩৯৬)
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
বর্ণনাকারীঃ আয়িশা (রাঃ)

উপসংহার

একটি নবজাতক শিশু ছেলে হোক, মেয়ে হোক, বৈচিত্র্যময় লিঙ্গের অধিকারী হোক, যেই হোক, সে পবিত্র এবং সুন্দর। একজন মা যেন কোন অবস্থাতেই একজন শিশুকে তার বুকের কাছ থেকে সরিয়ে না দেন। তাকে যেন হিজড়া, মানে গোত্র থেকে পরিত্যাগ না করেন। একটি শিশুর অধিকার হচ্ছে, একটি পরিবারের মধ্যে হাসি আনন্দ, ভালবাসা এবং স্নেহের মধ্যে বেড়ে ওঠার। তার লিঙ্গের ওপর ভিত্তি করে যেন তাকে কোন অবস্থাতেই অসম্মানের জীবনের দিকে ঠেলে দেয়া না হয়। তাকে একজন স্বাধীন, আত্মনির্ভরশীল, আত্মমর্যাদাশীল মানুষ হিসেবে বেড়ে ওঠার সুযোগ দেয়া হয়। আর ইসলামের এইসব নোংরা বিধিবিধান যেন সমাজ থেকে দূরীভূত হয়।


তথ্যসূত্র

  1. Perspectives on Arabic linguistics XVII-XVIII: papers from the Seventeenth and Eighteenth Annual Symposia on Arabic Linguistics, (John Benjamins, 2005), p. 97 []
  2. জ্বীন জাতির বিষ্ময়কর ইতিহাস, আল্লামা জালালুদ্দীন সুয়ূতি, পৃষ্ঠা ৫০, ৫১ []
  3. সহীহ বুখারী, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, হাদিস নম্বরঃ ৬৩৭৩ []
  4. সহীহ বুখারী, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, দশম খণ্ড, পৃষ্ঠা নম্বর- ২৪০, হাদিস নম্বরঃ ৬৩৭৩ []
  5. সহজ নসরুল বারী, শরহে সহীহ বুখারী, আরবি-বাংলা, সহজ তরজমা ও বিস্তারিত ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ, হযরত মাওলানা উসমান গনী, আল কাউসার প্রকাশনী, ১২তম খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৪০ []
  6. সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত), হাদিস নম্বরঃ ৪১০৯ []
  7. হাদীস সম্ভার, হাদিস নম্বরঃ ২৬৬৫ []
  8. সহীহ বুখারী, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, হাদিস নম্বরঃ ৩৯৮৮[]
  9. সহীহ বুখারী, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, হাদিস নম্বরঃ ৪৮৫৫ []
  10. সূনান আবু দাউদ, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, হাদিস নম্বরঃ ৪৮৪৬ []
  11. সূনান আবু দাউদ, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, হাদিস নম্বরঃ ৪৯২৮ []
  12. সুনান আবূ দাউদ, তাহক্বীকঃ আল্লামা নাসিরুদ্দীন আলবানী, ৫ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৫৩৫ []
  13. মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত), হাদিস নম্বরঃ ৪৪৮১ []
  14. সহীহ বুখারী, তাওহীদ পাবলিকেশন্স, হাদিস নম্বরঃ ৫৮৮৫ []
  15. সহীহ বুখারী, তাওহীদ পাবলিকেশন্স, হাদিস নম্বরঃ ৫৮৮৬ []
  16. সহীহ বুখারী, তাওহীদ পাবলিকেশন্স, হাদিস নম্বরঃ ৫৯৩৪ []
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত © সংশয় - চিন্তার মুক্তির আন্দোলন

আসিফ মহিউদ্দীন

আসিফ মহিউদ্দীন সম্পাদক সংশয় - চিন্তার মুক্তির আন্দোলন [email protected]

4 thoughts on “হিজড়াদের সম্পর্কে ইসলাম

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *