হুজুর কেবলা – আবুল মনসুর আহমদ

Print Friendly, PDF & Email

এক

এমদাদ তার সবগুলি বিলাতি ফিনফিনে ধুতি, সিল্কের জামা পোড়াইয়া ফেলিল; ফ্লেঙ্রে ব্রাউন রঙের পাম্পসুগুলি বাবুর্চিখানার বঁটি দিয়া কোপাইয়া ইলশা-কাটা করিল। চশমা ও রিস্টওয়াচ মাটিতে আছড়াইয়া ভাঙিয়া ফেলিল; ক্ষুর স্ট্রপ, শেভিংস্টিক ও ব্রাশ অনেকখানি রাস্তা হাঁটিয়া নদীতে ফেলিয়া দিয়া আসিল; বিলাসিতার মস্তকে কঠোর পদাঘাত করিয়া পাথর বসানো সোনার আংটিটা এক অন্ধ ভিক্ষুককে দান করিয়া এবং টুথক্রিম ও টুথব্রাশ পায়খানার টবের মধ্যে ফেলিয়া দিয়া দাঁত ঘষিতে লাগিল।

অর্থাৎ এমদাদ অসহযোগ আন্দোলনে যোগদান করিল! সে কলেজ ছাড়িয়া দিল।

তারপর সে কোরা খদ্দরের কলি্লদার কোর্তা ও সাদা লুঙ্গি পরিয়া মুখে দেড় ইঞ্চি পরিমাণ ঝাঁকড়া দাড়ি লইয়া সামনে-পিছনে সমান-করিয়া চুলকাটা মাথায় গোল নেকড়ার মতো টুপি কান পর্যন্ত পরিয়া চটিজুতা পায়ে দিয়া যেদিন বাড়ি মুখে রওনা হইল, সেদিন রাস্তার বহুলোক তাকে সালাম দিল। সে মনে মনে বুঝিল, কলিযুগেও দুনিয়ায় ধর্ম আছে। কলেজে এমদাদের দর্শনে অনার্স ছিল।

কাজেই সে ধর্ম, খোদা, রসুল কিছুই মানিত না। সে খোদার আরশ, ফেরেশতা, ওহি, হযরতের মেরাজ লইয়া সর্বদা হাসি ঠাট্টা করিত। কলেজ ম্যাগাজিনে সে মিল, হিউম, স্পেন্সার, কোমতের ভাব চুরি করিয়া অনেকবার খোদার অস্তিত্বের অসারতা প্রমাণ করিয়াছিল।
কিন্তু খেলাফত আন্দোলনে যোগদান করিয়া এমদাদ একেবারে বদলাইয়া গেল।

সে ভয়ানক নামাজ পড়িতে লাগিল। বিশেষ করিয়া নফল নামাজে সে একেবারে তন্ময় হইয়া পড়িল। গোলগাল করিয়া বাঁশের কঞ্চি কাটিয়া সে নিজ হাতে এক ছড়া তসবিহ তৈরি করিল। সেই তসবির ওপর দিয়া অষ্টপ্রহর অঙ্গুলি চালনা করিয়া সে দুইটা আঙুলের মাথা ছিঁড়িয়া ফেলিল।

কিন্তু এমদাদ টলিল না। সে নিজের নধর দেহের দিকে চাহিয়া বলিল : হে দেহ, তুমি আমার আত্মাকে ছোট করিয়া নিজেই বড় হইতে চাহিয়াছিলে! কিন্তু আর নয় সে আবার দ্বিগুণ উৎসাহে তসবিহ চালাইতে লাগিল।

দুই

দিন যাইতে লাগিল।
ক্রমে এমদাদ একটা অস্বস্তি বোধ করিতে লাগিল।
বহু চেষ্টা করিয়াও সে এবাদতে তেমন নিষ্ঠা আনিতে পারিতেছিল না। নিজেকে বহু শাসাইল, বহু প্রক্রিয়া অবলম্বন করিল; কিন্তু তথাপি পোড়া ঘুম তাকে তাহাজ্জতের নামাজ তরক করিতে বাধ্য করিতে লাগিল।
অগত্যা সে নামাজে বসিয়া খোদার নিকট হাত তুলিয়া কাঁদিবার বহু চেষ্টা করিল। চোখের পানির অপেক্ষায় আগে হইতে কান্নার মতো মুখ বিকৃত করিয়া রাখিল। কিন্তু পোড়া চোখের পানি কোনোমতেই আসিল না।
সে স্থানীয় কংগ্রেস ও খেলাফত কমিটির সেক্রেটারি ছিল।
সেখানে প্রত্যহ সকাল-বিকালে চারিপাশের বহু মওলানা-মওলবি সমবেত হইয়া কাবুলের আমিরের ভারত-আক্রমণের কত দিন বাকি আছে তার হিসাব করিতেন এবং খেলাফত নোট-বিক্রয়লব্ধ পয়সায় প্রত্যহ পান ও জরদা এবং সময় সময় নাশতা খাইতেন।
ইহাদের একজনের সুফি বলিয়া খ্যাতি ছিল। তিনি এক পীর সাহেবের স্থানীয় খলিফা ছিলেন এবং অনেক রাত পর্যন্ত ‘এলহু, এলহু’ করিতেন।
অল্পদিন পূর্বে ‘এস্তেখারা’ করিয়া তিনি দেখিয়াছিলেন যে চারি বৎসরের মধ্যে কাবুলের আমির হিন্দুস্থান দখল করিবেন।
তাঁহার কথায় সকলেই বিশ্বাস করিয়াছিল; কারণ মেয়েলোকের উপর জিনের আসর হইলে তিনি জিন ছাড়াইতে পারিতেন।
এই সুফি সাহেবের নিকট এমদাদ তার প্রাণের বেদনা জানাইল।

সুফি সাহেব দাড়িতে হাত বুলাইয়া মৃদু হাসিয়া ইংরাজি-শিক্ষিতদের উদ্দেশ্য করিয়া অনেক বাঁকাবাঁকা কথা বলিয়া উপসংহারে বলিলেন : হকিকতান যদি আপনি রুহের তরক্কি হাসেল করিতে চান, তবে আপনাকে আমার কথা রাখিতে হইবে। আচ্ছা; মাস্টার সাহেব, আপনি কার মুরিদ?
এমদাদ অপ্রতিভভাবে বলিল : আমি ত কারো মুরিদ হই নাই।
সুফি সাহেব যেন রোগ নির্ণয় করিয়া ফেলিয়াছিলেন এইভাবে মাথা নাড়িতে নাড়িতে বলিলেন : হ-ম, তাই বলুন। গোড়াতেই গলদ। পীর না ধরিয়া কি কেহ রুহানিয়ত হাসেল করিতে পারে? হাদিস শরিফে আসিয়াছে : (এইখানে সুফি সাহেব বিশুদ্ধরূপে আইন গাইনের উচ্চারণ করিয়া কিছু আরবি আবৃত্তি করিলেন এবং উর্দুতে তার মানে মতলব বয়ান করিয়া অবশেষে বাংলায় বলিলেন) : জয্বা ও সলুক খতম করিয়া ফানা ও বাকা লাভে সমর্থ হইয়াছেন এরূপ কামেল ও মোকাম্মেল, সালেক ও মজ্যুব পীরের দামন না ধরিয়া কেহ জমিরের রওশনি ও রুহের তরক্কি হাসেল করিতে পারে না।
হাদিসের এই সুস্পষ্ট নির্দেশের কথা শুনিয়া এমদাদ নিতান্ত ঘাবড়াইয়া গেল।
সে ধরা-গলায় বলিল : কী হইবে আমার তাহা হইলে সুফি সাহেব?
সুফি সাহেব এমদাদের কাঁধে হাত রাখিয়া বলিলেন : ঘাবড়াইবার কোনো কারণ নাই। কামেল পীরের কাছে গেলে এক দিনে তিনি সব ঠিক করিয়া দিবেন।
স্বস্তিতে এমদাদের মুখ উজ্জ্বল হইয়া উঠিল।
সে আগ্রহাতিশয্যে সুফি সাহেবের হাত চাপিয়ে ধরিয়া বলিল : কোথায় পাইব কামেল পীরে? আপনার সন্ধানে আছে?
উত্তরে সুফি সাহেব সুর করিয়া একটি ফারসি বয়েত আবৃত্তি করিয়া তার অর্থ বলিলেন : জওহরের তালাশে যারা জীবন কাটাইয়াছে, তারা ব্যতীত আর কেহ জওহরের খবর দিতে পারে? হাজার শোকর খোদার দরগায়, বহু তালাশের পর তিনি জওহর মিলাইয়াছেন।
সুফি সাহেবের হাত তখনো এমদাদের মুঠার মধ্যে ছিল। সে ত আরো জোরে চাপিয়া ধরিয়া বলিল : আমাকে লইয়া যাইবেন না সেখানে?
সুফি সাহেব বলিলেন : কেন লইয়া যাইব না? হাদিস শরিফে আসিয়াছে : (আরবি ও উর্দু) যে ব্যক্তি আল্লাহর রাস্তায় আসিতে চায়, তার সাহায্য করো।
সংসারে একমাত্র বন্ধন এবং অভিভাবক বৃদ্ধা ফুফুকে কাঁদাইয়া একদিন এমদাদ সুফি সাহেবের সঙ্গে পীর-জিয়ারতে বাহির হইয়া পড়িল।

তিন

এমদাদ দেখিল : পীর সাহেবের একতলা পাকা বাড়ি। বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। অন্দরবাড়ির সব ক’খানা ঘর পাকা হইলেও বৈঠকখানাটি অতি পরিপাটি প্রকাণ্ড খড়ের আটচালা।
সে সুফি সাহেবের পিছনে পিছনে বৈঠকখানায় প্রবেশ করিল। দেখিল : ঘরে বহু লোক জানু পাতিয়া বসিয়া আছেন। বৈঠকখানার মাঝখানে দেয়াল ঘেঁষিয়া অপেক্ষাকৃত উচ্চ আসনে মেহেদি-রঞ্জিত দাড়ি-বিশিষ্ট একজন বৃদ্ধ লোক তাকিয়া হেলান দিয়া আলবোলায় তামাক টানিতেছেন।
এমদাদ বুঝিল : ইনিই পীর সাহেব।

‘আসসালামু আলাইয়াকুম’ বলিয়া সুফি সাহেব সোজা পীর সাহেবের নিকট উপস্থিত হইয়া হাঁটু পাতিয়া বসিলেন। পীর সাহেব সম্মুখস্থ তাকিয়ার উপর একটি পা তুলিয়া দিলেন। সুফি সাহেব সেই পায়ে হাত ঘষিয়া নিজের চোখে, মুখে ও বুকে লাগাইলেন।
তৎপর সাহেব তাঁর হাত বাড়াইয়া দিলেন। সুফি সাহেব তা চুম্বন করিয়া দাঁড়াইয়া উঠিলেন এবং পিছাইয়া-পিছাইয়া কিছুদূর গিয়া অন্য সকলের ন্যায় জানু পাতিয়া বসিলেন।
পীর সাহেব এতক্ষণে কথা বলিলেন : কিরে বেটা, খবর কী? তুই কি এরই মধ্যে দায়েরায়ে হকিকতে মহব্বত ও জযবায়েযাতি-বনাম হোব্বে এশক হাসেল করিয়া ফেললি নাকি?
পীর সাহেবের এই ঠাট্টায় লজ্জা পাইয়া সুফি সাহেব মাথা নিচু করিয়া মাজা ঈষৎ উঁচু করিয়া বলিলেন : হযরত, বান্দাকে লজ্জা দিতেছেন!
পীর সাহেব তেমনি হাসিয়া বলিলেন : তা না হইলে নিজের চিন্তা ছাড়িয়া অপরের রুহের সুপারিশ করিতে আমার নিকট আসিলে কেন? কই, তোর সঙ্গী কোথায়? আহা! বেচারা বড়ই অশান্তিতে দিনপাত করিতেছে।
এই বলিয়া পীরসাহেব চক্ষু বুজিলেন এবং প্রায় এক মিনিট কাল ধ্যানস্থ থাকিয়া চক্ষু মেলিয়া বলিলেন : সে এই ঘরেই হাজির আছে দেখিতেছি।
উপস্থিত মুরিদগণের সকলে মুখ চাওয়াচাওয়ি করিতে লাগিল। এমদাদ ভক্তি ও বিস্ময়ে স্তব্ধ হইয়া একদৃষ্টে পীর সাহেবের দিকে চাহিয়া রহিল। মেহেদি-রঞ্জিত দাড়ি-গোঁফের ভিতর দিয়া পীর সাহেবের মুখ হইতে এক প্রকার জ্যোতি বিকীর্ণ হইতে লাগিল।

সুফি সাহেব এমদাদকে আগাইয়া আসিতে ইশারা করিলেন। সে ধীরে ধীরে পীর সাহেবের সম্মুখে উপস্থিত হইয়া সুফি সাহেবের ইঙ্গিতে অনভ্যস্ত হাতে কদমবুসি করিয়া উঠিয়া দাঁড়াইয়া রহিল।
পীর সাহেব ‘বস্ বেটা, তোর ভালো হইবে। আহা, বড় গরিব!’ বলিয়া আলবোলার নলে দম কষিলেন।
সুফি সাহেব আমতা আমতা করিয়া বলিলেন : হযরত এর অবস্থা তত গরিব নয়। বেশ ভালো তালুক সম্পত্তি_
পীর সাহেব নলে খুব লম্বা টান কষিয়াছিলেন; কিন্তু মধ্যপথে দম ছাড়িয়া দিয়া মুখে ধোঁয়া লইয়াই বলিলেন : বেটা, তোরা আজিও দুনিয়ার ধন-দওলত দিয়া ধনী-গরিব বিচার করিস। এটা তোদের বুঝিবার ভুল। আমি গরিব কথায় দুনিয়াবি গোরবৎ বুঝাই নাই। মুসলমানদের জন্য দুনিয়ার ধন-দওলত হারাম। এই ধন-দওলত এনসানের রুহানিয়ত হাসেলে বাধা জন্মায়, তার মধ্যে নফসানিয়ত পয়দা করে।
আল্লাহ তায়ালা বলিয়াছেন : (আরবি ও উর্দু) বেশক দুনিয়ার ধন-দওলত শয়তানের ওয়াস-ওয়াসা, ইহা হইতে দূরে পলায়ন করো। কিন্তু দুনিয়ার মায়া কাটানো কি সহজ কথা? তোদের আমি দোষ দিই না। তোদের অনেকেই এখন যেকেরের দরজাতেই পড়িয়া আছিস। যেকরে জলি ও যেকরে খফি এই দুই দরজার যেকের সারিয়া পরে ফেকেরের দরজায় পেঁৗছিতে হয়। ফেকের হইতে যহুর এবং যহুর হইতে মোরাকেবা-মোশাহেদার কাবেলিয়ত হাসেল হয়। খোদার ফজলে আমি আরেফিন, সালেহিন ও সিদ্দিকিনের মোকামাতের বিভিন্ন দায়েরার ভিতর দিয়া যেভাবে এলমে লাদুনি্নর ফলেজ হাসেল করিয়াছি, তোদের কলব অতটা কুশাদা হইতে অনেক দেরি অনেক বলিয়া তিনি হুক্কার নলটা ছাড়িয়া দিয়া সোজা হইয়া বসিলেন এবং চোখ বুজিয়া ধ্যানস্থ হইলেন।
কিছুক্ষণ চোখ বুজিয়া থাকিয়া হাসিয়া উঠিলেন এবং চিৎকার করিয়া বলিলেন : কুদরতে-ইয্দানি, কুদরতে-ইয্দানি। মুরিদরা সব সে চিৎকারে সন্ত্রস্ত হইয়া উঠিলেন।
কিন্তু কেউ কোনো কথা জিজ্ঞাসা করিতে সাহস করিলেন না।

পীর সাহেব চিৎকার করিয়াই আবার চোখ বুজিয়াছিলেন। তিনি এবার ঈষৎ হাসিয়া চোখ মেলিয়া বলিলেন : আমরা কত বৎসর হইল এখানে বসিয়া আছি?
জনৈক মুরিদ বলিলেন : হযরত, বৎসর কোথায়? এই না কয়েক ঘণ্টা হইল।
পীর সাহেব হাসিলেন। বলিলেন : অনেক দেরি_অনেক দেরি। আহা বেচারারা চোখের বাহিরে আর কিছুই দেখিতে পায় না।
অপর মুরিদ বলিলেন : হুজুর কেবলা, আপনার কথা মোটেই বুঝিতে পারিলাম না। পীর সাহেব মৃদু হাসিয়া বলিলেন : অত সহজে কি আর সব কথা বোঝা যায় রে বেটা? চেষ্টা কর্, চেষ্টা কর্।

মুরিদটি ছিলেন একটু আবদেরে রকমের। তিনি বায়না ধরিলেন : না কেবলা, আমাদিগকে বলিতেই হইবে। কেন আপনি বৎসরের কথা জিজ্ঞাসা করিলেন?
পীর সাহেব বলিলেন : ও কথা আমাকে জিজ্ঞাসা করিস না। তার চেয়ে অন্য কথা শোন্। এই যে সাদুল্লাহ (সুফি সাহেবের নাম) একটি ছেলেকে আমার নিকট মুরিদ করিতে লইয়া আসিল, আমি সে কথা কী করিয়া জানিতে পারিলাম? আজ তোমরা তাজ্জব হইতেছ। কিন্তু ইন্শাআল্লাহ, যখন তোমরা মোরাকেবায়ে নেসবতে বায়নান্নাসে তালিম লইবে, তখন অপরের নেসবত সম্বন্ধে তোমাদের কলব আয়নার মতো রওশন হইয়া যাইবে। আল্গরয ইহাও খোদার এক শানে আযিম। সাদুল্লাহ যখন আমার দস্তবুসি করে, তখন তার মুখের দিকে আমার নজর পড়িল এবং সঙ্গে সঙ্গে আমার রুহ সাদুল্লাহর রুহের দিকে মুতাওয়াজ্জোহ হইয়া গেল। সেখানে আমি দেখিলাম, সাদুল্লাহর রুহ আর একটা নতুন রুহের সঙ্গে আলাপ করিতেছে। উহাতেই আমি সব বুঝিয়া লইলাম। আল্লাহু আযিমুশশান।
বলিয়া পীর সাহেব একজন মুরিদকে হুক্কার দিকে ইঙ্গিত করিলেন।

মুরিদ হুক্কার মাথা হইতে চিলিম লইয়া তামাক সাজিতে বাহির হইয়া গেল। পীর সাহেব বলিলেন : তোরা আমার নিজের নুৎফার ছেলের মতো। তথাপি তোদের নিকট হইতে আমাকে অনেক গায়েবের কথা গোপন রাখিতে হয়। কারণ তোরা সে সমস্ত বাতেনি কথা বরদাশ্ত করিতে পারবি না। যেকের ও ফেকের দ্বারা কলব কুশাদা করিবার আগেই কোনো বড়রকমের নূরে তজলি্ল তাতে ঢালিয়া দিলে তাতে কলব অনেক সময় ফাটিয়া যায়। এলমে লাদুনি্ন হাসেল করিবার আগেই আমি একবার লওহে-মাওফুযে উপস্থিত হইয়াছিলাম। তখন আমি মাত্র দায়েরায়ে হকিকতে লাতা আইউনে তালিম লইতেছিলাম। সায়েরে নাযাবির ফয়েজ তখনো আমার হাসেল হয় নাই। কাজেই আরশে-মওয়াল্লার পরদা আমার চোখের সামনে হইতে উঠিয়া যাইতেই আমি নূরে ইয্দানি দেখিয়া বেহুঁশ হইয়া পড়িলাম। তারপর আমার জেসমের মধ্যে আমার রুহের সন্ধান না পাইয়া আমার মুর্শেদ কেবলা_তোরা তো জানিস আমার ওয়ালেদ সাহেবই আমার মুর্শেদ লওহে-মাহফুজ হইতে আমার রুহ আনিয়া আমার জেসমের মধ্যে ভরিয়া দেন এবং নিজের দায়রার বাহিরে যাওয়ার জন্য আমাকে বহুৎ তম্বিহু করেন। কাজেই দেখিতেছিস, কাবেলিয়ত হাসেল না করিয়া কোনো কাজে হাত দিতে নাই। খানিকক্ষণ আগে আমি জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম : আমরা কত বৎসর যাবৎ এখানে বসিয়া আছি? শুনিয়া তোরা অবাক হইয়াছিলি। কিন্তু এর মধ্যে যে ঘটনা ঘটিয়াছে, তা শুনিলে তো আরো তাজ্জব হইয়া যাইবি। সে জন্যই সে কথা বলিতে চাই নাই। কিন্তু কিছু কিছু না বলিলে তোরা শিখবি কোথা হইতে? তাই সে কথা বলাই উচিত মনে করিতেছি। সাদুল্লাহ এখানে আসিবার পর আমি আমার রুহকে ছাড়িয়া দিয়াছিলাম। সে তামাম দুনিয়া ঘুরিয়া সাত হাজার বৎসর কাটাইয়া তারপর আমার জেসমে পুনরায় প্রবেশ করিয়াছে। এই সাত হাজার বৎসরে কত বাদশাহ ওফাত করিয়াছে, কত সুলতানাৎ মেস্মার হইয়াছে, কত লড়াই হইয়াছে, সব আমার সাফসাফ মনে আছে। সেরেফ এইটুকুই বলিলাম; ইহার বেশি শুনিলে তোদের কলব ফাটিয়া যাইবে।

ইতিমধ্যে তামাক আসিয়াছিল।
পীর সাহেব নল হাতে লইয়া ধীরে ধীরে টানিতে লাগিলেন।
সভা নিস্তব্ধ রহিল। কলব ফাটিয়া যাইবার ভয়ে কেহ কোনো কথা জিজ্ঞাসা করিল না।
এমদাদ পীর সাহেবের কথা কান পাতিয়া শুনিতেছিল। কৌতূহল ও বিস্ময়ে সে অস্থিরতা বোধ করিতে লাগিল।
সে স্থির করিল, ইহার কাছে মুরিদ হইবে।

চার

পীর সাহেব অনেক নিষেধ করিলেন। বলিলেন : বাবা, সংসার ছাড়িয়া থাকিতে পারবে না, তাসাউওয়াফ বড় কঠিন জিনিস ইত্যাদি।
কিন্তু এমদাদ তাওয়াজ্জোহ লইল।
পীর সাহেব নিজের লতিফায় যেকের জারি করিয়া সেই যেকের এমদাদের লতিফায় নিক্ষেপ করিলেন।
সে দিবানিশি দুই চোখ বুজিয়া পীর সাহেবের নির্দেশমতো ‘এলহু এলহু’ করিতে লাগিল।
পীর সাহেব বলিয়াছিলেন : খেলওয়াৎ-দর-অঞ্জুমান দ্বারা নিজের কলবকে স্বীয় লতিফার দিকে মুতাওয়াজ্জোহ করিতে পারিলে তার কলবে যাতে আহাদিগয়তের ফয়েজ হাসেল হইবে এবং তার রুহ ঘড়ির কাঁটার ন্যায় কাঁপিতে থাকিবে।
কিন্তু এমদাদ অনেক চেষ্টা করিয়াও তার কলবকে লতিফায় মুতাওয়াজ্জোহ করিতে পারিল না। তৎপরিবর্তে তার চোখের সামনে পীর সাহেবের মেহেদি-রঞ্জিত দাড়ি ও তাঁর রুপা-বাঁধানো গড়গড়ার ছবি ভাসিয়া উঠিতে লাগিল।
ফলে তার কলবে যাতে আহাদিগয়তের ফয়েজ হাসেল হইয়া তার রুহকে ঘড়ির কাঁটার মতো কাঁপাইবার পরিবর্তে ফুফু-আম্মার স্মৃতি বাড়ি যাইবার জন্য তার মনকে উচাটন করিয়া তুলিতে লাগিল।
দিন যাইতে লাগিল।

অনাহারে-অনিদ্রায় এমদাদের চোখ দুটি মস্তকের মধ্যে প্রবেশ করিল। তার শরীর নিতান্ত দুর্বল ও মন অত্যন্ত অস্থির হইয়া পড়িল।
সে বুঝিল, এইভাবে আরো কিছুদিন গেলে তার রুহ বস্তুতই জেস্ম হইতে আযাত হইয়া আলমে-আমরে চলিয়া যাইবে।
সে স্থির করিল : পীর সাহেবের কাছে নিজের অক্ষমতার কথা নিবেদন করিয়া সে একদিন বিদায় হইবে।
কিন্তু বলি বলি করিয়াও কথাটা বলিতে পারিল না।
একটা নতুন ঘটনায় সে বিদায়ের কথাটা আপাতত চাপিয়া গেল! দূরবর্তী একস্থানে মুরিদগণ পীর সাহেবকে দাওয়াত করিল।
প্রকাণ্ড বজরায় এক মণ ঘি, আড়াই মণ তেল, দশ মণ সরু চাউল, তিনশত মুরগি, সাত সের অম্বুরি তামাক এবং তেরো জন শাগরেদ লইয়া পীর সাহেব ‘মুরিদানে’ রওয়ানা হইলেন।
পীর সাহেবের ভ্রমণবৃত্তান্ত ইংরাজিতে লিখিয়া কলিকাতায় সংবাদপত্রে পাঠাইবার জন্য এমদাদকেও সঙ্গে লওয়া হইল। নদীর সৌন্দর্য, নদীপারের প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য এমদাদের কাছে বেশ লাগিল।
পীর সাহেব গন্তব্যস্থানে উপস্থিত হইলেন।

তিনি মুরিদগণের নিকট যে অভ্যর্থনা পাইলেন, তাহা দেখিলে অনেক রাজা-বাদশাহ রাজত্ব ছাড়িয়া মোরাকেবা-মোশাহেদায় বসিতেন।
পীর সাহেব গ্রামের মোড়লের বাড়িতে আস্তানা করিলেন।
বিভিন্ন দিন বিভিন্ন মুরিদের বাড়িতে বিরাট ভোজ চলিতে লাগিল।
পীর সাহেবের একটু দূরে বসিয়া গুরুভোজন করিয়া এমদাদ এত দিনের কৃচ্ছ্রসাধনার প্রতিশোধ লইতে লাগিল। ইহাতে প্রথম প্রথম তার একটু পেটে পীড়া দেখা দিলেও শীঘ্রই সে সামলাইয়া উঠিল এবং তার শরীর হৃষ্টপুষ্ট ও চেহারা বেশ চিকনাই হইয়া উঠিতে লাগিল।
পীর সাহেবের ভাত ভাঙিবার কসরত দেখার সুযোগ ইতিপূর্বে এমদাদের হয় নাই। এইবার সে ভাগ্যলাভ করিয়া এমদাদ বুঝিল : পীর সাহেবের রুহানিশক্তি যত বেশিই থাকুক না কেন, তাঁর হজমশক্তি নিশ্চয়ই তার চেয়ে বেশি।

সন্ধ্যায় পুরুষদের জন্য মজলিশ বসিত।
রাতে এশার নামাজের পর অন্দরমহলে মেয়েদের জন্য ওয়াজ হইত। কারণ অন্য সময় মেয়েদের কাজে ব্যস্ত থাকিতে হয়।
সেখানে পুরুষদের প্রবেশ নিষেধ ছিল।
স্ত্রীলোকদিগকে ধর্মকথা বুঝাইতে একটু দেরি হইত। কারণ মেয়েলোকদের বুদ্ধিসুদ্ধি বড় কম_তারা নাকেল-আকেল।
কিন্তু বাড়িওয়ালার ছেলে রজবের সুন্দরী স্ত্রী কলিমন সম্বন্ধে পীর সাহেবের ধারণা ছিল অন্যরকম। মেয়ে-মজলিশে ওয়াজ করিবার সময় তিনি ইহারই দিকে ঘন ঘন দৃষ্টিপাত করিতেন।
তিনি অনেক সময় বলিতেন : তাসাউওয়াফের বাতেনি কথা বুঝিবার ক্ষমতা এই মেয়েটার মধ্যেই কিছু আছে। ভালো করিয়া তাওয়াজ্জোহ দিলে তাকে আবেদা রাবেয়ার দরজায় পেঁৗছাইয়া দেওয়া যাইতে পারে।
এশার নামাজের পর দাঁড়িয়া চিরুনি ও কাপড়ে আতর লাগানো সুন্নত এবং পীর সাহেব সুন্নতের একজন বড় মো’তেকাদ ছিলেন।
ওয়াজ করিবার সময় পীর সাহেবের প্রায়ই জযবা আসিত।

সে জযবাকে মুরিদগণ ‘ফানাফিল্লাহ’ বলিত।
এই ফানাফিল্লাহর সময় পীর সাহেব ‘জ্বলিয়া গেলাম’ ‘পুড়িয়া গেলাম’ বলিয়া চিৎকার করিয়া চিৎ হইয়া শুইয়া পড়িতেন। এই সময় পীর সাহেবের রুহ আলমে-খাল্ক্ হইতে আলমে-আমরে পেঁৗছিয়া রুহে ইয়াদানির সঙ্গে ফানা হইয়া যাইত এবং নূরে ইয়াদানি তার চোখের উপর আসিয়া পড়িত। কিন্তু সে নূরের জলওয়া পীর সাহেবের চক্ষে সহ্য হইত না বলিয়া তিনি এইরূপ চিৎকার করিতেন।
তাই জযবার সময় একখণ্ড কালো মখমল দিয়া পীর সাহেবের চোখ-মুখ ঢাকিয়া দিয়া তাঁর হাত-পা টিপিয়া দিবার ওসিয়ত ছিল।
এইরূপ জযবা পীর সাহেবের প্রায়ই হইত।
_এবং মেয়েদের সামনে ওয়াজ করিবার সময়েই একটু বেশি হইত।
এইসব ব্যাপারে এমদাদের মনে একটু খটকার সৃষ্টি হইল।
কিন্তু সে জোর করিয়া মনকে ভক্তিমান রাখিবার চেষ্টা করিতে লাগিল।
সে চেষ্টায় সফল হইবার আগেই কিন্তু ও-পথে বাধা পড়িল। প্রধান খলিফা সুফি বদরুদ্দীন সাহেবের সঙ্গে পীর সাহেবকে প্রায়ই কানাকানি করিতে দেখিয়া এমদাদের মনের খটকা বাড়িয়া গেল। তার মনে পীর সাহেবের প্রতি একটা দুর্নিবার সন্দেহের ছায়াপাত হইল।

এমন সময় পীর সাহেব অত্যন্ত অকস্মাৎ একদিন ঘোষণা করিলেন : তিনি আর দু-এক দিনের বেশি সে অঞ্চলে তশরিফ রাখিবেন না।
এই গভীর শোক সংবাদে শাগরেদ-মুরিদগণের সকলেই নিতান্ত গম্গিন হইয়া পড়িল।
জনৈক শাগরেদ সুফি সাহেবের ইশারায় বলিলেন : হুজুর কেবলা, আপনি একদিন বলিয়াছিলেন : এবার এ অঞ্চলের মুসলমানগণকে কেরামতে-নেসবতে বায়নান্নস দেখাইবেন? তা না দেখাইয়াই কি হুজুর এখান হইতে তশরিফ লইয়া যাইবেন? এখানকার মুরিদগণের অনেকেই বলিতেছেন : হুজুর মাঝে মাঝে কেরামত দেখান না বলিয়া উম্মি মুরিদগণের অনেকেই গোমরাহ হইয়া যাইতেছে। মাওলানা লকবধারী ঐ ভণ্ডটা ও-পাড়ার অনেক মুরিদকে ভাগাইয়া নিতেছে; সে নাকি বৎসর বৎসর একবার আসিয়া কেরামত দেখাইয়া যায়।

পীর সাহেব গম্ভীর মুখে বলিলেন : (আরবি ও উর্দু) আল্লাহই কেরামতের একমাত্র মালিক, মানুষের সাধ্য কী কেরামত দেখায়? ওসব শয়তানের চেলাদের কথা আমার সামনে বলিও না। তবে হ্যাঁ, মোরাকেবায়ে-নেসবতে বায়নান্নাস-এর তরকিব দেখাইব বলিয়াছিলাম বটে, কিন্তু তার আর সময় কোথায়?
সমস্ত সাগরেদ ও মুরিদগণ সমস্মরে বলিয়া উঠিল : না হুজুর, সময় করিতেই হইবে, এবার উহা না দেখিয়া ছাড়িব না।
অগত্যা পীর সাহেব রাজি হইলেন।
স্থির হইল, সেই রাতেই মোরাকেবা বসিবে।
সারা দিন আয়োজন চলিল।
রাত্রে মৌলুদের মহফেল বসিল। হযরত পয়গম্বর সাহেবের অনেক অনেক মোওয়াজেযাত বর্ণিত হইল।
মৌলুদ শেষে খাওয়াদাওয়া হইল এবং তৎপর মোরাকেবার বৈঠক বসিল।

পাঁচ

পীর সাহেব বলিলেন : আজ তোমাদের আমি যে মোরাকেবার তরকিব দেখাইব, ইহা দ্বারা যেকোনো লোকের রুহের সঙ্গে কথা বলিতে পারি। আমি যদি নিজে মোরাকেবায় বসি, তবে সেই রুহ গোপনে আমার সঙ্গে কথা বলিয়া চলিয়া যাইবে। তোমরা কিছুই দেখিতে পাইবে না। তোমাদের মধ্যে একজন মোরাকেবায় বসো, আমি তার রুহের দিকে তোমরা যার কথা বলিবে তার রুহের তাওয়াজ্জোহ দেখাইয়া তার রুহের ফয়েজ হাসিল করিব। তৎপর তোমরা যে কেউ তার সঙ্গে কথা বলিতে পারিবে। তোমাদের মধ্যে কে মোরাকেবায় বসিবে?
সকলে মুখ চাওয়াচাওয়ি করিতে লাগিল।
কেউই কোনো কথা বলিল না, মোরাকেবায় বসিতে কেউই অগ্রসর হইল না।
এমদাদ দাঁড়াইয়া বলিল : আমি বসিব।
পীর সাহেব একটু হাসিলেন।
বলিলেন : বাবা, মোরাকেবা অত সোজা নয়। তুই আজিও যে করে খফা-আম করিস নাই, মোরাকেবায় বসিতে চাস?
_বলিয়া তিনি হো হো করিয়া হাসিয়া উঠিলেন।
দেখাদেখি উপস্থিত সকলেই হাসিয়া উঠিল।

লজ্জায় এমদাদের রাগ হইল। সে বসিয়া পড়িল।
পীর সাহেব আবার বলিলেন : কি, আমার মুরিদগণের মধ্যে আজিও কারো এতদূর রুহানি তরক্কি হাসেল হয় নাই, যে মোরাকেবায় বসিতে পারে? আমার খলিফাদের মধ্যেও কেহ নাই?
বলিয়া তিনি শাগরেদদের দিকে দৃষ্টি ফিরাইলেন।
প্রধান খলিফা সুফি সাহেব উঠিয়া বলিলেন : হুজুর কেবলা কি তবে বান্দাকে হুকুম করিতেছেন? আমি তো আপনার আদেশে কতবার মোরাকেবায়-নেসবতে বায়নান্নাসে বসিয়াছি। কোনো নতুন লোককে বসাইলে হইত না?
সুফি সাহেব আরো অনেকবার বসিয়াছেন শুনিয়া মুরিদগণের অন্তরে একটু সাহসের উদ্রেক হইল।
তারা সকলে সমস্বরে বলিল : আপনিই বসুন, আপনিই বসুন।
অগত্যা পীর সাহেবের আদেশে সুফি সাহেব মোরাকেবায় বসিলেন।
পীর সাহেব উপস্থিত দর্শকদের দিকে চাহিয়া বলিলেন : কার রুহের ফয়েজ হাসিল করিব?
মুরিদগণের মুখে কথা যোগাইবার আগেই জনৈক সাগরেদ বলিল : এই মাত্র মৌলুদ-শরিফ হইয়াছে, হযরত পয়গম্বর সাহেবের মোয়াজেযা বয়ান হইয়াছে। তাঁরই রুহ আনা হোক।
সকলেই খুশি হইয়া বলিল : তাই হউক, তাই হউক।
তাই হইল।

সুফি সাহেব আতর-সিক্ত মুখমণ্ডলের গালিচায় তাকিয়া হেলান দিয়া বসিলেন। চারিদিকে আগরবাতি জ্বালাইয়া দেওয়া হইল। মেশক্ যাফরান ও আতরের গন্ধে ঘর ভরিয়া গেল।
পীর সাহেব তাঁর প্রধান খলিফার রুহে শেষ পয়গম্বর হযরত মোহাম্মদের রুহ-মোবারক নাযেল করিবার জন্য ঠিক তাঁর সামনে বসিলেন।
শাগরেদরা চারিদিক ঘিরিয়া বসিয়া মিলিত কণ্ঠে সুর করিয়া দরুদ পাঠ করিতে লাগিল। পীর সাহেব কখনো জোরে কখনো বা আস্তে নানা প্রকার দোয়া কালাম পড়িয়া সুফি সাহেবের চোখে-মুখে ফুঁকিতে লাগিলেন।
কিছুক্ষণ ফুঁকিবার পর শাগরেদগণকে চুপ করিতে ইঙ্গিত করিয়া পীর সাহেব বুকে হাত বাঁধিয়া একদৃষ্টে সুফি সাহেবের বুকের দিকে চাহিয়া রহিলেন।
সুফি সাহেবের বুকের দুইটা বোতাম খুলিয়া তাঁর বুকের খানিকটা অংশ ফাঁক করিয়া দেওয়া হইয়াছিল। পীর সাহেব তাঁর দৃষ্টি সেইখানেই নিবদ্ধ করিলেন।
অল্পক্ষণের মধ্যেই সুফি সাহেবের শরীর কাঁপিতে লাগিল। কম্পন ক্রমেই বাড়িয়া গেল। সুফি সাহেব ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলিতে লাগিলেন এবং হাত-পা ছুড়িতে ছুড়িতে মূর্ছিতের ন্যায় বিছানায় লুটাইয়া পড়িলেন।
পীর সাহেব মুরিদগণের দিকে চাহিয়া বলিলেন : বদর বাবাজির একটু তগ্লিফ হইল! কী করিব? পরের রুহের উপর অন্য রুহের ফয়েজ হাসেল আসানির সঙ্গে করে বেল্কুল না-মোমকেন। যা হউক, হযরতের রুহ তশরিফ আনিয়াছেন। তোরা সকলে উঠিয়া কেয়াম কর।

_বলিয়া তিনি স্বয়ং উঠিয়া পড়িলেন। সকলেই দাঁড়াইয়া সমস্ব্বরে পড়িতে লাগিল : ইয়া নবি সালাম আলায় কা ইত্যাদি।
কেয়াম ও দরুদ শেষ হইলে অভ্যাসমতো অনেকেই বসিয়া পড়িল।
পীর সাহেব ধমক দিয়া বলিলেন : হযরতের রুহে পাক এখনো এই মজলিশে হাজির আছেন, তোমরা কেহ বসিতে পারিবে না। কার কী সওয়াল করিবার আছে করিতে পারো।
এমদাদ একটা বিষয় ধাঁধায় পড়িয়া গেল। সে ইহাকে কিছুতেই সত্য বলিয়া মানিয়া লইতে পারিল না।
_মাথায় এক ফন্দি আঁটিয়া অগ্রসর হইয়া বলিল : কেবলা, আমি কোনো সওয়াল করিতে পারি?
পীর সাহেব চোখ গরম করিয়া বলিলেন : যাও না, জিজ্ঞাসা করো না গিয়া!
_বলিয়া কণ্ঠস্বর অপেক্ষাকৃত মোলায়েম করিয়া আবার বলিলেন : বাবা সকলের কথাই যদি রুহে পাকের কাছে পেঁৗছিত, তবে দুনিয়ার সব মানুষই ওলি-আল্লাহ হইয়া যাইত।
এমদাদ তথাপি সুফি সাহেবের দিকে চাহিয়া বলিল : আপনি যদি হযরত পয়গম্বর সাহেবের রুহ হন, তবে আমার দরুদ-সালাম জানিবেন।
হযরতের রুহ কোনো জবাব দিল না।
পীর সাহেব এমদাদের কাঁধে হাত দিয়া তাকে একদিকে ঠেলিয়া দিয়া বলিলেন : অধিক্ষণ রুহে পাকে রাখা বেআদবি হইবে। তোমাদের যদি কাহারও সিনা সাফ হইয়া থাকে, তবে আসিয়া যেকোনো সওয়াল করিতে পারো।
_বলিতেই পীর সাহেবের অন্যতম খলিফা মওলানা বেলায়েতপুরী সাহেব অগ্রসর হইয়া ‘আসসালামো আলায়কুম ইয়া রসুলুল্লাহ’ বলিয়া সুফি সাহেবের সামনে দাঁড়াইলেন।
সকলে বিস্মিত হইয়া শুনিল সুফি সাহেবের মুখ দিয়া বাহির হইল : ওয়া আলায়কুমস্ সালাম, ইয়া উম্মতি।

মওলানা সাহেব বলিলেন : হে রেসালাত-পনা, সৈয়দুল কাওনায়েন, আমি আপনার খেদমতে একটা আরজ করিতে চাই।
আওয়াজ হইল : শিগগির বলো, আমার আর দেরি করিবার উপায় নাই।
মওলানা : আমাদের পীর দস্তগিরত কেবলা সাহেব নূরে-ইয-দানির জওয়াশা সহ্য করিতে পারেন না, ইহার কারণ কী? তার আমলে কি কোনো গলদ আছে?
কঠোর সুরে উত্তর হইল : হ্যাঁ আছে।
পীর সাহেব শিহরিয়া উঠিলেন। তিনি কাঁদো কাঁদো সুরে নিজেই বলিলেন : কী গলদ আছে, ইয়া রাসুলুল্লাহ? আমার পঞ্চাশ বৎসরের রঞ্জ-কশি কি তবে সব পণ্ড হইয়াছে?
_বলিয়া পীর সাহেব কাঁদিয়া ফেলিলেন।

সুফি সাহেবের অচেতন দেহের মধ্যে হইতে আওয়াজ হইল : হে আমার পিয়ারা উম্মত, ঘাবড়াইও না। তোমার উপর আল্লাহর রহমত হইবে। তুমি মারফত খুঁজিতেছ। কিন্তু শরিয়ত ত্যাগ করিয়া কি মারফত হয়?
পীর সাহেব হাত কচলাইয়া বলিলেন : হুজুর, আমি কবে শরিয়ত অবহেলা করিলাম?
উত্তর হইল : অবহেলা করো নাই, কিন্তু পালনও করো নাই। আমি শরিয়তে চার বিবি হালাল করিয়াছি। কিন্তু তোমার মাত্র তিন বিবি। যারা সাধারণ দুনিয়াদার মানুষ তাদের এক বিবি হইলেও চলিতে পারে। কিন্তু যারা রুহানি ফয়েজ হাসিল করিতে চায়, তাদের চার বিবি ছাড়া উপায় নাই! আমি চার বিবির ব্যবস্থা কেন করিয়াছি, তোমরা কিছু বুঝিয়াছ? চার দিয়াই এ দুনিয়া, চার দিয়াই আখেরাত। চারদিকে যা দেখ সবই খোদা চার চিজ দিয়া পয়দা করিয়াছেন। চার চিজ দিয়া খোদাতায়ালা আদম সৃষ্টি করিয়া তার হেদায়েতের জন্য চার কেতাব পাঠাইয়াছেন। সেই হেদায়েত পাইতে হইলে মানুষকে চার এমামের চার তরিকা মানিয়া চলিতে হয়। এইভাবে মানুষকে চারের ফাঁদে ফেলিয়া খোদাতায়ালা চার কুরসির অন্তরালে লুকাইয়া আছেন। এই চারের পরদা ঠেলিয়া আল্মে-আমরে-নূরে-ইযদানিতে ফানা হইতে হইবে, দুনিয়াতে চার বিবির ভজনা করিতে হইবে।
পীর সাহেব সকলকে শুনাইয়া হযরতের রুহের দিকে চাহিয়া বলিলেন : এই বৃদ্ধ বয়সে আবার বিবাহ করিব?
_তুমি বৃদ্ধ? আমি ষাট বৎসর বয়সে নবমবার বিবাহ করিয়াছিলাম।

পীর সাহেব মিনতি ভরা কণ্ঠে বলিলেন : না রেসালাত-পনা : আমি আর বিবাহ করিব না।
_না করো, ভালোই। কিন্তু তোমার রুহানি কামালিয়ত হাসেল হইবে না, তুমি নূরে-ইযদানির জওয়ালা বরদাশ্ত করিতে পারিবে না। তোমার মুরিদানের কেহই নফসানিয়তের হাত এড়াইতে পারিবে না।
পীর সাহেব হাঁটু গাড়িয়া বসিয়া বলিলেন : আমি নিজের জন্য ভাবি না ইয়া রসুলুল্লাহ; কিন্তু যখন আমার মুরিদগণের অনিষ্ট হইবে, তখন বিবাহ করিতে রাজি হইলাম। কিন্তু আমি এক বুড়িকে বিবাহ করিব।
_তুমি তওবা আসতাগফার পড়ো। তুমি খোদার কলম রদ করিতে চাও? তোমার বিবাহ ঠিক হইয়া আছে। বেহেশতে আমি তার ছবি দেখিয়া আসিয়াছি।
_সে কে, ইয়া রসুলুল্লাহ?

_এই বাড়ির তোমার মুরিদের ছোট ছেলে রজবের স্ত্রী কলিমন।
_ইয়া রসুলুল্লাহ, আমি মুরিদের স্ত্রীকে বিবাহ করিব? সে যে আমার বেটার বউয়ের শামিল।
_ইয়া উম্মতি, আমি আমার পালিত পুত্র যায়েদের স্ত্রীকে নিকাহ করিয়াছিলাম, আর তুমি একজন মুরিদের স্ত্রীকে নিকাহ করিতে পারিবে না?
_ইয়া রসুলুল্লাহ, সে যে সধবা।
_রজবকে বলো স্ত্রীকে তালাক দিতে। কলিমন তোমার জন্যই হালাল। এ মারফতি নিকায় ইদ্দত পালনের প্রয়োজন হইবে না। আমি আর থাকিতে পারি না। চলিলাম। অররহহুমাতুল্লাহ আলায়কুম, ইয়া উম্মতি।
মূর্ছিত সুফি সাহেব একটা বিকট চিৎকার করিলেন। পীর সাহেবের অপর-অপর শাগরেদরা তাঁকে সজোরে পাখার বাতাস করিতে লাগিল।
মুরিদগণের সনির্বন্ধ অনুরোধ সত্ত্বেও পীর সাহেব মাথা নাড়িয়া বলিতে লাগিলেন : চাই না আমি রুহানি কামালিয়ত। আমি মুরিদের বউকে বিবাহ করিতে পারিব না।
গ্রাম্য মুরিদগণ আখেরাতের ভয়ে পীর সাহেবের অনেক হাত-পায়ে ধরিল। পীর সাহেব অটল।
এই সময় প্রধান খলিফা সুফি সাহেব স্মরণ করাইয়া দিলেন : এই নিকাহ না করিলে কেবল পীর সাহেবের একারই রুহানি লোকসান হইবে না, তাঁর মুরিদগণের সকলের রুহের উপরও বহুত মুসিবত পড়িবে।
তখন পীর সাহেব অগত্যা নিজের রেজামন্দী জানাইয়া দাড়িতে হাত বুলাইতে বুলাইতে বলিতে লাগিলেন : ছোবহান আল্লাহ! এ সবই কুদরতে এলাহি! তাঁরই শানে আজিম! আল্লাহপাক নিজেই কোরান মজিদে ফরমাইয়াছেন : (আরবি ও উর্দু)….।
বাপ-চাচা পাড়া-পড়শির অনুরোধে, আদেশে, তিরস্কারে ও অবশেষে উৎপীড়নে তিষ্টিতে না পারিয়া রজব তার এক বছর আগে বিয়া-করা আদরের স্ত্রীকে তালাক দিল এবং কাপড়ের খুঁটে চোখ মুছিতে মুছিতে বাড়ির বাহির হইয়া গেল।

কলিমনের ঘন-ঘন মূর্ছার মধ্যে অতিশয় ত্রস্ততার সঙ্গে শুভকার্য সমাধান হইয়া গেল।
এমদাদ স্তম্ভিত হইয়া বরবেশে সজ্জিত পীর সাহেবের দিকে চাহিয়া ছিল। তার চোখ হইতে আগুন ঠিকরাইয়া বাহির হইতেছিল।
এইবার তার চেতনা ফিরিয়া আসিল। সে একলাফে বরাসনে উপবিষ্ট পীর সাহেবের সম্মুখে উপস্থিত হইয়া তাঁর মেহেদি-রঞ্জিত দাড়ি ধরিয়া হেঁচকা টান মারিয়া বলিল : রে ভণ্ড শয়তান! নিজের পাপ-বাসনা পূর্ণ করিবার জন্য দুইটা তরুণ প্রাণ এমন দুঃখময় করিয়া দিতে তোর বুকে বাজিল না?
আর বলিতে পারিল না। শাগরেদ-মুরিদরা সকলে মার মার করিয়া আসিয়া এমদাদকে ধরিয়া ফেলিল এবং চড়-চাপড় মারিতে লাগিল।
এমদাদ গ্রামের মাতব্বর সাহেবের দিকে চাহিয়া বলিল : তোমরা নিতান্ত মূর্খ। এই ভণ্ডের চালাকি বুঝিতে পারিতেছ না? নিজের শখ মিটাইবার জন্য সে হযরত পয়গম্বর সাহেবকে লইয়া তামাশা করিয়া তাঁর অপমান করিতেছে। তোমরা এই শয়তানকে পুলিশে দাও।
পীর সাহেবের প্রতি এমদাদের বেয়াদবিতে মুরিদরা ইতিপূর্বে একটু অসন্তুষ্ট হইয়া ছিল। এবার তার মস্তিষ্কবিকৃতি সম্বন্ধে তারা নিঃসন্দেহ হইল। মাতব্বর সাহেব হুকুম করিলেন : এই পাগলটা আমাদের হুজুর কেবলার অপমান করিতেছে। তোমরা কয়েকজন ইহাকে কান ধরিয়া গ্রামের বাহির করিয়া দিয়া আসো।
ভূলুণ্ঠিত পীর সাহেব ইতিমধ্যে উঠিয়া আসতাগফেরুল্লাহ পড়িতে পড়িতে তাঁর আলুলায়িত দাড়িতে আঙুল দিয়া চিরুনি করিতেছিলেন। মাতব্বর সাহেবের হুকুমের পিঠে তিনি হুকুম করিলেন : দেখিস বাবারা, ওকে বেশি মারপিট করিস না। ও পাগল। ওর মাথা খারাপ। ওর বাপ ওকে আমার হাতে সঁপিয়া দিয়াছিল। অনেক তাবিজ দিলাম। কিন্তু কোনো ফল হইল না। খোদা যাকে সাফা না দেন, তাকে কে ভালো করিতে পারে?

লেখকঃ আবুল মনসুর আহমদ

আবুল মনসুর আহমেদ
প্রখ্যাত সাহিত্যিক আবুল মনসুর আহমেদ

2 thoughts on “হুজুর কেবলা – আবুল মনসুর আহমদ

  • August 12, 2018 at 5:57 AM
    Permalink

    এসকল মুরিদানে পীর এখন ও সমাজে চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়ছে। ধর্মচেতনার মদে মদমত্ত হয়ে সকল বাস্তব বোধবুদ্ধি বিলুপ্ত।

    Reply
  • September 25, 2018 at 6:41 PM
    Permalink

    বলিষ্ঠ সত্য

    Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *