হেমলক অথবা যীশুর কাঁটার মুকুট

Print Friendly, PDF & Email

সক্রেটিস

প্রাচীন গ্রীসে ৪৭০ খ্রিস্টপূর্বে জন্মগ্রহণ করেন একজন বেটে, কদাকার ব্যক্তি। যার নাম ছিল সক্রেটিস। আধুনিক দর্শন এবং নীতিশাস্ত্রের গুরু বলে পরিচিত এই লোকটিকে চেনে না, তার নাম জানে না, শিক্ষিত সমাজে এরকম লোক খুঁজে পাওয়া এই যুগে কঠিন ব্যাপার। তিনি কে ছিলেন? কেমন ছিলেন? মানব সমাজে তার প্রভাব কতটুকু? তিনি পৃথিবীকে কী দিয়ে গেছেন? তিনি এমন কী আবিষ্কার করেছেন যার কারণে তাকে নিয়ে এত প্রবন্ধ, এত আলোচনা, এত নাটক, এত সাহিত্য সৃষ্টি করা হয়েছে? তিনি কি তার সময়ে খুব জনপ্রিয় ছিলেন? সাধারণ বা আম জনগণ তার সম্পর্কে কী ভাবতো? তিনি কি সে সময়ের মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছিলেন? তার বন্ধু কারা ছিল, আর কারাই ছিল তার শত্রু?

সক্রেটিস পৃথিবীর মানুষের জন্য কোন বই লিখে যান নি। তার সম্পর্কে জানা যায় প্লাতোর ডায়ালগসমূহ, এরিস্তোফেনিসের নাটক এবং জেনোফেনোর ডায়ালগ থেকে। সক্রেটিসেরর বাবা সফ্রোনিস্কাস পেশায় ছিলেন একজন ভাস্কর এবং তার মায়ের নাম ফিনারিটি ছিলেন একজন ধাত্রী। তার স্ত্রীর নাম ছিল জানথিপি, তাদের তিন পুত্র সন্তানের জন্ম হয় যাদের নাম ছিল লামপ্রোক্লিস, সফ্রোনিস্কাস এবং মেনেজেনাস। সক্রেটিস মানুষ হিসেবে অতি সাধারণ মানের ছিলেন। দেখতে কদাকার হওয়ায় এবং কিছুটা অলস প্রকৃতি হবার কারণে সংসারে অশান্তি লেগেই ছিল, খণ্ডারিণী স্ত্রীর অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে মাঝে মাঝেই তিনি বাসায়ও ফিরতেন না। তাঁর মাথায় বড় টাক ছিল, নাক চ্যাপ্টা ছিল। শোনা যায় সে সময়ে তার একজন গেলমানও ছিল। কিন্তু গেলমান থাকাটা মহান সক্রেটিসের মহত্ব একবিন্দুও কমায় না।

soc

তিনি আসলে কী করেছেন?

আজকে আমরা যা কিছু জানি, সমস্ত জ্ঞান বিজ্ঞান একসময়ে কেন্দ্রীভূত ছিল দর্শন শাস্ত্রে। বলা হয় দর্শন সকল জ্ঞানের জননী। সক্রেটিস মূলত দর্শন চর্চা করে গেছেন। তার ছিল তীক্ষ্ণ যুক্তিজ্ঞান, পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা আর তার প্রশ্ন করার গুণ ছিল অনন্যমানের। তিনি অত্যন্ত উঁচুমানের তার্কিক ছিলেন, প্রশ্নের মাধ্যমে তিনি তুলে আনতেন দর্শনের বিভিন্ন দিক। দেখিয়ে দিতেন প্রতিষ্ঠিত ধারণার ত্রুটিসমূহ। দার্শনিক জেনোর ডায়ালেকটিক মেথড ব্যবহার করে তিনি ক্রমাগত প্রশ্নের মাধ্যমে তুলে আনতেন সত্যকে। পূর্ববর্তী সময়ের আরেকজন প্রখ্যাত দার্শনিক জেনো প্রস্তাব করেছিলেন এই দ্বান্দ্বিক পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে প্রথমে প্রতিপক্ষের মত স্বীকার করে নেওয়া হয়, কিন্তু এর পর যুক্তির মাধ্যমে সেই মতকে খণ্ডন করা হয়। এই পদ্ধতির একটি প্রধান কাজ হল প্রশ্ন-উত্তর। সক্রেটিস প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমেই দার্শনিক আলোচনা চালিয়ে যেতেন। প্রথমে প্রতিপক্ষের জন্য যুক্তির ফাঁদ পাততেন এবং একের পর এক প্রশ্ন করতে থাকতেন। যতক্ষণ না প্রতিপক্ষ পরাজিত হয়ে নিজের ভুল স্বীকার করে নেয় ততক্ষণ প্রশ্ন চলতেই থাকত। সক্রেটিসের এই পদ্ধতির অপর নাম সক্রেটিসের শ্লেষ (Socratic irony)।

পদ্ধতি মোতাবেক অধিকাংশ সময় তিনি সে সময়ের তরুণদের কোনো প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে শ্রোতার কাছ থেকে শুনতেন এবং ক্রমাগত পালটা প্রশ্ন করে করে বক্তার বক্তব্যকে অসাড়তা প্রমাণ করতেন। মহান সক্রেটিস হাটে বাজারে, লোক সমাগমে বক্তৃতা করে বেড়াতেন। তার বক্তৃতার অন্যতম বিষয় সমাজে প্রচলিত প্রথার বিরুদ্ধে, রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে, প্রচলিত সব ধর্মের বিরুদ্ধে। প্রচণ্ড যুক্তিতর্ক এবং প্রশ্নের মাধ্যমে তিনি নগ্ন করে দিতেন প্রচলিত সমাজকে, সামাজিক প্রথা আর ধর্মকে, ধর্মজীবীদেরকে, আইন কানুন আর ব্যবস্থাকে আর সেসময়ের প্রভাবশালীদেরকে।

তিনি দেখতে কদাকার ছিলেন, কিন্তু প্রচণ্ড শক্তি আর সাহস নিয়ে নিজের ধারণার কথা উচ্চারণ করতেন, সত্য জানাতেন। যুক্তি আর প্রশ্ন ছিল তার প্রধান অস্ত্র, যে অস্ত্রের সামনে তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থা, ধর্ম, প্রথা আর রাজনীতি অসহায় বোধ করতো। তার এই ক্যারিশমাটিক অস্ত্রের জোরে তিনি ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হয়ে উঠছিলেন, বিশেষ করে সেসময়ের তরুণদের মাঝে। তরুণরা তার বক্তৃতায় প্রচণ্ডরকম আকৃষ্ট হতে শুরু করলো। তার কথা শোনার জন্য বিভিন্ন অঞ্চল থেকে তরুণরা দলে দলে আসতে লাগলো, একটি গণজাগরণের সূচনা হলো। যেই জাগরণ ছিল চিন্তার মুক্তির, বাক-স্বাধীনতা, যুক্তি, দর্শন আর ধর্মবিরোধিতার, যেই জাগরণ ছিল সমস্ত প্রথাকে প্রশ্নবিদ্ধ করার, যুক্তিতর্কের মাধ্যমে সত্যকে সামনে তুলে নিয়ে আসার।

তার শত্রুদের সংখ্যা মোটেও কম ছিল না। তার শত্রুরা ছিল সে সময়ের রাজনীতিবিদগণ, সে সময়ের ধর্মযাজকগণ, যাদের জীবিকা নির্বাহের প্রধান পন্থা ছিল জনগণের মগজ ধোলাই করে মানুষকে মুর্খতার কুয়ায় শেকল দিয়ে আটকে রাখা। তাদের এতদিনকার প্রথা এবং রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি এবং আইনকানুন নিয়ে, দেবদেবী আর অলৌকিক ক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন করতে লাগলেন সক্রেটিস। এরপরে যা হবার, যা এখনও হয়ে চলেছে সেটা হল। তৎকালীন শাসক সমাজ তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আরোপ করলো যে সে তরুণ সমাজকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। তাদের নৈতিকতা নষ্ট করছে। প্রচলিত ধর্মকে অস্বীকার করছে, প্রচলিত দেবতাদের নিয়ে ঠাট্টা করছে, তাদের অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন করে যাচ্ছে। তার বিরুদ্ধে তরুণদের নৈতিকতা ধ্বংস করা, ধর্মবিরোধিতা সহ মানুষকে ধর্মের বিরুদ্ধে খেপিয়ে তোলার অভিযোগ দায়ের করা হয়। বিচারের সভায় সক্রেটিসের কাছে যুক্তিতে ভয়াবহভাবে পরাজিত হবার পরেও সক্রেটিসের শাস্তি হলো হেমলকের বিষে মৃত্যুদণ্ড।

যিনি পাহাড়ের উপর থেকে ছোট্ট একটি পাথর গড়িয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন, তৎকালীন শাসকেরা ভেবেছিল শাস্তির মাধ্যমেই এই কণ্ঠস্বর চিরতরে স্তব্ধ করে দেয়া যাবে। কিন্তু সেই ছোট্ট পাথরে এমন ঢল নামবে এটা তারা কল্পনাও করেনি। এর পরের ইতিহাস সকলেই জানে। সক্রেটিসের যোগ্য শিষ্য প্লেতো, যাকে বলা হয় দর্শন শাস্ত্র যাকে ছাড়া অচল, প্লেতোর যোগ্য শিষ্য আরিস্তোতল, যাকে বলা হয়েছিল সমস্ত জ্ঞান বিজ্ঞানের ধারক, যেই জ্ঞান আরিস্ততলে নেই সেই জ্ঞানের কোন প্রয়োজন মানব সভ্যতার নেই।

সক্রেটিস সেসময়ের প্রচলিত আইনে ‘অপরাধ’ করেছিলেন। রীতিমত ব্লাসফেমীর অপরাধে তিনি অপরাধী ছিলেন। প্রথাগত চিন্তায় তিনি মস্তবড় পাপী ছিলেন। ধর্মকে প্রশ্নবিদ্ধ করা, বিশ্বাস স্থাপন না করে সন্দেহ পোষণ করা নিঃসন্দেহে বিশ্বাসীদের কাছে অপরাধ স্বরূপ। তিনি যুক্তি এবং ন্যায়ের পক্ষে অবস্থান করতেন, স্বর্গের দেবতাদের অস্বীকার করতেন। তিনি বলতেন মৃত্যুর পরে কি হবে কে দেখেছে? তাহলে কেউ কেউ কীভাবে দাবী করছে যে তারা জানে মৃত্যুর পরে কি হবে? তিনি বলতেন, যা জানি না তা মানতেও পারবো না, তাকে ভয়ও পাবো না। তিনি বলতেন অজ্ঞানতা আর ভয় সকল পাপ সৃষ্টি করে, এই অজ্ঞানতা আর ভয়ই ধর্মসমূহের চালিকা শক্তি। একমাত্র জ্ঞানই সেই পাপ দূরীভূত করে। শাসকরা মনে করে জনগণকে অন্ধকারে রাখলেই জনগণ ভাল এবং সুখে থাকবে, শাসকরা তাই মিথ্যা শেখায় মিথ্যা জানায়। কিন্তু মিথ্যা কখনও শান্তি নিয়ে আসতে পারে না।

তাকে হত্যা করা হয় নির্মমভাবে। হেমলক বিষের দ্বারা হত্যার সময় তিনি দীর্ঘ আলোচনা করেছিলেন। প্লেটোর ফিডো গ্রন্থের শেষে সক্রেটিসের মৃত্যুর পর্বের বর্ণনা উদ্ধৃত আছে। কারাগার থেকে পালানোর উদ্দেশ্যে সক্রেটিস ক্রিটোর অনুরোধ ফিরিয়ে দেন। বিষপানের পর সক্রেটিসকে হাঁটতে আদেশ করা হয় যতক্ষণ না তাঁর পদযুগল ভারী মনে হয়। শুয়ে পড়ার পর যে লোকটি সক্রেটিসের হাতে বিষ তুলে দিয়েছিল সে তাঁর পায়ের পাতায় চিমটি কাটে। সক্রেটিস সে চিমটি অনুভব করতে পারেননি। তার দেহ বেয়ে অবশতা নেমে আসে। হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায়। মৃত্যুর পূর্বে তার বলা শেষ বাক্য ছিল: “ক্রিটো, অ্যাসক্লেপিয়াস আমাদের কাছে একটি মোরগ পায়, তার ঋণ পরিশোধ করতে ভুলোনা যেন।”

যীশু

এর অনেকবছর পরে, ইহুদিরা তখন অপেক্ষা করছিল একজন মহান ত্রাণকর্তার, যে পৃথিবীতে এসে তাদের রক্ষা করবে। অত্যাচার অনাচারে ছেয়ে গিয়েছিল তৎকালীন সমাজ। সে সময়ে জন্ম হয় যীশুর। তিনি প্রচলিত ধর্ম এবং প্রথাকে বাতিল ঘোষণা করলেন, এবং স্বপ্ন দেখলেন নতুন সমাজের, যেই সমাজে ক্ষুধা থাকবে না, দারিদ্র থাকবে না। যেই সমাজে ব্যভিচারিণীকে পাথর ছুড়ে হত্যা করা হবে না, দাসদের সাথে অমানবিক আচরণ করা হবে না। যেই সমাজ হবে মানুষের, যেই সমাজ হবে মানবতার। সংঘাত তৈরি হলো সে সময়ের শাসকদের সাথে, কাঁটার মুকুট পরিয়ে তাকে ক্রুশ বিদ্ধ করে হত্যা করলো সম্রাটের লোকজন। এরপরে তারাই আবার যীশুকে ঈশ্বরে পরিণত করলেন, যীশু ক্রমশই পরিণত হল তাদের রাজনীতিতে। নিজেরাই নিয়ম কানুন এবং যীশু সম্পর্কে কল্পকাহিনী বানিয়ে বা পুরনো কল্পকাহিনী এদিক সেদিক করে প্রচার করতে লাগলেন। যীশুকে পরিণত করা হলো কুমারী মাতার অলৌকিক সন্তান হিসেবে, তাকে বানানো হলো ঈশ্বরের পুত্র। অথচ, এই কল্পকাহিনীগুলোর প্রায় সবই প্রাচীন মিশরের খুব পুরনো উপকথা, সেখান থেকে চুরি করে নতুন মিথ তৈরি করা হলো, এবং যীশুকে রাজনৈতিক চরিত্রে পরিণত করলো তারই কিছু অনুসারী। যেই যীশু সে সময়ের প্রথার বিরোধিতা করতে গিয়ে নিহত হলেন, যেই যীশু সেই সময়ের শাসকদের বিরোধিতা করতে গিয়ে নিহত হলেন, তিনিই বনে গেলেন শাসকদের সবচাইতে বড় গুটিতে!

যীশু
যীশু

হাইপেশিয়া

পৃথিবী থেমে থাকে না। নতুন সূর্যের আবার উদয় হয়, পুরনো ধ্যান ধারণা পায়ে দলে নতুন ধারণার জন্ম নেয়, সেই ধারণা থেকে আবার নতুন ধারণার। এভাবেই সভ্যতা এগিয়ে যেতে থাকে। স্থবিরতা কাটিয়ে তরুণরা সৃষ্টি করে গতির, পুরনোকে ভেঙ্গে চুড়ে তারা নতুন সমাজ গঠন করে, পুরনো সমাজ যখন নষ্ট হয়ে উঠতে থাকে, মার্ক্সের সূত্র ধরেই সৃষ্টি হয় বিপ্লবের, দানা বাধতে থাকে নতুন চেতনার। এই তারুণ্য দমিয়ে রাখা কখনই সম্ভব হয় নি।

কিন্তু একই সাথে সেই সক্রেটিসের মতই চলতে থাকে নির্যাতন। ৪১৫ সালে গণধর্ষণের পরে নির্মমভাবে শরীরের অঙ্গ প্রত্যঙ্গকে টুকরো টুকরো করে হত্যা করা হলো দার্শনিক হাইপেশিয়াকে, কিন্তু তার প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে নি ধর্মান্ধরা, মহাবিশ্বে উপবৃত্তাকার পথ তারা ধ্বংস করতে পারেনি। ১৬০০ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি বিজ্ঞানী ব্রুনোকে বাইবেলের বিরুদ্ধে কোপারনিকাসের সূর্যকেন্দ্রিক মতবাদের সমর্থন করার অপরাধে উলঙ্গ করে খুঁটির সাথে বেঁধে আগুনে পুড়িয়ে মারা হয়। আরজ আলী মাতুব্বরকে কোর্টে তোলা হয় প্রশ্ন করার অপরাধে। ধর্মান্ধতা, মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িকতা, কুসংস্কার এবং অশিক্ষার অন্ধকারে নিমজ্জিত সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর কারণে দ্রোহী পুরুষ ড. আহমদ শরীফকে ধর্মান্ধরা মুরতাদ ঘোষণা করেছিল (ইনকিলাব ২৪ অক্টোবর ১৯৯২); হুমায়ুন আজাদকে চাপাতির আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত করা হয় প্রথার বিরুদ্ধে লেখনীর জন্য।

হাইপেশিয়া
হাইপেশিয়া

কিন্তু পৃথিবী সূর্যের চারিদিকেই ঘুরছে। ধর্মান্ধরা পারেনি সূর্যকে পৃথিবীর চারিদিকে ঘোরাতে। আরজ আলী এবং হুমায়ুন আজাদ এখনও বাঙলাদেশের মুক্তমনাদের হৃদয়ে বিরাজমান, হৃদয় থেকে তাদেরকে মুছে ফেলা যাবে না।

কিন্তু সেই মহান সক্রেটিস আর মহান সব মুক্তমনাদের এত অবদানের পরেও মানুষের বিশ্বাস থেমে থাকে না। মানুষ বিশ্বাস করতেই ভালবাসে, প্রশ্ন করতে, যাচাই করতে ভয় পায়। ভয় পায় নতুনকে, প্রথার বিরুদ্ধে তারা যেতে চায় না। তারা সক্রেটিসদেরও বিশ্বাস করে এক একজন পীরে পরিণত করতে চায়। যেটা আমরা দেখেছি আরিস্ততলের সময়ে। আরিস্ততল পৃথিবী কেন্দ্রিক মহাবিশ্বকে সমর্থন দিয়েছিলেন। তার অনুসারীরা ভুলে গিয়েছিলেন মুক্তচিন্তার বীজমন্ত্র, জ্ঞানের প্রাথমিক দর্শন, অবিশ্বাস এবং সন্দেহ-প্রশ্নের মাধ্যমে অনবরত যাচাই করে যাওয়া পুরনো ধারণাকে। তাই আরিস্ততলের পরবর্তী সময়টাকে ইতিহাসে চিহ্নিত করা হয় অন্ধকার যুগ নামে। আরিস্ততলের আমল থেকে শুরু করে মুসলিমদের জাগরণের আগ পর্যন্ত জ্ঞানবিজ্ঞানে তেমন কোন অগ্রগতিই হয় নি। এর কারণ ছিল আরিস্ততলে মানুষের প্রবল বিশ্বাস।

মানুষের এই “বিষ-শ্বাস” মানুষের অগ্রযাত্রাকে বারবার থামিয়ে দিয়েছে। তারা এক সময়ে বিশ্বাস করেছে সূর্যই ঈশ্বর, একসময়ে বিশ্বাস করেছে প্রাকৃতিক ঈশ্বর ধারণাকে। এক সময়ে বিশ্বাস করেছে বহুঈশ্বর, আবার এক সময়ে এক ঈশ্বরকে। প্রতিটা ধারণা থেকে অন্য ধারণায় উত্তরণ হয়েছে প্রশ্নের মাধ্যমে, সন্দেহের মাধ্যমে। একসময় মানুষ সূর্যের পূজা করতো, আগুনের পূজা করতো। একটি সময়ে তাদের সেই সকল ঈশ্বর সম্পর্কে তারা প্রশ্ন করেছে, তাদের ঐশ্বরিক ক্ষমতা নিয়ে সন্দেহ করেছে এবং পুরনো ধারণা বাতিল করে দিয়েছে। এরপরে প্রচলিত হল প্রকৃতির বিভিন্ন বস্তুকে ঈশ্বররুপে পূজা করা। কালক্রমে প্রচলিত এই প্রথাটিকেও মানুষ প্রশ্ন বিদ্ধ করে এবং ছুড়ে ফেলে দেয়। সভ্যতা সামনের দিকে আগায়। এভাবে বহুঈশ্বরবাদ থেকে একেশ্বরবাদের দিকে ধাবিত হয় মানুষ।

বহুঈশ্বর থেকে এক ঈশ্বরে “উত্তরণ” অবশ্যই রাজনৈতিক চিন্তাপ্রসূত। সভ্যতার অগ্রগতির জন্য সে সময়ে একনায়কতন্ত্র গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠায় একেশ্বরের উদ্ভব ঘটে, মানব ইতিহাসে দারুণ এক অগ্রগতির সূচনা হয়। মিশরে এই একেশ্বরবাদের সূচনা হলেও ইহুদিরা এই ধারণা গ্রহণ করে, এবং তারা ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠে। একসময়ে এই ধারণাতেও কিছু যোজন বিয়োজনের প্রয়োজন পরে, তৈরি করা হয় যীশু নামক এক চরিত্রের। যীশুর মৃত্যুর ভেতর দিয়ে যেই সাম্রাজ্যের সূচনা হয়, তা ইতিহাসে অবশ্যই স্মরনীয়। কিন্তু তাতেই থেমে থাকে না সভ্যতা।

মুহাম্মদ

একদিন বর্বর আরবদের দেশে একজন সাধারণ মানুষ বাপদাদার ধর্ম ত্যাগ করে সেই সময়ের সমাজ, ধর্ম, প্রথা এবং সংস্কৃতির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলেন; সেই দেশের প্রচলিত ধর্মের নামে অনাচার, মূর্তিপূজা, মেয়েদের জন্মের সময়ই মাটিতে পুতে ফেলার সংস্কৃতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানালেন। তিনি বললেন, এই সব অনাচার বন্ধ হোক, এই সব আইন মানি না। ধর্মের নামে কোন অনাচার চলতে দেয়া হবে না।

এরপরে শুরু হলো তার উপরে নিদারুণ অত্যাচার। তার অনুসারীদের হত্যা করা হলো, তাকে ভয়ভীতি দেখানো হলো। তাকে বলা হলো প্রচলিত দেবতাদের সম্মান করে কথা বলতে, তাদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত না করতে। কিন্তু তিনি দমে গেলেন না। প্রতিবাদ আর প্রতিরোধে মুখর হলেন। চেষ্টা চালিয়ে গেলেন বর্বর আরবদের বর্বর সব প্রথার বিরুদ্ধে। শক্তিশালী বক্তব্য দিয়ে আঘাত করতে লাগলেন সেই সব প্রথা নামের অনাচারের বিরুদ্ধে। পৌত্তলিক ধর্মগুলোকে প্রশ্ন করলেন, সন্দেহ করলেন, এবং অবিশ্বাস করলেন, বাতিল ঘোষণা করলেন। মূর্তিগুলোর বিরুদ্ধে কথা বললেন। তিনি বললেন ঐ মূর্তিগুলোর ক্ষমতা থাকলে তার ক্ষতি করে দেখাক। সে সময়ে এই ধরণের কথা অত্যন্ত ভয়ংকর পাপ বলে বিবেচিত হতো, ঈশ্বরের অবমাননা বলে বিবেচিত হতো, ঠিক এখন যেমন ধর্মের বিরুদ্ধে কথা বললে ধার্মিকগণ ক্ষেপে ওঠে, সে সময়েও একই অবস্থা ছিল। প্রথা এবং ধর্মবিরোধিতার অভিযোগে তাকে হত্যার চেষ্টা করা হলো। তিনি পালিয়ে গেলেন মদিনায়।
তিনি সে সময়ের প্রচলিত ধর্মের কড়া সমালোচক ছিলেন। মূর্তিপুজার বিরুদ্ধে তিনি প্রকাশ্যে বক্তব্য রাখতেন, প্রচলিত দেবদেবী সম্পর্কে কটাক্ষ করতেন। তৎকালীন আইন অনুসারে সেটাও ছিল ব্লাসফেমী, যেই অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছিলেন সক্রেটিস, গৌতম বুদ্ধ, যীশু, হাইপেশিয়া সহ আরো অনেকেই। তাকে প্রাণভয়ে পালিয়ে যেতে হয়েছিল মদিনায়, যাকে এখনো মুসলমানরা হিজরত বলে স্মরণ করে থাকে।

সেই লোকটির নামই হযরত মুহাম্মদ। সময়টা ৬০০ সালের কিছু পরে। আজও তার অনুসারীরা তার তৈরি প্রথা পালন করে, তাকে অনুসরণ করে। ঠিক যেমনটা মুহাম্মদের সময়কালের আরবের জনগণও পালন করতো তাদের পূর্বপুরুষের তৈরি করে দিয়ে যাওয়া ধর্ম। এরপরে ধীরে ধীরে মুহাম্মদের অনুসারীরাও সেই প্রথাকে আঁকড়ে ধরে রাখলেন। সময়ের সাথে সাথে যে সমস্ত প্রথা এবং ধর্মেরও সংস্কার প্রয়োজন, সব আইনের সংস্কার প্রয়োজন, সেটা বেমালুম ভুলে গেলেন। তাদের কাছে হযরত মুহাম্মদই হয়ে উঠলো আরেক প্রথার নাম। যিনি সমাজ সংস্কার করেছিলেন, যিনি প্রথা ভেঙ্গে ছিলেন, যিনি সে সময়ের ধর্মকে গুড়িয়ে দিয়েছিলেন, তিনিই হয়ে উঠলেন আরেক মূর্তি!!! আরেক প্রথা!!! আরেক ধর্ম!!!

মুহাম্মদ
মুহাম্মদ

ইসলামের মূল আদর্শই ছিল পৌত্তলিক মূর্তি পুজার বিরুদ্ধে। পুরনো দিনের বিখ্যাত মানুষদের ওপর দেবত্ব আরোপ এবং তাদেরকে দেবদেবী জ্ঞান করে, নির্ভুল আর কলঙ্কমুক্ত মনে করে তাদের পুজা করা হতো। ইসলাম সেই সকল মূর্তি পুজার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষনা করে। কিন্তু বর্বর আরবদের প্রতিনিধি মুহাম্মদের প্রধান ভুল ছিল নিজেকেই শেষ দাবী করে যাওয়া। তাই মুসলমানরা তাকেই পরবর্তীতে মূর্তিতে পরিণত করে, তার সমস্ত সমালোচনা এবং তার মতবাদ সম্পর্কে যৌক্তিক আলোচনা নিষিদ্ধ ঘোষনা করে। তার সময়ের পরে প্রচণ্ড অগ্রগতি সাধিত হয় এটা অবশ্যই সত্য, সেই সময়ে জ্ঞান বিজ্ঞানে মুসলিমদের অবদান কিছুতেই অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু সেই যে, সক্রেটিসের সেই বীজমন্ত্র- “সন্দেহ, অবিশ্বাস, যুক্তি, জ্ঞান আর প্রশ্নের মাধ্যমে পুরনো ধারণাকে ধ্বংস করে নতুন ধারণার সৃষ্টি?”

নতুন ধর্মের প্রেরণার প্রাথমিক ধাক্কায় মুসলিম সম্প্রদায় অনেক এগিয়ে গেলেও ধাক্কার জোর শেষ হয়ে যেতেই ঝিমিয়ে পরে। মানুষের মনে কোন প্রশ্ন নেই, অবিশ্বাস নেই, সন্দেহ নেই, জিজ্ঞাসা নেই। সকল প্রশ্নের উত্তর হচ্ছে এসকল বিষয় আল্লাহ তালা ভাল জানেন। অতএব এতকিছু না ভেবে তার উপাসনাতে মন দেয়াই লাভজনক!

হুমায়ুন আজাদ থেকে রাজীব, অভিজিৎ, অনন্ত, বাবু, নীলয়

মানুষ একের পর এক বিশ্বাস করে যেতে থাকে। কিছু মানুষ সবসময়ই বিশ্বাসের পক্ষে। সক্রেটিসের সময়ে যেই লোকটি বিচারের দায়িত্বে ছিল, সে সেই সময়ের প্রচলিত ধর্ম এবং প্রথায় বিশ্বাসী ছিল। হাইপেশিয়া থেকে ব্রুনো-হুমায়ুন আজাদ সকলেই সেই সব বিশ্বাসীদের দ্বারাই নিহত হয়েছেন। একই ভাবে মুহাম্মদের আমলেও সেই সময়ে প্রচলিত ধর্মে বিশ্বাসী ছিল আবু জেহেল এবং অন্যান্য কাফেরগণ। হযরত মুহাম্মদ ছিলেন প্রচলিত ধর্ম আর প্রথার বিরুদ্ধে দাড়িয়ে থাকা এক অসীম সাহসী সৈনিক, যিনি হার মানেন নি। যেমন ছিলেন হুমায়ুন আজাদ, যেমন ছিলেন রাজীব হায়দার, অভিজিৎ রায়, অনন্ত বিজয়, ওয়াশিকুর বাবু, নীলয় নীল সহ আরো অনেকে।

 হুমায়ুন আজাদ
হুমায়ুন আজাদ

অভিজিৎ রায়, আধুনিক বাঙলাদেশের মুক্তমনা আন্দোলনের প্রাণপুরুষ। অসংখ্য মানবদরদী মানবতাবাদী মুক্তচিন্তকের মতই তিনি কঠোরভাবে সমালোচনা করেছেন সমাজের নানা প্রথার, ধর্মীয় মতাদর্শের। তিনি যুক্তির ছুরি চালিয়ে ছিড়ে ফালাফালা করেছেন এক একজন মহামানবকে। দেখিয়ে দিয়েছেন সেই সব কথিত মহাপুরুষ আসমান থেকে নামা কোন প্রেরিত পুরুষ নয়, নিতান্তই সাধারণ মানুষ ছিল। তার যুক্তির সামনে বড় বড় কথিত ঈশ্বর দাঁড়াতে পারে নি, তার কলম কিবোর্ডের সামনে আল্লাহ ভগবান ঈশ্বর সকলেই গলা ধরাধরি করে কেঁদেছে। আল্লাহর আরশ তিনি কাঁপিয়ে লণ্ডভন্ড করে দিয়েছে সামান্য কলমের খোঁচায়। তার কলম থেকে রক্ষা পায় নি কোন ধর্মের ঈশ্বর, কোন ধর্মের অবতার বা পয়গম্বরই। তাই তো তাকে হত্যা করে অসহায় ঈশ্বরকে রক্ষা করতে চেয়েছে ধর্মান্ধরা। কারণ তারা নিজেরাও জানে, সেই সব কথিত ঈশ্বর নিজেদের রক্ষা করতে সক্ষম নয়। এক অভিজিৎ রায়ের কলমই তাদের সমস্ত সর্বশক্তিমান ঈশ্বরদের চাইতে শক্তিশালী।

প্রথাবিরোধী মানুষেরা

প্রথাবিরোধীরা এভাবেই প্রথার রক্ষকদের হাতে নিহত হয়েছেন নির্যাতিত হয়েছেন যুগে যুগে। ইসলামে বিশ্বাসীগণ হযরত মুহাম্মদকে নিজেদের সম্পত্তি মনে করে এক ধরনের আত্মপ্রসাদ লাভ করেন। কিন্তু হযরত মুহাম্মদ একজন প্রথাবিরোধীর নাম, প্রচলিত ধর্মে অনাস্থাজ্ঞাপনকারী একজন বিপ্লবীর নাম। তিনি সে সময়ের ধর্মান্ধ কুরাইশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন, তাদের বিশ্বাসের ভিত্তি ৩৬০ টা মূর্তি ধ্বংস করেছেন। সমূলে উৎখাত করেছেন সে সময়ে প্রচলিত বিভিন্ন প্রথা আর নিয়মকে, তৈরি করে দিয়েছেন নতুন নিয়ম। তার সময়কালে তার বিরুদ্ধে কম ষড়যন্ত্র হয় নি, তার বিরুদ্ধে কম অপপ্রচার চালায় নি কুরাইশরা। কিন্তু তিনি তার মতাদর্শে অটল ছিলেন। তিনি জানতেন তিনি এক বিশাল পরিবর্তন করতে যাচ্ছেন, প্রচলিত প্রথা আর ধর্মগুলোর শেকড়ে কুঠারাঘাত করায় প্রথার রক্ষকরা তাকে ছেড়ে কথা বলবে না।

কোন মহাপুরুষের মতবাদকে প্রশ্ন করা যাবে না, আঘাত করা যাবে না, অবিশ্বাস করা যাবে না, যা সেই বীজমন্ত্র-“সন্দেহ, অবিশ্বাসের মাধ্যমে পুরনো ধ্যান ধারণাকে ধ্বংস করে নতুন সৃষ্টি”কেই নস্যাৎ করে দেয়। হযরত মুহাম্মদ নিজেও যে কাজের জন্য সংগ্রাম করেছেন, সে সময়ের মানুষের বিশ্বাসে আঘাত করেছেন।
ছোটবেলা একটা গল্প মায়ের মুখে শুনতাম। গল্পটা মহানবী আর এক ইহুদী বুড়ির গল্প। এক ইহুদী বুড়ি রোজ মহানবীর নামাজে যাবার পথে কাঁটা বিছিয়ে রাখতো, মহানবী নামাজে সিজদা করার সময় পিঠে উটের নাড়িভুঁড়ি চাপিয়ে দিতো, নানান অত্যাচার করতো, অশ্রাব্য ভাষায় গালাগালি করতো। কিন্তু মানবদরদী মহানবী তাকে কিছুই বলতেন না। একদিন মহানবী দেখলেন, তার রাস্তায় কাঁটা নেই, তিনি তো হতবাক! নামাজ বাদ দিয়েই দৌড়ে গেলেন বুড়ির বাসায়। গিয়ে দেখেন বুড়ি অসুস্থ। এরপরে মানবতাবাদী মহানবী বুড়ির সেবা শুশ্রূষা করলেন, ভাল করে তুললেন। মহানবীর এই মানবপ্রেম দেখে ইহুদী বুড়ি পরে ইসলাম গ্রহণ করলো।
গল্পটা অসাধারণ। ছোটবেলা যখন গল্পটা শুনতাম, তখন আবেগে চোখ দিয়ে পানি বের হয়ে যেত। আহা, মহানবী কত ভালমানুষই না ছিলেন। ধর্ম বর্ণ সবাইকে সমান ভালবাসতেন। এরকম মানুষই তো পৃথিবীর জন্য দরকার। ছোটবেলা তাই মহানবীকে খুব ভালবাসতাম। আমার মা এরকম আরো নানান গল্প বলতেন মহানবীকে নিয়ে। শুনতাম আর মুগ্ধ হয়ে ভাবতাম, আমিও মহানবীর মত মানবদরদী হবো। আমাকেও কেউ গালাগালি, কটাক্ষ করলে আমি তাকে ভালবাসা দিয়ে উত্তর দেবো। কোনদিন তাদের হত্যা করবো না।
একটু বড় হবার পরে এই গল্পটা আরো বিস্তৃতভাবে জানার জন্য কোরআন পড়তে শুরু করলাম, স্বাভাবিকভাবেই ধারণা ছিল কোরআন হাদিস এই ধরণের ঐতিহাসিক সত্য ইতিহাসে পরিপূর্ণ থাকবে। কিন্তু কোরআন হাদিসগুলো সব তন্ন তন্ন করে খুঁজলাম। কোথাও এরকম কিছু খুঁজে পেলাম না। আমি খুব খুশি হতাম যদি আসলেই ঘটনাগুলো এরকম হতো, মহানবী তার সমালোচক, তাকে গালাগালি করা, তার বিরুদ্ধে কবিতা লেখা, তার সমালোচনা করা, তার উপরে অত্যাচার করা সবাইকে ভালবাসা আর প্রেম দিয়ে জয় করে ফেলতেন। মানবতার জয়গান গাইতেন। কোরআন, হাদিস, এবং অন্যান্য ইসলামি ইতিহাসে মহানবী আসলে তার সমালোচকদের, তাকে কটাক্ষকারীদের সাথে কী আচরণ করেছিলেন, তা খুঁজে দেখা তাই আমার জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। কিন্তু আশ্চর্য বিষয় হচ্ছে, হাদিস গ্রন্থগুলো ঘেঁটে একেবারেই ভিন্ন এক মুহাম্মদকে আবিষ্কার করলাম!
যেমন একটি ঘটনাঃ
সুনানে আবু দাউদ শরীফে হাদিসে বর্ণিত হয়েছে- মহানবীকে গালি দেওয়ার অপরাধে এক অন্ধ সাহাবী তার স্ত্রীকে হত্যা করে ছিলেন।
অন্ধ সাহাবী দাঁড়ালেন মানুষকে অতিক্রম করে সে কাঁপতে ছিল এমনকি রসূলের সামনে বসে পড়লেন এবং বললেন, হে আল্লাহর রসূল ! আমি ঐ মহিলার স্বামী সে আপনাকে গালি দিত এবং আপনার নিন্দা করত। আমি তাকে নিষেধ করতাম সে বিরত হত না এবং আমি তাকে ধমক দিতাম কিন্তু সে থামতো না, সে আমার প্রিয় সঙ্গিনী ছিল, তার থেকে আমার দুইটা মুক্তার মত ছেলে আছে। গতকল্য সে আপনাকে গালি দিচ্ছিল এবং দোষারোপ ও নিন্দা করছিল। অতঃপর আমি ছুরি নিয়ে তার পেটে রেখে তার উপর ভর দিয়ে এমনকি আমি তাকে হত্যা করেছি। তখন নবী ছল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম বললেন : ” তোমরা সাক্ষী থাক ঐ মহিলার রক্ত বৃথা হয়ে গেল”।(আবু দাউদঃ ৪৩৬১)

হেমলক


কয়েকবছর আগে আমাদের দেশে একটি ভয়ংকর ঘটনা ঘটে গিয়েছিল। আমাদের একজন প্রধানতম কবি, ভাষাবিজ্ঞানী এবং সাহিত্যিক ডঃ হুমায়ুন আজাদকে চাপাতি দিয়ে বইমেলার সামনে কোপানো হয়েছিল। যারা কুপিয়েছে, তারা ছিল ইসলামি মৌলবাদী, যারা হুমায়ুন আজাদের একটি উপন্যাস “পাক সার জমিন সাদ বাদ” এর বক্তব্য সহ্য করতে পারে নি। তাই অত্যন্ত নির্মমভাবে এই প্রথাবিরোধী মানুষটিকে তারা কুপিয়েছে এবং পরবর্তীতে হত্যাও করেছে। হ্যাঁ, এটাকে আমি হত্যাই বলবো, হুমায়ুন আজাদের স্বাভাবিক মৃত্যু হয় নি। হুমায়ুন আজাদ বলেছিলেন, এই আক্রমণের পিছনে হাত রয়েছে জামাত নেতা দেলোয়ার হোসেন সাইদীর, কিন্তু দেলোয়ার হোসেন সাইদীকে এই মামলায় গ্রেফতার করা হয় নি।
ধর্মান্ধ মৌলবাদীরা নির্বোধ, কারণ হুমায়ুন আজাদকে যদি কোপাতেই হয়, কোপানো উচিত ছিল তার “শুভব্রত, তার সম্পর্কিত সুসমাচার”-উপন্যাসটির জন্য। তাকে যদি কোপাতেই হয়, কোপানো উচিত ছিল তার “নারী”-গ্রন্থটির জন্য। এই দুইটি গ্রন্থের তুলনায় “পাক সার জমিন সাদ বাদ” নিতান্তই শিশু, কিন্তু ধর্ম যারা পালন করেন তাদের বুদ্ধিবৃত্তি যে কতটা নিচু সেটা তারা বুঝিয়ে দিলেন। শুভব্রত তাদের মস্তিষ্কে প্রবেশ করেনি, নারী পড়ে ধর্মদণ্ড উত্তেজিত না হয়ে হয়ত অন্য কিছু উত্তেজিত হয়েছে। কারণ এটাই তাদের কাজ, উত্তেজনা ছাড়া তাদের আর কিছুই নেই। তাদের সমস্ত অস্তিত্ব জুড়ে উত্তেজনা আর উত্তেজনা, পরকালে হুর সঙ্গমের স্বপ্নে যৌন উত্তেজনা, তার সাথে মেলে ধর্মতত্ত্ব। অথবা দুটোই একই রকমের উন্নতমম-শির, বোরখা না দেখলেই উত্তেজনা-হিজাব না দেখলেই উত্তেজনা-মেয়েদের চুল দেখা গেলেও তাদের উত্তেজনা। উত্তেজনার যেন শেষ নেই, তাদের ধর্মীয় এবং যৌন উত্তেজনা পরস্পর পরিপূরক।
শান্তি প্রতিষ্ঠা কখনও রক্তপাতের মাধ্যমে সম্ভব নয়। রক্তপাত এবং হত্যার মাধ্যমে যারা শান্তি কায়েমের স্বপ্ন দেখেন, তারা আসলে জানেন না, শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য রক্তপাত এবং কারো সম্ভ্রম রক্ষার জন্য ধর্ষণ একই অর্থ বহন করে। ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় এক মার্কিন জেনারেলকে একটি গ্রাম পুরোপুরি ধ্বংস করে দেয়ার কারণ জিজ্ঞেস করা হয়েছিল। উত্তরে সেই জেনারেল বলেছিলেন, ভিয়েতকঙ্গদের হাত থেকে গ্রামটিকে রক্ষার জন্যই তারা পুরো গ্রামটিকে ধ্বংস করে দেয়!
আমরা যারা সভ্য মানুষ বলে নিজেদের দাবী করি, তারা সবসময়ই বলি, মতের বিরুদ্ধে মত প্রকাশ করতে হবে, লেখার বিরুদ্ধে লিখে প্রতিবাদ জানাতে হবে, কবিতার বিরুদ্ধে কবিতা লিখে বা সমালোচনা করে তার প্রতিবাদ জানাতে হবে। কোনভাবেই কেউ কিছু লিখলে সেই লেখককে আক্রমণ করা যাবে না, নির্যাতন করা যাবে না। এটা সভ্য সমাজে বাস করার অন্যতম অলিখিত নিয়ম। মানুষ তার বাক-স্বাধীনতার চর্চা করবে, এবং আপনারও অধিকার রয়েছে কোনকিছু গ্রহণ না করার, আপনি তা বর্জন করুন বা তার প্রচণ্ড সমালোচনা করুন। কিন্তু আপনি আমার বিরুদ্ধে হাজার হাজার শব্দ ব্যবহার করে আমাকে আক্রমণ করলেও আপনার উপরে কখনই শারীরিক আক্রমণ চালাবো না। কারণ আমি নিজেকে সভ্য মানুষ বলে দাবী করি, এবং একজন চিন্তাশীল সভ্য মানুষ সর্বদা কলমকেই অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করবে, চাপাতি বা তরবারিকে নয়।
১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর বাঙলাদেশের ঘাতক দালাল রাজাকার আলবদর বাহিনী এদেশের নামকরা সব বুদ্ধিজীবীকে নিয়ে গিয়ে হত্যা করেছিল। এই জাতিকে একটি মেধাশূন্য, বুদ্ধিহীন, ধর্মান্ধ, কুসংস্কারাচ্ছন্ন জাতি হিসেবে অন্ধকূপে আটকে রাখার জন্যেই তারা এই কাজ করেছিল। মুক্তচিন্তা, মুক্তবুদ্ধি সর্বদাই তাদের শত্রু। তারা রাজনীতি করে, তারা ধর্ম পালন করে। তারা রাজনীতি দখল করতে চায়, তারা ধর্ম দখল করতে চায়। এবং এভাবেই তারা সবসময় মানুষকে দাসত্বের শৃঙ্খলে আটকে রাখতে চায়, আর সাধারণ মানুষও সেই শেকল গলায় ঝুলিয়ে দাসত্ব করে যায়। আর আমাদের প্রগতিশীল মুক্তমনা বুদ্ধিজীবী সমাজ সর্বদাই সেই সকল ধর্মান্ধ রাজনীতিবিদদের মুখোশ জনগণের সামনে খুলে দেয়। এই কারণেই তারাই ধর্মান্ধদের রোষানলে পরে সবচাইতে বেশি। এই কারণেই তারা আহমদ শরীফকে মুরতাদ খেতাব দেয়, আরজ আলীকে কোর্টে ওঠায়, জাহানারা ইমামকে জাহান্নামের ইমাম নাম দিয়ে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা দেয়, এই কারণেই কবি শামসুর রাহমানের বাড়িতে গিয়ে তারা আক্রমণ করে। এই চক্র অনেক প্রাচীন।
স্বাভাবিকভাবেই একজন উদারমনা ধার্মিক মানুষ মনে করেন, এই ধরণের কর্মকাণ্ডের সাথে ইসলাম বা কোন ধর্মের কোন সম্পর্ক নেই। এই সবই গুটিকয়েক মৌলবাদীর কাজ, তারা ধর্মকে নিজ স্বার্থে ব্যবহার করে। আমরাও তাদের কথা মেনে নিই। কিন্তু আসলেই কি ধর্ম এই ধরণের মৌলবাদী কর্মকাণ্ডের সমর্থন দেয়, কি দেয় না, আমরা তা কখনই যাচাই করে দেখি না।
সাইদী নামক জামাতের নেতাটির নির্দেশে এই হত্যাকাণ্ড হয়েছে, এটা এখন কমবেশি সকলেই জানেন। সাইদী ডঃ হুমায়ুন আজাদের বইটির খানিকটা পড়েই হুকুম দিয়েছিলেন তাকে হত্যা করতে। কারণ ছিল, এই বইটিকে ডঃ আজাদ খুব স্পষ্ট করে মৌলবাদীদের চরিত্র অংকন করেছিলেন, তাদের কদর্য জীবন তুলে ধরেছিলেন। কিন্তু এই ঘটনাকে কি ইসলাম সমর্থন করে? নিশ্চিতভাবেই বলতে পারি, শতকরা ১০০% জন মুসলিম বলে উঠবে, না, এই কর্মকাণ্ডের সাথে ইসলামকে জড়ানো যাবে না। এই ১০০% এর মধ্যে একটি বিশাল অংশ হয়তো মনে মনে হাসবে, এবং বলবে ভালই হয়েছে, এই লেখককে হত্যাই করা উচিত। কিন্তু মুখে বলবে, না-এর সাথে ইসলামের কোন সম্পর্ক নেই।
তাদের কথা মেনে নিচ্ছি। কিন্তু কথা হচ্ছে, এগুলো কী আসলেই ইসলাম সম্মত খুন? ইসলাম সম্মত আক্রমণ? মহানবী তার সমালোচকদের সাথে কেমন আচরণ করতেন? মহানবী তার উম্মতদের কী শিক্ষা দিয়ে গেছেন যার জন্য কিছু হলেই মুমিন মুসলমানগণ নাড়ায়ে তাকবীর আল্লাহু আকবর বলে চাপাতি হাতে কল্লা নামিয়ে দিতে প্রস্তুত থাকে? মহানবী যদি সেই বুড়িকে সেবা করে ভালবাসা দিয়ে জয় করে থাকে, তার উম্মতরা কোপাকুপির শিক্ষা পেল কোথা থেকে?
সত্য হচ্ছে, মুহাম্মদ নিজেও সমালোচনা একেবারেই সহ্য করতে পারতেন না। হযরত মুহাম্মদের জীবনীতেও যে ঠিক একই রকম অনেকগুলো ঘটনার বর্ণনা পাওয়া যায়, সেটা সম্ভবত আমাদের উদারমনা মুসলিমরা ভালভাবে জানেনই না। ঠিক একই ধরণের ঘটনা ঘটেছিল সেই সময়ে আরবে, এবং আজকে সাইদী যা করেছিল, ঠিক একই কাজ করেছিল মধ্যযুগে ইসলাম ধর্মের মহান পয়গম্বর হযরত হযরত মুহাম্মদ, যার বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায় বিভিন্ন হাদিস এবং মুহাম্মদের প্রথম জীবনী ইবনে ইসহাকের সিরাতে রাসুলাল্লাহ গ্রন্থতে।

ঘটনা ১
আবু আফাক ছিলেন একজন ইহুদি কবি, খুব সম্ভবত তিনি এক’শ বছর বয়সী বৃদ্ধ ছিলেন, অথবা তার কিছু কম বেশি। তিনি ইসলাম গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানান এবং একই সাথে তিনি ছিলেন হযরত মুহাম্মদ ও ইসলামের আগ্রাসী ও যুদ্ধংদেহী চরিত্রের সমালোচক। মুহাম্মদের সমালোচনা করে তিনি লিখেছিলেনঃ
Long have I lived but never have I seen
An assembly or collection of people
More faithful to their undertaking
And their allies when called upon
Than the sons of Qayla when they assembled,
Men who overthrew mountains and never submitted,
A rider who came to them split them in two (saying)
“Permitted”, “Forbidden”, of all sorts of things.
Had you believed in glory or kingship
You would have followed Tubba.
তথ্যসুত্রঃ Alfred Guillaume’s translation of Ibn Ishaq’s prophetic biography, chapter “Salim b. Umayr’s expedition to kill Abu Afak”
এই কবিতাটি শোনার সাথে সাথে হযরত মুহাম্মদ চিৎকার দিয়ে বলে উঠেছিলেনঃ “কে আমার জন্য এই বদমাশকে শাস্তি দেবে?”। ফলশ্রুতিতে মহানবীর অনুসারী সেলিম বিন উমায়ের তলোয়ার নিয়ে গিয়ে হত্যা করলেন আবু আফাককে! এত বৃদ্ধ একজন মানুষকেও রেহাই দেয়া হয় নি, এই বৃদ্ধ তো কাউকে একটি চড় মারার মত সামর্থ্যবানও ছিল না!

ইবনু হিশাম এখানে সারিইয়া সালেম বিন ওমায়েরকে আগে এনেছেন। তিনি বলেন, হারেছ বিন সুওয়াইদ বিন ছামেতকে হত্যা করার পর আবু ‘আফাক-এর মুনাফেকী স্পষ্ট হয়ে যায় এবং সে মুসলমানদের বিরুদ্ধে কুৎসা গেয়ে কবিতা বলে। তখন রাসূল (ছাঃ) তাকে হত্যার আদেশ দেন (ইবনু হিশাম ২/৬৩৫-৩৬)। অতঃপর আবু ‘আফাক-এর হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে ‘আছমা বিনতে মারওয়ান আল-খিত্বমিয়াহ মুনাফিক হয়ে যান এবং ইসলাম ও ইসলামের নবী (ছাঃ)-এর বিরুদ্ধে কুৎসা গেয়ে কবিতা বলেন। তখন রাসূল (ছাঃ)-এর নির্দেশে ওমায়ের বিন ‘আদী তাকে হত্যা করেন (ইবনু হিশাম ২/৬৩৬-৩৭)।
ঘটনা ২
ইবনে আল আশরাফ ছিলেন একজন ইহুদি গোত্রের প্রধান এবং একজন কবি। তিনিও ছিলেন তৎকালীন ইসলামিক জিহাদ, ইসলাম ও মুহাম্মদের সমালোচক। তিনি কবিতা লিখে সমালোচনা করতেন, একই কায়দায় মুহাম্মদের হুকুমে তাকেও হত্যা করা হয়, রাতের অন্ধকারে, চোরাগোপ্তা আক্রমণের মাধ্যমে।

ঘটনা ৩
ইয়াযিদ ইবনে যায়েদ ইবনে হিসান আল-খাতমির স্ত্রী আসমা বিনতে মারওয়ান ছিলেন ইসলাম এবং মুহাম্মদের সমালোচক। তিনি কবিতার মাধ্যমে সমালোচনা করতেন, মুহাম্মদের যুদ্ধ এবং কাফের নিধনের বিরুদ্ধে তিনি একটি কবিতা রচনা করেন, তা ছিলঃ
“তোমরা এক বিদেশীর বশীভূত হয়েছ আর তার উৎসাহে মালামালের লোভে খুন করছো। তোমরা সব লোভী মানুষ তোমাদের মধ্যে কি সামান্যতম আত্মসম্মানও নেই?”
এই কবিতা কানে আসার পর হযরত মুহাম্মদ বললেন, “তোমাদের মধ্যে কে আছে যে এই মহিলাকে খুন করবে?”
উমায়ের বিন আল-খাতমি নামের এক সাহাবী একথা শোনার সাথে সাথে সে রাতেই সেই মহিলার বাড়িতে গিয়ে তাঁকে হত্যা করেন। এই মহিলা কবি তখন তাঁর শিশুসন্তান পরিবেষ্টিত হয়ে ঘুমচ্ছিলেন। একটি শিশু তখন তার মায়ের স্তন্যপান করছিলো, উমায়ের সেই দুগ্ধপানরত শিশুটিকে সরিয়ে মহিলার বুকে তার তলোয়ার আমূলবিদ্ধ করে হত্যা করেন।
পরদিন সকালে উমায়েরের সাথে দেখা হলে হযরত মুহাম্মদ তাঁকে বলেন, “তুমি আল্লাহ আর তার নবীকে সাহায্য করেছ।” উমায়ের বলেন, “তার পাঁচটি ছেলে ছিল; আমার কি অনুশোচনা করা উচিৎ?” হযরত মুহাম্মদ উত্তর দেন, ” না, কারণ তার মৃত্যু আর দুটো ছাগলের ঢুঁশোঢুঁশি করা সমান।”
(In the morning he came to the apostle and told him what he had done and he (Muhammad) said, “You have helped God and His apostle, O Umayr!” When he asked if he would have to bear any evil consequences the apostle said, “Two goats won’t butt their heads about her”, so Umayr went back to his people.)
তথ্যসূত্র: ইবনে সা’দ কিতাব আল-তাবাকাত আল-কবির অনুবাদ এস. মইনুল হক, ভল্যুম ২, পৃ. ৩১

এখানেই শেষ নয়, এরকম উদাহরণ অসংখ্য, অসংখ্য। কয়েকটা উদাহরণ দিচ্ছি।
আবু রাফে হত্যাঃ মুহাম্মদকে বিদ্রূপ করার দায়ে হত্যার আদেশ দেয়া হয় এবং তার দুর্গের ভিতর শয়নকক্ষে ঢুকে হত্যার আদেশ কার্যকর করে মহানবীর সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে আতিক ও অন্যান্যরা।
(বুখারী হাদিস)
আব্দুল্লাহ বিন কাতাল ও তার দুই নর্তকী দাসী হত্যাঃ বুখারী,তাবারী, ইবন ইসহাকের বর্ণনামতে, মক্কা বিজয়ের পর মহানবীকে কে কটাক্ষ করে, অপমান করে গান গাওয়ার কারণে শুধু হত্যার আদেশই নয়, প্রকাশ্যে হত্যার আদেশ (যদিও কাবার গিলাফ ঝুলে আশ্রয় চায় তবুও) দেয়া হয়। এসময় এটাও বলা হয় যে, ক্রীতদাসী যাদের স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি নেই, অন্যের অনুগত তাদেরকেও হত্যা করতে হবে।
আর যিনি এই হত্যাকাণ্ডগুলো সম্পন্ন করে মহানবীর প্রিয়পাত্রতে পরিণত হয়েছিলেন, তিনি হচ্ছেন সাঈদ ও আবু বারযাহ।
আল হুয়াইরিদ বিন নুকাইদঃ ইবন সাদ রচিত‘কিতাব আল তাবাকাত আল কাবির’থেকে জানা যায়, তার কথা শুনে মুহাম্মদ কষ্ট পেয়েছিলেন, তাই মুহাম্মদ তাকে হত্যার হুকুম দিয়েছিলেন। এই কথা শুনে হযরত আলী লোকটার বাসায় গেলে বলা হয়, লোকটি বাড়িতে নেই। এ মিথ্যা কথা শুনে আলী তার ঘরের পিছনে লুকিয়ে ছিলেন, পরবর্তীতে তাকে হত্যা করেন আলী।
এই ধরণের চোরাগোপ্তা হামলা এবং হত্যা করা বর্বর বেদুইনদের আরবের অত্যন্ত প্রাচীন রীতি, তারা সুপ্রাচীন কাল ধরেই এর চর্চা করে আসছে। এবং এই সংস্কৃতি আমাদের দেশে ঢোকার ফলেই আমাদের বুদ্ধিজীবী, কবি, সাহিত্যিকদের উপরেও নেমে এসেছে বর্বর চোরাগোপ্তা হামলা। তাদের কণ্ঠ রোধ করে দেয়া হচ্ছে, তাদের হত্যা করা হচ্ছে নির্মমভাবে, ঠিক যেভাবে পাক বাহিনী করেছিল। পাক বাহিনী অজুহাত দেখিয়েছিল, আমাদের বুদ্ধিজীবীরা তাদের অখণ্ড পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র এবং মুক্তিযোদ্ধাদের উস্কানিতে লিপ্ত, একইভাবে এই মৌলবাদীরাও দাবী করছে, আমাদের বুদ্ধিজীবীরা তাদের ধর্মের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। কিন্তু একজন কবি বা একজন সাহিত্যিকের লেখাতেই যেই ধর্মের ভিত্তি কেঁপে ওঠে, তাকে হত্যা না করলে আর তাদের ধর্ম টেকে না, সেই ধর্মের কি আদৌ কোন যৌক্তিক ভিত্তি থাকে?
ভেবে দেখা প্রয়োজন, কত পরিশ্রম আর কত সাধনার দ্বারা এরকম এক একজন যুক্তিনিষ্ঠ মানুষের চিন্তা করার ক্ষমতা তৈরি হয়, আধুনিক মননশীলতা তৈরি হয়। মানবতার কল্যাণে তাদের এই অপূর্ব মেধা ব্যবহার করা যেত, সৃষ্টিশীলতা এবং মননশীলতার বিকাশে ব্যবহার করা যেত। কিন্তু মৌলবাদীরা সৃষ্টিশীলতার বিরুদ্ধে, মননশীলতার বিরুদ্ধে, মানবতার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় সবসময়ই। একজন কবি যাই লিখুক, যেভাবেই লিখুক, তার সমালোচনা হতে হবে কবিতা দিয়ে, লেখা দিয়ে। কোনমতেই চাপাতি বা তরবারি দিয়ে নয়। এই সহজ সত্যটা ধর্মান্ধ মৌলবাদীদের মস্তিষ্কে প্রবেশ করে না কিছুতেই। কিন্তু এই ধর্মম্মাদদের রুখতে হবে, নতুবা তারা আমাদের টেনে নিয়ে যাবে মধ্যযুগে, সেই বর্বর আরবে। ডঃ হুমায়ুন আজাদ সহ যুগে যুগে ধর্মের হাতে বলি হওয়া কবিদের প্রতি জানাচ্ছি শ্রদ্ধা। তারা বেঁচে থাকবেন আমাদের শ্রদ্ধায়, আমাদের চিন্তায়, আমাদের মননে। মানুষকে হত্যা করা যায়, কিন্তু তার চিন্তাকে এই মৌলবাদী ধর্মান্ধরা কীভাবে হত্যা করবে?

(পুরনো লেখা থেকে)
এই আবর্তন আর দুষ্টচক্রকে ভাঙ্গতে হলে দরকার নতুন জাগরণ, নতুন ধারণা। প্রয়োজন প্রথা বিরোধী যৌক্তিক মননশীল মানুষের। যা সৃষ্টির জন্য দরকার পুরনো ধারণাকে প্রশ্ন করা, সন্দেহ করা, অবিশ্বাস করা, অনাস্থা-জ্ঞাপন করা। কিন্তু কে করবে? আজকের তরুণরা সবাই দুইভাগে বিভক্ত হয়ে যার যার ধারণায় প্রবল ভাবে বিশ্বাসী, নতুন নতুন দেবতা এবং পীর সৃষ্টি করে, মুজিব বা জিয়ার মাজার তৈরি করে নতজানু হতে উৎসাহী এবং নিজ নিজ অবস্থানে সন্তুষ্ট। তারা ভুলে গেছে সভ্যতা আর অগ্রগতির সেই বীজমন্ত্র-সন্দেহ, অবিশ্বাস, প্রশ্ন আর যুক্তির মাধ্যমে পুরনো ধারণাকে ধ্বংস করে নতুন সৃষ্টি।

এজন্য প্রয়োজন সামগ্রিক বিপ্লবী চেতনার। ব্রিটিশ আমলে খণ্ড খণ্ড বিপ্লবের মাধ্যমে চলে যেতে বাধ্য হল, এরপরে সৃষ্টি হল পাকিস্তানের। পূর্ব পাকিস্তানের উপরে পশ্চিম পাকিস্তানের নির্মম অর্থনৈতিক শোষণের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সহ অনেক বিপ্লবী চেতনার মানুষ বিদ্রোহ করলেন, প্রতিবাদ করলেন, শাসকশ্রেণীর কাছে তা ছিল রাষ্ট্রদ্রোহীতা। স্বাধীনতা অর্জনের বিষয়টি বাঙালির জন্য ছিল অধিকার আদায় এবং নিজ অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই, অন্যদিকে তা পাকিস্তানের জন্য ছিল সেই রাষ্ট্রের প্রতি চরম ধৃষ্টতাপূর্ণ আচরণ। কারণ বঙ্গবন্ধু নিজেই ছিলেন তার সময়ের প্রথা এবং নিজ রাষ্ট্রের বিরোধী একজন বিপ্লবী, স্বাধীন বাঙলাদেশের একজন স্বপ্নদ্রষ্টা।

প্রথার রক্ষকেরা অবিশ্বাস করতে ভয় পায়, সন্দেহ করতে ভয় পায়, প্রশ্ন করতে ভয় পায়। এভাবেই তারা জ্ঞানের বিপক্ষে, সভ্যতার বিপক্ষে পরোক্ষভাবে ভূমিকা রাখে। আর নতুন চিন্তা, যুক্তি আর জ্ঞান সামনে এসে দাঁড়ালেই ভয়ে চিৎকার করে ওঠে। বন্ধ করতে বলে সবকিছু। স্থবিরতায় সুখ খুঁজে পায়, বিপ্লবকে ভয় পায়। কর্তৃপক্ষকে চিৎকার দিয়ে বলে প্রগতির পথ বন্ধ করে দিতে, প্রশ্নকে বন্ধ করতে। প্রশ্ন তার বিশ্বাসানুভূতিকে আঘাত করে, সন্দেহ-অবিশ্বাস তার প্রাচীন ধারণাগুলোকে রক্তাক্ত করে।

কিন্তু এর মাঝেও নতুন সূর্য ওঠে। এই সূর্যকে তারা থামাতে পারি নি কখনই, হেমলক দিয়েও না, যীশুর কাঁটার মুকুট দিয়েও না, মুহাম্মদের উপরে অত্যাচার দিয়েও না, হুমায়ুন আজাদ আর অভিজিৎ রায়কে হত্যা করেও না। যারা সকলেই ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগে অভিযুক্ত। প্রথার বিরোধীতার দায়ে অভিযুক্ত। কিন্তু তারা ফিনিক্সের মত ধ্বংসস্তূপ থেকে বারবার জন্ম নেয়, বারবার নিজের অস্তিত্ব জানান দেয় পৃথিবীকে। কারণ তারুণ্য এসবের পরোয়া করে না, তারা যেমন ধ্বংস করতে সক্ষম, সৃষ্টি করতেও সক্ষম।

আসিফ মহিউদ্দীন

আসিফ মহিউদ্দীন সম্পাদক সংশয় - চিন্তার মুক্তির আন্দোলন [email protected]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *