বাঙলা নাটক ও নাস্তিকতা – থিওরি অফ প্রব্যাবিলিটি?

Print Friendly, PDF & Email

ভূমিকা

বাঙলাদেশের একটি নাস্তিকতা বিষয়ক নাটকে সম্প্রতি থিওরি অফ প্রব্যাবিলিটির যুক্তি দিয়ে ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণের হাস্যকর একটি চেষ্টা করা হয়েছে। নাটকটি আমি দেখি নি, তবে কিয়দাংশ ফেইসবুকের কল্যাণে দেখা হলো। গল্পটিতে নাটকের নায়ক যখন ধর্ম সম্পর্কে বন্ধুদের সাথে আলাপ করছিলেন, নায়িকা খুব ভাবের সাথে এসে থিওরি অফ প্রব্যাবিলিটির কথা উল্লেখ করে বলেন যে, এই থিওরি অনুসারে নাকি মৃত্যুর পরে ঈশ্বর থাকলে সে সুবিধা (উচ্চারণ কি সুবিদা ছিল?) পাবে। অন্যদিকে, ঈশ্বর না থাকলে গল্পের নাস্তিক নায়কের খুব অসুবিধা (উচ্চারণ কি অসুবিদা ছিল?) হবে। নায়িকা আবার বড়াই করে বিজ্ঞানের ছাত্রী হিসেবে নিজেকে পরিচয়ও দিচ্ছিলেন, অর্থাৎ বোঝাতে চাইলেন যে, সে বেশি পণ্ডিত। যেহেতু সে বিজ্ঞানের ছাত্রী, সেহেতু তার কথাই সঠিক। যা একটি সুপরিচিত কুযুক্তি বা লজিক্যাল ফ্যালাসি, যাকে বলা হয় ‘প্রাধিকারের কুযুক্তি‘ (Argument from authority fallacy)। বাঙলাদেশের প্রায় নাটকই খুবই নিম্নমান সম্পন্ন, নাকে কান্না আর সস্তা প্রেম বিষয়ক। সেসব নিয়ে আমাদের আজকের আলোচনা নয়। কিন্তু এই নিম্নমানের স্ক্রিপ্ট লেখক যদি সামান্য পড়ালেখা করেও লিখতেন, জানতেন যে, উনার আসলে পসিবিলিটি শব্দটি ব্যবহার করার কথা ছিল, প্রব্যাবিলিটি নয়৷ কারণ প্রব্যাবিলিটি ব্যবহার করলে অসংখ্য সম্ভাব্য ফ্যাক্টরকে আমলে নিতে হয়। নাটকে নাস্তিকতা বিষয়ে আলোচনার আগে উনার একটু পড়ে নেয়া প্রয়োজন ছিল। বিষয়টি একদমই বেইসিক লেভেলের ভুল কথা।

প্রব্যাবিলিটি এবং পসিবিলিটি

প্রব্যাবিলিটি এবং পসিবিলিটি দুইটি সম্পর্কযুক্ত হলেও আসলে এই দুইয়ের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। প্রব্যাবিলিটি নিয়ে আলোচনার শুরুতেই সম্ভাব্য সকল সম্ভাবনাকে একত্র করে, তার ওপর ভিত্তি করে যেকোন একটি ঘটার সম্ভাব্যতা নির্ধারণ করা যায়। কোন একটি ফ্যাক্টর যদি বাদ যায়, তাহলে তা ভুল ফলাফল দেবে। অন্যদিকে, সাধারণ ভাষায় আমরা যেভাবে ব্যবহার করি, তাতে পসিবিলিটির বেলায় কেবল দুইটি সম্ভাবনা নিয়ে যে কোন একটি ঘটার সম্ভাবনা নির্ণয় করা যেতে পারে। এখানে দুইটি বিষয়ের কোন একটি ঘটবার সম্ভাবনা কত হতে পারে, তার খুব সাধারণ হিসেব করা হয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে কাজে লাগে, তবে পরিষ্কার করে নেয়া হয় যে, আরো অনেক কিছুই ঘটার সম্ভাবনা থাকবে। মৌলিকভাবেই নির্ধারিত সেটের বাইরে অন্য কিছু ঘটার সম্ভাবনা থাকলে পসিবিলিটির হিসেব সঠিক ফলাফল দিতে পারবে না।

প্রথমেই জেনে নেয়া যাক, প্রব্যাবিলিটি আর পসিবিলিটি শব্দ দুইটির অর্থ কী, এবং এর দ্বারা আসলে কী বোঝায়।

probability
noun
the quality or state of being probable; the extent to which something is likely to happen or be the case.”the rain will make the probability of a postponement even greater”

possibility
noun
a thing that may happen or be the case. “relegation remains a distinct possibility”

বিষয়টি আরো পরিষ্কার করা যাক। ধরা যাক, একটি কয়েনের দুইটি পাশ রয়েছে। এই কয়েনটি দিয়ে টস করলে যেকোন একটি আসার সম্ভাবনা ৫০-৫০ ভাগ। তবে এর এমনটি হওয়া খুবই স্বাভাবিক যে, দশবার কয়েন টস করলে দশবারই হেড আসছে। কারণ প্রতিবারই আলাদা আলাদা ভাবে একটি পাশ আসতে পারে। এমন নয় যে, দশবার কয়েন টস করলে পাঁচবার একপাশ, বাকি পাঁচবার আরেকটি পাশ আসবে।

কয়েন

কিন্তু আবার, যদি এটি কয়েন না হয়ে একটি ডাইস হয়, তাহলে, কোন একটি পাশ উপরে আসার সম্ভাব্যতা কমে যায়। কারণ এখানে হিসেব করা হবে ছয়টি আলাদা আলাদা ঘটনা ঘটবার সম্ভাব্যতাকে আমলে নিয়ে।

ডাইস

আবার ধরুন, একজন বললো, আমার ব্যাংক একাউন্টে পাঁচ হাজার কোটি টাকা আছে। তার এই কথাটি সত্য হওয়ার সম্ভাবনা কত? এখানে উত্তর কেবল হ্যাঁ বা না-তে সীমাবদ্ধ করে সম্ভাব্যতা নিয়ে যদি কাজ করি, তাহলে কী হয়? তাহলে উত্তর আসবে, এই পরিমাণ টাকা আমার ব্যাংক একাউন্টে থাকার সম্ভাব্যতা ৫০-৫০। কিন্তু আসলেই কী এটি কোন সঠিক তথ্য দিতে পারছে? এখানে যেই শব্দটি ব্যবহার হয়েছে, তা হচ্ছে সম্ভাব্যতা। অর্থাৎ যেকোন একটি ঘটা সম্ভব। সম্ভাবনা নয়।

এবারে যদি সম্ভাবনা নিয়ে কাজ করি, দেখা যাক, এরকম ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা আছে কিনা৷ বিজ্ঞানের জগতে নীতিগতভাবে কোন কিছু ঘটার সম্ভাবনা একদমই শূণ্য হতে পারে না। তবে সেটি শূন্যের কাছাকাছি হতে পারে৷ এই ক্ষেত্রেও, উনার ব্যাংক একাউন্টে এই পরিমাণ টাকা থাকার সম্ভাবনা শূণ্যের কাছাকাছি। কারণ উনার ব্যাংক একাউন্টে এক পয়সা থেকে শুরু করে অসীম সংখ্যার টাকা থিওরিটিক্যালি বা তাত্ত্বিকভাবে থাকতে পারে। সকল সম্ভাব্যতাকে গণ্য করলে, তা হবে অসীম সংখ্যা। তার ব্যাংক একাউন্টে ৪৯৯ টাকাও যেমন থাকতে পারে, আবার ৪৪৪৪৫৬৭৬২১১৯৮৬৫৬৮৯ টাকাও থাকতে পারে। যেকোনটি ঘটার যেহেতু সম্ভাবনা আছে, এবং আর কোন তথ্য যদি আমাদের কাছে না থাকে, তবে যেকোন সংখ্যক টাকা থাকার সম্ভাবনা আসলে শূন্যের কাছাকাছি। কারণ তা অসীম সংখ্যা দিয়ে ভাগ হবে। এর সাথে আবার যুক্ত হবে আরো কিছু কণ্ডিশন। যেমন, টাকার অংক যত বৃদ্ধি পাবে, সেই পরিমান টাকা তার ব্যাংক একাউন্টে থাকার সম্ভাব্যতা কত কমবে। কারণ এর সাথে যেই ফ্যাক্টর যুক্ত হবে, তা হচ্ছে, এত টাকা আসা সম্ভব কিনা।

নাটকে নাস্তিকতা – নাটকের অংশবিশেষ

আলোচনা

দেখা যাচ্ছে, নাটকের নায়িকা বলছে, সৃষ্টিকর্তা থাকলে সে সুবিধা পাবে, আর না থাকলে সুবিধা অসুবিধা কিছুই নেই। তাতে নাকি তার ৫০-৫০ চান্স আছে জান্নাতে যাওয়ার বা সুবিধা পাওয়ার। কিন্তু থাকলে নায়ক অসুবিধার মধ্যে পড়বে। আর সৃষ্টিকর্তা না থাকলে দুই পক্ষেরই কারোরই কোন অসুবিধা নেই। কারো কোন ক্ষতি নেই। অর্থাৎ, নায়িকা এখানে কয়েন টস করছেন, কিন্তু ডাইস খেলছেন না। অর্থাৎ, কেবল দুইটি সম্ভাব্যতাকে সামনে এনেছেন। সত্যিকার অর্থে এখানে অসংখ্য কিছু ঘটা সম্ভব। অসংখ্য ফ্যাক্টরকে আমলে নিতে হবে। সেসব এক এক করে লিস্ট করা যেতে পারে। সবকটি আমলে আনলেই বোঝা যাবে, নায়িকার জান্নাতে যাওয়ার সম্ভাবনা কতটুকু।

কী কী ঘটতে পারে, সেসব সবকিছু, একদম সবকিছু, তা যত হাস্যকরই মনে হোক না কেন, যেহেতু পুরো বিষয়টিই ধারণার ওপর ভিত্তি করে, কোন তথ্যপ্রমাণ ছাড়া হিসেব করতে হচ্ছে, সেসব আমলে না আনলে, ৫০-৫০ ভাগ সম্ভাবনা আছে, এমনটি বলা খুবই নিম্নমানের ভুল। তাই এখানে অন্যান্য সম্ভাব্যতাও আমাদের দেখা প্রয়োজন।

কারণ, পৃথিবীতে ৪২০০ টি ধর্ম আছে। এর মধ্যে কোন একটি ধর্মের ঈশ্বরের সত্য হওয়ার সম্ভাব্যতা যদি আমলে নিই, তাহলে আল্লাহর সত্য হওয়ার সম্ভাব্যতা ১/৪২০০। সেই সাথে, হিন্দুদের নাকি ৩৩ কোটি দেবদেবী। তাদের মধ্যে যেকোন একটি আবার সত্য হতে পারে। আবার একইসাথে কয়েকটি বা সবকটি দেবতাও সত্য হতে পারে। তাহলে আল্লাহর সত্য হওয়ার সম্ভাব্যতা আরো কমে যাবে।

আরো সহজ করে বোঝাচ্ছি। ধরা যাক, ১০০ টি ঈশ্বরের দাবী রয়েছে। এক একটি ঈশ্বরের দাবী আবার অন্যটি থেকে ভিন্ন। এদের মধ্যে কোন একটি ঈশ্বর সত্য হতে পারে, একইসাথে দুই বা অধিক সংখ্যক ঈশ্বর সত্য হতে পারে, আবার সবকটাই মিথ্যা হতে পারে। ধরে নিচ্ছি, ১ নং ঈশ্বর সত্য হলো। কিন্তু রেহনুমা নাটকে নাস্তিকতা নিয়ে যুক্তি দেয়া ঐ গল্পের নায়িকা জন্মেছেন ৫৭ নং ঈশ্বরের অনুসারী ধর্মের পরিবারে। তাহলে, সারাজীবন ৫৭ নং ঈশ্বরের আরাধনা করার পরেও, নায়িকা জান্নাত পাবেন না। কারণ তিনি ঈশ্বরের আরাধনা করার পরেও, সঠিক ঈশ্বরের আরাধনা করেন নি। করেছেন ভুল ঈশ্বরের আরাধনা। তাই উনার সকল আরাধনাই বাতিল বলেই গণ্য হবে।

আমরা ধর্মগ্রন্থসমূহ থেকে জানি, আব্রাহামিক ঈশ্বর অর্থাৎ, কথিত নবী ইব্রাহিমের থেকে আসা ধর্মসমূহের মধ্যে যেই ঈশ্বরের ধারণা পাওয়া যায়, সে খুব বেশী হিংসুটে এবং ঈর্ষাকাতর। তিনি অন্য ঈশ্বরের উপাসনা সহ্য করতে পারেন না। ইসলাম ধর্মে শিরক সবচেয়ে বড় পাপের কাজ। এখন, আপনি ভুল জায়গাতে ভুল ধর্মের পরিবারে জন্মালেন, এবং আপনাকে ছোট বেলা থেকে যদি সেই ধর্মের ধর্মীয় শিক্ষা দেয়া হয়, সেই ধর্মটিকেই একমাত্র সত্য ধর্ম বলে শেখানো হয়, আপনি যদি অন্যান্য সকল ধর্ম নিয়ে না পড়ে না জেনে নিজের পৈত্রিক সূত্রে প্রাপ্ত ধর্মটিকেই পালন করে মারা যান, তাহলে আপনার জান্নাত বা স্বর্গে যাওয়ার সম্ভাবনা কত? ৫০-৫০ ভাগ? না, এটি ভুল হিসেব। কারণ অন্যান্য সকল সম্ভাব্যতাকে আমলে আনতে হবে। সেসব আমলে আনলে আপনার জান্নাতে যাওয়ার সম্ভাবনা কমতে থাকবে। আরো অনেক কিছু ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে।

সাধারণত প্রতিটি মানুষই এক একটি দেশে এক একটি অঞ্চলে এক একটি পরিবারে জন্ম গ্রহণ করে। জন্মের পর থেকেই তাকে পরিবার থেকে শেখানো হয়, সে যেই ধর্মের পরিবারে জন্ম নিয়েছে, সেটিই একমাত্র সঠিক এবং সত্য ধর্ম। তার ঈশ্বরই একমাত্র সত্য ঈশ্বর, তার ধর্মটিই ঈশ্বরের মনোনীত ধর্ম, শান্তি ও সত্যের ধর্ম, এবং বাদবাকী সকল ধর্মই মিথ্যা বা বিকৃত। একমাত্র ঘটনাচক্রে সে যেই পরিবারে জন্ম নিয়েছে, তার সেই পরিবারের ধর্মটিই আসল। এখন, সে যেই এলাকায় জন্ম নিয়েছে, সেখানে যদি তার পৈত্রিক সূত্রে প্রাপ্ত ধর্মটিই প্রভাববিস্তারকারী হয়, তাহলে তার স্কুল কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, বন্ধুবান্ধবের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষই তার বিশ্বাসের পক্ষে থাকবে। তাকে নানাভাবে বোঝাবে, তার ধর্মটিই কত মহান এবং কত সত্য, কতই না বিজ্ঞানসম্মত। যেমন, ভারতে হিন্দু পরিবারে জন্ম নিলে শুনতে হবে, বেদের ভেতরে অনেক বিজ্ঞান আছে, গরুর পেশাব খেলে ক্যান্সার ভাল হয়, এই ধরণের উদ্ভট অবৈজ্ঞানিক কথা। আবার মুসলিম পরিবারে জন্ম নিলে শুনতে হবে, বিজ্ঞান নাকি কোরআনকে মেনে নিয়েছে। নাসার বিজ্ঞানীরা নাকি কোরআন গবেষণা করে বিজ্ঞান আবিষ্কার করে, এইসব। যেসব আমরা ওয়াজ মাহফিলে শুনি। কিন্তু, সত্য হচ্ছে, এসব ঐ ধর্মের অনুসারীদের মিথ্যাচার। কোন ধর্মই আজ পর্যন্ত প্রমাণিত হয় নি।

তাহলে, যদি দেখা যায়, রেহনুমা নাটকে নাস্তিকতা এবং সংশয়বাদকে হাস্যকর যুক্তি দেয়া ঐ নায়িকা বাঙলাদেশে জন্ম নিয়েছে, অথচ ইহুদী ধর্মটিই সত্য, সেই ঈশ্বরই আসল সৃষ্টিকর্তা, তাহলে সেই নাটকের নায়িকাও একই অবস্থানে আছে, যেখানে নাস্তিক নায়ক রয়েছে। ৮ বিলিয়ন মানুষের মধ্যে ৮ বিলিয়ন রকম বিশ্বাস। কোনটি সঠিক তা নির্ধারণ যদি যুক্তি প্রমাণ বাদ দিয়ে কয়েন টস বা ডাইসের ওপর আমরা নির্ধারণ করি, তাহলে ভুল করার সম্ভাবনাই বৃদ্ধি পাবে।

এতপরে আরো যেই জটিলতা রয়েছে, তা হচ্ছে, ইসলাম ধর্ম মানলে, ঘটনাচক্রে আল্লাহ সত্য হলেও যে কেউ জান্নাতে যাবে, সেটাও অনিশ্চিত। এই নাটকে নাস্তিকতা নিয়ে বলার সময়, এমন কথা বলা হয়েছে, শুনলে মনে হবে, আল্লাহকে শুধুমাত্র বিশ্বাস করলেই কেউ জান্নাতে চলে যাবে। বিষয়টি তথ্যগত ভুল। কারণ নবী মুহাম্মদের একটি বিখ্যাত হাদিস রয়েছে, যেখানে বলা হচ্ছে,

গ্রন্থের নামঃ হাদীস সম্ভার
হাদিস নম্বরঃ (1528)
অধ্যায়ঃ ১৩/ সুন্নাহ
পাবলিশারঃ ওয়াহীদিয়া ইসলামিয়া লাইব্রেরী
পরিচ্ছদঃ একতা ও বিচ্ছিন্নতা
(১৫২৮) মুআবিয়াহ (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা আল্লাহর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের মাঝে দণ্ডায়মান হয়ে বললেন, ‘‘শোনো! তোমাদের পূর্বে যে কিতাবধারী জাতি ছিল তারা ৭২ ফির্কায় বিভক্ত হয়েছিল। আর এই উম্মত বিভক্ত হবে ৭৩ ফির্কায়; এদের মধ্যে ৭২টি ফির্কাহ হবে জাহান্নামী আর একটি মাত্র জান্নাতী। আর ঐ ফির্কাটি হল (আহলে) জামাআত।
(আহমাদ ১৬৯৩৭, আবূ দাঊদ ৪৫৯৯)
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)

অর্থাৎ বোঝা যাচ্ছে, মুহাম্মদের উম্মতদের মধ্যেও হবে ৭৩ দল, তার মধ্যে ৭২ দলই যাবে জাহান্নামে। যুক্তিযুক্তভাবে অসীম সংখ্যক সম্ভাবনা আমলে না নিয়ে শুধু এবং কেবলমাত্র ইসলামকে আমলে নিলেও, জান্নাতে যাওয়ার সম্ভাবনা ১/৭৩। বাদবাকি সম্ভাবনাকে আমলে নিলে কী হবে? ঐ নাটকে নাস্তিকতা বিষয়ক আলোচনা ও দাবীর সাথে মিল পাচ্ছেন?

আবার, ঈশ্বরের কাকে জান্নাতে দেবেন কাকে জাহান্নামে, সেই সম্পর্কে আগে থেকে কিছু বলা যায় না। যেমন, ইসলাম ধর্মের আল্লাহ নিজের খেয়াল খুশী মতো জান্নাত জাহান্নাম দান করেন। তাকদীর সম্পর্কিত আলোচনায় যা বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। ধর্মের বা ধর্মগ্রন্থসমূহের দাবীসমূহের বাইরে কেবল যদি যুক্তিকেই প্রাধান্য দিই, তাহলে ঈশ্বর যে কেবল উপাসনাকারীদেরই জান্নাত দেবেন, এমন কোন যুক্তি নেই। ঈশ্বর কী করবেন কেন করবেন, তার জবাবদিহি মানুষের কাছে করবেন বলে মনে হয় না।

এরকম আরো অসংখ্য সম্ভাবনা রয়েছে। উদাহরণ হিসেবে কিছু উল্লেখ করছিঃ

  • যেমন, পরকালে দেখা গেল, সৃষ্টিকর্তা আছেন বটে, তবে তিনি নিজ বুদ্ধি খাটিয়ে ঈশ্বরের অস্তিত্ব সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণকেই বেশি গুরুত্ব দেন। অন্ধভাবে বিশ্বাসকে বা প্রমাণ না পেয়ে বিশ্বাসকে নয়। অর্থাৎ, প্রমাণের অভাবে অবিশ্বাস করলেই তিনি পুরষ্কার দেন। এরকম হলে নায়িকা বিপদে আছেন, নায়ক সুখেই থাকবেন।
  • এমন সম্ভাবনাও থাকতে পারে যে, সৃষ্টিকর্তা একটি অত্যন্ত খারাপ চরিত্র। প্রমাণ ছাড়া আমরা নিশ্চিত ভাবে বলতে পারি না, ঈশ্বর শুধুমাত্র ভালই হবে। সে হয়তো চায় মানুষ খুনোখুনী করে মরুক। তাহলে সারাজীবন মানুষ খুন না করে নায়ক নায়িকা দুইজনই বিপদেই থাকবেন।
  • এমনও তো হতে পারে, সারাজীবন ইসলামী নিয়ম কানুন পালন করে এক আল্লাহর উপাসনা করে মৃত্যুর পরে গিয়ে দেখলেন শিব ভদ্রলোক তার বিশাল শিবলিঙ্গ খাড়া করে প্রস্তুত হয়ে আছে, অবিশ্বাসীদের ধর্ষনের জন্য। তিনি আবার আল্লাহর উপাসকদের ওপর বিশেষভাবে বিরক্ত। এ তো খুব বিপদের কথা।
  • দেখা গেল, আফ্রিকার কোন এক জঙ্গলের বিকটদর্শন পুঙ্গাপুঙ্গা দেবতাই আসলে সত্য, বাদবাকি সব সৃষ্টিকর্তাই মিথ্যা। তিনি অবিশ্বাসীদের পেটাবার জন্য বড় কোন বাঁশ নিয়ে প্রস্তুত, আপনাকে বাঁশ প্রদানের জন্য। বিপদের কথা।
  • দেখা গেল, ইহুদীদের হিংস্র ঈশ্বর জিহভাই সত্য। তিনি তার দলবল নিয়ে ছুড়িতে শান দিচ্ছেন। কোপাবার জন্য। আল্লাহকে বিশ্বাসের অপরাধে তিনি আপনার সাথে কী কী করতে পারেন?
  • দেখা গেল, প্রাচীন গ্রিসের জিউসই একমাত্র সত্য, বাদবাকি সবই মিথ্যা। জিউস কী আপনাকে ক্ষমা করবে?
  • চার হাজারের উপরে ধর্ম, কোটির উপরে দেবতা। এদের মধ্যে যেকোন একটির সত্য হওয়ার সম্ভাব্যতাকে আমরা যদি আমলে নিই, তাহলে সংখ্যাটি অনেক বড় হয়ে যায়।
  • ভারতেই শুধুমাত্র অগণিত ঈশ্বর পুজিত হয়েছে। এদের সবাইকে আমলে নিলে সংখ্যাটি অনেক বড়।
  • আরো অনেক সম্ভাবনা রয়েছে, অনেক কিছু ঘটার। যদি প্রমাণ ছাড়া শুধুমাত্র ধারণার ওপরেই ভিত্তি করে আমরা আগাই, তাহলে তো সেই তথ্যগুলোকেও আমলে নিতে হবে।

এরকম অসীম সংখ্যক সম্ভাব্যতা একত্র করে হিসেব করলেই, তবেই কেবল সঠিক সম্ভাবনা পাওয়া সম্ভব হবে। হিসেবটিতে সৎভাবে সকল ফ্যাক্টর একত্র করা তাই জরুরি। যুক্তিযুক্তভাবে নিজের ধারণাকে সত্য বলে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা থাকলে, এই হিসেবটি নিরপেক্ষতা হারাবে। রেহনুমা নাটকে নাস্তিকতা বিষয়ক আলোচনায় সেসব কিছুই না এনে অসততার মাধ্যমে ধর্মকে বিজয়ী করার চেষ্টা করা হয়েছে।

প্যাস্কেলের বাজি

পযাসকেলের বাজি

প্যাস্কেলের বাজি (Pascal’s wager) দর্শন শাস্ত্রে একটি বিখ্যাত যুক্তি, যেটি দিয়েছিলেন সপ্তদশ শতকের ফরাসি দার্শনিক, গণিতবিদ ও পদার্থবিদ ব্লেইজ প্যাস্কেল (১৬২৩-১৬৬২)। এই যুক্তিটির সাহায্যে ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণের একটি চেষ্টা করা হয়, তবে যুক্তিটি অসংখ্যবার ভুল বলে প্রমাণ করা হয়েছে। এই কারণে এই যুক্তিটিকে কুযুক্তি বা লজিক্যাল ফ্যালাসি হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে। এই যুক্তিতে ধরে নেয়া হয় যে, ঈশ্বরের অস্তিত্ব আছে নাকি নেই, এই ব্যাপারটি যদি একটি বাজি ধরা হয়, তাহলে ঈশ্বরে বিশ্বাসী মানুষ সুবিধাজনক স্থানে থাকে।

প্যাস্কেল যুক্তি দেন, একজন যুক্তিবাদী ব্যক্তির এটি ধরেই জীবন যাপন করা উচিৎ যে, ঈশ্বরের অস্তিত্ব আছে, এবং তার ঈশ্বরে বিশ্বাসও করা উচিৎ। যদি আসলেই ঈশ্বরের অস্তিত্ব না থাকে, তবে সেই ব্যক্তির কেবল সীমিত পরিমাণে ক্ষতিই হবে, যেমন তিনি কিছু সুখ, বিলাসিতা ইত্যাদি হারাবেন। কিন্তু যদি ঈশ্বরের অস্তিত্ব থেকে থাকে, তবে তার অর্জন হবে অসীম (যেমন আজীবন স্বর্গবাস), আর একই সাথে তিনি অসীম ক্ষতিকেও এড়াতে পারবেন (যেমন আজীবন নরকবাস)।

এই বাজিটিতে নিম্নোক্ত যুক্তিগুলো ব্যবহার করা হয় (যা পেনসিস গ্রন্থের তৃতীয় অংশ, পৃষ্ঠা নং ২৩৩ এ বর্ণিত হয়েছে)- (তথ্যসূত্র ১)

  • ইশ্বর আছে, অথবা ঈশ্বর নেই। যুক্তি দিয়ে এই দুটোর মধ্যে একটিকে বাছাই করা যায় না।
  • একটি খেলা খেলা যাক… যেখানে হয় হেড না হয় টেইল আসবে।
  • আপনাকে বাজি রাখতেই হবে (এটা ঐচ্ছিক নয়)।
  • যদি ঈশ্বরের অস্তিত্ব থাকে তাহলে তাহলে লাভ আর ক্ষতি হিসাব করা যাক। এই দুটো সম্ভাবনা নিয়ে হিসাব করা যাক। যদি তুমি জেতো, তাহলে তুমি সব অর্জন করলে; যদি তুমি হারো তাহলে কিছুই হারলে না।
  • এক্ষেত্রে অর্জন করার জন্য আছে অনন্তকালের জন্য অসীম পরিমাণ সুখ, আর হারানোর জন্য আছে সীমিত সংখ্যক হারাবার সম্ভাবনা, আর তাই তোমার যা হারানোর আছে তা সীমিত। এই খেলায় হার আর জিতের সম্ভাবনা সমান সমান। ফলে এই খেলায় হারলে তোমার হারাবার আছে সসীম সংখ্যক জিনিস, যেখানে জিতলে তুমি পেতে পারো অসীম সংখ্যক জিনিসকে।
  • কিন্তু কেউ কেউ তাও ঈশ্বরকে বিশ্বাস করতে পারে না। তাদেরকে অন্তত ‘নিজের বিশ্বাস করার অক্ষমতাকে স্বীকার করা উচিৎ..’ এবং তারপর নিজেদেরকে মানানো উচিৎ।

প্যাস্কেলের বাজির উত্তর

লক্ষ্য করুন, প্যাস্কেলের এই যুক্তিটিতে কোন সুনির্দিষ্ট প্রমাণ ছাড়াই ধরে নেয়া হয়েছে, ঈশ্বর একটি একক দাবী। অথচ ঈশ্বর কোন একক দাবী নয়। মানব ইতিহাসে বহু সংখ্যক ঈশ্বরের দাবী খুঁজে পাওয়া যায়। সেই প্রাচীন কাল থেকে আজ অবধি যত ধর্ম এসেছে, প্রায় সবধর্মই কোন না কোনো প্রকারের ঈশ্বরের দাবী করেছে। যার কোনটিই আজ পর্যন্ত প্রমাণিত হয় নি।

বিভিন্ন ধর্মে আবার ঈশ্বরের বৈশিষ্ট্য এবং গুণাগুণ ভিন্ন ভিন্ন রকম। কোন ঈশ্বর লম্পট, যেমন জিউস, বা কৃষ্ণ, কোন ঈশ্বর বা দেবদেবী আবার ভয়াবহ, যেমন কালী বা শিব। আবার অনেক ঈশ্বর গণহত্যাকারী, কাফেরদের ঘৃনাকারী, বদমেজাজি, ইর্ষাপরায়ন। যেমন ইহুদী খ্রিস্টান ও মুসলিমদের ঈশ্বর। আফ্রিকার অনেক ঈশ্বর, প্রাচীন বিভিন্ন সভ্যতায় ঈশ্বরের বিভিন্ন ধারণা, একটি আরেকটির সাথে সাংঘর্ষিক। সেইসাথে, মহাবিশ্বের সৃষ্টিকর্তার যে কেবল ভাল এবং ন্যায়বিচারকারীই হতে হবে, এমন কোন যুক্তিও নেই। সে হতে পারে খুব বাজে চরিত্রের।

৪২০০ টি ধর্মের ঈশ্বর এবং এক হিন্দুধর্মেই ৩৩ কোটি দেবদেবীর হিসেব ধরে, যদি আমরা n সংখ্যক ঈশ্বরের দাবীকে পর্যালোচনা করি, তাহলে এদের মধ্যে যেকোন একটি ঈশ্বরের সত্য হওয়ার সম্ভাবনা সমান। একটি ঈশ্বর সত্য হলে, অন্য ঈশ্বরের উপাসনা কোন কাজে আসবে না। বরঞ্চ ঐ ঈশ্বর তাতে শাস্তির পরিমাণ বৃদ্ধি করে দেবেন।

ধরা যাক, আমি ইহুদী ধর্মের ঈশ্বরে বিশ্বাস করি। অর্থাৎ আমি ইসলাম ধর্মের আল্লাহকে অবিশ্বাস করি। অর্থাৎ আমি ইসলাম ধর্মের আল্লাহ সম্পর্কে একজন নাস্তিক। সত্যিকার অর্থে, আমি আসলে ৪১৯৯ টি ধর্মের ঈশ্বর সম্পর্কেও নাস্তিক, বা অবিশ্বাসী। উল্টোদিকে, একজন পরিপূর্ণ নাস্তিক আমার চাইতে শুধুমাত্র একটি বেশি ঈশ্বর সম্পর্কে নাস্তিক।

এইসবকিছু বিচার বিশ্লেষনের পরে দেখা যায়, একজন আস্তিক যে আসলে সুবিধাজনক স্থানে আছেন, এমনটি ভাবার বিশেষ কোন কারণই নেই। আপনারা রেহনুমা নাটকে নাস্তিকতা বিষয়ক আলোচনাটি মন দিয়ে দেখতে পারেন, সেইসাথে দর্শন বা যুক্তিবিদ্যার কিছু ভিডিও দেখতে পারেন।

এবিষয়ে নির্মিত নিচের ভিডিওটি দেখতে পারেনঃ

সেইসাথে, এই ভিডিও দুটিঃ

উপসংহার

বাঙলাদেশের নাটক বা সিনেমার মান আন্তর্জাতিকভাবে বিচার করলে, একদমই নিম্নমান সম্পন্ন। বহির্বিশ্বে যখন দর্শন বিজ্ঞান বিষয়ে রীতিমত গবেষক বিজ্ঞানীগণ চলচ্চিত্র বা সিরিয়ালে অংশ নেন, আমাদের দেশে চলচ্চিত্র নাটকে পাওয়া যায় অশিক্ষিত মূর্খ কিছু মানুষকে। একটি বিখ্যাত সিরিয়াল রয়েছে, দ্যা বিগ ব্যাং থিওরি নামে। সেখানে খোদ স্টিফেন হকিং-এর সাথে গল্পের নায়ক কথাবার্তা বলেছেন। স্টিফেন হকিং সে সিরিয়ালের একটি চরিত্রও। অন্যদিকে, আমাদের দেশের নাটক সিনেমার কথা নাই বা বললাম। তাদের উদ্দেশ্যে একটি শব্দই যথেষ্ট, প্যাথেটিক!

নাটক stephen hawking

তথ্যসূত্র

( ১ ) Pascal, Blaise (১৮৭৭)। Pensées de Pascal (ফরাসি ভাষায়)। Firmin-Didot। পৃষ্ঠা ২৩৩।

আসিফ মহিউদ্দীন

আসিফ মহিউদ্দীন সম্পাদক সংশয় - চিন্তার মুক্তির আন্দোলন [email protected]

One thought on “বাঙলা নাটক ও নাস্তিকতা – থিওরি অফ প্রব্যাবিলিটি?

  • March 30, 2023 at 2:24 PM
    Permalink

    যুক্তি গুলো কঠিন। তবে আপনি এ-ই পন্থা অবলম্বন করলে আপনিও বিপদের মধ্যে আছেন।

    Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *