রামের শূদ্র শম্বুক হত্যা নিয়ে আপনি অবাক কেন হচ্ছেন?

Print Friendly, PDF & Email

বাল্মীকি  রামায়ণের উত্তরকাণ্ডে দেখা যায়, বিষ্ণুর অবতার রামচন্দ্র তপস্যা করার অপরাধে শম্বুক নামক এক শূদ্র তপস্বীকে হত্যা করেন। (রামের শম্বুক হত্যার ঘটনাটি বিস্তারিত পড়ুন এখান থেকে)। রামায়ণে এই ঘটনাটি বর্ণিত হওয়া সত্ত্বেও রামের পক্ষ অবলম্বন করে অনেকে বলে থাকেন, রামের মত একটি চরিত্রের দ্বারা কখনোই শম্বুক বধ সম্ভব নয় অথবা রাম শম্বুক বধ করেননি। এর স্বপক্ষে তারা বেশ কিছু যুক্তি দিয়ে থাকেন। কলকাতা 24*7 নামক একটি অনলাইন নিউজ পোর্টালে এই ধরণের যুক্তি সমন্বিত একটি লেখা চোখে পড়ল (সেই লেখাটির লিংক) । তা নিয়ে কিছু কথা বলতে চাই।

দাবীঃ  ১) রাম সীতা উদ্ধারের জন্য বানর,ভাল্লুক এদের সাহায্য নিলেন, যারা বর্ণগতভাবে শূদ্রেরও নীচে। তাদের সাথে উঠলেন, বসলেন , খেলেন, থাকলেন।  ২) রাম নিষাদরাজ গুহের আতিথেয়তা গ্রহণ করেছিলেন।তার সাথে রামের সুসম্পর্ক ছিল। ৩) শবরী ক্ষত্রিয় বা ব্রাহ্মণ না হওয়া সত্ত্বেও রাম তার এঁটো কুল খেলেন। এমন রামের দ্বারা শম্বুক হত্যা হতেই পারেনা।  

উত্তরঃ  ১) রাম নিজের কার্যসিদ্ধির জন্য অর্থাৎ সীতা উদ্ধারের জন্যই বানর,ভাল্লুক প্রভৃতির সাহায্য নেন। রামায়ণে বর্ণিত বানর, ভাল্লুককে আক্ষরিক অর্থেই বানর, ভাল্লুক ধরলে রামায়ণ একটি রূপকথার গল্পে পরিণত হয়। এছাড়া তখন বানর, ভাল্লুক প্রভৃতিকে কোনো বর্ণের মধ্যেও ফেলা যায় না। লেখক হয়তো বানর, ভাল্লুক প্রভৃতিকে আক্ষরিক অর্থে বানর, ভাল্লুক না ভাবতে পারেন; তাদের ভারতের আদিবাসী জাতীয় কিছু ভেবে থাকতে পারেন। রামচন্দ্র সীতা উদ্ধারের জন্য যে তথাকথিত বানর, ভাল্লুকদের সাহায্য নেন, তাদের প্রতি রামচন্দ্রের মনোভাব খুব একটা ভালো ছিল না। বালীকে হত্যা করার সময় রাম যা বলেছিলেন তাতে তার সেই মানসিকতা ফুটে উঠেছিল। রামচন্দ্র বালীকে আড়াল থেকে হত্যা করার জন্য তীর নিক্ষেপ করলে বালী রামকে ধিক্কার জানান। তখন রাম নিজের এই দুষ্কর্মের সাফাই গাইতে গিয়ে বালীকে বলেন –  

“ বীর! আরো কিছু বলিবার আছে শুন, কিন্তু ক্রোধ করো না। আমি তোমাকে লুকিয়ে হত্যা করে বিন্দুমাত্র ক্ষুন্ন নই এবং এজন্য শোকও  করি না। লোকে প্রকাশ্য বা অপ্রকাশ্য থেকে বাগুরা,পাশ প্রভৃতি কূট উপায় দ্বারা হরিণকে ধরে থাকে। হরিণ ভীত বা বিশ্বাসে নিশ্চিত হউক, অন্যের সাথে বিবাদ করুক বা ধাবমান হউক, সতর্ক বা অসাবধানই থাকুক, মাংসাশী মনুষ্য তাকে বধ করে, এতে অনুমাত্র দোষ নেই। দেখ ধর্মজ্ঞ নৃপতিরা অরণ্যে মৃগয়া করে থাকে; সুতরাং তুমি শাখামৃগ বানর, যুদ্ধ কর বা নাই কর, মৃগ বলেই আমি তোমাকে বধ করেছি।“(বাল্মীকি রামায়ণ/ কিষ্কিন্ধ্যাকান্ড, অষ্টাদশ সর্গ অনুবাদ- হেমচন্দ্র ভট্টাচার্য)

কঠিন জাতিপ্রথাতে শূদ্র ও বর্ণবাহ্যদের হীন চোখে দেখা হত। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্যেরও সামাজিক সম্মান সমান ছিল না। এক বর্ণের মানুষ অন্য বর্ণের বৃত্তি অবলম্বন করতে পারতো না। কিন্তু এই কঠিন জাতিপ্রথায়ও আপদ ধর্ম বলে একটি বিষয় ছিল। আপদ ধর্ম অনুযায়ী কঠিন পরিস্থিতিতে বা সংকটকালে কোনো বর্ণ অন্য বর্ণের কাজ করতে পারতো। তখন  খাওয়া-দাওয়া বা ছোঁয়াছুঁয়ির ব্যাপারে তেমন নিষেধাজ্ঞা থাকতো না। মহাভারতের অনুশাসন পর্ব, শান্তি পর্বে এবং মহাভারতের বিভিন্ন স্থানে বর্ণপ্রথার বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে। এখানে আপদ ধর্মেরও বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায়। আপদ ধর্ম সম্বন্ধে বিশ্বামিত্রের চন্ডালের ঘর থেকে কুকুরের মাংস খাওয়ার একটি উপাখ্যান শান্তি পর্বে  বর্ণিত হয়েছে-   

ত্রেতা ও দ্বাপর যুগের সন্ধিকালে ১২ বছরব্যাপী অনাবৃষ্টির ফলে কৃষি, গবাদি পশুপালন অসম্ভব হয়ে পড়লে এক বিষম পরিস্থিতি দেখা দেয়। “সেই সময়ে মহর্ষি বিশ্বামিত্র স্ত্রী পুত্রকে কোনো এক জনপদে ফেলে রেখে ক্ষুধার্ত হয়ে নানাস্থান পর্যটন করতে লাগলেন। একদিন তিনি চণ্ডাল বসতিতে এসে দেখলেন ভগ্ন কলস, কুক্কুরের চর্ম, শূকর ও গর্দভের অস্থি এবং মৃত মনুষ্যের বস্ত্র চারিদিকে ছড়ানো রয়েছে। কোথাও কুক্কুট ও গর্দভ ডাকছে , কোথাও চণ্ডালরা কলহ করছে । বিশ্বামিত্র খাদ্যের অন্বেষণ করলেন কিন্তু কোথাও মাংস, অন্ন বা ফলমূল পেলেন না; তখন তিনি দুর্বলতায় অবসন্ন হয়ে ভূপতিত হলেন। এমন সময় তিনি দেখতে পেলেন , এক চণ্ডালের গৃহে সদ্যনিহত কুক্কুরের মাংস রয়েছে। বিশ্বামিত্র ভাবলেন, প্রাণরক্ষার জন্য চুরি করলে দোষ হবে না। রাত্রিকালে চণ্ডালরা নিদ্রিত হলে বিশ্বামিত্র কুটিরে প্রবেশ করলেন। সেই কুটিরস্থ চণ্ডাল জাগরিত হয়ে বললে , কে তুমি মাংস চুরি করতে এসেছ, তোমাকে আর বাঁচতে দেব না।“  এরপর বিশ্বামিত্র চণ্ডালকে তার দুরবস্থার কথা জানান। চণ্ডাল নানা কথার মাধ্যমে বিশ্বামিত্রের মত ঋষিকে চণ্ডালের ঘর থেকে কুকুরের মাংস খেতে বারণ করেন। বিশ্বামিত্র বলেন, “ এখন আমার পক্ষে মৃগমাংস আর কুক্কুরমাংস সমান । আমার প্রাণসংশয় হয়েছে , অসৎ কার্য করলেও আমি চণ্ডাল হয়ে যাব না। চণ্ডাল বলেন, “ ব্রাহ্মণ কুকর্ম করলে তার ব্রাহ্মণত্ব নষ্ট হয় , এজন্য আমি আপনাকে নিবারণ করছি। নীচ চণ্ডালের গৃহ থেকে কুক্কুরমাংস হরণ করলে আপনার চরিত্র দূষিত হবে, আপনাকে অনুতাপ করতে হবে।“ বিশ্বামিত্র চণ্ডালের কোনো কথাই শোনেন না, তিনি চণ্ডালের ঘর থেকে কুকুরের মাংস এনে সপরিবারে ভোজন করেন। (রাজশেখর বসু কর্তৃক অনুবাদিত মহাভারত/ শান্তি পর্ব/ ১২)

এই উপাখ্যানে দেখা যায়, বর্ণ প্রথা যতই কঠিন রূপ ধারণ করুক না কেন বিপদে পড়লে বর্ণ প্রথার  বিপরীত আচরণ করা দোষের ছিল না। রাম বিপদে পড়ে সীতা উদ্ধারের জন্য যে বানর, ভাল্লুক ইত্যাদির সাহায্য নিয়েছেন এটাকে তার আপদ ধর্ম বলেও ব্যাখ্যা করা যায়। এই ঘটনাটি আবশ্যিকভাবে রামের উদারতাকে প্রমাণ করে না।     

২)বাল্মীকি রামায়ণের অযোধ্যাকাণ্ডে গুহ নামের এক নিষাদরাজার উল্লেখ পাওয়া যায়। গুহ রামকে নানা খাবার এনে দিলে রাম সেসব খাবার গ্রহণ করেন না, রাম কেবল ঘোড়ার জন্য আনা খাদ্য গ্রহণ করেন। রাম গুহকে বলেন, “তুমি প্রীতিবশত যে সকল আহারদ্রব্য উপহার দিলে, আমি কিছুতেই প্রতিগ্রহ করিতে পারি না। এক্ষণে চীরচর্ম ধারণ ও ফলমূল ভক্ষণপূর্বক তাপসব্রত অবলম্বন করিয়া অরণ্যে ধর্মসাধন করিতে হইবে, সুতরাং কেবল অশ্বের ভক্ষ ভিন্ন অন্য কোনো দ্রব্যই লইতে পারি না।“(1) রাম বলেন, তিনি ফলমূল ভক্ষণ করে তাপসব্রত অবলম্বন করবেন। কিন্তু গুহের কাছ থেকে বিদায় নিয়েই রাম লক্ষ্মণ মাংসের জন্য পশু হত্যা করেন। অযোধ্যাকাণ্ডেই দেখা যায় রাম লক্ষ্মণ মাংসের জন্য পশুহত্যা করছেন-

तौ तत्र हत्वा चतुरो महामृगान्
वराहमृश्यं पृषतं महारुरुम्।
आदाय मेध्यं त्वरितं बुभुक्षितौ
वासाय काले ययतुर्वनस्पतिम्।।2.52.102।।

অর্থাৎ, অনন্তর রাম সুসমৃদ্ধ শস্যবহুল বৎস্যদেশে উপস্থিত হইয়া লক্ষ্মণের সহিত বরাহ, ঋষ্য, পৃষৎ ও মহারুরু এই চারিপ্রকার মৃগ বধ করিলেন এবং উহাদের পবিত্র মাংস গ্রহণ পূর্বক সায়ংকালে অত্যন্ত ক্ষুধার্ত হইয়া বনমধ্যে প্রবিষ্ট হইলেন। (অনুবাদক হেমচন্দ্র ভট্টাচার্য)   

এছাড়া রামায়ণে অনেক স্থানেই রাম-লক্ষ্মণকে পশু শিকার করতে দেখা যায়। (2)

সুতরাং দেখা যায় রাম নিষাদরাজ গুহকে মিথ্যা বললেন। নিষাদ বলেই কি রাম তার খাদ্য গ্রহণ করলেন না? রাম কেনই বা গুহকে মিথ্যা বললেন এই প্রশ্ন থেকেই যায়!
তবে রাম গুহের জল গ্রহণ করেছিলেন (3) এবং রামায়ণে নিষাদরাজ গুহকে রামের ‘প্রাণসম সখা’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে।(4) রাম তাকে আলিঙ্গনও করেছিলেন। রাম কি  তার এই ‘প্রাণসম সখা’র সাথেও তার অগোচরে জাতপাত বজায় রেখেছিলেন!? নাকি কোনো অজ্ঞাত স্বার্থের জন্যই রাম তার সাথে বন্ধুত্ব করেছিলেন, যেমনটা সুগ্রীবের সাথে রাম করেছিলেন? (সুগ্রীবের ভাই বালীর প্রতি রামের আচরণে রাম বানরজাতিকে কিভাবে দেখতেন তা ফুটে উঠেছিল)  নইলে বলতে হয় মহাকবি বাল্মীকি বিরচিত রামায়ণে অসঙ্গতি রয়েছে। এই অসঙ্গতি বাল্মীকির রামায়ণ গ্রন্থটির প্রামাণিকতাকে কি প্রশ্নবিদ্ধ করেনা?

নিষাদরাজ গুহ ছাড়াও বাল্মীকি রামায়ণের অরণ্যকাণ্ডে (৩৫ সর্গ) আরেকবার নিষাদের প্রসঙ্গ আসে। রাবণ যখন সীতা হরণের জন্য যাচ্ছিলেন তখন তিনি এক বৃহৎ বট বৃক্ষ দেখতে পান। এরপর রামায়ণে বলা হয় এই বৃক্ষের শতযোজন দীর্ঘ এক শাখায় এক হাতি ও কচ্ছপকে গ্রহণ করে একসময় গরুড় বসেছিলেন । সেই গাছের নিচে তখন অনেক মুনিরা তপস্যা করছিলেন। গরুড়ের দেহের ভারে বট গাছের শাখা ভেঙ্গে গেলে গরুড় সেই মুনিদের রক্ষা করার জন্য শত যোজন ব্যাপী শাখা, হাতি ও কচ্ছপকে গ্রহণ করে গমন করতে থাকেন। কিছুটা দূরে গিয়ে সেই হাতি ও কচ্ছকে গরুড় খেয়ে ফেলেন এবং সেই বিশাল বট গাছের শাখা দ্বারা নিষাদ দেশের উচ্ছেদ সাধন করে অত্যন্ত খুশি হন।

তেষাং দয়ার্থাং গরুড়স্তাং শাখাং শতযোজনাম্।

ভগ্নামাদায় বেগেন তৌ চোভৌ গজকচ্ছপো।। ৩১

একপাদেন ধর্ম্মাত্মা ভক্ষয়িত্বা তদামিষম্।

নিষাদবিষয়ং হত্বা শাখয়া পতগোত্তমঃ।। ৩২

প্রহর্ষমতুলং লেভে মোক্ষয়িত্বা মহামুনীন্।।

স তু তেন প্রহর্ষেণ দ্বিগুণীকৃতবিক্রমঃ।

অমৃতানয়নার্থং বৈ চকার মতিমান্ মতিম্।। ৩৪

অর্থঃ পক্ষিশ্রেষ্ঠ বুদ্ধিমান ধর্মাত্মা গরুড় তাহাঁদিগের প্রতি দয়াপরবশ হইয়া একপদে সেই শতযোজনবিস্তৃত ভগ্নশাখা এবং অন্য পদে সেই হস্তী ও কচ্ছপকে ধারণ করত তাহাঁদিগের মাংস ভক্ষণপূর্বক মহর্ষিগণকে রক্ষা করিয়াছিলেন এবং তদ্দ্বারা নিষাদরাজ্য ধংসপূর্বক সাতিশয় হর্ষ লাভ করত সেই আনন্দে দ্বিগুনবিক্রমশালী হইয়া অমৃতহরণে কৃতসংকল্প হইয়াছিলেন।

(বাল্মীকি রামায়ণ/অরণ্যকাণ্ড/৩৫/৩১-৩৪ | পঞ্চানন তর্করত্ন ; পাবলিশার- বেণীমাধব শীলস লাইব্রেরী)  

তাহলে দেখা যায় রামায়ণেও নিষাদদের প্রতি সুস্পষ্ট বিদ্বেষের প্রমাণ রয়েছে। গরুড়ের এই নিষাদধংসের কাহিনী শুধু রামায়ণে নয় মহাভারতেও পাওয়া যায়। মহাভারতে গরুড় অমৃত আহরণ করতে যাওয়ার সময় তার মাকে জিজ্ঞেস করে রাস্তায় তিনি কি খাবেন। তার মা বিনতা তখন উত্তর দেন-

“ বৎস! সমুদ্রমধ্যে বহু সহস্র নিষাদ বাস করে, তুমি তাহাদিগকে ভোজন করিয়া অমৃত আনয়ন কর, কিন্তু হে বৎস! দেখিও যেন ব্রাহ্মণবধে কদাচ তোমার বুদ্ধি না জন্মে। অনল সমান ব্রাহ্মণগণ সর্ব জীবের অবধ্য।ব্রাহ্মণ কুপিত হইলে অগ্নি, সূর্য, বিষ ও শস্ত্রতুল্য হয়েন। ব্রাহ্মণ সর্ব জীবের গুরু। এই নিমিত্ত ব্রাহ্মণ সর্ব ভূতের আদরণীয়। অতএব হে বৎস, তুমি অতিশয় কুপিত হইয়াও যেন কোনক্রমে ব্রাহ্মণের হিংসা বা তাহাদিগের সহিত বিদ্রোহাচরণ করিও না। নিত্য নৈমিত্তিক জপ হোমাদি ক্রিয়াকলাপে নিরত, বিশুদ্ধ ব্রাহ্মণ ক্রুদ্ধ হইলে যেরূপ দগ্ধ করিতে পারেন , কি অগ্নি, কি সূর্য কেহই সেরূপ পারেন না। ব্রাহ্মণ সর্ব জীবের অগ্রজাত, সর্ব বর্ণের শ্রেষ্ঠ  এবং সর্ব ভূতের পিতা ও গুরু।“

(কালিপ্রসন্নের মহাভারত/ আদিপর্ব /২৮ অধ্যায়)

গরুড় তার মায়ের কথা মত নিষাদদের সংহার করেন-

” গরুড় মাতৃবাক্য শ্রবণান্তর পক্ষদ্বয় বিস্তার পূর্বক গগণ মার্গে উড্ডীন হইয়া বুবুক্ষাপ্রযুক্ত সাক্ষাৎ কৃতান্তের ন্যায় নিষাদপল্লীতে উপনীত হইলেন এবং নিষাদ সংহারের নিমিত্ত ধূলিরাশি দ্বারা নভোমন্ডল আচ্ছন্ন ও সমুদ্রের জল শোষণ করিয়া সমীপস্থ সমস্ত মহীধরগণকে বিচলিত করিতে লাগিলেন। পরিশেষে বিহঙ্গরাজ প্রকাণ্ড মুখ ব্যাদান পূর্বক নিষাদ নগরীর পথ রুদ্ধ করিয়া বসিলেন । বিষাদসাগরে নিমগ্ন নিষাদগণ প্রবল-বাত্যাহত ধূলিপটলে অন্ধপ্রায় হইয়া ভুজঙ্গভোজী গরুড়ের অতি বিস্তীর্ণ আননাভি মুখে ধাবমান হইল। যেমন প্রবল বায়ুবেগে সমস্ত বন ঘূর্ণিত হইলে পক্ষীগণ আকাশ মার্গে উঠে, সেইরূপ নিষাদেরাও গরুড়ের অতি বিশাল মুখ বিবরে প্রবিষ্ট হইল। পরিশেষে ক্ষুধার্ত বিহগরাজ মুখ মুদ্রিত করিয়া বহুসংখ্যক নিষাদ ভক্ষণ করিলনে।”

(কালিপ্রসন্নের মহাভারত/ আদিপর্ব /২৮ অধ্যায়)

৩) লেখক দাবী করেছেন, রাম শবরীর এঁটো কুল খেয়েছিলেন। লেখক তার লেখায় অনেকক্ষণ ধরে বাল্মীকি রামায়ণ ছাড়া অন্যান্য রামায়ণের অগ্রহণযোগ্যতা নিয়ে কথা বলেছেন। কিন্তু শবরীর এঁটো কুল খাওয়ার যে উদাহরণ তিনি দিয়েছেন, এটি বাল্মীকির রামায়ণে নেই। বাল্মীকি রামায়ণের অরণ্যকাণ্ডের ৭৩ তম সর্গে শবরীর কথা বলা আছে-  

 “ ওই বনে মাতঙ্গশীষ্যগণের বাসস্থান ছিল। তাহারা গুরুর জন্য প্রতিনিয়ত বন্য ফলমূল আহরণ করিতেন। তৎকালে তাহাদের বহনশ্রমে তাহাদের দেহ হইতে যে অজস্র ঘর্মবিন্দু ভূতলে পড়িত , উহাদের তপবলে তাহাই পুষ্পরূপে উৎপন্ন হইয়াছে। এক্ষণে বহুদিন অতীত হইল, তাহারা লোকান্তরে গিয়াছেন কিন্তু আজিও তথায় শবরী নামে একটি তপস্বী বাস করিতেছেন। ঐ ধর্মপরায়ণা চিরজিবন তাহাদের পরিচারিকা ছিলেন। তুমি সকলের পূজ্য ও দেবপ্রভাব, অতঃপর শবরী তোমায় দর্শন করিয়া স্বর্গারোহণ করিবেন। … “ (বাল্মীকি রামায়ণ/ অরণ্যকাণ্ড/ ত্রিসপ্ততিতম স্বর্গ |অনুবাদক হেমচন্দ্র ভট্টাচার্য)  

অরণ্যকাণ্ডের ৭৪ তম সর্গে বলা হয়েছে-

“ তখন রাম ও লক্ষণ সুগ্রীব দর্শনার্থ কবন্ধ নির্দিষ্ট পথ আশ্রয় করিলেন এবং পর্বতোপরি স্বাদু ফল পূর্ণ বৃক্ষসকল দেখিতে দেখিতে পম্পার অভিমুখে পশ্চিমাস্য হইয়া যাইতে লাগিলেন। দিবা অবসান হইয়া আসিল। উহারা পর্বতপৃষ্ঠে রাত্রিযাপন করিলেন। এবং প্রাতে পম্পার পশ্চিমতটে উপস্থিত হইলেন। তথায় তাপসী শবরীর আশ্রম, বহু বৃক্ষে পরিবৃত ও রমণীয়। উহারা তাহা নির্ণয় পূর্বক শবরীর নিকটস্থ হইলেন। তখন সিদ্ধা উহাদিগকে দেখিবামাত্র তৎক্ষণাৎ কৃতাঞ্জলিপুটে গাত্রোত্থান করিলেন এবং উহাদিগকে প্রণাম করিয়া বিধানানুসারে পাদ্য ও আচমণীয় দিলেন।

অনন্তর রাম ঐ ধর্মাচারিণীকে কহিলেন, অয়ি চারুভাষিণী, তুমি তো তপোবিঘ্ন জয় করিয়াছ? তপস্যা ত বর্ধিত হইতেছে? ক্রোধ ত বশীভূত করিয়াছ? আহার সংযম কিরূপ? নিয়ম ত পালিত হইয়া থাকে এবং গুরুসেবাও ত সফল হইয়াছে?

তখন সিদ্ধসম্মত বৃদ্ধা শবরী সম্মুখিন হইয়া কহিলেন, রাম! অদ্য তোমায় দেখিয়াই আমার তপস্যা সফল, জন্ম স্বার্থক এবং গুরুসেবাও ফলবতী হইল। অদ্য তোমার পূজা করিয়া আমার স্বর্গ হইবে। তুমি যখন সৌম্য দৃষ্টিতে আমায় পবিত্র করিলে , তখন আমি তোমার কৃপায় অক্ষয় লোক লাভ করিব। আমি যে সকল তাপসের পরিচারণা করিতাম , তুমি চিত্রকূটে উপস্থিত হইবামাত্র তাহারা এই আশ্রমপদ হইতে দিব্য বিমানে স্বর্গে আরোহণ করিয়াছেন। ঐ ধার্মিকেরা প্রস্থান কালে আমাকে কহিয়াছিলেন রাম তোমার ঐ পূণ্যাশ্রমে আসিবেন। তুমি তাহাকে ও লক্ষণকে যথোচিত আতিথ্য করিও। তাহাকে দেখিলে তোমার উৎকৃষ্ট অক্ষয় লোক লাভ হইবে। রাম! আমি মুনিগণের এই কথা শুনিয়া তোমার জন্য পম্পাতীর হইতে বন্য ফলমূল আহরণ করিয়াছি।

তখন ধর্মশীল রাম ত্রিকালজ্ঞ শবরীকে কহিলেন, তাপসী! আমি দনুর মুখে তাপসগণের মাহাত্ম্য শুনিয়াছি । এক্ষণে যদি তোমার মত হয় , তবে স্বচক্ষে তাহা দেখিবারও ইচ্ছা করি।

অনন্তর শবরী কহিলেন, রাম ! এই দেখ মৃগপক্ষী পূর্ণ নিবিড় মেঘাকার মতঙ্গবন। এই স্থানে শুদ্ধসত্ত্ব মহর্ষিগণ মন্ত্রোচ্চারণপূর্বক জ্বলন্ত অনলে পবিত্র দেহপঞ্জর আহুতি প্রদান করিয়াছিলেন। এই প্রত্যকস্থলী নাম্নী বেদি; ইহাতে সেই সমস্ত পূজনীয় গুরুদেব শ্রম কম্পিত করে পুষ্পোপহার প্রদান করিতেন। দেখ, তাহাদের তপোবলে আজিও এই অতুলপ্রভা বেদি শ্রী সৌন্দর্যে চতুর্দিক শোভিত করিতেছে। তাহারা উপবাসজনিত আলস্যে পর্যটন করিতে পারিতেন না, ঐ দেখ এই নিমিত্ত সপ্ত সমুদ্র স্মৃতিমাত্র এই স্থানে আসিয়াছেন। তাহারা স্নানান্তে বল্কলসকল বৃক্ষে রাখিতেন, আজিও সেগুলি শুষ্ক হইতেছে না। উহারা পদ্মাদি পুষ্প দ্বারা দেবপূজা করিয়াছিলেন, এখনো সেসকল ম্লান হয় নাই। রাম! এই ত তুমি সমস্ত বনই দেখিলে , যাহা শুনিবার তাহাও শুনিলে , এক্ষণে আজ্ঞা কর আমি দেহত্যাগ করিব।যাহাদের এই আশ্রম , আমি যাহাদের পরিচর্যা করিতাম , এক্ষণে তাহাদিগেরই সন্নিহিত হইব।

রাম শবরীর এই ধর্মসঙ্গত কথা শুনিয়া , যারপরনাই সন্তুষ্ট হইলেন, কহিলেন, আশ্চর্য! ভদ্রে ! তুমি আমাকে সমুচিত পূজা করিয়াছ, এক্ষণে যথায় ইচ্ছা সুখে প্রস্থান কর।

তখন চিরচর্ম ধারিণী জটিলা শবরী রামের অনুজ্ঞাক্রমে অগ্নিকুণ্ডে দেহ আহুতি প্রদান করিলেন। । উহার জ্যোতি প্রদীপ্ত হুতাশনের ন্যায় উজ্জ্বল হইয়া উঠিল। উহার সর্বাঙ্গে দিব্য অলঙ্কার , দিব্য মাল্য ও দিব্য গন্ধ, তিনি উৎকৃষ্ট বসনে যারপরনাই প্রিয়দর্শন হইলেন এবং বিদ্যুতের ন্যায় ঐ স্থান আলোকিত করিতে লাগিলেন। পরে যথায় পূণ্যশীল মহর্ষিরা বিহার করিতেছেন, তিনি সমাধিবলে সেই পবিত্রলোকে গমন করিলেন। ”  (বাল্মীকি রামায়ণ/ অরণ্যকাণ্ড/ চতুঃসপ্ততিতম সর্গ | অনুবাদক- হেমচন্দ্র ভট্টাচার্য )

প্রথমত, বাল্মীকি রামায়ণে কোথাও শবরীর বর্ণ বা জাতির উল্লেখ নেই। শবরী নিম্নবর্ণের ছিলেন কিনা তেমন কিছু সেখানে বলা হয়নি। শবরী রামের জন্য কিছু ফলমূল আহরণ করেছিলেন তা জানা যায় , তবে রাম সেই ফল ভক্ষণ করেছিলেন কিনা সে সম্বন্ধে কিছুই জানা যায় না। আর নিম্নবর্ণের শবরীর এঁটো কুল খাওয়ার ঘটনা তো  বাল্মীকি রামায়ণে পাওয়াই যায় না।  

তাহলে রামের নিম্ন বর্ণের শবরীর এঁটো কুল খাওয়ার কাহিনীটি এলো কোথা থেকে?

দ্বাদশ শতাব্দীর কম্বন এর রামবতারম এ রাম শবরীর খাদ্য গ্রহণ করেন। চতুর্দশ শতাব্দীর তেলেগু ভাষায় রচিত রঙ্গনাথম রামায়ণ এ বলা হয়, রাম শবরীর ফল গ্রহণ করেন। পঞ্চদশ শতাব্দীর সংস্কৃত ভাষায় রচিত আধ্যাত্ম রামায়ণে শবরী নিজেকে নিচু জাতির বলে বর্ণনা করেন। কিন্তু রাম দীর্ঘ বক্তব্য প্রদান করে বলেন ভক্তির কাছে সামাজিক অবস্থানের কোনো স্থান নেই। তুলসী দাসের রামচরিতমানসের শবরী ও রামের কাহিনীতেও আধ্যাত্ম রামায়ণের সুর প্রতিধ্বনিত হয়। কিন্তু এই রামায়ণগুলোর মধ্যে কোথাও রামের শবরীর দেওয়া এঁটো কুল খাওয়ার কথা নেই।

পঞ্চদশ শতাব্দীর বলরাম দাস ওড়িয়া ভাষায় দন্ডি রামায়ণ রচনা করেন। তাতে শবরী রামের জন্য আম সংগ্রহ করার সময় তার স্বাদ জানার জন্য তা খেয়ে দেখেন এবং তা রামের জন্য সংগ্রহ করেন। শবরী এখানে একজন আদিবাসী। শবরীর এঁটো আম খাওয়ার সময় দন্ডি রামায়ণের রাম বলেন তিনি জাতপাতের পরোয়া করেন না।  

বলরাম দাস পঞ্চশাখা দলের সদস্য ছিলেন। পঞ্চশাখারা নিজেদের শূদ্র মুনি বলে পরিচয় দিতেন। তারা ব্রাহ্মণ্যবাদী গোঁড়ামিকে অস্বীকার করতেন। বলরাম দাস কেন রামের নিম্নবর্ণের শবরীর এঁটো আম খাওয়ার কথা লিখেছিলেন তা ধারণা করা যায়।    

তিনশ বছর আগে প্রিয় দাস ব্রজ ভাষায় তার ভক্তি রস বোধিনীতে বৈষ্ণব সন্ন্যাসীদের জীবনী বর্ণনা করেন। সেখানে তিনি শবরীর কথা বলেন। এই গ্রন্থ অনুসারে, পম্পা হ্রদের তীরবর্তী সন্ন্যাসীরা শবরীকে নিম্নবর্ণের অচ্ছুত হিসাবে দেখত,  কিন্তু রাম সেই শবরীর এঁটো কুল খেয়েছিলেন।

গত শতাব্দীতে গীতা প্রেস গোরখপুরের কল্যাণ ম্যাগাজিনে প্রিয় দাসের শবরীর কাহিনীকে জনপ্রিয় করে তোলা হয়। ১৯৮৭-৮৯ সালের রামানন্দ সাগরের রামায়ণের টিভি সিরিজ বেশ বিখ্যাত হয়। প্রিয় দাসের কাহিনীর মত এখানেও রাম শবরীর এঁটো কুল খাচ্ছেন বলে দেখানো হয়। ফলস্বরূপ এই কাহিনীটিই হিন্দুদের মধ্যে অধিক জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।  ( তথ্যসূত্র- Dining out at Lake Pampa- Philip Lutgendorf )    

এভাবেই বাল্মীকির রামায়ণে রামের এঁটো কুল খাওয়ার কথা না থাকলেও হিন্দুদের মাঝে তা ছড়িয়ে পড়ে। আর দেখা যায় এই কাহিনীগুলো খুবই অর্বাচীন , পঞ্চদশ শতাব্দীর আগের নয়।

লেখক বাল্মীকি রামায়ণ ছাড়া বাকি রামায়ণগুলোকে অপ্রমাণিক বলে বিবেচনা করলেও রামচন্দ্রের শবরীর এঁটো কুল খাওয়ার কাহিনীটি যে বাল্মীকি রামায়ণে নেই, তা যাচাই করেননি।

দাবীঃ শম্বুক হত্যা, জাতপাত রামের চরিত্রের সাথে যায় না।

উত্তরঃ রামচন্দ্র বালীকে হত্যা করার জন্য আড়াল থেকে তীর নিক্ষেপ করলে বালী তাকে ভর্ৎসনা করেন। বালীর অভিযোগের উত্তর দিতে গিয়ে রাম মনুর উল্লেখ করে মনুসংহিতা হতে দুটি শ্লোক উদ্ধৃত করেন-

शक्यम् त्वया अपि तत् कार्यम् धर्मम् एव अनुवर्तता |
श्रूयते मनुना गीतौ श्लोकौ चारित्र वत्सलौ ||
गृहीतौ धर्म कुशलैः तथा तत् चरितम् मयाअ || ४-१८-३०

অর্থাৎ,  আর তুমিও যদি ধর্মের অপেক্ষা রাখিতে , তাহা হইলে তোমায় স্বতঃপ্রবৃত্ত হইয়াই এই দণ্ড ভোগ করিতে হইত। মহর্ষি মনু চরিত্র শোধক দুইটি শ্লোক কহিয়াছেন , ধার্মিকেরা তাহাতে আস্থা প্রদর্শন করেন , আমিও সেই ব্যবস্থাক্রমে এইরূপ করিলাম। (অনুবাদক- হেমচন্দ্র ভট্টাচার্য)

राजभिः धृत दण्डाः च कृत्वा पापानि मानवाः |
निर्मलाः स्वर्गम् आयान्ति सन्तः सुकृतिनो यथा || ४-१८-३१

शसनात् वा अपि मोक्षात् वा स्तेनः पापात् प्रमुच्यते |
राजा तु अशासन् पापस्य तद् आप्नोति किल्बिषम् || ४-१८-३२

অর্থাৎ, মনু কহিয়াছেন, মনুষ্যেরা পাপাচরণ পূর্বক রাজদণ্ড ভোগ করিলে বীতপাপ হয় এবং পূণ্যশীল সাধুর ন্যায় স্বর্গে গমন করিয়া থাকে । নিগ্রহ বা মুক্তি যেরূপে হউক , পাপী শুদ্ধ হয় কিন্তু যে রাজা দণ্ডের পরিবর্তে মুক্তি দিয়া থাকেন , পাপ তাহাকেই স্পর্শে। ( অনুবাদক- হেমচন্দ্র ভট্টাচার্য)

রামচন্দ্র মনুর যে কথার উদ্ধৃতি দিলেন তা মনুসংহিতায় (৮/৩১৬-৩১৮) রয়েছে।  সুতরাং দেখা যায়, রাম মনুকে চেনেন এবং মান্যও করেন। রাম যে মনুর মতোই জাতিবাদী তা রামের শম্বুক বধে ফুটেও ওঠে। বাল্মীকি রামায়ণে বর্ণিত রামের চরিত্রের সাথে শম্বুক বধ একদমই অসামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। ( মনুর ব্রাহ্মণ্যবাদ, শূদ্রের প্রতি দমনপীড়নমূলক আইন এবং নারীদের প্রতি বৈষম্যমূলক বিধান এখান থেকে পড়ুন। )

দাবীঃ ১) প্রাচীন ভারতে বর্ণব্যবস্থা বংশানুক্রমিক ছিল না। বর্ণ ছিল পেশা ভিত্তিক এবং পেশা পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বর্ণও পরিবর্তন হয়ে যেত। যেমনঃ বিশ্বামিত্র। ইনি জন্মসূত্রে ক্ষত্রিয় হলেও নিজ কর্মের দ্বারা ব্রাহ্মণত্ব অর্জন করেন।যেহেতু প্রাচীনকালে বর্ণ পরিবর্তন করা যেত, তাই রাম শম্বুককে হত্যা করতে পারেন না। ২)বাল্মীকির রামায়ণ ছাড়াও ভারতবর্ষে নানাভাষায় রামায়ণ লেখা হয়েছে। তুলসি দাসের রামচরিত মানস, কৃত্তিবাসের শ্রীরাম পাঁচালি। তারা নিজেদের মত করে রামায়ণকে কাটাছেড়া করেছেন । যেমন বাল্মীকির রাম দুর্গাপূজা করেননি, কিন্তু কৃত্তিবাস তাকে দিয়ে দুর্গাপূজা করিয়েছেন। প্রাচীন হিন্দু ধর্ম সাহিত্যের সবচেয়ে বড় অসুবিধা হল তুলসী দাস থেকে নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ি যে যখন পেরেছেন রামায়ণ, মহাভারতকে সম্পাদনা করেছেন তার ফল আমরা ভোগও করছি। এর ফলে শম্বুক বধ, সীতার বনবাস, অগ্নিপরীক্ষার মত অশুদ্ধি রামায়ণে ঢুকে পড়ে ভারতবর্ষের বুকে জন্মানো রামের চরিত্রকে কালিমালিপ্ত করেছে।  শম্বুক বধ, সীতার বনবাস, অগ্নিপরীক্ষা ইত্যাদি রয়েছে রামায়ণের উত্তরকাণ্ডে। এই উত্তরকাণ্ড আদি রামায়ণের অংশ নয়। একে পরবর্তীতে ঢোকানো হয়েছে।  

উত্তরঃ ১) এটা সত্য যে একেবারে আদিতে বর্ণব্যবস্থার অত্যন্ত কঠিন রূপ বিদ্যমান ছিল না। হিন্দু গ্রন্থে বর্ণপরিবর্তন এর অনেক উদাহরণ পাওয়া যায়, যার মধ্যে বিশ্বামিত্রের বর্ণ পরিবর্তন এর উদাহরণ একটি। এছাড়া মহাভারত হতে জানা যায়,  বীতহব্য ক্ষত্রিয় থেকে ব্রাহ্মণ হয়েছিলেন। এটাও সত্য যে, বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থে বর্ণপরিবর্তনকারী বিশ্বামিত্রকে সম্মানিত এক ব্যক্তিত্ব হিসেবেই দেখা যায়। হিন্দু শাস্ত্রে বর্ণ পরিবর্তন এর অনেক উদাহরণ রয়েছে যা আদিমকালের শিথিল বর্ণব্যবস্থার স্মৃতি। কিন্তু এই বর্ণব্যবস্থাই একসময় কঠোর হয়ে পড়ে। জন্মের দ্বারাই তা নির্ধারিত হতে থাকে, কর্মের দ্বারা এর পরিবর্তন অসম্ভব পড়ে। কোনো ব্যবস্থাই যেমন রাতারাতি গড়ে ওঠেনা, তেমনি কঠোর জাতিপ্রথাও রাতারাতি গড়ে ওঠেনি। প্রথমদিকের নমনীয় বর্ণব্যবস্থা যেমন ঐতিহাসিক সত্য, তেমনি পরবর্তীকালে এর যে কঠিন রূপটি ইতিহাসে ফুটে উঠেছিল, অসংখ্য মানুষ যার বলী হয়েছিল , সেটাও ঐতিহাসিক সত্য। প্রাচীন ভারত বলতে লেখক ঠিক কোন সময়কে বোঝাচ্ছেন তা বোধগম্য হচ্ছে না। প্রাচীন ভারতের গ্রন্থের মধ্যে যদি রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণ, ধর্মশাস্ত্র ইত্যাদি পড়ে তাহলে বলতে হয় প্রাচীন ভারতেও বর্ণব্যবস্থা কঠোর ও বংশানুক্রমিক ছিল।   

বংশানুক্রমিক কঠোর বর্ণব্যবস্থা সম্পর্কে জানতে নিচের  লেখাগুলো পড়ে দেখতে পারেন –

২) রামের শম্বুক হত্যার ঘটনাটি কেবল যে বাল্মীকি রামায়ণের উত্তরকাণ্ডে (লেখক একে প্রক্ষিপ্ত মনে করেন) রয়েছে তা কিন্তু নয়। মহাভারতেও রামের শূদ্র শম্বুক হত্যার ঘটনাটি উক্ত হয়েছে। মহাভারতের শান্তি পর্বে বলা হয়েছে-

“আমি শুনিয়াছি যে, সত্যপরাক্রম মহাত্মা রামচন্দ্র তপঃ পরায়ণ শম্বুক নামক শূদ্রকে বিনাশ করিলে সেই ধর্ম প্রভাবে এক ব্রাহ্মণ বালক পুনরুজ্জীবিত হইয়াছিল।“

(কালিপ্রসন্ন সিংহ কর্তৃক অনূদিত মহাভারত/ শান্তি পর্ব/ ত্রিপঞ্চাশদধিক শততম অধ্যায়)

তাহলে কি মহাভারতের শান্তি পর্বও প্রক্ষিপ্ত?

লেখক মনে করেন যে তুলসী দাসের রামচরিত মানস, কৃত্তিবাসের শ্রীরাম পাঁচালি এগুলো মূল প্রামাণ্য রামায়ণ নয়। লেখক যদি তাই মনে করে থাকেন, তবে তিনি কেন বারবার তার লেখাটিতে কৃত্তিবাসী রামায়ণ থেকে তথ্য দিয়েছেন তা বোধগম্য হয় না। রাম বিশ্বামিত্রকে সম্মান করতেন তার উদাহরণ লেখক কৃত্তিবাসী রামায়ণ থেকে দেন-

“প্রজার বিপদ শুনি রামের ত্রাস।

ধাইয়া গেলেন রাম বিশ্বামিত্র-পাশ।। 
মুনির চরণ ধরি বলে রঘুমণি।

প্রজালোকে রক্ষা প্রভু করহ আপনি।।“

হিন্দুদের মধ্যে অনেকেই উত্তরকাণ্ডকে প্রক্ষিপ্ত বলেন। উত্তরকাণ্ডের উল্লেখ রামায়ণের আদিকাণ্ডে রয়েছে-

প্রাপ্তরাজ্যস্য রামস্য বাল্মীকির্ভগবানৃষিঃ।

চকার চরিতং কৃৎস্নং বিচিত্রপদমর্থবৎ।। ১

চতুর্ব্বিংশসহস্রাণি শ্লোকানামুক্তবানৃষিঃ।

তথা সর্গশতান্ পঞ্চ ষট্কাণ্ডানি তথোত্তরম্।। ২

অর্থাৎ, ভগবান বাল্মীকি, লব্ধরাজ্য রামের সমস্ত চরিত্র, বিচিত্রপ ও সুপ্রশস্তার্থ- সমন্বিত প্রবন্ধে বর্ণন করেন। মুনিবর এই প্রবন্ধে প্রথমত ছয় কাণ্ড, পঞ্চশত সর্গ ও চতুর্বিংশতি সহস্র শ্লোক এবং শেষে উত্তরকাণ্ড নির্দেশ করিয়াছেন।

( বাল্মীকি রামায়ণ/ আদিকাণ্ড/ চতুর্থ সর্গ | অনুবাদক – পঞ্চানন তর্করত্ন)

উত্তরকাণ্ডে বর্ণিত সীতার বনবাসের প্রসঙ্গ বাল্মীকি রামায়ণের আদিকাণ্ডেও এসেছে-

প্রেষণং বায়ূপুত্রস্য ভরতেণ সমাগমম্ ।

রামাভিষেকাভ্যুদয়ং সর্ব্বসৈন্যবিসর্জ্জনম্।

স্বরাষ্ট্ররঞ্জনং চৈব বৈদেহ্যাশ্চ বিসর্জ্জনম্।। ৩৮

অর্থঃ (বাল্মীকি) ভরতের নিকট হনুমানকে প্রেরণ, ভরতের সহিত সমাগম, রাজ্যাভিষেক-সমারোহ, সমস্ত সৈন্য বিসর্জন, রাজ্য রঞ্জন ও সীতাদেবীকে বনে প্রেরণ বর্ণন করেন।( বাল্মীকি রামায়ণ / আদিকাণ্ড/ ৩য় সর্গ | অনুবাদক- পঞ্চানন তর্করত্ন)

উত্তরকাণ্ডের উল্লেখ ও সীতার বনবাসের উল্লেখ আদিকাণ্ডতে থাকার কারণে কি উত্তরকাণ্ডের সাথে সাথে আদিকাণ্ডও প্রক্ষিপ্ত?

লেখকের কথা মোতাবেক উত্তরকাণ্ডের সীতার বনবাস, অগ্নিপরীক্ষা, পাতাল প্রবেশ, শম্বুক বধ ইত্যাদি ঘটনা ভারতবর্ষের বুকে জন্মানো শ্রীরামের চরিত্রকে কালিমালিপ্ত করেছে। সীতার বনবাস, পাতাল প্রবেশ, শম্বুক বধ না হয় রামায়ণের উত্তরকাণ্ডে রয়েছে, কিন্তু সীতার অগ্নিপরীক্ষা রামায়ণের লঙ্কাকাণ্ডে রয়েছে। সীতার সাথে রাম যেমন আচরণ করেন এবং যার ফলে সীতা অগ্নিপরীক্ষা দিতে বাধ্য হন, তাও কিন্তু রামের চরিত্রকে কালিমাহীন করে না ।লঙ্কাকাণ্ডে যেহেতু সীতার অগ্নিপরীক্ষার কথা রয়েছে, তাহলে কি এখন ভারতবর্ষের রামের চরিত্র বর্ণনাকারী রামায়ণের লঙ্কাকাণ্ডও প্রক্ষিপ্ত?

মহাভারতেও রামের উপাখ্যান পাওয়া যায়। সেখানেও রাম সীতা উদ্ধারের পর তার সাথে খারাপ ব্যবহার করেন-

“রাবণ বধের পর রাম বিভীষণকে লঙ্কারাজ্য দান করলেন। অনন্তর বৃদ্ধ মন্ত্রী অবিন্ধ্য বিভীষণের সঙ্গে সীতাকে রামের কাছে এসে বললেন, সুচরিত্রা দেবী জানকীকে গ্রহণ করুন। বাষ্পাকুলনয়না শোকার্তা সীতাকে দেখে রাম বললেন, বৈদেহী, আমার যা কর্তব্য তা করেছি। আমি তোমার পতি থাকতে তুমি রাক্ষস গৃহে বার্ধক্য দশা পাবে তা হতে পারে না, এই কারণেই আমি রাবণকে বধ করেছি। আমার ন্যায় ধর্মজ্ঞ লোক পরহস্তগতা নারীকে ক্ষণকালের জন্যও নিতে পারে না। তুমি সচ্চরিত্রা বা অসচ্চরিত্রা যাই হও , কুক্কুরভুক্ত হবির ন্যায় তোমাকে আমি ভোগের জন্য নিতে পারি না।

এই দারুণ বাক্য শুনে সীতা ছিন্ন কদলীতরুর ন্যায় ভূপতিত হলেন। এই সময়ে ব্রহ্মা, ইন্দ্র, অগ্নি, বায়ু প্রভৃতি দেবগণ, সপ্তর্ষিগণ, এবং দিব্যমূর্তি রাজা দশরথ হংসযুক্ত বিমানে এসে দর্শন দিলেন। সীতা রামকে বললেন, রাজপুত্র, তোমার উপর আমার ক্রোধ নেই, স্ত্রীপুরুষের গতি আমার জানা আছে। যদি আমি পাপ করে থাকি , তবে আমার অন্তশ্চর প্রাণবায়ু আমাকে ত্যাগ করুন। যদি আমি স্বপ্নেও অন্য পুরুষকে চিন্তা না করে থাকি তবে বিধাতার নির্দেশে তুমিই আমার পতি থাক। তখন দেবতারা রামকে বললেন, অতি সূক্ষ্ম পাপও মৈথেলির নেই , তুমি একে গ্রহণ কর । দশরথ বললেন,  বৎস, তোমার মঙ্গল হউক, চতুর্দশ বর্ষ পূর্ণ হয়েছে , তুমি অযোধ্যায় গিয়ে রাজ্য শাসন কর।“ ( রাজশেখর বসু কর্তৃক অনূদিত মহাভারত/ বন পর্ব – ৫৪)

তাহলে কি মহাভারতের বন পর্বও প্রক্ষিপ্ত? যেহেতু আজকের যুগে এসে নিজ ধর্মের যা পছন্দ হয়না তাকেই প্রক্ষেপ বলার একটা প্রবণতা লক্ষ্য করা যায় অনেক হিন্দু ধর্মানুসারীদের মধ্যে! এত প্রক্ষেপ যুক্ত গ্রন্থগুলো কি করে হিন্দুদের কাছে ধর্মগ্রন্থ হিসেবে মান্যতা পেতে পারে তা কিছুতেই বোধগম্য হচ্ছে না।

দাবীঃ সমগ্র রামায়ণের ভিত্তিই হল শূদ্রের অভিশাপ। রামের পিতা দশরথ শূদ্র তপস্বীকে ভুলবশত হত্যা করেন। শূদ্র তপস্বীর পিতা দশরথকে অভিশাপ দেয় যে দশরথেরও পুত্রশোক ভোগ করতে হবে। সেই দশরথের পুত্র রাম কেন শূদ্র তপস্বীকে হত্যা করতে যাবেন?  

উত্তরঃ অযোধ্যাকাণ্ডের ৬৩ তম সর্গে দশরথ ভুলবশত শব্দভেদী বান দ্বারা এক তপস্বী যুবককে হত্যা করেন। সেই তপস্বী মারা যাওয়ার আগে দশরথের সাথে কিছুক্ষণ কথা বলেন। তপস্বীর কথা মত দশরথ তার মৃত্যুসংবাদ তার মাতা পিতার কাছে পৌঁছে দিতে যান। সেই তপস্বীর মাতা পিতাকে দশরথ সব কিছু বলেন। তপস্বীর পিতা দশরথকে অভিশাপ দেন-

पुत्रव्यसनजं दुःखं यदेतन्मम साम्प्रतम्।

एवं त्वं पुत्रशोकेन राजन्कालं करिष्यसि।।2.64.55।।

অর্থাৎ, আমি যেমন পুত্রশোকে ভুগছি, তোমারও তেমনি পুত্রশোকেই মৃত্যু হবে।

মুনিকুমারকে শূদ্র বলে দাবী করা হয়েছে। মুনি কুমার শূদ্র ছিলেন না। তার পিতা ছিলেন বৈশ্য এবং মাতা ছিলেন শূদ্র বর্ণের। সেই হিসাবে মুনিকুমার অনুলোমজ (যখন পিতা উচ্চবর্ণের ও মাতা নিম্নবর্ণের) সঙ্কর বর্ণের ছিলেন।  তবে মুনিকুমারের পিতা মাতা উভয়কেই অবশ্য তপস্যা করতে দেখা যায়। এমনকি পুত্রের মৃত্যুর পর বৈশ্য পিতার সাথে সাথে শূদ্রা মাতাও স্বর্গে আরোহণ করেন। এতটুকু পড়ে মনে হতে পারে যে এই কাহিনী সম্পূর্ণভাবে বর্ণবাদের বিপরীতে যায়। কিন্তু আসলে তা নয়।  মুনিকুমার মৃত্যুর আগে দশরথকে বলেছিলেন-

संस्तभ्य शोकं धैर्येण स्थिरचित्तो भवाम्यहम्। 

ब्रह्महत्याकृतं पापं हृदयादपनीयताम्।।2.63.52।।

न द्विजातिरहं राजन्मा भूत्ते मनसो व्यथा।

शूद्रायामस्मि वैश्येन जातो जनपदाधिप।।2.63.53।

অর্থাৎ, আমি ধৈর্যের সহিত চিত্তের স্থৈর্য সম্পাদন এবং শোক সংবরণপূর্বক কহিতেছি, শ্রবণ কর। ব্রহ্মহত্যা করিলাম বলিয়া তোমার মনে যে সন্তাপ উপস্থিত হইয়াছে , তুমি এক্ষণে তাহা পরিত্যাগ কর। আমি ব্রাহ্মণ নহি , বৈশ্যের ঔরসে শূদ্রার গর্ভে আমার জন্ম হইয়াছে। (হেমচন্দ্র ভট্টাচার্যের অনুবাদ)

এখানে ব্রহ্মহত্যা বলে একটি শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। অন্যান্য বর্ণের প্রাণের চাইতে ব্রাহ্মণের প্রাণকে অধিক মূল্যবান দেখিয়ে ব্রাহ্মণের হত্যাকে ব্রহ্মহত্যা নাম দেওয়া হয়েছিল। অন্যান্য বর্ণের মানুষকে হত্যা করার চাইতে ব্রহ্মহত্যা করা একটি বড় অপরাধ ছিল। এখানেও একই কথা পাওয়া যাচ্ছে , মুনিকুমার দশরথকে বলছেন তিনি বৈশ্যার ঔরসে শূদ্রার গর্ভে জন্মেছেন, তাই দশরথের ব্রহ্মহত্যার মত অধিক পাপ হবে না।


বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ কলকাতা 24*7 এর আলোচ্য আর্টিকেলটির খন্ডনে কিছু বাড়তি যুক্তিও যুক্ত করেছি এই লেখাটিতে এবং সেই লেখাটির যুক্তিগুলোকে বিক্ষিপ্ত অবস্থা থেকে প্রয়োজনে সাজাতেও হয়েছে। এইসকল যুক্তিগুলো রামের পক্ষ নিয়ে কেউ ব্যবহার করতে পারেন। 


সহায়ক গ্রন্থ-

  • হেমচন্দ্র ভট্টাচার্য কর্তৃক অনুবাদিত রামায়ণ
  • রাজশেখর বসুর মহাভারত
  • মনুসংহিতা
  • Dining Out at Lake Pampa-Philip Lutgendorf, University of Iowa

তথ্যসূত্র-

(1)  বাল্মীকি রামায়ণ/ অযোধ্যাকাণ্ড/ পঞ্চাশ সর্গ | অনুবাদক- হেমচন্দ্র ভট্টাচার্য

(2) समाश्वस मुहूर्तम् तु शक्यम् वस्तुम् इह त्वया || ३-४७-२२
आगमिष्यति मे भर्ता वन्यम् आदाय पुष्कलम् |
रुरून् गोधान् वराहान् च हत्वा आदाय अमिषान् बहु || ३-४७-२३

“Be comfortable for a moment, here it is possible for you to make a sojourn, and soon my husband will be coming on taking plentiful forest produce, and on killing stags, mongooses, wild boars he fetches meat, aplenty. (3-47-22b, 23) source

রাম লক্ষ্মণকে বলেন, “  বৎস্য, এক্ষণে আমাদিগকে মৃগ মাংস আহরণ করিয়া গৃহযাগ করিতে হইবে। যাহারা বহুদিন জীবনধারণের বাসনা করেন , তাহাদিগের বাস্তুশান্তি করা আবশ্যক। অতএব তুমি অবিলম্বে মৃগবধ করিয়া আন। শাস্ত্রনির্দিষ্ট বিধি পালন করা সর্বতোভাবেই শ্রেয় হইতেছে।

তখন লক্ষ্মণ বন হইতে মৃগ বধ করিয়া আনিলেন। তদ্দর্শনে রাম পুনরায় তাহাকে কহিলেন , বৎস্য, তুমি গিয়া এই মৃগের মাংস পাক কর ; আমি স্বয়ংই বাস্তুশান্তি করিব। দেখ, অদ্যকার দিবসের নাম ধ্রুব এবং এই মুহূর্তও সৌম্য , অতএব তুমি এই কার্যে  যত্নবান হও। তখন লক্ষ্মণ প্রদীপ্ত বহ্নিমধ্যে পবিত্র মৃগমাংস নিক্ষেপ করিলেন এবং উহা শোণিতশূণ্য ও উত্তপ্ত হইয়াছে দেখিয়া রামকে কহিলেন, আর্য, আমি এই সর্বাঙ্গ সুন্দর কৃষ্ণ বর্ণ মৃগ অগ্নিতে পাক করিয়া আনিলাম, আপনি এক্ষণে গৃহযাগ আরম্ভ করুন।“ ( বাল্মীকি রামায়ণ/ অযোধ্যা কাণ্ড/  ষটপঞ্চাশ সর্গ | অনুবাদক- হেমচন্দ্র ভট্টাচার্য)

(3)  অযোধ্যা কাণ্ড / একপঞ্চাশ – দ্বিপঞ্চাশ সর্গ

(4)  বাল্মীকি রামায়ণ/ অযোধ্যাকাণ্ড/ পঞ্চাশ সর্গ | অনুবাদক- হেমচন্দ্র ভট্টাচার্য

অজিত কেশকম্বলী II

"মানুষ ছাড়া ক্ষ্যাপারে তুই মূল হারাবি, মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি।"

6 thoughts on “রামের শূদ্র শম্বুক হত্যা নিয়ে আপনি অবাক কেন হচ্ছেন?

  • June 29, 2019 at 5:26 AM
    Permalink

    আবার একবার ধার্মিকদের hypocrisy কে ধুয়ে দিলেন আপনার তথ্যবহুল ও যুক্তিসমৃদ্ধ লেখাটির মাধ্যমে। এভাবেই আরও সমৃদ্ধ করুন মানুষকে। অনেক ভালোবাসা❤

    Reply
  • July 4, 2019 at 12:39 PM
    Permalink

    এটা চলতে থাকবে ততদিন যতদিন আমরা আর্যদের জাতব‍্যবস্থা মেনে নেবো।
    আর হিন্দু হয়ে এদের জাতব্যবস্থার শয়তানি মানবেন না, এটা হয় ? হিন্দু -ব্যবস্থাতো চার-বর্ণ ব্যবস্থা-সর্বস‍্য । হিন্দু হলেই আপনার কোন না কোন জাত হতেই হবে ,সেগুলোর মধ্যে আবার শয়তানগুলো উচু-নিচুর ভেদাভেদ রেখেছে, নিজেদের স্বার্থে।
    সুতরাং এ থেকে মুক্তি পেতে
    ছোটজাত গুলোর আর কোন উপায় নেই ,একমাত্র হিন্দু-ধর্ম ত‍্যাগ করলেই এর অবসান হবেই হবে।
    আপনারা -আমরা বজ্জাত বামুনের দেওয়া হিন্দু ধর্মকে কেন নিজের ধর্ম মনে করে গর্ব করব ?, আর কেনইবা মিছি-মিছি শয়তান গুলোর গাল খাবো ?
    পাল যুগে আমরাতো বৌদ্ধ ছিলাম, তারপর শয়তানদের ফাদে পড়ে , চন্ডাল থেকে হিন্দু হয়েই যত ভুল হোল।আমরা আবারও জাতপাতহীন পরিচ্ছন্ন বৌদ্ধ
    ধর্মে convert হলে এই সমস্যার সমাধান সম্ভব হবে। বাবাসাহেব আম্বেদকর বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহন করে স্বাধর্মে প্রত্যাবর্তন করেছিলেন।

    Reply
    • November 5, 2021 at 10:31 PM
      Permalink

      সম্পূর্ণ বাজে কথা এটা তোকে কে বলেছে যে বৌদ্ধধর্মে জাতপাত নেই কিংবা ভারতবর্ষের বৌদ্ধরা জাতপাত মানতেন না। তোর বৃটিশদের দালাল আম্বেদকর না হিন্দুধর্ম দর্শন বুঝেছে না বৌদ্ধ ধর্ম ও দর্শন বুঝেছে। তোর গৌতম বুদ্ধ নিজেই ৫৫১টা জাতকের গল্পের মধ্যে ১০৫বার ব্রাহ্মণের ঘরে জন্মেছিলেন। ওনার সর্ব্বপ্রথম ছাত্র ছিলেন কৌণডিন্য যিনি একজন বিশ্বকর্মা ব্রাহ্মণ ছিলেন। প্রথম বৈদ্ধ কাউন্সিলের যিনি হেড ছিলেন তাঁর নাম মহাকাশ্যপ আর তিনি একজন ব্রাহ্মণ সন্তান। বৌদ্ধ ধর্মে এক উপালী ছাড়া আর কোনও নিম্নবর্ণের মানুষ মহান কোনও কাজ করেছিলো এমন কোনও প্রমাণ নেই। যদি থাকে তো ২০জন শূদ্র বৌদ্ধ আচার্য্যের নাম বল! হীনযানীরা যখন মহাযানীদের থেকে আলাদা হয়ে যায় তখন মহাযানী বৌদ্ধ যাঁরা ছিলো দার্শনিক তাঁদের মধ্যেকার প্রত্যেকেই হয় ব্রাহ্মণ সন্তান ছিলো নয়তো ছিলো ক্ষত্রিয়। দ্বিতীয় বৌদ্ধ বলা হয় নাগার্জুনকে আর তিনি ছিলেন ব্রাহ্মণ সন্তান। ধর্মাকীর্তিও তাই। বসুবন্ধু আসাঙ্গা কোন জাতিতে পরতো সেটা একটু গুগুল করে দেখে নিস। ও হ্যাঁ ভালো কথা ললিতবিস্তার সূত্রে স্পষ্টতই লেখা আছে যে বোধীসত্ত্ব কোনও নিম্নবর্ণের জন্মাননা। তিনি একমাত্র ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়কুলেই জন্মান। একটু পড়াশুনা কর কাজে দেবে। আর নারীদের প্রতি সম্মান! আর হাসাস না। জাতকের গল্পগুলি একটু পড়িস কেমন! তোকে অন্তত ২০টা জাতকের গল্প দেখাতে পারবো যেখানে নারীদের বেশ্যা পর্যন্ত বলা হয়েছে।

      Reply
  • August 8, 2020 at 1:50 PM
    Permalink

    যে কোনো ধর্ম গ্রন্থ এর শেষে থাকে মাহাত্ম্য,তেমনি যুদ্ধকান্ডো র শেষেও মাহাত্ম্য আছে। তাহলে উত্তরা কান্ড টি কি পড়ে যোগ করা হয় বলে কি মনে হয় না?

    Reply
    • January 29, 2021 at 3:39 AM
      Permalink

      রামায়ণের বালকাণ্ডেও মাহাত্ম্য আছে। তার মানে কি রামায়ণ বালকাণ্ডে সমাপ্ত?

      Reply
  • November 5, 2021 at 10:21 PM
    Permalink

    চল তুইযে কতোবড় মিথ্যাবাদী জোচ্চর সেটা প্রমাণ করি। অরণ্যকাণ্ড, ৭৪ নং অধ্যায়, ১৮নং শ্লোক, গীতা প্রেস

    “…এবমুক্তঃ স ধর্মাত্মা শবর্যা শবরীমিদম্
    রাঘবঃ প্রাহ বিজ্ঞানে তাং নিত্যমবহিষ্কৃতাম্…”

    শবরী এইরকম বললে, ধর্মাত্মা রঘুনন্দন শ্রীরাম, আত্মজ্ঞানস্বরূপে অবহিষ্কৃতা ( অনার্যা হয়েও আর্য্যসমাজে স্বীকৃতা) শবরীকে বললেন-

    ( এই শ্লোকে স্পষ্টতই বুঝা যাচ্ছে তিনি এক অনার্য্য কর্ণ্যা ছিলেন তথাপি তিনি একজন যোগীনি আর তুই বলছিস তাঁর নাকি জাতি সঠিকভাবে নিরুপণই করা যায়না)

    এইবার প্রশ্ন হচ্ছে শবরী অগ্নিতে প্রবেশ করলেন কেন? তারও উত্তর পরের শ্লোকগুলিতেই আছে।

    ২২নং শ্লোক “…ইহ তে ভাবিতাত্মানো গুরবো মে মহাদ্যুতে।
    জুহবাংচক্রিরে নীড়ং মন্ত্রবন্মন্ত্রপূজিতম্…”

    হে মহাদীপ্তিমান রামচন্দ্র! এখানে ব্রহ্মভাব ভাবিত চিত্ত পূতমনাঃ আমার সেই গুরুগণ কুটির করেছিলেন এবং মন্ত্রপুত দেহকে মন্ত্রোচারণপূর্বক এখানেই অগ্নিতে আহুতি দিয়েছিলেন।

    ২৯নং শ্লোক “…তেষামিচ্ছাম্যহং গন্তুং সমীপং ভবিতাত্ননাম্
    মুনীনামশ্রমো যেষামহং চ পরিচারিণী…”

    আমি যাঁদের সেবিকা, যাঁদের এই আশ্রম, ব্রহ্মভাবে ভাবিতচিত্ত সেই মুনিদের কাছে আমি যেতে চাইছি।

    আর শবরী যে একজন তপস্বিনী ছিলেন তাঁর প্রমাণ ৬ নং শ্লোক “…তৌ দৃষ্ট্বা তু তদা সিদ্ধা সমুত্থায় কৃতাঞ্জলিঃ
    পাদৌ জগ্রাহ রামস্য লক্ষ্মণস্য চ ধীমতঃ…”

    আর বেশী কিছু বললাম না।

    Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *