স্বতন্ত্র ভাবনাসংশয়বাদস্টিকি

ঈশ্বরের ধর্মবিশ্বাস

ঈশ্বর সব কিছু সৃষ্টি করেছেন বলে শোনা যায়, কিন্তু তাকে নাকি কেউ সৃষ্টি করেন নি অর্থাৎ তিনি নাস্তিক। এই ঈশ্বর অলৌকিক সত্ত্বা। তিনি আমাদের কাছে গুরুত্বহীন। ওনার চেয়ে  আমাদের কাছে ঢের গুরুত্বপূর্ণ পৃথিবীর ঈশ্বর, মানে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, যিনি সমাজ সংস্কারক হিসাবে ভারতবাসীর অন্তরে অমর হয়ে আছেন । দেশের অশিক্ষা-কুসংস্কারের তিমিরে আলোকশিখা হয়ে এসেছিলেন তিনি। বিদ্যাসাগরের ধর্মবিশ্বাস ঠিক কি ছিল? জানা যায় তিনিও নাকি তথাকথিত সর্বশক্তিমানের মতই নাস্তিক ছিলেন!

আচার্য কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্য লিখেছেন,” বিদ্যাসাগর নাস্তিক ছিলেন, একথা বোধহয় তোমরা জানো না, যাহারা জানিতেন তাহারা কিন্তু সে বিষয় লইয়া তাহার সঙ্গে বাদানুবাদে প্রবৃত্ত হইতেন না।…. ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে আমাদের দেশে যখন ইংরাজি শিক্ষার প্রবর্তন হয়, তখন আমাদের ধর্ম বিশ্বাস শিথিল হইয়া গিয়েছিল। যেসকল বিদেশীয় পণ্ডিত বাংলাদেশে শিক্ষকতা আরম্ভ করিলেন, তাহাদের অনেকের নিজ নিজ ধর্মে বিশ্বাস ছিল না। ডেভিড হেয়ার নাস্তিক ছিলেন, একথা তিনি কখনও গোপন করেন নাই, ডিরোজিও ফরাসী রাষ্ট্রবিপ্লবের সাম্য মৈত্রি স্বাধীনতার ভাব হৃদয়ে পোষণ করিয়া ভগবানকে সরাইয়া reason পূজা করিতেন। পাশ্চাত্য সাহিত্যের ভাবনায় এদেশীয় ছাত্রদের ধর্মবিশ্বাসই ছিল। চিরকাল পোষিত হিন্দুর ভগবান সেই বন্যায় ভাসিয়া গেলেন। বিদ্যাসাগর নাস্তিক হইবেন তাহাতে আর আশ্চর্য কি?” (1)

বিদ্যাসাগরের জীবনীকার গোঁড়া হিন্দু বিহারীলাল সরকার গভীর আক্ষেপের সঙ্গে বিদ্যাসাগরের সম্বন্ধে লিখেছেন, “আধ্যাপকের বংশে জন্ম লইয়া ব্রাহ্মণ পণ্ডিতের সন্তান হইয়া,  হৃদয়ে অসাধারণ দয়া, পরদুঃখকাতরতা প্রবৃত্তি পোষণ করিয়া হিন্দু শাস্ত্রের প্রতি, হিন্দু ধর্মের প্রতি তিনি আন্তরিক দৃষ্টি রাখিলেন না কেন?…বিদ্যাসাগর কালের লোক। কালধর্মই তিনি পালন করিয়া গিয়াছেন। ইহাতে হিন্দুর অনিষ্ট হইয়াছে, হিন্দু ধর্মে আঘাত লাগিয়াছে…নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণের বংশধর বিদ্যাসাগর, উপনয়নের পর অভ্যাস করিয়াও ব্রাহ্মণের জীবন সর্বস্ব গায়ত্রী পর্যন্ত ভুলিয়া  গিয়াছিলেন।” (2)

বিদ্যাসাগরের অন্যতম জীবনীকার চণ্ডীচরণ বন্দোপাধ্যায়ও একই কথা বলেন, “তাহার (বিদ্যাসাগরের) নিত্যজীবনের আচার ব্যবহার, ক্রিয়াকলাপ আস্থাবান হিন্দুর অনুরূপ ছিল না, অপরদিকে নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণের লক্ষণের পরিচয়ও কখনও পাওয়া যায় নাই।”(3)

বিদ্যাসাগরের ভাই শম্ভুচন্দ্র বলেছেন, “অগ্রজ মহাশয় শৈশবকাল হইতে কাল্পনিক দেবতার প্রতি কখনই ভক্তি বা শ্রদ্ধা করিতেন না। জগতের মধ্যে কেবল হিন্দুগণ দেবদেবী প্রতিমার প্রতি যেরূপ হৃদয়ের সহিত ভক্তি প্রকাশ করেন, তিনি জনক জননীকে বাল্যকাল হইতে তদ্রুপ আন্তরিক শ্রদ্ধা ও দেবতাস্বরূপ জ্ঞান করিতেন।“ (4)

শম্ভুচন্দ্র আরও বলেন, “সেইদিনে ‘ধর্ম প্রচারক ও কয়েকজন কৃতবিদ্য লোকের’ প্রশ্নের উত্তরে বিদ্যাসাগর যা বলেছিলেন তাই সম্ভবত তার ধর্মচিন্তা- ‘ ধর্ম যে কি, তাহা মানুষের বর্তমান অবস্থায় জ্ঞানের অতীত এবং ইহা জানিবারও কোনো প্রয়োজন নাই।‘ “ (5)

বিদ্যাসাগররের সাথে একবার রামকৃষ্ণের সাক্ষাৎ হয়েছিল। সেই সাক্ষাতের বিস্তারিত বিবরণ ‘কথামৃতে’ লিখিত আছে। রামকৃষ্ণ কোনোমতেই ঈশ্বরচন্দ্রের মুখ থেকে ঈশ্বর সম্বন্ধে কোনো স্থির বিশ্বাসভক্তির একটি কথাও আদায় করতে পারেন নি। বিদ্যাসাগর রামকৃষ্ণকে বলেছিলেন, “ঈশ্বরকে ডাকবার আর কি দরকার। দেখ, চেঙ্গিস খাঁ যখন লুটপাট আরম্ভ করলে তখন অনেক লোককে বন্দী করলে। ক্রমে প্রায় এক লক্ষ বন্দী জমে গেল। তখন সেনাপতিরা এসে বললে মহাশয়, এদের খাওয়াবে কে ? সঙ্গে এদের রাখলে বিপদ ছেড়ে দিলেও আমাদের বিপদ। কি করা যায় ? তখন চেঙ্গিস খাঁ বললেন, তাহলে, কি করা যায়, এদের সব বধ কর। তাই কচাকচ করে কাটার হুকুম হয়ে গেল। এই হত্যাকাণ্ড তো ঈশ্বর দেখলেন, কই, একটু নিবারণ তো করলেন না। তা তিনি থাকেন থাকুন, আমার দরকার বোধ হচ্ছে না। আমার তো কোন উপকার হল না।“

অমিয়কুমার হাটি বলেন, “বিদ্যাসাগর কোনো ধর্মযাজকের কাছে ঘেষেননি- মন্দিরে যাননি। পূজা আর্চা করতেন না। কিন্তু ছিলেন মানবতায় উদ্বুদ্ধ দয়ার সাগর।“ (6)

বিদ্যাসাগরের সময়কালেও মানুষেরা বর্ণবাদী চিন্তাধারা দ্বারা ভীষণভাবে আক্রান্ত ছিল। ফলস্বরূপ কেবল ব্রাহ্মণ ও বৈদ্যরাই সংস্কৃতে লেখাপড়া করে পারতো, শূদ্রেরা সংস্কৃতে লেখাপড়া করতে পারতো না। বিদ্যাসাগর যে গোঁড়া চিন্তাধারা  হতে মুক্ত ছিলেন তা বোঝা যায়, যখন তিনি শূদ্রদের জন্য সংস্কৃত কলেজের দরজা খুলে দেন। বিদ্যাসাগরের ভাই শম্ভুচন্দ্র ‘বিদ্যাসাগর চরিতে’ এই বিষয়টি বর্ণনা করেছেন-

“ তৎকালে সংস্কৃত কলেজে কেবল ব্রাহ্মণ ও বৈদ্যজাতীয় সন্তানগণ অধ্যয়ন করিত, ব্রাহ্মণের সন্তানেরা সকল শ্রেণিতে অধ্যয়ণ করিত। বৈদ্যজাতীয় বালকেরা দর্শন শাস্ত্র পর্যন্ত অধ্যয়ণ করিতে পাইত, বেদান্ত ও ধর্ম শাস্ত্র অধ্যয়ণ করিতে পাইত না। শূদ্র বালকের পক্ষে সংস্কৃত কলেজে অধ্যয়ন  নিষেধ ছিল। অগ্রজ মহাশয় প্রিন্সিপাল হইয়া শিক্ষা সমাজে রিপোর্ট করেন যে হিন্দু মাত্রেই সংস্কৃত কলেজে অধ্যয়ন করিতে পারিবেক। শিক্ষাসমাজ রিপোর্টে সন্তুষ্ট হইয়া তাহার প্রস্তাবে সম্মত হইলেন। ইহা শ্রবণ করিয়া ব্রাহ্মণেরা আপত্তি করেন, শূদ্রের সন্তানেরা সংস্কৃত ভাষা কদাচ শিক্ষা করিতে পাইবে না। তাহাতে অগ্রজ মহাশয় বলিয়াছিলেন যে পণ্ডিতেরা তবে কেমন করিয়া সাহেবদিগকে সংস্কৃত শিক্ষা দিয়ে থাকেন? আর সভাবাজারের রাজা রাধাকান্তদেব শূদ্রবংশোদ্ভব, তবে তাহাকে কি কারণে সংস্কৃত শিক্ষা দেওয়া হইয়াছিল।  এইরূপে সকল আপত্তি অগ্রজ মহাশয়ের দ্বারা খন্ডিত হইয়াছিল। তাহার মত এই যে, শূদ্রসন্তানেরা ব্যাকরণ, সাহিত্য, অলঙ্কার ও দর্শনশাস্ত্র অধ্যয়ন করিতে পারিবেন, শাস্ত্রের কোনো স্থানে ইহার বাধা নাই। কেবল ধর্ম শাস্ত্র স্মৃতি অধ্যয়ন করিতে পারিবেন না। তজ্জন্য শূদ্রের সন্ততির শ্রেণীতে অধ্যয়ন রহিত হইয়াছে। তদবধি শূদ্রজাতীয় সন্তানগণ সংস্কৃত কলেজে প্রবিষ্ট হইয়া সংস্কৃত ভাষা অবাধে শিক্ষা করিয়া আসিতেছেন। “ (7)

বিদ্যাসাগর  সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ থাকাকালীন এক বছরে বিস্তর পরিবর্তন আনেন। কর্তৃপক্ষ তাতে সন্তুষ্ট ছিল কিন্তু দ্বিধাও ছিল। তাই বারাণসী সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ ব্যালেন্টাইনকে কলকাতা সংস্কৃত কলেজ পর্যবেক্ষণ করে রিপোর্ট পেশ করতে বলা হয়। ব্যালেন্টাইন রিপোর্ট পেশ করেন। তাতে বিদ্যাসাগরের ব্যবস্থার গুণের পাশাপাশি ত্রুটিও উল্লেখ করে বলেন কিছু নতুন বই পড়িয়ে ত্রুটি সংশোধন করতে। “তার মতে, ত্রুটি প্রধানত এই যে, সংস্কৃত জ্ঞানে সত্যের একটা ধারা দেখা দেওয়া স্বাভাবিক; ইংরেজি জ্ঞানে দেখা যাওয়া উচিত সত্যের এক পৃথক ধারা।ছাত্রেরা ভাবে, সত্য দ্বিমূর্তি (Truth is double)।  ব্যালেন্টাইন প্রস্তাব করলেন, তার নিজের রচিত মিল এর লজিক এর (J.S. Mill Logic) সংক্ষিপ্তসার ও পাশ্চাত্য আদর্শবাদী দার্শনিক বিশপ বার্কলের ‘তত্ত্বান্বেষণ’ (Berkeley, Inquiry) কলিকাতা সংস্কৃত কলেজে পড়ানো হোক। বার্কলের ভাববাদ অনেকটা ভারতীয় ভাববাদের মত- দুয়ের মিল দেখবে ছাত্ররা। তাতে দু দেশের দর্শনের প্রতিই শ্রদ্ধাবান হবে- এই ছিল ব্যালেন্টাইনের যুক্তি।“ (8)

শিক্ষাপরিষদ ব্যালেন্টাইনের রিপোর্ট বিদ্যাসাগরের কাছে পাঠালে বিদ্যাসাগর পাঠ্যক্রমে পরিবর্তন আনার কোনো প্রয়োজন অনুভব করলেন না। বিদ্যাসাগর এর এক সুদীর্ঘ উত্তর লিখে পাঠালেন। বিদ্যাসাগর বলেন, “ কতকগুলি কারণে সংস্কৃত কলেজে বেদান্ত ও সাংখ্য দর্শন না পড়িয়ে উপায় নেই।…. বেদান্ত ও সাংখ্য যে ভ্রান্ত দর্শন,  এ সম্বন্ধে এখন আর মতদ্বৈত নেই।…. সংস্কৃতে যখন এগুলি শেখাতে হবে, এদের প্রভাব কাটিয়ে তুলতে প্রতিষেধকরূপে ইংরেজিতে ছাত্রদের দর্শন পড়ানো দরকার।

বিদ্যাসাগরের মতে, বার্কলের Inquiry সে ধরণের যথার্থ পাশ্চাত্য দর্শন নয়- ইউরোপেও এখন আর তা (বার্কলে) খাটি দর্শন বলে বিবেচিত হয় না। কাজেই এতে কোনোক্রমেই সে কাজ ( প্রতিষেধকের কাজ) চলবে না। বার্কলের দর্শনে  বেদান্ত ও সাংখ্য দর্শনের প্রতি ভারতীয় ছাত্রদের শ্রদ্ধা কমা দূরে থাক আরও বেড়ে যাবে।

দ্বিতীয় কথা: ‘সত্য দ্বিবিধ’- ছাত্রদের মনে এই ভ্রান্ত ধারণা জন্মাবে, ব্যালেন্টাইনের এই ভয়ও অমূলক। বিদ্যাসাগর তর্ক তুললেন-
সংস্কৃত ও ইংরেজি দু’ভাষার বিজ্ঞান ও সাহিত্য পড়ে যে যথার্থরূপে ধারণা করেছে, তার কাছে সত্য- সত্যই। সত্য দু-রকম- এ ভাব অসম্পূর্ণ ধারণার ফল। ‘সংস্কৃত কলেজে আমরা যে শিক্ষাপ্রণালী অবলম্বন করেছি, তাতে এরূপ ফলের সম্ভাবনা নিশ্চয়ই দূর হবে।’ “ (9)

ব্যালেন্টাইনের উত্তর দিতে গিয়ে বিদ্যাসাগর আরো বলেছিলেন,” দুঃখের বিষয়ে আমি ব্যালেন্টাইনের সঙ্গে একমত নই। পাশ্চাত্য বিজ্ঞান ও হিন্দুশাস্ত্রের মধ্যে সব জায়গায় মিল দেখানো সম্ভব নয়। সম্প্রতি দেশে বিশেষ করে কলকাতায় ও তার আশেপাশে  পণ্ডিতদের মধ্যে এক অদ্ভুত মনোভাব পরিস্ফুট হয়ে উঠেছে। শাস্ত্রে যার বীজ আছে এমন কোনো বৈজ্ঞানিক সত্যের কথা শুনলে সেই সত্য সম্বন্ধে তাদের শ্রদ্ধা ও অনুসন্ধিৎসা জাগা দূরে থাক, তার ফল হয় বিপরীত অর্থাৎ সেই শাস্ত্রের প্রতি তাদের বিশ্বাস আরো গভীর হয় এবং শাস্ত্রীয় কুসংস্কার আরো বাড়তে থাকে। তারা মনে করেন যেন শেষ পর্যন্ত শাস্ত্রেরই জয় হয়েছে, বিজ্ঞানের জয় হয়নি।” (10)

বিদ্যাসাগর তার ভাই শম্ভুচন্দ্রের কাছে যখন শুনতে পান, তার বিধবা বিবাহের আন্দোলনের ফলে তার আত্মীয় পরিজন তার সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করতে পারেন, তখন বিদ্যাসাগর বলেছিলেন, “বিধবা-বিবাহ প্রবর্তন আমার জীবনের সর্বপ্রধান সৎকর্ম।…এ বিষয়ের জন্য সর্বস্বান্ত হইয়াছি এবং আবশ্যক হইলে প্রাণান্ত স্বীকারেও পরাঙ্মুখ নহি।…আমি দেশাচারের নিতান্ত দাস নহি; নিজের বা সমাজের মঙ্গলের নিমিত্ত যাহা উচিত বা আবশ্যক বোধ হইবে, তাহা করিব।” (11)

বিধবা বিবাহ চালু করার ব্রতে যখন বিদ্যাসাগর ব্রতী তখন অনেক হিন্দু শাস্ত্রবিশারদ পণ্ডিত বিদ্যাসাগরের আপ্রাণ বিরোধীতা করেছিলেন। নরকের ভয় দেখিয়ে ভীত করতে চেয়েছিলেন। তাদেরই একজনের উত্তরে বিদ্যাসাগর ঠাট্টার ছলে বলেছিলেন,  “ …যদি নরক নামে বাস্তবিক কোনও স্থান থাকে, এবং কাহারও পক্ষে, সেই নরকপদবাচ্য স্থানে যাইবার ব্যবস্থা থাকে; তাহা হইলে টিকিকাটা বিদ্যাবাগীশের পাল সর্বাগ্রে নরকে যাইবেন, এবং নরকের সকল জায়গা দখল করিয়া ফেলিবেন, আমরা আর সেখানে স্থান পাইব না। “ (12)

বিদ্যাসাগরকে অনেকে নাস্তিক বলেছেন, অনেকে বলেছেন তিনি তেমন ধর্মাচারী ছিলেন না,ধর্ম বা ঈশ্বর নিয়ে তেমন মাথা ঘামাতেন না।তিনি সাংখ্য ও বেদান্ত দর্শনকে ভ্রান্ত বলতে সঙ্কোচ বোধ করেননি।  তারপরেও বিদ্যাসাগরের নানা লেখায় সৃষ্টিকর্তার উল্লেখ মেলে। যেমন বিদ্যাসাগর তার লেখা ‘বাল্যবিবাহের দোষে’ বলেছিলেন, “ সৃষ্টিকর্তার এই বিশ্বরচনা মধ্যে সর্বজীবেই স্ত্রী পুরুষ সৃষ্টি ও  তদুভয়ের সংসৃষ্টি দৃষ্টি গোচর হইতেছে। “ হয়তোবা বিদ্যাসাগর সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাস করতেন। তবে খুব সম্ভবত সেই সৃষ্টিকর্তা বা ঈশ্বর প্রচলিত ধর্মের ঈশ্বর নয়। সমাজের কুপ্রথার সাথে আজীবন লড়াই করেছেন বিদ্যাসাগর। তারপরেও কিছু ক্ষেত্রে তিনি যে সমাজে বাস করতেন, সেই সমাজের কিছু প্রথা মেনে নিয়েছিলেন। তিনি পৈতা পড়তেন। চিঠি লেখার শুরুতে সবসময় ‘শ্রী শ্রী হরি শরণম’ লিখেছেন। মা মারা গেলে তার শ্রাদ্ধ করেছিলেন। অনেকে বলতে পারেন, বিদ্যাসাগর তো শাস্ত্র দিয়ে শাস্ত্র খণ্ডন করেছিলেন। কিন্তু সত্য হল শাস্ত্রসম্মত বলেই তিনি বিধবা বিবাহের প্রবর্তন করেন নি বরং বিধবাদের যন্ত্রণা যখন তার মর্মে আঘাত করেছিল, তখন তাতে সাড়া দিয়ে ঈশ্বর পথ খুঁজতে তৎপর হয়েছিলেন। তৎকালীন ধর্মভীরু সমাজের সংস্কারের পথ যখন শাস্ত্রের মধ্য দিয়েই গিয়েছিল, তখন বিদ্যাসাগর সেই পথই অবলম্বন করেন।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিদ্যাসাগরের সম্বন্ধে বলেছেন, “বিদ্যাসাগর মহাশয়ও সেইরূপ, আচারের যে হৃদয়হীন প্রাণহীন পাথর দেশের চিত্তকে পিষে মেরেছে, রক্তপাত করেছে, নাড়ীকে পীড়া দিয়েছে, সেই পাথরকে দেবতা বলে মানেননি, তাকে আঘাত করেছেন। অনেকে বলবেন যে, তিনি শাস্ত্র দিয়েই শাস্ত্রকে সমর্থন করেছেন। কিন্তু শাস্ত্র উপলক্ষ মাত্র ছিল; তিনি অন্যায়ের বেদনায় যে ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন সে তো শাস্ত্রবচনের প্রভাবে নয়। তিনি তার করুণার ঔদার্যে মানুষকে মানুষরূপে অনুভব করতে পেরেছিলেন,  তাকে কেবল শাস্ত্রবচনের বাহক রূপে দেখেন নি। তিনি কতকালের পুঞ্জিভূত লোকপীড়ার সম্মুখিন হয়ে নিষ্ঠুর আচারকে দয়ার দ্বারা আঘাত করেছিলেন। তিনি কেবল শাস্ত্রের দ্বারা শাস্ত্রের খণ্ডন করেন নি, হৃদয়ের দ্বারা সত্যকে প্রচার করে গেছেন।” (13)

তথ্যসূত্র –

  • (1) অনন্য বিদ্যাসাগর- অনুনয় চট্টোপাধ্যায়
  • (2) অনন্য বিদ্যাসাগর- অনুনয় চট্টোপাধ্যায়
  • (3) অনন্য বিদ্যাসাগর- অনুনয় চট্টোপাধ্যায়
  • (4) বিদ্যাসাগর চরিত- শম্ভুচন্দ্র
  • (5) ঊনবিংশ শতাব্দীর যুক্তিবাদ ও বিদ্যাসাগর – গৌতম গঙ্গোপাধায়
  • (6) বিদ্যাসাগর: বিজ্ঞানমনস্কতা ও জনস্বাস্থ্যচেতনা- অমিয়কুমার হাটি
  • (7) বিদ্যাসাগর চরিত- শম্ভুচন্দ্র
  • (8) ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর – গোপাল হালদার
  • (9) ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর – গোপাল হালদার
  • (10) অনন্য বিদ্যাসাগর- অনুনয় চট্টোপাধ্যায়
  • (11) সংস্কৃত পণ্ডিত ও বাংলার নবজাগরণ – রমেশচন্দ্র মজুমদার
  • (12) ব্রজবিলাস- বিদ্যাসাগর
  • (13) বিদ্যাসাগর – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

সহায়ক গ্রন্থ-

  1. পশ্চিমবঙ্গ,  বিদ্যাসাগর সংখ্যা, ১৪০১  প্রকাশক – তথ্য অধিকর্তা, তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগ, পশ্চিমবঙ্গ সরকার
  2. বিদ্যাসাগরের রচনাবলী

অজিত কেশকম্বলী II

"মানুষ ছাড়া ক্ষ্যাপারে তুই মূল হারাবি, মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি।"

4 thoughts on “ঈশ্বরের ধর্মবিশ্বাস

  • রুদ্র প্রসাদ বালা

    লেখাটা পড়ে ভালো লাগলো

    Reply
  • লেখাটা ভাল লেগেছে খুব।।।।

    Reply
  • md mohosin

    বিদ্যাসাগর এক যুগপুরুষ। আধুনিক পুরুষ। মুক্তমনের মানুষ। প্রকৃতার্থে একজন শিক্ষিত মানুষ। সর্বোপরি তিনি ছিলেন এক যথার্থ বিজ্ঞানমস্ক সনাজবিজ্ঞানী, যাঁর পথে মূল লক্ষ্য হিন্দু সমাজের, হিন্দু ধর্মের নয়, হিন্দু সমাজের সংস্কার। তিনি যথার্থ বুঝেছিলেন। ধর্ম স্থবির। ধর্মের স্থবিরতা ভেঙে তাকে গতিশীল করার প্রয়োজনও নাই, সে প্রয়াস বৃথা শ্রম পণ্ডশ্রম।
    সমাজের সংস্কারের জন্য ধর্মকেই হাতিয়ার করেছিলেন। আমাদেরও তাকে অনুসরণ করে চললে লক্ষ্য সিদ্ধ হবে। তিনি পৈতে পরতেন, পুজোও করতেন, তাতে ছিলনা নিষ্ঠা, বরং ছিল অশ্রদ্ধা। এটাই শিক্ষনীয়। আমাদের এই অন্ধের সমাজেই থাকতে হবে। কিছু ধর্মের রীতিও ধরিমাছ না ছুঁই পানি করে মানা যেতে পারে, তাতে তিনি ব্রার্ত্য হবেন না। কোরাণ হাদিস দিয়েই কোরাণ হাদিসের অসারতা প্রতীষ্ঠা করতে হবে।

    Reply
  • M.H.Palash

    সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব
    ———————–
    সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব সম্পর্কে বুঝতে গেলে আগে আমাদের সৃষ্টিকর্তার সংজ্ঞা সম্পর্কে সচ্ছ ধারনা রাখতে হবে।সৃষ্টিকর্তার প্রকৃত সংজ্ঞা কি?সৃষ্টিকর্তার প্রকৃত সরূপ কেমন?
    আসলে সৃষ্টিকর্তার প্রকৃত পক্ষে কোন সংজ্ঞা নেই।আসলে আমরা আমাদের চারপাশের নানা কিছু উদ্ভাবনের উদ্ভাবককে ঐ উদ্ভাবনের সৃষ্টিকর্তা হিসেবে মনেকরি।কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সে সৃষ্টিকর্তা নয়,সে হল উদ্ভাবক।আর সেই উদ্ভাবককে আমরা ঐ উদ্ভাবনের সৃষ্টিকর্তা মনেকরি।তাই সৃষ্টিকর্তার সরূপ নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়।সৃষ্টিকর্তা বলতে এমন সত্ত্বাকে বোঝানো হবে যে কোন কিছু ছাড়াই কিছু সৃষ্টি করতে সক্ষম।আর উদ্ভাবক হল সেই যে কতিপয় উপাদানকে একরূপ থেকে অন্য রূপে শুধুমাত্র রূপদান করে মাত্র।যেমন কেউ একজন নতুন কোন যন্ত্র উদ্ভাবন করলো।যা ইতোপূর্বে ছিলনা।আর আমরা তাকে ঐ যন্ত্রটি উদ্ভাবনের সৃষ্টিকর্তা মনে করতে শুরু করলাম।আর এ দৃষ্টিকোন থেকে বিবেচনা করলেই বাধে সৃষ্টিকর্তার সংজ্ঞা নিয়ে বিপত্তি।সূক্ষ্মভাবে চিন্তা করলে দেখা যাবে যন্ত্রটির উদ্ভাবক কিন্তু যন্ত্রটিকে সৃষ্টি করেনি।ঐ যন্ত্রটি তৈরী করার উপাদানসমূহ কিন্তু পূর্ব হতেই প্রকৃতিতে বিদ্যমান ছিল,উদ্ভাবক শুধু তার মতো করে উপাদানগুলোকে সন্নিবেশ করে অন্য একটা রূপে রূপ দিয়েছে মাত্র।তাই সে ঐ যন্ত্রটির উদ্ভাবক মাত্র,সৃষ্টিকর্তা নয়।তাকে ঐ যন্ত্রটির সৃষ্টিকর্তা তখনি বলা যেতে পারে যখন সে কোন কিছু ছাড়াই অর্থাৎ শুন্য থেকে সৃষ্টি করতে পারবে।

    এবারে আসা যাক সৃষ্টিকর্তা নিয়ে আমাদের এত সংশয় কেন?
    সৃষ্টিকর্তা নিয়ে আমাদের সংশয়ের সবচেয়ে বড় কারন হল ধর্মগ্রন্থগুলো।ধর্মগ্রন্থগুলো সৃষ্টিকর্তা সম্পর্কে আমাদের ধারনা দেয় ঠিকই কিন্তু এর সংজ্ঞা সম্পর্কে কিছুই বলেনা।আর কিছু কিছু ধর্মগ্রন্থেতো সৃষ্টিকর্তার সরূপকে ব্যক্তিকেন্দ্রিক রূপে রূপায়িত করা হয়।যার ফলে সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব নিয়ে তৈরী হয় আস্তিক নাস্তিক নামক বিশ্বাসের সংঘাত।
    আসলে সৃষ্টিকর্তা বুঝতে গেলে আমাদের জানতে হবে কোন ব্যাপারটাকে সৃষ্টি করা যায়না?অথচ সমস্ত সৃষ্টিশীলতার মাঝে ঐ অস্তিত্বটা থাকতেই হবে।ওটা ছাড়া কোনকিছুই গঠিত হতে পারেনা।উত্তর হল শক্তি(energy)।এই মহাবিশ্বে শক্তি ছাড়া কিছুই সৃষ্টি হতে পারেনা।কিন্তু শক্তিকে কেউ কখনো সৃষ্টি করতে পারেনা।এই প্রকৃতির অস্তিত্বও শক্তি ছাড়া অকল্পনীয়।আমারা যা কিছুই দেখতে পাই তা হলো শক্তির বিভিন্ন রূপ।শক্তির নিত্যতা সুত্র অনুযায়ী শক্তির সৃষ্টি বা বিনাশ নেই, শুধু একরূপ থেকে অন্য রূপে পরিবর্তিত হয় মাত্র।বিগব্যাং এর পূর্বেও কোন না কোন রূপে শক্তি বর্তমান ছিল এবং এই মহাবিশ্ব যদি কোন কারনে নিশ্চিহ্নও হয়ে যায় তথাপি শক্তি কোন না কোন রূপে বিদ্যমান থাকবেই।আর এই শক্তিই হল সমস্তকিছুর সৃষ্টিকর্তা।মহাবিশ্বে শক্তি ছাড়া কোন স্থান নেই,কোন ম্যাটার নেই।আর শক্তি সময়ের সাথে সম্পর্কিত নয়,বরং শক্তির সাথে সম্পর্কিত সময়ের বিভিন্ন রূপ।
    ধর্মগ্রন্থগুলোতো মানুষেরই সৃষ্টি।কোন ধর্মগ্রন্থই তো আর ঐ ধর্মগ্রন্থের উল্লিখিত সৃষ্টিকর্তা নিজে এসে দিয়ে যায়নি।কিন্তু ঐ ধর্মগ্রন্থগুলোতে বর্নিত সৃষ্টিকর্তার যে সরূপ বর্ননা করা হয় তা কিন্তু পরোক্ষভাবে শক্তিকেই(energy) নির্দেশ করে।এই শক্তিটাই ঈশ্বর।
    তাই পরোক্ষ দৃষ্টিকোন থেকে কেউই নাস্তিক হতে পারেনা।ব্যক্তিকে যে কোনভাবেই হোক আস্তিক হতেই হবে।কেউ যদি নিজেকে প্রকৃতপক্ষে নাস্তিক দাবী করে তবে তার দাবীটা পুরোপুরিভাবেই অবৈজ্ঞানিক।তবে হ্যা ব্যক্তি চিন্তা ভিত্তিক যে ঈশ্বরের ধারনা প্রচলিত তা হতে মুক্তমনা হতে হতে পারে।কিন্তু নাস্তিক হতে পারেনা।কারন ব্যক্তিটা শক্তির কোন না কোন রূপে আবর্তিত হয়েই অস্তিত্বে এসেছে।আর কেউ না হোক, শক্তি থেকেই রূপান্তরিত হয়েই কিন্তু মহাবিশ্বের সমস্ত কিছু অস্তিত্বে এসেছে।তাই যৌক্তিক দৃষ্টিকোন থেকে কেউ চাইলেও নাস্তিক হওয়ার সুযোগ নেই।

    Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *