করোনা ভাইরাস – আল্লাহর গজব?
সূচিপত্র
করোনা ভাইরাস রোগ ২০১৯ (কোভিড-১৯)
বর্তমান সময়ে করোনা ভাইরাসের বৈশ্বিক মহামারী চলছে। করোনা ভাইরাস রোগ ২০১৯ (কোভিড-১৯) রোগটি সংঘটিত হয় “Severe acute Respiratory Syndrome Coronavirus 2 (SARS-CoV-2)” নামক একটি বিশেষ ভাইরাস (১) থেকে। রোগটির সাধারণ উপসর্গ হিসেবে জ্বর, সর্দি এবং শ্বাসকষ্ট দেখা যায়। কিছু ক্ষেত্রে মাংসপেশির ব্যাথা, বারবার থুতু সৃষ্টি এবং গলায় ব্যাথা দেখা যেতে পারে (২)(৩)। সাধারণত রোগটি আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি-কাশির মাধ্যমে ছড়ায় (৪)(৫)। এছাড়াও, আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি-কাশির কারণে জীবাণুযুক্ত হাত দিয়ে স্পর্শ করার কারণে পরিবেশের বিভিন্ন বস্তুর পৃষ্ঠতলে লেগে থাকলে এবং সেই ভাইরাসযুক্ত পৃষ্ঠতল অন্য কেউ হাত দিয়ে স্পর্শ করে নাকে-মুখে-চোখে হাত দিলে করোনা ভাইরাস নাক-মুখ-চোখের শ্লেষ্মাঝিল্লী দিয়ে দেহে প্রবেশ করে। করোনা ভাইরাস দেহে প্রবেশের ২ থেকে ১৪ দিনের মধ্যে রোগের উপসর্গ দেখা যায় (৬)।
সর্বপ্রথম এই রোগটি শনাক্ত করা হয় চীনের হুপেই প্রদেশের উহান শহরে, ২০১৯ সালের শেষ মাসে। ২০২০ সালের ১১ই মার্চ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা রোগটিকে একটি বৈশ্বিক মহামারী হিসেবে স্বীকৃতি দেয় (৭)। ২০২০ সালের ১১ই এপ্রিল পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ২০০টিরও বেশি দেশ ও অধীনস্থ অঞ্চলে এই রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ১৭,৫৪,৪৫৭ জন, সুস্থ হয়েছেন ৩,৯৫,৪১৮ জন এবং মৃত্যুবরণ করেছেন ১,০৭,৫২০ জন (৮) (আক্রান্ত, সুস্থ এবং মৃতের সংখ্যা বেড়েই চলেছে, বর্তমান পরিস্থিতি জানতে উইকিপিডিয়ার “2019–20 coronavirus pandemic data” শিরোনামের পাতাটি দেখুন)।
করোনা ভাইরাস নিয়ে ধার্মিকদের বক্তব্য
যখন চীনের উহান শহরে কোভিড-১৯ রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা গেলো, যখন করোনা ভাইরাসের সংক্রমণে চীনে শত শত মানুষ মৃত্যুবরণ করতে থাকলো, তখন মুসলিমদের একটি বড় অংশ বলতে লাগলো যে, করোনা ভাইরাস চীনের ওপর আল্লাহর গজব ছাড়া আর কিছুই নয়, কেননা চীন উইঘুর মুসলিমদের ওপর জুলুম নির্যাতন চালাচ্ছে, কুরআন পুনর্লিখন করতে চেয়েছে।
চীন থেকে করোনা ভাইরাস যখন অন্যান্য দেশে ছড়িয়ে পড়ার সাথেসাথে মুসলিমপ্রধান দেশসমূহেও ছড়িয়ে পড়লো এবং মুসলিমরাও এই ভাইরাসের শিকার হতে থাকলো, তখন সেই একই মুসলিমরা বলতে লাগলো যে, এটা মুসলিমদের জন্য আল্লাহতালার পক্ষ থেকে একটি পরীক্ষা, আল্লাহ তার বান্দাদের নানা সময়ে নানারকম বালামুসিবত দিয়ে ঈমানের পরীক্ষা নেন।
ধর্মবিশ্বাসীদের একটি বড় অংশের বিশ্বাস, কোভিড-১৯ রোগে বিশ্বজুড়ে লক্ষ লক্ষ মানুষ আক্রান্ত হওয়া হাজার হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করা আসলে মানুষের পাপের শাস্তি ছাড়া কিছু না। ইসলাম প্রচারকরা দাবি করেছেন, মানুষ ইসলামী নীতি অনুসরণ করে জীবনযাপন করে না, তাই আল্লাহ্ রাগ করে গজব নাজিল করেছেন। খ্রিস্টান ধর্ম প্রচারকরাও দাবি করেছেন, ঈশ্বর মানুষকে তাদের পাপের শাস্তি দিচ্ছেন। একইরকম দাবি করেছেন ইহুদি এবং হিন্দু ধর্ম প্রচারকরাও।
ধার্মিকদের বক্তব্যের জবাব
এটা খুবই দুঃখজনক ব্যাপার যে, একবিংশ শতাব্দীতে এসেও কোটি কোটি মানুষের ভয়কে ব্যবহার করে, লক্ষ লক্ষ মানুষের অসুস্থতাকে ব্যবহার করে, হাজার হাজার মানুষের মৃত্যুকে ব্যবহার করে ধার্মিকগণ তাদের ধর্মীয় মতাদর্শের বিজ্ঞাপন দিয়ে যাচ্ছে। মানুষ হয়ে মানুষের কষ্ট অনুভবের চেষ্টার পরিবর্তে, শোক প্রকাশের পরিবর্তে, সহানুভূতি প্রদর্শনের পরিবর্তে তারা নিজেদের ধর্মীয় মতাদর্শকে বড় করে দেখানোই বড় করে দেখছে।
হ্যাঁ, এটা সত্য যে, চীন সরকার ১০ লাখের মতো উইঘুর মুসলিমকে চীনের পশ্চিমাঞ্চলীয় শিনজিয়াং অঞ্চলে কয়েকটি শিবিরে বন্দী করে রেখেছে (৯), আমি এই ঘটনার তীব্র নিন্দা জানাই। কেবল এই ঘটনা নয়, পৃথিবীর সকল মুসলিম নির্যাতনেরই আমি তীব্র নিন্দা জানাই।
এই কথাটিও সত্য যে, চীন সরকার কুরআন পুনর্লিখন করতে চেয়েছে (১০)। তবে আমি চীন সরকারের এই সিদ্ধান্তের তীব্র নিন্দা জানাতে চাই না যদি চীন সরকারের নতুন কুরআন মুসলিমদের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার ইচ্ছা না থাকে।
২০২০ সালের ১১ই এপ্রিল পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, চীনে কোভিড-১৯ রোগে ৮১,৯৫৩ জন মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন এবং ৩,৩৩৯ জন মানুষ মৃত্যুবরণ করেছেন। চীনে যারা করোনার যন্ত্রণা ভোগ করলো, যারা যন্ত্রণা ভোগ করতে করতে মারা গেলো, তারা সবাই কি মুসলিম নির্যাতনের সাথে জড়িত ছিলো? তারা সবাই কি কুরআন পরিবর্তন করতে চেয়েছিলো? করোনা ভাইরাস যদি চীনের মুসলিম নির্যাতনের বিরুদ্ধে, কুরআন পরিবর্তন করার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আল্লাহর গজবই হয়, তাহলে যারা কোনোদিনই কোনোভাবে মুসলিম নির্যাতনের সাথে জড়িত ছিলো না, যারা কুরআন পরিবর্তন করতে চায়নি, তারাও কেনো করোনার যন্ত্রনা ভোগ করলো, তারাও কেনো করোনার যন্ত্রনা ভোগ করতে করতে মারা গেলো?
এইযে পুরো পৃথিবীজুড়ে ১৭ লাখেরও বেশি মানুষ করোনার শিকার হলো, এসব মানুষদের মধ্যে হয়তো এমন অনেক মানুষই আছেন, যারা কখনো কারো ওপর জুলুম করেনি, কখনো কারো ওপর জুলুম করতে চায়নি, কখনো কোনো জুলুম সমর্থন করেনি, এমন মানুষদেরও কি আল্লাহর গজব প্রাপ্য? সংখ্যায় অনেক কম হলেও বিশ্বজুড়ে করোনা ভাইরাসের শিকার হয়েছে ছোট বাচ্চারাও, ছোট বাচ্চাদেরও কি আল্লাহর গজব প্রাপ্য? যে আল্লাহ্ কিছু অপরাধীর অপরাধের জন্য নিরপরাধ মানুষদেরকেও যন্ত্রণা দেয় সেই আল্লাহর অস্তিত্ব যদি থেকেও থাকে, সে কি কারো শ্রদ্ধা পাবার যোগ্য?
এবার আসি, করোনা ভাইরাসকে আসলেই আল্লাহর গজব বলা যায় কিনা সেই বিষয়ে।
করোনা ভাইরাস যদি মুসলিম নির্যাতনের বিরুদ্ধে আল্লাহর গজব হয়ে থাকে, তাহলে কেবল তারাই করোনা ভাইরাসের শিকার হওয়ার কথা যারা মুসলিমদের ওপর নির্যাতন করেছে বা করছে এবং যারা মুসলিমদের ওপর নির্যাতন সমর্থন করে। করোনা ভাইরাস যদি কাফেরদের ওপর আল্লাহর গজব হয়ে থাকে, তাহলে কেবল কাফেররাই করোনা ভাইরাসের শিকার হওয়ার কথা। কিন্তু, দেখা যাচ্ছে, অমুসলিমদের মতো মুসলিমরাও করোনা ভাইরাসের শিকার হয়েছে এবং হয়েই যাচ্ছে।
মুসলিমপ্রধান দেশ মালেশিয়ার কুয়ালালামপুরের শ্রী পেতালিং-এ একটি মসজিদে তাবলীগ জামাতের ২৭ ফেব্রুয়ারী থেকে ১ মার্চ পর্যন্ত চারদিনের একটি সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে প্রায় ১৬,০০০ জন মুসল্লী অংশগ্রহণ করেন, যাদের মধ্যে ১,৫০০ জন মালেশিয়ার বাইরে থেকে আসেন। ১৭ই মার্চ পর্যন্ত, মালেশিয়ায় শনাক্ত হওয়া ৬৭৩ জন কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীর প্রায় তিন ভাগের দুই ভাগই তাবলীগ জামাতের এই সমাবেশে অংশগ্রহণ করেছিলেন (১১)। মার্চ মাসের মাঝামাঝি সময়ে, ভারতের দিল্লিতে ‘মরকজ নিজামুদ্দিন’ নামে পরিচিত একটি মসজিদে তাবলীগ জামাতের সমাবেশ উপলক্ষে অন্তত আড়াই হাজার মুসল্লী সমবেত হয়েছিলেন (১২)। ৭ই এপ্রিল পর্যন্ত, ভারতে শনাক্ত হওয়া ৪,৪০০ জন কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীর প্রায় তিন ভাগের এক ভাগই তাবলীগ জামাতের এই সমাবেশে অংশ নিয়েছিলেন (১৩)।
এছাড়াও, ২০২০ সালের ১১ই এপ্রিল পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ তুর্কীতে কোভিড-১৯ রোগে আক্রান্ত হয় ৫২,১৬৭ জন, মারা যায় ১,১০১ জন। মুসলিমপ্রধান দেশ ইন্দোনেশিয়ায় কোভিড-১৯ রোগে আক্রান্ত হয় ৩,৮৪২ জন, মারা যায় ৩২৭ জন। মুসলিমপ্রধান দেশ পাকিস্তানে আক্রান্ত হয় ৫,০১১ জন, মারা যায় ৭৭ জন। মুসলিমপ্রধান দেশ আরব আমিরাতে আক্রান্ত হয় ৩,৭৩৬ জন, মারা যায় ২০ জন। মুসলিমপ্রধান দেশ কাতারে আক্রান্ত হয় ২,৭২৮ জন, মারা যায় ৬ জন। মুসলিমপ্রধান দেশ আলজেরিয়ায় আক্রান্ত হয় ১,৮২৫ জন, মারা যায় ২৭৫ জন। মুসলিমপ্রধান দেশ মিশরে আক্রান্ত হয় ১,৭৯৪ জন, মারা যায় ১৩৫ জন। মুসলিমপ্রধান দেশ বাহরাইনে আক্রান্ত হয় ১,০১৬ জন, মারা যায় ৬ জন। মুসলিমপ্রধান দেশ কাজাখস্তানে আক্রান্ত হয় ৮৫৯ জন, মারা যায় ১০ জন। মুসলিমপ্রধান দেশ তুনিসিয়ায় আক্রান্ত হয় ৬৭১ জন, মারা যায় ২৫ জন। মুসলিমপ্রধান দেশ উজবেকিস্তানে আক্রান্ত হয় ৭৬৭ জন, মারা যায় ৩ জন। আমাদের এই মুসলিমপ্রধান বাংলাদেশে আক্রান্ত হয় ৪৮২ জন, মারা যায় ৩০ জন। ইসলামের জন্মভূমি এবং ইসলামিক রাষ্ট্র সৌদি আরবে আক্রান্ত হয় ৪,০৩৩ জন, মারা যায় ৫২ জন। ইসলামিক রাষ্ট্র আফগানিস্তানে আক্রান্ত হয় ৫৫৫ জন, মারা যায় ১৮ জন। ইসলামিক রাষ্ট্র ওমানে আক্রান্ত হয় ৫৪৬ জন, মারা যায় ৩ জন। আক্রান্ত এবং মৃতের সংখ্যা ক্রমশ বেড়েই চলেছে।
প্রাকৃতিক দুর্যোগ কিংবা দূর্ঘটনার শিকার মুসলিমরা অসংখ্যবার হয়েছে। কখনো হয়েছে ভূমিকম্পের শিকার, কখনো ঘূর্নিঝড়ের, কখনো বা বন্যার, এমনকি হজ্জ করতে গিয়ে দূর্ঘটনার শিকার হয়ে শত শত মুসল্লী মারা যাওয়ার ঘটনার সংখ্যাও কম নয়। ১৯৯০ সালে হজ্জ করতে গিয়ে ছত্রভঙ্গে মারা যায় ১,৪২৬ জন মুসলিম (১৪)। ১৯৯৪ সালে হজ্জ করতে গিয়ে ছত্রভঙ্গে মারা যায় ২৭০ জন মুসলিম (১৫)। ২০০৪ সালে হজ্জ করতে গিয়ে ছত্রভঙ্গে মারা যায় ২৫১ জন এবং আহত হয় ২৪৪ জন মুসলিম (১৬)। ২০০৬ সালে হজ্জ করতে গিয়ে ছত্রভঙ্গে মারা যায় ৩৪৬ জন এবং আহত হয় ২৮৯ জন (১৭)। ২০১৫ সালে হজ্জ করতে গিয়ে ছত্রভঙ্গে মারা যায় ২,২৩৬ জন মুসলিম (১৮)। ১৯৯৭ সালে হজ্জ করতে গিয়ে অগ্নিকাণ্ডে মারা যায় ৩৪৩ জন এবং আহত হয় ১৫০০ জন (১৯)। এই মুসলিমরা ইসলামী নীতি নৈতিকতা থেকে দূরে সরে যাওয়া মুসলিম ছিলেন না, বরং আল্লাহ্ ভালোবেসে আল্লাহর ওপর বিশ্বাস ও ভরসা রেখেই তারা আল্লাহর ইবাদত করতে গিয়েছিলেন, কিন্তু আল্লাহ্ তাদের বাঁচায় নি।
১৯৯৮ সালে, মুসলিমপ্রধান বাংলাদেশের ৭৫% এরও বেশি এলাকা প্লাবিত হয়, এতে ৩ কোটি মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়ে, হাজারেরও বেশি মানুষ মারা যায় (২০)। ১৯৮৯ সালে, বাংলাদেশের মানিকগঞ্জ জেলায়, ইতিহাসের সবচেয়ে মারাত্মক টর্নেডোটি আঘাত হানে, যার ফলে ১,৩০০ জন মানুষের মৃত্যু ঘটে, ১২,০০০ মানুষ আহত হয় (২১। ১৯৯৬ সালেও, বাংলাদেশে একটি মারাত্মক এবং ধ্বংসাত্মক টর্নেডো আঘাত হানে, যার ফলে ৬০০ জন মানুষের মৃত্যু ঘটে, ৩৭,২৮৪ জন আহত হয়, ৩৬, ৪২০টি ঘর ধ্বংস হয় (২২) (২৩)। ১৯৭০ সালে, পূর্বপাকিস্তানে (বর্তমান বাংলাদেশ) এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গে একটি বিধ্বংসী ঘূর্নিঝড় আঘাত হানে, যা ছিলো ইতিহাসের সবচেয়ে মারাত্মক ঘূর্নিঝড়, যার ফলে মারা যায় ৫ লক্ষ মানুষ (২৪)। ১৯৯১ সালে, একটি মারাত্মক ঘূর্নিঝড়ের কবলে পড়ে প্রাণ হারায় বাংলাদেশের ১,৩৮, ৮৬৬ জন মানুষ (২৫)। ২০০৭ সালে, ঘূর্নিঝড় সিডর কেড়ে নেয় বাংলাদেশের ৩,৪৪৭ থেকে ১৫,০০০ প্রাণ (২৬) (২৭)।
১৯৭৪ সালে, মুসলিমপ্রধান পাকিস্তানে ৬.২ মাত্রার একটি ভূমিকম্পের কারণে মারা যায় ৫,৩০০ জন মানুষ, আহত হয় ১৭,০০০ জন (২৮)। ২০১৩ সালে, পাকিস্তানে ৭.৭ মাত্রার একটি ভূমিকম্প কেড়ে নেয় ৮২৫ জন মানুষের প্রাণ, আহত করে ৭০০ জনকে (২৯)। ২০১০ সালের একটি বন্যায়, পাকিস্তানের প্রায় ২,০০০ মানুষ প্রাণ হারায়, ক্ষতিগ্রস্থ হয় ২ কোটি মানুষ (৩০)। ১৯৯৮ সালে, একটি মারাত্মক ঘূর্নিঝড়ের কবলে পড়ে ঝড়ে যায় মুসলিমপ্রধান পাকিস্তানের ৪,০০০ থেকে ১০,০০০ মানুষের প্রাণ (৩১) (৩২)।
১৯৯২ সালে, মুসলিমপ্রধান দেশ মিশরে ৫.৮ মাত্রার একটি ভুমিকম্প কেড়ে নেয় ৫৪৫ প্রাণ, আহত হয় ৬,৫১২ জন, গৃহহীন হয়ে পড়ে ৫০,০০০ মানুষ (৩৩)।
২০০৪ সালে, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ ইন্দোনেশিয়ায়, এক সারি শক্তিশালী সুনামির আঘাতে প্রাণ হারায় ১ লক্ষ ৬৭ হাজার মানুষ। এটাই ছিলো ইতিহাসের সবচেয়ে মারাত্মক সুনামির ঘটনা (৩৪)।
১৯৩৯ সালে, মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ তুর্কীতে ৭.৮ মাত্রার একটি ভূমিকম্পে ৩২,৭০০ থেকে ৩২,৯৬৮ জন মানুষ মারা যায়, আহত হয় ১ লক্ষ মানুষ (৩৫)।
এই ছিলো সামান্য কিছু উদাহরণ।
“আল্লাহ্ মুসলিমদের পরীক্ষা নেন”
মুসলিমদের আল্লাহর গজবের দাবির জবাবে যখন প্রশ্ন করা হয়, ‘আল্লাহর গজব মুসলিমদের ওপরেও কেনো পড়ে?’, তখন তারা বলেন, আল্লাহ তার মুসলিম বান্দাদের ওপর বালামুসিবত দিয়ে ঈমানের পরীক্ষা নেন, অমুসলিমদের জন্য যা গজব মুসলিমদের জন্য তা পরীক্ষা। মুসলিমদের মধ্যে এই অজুহাতটি খুবই জনপ্রিয় এবং বহুল ব্যবহৃত। নিজেদের অন্ধবিশ্বাসের মাছ ঢাকতেই তারা এই শাক ব্যবহার করে।
মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ কোনো অঞ্চলে প্রাকৃতিক দূর্যোগের ঘটনা ঘটলে কেবল প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয় না, কেবল প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ মারা যায় না। প্রাকৃতিক দূর্যোগের যন্ত্রণা ভোগ করতে করতে মারা যায় দুগ্ধপোষ্য সন্তান, ছোট ছোট বাচ্চা। সেইসাথে মারা যায় গরু, ছাগল, কুকুর, বিড়ালের মতো অনেক নিরপরাধ নিষ্পাপ প্রাণী। দুগ্ধপোষ্য সন্তান, ছোট ছোট বাচ্চা কিংবা কিশোরকিশোরীদের হত্যা করে আল্লাহ্ কিসের পরীক্ষা নেন? আল্লাহ্ কেমন ঈশ্বর যে এতো এতো নিরপরাধ নিষ্পাপ প্রাণ হত্যা করে মুসলিমদের ঈমানের পরীক্ষা নেওয়ার জন্য? আল্লাহর পরীক্ষার জন্য কেনো নিরপরাধ নিষ্পাপ প্রাণকেও যন্ত্রণা ভোগ করতে হবে? আল্লাহ্ কি নিরপরাধ নিষ্পাপ প্রাণের ওপর শারীরিক ও মানসিক জুলুম চালানো ব্যতীত তার মহামূল্যবান পরীক্ষা নিতে অক্ষম? যদি তিনি সক্ষম হয়ে থাকেন, তাহলে কি তিনি পরম দয়ালু নয়, সুবিচারক নয়?
মুসলিমদের অনেকে বলেন, আল্লাহ্ অনেক সময় সন্তানকে বড় ধরনের রোগ বা বিপদ দিয়ে মা-বাবার ঈমানের পরীক্ষা নেন কিংবা, শাস্তি দেন।
এই ধারণাটি আল্লাহকেই আরও নিষ্ঠুর প্রমাণ করে। মা-বাবার ঈমানের পরীক্ষার জন্য কেনো নিরপরাধ নিষ্পাপ সন্তানকে যন্ত্রণা ভোগ করতে হবে, যা তার প্রাপ্য নয়? মা-বাবার পাপের জন্য কেনো সন্তানকে শাস্তি ভোগ করতে হবে, যা তার প্রাপ্য নয়? আপনার কোনো অন্যায়ের জন্য আপনার মা-বাবাকে যদি শাস্তি দেওয়া হয়, আপনি কি সেটা সমর্থন করবেন?
“আল্লাহ্ পাপী মুসলিমদের শাস্তি দেন”
মুসলিমরা এও বলে থাকেন যে, ইসলামী নীতি নৈতিকতা থেকে দূরে সরে যাওয়ার কারণে মুসলিমদের ওপরেও গজব নাজিল হয়।
আবারও একই কথা বলতে হচ্ছে, কোনো মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলে প্রাকৃতিক দূর্যোগের ঘটনা ঘটলে কেবল সেইসব মুসলিম ক্ষতিগ্রস্ত হয় না যারা ইসলাম থেকে দূরে সরে গিয়েছিলো, কেবল সেইসব মুসলিম মারা যায় না যারা ইসলাম থেকে দূরে সরে গিয়েছিলো। প্রাকৃতিক দূর্যোগের যন্ত্রণা ভোগ করতে করতে মারা যায় দুগ্ধপোষ্য সন্তান, ছোট ছোট বাচ্চা। সেইসাথে মারা যায় গরু, ছাগল, কুকুর, বিড়ালের মতো অনেক নিরপরাধ নিষ্পাপ প্রাণী।
উপসংহার
আল্লাহর নাজিলকৃত গজবের শিকার যদি মুসলিম-অমুসলিম, ধার্মিক মুসলিম, ইসলাম থেকে দূরে সরে যাওয়া মুসলিম, দুগ্ধপোষ্য বাচ্চা, বৃদ্ধ মানুষ সবাই হয় তাহলে আমরা কিভাবে বুঝবো এটাই আল্লাহর গজব? কিভাবেই বা বুঝবো এটা আল্লাহরই গজব, হিন্দুদের বিষ্ণু কিংবা খ্রিস্টানদের ইয়াহওয়েহর না? অর্থ্যাৎ, পরিষ্কারভাবেই, ‘আল্লাহর গজব’ ধারণাটি যুক্তিহীন এবং একটি অন্ধবিশ্বাস।
ঠিক যে যে কারণে মুসলিমদের আল্লাহর গজবের দাবিটি যুক্তিহীন, ঠিক সেই সেই কারণেই হিন্দুদের ভগবান কিংবা খ্রিস্টানদের ঈশ্বরের গজবের দাবিও যুক্তিহীন।
সেই আদিকাল থেকেই মানুষ এই যুক্তিহীন ধারণাটি মনে লালন করে আসছে। যুগ যুগ ধরে এই কুবিশ্বাসটি ব্যবহার করে মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে, মানুষও তাদের ধর্মীয় অন্ধত্বের কারণে যুগ যুগ ধরে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। এটা আমাদের জন্য খুবই দূর্ভাগ্যজনক যে, আজও পৃথিবীর বেশিরভাগ মানুষ এই ‘গজব’ নামক উদ্ভট ধারণা নিজেদের মনে লালন করছে, এই উদ্ভট ধারণা নিজেদের মনে লালন করে মানুষের প্রাপ্য অধিকার অস্বীকার করছে, মানুষের প্রাপ্য অধিকারের বিরোধিতা করছে। এই একবিংশ শতাব্দীতে এসেও আমরা দেখছি, মুসলিমদের একটি বড় অংশ প্রাকৃতিক দূর্যোগের জন্য মেয়েদের জিন্স প্যান্ট পরাকে দায়ী করছে। এসব দেখেও আমাদের বেঁচে থাকতে হয়, চাইলেই সবকিছু পরিবর্তন করা যায় না।
তথ্যসূত্রসমূহঃ
- Naming the coronavirus disease (COVID-19) and the virus that causes it – World Health Organisation
- “Coronavirus Disease 2019 (COVID-19) Symptoms” – Centers for Disease Control and Prevention.
- “Q&A on coronaviruses (COVID-19)” – World Health Organization (WHO)
- “Q&A on coronaviruses”. World Health Organization (WHO)
- “2019 Novel Coronavirus (2019-nCoV)”. Centers for Disease Control and Prevention
- “Symptoms of Novel Coronavirus (2019-nCoV)”. www.cdc.gov
- “WHO Director-General’s opening remarks at the media briefing on COVID-19 – 11 March 2020”. World Health Organisation.
- 2019–20 coronavirus pandemic by country and territory – Wikipedia
- চীনে উইগর মুসলিম নির্যাতনের ব্যাপারে যা জানা গেছে – বিবিসি নিউজ বাংলা
- কোরআন ও বাইবেল পুনর্লিখন করবে চীন – Dhaka Tribune
- “Coronavirus COVID-19 cases spiked across Asia after a mass gathering in Malaysia. This is how it caught the countries by surprise” – ABC News.
- করোনাভাইরাস: ভারতের দিল্লিতে তাবলীগ জামাতের একটি মসজিদ মরকজ নিজামুদ্দিন ‘হটস্পট’ হিসেবে চিহ্নিত – বিবিসি নিউজ বাংলা
- How Tablighi Jamaat event became India’s worst coronavirus vector – Al Jazeera
- 1990 Mecca tunnel tragedy – Wikipedia
- 1994 Hajj stampede – Wikipedia
- 2004 Hajj stampede – Wikipedia
- 2006 Hajj stampede – Wikipedia
- 2015 Mina stampede – Wikipedia
- Mecca fire of 1997 – Wikipedia
- Bangladesh floods recede, but death toll rises
- Tornados in Bangladesh and East India
- The Deadliest Tornado in the World
- Bangladesh: Tornado – Information Bulletin n° 3
- Remembering the great Bhola cyclone – Dhaka Tribune
- “The Worst Natural Disasters by Death Toll” (PDF)
- Bangladesh cyclone toll climbs to 3,447 dead–official
- Bangladesh cyclone death toll hits 15,000 – The Telegraph
- “A List of Deadly Earthquakes in the World: 1500–2000”, International Handbook of Earthquake & Engineering Seismology, Part A, Volume 81A (First ed.), Academic Press, p. 708, ISBN 978-0124406520
- 825 dead, relief slow to reach Balochistan quake victims
- Pakistan Floods:The Deluge of Disaster – Facts & Figures as of 15 September 2010
- Cyclone Vayu spares Gujarat: In 1998, a cyclone rained death, killed thousands in state
- Munich Re’s review of natural catastrophes in 1998
- 1992 Cairo earthquake – Wikipedia
- 2004 Indian Ocean earthquake and tsunami – Wikipedia
- 1939 Erzincan earthquake – Wikipedia
যে যা খুশি ভাবতে পারে। তার জন্য নির্দিষ্ট স্থান আছে রে বিজ্ঞানী। আল্লাহ জাহান্নাম পূর্ন করবেন মানুষ এবং জ্বিন দিয়া।
সুতারাং, সে দিনের অপেক্ষা কর যে দিন সবাইকে একত্রিত করা হবে। আর তোর এসব ভিত্তিহীন যুক্তি সাক্ষ্য দিবে তোর নিজের মুখে বলাই লাগবেনা কিছু। খালি যে হাত দিয়া লিখছত সে হাত কিভাবে কথা বলে সেটাই দেখবি।
আরেকটা কথা হল, এটা আল্লাহর গজব সেটাতো ১০০% আর এটাকে মিথ্যা প্রমান করতে মুসলমানদের দিকে না তাকিয়ে কুরআনের দিকে তাকা।
স্বয়ং, মুসলমানরাই কতটা ভয়াবহ অবস্থাতে আছে সেটা গান বাজনা টিকটক বিগো এসব দেখলেই বোঝা যায়।
হুজুরদের বয়ান দিয়া প্রমান দেখাস! এই হুজুরেরাও এইসব দেখে।
শোন, সকল মুসলমান এই রোগে আক্রান্ত হয়নি আর যারা আক্রান্ত হয়েছে তাদের ব্যাকগ্রাউন্ড তারা জানে আর আল্লাহ জানে।
সকল মুসলমান জান্নাতে যাবে না একথাই ঠিক। আল্লাহর একমাত্র মনোনিত ধর্ম ইসলাম একথাই ঠিক।
ড্রাইভার দিয়ে গাড়ির মান দেখাটা যেমন বোকামি, মুসলমানদের দিয়ে ইসলাম ধর্মকে দেখাটাও বোকামি। ধর্ম দেখতে হলে দেখতে হবে ধর্মগ্রন্থ।
“প্রকৃতি” (Nature) নামে একটা অদৃশ্য সত্বার অস্তিস্ত্ব জাতি-ধর্ম-বর্ণ, অধর্ম নির্বিশেষে সবাই স্বীকার করেন। প্রাণীর দেহে প্রাণের অস্তিস্ত্বে সকলেই বিশ্বাস করে থাকেন। দেহ থেকে প্রাণ বেরিয়ে গেলে কেউ কবরস্থানে (মুসলিম+খ্রীষ্টান+ইহুদী সেমিটিক), কেউ শশ্মানে (অ্যারিয়ান বা হিন্দু-বৌদ্ধ) প্রাণহীন দেহকে মাটি চাপা দিয়ে কিংবা পুড়িয়ে দেন। গরু মহিষ, ছাগল মরা হলে কেউ খেতে চান না, পছন্দ করেন না। যদিও “প্রাণ” দেখা যায় না তবুও সবাই বিশ্বাস করে থাকেন। “প্রকৃতি” নামক অদৃশ্য শক্তি ছাড়াও হালে যে “করোনা কোভিড-১৯” এর অস্তিত্বকে বিশ্বাস করে না এমন কেহ পৃথিবীতে আছে কিনা সন্দেহ। যা সাধারণ চোখে এমনকি দূরবীক্ষণ, ডিজিটাল ইলেকট্রনিক্সের মাইক্রোস্কোপেও নয়, করোনাকে দেখতে হলে দরকার ইলেক্ট্রন নির্মিত বিশেষ অণুবীক্ষণ যন্ত্র। আমরা অতি সহজেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং সরকার বাহাদুরের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ঘোষণামতে নির্দ্ধিধায় করোনাকে চর্মচক্ষে না দেখেই শতভাগ বিশ্বাস করেছি।
আমরা এটাও বলে থাকিঃ “প্রাকৃতিক সম্পদের অপচয়, অপব্যবহারের কারণে “প্রকৃতি” পরিবেশ বিপর্যয়ের মাধ্যমে প্রতিশোধ নিচ্ছে”। তাহলে করোনার মাধ্যমে আল্লাহ কারও ঈমানের পরীক্ষা নিচ্ছেন, করোনার মাধ্যমে কৃতকর্মের কারণে আল্লাহ প্রতিশোধ নিচ্ছেনঃ এরূপ বল্লে ভুল কোথায়? অথচ আমরা প্রাকৃতিক ডাকে (নেচার কল) সাড়া দিয়ে প্রায় প্রতিদিন সকাল-বিকালে ওয়াশরুমে গমণ করে থাকি।
এরকম আমলকারী ব্যক্তিই সত্যিই শুয়ারের চেয়েও অধিক নিকৃষ্ট যদিও সে মানুষের সুরাতধারী হউক না কেন? সে আসলেই জানোয়ারের চেয়েও নিকৃষ্ট ব্যক্তি
এই ওয়েবসাইটে সম্পৃক্ত ব্যক্তিদের আল্লাহর হেদায়েত থাকলে হেদায়েত নতুবা ধ্বংস হয়ে যাওয়ার কামনা করছি-আল্লাহুম্মা আমীন। আল্লাহু আকবার