কুরআন এবং ধোঁয়া থেকে মহাবিশ্ব
হারুন ইয়াহিয়ার মতো বিখ্যাত ইসলাম প্রচারকগণ দাবি করেছেন, কুরআন নক্ষত্রের গঠন এবং মহাবিশ্বের প্রথম দিকের অগ্রগতির ধাপের সঠিক বর্ণনা তুলে ধরে৷ এই দাবিটি কোনোরকম সমালোচনামূলক নিরীক্ষণ ছাড়াই বিভিন্ন ওয়েবসাইটে ব্যাপকভাবে প্রচারিত এবং পুনরাবৃত্ত হয়েছে। এই দাবিটির মূল উপাদান হচ্ছে, সূরা ফুসিলাতের একটি আয়াত। সূরা ফুসিলাত কুরআনের ৪১তম সূরা যা বলে, “আসমানসমূহ” একসময় ধোঁয়া ছিল। ইসলাম প্রচারকগণ দাবি করেন, মহাবিশ্বের আদি অবস্থার এই তথ্য সপ্তম শতাব্দীর আরববাসীদের কাছে পরিচিত ছিল না এবং বিংশ ও একবিংশ শতাব্দীতে এসেই মানুষ বৈজ্ঞানিক গবেষণার মাধ্যমে এই তথ্য জানতে পেরেছে।
সূচিপত্র
মুসলিমদের পক্ষ থেকে দাবি
আধুনিক সৃষ্টিতত্ত্বের পর্যবেক্ষণীয় এবং তাত্ত্বিক বিজ্ঞান পরিষ্কারভাবেই ইংগিত প্রদান করে যে, একটি পর্যায়ে পুরো মহাবিশ্ব কেবল ধোঁয়ার মেঘ হয়েছিল। এটি আধুনিক সৃষ্টিতত্ত্বের অন্যতম একটি অবিতর্কিত বিষয়। বিজ্ঞানীরা এখন সেই ধোঁয়ার অবশিষ্টাংশ থেকে নতুন নক্ষত্রের গঠন হওয়া পর্যবেক্ষণ করতে পারেন। (চিত্র ১ এবং ২ দেখুন)


রাতে আমাদের দেখতে পাওয়া উদ্ভাসক নক্ষত্রসমূহ একসময় ঠিক সেরকম ছিলো যেরকম পুরো মহাবিশ্ব ছিলো সেই ধোঁয়ার উপাদানে।
আল্লাহ্ কুরআনে বলেছেন :
41:11
ثُمَّ اسۡتَوٰۤی اِلَی السَّمَآءِ وَ ہِیَ دُخَانٌ فَقَالَ لَہَا وَ لِلۡاَرۡضِ ائۡتِیَا طَوۡعًا اَوۡ کَرۡہًا ؕ قَالَتَاۤ اَتَیۡنَا طَآئِعِیۡنَ ﴿۱۱﴾
তারপর নজর দিয়েছেন আকাশের দিকে যখন তা ছিল ধোঁয়া। তখন তিনি আকাশ আর পৃথিবীকে বললেন- আমার অনুগত হও, ইচ্ছায় অথবা অনিচ্ছায়। উভয়ে বলল- আমরা স্বেচ্ছায় অনুগত হলাম।
যেহেতু পৃথিবী এবং আসমানসমূহ এই একই ধোঁয়া থেকে গঠিত হয়েছিল, সেহেতু আমরা এ সিদ্ধান্তে আসতে পারি যে, পৃথিবী এবং আসমানসমূহ ছিল এক সংযুক্ত সত্ত্বা। তারপর এই সমরুপ ধোঁয়া থেকে তারা গঠিত হয় এবং একে অপর থেকে আলাদা হয়।
আল্লাহ্ কুরআনে বলেছেন :
21:30
اَوَ لَمۡ یَرَ الَّذِیۡنَ کَفَرُوۡۤا اَنَّ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضَ کَانَتَا رَتۡقًا فَفَتَقۡنٰہُمَا ؕ وَ جَعَلۡنَا مِنَ الۡمَآءِ کُلَّ شَیۡءٍ حَیٍّ ؕ اَفَلَا یُؤۡمِنُوۡنَ ﴿۳۰﴾
অবিশ্বাসীরা কি দেখে না যে, আকাশ আর যমীন এক সঙ্গে সংযুক্ত ছিল, অতঃপর আমি উভয়কে আলাদা করে দিলাম, আর প্রাণসম্পন্ন সব কিছু পানি থেকে সৃষ্টি করলাম। তবুও কি তারা ঈমান আনবে না?
ড. আলফ্রেড ক্রোনার পৃথিবীর প্রখ্যাত ভূতত্ত্ববিদদের একজন। তিনি ভূতত্ত্ব অধ্যাপক এবং জোহানেস গুটেনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের Institute of Geosciences এর ভূতত্ত্ব বিভাগের চেয়ারম্যান। তিনি বলেছেন, “ভাবছি মুহাম্মদ কোথা থেকে আসলো . . . আমার মনে হয়, এটি প্রায় অসম্ভব যে সে মহাবিশ্বের সাধারণ উৎসের মতো বিষয় জেনে থাকতে পারে। কেননা বিজ্ঞানীরা মাত্র গত কয়েক বছরের মধ্যে খুবই জটিল এবং অগ্রবর্তী প্রযুক্তিক পদ্ধতির সাহায্যে জানতে পেরেছিল যে, এই হচ্ছে ঘটনা।” তিনি আরও বলেন, “চৌদ্দশ বছর আগের একজন মানুষ যিনি পারমানবিক পদার্থবিদ্যা বিষয়ক কোনো জ্ঞান রাখেন না, আমি মনে করি, তিনি নিজে নিজে জানতে পারবেন না যে, পৃথিবী এবং আকাশের উৎস একই।”
“The Quran on the Origin of the Universe” (archived)
I. A. Ibrahim, Islam-Guide, accessed December 19, 2013.
বিশ্লেষণ
একক শব্দের বর্ণনা
আলোচ্য দাবিটিতে আগেই মেনে নেওয়া হয়েছে যে, কুরআনের বক্তা অবশ্যই এক শব্দের ব্যবহার করে মহাবিশ্বের আদি অগ্রগতির ধাপ বর্ণনা করেছেন। যাইহোক না কেন, কেউই সন্তুষ্ট হবেন না যদি একজন বিজ্ঞানী এক শব্দ দ্বারা নক্ষত্রসমূহের গঠন বর্ণনা করেন। এমনকি ইসলাম প্রচারকরাও উপলব্ধি করতে পারেন যে, এক শব্দের বর্ণনা এমন জটিল একটি বিষয়কে প্রকাশ করতে যথেষ্ট নয়, যেই কারণে তারা তাদের পয়েন্ট দাঁড় করানোর জন্য মহাবিশ্বের এই অবস্থাকে বর্ণনা করতে বহু শব্দ এমনকি একটি শর্ট প্যারাগ্রাফও ব্যাবহার করেন।
কুরআনের বক্তা খুব বিস্তারিতভাবে বলেছেন যে, আপনি কাকে বিয়ে করতে পারেন ও কাকে নয় এবং কিভাবে সম্পদ ভাগাভাগি করতে হবে। তাছাড়াও কুরআন বহুবার গল্পসমূহ পুনরায় বলে। এসব তথ্যের ওপর ভিত্তি করে এটি যুক্তিসহ ব্যাখ্যা করা কঠিন যে কেন মহাবিশ্বের গঠনের মতো এতো জটিল কোনোকিছু বর্ণনা করতে এতো সামান্য তথ্য ব্যবহার করা হল।
নেবুলা এবং মিল্কিওয়ে
তারপর দাবিটি দূরবর্তী নীহারিকার ছবি ব্যাবহার করেছে যা কেবল আধুনিক টেলিস্কোপের সাহায্য দ্বারা দৃশ্যমান। নিচে উল্লেখিত রাতের আকাশের অন্য একটি চিত্র দূরবর্তী নীহারিকার চেয়ে অনেক বেশি ধোঁয়ার স্মারক এবং এখানে পৃথিবীতে এটি খালি চোখে দেখা যেতে পারে। রাতের আকাশে মিল্কিওয়েকে ধোঁয়া হিসেবে কল্পনা করতে ঐশ্বরিক দৈববাণী কিংবা অগ্রসর বৈজ্ঞানিক যন্ত্রের প্রয়োজন নেই। খুব সহজেই বুঝা যায় যে, সপ্তম শতাব্দীতে মরুভূমি থেকে আকাশে তাকিয়ে থাকা একজন মানুষ কিভাবে মিথটি আবিষ্কার করতে পারে।


কুরআনের আয়াতের প্রসঙ্গ
মুসলিমরা তাদের ধর্মকে ঐশ্বরিক ধর্ম হিসেবে প্রমাণ করার উদ্দেশে কুরআনের বিভিন্ন আয়াতের অল্প একটু অংশ উল্লেখ্য করে তা আধুনিক বিজ্ঞানের সাথে জোর করে মিলানোর চেস্টা করে। কুরআনে মিরাকল আছে বলে দাবি করে তারা যেসব আয়াত উল্লেখ্য করে সেইসব আয়াতের আগে পরের আয়াত তারা কখনোই উল্লেখ্য করে না, আয়াতটি কি প্রসঙ্গে কি বলছে তা তারা এড়িয়ে যায়।
এখানে মুসলিমদের মূল দাবি হচ্ছে, আলোচ্য আয়াতটি মহাবিশ্বের আদি অগ্রগতির ধাপ বর্ণনা করে। যদিও তারা আগে পরের আয়াত কি বলছে ত উল্লেখ্য করেননি, এমনকি যেই আয়াতে মিরাকল আছে বলে দাবি করা হয়েছে সেই আয়াতও পুরোপুরি উল্লেখ্য করেননি। আমি আগে পরের আয়াতসহ পুরো আয়াতটি তুলে ধরছি :
41:9
قُلۡ اَئِنَّکُمۡ لَتَکۡفُرُوۡنَ بِالَّذِیۡ خَلَقَ الۡاَرۡضَ فِیۡ یَوۡمَیۡنِ وَ تَجۡعَلُوۡنَ لَہٗۤ اَنۡدَادًا ؕ ذٰلِکَ رَبُّ الۡعٰلَمِیۡنَ ۚ﴿۹﴾
বল- তোমরা কি তাঁকে অস্বীকারই করছ যিনি যমীনকে সৃষ্টি করেছেন দু’দিনে আর তাঁর সমকক্ষ বানাচ্ছ? তিনিই তো বিশ্বজগতের রব্ব।
41:10
وَ جَعَلَ فِیۡہَا رَوَاسِیَ مِنۡ فَوۡقِہَا وَ بٰرَکَ فِیۡہَا وَ قَدَّرَ فِیۡہَاۤ اَقۡوَاتَہَا فِیۡۤ اَرۡبَعَۃِ اَیَّامٍ ؕ سَوَآءً لِّلسَّآئِلِیۡنَ ﴿۱۰﴾
(যমীন সৃষ্টির পর) তার বুকে তিনি সৃদৃঢ় পর্বতমালা স্থাপন করেছেন, যমীনকে বরকতমন্ডিত করেছেন আর তাতে প্রার্থীদের প্রয়োজন মুতাবেক নির্দিষ্ট পরিমাণ খাদ্য সঞ্চিত করেছেন চার দিনে।
41:11
ثُمَّ اسۡتَوٰۤی اِلَی السَّمَآءِ وَ ہِیَ دُخَانٌ فَقَالَ لَہَا وَ لِلۡاَرۡضِ ائۡتِیَا طَوۡعًا اَوۡ کَرۡہًا ؕ قَالَتَاۤ اَتَیۡنَا طَآئِعِیۡنَ ﴿۱۱﴾
তারপর নজর দিয়েছেন আকাশের দিকে যখন তা ছিল ধোঁয়া। তখন তিনি আকাশ আর পৃথিবীকে বললেন- আমার অনুগত হও, ইচ্ছায় অথবা অনিচ্ছায়। উভয়ে বলল- আমরা স্বেচ্ছায় অনুগত হলাম।
41:12
فَقَضٰہُنَّ سَبۡعَ سَمٰوَاتٍ فِیۡ یَوۡمَیۡنِ وَ اَوۡحٰی فِیۡ کُلِّ سَمَآءٍ اَمۡرَہَا ؕ وَ زَیَّنَّا السَّمَآءَ الدُّنۡیَا بِمَصَابِیۡحَ ٭ۖ وَ حِفۡظًا ؕ ذٰلِکَ تَقۡدِیۡرُ الۡعَزِیۡزِ الۡعَلِیۡمِ ﴿۱۲﴾
অতঃপর তিনি আকাশমন্ডলীকে সাত আকাশে বিন্যস্ত করলেন দু’দিনে আর প্রত্যেক আকাশকে তার বিধি-ব্যবস্থা ওয়াহীর মাধ্যমে প্রদান করলেন। আমি আলোকমালার সাহায্যে দুনিয়ার আকাশের শোভাবর্ধন করলাম আর সুরক্ষার (ও ব্যবস্থা করলাম)। এ হল মহা পরাক্রমশালী সর্বজ্ঞ আল্লাহর সুনির্ধারিত (ব্যবস্থাপনা)।
উপরে উল্লেখিত আয়াতসমূহ থেকে আমরা জানতে পারছি, কুরআনের বক্তা বলেছেন, আল্লাহ্ আসমান তৈরি করার আগে পৃথিবী তৈরি করেছেন। উপরের আয়াতসমূহ পৃথিবীর সবার আগে তৈরি হওয়া এবং পরে তাতে পাহাড় পর্বত ও খাদ্য তৈরি হওয়ার সময়ানুক্রমিক হিসাব প্রদান করে। পৃথিবী তৈরি করার এবং তা পাহাড় পর্বত ও খাদ্য দ্বারা সাজানোর পরেই আল্লাহ্ সাত আসমান, চন্দ্র সূর্য এবং নক্ষত্র তৈরি করেন। আয়াত ১১ তে দেখা যায়, আল্লাহ্ আকাশ এবং পৃথিবীর সাথে কথা বলছেন। পৃথিবী যদি সবার আগে তৈরি নাহয় তাহলে আল্লাহ্ কিভাবেই বা পৃথিবীর সাথে কথা বলতে পারলো? রেডিওমেট্রিক ডেটিং থেকে জানা যায়, পৃথিবী প্রায় ৪.৫ বিলিয়ন বছর আগে গঠিত হয়, মহাবিশ্ব প্রথম সম্প্রসারিত হওয়ার প্রায় ৯ বিলিয়ন বছর পর। (1) কুরআনের বক্তা এবিষয়ে কিছুই জানতেন না এবং তাই তিনি দাবি করেছেন যে, পৃথিবী এবং এই “ধোঁয়া” একই সময়ে অস্তিত্বশীল ছিল। কুরআন অনুযায়ী, যখন পৃথিবী অস্তিত্বশীল ছিল তখনও নক্ষত্রসমূহ তৈরি করা হয়নি বা তাদের অস্তিত্ব ছিল না।
বিজ্ঞানীদের সমর্থন
যখন ড. আলফ্রেড ক্রোনার জার্মানিতে ভূতত্ত্ব অধ্যাপক ছিলেন তখন তিনি কখনোই কুরআনকে বৈজ্ঞানিক তথ্যের জন্য নির্ভুল উৎস হিসেবে সমর্থন দেননি। ২০১১ তে ক্রোনারের সাথে পরিচালিত একটি ইন্টারভিউ ভিডিও নিশ্চিত করে যে, তার আশির দশকের মন্তব্যসমূহ অপ্রাসঙ্গিক ভাবে নেওয়া হয়েছে। (2) তিনি বর্তমানেও কুরআনের সৃষ্টিতত্ত্ব সমর্থন করেন না এবং সেই ইন্টারভিউ এর সময়ও করেননি। তিনি স্বীকার করেছেন যে, কুরআনের বিভিন্ন অংশ আধুনিক বিজ্ঞান সমর্থন করেনা এবং সেইসব পুরোপুরিই অবৈজ্ঞানিক ও পৌরাণিক।
তথ্যসূত্রঃ
- “Age of the Earth”, U.S. Geological Survey, July 9, 2007 (archived).
- TheRationalizer, “Alfred Kröner – Quote mined scientist denounces Quran miracle claims”, YouTube (video), March 21, 2011.
মূল – WikiIslam
আরও পড়ুনঃ
ভাই মুমিনরা এখন বলছে, বাকারার উক্ত আয়াতে ছুম্মা অর্থ অতঃপর ব্যবহ্যার হয় নি। বরং moreover বা তাছাড়া ব্যবহৃত হয়েছে