জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় আন্দোলন এবং ডিবি পুলিশের সাথে একরাত।
২০১১ সালের ঘটনা। ব্লগ লেখার জন্য বাঙলাদেশে প্রথম আমাকে গোয়েন্দা পুলিশ দ্বারা নির্যাতন করা হয়েছিল, অভিযোগ ছিল রাষ্ট্রবিরোধীতা। সেই ঘটনা নিয়েই এই লেখাটি।
ক’দিন ধরেই শুনছিলাম জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সেমিস্টার ফি নাকি অনেক বাড়ানো হয়েছে। কত বাড়ানো হয়েছে কি বৃত্তান্ত কিছুই জানতাম না। একদিন রাতে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছোটবোন লাকি আক্তার একটা মেসেজ পাঠালো, বললো জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলন নিয়ে আমি যেন কিছু লিখি। ওকে বললাম, ঠিক আছে, আমি পুরো ব্যাপারটা আগে ভালভাবে একটু জেনে নিই, আইনের ধারাগুলোতে কি আছে, আন্দোলনটা যৌক্তিক আন্দোলন কিনা তা বুঝে কাল লিখবো। তো আমিও এদিক সেদিক ফোন করা শুরু করলাম, ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করলাম যে ঘটনাটা আসলে কী। এবং দেখতে পেলাম, এটা পুরোপুরি যৌক্তিক আন্দোলন, এবং এই আন্দোলন সফল না হলে জগন্নাথের হাজার হাজার শিক্ষার্থীর শিক্ষা জীবন বিপন্ন হবে। বিরোধী দলগুলোও এই আন্দোলনে সহায়তা করবে না, কারণ মূর্খ জনগোষ্ঠী সরকারী ও বিরোধী দল উভয়ের জন্যেই লোভনীয় পন্য, তাদেরকে ব্যবহার করে, তাদের মাথায় কাঁঠাল ভেঙ্গেই রাজনৈতিক নেতাদের উদরপুর্তি হবে। তাদের ছাত্র সংগঠনগুলো চালাতে প্রয়োজন কিছু টেন্ডারবাজ সন্ত্রাসী-গুন্ডাপান্ডা। তারা নির্বাচনে জেতার জন্য চায় মগজহীন বুদ্ধিহীন দলীয় চাটুকার জাতির পিতা বা জাতির ঘোষকের নামে মাথা ঝাকানো প্রজন্ম। তাই তারা সাধারণ নিম্নবিত্ত ছাত্রদের এই আন্দোলনে কোনভাবেই শরীক হবে না। আর ব্লগ-ফেসবুকেও আওয়ামী জামাত শিবির বেশ সংখ্যাগুরু, তাদের একদল মুক্তিযুদ্ধ মুক্তিযুদ্ধ বলে মুখে ফেনা তুলবে, সরকারের অযৌক্তিক নীতির বিরুদ্ধে ছাত্রদের আন্দোলনকে শিবির ট্যাগ দেবে, অন্যদিকে জামাত-বিএনপি এই আন্দোলনকে পুঁজি করে তাদের বাপদাদাদের রক্ষা করার চেষ্টা করবে। ফলাফল হিসেবে দেখা যাবে, আন্দোলনটা কোন এক পক্ষে ছিনতাই করে নিয়ে গেছে। তাই আমাদেরই কিছু করতে হবে, নতুবা এই ছাত্রগুলো কাল ইসলামী মৌলবাদী জামাত শিবির বা ছাত্রলীগের গুন্ডায় পরিণত হলে তারা আমাদের গলাতেই ছুরি ধরবে।
এর পরদিন ব্লগার বন্ধু এবং আমাদের জাতীয় স্বার্থে ব্লগার অনলাইন একটিভিস্ট ফোরামের আরেকজন স্বমন্বয়ক পারভেজ আলম ফোন দিয়ে বললো, সেও একটা লেখা দিচ্ছে, আমি কখন দেবো সে জানতে চাইলো। আমি জানালাম এই কিছুক্ষণ পরেই দিচ্ছি। অফিসে এসে দেখলাম প্রচন্ড মাথা ব্যাথা। বাল্যবন্ধু মাহবুব রশিদ, যে আমার অফিসেই চাকরি করতো, তাকে বললাম, “আমি মুখে বলতেছি কি লিখতে হবে, তুই একটু টাইপ কইরা দে। আমি মনিটরের দিকে তাকাইতে পারতেছি না।” বিড়ি খাওয়ানোর শর্তে বেটা রাজি হলো। ওকে দিয়ে কয়েক প্যারা লিখানোর পরে নিজেই টাইপ করতে বসলাম। মাথা ব্যাথা ছিল, মনিটরের সামনে বসতে পারতেছিলাম না, কষ্ট হচ্ছিল। ৪০ মিনিটে কোনরকমে লিখে পোস্ট করলাম কয়েকটা ব্লগে। ৩০ তারিখ শাহবাগের মোড়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্ধিত বেতন আইনের(২৭/৪ ধারা) বিরুদ্ধে আন্দোলনের সাথে সংহতি জানিয়ে সমাবেশের ডাক দিয়ে একটি লেখা পোস্ট করি, লেখাটি হচ্ছে, প্রসঙ্গ- জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় এবং শিক্ষার বানিজ্যিকীকরণ। কিভাবে জানি আমার লেখাটা বিপুল সংখ্যকবার শেয়ার হলো, এবং জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেসবুক গ্রুপেও সেটা কেউ একজন শেয়ার দিলো।
এরপরে পারভেজ আলমও লিখে ফেললো। পারভেজের লেখা দুই তিনটা ব্লগে স্টিকিও করা হলো। আমার লেখা সাধারণত স্টিকি করা হয় না, আমি তা চাইও না। কারণ আমার লেখা স্টিকি করলেই একদল ছাগু-ধর্মগাধা জিহাদী জোশ নিয়ে সবসময় ঝাঁপিয়ে পরে। বিভিন্ন ব্লগের মডারেটররা এই কারণে স্টিকি করার জন্য কোন ক্লিন ইমেজের ব্লগার চায়, যারা সবার কাছে-সব পক্ষের কাছে গ্রহনযোগ্য। কারো সাথেই যাদের খুব একটা ঝামেলা নাই, সবার ব্লগে গিয়েই যারা কথাবার্তা বলে এমন ব্লগার মডারেটরদের সবসময় প্রিয়। আমি আসলে খুব কম মানুষের কাছেই গ্রহণযোগ্য, আর সামহোয়্যার যেইরকম ছাগু অধ্যুষিত, তাতে সেইখানে ক্লিন ইমেজ রাখা তো আমার পক্ষে একেবারেই অসম্ভব। যাইহোক, আমি এই জায়গায় শুরুতেই বাদ পরে যাই। এছাড়াও কোন ব্লগের মডারেটররাই আমাকে ঠিক পছন্দ করে না, এটাই একটা বড় কারণ।
আমরা জাতীয় স্বার্থে ব্লগার অনলাইন একটিভিস্ট ফোরামের সকল সদস্য আলোচনা করে আন্দোলনের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করলাম এবং একটি সংহতি সমাবেশের ডাক দিলাম। সেই অনুসারে শাহবাগে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের সাথে সংহতি জানিয়ে একটা জনসভার আয়োজন শুরু করলাম প্রগতিশীল ছাত্রজোটের সাথে।
২৮ তারিখ পোস্ট দিলাম, এরপরে আন্দোলন শুরুর পোস্ট, ৩০ তারিখে জনসভার আহবান করলাম। আয়োজনে আমাদের সাথে ছিল প্রগতিশীল ছাত্রজোট, কথা ছিল আমরা তাদের জনসভায় গিয়ে তাদের এবং জগন্নাথের ছাত্রদের সাথে সংহতি জ্ঞাপন করবো। ২৯ তারিখে রাত ১১ টার দিকে আমার এক বাল্যবন্ধুকে ডিবি পুলিশ তুলে নিয়ে গেল। ডিবি পুলিশের কাছে আমার মোবাইলের কল রেকর্ড ছিল, তারা দীর্ঘদিন ধরেই আমার মোবাইল ট্রাক করে। তারা এর আগের মাসের শেষ কলটা ট্রাক করে, যেই কলে আমি আমার ঐ বন্ধুটিকে ফোন করেছিলাম, এবং আমার সেই বন্ধুকে মিন্টুরোডে তাদের অফিসে তুলে নিয়ে গেল। সেখানে জিজ্ঞাসাবাদের পরে তারা আমার নানান এঙ্গেল থেকে ছবি দেখালো, যেই ছবি গুলো তারা বিভিন্ন সময়ে গোপনে তুলেছে। তারা এটাও জানালো যে, অনলাইনে, ফেসবুক এবং ব্লগে সরকারের অর্থায়নে কিছু বিখ্যাত ব্লগার রয়েছেন, তারা নিয়মিত সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনকারী এবং সরকারের সমালোচনাকারী বিভিন্ন ব্লগারের তথ্য ডিজিএফআই ও ডিবিকে সরবরাহ করে, যার বিনিময়ে তারা মোটা অংকের টাকা নেয়। সেই সকল বিখ্যাত ব্লগার কোন চাকরি বাকরি করে না, ব্লগে ফেসবুকে সরকারের পক্ষে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন অপকর্মের সাফাই গাওয়াই তাদের জীবন ধারণের উৎস। তারা আমার সেই বন্ধুকে এটাও বললো যে, ঐ সকল ব্লগার-ফেসবুক একটিভিস্ট আমার বেশ ঘনিষ্ঠ লোক, তারাই আমার বিরুদ্ধে সরকারকে তথ্য দিচ্ছে।
তারা সেই রাতে আমার সেই বন্ধুটিকে নিয়ে ১২ টার দিকে আমার বাসা এবং ৩ টার দিকে আমার অফিসে হানা দিল, কিন্তু আমার অফিসটি তারা খুঁজে পেল না। আমি রাতে অফিস করি বলে বাসাতেও তারা আমাকে পেল না। তারা সেই রাত থেকে ৩-৪ দফায় আমার বাসায় আসে, আমার পরিবারের সদস্যদের জেরা করে এবং আমাকে না পাওয়ায় তারা বেশ ক্ষিপ্ত হয়। তারা অতিস্বত্ত্বর তার পরেরদিনই আমাকে তাদের অফিসে যোগাযোগ করতে বলে, নতুবা আমার বিরুদ্ধে মামলা দেবার হুমকি দেয়।
সেদিন সকালে আমি অফিস থেকে সরাসরি বোনের বাসায় চলে যাই, কারণ বোনের বাসা শাহবাগের থেকে খুব কাছে। যেহেতু আমাকে সকালেই জনসভায় যোগ দিতে হবে, সারারাত অফিস করে দুই তিন ঘন্টা ঘুমানোটাও জরুরী ছিল। তাই বোনের বাসাতেই গেলাম। সকালেও আমার বাসায় ডিবির একটা টিম আবারো হানা দেয়, এবং আমার বোনের বাসাতেও বারবার ফোন আসে। আমি তখন জনসভা নিয়ে চিন্তিত, ডিবি পুলিশ কেন আমাকে খোঁজে সেটা আমি একেবারেই বুঝে উঠতে পারি নি। তাই ঘুমাবার সময় আমার বোন বারবার আমাকে এই নিয়ে জিজ্ঞেস করার পরেও আমি ব্যাপারটাকে গুরুত্ব দেই নি।
৩০ তারিখ ২:৩০ টায় শাহবাগে গিয়ে দেখলাম পুলিশ ইতিমধ্যে এখানে আসা ৩০ জন ছাত্রকে বিনা কারণে গ্রেফতার করে ফেলেছে। এই ছাত্রগুলো আমাদের জনসভাতে যোগ দিতেই এসেছিল, এবং পুরো এলাকা পুলিশ ঘেরাও করে রেখেছে। আমাদেরও ঢুকতে দিচ্ছে না। আমরা পিছনের রাস্তা দিয়ে আজিজ মার্কেটে জমা হলাম, এবং বাকি বিল্লাহ ভাই, ফিরোজ ভাই, ফারুক ওয়াসিফ, সবুজ বাঘ, পারভেজ আলম, কল্লোল মুস্তফা, সজিব, মাহবুব রশিদ সহ সকলে মিলে সিদ্ধান্ত নিলাম, গ্রেফতার হলেও আমাদের জনসভা সফল করতে হবে। গ্রেফতারের ভয়ে আমরা ফিরে যাবো না। আমরা পিছু হটা মানে জগন্নাথের ছাত্রদের মনোবল ভেঙ্গে দেয়া, এটা কিছুতেই হতে দেয়া যাবে না। প্রয়োজনে আমরা সকলেই গ্রেফতার হবো।
আমার ভাগিনাও সে সময়ে আমার সাথে ছিল। আমি ভাগিনাকে বললাম, “তুমি দূরে দাড়ায়ে থাকবা, আমরা গ্রেফতার হলে বা পুলিশ লাঠিচার্জ করলেই দৌড় দিবা, এবং বাসায় খবর দিবা। হাসপাতালে থাকলে বা থানায় নিয়ে গেলে ঘাবড়ানোর কিছু নাই, পিটা খাইলে দুই চারদিন বিছানায় থাকা লাগবে। কোন ব্যাপার না।”
এরপরে শাহবাগে পুলিশের বুহ্য ভেদ করে ঢুকে পরলাম, এবং ঢুকেই ব্যানার নিয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম।
দাঁড়িয়েই আমরা একে একে শুরু করে দিলাম আগুন গরম বক্তব্য। আমরা আতংকে ছিলাম, পুলিশও বেশ মারমুখী ছিল। কিন্তু আমরা দাঁড়িয়ে যাবার সাথে সাথেই সাংবাদিকরা আমাদের ঘিরে ফেললো। তখন দেখলাম পুলিশও আর কিছু বলছে না, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনছে। আমার মত অধমকেও বক্তব্য দিতে বলা হলো, আমি বক্তব্য দিতে একেবারেই পারি না। তাও দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ হাতপা ছুড়ে চেঁচামেচি করলাম, এবং দেখালাম বেশ হাততালিও দেয়া হচ্ছে। তখন নিজেকে আসলেই নেতা নেতা মনে হচ্ছিল। এই জোশে আরো কিছু বয়ান দিয়ে ফেললাম।
এরপরে সভা শেষে আমরা শাহবাগ থানায় গেলাম আমাদের ৩০ জন ছাত্রকে মুক্ত করতে। সেখানে গিয়ে তাদের সাথে দেখা করলাম, এবং পুলিশের সাথে বেশ খানিকক্ষণ বাদানুবাদ হলো। পুলিশ আমাদের দাবীর প্রেক্ষিতে জানালো, সন্ধ্যা হলেই তাদের ছেড়ে দেয়া হবে। আমার মোবাইলে তখন ফোনের পরে ফোন আসছে, আমার কয়েকজন বোন ফোন দিয়েই যাচ্ছে, জানতে চাচ্ছে ঘটনা কি।
আমি বড়বোনের বাসায় ফিরে আসলাম। আসার পরে পুরো ঘটনা শুনলাম, যে আমার বাসায় পুলিশের অস্ত্রসহ একটা টিম ৩-৪ বার হানা দিয়েছে। তারা একটা মোবাইল নম্বরও রেখে গেছে, সেই নম্বরে ফোন দিলাম। ফোন ধরলেন এসপি রফিকুল ইসলাম। তিনি জানালেন, আগামীকাল আমাকে ডিবির মিন্টু রোডে গিয়ে তাদের সাথে দেখা করতে হবে, অন্যথায় তারা আমার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে। আমি জিজ্ঞেস করলাম কি ব্যাপার? তারা কোন কথাই বলতে রাজি হলো না, আমি তাদের জানালাম ঠিক আছে, আগামীকাল আমি ডিবি অফিসে যাবো।
তারপরের দিন বড়বোনকে সাথে নিয়ে ডিবি অফিসে গেলাম, আগের রাতে বেশ কয়েকজনকে জানিয়ে রেখেছিলাম যে আমি ডিবি অফিসে যাচ্ছি। কোন ঝামেলা হতে পারে। কি বিষয় পরিষ্কারভাবে জানি না। সন্ধ্যা ৭ টায় তাদের কার্যালয়ে গেলাম, তারা আমাকে নানা ধরণের ছবি দেখালো, নানা পোস্টের প্রিন্ট আউট দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলো এগুলো আমার লেখা কিনা। আমি বললাম, হ্যাঁ।
তারা আমাকে জানালো, আমার জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় বিষয়ক লেখাটি নাকি সরকারের গোয়েন্দা বিভাগের নজরে এসেছে এবং তাদের কাছে লেখাটি জনস্বার্থ বিরোধী, জনগনের জানমাল নিরাপত্তার জন্য হুমকীস্বরুপ বলে মনে হয়েছে। এবং লেখাটি খুব সহজেই তরুন ছাত্র সমাজকে উষ্কানী দিয়ে যে কোন নাশকতামূলক কাজ করিয়ে নিতে সমর্থ বলেও তারা মনে করছেন। এই সুত্রে গোয়েন্দা বিভাগে একটি প্রতিবেদন পেশ হয়, যতদুর মনে পরে, গোয়েন্দা প্রতিবেদনটা ছিল এরকমঃ
“সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রুপে যার সদস্য সংখ্যা ৩৪৭ জন, সামহোয়্যারইনব্লগ সাইটের একটি ব্লগ পোস্ট দেখা যাচ্ছে, যে পোস্টটি ছেপেছেন জনৈক আসিফ মহিউদ্দীন, ফোনঃ *****, ই-মেইলঃ****, ঠিকানাঃ যাত্রাবাড়ী।
লেখাটিতে পুলিশ এবং সরকারের বিরুদ্ধে বক্তব্য দেয়া হয়েছে, ঐ আন্দোলনকে বেগবান করার মত যথেষ্ট উপকরণ লেখাটিতে রয়েছে। লেখাটি উত্তেজক এবং জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদেরকে লেখাটি বিভিন্ন ধরণের নাশকতামূলককাজে উষ্কে দিতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
জনগনের জানমাল নিরাপত্তার জন্য হুমকি স্বরুপ উক্ত লেখাটির লেখককে তদন্তের জন্য জিজ্ঞাসাবাদের নির্দেশ দেয়া হচ্ছে, এবং উক্ত লেখক কি স্বার্থে কোন কোন মহলের হয়ে সরকারকে বিপদে ফেলার জন্য এধরণের লেখা লিখছেন, তা খতিয়ে দেখতে নির্দেশ দেয়া হচ্ছে।”
তখন লক্ষ্য করলাম রফিকুল ইসলাম সাহেবের এই পিসিতে বাংলা ফন্ট নেই, আমি তাকে বললাম আমি ফন্ট ইন্সটল করে দিতে পারি। সে তার চেয়ার ছেড়ে উঠে গেল, আমি দীর্ঘক্ষণ তার চেয়ারে বসে ফন্ট ইন্সটল করে দিলাম। উল্লেখ্য, তার নেটের স্পীড খুব ভাল ছিল।
তারা আমার ব্লগে ঢুকলো, আমার ফেসবুকের ওয়াল চেক করতে লাগলো। চেক করতে করতে নানা স্ট্যাটাসের প্রিন্টআউট নেয়া শুরু হলো, এবং আমার ব্লগ পোস্টের প্রিন্ট আউট নিয়ে বিভিন্ন কালি দিয়ে আন্ডারলাইন করা শুরু হলো।
তখন বুঝে গেছি, মূল বিষয় হচ্ছে জগন্নাথের ছাত্র আন্দোলন। তারা বিশেষভাবে এই পোস্টটাই নিয়েই বেশি জিজ্ঞাসাবাদ করছিল। জগন্নাথের ছাত্ররা তার ক’দিন আগে এক এমপির গাড়ি আটকেছিল, তাই সরকারের পক্ষ থেকে কঠোর নির্দেশ এসেছে, যারাই এই আন্দোলনের মূলে আছে, তাদের ধরে চালান করতে, তাদের টাইট দিতে। এর মধ্যে রফিকুল ইসলাম সাহেব আমার বেশ কয়েকটা নাস্তিক্যবাদী পোস্ট পড়া শুরু করে দিলেন, এবং আমাকে নানা প্রশ্ন করতে লাগলেন।
আমার কয়েকটা পোস্ট দেখে চোখ গোল গোল করে জিজ্ঞেস করলেন,
-আপনি নামাজ পড়েন?
-জ্বী না, আমি নামাজ পড়ি না।
-নামাজ রোজা কিছুই করেন না?
-জ্বী না, ঐসব কিছুই করি না।
-আপনি কি নাস্তিক?
-জ্বী, আমি একজন নাস্তিক।
-আপনি নাস্তিক কেন?
-আমি ধর্মে বিশ্বাসী নই, এবং ঈশ্বর আছে এমন কোন প্রমাণও পাই নি। এই কারণে।
-কিন্তু আপনি নাস্তিক ভাল কথা, সেগুলো আপনি প্রচার করছেন কেন?
-একজন ধার্মিকের যদি অধিকার থাকে তার ধর্মের প্রচারের, তার বিশ্বাসের প্রচারের, একজন নাস্তিকেরও অধিকার থাকা উচিত তার অবিশ্বাসের প্রচারের। এবং ধর্মের যুক্তিহীনতা তুলে ধরার।
-কিন্তু এটা কি আমাদের রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যাচ্ছে না?
-আমাদের রাষ্ট্র তো কোন ধর্মের অনুসারী না, রাষ্ট্র কোন মানুষ নাা। তাই রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কিভাবে যাচ্ছে?
– কিন্তু আপনি তো সংখ্যাগুরু মানুষের বিশ্বাসে আঘাত দিতে পারেন না।
– সংখ্যাগুরু মানুষ যদি বিশ্বাস করে “জন্মনিয়ন্ত্রন খুব খারাপ কাজ” এবং এই বিশ্বাসে যদি তারা জনসংখ্যা বৃদ্ধি করতে থাকে, তাহলে অবশ্যই আমার অধিকার আছে তাদের বিশ্বাসে আঘাত করে তাদের সামনে আমার যুক্তি তুলে ধরবার। সংখ্যাগুরু হলেই কারো কথা সত্য হবে এমন না, গ্যালিলিওর সময়ে সংখ্যাগুরু মানুষ যা ভাবতো, সেটা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। ইতিহাসে এমন নজির প্রচুর। সর্বত্রই যুক্তির জয় হয়েছে।
– কিন্তু জীবন তো যুক্তি দিয়ে চলে না।
– তাহলে কি জীবন ধর্ম বা বিশ্বাস দিয়ে চলে? আপনি সুরা কালাম পরে চোর ধরতে পারবেন?
– দেখেন আপনার সাথে আমি তর্ক করতে চাচ্ছি না, কিন্তু আপনাদের এই নাস্তিকতা সমাজের জন্য কি সুফল এনে দেবে?
– মানুষ যত যুক্তিবাদী হবে, তত কম ঠকবে। রাজনৈতিক দলগুলো মানুষকে অশিক্ষিত করে রাখতে চায়, আজীবন তাদের ব্যবসা চালাবার জন্য। ধর্মব্যবসায়ীরা মানুষকে অন্ধকারে রাখতে চায়, তাদের লুটবার জন্য। আমরা সকল মানুষের সমান অধিকারের কথা বলি, মানবতার কথা বলি। এটাই সুফল। এটা একদিনে আসবে না, তবে সংগ্রাম করতে হবে।
– আপনাদের এই নাস্তিকতার সাথে ব্লগে কে কে জড়িত আছে?
– নাস্তিক্যবাদী মুক্তমনা ব্লগিং এর সাথে বহু মানুষ জড়িত আছে। নাস্তিকের ধর্মকথা, অভিজিৎ রায়, আমি আসিফ মহিউদ্দীন, এরা হচ্ছি এই দিকে বেশ জনপ্রিয়। এছাড়াও শত শত মুক্তমনা ইতিমধ্যে কাজ করছেন, এবং আমরা সকল ধর্মীয় প্রপাগান্ডার জবাব দিয়ে কুসংস্কারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করি।
– কুসংস্কারের বিরুদ্ধে কি কি যুদ্ধ করেছেন এই পর্যন্ত শুনি?
– নানা ধরণের যুদ্ধ হয়েছে। যেমন ধরুন নীল আর্মস্ট্রং মুসলিম হয়েছেন বলে একটা প্রপাগান্ডা আছে, আবার চাঁদে আজান শোনা গেছে বলে দাবী করা হয়। চাঁদ দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে বলেও দাবী করা হয়। আমরা দেখিয়েছি এসবই মিথ্যা। আবার ধরেন মাঝে মাঝে মাংশের ভেতরে আল্লাহু লেখা পাওয়া যায়, আমরা বলছি এগুলো ধাপ্পাবাজি। ধর্মব্যবসা।
– আপনি প্রমাণ করতে পারবেন এগুলো মিথ্যা?
-অবশ্যই পারবো। (এরপরে আমি দীর্ঘ সময় নিয়ে চাঁদে আজান শোনার অপযুক্তিগুলো তাকে বোঝালাম, সেগুলো কেন ভুল তা ব্যাখ্যা করলাম।)
– ঠিক আছে, কিন্তু আপনি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে জড়িত হলেন কেন? আপনি তো ওখানকার ছাত্র না।
– কোন যৌক্তিক আন্দোলনের সাথে জড়িত হতে হলে তার ছাত্র হতে হয় না। এই আন্দোলনের সুফল সবাই পাবে।
– কিন্তু আপনি যে রাষ্ট্রবিরোধী কাজে যুক্ত হয়ে গেছেন সেটা বুঝতে পারছেন?
– এটা খুব বেশি হলে সরকার বিরোধী কাজ, কোনভাবেই রাষ্ট্রবিরোধী নয়।
– আপনি আমাকে কোনটা রাষ্ট্রবিরোধী কোনটা সরকার বিরোধী এই জ্ঞান দেবেন?
– আপনাকে জ্ঞান দিচ্ছি না, তবে এটা আপনার জানা থাকার কথা।
– আপনাদের এই আন্দোলন যৌক্তিক, আমি নিজেও জানি ছাত্রদের বেতন এত বাড়ালে ছাত্ররা পড়তে পারবে না। তবে রাষ্ট্র কিন্তু দেখবে না আপনি যৌক্তিক আন্দোলন করছেন নাকি অযৌক্তিক। রাষ্ট্র দেখবে আপনি তার পক্ষে নাকি বিপক্ষে। পক্ষে থাকার চেষ্টা করাই বুদ্ধিমানের কাজ।
– সেরকম হলে আমি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধেই থাকবো।
– আপনি জানেন আপনার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রবিরোধী মামলা দেয়া সম্ভব?
– সেটা দিতে চাইলে দিতেই পারেন, কিন্তু আগেও বলেছি আবারো বলছি, সরকারের বিভিন্ন কর্মকান্ডের বিরোধীতা আর রাষ্ট্র বিরোধীতা এক নয়।
এই সময়ে আমার বড় বোন সেই অফিসারের কাছে কাকুতি মিনতি শুরু করে, এবং বলতে শুরু করে আমি যা করেছি ভুল করেছি। আমি আর এই ধরনের কোন কাজ করবো না। সেই অফিসার আমার বোনকে বলে, এই কথাগুলো লিখিতভাবে দিলে তারা আমাকে ছেড়ে দেবে, নতুবা আমার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রবিরোধী মামলা দেয়া হবে। সেই মামলায় আমার নাস্তিক্যবাদী পোস্টগুলো এড করে আমাকে নাজেহাল করা হবে।
আমি তখন আমার বোনকে বললাম, আমার কোন কাজই অযৌক্তিক ছিল না, কোন অপরাধ ছিল না। পুলিশ যা করার করতে পারে, তারা তাদের মত চলুক। তাদের নির্দেশে আমি কখনই আমার লেখা বন্ধ করবো না।
তখন পুলিশ আমার কাছ থেকে একটা মুচলেকা নেবার চেষ্টা করে, আমাকে বলে যে আমি আর কোনদিন ব্লগে ফেসবুক লিখবো না, এইটা লিখে দিলে তারা আমাকে ছেড়ে দেবে। নতুবা জামিন অযোগ্য রাষ্ট্রবিরোধী মামলার ভয় দেখানো শুরু করে, এবং আমাকে ওদের রিমান্ড রুমের পাশে বসিয়ে রাখে। রিমান্ড রুমের পাশে বসে একটা কাজ সেড়ে ফেলেছিলাম, বাকি ভাই, মাহবুব রশিদ, পারভেজ আলম সহ কয়েকজনকে মেসেজ দিয়ে দিয়েছিলাম। তারা নানাভাবে ভয়ভীতি দেখাতেই থাকে, এবং আমারো একটু ঘাড় তেড়া টাইপ স্বভাবের কারণে আমি তাদের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করি এবং জানাই, আমার বাকস্বাধীনতা রয়েছে যে কোন বিষয়ে স্বাধীনভাবে নিজের মত প্রকাশের। তখন আমার বিষয়ে তদন্তকারী কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম আমাকে “বাস্তবতা না বুঝে নীতি নৈতিকতার দুনিয়ার বাস করি” বলে ভৎসনা করে।
রিমান্ড রুমে এক এক জনকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, এবং সে বের হচ্ছিল অজ্ঞান হয়ে। ভিতরে প্রচন্ড মারধোরের চিৎকার। আমার বোনকে তখন চলে যেতে বলা হয়েছে। দুলাভাই এসে আমার বোনকে নিয়ে গেছে। পরে দেখলাম আমার বোন ডেপুটি পুলিশ কমিশনার মনিরুল ইসলামের রুমের পাশে বসে আছে, তার কাছে তদবির করতে গেছে। ডেপুটি পুলিশ কমিশনার মনিরুল ইসলামের নির্দেশেই আমার উপরে এই নির্যাতনগুলো হচ্ছিল বলেই মনে হলো। তখন রফিকুল ইসলাম আমার বোনকে ধমক দিয়ে ডিবি অফিস থেকে চলে যেতে বাধ্য করলেন। এরপরে আবারো শুরু হয় জিজ্ঞাসাবাদ, তবে তখন রফিকুল ইসলামের চেহারা পুরাই পালটে গেছে। এতক্ষণ সে আপনি করেই বলছিল, আমার বোন যাবার পরেই সে তুমি বলা শুরু করলো এবং কথায় কথায় আমাকে শাসানো শুরু করেছিল।
এরপরে আমাকে চোঁখ বেধে জিজ্ঞাসাবাদ করা শুরু হলো। রফিকুল ইসলাম তখন বাসায় চলে যাবেন, তিনি দায়িত্ব দিয়ে গেলেন ঐ অফিসে আসা ডিজিএফআই সদস্যদের, যাদের একজনার নাম পরে জেনেছিলাম, সে ছিল ডিবি ইন্সপেক্টর রুহুল আমিন। তাদের সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দিলেন এইভাবেঃ
“এই যে আপনাদের আসিফ মহিউদ্দীন, জগন্নাথের আন্দোলনকারী এবং জনসভার আয়োজকদের একজন। আর ইনি একজন স্বঘোষিত নাস্তিক, সুতরাং সেইভাবেই আদর আপ্যায়ন করবেন”
ডিজিএফ আই সদস্যরা আমার চোখ বাধলো। এবং ভিডিও ক্যামেরা এনে পুরো জিজ্ঞাসাবাদ ভিডিও করলো। চোখ বাধা অবস্থায় আমি ভাবছিলাম মারধোর করবে, তাই শক্ত হয়েই বসে ছিলাম। সেখানে বসে বসে মনে নানা ভাবের উভয় হচ্ছিল। আহারে, এখন পর্যন্ত কোন মেয়ের সাথে ভালকরে প্রেম করতে পারলাম না। ভাবছিলাম মেরে টেরে ফেললে কি হবে, কে কে কান্নাকাটি করবে? ব্লগে ফেসবুকে বা অন্যান্য বন্ধুরা জানবে তো? জানলেও তারা কয়দিন মনে রাখবে? আমার মৃত্যু সংবাদে কয়জন এসে লাইক দিয়ে একটু পরে ভুলে যাবে। জগন্নাথের ছাত্ররা জানবে তো? জানলেও ক’দিন মনে রাখবে? কয়েকদিন একটু হৈচৈ হবে, এরপরে সবাই ভুলে যাবে। খুব হতাশ লাগছিল। নিজের গ্যাটের পয়সা খরচ করে, সারারাত অফিসে করে রক্ত পানি করা টাকা দিয়ে ব্যানার বানাও, জনসভা করো, আন্দোলন করো, আবার পুলিশের হাতে মার খাও। এরপরে তারা মেরে লাশ গুম করে দিলে কে খুঁজে বের করবে?
ডিজিএফআই এর সদস্যরা আমাকে দেড়-দুই ঘন্টা জিজ্ঞাসাবাদ করে। এই জিজ্ঞাসাবাদের সময় তাদের জিজ্ঞাসা ছিল প্রধানত বিভিন্ন আন্দোলনে আমি ঘরের খেয়ে বনের মোষ কেন তাড়াচ্ছি, আমি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র না হয়েও কেন তাদের আন্দোলনে যোগ দিয়ে নিজের জীবন হুমকির মুখে ফেলেছি, এই রাষ্ট্রবিরোধী কাজের জন্য আমি অর্থনৈতিক ভাবে কিভাবে লাভবান হয়েছি, এত বড় এবং লম্বা লেখা আমি কোন ধরণের আর্থিক সুবিধা ছাড়া কেন লিখলাম সেটা, পত্রিকায় লিখলে টাকা পাওয়া যায়-ব্লগে বিনাপয়সায় মানুষ এত কঠিন কঠিন লেখা কেন লিখবে সেটা নিয়ে তাদের বেশ আশ্চর্য বলে মনে হচ্ছিল। এছাড়াও আমি নাস্তিক কিনা, আমি শুকর খাই কিনা, নামাজ রোজা কেন করি না, ধর্মবিরোধী লেখা কেন লিখি, ইত্যাদি।
আমি নাস্তিক কিভাবে হলাম, মদ খাই কিনা, নাস্তিক হয়ে আমি কি সুফল পাচ্ছি, জগন্নাথের ছাত্রদের আমি কিভাবে চিনি। তাদের নাম কি? আন্দোলনের সাথে কারা কারা জড়িত? অনলাইনে সরকারের হয়ে দালালী করা বিখ্যাত ব্লগারদের(নাম বলছি না) সম্পর্কে আমার মতামত কি? তাদের সাথে আমি কেন যোগ দিচ্ছি না?
এরপরে তারা দীর্ঘ সময় নিয়ে আমার ভিডিও করলো। তখন আমার অবস্থা আসলেই খারাপ ছিল, আমি ভয় পাচ্ছিলাম। আমি বললাম, আমি নিজেও ছাত্রজীবনে অনেক কষ্ট করেছি। সেমিস্টার ফি না দিতে পারা, এবং সেই নিয়ে তৈরি হওয়া হতাশা যে কতটা কষ্ট দেয়, আমি সেটা জানি। এবং জানি বলেই এই আন্দোলন আমারো সংগ্রাম। এই আন্দোলন সফল হলে মনে হবে নিজেই জিতে গেছি।
জিজ্ঞাসাবাদ শেষে তারা আমাকে পাশের চেয়ারে বসে থাকতে বললেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম, এবারে কি বাসায় যেতে পারি? তখন রাত ৩ টার মত বাজে হয়তো। তারা আমাকে বললেন, এখন তো বাসায় যাবেই না, কখনই যাবে কিনা সেটা আমরা সকালে সিদ্ধান্ত নেবো। আর তোমাকে কি কি আপ্যায়ন করা হবে সেটাও ঠিক করবো।
এরপরে আমাকে হ্যান্ডক্রাফ পরিয়ে নিয়ে যাওয়া হলো। আমাকে যে নিয়ে গেল, তাকে নির্দেশ দেয়া হলো, সারারাত যেন আমাকে একটা চেয়ারে বসিয়ে রাখা হয়, এবং আমি যেন আমার চোখের পাতা এক করতে না পারি। এছাড়াও কোন খাবার বা পানিও যেন দেয়া না হয়।
আমাকে হাজতের পাশের রুমে নিয়ে গেল, সেখানে কোন চেয়ার খালি ছিল না। আমাকে বসানো হলো আলমারীর পাশে একটা ছালার উপরে। সেই ছালায় এতই দুর্গন্ধ ছিল যে, আমার বমি চলে আসছিল। আমি তখন বললাম, আমাকে তো চেয়ারে বসাতে বলা হয়েছিল, এইখানে আমি বসবো কেন? আমি তো পলিটিক্যালী আটক, পলিটিক্যাল আটকের নিয়মানুসারে আমাকে তো আপনারা এইভাবে নোংরা ছালার উপরে বসাতে পারেন না।
তারা আমাকে বেশ গালাগালি করলো, এবং বললো, তোর জন্য কি রাজসিংহাসন আনা লাগবে নাকি?
আমি আর কোন উপায় না দেখে সেখানেই বসলাম। আমার পাশেই শুয়ে ছিল খুব সম্ভবত একজন সামাজিক প্রতিবন্ধী, যিনি তার পা দুটো খুব অশ্লীলভাবে রেখে শুয়েছিলেন। তার গা থেকে বিকট গন্ধও আসছিল।
সেই সময়টা সময় যেন থমকে গিয়েছিল। আমি একটু হেলান দিতে পারছিলাম না, একটু চোখ বন্ধ করতে পারছিলাম না। সিগারেট খাবার জন্য বুকটা খা খা করছে, বিকট গন্ধে বমি আসছে। খুবই বিতিকিচ্ছিরি অবস্থা। সময় যেন আগাচ্ছে না, মোবাইলটাও জব্দ করা হয়েছে। মোবাইলটা থাকলেও একটু ফেসবুকে ঢুকে সময় পার করা যেত। কিন্তু এক একটা সেকেন্ডই তখন এক এক বছর মনে হচ্ছে। ঘড়িতে সময় আর আগায় না। কখন সকাল হবে, কখন সকাল হবে, সেই প্রতীক্ষা।
এর মধ্যে এক মামাকে ভাও করার চেষ্টায় ছিলাম, তাকে অনুরোধ জানালাম একটা সিগারেট খাবার ব্যবস্থা করে দিতে। সে ৫০ টাকা চাইলো। আমি প্রথমে ভাবলাম এই ধরণের দুর্নীতি করা ঠিক হবে না, পরে আর নিজেকে দমাতে পারছিলাম না, ৫০ টাকা দিলাম তাকে। সে আমার হাতে হাতকড়া পড়িয়ে পাশের রুমে নিয়ে গেল, সেখানে লুকিয়ে লুকিয়ে একটা বিড়ি টানলাম।
এরপরে আবার প্রতীক্ষার পালা, রাত শেষ হয় না শেষ হয় না। সেটাই ছিল আমার জীবনের সবচাইতে বড় রাত। ৪-৫-৬-৭-৮টা বাজলো, তখন আমাকে একটু খিচুরী দাওয়া হলো।
আমি বসে ছিলাম হাজতের একদম পাশেই, হাজতের ঠিক বাইরে। হাজতের কয়েকজনার সাথে ইশারায় কথাবার্তাও বললাম। সকাল ৯ টার দিকে হাজতের ভিতরে শুরু হলো ইসলামী অনুষ্ঠান, একজন ধর্ষন মামলার আসামী সুললীত কন্ঠে ইসলামী জলসা এবং আলোচনা সভা শুরু করলেন। আমি এই সময়টুকু বেশ মজা পেতে শুরু করলাম, কারণ ইসলামী বক্তা একদম সাইদীর মতই কথা বলছিল। একবার কর্তব্যরত পুলিশ এসে ধমক দেবার চেষ্টা করে, কিন্তু সব কয়েদী তখন চিল্লাপাল্লা শুরু করে, তারা বলে এটা তো ধর্মীয় আলোচনা, এই আলোচনায় কেন পুলিশ বাধা দিচ্ছে! পরে দেখলাম দুইজন পুলিশও বসে আলোচনা শোনা শুরু করলো। মনে মনে ভাবছিলাম, আমাকে হাজতে ঢুকতে দিলে এতক্ষণে ফাটাইয়া ইসলামী বয়ান দিতে পারতাম!
এর কিছুক্ষণ পরে আমাকে হাজতের বাথরুমে যেতে দেয়া হলো। সেখানে এক কয়েদী আমাকে জানালো, কোন সমস্যা হলে তাকে জানাতে। তার হাতে নাকি ভাল উকিল আছে। আমি আবারো আগের জায়গায় গিয়ে বসলাম।
১০ টার দিকে আমাকে হাজতে ঢোকানো হলো। হাজতে বেশ কয়েকজনার সাথে দীর্ঘ আলাপ আলোচনা হলো, তাদের ভেতরে একজন ফেন্সিডিল ব্যবসায়ী আমাকে জানালো যে, সে দুইদিন আগে আমাকে শাহবাগে ভাষণ দিতে দেখেছে। আমাকে তারা বেশ বড় কোন নেতাই মনে হয় ভেবে নিয়েছিল, এবং আমাকে সিগারেটও খাওয়ালো বাথরুমে নিয়ে। বেশ একটা পরিবার পরিবার ভাব। আমার সেই সময়টুকু বেশ ভালই লাগছিল। কয়েদী কয়েদী ভাই ভাই, একজন খুনী একজন ধর্ষক একজন ইয়াবা ফেন্সী ব্যবসায়ী, সকলেই কেমন ঘনিষ্ট বন্ধুর মত।
সেই সময় দেখলাম একজন লোক এসে আসিফ নামে কাউকে খুঁজছে। আমি হাজতের শিকের সামনে আসলাম, দেখি সে মিটিমিটি হাসছে। সে আমাকে বললো, তাকে অনুলেখা নামের একজন পাঠিয়েছে, এটা দেখতে যে আমি আসলেই হাজতে আছি নাকি মিথ্যা বলছি। পরে জেনেছিলাম এই ছেলেটাকে অমি রহমান পিয়াল এবং সুশান্ত দা পাঠিয়েছিল খবর নিতে। সেই সময়ে এই রকম কাউকে দেখাটাও একটু বাড়তি সাহস জুগিয়েছিল।
ছেলেটা জানালো, ঐদিক থেকে কিছু করা যাচ্ছে না। কারণ এই আটক বেশ উপর মহলের নির্দেশেই হয়েছে। মামলা দিলে বা আইনগতভাবে গ্রেফতার করলে বা কোর্টে চালান করে দিলে একটা ব্যবস্থা হবে হয়তো। কিন্তু ডিবি পুলিশ নাকি স্বীকারই করছে না যে আমি হাজতে আছি। এইটা খুবই রিস্কি ব্যাপার, কারণ আমাকে মেরে লাশ গুম করে দিলেও কোন প্রমাণ থাকবে না।
দুপুর ১টার দিকে পুনরায় আমাকে ডিবির অফিসে নিয়ে আসা হলো। রফিকুল ইসলামের সাথে দীর্ঘ বাহাস শুরু হলো। তার কম্পিউটারে কি কি সমস্যা ছিল, তার অনুরোধে সেগুলোও ঠিক করে দিলাম। বিনিময়ে সে আমাকে একগ্লাস ঠান্ডা পানি খাওয়ালো। তখন সে আমাকে নানা ধরণের উপদেশ দেয়া শুরু করেছিল। যেমন এই সব বিপ্লবী কাজ কাম ছেড়ে আমি যেন বিয়ে শাদী করি, ঘর সংসার করি। এই সব বিপ্লব করে কিছুই হয় না, তারাও নাকি এক সময় খুব বিপ্লব করেছে। এখন বুঝতে পেরেছে নিজে বাঁচলেই হয়, ফকিন্নীর বাচ্চারা মরলেই কি আর বাঁচলেই কি। আমি যথারীতি তার উপদেশ প্রত্যাখ্যান করতে লাগলাম, এবং বললাম, আমার জীবন দর্শন ভিন্ন রকম।
এরপরে আমার বোনকে ফোন করে আসতে বলা হলো। আমার বোন গেটের কাছেই সকাল থেকে বসে ছিল, আমার অন্যান্য বোনরাও সারারাত ঘুমায় নাই। তখন রফিকুল ইসলাম সাহেব চলে গেলেন, এবং অন্য একজন লোককে দায়িত্ব দিয়ে গেলেন। সে এসে আবার আগের মতই আমার লিখালিখি বন্ধের মুচলেখার জন্য চাপাচাপি শুরু করলেন। আমি আবারো তা প্রত্যাখ্যান করলাম। এবং বুঝতে পারলাম, আজকে রাতেও হাজতেই থাকা লাগবে। আমার পকেটে তখন ২৩০ টাকা।
তখন আমার বোন এসে কান্নাকাটি শুরু করে, এবং আমাকে মুচলেকা দেয়ার জন্য চাপাচাপি করতে থাকে। সে নানা কথা বলে আমাকে ইমোশন্যাল ব্লাকমেইল করতে থাকে, তখন বাধ্য হই একটা মুচলেকা দেবার। মুচলেকাটা অবশ্য একটু কৌশলে লিখলাম; লিখলাম যে, আমি আর ফেসবুক স্ট্যাটাসে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্ধিত বেতনের বিরুদ্ধে জনসভা ডাকবো না। (মনে মনে ভাবলাম, স্ট্যাটাসে না ডাকলেও ব্লগে ডাকা বিষয়ে মুচলেকায় কিছু বলা নেই, বা ফেসবুক নোটের মাধ্যমেও জনসভা আহবান করতে বাধা নেই।)
ডিবি অফিস থেকে বাইরে বের হয়েই বাধন স্বপ্নকথকের ফোন, একটু পরেই জানার ফোন পেলাম। তাদের জানালাম ঠিক আছি। এরপরে পারভেজ আলম, মাহবুব রশিদকে জানালাম, তারপরে বাকী ভাইকেও জানালাম। তখন শুনলাম আমার মুক্তির জন্য নাকি শাহবাগে জনসভার আয়োজন হয়েছে, সেখানে আনু মুহাম্মদ স্যার সহ নানান গুরুত্বপুর্ণ ব্যাক্তি আসবেন। আমিও সেখানে যাবো কিনা জিজ্ঞেস করলো। আমার শরীর তখন খারাপ হয়ে গিয়েছিল, আমি জানালাম আমি যেতে পারছি না।
বোনের গাড়িতে উঠেই বললাম আমাকে এক জায়গায় নামিয়ে দাও, আমার বিড়ি খাওয়া লাগবে। বোনরা অনুমতি দিল, তখন বোনদের সামনেই ধুমাইয়া বিড়ি টানা স্টার্ট করলাম।
বাসায় আসলাম, ফোনের পর ফোন, পিঠে ব্যাথা, মাথা ব্যাথা, শাহবাগে জনসভা চলছে, ফারুক ওয়াসিফ ভাই সেখানে জ্বালাময়ী ভাষণ দিচ্ছেন।
বিবিসি-প্রথম আলো সহ অনেক পত্রিকা থেকে লাগাতার ফোন আসতে লাগলো। প্রথম আলো যথারীতি মেজাজ খারাপ করলো, তাদের ভাব দেখে মনে হচ্ছিল তারা আমার ইন্টারভিউ নিয়ে আমার চোদ্দ গুষ্ঠী উদ্ধা করছেন। তাদের ফোন রেখে দিলাম।
সেইদিন রাতে মাহবুব বোনের বাসার সামনে আসলো, সেখানে একসাথে চা বিড়ি খেলাম আর আড্ডা দিলাম। কয়েকদিন খুবই ভয়ে ভয়ে ছিলাম, বিডিনিউজ২৪ এ আমার সাক্ষাৎকার ছাপা হবার পরে এবং ডয়েচ ভেলে রেডিওতে আমার সাক্ষাৎকার প্রচারিত হবার পরে ঐ পুলিশ অফিসার বেশ কয়েকবার হুমকিও দিয়েছিল। যাইহোক, এই হচ্ছে সেই সময়ের ঘটনা।
এই পুরো ঘটনার অনলাইনে একটা বিশাল নাড়া পরে গিয়েছিল তা পরে টের পেয়েছিলাম। আমি কৃতজ্ঞ সেই সব মানুষদের কাছে, যারা বিভিন্ন ভাবে আমার পাশে ছিলেন। ব্লগ-ফেসবুকের কিছু চিহ্নিত ছাগু ছাড়া সকলেই সেই সময় আমার পক্ষে ব্যাপক লড়াই করেছেন, সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন। তাদের এই ঋণ শোধ দেবার ক্ষমতা আমার নাই। তারপরেও কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।
কারো নাম উল্লেখ করতে চাচ্ছি না, কারণ কারো নাম উল্লেখ করা হলে যারা অন্যভাবে বা পরিচয় গোপন করে সমর্থন দিয়েছেন, তাদের গৌন করা হবে। কিন্তু আমি সকল অনলাইন একটিভিস্টের কাছেই কৃতজ্ঞ, তাদের সারারাতের বিপ্লবই আমাকে বাইরে বের করে নিয়ে এসেছে।
তাই এটাই শেষ নয়, এখনই বিয়ে করে ঘর সংসার করে পরিবর্তনের ইচ্ছাকে কবর দিচ্ছি না, লড়াই চলবেই। হয়তো আমার মত ক্ষুদ্র মানুষের ক্ষুদ্র লড়াইতে কোন পরিবর্তনই হবে না, তবে আমাকে দেখে আরো কয়েকজন লড়াই শুরু করবে, এভাবেই পাহাড়ে একটা নুড়িও ধ্বস নামাতে পারে।
আমার জন্য একটি পোস্টার বানানো হয়েছিলঃ
বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক। মানুষের জয় হোক।
প্রাসঙ্গিক পোস্ট সমুহঃ
■ আসিফ মহিউদ্দীনের আটকঃ বাক-স্বাধীনতার পক্ষে গনজোয়ার।
■ একটি খবরঃ এনএসআই কর্মকর্তাদের প্রহারে গুরুতর আহত ডিবি পুলিশ কর্মকর্তা