জো সুই শার্লি! আমিই চার্লি হেবডো!
চার্লি হেবডো (সঠিক ফরাসি উচ্চারণঃ শার্লি এবডো) একটি ফরাসী ব্যঙ্গাত্মক সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন যেখানে কার্টুন, রিপোর্ট, পোলিমিকস এবং জোকস ছাপা হয়, যার মূল লক্ষ্য হয়েছে কট্টর ডানপন্থী দল (বিশেষত ফরাসি জাতীয়তাবাদী জাতীয় ফ্রন্ট পার্টি), ধর্ম (ক্যাথলিক, ইসলাম, ইহুদী ধর্ম), রাজনীতি এবং সংস্কৃতি। ১৯৭০ সালে ম্যাগাজিনটি প্রথম প্রকাশ করা শুরু হয়। ১৯৮১ সালে প্রকাশনী বন্ধ হয়ে গেলেও আবার ১৯৯২ সালে আবার চালু হয়। ম্যাগাজিনটির একটি ধর্মবিরোধী এবং ব্যাপকভাবে প্রতিষ্ঠান বিরোধী অবস্থান ফুটে উঠে এটির ধর্মনিরপেক্ষ, সংশয়বাদী এবং নাস্তিক, চরম বামপন্থী, এবং বর্ণবাদ বিরোধী লেখার মধ্য দিয়ে।
মোহাম্মদের ছবি ছাপার পর ম্যাগাজিনটি ২০১১ এবং ২০১৫ সালে দুটি সন্ত্রাসী হামলার লক্ষ্যবস্তু হয়। ২০১১ এর মুহম্মদ ইস্যু নিয়ে বিতর্কের পর ম্যাগাজিনের সম্পাদক এক সাক্ষাৎকারে উল্লেখ করেছেন যে প্রকাশনা নিয়ে ক্যাথলিক সংগঠনগুলি ১৩ বার আইনগতভাবে আদালতে অভিযোগ করেছে, যেখানে মুসলমানরা কেবল ১ বার আইনি পন্থার সাহায্য নিয়েছে (কেরাইআন ও লিচফিল্ড, ২০১৫)। ইসলাম নিয়ে ব্যঙ্গ প্রকাশনা করা নিয়ে ফ্রান্সে বসবাসরত মুসলমানরা নানা সময়ে আন্দোলন করেছে যদিও চার্লি হেবডোর ভাষ্যমতে তারা ইসলামকে আক্রমণ করছে না বরং মুসলমান জঙ্গিদের আক্রমণ করছে লেখার মধ্য দিয়ে। ২০১৫ সালের হামলায় মৃত্যু হয়েছিল ১২ জনের যার মধ্যে ছিলেন চারজন কার্টুনিস্ট।
২০১৫ সালের শুটিং-এর ঘটনায় বেঁচে গিয়েছিলেন রেনাল্ড লুজিয়ে যিনি এঁকেছিলেন মোহাম্মদের কার্টুনটি। সংবাদপত্র দফতরে হামলার পর বিক্ষোভের প্রধান মুখ হয়ে উঠেছিলেন, এঁকেছিলেন হামলার পরের দিনের প্রথম পাতা, স্লোগান দিয়েছিলেন ‘জো সুই শার্লি’। লুজিয়ে চার্লি হেবডো ছেড়ে চলে গেলেও চার্লি হেবডো এখনও সংগ্রাম করে যাচ্ছে, এখনও ছাপছে, এখনও নিষিদ্ধতা ভাঙছে এবং এখনও বিদ্রূপ করে যাচ্ছে সংগঠিত ধর্মগুলোকে। যারা ফরাসি ভাষায় অভ্যস্ত নন তাঁদের জন্য কিছু ধর্মীয় প্রচ্ছদ অনুবাদ করার হলো বাংলায়। চার্লি হেবডো কে বাংলায় অনুবাদ করার মূল উদ্দেশ্য হলো বাক স্বাধীনতার পক্ষ নেয়া।
চার্লি হেবডো এর (শার্লি এবডো) শুটিং এর হৃদয়বিদারক ঘটনা স্মরণ করতে আর বাকস্বাধীনতার পক্ষে সচেতনতা গড়ে তোলার লক্ষ্যে ২০২০ সালের জানুয়ারীর ৭ তারিখ থেকে এক মাস প্রতিদিন ১টি করে প্রচ্ছদ বাংলায় অনুবাদ করা হয়েছে জিন্দাপীর ফেসবুক পেইজে।
চার্লি হেবডো এর এই প্রচ্ছদটির ডিজাইন ২০১১ সালের ৩ রা নভেম্বরের প্রচ্ছদের মতো করে বানানো হয়েছে। ‘সব মাফ করা হলো’ টাইটেলের কভারটিতে দেখা যাচ্ছে মলিন মুখে মুহাম্মদের হাতে একটি প্ল্যাকার্ড যেখানে অরিজিনালি লেখা ছিল আমিই চার্লি। এই ইস্যুতে যে চারজন কার্টুনিস্ট খুন হয়েছেন তাঁদের আঁকা কার্টুনের পাশাপাশি অনেক নতুন কার্টুন ছাপা হয়েছিল। মুক্তমনা লেখক অভিজিৎ রায়ের হত্যাকাণ্ডের পর বাঙালি মুক্তমনা সার্কেলে ‘আমিই অভিজিৎ’ ছিল আন্দোলনের মূল স্লোগান এবং এটার সাথে আবেগ জড়িয়ে আছে। তাই আক্ষরিক অনুবাদ না করে এখানে আমিই অভিজিৎ প্রেফার করা হয়েছে।
হতাশ মোহাম্মদের ছবি ব্যবহার করা হয়েছে ফরাসী সাপ্তাহিক ম্যাগাজিনের এই প্রচ্ছদে। যাইল্যান্ডস-পোস্টেন নামের একটি ডেনিশ ম্যাগাজিনে মোহাম্মদের চিত্রাঙ্কন যেখানে নবীর পাগড়ির ভেতর বোমা দেখানো হয়েছিল প্রকাশের পর ইসলামিক মৌলবাদীদের দ্বারা হুমকির সম্মুখীন হয়েছিল। প্রচ্ছদের এই ছবিটি সেই ডেনিশ ম্যাগাজিনের সমর্থনে একটি প্রতিযোগিতার মধ্যে বিজয়ী হয়েছিল। চার্লি হেবডো এর এই ইস্যুতে আরও ১২ টি কার্টুন ছিল, যার মধ্যে একটি ছিল চার জন সন্ত্রাসী যাদের মৃতদেহ থেকে তখনও ধোঁয়া বেরুচ্ছে বেহেশতে পৌঁছেছে, এবং মোহাম্মদ বলছে, “অপেক্ষা করো, আমাদের হুর শেষ হয়ে গেছে।”
এই প্রচ্ছদের পটভূমি ছিল দালাই লামার ফ্রান্স আগমন এবং সেই সাথে বৌদ্ধ ধর্মের প্রসার। ফ্রান্সের শীর্ষ তিন ধর্ম ছিল খ্রিষ্টান, ইসলাম ও ইহুদি। সেগুলোর বদলে প্রচ্ছদে ফুটবল, বর্ণবাদ, ও কর-ফাঁকিকেই ফরাসীদের মূল ধর্ম বলা হয়েছে। এই ইস্যুতে কেন ফ্রান্সকে অলিম্পিক আয়োজক দেশ হতে দেওয়া উচিত এবং আমেরিকার আসন্ন ইলেকশন নিয়েও আলোচনা করা হয়েছে।
এই প্রচ্ছদে পোপ ষোড়শ বেনেডিক্টকে একটা বিস্ময়সূচক শব্দ যা দিয়ে মল থেকে তৈরি সারের কথা বুঝানো হয় বলতে দেখা যাচ্ছে যেটা বাংলায় ঠিক গালি হিসেবে ব্যবহার করা হয় না; অসন্তোষ ব্যক্ত করার জন্য একটা প্রচলিত গালি ব্যবহার করা হয়েছে। অনেকের ধারণা যারা ধর্মীয় ক্ষমতার শীর্ষে পৌঁছেছে তাঁরা জানে ধর্ম একটা মানুষের তৈরি তত্ত্ব এবং সেটা জেনেই তাঁরা ধর্মকে ব্যবহার করে। এই প্রচ্ছদের মূল উদ্দেশ্য হলো ধার্মিকদের যে ধারণা ‘যারা ঈশ্বরে বিশ্বাস করে না তাঁদের নৈতিকতার অভাব আছে’ সেটা নিয়ে প্রশ্ন তুলা।
এই প্রচ্ছদে ফ্রান্সে মহিলাদের প্রকাশ্যে বোরকা পরা নিষিদ্ধ করা নিয়ে বিতর্ক ফুটিয়ে তুলা হয়েছে। ২০০৭ সালে গৃহীত ধর্মনিরপেক্ষতা সনদে বলা হয়েছে যে “একজন সরকারী কর্মী তার দায়িত্ব পালনের সময় ধর্মীয় বিশ্বাসকে প্রকাশ করতে পারবে না”। ২০০৯ সালে প্যারিসে এক মহিলা ট্র্যাফিক পুলিশ অফিসার তার হিজাব অপসারণ করতে অস্বীকার করায় তাকে দুই বছরের জন্য সাসপেন্ড করা হয়েছিল। ২০১০ এর সেপ্টেম্বরে সর্বপ্রথম ইউরোপীয় দেশ হিসেবে ফ্রান্স প্রকাশ্যে বোরকা ও নিকাব পরা নিষিদ্ধ করেছিল। আল-কায়েদা এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকার উভয় পক্ষই ফ্রান্সের এই সিদ্ধান্তকে নিন্দা জানায় যেটাও সম্ভবত ঐতিহাসিক প্রথম ঘটনা যেখানে এই দুই পরিপন্থী পক্ষের মত এক ছিল।
রোমান পোলানস্কি একজন ফরাসী-পোলিশ বংশোদ্ভূত চলচ্চিত্র পরিচালক, প্রযোজক, লেখক এবং অভিনেতা। ১৯৭৮ সাল থেকে পোলানস্কি মার্কিন অপরাধমূলক বিচার ব্যবস্থা থেকে পলাতক। যৌন নির্যাতনের মামলায় ১৩ বছরের এক নাবালিকা ধর্ষণের অভিযোগ স্বীকার করার পর কারাদণ্ড শুরুর অপেক্ষার সময় আমেরিকা ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন। ফরাসী নাগরিক হবার কারণে তিনি প্রত্যর্পণ থেকে রক্ষা পেয়েছেন এবং তখন থেকেই বেশিরভাগ সময় তিনি ফ্রান্সে কাটান। পরবর্তীতে তিনি টাকার বিনিময়ে চুক্তি করার চেষ্টা করেন ধর্ষিতাকে মামলা প্রত্যাহার করানোর জন্য। ২০০৯ সালে আমেরিকার অনুরোধে পোলানস্কিকে সুইজারল্যান্ড আটক করলে বিভিন্ন হলিউডের খ্যাতনামা ব্যক্তিরা এবং ইউরোপীয় শিল্পী ও রাজনীতিবিদরা তাঁর মুক্তি দাবি করেছিল। ২০১০ সালে পোলানস্কিকে ২ মাস জেলে আটকে রাখলেও তাঁকে আমেরিকার কাছে হস্তান্তর করার দাবি নাকচ করে দেয় সুইজারল্যান্ডের আদালত এবং তাঁকে জেল থেকে মুক্তি দেয়া হয়। ২০১৫ সালে পোল্যান্ডের আদালত পোলানস্কিকে আমেরিকার হাতে তুলে দেওয়াটা বেআইনী হবে বলে ঘোষণা দেয়। যেহেতু পোলানস্কি নাবালিকার সাথে যৌন সম্পর্কে লিপ্ত হবার পরেও পার পেয়ে গিয়েছিলেন, তাই এই প্রচ্ছদে পোপকে দেখা যাচ্ছে এক শিশুকামী বিশপকে উপদেশ দিচ্ছেন পোলানস্কির মতো সিনেমা বানাতে।
চার্লি হেবডো এর এই প্রচ্ছদে বিন লাদেনের ফ্রান্সকে হুমকি দেয়া নিয়ে কার্টুন ছাপা হয়েছে। এই ইস্যু ছাপার পাবলিশ হবার এক সপ্তাহ আগে আল-জাজিরা নেটওয়ার্ক দ্বারা সম্প্রচারিত একটি টেপে বিন লাদেন ফ্রান্সের সেনাবাহিনীকে আফগানিস্তান থেকে সরিয়ে নেওয়ার এবং ফ্রান্সে বসবাসরত মুসলমানদের উপর অত্যাচার না করার জন্য সতর্ক করেছিল। তবে ১১ ই সেপ্টেম্বর ২০০১ সালের পর থেকে এই ইস্যু ছাপা পর্যন্ত পশ্চিমে বিশ্বে মাত্র দুটি সফল সন্ত্রাসী আক্রমণ হয়েছিল। স্পেনের মাদ্রিদে যাত্রীবাহী ট্রেনগুলিতে ২০০৪ সালের মার্চ মাসে বোমা হামলায় ১৯১ জন নিহত হয়েছিল আর ইংল্যান্ডের লন্ডনে গণ-পরিবহনে ২০০৫ সালের জুলাই মাসের বোমা হামলায় ৫২ জন নিহত হয়েছিল। ফ্রান্সের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আল-জাজিরার অডিও রেকর্ডকে বিশ্বাসযোগ্য বলে দাবি করেন।
এই প্রচ্ছদে পোপ ষোড়শ বেনেডিক্টকে উৎসর্গ করতে দেখা যাচ্ছে। কনসেকরেশনের সময় সাধারণত পোপের হাতে পাত্র, বাইবেল বা অন্য কোনও ধর্মীয় পবিত্র স্মরণচিহ্ন দেখা যায়। এখানে সেসবের পরিবর্তে পোপের হাতে কনডোম দেখা যাচ্ছে। আমার শরীর আমার অধিকার কথাটাও বিদ্রূপ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে কারণ ক্যাথোলিক ধর্মযাজকদের অকৃতদার জীবন যাপন করতে হয়।
এই প্রচ্ছদে যিশুর জন্ম দৃশ্যকে ব্যঙ্গ করা হয়েছে। মেরি আর জোসেফের মাঝখানে যিশুর বদলে শিশু মোহাম্মদকে দেখা যাচ্ছে। এখানে মেরি আর জোসেফের মুখে খুশির বদলে শঙ্কা দেখাচ্ছে আর পেছনের ষাঁড় আর গাধাটাও রাগে ফুঁসছে। ষাঁড়কে সাধারণত ইজরায়েল ভাবা হয় আর গাধাকে অন্যান্য অ-ইহুদী জাতির বিশেষ করে খ্রিস্টানদের প্রতীক হিসেবে গণ্য করা হয়। যিশুর জন্ম দৃশ্যে গাধা এবং ষাঁড়টির একসাথে থাকাটা একাধারে আধ্যাত্মিক এবং শারীরিক, পরিষ্কার ও অপরিষ্কার, অভ্যন্তরীণ এবং বাহির, এবং সর্বোপরি স্বয়ম্ভূ ও সৃষ্ট সকল বিপরীত মেরুর প্রতীকী মিলন যীশু খ্রিস্টের মধ্য দিয়ে প্রকাশ করা হয়। যেহেতু ইসলাম হলো ইহুদী ও খ্রিস্টীয় উভয়েরই ধারণার সংমিশ্রণ,তাই এই দুই ধর্মের লোকের ইসলামোফোবিয়া থাকার কোনো কারণ থাকা উচিৎ না। এই প্রচ্ছদে মূলত খ্রিস্টান আর ইহুদীদের ব্যঙ্গ করা হয়েছে কিন্তু মোহাম্মদের প্রতিকৃতি থাকায় মুসলমানরাও ক্রুদ্ধ হবে।
এই প্রচ্ছদের টাইটেলে লেখা হয়েছিল – “অ্যাভিগন এর প্রস্রাবের মধ্যে খ্রিস্টের কেলেঙ্কারির পরে।” এখানে অ্যাভিগন বলতে অ্যাভিগন – এর মিউজিয়ামকে বুঝানো হয়েছিল কিন্তু অনেক পাঠকই পড়ামাত্র মিউজিয়ামের কোন শিল্পকর্মের কথা বলা হয়েছে সেটা বুঝতে পারবেন না। এটা আক্ষরিক অনুবাদ করার বদলে ভাবগতভাবে ফুটিয়ে তুলা হয়েছে।
Immersion (Piss Christ) আমেরিকান শিল্পী এবং ফটোগ্রাফার আন্দ্রেস সেরানোর ১৯৮৭ সালের একটি ছবি। এখানে একটি ছোট কাঁচের ট্যাঙ্কে শিল্পীর প্রস্রাবের মধ্যে নিমজ্জিত রয়েছে একটি ছোট প্লাস্টিকের ক্রুশবিদ্ধ যিশু। এই শিল্পকর্মটি আমেরিকার ন্যাশনাল এন্ডোমেন্ট ফর আর্টস এর পুরষ্কার জিতে নেয় যেটা নিয়ে পরে সমালোচনার ঝড় উঠে।
খ্রিস্টকে নিয়ে সবচেয়ে বিতর্কিত শিল্পকর্মের মধ্যে এটি অন্যতম এবং এটাকে নিয়ে বিতর্কের মূল কারণ ছিল এটাকে ব্লাসফেমাস মনে করা হয়েছিল। এই শিল্পকর্মের জন্য সেরানোকে মৃত্যুর হুমকি পর্যন্ত দেয়া হয়েছিল। এই প্রসঙ্গে সেরানোর মন্তব্য ছিল, “আমার ধারণা ছিল না যে হিসুর মধ্যে যিশু এত লোকের দৃষ্টি আকর্ষণ করবে যেহেতু আমি এটা দিয়ে ব্লাসফেমি বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত কোনোটাই করতে চাইনি। আমি সারাজীবন একজন ক্যাথলিক এবং খ্রিস্টের অনুসারী।”
এই শিল্পকর্ম সম্পর্কে সেরানো আরও বলেছিলেন যে এটি খ্রিস্টের মৃত্যুযাত্রার প্রতীকীকরণ যখন ক্রুশবিদ্ধ হয়ে তাঁর শরীর থেকে কেবল রক্তই বের হয়নি উপরন্তু সাথে মল-মূত্রও ছিল। এই শিল্পকর্মটি ধর্মকে নিন্দা করার উদ্দেশ্যে করা হয়নি বরং সমসাময়িক সংস্কৃতিতে খ্রিস্টান আইকনগুলি বাণিজ্যিকীকরণের মাধ্যমে কীভাবে সস্তা বস্তুতে রূপান্তরিত হয়েছে সেটা ফুটিয়ে তুলা হয়েছে।
২০১১ সালের ১লা এপ্রিল ফ্রান্সের অ্যাভিগন-এর সমসাময়িক শিল্প যাদুঘরে প্রদর্শনীর সময় খ্রিস্টান বিক্ষোভকারীরা পিস খ্রিস্টের একটি মুদ্রণ “মেরামতির বাইরে” ভাঙচুর করেছিল। সে ঘটনাটার উপর ভিত্তি করে এই প্রচ্ছদের কার্টুনটি আঁকা হয়েছে। ফরাসি ভাষায় সব ধর্মের সাথে কুকুরছানা আসে লেখা হয়েছিল নিচে টিস্যু পেপারের পাশে যেটা দিয়ে বুঝানো হয়েছিল যে ধর্মের অনুচ্ছেদ ব্যবহার করে কুকুরছানার মল পরিষ্কার করা হয়।
ফরাসী বিদ্রূপাত্মক ম্যাগাজিন চার্লি হেবরডো উপর ২০১৫ সালের হামলার পর বার্তাসংস্থা এপি তার চিত্র গ্রন্থাগার থেকে সেরানোর “পিস ক্রাইস্ট” এর চিত্রটি সরিয়ে দিয়েছে।
প্রতিবেশী তিউনিসিয়া ও মিশর এর আরব বসন্তের পর লিবিয়াতেও ইসলামপন্থীরা আরও একটি অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে দেশের সবচেয়ে শক্তিশালী দল হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছিল। পশ্চিমা শক্তিগুলি যারা মুয়াম্মর গাদ্দাফিকে পরাস্ত করতে সাহায্য করেছিল তাদের ধারণা ছিল যে দেশের নতুন নেতারা মডারেট মুসলমান হবে। কিন্তু ন্যাশনাল ট্রানজিশনাল কাউন্সিলের নেতা মোস্তফা আবদুল-জলিল ক্ষমতায় যাবার পরে ঘোষণা দেয় যে, ইসলামিক শরিয়াহ আইন মেনে রাষ্ট্রের সংবিধান চলবে এবং বহুবিবাহকে বৈধতা দেওয়া হবে। এই প্রচ্ছদটি এই ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে ছাপা হয় যেখানে একজন লোককে (খুব সম্ভবত লিবিয়ায় তৎকালীন আমেরিকার রাষ্ট্রদূত জিন ক্রেটজ) লিবিয়ায় শরীয়া আইন নিয়ে খুব খোশ মেজাজে দেখা যাচ্ছে।
মুহাম্মদের ব্যঙ্গচিত্র থাকা এই সংখ্যার সামনের কভারটি আলোড়ন তুলেছিল। প্রকাশের কিছুদিন আগে তিউনিশিয়ার ইসলামপন্থী দল এন্নাধার নির্বাচনী জয় সেলিব্রেট করার জন্য এখানে পত্রিকার নাম পাল্টে শরীয়া হেবডো রাখা হয়েছে। ইস্যুতে ঘোষণা করা হয়েছে, “তিউনিসিয়ায় ইসলামী এন্নাধা পার্টির বিজয় যথাযথভাবে উদযাপন করার জন্য … চার্লি হেবডো মুহাম্মদকে তার পরবর্তী সংখ্যার বিশেষ প্রধান সম্পাদক হতে বলেছেন, ম্যাগাজিন এক বিবৃতিতে বলেছে … ইসলামের নবীকে জিজ্ঞাসা করার সাথে সাথে তিনি রাজি হন এবং আমরা এর জন্য তাকে ধন্যবাদ জানাই।“ প্রকাশনার দিন ইস্যুটির ১১০,০০০ কপি বিক্রি হয়েছিল এবং এর পত্রিকার পাবলিশার পুনঃপ্রকাশের ঘোষণা দিয়েছিল।
ইসলামের কিছু ব্যাখ্যা অনুযায়ী মুহাম্মদের চিত্রণ নিষিদ্ধ। এই প্রকাশের পরে, ম্যাগাজিনের অফিসে আগুন নিক্ষেপ করা হয় এবং এর ওয়েবসাইট হ্যাক হয়ে যায়। আক্রমণকারীরা হ্যাকড সাইটে একটি নোটিশ পোস্ট করেছিল যাতে লেখা ছিল, “আপনারা বাকস্বাধীনতার অজুহাত দেখিয়ে ইসলামের সর্বশক্তিমান নবীকে ঘৃণাজনক ও অবজ্ঞাপূর্ণ কার্টুন দিয়ে গালি দিচ্ছেন। আপনাদের উপর আল্লাহর গজব পরুক!” পরবর্তীতে ২০১৫ সালে চার্লি হেবডো এর অফিসে জঙ্গি আক্রমণের অন্যতম কারণ এই ইস্যুর প্রচ্ছদকে ধারণা করা হয়।
নবী মোহাম্মদের কার্টুন ছাপানোর পর ব্যঙ্গাত্মক ম্যাগাজিন চার্লি হেবডোর প্যারিস অফিসের আগুন-বোমা হামলার শিকার হওয়ার মাত্র ছয় দিন পরেই এই প্রচ্ছদটি ছাপা হয় যেখানে দেখা যাচ্ছে একজন দাড়িওয়ালা টুপি পরা মুসলমান একজন কার্টুনিস্টকে চুমু খাচ্ছে। উপরের ক্যাপশনে লিখা হয়েছে ‘প্রেম: ঘৃণার চেয়েও শক্তিশালী’। দেখতে নিরীহ হলেও এই প্রচ্ছদের মধ্য দিয়ে চার্লি হেবডোকে আগের চেয়েও সাহসী একটা বিষয় সবার সামনে তুলে ধরেছে সেটা হচ্ছে সমকামীতা যা ইসলামে নিষিদ্ধ। চার্লি হেবডোর সম্পাদক, স্টেফান চার্বননিয়ার অগ্নিসংযোগের পরে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “আমরা ভেবেছিলাম যে মানুষের চিন্তাভাবনার উন্নতি হয়েছে এবং সম্ভবত আমাদের বিদ্রূপমূলক কাজের প্রতি, আমাদের বিদ্রূপ করার অধিকারের প্রতি লোকের আরও শ্রদ্ধা থাকবে। প্রাণ খুলে হাসার স্বাধীনতা বাকস্বাধীনতার মতোই গুরুত্বপূর্ণ”।
এই সংখ্যার প্রচ্ছদটি একটা বিখ্যাত ফরাসি চলচ্চিত্রের নামের সাথে মিলিকে রাখা হয়েছে যেটার নাম ‘Le Dîner de Cons’। যিশুকে হাস্যোজল মুখে বলতে দেখা যাচ্ছে, ” À Table!” যার আক্ষরিক অর্থ টেবিলে হলেও এখানে বুঝানো হয়েছে চলো খাই বা মজা নিই। পেছনের ক্যারিকেচারে যে লোকদের দেখা যাচ্ছে তারা হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের ফরাসি খ্রিস্টানবাদী। এই ইস্যুতে ফরাসি ক্যাথলিকদের ব্যঙ্গ করা হয়েছে যারা বিভিন্ন সময়ে চার্লি হেবডোর বিরুদ্ধে আদালতের শরণাপন্ন হয়েছে। এই ইস্যু সম্পর্কে সম্পাদক জেরার্ড বিয়ার্ড বলেন, “যখন ধর্ম ব্যক্তিগত আলোচনার বাইরে যায়, তখন এটাকে রাজনৈতিক মতামতের মতোই সমালোচনা করা যায়।”
মূল সিনেমাটিতে প্যারিসের প্রকাশক পিয়েরে ব্রোচান্ট একটি সাপ্তাহিক “আহাম্মকদের ডিনার” এ যোগ দেন, যেখানে প্যারিসের বিশিষ্ট ব্যবসায়ীরা সাথে একজন করে বোকা লোক অতিথি হিসেবে নিয়ে আসে এবং অন্যরা সেই বোকা লোককে উপহাস করতে পারে। রাতের খাবার শেষে সন্ধ্যার “আহাম্মকদের চ্যাম্পিয়ন” নির্বাচন করা হয়।
কভারে দেখা যাচ্ছে যে এখন রাব্বি হুইলচেয়ারে একজন ইমামকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে আর উপরের টাইটেলে লেখা হয়েছে অচ্ছুত ২ আর নিচে লেখা “আমাদের ব্যঙ্গ করা যাবে না।” এই সংখ্যার শেষ পৃষ্ঠায় আরও রয়েছে মোহাম্মদের দুটো উলঙ্গ ক্যারিকেচার। ফ্রান্সে আমেরিকান দূতাবাসের কাছে সালাফিদের বিক্ষোভের কয়েকদিন পরই এই প্রচ্ছদ প্রকাশ করা হয়। মুসলিম এবং ইহুদি উভয় সম্প্রদায়ের ধর্মীয় নেতারা এই প্রচ্ছদের নিন্দা জানান। এই বিষয়ে চার্লি হেবডো বরাবরের মতো মত প্রকাশের স্বাধীনতার কথা তুলে ধরেছে। “যদি আমরা মুহাম্মদকে আঁকার অধিকার রাখি বা না করি, যদি তা বিপজ্জনক বলে না করা হয় এই প্রশ্নটি শুরু করি, পরবর্তী প্রশ্নটি হতে চলেছে” আমরা কি সংবাদপত্রে মুসলমানদের প্রতিনিধিত্ব করতে পারি? যদি মুসলমানদের ছবি না দেয়া যায় বা তাদের সম্পর্কে আলোচনা করা যায় তাহলে কি আমরা সংবাদপত্রে মানুষের প্রতিনিধিত্ব করতে পারি?”, প্রকাশনার পরিচালক চার্ব ব্যাখ্যা করে বলেন। তিনি আরও বলেন যে, “এভাবে চলতে থাকলে শেষ পর্যন্ত, আমরা আর কোনও কিছুর প্রতিনিধিত্ব করতে পারব না; বিশ্ব এবং ফ্রান্সে মুষ্টিমেয় উগ্রবাদীরা জয়ী হবে।”
এই প্রচ্ছদটিতে সমকামী দম্পতিদের দত্তক নেওয়ার বিষয়ে উত্তপ্ত পাবলিক বিতর্ককে ফুটিয়ে তুলা হয়েছে। ক্যাথলিকরা যারা এর বিরুদ্ধে প্রচার চালাচ্ছিল তাদের স্লোগান ছিল, “বাবা একজন আর মা একজন।” ছোটদের জন্য লিখা একটি সমকামী গল্পের নামকে এখানে টাইটেলে ব্যবহার করা হয়েছে যার কাহিনী অনেকটা ইংরেজি এক সমকামী গল্পের মতোই যেখানে জেনিফারের দুজন সমকামী বাবা তার দেখাশুনা করে। খ্রিস্টান ধর্মে ঈশ্বরের তিন রূপ যেখানে একই সাথে ঈশ্বর জগতের পিতা, যিশুখ্রিস্ট ও পবিত্র আত্মার মধ্য দিয়ে প্রকাশ পায়। সেটাকে এখানে অপরের সাথে সঙ্গমে লিপ্ত অবস্থায় চিত্রাঙ্কন করে ব্যঙ্গ করা হয়েছে।
পোপ ষোড়শ বেনেডিক্ট সবাইকে অবাক করে দিয়ে ফেব্রুয়ারির ১১ তারিখ পদত্যাগের ঘোষণা দেন। সরকারী পদত্যাগের বিবৃতিটি তাঁর ক্ষয়িষ্ণু শারীরিক ও মানসিক শক্তিকে পদত্যাগের কারণ হিসেবে ব্যাখ্যা দেন। এর আগে শুধুমাত্র পঞ্চম সেলেস্টিন ১২৯৪ সালে অভিষেকের অল্প কিছু দিনের মধ্যে অফিস ত্যাগ করেছিলেন। পোপ ষোড়শ বেনেডিক্ট হলেন পদত্যাগকারী দ্বিতীয় পোপ। চার্লি হেবডোর কার্টুনে ইঙ্গিত দেত্তয়া হয় যে পোপ ক্লোসেটে থাকা একজন সমকামী। পোপের পদত্যাগের ঘোষণার পরের দিন ফরাসি আইন প্রণেতারা ৩২৯ বনাম ২২৯ ভোটে সমকামী দম্পতিদের বাচ্চা দত্তক নেওয়ার বৈধতা দেয় যেটা নিয়ে গত সপ্তাহের প্রচ্ছদ ছাপা হয়েছিল।
এই ইস্যুতে চার্লি হেবডো ভ্যাটিকানের “গে লবি” কে কটাক্ষ করছে। ইতালীয় সংবাদমাধ্যমে এই ইস্যু প্রকাশের আগের সপ্তাহে বেশ কয়েকটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল যা ভ্যাটিকানের মধ্যে একটি “সমকামী লবি” উপস্থিতির সম্ভাবনাকে উস্কে দিয়েছিল। “পার্থিব প্রকৃতি”র সাথে লিঙ্ক থাকার জন্য সাধারণ লোকদের দ্বারা ভ্যাটিকানের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা ব্ল্যাকমেইলের শিকার হয়েছে যা পোপের পদত্যাগের সাথে এই ধরনের কথারও জন্ম দেয় এই নিবন্ধগুলি। প্রচ্ছদটিতে ফরাসি ভাষায় প্রশ্ন করা হয়েছে ধোঁয়া কি বের হচ্ছে? – কালো ধোঁয়া মানে নতুন পোপকে নির্বাচন করা বাকি আর সাদা ধোঁয়া মানে নতুন পোপ নির্বাচিত হয়ে গেছেন।।
ভ্যাটিকানের পোপ নির্বাচনের কারচুপির কথা বলা হয়েছে এই ইস্যুতে। লস অ্যাঞ্জেলেস টাইমস পূর্বাভাস দিয়েছিল যে লাতিন আমেরিকার কোনও পোপ নির্বাচিত হওয়া অসম্ভব। ১১৭ জন ভোটারের মধ্যে ১১৫ জন উপস্থিত ছিল। এদের মধ্যে ইতালি থেকে ২৮, ইউরোপের বাকি দেশগুলো মিলিয়ে ৩২, উত্তর আমেরিকা থেকে ২০, দক্ষিণ আমেরিকা থেকে ১৩, এশিয়া এবং অস্ট্রেলিয়া মহাদেশ মিলিয়ে ১১, আর আফ্রিকা মহাদেশ থেকে ছিল ১১ জন কার্ডিনাল ভোটার। সবাইকে অবাক করে দিয়ে আর্জেন্টিনীয় মারিও বেরগোলিও পোপ নির্বাচিত হন এবং নাম নেন পোপ ফ্রান্সিস।
অনেক খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী অনেকদিন ধরে বিভিন্ন রক্ষণশীল পোপের পরে একজন উদারপন্থী পোপ পেয়ে খুশি হয়েছিল। এই প্রচ্ছদে মডেল এবং রিয়ালিটি টিভি ব্যক্তিত্ব নাবিলা বেনাতিয়াকে অনুকরণ করতে দেখা যাচ্ছে পোপ ফ্রান্সিসকে। রিয়ালিটি টিভি শো এর এক এপিসোডে শ্যাম্পু কেনা নিয়ে এক প্রতিদ্বন্দ্বীর সাথে তর্কের পর সে যে কথা বলেছিল সেটা ভাইরাল হয়ে যায়। নাবিলার মতো করে পোপ ফ্রান্সিস ফোনে অন্যপ্রান্তে গডকে জিজ্ঞেস করছে, “আপনি গড হলে আপনার কাছে শ্যাম্পু কেন থাকবে না?”
২০১৩ সালে মিশরের সেনাবাহিনী তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ও মুসলিম ব্রাদারহুড নেতা মোহাম্মদ মুরসিকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য একটি জোটের নেতৃত্ব দেয় এবং ২০১২ সালের সংবিধান স্থগিত করে। পরবর্তীতে ২০১৩ সালের জুলাই মাসে মুসলিম ব্রাদারহুড সমর্থকরা কয়েক ডজন গির্জা পোড়ায়। মডারেট মুসলমানরা দাবি করে যে ইসলাম শান্তির ধর্ম এবং অস্বীকার করে যে কুরানে শান্তির পাশাপাশি বিধর্মীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধেরও ডাক দেয়া হয়েছে। এই কভারে দেখা যাচ্ছে যে একজন ইহুদী কুরআন কে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করার চেষ্টা করছে কিন্তু বুলেট কুরআন ভেদ করে তাঁর শরীরে আঘাত হানছে। ক্যাপশনে লিখা হয়েছে যে কুরআন কোনও কাজের না, এটা গুলি থামায় না – যার মানে হচ্ছে কুরানে শান্তির বানীগুলো জঙ্গিদের হাত থেকে বিধর্মীদের রক্ষা করার জন্য যথেষ্ট না।
এই প্রচ্ছদে তিন জন নবীকে পাশাপাশি বসে থাকতে দেখা যাচ্ছে আর তিন জনই স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীর অভিভাবক আর শিক্ষকদের মিটিং নিয়ে বিরক্ত। টাইটেলে লেখা ছিল ঈশ্বর, স্কুলের বাইরে – সেটাকে নবী অনুবাদ করা হয়েছে যাতে পাঠকরা বুঝতে পারে এখানে নবীরা বসে আছে। যেহেতু তিন নবীর সবার পিতৃপরিচয় সন্দিহান তাই তারা কেউ এই মিটিং নিয়ে খুব একটা খুশি না। আর ঈশ্বরও উপস্থিত নেই তাদের জন্ম পরিচয় শিক্ষকদের কাছে তুলে ধরার জন্য।
আলজেরিয়ার আইসিস সমর্থকদের হাতে এক ফরাসি নাগরিকের জিম্মি ও পরে হত্যার প্রেক্ষাপটে এই ইস্যুটি ছাপা হয়েছিল। আইসিসের উত্থান এবং তাদের দ্বারা বিভিন্ন বিদেশী আর স্থানীয়দের প্রকাশ্যে সর্বসাধারণের সামনে হত্যা করে সেসব ভিডিও বিভিন্ন মাধ্যমে ছড়িয়ে দেবার যে প্রবণতা ছিল সেটা দেখানো হয়েছে এই কভারে। বিশ্বের বেশিরভাগ মানুষ মনে করে যে, আইসিসের জঙ্গি ধারণার সাথে ইসলামের সাথে কোনও সম্পর্ক নেই। সেটাই ফুটিয়ে তুলা হয়েছে চার্লি হেবডোর এই প্রচ্ছদে ভবিষ্যদ্বাণী করার মধ্য দিয়ে যে, মুহাম্মদ ফিরে আসলে কী ঘটতে পারে এবং দেখা যাচ্ছে যে আইসিসের হাত থেকে মুহাম্মদেরও নিস্তার নেই।
এই কভারটিতে দেখা যাচ্ছে যে একদল মাথায় স্কার্ফ পরা, গর্ভবতী নাইজেরিয়ান মহিলারা “আমাদের ওয়েলফেরারে হাত দিবি না!” বলে চিৎকার করছে আর শিরোনামে লেখা আছে, “বোকো হারামের যৌনদাসী রাগান্বিত।” এটা দেখে অনেকের মনে হবে যে ম্যাগাজিনটি নাইজেরিয়ার মানব পাচারের শিকার মহিলাদের উপহাস করছে; তাই অ-ফরাসি পাঠকদের মধ্যে ক্ষোভ হতেই পারে। কিন্তু ম্যাগাজিনটি এর ঠিক বিপরীতে বলছে। ফ্রান্সের আরেক ব্যঙ্গাত্মক পত্রিকার লিবি নেলসন ব্যাখ্যা দেন, “এটি এতটা সহজ নয় যেটা মনে হয়; রসিকতা সাধারণত দুটি স্তরে থাকে।” এই প্রচ্ছদে, দ্বিতীয় স্তরটি ফরাসি ঘরোয়া রাজনীতির সাথে সম্পর্কিত: চার্লি হেবডো একটি বামপন্থী ম্যাগাজিন যা কল্যাণমূলক কর্মসূচিকে সমর্থন করে। অন্যদিকে ফরাসি ডানপন্থীরা অভিবাসীদের ওয়েলফেয়ার দেবার বিরোধিতা করে এবং দাবি করে যে অভিবাসীরা ফরাসি কল্যাণমূলক কর্মসূচির সুবিধা নিয়ে সিস্টেমকে প্রতারণা করে। এই প্রচ্ছদটি আসলে যা বলেছে তা হলো অভিবাসীদের কল্যাণ আর অধিকারের ব্যাপারে ফরাসী ডানপন্থী রাজনীতিবিদরা এতটাই নিদারুণ, যে তারা বিশ্বাস করাতে চায় যে বোকো হারামের যৌন দাসত্ব থেকে পালিয়ে নাইজেরিয়ান অভিবাসীরা এখানে ওয়েলফেয়ার চুরি করতে এসেছে। তাই, এখানে চার্লি হেবডো আসলে অভিবাসীদের পক্ষে কথা বলছে। চার্লি হেবডোর মতো দ্বি-স্তরের ব্যঙ্গ সম্পর্কে এটিই মুশকিল: আপনি যদি উভয় স্তর বুঝেন তবেই কেবল রসিকতা কার্যকর হয় আর যার জন্য প্রায়শই ফরাসি রাজনীতি বা সংস্কৃতি সম্পর্কিত জ্ঞানের প্রয়োজন হয়। আপনি যদি সেই স্তরটি না দেখেন তবে কভারগুলি খুব বর্ণবাদী বলে মনে হতে পারে।
এই স্পেশাল ইস্যুর শিরোনামে লেখা হয়েছে “চার্লি হেবডো” সেন্সর করতে হবে! ফ্রান্সের আইন অনুযায়ী সব ধর্মকেই সমালোচনা এবং ব্যঙ্গ করা যায়। যদিও ফ্রান্সে এখন আর ব্লাসফেমি আইন নেই, যেকোনো ধর্মের সমালোচনার বিরুদ্ধে ধর্মীয় কর্তৃপক্ষগুলোকে সর্বসম্মতভাবে একজোট হয়ে দাঁড়াতে দেখা যায়। ২০০৭ সালের ফেব্রুয়ারীর ৭ তারিখ চার্লি হেবডোর বিরুদ্ধে ইউনিয়ন অব ইসলামিক অর্গানাইজেশনস অফ ফ্রান্স (ইউওআইএফ) এবং প্যারিসের গ্র্যান্ড মসজিদ (জিএমপি) এর আনা অভিযোগের বিচার শুরু হয়। এই অভিযোগের প্রতিক্রিয়া হিসাবে এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য চার্লি হেবডো প্রচ্ছদে তিনটি একেশ্বরবাদী ধর্মের প্রতিনিধিত্ব করে এমন লোকদের ছবি এঁকে এই বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করছে। চার্লি হেবডোর ভাষ্যমতে ক্যারিকেচারের সাহিত্যিক ধারাটি ইচ্ছাকৃতভাবে উস্কানিমূলক হলেও ভাবনা ও মতামতের মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং যোগাযোগের ক্ষেত্রে মৌলিক অধিকারের অন্তর্ভুক্ত।
এই ইস্যুতে ইসলামের সংস্কার নিয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। কিছু লিবারেল মুসলমান অতীতে প্রস্তাব দিয়েছে যে ইসলাম সংস্কার করে ফরাসি মুসলমানদের জন্য “ফ্রান্সের ইসলাম” করা জরুরী। আবার এর বিপরীতেও লোক আছে যারা ধারণাটি অযৌক্তিক বলে মনে করে কারণ তাদের মতে ইসলামের একটি ধারাই সত্য এবং ইসলাম সংস্কার করা যায় না। যেসব মুসলমান সংস্কার চায় তারা অবিশ্বাসীদের (যারা ইসলাম ধর্ম মেনে চলে না) প্রতি ঘৃণামূলক বক্তব্য প্রচারকারী সমস্ত মসজিদ বন্ধ করে দেওয়ার পক্ষে এবং সৌদি আরব এবং কাতারের মতো দেশগুলি দ্বারা মসজিদের অর্থায়নকে আটকানোর পক্ষে। সংস্কারপন্থীরা মনে করে ইসলামের বর্তমান আদর্শ ফ্রান্স প্রজাতন্ত্রের আদর্শের সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ। পিছিয়ে পড়া মুসলমানদের শিক্ষা আর বিনিয়োগের মাধ্যমে ফ্রান্সের মূল স্রোতে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে বলে তারা মনে করে। একই সাথে তারা চায় যে ফরাসি ইন্টেলিজেন্স সংস্থাগুলোকে আরও শক্তিশালী করে গড়ে তুলতে যাতে তারা সন্ত্রাসীদের এবং তাদের সহযোগীদের জঙ্গি কার্যকলাপ করার আগে থামাতে সমর্থ হয়।
চার্লি হেবডোর জার্মান প্রচ্ছদে কুরআনের চার জন পুরুষ সাক্ষীর ধারনাকে ব্যঙ্গ করে লিখা হয়েছে যে, একটি সফট ইসলামিক আইনের জন্য ইমামপিছু চারটির বেশি ক্যামেরা রাখা যাবে না। চার্লি হেবডো প্যারিস সদর দফতরে ইসলামিক সন্ত্রাসী হামলার প্রায় দুই বছর পরে জার্মান সংস্করণ চালু করে। শুরুর দিকে মূলত ফরাসী ভাষা থেকে অনুবাদ করা নিবন্ধ এবং কার্টুন আর পরে জার্মান কার্টুনিস্টদের সহযোগিতায় তাদের নিজেদের ভাষায় কনটেন্ট তৈরি করার প্ল্যান ছিল জার্মান অফিসের। কিন্তু বিক্রি কমে যাওয়ায় উদ্বোধনের এক বছর পরেই বন্ধ করে দেয়া হয় চার্লি হেবডোর জার্মান সংস্করণ। জার্মানিতে চার্লি হেবডো আসার আগেই দুটি শীর্ষস্থানীয় ব্যঙ্গাত্মক মাসিক পত্রিকা টাইটানিক এবং ইউলানস্পিগেল ছিল। জার্মান সংস্করণটি ফ্রান্সে থাকা বার্লিনের একজন ৩৩ বছর বয়সী দ্বারা সম্পাদিত হয়েছিল যিনি তার সহকর্মীদের পরামর্শে ‘মিনকা স্নাইডার’ ‘ছদ্মনাম ব্যবহার করতেন। ২০১৫ সালের ৭ জানুয়ারী সন্ত্রাসী হামলার কারণে চার্লি হেবডো ফ্রান্সের একটি গোপন জায়গা থেকে প্রকাশ করা হয়।
স্পেনের বার্সেলোনায় জনপ্রিয় পর্যটন এলাকা লা রাম্বলা-তে জনতার ভিড়ের মধ্যে একটি ভ্যান চালিয়ে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনায় ১৩ জন নিহত এবং কমপক্ষে ১৩০ জন আহত হন। এই হামলার পরিপ্রেক্ষিতে, চার্লি হেবডোর শিরোনাম ছিল: ইসলাম, শান্তির ধর্ম … চিরন্তন! তখন পত্রিকার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয় যে সন্ত্রাসবাদ ও কোরআনের মধ্যে যোগসাজশ খুঁজার চেষ্টা করছে তারা। এর প্রতিবাদে পরের সপ্তাহে চার্লি হেবডো কুরআনের থেকে অনুচ্ছেদ প্রকাশ করে যেখানে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে প্রত্যেক ভাল মুসলমানকে অবশ্যই ইহুদিদের হত্যা করতে হবে। চার্লি হেবডোর বক্তব্য অনুযায়ী বাস্তবতা হচ্ছে সমস্ত ধর্ম একে অপরকে ঘৃণা করে। “ধর্মীয় সত্য” এর নামে, আমাদের সমস্ত ধর্মীয় বক্তৃতা বিনীতভাবে সম্মান করতে, তাদের যুক্তির গোলকধাঁধাতে প্রবেশ করতে এবং তাদের অসংগতির সমাধান খুঁজতে বলা হয়। ধর্মের ভুলগুলোকে গোঁজামিল দিয়ে মেলানো চার্লি হেবডোর লেখকদের কাজ না, এবং এই সমস্যাগুলি সমাধান করার আরও একটি উপায় রয়েছে। মুসলিম, খ্রিস্টান, ইহুদি বা বৌদ্ধ পরিবারে বেড়ে ওঠা বাধ্যতামূলক হওয়া উচিৎ নয়। গণতন্ত্রে যে কেউ নিজের পরিবারের ধর্ম ত্যাগ করতে পারে। এই সমস্ত আদিম, পশ্চাদপসরণ এবং কখনও কখনও বর্বর পাঠ্যগুলির উপদেশ মেনে চলতে কেউ বাধ্য নয়। মানুষ ধর্ম ব্যতীত বাঁচতে পারে এবং আর এই ধর্মীয় পুস্তকগুলো পড়ে থাকুক বুকশেলফে ধূলা আর মাকড়শার জালের নিচে কারণ এই পাঠ্যগুলিতে বাস্তবে পবিত্র কিছুই নেই। এই বইগুলোকে প্রতিরোধ করার সর্বোত্তম উপায় হলো এগুলোকে ভুলে যাওয়া, এগুলোকে ফেলে দেওয়া এবং এগুলো যেই শূন্যস্থান থেকে এসেছে সেখানে ফিরিয়ে দেয়া। আর তার জন্য আমাদের দরকার নির্ভীক গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা।
ইসলামোজিস্ট তারিক রামাদানের উপর একটি ব্যঙ্গাত্মক কার্টুন প্রকাশের পরে সোশ্যাল নেটওয়ার্কগুলিতে চার্লি হেবডোকে মৃত্যুর হুমকি দেয়া হয়। সুইস ধর্মতত্ত্ববিদের বিরুদ্ধে দুটি ধর্ষণের অভিযোগকে দেখানো হয়েছে লিঙ্গ বিকৃত করে প্যান্টের মধ্যে খাড়া অবস্থায় এবং পক্ষসমর্থনে তিনি বলছেন, “আমি ইসলামের ষষ্ঠ স্তম্ভ”। প্রকাশনার পরিচালক রিস-কে এই ডিজাইন সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, “তারিক রামাদান নিজেকে একজন জ্ঞানী এবং ইসলামবিজ্ঞানী হিসেবে নিজেকে সবার সামনে তুলে ধরেন। আর আমরা জানি যে ইসলামের ষষ্ঠ স্তম্ভ হচ্ছে জিহাদ। জিহাদকে যখন চিত্রাঙ্কন করা হয় তখন সেটাকে দেখতে এমনই দেখায়।” পরবর্তীতে আরও কয়েকজন তারিক রামাদানের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ আনে যাদের মধ্যে অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েরাও ছিল। তারিক রামাদান যৌন সম্পর্কের কথা স্বীকার করলেও বলেন যে যারা তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছে তারা ‘বর্নবাদী’ এবং তাদের সাথে তারিক রামাদানের সম্মতিসূচক সম্পর্ক ছিল। নিজেকে নির্দোষ দাবি করেন তারিক রামাদান।
চার্লি হেবডোতে যখন এ ইস্যু ছাপা হয়েছে তখন সিরিয়ায় আটক ফরাসিদের ফিরে আসার প্রশ্নটি নিয়ে সমাজে বিতর্ক চলছিল। জিহাদের নামে সিরিয়ায় যোগ দেওয়া এই ফরাসি লোকদের ব্যাপারে ফরাসী সরকার কী করবে? সিরিয়ায় ফরাসিদের সংখ্যার বিষয়ে কোনও সঠিক তথ্য পাওয়া যায়নি। আরব-কুর্দি জোট সিরিয়ান ডেমোক্র্যাটিক ফোর্সেস (এসডিএফ) এর হাতে আটক ১৩০ জন ফরাসি লোকের মধ্যে ছিল পঞ্চাশ জন পুরুষ ও মহিলা এবং কয়েক ডজন শিশু। ফ্রান্স প্রাপ্তবয়স্কদের দেশে ফিরে আসার অনুমতি দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে এবং বলেছে যে যারা ফিরে আসবে তাদের অবশ্যই স্থানীয় বিচারের মুখোমুখি হতে হবে। এখন অবধি প্যারিস কেবল মুষ্টিমেয় শিশু যাদের মধ্যে বেশিরভাগই অনাথকে ফিরিয়ে নিয়েছে। সিরিয়া থেকে ইসলামিক স্টেটের যোদ্ধাদের ফিরিয়ে নিতে ফরাসী সরকারের প্রত্যাখ্যানের ফলে ফ্রান্স থেকে আরও অনেক মুসলমান জিহাদে যোগ দিবে বলে কিছু লোকের ধারণা যা ফ্রান্সের জনসাধারণের নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ।
রাজনৈতিক সেন্সরশিপ এখনো দৃশ্যমান এবং প্রতিবাদকারীদের মুখবন্ধ করার সর্বাত্মক চেষ্টা চালানো হয় অনেক জায়গায়। স্বৈরশাসকরা বিদেশী গণমাধ্যমকে যারা তাদের সমালোচনা করে, শুধু হুমকিই দেয় না বরং তথ্য প্রযুক্তির কল্যাণে অন্য উপায়ে হেনস্থা করার চেষ্টা করে। এরদোগান নারীদের মুক্তি দিয়েছেন শিরোনামের ইস্যুটি ছাপার পর চার্লি হেবডোর ইন্টারনেট সাইট তিন ঘণ্টার মধ্যে ১৬২,০০০ বার আক্রমণের শিকার হয়, সেই সাথে মামলাও করা হয় পত্রিকার বিরুদ্ধে। পঞ্চাশ বছর আগে ইউরোপে স্বৈরশাসকদের প্রাদুর্ভাব ছিল যখন পর্তুগালের সালাজার, আলবেনিয়ার এনভার হোক্সহা, গ্রিসের সামরিক জান্তা, স্পেনের ফ্রান্সিস্কো ফ্রাঙ্কোর মতো লোকেরা রাজত্ব করেছিল। সে তুলনায় এই প্রজাতির শাসক ইউরোপে কমে গেলেও ইউরোপের সীমান্তে পুতিন, এরদোগান বা আসাদের মতো স্বৈরাচারী এখনও বিদ্যমান। নিউইয়র্ক টাইমস দাবি করেছে যে রাজনৈতিক কার্টুন এবং ক্যারিকেচারগুলি এখন বাকস্বাধীনতার জন্য অপরিহার্য নয়। কিন্তু চার্লি হেবডোর ভাষ্য মতে একটি ফরাসি সংবাদপত্রের বিরুদ্ধে তুরস্কের করা মামলা প্রমাণ করে যে বাকস্বাধীনতা রক্ষার জন্য ফ্যাসিস্টদের উপর কলম এবং অঙ্কন দ্বারা আক্রমণ চালিয়ে যেতে হবে। বর্তমান যুগের স্বৈরাচার শাসকরা যুগের পরিবর্তনের সাথে মানিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছে এবং গণতন্ত্রের দুর্বলতাগুলি কাজে লাগিয়ে আইনি পদ্ধতিতে গণতন্ত্রের ভিত্তিকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়।
লেখক এবং কার্টুনের অনুবাদকঃ জিন্দাপীর – Zinda Pir
Cover Photo Copyright: Jeanne Menjoulet
Other Photos: Charlie Hebdo: Journal satirique & laïque – Dessins de presse
Disclaimer & Fair Use Statement
This post may contain copyrighted material, the use of which may not have been specifically authorized by the copyright owner. The purpose of this post is to translate and introduce Bengali people with Charlie Hebdo and create awareness for freedom of expression. This material is available in an effort to explain issues relevant to freedom of speech and supporting the freedom of the cartoonists. The material contained in this post is distributed without profit for educational purposes.
This should constitute a ‘fair use’ of any such copyrighted material (referenced and provided for in section 107 of the US Copyright Law).
If you wish to use any copyrighted material from this site for purposes of your own that go beyond ‘fair use’, you must obtain expressed permission from the copyright owner.