ডানপন্থী নাস্তিকতার উত্থান
ডানপন্থী নাস্তিকতা ব্যাপারটা ঐতিহ্যগতভাবে অনেকটা কাঁঠালের আমসত্ত্বের মত শোনা গেলেও এই নতুন সহস্রাব্দের অন্তত দ্বিতীয় দশক থেকে মূর্ত বাস্তবতায় পরিণত হয়েছে। এই দশকে বিশ্বব্যাপী রাজনীতিতে নতুন করে ডানপন্থীদের উত্থান, ট্রাম্পের নির্বাচনে জয়লাভ, ভারতে মোদির দ্বিতীয়বারের মত নিরঙ্কুশ ক্ষমতাপ্রাপ্তি, ব্রেক্সিট, বরিস জনসনের জয়লাভ, পূর্ব-ইউরোপের অনেক দেশে নীরবে ইসলামের প্রসার রুদ্ধ করে দেয়ার চেষ্টাসহ আরো অনেক ভাঙ্গা-গড়ার সাথে এই ডানপন্থী নিরীশ্বরবাদের দর্শনকে জড়ানো হয়। আদতে এই দর্শনের বা এই ধরণের দর্শনধারীদের এমন কোন সুবিশাল ক্ষমতা আছে কিনা সেটা একটা প্রশ্ন অবশ্যই। তার চাইতেও বড় প্রপঞ্চ হচ্ছে বিরোধীপক্ষের দেয়া এই ট্যাগ বা টাইটেল কি এই দর্শনধারীদের সাথে যায় কিনা তা। ঐতিহ্যগতভাবে ডানপন্থা নামক আদর্শের সাথে যেসব অনুষঙ্গ জড়িয়ে আছে অনেক দশক ধরে, ধর্মীয় জীবনবীক্ষা, ধর্ম-ভিত্তিক নৈতিকতা, সামাজিক রক্ষণশীলতা, অর্থনৈতিকভাবে ব্যক্তির দায়, জাতি-দেশ-গোত্রের প্রতি নিরঙ্কুশ দায়বদ্ধতা, এই সমস্ত অনুষঙ্গের বেশিরভাগ দিকেই ডানপন্থী-নাস্তিকদের অবস্থান আসলে উল্টো। এরা ঈশ্বরের অস্তিত্বের ব্যাপারে সন্দিহান, ধর্মভিত্তিক নৈতিকতাকে মনে করে অপ্রয়োজনীয় ও ক্ষতিকর, সামাজিক জীবনে লিঙ্গভিত্তিক জীবনাচারের বাধ্যবাধকতাকে অস্বীকার করে, সমকামিতা বিষয়ে ব্যক্তিস্বাধীনতাকে চূড়ান্ত মানে, অর্থনৈতিকভাবে রাষ্ট্রের উচিত দরিদ্রদের দেখাশোনা করা এই নীতিতে বিশ্বাস রাখে। এতকিছুর পরেও আধুনিক লিবারেলরা এই গোষ্ঠীকে ক্ষেত্রবিশেষে সত্যিকারের রক্ষণশীলদের চাইতেও ক্ষতিকর মনে করে।
এই উদ্ভট প্রপঞ্চের শুরু ঠিক কোথা থেকে সেটা একেবারে নিশ্চিত করে বলা যায় না। প্রথম বিভাজনের শুরু সম্ভবত আগের দশকের নতুন নাস্তিকতার উত্থানের সময় থেকে। ডকিন্স, হিচেন্স, ডেনেট, হ্যারিসের একসাথে নাস্তিকতা বিষয়ক অনেকগুলো ক্ষুরধার বই ও লেকচার যখন বের হওয়া শুরু হলো তখন লিবারেলরা এগুলোকে স্বাগত জানিয়েছিলো দ্ব্যর্থহীনভাবে। চার ঘোড়সওয়ারের সবাই মূলত খ্রিস্টধর্মের পটভূমি থেকে উঠে আসার কারণে তাদের সমালোচনার তীর মূলত খ্রিস্টান ধর্ম ও পশ্চিমা রক্ষণশীলতার দিকেই তাক করা ছিলো। যেহেতু এই জিনিস পশ্চিম ও পূর্বের সমস্ত লিবারেলদেরই পুরনো শত্রু ছিলো সেহেতু এর পতন যত ত্বরান্বিত করা যায় ততই মঙ্গল। ঝামেলার শুরু হলো যখন এদের সাথে তাল মিলিয়ে আয়ান হারসি আলি, আলি সিনা, আবুল কাশেম, তসলিমা নাসরিনরা ইসলাম ধর্ম ও মুসলিম সমাজের রক্ষণশীলতার বিরুদ্ধে একই রকম বৈশ্বিক আওয়াজ তোলা শুরু করলেন। ইসলামি রক্ষণশীল সমাজ থেকে উঠে আসে এরা দেখাতে শুরু করলেন পশ্চিমের খ্রিস্টধর্মভিত্তিক রক্ষণশীলতা অবশ্যই ক্ষতিকর এবং মিথ্যা কিন্তু সেই সাথে ধোঁয়াশায় ডুবে থাকা ইসলামি দেশগুলোর রক্ষণশীলতা ও দার্শনিক পশ্চাতপদতাও কম নয়। হিচেন্স মরে গিয়ে বেঁচেছেন। ডেনেট একটু চেপে গেছেন। কিন্তু ডকিন্স ও হ্যারিস দেখলেন মুসলিম সমাজ থেকে উঠে আসা এইসব বিপ্লবীদের কথাও সত্য। ইসলাম সম্পর্কে নতুন করে তলিয়ে দেখতে গিয়ে ডকিন্স হ্যারিস ও তাদের সমমনারা দেখতে পেলেন খ্রিস্টান ধর্মের চাইতেও বিষাক্ত ও ভয়াবহ জীবনদর্শন লুকিয়ে আছে ইসলামের একেবারে কেন্দ্রীয় কাঠামোর ভিতরে। এর আগ পর্যন্ত এরাও বিশ্বাস করতেন নাইন-ইলেভেন ও অন্যান্য সন্ত্রাসমূলক নষ্টামি আসলে ইসলামকে ভুল ব্যাখ্যা করা কিছু বিপথগামীর এবং মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকায় পশ্চিমা দেশগুলোর দীর্ঘদিনের নিপীড়কের সমর্থনমূলক ও আগ্রাসী রাজনীতির প্রতিক্রিয়া।
কিন্তু ইসলাম ও ইসলামী দেশগুলোর ভিতর তলিয়ে দেখা গেলো খ্রিস্টান-ধর্মীয় পশ্চাতপদতা ও রক্ষণশীলতার অনেক কিছুই যেমন বাইবেল ও খ্রিস্টান ধর্মের অনেক ডকট্রিন থেকে জাত, তেমন করেই ইসলামি জিহাদ ও ইসলামি সমাজগুলোর পশ্চাতপদতার অনেক কিছুই সরাসরি কোরান ও হাদিস থেকে উদ্ভূত। ডকিন্স হ্যারিস ও তাদের সমর্থকরা তখন খ্রিস্টান ধর্মের পাশাপাশি ইসলামের ভিতর লুকিয়ে থাকা বিষাক্ত দর্শনগুলো নিয়েও বলা শুরু করলেন। এই জায়গায় এসে প্রথম সংঘর্ষ ঘটে পশ্চিমা লিবারেল নাস্তিক ও ডানপন্থী খেতাব-পাওয়া নাস্তিকদের মধ্যেই। মূল কারণ হচ্ছে পশ্চিমা লিবারেলের শত্রুর মধ্যে ধর্মীয় রক্ষণশীলতা যেমন একটা তেমনি বড় বা আরো বিশাল হচ্ছে বর্ণবাদ, লিঙ্গবাদ এইগুলা। পশ্চিমা লিবারেলরা ধরে নিলো ইসলামের ও ইসলামি রক্ষণশীল সমাজগুলোর নষ্টামির সমালোচনা করা মানে হচ্ছে পশ্চিমা জনগণকে ‘মুসলিম’দের বিরুদ্ধে খেপিয়ে তোলা। ইউরোপ আমেরিকাতে যেহেতু জনসংখ্যার বেশ বড় একটা সংখ্যালঘু অংশ হচ্ছে মুসলিম অথবা মুসলিম ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে আসা জনগণ, তাই এরা শঙ্কিত হতে থাকলো এই ভেবে যে ইসলামের সমালোচনা শেষ পর্যন্ত সাধারণ মানুষের কাছে মুসলিমদের সমালোচনা হিসাবে পৌঁছাবে, এবং দীর্ঘদিনের আন্দোলনের মাধ্যমে কমিয়ে রাখা বর্ণবাদ আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে। এই আশংকা থেকে এদের কাছে দীর্ঘদিনের নির্যাতিত আয়ান হারসি আলি, তসলিমা নাসরিনরা অচ্ছুত হওয়া শুরু করলেন। ডকিন্স ও হ্যারিসরা হয়ে উঠলেন খোদ হিটলারের শিক্ষক।
ইসলাম ও মুসলিমদের বিরুদ্ধে বর্ণবাদের উত্থান ঠেকাতে পশ্চিমের লিবারেলরা শুরু করলেন এক অভূতপূর্ব অভিনব দ্বৈত-নীতি। নিজেদের সমাজের ভিতরের ধর্মীয় রক্ষণশীলতাকে আগের মতই বৈপ্লবিক জোশে তুলোধূনো করতে থেকেই এরা শুরু করলেন ইসলামি নির্যাতনের প্রতীক হিজাবকে, শরীয়াকে সমর্থন। এই উদ্ভট ঘটনাপ্রবাহে হকচকিয়ে গেলো যুক্তি বিজ্ঞান ও সত্যের প্রতি সৎ থাকার প্রাণান্তকর চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া আমাদের মত পূর্ব ও পশ্চিমের নাস্তিক লিবারেলদের বেশ বড় একটা অংশ। আমাদের মাথাতেই কিছুতেই ধরলো না কেনো সাধারণ মানুষের ভিতরের বর্ণবাদের উত্থানের সম্ভাবনাকে রহিত করতে গিয়ে মিথ্যার পক্ষে ও নিজেদের যৌক্তিক দর্শনের বিরুদ্ধে যেতে হবে। কোরানের ভিতরে, হাদিসের ভিতরে যদি সাম্প্রদায়িক, বর্ণবাদী, লিঙ্গবাদী দর্শন থাকে, সেধরণের আয়াত থাকে, জীবনদর্শন থাকে সেগুলোর বিরুদ্ধে কথা বলা অযৌক্তিক কেনো হবে। এমনকি পশ্চিমের সাধারণ জনগণের বুদ্ধিমত্তাকে কেনো এত ছোট করে দেখতে হবে এটাও মাথায় ঢুকলো না। সাধারণ জনগণ ইসলামের সমালোচনা আর ঢালাওভাবে মুসলিমদের বিরুদ্ধে বিষোদগারকে আলাদা করতে পারবে না, তাদের বুদ্ধিমত্তাকে এতটাই ভঙ্গুর ও নীচ ভাবতে হবে কেনো, এটাও। অনস্বীকার্য যে জনগণের একটা অংশ অবশ্যই দার্শনিক আলোচনার খুঁটিনাটি এড়িয়ে গিয়ে মুসলিম খারাপ এই সরল নীতিতে চলে যাবে সেই আশংকা একেবারে অমূলক নয়। কিন্তু কে কিভাবে ব্যবহার করলো, এই কথা আগে থেকে মাথায় রেখে কবে কোন যৌক্তিক, দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিক সত্যের উদঘাটন থেমে থেকেছে ?
একবার যখন ভেদরেখা স্পষ্ট হয়ে উঠলো, তখন দেখা গেলো পশ্চিমের ঐতিহ্যগত লিবারেল আর নতুন খেতাব-প্রাপ্ত ডানপন্থী নাস্তিকদের মাঝখানে বয়ে যাওয়া নদীর সংখ্যা নিতান্ত কম নয়। চেতনা ও বিশ্বাস ও চিন্তাপদ্ধতির জায়গাতে।
দ্বিতীয় পর্বে বড় ধাক্কা লাগলো নারীবাদ নিয়ে। ঐতিহ্যগতভাবে পশ্চিমা লিবারেল আর নাস্তিকদের মোটামুটি শতভাগের মধ্যে প্রাথমিক নারীবাদের প্রস্তাবনাসমূহ নিয়ে আদতে কোন বিভেদ ছিলো না। সামাজিকভাবে লিঙ্গের ভিত্তিতে জীবনরূপ ঠিক করে দেয়ার অধিকার ব্যক্তির নিজের ছাড়া আর কারো নাই, নিরাপত্তার অধিকার লিঙ্গ-নিরপেক্ষভাবে সবার জন্য সমান, রাজনীতি, অর্থনীতি সমাজনীতিতে যার যেভাবে অংশগ্রহণ করার ইচ্ছা জাগে সে সেভাবে চেষ্টা করে যাবে আলগা কোন লিঙ্গবৈষম্যমূলক বাঁধা ছাড়া এইসব নীতি অনেক বছর আগে থেকেই অন্তত পশ্চিমের উন্নত সমাজগুলোতে স্বীকার করে নেয়া হয়েছে। কিন্তু ইসলাম নিয়ে দর্শন ও সত্যিকার কার্যপদ্ধতির মধ্যে লিবারেলদের হিপোক্রেসি দৃশ্যমান হওয়ার পরে নারীবাদ নিয়েও কাছাকাছি ধরণের একটা হিপোক্রেসি অনেকটাই আনকোরা নতুনভাবে দৃশ্যমান হলো ডানপন্থী নাস্তিকদের কাছে।
ব্যাপার হলো কাগজে কলমে নারীর যে অধিকারের জন্য লড়াই করার নাম করে নারীবাদের জন্ম, পশ্চিমের সমাজে একটু চোখ কান খোলা রেখে ঘুরলেই দেখা যায় সেগুলোর প্রায় সবগুলোই এরই মধ্যে অর্জিত। একেবারে কম করে বলতে গেলে নীতিগতভাবে, আইনগত পর্যায়ে। এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে কিছুটা উল্টো আইনগত সুবিধার পাল্লা বরং ভারী হয়ে গেছে নারীর দিকে। অবশ্যই প্রায়োগিকভাবে এবং বাস্তবক্ষেত্রে সর্বত্র সবকিছু যে প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেছে এমন বলার অথবা সেটা ভেবে নিজেদের অধিকার-চেতনাতে ঢিল দিয়ে দেয়ার মত অবস্থা নাই। কিন্তু প্রায়োগিকভাবে বা বাস্তব ক্ষেত্রে যেইটুকু অনাচার তার বিরুদ্ধে আন্দোলন তো আসলে সমাজের কাঠামোকে উল্টে ফেলে দেয়ার আন্দোলন নয়। সেটা আইনের শাসন নিশ্চিত করার আন্দোলন হতে পারে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন হতে পারে। কোথাও কোথাও একটু পুরনো জঞ্জাল রয়ে গেছে সেটা পুরো সমাজের অনাচারের প্রতীক হিসাবে দেখানোর কোন কারণ তো নাই। ইসলামকে গভীরভাবে তলিয়ে দেখার মত করে নাস্তিক রক্ষণশীলের দল এখন নতুন করে আবার নারীবাদকেও তলিয়ে দেখতে গেলো। এতদিন ঠিক ঐভাবে তলিয়ে দেখার প্রয়োজন বোধ করে নাই কারণ মিত্রপক্ষের সমস্ত খুঁটিনাটি কে-ই বা অত ঘেঁটে দেখে। ভেদরেখার কল্যাণে এই ঘেঁটে দেখার শুরু করলো আমার বা আমাদের মত নাস্তিকদের একটা বিশাল দল।
ঘাঁটতে গিয়ে দেখা গেলো সমান-অধিকার, সমান-সুযোগের নারীবাদ আসলে ম্যারি ওলস্টোনক্র্যাফটের মত বুড়ো হয়ে মরে গেছে আরো অনেক দশক আগেই। পশ্চিমা লিবারেল ও বিপ্লবীদের মধ্যে নারীবাদের যে সংস্করণ এখন চলছে তার সাথে অপরিচিত অনেকেই, যারা নিজেদের গর্বভরে নারীবাদী বলে দাবী করে তাদের মধ্যেরও। একেবারে চরমে গেলে আছে নারীবাদের একদল জোরসে দাবী করে যেকোন ধরণের লিঙ্গপ্রবেশমূলক যৌনমিলনই ধর্ষণ। সেটা নারীর মৌখিক বা লিখিত বা নোটারিকৃত যে ধরণের সম্মতিই থাকুক। আরেকদল মনে করে জনসংখ্যার মধ্যে নব্বই ভাগ পুরুষ অপ্রয়োজনীয় ও ক্ষতিকর। এদেরকে মেরে ফেলে কেবল নোংরা কাজের জন্য ও স্পার্মের উৎস হিসাবে কিছু পুরুষ রেখে বাদীদের ধাপে ধাপে নিশ্চিহ্ন করে দিতে হবে। অবশ্যই, এই ধরণের নারীবাদীদের দর্শন দিয়ে নারীবাদের বর্তমান সংস্করণ বিচার করতে কোন পাগলও যাবে না। ডানপন্থী নাস্তিকরা তো অবশ্যই নয়। পৃথিবীর যেকোন মতবাদের ভিতরে এক অংশ এইরকম পর্যায়ে চলে যায় সেটা জানা কথাই।
উদ্ভট চরমগুলো বাদ দিলে নারীবাদের বর্তমান সংস্করণের যে রূপটি চোখে আসে সেটিও কোনভাবেই যৌক্তিক বলে মনে হয় আমার ও আমাদের মত ডানপন্থী নাস্তিকদের কাছে। সর্বাধুনিক ইন্টারসেকশনাল নারীবাদে যাওয়ার আগের সংস্করণের নারীবাদের যেসব প্রস্তাবনা ও স্বীকার্য রয়েছে সেগুলো স্বীকার করাই কষ্টকর, অন্তত যুক্তি বিজ্ঞান ও সত্যনিষ্ঠার দৃষ্টিকোণ থেকে। এখন যে সমাজে বসবাস করে নারী ক্ষুরধার ঝাঁঝালো বক্তব্য দিচ্ছে সেই সমাজও নারীকে দাসী পণ্য ও দ্বিতীয় শ্রেণীর গৃহপালিত পশু করে রাখার উদ্দেশ্যেই তার সমস্ত প্রতিষ্ঠান, সমস্ত আইন ও সমস্ত সংগঠনকে সাজিয়েছে। সমাজ ও তার সমস্যা ও অনাচারসমূহ বুঝতে গেলে মানুষের পুরো ব্যবস্থাকে দেখতে হবে পুরুষতান্ত্রিকতা নামক এক সর্বব্যাপী জগদ্দলের তত্ত্ব থেকে। সেখান থেকেই নাস্তিকতা, বিজ্ঞান, বিপ্লব সমস্ত কিছু উৎসারিত হবে। একপতীপত্নীক একক পরিবার হচ্ছে এই পুরুষতান্ত্রিকতার শোষণ ও নির্যাতনের প্রথম ও প্রধান হাতিয়ার। পশ্চিমের আইনের শাসন-ভিত্তিক সমাজও আসলে পুরোটাই কাজ করে ধর্ষণের সংস্কৃতির লালন ও পরিবর্ধনে। নিজের জীবন নিজের মত করে সাজিয়ে নিচ্ছে, উপভোগ করছে, নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নিতে পারছে বলে যেসব নারী নিজেদের স্বাধীন মনে করে, তারা আসলে স্বাধীনতা নয়ই উল্টো মানসিক বিভ্রমে ভুগছে। এরা একদিক থেকে শত্রু। কারণ এরা পুরুষতন্ত্রের রক্ষক, সেবাদাসী হিসাবে কাজ করছে নিজেদের অজান্তেই। এই হচ্ছে চলমান সিরিয়াস নারীবাদের কিছু উল্লেখযোগ্য তত্ত্ব ও প্রস্তাবনা।
নারীবাদের চলমান বা দুই এক ধাপ আগের সংস্করণের বড় বড় তত্ত্বসমূহের গভীরে যাওয়ার আগে প্রথমে যে বিষয় নিয়ে ডানপন্থী নাস্তিকদের সাথে কথিত লিবারেলদের বিভাজন শুরু হয় তা হচ্ছে gender pay gap বা বেতনের লিঙ্গবৈষম্য নিয়ে। কোন একটা গবেষণা থেকে উঠে এলো পুরুষদের তুলনায় নারীর গড় আয় চারভাগের তিনভাগের মত। অর্থাৎ একই সময়ে পুরুষদের আয় ১ টাকা হলে সেখানে নারীরা পায় মাত্র ৭৫ পয়সার মত। সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে যেহেতু পুরুষ-নারীর বৈষম্য এখনো রয়ে গেছে, সেহেতু এই ধরণের গবেষণার ফল থেকে সেসব বৈষম্যকে একটা শক্তপোক্ত বৈজ্ঞানিক ভিত্তি দেয়া গেলো বলে স্বাভাবিকভাবেই সবাই ধরে নিয়েছিলো। কিন্তু আমরা যারা যুক্তি বিজ্ঞান ও সত্যের প্রতি নিষ্ঠাকে নিজেদের বিশ্বাস ও কর্মপদ্ধতির মৌলিক পথ হিসাবে ধরে নিয়েছি তারা যেকোন গবেষণাকে হুট করে চরম সত্য বলে ধরে নেয়ার আগে টুকটাক কিছু যাচাই বাছাই করার প্রয়োজন বোধ করি। এধরণের গবেষণার ক্ষেত্রে সবার প্রথমে যে কথাটা মাথায় আসে তা হলো মেথডলজি বা পদ্ধতি। কি ধরণের তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে, সেগুলোকে কিভাবে বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
আয়ের লিঙ্গবৈষম্য তুলে ধরা গবেষণার মেথডলজি পরীক্ষা করে দেখা গেলো ঢালাওভাবে বেশ কিছু নারী ও পুরুষের বেতন আর কাজের সময় যোগ করে সেগুলোকে গড় করে এই ফলাফল পাওয়া গেছে। এই পদ্ধতি গবেষণা করার জন্য মোটেও উপযুক্ত নয়। কারণ বেতন বা আয়ের পরিমাণ নির্ধারিত হওয়ার অনেকগুলো অনুষঙ্গ আছে। একাডেমিক শিক্ষার লেভেল, কাজের ক্ষেত্র, কাজের ধরণ(ফুল-টাইম, পার্ট-টাইম), কাজের অভিজ্ঞতার পর্যায়, এরকম শত শত ফ্যাক্টর এখানে কাজ করে। কোন অর্থবহ গবেষণা করতে হলে, শুধুমাত্র লিঙ্গকে ভ্যারিয়েবল রেখে আর বাকী সব ফ্যাক্টর এক করতে হবে। নাহলে নিজের ইচ্ছেমত যেকোন কিছু দেখানো যায় ডেটা দিয়ে, যা বিজ্ঞানের ও সত্যের বিচারে অর্থহীন। যেমন পঞ্চাশ জন পুরুষ ইঞ্জিনিয়ারের ডেটা আর পঞ্চাশ জন গার্মেন্টস শ্রমিক নারীর ডেটা নিয়ে দেখানো যাবে পুরুষের আয় নারীর তুলনায় দশ গুন। কাজের সময় একই হলেও। উল্টোদিকে পঞ্চাশ জন নারী ডাক্তারের আয় আর পঞ্চাশ জন পুরুষ দিনমজুরের আয় দিয়ে দেখানো যাবে নারীর আয় পুরুষের তুলনায় দশ গুন বিশ গুন যেমন খুশি। সত্যিকারের লিঙ্গভিত্তিক আয়বৈষম্যর পরিমাণ বের করে আনতে গেলে সেইভাবে ডেটা সংগ্রহ করতে হবে। যেমন পঞ্চাশ জন কাছাকাছি বয়সের, ধরা যাক শিশু বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের আয়, যারা সবাই সরকারি মেডিক্যাল থেকে পাশ করেছে, কেউ-ই এমবিবিএস এর পরে কোন উচ্চতর ডিগ্রি নেয় নাই, সবাই একই ধরণের হাসপাতালে কাজ করে, এরকম একটা স্যাম্পল নিয়েও যদি দেখা যায় পুরুষদের গড় আয় নারীদের তুলনায় বেশি তাহলেই কেবল আয়বৈষম্যের সাথে লিঙ্গবৈষম্যের সম্পর্ক দেখানো যাবে। দুএকটা গবেষণায় এমন করার পরে দেখা গেলো আয়বৈষম্য পুরোপুরি উবে গেছে। অন্তত পশ্চিমের সমাজে। অবশ্যই নারীবাদী লিবারেলরা এইধরনের মেথডলজি চেক করাকে দেখলেন নির্যাতন ও বৈষম্যকে জায়েজ করার অজুহাত দেখানো হিসাবে। আমরা ডানপন্থী নাস্তিকরা মাননীয় স্পিকার হয়ে গেলাম।
এর পরে এলো যৌন-নির্যাতনের সামাজিক প্রতিক্রিয়ার ব্যাপারটি। পশ্চিমের সমাজগুলো অনেক ভাংগা-গড়ার পরে অন্তত বিগত বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে সমাজের সকলের জন্য আইনের শাসন মোটামুটি নিশ্চিত করার পর্যায়ে নিতে যেতে পেরেছে। ধর্ষণ, যৌন-নির্যাতন, নারীর উপর শারিরীক সহিংসতাকে অত্যন্ত জঘণ্য অপরাধ হিসাবেই দেখা হয় এবং সেই অনুযায়ী আইন ও বিচার ব্যবস্থাও কাজ করে। অবশ্যই বিচার ব্যবস্থা দিয়ে পৃথিবীতে মানুষকে অন্তত কোনদিনই কোন অপরাধ থেকে শতভাগ দূরে রাখা সম্ভব হয় নাই। কোন সমাজই সেটা পারে নি। এই অবস্থার মধ্যে বর্তমানের সমাজেও নারীর উপর যৌন-নির্যাতন ঘটে। এটা মানুষের সমাজের একটা তিক্ত বাস্তবতা। কিন্তু নারীবাদীরা জোর গলায় দাবী করতে থাকলেন এইসব যৌন-নির্যাতনের ঘটনা ব্যক্তির সীমাতিক্রম নয় বরং সমাজের সমস্ত প্রতিষ্ঠান ও প্রথা মিলে পুরুষকে অনেকটা লেলিয়ে দেয়া হছে নারীকে যৌন-হেনস্থা করার জন্য। পশ্চিমের সমাজে বসবাসকারীরা, তাদের মধ্যে এমনকি জীবনের কোন না কোন এক পর্যায়ে নিজে নির্যাতনের শিকার হওয়া নারীদেরও বিশাল একটা অংশ স্পষ্টই দেখতে পাচ্ছেন এটা একটা উদ্ভট, ক্ষতিকর মিথ্যা ছাড়া কিছু নয়। যৌন-নির্যাতন প্রতিরোধে স্পষ্ট আইন আছে সবখানে, নির্যাতনের পরে অপরাধীকে ধরা ও তার শাস্তি নিশ্চিত করার জন্য উপযুক্ত কাঠামো ও বাহিনী আছে। এতকিছুর পরও গোটা সমাজকে এই ধরণের অপবাদের দায়ে জর্জরিত করার পিছনের উদ্দেশ্য ও বিধেয় খুঁজতে গিয়ে আমরা হয়রান হয়ে যায়।
অবশ্য একটুদূর ঘাঁটার পর আসতে শুরু করলো পুরো সমাজকে ধর্ষক লালনের নার্সারি বলার পিছনের কারণ। আইনের শাসনের সমাজে যেহেতু প্রত্যেক নাগরিকই নিজের উপর ঘটে যাওয়া অবিচার ও নির্যাতনের বিচার চাইতে পারে। যেহেতু যেকোন অভিযোগকারীর ক্ষোভকে আইন-ব্যবস্থা গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করতে বাধ্য থাকে সেহেতু এই ধরণের ব্যবস্থার অপব্যবহার রোধ করার জন্য প্রত্যেক আইন-ব্যবস্থা প্রত্যেক সমাজকেই অনেকধরণের চেক ও ব্যালান্স রাখতে হয়। আমি চাইলেই বলতে পারি অমুক লোক আমার এক কোটি টাকা ধার নিয়ে আর ফেরত দেয় নি, ওকে বাধ্য করা হোক। সিস্টেমের অপব্যবহার রোধের জন্য আমাকে যথোপযুক্ত প্রমাণ নিয়ে হাজির হতে হবে বিচার পাওয়ার জন্য। এমনকি আমার অভিযোগ যদি সত্যও হয়, সেটার পক্ষে প্রমাণ না থাকলে বিচার পাওয়া সম্ভব নয়। হাজার হাজার বছর ধরে ধীরে ধীরে বিভিন্ন ভাংগা গড়ার মাধ্যমে আমাদের বিচার ব্যবস্থা এই মূলনীতিতেই গড়ে উঠেছে যে নিরপরাধকে কোনরকমেই শাস্তি দেয়া যাবে না। এমনকি তার ফলে সত্যিকারের অপরাধীদের একটা অংশ ছাড়া পেয়ে যাওয়ার সম্ভাব্যতা থাকলেও। এই ব্যবস্থার দূর্বলতা অবশ্যই আছে, কিন্তু অনেক কিছু উল্টেপাল্টে দেখার পরে দেখা গেছে এর চাইতে ভালো ব্যবস্থা এখনো আমাদের হাতে নাই। লিবারেল নারীবাদীদের যৌন-নির্যাতনের ব্যাপারে ক্ষোভ ঠিক এই জায়গাতেই। তারা চাচ্ছেন যৌন-নির্যাতনের অভিযোগ নিয়ে যাওয়া নারীকে দ্ব্যর্থহীনভাবে বিশ্বাস করা হোক। উপযুক্ত প্রমাণ উপস্থাপণ করতে বলার দাবীকে তারা মনে করছেন নির্যাতীতের উপর দ্বিতীয় পর্যায়ের রাস্ট্রীয় নির্যাতন। অবশ্যই স্বীকার্য যে এ ধরণের পরিস্থিতি একেবারে ভিত্তিহীন নয়। যৌন-নির্যাতন অনেক ক্ষেত্রেই ঘটে যেখানে প্রমাণ বা স্বাক্ষী হাজির করা যায় না। কিন্তু তার বিপরীতে যৌন-নির্যাতনের অভিযোগকে সরাসরি ব্ল্যাংক চেক দিয়ে দেয়াও কোন সমাধান নয়। মানুষ অপব্যবহার করতে পারে না এমন কিছু মহাবিশ্বের কোন কানাচেও নাই। যদি প্রতিটা মানুষের প্রতিটা মাইক্রোসেকেন্ডের কাজের অডিও ভিডিও কোথাও রেখে দেয়া যায় তাহলে হয়তো পুরোপুরি প্রতিরোধ বা বিচার করা সম্ভব হবে সমস্ত কিছুর। কিন্তু তেমন ধরণের সিস্টেম কেবল অবাস্তবই নয়, কাম্যও হতে পারে না সুস্থ্য স্বাভাবিক মানুষের জন্য। এখন এই উদ্ভুত দুর্বলতার মধ্যে যদি বলা হয় যে, সমাজের বিচারের উপর ভরসা করা ঠিক, কিন্তু সাথে সাথে নারীদের নিজেদেরও উচিৎ নিজস্ব নিরাপত্তার বিষয়টি মাথায় রেখে নিজের চলাচল ঠিক করার, তখন আবার উল্টো সেই-অভিযোগ যে অপরাধীর বিচারের কথা না বলে ভিক্টিমকে ব্লেইম করা হচ্ছে। আবার ঘুরে ফিরে যেই লাউ সেই কদুতে ফেরত যাওয়া। এই ক্যাচালের ফাঁদে পড়েই নারীবাদ ও নারীবাদ নামক যেকোন কিছুকে বিষাক্ত বর্জ্যের মত এড়িয়ে চলার একটা প্রবণতা তৈরী হয় বাস্তবতা ও সত্যের প্রতি নিষ্ঠা রাখার চেষ্টা করা নাস্তিকদের মধ্যে। ফলত আমরা পরিচিত হয়ে উঠি নারীবিদ্বেষী ডানপন্থী নাস্তিক হিসাবে।
যৌন-নির্যাতন ও নিপীড়ন শতভাগ বন্ধ করার মত কোন আইনি বা কাঠামোগত উপায় আসলে নাই এই তিক্ত বাস্তবতা ডানপন্থী নাস্তিকদের মত লিবারেল নারীবাদীরাও বিলক্ষণ উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। একইভাবে ঢালাওভাবে যেকোন অভিযোগকারীর অভিযোগই সত্য বলে ধরে নিতে হবে এই মূলনীতিও যে নেয়া যায় না সেটা অল্পদিনের মধ্যেই প্রকাশ পাওয়া শুরু করে। মিথ্যা অভিযোগ, হয়রানী-মূলক অভিযোগের উদাহরণ যেমন কিছুদিন পরপর প্রকাশিত হওয়া শুরু করলো তেমনি আবার যৌন-নির্যাতন বিষয়ক আইনি প্রক্রিয়াগুলোর ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে বেশ বড় একটা অংশ পাওয়া গেলো যেগুলো পরে প্রমাণীত হয়েছে হয়রানির উদ্দেশ্যে করা অভিযোগ বলে। নারীর উপর যৌন-নির্যাতন সম্পূর্ণ নির্মূল করার উপায় হিসাবে আইনি কঠোরতা বা বিচার প্রক্রিয়ার চাইতে তাই গুরুত্বপূর্ণ বলা হলো যৌন-নির্যাতন বিষয়ক সমাজের সার্বিক সংস্কৃতিকে পাল্টানো। কিন্তু সমাজের অন্যান্য অপরাধগুলো নিয়ে যদি আমরা দেখি তাহলে দেখা যায় চুরি ডাকাতি খুন দুর্নীতির মত সমাজের অন্যান্য অপরাধগুলোকেও সাধারণত সব সমাজেই সর্বজনস্বীকৃতভাবেই ঘৃণীত ও শাস্তিযোগ্য কাজ হিসাবে সংস্কৃতিতে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। তারপরও এইসব অপরাধের কোনটাই কোন সমাজ থেকেই পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়ে যায় নি। অদূর ভবিষ্যতে বিলুপ্ত হয়ে যাবার মত কোন সম্ভাবনাও নেই। শুধুমাত্র যৌন-নির্যাতনের ক্ষেত্রে কিভাবে শুধু সমাজের মানসিকতার পরিবর্তন দিয়ে এটা বন্ধ করে দেয়া যাবে তা বোধগম্য হলো না আমাদের কাছে। তখন আমরা হয়ে গেলাম ধর্ষণ-সংস্কৃতির লালনকারি, ধর্ষণের সাফাই গাওয়া গোষ্ঠী।
এরকম একটা সাংস্কৃতিক আবহের মধ্যে লিবারেল নারীবাদীরা শুরু করলেন সমাজের সর্বস্তরে প্রায় সর্বক্ষেত্রে পুরুষের প্রায় সমস্ত আচরণের বিরুদ্ধে অভিযোগ। জীবন জগতকে ব্যাখ্যা করতে যাওয়ার প্রচেষ্টা, মানুষের সামাজিক আচরণ ও তার লিঙ্গভিত্তিক বৈচিত্রকে বুঝতে যাওয়ার চেষ্টাকে এক কথায় বাতিল করে দেয়া হলো mansplaing বলে। শব্দটির সংজ্ঞা যেভাবে দেয়া হলো, পুরুষ কতৃক সাধারণত নারীর কাছে কোন কিছুকে অতিরিক্ত আত্নবিশ্বাসের সাথে অতিরিক্ত সরলভাবে সাধারণত নারীকে নির্বোধ ধরে নিয়ে ব্যাখ্যা করা, সেটা একেবারে নেহাত অযৌক্তিক বা অলীক নয়। এরকম ব্যাখ্যা, এরকম পরিস্থিতির সত্যিকার উদাহরণ অনেক পাওয়াই যাবে। সেটাকে শুধুমাত্র পুরুষের একার দোষ বলে ধরা উচিত কি অনুচিত সেই প্রশ্নে যাওয়ার আগেই শব্দটির সত্যিকারের ব্যবহার বা অপব্যবহার শুরু হলো ব্যপকভাবে। সেই ধরণের অবস্থায় আমার এই জাতীয় সমস্ত লেখাই ঐ এক পাত্রে মেনস্প্লেইনিং বলে ফেলে দেয়া যাবে। যুক্তি, যাচাই আর সত্যনিষ্ঠার মত কোন গাইডের দরকার পড়ে না তাহলে। টক্সিক-ম্যাসকুলিনিটি(Toxic masculinity), মেন-স্প্রেডিং (man-spreading) এর মত আরো বেশ কিছু ধারণা যোগ করা হলো সমাজের সার্বিক ভোকাবুলারিতে। এইসব অতিরঞ্জন দেখতে দেখতে ত্যক্ত বিরক্ত হয়ে আমরা আরো আলাদা হয়ে যেতে থাকলাম লিবারেলদের কাছ থেকে।
বিভাজনের তৃতীয় অনুষংগটি হচ্ছে বর্ণবাদ। অন্য অনুষংগগুলোর মতই মৌলিক নীতিতে এখানেও খুব একটা পার্থক্য ছিলো না পশ্চিমের লিবারেল আর ডানপন্থী নাস্তিক খেতাবপ্রাপ্তদের মধ্যে। মানুষের সার্বিক ইতিহাসে এক জাতি অপর জাতির বিরুদ্ধে ঘৃণা জারী রাখার জন্য, নিজেদের শ্রেষ্ঠ মনে করে অন্যদের উপর নিজেদের নির্যাতনকে স্বাভাবিক বিষয় হিসাবে দেখার জন্য বর্ণবাদী চিন্তা লালন করেছে, এমনকি সময়ে সময়ে সেগুলোকে প্রাকৃতিক সত্য হিসাবে দেখানোরও চেষ্টা করেছে। এই ধারার চিন্তার প্রভাবে বর্তমানের আধুনিক সমাজ থেকেও পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়ে যায় নি। এর সমস্ত কিছুই আমরাও স্বীকার করে নিয়েছি লিবারেলদের মতই। কিন্তু বড় ভেদরেখা তৈরী হয়ে গেলো সমাজের ভিতরে এই বর্ণবাদের উৎস ও এর প্রতিকার প্রক্রিয়ার নিয়ে।
এই বিভাজন এখন নগ্নভাবে দৃশ্যমাণ হলেও এর উৎপত্তি কিন্তু অতটা সাম্প্রতিক নয়। এর উৎপত্তি সেই পুরনো নেচার-নার্চার বিতর্ক থেকে। লিবারেলিজম, মানব-কল্যাণ ভিত্তিক সকল নাগরিকের সমান অধিকার ভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা তৈরীর প্রক্রিয়ার শুরু বলতে গেলে এই জায়গা থেকেই। সামন্ত যুগের পরে যখন মানুষের সার্বিক দর্শনে যখন স্বীকার করে নেয়া হলো যে ঈশ্বর প্রদত্ত উচ্চ-বংশ বা উচ্চ-জাত বলে কিছু নেই, মানুষকে শিক্ষা দিয়েই সমাজের যেকোন অবস্থানের জন্য যেকোন কাজের জন্য তৈরী করে নেয়া যায় সেখান থেকেই আসলে লিবারেলিজমের স্বর্ণযুগের শুরু। এই চিন্তা পদ্ধতির মূর্তমান সাফল্য হচ্ছে বর্তমানের পশ্চিমা সমাজ। কিন্তু এই প্রাথমিক দর্শন ধীরে ধীরে পরিণত হতে থাকে কঠোর আচরণবাদী দর্শনে। উনিশ শতকের শেষভাগ থেকে প্রস্তাবিত হতে থাকে মানুষের আসলে প্রাণী হিসাবে কোন প্রবৃত্তি বলতে কিছু নাই। তার আচরণ, শরীর, চিন্তা সমস্ত কিছুই কেবল সামাজিকীকরণের ফলাফল। চিন্তার এই ধারা বর্তমানের লিবারেল নারীবাদীদের জন্য সুবিধাজনক। এই ধারায় চিন্তা করলে সমাজের ভিতরে বিদ্যমান সমস্ত সমস্যার জন্য, সমস্ত খারাপের জন্য সমাজকে ও তার শিক্ষা-ব্যবস্থাকে দায়ী করা যায়। আবার এই মূলনীতির উপর অটল থাকলে বলা যায় সমাজের সমস্ত সমস্যা সমাধাণের উপায় হচ্ছে শিশুকে দেয়া শিক্ষা পাল্টানো। তাহলে আর তিক্ত ও কঠোর বাস্তবতার খুঁটিনাটি নিয়ে মাথা ঘামাতে হয় না।
কিন্তু ঘটনা হইলো দুনিয়াতো আর স্বর্গোদ্যান না। মানুষও নূরের তৈরী ফেরেশতা না। মানুষের সমাজের একটা সাধারণ সূত্র হইলো কোনকিছু যদি মনে হয় অতিরিক্ত পারফেক্ট, এতই পারফেক্ট যে সম্ভবত মিথ্যা, বাস্তবে সব-ক্ষেত্রে সেটাই হয়। কঠোর আচরণ-বাদের ধারণাগুলো নিয়ে জীব-বিজ্ঞানীরা পরীক্ষা শুরু করতে থাকলে দেখা গেলো ধারণাগুলো দর্শনের ক্ষেত্রে যত চমৎকার, বাস্তবতার সাথে ততটা সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। যেসব প্রাণীকে মানুষের নিজেদের অতিরিক্ত আত্ন অহংকারের চোটে নিম্নশ্রেণীর প্রানী বলে দীর্ঘদিন ধরে ট্যাগ করে এসেছে তাদের বিভিন্ন সামাজিক আচরণের মধ্যে যখন দেখা গেলো ভৌগলিক বা পরিবেশগত পার্থক্য স্বত্তেও একটা প্রজাতির আচরণের মধ্যে বেশ বড় একটা অংশ একই রকম। যেকোন ভূগোলে, যেকোন আবহাওয়ায়। এদের ক্ষেত্রে সহজেই বলে দেয়া গেলো যেহেতু এদের জেনেটিক কোড একই রকম, সুতরাং এদের আচরণের বড় একটা অংশ তাদের প্রবৃতিগত। অতএব সব জায়গায় একই রকম হবে তাতে আর বিচিত্র কি।
কিন্তু ঝামেলা বাঁধলো মানুষের কাছাকাছি বিবর্তনীয় আত্নীয়-স্বজনদের সামাজিক-আচরণ পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে। শিম্পাঞ্জি, গরিলা, বেবুন এইসব। একেকটা দলকে প্রায় দশ-বিশ বছর ধরে নিবিড় পর্যবেক্ষণ করা হলো। পর্যবেক্ষণ করা হলে বিভিন্ন ভূগোলে, বিভিন্ন জলবায়ুতে। দেখা গেলো এদের সামাজিক সংগঠনের মধ্যেও ভৌগলিক ও পরিবেশগত পার্থক্য থাকলেও একটা প্রজাতির মধ্যে কিছু আচরণ, কিছু প্রথা সব জায়গাতেই একই রকম। এর পরে অবশ্যাম্ভাবীভাবেই আসবে মানুষের কথা। প্রথম এই গরম আগুনে হাত পোড়ান E. O. Wilson নামের এক আমেরিকান বিজ্ঞানী। উইলসন নিজে একজন জগদ্বিখ্যাত পিপড়াবিজ্ঞানী। সম্ভবত খুব সহজেই এক নাম্বার। নিজের দক্ষতার পিপড়াদের সমাজ থেকে শুরু করে, অন্যান্য জীববিজ্ঞানীদের পর্যবেক্ষণ করা অন্যান্য প্রাণীদের সামাজিক জীবনাচরণ ও সর্বোপরি মানুষের কাছাকাছি প্রাইমেটদের সামাজিক জীবনের উপাত্ত নিয়ে সমস্ত তথ্যকে সুবিন্যস্ত উপায়ে সাজিয়ে তিনি প্রস্তাব করেন তার সোশিওবায়োলজি তত্ত্ব। অবশ্যাম্ভাবীভাবে সেখানে মানুষের সামাজিক আচরণকেও একটা কাঠামোতে নিয়ে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করা হয়েছে। পুরো বিষয়টিই কঠোর বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির উপর নিষ্ঠ থেকে করা হলেও, তার বইয়ের বিরুদ্ধে তুমুল প্রতিবাদ উঠে লিবারেল পক্ষ থেকে। প্রথম দিকে এই বিরোধিতা যৌক্তিক ও তথ্যনির্ভর এবং একাডেমিক উপায়ে করার চেষ্টা করা হয়। অন্য একটা বিশ্ববিদ্যালন্যে সোশিওবায়োলজির বিরুদ্ধ পক্ষের সার্কেল গড়ে তোলা হয়। কিন্তু ধীরে ধীরে বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ায় বিরোধীরা নিজেদের স্বপক্ষে প্রমাণ ও বৈজ্ঞানিক বাস্তবতা তুলে আনতে না পেরে নিষ্ক্রিয় থেকে প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। কারণ সোশিওবায়োলজির পরে নৃতাত্তিক ও আচরণগত অর্থনীতিবিদরা অনেক রকমের বৈজ্ঞানিক পরীক্ষণ নিরীক্ষণ করে যতই নতুন তথ্য আনতে থাকলেন ততই দেখা গেলো সেগুলো বরং উইলসনের প্রাথমিক প্রস্তাবণাকেই সমর্থণ করে।
একাডেমিয়াতে সোশিওবায়োলজির বিরোধিতা নিষ্প্রভ হয়ে গেলেও লিবারেল রাজনীতি তাতে বিন্দুমাত্র দমে নি। উইলসনের লেকচারে বিরোধীরা সহিংস হয়ে উঠলে তাকে পুলিশি প্রতিরক্ষা নিতে হয়। তার প্রস্তাবিত সোশিওবায়োলজি তত্ত্ব ও পরবর্তীতে বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানকে লিবারেলরা নিজেদের মধ্যে গালি হিসাবে ব্যবহার করতে থাকে। ঘটনা হলো উইলসন ও তার তত্ত্বের পক্ষে বিভিন্ন পরীক্ষণ করে উপাত্ত সংগ্রহ করা বিজ্ঞানীদের বৈজ্ঞানিক দক্ষতার ধারে কাছেও কেউ ছিলো না বিরোধী লিবারেল পক্ষে। বৈজ্ঞানিক বিরোধিতায় না পেরে তারা একটা পয়েন্টে একাট্টা হয়। তাদের সমস্ত ক্ষোভ হচ্ছে মানুষের সামাজিক আচরণের উপর তার জেনেটিক কোডের প্রভাব আছে এই এক জায়গাতে। লিবারেলদের জগৎ-বীক্ষা থেকে দেখলে অবশ্য তাদের ক্ষোভ ও ভয় অমূলক নয়। কারণ তাদের সমস্ত কিছুই দাঁড়িয়ে আছে ঐ একটা বিন্দুর উপর। মানুষের উপর তার জিনের কোন প্রভাব নাই। অন্তত তার সামাজিক আচরণ ও মনস্তত্তে।
ঠিক এই জায়গাতে এসে আমরা ডানপন্থী নাস্তিকরা লিবারেলদের চিন্তা প্রক্রিয়ার রহস্যের খেই হারিয়ে ফেলি। হিসাব মতেতো আমরা যেমন নাস্তিক তেমনি লিবারেল নাস্তিকরাও নাস্তিক। দুই পক্ষই সমস্ত অলৌকিক ব্যাখ্যাকে অস্বীকার করি। দুই পক্ষই মনে করি পুরো মহাবিশ্বে যা কিছু ঘটে সেগুলো বস্তুকণা ও শক্তির পারস্পরিক ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার ফলাফল হিসাবে ঘটে। দুই পক্ষই বিবর্তনীয় জীববিদ্যার মাধ্যমে মানুষসহ পুরো জীবজগতের মধ্যকার বৈচিত্রকে ব্যাখ্যা করা যায় বলে মানি। গন্ডারের শিং এর আকার যেমন তার কোষের ভিতরে থাকা ডিএনএ দিয়ে নির্ধারিত হয়, তেমনি আমার মাথার টাকের শেইপও আমার কোষের ভিতরে থাকা কোন না কোন একটা ডিএনএর কোন না কোন একটা অংশ দিয়ে নির্ধারিত হয়। আবার অন্য জায়গা থেকে দুইপক্ষই জানি মানুষের যা চিন্তা ও আচরণ তার সমস্ত কিছুই মানুষের মস্তিষ্কের ভিতরে থাকা নিউরণের বিভিন্ন রাসায়নিক বিক্রিয়ার ফলাফল। সেইসব রাসায়নিক বিক্রিয়া আবার নির্ভর করে তার মস্তিষ্কের গঠনের উপরে। মস্তিষ্কের গঠন ঠিক হয় কোষের ভিতরে থাকা ডিএনএ বা জিন দিয়ে। একই ভাবে যদি মানুষের চামড়ার রং আর শরীরের উচ্চতা আর চুলের স্থায়িত্ব ঠিক হয় তাহলে মস্তিষ্কের ক্রিয়াকে আলাদা করার কারণ কি ? কেনো লিবারেলরা চামড়ার রং আর দাঁতের গঠনের ব্যাপারে জিনের প্রভাবকে খুবই স্বাভাবিক ধরে নিলেও মস্তিষ্কের কার্যকলাপকে সম্পূর্ণ আলাদা ব্যাপার বলে মনে করে এই চিন্তা প্রক্রিয়ার রহস্য কিছুতে আমাদের ডানপন্থী নাস্তিকদের মাথায় ধরে না।
চিন্তার এই ধারার পরবর্তী পর্যায়েই আসে বর্ণবাদের ব্যাপারটি। মানুষে মানুষের শারিরীক ও মানসিক পার্থক্যের জায়গাতে যেহেতু তার কোষের ভিতরের জিনের একটা বড় প্রভাব আছে স্বভাবতই সেই প্রভাব আমরা অবশ্যাম্ভাবীভাবে মানুষের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যেও দেখতে পাবো। একটা জাতির সাথে আরেকটা জাতির যদি গায়ের রং এর পার্থক্য হতে পারে, সদি শারিরীক উচ্চতার পার্থক্য হতে পারে তাহলে তাদের মধ্যে সামাজিক আচরণের অথবা বুদ্ধিমত্তার পার্থক্য কেনো হতে পারবে না এই জিনিস আমাদের মাথায় ঢুকে না। সবগুলোইতো জিনের পার্থক্যের ফলাফল। অবশ্যই আমাদের বর্তমান সমাজ যেভাবে প্রবল গতিতে গ্লোবালাইযড হচ্ছে তাতে কয়েক শতকের মধ্যে এই ধরণের পার্থক্য প্রায় পুরোপুরিই নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। সেটা কাম্য কি অকাম্য সেই আলোচনা অনর্থক। কিন্তু এটা নিশ্চিত যে তখনকার সমাজে আর জাতিগোষ্ঠীর ভেদরেখা থাকবে না। কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত বৈজ্ঞানিক বাস্তবতা হিসাবে এটা আছে সেটাকে কেবল চোখ বন্ধ করে অস্বীকার করলেইতো আর সেটা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে না। বর্তমানের বাস্তবতায় জাতিতে জাতিতে পার্থক্যের এই সত্য নিয়ে আসলে করনীয় কি বা আদৌ করণীয় কিছু আছে কিনা এই নিয়ে বিশাল বড় একোটা ভুল-বোঝাবুঝি তৈরী হয় লিবারেল আর ডানপন্থী নাস্তিকদের মধ্যে। আমরা দ্ব্যর্থহীনভাবে বলি মানুষে মানুষে গায়ের রং আর শারিরীক উচ্চতার পার্থক্যের জন্য যেমন আমরা তাদের অধিকার ও প্রাপ্য সুযোগ-সুবিধা নিয়ে কোনপ্রকার বৈষম্য মানি না, একইভাবে জাতিতে জাতিতে যত সহস্র রকমের পার্থক্য থাকুক তার কোনটাই জাতিগুলোর মধ্যে অধিকার আর প্রাপ্য সুযোগ-সুবিধার বৈষম্য করার জন্য যুক্তি হতে পারে না। কিন্তু লিবারেলরা মনে করে এটা আমাদের শঠতা। তাদের জীবনবীক্ষা মতে জাতিতে জাতিতে সব রকমের পার্থক্য মানলেও মানসিক ও আচরণগত পার্থক্য কোনভাবেই স্বীকার করা যাবে না। আমরা তাদের এই চিন্তাপদ্ধতির সুলুক সন্ধাণে গিয়ে মাননীয় স্পিকারে পরিণত হই বারবার।
এখন কথা হচ্ছে আমরাতো দ্ব্যর্থহীনভাবে ঘোষণা দিচ্ছি যে, জাতিতে জাতিতে যত সহস্র রকমের পার্থক্য থাকুক তার কোনটাই জাতিগুলোর মধ্যে অধিকার আর প্রাপ্য সুযোগ-সুবিধার বৈষম্য করার জন্য যুক্তি হতে পারে না, কিন্তু তারপরেও কেনো জাতিগুলোর মধ্যে কি ধরণের পার্থক্য আছে এই বিষয়ে গবেষণা করাকে কেনো প্রয়োজনীয় মনে করি আমরা ? কোন নীতি-নির্ধারণে যদি ব্যবহার করার কোন ইচ্ছা না থাকে তাহলে কি স্রেফ সময় ও অর্থের অপচয় নয় ? উল্টো জাতিগুলোর মধ্যে ঠোকাঠুকি বাড়াবে না কি এধরণের বিষয় নিয়ে নাড়াচাড়া করা ?
প্রথমত মানুষের যে অনন্ত কৌতূহল জীবন ও জগত নিয়ে তাতে কোন জ্ঞান দরকারী আর কোন জ্ঞান অদরকারী এই দিয়ে মানুষকে বাঁধা যায় নি কোনদিন। দ্বিতীয়ত জাতিগুলোর মধ্যে কি ধরণের জেনেটিক পার্থক্য রয়েছে এই জ্ঞান একেবারে ফেলনা নয়। উপযুক্তভাবে ব্যবহার করতে পারলে বরং সমাজের বিভিন্ন অসুস্থতার সমাধানে এই জ্ঞান আমাদের সাহায্য করতে পারে। এই ধরণের চিন্তা থেকেই রিচার্ড হার্নেস্টাইন ও চার্লস মুরে নামের দুইজন আমেরিকান বিজ্ঞানী সমাজে মানুষের সফলতার সাথে আইকিউ নামক জিনিসের যোগসূত্র খুঁজতে নেমেছিলেন। কয়েক দশকব্যাপী তাদের দীর্ঘ গবেষণার ফল থেকে জানা গেলো বর্তমানের বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থা যেধরণের তাতে একজন মানুষের বৈষয়িক সফলতার সাথে তার আইকিউ’র বেশ বড় ধরণের একটা সম্পর্ক আছে। এই সম্পর্ক তার আর্থসামাজিক অবস্থা, গায়ের রং ও নৃতাত্তিক জাত সমস্ত কিছুর চাইতেও বড়। অর্থাৎ যে জাতির হোক, যত খারাপ অবস্থাতেই বড় হোক যাদের আইকিউ বেশি তারাই পরবর্তী জীবনে বৈষয়িক সাফল্য পেয়েছে।
এখন আইকিউর সাথে বুদ্ধিমত্তা নামক আরো বড় ধারণা কি আসলে যুক্ত নাকি আলাদা ব্যাপার সেটা বেশ তর্কস্বাপেক্ষ। নির্দ্বিধায় যতটুকু বলা যায় এই একটা সংখ্যার সাথে মানুষের সৃষ্টিশীলতা বা তার মূল্যের সম্পর্ক অন্তত নাই। কিন্তু বর্তমানের যে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, তাতে যে ধরণের মানুষ বৈষয়িক সফলতা পায় সেটা আইকিউ দিয়ে বেশ ভালোভাবে প্রেডিক্ট করা যায়। কিন্তু ঝামেলা বাধলো যখন এদের মত আরো কয়েকজন বেশ শক্ত মেথডলজির মাধ্যমে দেখালেন যে কালো চামড়ার আমেরিকান দের “গড়” আইকিউ অন্য ধরনের আমেরিকানদের তুলনায় ১৫ পয়েন্ট কম। মেথডলজি ঠিক রাখার জন্য তারা নানান ধরণের ব্যবস্থায় পরীক্ষা করলেন, আফ্রিকাতে গিয়ে স্থানীয় জনগণের মধ্যে পরীক্ষা করলেন, ভাষাগত প্রভাব এড়ানোর জন্য লিখিত ভাষার ব্যবহার ছাড়া অন্য ধরণের পরীক্ষা পদ্ধতিতে আইকিউ পরীক্ষা করলেন। সবগুলো মিলিয়েই এই ১৫ পয়েন্টের ব্যবধান কিছুতেই ঘুচলো না।
এই ধরণের পরীক্ষা থেকে স্বিদ্ধান্ত নেয়া যায় খুব সামান্যই। তবে যেটুকু বুঝা যায় তা হচ্ছে বর্তমান বিশ্বের যে অর্থনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থা তাতে আইকিউ দিয়ে সাফল্য নির্ভর করে যেসব জায়গায় সেসব জায়গাতে অন্য সব ধরণের ফ্যাক্টর একই থাকলে কালোদের সাফল্যের পরিমাণের সাথে জনসংখ্যায় তাদের অনুপাত মিলবে না। যেমন ধরা যেতে পারে বিজ্ঞানীদের সংখ্যার অনুপাতে। আমেরিকার জনগণের মধ্যে কালোদের অনুপাত মোটামুটি ১৩ পার্সেন্টের মত। বর্তমানের বিশ্বব্যবস্থায় পিএইচডিধারী বিজ্ঞানী হওয়ার সাথে আইকিউ যেহেতু সম্পর্কিত সেহেতু এদের গবেষণার ফলাফল অনুযায়ী ১০০ জন আমেরিকান বিজ্ঞানীর মধ্যে কালোদের সংখ্যা ১৩ জন হবে না। কিছুটা কম হবে। বর্তমানের বাস্তবতায় সেটা মাত্র ৫ জন। অবশ্য এর মধ্যে কোটা ও অন্যান্য ধরণের বিষয় জড়িত থাকায় ব্যাপারটা কতটুকু বাস্তবতাকে প্রতিফলিত করে সেটা আবার আরেক ধোঁয়াশার বিষয়।
অবশ্যই আফ্রিকা থেকে নির্মমভাবে পণ্যের মত তুলে নিয়ে আসা একটা জনগোষ্ঠীকে দাস হিসাবে বর্বরতমভাবে অত্যাচার করে মাত্র তিনচার দশক ধরে জীবনের সব ক্ষেত্রে বিচরণের সুযোগ দিলে তারা যে তাদের আইকিউ দিয়ে যদ্দুর যাওয়া যায় ততদূরও যেতে পারবে সেটা কখনোই আশা করা যায় না। কারণ বর্ণবাদের সমস্যা অনেক গভীরে এক ধরণের দুষ্টচক্রের তৈরী করে। দাসের জীবন থেকে মুক্ত হলেও খুবই খারাপ পরিবেশে, দারিদ্রের মধ্যে বড় হওয়ার ফলে কালো জনগণের একটা বড় অংশ অন্য কিছু না পেয়ে অপরাধমূলক অনেক কাজে জড়িয়ে পড়তে বাধ্য হয়। ফলে জনগণের অন্য জাতিগুলোর মধ্যে এক ধরনের স্টেরিওটাপ তৈরী হয় যে কালোরা অপরাধ করে বেশি। তার ফলশ্রুতিতে কালোরা আবার নিজেদের জীবনের উন্নতি করার সুযোগ পায় কম, অন্যদের অবিশ্বাসের কারণে। ফলে আবার দারিদ্র, আবার অপরাধ। এই দুষ্টচক্র ভাংতে দিলে ও কোটা ব্যবস্থার বিলোপ করলে বিজ্ঞানীদের মধ্যে কালোদের শতকরা অনুপাত খুব সম্ভবত ১৩ জনে যাবে না। একটু কম থাকবেই।
এই খুবই সামান্য একটা টেকনিক্যাল পয়েন্টে গিয়ে লিবারেল নাস্তিকদের সাথে ডানপন্থী নাস্তিকদের বড় একটা বিভাজন হয়ে যায়। লিবারেল ঘরানার লোকজনের বক্তব্য হচ্ছে আইকিউ দিয়ে বা বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষেত্রগুলোতে আগের যুগের দাস-মালিক নির্যাতক জনগোষ্ঠীর পরবর্তী প্রজন্মের সাথে নির্যাতীত জনগোষ্ঠির পরবর্তী প্রজন্মের যে পার্থক্য তার প্রায় সবটাই মূলত বর্তমান পর্যন্ত প্রবাহিত জাতিগত ঘৃণা ও বর্ণবাদের ফলাফল। এই ধারণা থেকে বিজ্ঞান ছাড়াও অন্যান্য যত ক্ষেত্রে জনসংখ্যার অনুপাতের সাথে সাফল্য বা ব্যার্থতার অনুপাত মেলে না সেই সব ক্ষেত্রেই তারা বর্ণবাদের দীর্ঘ ছায়ার দাবী তুলেন। সিনেমার অস্কারে, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজম্যান্টে, পুলিশের হাতে গ্রেফতার হওয়ার অপরাধীদের সংখ্যায় সমস্ত কিছুতে।
দীর্ঘসময়ব্যাপি সংঘটিত বর্ণবাদের অত্যাচার ও তার ফলাফলে তৈরী হওয়া দুষ্টচক্রের কারণে সত্যিকারের অর্থে কোন ধরণের অনুপাত যে বর্ণবাদের প্রভাব পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়েছে তা নির্দেশ করবে সেটা আন্দাজ করা খুবই দূরুহ ব্যাপার। কিন্তু সেই অবস্থানে গেলেও জাতিগত জেনেটিক পার্থক্যের প্রভাব যে বিলুপ্ত হয়ে যাবে না সেটা আমার মত অনেক ডানপন্থী নাস্তিক খেতাবপ্রাপ্তদের ধারণা। এমনকি বর্তমানের বর্ণবাদ পুরোপুরি বিলুপ্ত না হওয়া পরিস্থিতিতেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে সাফল্যের ক্ষেত্রে দেখা যায় উল্টো পরিস্থিতিতি। জনসংখ্যার মাত্র ১৩ শতাংশ হওয়া স্বত্তেও আমেরিকার ন্যাশনাল বাস্কেটবল এসোসিয়েশনের খেলোয়াড়দের মধ্যে প্রায় ৭৫ শতাংশ হচ্ছে কালো আমেরিকানরা। অর্থাৎ সব জাতি যদি সমস্ত কিছুতে সমান হয় তাহলে যা হওয়ার কথা তার চাইতে প্রায় ৬ গুন বেশি কালোদের আধিপত্য এই জায়গায়। লিবারেলরা এটাকে পুরোপুরি সামাজিক স্টেরিওটাইপের ফলাফল বললে চাইলেও, এতখানি বৈষম্য, বিশেষত সফলতার ক্ষেত্রে, কোনভাবেই হজম করার মত অবস্থা নয়। অবশ্য এই বৈষম্যের প্রতিকার নিয়ে খুব বড় কোন চিন্তার কথা লিবারেলদের মধ্যে দেখা যায় না। কোন এক অদ্ভুত কারণে তাদের সমস্ত আগ্রহ সেসব বিষয় নিয়ে যেগুলোকে মানসিক দক্ষতা বা মস্তিষ্কের কার্যকলাপের সাথে জড়ানো যায়, সেইসব ক্ষেত্রের বৈষম্য নিয়ে। চিন্তার এই পার্থক্যের জায়গাটা আমাদের মাথায় ধরে না। বাস্কেটবল খেলার দক্ষতা যেমন বস্তুগত ক্রিয়া-বিক্রিয়ার ফলাফল, অস্কারে পুরষ্কার পাওয়া বা বৈজ্ঞানিক জার্নালে প্রবন্ধ প্রকাশ করাটাও মস্তিষ্কের ভিতরে ঘটয়া ক্রিয়া-বিক্রিয়ার ফলাফল বলেই বস্তুবাদী ডানপন্থী-নাস্তিকের কাছে মনে হয়। কোন এক অজানা কারণে লিবারেল নাস্তিকরা হয়তো এখনো শরীর আর আত্না নামক লৌকিক ও অলৌকিক দুইটা বিষয়ে আস্থা রাখেন বলে মনে হয়। যেকারণে তারা বাস্কেটবলের সাফল্যে পার্থক্য মানতে পারেন কিন্তু অস্কারে পার্থক্য মানতে পারেন না।
জাতিগত পার্থক্যের এই ব্যাপারগুলো দীর্ঘদিন যাবৎ কেবল একাডেমিয়ার একটা ক্ষুদ্র কোণেই আলোচিত হত। এমনিতে বর্তমানের ইউরোপ আমেরিকার মত বিভিন্ন মিশ্র জাতিসত্তার জায়গাগুলোতে জাতিগত স্টেরিওটাইপ, অর্থাৎ সমাজ ও অর্থনীতির কোন একটা বিশেষ ক্ষেত্রে কোন একটা নৃতাত্তিক গোষ্ঠীর আধিপত্য বা কোন একটা গোষ্ঠীর প্রায় অনুপস্থিতি মোটামুটি পরিচিত হলেও তেমন বড় কোন সমস্যার তৈরী করে নি অনেকদিন। এশিয়ান (চীন,জাপান,কোরিয়া) বংশোদ্ভুত আমেরিকানদের একাডেমিক সাফল্যে অন্যদের তুলনায় এগিয়ে থাকা, ভারতীয় বংশোদ্ভুতদের আইটি সেক্টরে আধিপত্য, কালো আমেরিকানদের বাস্কেটবল, দৌড়, জ্যায ও র্যাপের জগতে আধিপত্য, ইটালিয়ানদের রেস্তোরা ব্যবসায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা, ইহুদিদের মিডিয়া, কমেডি ও ব্যাংকিং সেক্টরে আধিপত্য এইসব বিষয় বিভিন্ন সময়ে আলোচনার বিষয়বস্তু হলেও, মূলত হাস্যতামাশা ও সময়ে সময়ে প্রায়-পাগল কনস্পিরেসি থিউরির প্রবক্তাদের আলোচনার বাইরে সম্মিলিত সমাজের মিথস্ক্রিয়ায় এগুলো তেমন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিলো না তেমনভাবে কখনোই। অবশ্য এইসব স্টেরিওটাইপ ঠিক কতখানি একেবারে শক্তপোক্ত প্রমাণভিত্তিক বিষয় আর কতখানি মানুষের মধ্যে একেকটা জাতির তৈরী হওয়া ইমেজের কারণে তার দৃষ্টিভংগী জীবন ও জগতকে ঐভাবে দেখে বলে তৈরী হওয়া সেটা সবসময়ই প্রাণবন্ত তর্কের জায়গা ছিলো। কনফার্মেশন বায়াস এক্ষেত্রে বড় একটা ভূমিকা অবশ্যই রাখে। যেমন কেউ যদি কোথাও থেকে একটা ধারণা পায় যে এশিয়ানরা পড়ালেখায় ভালো করে তাহলে সে কেবল বিভিন্ন জায়গায় প্রথম/দ্বিতীয় হওয়া এশিয়ানদের কথাই মনে রাখবে, অন্যদের কথা ভুলে যাবে। এভাবে তার মনে স্টেরিওটাইপ আরো ধীরে ধীরে শক্তিশালী হবে। আবার মাঝে মাঝে বিভিন্ন পেশা ও ক্ষেত্রের জাতিগত বিন্যাসের জরীপ থেকে এইসব স্টেরিওটাইপ যে পুরোপুরি সামাজিক বিনির্মান নয়, তথ্যগত ভিত্তিও আছে সেগুলোও উঠে এসেছে। এসব তথ্যকে অবশ্য দুইপক্ষ দুইভাবে বিশ্লেষণ করে এসেছে। যারা সামাজিকভাবে নির্মিত চেতনার প্রভাবে বিশ্বাসী তারা জাতিগত বিন্যাসকে সেই দিক থেকে ব্যাখ্যা করেছে, যারা প্রাকৃতিক প্রবণতা ও ঐতিহাসিক ঘটনার প্রেক্ষাপটের প্রভাবে বিশ্বাসী তারা সেসব দিয়ে জাতিগত বিন্যাসকে ব্যাখ্যা করেছে।
আপাত নিরীহ এই জাতিগত বিন্যাসের ব্যাপারটিতে নতুন সহস্রাব্দে এসে প্রথম বড় ধাক্কা ও প্রথম বড় তিক্ত রাজনৈতিক বিরোধের সূচনা হয় ট্রেভন মার্টিন নামের এক কালো আমেরিকান এর পুলিশের গুলিতে মৃত্যু হওয়ার পরে। আসলে তার মৃত্যুর মামলায় অভিযুক্ত পুলিশ অফিসার জর্জ জিমারম্যান এর নিঃশর্ত মুক্তির রায়ের পরে। শুরু হয় ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার আন্দোলনের। এ আন্দোলনের প্রবক্তাদের উদ্দেশ্য ছিলো কালো-আমেরিকানদের উপর পুলিশি সন্দেহ ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে। তাদের ভাষ্যমতে আমেরিকান সমাজে কালোদের বিরুদ্ধে প্রচলিত স্টেরিওটাইপ ও বর্ণবাদী চেতনার কারণেই মূলত পুলিশি হয়রানি ও অন্যান্য নির্যাতনের শিকার বেশি হতে হয় তাদের। অন্যায় হয়রানি ও নির্যাতনের পক্ষে আসলে ডান বাম কোন শিবিরের কেউই ছিলো না। বিরোধিতার জায়গাটা মূলত তৈরী হয় এইসব অন্যায় নির্যাতনকে কি কাঠামোগত বর্ণবাদের ফলাফল হিসাবে দেখা হবে নাকি বাস্তব ক্ষেত্রে দেখা যে অবৈধ ড্রাগ ব্যাবসা ও অপরাধজগতের অন্যান্য ক্ষেত্রে কালোদের সংখ্যাগরীষ্ঠতার ফলাফল হিসাবে দেখা হবে। আদতে অতখানি বড় ও বিরোধিতার জায়গা ছিলোনা। কাঠামোগত বর্ণবাদ এবং স্টেরিওটাইপ ভিত্তিক চিন্তার একটা প্রভাব আছে এক্ষেত্রে সেটাও অন্তত লিবারেলদের মধ্যে সব পক্ষই স্বীকার করে। বিরোধিতা হচ্ছে প্রথমত এটাই কি একমাত্র অথবা সবচে বড় অনুষংগ নাকি অন্যান্য ব্যাপারও বিবেচনায় আনতে হবে তা, এবং দ্বিতীয়ত এই চক্র ভেংগে বের হওয়ার জন্য, বের করে আনার জন্য কালোদের ও অন্যান্য জাতিদের কি করণীয় তা নিয়ে।
এখানে দীর্ঘদিন ধরে একাডেমিয়ার এক কোণে চলতে থাকা একটা দার্শণীক বিরোধ নতুনভাবে সামাজিক আলোচনার কেন্দ্রে উঠে আসে। আচরণবাদী ও সামাজিক বিনির্মানই মানুষের সমাজের সমস্ত দিক নিয়ন্ত্রণ করে এই ধারণায় বদ্ধমূল থাকা মূলত সমাজবিজ্ঞানীরা জাতিগত স্টেরিওটাইপকে সামাজিক বিনির্মাণকেই জাতিগত স্টেরিওটাইপের প্রধান এবং অনেকটা একমাত্র কারণ বলেই মনে করেন। এদের ভাষ্যমতে আমাদের বিভিন্ন আচরণের মধ্যে, বিভিন্ন শব্দের মধ্যে জাতিগত স্টেরিওটাপ ঢুকে আছে বলে শিশুরা বড় হতে হতে এইসব শব্দের ভিত্তিতে এইসব আচরণের ভিত্তিতে সমাজকে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে যায়। ফলত নিজেদের স্বাতন্ত্র বিচার ও তথ্যগত যাচাইয়ের আগেই কোন একটা জাতি নিয়ে কোন একটা গোত্র নিয়ে প্রচলিত ধারণাগুলো একেবারে নিজেদের সুচিন্তিত মতামত বলে আত্নস্থ করে নেয় নিজেদের অজান্তেই। অন্যদিকে বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞান, নৃতত্ত্ব ও মানুষের মস্তিষ্ক ও কগনিশন নিয়ে কাজ করা বিজ্ঞানীদের একটা বড় অংশের ভাষ্য ছিলো মানব-শিশু অতখানি ম্যানিপুলেটযোগ্য মস্তিষ্ক নিয়ে জন্মায় না। চিন্তা-পদ্ধতি, সংখ্যা ধারণা, জগতের কাঠামোবদ্ধতা এইসব নিয়ে একটা প্রাথমিক হার্ডওয়্যার সাথে নিয়েই সে জন্মায়। পরবর্তীতে জীবনের বিভিন্ন অভিজ্ঞতা ও সমাজের শিক্ষার ভিত্তিতে পরিবর্তন পরিবর্ধনের মাধ্যমে তার নিজের চিন্তা ও দর্শন ঠিক হলেও শুধু শিক্ষা দিয়ে সামাজিকীকরণ দিয়ে তাকে একেবারে যেকোন কিছুতেই পরিণত করে দেয়া যায় না। ক্রমাগত খারাপ শিক্ষা দিয়ে তার রাজনৈতিক ও সামাজিক বিশ্বাসকে হয়তো একটা নির্দিষ্ট ছাঁচে তৈরী করা যায় কিন্তু সেইসব ছাঁচ ভেংগে সত্য জানার চেষ্টা করার মত যোগ্যতা সবার ভিতরেই কম বেশী থাকে। এ ধরণের উদাহরণ বাস্তব জীবনেও অনেক দেখা যায়। আবার অন্যদিকে প্রাপ্তবয়ষ্ক মানুষের উপর পরীক্ষা চালালে যেহেতু সামাজিকীকরণ ও খারাপ শিক্ষার প্রভাব আলাদা করা যাবে না সেহেতু এ ধরণের বিজ্ঞানীরা ভাষা শিক্ষার আগের শিশুদের উপর ও কিছু কিছু ক্ষেত্রে মানুষের মত ভাষা ও শিক্ষাপদ্ধতি না থাকা মানুষের কাছাকাছি প্রাইমেটদের উপর বিভিন্ন পরীক্ষা চালিয়ে তাদের ধারণার পক্ষে বিভিন্ন প্রমাণ ও তথ্য সংগ্রহ করেছেন।
এ জায়গায় সাধারণ লিবারেলদের সাথে ডানপন্থী খেতাবপ্রাপ্ত নাস্তিকদের একটা দার্শণীক বিরোধ প্রকট হয়ে উঠে। লিবারেলদের প্রস্তাবিত সামাজিক বিনির্মাণ তত্ত্বের স্বপক্ষে প্রাপ্ত উপাত্তের পরিমাণ যে খুব সামান্য তা-ই শুধু নয়। অনেক ক্ষেত্রেই অনেকটা পরীক্ষণের অযোগ্য করেই তাদের তত্ত্বগুলোকে যত্নের সাথে ডিজাইন করা হয়েছে বলে মনে হয়। সেটা মানুষের সামাজিকীকরণ নিয়ে হোক বা মানুষের লিঙ্গবৈষম্যের ইতিহাস ও গতিপ্রকৃতি নিয়ে হোক। এই চিন্তাপদ্ধতির একটা লক্ষণ দেখা যায় মানুষের সমাজ, অর্থনীতি, বৈষম্য ও বিভেদের রসায়নকে এদের দৃষ্টিভংগীতে ভিন্ন ভিন্ন ছোট ছোট চেতনা ও কাজের যোগফল হিসাবে নয় বরং একটা গ্র্যান্ড ন্যারেটিভ থেকে দেখার চেষ্টায়। তাদের তত্ত্ব অনুযায়ী মানুষের সমাজের কোন দিককেই আলাদা করে দেখা যাবে না। বরং সমস্ত কিছুকে একটা সর্বময় সর্বব্যাপী কাঠামোর ভিতরে দেখতে হবে। তাদের তত্ত্বসমূহের এজন্য ব্যাপ্তি সাধারণত বিশাল হয়। পুরুষতান্ত্রিকতা, শোষণের কাঠামো, নিপীড়নের ক্ষমতাব্যবস্থা এরকম। আরেকটা লক্ষণ হচ্ছে যখন দৃষ্টিগ্রাহ্য, পরীক্ষণযোগ্য, স্বীকার্য কোন প্রমাণ না পাওয়া তখন খুব দ্রুতই অন্তর্গত, পুরো সিস্টেমব্যাপী সাধারণভাবে ছড়িয়ে পড়া কোন অদৃশ্য চেতনার প্রভাব বলে সমাজ ও জগতের নির্দিষ্ট ঘটনাবলীকে দেখার চেষ্টায় চলে যাওয়া।
বৈজ্ঞানিক পরীক্ষণ বা তত্ত্ব ও প্রতিতত্ত্বের চলাচল নিয়ে এই বিরোধ মীমাংসা হওয়ার কথা নয়। কারণ বিরুদ্ধ পক্ষ কোন নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক ফলাফল নিয়ে তাদের ধারণার বিপরীত কোন বাস্তবতার কথা তুলে আনলেও তাদের সর্বব্যাপী তত্ত্বের আলোকে সেগুলোকেও শোষণের কাঠামোর একটা অনুষংগ বলে চালিয়ে দিবেন শিক্ষা ও সামাজিকীকরণ ও সমাজ কাঠামোকে সমস্ত ধরণের অসুস্থতার উৎস বলা সামাজিক তাত্তিকরা। এই দিকে আলোচনায় খুব বেশি অগ্রগতির সুযোগ নাই বলে আলোচনা উত্তীর্ণ হয় দ্বিতীয় ধাপে। অর্থাৎ সমাজের কোন একটা গোষ্ঠী বা নির্দিষ্ট কোন একটা জাতি যে কারণেই হোক যখন নেগেটিভ স্টেরিওটাইপ ও কাঠামোগত বৈষম্যের শিকার তখন এর থেকে উত্তরণের উপায় কি তা নিয়ে। লিবারেলদের জগতচেতনা অনুযায়ী যেহেতু মানুষের সমাজের সমস্তকিছু সর্বব্যাপী বিভিন্ন কাঠামোর মাধ্যমে ঠিক হয়ে যায় সেহেতু নেগেটিভ স্টেরিওটাইপ ও কাঠামোগত বৈষম্যের অবসানে নির্যাতীত অথবা বৈষম্যের শিকার হওয়া গোষ্ঠীর পক্ষে কিছু করা সম্ভব নয়। সংশোধন বা উন্নয়ন করতে পারে কেবল বর্তমানে নির্যাতকের আসনে বসে থাকা, বর্তমান ব্যবস্থার সুফল ভোগ করা গোষ্ঠী।
চলমান নির্যাতনের দায় কার সেই প্রশ্ন অমিমাংসীত রেখেও এই অবস্থা থেকে বের হওয়ার উপায় ও করণীয় নিয়ে তাই আবার আরেকটি তিক্ত বিভাজন দেখা দেয় লিবারেল ও ডানপন্থী নাস্তিকদের মধ্যে। ডানপন্থী নাস্তিকদের বিশ্বাস যেহেতু মানুষের শক্ত জীবনীশক্তি ও বিবর্তনের লাখ লাখ বছরের সময় পরিক্রমায় টিকে আসা মানুষের যোগ্যতায় তাই তারা মনে করেন চলমান ব্যবস্থা থেকে উত্তরণের সূচনা নির্যাতীতের নিজের পক্ষেও সম্ভব। অবশ্যই নির্যাতককেও নিজেদের অপরাধ ও নির্যাতন সম্পর্কে সচেতন, ওয়াকিবহাল হতে হবে এবং সংশোধণের চেষ্টা করতে হবে। কিন্তু দুইটি প্রক্রিয়ার একক কোন একটা দিয়ে কখনোই পুরো ব্যাপারটা সংশোধন করা যাবে না। যেমন কালোদের বিরুদ্ধে বর্ণবাদের স্টেরিওটাইপের চক্র ভাংগার ক্ষেত্রে যদি কেবল দোষ অন্য জাতিদের এই একটা জায়গায় নিজেদের শক্তির সমস্ত কিছু ব্যয় করা হয় তাহলে এই চক্র সম্ভবত ভাংগবে না। একেবারে এই মুহুর্তের করণীয় হিসাবে নিজেদের বর্ণবাদী চিন্তার কাঠামো তৈরীর জায়গাগুলো সংশোধন শুরু করা যায়, দীর্ঘদিনের নির্যাতন ও অপরায়নের ফলে তৈরী হওয়া পশ্চাৎপদতা কাটানোর জন্য বিভিন্ন ক্ষেত্রে আলাদা কিছু সুযোগ সুবিধা দিয়ে পজিটিভ একটা চক্র শুরু করা যেতে পারে, কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত একক কালো ব্যক্তি ও তাদের সমাজ সামগ্রিকভাবে নিজেদের প্রচেষ্টার ব্যাপারে সক্রিয় না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত উন্নতি সম্ভব নয়। ঝামেলা হচ্ছে নিজেদের প্রচেষ্টার বিন্দুমাত্র উল্লেখেই লিবারেলরা পুরো চিন্তাপদ্ধতিকে আবার ভিক্টিম ব্লেইমিং নামক কাঠামোতে ফেলে দেন।
লিবারেলদের দুই পক্ষের মধ্যে তৈরী হওয়া বিভাজনের ভেদরেখার তিক্ততম ক্ষত এই এক জায়গাতে। কট্টর ডানপন্থী, নাৎসিবাদী বা ধর্মীয় খেলাফতবাদীর কোন লজ্জা নেই, কোন দ্বিধা নেই ভিক্টিমকে ব্লেইম করাতে। তার জীবনবীক্ষা অনুযায়ী নিজেদের জাত বা নিজেদের ধর্মের শ্রেষ্ঠত্বের ধারণা পাকাপোক্ত বলে অন্য জাতকে অন্য গোষ্ঠীকে অন্য ধর্মের অনুসারীকে সে নিজেদের সমপর্যায়ের মানুষ বলে স্বীকার করে না। ফলে প্রাকৃতিক ব্যবস্থার দোহাই দিয়ে হোক বা নিজের প্রস্তাবিত সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী সৃষ্টিকর্তার দোহাই দিয়ে হোক অন্যের ভিক্টিমহুডকে সে জায়েজ এবং অনেক ক্ষেত্রেই দরকারী বলে মনে করে। কিন্তু নিজেদের নাস্তিক, যুক্তি ও সত্যের উপর আস্থা রাখা শ্রেণী হিসাবে মনে করা ডানপন্থী নাস্তিকরা তা পারে না। ভিক্টিম ব্লেইমিং এর অভিযোগ তাই এই শ্রেণীর কাছে অত্যন্ত গুরুত্বের বিষয়। এত গুরত্বের সাথে বিবেচনা করেও এত দায়িত্বের সাথে সমাজের বৈষম্য দূর করার উপায় নিয়ে চিন্তা করার পরও এই অভিযোগ থেকে বাঁচতে না পারার কারণে লিবারেলদের এই মানসিকতাকে ডানপন্থী নাস্তিকরা অন্য একটি বিরুদ্ধ কাঠামোর আলোকে দেখার শুরু করে।
কাঠামোটি হচ্ছে অনন্ত ভিক্টিমহুডের। লৈংগিক, জাতিগত, বর্ণগত, ধনগত বৈষম্য ও শোষণের বাস্তবতা অস্বীকার করা এর উদ্দেশ্য নয়। উদ্দেশ্য হচ্ছে এইযে সমাজের সমস্ত কিছুকে ভিক্টিম মানসিকতা থেকে দেখার চেষ্টা, তার ফলে উৎপন্ন হওয়া দুষ্টচক্রের ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করা। সমাজে নিজের অবস্থান ও নিজের জাতি বা গোষ্ঠীর অবস্থানকে যদি কেবল নিজেদের উপর বৈষম্য ও নির্যাতনের কাঠামো থেকে দেখা হয় তাহলে প্রথমত এইসব বিন্যাসের পিছনে যে অনেক ধরণের আলাদা আলাদা অনুষংগের আলাদা আলাদা প্রভাব ও তাদের মিথস্ক্রিয়ায় উৎপন্ন একটা বিশাল গবেষণাযোগ্য ক্ষেত্র রয়েছে সেটার অনুসন্ধান পুরোপুরি নাই হয়ে যায়। সত্য কারণের অনুসন্ধান বন্ধ হয়ে গেলে সত্য সমাধাণের পথও কোনদিন খুলবে না। দ্বিতীয়ত এই ধরণের দৃষ্টিভংগী ব্যক্তির ও সমাজের নিজেদের উত্তরণ চেষ্টার মনোবল ভেংগে দেয়। কালো আমেরিকান যদি মনে করে তার জীবনের সমস্ত ব্যর্থতা, সমস্ত অপূর্ণতা, সমস্ত অসুস্থতার মূলে কেবল অন্যদের জাতিগত বিদ্বেষ ও বর্ণবাদের ফলাফল তাহলে তার ভিতরে নিজেদের উন্নত করার চেষ্টা আসবে না। ব্যক্তি নারী যদি মনে সমাজের ভিতরে তার অবস্থান, শিক্ষায় তার পশ্চাৎপদতা ও বিজ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে তার অবস্থানের অনুপাত যে নগণ্য এসবের সমস্তই কেবল সমাজের সর্বব্যাপী লৈংগিক রাজনীতির ফলাফল তাহলে কোন একটা ক্ষেত্রে তার সফল হওয়ার চেষ্টা করা অর্থহীন। সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের সর্বময় পরিকল্পণায় নিজের ব্যক্তিগত প্রচেষ্টা ও চেতনার কোন মূল্য নাই বলে চলৎশক্তিহীন হয়ে সবকিছু ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দেয়ার মানসিকতার সাথে পার্থক্য নাই কোন।
অনন্ত ভিক্টিম মানসিকতার এই রাজনীতি কেবল আমেরিকান সমাজে কালোদের বিরুদ্ধে বর্ণবাদ ও সামগ্রিক বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে নারীদের পিছিয়ে পড়ার কারণ ও প্রতিকার চেষ্টার ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ থাকে নি। নতুন সহস্রাব্দের শুরু থেকে মানুষের সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনের প্রায় সমস্ত ক্ষেত্রকেই ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে এই চিন্তার প্রসার শুরু হয়। জন্ম হয় ইন্টারসেকশনাল ফেমিনিজম এর। বাংলায় হয়ত বলা যায় সম্মিলিত নারীবাদ। ধারণটা এমন যে একজন মানুষ তার জীবনের বর্তমান পর্যায়ে তার যে নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য যেমন লিঙ্গ বা গায়ের রং এর জন্য বৈষম্যের শিকার হচ্ছে সেটাই তার সার্বিক অবস্থানের ব্যাখ্যায় যথেষ্ঠ নয়। শুধুমাত্র নারীবাদের আলোকে একজন মানুষের জীবন-অভিজ্ঞতা ও সামাজিক অবস্থানের সমস্ত কিছু ব্যাখ্যা না করে, তার জীবনের বর্তমান অবস্থানকে অনেকগুলো পথ-পরিক্রমার একটা শেষ বিন্দু ধরা যায়। যেমন ধরা যাক একজন সমকামী নারী ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে আমেরিকাতে অভিবাসী হয়েছেন। তার জীবনের অভিজ্ঞতা কেবল কথিত পুরুষতন্ত্রের কাঠামোর ভিতরে থেকে বৈষম্যের শিকার হয়ে উপরে উঠে আসার চেষ্টা নয়। সমকামী হিসাবে, গায়ের চামড়ার জন্য, শারিরীক আকৃতির জন্য, ধর্মের পার্থক্যের জন্য এরকম আরো অনেকগুলো ক্ষেত্র মিলিয়ে তার বর্তমান পরিস্থিতি। সম্মিলিত নারীবাদ বা ইন্টারসেকশনাল ফেমিনিজম তাই গোটা সমাজব্যবস্থাকে আক্রমণ করতে চায় প্রত্যেক নির্যাতীতের সমস্ত অভিজ্ঞতার আলোকে, সমস্ত সংঘর্ষবিন্দু থেকে। যুক্তি হচ্ছে একটা নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যের কারণে ঘটা বৈষম্য কেবল আলাদা একটা ক্ষেত্রে এককভাবে আটকে থাকে না। বরং বৈষম্যের নানা অনুষংগগুলো একটা অপরটাকে বিবর্ধিত করে। অর্থাৎ একজন কালো চামড়ার নারীর অভিজ্ঞতাকে কেবল কালো চামড়া ও নারীর অভিজ্ঞতার যোগফল হিসাবে দেখলে হবে না বরং এই দুই বৈশিষ্ট্য একত্র হওয়ার কারণে তার কিছু স্বতন্ত্র বৈষম্য ও নির্যাতনের অভিজ্ঞতা থাকবে যেগুলো কালো চামড়ার পুরুষ আর সাদা চামড়ার নারীর অভিজ্ঞতাকে একত্র করলেও পাওয়া যাবে না।
এগুলো সবই অনুধাবনযোগ্য। এমন কোন উদ্ভট কথা নয় যা খুব বেশি তুমুল কোন বিরোধিতার সৃষ্টি করে। কিন্তু কথা হলো, যেখানে কেবল বর্ণবাদের অভিজ্ঞতাকেই প্রাকৃতিক প্রবণতা, আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা, বৈশ্বিক ইতিহাসের ঘটনাক্রম থেকে পুরোপুরি আলাদা করা যায় না, সেখানে আরো কয়েক পরতের বৈশিষ্ট্য এবং তার সাথে সাথে তাদের মিথস্ক্রিয়ার ফলাফলকে যোগ করলে সমাজের বর্তমান নির্যাতন ও বৈষম্যের কাঠামো বুঝার চেষ্টা করাটা প্রায় পুরোপুরি অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। এই জায়গায় এসে আমাদের কথিত ডানপন্থী নাস্তিকদের কাছে ব্যাপারটা ইচ্ছাকৃত ধোঁয়াশা তৈরীর চেষ্টা বলে মনে হতে থাকে। ধার্মিকদের প্রস্তাবিত ঈশ্বরের ধারণাতে যেমন অনেক রকমের বৈশিষ্ট্য ঈশ্বরের সাথে যোগ করে তাকে পুরোপুরি যৌক্তিক ও বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ার বাইরের কোনকিছুতে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হয়, যাতে কোনভাবেই তাকে প্রমাণ বা খন্ডন করা মানুষের পক্ষে অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়, ঠিক তেমনভাবেই সমাজের বৈষম্য ও নির্যাতনের কাঠামোকে এমন একটি দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে যাতে একে বিশ্লেষণ ও প্রতিকারের কোন চেষ্টাই আর করা না যায়। পশ্চিমা লিবারেল ইন্টারসেকশনালিস্টদের পক্ষে আলোচনাকে এইদিকে নিয়ে যাবার একটি সুবিধা হচ্ছে বিরুদ্ধ পক্ষের কোন যুক্তিকে আর সরাসরি ফেইস করতে হয় না এই কাঠামো থেকে সমাজকে দেখলে। বর্তমান অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য ব্যক্তির নিজের ইচ্ছা বা প্রচেষ্টা আছে কি নাই সেই প্রশ্নে যাবার আগেই সমস্ত আলোচনাকে ভন্ডুল করে দেয়া যায় শত শত ইন্টারসেকশনাল পয়েন্টের পরিমাপ-অযোগ্য মিথস্ক্রিয়ার ফলাফল দিয়ে।
ইন্টারসেকশনালিজম এর আলোচনায় আক্ষরিক অর্থেই ব্যক্তির বর্তমান সামাজিক অবস্থানের ব্যাখ্যায় হাজির করা শুরু হয় শত শত অনুষংগ ও বৈশিষ্ট্যকে। বর্ণবাদ, লিঙ্গবাদ ও সামাজিক শ্রেণীর সাথে যোগ হয় জন্মগত শারিরীক অক্ষমতা, মানসিক ব্যাধি, দৈহিক স্থূলতা, রুপান্তরকামীতা, ঔপনিবেশিক শাসনের ফলাফল এমনকি শরীরের দুর্গন্ধ পর্যন্ত। অর্থাৎ এই জাতীয় যতরকমের অনুষংগ ও বৈশিষ্ট্য ব্যাক্তির সামাজিক অবস্থানের সাথে জড়িত তার সবগুলো মিলিয়ে একটা জগাখিচুড়ি। এই জগাখিচুড়ি আবার সামনে নিয়ে আসে অনন্ত ভিক্টিম মানসিকতার ব্যাপারটি। গাত্রবর্ণ ও লিঙ্গের মত বৈশিষ্ট্য যেসবের সাথে ব্যাক্তির নিজস্ব পছন্দ-অপছন্দ বা তার নিজের কর্মস্পৃহার সম্পর্ক খুবই সামান্য তার সাথে সমানতালে যোগ করা হয় দৈহিক স্থূলতা, শরীরের দূর্গন্ধ আর মানসিক সামর্থ্যের ব্যাপারগুলোকে। উদ্দেশ্য হচ্ছে গাত্রবর্ণের মত দৈহিক স্থূলতাকেও ব্যক্তির নিজস্ব এখতিয়ারের বাইরের কোন বিষয় বলে চালিয়ে দেবার চেষ্টা যাতে করে গাত্রবর্ণের জন্য অনুভব করা বৈষম্য ও দৈহিক স্থূলতার জন্য অনুভব করা সমাজের কাছ থেকে বা সম্ভাব্য যৌনসংগীর কাছ থেকে পাওয়া প্রত্যাখান দুইটাকেই সমাজের সার্বিক অবিচার ও বৈষম্য বলে চালিয়ে দেবার চেষ্টা।
আর্থসামাজিক অবস্থান তথা ধন-তান্ত্রিক ব্যবস্থার অকার্যকারীতার ফলে ব্যাক্তির অর্থনৈতিক নাজুকতার ব্যাপারটি লিবারেলদের কাছে কখনোই পুরোপুরী ব্যাক্তির নিজস্ব দায়ের ব্যাপার ছিলো না। ডানপন্থী নাস্তিকদের কাছেও না। যদিও নাস্তিকদের একাংশ ঐতিহাসিকভাবেই লিবারটেরিয়ানিজম ঘরানার সমর্থক ছিলো আগে থেকেই, তবু ব্যক্তির সমস্ত অর্থনৈতিক অসহায়ত্বের দায় তার নিজস্ব কর্মস্পৃহার ঘাটতির কারণে তৈরী হওয়া, এমন চরমপন্থী মতামত খুব কম সংখ্যক লিবারেল নাস্তিকই ধারণ করতো। ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সমাজের সার্বজনীন সম্পদের ব্যাবহার ও বণ্টনে বৈষম্যের কারণে ব্যাক্তির অর্থনৈতিক অসহায়ত্বের দায়ের একাংশ সিস্টেমের উপরও বর্তায় সেটা সবাই মেনে নিয়েছিলো। কাঁচা ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থা সবার জন্য বসবাসযোগ্য ও ন্যায্য সমাজ তৈরী করতে পারে না সেটাও সবাই মেনে নিয়েছিলো।
কিন্তু ব্যক্তির আর্থিক অসহায়ত্ব আর তার গাত্রবর্ণকে যেমন একইভাবে দেখা যায় না, তেমনি তার দৈহিক স্থূলতা আর গায়ের দুর্গন্ধকেও কোনভাবেই আরসব সিরিয়াস বিষয়ের সাথে একত্র করা যায় না এটা ডানপন্থী নাস্তিকদের সাথে লিবারেল নাস্তিকদের বিভাজনের বড় একটি অনুষংগ হয়ে দাঁড়ায়।
বৈশ্বিক রাজনীতি ও দর্শনের আলোচনায় ইন্টারসেকনালিজমের মত ধারণাকে অতখানি জোরের সাথে চাপিয়ে দেবার প্রচেষ্টার সত্যিকারের কারণ আসলে কেউ-ই পরিষ্কার করে ধরতে পারে নি। ডানপন্থী নাস্তিকদের কাছে মনে হয়েছে হয়তো আসলে নারীবাদের মৌলিক বিষয়গুলো যেহেতু পশ্চিমে নীতিগতভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে সেহেতু নারীবাদ নামক আন্দোলন আলাদা করে চালিয়ে যাবার প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে, সেহেতু অন্য যেকোন কিছুকে অবলম্বন করে যেভাবেই হোক পেশাগত নারীবাদীদের নিজ পেশায় টিকে থাকার প্রাণান্ত চেষ্টা এই ইন্টারসেকনালিজম। আবার অন্যদিকে পশ্চিমের লিবারেলদের হয়তো মনে হয়েছে গত কয়েক শতকের বর্ণবাদী ও ঔপনিবেশিক শাসন-ব্যবস্থাই বর্তমান বিশ্বের সমস্ত রকমের অসুস্থতা ও বৈষম্যের জন্য দায়ী, তাই এইসব অসুস্থতা বৈষম্য ও অন্যায়ের সমস্ত রকমের প্রতিকারের দায়ও বর্ণবাদী ও ঔপনিবেশিক ব্যবস্থার সুবিধাভোগীদের নিতে হবে। ব্যাক্তি, জাতি বা সমাজের কোন করণীয় কর্তব্য প্রস্তাব করার চেষ্টাকে দেখা হবে ভিক্টিম-ব্লেইমিং হিসাবে।
—
ইতিহাসের ঘটনাপ্রবাহ, অন্যায় অবিচার ও তার প্রতিকারের দায় বর্তমানের উত্তরপ্রজন্মের উপর চাপানোর প্রচেষ্টার মধ্যে বিপদ অনেক রকমের। প্রথমত এই প্রস্তাবণার ভিতরেই যে দগদগে বর্ণবাদের ছাপ লেগে আছে তা কিভাবে বর্ণবাদ ও সকল রকমের বৈষম্যের তুমুল বিরোধী লিবারেলদের চোখ এড়িয়ে যায় এই ব্যাপারটা কিছুতেই ডানপন্থী নাস্তিকদের মাথায় ধরে না। কয়েক প্রজন্ম আগের একটা গোষ্ঠীর লোকজন অন্য গোষ্ঠীর উপর বৈষম্য ও নির্যাতন চালিয়েছে বলে নির্যাতকের উত্তর প্রজন্মকে নিজেদের কোন দোষ না থাকা স্বত্তেও তাদের সম্প্রদায়ের দোষের ভাগী হতে হবে, তাদের বর্তমান ন্যায্য দাবী-দাওয়া ছেড়ে দিয়ে আগের যুগের বৈষম্যের প্রতিকার করতে হবে ? অর্থাৎ ব্যাক্তির নিজের কাজ নয় বরং তার সম্প্রদায়ের কাজ দিয়ে তার করণীয় ও অস্তিত্ত্বের যৌক্তিকতা বিচার হবে, এ যদি বর্ণবাদ সম্প্রদায়বাদ না হয় তাহলে এইসব শব্দকে নতুন করে সংজ্ঞায়িত করতে হয়। অবশ্য সেই চেষ্টা যে একেবারে চলছে না তা নয়। ইন্টারসেকনালিজম যুগের পশ্চিমা লিবারেল রাজনীতির দর্শন অনুযায়ী বর্ণবাদী ও লিঙ্গবাদী আচরণ ও কথার জন্য দোষী হবে একমাত্র সাদা, পুরুষ ও ধনীরা। নারীর, কালোদের, সমকামীদের, মোটাদের, মুসলিমদের কোন কাজ বা কথা কিছুকেই বর্ণবাদ বা লিঙ্গবাদের আলোকে দেখা যাবে না। ইসলামি জিহাদীদের সন্ত্রাসী কার্যকলাপের আলোচনায় এজন্য বারবার ঐতিহাসিক অবিচার, মধ্যপ্রাচ্যে পশ্চিমা দেশগুলোর আগ্রাসী রাজনীতি, হেগেমনি আর গ্র্যান্ড-ন্যারেটিভকে টেনে আনা হয়। নির্যাতীত হোক বা নির্যাতক একক ব্যাক্তির অতি-সাধারণ সিভিল দায়িত্বও আর সাধারণ জ্ঞানের প্রসংগকে এড়িয়ে যাওয়া হয়। এরই সূত্র ধরে বাংলাদেশে আর্মির মেজরের স্ত্রী তার বাসার কাজের মেয়ের উপর ভয়াবহ শারিরীক নির্যাতন চালালেও তার আলোচনায় একক ব্যাক্তির অতি সাধারণ মানবিকতার বদলে বরং সমাজের গ্র্যান্ড ন্যারেটিভ আর মেইল হেগেমনির সাথে মেজরের স্ত্রীও আসলে একজন নির্যাতীত নিষ্পেষিত নারী সেইসব কিচ্চার আসর বসে।
সমাজের বর্তমান অবিচার ও অসুস্থতার সমস্ত দায় ঐতিহাসিক অবিচার, বর্ণবাদ আর ঔপনিবেশিক শোষণের মহাগল্পের আলোকে বিচার করার চেষ্টা থেকে পশ্চিমের লিবারেলদের চেতনায় বর্তমানের পশ্চিমের একমাত্র করণীয় হচ্ছে অবিরত নতজানু হয়ে থাকা, অবিরত নিজেদের সমস্ত কিছু দিয়ে, সমস্ত সম্পদ ও সময় দিয়ে তাদের তিন প্রজন্ম আগের পূর্বপুরুষের কৃতকর্মের প্রায়ঃশ্চিত্ত করা। মধ্যপ্রাচ্যে নিজেদের রক্তলিপ্সু অসুস্থ দর্শনের কামড়াকামড়িতে এক পক্ষ আরেক পক্ষের কাছ থেকে দৌড়ানি খেয়ে পালাতে চাইলে তাদের সবাইকে বিনা বিচারে বিনা শর্তে ইউরোপে আশ্রয় দিতে হবে। লিবারেল আর ডানপন্থী নাস্তিকদের মধ্যে দর্শনের জায়গা থেকে সরে এসে সত্যিকারের রাজনৈতিক দ্বন্দের একটা সূচনা হয় এই প্রশ্ন ধরে। কথিত ডানপন্থী নাস্তিকদের মতামত ছিলো বর্তমানের দুনিয়ার প্রত্যেক দেশের, প্রত্যেক সম্প্রদায়ের অধিকার আছে নিজ দেশের, নিজ অঞ্চলের সুবিধা ও অসুবিধা অনুযায়ী কতটুকু সাহায্য অন্যকে করতে পারবে কি পারবে না তা ঠিক করার। ব্যাক্তিগত পর্যায়ে এই নীতি অনেক আগে থেকেই সর্বজনস্বীকৃত। নিজে ডুবে যাচ্ছে এই অবস্থায় অন্যকে বাঁচানোর মহানুভবতা কেউ কেউ দেখাতে পারে, কিন্তু কখনোই সেটা কারো জন্য কর্তব্য বলে ঠিক হতে পারে না। মধ্যপ্রাচ্য থেকে শরনার্থীদের ঢল ইউরোপের দিকে রওনা হওয়া শুরু করলে, নিজেরা ডুবে হলেও পূর্বপুরুষের কৃতকর্মের প্রায়ঃশ্চিত্ত করার জন্য সবাইকে আশ্রয় দিতে হবে, লিবারেলদের এই দাবীর মুখে আত্ননিয়ন্ত্রণের অধিকারের দাবী নিয়ে আলাদা হয়ে যায় ডানপন্থী নাস্তিকরা। অর্থনৈতিক ও সামাজিক আরো অনেক রকমের সংঘর্ষের সাথে সাথে শরণার্থীদের সহায়তার ব্যাপারে এই কট্টরপন্থার কারণে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন থেকে ব্রিটেনের বের হয়ে যাওয়াকে সমর্থণ করে ডানপন্থী নাস্তিকরা। বাস্তবের ময়দানে সাধারণের মতামত পরিবর্তনে এই ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর সত্যিকারের প্রভাব কতটুকু ছিলো সেটা পরিমাপ করা সম্ভব না হলেও অন্তত ইন্টারনেটের দুনিয়াতে এই বিভাজনের প্রতিধ্বনি ছিলো অনেক দিন।
দ্বিতীয়ত ঐতিহাসিক অবিচার ও বৈষম্যের প্রতিকারের দায় উত্তর প্রজন্মের উপর চাপানো ও ঐতিহাসিক অবিচারের জন্য উত্তরপ্রজন্মকে দায় মাথায় নিয়ে নতজানু হওয়ার জন্য জোর করার ব্যাপারটি অত্যন্ত বিপদজনক আরেকটি প্রক্রিয়ার জন্ম দিয়ে এসেছে মানুষের ইতিহাসে বারবার। গণহত্যার। প্রতিটি গণহত্যা দম বন্ধ করে দেয়ার নৃশংসতা, রক্তপাত ও ধ্বংসের এক চূড়ান্ত অর্জি হলেও প্রায় সমস্ত ক্ষেত্রেই এই প্রক্রিয়ার শুরু নৈতিক ও আদর্শিক উন্নত চেতনা থেকেই, যে চেতনা পশ্চিমের লিবারেলরা এখন ধারণ করে ও যেই চেতনা ধারণ করে না বলে ডানপন্থী নাস্তিকদের নরকের সর্বনিম্ন স্তরের কীট বলে মনে করে তারা। ইহুদিদের পূর্বপুরুষরা যিশুকে অন্যায়ভাবে ক্রুশবিদ্ধ করেছে বলে তাদের পাপের ফল ভোগ করতে গিয়ে হিটলারের হলোকাস্টের অনেক আগে থেকেই ইউরোপজুড়ে ইহুদিরা বারবার গণহত্যার ও নির্যাতনের শিকার হয়েছে। ধনিক শ্রেণীর শোষণের ও নির্যাতনের প্রায়শ্চিত্ত করার জন্য রাশিয়ায়, চীনে, কম্বোডিয়ায় কোটি কোটি মানুষকে হত্যা করেছে চির-নির্যাতীত শ্রমিক ও সর্বহারারা নিজেদের উঁচু নৈতিক অবস্থান থেকেই। রুয়ান্ডার তুৎসীদের অতীত অন্যায় ও নির্যাতনের প্রতিকার করতে গিয়ে নিজেদের ন্যায়ের পক্ষের সেনানী মনে করেই হুতুরা ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো হত্যা, নৃশংসতা, বিভৎসতার অর্জিতে। মানুষের সার্বিক ইতিহাসে এসব উদাহরণের কমতি যেমন নাই তেমনি বিস্ময়করভাবে প্রতিটা নৃশংসতার পক্ষের যুক্তি দেয়া লোকের অভাব নাই এখনো। ন্যায়ের ও নির্যাতীতের পক্ষের সেনানীরা বরং সেই দিক থেকে বেশী ভয়ংকর।
—
এখন কথা হচ্ছে ন্যায়ের ও নির্যাতীতের পক্ষের বিনিদ্র সেনানী হিসাবে ক্ষমাগত ক্ষোভ ও ঘৃণার রাজনীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত লিবারেলদের কাছ থেকে ডানপন্থী নাস্তিকরা ঠিক ইতিহাসের এই পর্যায়ে এসে কোন ধরণের গোষ্ঠীর উপর গণহত্যা ও বিভৎসতা চালানোর আশংকা করছে এই প্রশ্ন করা হলে উত্তর দেয়া খুব সহজ নয়। অন্যসব গণহত্যার ক্ষেত্রেও পরবর্তী যুগের বিশ্লেষণে যখন দেখা গেছে গণহত্যার প্রথম বীজটা যখন রোপন করা হয়েছে তখন সেটার সম্ভাবনা নিতান্তই হাস্যকর ছিলো। শ্রমিকের মনে যখন অসন্তোষ আর সর্বশেষ সমাধানের চিন্তা উঁকিঝুঁকি দিচ্ছিলো তখন জমিদারের মনে নিশ্চয় কৌতুকই ছিলো, ছোটলোকের জাত আবার আন্দোলন করবে ! বর্তমানের দুনিয়াতেও আমেরিকান কালোরা সাদাদের উপর গণহত্যা চালাবে কিংবা নারীরা পুরুষদের বিশাল একটা অংশকে হত্যা করে বাকীদের খাঁচার বন্দী জানোয়ারের মত করে রেখে দেবে এই ধরণের চিন্তা অলীক, উদ্ভট, হাস্যকর। এখনকার ঘটনাপ্রবাহ ও বাস্তবতায় বরং যে ধরণের সম্ভাবনা ডানপন্থী নাস্তিকরা দেখে তা হচ্ছে আরো বেশি বিভাজন ও আরো বেশি অপরায়নের। এই বিভাজন ও অপরায়ন কেবল লিবারেল আর ডানপন্থী খেতাবপ্রাপ্ত নাস্তিকদের মধ্যেই ঘটছে তা নয়। বর্ণবাদ, লিঙ্গবাদ, সমকাম-বিরোধিতা, শ্রেণীবৈষম্য, শারিরীক আকৃতিবৈষম্য, মোটাবৈষম্য সহ এরকম সহস্র অন্যায়ের বিরুদ্ধে নিয়ত সোচ্চার ও নিয়ত তেঁতে থাকা লিবারেলরা নিজেদের মধ্যেও বিভাজিত হচ্ছে প্রতিদিন। কারণ নিজেকে ন্যায়ের পক্ষের দুর্নিবার সৈনিক মনে করা একজন লিবারেল অতি তুচ্ছ কোন এক কারণে গতকালের সহযোদ্ধাকে আজ নরকের সর্বনিম্ন কীট বলে ছুঁড়ে ফেলতে দ্বিধা করছে না। এমনকি আরো উদ্ভট ও বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে এইসব সত্যের সেনানীরা যাদের প্রতিরক্ষা ও যাদের প্রতি দায়মোচনের রাজনীতি করছে ও বলা চলে যাদের উপজীব্য করে নিজেদের রাজনীতি চালিয়ে যাচ্ছে তাদের উপর অবিচার ও অন্যায় করতেও পিছপা হচ্ছে না সময়ে সময়ে। বৃহত্তর দুনিয়াতে ন্যায় ও সাম্য কায়েমের যে বিশাল কর্মযজ্ঞে সে নিজে সামিল আছে তার সুবিশাল আমলনামার কাছে এদিক সেদিক ক্ষুদ্র দু একটা অন্যায় খুবই তুচ্ছ, ভাবনা সম্ভবত এইরকম। মাঝে মাঝে বিশাল নারীবাদীদের ব্যক্তিগত জীবনে আরেকজন নারীর উপর নির্যাতনের যেসব কাহিনী দেখা যায় সেসবের পিছনের মনস্তত্ব হয়তো এরকমই।
এমনিতে নারীবাদের দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ পর্যায়ের দর্শন ছড়িয়ে পড়ার পর থেকে পশ্চিমের সমাজের সাসটেইনেবিলিটি ঠিক সুস্থ্য পর্যায়ে নাই। প্রায় প্রতিটি দেশ ভুগছে অতি নিন্ম জন্মহার, পারিবারীক ও সামাজিক ভাংগন এবং জনগণের ক্রম-বিচ্ছিন্নতায়। অর্থনৈতিকভাবে ধ্বসে পড়াকে ঠেকিয়ে রাখা যাচ্ছে কেবল এইসব আন্দোলন যেখানে ছড়িয়ে পড়ে নি, যেখানে জন্মহার এখনো উত্তুংগ পর্যায় আছে, সেসব জায়গা থেকে আসা অভিবাসীদের মাধ্যমে। ঐসব জায়গাতেও যখন একই আদর্শ ও জীবনপদ্ধতি ছড়িয়ে পড়বে তখন আসলে কোনদিকে যাবে মানুষের ইতিহাস কেউ জানে না। ডানপন্থী নাস্তিকদের মধ্যে একাংশ অবশ্য প্রাচীন রোম সাম্রাজ্যের ক্ষয়ের দিনগুলোর সাথে তুলনা করে ভবিষ্যতবাণী করে থাকে যে বর্তমানের পশ্চিমের সমাজ হয়তো একইভাবে ভেংগে পড়বে এবং বর্তমানের পিছিয়ে পড়া গোষ্ঠীগুলোর লুটের মাল হবে। হাজারে হাজারে নিউক্লিয়ার বোম আর প্রায় ঈশ্বরের মত ক্ষমতাবান প্রযুক্তির মালিকরা ওভাবে ধ্বসে পড়বে সেই সম্ভাবনার কথা ভাবাও বেশ অলীক, উদ্ভট ও হাস্যকর।
ভবিষ্যতে গিয়ে দেখে আসার মত টাইমমেশিন যেহেতু নাই সেহেতু সব যুগের সব ভবিষ্যতবক্তারা যার করে গেছেন সেটাই করতে হয়। এ যুগের ক্ষতগুলো আরো বড় হবে, এ যুগের বিচ্ছিন্নতাগুলো আরো চওড়া হবে সে সম্ভাবনার কথা। আদিতে ডানপন্থী খেতাবপ্রাপ্ত নাস্তিক আর সাধারণ লিবারেল বা প্রগতিশীলদের উদ্দেশ্য ও দর্শন কাছাকাছিই ছিলো। সেখান থেকে যে বিভাজন বা বিচ্ছিনতার উম্মেষ, সময়ের সাথে সাথে সেটা হয়তো ছড়িয়ে পড়বে পুরো জনগোষ্ঠীতেই। হতে পারে মানুষের প্রজনন ব্যবস্থাও পাল্টে যাবে আমূল। শিম্পাঞ্জি বা বেবুনের মত মানুষের প্রজনন ব্যবস্থাও নারী পুরুষের দুইটা আলাদা গোত্রের মধ্যে সাময়িক সহযোগীতার একটা ব্যাপার হয়ে উঠতে পারে। নিউক্লিয়ার পরিবারের ভাংগন ও বিলোপকে নারীবাদের প্রধানতম উদ্দশ্য বলে ধার্য করা নারীবাদীদের হয়তো মনযিলে মকসুদে পৌঁছানো হবে এতে। কিন্তু সেই পৌঁছানোর প্রক্রিয়ায় বর্তমানের সুবিধা ও সুযোগ এবং অনেক অভ্যস্ততাও হাতছাড়া হবে সেটা নিশ্চিত। সেই হাতছাড়া হওয়া জিনিসগুলো কিছু পেতে গেলে যে অবশ্যাম্ভাবী কিছু দাম পরিশোধ করা হিসাবে দেখা হবে নাকী আবার কোন বড় ষড়যন্ত্র আবার কোন বিশাল নির্যাতনের সিস্টেমের উপর দায় চাপানোর দুর্বার আন্দোলন চলতে থাকবে সেটা একটা কৌতূহলউদ্দীপক ব্যাপার হবে।
অবশ্য এই পরিবর্তন প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধ-প্রতিক্রিয়াও যে হবে না সেটা বলা যায় না। এমনকি বর্তমানের দুনিয়াতে এরই মধ্যে বিরুদ্ধ্ব-প্রতিক্রিয়ার স্রোতটি শুরু হয়ে গেছে। বিশ্বজুড়ে ঐতিহ্যগত ডানপন্থী-ভাবধারার পুনরুত্থান ঘটছে। কৌতূহল জাগানিয়া ব্যাপার হচ্ছে এই নতুন ডানপন্থার যুক্তি, কর্মপদ্ধতি ও দর্শনের সাথে কিছু কিছু জায়গায় মিল পাওয়া যাচ্ছে বলেই নাস্তিকদের একপক্ষ মূলত ডানপন্থী-নাস্তিক হিসাবে চিহ্নিত হয়েছে লিবারেলদের কাছ থেকে। মধ্যবর্তী আরেকটি দলেরও আবির্ভাব ঘটেছে। যাদেরকে বলা হচ্ছে অন্য-ডান বা alt-right, যাদের দর্শন ও রাজনৈতিক বিশ্বাস আবার ঐতিহ্যগত ডানপন্থীদের বেশ কাছাকাছি। এদের সাথে ডানপন্থী-নাস্তিকদের দার্শনিক ও রাজনৈতিক মিল খুব সামান্য হলেও লিবারেলদের কাছ থেকে দুইপক্ষকেই একই বোতলে ভরে ফেলার প্রবণতা দেখা যায় হামেশাই। মজার ব্যাপার হচ্ছে এইরকম জোরপূর্বক একীভূতকরণের চেষ্টা নিয়ে ডানপন্থী নাস্তিকদের মধ্যে খুব বেশি ক্ষোভ বা প্রতিক্রিয়া নাই। কারণ এক ধরণের বৌদ্ধিক অভিজ্ঞান লাভ হয়েছে এই বিভাজনের গতিপ্রকৃতি ও বিরোধের চলাচলে। সে অভিজ্ঞান হচ্ছে মানুষের একেকটা নির্দিষ্ট দর্শন ও জীবনবীক্ষার মধ্যে খারাপ ও ভালো, ন্যায় ও অন্যায়ের পার্থক্য করার প্রক্রিয়াটি চালু রাখা যায় বটে তবে সেটা তেমন কোন অমোঘ ও অপরিবর্তনীয় বিষয় নয়। ভালো ও খারাপ, ন্যায় ও অন্যায়ের বোঝার বড় অংশটি দর্শন বা জীবনবীক্ষার মধ্যে নেই। সেটা আছে সেইসব দর্শন ও রাজনীতির ধ্বজাধারী মানুষের মধ্যে।
—
এই অভিজ্ঞানের কারণে বিশ্বজুড়ে ডানপন্থার পুনরুত্থানে ঐতিহ্যগত সময়ের মত অতখানি শশব্যস্ত, অতখানি আতংকগ্রস্থ নয় ডানপন্থী নাস্তিকরা। কারণ ডানপন্থার যেসব বিশ্বাস, যেসব কর্মপন্থাকে অযৌক্তিক, অন্যায্য ও খারাপ বলে সেগুলোর প্রতিরোধ করে এসেছিলো লিবারেলদের দুইপক্ষই সেসব বিশ্বাস ও কর্মপন্থা হুবহু একইরকমভাবে পশ্চিমের বর্তমান ন্যায়ের সেনানী লিবারেলদের মধ্যে নগ্নভাবেই দেখা যাচ্ছে। বর্ণবাদ ও অপরায়ন ডানপন্থীরা করেছে গায়ের রং আর নৃতাত্ত্বিক জাত দিয়ে। সেই একই পরিমাণ অথবা তার চাইতে বেশি ঘৃণা ও বিদ্বেষ নিয়ে লিবারেলরাই অপরায়ন আর বর্ণবাদের চর্চা করছে তাদের স্ট্যান্ডার্ড মডেলের দর্শনের চাইতে চুল পরিমাণ বিচ্যুতি দেখানো লিবারেলদের বিরুদ্ধেই। নতুন ডানপন্থার উত্থান বরং ডানপন্থী নাস্তিকদের কাছে কিছুটা আমোদকর কাব্যিক ন্যায়বিচারের মতই। বিরুদ্ধপক্ষের যেকোন মতামত, যেকোন অনুসন্ধিৎসা, বৈজ্ঞানিক কাঁটাছেড়াকে লিবারেলরা এক কথায় বর্ণবাদী, নির্যাতনের সাফাই গাওয়া, ধর্ষণের এপোলেজেটিক বলে উড়িয়ে দিয়ে এসেছিলো, কোন প্রকার যৌক্তিক ও তথ্যগত অংশগ্রহণ ছাড়াই। এখন ট্রাম্পের ‘ফেইক নিউজ’ নামক এক কথা দিয়ে লিবারেলদের সমস্ত যৌক্তিক ও অযৌক্তিক পয়েন্টকে উড়িয়ে দেয়া দেখলে, এবং বিশাল একটা জনগোষ্ঠী ট্রাম্পের সেই কথাকে বিশ্বাস করছে দেখলে, খুবই হাস্যকর রকমের কিন্তু খুবই বাস্তব এই প্রতিসাম্য দেখে এক ধরণের চাপা উল্লাস বোধ করাটা খুব বেশি অন্যায় বলে মনে হয় না। জলবায়ু পরিবর্তনের কাঠামোবদ্ধ সত্য বিজ্ঞানের বিপরীত, নিজের এলাকায় অনেক তুষার পড়ছে বলে বিজ্ঞানীদের এইসব গবেষণাকে বাকোয়াজ বলে উড়িয়ে দেয়া ডানপন্থী পাগলের কথাতে এখন আর খুব একটা রক্ত গরম হয়ে উঠে না ডানপন্থী নাস্তিকদের। কারণ বিজ্ঞান ও যুক্তির অবতার লিবারেলরাও মানুষের বিবর্তনীয় ইতিহাসের আলোকে কঠোর বৈজ্ঞানিক কর্মপদ্ধতি ও মান-নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে গড়ে উঠা বিজ্ঞানের বিশাল এক শাখাকে উড়িয়ে দিয়ে এসেছে, ‘বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞান’, ‘ধর্ষণের সাফাই’, ‘বর্ণবাদের সাফাই’ বলে। এখন নিজেদের তৈরি ওষুধে নিজেদের জিহ্বা পুড়ে গেলে ডানপন্থী নাস্তিকের কাছ থেকে গা-জ্বালানো মুচকি হাসির বদলে অন্য কিছু আশা করা বাতুলতা।
সমস্ত কিছু ব্যাখ্যার পরও লিবারেলদের দুই পক্ষের মধ্যে এই বিভাজনের গভীরতর কারণের ব্যাপারটি অব্যাখ্যাত থেকেই যায়। ঠিক কি কারণে নাস্তিক ও যুক্তি-বিজ্ঞানে আস্থা রাখা দুই গোত্রের মধ্যে এমন তিক্ত বিভাজন শুরু হলো সেটা আরো বিস্তারিত অনুসন্ধানের দাবী রাখে। তবে বর্তমান বাস্তবতা ও ঘটনাপরিক্রমায় মনে হয়ে এই বিভাজন অবধারিত ছিলো। এই দুই পক্ষ নাস্তিকতা ও অলৌকিকতার প্রত্যাখ্যানের বিন্দুতে একত্র হলেও, এই বিন্দুতে আসার পথ পরিক্রমা দুই পক্ষের সম্পূর্ণ আলাদা ছিলো। ঈশ্বরের অস্তিত্ব সম্পর্কে সন্দেহ এবং ধর্মের অসারতার কারণ ডানপন্থী নাস্তিকের কাছে ছিলো, এগুলো মিথ্যা বা প্রমাণ-অযোগ্য। লিবারেলের কাছে ছিলো এগুলো ক্ষতিকর। অবশ্যই, দুইপক্ষই একইসাথে বিশ্বাস করতো এগুলো মিথ্যা এবং ক্ষতিকর। পার্থক্য হচ্ছে কোনটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ কার কাছে। ডানপন্থী নাস্তিকের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে সত্য-মিথ্যা, ক্ষতিকরটা হচ্ছে অতিরিক্ত যোগ হওয়া। ন্যায়ের সেনানী লিবারেলের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে এগুলো ক্ষতিকর, এগুলো যে মিথ্যা সেটা অতিরিক্ত পাওনা। ডানপন্থী নাস্তিক তাই সত্য-মিথ্যার সন্ধানে নিজের একসময়ের রাজনৈতিক বিশ্বাস ও দর্শন থেকে যেদিকেই সরে যাক, সেটাকে পাত্তা দেয় না কারণ সত্যের সন্ধান তার একমাত্র ধ্রুব। ন্যায়ের সেনানী লিবারেল নিজের মতানুযায়ী ন্যায় ও ভালোর সন্ধানে নিজের রাজনৈতিক বিশ্বাস ও দর্শন মিথ্যার দিকে সরে যাচ্ছে নাকি সত্যের দিকে সরে যাচ্ছে সেটাকে পাত্তা দেয় না। কারণ তার কাছে গুরুত্বের জায়গা হচ্ছে ন্যায় ও ভালোর প্রতিষ্ঠা। অনুসন্ধানটা আবেগের। বিপরীতে ডানপন্থী নাস্তিকের অনুসন্ধান কাঠখোট্টা সত্য ও পরীক্ষণলব্ধ প্রমাণের।
মোটাদাগে পশ্চিমা লিবারেল ও ডানপন্থী নাস্তিকদের বিরোধের মূল জায়গাগুলো অনেকটা এইরকম-
- ১- ডানপন্থী নাস্তিকের মতে বর্তমানের বৈশ্বিক রাজনৈতিক বাস্তবতায় ইসলাম ও তার ভিতরে থাকা ভয়ংকর দর্শনগুলো বিরোধিতা করা জরুরী। লিবারেলদের মতে মুসলিমদের বিরুদ্ধে অন্যায্য বর্ণবাদী প্রবণতা বাড়ানোর সম্ভাবণার কথা মাথায় রেখে ইসলামের সমালোচনা আপাতত বন্ধ রাখা উচিত।
- ২- ডানপন্থী নাস্তিকের মতে মানুষের সমাজে নারী পুরুষের অবস্থান ও জীবনাচরণের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের আলাদা শারীরবৃত্ত, আলাদা প্রজনন উদ্দেশ্য এবং আলাদা গঠনের প্রভাব আছে অনেকদূর। সামাজিক বিনির্মাণের প্রভাবও অবশ্যই আছে। কিন্তু সবটাই সামাজিক বিনির্মাণ নয়। নারী পুরুষ সমস্ত ক্ষেত্রে একই রকম হবে এটা সম্ভব যেমন নয়, তেমনি কাম্যও নয়। লিবারেলদের মতে নারী পুরুষের সমস্ত পার্থক্য অন্তত যেগুলো সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনের তার পুরোটাই পুরুষতন্ত্র নামক কাঠামোর বানানো এবং এগুলো পুরোপুরি উঠে গেলে সামাজিক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক জীবনে নারী পুরুষের শতভাগ সাম্য আসবে এবং সেটাই কাম্য। যেসব নারী এরকম চায় না তারাও কেবল ব্রেইনওয়াশের শিকার।
- ৩- ডানপন্থী নাস্তিকের মতে বর্ণবাদসহ মানুষের সমাজের বিভিন্ন গোত্রের মধ্যে বৈষম্য ও অবিচারের যেসব কাঠামো প্রচলিত আছে বর্তমান সমাজে সেগুলোর আলাদা আলাদা উৎপত্তি ও আলাদা আলাদা ঐতিহাসিক পরিক্রমা আছে। সমস্ত অবিচার লুপ্ত হয়ে গেলেও জাতি ও গোত্রসমূহের মধ্যে সব পার্থক্য লুপ্ত হয়ে যাবে না। লিবারেলদের মধ্যে জাতি গোত্র ও গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে সমস্ত পার্থক্যের মূলে রয়েছে সর্বব্যাপী বৈষম্যের কাঠামো।
- ৪- ডানপন্থী নাস্তিকের মতে বর্তমান সমাজের বৈষম্য ও অবিচারের কাঠামো ভাঙ্গার উপায় হচ্ছে বৈষম্য ও অবিচার বন্ধ করে, প্রত্যেক গোত্র ও গোষ্ঠী নিজেদের ভালোর জন্য কাজ করে যাওয়া, অন্যের ক্ষতি না করে। লিবারেলদের মতে বর্তমান বৈষম্য ও অবিচার ও অপ্রতিসাম্য যেহেতু অতীতের বৈষম্য ও অবিচারের ফল, সেহেতু এগুলো বন্ধ করাই যথেষ্ট নয়, সব রকমের ঐতিহাসিক অবিচার অন্যায় ও অসাম্যের প্রতিকার করতে হবে। বর্তমান প্রজন্মকে পূর্ব প্রজন্মের দায় শোধ করতে হবে।
- ৫- ডানপন্থী নাস্তিকের মতে মানুষের রাজনৈতিক ও দার্শনিক উদ্দেশ্যের বাইরেও প্রাকৃতিক সত্য জানার উপায় আছে এবং বিজ্ঞানের মাধ্যমে সেগুলো জানা সম্ভব। লিবারেলদের মতে বিজ্ঞানসহ সমস্ত প্রতিষ্ঠান মিলেই সুবিধাভোগী গোষ্ঠীর স্বার্থ সংরক্ষণ ও অবিচারের কাঠামো টিকিয়ে রাখে।
লেখকঃ মাওলানা দূরের পাখি
অনেক বেশী ভাল লিখছেন
খুব সুন্দর একটা লেখা পড়লাম