রাম কর্তৃক নিরপরাধ শূদ্র শম্বুকের হত্যা
জাতিভেদ হিন্দু সমাজ ও ভারতবর্ষের ইতিহাসে এক কলঙ্কজনক অধ্যায়। সহস্র বছর ধরে ভারতীয় উপমহাদেশ জাতিভেদের বিষবাষ্পে দগ্ধ হয়েছে। আজও হয়ে চলেছে নিম্নবর্ণের মানুষদের ওপরে অকথ্য অত্যাচার। কখনো বা গোঁফ রাখার অপরাধে, কখনো বা ঘোড়ায় চড়ার অপরাধে, কখনো বা মন্দিরে প্রবেশের অপরাধে আজো চলছে নিম্নবর্ণের হিন্দুদের উপর অত্যাচার। এই জাতিভেদের বিভীষিকা এল কোথা থেকে? এর উৎস কি? অনেক হিন্দুই বলে থাকেন, এগুলো মানুষ তৈরি করেছে, ঈশ্বর তৈরি করেনি অথবা এই জাতিভেদ, এসব ধর্মে কোথাও নেই। হিন্দুদের মধ্যে ‘জাতি/ বর্ণ হয় কর্ম গুণে’ এমনও দাবী করতে দেখা যায় আজকাল। এইসব দাবীকারীরা এই বিষয়ে অজ্ঞাত যে, হিন্দুশাস্ত্রের রন্ধ্রে রন্ধ্রে জাতিভেদ মিশে আছে। রামায়ণে জাতিপ্রথার জঘন্য প্রকাশ দেখা যায়, যখন রামচন্দ্র নিরীহ শম্বুককে হত্যা করেন। শম্বুকহত্যা শুধুমাত্র কোনো ব্যক্তিবিশেষের হত্যা নয়, শম্বুক ভারতের আপামর দরিদ্র-শোষিত শ্রমজীবী মানুষদের প্রতিনিধি। শম্বুকের নৃশংস হত্যা শূদ্রদের প্রতি চলে আসা অত্যাচারের ইতিহাস। সেই ইতিহাস মুছবার নয়,ভুলবার নয়।
রামচন্দ্রের শম্বুক হত্যার ঘটনাটি বাল্মীকি ও কৃত্তিবাস উভয়ের রামায়ণেই মেলে।
বাল্মীকি রামায়ণে শম্বুক বধ
একদিন এক ব্রাহ্মণ তার অকালে মৃত বালক সন্তানকে নিয়ে রামচন্দ্রের দরবারে উপস্থিত হন। ব্রাহ্মণটি বিলাপ করতে থাকেন,
“হা! আমি পূর্ব জন্মে কি দুষ্কর্ম করেছিলাম? কোন দুষ্কর্মের ফলে আমি এই একমাত্র পুত্রকে হারালাম? হা বৎস! তুমি অপ্রাপ্তযৌবন বালক, সবে মাত্র ১৫ বছর, তুমি আমায় ফেলে অকালে কোথায় চলে গেলে? আমি ও তোমার জননী আমরা উভয়ে তোমার শোকে অল্পদিনের মধ্যেই দেহপাত করব।” (১)
ব্রাহ্মণের কথানুসারে, তিনি জীবনে কোনো পাপ করেননি, কোনো জীবের প্রতি হিংসা করেননি। পূর্বে রামের রাজ্যে তিনি কখনো কাউকে মরতে দেখে নি, অন্য রাজার শাসনেও এমন কিছু ঘটে না। রামের রাজ্যে যেহেতু এখন অকালে ব্রাহ্মণের বালক মারা গেল, তাহলে নিশ্চয় রামেরই কোনো ঘোর পাপ আছে অথবা রামের রাজ্যের অধিবাসীরা নানা ধরণের পাপ কাজ করে চলেছে এবং রাম তার কোনো প্রতিকারও করছে না; তার ফলেই ব্রাহ্মণের পুত্র মারা গিয়েছে। রাজা অসচ্চরিত্র হলে প্রজার অকালমৃত্যু হয়ে থাকে।রামকে উদ্দেশ্য করে ব্রাহ্মণ বলেন,
“তুমি এই বালককে জীবিত কর, নইলে আমি ও আমার স্ত্রী আজ এই রাজদ্বারে প্রাণত্যাগ করবো।” (১)
রাম ব্রাহ্মণের বিলাপ শুনতে পেলেন। তিনি তার মন্ত্রী, সভাসদ ও পরামর্শ দাতা ঋষিদের ডেকে আনলেন। রামের আহ্বানে বশিষ্ট,মার্কণ্ডেয়, মৌদ্গল্য, বামদেব, কাশ্যপ, কাত্যায়ণ, জাবালি, গৌতম ,নারদ প্রভৃতি ঋষিরা উপস্থিত হলেন। রাম তাদের ব্রাহ্মণপুত্রের অকাল মৃত্যুর কথা জানালেন এবং তার রাজ্যে এভাবে ব্রাহ্মণপুত্রের অকাল মৃত্যুবরণের কারণ জানতে চাইলেন।
তখন নারদ রামকে বলেন,
“সত্যযুগে কেবল ব্রাহ্মণেরা তপস্যা করতেন, অন্যদের তপস্যার অধিকার ছিল না। ব্রাহ্মণেরাই সর্বপ্রধান ছিলেন। এইকারণে এই যুগে কারো অকাল মৃত্যু হত না, সকলেই দীর্ঘজীবি ছিল। তারপর আসে ত্রেতাযুগ। এই যুগে মানুষের ব্রহ্মে আত্মবুদ্ধি শিথিল হয়ে যায় এবং আত্মাভিমানের ফলে ক্ষত্রিয়ের জন্ম হয়। সত্যযুগে তপস্যায় কেবল ব্রাহ্মণেরই অধিকার ছিল কিন্তু ত্রেতায় ক্ষত্রিয়েরাও তপস্যা করতে পারতেন। এই যুগে অধর্ম এক পায়ে আবির্ভূত হয়। অধর্মের আশ্রয় হলে তেজের হ্রাস হয়, এই যুগে তাই ছিল। পূর্বে সত্যযুগে রজোগুণমূলক যে জীবিকা ‘মলের মত অত্যন্ত ত্যাজ্য ‘ ছিল, তার নাম পরে হয় কৃষি । অধর্ম সেই কৃষি রূপ একপাদে আবির্ভূত হয়। অর্থাৎ সত্যযুগের লোকজন কেবল অপ্রযত্নোপলব্ধ ফলমূল খেয়েই বেঁচে থাকতো। অধর্মের এই কৃষি রূপে একপাদে পৃথিবীতে আবির্ভূত হওয়ার কারণে লোকের আয়ু সত্যযুগের চাইতে কমে যায়। ” (১)
“ত্রেতাযুগে ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়েরাই কেবল তপস্যা করতে পারতেন। অন্য বর্ণেরা অর্থাৎ বৈশ্য ও শূদ্রেরা তাদের সেবা করতো। বৈশ্য কৃষি কাজের মাধ্যমে ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয় এই দুই বর্ণের এবং শূদ্র ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য এই তিন বর্ণেরই সেবা করতো। যখন অধর্মের পরিমাণ আরো বেড়ে যায়, অধর্ম দুই পায়ে বিচরণ করে, তখন দ্বাপরযুগে বৈশ্যেরাও তপস্যার অধিকার লাভ করে। অর্থাৎ সত্য, ত্রেতা ও দ্বাপর এই তিনযুগে ক্রমান্বয়ে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য তপস্যার অধিকার লাভ করেছিল কিন্তু এই তিনযুগে শূদ্রের তপস্যার কোনো অধিকার ছিল না। নীচ বর্ণ শূদ্র কলিযুগে ঘোরতর তপস্যা করবে। শূদ্র জাতির দ্বাপরে তপস্যা করা অতিশয় অধর্ম। সেই শূদ্র আজ নির্বুদ্ধিতাবশত রামের রাজ্যে তপস্যা করছে।সেই কারণেই এই ব্রাহ্মণের পুত্র অকালে মৃত্যু বরণ করলো।” (১)
তারপর নারদ রামকে আরও বলেন,
” মহারাজ তুমি তোমার সমস্ত দেশ অনুসন্ধান কর। যেখানে দুষ্কর্ম দেখবে (অর্থাৎ, শূদ্রকে তপস্যা করতে দেখবে) তার দমনের চেষ্টা করবে। এমন করলেই তোমার ধর্ম বৃদ্ধি ও মানুষের আয়ুবৃদ্ধি হবে।” (১)
রাম নারদের কথা শুনে লক্ষ্মণকে বললেন ,
“লক্ষ্মণ তুমি ব্রাহ্মণকে গিয়ে আশ্বাস দাও, আর ব্রাহ্মণের পুত্রের শরীর তেল ও উৎকৃষ্ট গন্ধদ্রব্য দ্বারা সংরক্ষণ কর। ” (১)
তারপর রাম তার পুষ্পক রথে চড়ে তপস্যারত শূদ্রের খোঁজ করতে লাগলেন। রাম প্রথমে পশ্চিমদিকে গেলেন, তারপর উত্তরদিকে ও তারপরে পূর্বদিকে। কিন্তু কোথাও সেই শূদ্রের দেখা পেলেন না। তারপর তিনি দক্ষিণে শৈবাল পর্বতের উত্তর পাশে একটি সরোবরের তীরে এক তপস্বীকে দেখতে পেলেন। তপস্বী বৃক্ষে পা ঝুলিয়ে, মাথা নিচের দিকে রেখে কঠোর তপস্যা করছিলেন। তাকে দেখে রাম ধন্য ধন্য করে তার কাছে যান । রাম তার জাতি কি জানতে চান এবং জানতে চান তিনি কি কারণে তপস্যা করছেন।
তপস্বী বলেন,
“রাজন! আমি শূদ্রযোনিতে জন্মেছি। এমন তপস্যার দ্বারা সশরীরে দেবত্বলাভ করতে চাই। যখন আমার দেবত্বলাভের ইচ্ছা আছে, তখন আপনি নিশ্চয় জানবেন যে আমি মিথ্যা বলছি না। আমার শূদ্রজাতি, আমার নাম শম্বুক।” (১)
এইকথা শোনামাত্রই রাম তার খড়গ বের করেন এবং সেই শূদ্রের মুন্ডুচ্ছেদ করেন।
শূদ্রকে হত্যা করতে দেখে দেবতারা রামকে বাহবা দিতে থাকেন, রামের উপর পুষ্পবৃষ্টি করতে থাকেন। দেবতারা রামকে বলেন,
“রাম! তুমি দেবতাদের প্রিয় কাজ করলে, এখন তোমার যেমন ইচ্ছা আমাদের কাছে তেমন বর প্রার্থনা কর। এই শূদ্র তোমারই জন্য দেবত্ব লাভ করতে পারলো না। এটাই আমাদের জন্য পরম সন্তোষের।” (১)
তখন রাম ইন্দ্রকে বলেন,
“যদি আপনারা আমার প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে থাকেন তবে সেই ব্রাহ্মণের পুত্র আবার জীবিত হোক; আমাকে এই বর দিন। সে আমারই দোষে অকালে মারা গিয়েছে, আপনারা তার প্রাণদান করুন। আমি তাকে পুনর্জীবিত করবো- ব্রাহ্মণের কাছে এই প্রতিজ্ঞা করে এসেছি।” (১)
এরপর রামায়ণ অনুসারে নিরপরাধ শূদ্রের মৃত্যুর ফলে ব্রাহ্মণের পুত্র জীবিত হয়ে ওঠে।
কৃত্তিবাসী রামায়ণে শম্বুক বধ
কৃত্তিবাস রচিত বাংলা রামায়ণেও শম্বুকের ঘটনাটি সামান্য ভিন্নতা ছাড়া প্রায় অবিকৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। এখানে ইন্দ্রের স্থলে ব্রহ্মার উল্লেখ দেখা যায়। রামের শম্বুক বধে বাল্মীকিতে উল্লেখিত ইন্দ্রের বদলে ব্রহ্মা উৎফুল্ল হয়ে ওঠেন। এছাড়া,কৃত্তিবাস ও বাল্মীকির শম্বুকহত্যা বর্ণনায় তেমন উল্লেখযোগ্য পার্থক্য নেই।
কৃত্তিবাসী রামায়ণের কাহিনীটি এরূপঃ
অযোধ্যার রাজা রাম ধর্ম পালনকারী; তার রাজ্যে কোনো অকালমৃত্যু হয় না। কিন্তু একদিন এক ব্রাহ্মণ তার পাঁচ বছরের শিশুকে কোলে নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে রামের কাছে এলেন। তিনি বলেন, তিনি তো কোনো পাপ করেননি তাহলে তার পুত্র কেন মারা গেল? তারপর সেই ব্রাহ্মণ রামকে অভিশাপ দেওয়ার ভয় দেখান। ব্রাহ্মণ বলেন-
“না করেন রাজ্যচর্চা রাম রঘুবর।
ব্রহ্মশাপ দিব আজি রামের উপর।।” (২)
ব্রাহ্মণ বলতে থাকেন, অধার্মিকের রাজ্যেই এমন ঘটনা ঘটে, তাই তারা রামের রাজ্য ছেড়ে অন্য রাজ্যে চলে যাবেন।
ব্রাহ্মণের কথা শুনে রাম অস্বস্তিতে পড়ে যান।
ব্রাহ্মণ বলতে থাকেন,
“দ্বিজ বলে পাপ নাহি আমার শরীরে।
তবে অকালেতে মোর পুত্র কেন মরে।।” (২)
রামের বিপদ দেখে বশিষ্ট, কশ্যপ, নারদ প্রভৃতি ঋষিরা উপস্থিত হন। নারদ রামকে বলেন,
“মুনি বলে রঘুনাথ শাস্ত্রের বিচার।
সত্যযুগে তপস্যা দ্বিজের অধিকার।।
ত্রেতা যুগে তপস্যা ক্ষত্রিয় অধিকার।
দ্বাপরেতে তপ করে বৈশ্যের বিচার।।
কলিযুগে তপস্যা করিবে শূদ্রজাতি।
তপস্যার নীতি এই শুন রঘুপতি।।
অকালে অনধিকারে শূদ্র তপ করে।
সেইরাজ্যে অকালেতে দ্বিজ পুত্র মরে।।
কলিকালে শূদ্র আর পতিহীনা নারী।
তপস্যা করিলে সৃষ্টি নাশিবারে পারি।।
অকালে করিলে তপ ঘটায় উৎপাত ।
অকাল মরণ নীতি শুন রঘুনাথ।।
না মরে তোমার পাপে দ্বিজের কুমার।
তপস্যা করিছে কোথা শূদ্রদুরাচার।।” (২)
অর্থাৎ, সত্যযুগে ব্রাহ্মণ তপস্যা করতে পারেন, ত্রেতাতে ক্ষত্রিয় ,দ্বাপরে বৈশ্য ও কলিতে শূদ্র। রামের রাজ্যে অকালে কোনো শূদ্র তপস্যা করছিলেন, এই জন্যেই ব্রাহ্মণের পুত্র মারা গেল।
নারদের কথা শুনে রাম লক্ষণকে ডেকে ব্রাহ্মণের পুত্রের দেহকে তেল দিয়ে সংরক্ষণ করতে বলেন। এই বলে রাম তার রথে আরোহণ করে চারদিকে ‘শূদ্র দুরাচারকে’ খুঁজতে থাকেন। খুঁজতে খুঁজতে অবশেষে দক্ষিণদিকের ঘোর বনে গিয়ে রাম সেই শূদ্রের দেখা পান। রাম দেখতে পান মাথা নিচে পা উপরের দিকে রেখে সামনে অগ্নিকুন্ড জ্বেলে এক তপস্বী কঠিন তপস্যা করে চলেছেন। এই তপস্বীকে দেখে রাম ধন্য ধন্য করে ওঠেন। কৃত্তিবাস বর্ণনা করছেনঃ
“দেখিয়া কঠোর তপ শ্রীরামের ত্রাস।
ধন্য ধন্য বলি রাম যান তার পাশ।।”(২)
তারপর রাম তার জাতি-পরিচয় ও তার তপস্যার কারণ জানতে চান-
“জিজ্ঞাসা করেন তারে কমল লোচন।
কোন জাতি তপ কর কোন প্রয়োজন।।” (২)
তপস্বী বলেন,
“তপস্বী বলেন আমি হই শূদ্রজাতি।
শম্বুক নাম ধরি আমি শুন মহামতি।।
করিব কঠোর তপ দুর্লভ সংসারে।
তপস্যার ফলে যাব বৈকুন্ঠ নগরে।।” (২)
শম্বুকের কথা শুনে রাম রাগে কাঁপতে থাকেন এবং কোনো বিলম্ব না করে এককোপে শম্বুকের গলা কেটে ফেলেন। কৃত্তিবাসী রামায়ণে বলা হয়েছেঃ
“তপস্বীর বাক্যে কোপে কাঁপে রামতুণ্ড।
খড়্গ হাতে কাটিলেন তপস্বীর মুণ্ড।।” (২)
রামের এমন কাজ দেখে দেবতারা ধন্য ধন্য করতে থাকেন ও রামের ওপর পুষ্পবৃষ্টি করতে থাকেন। ব্রহ্মা রামের এই কর্মের প্রশংসা করে বলেন, “শূদ্র হয়ে তপ করে পাই বড় লাজ” । রামের প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে ব্রহ্মা রামকে বর দিতে চান।
শ্রীরাম বলেন, “বর দিতে চাইলে ব্রাহ্মণের সন্তানকে জীবিত করুন”। তখন ব্রহ্মা বলেন, রামের এই বর চাওয়ার কোনো প্রয়োজনই নেই, কারণ শূদ্রের গলা কাটা গেলেই ব্রাহ্মণের সন্তানেরা বেঁচে ওঠে। কৃত্তিবাসের বচন শুনুনঃ
“ব্রহ্মা বলে এ বর না চাহ রঘুমণি।
শূদ্র কাটা গেল, দ্বিজ বাচিল আপনি।।” (২)
শূদ্রের মরণের ফলেই ব্রাহ্মণের সন্তান বেঁচে উঠলো আর সভামধ্যে রামের ধন্যি ধন্যি পড়ে গেল।
(কৃত্তিবাসী রামায়ণ, উত্তরকান্ড)
তাহলে রামায়ণের ঘটনা থেকে দেখা যায়, রামরাজ্যে শূদ্রের তপস্যার অধীকার ছিল না। শূদ্র হয়ে তপস্যা করা রাম,নারদ,ব্রহ্মা,ইন্দ্র প্রভৃতি দেবতাদের চোখে চরম ধৃষ্টতা ছাড়া অন্য কিছু ছিল না।
জাতিভেদ ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দু ধর্মের ভিত স্বরূপ। এর উপরেই দাঁড়িয়ে আছে ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দু ধর্ম। এতে সমতার কথা নেই, পদে পদে রয়েছে অসমতা আর শোষণ। আমরা সকলেই যে মানুষ, সকলেই যে সমান, মানুষের মাঝে যে কোনো ভেদাভেদ নেই, ব্রাহ্মণ্যবাদী ধর্ম তা জানে না। এতে কেবল রয়েছে ব্রাহ্মণের শ্রেষ্ঠত্ব ও শ্রমজীবী মানুষদের উপর অত্যাচার। যখন শাসকের বেশে শোষকেরা প্রজার ঘাড়ে বসে খেতে থাকে তখনই তাদের মুখ থেকে উৎসারিত হয়, “পূর্বে সত্যযুগে রজোগুণমূলক যে জীবিকা মলের মত অত্যন্ত ত্যাজ্য ছিল, তার নাম পরে হয় কৃষি । অধর্ম সেই কৃষি রূপ একপাদে আবির্ভূত হয়”। তাদের কাছে কৃষিকাজ ছিল নিন্দনীয়, ঠিক ‘মলের মত’। প্রজার রক্তচোষা এই বাদুড়েরা কেবল আধ্যাত্মিক স্বপ্ন দেখে। সেই স্বপ্নে শূদ্রের থাকে না শিক্ষার অধিকার, থাকে না তপের অধিকার, থাকে না সম্মান, থাকে না সমতা।
নারদের বর্ণনানুসারে, সত্য যুগে যখন কোনো অধর্ম ছিল না, তখন কেবল ব্রাহ্মণেরা তপস্যা করতেন। যখন অধর্মের পরিমাণ বাড়তে থাকে, তখন ত্রেতাতে ক্ষত্রিয়,দ্বাপরে বৈশ্য তপস্যা করতে পারেন, এবং যখন শূদ্র তপস্যা করেন তখন অধর্মে জগত পরিপূর্ণ হয়ে যায়। ব্রাহ্মণ্যবাদী ধর্মে ব্রাহ্মণের শ্রেষ্ঠত্ব ভিন্ন অপর কিছু দৃষ্ট হয় না।এর শিরায় শিরায় অসাম্য। এই অসাম্যে সর্বাপেক্ষা বলি হয় শূদ্র। তপ করার অপরাধেই শূদ্র নিহত হয় বিষ্ণুর অবতার রামের হাতে আর অন্যদিকে শূদ্রের মৃত্যুতেই নিজে নিজে বেঁচে ওঠে ব্রাহ্মণের পুত্র।
যখনই কোনো শূদ্র শিক্ষার মাধ্যমে সমাজে উন্নতির চেষ্টা করেছেন, তখনই রামচন্দ্রের মত শাসকেরা ব্রাহ্মণদের ইশারায় শূদ্রের মস্তকছেদন করেছেন।এভাবেই শম্বুকের ন্যায় সহস্র-কোটি শূদ্রের রক্তে রচিত হয়েছে ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দু ধর্মের ইতিহাস।
তথ্যসূত্রঃ
১/ হেমচন্দ্র ভট্টাচার্য কর্তৃক অনুদিত বাল্মীকি রামায়ণের উত্তরকান্ডের ৭৩-৭৬ সর্গে শম্বুক বধের কাহিনী উল্লেখিত আছে। পঞ্চানন তর্ক রত্ন কর্তৃক অনুদিত বেণীমাধব শীলস লাইব্রেরীর বাল্মীকি রামায়ণের উত্তরকাণ্ডের ষড়শীতিতম সর্গ থেকে ঊননবতীতম সর্গে শম্বুক বধের কাহিনীটি রয়েছে।
২/ কৃত্তিবাসী রামায়ণ/উত্তরকাণ্ড,অক্ষয় লাইব্রেরী,৬০৬ পৃষ্ঠা থেকে ৬০৭ পৃষ্ঠা
অন্ধভাবে বিশ্বাস করবেন না, রামায়ণ ডাউনলোড করে পড়ুন-
রামায়ণের ডাউনলোড লিংক
সত্য তুমি এত তেতো ক্যান?
সত্য বরাবরই কঠিন।
আপনার বর্ণপ্রথা সম্বন্ধে ধারণা নেই, শূদ্র কাদের বলা হয় আপনি জানেন না। এখান থেকে লেখাগুলো পড়ুন-
https://www.shongshoy.com/archives/tag/হিন্দু-ধর্মে-জাতিভেদ
আপনি লেখাটি সম্পূর্ণ পড়েননি মনে হয়। সেই শূদ্র তপস্বীর কঠোর তপস্যা দেখে রাম তার ধন্য ধন্য করেছিলেন। তারপর তার জাতির নাম শোনামাত্রই রাম তার গলা কেটে ফেলেন। রামায়ণে শূদ্র শম্বুকের খারাপ কাজ একটাই, শূদ্র হয়ে তপস্যা করা।
শূদ্রের গলা কেন কাটেন? এর কারণ হিসাবে আগেই বলা আছে-
“সত্যযুগে কেবল ব্রাহ্মণেরা তপস্যা করতো, অন্যদের তপস্যার অধিকার ছিল না। ব্রাহ্মণেরাই সর্বপ্রধান ছিল। এইকারণে এই যুগে কারো অকাল মৃত্যু হত না সকলেই দীর্ঘজীবি ছিল। তারপর আসে ত্রেতাযুগ। এই যুগে মনুষ্যের ব্রহ্মে আত্মবুদ্ধি শিথিল হয়ে যায়, এবং আত্মাভিমানের ফলে ক্ষত্রিয়ের জন্ম হয়। সত্যযুগে তপস্যায় কেবল ব্রাহ্মণেরই অধিকার ছিল কিন্তু ত্রেতায় ক্ষত্রিয়েরাও তপস্যা করতে পারতো। এই যুগে অধর্ম এক পায়ে আবির্ভূত হয়। অধর্মের আশ্রয় হলে তেজের হ্রাস হয়, এই যুগে তাই ছিল। পূর্বে সত্যযুগে রজোগুণমূলক যে জীবিকা মলের মত অত্যন্ত ত্যজ্য ছিল, তার নাম পরে হয় কৃষি । অধর্ম সেই কৃষি রূপ একপাদে আবির্ভূত হয়। অর্থাৎ সত্যযুগের লোকজন অপ্রযত্নোপলব্ধ ফলমূলমাত্র খেয়েই বেঁচে থাকতো। অধর্মের এই কৃষি রূপে একপাদে পৃথিবীতে আবির্ভূত হওয়ার কারণে লোকের আয়ু সত্যযুগ অপেক্ষা হ্রাস হয়ে যায়। ”
“ত্রেতাযুগে ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়েরাই কেবল তপস্যা করতে পারতো , অন্য বর্ণেরা অর্থাৎ বৈশ্য ও শূদ্রেরা তাদের সেবা করতো। বৈশ্য কৃষি কাজের মাধ্যমে ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয় এই দুই বর্ণের এবং শূদ্র ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য এই তিন বর্ণেরই সেবা করতে শুরু করে।যখন অধর্মের পরিমাণ আরো বেড়ে যায়, অধর্ম দুই পায়ে বিচরণ করে তখন দ্বাপরযুগে বৈশ্যেরাও তপস্যার অধিকার লাভ করে। অর্থাৎ সত্য, ত্রেতা ও দ্বাপর এই তিনযুগে তপস্যা ক্রমান্বয়ে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য এরা তপস্যার অধিকার পেয়েছিল।কিন্তু এই তিনযুগে শূদ্রের তপস্যার কোনো অধিকার ছিল না। নীচ বর্ণ শূদ্র কলিযুগে ঘোরতর তপস্যা করবে। শূদ্র জাতির দ্বাপরে তপস্যা করা অতিশয় অধর্ম। সেই শূদ্র আজ নির্বুদ্ধিতা বশত রামের রাজ্যে তপস্যা করছে, সেইজন্য এই ব্রাহ্মণের পুত্র অকালে মৃত্যু বরণ করেছে।”।
বাল্মীকি রামায়ণ অনুসারে শবরী শূদ্র নয়। আপনি অনলাইন এবং quora য় পড়াশোনা না করে মূল গ্রন্থ পড়ুন।
শূদ্র শবরীর এটো কুল খাওয়া সহ, বিভিন্ন মিথ্যা দাবীর খণ্ডন এখানে আছে-
https://www.shongshoy.com/archives/13696
অবশ্যই প্রত্যেকটি তথ্য যাচাই করবেন বাল্মীকি রামায়ণ থেকে। বাল্মীকি রামায়ণের ডাউনলোড লিংক-
https://www.ebanglaebook.com/%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%B2%E0%A7%8D%E0%A6%AE%E0%A7%80%E0%A6%95%E0%A6%BF-%E0%A6%B0%E0%A6%BE%E0%A6%AE%E0%A6%BE%E0%A7%9F%E0%A6%A3-%E0%A6%AA%E0%A6%9E%E0%A7%8D%E0%A6%9A%E0%A6%BE%E0%A6%A8%E0%A6%A8/
https://www.ebanglaebook.com/%e0%a6%ac%e0%a6%be%e0%a6%b2%e0%a7%8d%e0%a6%ae%e0%a7%80%e0%a6%95%e0%a6%bf-%e0%a6%b0%e0%a6%be%e0%a6%ae%e0%a6%be%e0%a7%9f%e0%a6%a3-%e0%a6%b9%e0%a7%87%e0%a6%ae%e0%a6%9a%e0%a6%a8%e0%a7%8d%e0%a6%a6/
Emon dhormo k puriye deoa uchit….sudra da aachhe bolei du mutho onno khete paas re brahman chutiyara….toder choritro aami vaalo vaabei jaani ….
All religions must vanish and there should be complete separation of religion from State.
মূল কথা হল রাজনৈতিক নেতা হবার প্রত্যাশায় রাম শবরির এঁটো খায়। নেতা হয়ে গেলে শূদ্রকের মুন্ড ছেদন করতে আপত্তি নেই। এযুগেও একই গল্প। গরিবের বাচ্চাকে কোলে নেওয়া, আর ক্ষমতায় এলে সে বস্তি বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া।
@Kallol Chakrabarti রাম যে শবরীর এঁটো ফল খেয়েছে এটা হাল আমলে রটানো হয়েছে। বাল্মীকি রামায়ণে এবং অন্যান্য প্রাচীন রামায়ণে এই কথা নেই। বিস্তারিত পড়ুন এই লিংক থেকে-
https://www.shongshoy.com/archives/13696