দুষ্টু পিতামহ ‘ব্রহ্মা জানেন গোপন কম্মোটি’!
ব্রহ্মা, চার মস্তকধারী এই পুরুষ হিন্দু ধর্মে সৃজনকর্তা রূপে পরিগণিত হন। তিনি বৃদ্ধ, তাকে ‘পিতামহ ব্রহ্মা’ বলেও ডাকা হয়ে থাকে। পিতামহ হলেও সৃষ্টকর্তা ব্রহ্মা বড্ড রসিক এবং দুষ্টু প্রকৃতির দেবতা ছিলেন।
ব্রহ্মার উপর অনেক রকমের দুষ্টুমির অভিযোগ আছে। এর মধ্যে ভয়াবহ একটি অভিযোগ হল, অজাচারের অভিযোগ। ব্রহ্মা তার কন্যার সাথে সঙ্গম করতে চেয়েছিলেন। অনেক ধর্মগ্রন্থের বিবরণ অনুযায়ী সেই চাওয়া আর পাওয়াতে পরিণত হতে পারেনি, কেবল চাওয়াতেই সীমাবদ্ধ থেকেছিল। আবার অনেক ধর্মগ্রন্থ অনুযায়ী তিনি তার পলায়নরতা কন্যাকে ধর্ষণ করেছিলেন; কিছু বিবরণ অনুসারে তিনি তার কন্যাকে বিয়ে করেছিলেন। এই যে একই ঘটনার নানা রকমের বিবরণ পাওয়া যাচ্ছে, এটি হিন্দু ধর্মে একদমই বিরল নয়। এই ধর্ম হাজার হাজার বছরের পুরনো। সময়ের সাথে সাথে এর অনেক বিবর্তনও ঘটেছে। কোনো একক ব্যক্তি এই ধর্মের প্রবর্তন করেননি এবং এই ধর্মের গ্রন্থগুলিও একক কোনো ব্যক্তির হাতে রচিত হয়নি। যেহেতু নানা মুনির হাতে এগুলো রচিত হয়েছে, তাই এখানে নানা মত যে দেখতে পাওয়া যায়, এতে অবাক হওয়ার কিছুই নেই। হিন্দুদের অনেক পুরাণ আছে, প্রধান পুরাণ ১৮ টি। এসবই নাকি কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন বেদব্যাস লিখেছিলেন। কিন্তু ঐতিহাসিক বিশ্লেষণে দেখা যায়, এগুলো কোনো নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট কোনো ব্যক্তির হাতে রচিত হয়নি ; নানা জনের হাতে এই বর্তমান পুরাণগুলি রচিত হয়েছে। ব্যাসের নামে প্রচলিত অনেক পুরাণে তো ইংরেজ আমলেও অনেক কিছু ঢোকানো হয়েছে। এসব অবশ্যই হিন্দুরাই ঢুকিয়েছিল, বিধর্মীরা নয়। যাইহোক, বিবিধ কারণে হিন্দু ধর্মে একই ঘটনার একাধিক ভার্সন আমাদের চোখে পড়ে, যা অত্যন্ত স্বাভাবিক।
ব্রহ্মার সাথে তার কন্যার অজাচারের ব্যাপারটি প্রচুর হিন্দু ধর্মগ্রন্থে উল্লেখিত আছে। বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থের কাহিনীগুলোতে অনেকসময়ই কন্যার নাম বদলে গিয়েছে। কখনো সেই কন্যাকে বলা হয়েছে দৌঃ, কখনো বলা হয়েছে ‘ঊষা’ , কখনো ‘সরস্বতী’ বলা হয়েছে, কখনো বলা হয়েছে ‘সন্ধ্যা’ , আবার কখনো সে কন্যা ‘বাক’, কখনো বা ‘শতরূপা’। কন্যার নাম বদলালেও এখানে পিতার নাম মোটামুটি একই আছে। এখানে বরারবই পিতা হলেন, প্রজাপতি বা ব্রহ্মা।
বৃহদারণ্যক উপনিষদে দেখা যায় প্রজাপতি তার শরীর থেকে এক নারীকে সৃষ্টি করে তার সাথেই মিলিত হয়েছিলেন। এই অজাচারের ফলেই নাকি মানুষের উৎপত্তি হয়েছিল! কিন্তু নারীটির কাছে প্রজাপতির এই আচরণ নিন্দনীয় বলে মনে হয়েছিল, কেননা প্রজাপতির দেহ থেকেই তো তিনি সৃষ্টি হয়েছেন! তাই সেই নারীটি পলায়ণ করতে শুরু করেন। তিনি গাভী, অশ্বা, গর্দভী প্রভৃতির রূপ ধরে পলায়ন করতে থাকেন; আর প্রজাপতিও বৃষ, অশ্ব, গর্দভ প্রভৃতির রূপ ধরে তার সাথে সঙ্গম করেন। এর মাধ্যমেই নাকি এইসকল প্রাণীর উৎপত্তি হয়েছে! সেই নারীটি সব রকমের প্রাণীর রূপ ধারণ করেই পলায়ন করছিলেন আর প্রজাপতিও সকল প্রাণীর রূপ ধরেই তার সাথে সম্ভোগ করেছিলেন। এইভাবেই নাকি সকল প্রাণীর সৃষ্টি হয়েছিল। [1]
পলায়নরতা নারীর সাথে তার অনিচ্ছাসত্ত্বেও সহবাস করাকে ধর্ষণ ব্যতীত আর কি বলা যেতে পারে? আর প্রজাপতিকে ধর্ষক ব্যতীত আর কিই বা বলা যেতে পারে? সৃষ্টিকর্তার কি ধর্ষণ ছাড়া সৃষ্টিকার্য করার সামর্থ্য ছিল না? নাকি সেই স্রষ্টা মানবসমাজের কোনো ধর্ষকের মানসপুত্র মাত্র? মানুষ কি তার মত করেই স্রষ্টার কল্পনা করেছিল?
পঞ্চবিংশ ব্রাহ্মণেও প্রজাপতির অজাচারের কাহিনী মেলে। এখানে তিনি তার কন্যা ঊষাকে কামনা করেছিলেন। [2]
শতপথ ব্রাহ্মণ অনুসারে প্রজাপতি তার কন্যা দৌঃ বা ঊষার প্রতি কামার্ত হয়ে তার সাথে সহবাস করেছিলেন। দেবতাদের চোখে প্রজাপতির এই কর্ম পাপ বলেই বিবেচিত হয়েছিল। দেবতারা তখন পশুপতি রুদ্রকে ডেকে বললেন, “নিজের মেয়ের সাথে, আমাদের বোনের সাথে যে এমন আচরণ করে সে নিশ্চয় পাপ করে । বিদ্ধ কর তাকে রুদ্র, লক্ষ্য স্থির করে তাকে বিদ্ধ কর। “ [3]
ঐতরেয় ব্রাহ্মণেও একই কথা আছে, প্রজাপতি তার নিজের কন্যাকে কামনা করেছিলেন। প্রজাপতি হরিণের রূপ ধারণ করে রোহিতের রূপ ধারণ করা তার কন্যার সাথে সহবাস করেছিলেন। কেউ বলেন সেই কন্যা হলেন দৌঃ, আবার কেউ বলেন সেই কন্যা হলেন ঊষা। দেবতারা প্রজাপতির এই নিন্দনীয় কাজটি পছন্দ করতে পারেননি। তারা এমন একজনকে খুঁজতে লাগলেন যিনি প্রজাপতিকে শাস্তি দিতে পারেন। দেবতারা তাদের শরীরের তেজকে একত্রিত করে ভূতবান নামে এক পুরুষকে সৃষ্টি করেন। সেই ভূতবান প্রজাপতিকে তীর দ্বারা বিদ্ধ করেছিলেন। [4]
শিবপুরাণ অনুসারে, ব্রহ্মা তার কন্যা সরস্বতীর রূপে দেখে কামাতুর হয়ে পড়েন এবং তাকে বলেন,” ওই সুন্দরী! যেও না, দাঁড়াও! “ একথা শুনে সরস্বতী ভীষণ রেগে যান এবং ব্রহ্মাকে বলেন, “ পিতা হয়ে কিভাবে তুমি ধর্মবিরুদ্ধ অশুভ কথা বললে!” এরপর সরস্বতী ব্রহ্মাকে অভিশাপ দেন। [5]
স্কন্দ পুরাণ অনুসারে ব্রহ্মা তার কন্যা ‘বাক’ কে কামনা করেছিলেন। বাক ব্রহ্মার উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে, হরিণের রূপ ধারণ করলে, ব্রহ্মাও হরিণের রূপ ধারণ করে তার সাথে মিলিত হওয়ার উদ্দেশ্যে তার পেছনে গমন করেন। ব্রহ্মার এই দুষ্কর্মের শাস্তি হিসাবে শিব ব্যাধের রূপ ধারণ করে এই হরিণরূপী ব্রহ্মাকে হত্যা করেছিলেন। পরে অবশ্য ব্রহ্মাকে আবার জীবিতও করা হয়েছিল। [6]
কালিকা পুরাণ অনুসারে ব্রহ্মার মনে তার কন্যা সন্ধার প্রতি অজাচারের বাসনা জেগেছিল। ব্রহ্মা কামদেবকে সৃষ্টি করেছিলেন এবং তাকে সকলের মধ্যে যৌনাকাঙ্ক্ষা জাগানোর শক্তিও দিয়েছিলেন ব্রহ্মা। শক্তি পাওয়ার পর কামদেব সেই শক্তির কার্যকারিতা পরীক্ষা করে দেখতে চাইলেন, আর পরীক্ষাটি করলেন ঠিক ব্রহ্মার উপরেই। কামদেব ব্রহ্মাকে কামবাণ দ্বারা বিদ্ধ করলেন।কামবাণে বিদ্ধ হয়ে ব্রহ্মা তার নিজের ইন্দ্রিয়ের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেললেন। এর ফলে তার মনে তার কন্যা সন্ধ্যার প্রতি অজাচারের বাসনার উদয় হল। [7]
মহাভাগবত পুরাণেও এই কাহিনীটি একইরকমভাবে পাওয়া যায়। [8]
ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণেও ব্রহ্মার অজাচারের উল্লেখ মেলে। ব্রহ্মবৈবর্ত অনুসারে কামদেবের প্রভাবে ব্রহ্মার মনে তার কন্যার প্রতি কামভাবের উদয় হয়। ব্রহ্মা তার সেই কন্যার সাথে সহবাস করার জন্য তাকে তাড়া করেন। সেই নারীও পালাতে পালাতে তার ভাইদের কাছে উপস্থিত হন। সেই নারীর ভাইয়েরা অর্থাৎ ব্রহ্মার পুত্রেরা ব্রহ্মার এই অজাচারী মনোভাবের জন্য ব্রহ্মাকে ভীষণভাবে তিরস্কৃত করেন।[9]
মৎস্য পুরাণ অনুসারে ব্রহ্মার মনে তার কন্যা শতরূপার প্রতি কাম জেগেছিল। শতরূপা যখন ব্রহ্মাকে প্রণাম করার জন্য প্রদক্ষিণ করছিলেন, তখন তার রূপ দেখার জন্য ব্রহ্মার বাকি তিন দিকে তিনটি মাথার সৃষ্টি হয়। আগে তিনি এক মস্তকধারী ছিলেন, এরপর হলেন চতুর্মস্তকধারী।এছাড়াও তার কামাতুরতার কারণে উপরের দিকেও একটি মাথার সৃষ্টি হল। এর ফলে ব্রহ্মা পঞ্চমস্তকধারী হলেন। ব্রহ্মা যে আগে পঞ্চমুখবিশিষ্ট ছিলেন, একথা অনেক শাস্ত্র হতেই জানা যায়। যাইহোক, এরপর ব্রহ্মা তার কন্যা শতরূপাকে বিয়ে করেন এবং একশ বছর পদ্মপাতার ভেতরে শতরূপার সাথে সঙ্গম করেন। এর ফলে ব্রহ্মার ঔরসে শতরূপার গর্ভে মনু নামে এক পুত্রের জন্ম হয়। [10]
এতক্ষণ বলা হল পিতামহের অজাচার এবং ধর্ষণের ইতিবৃত্ত। কিন্তু এসব ছাড়াও পিতামহ ব্রহ্মার শীঘ্রপতনের রোগ ছিল। অনেক আস্থাশীল ব্যক্তিরা হয়তো লেখাটি পড়ছেন। আপনারা দয়া করে একথা শোনার সাথে সাথেই ক্রুদ্ধ হবেন না । আগে শুনে নিন, কেন পিতামহ ব্রহ্মার সম্বন্ধে একথা বললাম।
কালিকা পুরাণে ব্রহ্মাকে শিবের স্ত্রী সতীকে দেখে বীর্যপাত করতে দেখা যায়।
কালিকা পুরাণ বলছে, সতীর পিতা দক্ষ সতীকে শিবের হাতে সম্প্রদান করেছিলেন আর বিয়ের সকল বিধি মেনে শিব সতীকে বিয়ে করেছিলেন।
সতীর রূপলাবণ্য দেখে বিষ্ণু শিবকে পরামর্শ দিয়েছিলেন, “ যে ব্যক্তি সতীকে দেখে বা সতীর রূপলাবণ্যের কথা শুনে তার প্রতি অভিলাষ করবে, হে ভূতনাথ! তুমি তাকে বধ করবে, এই বিষয়ে বিতর্ক করো না।“
বিষ্ণুর কথা শুনে শিব বলেছিলেন, “তাই হবে।“
এরপর একসময় ভগবান ব্রহ্মা সতীকে হাসতে দেখে কামাতুর দৃষ্টিতে তার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। তখন ব্রহ্মার ইন্দ্রিয়ের বিকার ঘটে। তখন মুনিদের সামনেই পিতামহ ব্রহ্মার বীর্য মাটিতে পতিত হয়।
ব্রহ্মার এই কাণ্ড দেখার পর মহাদেব শূল দিয়ে ব্রহ্মাকে হত্যা করতে উদ্যত হন। শিব ব্রহ্মাকে হত্যা করার জন্য ধাবমান হলে মরীচি, নারদ প্রভৃতি দ্বিজেরা হাহাকার করতে থাকেন। দক্ষও শীঘ্রই উপস্থিত হয়ে শিবকে বলেন ব্রহ্মাকে বধ না করতে। তখন শিব দক্ষকে নারায়ণের কথা মনে করিয়ে দেন এবং বলেন, “ ব্রহ্মা সকাম হয়ে সতীকে দেখে বীর্যপাত করলো কেন? ব্রহ্মা যখন অপরাধ করেছে, তখন অবশ্যই ব্রহ্মাকে হত্যা করবো।“
শিব এই কথা বলতে বলতেই বিষ্ণু এসে হাজির হন এবং বিষ্ণু বলতে থাকেন, “ জগত স্রষ্টা ব্রহ্মাকে হত্যা করো না। ইনিই সতীকে তোমার স্ত্রী করেছেন। ব্রহ্মার প্রাদুর্ভাব প্রজা সৃষ্টি করার জন্যই হয়েছে। ব্রহ্মা মারা গেলে জগত সৃষ্টি করার মত কেউ আর থাকবে না। আমরা তিনজন মিলেই সৃষ্টি কার্য, পালন কার্য এবং সংহার কার্য করি। এই কাজগুলোর মধ্যে কোনটি ব্রহ্মা করেন, কোনটি আমি করি, কোনটি বা তুমি করো। এই তিনজনের মধ্যে যদি কেউ মারা যায় তবে তার কাজ কে করবে? অতএব, হে শিব! তুমি তাকে বধ করো না।“
বিষ্ণুর এই কথা শুনেও মহাদেব ক্ষান্ত হন না। ক্ষুব্ধ হয়ে তিনি বিষ্ণুকে বলেন, “ আমি এই ব্রহ্মাকে বধ করে প্রতিজ্ঞা পালন করবো। সৃষ্টিকর্তার যদি অভাব হয়, তাহলে আমি নিজেই স্থাবর জঙ্গম প্রজা সৃষ্টি করবো অথবা আমি নিজে অন্য কোনো সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টি করবো, তিনিই আমার আদেশে সবসময় সৃষ্টি করবেন।“
যাইহোক, এরপর বিভিন্ন পৌরাণিক কাহিনীর অবতারণা করে বিষ্ণু সেইযাত্রায় ব্রহ্মার প্রাণ রক্ষা করেন।[11]
এই তো গেল পিতামহ ব্রহ্মার শীঘ্রপতনের কাহিনী। স্কন্দপুরাণেও ব্রহ্মার এই কার্যের আভাস মেলে। স্কন্দপুরাণ বলছে, “ পূর্বে যার সৌন্দর্যের জলে নিমগ্ন হয়ে ব্রহ্মাও একদিন ধৈর্যচ্যুত হয়েছিলেন , সেই রূপসী পার্বতীর সাথে আর কোন নারী উপমা দেব?” [12]
শিব পুরাণেও পার্বতীকে দেখে ব্রহ্মার বীর্যপাত হওয়ার কাহিনী পাওয়া যায়। শিবপুরাণ মতে, শিব ও পার্বতীর বিয়ের সময় যখন তারা প্রদক্ষিণ করছিলেন, তখন কেবল পার্বতীর আঙ্গুল দেখেই ব্রহ্মার বীর্যপাত হয়। সেই বীর্য থেকে বটুকদের উৎপত্তি হয়। বটুকেরা হলেন বালক ঋষি। শিব এই কাণ্ড দেখে ভীষণ রেগে যান। ব্রহ্মা ও দেবতারা হাতজোড় করে প্রার্থনা করলে শিব শান্ত হন।[13]
ব্রহ্মার শীঘ্রপতনের আরেকটি কাহিনী পাওয়া যায় ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ বলছে, একদা সৃষ্টিকালে ব্রহ্মা, অনন্ত ও মহেশ্বর শ্বেতদ্বীপে বিষ্ণুকে দেখতে যান। বিষ্ণুর সভার রত্নসিংহাসনে তারা সকলে উপবেশন করেন। সেই সভায় বিষ্ণু এবং লক্ষ্মী হতে উৎপন্ন নারীরা নাচ-গান করছিলেন। পিতামহ ব্রহ্মা তাদের ‘কঠিন শ্রোণী, পীন স্তনমণ্ডল’ ও মুখের হাসি দেখে কামুক হয়ে পড়েন; তিনি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হন। তিনি সভার মধ্যেই বীর্যপাত করেন। লজ্জায় ব্রহ্মা তার বীর্য কাপড় দিয়ে ঢেকে দেন। নাচগান শেষ হলে ব্রহ্মা কাপড়সহ তার সেই বীর্য ক্ষীরোদসাগরে নিক্ষেপ করেন। সেই বীর্য থেকে বালকরূপী অগ্নিদেবের জন্ম হয়। এই বালককে নিয়ে ব্রহ্মা এবং বরুণদেবের মধ্যে কাড়াকাড়ি শুরু হয়। বরুণ বলেন, তিনি জলের দেবতা আর এই বালকের জন্মও জলে, তাই এই বালক বরুণেরই সন্তান। বিষ্ণু শিশুটিকে নিয়ে এই টানাটানির মীমাংসা করেন। বিষ্ণু বলেন, “কামিনীদের নিতম্ব দেখে ব্রহ্মার যে বীর্যপাত হয়েছিল, তা তিনি লজ্জাবশত ক্ষিরোদসাগরে নিক্ষেপ করেছিলেন। সেই বীর্য থেকেই এই শিশুর জন্ম। সুতরাং ধর্মানুসারে এই বালক বিধাতা ব্রহ্মার পুত্র এবং শাস্ত্রানুসারে বরুণের ক্ষেত্রজ পুত্র।“ [14]
ব্রহ্মার ধর্ষণের একটি কাহিনী আগেই বর্ণিত হয়েছে। এ ছাড়াও আরেকটি কাহিনী রয়েছে। ব্রহ্মা শান্তনু নামে এক ঋষির স্ত্রীকে ধর্ষণ করার চেষ্টা করেছিলেন, যদিও এতে তিনি সক্ষম হননি। এই কাহিনীটি কালিকা পুরাণে বর্ণিত হয়েছে। সম্পূর্ণ ঘটনাটি শোনা যাক-
শান্তনু নামে এক ঋষি ছিলেন। তার অমোঘা নামে এক রূপবতী স্ত্রী ছিল। একদিন তপস্বী শান্তনু ফলমূল সংগ্রহ করার জন্য বনে গমন করেন। তখন পিতামহ ব্রহ্মা অমোঘার কাছে উপস্থিত হন। কামপীড়িত ব্রহ্মা নিজের ইন্দ্রিয়ের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে মহাসতী অমোঘাকে ধরার জন্য ছুটে যান। অমোঘা ব্রহ্মাকে ছুটে আসতে দেখে ‘না, না এমন করবেন না’ বলে তার পর্ণশালার মধ্যে ঢুকে যান। পর্ণশালায় ঢোকার সাথে সাথে দরজা বন্ধ করে অমোঘা ব্রহ্মাকে বলতে থাকেন, “ আমি মুনির পত্নী, স্বেছায় কখনো নিন্দনীয় কাজ করবো না, আর যদি বলাৎকার করো, তাহলে তোমাকে অভিশাপ দেব।“
অমোঘা এই কথা বলতে বলতে শান্তনু মুনির আশ্রমেই ব্রহ্মার বীর্য পতিত হয়।বীর্যপাত শেষে ব্রহ্মা তার হংসযানে করে তার আশ্রমের দিকে যাত্রা শুরু করেন।
ব্রহ্মা চলে যাওয়ার পর শান্তনু মুনি তার আশ্রমে ফিরে আসেন। তিনি তার আশ্রমের বাইরে হাসের পায়ের ছাপ দেখতে পান।
তার আশ্রমে ঠিক কি ঘটেছিল, তা শান্তনু তার স্ত্রী অমোঘার কাছে জানতে চান। অমোঘা শান্তনুকে জানান-
“ একজন কমণ্ডলুধারী চার মাথাওয়ালা লোক হংসবিমানে করে এখানে এসে আমার সাথে সহবাস করতে চায়। এরপর আমি যখন পর্ণশালার ভেতর ঢুকে তাকে ভর্ৎসনা করি , তখন সে বীর্যপাত করে আমার অভিশাপের ভয়ে এখান থেকে পালিয়ে যায়।“
অমোঘার বিবরণ শুনে শান্তনু বুঝতে পারেন, পিতামহ ব্রহ্মাই সেখানে এসেছিলেন। [15]
তাহলে দেখা যায় সৃষ্টিকর্তা পিতামহ ব্রহ্মা অজাচার, ধর্ষণ, সর্বসমক্ষে বীর্যপাতের মত নিন্দিত কার্যের সাথে জড়িত ছিলেন। সত্যই দুষ্টু পিতামহ ‘ব্রহ্মা জানেন গোপন কম্মোটি’!
আরও পড়ুনঃ ভগবান ব্রহ্মার অজাচার
তথ্যসূত্র
- বৃহদারণ্যক উপনিষদ/১/৪/৩ ; অনুবাদক সীতানাথ তত্ত্বভূষণ; হরফ প্রকাশনী[↑]
- পঞ্চবিংশ ব্রাহ্মণ ৮/২/১০ translated by Dr. W. Caland | Published by the Asiatic Society of Bengal [↑]
- শতপথ ব্রাহ্মণ ১/৭/৪/১-৩ ;Translated by JULIUS EGGELING ; motilal banarsidass publishers PRIVATE LIMITED [↑]
- ঐতরেয় ব্রাহ্মণ/ ৩য় পঞ্চিকা/ ১৩ অধ্যায়/ ৯ খণ্ড ; অনুবাদক- রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী [↑]
- শিবপুরাণ/জ্ঞানসংহিতা/৪৯ অধ্যায়/৭৭-৭৯; অনুবাদক-শ্রী পঞ্চানন তর্করত্ন [↑]
- স্কন্দ পুরাণ/ব্রহ্মখণ্ড/সেতুমাহাত্ম্য পর্ব/ অধ্যায় ৪০[↑]
- কালিকা পুরাণ, ১ম এবং দ্বিতীয় অধ্যায়; পঞ্চানন তর্করত্নের অনুবাদ অবলম্বনে; নবভারত পাবলিশার্স[↑]
- মহাভাগবত পুরাণ/ ১ম খণ্ড/ ২১ অধ্যায় ; অনুবাদক- শ্যামাপদ ন্যায়ভূষণ [↑]
- ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ/ শ্রীকৃষ্ণজন্মখণ্ড/ ৩৫ অধ্যায় ; পণ্ডিতবর শ্রীযুক্ত পঞ্চানন তর্করত্ন কর্তৃক অনুবাদিত ও সম্পাদিত; শ্রী শ্রীজীব ন্যায়তীর্থ কর্তৃক পরিশোধিত; নবভারত পাবলিশার্স [↑]
- মৎস্য পুরাণ/৩য় অধ্যায়; শ্রী পঞ্চানন তর্করত্ন কর্তৃক সম্পাদিত[↑]
- কালিকা পুরাণ, একাদশ অধ্যায়; পঞ্চানন তর্করত্নের অনুবাদ অবলম্বনে; নবভারত পাবলিশার্স[↑]
- স্কন্দ পুরাণ, বিষ্ণুখণ্ড, কার্ত্তিক মাসের মাহাত্ম্য কথন, ১৭ অধ্যায়[↑]
- শিবপুরাণ/ জ্ঞানসংহিতা/ ১৮ অধ্যায়; সম্পাদকঃ পণ্ডিতবর শ্রীযুক্ত পঞ্চানন তর্করত্ন; প্রকাশকঃ শ্রী নটবর চক্রবর্তী[↑]
- ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ, শ্রীকৃষ্ণজন্মখণ্ড, ৩১ অধ্যায়, অনুবাদক ও সম্পাদকঃ পণ্ডিতবর শ্রীযুক্ত পঞ্চানন তর্করত্ন; শ্রী শ্রীজীব ন্যায়তীর্থ কর্তৃক পরিশোধিত; নবভারত পাবলিশার্স[↑]
- কালিকা পুরাণ/৮২ অধ্যায়; পঞ্চানন তর্করত্নের অনুবাদ অবলম্বনে; নবভারত পাবলিশার্স[↑]
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত © ২০২৪ "সংশয় - চিন্তার মুক্তির আন্দোলন"
গৌতম বুদ্ধ কে নিয়ে কি আপনাদের কোন মতামত আছে? গৌতম কে হিন্দুদের অবতার হিসেবে মানে। আমি তাকে ফলো করব। হিন্দুদের ব্যাপার টাই এমন যারা যারে ইচ্ছা ফলো করবে এবং সেটাই করে আসছে খারাপ গুলাকে ফেলে গিয়ে, এবং তার চেও বেসি হল হিন্দুরা গুরু এর কথা বেসি শোনে। সুতরাও ব্রম্মা কি করল তাতে কিছুই যায় আছে না। বা করলেও এর মাধ্যমে সমাজে এখন কি প্রভাব পড়তেছে? ১৯৯০ এর পর থেকে কথা বলুন। তার খারাপ কর্মের জন্যেই তাকে আমরা পুজা করিনা।
@still hindu
এই লেখা দুটি পড়তে পারেন-
https://www.shongshoy.com/archives/10991
https://www.shongshoy.com/archives/11026
@অজিত কেশকম্বলী II
আপনার লিঙ্ক দুটি দেখিয়ে তো কোন লাভ হল না। আমি যা মানার সেটা তো মানবই গুরু তো আমি বাছাই করে নিব। ওই গ্রন্থ গুলাও গুরুদের রচিত। হিন্দুরা এভাবেই চলে আসছে। যার যেটা ভাল লাগে সেটা গ্রহন করে এবং দিন দিন ভাল জিনিস টাই গ্রহন করছে। আপনি ব্যার্থ । আপনার এই লেখা গুলার মাধ্যমে যেটা হচ্ছে সেটা হল আমাদের রিতি নিতি আরো সংস্কার হয়ে আরো সুন্দর হয়ে যাচ্ছে।জাত প্রথা চলে যাচ্ছে। বিদেশে দেখেন না কোন হিন্দু আফিস আদালতে শাখা শিদুর পরে যায়? মুস্লিম রা কিন্তু ঠিক ই হিজাব পরে যায় এমন কি হিজাব ডে বানিয়েছে হাহা। আমারা এডপ্ট করতে পারি কিন্তু আপনি বলছেন যে না আমার এটা করা চলবে না আব্রাহামিক ভাবধারা এর মত। সবচে বড় ব্যাপার হল হিন্দুরা কাউকে খ্রীষ্টান,মুস্লিম দের মত, হাজার টা চ্যানেল খুলে, বা রাস্তায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ধর্মে আসতে বলে না। দিনশেষে আমরাই সফল।
@হিন্দুই আছি এখনো,
কোনো কাজ হওয়ার জন্য আপনাকে লিংক দুটি দেওয়া হয়নি। বুদ্ধকে কেন অবতার বানিয়েছিল হিন্দুরা তা দেখাতেই লেখাটি দিয়েছিলাম। পড়বেন, জানবেন এটুকুই যথেষ্ট।
আর আপনার যা মানতে ইচ্ছা হবে, আপনি অবশ্যই তাই মানবেন; এতে কারো কিছু আসা যাওয়া উচিত নয়।
আপনি বলেছেন, “আপনার এই লেখা গুলার মাধ্যমে যেটা হচ্ছে সেটা হল আমাদের রিতি নিতি আরো সংস্কার হয়ে আরো সুন্দর হয়ে যাচ্ছে।জাত প্রথা চলে যাচ্ছে। ”
এটা আমার ব্যর্থতা নয়, সফলতা। কুরীতি, জাতপাত, অমানবিক আচার-অনুষ্ঠান এসব দূর করাই আমার লক্ষ্য।
অসামান্য লেখা ধন্যবাদ