ধর্ম, বিজ্ঞান ও আরিফ আজাদ
যদি বেঁচে যাও এবারের মতো
যদি কেটে যায় মৃত্যুর ভয়
জেনো বিজ্ঞান লড়েছিলো একা
মন্দির মসজিদ নয়
উপরের চারটি লাইনের ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে জনপ্রিয় বাংলাদেশি ইসলামিক অ্যাপোলজিস্ট আরিফ আজাদ একটি বিশাল পোস্ট লিখেছিলেন। তার সেই পোস্টের জবাব আমি আমার পূর্বের লেখায় দিয়েছিলাম, তার দাবিসমূহের অসারতা তুলে ধরেছিলাম। তারপর খেয়াল করলাম এবিষয়ে আরও একটি পোস্ট তিনি লিখেছেন (১)। পড়ে দেখলাম, বরাবরের মতোই কিছু প্রলাপ বকে নাস্তিকদের দাঁত ভেঙে দেওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা। যাইহোক, কথা বাড়াবো না, তার পুরো পোস্টটির স্ক্রিনশট তুলে ধরে আমার মূল আলোচনায় চলে যাচ্ছিঃ
(caption id=”attachment_19548″ align=”aligncenter” width=”619″) আরিফ আজাদের ২২শে এপ্রিল, ২০২০ তারিখের একটি ফেসবুক পোস্ট(/caption)(১) তো, প্রথমেই আরিফ আজাদ আমাদেরকে বোঝাতে চাইলেন, ধর্ম ও বিজ্ঞান দুটি আলাদা বিষয়, ধর্ম এক কাজ করে বিজ্ঞান আরেক কাজ করে, বিজ্ঞান যে প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে না ধর্ম সে প্রশ্নের উত্তর দেয়। অতএব, ধর্মের সাথে বিজ্ঞানের কোনো সংঘর্ষ নেই, ধর্মের বিচার বিজ্ঞানের সাহায্যে করা যায় না। উদাহরণ দিয়ে বোঝানোর জন্য তিনি বললেন, বিজ্ঞান পারমাণবিক বোমা আবিষ্কার করলেও সেই পারমাণবিক বোমা কোথায় ব্যবহার করা যাবে আর কোথায় যাবে না সেই প্রশ্নের উত্তর বিজ্ঞান দিতে পারে না, ধর্মই দেয়।
নাস্তিকরা বললো, একমাত্র বিজ্ঞানই আমাদের এই মহামারী থেকে বাঁচাতে পারে, মন্দির কিংবা মসজিদ নয়। তার জবাবে আরিফ আজাদ ধর্ম ও বিজ্ঞান এক নয় প্রমাণে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। আলোচনাটা যেখানে প্রার্থনা মানুষের জীবন বাঁচাতে পারে কিনা সেটা নিয়ে, আরিফ আজাদ সেখানে ধর্ম ও বিজ্ঞান কেনো এক নয় সেই ব্যাখ্যা দিলেন। আরিফ আজাদ এখানে রেড হেরিং ফ্যালাসির আশ্রয় নিয়েছেন।
রেড হেরিং এক প্রকার কুযুক্তি আর এই কুযুক্তিটা তখনই হয় যখন কেউ আলোচনার মূল বিষয় থেকে সরে গিয়ে বা এড়িয়ে গিয়ে এমন একটি বিষয় সামনে আনেন যা আলোচনার মূল বিষয়ের সাথে সরাসরি সম্পর্কিত নয়। প্রার্থনা মানুষের জীবন বাঁচাতে পারে কিনা সেটা এক আলোচনা, ধর্ম ও বিজ্ঞান একই বিষয় কিনা সেটা আরেক আলোচনা। ধর্ম ও বিজ্ঞানের একই বিষয় না হওয়াটা প্রমাণ করে না, প্রার্থনা মানুষের জীবন বাঁচাতে পারে বা ঈশ্বর বলে কেউ আছেন যিনিই আমাদেরকে বাঁচান।
(২) একথা কেউই অস্বীকার করে না যে, ধর্ম ও বিজ্ঞান দুইটা দুই বিষয়। ধর্ম ও বিজ্ঞানের একে অপর থেকে আলাদা হওয়া, না প্রমাণ করে প্রার্থনায় মানুষের জীবন বাঁচতে পারে, না প্রমাণ করে ধর্ম ও বিজ্ঞানের মধ্যে কোনো সংঘর্ষ নেই। ধর্ম ও বিজ্ঞান দুইটা দুই বিষয় হলেই যে তাদের মধ্যে কোনো বিরোধ থাকবে না, একে অপরের সাথে সাংঘর্ষিক হবে না, তার কোনো ভিত্তি নেই।
ধর্মের সাথে বিজ্ঞানের কোনো সংঘর্ষ নেই বোঝানোর উদ্দেশ্যে আরিফ আজাদরা বলেন, বিজ্ঞানের কাজ আবিষ্কার করা আর ধর্মের কাজ ভালো খারাপের শিক্ষা দেওয়া। আরিফ আজাদরা খুব কৌশলে এই বিষয়টি এড়িয়ে যান যে, ধর্ম কেবল কি করা যাবে আর কি করা যাবে না সেটা ঠিক করে দেয় না, ধর্ম বাস্তব জগৎ বিষয়ক অনেককিছু দাবিও করে। ধর্ম আমাদের শেখাতে চায় আকাশটা কেমন, কেমন এই পৃথিবী, সূর্য কিসের চারদিকে ঘোরে, কেনো বজ্রপাত হয়, শীত গ্রীষ্ম কিভাবে আসে, মাতৃগর্ভে ভ্রূণ কোন সময়ে কোন অবস্থায় থাকে, এমন আরও অনেক কিছু। এদিকে, বিজ্ঞান সত্যের খোঁজে থাকে, খুঁজে বের করে। বাস্তব জগৎ বিষয়ক, বাস্তবতা বিষয়ক সত্য খুঁজে বের করাই বিজ্ঞানের কাজ। যে বিষয়ে ধর্মের বেশকিছু দাবি রয়েছে, সেই বিষয়েই বিজ্ঞান সত্যানুসন্ধান করে। ধর্ম প্রকৃতি বিষয়ক বেশকিছু ধারণা দেয়, এদিকে বিজ্ঞানের কাজই হলো প্রকৃতি বিষয়ক সকল ভুল ধারণা ভেঙে সঠিক তথ্য খুঁজে বের করা। আর এজন্যই ধর্ম ও বিজ্ঞানের মধ্যে তুলনা করা যায়, ধর্মকে বিজ্ঞানের সাহায্যে বিচার করা যায়।
ধর্ম তার সকল দাবিই বিনা প্রমাণে সত্য বলে মেনে নিতে শেখায়, বিজ্ঞান বিনা প্রমাণে কোনোকিছুই সত্য বলে মেনে নেয় না। ধর্ম বলে বিশ্বাস করতে, বিজ্ঞান বলে প্রমাণের ওপর নির্ভর করতে। ধর্ম করে সন্দেহ পোষণে নিরুৎসাহিত, বিজ্ঞান করে সন্দেহ পোষণে উৎসাহিত। ধর্ম ও বিজ্ঞানের সংঘর্ষ পানির মতোই পরিষ্কার।
(৩) আরিফ আজাদ তার লেখায় প্রশ্ন তুলেছেন, যদি কোনোভাবে প্রমাণিত হয়, এই করোনা ভাইরাস চীনের ল্যাবে তৈরি, তাহলে নাস্তিকদের কি অবস্থা হবে? তার প্রশ্ন, যদি জানা যায়, বিজ্ঞানের সাহায্যেই এই ভাইরাস তৈরি, তাহলে এখানে বিজ্ঞান রক্ষাকর্তার ভূমিকায় থাকবে না হন্তারকের ভূমিকায়?
আগেও বলেছি, ‘বিজ্ঞান বাঁচায়’ কথাটি দ্বারা এটা বোঝানো হয় না যে, বিজ্ঞান একক কোনো সত্ত্বা যা আমাদের বাঁচায়, বরং এটাই বোঝানো হয়, বিজ্ঞানের অবদান আমাদের বাঁচতে সাহায্য করে বা বিজ্ঞানের সাহায্যে আমরা বাঁচতে পারি। এটা অস্বীকার করার কিছু নেই যে, বিজ্ঞান যেমন মানুষকে বাঁচাতে পারে, তেমনি বিজ্ঞান আবার মানুষকে মারতেও পারে।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, করোনা ভাইরাস চীনের ল্যাবে তৈরি প্রমাণিত হলে আরিফ আজাদরা বিজ্ঞানকেই দোষারোপ করবেন, যারা ভাইরাসটি তৈরি করেছেন তাদেরকেই দোষারোপ করবেন, ভুলেও তাদের আল্লাহর নিন্দা করবেন না। ভালো কাজে আল্লাহর দায় থাকলেও, খারাপ কাজে আল্লাহর দায় থাকে না।
আরিফ আজাদ অবশ্য তার বই প্যারাডক্সিক্যাল সাজিদে একটি কুযুক্তির সাহায্যে এই হিপোক্রেসি জাস্টিফাই করার চেষ্টা করেছেন (২)। সংক্ষিপ্তরূপে তার যুক্তিটি তুলে ধরছিঃ
কোনো ভালো কাজের উদ্দেশ্যে কোনো বিজ্ঞানী যদি কোনো যন্ত্র আবিষ্কার করেন এবং সেই যন্ত্রের সাহায্যে কেউ যদি কোনো ভালো কাজ করেন, তাহলে সেই ভালো কাজের ক্রেডিট সেই বিজ্ঞানীও পাবেন যিনি যন্ত্রটি আবিষ্কার করেছেন, কেননা তিনি যন্ত্রটি আবিষ্কার না করলে হয়তো ভালো কাজটি করাই যেতো না। কিন্তু, কেউ যদি যন্ত্রটি ব্যবহার করে ভালো কাজের সুযোগ পেয়েও না করে কিংবা যন্ত্রটির অপব্যবহার করে কোনো খারাপ কাজ করে, তাহলে সেটা সেই বিজ্ঞানীর দোষ হবে না যিনি যন্ত্রটি আবিষ্কার করেছেন, কেননা তিনি এমনটি করতে বলেননি। একইভাবে, আল্লাহ্ মানুষকে ভালো কাজের জন্য হাত, পা, চোখ, মুখ, নাক, মস্তিষ্ক দিয়ে সৃষ্টি করেছেন, সাথে দিয়েছেন স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি। এখন, মানুষ যদি ভালো কাজ করে, সেই ভালো কাজের ক্রেডিট আল্লাহ্ও পাবেন, কেননা আল্লাহ্ মানুষকে ভালো কাজের জন্য হাত, পা, চোখ, মুখ, নাক মস্তিষ্ক দিয়ে সৃষ্টি করেছেন বলেই মানুষ ভালো কাজ করতে পারে। আর, মানুষ যদি খারাপ কাজ করে বেড়ায়, তাহলে তার দায় আল্লাহর নয়, কেননা আল্লাহ্ মানুষকে খারাপ কাজ করে বেড়ানোর জন্য সৃষ্টি করেননি, বরং খারাপ কাজ থেকে দূরে থাকতে বলেছেন।
দুঃখজনকভাবে, এই যুক্তিটি ব্যবহার করে আরিফ আজাদ কিছুই প্রমাণ করতে পারেননি।
একজন বিজ্ঞানী কেবল একটি যন্ত্র আবিষ্কার করতেই পারেন। যন্ত্রটি কখন কে ভালো কাজে ব্যবহার করবে আর কখন কে খারাপ কাজে ব্যবহার করবে সেসব তিনি আগে থেকেই নির্ধারণ করে রাখতে পারেন না। তার ইচ্ছাতেই যন্ত্রটি ভালো কিংবা খারাপ কাজে ব্যবহৃত হয় না।
ইসলাম অনুযায়ী, কাল আপনি কোনো ভালো কাজ করবেন নাকি খারাপ করবেন, আপনার সাথে ভালো কিছু ঘটবে নাকি খারাপ কিছু ঘটবে, তা আল্লাহ্ আসমান ও যমীন সৃষ্টির পঞ্চাশ হাজার বছর আগেই নির্ধারণ করে রেখেছেন। আল্লাহ্ আপনার তাকদীরে বা নিয়তিতে আপনি যা যা করবেন বলে লিখে রেখেছেন, আপনি তাই তাই করবেন। যা যা আপনার সাথে হবে বলে লিখে রেখেছেন, তাই তাই আপনার সাথে হবে।
এবিষয়ে নিচের সহিহ হাদিসসমূহ উল্লেখযোগ্যঃ
গ্রন্থঃ সূনান তিরমিজী (ইফাঃ)
অধ্যায়ঃ ৩৫/ তাকদীর (كتاب القدر عن رسول الله ﷺ)
হাদিস নম্বরঃ ২১৫৮
পরিচ্ছেদ নাই।
২১৫৮. ইয়াহইয়া ইবন মূসা (রহঃ) ….. আবদুল ওয়াহিদ ইবন সালিম রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি একবার মক্কায় এলাম। সেখানে আতা ইবন আবু রাবাহ (রহঃ) এর সঙ্গে দেখা করলাম। তাঁকে বললামঃ হে আবূ মুহাম্মদ, বাসরাবাসরীরা তো তাকদীরের অস্বীকৃতিমূলক কথা বলে। তিনি বললেনঃ প্রিয় বৎস, তুমি কি কুরআন তিলাওয়াত কর? আমি বললামঃ হ্যাঁ। তিনি বললেনঃ সূরা আয-যুখরুখ তিলাওয়াত কর তো। আমি তিলাওয়াত করলামঃ
حم* وَالْكِتَابِ الْمُبِينِ * إِنَّا جَعَلْنَاهُ قُرْآنًا عَرَبِيًّا لَعَلَّكُمْ تَعْقِلُونَ * وَإِنَّهُ فِي أُمِّ الْكِتَابِ لَدَيْنَا لَعَلِيٌّ حَكِيمٌ
হা-মীম, কসম সুস্পষ্ট কিতাবের, আমি তা অবতীর্ণ করেছি আরবী ভাষায় কুরআন রূপে, যাতে তোমরা বুঝতে পার। তা রয়েছে আমার কাছে উম্মূল কিতাবে, এ তো মহান, জ্ঞান গর্ভ (৪৩ঃ ১, ২, ৩, ৪)।
তিনি বললেনঃ উম্মূল কিতাব কি তা জান? আমি বললামঃ আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলই ভাল জানেন। তিনি বললেনঃ এ হল একটি মহাগ্রন্থ, আকাশ সৃষ্টিরও পূর্বে এবং যমীন সৃষ্টিরও পূর্বে আল্লাহ তাআলা তা লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন। এতে আছে ফির‘আওন জাহান্নামীদের অন্তর্ভুক্ত, এতে আছে তাব্বাত ইয়াদা আবী লাহাবীও ওয়া তাব্বা (تَبَّتْ يَدَا أَبِي لَهَبٍ وَتَبَّ) আবূ লাহাবের দুটি হাত ধ্বংস হয়েছে আর ধ্বংস হয়েছে সে নিজেও।
আতা (রহঃ) বলেনঃ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর অন্যতম সাহাবী উবাদা ইবন সামিত রাদিয়াল্লাহু আনহু-এর পুত্র ওয়ালীদ (রহঃ)-এর সঙ্গে আমি সাক্ষাত করেছিলাম। তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলামঃ মৃত্যুর সময় তোমার পিতা কি ওয়াসীয়ত করেছিলেন?
তিনি বললেনঃ তিনি আমাকে কাছে ডাকলেন। বললেনঃ হে প্রিয় বৎস, আল্লাহকে ভয় করবে। যেনে রাখবে যতক্ষণ না আল্লাহর উপর ঈমান আনবে এবং তাকদীরের সব কিছুর ভাল-মন্দের উপর ঈমান আনবে ততক্ষণ পর্যন্ত তুমি কখনো আল্লাহর ভয় অর্জন করতে পারবে না। তা ছাড়া অন্য কোন অবস্থায় যদি তোমার মৃত্যু হয় তবে জাহান্নামে দাখেল হতে হবে। আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছিঃ আল্লাহ তাআলা সর্ব প্রথম কলম সৃষ্টি করেছেন। এরপর একে নির্দেশ দিলেন, লিখ, সে বললঃ কি লিখব? তিনি বললেনঃ যা হয়েছে এবং অনন্ত কাল পর্যন্ত যা হবে সব তাকদীর লিখ। সহীহ, সহিহহ ১৩৩, তাখরিজুত তহাবিয়া ২৩২, মিশকাত ৯৪, আযযিলাল ১০২, ১০৫, তিরমিজী হাদিস নম্বরঃ ২১৫৫ (আল মাদানী প্রকাশনী)
(আবু ঈসা বলেন) এ হাদীসটি এ সূত্রে গারীব।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
গ্রন্থঃ সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত)
অধ্যায়ঃ ৩৫/ সুন্নাহ (كتاب السنة)
হাদিস নম্বরঃ ৪৭০৩
১৭. তাকদীর সম্পর্কে
৪৭০৩। মুসলিম ইবনু ইয়াসার আল-জুহানী (রহঃ) সূত্রে বর্ণিত। একদা উমার ইবনুল খাত্তাব (রাঃ)-কে এ আয়াত সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলোঃ ‘‘যখন তোমার রব আদম সন্তানের পিঠ থেকে তাদের সমস্ত সন্তানদেরকে বের করলেন…’’ (সূরা আল-আ‘রাফঃ ১৭২)। বর্ণনাকারী বলেন, আল-কা‘নবী এ আয়াত পড়েছিলেন। উমার (রাঃ) বলেন, আমি এ সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট প্রশ্ন করতে শুনেছি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ মহান আল্লাহ আদম (আঃ)-কে সৃষ্টি করার পর স্বীয় ডান হাতে তাঁর পিঠ বুলিয়ে তা থেকে তাঁর একদল সন্তান বের করে বললেন, আমি এদেরকে জান্নাতের জন্য সৃষ্টি করেছি এবং এরা জান্নাতবাসীর উপযোগী কাজই করবে। অতঃপর আবার তাঁর পিঠে হাত বুলিয়ে একদল সন্তান বেরিয়ে এনে বললেন, এদেরকে আমি জাহান্নামের জন্য সৃষ্টি করেছি এবং জাহান্নামীদের উপযোগী কাজই করবে। একথা শুনে এক ব্যক্তি বললো, হে আল্লাহর রাসূল! তাহলে আমলের কি মূল্য রইলো? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, মহান আল্লাহ যখন কোনো বান্দাকে জান্নাতের জন্য সৃষ্টি করেন তখন তার দ্বারা জান্নাতবাসীদের কাজই করিয়ে নেন। শেষে সে জান্নাতীদের কাজ করেই মারা যায়। আর আল্লাহ এর বিনিময়ে তাকে জান্নাতে প্রবেশ করান। আর যখন তিনি কোনো বান্দাকে জাহান্নামের জন্য সৃষ্টি করেন, তখন তার দ্বারা জাহান্নামীদের কাজ করিয়ে নেন। অবশেষে সে জাহান্নামীদের কাজ করে মারা যায়। অতঃপর এজন্য তিনি তাকে জাহান্নামে প্রবেশ করান।(1)
সহীহ, পিঠ বুলানো কথাটি বাদে।
(1). তিরমিযী, নাসায়ী, আহমাদ। সনদে মুসলিম ইবনু ইয়াসার এবং উমার (রাঃ)-এর মাঝখানে বর্ণনাকারী বাদ পড়েছে (ইনকিতা রয়েছে) । আর উভয়ের মাঝে জনৈক ব্যক্তি রয়েছে যাকে নু‘আইম ইবনু রবী‘আহ বলা হয়। তিনি অজ্ঞাত। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
গ্রন্থঃ সহীহ মুসলিম (ইফাঃ)
অধ্যায়ঃ ৪৮/ তাকদীর (كتاب القدر)
হাদিস নম্বরঃ ৬৫০৭
২. আদম (আঃ) ও মুসা (আঃ) এর বিতর্ক
৬৫০৭। আবূ তাহির আহমাদ ইবনু আমর ইবনু আবদুল্লাহ ইবনু সারহ (রহঃ) … আবদুল্লাহ ইবনু আমর ইবনুল আস (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে বলতে শুনেছি যে, তিনি বলেছেনঃ আল্লাহ তাঁআলা সমগ্র সৃষ্টির ভাগ্যলিপি আসমান ও যমীন সৃষ্টির পঞ্চাশ হাজার বছর আগেই লিপিবদ্ধ করেছেন। তিনি বলেন, সে সময় আল্লাহর আরশ পানির উপরে ছিল।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
গ্রন্থঃ সহীহ বুখারী (তাওহীদ)
অধ্যায়ঃ ৯৭/ তাওহীদ (كتاب التوحيد)
হাদিস নম্বরঃ ৭৪৫৪
৯৭/২৮. আল্লাহ্ তা‘আলার বাণীঃ আমার প্রেরিত বান্দাদের সম্পর্কে আমার এ কথা আগেই স্থির হয়ে গেছে। (সূরাহ আস্ সাফফাত ৩৭/১৭১)
৭৪৫৪. ‘আবদুল্লাহ্ ইবনু মাস‘ঊদ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যিনি ‘সত্যবাদী’ এবং ‘সত্যবাদী বলে স্বীকৃত’ আমাদের কাছে বর্ণনা করেছেন যে, তোমাদের প্রত্যেকের সৃষ্টি হলো এমন বীর্য থেকে যাকে মায়ের পেটে চল্লিশ দিন কিংবা চল্লিশ রাত একত্রিত রাখা হয়। তারপর তেমনি সময়ে আলাক হয়, তারপর তেমনি সময়ে গোশতপিন্ডে পরিণত হয়। তারপর আল্লাহ্ তার কাছে ফেরেশতা প্রেরণ করেন। এই ফেরেশতাকে চারটি বিষয় সম্পর্কে লেখার করার জন্য হুকুম দেয়া হয়। যার ফলে ফেরেশেতা তার রিযক, ‘আমাল, আয়ু এবং দুর্ভাগা কিংবা ভাগ্যবান হওয়া সম্পর্কে লিখে দেয়। তারপর তার মধ্যে প্রাণ ফুঁকে দেয়া হয়। এজন্যই তোমাদের কেউ জান্নাতীদের ‘আমাল করে এতটুকু এগিয়ে যায় যে, তার ও জান্নাতের মাঝে কেবল এক গজের দূরত্ব থাকতেই তার ওপর লিখিত তাক্দীর প্রবল হয়ে যায়। তখন সে জাহান্নামীদের ‘আমাল করে। শেষে সে জাহান্নামে প্রবেশ করে। আবার তোমাদের কেউ জাহান্নামীদের মত ‘আমাল করে এমন পর্যায়ে পৌঁছে যে, তার ও জাহান্নামের মাঝে মাত্র এক গজের দূরত্ব থাকতে তার উপর তাকদীরের লেখা প্রবল হয়, ফলে সে জান্নাতীদের মত ‘আমাল করে, শেষে জান্নাতেই প্রবেশ করে। (৩২০৮) (আধুনিক প্রকাশনী- ৬৯৩৬, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৬৯৪৬)
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
উপরের সহিহ হাদিসসমূহ থেকে এটা খুব পরিষ্কারভাবেই বোঝা যায় যে, ইসলাম অনুযায়ী, আমরা কোনো ভালো কাজ করলে আল্লাহর ইচ্ছাতেই করি, কোনো খারাপ কাজ করলেও আল্লাহর ইচ্ছাতেই করি। অর্থ্যাৎ, ইসলামই আমাদের বলছে, আমাদের ভালো কাজের দায়ও যেমন আল্লাহর, তেমনি আমাদের খারাপ কাজের দায়ও আল্লাহর, আমরা তার খেলার পুতুল ছাড়া কিছুই না।
(৪) এছাড়াও, আরিফ আজাদের দাবি, কি করা যাবে আর কি করা যাবে না, কোনটা ঠিক আর কোনটা ভুল, তা কেবল ধর্মই শেখায়। তার বক্তব্য, ধর্মই নৈতিকতার উৎস।
ধর্মকেই নৈতিকতার একমাত্র উৎস হিসেবে প্রমাণ করতে তিনি আমেরিকার জাপানের হিরোশিমা-নাগাসাকিতে পারমানবিক বোমা মেরে জাপানকে একপ্রকার বিধ্বস্ত করার উদাহরণ টেনেছেন। তার বক্তব্য অনুযায়ী, যেহেতু আমেরিকার হর্তাকর্তারা জাপানের হিরোশিমা-নাগাসাকিতে পারমানবিক বোমা মেরে জাপানকে একপ্রকার বিধ্বস্ত করে দিয়েছিলো, সেহেতু ধর্মই নৈতিকতার উৎস। কি হাস্যকর! আরিফ আজাদের কাছ থেকে অবশ্য এরচেয়ে ভালো কিছু আশা করাও যায় না। আরিফ আজাদ এখানেও রেড হেরিং ফ্যালাসির আশ্রয় নিয়েছেন। আরিফ আজাদের মধ্যে এটা বোঝার মতো বোধশক্তিও নেই যে, কোনো মানুষের কোনো মানুষকে খুন করা প্রমাণ করে না যে, ধর্মই নৈতিকতার একমাত্র উৎস।
আরিফ আজাদের বিশ্বাস অনুযায়ী, ধর্ম না থাকলে তিনি যখন খুশি তখন যাকে ইচ্ছা তাকে খুন করে বেড়াতেন, যখন খুশি তখন যাকে ইচ্ছা তাকে ধর্ষণ করতেন, নিজের মা বোনকেও ছাড়তেন না। তার বিশ্বাস অনুযায়ী, ১৪০০ বছর আগের একটি বই-ই কেবল তাকে যখন খুশি তখন যাকে ইচ্ছা তাকে খুন করা থেকে বিরত রাখে, যখন খুশি তখন যাকে ইচ্ছা তাকে ধর্ষণ করা থেকে বিরত রাখে।
মানুষ হত্যা যে খারাপ বা ভুল সেটা আমরা কিভাবে বুঝি? আমরা যদি যখন খুশি যাকে খুশি খুন করে বেড়াই, তাহলে মানব সমাজ বলে আর কিছু থাকবে না। আমরা সবাই-ই সুখেস্বচ্ছন্দে নিরাপদে বেঁচে থাকতে চাই। আমরা সবাই-ই সুবিধা পেতে চাই, অসুবিধা থেকে দূরে থাকতে চাই। নিজেদের সুবিধার জন্যই, অসুবিধা থেকে দূরে থাকার জন্যই আমরা সমাজবদ্ধ হয়ে বাস করি। তাই, সমাজের সুবিধা সমাজের কল্যাণ নিজেরই সুবিধা নিজেরই কল্যাণ, সমাজের অসুবিধা সমাজের দুর্বিপাক নিজেরই অসুবিধা নিজেরই দুর্বিপাক। সবাই যদি সবাইকে খুন করে বেড়ায় তাহলে সমাজের অস্তিত্বই আর থাকে না, নিজেদের অস্তিত্বের স্বার্থেই সমাজের অস্তিত্ব প্রয়োজন। আর সেজন্যই, খুন করা বা এজাতীয় কাজ ‘খারাপ’ বা ‘ভুল’ বলে বিবেচিত।
কোনো কাজ কি পরিমাণ সুবিধাজনক বনাম কি পরিমাণ অসুবিধাজনক সেই বিষয়ের ওপর নির্ভর করে আমরা সেই কাজকে মূল্যায়ন করতে পারি।
বাস্তবতাই নৈতিকতার ভিত্তি, কোনো মধ্যযুগীয় বই নয়।
ধর্ম কেবল অন্ধভাবে কিছু নিয়মকানুন অনুসরণ করতে শেখায়, কিছু কাজকে অন্ধভাবে ভালো জানতে শেখায় আবার কোনো কাজকে অন্ধভাবে খারাপ জানতে শেখায়। ধর্ম যা ভালো জানতে শেখায় তা প্রকৃতপক্ষে অত্যন্ত খারাপ হতে পারে। আবার, ধর্ম যা খারাপ জানতে শেখায় তা প্রকৃতপক্ষে খারাপ নাও হতে পারে। অন্ধভাবে কিছু নিয়মকানুন অনুসরণ করাকে আনুগত্য বলে, নৈতিকতা নয়।
আরও পড়ুন
- করোনা ভাইরাস — বাঁচাবে কে?
- ইসলামের অন্যতম ভিত্তি তাকদীর প্রসঙ্গে
- আবু লাহাবের পূর্ব নির্ধারিত অপরাধসমূহ
- নৈতিকতার উৎস কি?
তথ্যসূত্রসমূহ
- আরিফ আজাদের ২২শে এপ্রিল, ২০২০ তারিখের পোস্ট
- প্যারাডক্সিক্যাল সাজিদ – স্রস্টা কেন খারাপ কাজের দায় নেন না?
আরিফ আজাদ, যদি আপনি একটা রোবট বানান এবং তার মধ্যে তার সব ভালো এবং খারাপ কাজের ইনপুট দিয়ে রাখেন তবে যখন রোবটটি কোনো ভালো বা খারাপ কাজ করবে, তখন সেই ভালো এবং খারাপ কাজগুলোর দায় রোবটের নির্মাতাকেই নিতে হবে।
যদি আপনি মনে করেন যে আল্লাহই, আমাদের সৃষ্টি করেছেন এবং আমাদের ইনপুট তথা ভালো খারাপ এবং পরিনতি তথা জান্নাত জাহান্নাম আগে থেকেই নির্ধারণ করে রেখেছে তবে কোনো মানুষই তার কাজের জন্য দায়ী নয়। দায়ী হচ্ছে তার নির্মাতা বা আপনার (কাল্পনিক) আল্লাহ।
ভালো বলেছেন।
বাহ বেশ বলেছেন!
কোরানের উত্তরাধিকার আইনে ভুল সম্পর্কে ও কোরানের আইন লঙ্ঘনকারী ফাজায়েল নীতি সম্পর্কে প্রবন্ধ দেখতে চাই
আরিফ আজাদকে নিয়ে আমার একটি গল্প-
https://istishon.blog/node/37203
“স্রস্টা কেন খারাপ কাজের দায় নেন না?”
এই প্রশ্নের উওর খুজছি।
আরিফ আজাদের ঔ প্যারা সাজিদ বইতেই তো সে তার কুযুক্তি বিরোধিতা করলো।
সে তার বইতে বললো, আল্লাহ মানুষকে হাত পা দিয়েছে ভালো কাজ করার জন্য। তাই ভালো কাজ করলে ক্রেডিট আল্লাহর। আর মানুষকে ভালো কাজের জন্য হাত পা দিলেও সে খারাপ কাজ করে। তাই খারাপ কাজের দায় মানুষের।
আর ওদিকে সে তার পোস্টে বলল, হিরোশিমা ও নাগানাকির জন্য পারমাণবিক বোম কিংবা করোনা ভাইরাস বানালে তার দায় বিজ্ঞানের।
এখন কথা হচ্ছে, তার মতো তো আমিও বলতে পারি, বিজ্ঞানের উদ্দেশ্য ভালো কাজ করার জন্য। বিশ্ব মানবতার জন্য। ভালো কাজ করার জন্য যখন বিজ্ঞান, তাই কেউ বিজ্ঞান দিয়ে খারাপ কাজ করলে তার দায় মানুষের, বিজ্ঞানের নয়।
আর ধর্ম নৈতিকতার শিক্ষা দেয়, তাইতো পৃথিবীতে ধর্ম নিয়ে এতো রক্তপাত, এতো যুদ্ধ। ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের জন্য ধর্মের সমালোচনাকারীদের মাথা ফেলার জন্য উল্লাস করা। তাই ধর্ম নৈতিকতার শিক্ষা দেয়, কথাটা আজগুবি।