প্রশ্নোত্তরবিজ্ঞান

নির্বুদ্ধিতার ষোলকলা এবং অন্যান্য!

ভূমিকা

শুধু দুটি বিষয়ই অসীম। মহাবিশ্ব এবং মানুষের নির্বুদ্ধিতা। তবে প্রথমটি অসীম কিনা আমি নিশ্চিত নই।
– আইনস্টাইন।

একজন মুক্তমনা মানুষ এবং একজন ধর্মান্ধের মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে, মুক্তমনা মানুষ কখনো কোনকিছু ভুল লিখলে, অযৌক্তিক বক্তব্য দিলে, অন্য মুক্তমনারাই তার কঠোর সমালোচনা করবে। এই যেমন ধরুন প্রফেসর এবং বিজ্ঞানী রিচার্ড ডকিন্স কিছু নারী বিরোধী টুইট করেছিল বলে তাঁকে প্রায় একঘরে করে ফেলা হয়েছিল। আমি যখন তাঁঁর সাথে প্রথমবার দেখা করি, সেই সময়ে নারীবাদী নাস্তিকরা কঠোর সমালোচনা করে তাঁকে প্রায় বিধ্বস্ত করে ফেলেছিল। ডকিন্সের সাথে আমি কথা বলছি দেখে অনেক প্রখ্যাত নারীবাদী লেখক আমাকে একটু এড়িয়ে চলতে শুরু করেছিল। ডকিন্সের মত বিখ্যাত একাডেমিশিয়ানের পর্যন্ত নানা জায়গাতে দুঃখ প্রকাশ করে বিবৃতি দিতে হয়েছে। সেগুলো পুরনো কথা, যে কেউ খুঁজলে সেগুলো পড়তে পারবে। কিন্তু একজন ধর্মান্ধ মানুষ যাই লিখুক না কেন, অন্য আরেকজন ধর্মান্ধ না পড়ে না বুঝে না যাচাই করেই প্রশংসায় পঞ্চমুখ হবে। নিচে লিখতে থাকবে, একদম দাঁত ভাঙ্গা জবাব দিয়েছেন বস। জাজাকাল্লাহ খায়ের। সোভানাল্লাহ।

আবার ধরুন, কিছুদিন আগে নেদারল্যান্ডসে একটা কনফারেন্সে আমি, শান্ত ভাই, বন্যা আপা, নুর নবী দুলাল এবং শাম্মি ডয়েচে ভেলের একটা লাইভে অংশ নিয়েছিলাম। সেখানে তুমুল তর্ক বিতর্ক হলো, তার আগের রাত পরের রাতেও আমরা তুমুল তর্ক করে সময় কাটালাম। তর্ক হয়েছিল অনেকগুলো বিষয় নিয়ে। এক একজনার এক এক রকম মতামত। এবং সকলেই নিজ নিজ যুক্তি তুলে ধরছিলেন। আবার আমরা সবাই একসাথেই খানাপিনা করলাম, আনন্দ করলাম। দারুণ আনন্দের সময় কেটেছিল। বিতর্কটি দেখতে পারেন।

ঠিক একই সাথে লক্ষ্য করা যায়, ধর্মান্ধ মৌলবাদীদের লেখার মধ্যে কোন বিতর্কের অবকাশ নেই। এতে যেই সমস্যাটি হচ্ছে, তা হলো, ধর্মান্ধদের লেখায় তাই পাঠক কিছু শিখতে পারছে না। শুধু এক ধরণের স্বস্তি পাচ্ছে এই ভেবে যে, নাস্তিকদের খুব একটা কিছু জবাব দেয়া হয়েছে। মূল বিষয়বস্তু কী, সেটা কতটা অথেনটিক সেগুলো একজনও যাচাই করতে যাচ্ছে না। এবং সংখ্যায় অশিক্ষিত মুর্খদের সংখ্যা বেশি হওয়ায় এরাও ভেবে নেয়, যেহেতু এতগুলো মানুষ প্রশংসা করছে, তাই এটাই সঠিক কথা। আমি এই লেখাটি লিখছি সেইসব অশিক্ষিত লোকদের কটাক্ষ করার জন্য নয়। তাদের মধ্যে যুক্তি এবং যাচাই করে দেখার মানসিকতা বিকাশের চেষ্টার জন্য। যদিও জানি, লাভের লাভ কিছু হবে না। তারপরেও, চেষ্টা করতেই হবে। মুক্তচিন্তার কাজই তো সেটা। শিক্ষা বঞ্চিত এইরকম অসংখ্য দুর্ভাগা ছেলেপেলে আমাদের সমাজে অজস্র। তাদের এই অশিক্ষা কুশিক্ষা নির্বুদ্ধিতার দায় আমাদেরও কম নয়।

আজকে আমার স্ট্যাটাসে একজন একটা কমেন্ট করে গেলেন। সেই স্ট্যাটাসটি কে লিখেছে সেটা খুঁজতে গিয়ে দেখলাম খুব ভয়াবহ অবস্থা। অসংখ্য অশিক্ষিত মূর্খ লোক বাহাবা দিচ্ছে, একজনও ভুলটি ধরিয়ে দিচ্ছে না। কেউ ভুল ধরিয়ে দিলেই গালি খেতে হচ্ছে। শুধু গালিই নয়, মেরে ফেলারও হুমকি দেখলাম কয়েকটি। বুঝুন অবস্থা, এরকম মেরে ফেলার হুমকি দিলে কেউ পরবর্তীতে ভুল ধরিয়ে দিতে সাহস পাবে? মানে, ভুলটি প্রতিষ্ঠা করার জন্য চাপাতির হুমকি দিতে হচ্ছে? আমরা কী এতটাই মধ্যযুগে বসবাস করছি যে, একটা সামান্য ভুল ধরিয়ে দিলে জবাই করার হুমকি দেয়া হবে? অদ্ভুত এদের মন মানসিকতা! যাইহোক, হুমকি খেতে হবে জানি। তারপরেও ভুলগুলো এক এক করে ধরিয়ে দিই। শুরুতেই বিজ্ঞানযাত্রার এই লেখাটি পড়ে নিতে পারেন।

ক্যাথলিক ধর্ম? সেটা আবার কী?

আসুন দেখি সেই স্ট্যাটাসটি। এতক্ষণে তা এডিট করে ফেলা হয়েছে, তাই এডিট হিস্টোরি থেকে তুলে দিচ্ছি।

গ্রীক পুরান প্রাচীন ক্যাথলিকদের ধর্মগ্রন্থ
খ্রিস্টধর্ম এবং ক্যাথলিক ধর্ম আলাদা

উল্লেখ্য, ক্যাথলিক ধর্ম বলে আলাদা কোন ধর্ম নেই। ক্যাথলিক চার্চ এবং ক্যাথলিকরা খ্রিস্ট ধর্মের অন্তর্ভূক্ত একটা শাখা। ক্যাথোলিক অর্থ ‘সার্বজনীন’ (including a wide variety of things; all-embracing.), ক্যাথোলিকেরা যীশু খ্রিষ্টের মূর্তি ও বিভিন্ন ছবি বানিয়ে প্রার্থণা করে। যিশু ও তার বারোজন শিষ্য (Twelve Apostles) প্রবর্তিত প্রথম ও অবিভক্ত খ্রিস্টান সম্প্রদায় থেকে শুরু করে পুরুষ পরম্পরার মাধ্যমে, পোপ নির্বাচনের মাধ্যমে এই ক্যাথলিক চার্চ খ্রিস্টান ধর্মের সবচাইতে বড় শাখা হিসেবে সারা পৃথিবীতে পরিচিত। গ্রিক পুরাণের সাথে ক্যাথলিক ধর্মগ্রন্থ কোনভাবেই সম্পর্কিত নয়। গ্রিক পুরাণ মানে প্রাচীন ক্যাথলিক ধর্মগ্রন্থ, এরকম দাবী শুধু মিথ্যাই নয়, হাস্যকরও বটে।

উল্লেখ্য, ক্যাথলিক শব্দটি গ্রিক ভাষা থেকে উদ্ভূত। তবে তার মানে এই নয় যে, গ্রিক পুরাণের সাথে ক্যাথলিক ধর্মগ্রন্থ সম্পর্কিত বা গ্রিক পুরাণে যিশুর সম্পর্কে লেখা ছিল বা ক্যাথলিক খ্রিস্টানরা জিউস বা থেমিসে বিশ্বাস করে। ক্যাথলিক কারা সেটা আপনি নিজেই খুঁজে পড়তে পারেন।

আলোর গতির সাথে মানুষ পাল্লা দিচ্ছে?

আলোর গতিতে মানুষ যাচ্ছে?

আলোর গতির সাথে পাল্লা দেয়ার মত কিছু মানুষ এখনো আবিষ্কার করতে পারে নি। থিওরিটিক্যালি এটা অসম্ভবের কাছাকাছি। কারণ আইনস্টাইনের সূত্র অনুসারে, কোন বস্তুর গতি আলোর গতির কাছাকাছি হতে থাকলে বা আলোর গতি সম্পন্ন হলে তার ভর বাড়তে থাকবে বা হয়ে যাবে অসীম। তাই সেই অসীম ভরের কিছু গতিপ্রাপ্ত করা টেকনিক্যালি কঠিন। এটি যে লিখেছে সে সম্ভবত সায়েন্স ফিকশন পড়ে সায়েন্স বুঝেছে। মানুষ এমন কোন বাহন এখনো বানাতে পারে নি যাতে করে আলোর গতির সাথে পাল্লা দেয়া সম্ভব। সাম্প্রতিক সময়ে ভিন্ন উপায়ে কিছু চেষ্টা হচ্ছে, সেটা আলোর গতির সাথে পাল্লা দিয়ে নয়। তবে কঠিন বলছি কারণ অসম্ভব নয়। আলোর চেয়ে বেশি গতি সম্পন্ন কণা নিয়ে গবেষনা হচ্ছে, অনেকগুলো গবেষনাপত্রও বের হয়েছে যেগুলো খুবই আগ্রহ উদ্দীপক। আবার অনেকগুলো পরীক্ষার ফলাফল পরে ভুল প্রমাণ হয়েছে। যেকেউ চাইলে এই নিয়ে পড়তে পারেন। তবে বর্তমানে মানুষ আলোর গতির সাথে পাল্লা দিচ্ছে, এরকম দাবী অত্যন্ত হাস্যকর। যেটা সাধারণ বিজ্ঞানের একদম স্কুল লেভেলের বই পড়লেও জানা যায়। অথবা আইনস্টাইনের সূত্র যে পড়েছে সেই জানবে।

মহাকাশে কী কোন উপর নিচ আছে?

সূর্য রাতের বেলায় কোথায় যায়?

মহাকাশে কোন উপর নিচ বলেই কিছু নেই। মহাকাশে সবই উপর, আবার সবই নিচ। উপর নিচ হচ্ছে পৃথিবীতে আমরা যারা থাকি, তাদের জন্য একটি আপেক্ষিক বিষয়। কিন্তু পৃথিবী বা অন্য কোন গ্রহের বাইরে উপর নিচের প্রসঙ্গই হাস্যকর। ডাইনে বায়ে উপরে নিচে সবই বিশাল শূন্যতা। তাই কোন দিককে আপনি উপর আর কোন দিককে নিচ ধরবেন? ডান বাম উপর নিচ সবই পৃথিবীর প্রেক্ষিতে, কিন্তু মহাশূন্যে সেগুলোর হিসেব একেবারেই অবান্তর।

ক্যাথলিক মেয়েরা পাদ্রী হতে পারে?

মেয়েরা পাদ্রী হতে পারে?

ইসলামের মত খ্রিস্টান ক্যাথলিকরাও পুরোমাত্রায় পুরুষতান্ত্রিক, তাই ক্যাথলিক মেয়েরা চার্চের পাদ্রী হতে পারে না। হতে পারে চার্চের সেবিকা, বা সিস্টার। এমনকি, সবচাইতে বিখ্যাত মাদার তেরেসা পর্যন্ত ছিলেন একজন ক্যাথলিক নান। নারী হওয়ায় পাদ্রী হওয়ার যোগ্যতাই তার ছিল না। কীভাবে সম্ভব যে, গ্যালিলিওর দুই দুইটি মেয়ে বেমালুম পাদ্রী হয়ে গেল! অবাক কাণ্ড!

সাংবাদিক মানেই কী বিজ্ঞানী? 

নির্বুদ্ধিতা 6
সাংবাদিক আর বিজ্ঞানী কি এক?

উপরের আন্ডারলাইন করা কথাগুলো পড়ুন। উল্লেখিত রিচার্ড মিলটন একজন ফিকশন এবং নন ফিকশন লেখক, এবং সাংবাদিক। উইকিপিডিয়াতে তাকে এতটাই অগুরুত্বপুর্ণ মনে করা হয়েছে যে, তার কোন ছবিও যুক্ত করা হয় নি। কোন অবস্থাতেই তিনি একজন বিজ্ঞানী নন। একাডেমিক লেভেলে বিজ্ঞানী হওয়ার জন্য সেই বিষয়ে একাডেমিক কোয়ালিফিকেশন দরকার হয়। কোন পত্রিকায় কলাম লিখলেই তাঁকে বিজ্ঞানী হিসেবে গণ্য করা শুধুমাত্র আরব দেশগুলোতে সম্ভব। কোন সভ্য দেশে একজন সাংবাদিককে বিজ্ঞানী হিসেবে গণ্য করার কোন প্রশ্নই আসে না। কোন কোন মূর্খ ভাবতেই পারে, কেউ কোন বই লিখলেই সেটা বিজ্ঞান। তা ভাবুক, কিন্তু এরকম দাবী শুধু হাস্যরসই যোগায়।

পৃথিবীর যে কোন গণ্ডমূর্খ বিবর্তনবাদকে মিথ্যা বলতেই পারে। সেই স্বাধীনতা সকলের রয়েছে। বিবর্তনবাদকে মিথ্যা বললে কেউ কল্লা নামিয়ে দেবে না। কিন্তু কোথাকার কোন সাংবাদিক যদি কোন একাডেমিক কোয়ালিফিকেশন এবং জ্ঞান ছাড়াই বিজ্ঞানের কোন বিশেষ বিষয়ে পণ্ডিতি করতে আসে, তাঁকে তো সবাই মূর্খই বলবে, তাই না? ধরুন, কাল যদি কোন উত্তর দক্ষিণডট২৪ ডট কম নামক কোন ভুঁইফোড় পত্রিকার কোন সাংবাদিক দাবী করে, পৃথিবী আসলে সমতল, বিজ্ঞানীরা কী তাঁকে সম্মান করে তার গাঁজাখুরি কথা শুনবে?

ভাবুন তো অবস্থা! কোথাকার কোন সাংবাদিককে নাকি বিজ্ঞানী হিসেবে তার কাজকে সম্মান জানাতে হবে! এরকম অসংখ্য বোকার মত শিশুতোষ কথাবার্তায় ভরপুর এই ছেলেটির প্রোফাইল। একদম যেন ফারাবী শাফিউরের যোগ্য উত্তরসূরি। পার্থক্য হচ্ছে, এই ছেলে মোবাইলে একুশ টাকা চাচ্ছে না। এই সামান্য কয়েকটি উদাহরণ দিলাম। আশ্চর্য্য বিষয় হচ্ছে, একজনও এইসব ভুলগুলো ধরিয়ে তো দিলেনই না, বরঞ্চ মুক্তমনাদের কেউ খুব ভদ্রভাষায় ভুলগুলো ধরিয়ে দেয়া মাত্রই ব্লক করে দেয়া হলো, কমেন্ট মুছে ফেলা হলো, অনেককে গালাগালি এবং জবাই করার হুমকিও দেয়া হলো।

যাইহোক। এদের জন্য করুণা বোধ করি। এরাই হচ্ছে ইসলামি বিজ্ঞানী, এরাই হচ্ছে আগামীর আল্লামা সাইদী। সমস্যা আসলে এদের নয়, আমাদের শিক্ষার কাঠামোই এরকম যে, এইসব ছেলেপেলে গণ্ডায় গণ্ডায় সৃষ্টি হচ্ছে। সেই ব্যর্থতা আমাদের নিজেদেরও যে, আমরা এদের শিক্ষাটুকু দিতে পারি নি। তাই আমি চেষ্টা করলাম। বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করলাম। এরা শিক্ষাটুকু নেবে নাকি আমাকে গালি দিয়ে আমার কল্লা ফেলে দিতে বলবে, তা তারা বিবেচনা করবে। আমার দায়িত্বটুকু শুধু আমি পালন করলাম।

আসিফ মহিউদ্দীন

আসিফ মহিউদ্দীন সম্পাদক সংশয় - চিন্তার মুক্তির আন্দোলন [email protected]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *