বই

প্রবচনগুচ্ছ – হুমায়ুন আজাদ

মানুষ সিংহের প্রশংসা করে, কিন্তু আসলে গাধাকেই পছন্দ করে।

পুঁজিবাদের আল্লার নাম টাকা, মসজিদের নাম ব্যাংক।

সুন্দর মনের থেকে সুন্দর শরীর অনেক আকর্ষণীয়। কিন্তু ভণ্ডরা বলেন উল্টো কথা।

হিন্দুরা মূর্তিপূজারী; মুসলমানেরা ভাবমূর্তিপূজারী। মূর্তিপূজা নির্বুদ্ধিতা; আর ভাবমূর্তিপূজা ভয়াবহ।

শামসুর রাহমানকে একটি অভিনেত্রীর সাথে টিভিতে দেখা গেছে। শামসুর রাহমান বোঝেন না কার সঙ্গে পর্দায়, আর কার সঙ্গে শয্যায় যেতে হয়।

আগে কারো সাথে পরিচয় হ’লে জানতে ইচ্ছে হতো সে কী পাশ? এখন কারো সাথে দেখা হ’লে জানতে ইচ্ছে হয় সে কী ফেল?

শ্রদ্ধা হচ্ছে শক্তিমান কারো সাহায্যে স্বার্থোদ্ধারের বিনিময়ে পরিশোধিত পারিশ্রমিক।

আজকাল আমার সাথে কেউ একমত হ’লে নিজের সম্বন্ধে গভীর সন্দেহ জাগে। মনে হয় আমি সম্ভবত সত্যভ্রষ্ট হয়েছি, বা নিম্নমাঝারি হয়ে গেছি।

‘মিনিষ্টার’ শব্দের মূল অর্থ ভৃত্য। বাঙলাদেশের মন্ত্রীদের দেখে শব্দটির মূল অর্থই মনে পড়ে।

১০

আগে কাননবালারা আসতো পতিতালয় থেকে, এখন আসে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।

১১

জনপ্রিয়তা হচ্ছে নেমে যাওয়ার সিঁড়ি। অনেকেই আজকাল জনপ্রিয়তার পথে নেমে যাচ্ছে।

১২

উন্নতি হচ্ছে ওপরের দিকে পতন। অনেকেরেই আজকাল ওপরের দিকে পতন ঘটছে।

১৩

ব্যর্থরাই প্রকৃত মানুষ, সফলেরা শয়তান।

১৪

আমাদের অঞ্চলে সৌন্দর্য অশ্লীল, অসৌন্দর্য শ্লীল। রুপসীর একটু নগ্নবাহু দেখে ওরা হৈ চৈ করে, কিন্তু পথে পথে ভিখিরিনির উলঙ্গ দেহ দেখে ওরা একটুও বিচলিত হয় না।

১৫

পরমাত্মীয়ের মৃত্যুর শোকের মধ্যেও মানুষ কিছুটা সুখ বোধ করে যে সে নিজে বেঁচে আছে।

১৬

একটি স্থাপত্যকর্ম সম্পর্কেই আমার কোনো আপত্তি নেই, তার কোনো সংস্কারও আমি অনুমোদন করি না। স্থাপত্যকর্মটি হচ্ছে নারীদেহ।

১৭

প্রতিটি দগ্ধ গ্রন্থ সভ্যতাকে নতুন আলো দেয়।

১৮

বাঙলার প্রধান ও গৌণ লেখকদের মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে প্রধানেরা পশ্চিম থেকে প্রচুর ঋণ করেন, আর গৌণরা আবর্তিত হন নিজেদের মৌলিক মূর্খতার মধ্যে।

১৯

মহামতি সলোমনের নাকি তিন শো পত্নী, আর সাত হাজার উপপত্নী ছিলো। আমার মাত্র একটি পত্নী। তবু সলোমনের চরিত্র সম্পর্কে কারো কোনো আপত্তি নেই, কিন্তু আমার চরিত্র নিয়ে সবাই উদ্বিগ্ন।

২০

বাঙালি মুসলমানের এক গোত্র মনে করে নজরুলই পৃথিবীর একমাত্র ও শেষ কবি। আদের আর কোনো কবির দরকার নেই।

২১

বাঙালি যখন সত্য কথা বলে তখন বুঝতে হবে পেছনে কোনো অসৎ উদ্দেশ্য আছে।

২২

আধুনিক প্রচার মাধ্যমগুলো অসংখ্য শুয়োরবৎসকে মহামানবরূপে প্রতিষ্ঠিত করেছে।

২৩

অধিকাংশ রূপসীর হাসির শোভা মাংসপেশির কৃতিত্ব, হৃদয়ের কৃতিত্ব নয়।

২৪

পাকিস্তানিদের আমি অবিশ্বাস করি, যখন তারা গোলাপ নিয়ে আসে, তখনও।

২৫

আবর্জনাকে রবীন্দ্রনাথ প্রশংসা করলেও আবর্জনাই থাকে।

২৬

নিজের নিকৃষ্ট কালে চিরশ্রেষ্ঠ ব্যক্তিদের সঙ্গ পাওয়ার জন্যে রয়েছে বই; আর সমকালের নিকৃষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গ পাওয়ার জন্যে রয়েছে টেলিভিশন ও সংবাদপত্র।

২৭

শৃঙ্খলপ্রিয় সিংহের থেকে স্বাধীন গাধা উত্তম।

২৮

বাঙলায় তরুণ বাবরালিরা খেলারাম, বুড়ো বাবরালিরাভণ্ডরাম।

২৯

প্রাক্তন বিদ্রোহীদের কবরে যখন স্মৃতিসৌধ মাথা তোলে, নতুন বিদ্রোহীরা তখন কারাগারে ঢোকে, ফাসিঁকাঠে ঝোলে।

৩০

একনায়কেরা এখন গণতন্ত্রের স্তব করে, পুজিঁপতিরা ব্যস্ত থাকে সমাজতন্ত্রের প্রশংসায়।

৩১

বেতন বাঙলাদেশে এক রাষ্ট্রীয় প্রতারণা। এক মাস খাটিয়ে এখানে পাঁচ দিনের পারিশ্রমিক দেয়া হয়।

৩২

পুরস্কার অনেকটা প্রেমের মতো; দু-একবার পাওয়া খুবই দরকার, এর বেশি পাওয়া লাম্পট্য।

৩৩

এক-বইয়ের-পাঠক সম্পর্কে সাবধান।

৩৪

অভিনেত্রীরাই এখন প্রাতঃস্মরণীয় ও সর্বজনশ্রদ্ধেয়।

৩৫

কবিরা বাঙলায় বস্তিতে থাকে, সিনেমার সুদর্শন গর্দভেরা থাকে শীতাতপনিয়ন্ত্রিত প্রাসাদে।

৩৬

মানুষের ওপর বিশ্বাস হারানো পাপ, তবে বাঙালির ওপর বিশ্বাস রাখা বিপজ্জনক।

৩৭

বুদ্ধিজীবীরা এখন বিভক্ত তিন গোত্রে। ভণ্ড, ভণ্ডতর, ভণ্ডতম।

৩৮

শিক্ষকের জীবনের থেকে চোর, চোরাচালানি, দারোগার জীবন অনেক আকর্ষণীয়। এ সমাজ শিক্ষক চায় না, চোর- চোরাচালানি-দারোগা চায়।

৩৯

শয়তানের প্রার্থনায় বৃষ্টি নামে না, ঝড় আসে; তাতে অসংখ্য সৎ মানুষের মৃত্যু ঘটে।

৪০

যে বুদ্ধিজীবী নিজের সময় ও সমাজ নিয়ে সন্তুষ্ট, সে গৃহপালিত পশু।

৪১

আর পঞ্চাশ বছর পর আমাকেও ওরা দেবতা বানাবে; আর আমার বিরুদ্ধে কোনো নতুন প্রতিভা কথা বললে ওরা তাকে ফাঁসিতে ঝুলোবে।

৪২

আমি এতো শক্তিমান আগে জানা ছিলো না। আজকাল মিত্র নয়, শত্রুদের সংখ্যা দেখে আত্মবিশ্বাস ফিরে পাই।

৪৩

পা, বাঙলাদেশে, মাথার থেকে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। পদোন্নতির জন্যে এখানে সবাই ব্যগ্র, কিন্তু মাথার যে অবনতি ঘটছে, তাতে কারো কোনো উদ্বেগ নেই।

৪৪

হায় ! থাকতো যদি একটি লম্বা পাঞ্জাবি, আমিও খ্যাতি পেতাম মহাপণ্ডিতের।

৪৫

এখানকার একাডেমিগুলো সব ক্লান্ত গর্দভ; মুলো খাওয়া ছাড়া ওগুলোর পক্ষে আর কিছু অসম্ভব।

৪৬

জন্মাতরবাদ ভারতীয় উপমহাদেশের অবধারিত দর্শন। এ- অঞ্চলে এক জন্মে পরীক্ষা দিতে হয়, আরেক জন্মে ফল বেরোয়, দু-জন্ম বেকার থাকতে হয়, এবং ভাগ্য প্রসন্ন হ’লে কোন এক জন্মে চাকুরি মিলতেও পারে।

৪৭

রবীন্দ্রনাথের নোবেল পুরস্কার পাওয়ার দরকার ছিলো না, কিন্তু দরকার ছিলো বাঙলা সাহিত্যের। পুরস্কার না পেলে হিন্দুরা বুঝতো না যে রবীন্দ্রনাথ বড়ো কবি; আর মুসলমানেরা রহিম, করিমকে দাবি করতো বাঙলার শ্রেষ্ঠ কবি হিশেবে।

৪৮

বাঙলাদেশে কয়েকটি নতুন শাস্ত্রের উদ্ভব ঘটেছে; এগুলো হচ্ছে স্তুতিবিজ্ঞান, স্তবসাহিত্য, সুবিধাদর্শন ও নমস্কারতত্ত্ব।

৪৯

এখানে অসতেরা জনপ্রিয়, সৎ মানুষেরা আক্রান্ত।

৫০

টেলিভিশন, নিকৃষ্ট জিনিশের একনম্বর পৃষ্ঠপোষক, হিরোইন প্যাথেড্রিনের থেকেও মারাত্মক। মাদক গোপনে নষ্ট করে কিছু মানুষকে, টেলিভিশন প্রকাশ্যে নষ্ট করে কোটি কোটি মানুষকে।

৫১

পৌরানিক পুরুষেরা সামান্য অভিজ্ঞতা ভিত্তি ক‘রে অসামান্য সব সিদ্ধান্ত নিতেন। যযাতি পুত্রের কাছে থেকে যৌবন ধার ক’রে মাত্র এক সহস্র বছর

সম্ভোগের পর সিদ্ধান্তে পৌছেন যে সম্ভোগে কখনো তৃপ্তি আসে না! এতো বড়ো একটি সিদ্ধান্তের জন্যে সহস্র বছর খুবই কম সময় : আজকাল কেউ এতো কম অভিজ্ঞতায় এতো বড়ো একটি সিদ্ধান্ত নেয়ার সাহস করবে না।

৫২

অভিনেতারা সব সময়ই অভিনেতা; তারা যখন বিপ্লব করে তখন তারা বিপ্লবের অভিনয় করে। এটা সবাই বোঝে, শুধু তারা বোঝে না।

৫৩

বাঙলাদেশের প্রধান মূর্খদের চেনার সহজ উপায় টেলিভিশনে কোনো আলোচনা-অনুষ্ঠান দেখা। ওই মূর্খমন্ডলিতে উপস্থাপকটি হচ্ছেন মূর্খশিরোমণি।

৫৪

বাঙলা, এবং যে-কোনো, ভাষার শুদ্ধ বানান লেখার সহজতম উপায় শুদ্ধ বানানটি শিখে নেয়া।

৫৫

পৃথিবী জুড়ে প্রতিটি নরনারী এখন মনে ক’রে তাদের জীবন ব্যর্থ; কেননা তারা অভিনেতা বা অভিনেত্রী হ’তে পারে নি।

৫৬

মৌলিকতা হচ্ছে মঞ্চ থেকে দূরে অবস্থান।

৫৭

এরশাদের প্রধান অপরাধ পরিবেশদূষণ : অন্যান্য সরকারগুলো পুরুষদের দূষিত করেছে, এরশাদ দূষিত করেছে নারীদেরও।

৫৮

বাঙালি একশো ভাগ সৎ হবে, এমন আশা করা অন্যায়। পঞ্চাশ ভাগ সৎ হ’লেই বাঙালিকে পুরস্কার দেয়া উচিত।

৫৯

একজন চাষী বা নদীর মাঝি সাংস্কৃতিকভাবে যতোটা মূল্যবান, সারা সচিবালয় ও মন্ত্রীপরিষদও ততোটা মূল্যবান নয়।

৬০

মানুষ ও কবিতা অবিচ্ছেদ্য। মানুষ থাকলে বুঝতে হবে কবিতা আছে : কবিতা থাকলে বুঝতে হবে মানুষ আছে।

৬১

বাঙালি আন্দোলন করে, সাধারণত ব্যর্থ হয়, কখনোকখনো সফল হয়; এবং সফল হওয়ার পর মনে থাকে না কেনো তারা আন্দোলন করেছিলো।

৬২

এদেশের মুসলমান এক সময় মুসলমান বাঙালি, তারপর বাঙালি মুসলামান, তারপর বাঙালি হয়েছিলো; এখন আবার তারা বাঙালি থেকে বাঙালি মুসলমান, বাঙালি মুসলমান থেকে মুসলমান বাঙালি, এবং মুসলমান বাঙালি থেকে মুসলমান হচ্ছে। পৌত্রের ঔরষে

জন্ম নিচ্ছে পিতামহ।

৬৩

নিন্দুকেরা পুরোপুরি অসৎ হ’তে পারেন না, কিছুটা সততা তাঁদের পেশার জন্যে অপরিহার্য; কিন্তু প্রশংসাকারীদের পেশার জন্যে মিথ্যাচারই যথেষ্ট।

৬৪

বাস্তব কাজ অনেক সহজ অবাস্তব কাজের থেকে ; আট ঘন্টা একটানা শ্রম গাধাও করতে পারে, কিন্তু একটানা এক ঘন্টা স্বপ্ন দেখা রবীন্দ্রনাথের পক্ষেও অসম্ভব।

৬৫

একটি নির্বোধ তরুণীর সাথেও আধ ঘণ্টা কাটালে যে-জ্ঞান হয়, আরিস্ততলের সাথে দু-হাজার বছর কাটালেও তা হয় না।

৬৬

প্রতিটি সার্থক প্রেমের কবিতা বোঝায় যে কবি প্রেমিকাকে পায় নি, প্রতিটি ব্যর্থ প্রেমের কবিতা বোঝায় যে কবি প্রেমিকাকে বিয়ে করেছে।

৬৭

বিলেতের কবিগুরু বলেছিলেন যারা সঙ্গীত ভালোবাসে না, তারা খুন করতে পারে; কিন্তু আজকাল হাইফাই শোনার সাথেসাথে এক ছুরিকায় কয়েকটি-গীতিকার, সুরকার, গায়ক/গায়িকাকে খুন করতে ইচ্ছে হয়।

৬৮

এখন পিতামাতারা গৌরব বোধ করেন যে তাঁদের পুত্রটি গুণ্ডা। বাসায় একটি নিজস্ব গুণ্ডা থাকায় প্রতিবেশীরা তাঁদের সালাম দেয়, মুদিদোকানদার খুশি হয়ে বাকি দেয়, বাসার মেয়েরা নির্ভয়ে একলা পথে

বেরোতে পারে, এবং বাসায় একটি মন্ত্রী পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

৬৯

তৃতীয় বিশ্বের নেতা হওয়ার জন্যে দুটি জিনিশ দরকার : বন্দুক ও কবর।

৭০

প্রতিটি বিজ্ঞাপনে পণ্যটির থেকে পণ্যাটি অনেক লোভনীয়; তাই ব্যর্থ হচ্ছে বিজ্ঞাপনগুলো। দর্শকেরা পণ্যের থেকে পণ্যাটিকেই কিনতে ও ব্যবহার

করতে অধিক আগ্রহ বোধ করে।

৭১

কোন দেশের লাঙলের রূপ দেখেই বোঝা যায় ওই দেশের মেয়েরা কেমন নাচে, কবিরা কেমন কবিতা লেখেন, বিজ্ঞানীরা কী আবিষ্কার করেন, আর রাজনীতিকেরা কতোটা চুরি করে।

৭২

যারা ধর্মের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দেয়, তারা ধার্মিকও নয়, বিজ্ঞানীও নয়। শুরুতেই স্বর্গ থেকে যাকে বিতারিত করা হয়েছিলো, তারা তার বংশধর।

৭৩

যতোদিন মানুষ অসৎ থাকে, ততোদিন তার কোনো শত্রু থাকে না; কিন্তু যেই সে সৎ হয়ে উঠে, তার শত্রুর অভাব থাকে না।

৭৪

নারী সম্পর্কে আমি একটি বই লিখছি; কয়েকজন মহিলা আমাকে বললেন, অধ্যাপক হয়ে আমার এ-বিষয়ে বই লেখা ঠিক হচ্ছে না। আমি জানতে চাইলাম, কেনো ? তাঁরা বললেন, বিষয়টি অশ্লীল !

৭৫

এদেশে সবাই শিক্ষানুরাগী ও সমাজসেবক : দারোগার শোকসংবাদেও লেখা হয়, ‘তিনি শিক্ষানুরাগী ও সমাজসেবক ছিলেন!’

৭৬

শিল্পকলা হচ্ছে নিরর্থক জীবনকে অর্থপূর্ণ করার ব্যর্থ প্রয়াস।

৭৭

কিছু বিশেষণ ও বিশেষ্য পরস্পরসম্পর্কিত; বিশেষ্যটি এলে বিশেষণটি আসে, বিশেষণটি এলে বিশেষ্যটি আসে। তারপর একসময় একটি ব্যবহার করলেই অন্যটি বোঝায়, দুটি একসাথে ব্যবহার করতে হয় না। যেমন : ভণ্ড বললেই পীর আসে, আবার পীর বলতেই ভন্ড আসে। এখন আর ‘ভণ্ড পীর’ বলতে হয় না; ‘পীর’ বললেই ‘ভণ্ড পীর’ বোঝায়।

৭৮

ভক্ত শব্দের অর্থ খাদ্য। প্রতিটি ভক্ত তার গুরুর খাদ্য। তাই ভক্তরা দিনদিন জীর্ণ থেকে জীর্ণতর হয়ে আবর্জনায় পরিণত হয়।

৭৯

মূর্তি ভাঙতে লাগে মেরুদণ্ড, মূর্তিপূজা করতে লাগে মেরুদণ্ডহীনতা।

৮০

আমাদের সমাজ যাকে কোনো মূল্য দেয় না, প্রকাশ্যে তার অকুণ্ঠ প্রশংসা করে, আর যাকে মূল্য দেয় প্রকাশ্যে তার নিন্দা করে। শিক্ষকের কোনো মূল্য নেই, তাই তার প্রশংসায় সমাজ পঞ্চমুখ; চোর, দারোগা, কালোবাজারি সমাজে অত্যন্ত মুল্যবান, তাই প্রকাশ্যে সবাই তাদের নিন্দা

করে।

৮১

সৌন্দর্য রাজনীতির থেকে সব সময়ই উৎকৃষ্ট।

৮২

ক্ষুধা ও সৌন্দর্যবোধের মধ্যে গভীরসম্পর্ক রয়েছে। যে-সব দেশে অধিকাংশ মানুষঅনাহারী, সেখানে মাংসল হওয়া রূপসীর লক্ষণ; যে-সব

দেশে প্রচুর খাদ্য আছে,সেখানে মেদহীন হওয়া রূপসীর লক্ষণ। এজন্যেই হিন্দি আর বাঙলা ফিল্মের নায়িকাদের দেহ থেকে মাংস চর্বি উপচে পড়ে। ক্ষুধার্ত দর্শকেরা সিনামা দেখে না, মাংস ও চর্বি খেয়ে ক্ষুধা নিবৃত্ত করে।

৮৩

বাঞ্ছিতদের সাথে সময় কাটাতে চাইলে বই খুলুন, অবাঞ্ছিতদের সাথে সময় কাটাতে চাইলে টেলিভিশন খুলুন।

৮৪

স্তবস্তুতি মানুষকে নষ্ট করে। একটি শিশুকে বেশি স্তুতি করুন, সে কয়েকদিনে পাক্কা শয়তান হয়ে উঠবে। একটি নেতাকে স্তুতি করুন, কয়েকদিনের মধ্যে দেশকে সে একটি একনায়ক উপহার দেবে।

৮৫

ধনীরা যে মানুষ হয় না, তার কারণ ওরা কখনো নিজের অন্তরে যায় না। দুঃখ পেলে ওরা ব্যাংকক যায়, আনন্দেওরা আমেরিকা যায়। কখনো ওরা নিজের অন্তরে যেতে পারে না, কেননা অন্তরে কোনো বিমান যায় না।

৮৬

বাঙলাদেশের রাজনীতিকেরা স্থূল মানুষ, তারা সৌন্দর্য বোঝে না ব’লে গণতন্ত্রও বোঝে না; শুধু লাইসেন্স-পারমিট-মন্ত্রীগিরি বোঝে।

৮৭

এমন এক সময় আসে সকলেরই জীবনে যখন ব্যর্থতাগুলোকেই মনে হয় সফলতা, আর সফলতাগুলোকে মনে হয় ব্যর্থতা।

৮৮

রাজনীতি ও সংস্কৃতি সম্পুর্ণ বিপরীত বস্তু ; একটি ব্যাধি অপরটি স্বাস্থ্য।

৮৯

মহিলাদের ঘ্রাণশক্তি খুবই প্রবল। আমার এক বন্ধুপত্নী স্বামীর সাথে টেলিফোনে আলাপের সময়ও তার স্বামীর মুখে হুইস্কির ঘ্রাণ পান।

৯০

আগে প্রতিভাবানেরা বিদেশ যেতো; এখন প্রতিভাহীনেরা নিয়মিত বিদেশ যায়।

৯১

অধিকাংশ সুদর্শন পুরুষই আসলে সুদর্শন গর্দভ; তাদের সাথে সহবাসে একটি দুষ্প্রাপ্য প্রাণীর সাথে সহবাসের অভিজ্ঞতা হয়।

৯২

বিশ্বের নারী নেতারা নারীদের প্রতিনিধি নয় ; তারা সবাই রুগ্ন পিতৃতন্ত্রের প্রিয় সেবাদাসী।

৯৩

কোন বাঙালি আজ পর্যন্ত আত্মজীবনী লেখে নি, কেননা আত্মজীবনী লেখার জন্যে দরকার সততা। বাঙালির আত্মজীবনী হচ্ছে শয়তানের লেখা ফেরেশতার আত্মজীবনী।

৯৪

মানুষের তুলনায় আর সবই ক্ষুদ্র : আকাশ তার পায়ের নিচে,চাঁদ তার এক পদক্ষেপের দূরত্বে, মহাজগত তার নিজের বাড়ি।

৯৫

কারো প্রতি শ্রদ্ধা অটুট রাখার উপায় হচ্ছে তার সাথে কখনো সাক্ষাৎ না করা।

৯৬

চারাগাছেও মাঝেমাঝে ফোটে ভয়ংকর ফুল।

৯৭

পুরুষ তার পুরুষ বিধাতার হাতে লিখিয়ে নিয়েছে নিজেররচনা; বিধাতা হয়ে উঠেছে পুরুষের প্রস্তুত বিধানের শ্রুতিলিপিকর।

৯৮

হিন্দুবিধানে পুরুষ দ্বারা দূষিত না হওয়া পর্যন্ত নারী পরিশুদ্ধ হয় না!

৯৯

উচ্চপদে না বসলে এদেশে কেউ মূল্য পায় না। সক্রেটিস এদেশে জন্ম নিলে তাঁকে কোনো একাডেমির মহাপরিচালক পদের জন্যে তদ্বির চালাতে

হতো।

১০০

সব ধরনের অভিনয়ের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হচ্ছে রাজনীতি; রাজনীতিকেরা অভিনয় করে সবচেয়ে বড় মঞ্চে ও পর্দায়।

১০১

সক্রেটিস বলেছেন তিনি দশ সহস্র গর্দভ দ্বারা পরিবৃত। এখন থাকলে তিনি ওই সংখ্যার ডানে কটি শূন্য যোগ করতেন?

১০২

বাঙালি মুসলমান জীবিত প্রতিভাকে লাশে পরিনত করে, আর মৃত প্রতিভার কবরে আগরবাতি জ্বালে।

১০৩

নজরুলসাহিত্যের আলোচকেরা সমালোচক নন, তাঁরা নজরুলের মাজারের খাদেম।

১০৪

ভ্রষ্ট বাঙালিকে ভালোবাসার শ্রেষ্ঠ উপায় তার গালে শক্ত ক’রে একটি চড় কষিয়ে দেয়া।

১০৫

ভিখিরির জীবন মহৎ উপন্যাসের বিষয় হ’তে পারে, কিন্তু রাষ্ট্রপ্রধানদের জীবন সুখপাঠ্য গুজবনামারও অযোগ্য।

১০৬

বাঙালির জাতিগত আলস্য ধরা পড়ে ভাষায়। বাঙালি ‘দেরি করে’, ‘চুরি করে’, ‘আশা করে’, এমনকি ‘বিশ্রাম করে’। বিশ্রামও বাঙালির কাছে কাজ।

১০৭

বাঙালি অভদ্র, তার পরিচয় রয়েছে বাঙালির ভাষায়। কেউ এলে বাঙালি জিজ্ঞেস করে, ‘কী চাই?’ বাঙালির কাছে আগন্তুকমাত্রই ভিক্ষুক। অপেক্ষা করার অনুরোধ জানিয়ে বাঙালি বলে, ‘দাঁড়ান’। বসতে বলার সৌজন্যটুকুও বাঙালির নেই।

১০৮

এখানে সাংবাদিকতা হচ্ছে নিউজপ্রিন্ট-বলপয়েন্ট-মিথ্যার পাচঁন।

১০৯

মানুষ মরণশীল, বাঙালি অপমরণশীল।

১১০

এ-সরকার মাঝে মাঝে গোপন চক্রান্ত ফাঁস ক’রে ফেলে। সরকার মাটি আর মানুষের সমন্বয় ঘটানোরসংকল্প ঘোষণা করেছে। আমি ভয় পাচ্ছি, কেননা মাটি ও মানুষের সমন্বয় ঘটে শুধু কবরে।

১১১

আজকালকার আধিকাংশ পি এইচ ডি অভিসন্দর্ভই মনে আশার আলো জ্বালায়; মনে হয় এখানেই নিহিত আমাদের শিক্ষাসমস্যা সমাধানের বীজ। প্রথম বর্ষ অনার্স শ্রেণীতেই এখন পি এইচ ডি কোর্স চালু করা সম্ভব, এতে ছাত্ররা আড়াই বছরে একটি ডক্টরেট ডিগ্রি পেতে পারে।

এখানকার অধিকাংশ ডক্টরেটই স্নাতকপূর্ব ডক্টরেট; অদূর ভবিষ্যতে উচ্চ-মাধ্যমিক ডক্টরেটও পাওয়া যাবে।

১১২

সত্য একবার বলতে হয়; সত্য বারবার বললে মিথ্যার মতো শোনায়। মিথ্যা বারবার বলতে হয়; মিথ্যা বারবার বললে সত্য ব’লে মনে হয়।

১১৩

ফুলের জীবন বড়োই করুণ। অধিকাংশ ফুল অগোচরেই ঝ’রে যায়, আর বাকিগুলো ঝোলে শয়তানের গলায়।

১১৪

ঢাকা শহরে, ক্রমবর্ধমান এ-পাগলাগারদে, সাতাশ বছর আছি। ঢাকা এখন বিশ্বের বৃহত্তম পাগলাগারদ; রাজধানি নয়, এটা পাগলাধানি; কিন্তু বদ্ধপাগলেরা তা বুঝতে পারে না।

১১৫

বদমাশ হওয়ার থেকে পাগল হওয়া অনেক মানবিক।

১১৬

টেলিভিশনে জাহাজমার্কা আলকাতরার বিজ্ঞাপনটি আকর্ষণীয়, তাৎপর্যপূর্ণ; তবে অসম্পুর্ণ । বিজ্ঞাপনটিতে জালে,জাহাজে, টিনের চালে আলকাতরা লাগানোর উপকারিতার কথা বলা হয়; কিন্তু বলা উচিত ছিলো যে জাহাজমার্কা আলকাতরা লাগানোর উৎকৃষ্টতম স্থান হচ্ছে টেলিভিশনের

পর্দা, বিশেষ ক’রে যখন বাঙলাদেশ টেলিভিশনের অনুষ্ঠান দেখা যায়।

১১৭

রবীন্দ্রনাথ এখন বাঙলাদেশের মাটিথেকে নির্বাসিত, তবে আকাশটা তাঁর। বাঙলার আকাশের নাম রবীন্দ্রনাথ।

১১৮

গণশৌচাগার দেখলেই কেনোযেনো আমার বাঙালির আত্মাটির কথা বারবার মনে পড়ে।

১১৯

আমাদের অধিকাংশের চরিত্রএতো নির্মল যে তার নিরপেক্ষ বর্ণনা দিলেও মনে হয় অশ্লীলগালাগাল করা হচ্ছে।

১২০

এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি,তুমি কথা বলো।

১২১

বিনয়ীরা সুবিধাবাদী, আর সুবিধাবাদীরা বিনয়ী।

১২২

মোল্লারা পবিত্র ধর্মকেই নষ্ট ক’রে ফেলেছে; ওরা হাতে রাষ্ট্র পেলে তাকে জাহান্নাম ক’রে তুলবে ।

১২৩

জীবন খুবই মূল্যবান : জীবনবাদীরাযতোটা মূল্যবান মনে করে, তার চেয়ে অনেক বেশি মূল্যবান। আর শিল্পকলা জীবনের থেকেও মূল্যবান।

১২৪

দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম প্রেম ব’লে কিছু নেই। মানুষ যখন প্রেমে পড়ে, তখন প্রতিটি প্রেমই প্রথম প্রেম।

১২৫

মার্ক্সবাদের কথা শুনলে এখন মোল্লারাও ক্ষেপে না, সমাজতন্ত্রের কথা তারা সন্তোষের সাথেই শোনে; কিন্তুশরীরের কথা শুনলে লম্পটরাও ধর্মযুদ্ধে নামে।

১২৬

কোন কালে এক কদর্য কাছিম দৌড়ে হারিয়েছিলো এক খরগোশকে, সে-গল্পে কয়েক হাজার ধ’রে মানুষ মুখর। তারপর খরগোশ কতো সহস্রবার হারিয়েছে কাছিমকে, সে-কথা কেউ বলে না।

১২৭

বিধাতা মৌলবাদী নয়। কে প্রার্থনা করলো, কে করলো না; কে কোন তরুণীর গ্রীবার দিকে তাকালো, কোন রূপসী তার রূপের কতো অংশ

দেখালো, এসব তাকে বিন্দুমাত্র উদ্বিগ্ন করে না। কিন্তু বিধাতার পক্ষে এতে ভীষণ উদ্বিগ্ন বোধ করে ভণ্ডরা।

১২৮

খুব ভেবে চিনতে মানুষ আত্মসমর্পণ করে, আর অনুপ্রাণিত মুহূর্তে ঘোষণা করে স্বাধীনতা।

১২৯

মানুষ যখন তার শ্রেষ্ঠ স্বপ্নটি দেখে তখনি সে বাস করে তার শ্রেষ্ঠ সময়ে।

১৩০

এ-বদ্বীপে দালালি ছাড়া ফুলও ফোটে না, মেঘও নামে না।

১৩১

আমার লেখার যে-অংশ পাঠককে তৃপ্তি দেয়, সেটুকু বর্তমানের জন্যে; আর যে-অংশ তাদের ক্ষুব্ধ করে সেটুকু ভবিষ্যতের জন্য।

১৩২

পৃথিবীতে একটি মাত্র দক্ষিনপন্থী সাম্যবাদী দল রয়েছে। সেটি আছে বাঙলাদেশে।

১৩৩

আমাদের প্রায়-প্রতিটি মার্ক্সবাদী তাত্ত্বিকের ভেতরে একটি ক’রে মৌলবাদী বাস করে। তারা পান করাকে পাপ মনে করে, প্রেমকে গুনাহ্ মনে করে, কিন্তু চারখান বিবাহকে আপত্তিকর মনে করে না।

১৩৪

শ্রেষ্ঠ মানুষের অনুসারীরাও কতোটা নিকৃষ্ট হ’তে পারে চারদিকে তাকালেই তা বোঝা যায়।

১৩৫

ঋষি রবীন্দ্রনাথের ছবি দেখলে বাল্যকাল থেকেই তাঁর জন্মাব্দ ১৮৬১র আগে দুটি বর্ণ যোগ করতে আমার ইচ্ছে হয়। বর্ণ দুটি হচ্ছে খ্রিপূ।

১৩৬

বাঙলার প্রতিটি ক্ষমতাধিকারী দল সংখ্যাগরিষ্ঠ দুর্বৃত্তদের সংঘ।

১৩৭

কবিতা এখন দু-রকম: দালালি, ও গালাগালি।

১৩৮

বাঙলাদেশের সাহিত্যে আধুনিকতাপর্বের পর কি আসবে আধুনিকতা-উত্তর-পর্ব ? না। আসতে দেখছি গ্রাম্যতার পর্ব।

১৩৯

পাকিস্থানের ইতিহাস ঘাতক আর শহীদদের ইতিহাস। বাঙলাদেশের ইতিহাস শহীদ আর ঘাতকদের ইতিহাস।

১৪০

বাঙলার বিবেক খুবই সন্দেহজনক। বাঙলার চুয়াত্তরের বিবেক সাতাত্তরে পরিণত হয় সামরিক একনায়কের সেবাদাসে।

১৪১

বাঙলাদেশ অমরদের দেশ। এ-দেশের প্রতি বর্গমিটার মাটির নিচে পাঁচ জন ক’রে অমর ঘুমিয়ে আছেন।

১৪২

একবার রাজাকার মানে চিরকাল রাজাকার; কিন্তু একবার মুক্তিযোদ্ধা মানে চিরকাল মুক্তিযোদ্ধা নয়।

১৪৩

পৃথিবী জুড়ে সমাজতন্ত্রের সাম্প্রতিক দুরবস্থার সম্ভবত গভীর ফ্রয়েডীয় কারণ রয়েছে। সমাজতন্ত্রের মার্ক্সীয়, লেলিনীয়, স্তালিনীয় আবেদন ছিলো,

কিন্তু যৌনাবেদন ছিলো না।

১৪৪

স্বার্থ সিংহকে খচ্চরে আর বিপ্লবীকে ক্লীবে পরিণত করে।

১৪৫

অপন্যাস হচ্ছে সে-ধরনের সাহিত্য, যা বছরেলাখ টন উৎপাদিত হ’লেও সাহিত্যের কোনো উপকার হয় না; আর আধ কেজি উৎপাদিত না হ’লেও

কোনো ক্ষতি হয় না।

১৪৬

আঠারো তলা টাওয়ারের থেকে শিশিরবিন্দু অনেক উঁচু। চিরকাল শিশিরবিন্দুর পাদদেশে দাঁড়িয়ে আছি, কিন্তু অনেক টাওয়ারের চুড়োয় উঠেছি।

১৪৭

সৎ মানুষ মাত্রই নিঃসঙ্গ, আর সকলের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু।

১৪৮

বিপ্লবীদের বেশি দিন বাঁচা ঠিক নয়। বেশি বাঁচলেই তারা প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে ওঠে।

১৪৯

পুঁজিবাদী পর্বের সবচেয়ে বড়ো ও জনপ্রিয় কুসংস্কারের নাম প্রেম।

১৫০

জীবনের সারকথা কবর।

১৫১

শাড়ি প’রে শুধু শুয়ে থাকা যায়; এজন্যে বাঙালি নারীদেরহাঁটা হচ্ছে চলমান শোয়া।

১৫২

শাশ্বত প্রেম হচ্ছে একজনের শরীরে ঢুকে আরেকজনকে স্বপ্ন দেখা।

১৫৩

প্রেম হচ্ছে নিরন্তর অনিশ্চয়তা; বিয়ে ও সংসার হচ্ছে চূড়ান্ত নিশ্চিন্তির মধ্যে আহার, নিদ্রা, সঙ্গম, সন্তান, ও শয়তানি।

১৫৪

মধ্যবিত্ত পতিতাদের নিয়ে সমস্যা হচ্ছে তারা পতিতার সুখ ও সতীর পূণ্য দুটিই দাবি করে।

১৫৫

ইতিহাস হচ্ছে বিজয়ীর হাতে লেখা বিজিতের নামে একরাশ কুৎসা।

১৫৬

এখানে কোনো কিছু সম্পর্কে কিছু লেখাকে মনে করা হয় গভীর শ্রদ্ধার প্রকাশ। গাধা সম্পর্কে আমি একটি বই লিখেছি, অনেকে মনে করেন আমি গাধার প্রতি যারপরনাই শ্রদ্ধাশীল। গরু সম্পর্কে আমি একটি বই লিখেছি, অনেকে মনে করেন গরুর প্রতি আমি প্রকাশ করেছি আমার অশেষ শ্রদ্ধা। নারী সম্পর্কে আমি একটি বই লিখেছি। একটি পার্টটাইম পতিতা, যার তিনবার হাতছানিতেও আমি সাড়া দিই নি, অভিযোগ করেছেন, নারী সম্পর্কে বই লেখার কোনো অধিকার আমার নেই, যেহেতু আমি পতিতাদের শ্রদ্ধা করি না, অর্থাৎ তাদের হাতছানিতে সাড়া দিই না।

১৫৭

পুরুষতান্ত্রিক সভ্যতার শ্রেষ্ঠ শহীদের নাম মা।

১৫৮

গত দু-শো বছরে গবাদিপশুর অবস্থার যতোটা উন্নতি ঘটেছে নারীর অবস্থার ততোটা উন্নতি ঘটে নি।

১৫৯

মসজিদ ভাঙে ধার্মিকেরা, মন্দিরও ভাঙে ধার্মিকেরা, তারপরও তারা দাবি করে তারা ধার্মিক, আর যারা ভাঙাভাঙিতে নেই তারা অধার্মিক বা নাস্তিক।

১৬০

মসজিদ ভাঙলে আল্লার কিছু যায় আসে না, মন্দির ভাঙলে ভগবানের কিছু যায় আসে না; যায় আসে শুধু ধর্মান্ধদের। ওরাই মসজিদ ভাঙে, মন্দির ভাঙে।

১৬১

মসজিদ তোলা আর ভাঙার নাম রাজনীতি, মন্দির ভাঙা আর তোলার নাম রাজনীতি। কিন্তু ওরা তাকে চালায় ধর্মের নামে।

১৬২

মসজিদ ও মন্দির ভাঙার সময় একটি সত্য দীপ্ত হয়ে ওঠে যে আল্লা ও ভগবান কতো নিষ্ক্রিয়, কতো অনুপস্থিত।

১৬৩

পৃথিবীতে রাজনীতি থাকবেই। নইলে ওই অপদার্থ অসৎ লোভী দুষ্ট লোকগুলো কী করবে?

১৬৪

ক্ষমতায় যাওয়ার একটিই উপায়; সমস্যা সৃষ্টি করা। সমস্যা সমাধান ক’রে কেউ ক্ষমতায় যায় না, যায় সৃষ্টি ক’রে।

১৬৫

পশু আর পাখিরাই মানবিক।

১৬৬

অন্যদের কাহিনীর ক্ষীণ সূত্র নিয়ে হ্যামলেট বা ওথেলো বা ম্যাকবেথ লেখা, আর বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পথের পাঁচালী কেটে কেটে, নষ্ট ক’রে, সত্যজিতের পথের পাঁচালী তৈরি করা সম্পূর্ণ ভিন্ন কথা। অন্যের কাহিনীসূত্র নিয়ে হ্যামলেট লেখা মানবপ্রজাতির একজনের বিস্ময়কর প্রতিভার লক্ষণ, আর বিভূতিভূষণের পথের পাঁচালী ছিঁড়ে

সত্যজিতের পথের পাঁচালী তৈরি চিত্রগ্রহণদক্ষতার পরিচায়ক। আরেকটি উৎকৃষ্টতর হ্যামলেট বা ওথেলো বা ম্যাকবেথ, বা মেঘনাদবধ মানুষের ইতিহাসে আর লেখা হবে না; কিন্তু সত্যজিতের পথের পাঁচালীর থেকে উৎকৃষ্ট পথের পাঁচালী হয়তো তৈরি হবে আগামী দশকেই।

১৬৭

সত্যজিত যদি ভারতরত্ন হন, তবে বিভূতিভূষণ বিশ্বরত্ন, সভ্যতারত্ন; কিন্তু অসভ্য প্রচারের যুগে মহৎ বিভূতিভূষণকে পৃথিবী কেনো ভারতও চেনে না, চেনে গৌণ সত্যজিৎকে।

১৬৮

বিভূতিভূষণের পথের পাঁচালীর পাশে সত্যজিতের চলচিত্রটি খুবই শোচনীয় বস্তু, ওটি তৈরি না হ’লেও ক্ষতি ছিলো না; কিন্তু বিভূতিভূষণ যদি পথের পাঁচালী না লিখতেন, তাহলে ক্ষতি হতো সভ্যতার।

১৬৯

সৌন্দর্য যেভাবেই থাকে সেভাবেই সুন্দর।

১৭০

শরীরই শ্রেষ্ঠতম সুখের আকর। গোলাপের পাপড়ির ওপর লক্ষ বছর শুয়ে থেকে, মধুরতম দ্রাক্ষার সুরা কোটি বছর পান ক’রে, শ্রেষ্ঠতম সঙ্গীত সহস্র

বছর উপভোগ ক’রে যতোখানি সুখ পাওয়া যায়, তার চেয়ে অর্বুদগুণ বেশি সুখ মেলে কয়েক মুহূর্ত শরীর মন্থন ক’রে।

১৭১

মানুষের উৎপত্তি সম্পর্কে দুটি তত্ত্ব রয়েছে : অবৈজ্ঞানিকটি অধঃপতনতত্ত্ব,

বৈজ্ঞানিকটি বিবর্তনতত্ত্ব। অধঃপতনতত্ত্বের সারকথা মানুষ স্বর্গ থেকে অধঃপতিত। বিবর্তনতত্ত্বের সারকথা মানুষ বিবর্তনের উৎকর্ষের ফল। অধঃপতনবাদীরা অধঃপতনতত্ত্বে বিশ্বাস করে; আমি যেহেতু মানুষের উৎকর্ষে বিশ্বাস করি, তাই বিশ্বাস করি বিবর্তনতত্ত্বে। অধঃপতন থেকে উৎকর্ষ সব সময়ই উৎকৃষ্ট।

১৭২

শোনা যায় পুরোনো কালে ঘটতো নানা অলৌকিক ঘটনা, তবে পুরোনো কালের অলৌকিক ঘটনাগুলো বানানো বা ভোজবাজি। প্রকৃত অলৌকিক ঘটনার কাল হচ্ছে বিশশতক। পুরোনো কালের কোনো মোজেজ লাঠিকে সাপ বানাতে, বা সমুদ্রের উপর সড়ক তৈরি করতে পারতেন- ক্ষণিকের জন্যে। ওগুলো নিম্নমানের যাদু। সত্য স্থায়ী অলৌকিকতা সৃষ্টি করতে পেরেছে শুধু বিশশতকের বিজ্ঞান। বিদুৎ, বিমান, টেলিভিশন, কম্পিউটার,

নভোযান, এমনকি সামান্য শেলাইকলটিও অতীতের যে-কোনো অলৌকিক ঘটনার চেয়ে অনেক বেশি অলৌকিক। বিজ্ঞান অলৌকিকতাকে সত্যে পরিণত করেছে ব’লে গাধাও তাতে বিষ্মিত হয় না, কিন্তু পুরোনো তুচ্ছ অলৌকিকতার কথায় সবাই বিহ্বল হয়ে ওঠে।

১৭৩

পুরোনো কালের মানুষ যদি দৈবাৎ একটি টেলিভিশনের সামনে এসে পড়তো, তাহলে তাকে দেবতা মনে ক’রে পুজো করতো। আজো সেই পুজো চলতো।

১৭৪

ধর্মের কাজ মানুষের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করা; তাই এক ধার্মিকের রক্তে সব সময়ই গোপনে শানানো হ’তে থাকে অন্য ধার্মিককে জবাই করার ছুরিকা।

১৭৫

ধার্মিক কখনোই সম্পুর্ন মানুষ নয়, অনেক সময় মানুষই নয়।

১৭৬

মৃত সিংহের থেকে জীবিত গাধাও কতো জোতির্ময় উজ্জ্বল !

১৭৭

আমার অনুরাগীরা চরম অনুরাগ প্রকাশের সময় খুব আবেগভরে বলেন যে আমার মতো পণ্ডিত ও প্রতিভাবান লোক আর নেই; তাই আমার অনেক কিছুই হওয়া উচিত। যেমন অবিলম্বে আমার হওয়া উচিত কোনো একাডেমির মহাপরিচালক, বা কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ইত্যাদি।

শুনে আমি তাঁদের ও নিজের জন্যে খুব করুণা বোধ করি। আমি হ’তে চাই মহৎ, আর অনুরাগীরা আমাকে ক’রে তুলতে চান ভৃত্য।

১৭৮

আপনি যখন হেঁটে যাচ্ছেন তখন গাড়ি থেকে যদি কেউ খুব আন্তরিকভাবে মিষ্টি হেসে আপনার দিকে হাত নাড়ে, তখন তাকে বন্ধু মনে করবেন

না। মনে করবেন সে তার গাড়িটার দিকে আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ ক’রে আপনাকে কিছুটা পীড়ন ক’রে সুখী হ’তে চায়।

১৭৯

শিশু, সবুজ, তরুণীরা আছে ব’লে বেঁচে থাকা আজো আমার কাছে আপত্তিকর হয়ে ওঠে নি।

১৮০

টাকাই অধিকাংশ মানুষের একমাত্র ইন্দ্রিয়।

১৮১

শিল্পীর কতোটা স্বাধীনতা দরকার ? নির্বোধেরা মনে করে এবং দাবি করে যে শিল্পীর দরকার অবাধ স্বাধীনতা। যেনো শিল্পীকে সমাজরাষ্ট্র অবাধ স্বাধীনতা দিয়ে দেবে, আর সে মনের আনন্দে শিল্পকলা সৃষ্টি ক’রে চলবে। এটা শিল্পকলা ও স্বাধীনতা সম্পর্কে এক মর্মস্পর্শী ভ্রান্তি। সত্য

এর বিপরীত। সাধারণ মানুষের থেকে একবিন্দুও বেশি স্বাধীনতা শিল্পীর দরকার নয়; সাধারণ মানুষেরই দরকার অবাধ স্বাধীনতা, কেননা তার স্বাধীনতা সৃষ্টি করতে পারে না। শিল্পীর কোনো দরকার পড়ে না দিয়ে দেয়া স্বাধীনতার, কেননা শিল্পীর কাজই স্বাধীনতা সৃষ্টি করা, আর স্বাধীনতা সৃষ্টি করার প্রথাগত নাম হচ্ছে শিল্পকলা।

১৮২

মানুষ মরলে লাশ হয়, সংস্কৃতি মরলে প্রথা হয়।

১৮৩

ক্ষমতায় থাকার সময় যারা সত্য প্রকাশ করতে দেয় না, ক্ষমতা হারানোর পর তারা অজস্র মিথ্যার প্রকাশ রোধ করতে পারে না।

১৮৪

আমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে।

১৮৫

পৃথিবীর প্রধান বিশ্বাসগুলো অপবিশ্বাস মাত্র। বিশ্বাসীরা অপবিশ্বাসী।

১৮৬

শয়তানই আজকাল আল্লা আর ঈশ্বরের নাম নিচ্ছে প্রাণ ভ’রে। আদিম শয়তান আর যাই হোক রাজনীতিবিদ ছিলো না, কিন্তু শয়তান এখন রাজনীতি শিখেছে; আল্লা আর ঈশ্বর আর জেসাসের নামে দিনরাত শ্লোগান দিচ্ছে।

১৮৭

মৌলবাদ হচ্ছে আল্লার নামে শয়তানবাদ।

১৮৮

একটি ধর্মান্ধের মুখের দিকে তাকালেই বোঝা যায় আল্লা অমন লোককে পছন্দ করতে পারে না।

১৮৯

ঐতিহ্য বলতে এখানে লাশকেই বোঝায়। তবে লাশ জীবনকে কিছুই দিতে পারে না।

১৯০

গাধা একশো বছর বাঁচলেও সিংহ হয় না।

১৯১

একটি আমলা আর একটা মন্ত্রীর সাথে পাঁচ মিনিট কাটানোর পর জীবনের প্রতি ঘেন্না ধ’রে গেলো; তারপর একটি চড়ুইয়ের সাথে দু-মুহূর্ত কাটিয়ে জীবনকে আবার ভালবাসলাম।

১৯২

আমি ঈর্ষা করি শুধু তাদের যারা আজো জন্মে নি।

১৯৩

ভাবাদর্শগত জীবন হচ্ছে বন্দী জীবন। মানুষ জীবন যাপনের জন্যে জন্মেছে, ভাবাদর্শ যাপনের জন্যে জন্মে নি।

১৯৪

মুসলমানের মুক্তি ঘটে নি, কারণ তারা অতীত ও তাদের মহাপুরুষদের সম্পর্কে কোনো সত্যনিষ্ঠ আলোচনা করতে দেয় না।

১৯৫

গান্ধি দাবি করেন যে তিনি একই সাথে হিন্দু, খ্রিষ্টান, মুসলমান, বৌদ্ধ, ইহুদি, কনফুসীয় ইত্যাদি। একে তিনি ও তাঁর অনুসারীরা মহৎ ব্যাপার ব’লে মনে করেছেন। কিন্তু এটা প্রতারণা, ও অত্যন্ত ভয়ঙ্কর ব্যাপার,- তিনি নিজেকে ক’রে তুলেছেন সব ধরনের খারাপের সমষ্টি। এমন প্রতারণা থেকেই উৎপত্তি হয়েছে বাবরি মসজিদ উপাখ্যানের। তিনি যদি বলতেন আমি হিন্দু নই, খ্রিস্টান নই, মুসলমান নই, বৌদ্ধ নই, ইহুদি নই, কনফুসীয় নই; আমি মানুষ, তাহলে বাবরি মসজিদ উপখ্যানের সম্ভাবনা অনেক কমতো।

১৯৬

ভারতীয় সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদের আধুনিক উৎস মোহনচাঁদ করমচাঁদ গান্ধি।

১৯৭

সতীচ্ছদ আরব পুরুষদের জাতীয় পতাকা।

১৯৮

পাপ কোনো অন্যায় নয়, অপরাধ অন্যায়। পাপ ব্যক্তিগত, তাতে সমাজের বা অন্যের, এমনকি পাপীর নিজেরও কোনো ক্ষতি হয় না; কিন্তু অপরাধ সামাজিক, তাতে উপকার হয় অপরাধীর, আর ক্ষতি হয় অন্যের বা সমাজের।

১৯৯

সবচেয়ে হাস্যকর কথা হচ্ছে একদিন আমরা কেউ থাকবো না।

২০০

পৃথিবীতে যতোদিন অন্তত একজনও প্রথাবিরোধী মানুষ থাকবে, ততো দিন পৃথিবী মানুষের।

One thought on “প্রবচনগুচ্ছ – হুমায়ুন আজাদ

  • Unknown Traveller

    “পৃথিবীতে যতোদিন অন্তত একজনও প্রথাবিরোধী মানুষ থাকবে, ততো দিন পৃথিবী মানুষের।”
    জয়তু প্রফেসর ড.হুমায়ুন আজাদ….তুমি আমাদের হৃদয়ে লাল নীল দীপাবলি হয়ে বেঁচে থেকো….

    Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *