বাংলায় মুসলিম সংখ্যাধিক্যের কারণ কি ব্রাহ্মণ্যবাদের অত্যাচার?

Print Friendly, PDF & Email

ভূমিকা

বাংলায় এত বেশি সংখ্যক মানুষের ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত হওয়া নিয়ে যে অনুকল্পগুলো দেখা যায় সেগুলোর মধ্যে দুটো হচ্ছে:

১। ব্রাহ্মণ্যবাদের নিপীড়নের বিরুদ্ধে নিম্ন বর্ণের হিন্দুদের প্রতিক্রিয়া
২। হিন্দু নিপীড়নের বিরুদ্ধে বৌদ্ধদের প্রতিক্রিয়া

দেখা যাচ্ছে এই দুটো অনুকল্পেই উচ্চবর্ণের হিন্দু, হিন্দু ব্রাহ্মণ্যবাদী বা হিন্দু শাসকদের অত্যাচারের ব্যাপারটি জড়িত, ১ম অনুকল্পে যার শিকার হয়েছে নিম্ন বর্ণের হিন্দুরা আর ২য় অনুকল্পে বৌদ্ধরা। অনলাইন এর বিভিন্ন আলোচনা সহ বিভিন্ন স্থানেই এই অনুকল্প দুটোকে বাংলায় মুসলিম সংখ্যাধিক্যের কারণ হিসেবে ব্যাখ্যা করতে দেখা যায়। এই অনুকল্প দুটোকে বিশ্লেষণ করার জন্যই এই লেখাটি। এই বিষয়ে অনুকল্প যে আর নেই তা নয়, দুটো অনুকল্পেই অত্যাচারী গোষ্ঠী প্রায় এক রকম হবার কারণে একই সাথে এই দুটো অনুকল্প নিয়ে আলোচনা করছি।

ব্রাহ্মণ্যবাদের নিপীড়নের বিরুদ্ধে নিম্ন বর্ণের হিন্দুদের প্রতিক্রিয়া হিসেবে তাদের ইসলামে ধর্মান্তর

হেনরি বেভারলি ১৮৭২ সালে বাংলার আদমশুমারি এর রিপোর্ট তৈরি করেন। তিনি বলেছিলেন, হিন্দুদের অনন্য বর্ণপ্রথা “বাংলার প্রায়-উভচর (semi-amphibious) আদিবাসীদেরকে তাদের উচ্চ বর্ণের প্রভূগোষ্ঠী সেবার উদ্দেশ্যে কাঠুরে আর পানিবাহকে পরিণত করেছিল। এই প্রভুদের দৃষ্টিতে তারা ছিল নোংরা পশু, ঘৃণিত জীব মাত্ৰ।”। যুক্তি দেখানো হয় যে, এই বঞ্চিত ও লাঞ্ছিত জনগোষ্ঠীর সামনে ইসলাম তুলে ধরেছিল ঈশ্বরের একত্ব ও মানুষের সাম্যের ধারণা, আর তারই জন্য নিম্নবর্ণের হিন্দুরা স্বাভাবিকভাবেই ইসলাম ধর্ম গ্রহণে প্রণোদিত হয়েছিল। কিন্তু অনুকল্প বা হাইপোথিসিজের এর বিরুদ্ধে কয়েকটি যুক্তি দাঁড়া করানো যায়:

১। রিচার্ড ইটন তার The Rise of Islam and the Bengal Frontier গ্রন্থে বলেন, মধ্যযুগের বাংলায় উচ্চ বর্ণের হিন্দুদের মধ্যে শোষণের ধারণার অস্তিত্ব ছিল না। প্রাক-আধুনিক যুগে উচ্চ বর্ণের হিন্দু কর্তৃক নিম্ন-বর্ণের হিন্দুদের শোষণকে শোষণ হিসেবে দেখা হত না, বরং মনে করা হত এটি প্রাকৃতিক নিয়ম-রীতিরই অংশ। উচ্চ বর্ণের হিন্দুদের আধিপত্যের বিরুদ্ধে তীব্র ক্ষোভের ধারণা ইউরোপের আলোকিত যুগের (Enlightenment) ফসল। তাই এই অনুকল্পকে ইটনের “reading history backward” বা “উল্টো দিক থেকে ইতিহাস পাঠ” হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন।

২। লক্ষ করা গেছে, দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য অংশে উচ্চ বৰ্ণ কর্তৃক শোষণের ধারণার অস্তিত্ব থাকলেও বাংলায় সেভাবে তার অস্তিত্ব ছিল না। বাংলায় সমাজে ব্রাহ্মণদের কর্তৃত্ব এত দুর্বল ছিল যে, তাদের পক্ষে শোষণ চালানো সম্ভব ছিল না। বাংলায় অনেক ব্ৰাহ্মণ নিজেদেরকে ভেজাল ও দো-আশলা মনে করত। আর. সি. মজুমদার এর বাংলাদেশের ইতিহাস গ্রন্থে উল্লেখ আছে, ব্রাহ্মণদের শুদ্ধতা রক্ষার জন্য আদিশূরকে কণৌজ থেকে পাঁচজন ব্ৰাহ্মণ আমদানি করতে হয়েছিল। চট্টোপাধ্যায়, বন্দ্যোপাধ্যায়, মুখোপাধ্যায়, গঙ্গোপাধ্যায় ও ভট্টাচার্যরা হচ্ছেন সেই আনু. একাদশ শতকের দিকে উত্তর ভারত থেকে আসা ৫টি কনৌজ বা কন্যকুব্জ বা কুলীন ব্রাহ্মণ, চক্রবর্তীরাও এই বাইরে থেকে এসেছিল দাবি করা হয়। এই ব্রাহ্মণদের সাথে ঘোষ, বসু, মিত্র, দত্ত প্রভৃতি কুলিন কায়স্থরাও এসেছিল। এরাই শুদ্ধ ব্রাহ্মণ ছিল বলে দাবি করা হয়। মূলত বাংলার পশ্চিমাঞ্চলে বা বর্তমান পশ্চিমবঙ্গ অঞ্চলে এরা বেশি ছিল, সেখানে ইসলামে ধর্মান্তর তেমন হয়নি ও মুসলিম সংখ্যাধিক্য ছিল না। মুসলিম আধিক্য ও ধর্মান্তর ঘটে পূর্ব ও দক্ষিণ বঙ্গে যেখানে এই “বিশুদ্ধ ব্রাহ্মণরা” ছিলেন না।

কোষ্ঠী-তালিকার সাহিত্য হতে এও জানা যায় যে, সেন রাজা – বল্লাল সেন ও বর্মণ রাজা – শ্যামল বর্মা ব্রাহ্মণদেরকে বাংলার বাইরের অঞ্চল থেকে আমন্ত্রণ করে এনেছিলেন। হুলায়ূধ (১২শ শতাব্দী) উল্লেখ করেছেন যে, স্থায়ীয় ব্রাহ্মণরা বৈদিক ধৰ্মানুষ্ঠান পরিচালনায় সুশিক্ষিত ছিল না। বাংলার স্থানীয় ব্রাহ্মণরা প্রধানত দু’শ্রেণীতে বিভক্ত ছিল : শ্রোত্রিয় ব্রাহ্মণ ও বর্ণ ব্রাহ্মণ। শ্রোত্রিয় ব্রাহ্মণরা বর্ণ ব্রাহ্মণদেরকে অস্পৃশ্য মনে করত এবং তাদের হাতের জল স্পর্শ করত না। বর্ণ ব্রাহ্মণদের নিজেদের মধ্যেও আবার বিভিন্ন ক্রমবিন্যাস ছিল। চাষী কৈবর্তদের পুজো-আচ্চা করে যে সব বৈদিক ব্রাহ্মণ- তারা পদমর্যাদায় এত নিচে যে, তাদের যজমানরাই তাদের বাড়িতে খাদ্য গ্রহণ করে না। অগ্ৰদানী ব্রাহ্মণরা মৃতের সংকার করে এবং মৃতের অর্ঘ্য গ্রহণ করে; তাদেরকে দুষিত মনে করা হয়। গ্রহ-বিপ্র বা আচার্য যারা গণক, হস্তরেখাবিদ, কোষ্ঠী-লেখক হিসেবে কাজ করত তাদেরকে ভেজাল ব্রাহ্মণ মনে করা হত। ভট্ট ব্রাহ্মণরা ধনী লোকদের গুণ-কীর্তন করে জীবিকা নির্বাহ করত। তারা ছিল মিশ্র বিবাহজাত সন্তান; তাদেরকে পতিত বলে গণ্য করা হত। Sir Herbert Risley তার The people of India গ্রন্থে লিখেছেন, বাংলার বর্ণ ব্রাহ্মণরা আর্য ছিল না, স্থানীয় দেবদেবীর গোষ্ঠী পুরোহিতকে ব্রাহ্মণ পদবী প্রদান করে স্থানীয়ভাবে একটি সহজ পদ্ধতির মাধ্যমে সৃষ্টি করা হয়েছিল এ রকম অনেক ব্রাহ্মণ”। (“manufactured on the spot by simple process of conferring the title of Brahman on the tribal priests of the local deities” – Sir Herbert Risley, 1915. The people of India. Page – 33)। বাংলায় অনেক ব্ৰাহ্মণ নিজেরাই নিম্নবর্ণের হিন্দুদের মতো নিপীড়িত ছিল। ফলে এটি মেনে নেয়া কঠিন যে, বাংলায় ব্রাহ্মণদের অত্যাচার নিম্নবর্ণের হিন্দুদের ইসলাম ধর্মের দিকে ঠেলে দেয়।

৩। নিচু বর্ণের ধর্মান্তরের অনুকল্প মধ্যযুগের বাংলায় ইসলামের সাম্য ধারণাকেও অতিরঞ্জিত করে। তাত্ত্বিকভাবে ইসলামের সকল অনুসারীরাই আল্লাহ ও তার নবীর চোখে সমান। তবে বাংলায় মুসলমানরা নিজেরাই হিন্দু বর্ণ প্রখা দ্বারা সংক্রমিত হয়েছিল। বাংলায় মুসলমানদের দুটি প্রধান সামাজিক ভাগ ছিল: “আশরাফ” ও ‘আজলাফ’; বাংলায় বিকৃত হয়ে ‘আজলাফ’ শব্দটি ‘আতরাফ’-এ রূপান্তরিত হয়েছে। এখানে উল্লেখ করা যায়, বাংলায় উচ্চ বর্ণের হিন্দু থেকে ধর্মান্তরিত লোকজনকে বিদেশীদের-সন্দেহাতীত-বংশধরের সমকক্ষ বলে ধরে নেয়া হত এবং ‘আশরাফ’ বা সম্ভ্রান্ত বলে গণ্য করা হত। E. A. Gait তার ১৯০২ সালের ভারতের আদম শুমারির রিপোর্টে উল্লেখ করেন, “পেশাজীবীসহ নিচু শ্রেণী থেকে ধর্মান্তরিত অন্য সকল মুসলমানদের অবজ্ঞাপূর্ণ ভাষায় ‘আজলাফ’, ‘জঘন্য’ বা ‘ছোটলোক’ বলে অভিহিত করা হত। তাদেরকে ‘কামিনা’ বা ‘ইতর’ বা রাজেল-ও (রিজাল-এর বিকৃত রূপ, যার অর্থ “অকর্মণ্য”) বলা হত।”

তাই বলা যায়, নিম্ন শ্রেণীর হিন্দুরা ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়ে আপনাআপনি ভ্রাতৃত্বের জাতের সাম্যবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে পড়েনি। ধর্মান্তরের কারণে তাদের অর্থনৈতিক অবস্থা এমনকি তাদের সামাজিক মর্যাদাও উল্লেখযোগ্যভাবে পরিবর্তিত হয়নি। বাস্তবিকপক্ষে, মুসলমান বাংলায় নিম্নতম বর্ণের থেকে ধর্মান্তরিত মুসলমানদের প্রতি অধিক বৈষম্য প্রদর্শন করা হয়েছে। গেইট উল্লেখ করেছেন যে, “কোনও কোনও ক্ষেত্রে তৃতীয় একটি শ্রেণী – আরজল বা ‘সর্বনিম্ন শ্রেণী’, এতে যুক্ত করা হয়। সবচেয়ে নিম্ন শ্রেণীর লোকজন – যেমন, হালালখোর, লালবেগী, আবদাল, বেদেরা এতে অন্তর্ভুক্ত ছিল। তাদের সাথে অন্য মুসলমানরা কোনও সম্পর্ক রাখত না; মসজিদে ঢোকা বারণ ছিল তাদের; সর্বসাধারণের কবরস্থানও তারা ব্যবহার করতে পারত না।” এ ধরনের বৈষম্যের কারণে এবং মুসলমানদের আদত আচরণ দেখে নিচু বর্ণের হিন্দুরা ধর্মান্তরিত হতে নিরুৎসাহিত বোধ করবে – এটিই স্বাভাবিক।

৪। ব্রাহ্মণদের অত্যাচার কোনওক্রমেই কেবল বাংলায় দেখা গেছে, এমন নয়। সমগ্র ভারতেই ব্রাহ্মণরা নিচু বর্ণের হিন্দুদেরকে অত্যাচার করেছে। দক্ষিণ এশিয়ার প্রবাদে দেখা যায় যে, ব্রাহ্মণরা উপমহাদেশের সর্বত্রই সমভাবে ঘৃণিত। ব্রাহ্মণদের সম্পর্কে বলা হয় যে, তারা “দেখতে সাধু কিন্তু অন্তরে কসাই।” নিম্নোক্ত প্রবাদটি ব্রাহ্মণদের প্রতি ঘৃণার প্রমাণ দেয় : “ইস দুনিয়া মে তিন কসাই, পিশু, খাটমল, ব্রাহ্মণ ভাই।”
(এই দুনিয়ায় আছে তিন রক্তচোষা/ ছাড়পোকা, ব্রাহ্মণ ভাই আর মশা)।
(“Is Duniya men tin Kasai/ Pishu, Khatmal, Brahman Bhai” (Blood suckers three on earth there be/ the bug, the Brahman and the flea – Sir Herbert Risley, 1915. The people of India.)।

বাস্তবে বাংলাকে জঘন্যতম ধরনের ব্রাহ্মণ্য অত্যাচার সহ্য করতে হয়নি। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য অংশে এধরনের অত্যাচার ছিল আরও তীব্র। উদাহরণস্বরপ, মাদ্রাজের কথা তুলে ধরা যায়; সেখানে ধরে নেয়া হয় যে, একজন নিম্ন বর্ণের অচ্ছুৎ যদি উচ্চ বর্ণের ব্রাহ্মণের যাট ফুটের মধ্যে ঢুকে যায় তবে তাকে অপবিত্র করা হয়। দক্ষিণ ভারতের কোনও কোনও এলাকায় “ব্রাহ্মণদের আসতে দেখলে” শূদ্রদের রাস্তা ছেড়ে দিতে হয়, অথবা মধ্যযুগে যুরোপে কুষ্ঠরোগীদেরকে যেমন বিশেষ এক ধরনের শব্দ করে তাদের আগমনের সংবাদ দিতে হত তেমনি শব্দ করে চলতে হয়। (Risley, 1915, একই গ্রন্থ)। এধরনের বৈষম্যের অস্তিত্ব বাংলায় ছিল না। নিম্নবর্ণের হিন্দুদের প্রতি ব্রাহ্মণ্যবাদী অত্যাচারের বিপরীতে ইসলামি সাম্যবাদ যদি ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরের প্রধান আকর্ষণ হত, তাহলে উপমহাদেশের অন্যান্য অংশে ইসলামের প্রসার অধিকতর লক্ষণীয় হত। কিন্তু ভারতবর্ষের অন্যান্য ব্রাহ্মণ দ্বারা নিপীড়িত অঞ্চলে মুসলমান সংখ্যাধিক্য দেখা যায় না।

হিন্দু নিপীড়নের বিরুদ্ধে বৌদ্ধদের প্রতিক্রিয়া হিসেবে তাদের ইসলামে ধর্মান্তর

কয়েকজন ঐতিহাসিক আছেন যারা বাংলার মুসলমান সংখ্যাধিক্যের কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেন বাংলায় বৌদ্ধদের গণ ধর্মান্তরকে। মারে টাইটাস তার Islam in India and Pakistan গ্রন্থে বলেছিলেন, “পূর্ব বাংলার অধিবাসীরা স্থুল প্রকৃতির বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাবাধীন ছিল। শক্তিতে বলিয়ান আর্য শাসকরা তাদের ঘৃণা করত, তুচ্ছতাচ্ছিল্য করত। তাই মনে করা হয় যে, এই বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারীগণ সানন্দে মুসলমান ধৰ্ম-প্রচারকদের স্বাগত জানিয়েছিল”। আর. সি. মিত্র তার The Decline of Buddhism in India গ্রন্থে বলেছিলেন, “হিন্দু ও বৌদ্ধদের মধ্যে শত্রুতার কারণে হয়ত তাদের ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তর ত্বরান্বিত হয়েছিল”।

তবে, বৌদ্ধদের ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরের কোনও প্রত্যক্ষ ঐতিহাসিক প্রমাণ নেই। অবশ্য হিন্দুদের দ্বারা বৌদ্ধদের অত্যাচারের পরোক্ষ প্রমাণ মেলে। নীহার রঞ্জন রায় তার বাঙালীর ইতিহাসের আদি পর্ব গ্রন্থে একটি রেফারেন্স এর উল্লেখ করে বলেছিলেন, নিপীড়িত বৌদ্ধ শ্ৰমণরা বাংলায় মুসলমান আক্রমণকারীদের গুপ্তচর হিসেবে কাজ করেছে। সেন রাজারা বৌদ্ধধর্মের বিদ্বেষী ছিল। দান সাগর গ্রন্থে (যা বল্লাল সেন কর্তৃক রচিত বলে অনুমান করা হয়) রাজাকে নাস্তিকদের (বৌদ্ধদের বোঝানো হয়েছে) নিধনকারী হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে। রামাই পণ্ডিত বর্ণনা করেছেন, কীভাবে বৌদ্ধরা ব্রাহ্মণদের অত্যাচার থেকে রক্ষা পাবার জন্য ধর্ম-দেবতার সাহায্য কামনা করেছিল।

বাংলায় কিছু বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীর ইসলাম ধর্ম গ্রহণ অসম্ভব নয়। কিন্তু এরকম বিচ্ছিন্ন ধর্মান্তর যে কোনও ক্রমেই যে বাংলায় মুসলমানদের সংখ্যাধিক্যের কারণ হতে পারে না সে সম্পর্কে আমি চারটি যুক্তি দিচ্ছি:

১। মুসলমান বিজয়ের সময় বৌদ্ধরা বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ অধিবাসী ছিল না। নীহার রঞ্জন রায় তার “বাঙ্গালির ইতিহাসের আদি পর্ব” গ্রন্থে বলছেন, পাল শাসনামলে (৭৫৬-১১৪৩ খ্রি.) যখন বৌদ্ধ রাজারা বাংলা শাসন করত তখনও বাংলায় বৌদ্ধদের চেয়ে হিন্দু জনসংখ্যা ছিল অনেক বেশি। ঐতিহাসিক মুহাম্মদ মোহর আলী তার History of the Muslims of Bengal গ্রন্থে বলেন, মুসলমান বিজয়ের সময় সংখ্যার ক্রমবিচারে যে তিনটি প্রধান ধর্মাবলম্বী মানুষ এদেশে বাস করত তারা ছিল, হিন্দু, বৌদ্ধ ও জৈন (অর্থাৎ জনসংখ্যায় সবচেয়ে বেশি হিন্দু, তারপর বৌদ্ধ, তারপর জৈন)। শুধু বৌদ্ধদের ধর্মান্তরণ তাই বাংলায় মুসলমান সংখ্যাধিক্যকে যৌক্তিকভাবে ব্যাখ্যা করতে পারে না।

২। হিন্দুদের অত্যাচারের কারণে বৌদ্ধরা দলে দলে ইসলাম গ্রহণ করেছিল- এই অনুকল্প যদি সত্যি হত তবে ত্রয়োদশ শতাব্দীতে মুসলমান শাসন প্রতিষ্ঠার পরপরই তা ঘটবার কথা ছিল। কিন্তু ইবনে বতুতার Travels in Asia and Africa গ্রন্থে পাওয়া যাচ্ছে যে, এমনকি চতুর্দশ শতাব্দীতেও পূর্ব বাংলায় এ ধরনের কোন গণ-ধর্মান্তর ঘটেনি। ধর্ম প্রচারক শাহজালালের সাথে দেখা করে সিলেট থেকে ফেরার পথে তিনি মেঘনা নদী দিয়ে পনের দিনব্যাপী ভ্রমণ করেছিলেন। পূর্ব বাংলার লোকজনকে তখন তিনি “মুসলমান শাসনাধীন কাফের” বলে বর্ণনা করেছেন। এখান থেকেও বোঝা যায় যে, পূর্ব বাংলায় মুসলমান সংখ্যাধিক্যেকে বৌদ্ধদের গণ ধর্মান্তরণ দিয়ে ব্যাখ্যা করা যাবে না।

৩। বাংলায় ইতিহাসের বইগুলোতে হিন্দু ও বৌদ্ধদের বিরোধকে যতটা না বেশি করে উপস্থাপন করা হয়েছে, সেভাবে হিন্দু ও বৌদ্ধদের সম্প্রীতি ও বোঝাপড়ার ইতিহাস নিয়ে খুব একটা তুলে ধরা হয়নি। কিন্তু বাংলায় হিন্দু ও বৌদ্ধ সম্প্রীতির উদাহরণ আছে। নিহার রঞ্জনের বইতেই পাওয়া যায়, পাল রাজারা ছিল বৌদ্ধ কিন্তু তারা ব্রাহ্মণ রাজকুমারীদের বিয়ে করেছিল এবং হিন্দু মন্দিরের পৃষ্ঠপোষকতা করেছিল। বৌদ্ধ বিহার-এ হিন্দু দেবতাদের পূজা হয়েছে। অন্যদিকে, হিন্দু-ধৰ্ম বুদ্ধকে দেবতার আসনে বসিয়েছিল। বৈষ্ণবদের দশাবতারের ধারণায় বুদ্ধ নবম অবতার। বুদ্ধের মূর্তি দ্বারা হিন্দুদের প্রতিমা প্রভাবিত হয়েছে। গণমানুষের পর্যায়ে হিন্দু ও বৌদ্ধ একে অপরের অনেক কাছাকাছি চলে এসেছিল…

৪। অনুকল্পে বলা হচ্ছে যে, বৌদ্ধরা মুসলমানদেরকে স্বাগত জানিয়েছিল। কিন্তু ইতিহাস বলছে, মুসলিমদের সাথে বৌদ্ধদের সম্পর্ক ভাল ছিল না। যেখানে হিন্দু ধৰ্ম বুদ্ধকে ভগবান হিসেবে পূজা করে, সেখানে ইসলাম ধর্ম বুদ্ধকে স্বীকারই করে না। তাই হিন্দু ধর্ম থেকে রক্ষা পাবার জন্য আপামর জনগণ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করবে এটি ভাবা যুক্তিযুক্ত বলে মনে হয়না। দক্ষিণ এশিয়ায় মুসলমানরা বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি খুব একটা সহনশীল ছিল না। উইল ডুরান্ট তার Our Oriental Heritage গ্রন্থে বলেন, “আরবরা যখন বাংলায় আসল তখন তারা প্রতিজ্ঞা করল, তারা সহজ-সরল, সুখ-দুঃখে উদাসীন একেশ্বরবাদ প্রচার ও প্রসার করবে। অলস, অর্থলিপ্সু, অলৌকিক-ঘটনা-সংঘটনকারী বৌদ্ধ ভিক্ষুদেরকে তারা ঘৃণার দৃষ্টিতে দেখত। তারা বৌদ্ধ মঠ ধ্বংস করে ও হাজার হাজার ভিক্ষুকে হত্যা করে। আর এভাবে তারা ঝুঁকিবিমুখ লোকজনের কাছে মঠের জীবনকে অপ্রিয় করে তোলে”। ঘটনাপঞ্জির লিপিকার মিনহাজ-ই-সিরাজ উল্লেখ করেছিলেন, বখতিয়ার খিলজী উদন্তপুরী বিহারের ন্যাড়া-মাথা ভিক্ষুদের হত্যা করেছিলেন। এবং মঠের পাঠাগার ধ্বংস করেছিলেন।

উপরের যুক্তিগুলোর ভিত্তিতে হিন্দু শাসক, ব্রাহ্মণ্যবাদী ও উঁচুবর্ণের হিন্দুদের অত্যাচারের কারণে নিম্নবর্ণের হিন্দুরা ও বৌদ্ধরা দলে দলে ধর্মান্তরিত হয়েছিল – এরকম অনুকল্পকে সত্য বলে মনে হয় না। তবে বাংলার পূর্ব ও দক্ষিণাঞ্চলে মুসলিমদের সংখ্যাধিক্য রয়েছে, আর এই মুসলমানদের বেশিরভাগের পূর্বপুরুষই মধ্যযুগে ধর্মান্তরিত। তাদের ইসলাম গ্রহণ করার কারণ নিশ্চই আছে। আর সেই কারণকে ব্যাখ্যা করার জন্য তৈরি হয়েছে আরও অনুকল্প, যেগুলোর কোনটার মধ্যে লুকিয়ে আছে আসল সত্য। ভবিষ্যতে সেগুলো নিয়েও বিশ্লেষণ করা হবে।

4 thoughts on “বাংলায় মুসলিম সংখ্যাধিক্যের কারণ কি ব্রাহ্মণ্যবাদের অত্যাচার?

  • February 15, 2019 at 2:27 AM
    Permalink

    “বাংলায় ইতিহাসের বইগুলোতে হিন্দু ও বৌদ্ধদের বিরোধকে যতটা না বেশি করে উপস্থাপন করা হয়েছে, সেভাবে হিন্দু ও বৌদ্ধদের সম্প্রীতি ও বোঝাপড়ার ইতিহাস নিয়ে খুব একটা তুলে ধরা হয়নি। কিন্তু বাংলায় হিন্দু ও বৌদ্ধ সম্প্রীতির উদাহরণ আছে। ”

    নীহার রঞ্জন বেশ কিছু সম্প্রীতির উদাহরণ দিয়েছেন সত্য কিন্তু সম্প্রীতির উদাহরণগুলি বিদ্বেষকে ছাপিয়ে গিয়েছে বলে মনে হয়না।

    বৌদ্ধ বিহারে হিন্দু দেবতার পূজার মতোই হিন্দুরাও বৌদ্ধদের অনেক দেবদেবী গ্রহণ করেছিলেন। ভিন্ন সংস্কৃতিগুলি পাশাপাশি অবস্থান করলে তাদের মধ্যে প্রতিযোগিতা, সংস্কৃতির আদান প্রদান হওয়া সম্ভব, যেমনটা অনেকসময় হিন্দু মুসলমানের ক্ষেত্রেও হয়েছে। অক্ষয়কুমার দত্তের ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায় বইতে দেখেছিলাম, একটি হিন্দুদের মন্ত্রে কালীকে আল্লা মুহাম্মদের দিব্যি দেওয়া হয়েছে। আবার সত্যনারায়ণের শিন্নি হিন্দুদের মধ্যে দেখা যায়। এই ধরণের বেশ কিছু প্রমাণ মেলে যেখানে সংস্কৃতির আদান প্রদান হয়েছে। এই ধরণের আদানপ্রদান তাদের মধ্যকার বিভেদকে ছাপিয়ে যেতে পেরেছিল বলে মনে হয়না।

    বুদ্ধকে অবতার বানানোর ব্যাপারটি একটা প্রতারণা ছিল, নীহার রঞ্জনের বইতেও এর কিছুটা উল্লেখ মেলে। এখানে বিস্তারিত দেখুন-
    https://www.shongshoy.com/archives/11026

    Reply
  • February 15, 2019 at 7:32 AM
    Permalink

    হুম। দশ মহাবিদ্যার ধারণাতেও বৌদ্ধদের দেবী ঢুকে গেছে। শাক্ত ও তান্ত্রিক ধারায় বৌদ্ধ ধারণার অবদান আছে। আপনার ঐ নিবন্ধ আমাকে সমৃদ্ধ করেছে। অক্ষয়কুমার দত্তের “ভারতীয় উপাসক সম্প্রদায়” বইটা কিনেছি। কালীকে আল্লা মুহাম্মদের দিব্যি দেয়ার ব্যাপারটা সেই বই এর কোন অধ্যায়ে পাওয়া যাবে বললেন কী? হিন্দুদের সত্যনারায়ণের পুজা দেয়াটা আসলে বাংলায় ইসলামের স্থানীয় আকারে ইনক্লুশনেরই ফসল। সত্য পীর, মনাই পীর, গাজি পীর ইত্যাদি পীরকে স্থানীয় হিন্দু মুসলিমরা হিন্দু ধর্মের দেবতার ধারণার সাথে মিলিয়ে ফেলে। বাংলায় ইসলামের প্রসার ও ইসলামে ধর্মান্তরনে ইসলাম প্রসারের এই দিকটা খুব গুরুত্বপূর্ণ।

    Reply
  • February 15, 2019 at 4:56 PM
    Permalink

    @সুমিত, ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায় এর দুটি খণ্ড রয়েছে। দুটিই ভীষণভাবে তথ্যসমৃদ্ধ। সেখানে হিন্দু মুসলমান সংস্কৃতির মধ্যে সমন্বয়ের প্রচুর উদাহরণ পাওয়া যায়।

    আমার কাছে কালীকে আল্লাহ মুহাম্মদের দিব্বি দেওয়ার কথাটি সংগৃহীত রয়েছে। (ঠিক কত অধ্যায়ে এটি রয়েছে মনে করতে পারছি না। )-

    ““কোথা গো মা কালি! ওমা চণ্ডি! বালগত রাখ মোরে,
    আঁচল দিয়া ছাপাইয়া যদি না রাখ মোরে,
    আল্লা মহম্মদের দিব্বি লাগে গো তোমারে।”

    বইটির দুটি খণ্ডের পিডিএফ দিচ্ছি।
    ১ম খণ্ড https://drive.google.com/file/d/1yVitciHFQjewYwI2AsftA9ttgBfox_Oq/view
    ২য় খণ্ড https://drive.google.com/file/d/15rGJTYA4wIU51F0gCMRWM9N2Rh8VWwb2/view

    Reply
    • February 15, 2019 at 5:00 PM
      Permalink

      বই দুটি কিনে রেখেছি। পড়া শুরু করা হয়নি এখনও যদিও। শীঘ্রই শুরু করব। আপনার মন্তব্য দেখে বই দুটো পড়ার আগ্রহ অনেক বেড়ে গেল। ধন্যবাদ।

      Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *