বিবেকের কাঠগড়ায় “জিজিয়া”
সূচিপত্র
- 1 ভূমিকা
- 2 ১। জিজিয়া কি এবং ইসলাম ধর্মে জিজিয়ার গুরুত্ব কতখানি?
- 3 ২। জিজিয়া কেন নেওয়া হয়? জিজিয়া প্রথা কি মোহাম্মদের শাসনামলে চালু ছিল?
- 4 ৩। জিজিয়া কত প্রকার?
- 5 ৪। জিজিয়া কাদের উপর প্রযোজ্য ?
- 6 ৫। জিজিয়ার পরিমাণ কিভাবে নির্ধারিত হয়?
- 7 ৬। জিজিয়া কিভাবে দিতে হয়?
- 8 ৭। জিজিয়া প্রথা কতদিন চলবে?
- 9 ৮। মুসলিমদের জাকাত কি অমুসলিমদের জিজিয়া?
- 10 ৯। জিজিয়া নিয়ে মুসলিমরা কি প্রচার করে?
- 11 ১০। একটি তুলনামূলক পর্যালোচনায় মুসলিমদের প্রতিক্রিয়া কি হতে পারে?
ভূমিকা
ইসলাম “প্রচারের” দায়িত্বে যারা নিয়োজিত থাকেন তারা সঙ্গত কারণেই ইসলামের কোন বিষয়কে সত্য – মিথ্যা, নৈতিক-অনৈতিক, তুলনামূলক পর্যালোচনা, নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি এসব মাপকাঠিতে বিচার না করে শুধুমাত্র সেটিকে “প্রচার এবং প্রতিষ্ঠা” করার দিকেই বেশি মনযোগী হন। সে জন্যেই ইসলামের অনেক প্রচারকের কাছেই অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারনা নেই যার ফলে ইসলামের অনুসারীরাও এই ব্যাপারগুলোতে অনেকটা অন্ধকারে থেকে যায়। ইমামরা মসজিদে দান খয়রাত করাকে যতটা উৎসাহী করে থাকেন , অর্থ বুঝে তাফসীর বুঝে হাদিস কোরআন পড়াটাকে ঠিক ততটা উত্তম আমল মনে করেন না বা করলেও সেটা প্রচার করেন না। আমার আজকের এই লেখার উদ্দেশ্য হল একজন মসুলিমকে তার ধর্মের সর্বজনগৃহীত, বিশুদ্ধতম এবং আদিম গ্রন্থসমূহ হতে রেফারেন্স দিয়ে তাদের কাছে “জিজিয়া” করের ধারনাটি পরিষ্কার করা।
আমার দীর্ঘ আলোচনায় আমি সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ইসলামের ইতিহাস পর্যালোচনা সাপেক্ষে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করব ঃ-
- ১। জিজিয়া কি এবং ইসলাম ধর্মে জিজিয়ার গুরুত্ব কতখানি?
- ২। জিজিয়া কেন নেওয়া হয়? জিজিয়া প্রথা কি মোহাম্মদের শাসনামলে চালু ছিল?
- ৩। জিজিয়া কত প্রকার?
- ৪। জিজিয়া কাদের উপর প্রযোজ্য ?
- ৫। জিজিয়ার পরিমাণ কিভাবে নির্ধারিত হয়?
- ৬। জিজিয়া কিভাবে দিতে হয়?
- ৭ । জিজিয়া প্রথা কতদিন চলবে?
- ৮ । মুসলিমদের জাকাত কি অমুসলিমদের জিজিয়া?
- ৯। জিজিয়া নিয়ে মুসলিমরা কি প্রচার করে?
অতঃপর আমি একটি তুলনামূলক পর্যালোচনায় মুসলিমদের প্রতিক্রিয়া কি হতে পারে সে বিষয়ে কিছু প্রশ্ন উত্থাপন করব এবং কিছু মতামত প্রকাশ করে লেখাটির ইতি টানব।
১। জিজিয়া কি এবং ইসলাম ধর্মে জিজিয়ার গুরুত্ব কতখানি?
জিজিয়া শব্দটি আলোচনার প্রসঙ্গে আসে কোরআনের এই আয়াত এর মাধ্যমে।
সূরা আত তাওবাহ , আয়াত ২৯ (৯ঃ২৯)
Surah-At-Taubah
قَاتِلُواْ الَّذِينَ لاَ يُؤْمِنُونَ بِاللّهِ وَلاَ بِالْيَوْمِ الآخِرِ وَلاَ يُحَرِّمُونَ مَا حَرَّمَ اللّهُ وَرَسُولُهُ وَلاَ يَدِينُونَ دِينَ الْحَقِّ مِنَ الَّذِينَ أُوتُواْ الْكِتَابَ حَتَّى يُعْطُواْ الْجِزْيَةَ عَن يَدٍ وَهُمْ صَاغِرُونَ
তোমরা যুদ্ধ কর আহলে-কিতাবের ঐ লোকদের সাথে, যারা আল্লাহ ও রোজ হাশরে ঈমান রাখে না, আল্লাহ ও তাঁর রসূল যা হারাম করে দিয়েছেন তা হারাম করে না এবং গ্রহণ করে না সত্য ধর্ম, যতক্ষণ না করজোড়ে তারা জিযিয়া প্রদান করে।
Fight those who believe not in Allah nor the Last Day, nor hold that forbidden which hath been forbidden by Allah and His Messenger, nor acknowledge the religion of Truth, (even if they are) of the People of the Book, until they pay the Jizya with willing submission, and feel themselves subdued.
এবার কিছু বিখ্যাত তাফসীর গ্রন্থ থেকে এই আয়াত এর তাফসীর দেখে নেওয়া যাক , সেই সাথে আমাদের কাছে জিজিয়া শব্দের মানেও পরিষ্কার হয়ে যাবে। জিজিয়া করের কোন রকম সংজ্ঞা আমি নিজে নিজে দিব না, আসুন , তাফসীর থেকে জেনে নিন জিজিয়ার সংজ্ঞা।
এই লেখার সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হল এই তাফসীর সমূহ। তাই, তাফসীর সমূহ এড়িয়ে গেলে পাঠকরা কখনওই ধারনা পাবেন না যে জিজিয়া বলতে কি বুঝায়। আমার এই লেখার বাকি আলোচনা কোরআন হাদিসের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নাকি বানোয়াট-মনগড়া সেটা বুঝতে হলে অবশ্যই তাফসীর সমূহ পড়ে আসতে হবে। কেউ যদি শুধু তাফসীর গুলো দেখে এবং আমার এই লেখার বাকি অংশটুকু না পড়ে তাহলেও সে জিজিয়ার উদ্দেশ্য সম্পর্কে মোটামুটি পরিষ্কার ধারনা পেয়ে যাবে, কিন্তু তাফসীর না পড়ে আমার পুরো লেখাটি পড়লেও আসলে তার কাছে জিজিয়ার ধারনা পরিষ্কার হবে না।
পাঠকের প্রতি আমার বিনীত অনুরোধ তাফসীর না পড়ে আমার এই লেখার বাকি অংশটুকু পড়বেন না।
একজন মুসলিম শাসকের কাছে জিজিয়ার গুরুত্ব অপরিসীম কারণ এটি সরাসরি আল্লাহর নির্দেশ বা কোরআনের কথা। এই আদেশ অমান্য করলে সে শরিয়া মতে কাফের হয়ে যাবে এবং সেই রাষ্ট্র আর ইসলামী রাষ্ট্র থাকবে না, তাঘুত (বিদ্রোহী) রাষ্ট্রে পরিণত হবে। অন্য কোন মুসলিম রাষ্ট্র তাকে আক্রমণ করে দখল করে নিয়ে সেখানে শরিয়া বা আল্লাহর আইন প্রতিষ্ঠা করলে সেটা বৈধ বলে গণ্য হবে।
২। জিজিয়া কেন নেওয়া হয়? জিজিয়া প্রথা কি মোহাম্মদের শাসনামলে চালু ছিল?
উপরের তাফসীর সমূহ থেকে আমরা জানতে পারি যে সৃষ্টিকর্তার ব্যাপারে যদি কেউ মুসলমানদের সাথে ভিন্ন মত পোষণ করে তবে সে একজন অপরাধী এবং এই অপরাধের একমাত্র শাস্তি হল মৃত্যুদণ্ড। এবং এই শাস্তি মউকুফের একমাত্র পন্থা হল জিজিয়া। অর্থাৎ একজন ভিন্ন মতের লোককে যদি মুসলিম রাষ্ট্রে প্রাণে বেঁচে থাকতে হয় তবে তাকে সরকার নির্ধারিত পরিমাণ সম্পদ জিজিয়া কর হিসাবে প্রদান করতে হবে। তবে সে যদি নিয়মিত জিজিয়া প্রদান করে তবে তার প্রাণ এবং সম্পদ “অন্য মুসলিমদের হাত থেকে” রক্ষা করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। কিন্তু অন্য কোন রাষ্ট্র যদি আক্রমণ করে তাদের দখল করে নেয় তবে ওই ইসলামী রাষ্ট্রের জন্য ইসলামের বিধান হচ্ছে তাদের সবাইকে ওই বছরের আদায়কৃত জিজিয়ার সম্পদ ফিরিয়ে দিতে হবে । উদাহরণ হিসাবে আমরা একটি ঐতিহাসিক ঘটনার দিকে আলোকপাত করতে পারি। বাইজেন্টাইন শাসক হেরাক্লিয়াস যখন হোমস (এমেসা ) এর সংখ্যালঘু ভিন্ন মতের খ্রিস্টানদের উপর আক্রমণ করেছিল তখন খালিদ বিন ওয়ালিদ তাদের জীবন রক্ষার জন্য হেরাক্লিয়াস এর বিরুদ্ধে জুদ্ধ করেনি, তাদের জীবনের নিরাপত্তা দেয় নি এবং তাদের ওই বছরের জিজিয়ার অর্থ ফিরিয়ে দিয়েছিল।
তাফসীর সমূহে কিছুটা পরিলক্ষিত হয় যে মুহাম্মাদের সময়ে সে নিজেই এই জিজিয়া কর নিত। এর মধ্যে খাইবারের ঘটনা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
মুহাম্মদ খাইবারের অমুসলিমদের ওপরে বিজয়ী হবার পর তাদের সেই অঞ্চল থেকে বিতাড়িত করতে চায়। কিন্তু খাইবারের অমুসলিমরা যখন তাদের বাৎসরিক উৎপাদনের অর্ধেক ফল মুহাম্মদকে জিজিয়া হিসাবে প্রদান করার প্রস্তাব দেয় এবং বিনিময়ে খাইবারে অবস্থান করার অনুমতি চায় তখন মুহাম্মদ তাদের সে প্রস্তাব গ্রহণ করে এবং এই শর্তে তাদের যতদিন ইচ্ছা খাইবারে বসবাস করার অনুমতি দেয়।
মুহাম্মদ এবং সাহাবীরা যে তাদের শাসনামলে অমুসলিমদের কাছ থেকে তাদের প্রানের বিনিময়ে জিজিয়া নিতো এ সম্পর্কিত আরও কিছু সহিহ হাদিসের রেফেরন্স নিচে উল্লেখ করা হলঃ
হাদিস সমূহ সহিহ কিনা সেটা আপনার বিশ্বস্ত কোন আলেমের সাথে আলাপ করে জেনে নেবার পরামর্শ রইল।
জিজিয়া নেয়ার কারণ হিসাবে আরও একটা কারণ বলা হয় (জিজিয়ার পক্ষে সাফাই গাইতে অটোম্যান খলীফারা সব থেকে বেশি এই যুক্তি প্রচার করতো)। যেহেতু ইসলামী রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় অমুসলিমদের কোন ভূমিকা নেই, সেহেতু তাদের থেকে অতিরিক্ত কর আদায় করা হয় এবং এই অতিরিক্ত অর্থ মুসলিম রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব রক্ষার কাজে নিয়োজিত যে মুলসিম সৈন্যরা আছে তাদের ভরণপোষণে ব্যয় করা হয়। কিন্তু তাদের এই যুক্তি খুবই দুর্বল এই জন্য যে, মুলসিমরাই অমুসলিমদের সেনাবাহিনীতে সুযোগ দেয় না, এটা শরিয়ার বিধান, কোন অমুসলিম, একটি মুসলিম দেশের সেনাবাহিনীতে যুক্ত হতে পারবে না। এক ধরনের অবিশ্বাস থেকেই এই আইনটি তৈরি করা। সুতরাং তোমরাই অমুসলিমদের সেনাবাহিনীতে সুযোগ দিচ্ছ না আবার তোমরাই বলতেছ সেটার জন্য compensation দিতে ব্যাপারটা আসলে স্ববিরোধী।
রেফারেন্সঃ
Surah-Al-Imran, (3:28)
মুমিনগন যেন অন্য মুমিনকে ছেড়ে কেন কাফেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ না করে। যারা এরূপ করবে আল্লাহর সাথে তাদের কেন সম্পর্ক থাকবে না। তবে যদি তোমরা তাদের পক্ষ থেকে কোন অনিষ্টের আশঙ্কা কর, তবে তাদের সাথে সাবধানতার সাথে থাকবে আল্লাহ তা’আলা তাঁর সম্পর্কে তোমাদের সতর্ক করেছেন। এবং সবাই কে তাঁর কাছে ফিরে যেতে হবে।
Let not the believers Take for friends or helpers Unbelievers rather than believers: if any do that, in nothing will there be help from Allah. except by way of precaution, that ye may Guard yourselves from them. But Allah cautions you (To remember) Himself; for the final goal is to Allah.
Surah-Al-Imran, (3:118)
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُواْ لاَ تَتَّخِذُواْ بِطَانَةً مِّن دُونِكُمْ لاَ يَأْلُونَكُمْ خَبَالاً وَدُّواْ مَا عَنِتُّمْ قَدْ بَدَتِ الْبَغْضَاء مِنْ أَفْوَاهِهِمْ وَمَا تُخْفِي صُدُورُهُمْ أَكْبَرُ قَدْ بَيَّنَّا لَكُمُ الآيَاتِ إِن كُنتُمْ تَعْقِلُونَ
হে ঈমানদারগণ! তোমরা মুমিন ব্যতীত অন্য কাউকে অন্তরঙ্গরূপে গ্রহণ করো না, তারা তোমাদের অমঙ্গল সাধনে কোন ক্রটি করে না-তোমরা কষ্টে থাক, তাতেই তাদের আনন্দ। শত্রুতাপ্রসুত বিদ্বেষ তাদের মুখেই ফুটে বেরোয়। আর যা কিছু তাদের মনে লুকিয়ে রয়েছে, তা আরো অনেকগুণ বেশী জঘন্য। তোমাদের জন্যে নিদর্শন বিশদভাবে বর্ণনা করে দেয়া হলো, যদি তোমরা তা অনুধাবন করতে সমর্থ হও।
O ye who believe! Take not into your intimacy those outside your ranks: They will not fail to corrupt you. They only desire your ruin: Rank hatred has already appeared from their mouths: What their hearts conceal is far worse. We have made plain to you the Signs, if ye have wisdom.
Surah-An-Nisaa, (4:139)
الَّذِينَ يَتَّخِذُونَ الْكَافِرِينَ أَوْلِيَاء مِن دُونِ الْمُؤْمِنِينَ أَيَبْتَغُونَ عِندَهُمُ الْعِزَّةَ فَإِنَّ العِزَّةَ لِلّهِ جَمِيعًا
যারা মুসলমানদের বর্জন করে কাফেরদেরকে নিজেদের বন্ধু বানিয়ে নেয় এবং তাদেরই কাছে সম্মান প্রত্যাশা করে, অথচ যাবতীয় সম্মান শুধুমাত্র আল্লাহরই জন্য।
Yea, to those who take for friends unbelievers rather than believers: is it honour they seek among them? Nay,- all honour is with Allah.
Surah-An-Nisaa, (4:144)
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُواْ لاَ تَتَّخِذُواْ الْكَافِرِينَ أَوْلِيَاء مِن دُونِ الْمُؤْمِنِينَ أَتُرِيدُونَ أَن تَجْعَلُواْ لِلّهِ عَلَيْكُمْ سُلْطَانًا مُّبِينًا
হে ঈমানদারগণ! তোমরা কাফেরদেরকে বন্ধু বানিও না মুসলমানদের বাদ দিয়ে। তোমরা কি এমনটি করে নিজের উপর আল্লাহর প্রকাশ্য দলীল কায়েম করে দেবে?
O ye who believe! Take not for friends unbelievers rather than believers: Do ye wish to offer Allah an open proof against yourselves?
Surah-Al-Maidah (5:51)
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُواْ لاَ تَتَّخِذُواْ الْيَهُودَ وَالنَّصَارَى أَوْلِيَاء بَعْضُهُمْ أَوْلِيَاء بَعْضٍ وَمَن يَتَوَلَّهُم مِّنكُمْ فَإِنَّهُ مِنْهُمْ إِنَّ اللّهَ لاَ يَهْدِي الْقَوْمَ الظَّالِمِينَ
হে মুমিণগণ! তোমরা ইহুদী ও খ্রীষ্টানদেরকে বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করো না। তারা একে অপরের বন্ধু। তোমাদের মধ্যে যে তাদের সাথে বন্ধুত্ব করবে, সে তাদেরই অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহ জালেমদেরকে পথ প্রদর্শন করেন না।
O ye who believe! take not the Jews and the Christians for your friends and protectors: They are but friends and protectors to each other. And he amongst you that turns to them (for friendship) is of them. Verily Allah guideth not a people unjust.
Surah-Al-Maidah(5 : 57)
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُواْ لاَ تَتَّخِذُواْ الَّذِينَ اتَّخَذُواْ دِينَكُمْ هُزُوًا وَلَعِبًا مِّنَ الَّذِينَ أُوتُواْ الْكِتَابَ مِن قَبْلِكُمْ وَالْكُفَّارَ أَوْلِيَاء وَاتَّقُواْ اللّهَ إِن كُنتُم مُّؤْمِنِينَ
হে মুমিনগণ, আহলে কিতাবদের মধ্য থেকে যারা তোমাদের ধর্মকে উপহাস ও খেলা মনে করে, তাদেরকে এবং অন্যান্য কাফেরকে বন্ধু রূপে গ্রহণ করো না। আল্লাহকে ভয় কর, যদি তোমরা ঈমানদার হও।
O ye who believe! take not for friends and protectors those who take your religion for a mockery or sport,- whether among those who received the Scripture before you, or among those who reject Faith; but fear ye Allah, if ye have faith (indeed).
Narrated AbuSa’id al-Khudri:
The Prophet (ﷺ) said: Associate only with a believer, and let only a God-fearing man eat your meals.
আবু দাউদ- ৪৮১৪
৩। জিজিয়া কত প্রকার?
বিভিন্ন মাযহাবে জিজিয়া নিয়ে কিছু মতভেদ আছে । মুসলিম শাসকদের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে মাজহাব ভেদে দুই প্রকারের জিজিয়ার উপস্থিতি ইতিহাসে দেখা যায়ঃ
- জিজিয়া সুলহিয়া (Concilletory Jizya / সন্ধিমূলক জিজিয়া )
- জিজিয়া আনাইয়া (Forced Jizya/ জবরদস্তিমূলক জিজিয়া )
বস্তুত সকল জিজিয়াই জোরপূর্বক তবে এদের মধ্যে একটা সূক্ষ্ম পার্থক্য রয়েছে । মুসলিমরা যখন অমুসলিমদের এলাকা দখল করে নিবে তখন তারা অমুসলিমদের উপর জিজিয়া আরোপ করবে। যদি অমুসলিমরা এই শর্তে রাজি হয় তবে মুসলিমরা তাদের হত্যা করবে না । এই শর্তে যে জিজিয়া নেওয়া হয় সেটা “জিজিয়া সুলহিয়া।” এই ব্যাপারে সব মাজহাবের অনুসারীরাই একমত । তবে কেউ এই শর্ত ভঙ্গ করলে কি হবে সেটা নিয়ে দ্বিমত আছে । হানাফি এবং মালিকি মাজহাবের অনুসারীরা মনে করে যারা জিজিয়ার শর্ত ভঙ্গ করবে তাদের আক্রমণ করে তাদের থেকে জোরপূর্বক জিজিয়া আদায় করে নিতে হবে,তারা যদি জিজিয়ার শর্ত পূরণে অপারগ হয় তবে তাদের স্ত্রী কন্যাদের দাসী হিসাবে ভোগ/বিক্রি করা যাবে এবং কর্মক্ষম পুরুষদের দাস হিসাবে ব্যাবহার বা বিক্রি করা যাবে। এভাবে করের সমপরিমাণ ক্ষতিপূরণ আদায় হয়ে গেলে ওই বছরের মত তাদের উপর আর কোনরূপ জবরদস্তি করা যাবে না। এইভাবে আদায়কৃত জিজিয়াকে বলে জিজিয়া আনাইয়া বা জবরদস্তি মূলক জিজিয়া । অপরপক্ষে , শাফি এবং হানবলি মাজহাব এর অনুসারীরা মনে করে জিজিয়া আনাইয়া আদায় না করে প্রচলিত কিতালের বিধান অনুসারে তাদের বিরুদ্ধে জুদ্ধ করে তাদের বালেগ পুরুষদের হত্যা করতে হবে এবং তাদের স্ত্রী কন্যা এবং অর্জিত সকল সম্পদ গনিমতের মাল হিসাবে ভোগ করা হবে । মুহম্মদের সাহাবিদের মধ্যে খুব প্রসিদ্ধ একজন সাহাবি ছিলেন আমর-ইবন-আল-আস । উনি বারকা (বর্তমান লিবিয়ার উত্তর পূর্ব একটি অঞ্চল ) এর লোকদের উপরে জিজিয়ার যে পরিমাণ নির্ধারণ করেছিলেন সেটা প্রদানে তারা ব্যার্থ হলে তিনি তাদের স্ত্রী কন্যাদের দাসী হিসাবে বিক্রি করে জিজিয়ার সমপরিমাণ অর্থ প্রদানে বাধ্য করেন । জিজিয়ার শর্ত পূরণ করে(উপার্জনক্ষম বালেগ) এমন একজন ব্যাক্তি যদি জিজিয়া প্রদানে অস্বীকৃতি জানায় (কিন্তু তার গোত্রের সবাই নিয়মিত জিজিয়া দিয়ে থাকে ) তবে ওই ব্যাক্তির ক্ষেত্রে ইসলামের বিধান হচ্ছে তাকে হত্যা করতে হবে অথবা তার স্ত্রী কন্যাদের দাসী হিসাবে ব্যাবহার করতে হবে এবং পরিবারের বাকি পুরুষদের দাস হিসাবে বিক্রি করতে হবে।
৪। জিজিয়া কাদের উপর প্রযোজ্য ?
কোরআনের আয়াত মতে যারা আহলে কিতাবে বিশ্বাসী কিন্তু অমুসলিম তাদের সবার উপর(নারী পুরুষ শিশু, বয়স্ক নির্বিশেষে) এই কর প্রযোজ্য। তবে তাফসীর, সিরাত এবং হাদিস বিশ্লেষণে দেখা যায় এই কর মূলত বালেক এবং কর্মক্ষম সকল অমুসলিম পুরুষদের উপর প্রযোজ্য। শিশু, মহিলা প্রতিবন্ধী এবং অতি বয়স্ক এমন লোকদের উপর জিজিয়া প্রযোজ্য নয় (তাফসীরে আরও বিস্তারিত আছে, কারা জিজিয়া করের আওতায় পড়ে না)।
হানাফি এবং মালিকি মাজহাবের কিতাবগুলো থেকে দেখা যায় এই কর সকল অমুসলিমদের উপরেই প্রযোজ্য এবং মোহাম্মদ পেগান এবং জোরাস্ট্রিয়ান কাছ থেকে জিজিয়া আদায় করেছেন, যদিও তারা আহলে কিতাবে বিশ্বাসী ছিল না। কিন্তু সাফি এবং হানবলি মাজহাব এর অনুসারীরা মনে করে আহলে কিতাব ছাড়া অন্য অমুসলিমদের জন্য শর্ত হচ্ছে হয় তাদের সবাইকে মুসলিম হতে হবে নতুবা তাদের হত্যা করতে হবে। খলীফায়ে রাশেদিনগন কিতাবি ছাড়া অন্য অমুসলিমদের হত্যা না করে তাদের কাছ থেকে জিজিয়া আদায় করেছেন ।
জিজিয়া সুলহিয়া শুধুমাত্র বালেগ এবং কর্মক্ষম পুরুষদের কাছ থেকে নেয়া যাবে এবং এ ছাড়া অন্য অমুসলিমদের উপর নেওয়া যাবে না এই ব্যাপারে সকল মাজহাবের অনুসারীরা একমত।
৫। জিজিয়ার পরিমাণ কিভাবে নির্ধারিত হয়?
জিজিয়া করের পরিমাণ এবং শর্ত নিয়ে নিয়ে ইসলামী স্কলারদের মধ্যে ১৪০০ বছর ধরেই এখতেলাফ(মতবিরোধ) চলছে। তবে ইতিহাসের কিছু পরিসংখ্যানের দিকে তাকালে পরিস্থিতি সম্পর্কে কিছুটা ধারনা পাওয়া যেতে পারে ।
- মুহাম্মদ ইয়েমেনের অন্ত্যন্ত গরীব এবং হতদরিদ্র একটি অমুসলিম জনগোষ্ঠীর উপরে ১ দিনার (তখনকার সময়ের ১০-১২ দিরহাম ) হারে জিজিয়া আরোপ করেছিল। অর্থাৎ প্রত্যেক সাবালক পুরুষের মাথার জন্য ১ দিনার জিজিয়া কর আদায় করত মোহাম্মদ । উল্লেখ্য , তখনকার সময়ে ১০ দিরহাম মানে ছিল এভারেজ লোকসংখ্যার একটা নিম্নবিত্ত পরিবারের ১০-১২ দিনের সংসার খরচ। এখানে একটা ব্যাপার মনে রাখতে হবে আমাদের বর্তমানের পরিবারের ধারনা তখনকার সময় থেকে অনেক ভিন্ন, এখন গড়ে পরিবারে লোক থাকে ৪-৫ জন কারণ এখন আমরা একক পরিবারের ধারনা অনুসরণ করি। কিন্তু তখন বহুবিবাহ এবং একান্নবর্তী ধারনার কারণে পরিবারে বর্তমান সময়ের ৪ থেকে ৫ গুন লোক বাস করত । এই পরিমাণ কর চাপানো হয়েছিল ইয়েমেনের অমুসলিমদের উপরে যারা ছিল অত্যন্ত গরীব । এটা ছিল সকল অমুসলিমদের জন্য জিজিয়া করের নুন্যতম হার (১ দিনার) । অর্থাৎ, সমাজের যারা সবথেকে গরীব এবং কর্মক্ষম(বর্তমান প্রেক্ষাপটে কুলি, দিন মজুর ) তাদের এই হারে কর দিতে হত যা তাদের সংসারের ১০ দিনের খরচ ছিল। যদি কারও ২ দিনার প্রদান করার সামর্থ্য থাকত তবে তার উপর দুই দিনার জিজিয়া আরোপ হত, যদি কারও ৪ দিনার দেবার সামর্থ্য হত তবে তার উপর ৪ দিনার জিজিয়া আরোপ হত। মুহাম্মদ এবং খলীফায়ে রাশিদনের সময়ে এটাই ছিল জিজিয়া করের সর্বোচ্চ পরিমাণ। এই ব্যাপারে সকল ইসলামী স্কলাররা একমত যে সবথেকে গরীব মসুলিম উপার্জনক্ষম লোকটিকেও বছরে কমপক্ষে ১ দিরহাম (৪.২৩৫ গ্রাম স্বর্ণ ) জিজিয়া কর হিসাবে প্রদান করতে হবে। আর এই করের সর্বোচ্চ পরিমাণ কি হবে এবং তার শর্ত কি হবে সেটা নির্ধারণ করবে আঞ্চলিক শাসক – এই ব্যাপারেও আলেমগণ একমত।
- হযরত উমারের সাথে বনী তগ্লিব গোত্রের যে জিজিয়ার শর্ত ছিল তা হল মুসলমানদের জাকাতের দিগুণ হারে তাদের প্রত্যেককে জিজিয়া কর প্রদান করতে হবে।
- খাইবারের যে সহিহ হাদিসের (বুখারী , মুসলিম ) রেফারেস্ন উল্লেখ করা হয়েছে সেখানে দেখা যায় মুহাম্মদ তাদের বাৎসরিক উৎপাদনের অর্ধেক জিজিয়া হিসাবে আদায় করত।
- উপমহাদেশের বিখ্যাত মুসলিম শাসক আলাউদ্দিন খিলজির সময়ে জিজিয়ার পরিমাণ ছিল ৫০-৭৫ শতাংশ।
- বিখ্যাত মুঘল শাসক নিজ ধর্মেমতের বিরুদ্ধে গিয়ে মানবতার এক বিরল এবং উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন। তিনি তার শাসনামলে এই কর বাতিল করেন। অমুসলিমদের প্রতি সম্রাট আকবরের এই উদার ও সহনশীল নীতিতে অসন্তুষ্ট হয়ে জনপ্রিয় সুফী সাধক শেখ আহমদ সিরহিন্দী তাকে ইসলামী আইনের লংঘনকারী আখ্যায়িত করে চিঠি পাঠান। চিঠিতে সিরহিন্দী লেখেন-
‘ইসলামের সম্মান ‘কুফরী’ (অবিশ্বাস) ও ‘কাফির’ (অবিশ্বাসী) কে অপমান করার মধ্যে নিহিত। যে কাফিরকে সম্মান দেয় সে মুসলিমকে অমর্যাদা করে। তাদের উপর জিজিয়া আরোপের উদ্দেশ্য হলো, এমন করে তাদেরকে অবমানিত করা যাতে তারা ভাল পোশাক পরতে বা জাঁকজমকের সাথে বাস না করতে পারে। তারা ভীতসন্ত্রস্ত ও কম্পমান থাকে।’
৬। জিজিয়া কিভাবে দিতে হয়?
জিজিয়া কিভাবে আদায় করতে হবে সে ব্যাপারে তাফসীর সমূহেই বেশ বিস্তারিত লেখা আছে। আমি আরও কিছু ঐতিহাসিকভাবে বিখ্যাত ইসলামী স্কলারের উক্তি তুলে ধরলামঃ
বিখ্যাত ইসলামী বিশ্লেষক আল-জামাকশারী জিজিয়া প্রদানের ব্যাখ্যা দিয়েছেনঃ
তাদের নিকট থেকে জিজিয়া নেয়া হবে অবমাননা ও মর্যাদাহানিকরভাবে। জিম্মিকে সশরীরে হেঁটে আসতে হবে, ঘোড়ায় চড়ে নয়। যখন সে জিজিয়া প্রদান করবে, তখন কর-আদায়কারী বসে থাকবে আর সে থাকবে দাঁড়িয়ে। আদায়কারী তার ঘাড় ধরে ঝাঁকি দিয়ে বলবে, ‘জিজিয়া পরিশোধ কর।’ এবং জিজিয়া পরিশোধের পর আদায়কারী ঘাড়ের পিছনে একটা চাটি মেরে তাকে তাড়িয়ে দিবে।
মিশরের বিখ্যাত সুফি পণ্ডিত আস-সারানিঃ
অতপর আমির তার ঘাড়ে একটা চাটি মারবে এবং আমিরের সামনে উপস্থিত লোকেরা (মুসলিম) তাকে রূঢ়ভাবে হটিয়ে দিবে।
কাশ্মীরের সুলতান জয়নুল আবেদীনের কাছে এক চিঠিতে পারস্যের ইসলামী পণ্ডিত লেখেন:
‘তাদের উপর জিজিয়া আরোপের প্রধান উদ্দেশ্য হলো তাদেরকে অবমানিত করা। আল্লাহ তাদেরকে অসম্মানিত করার জন্যই জিজিয়া প্রতিষ্ঠা করেছেন। এর উদ্দেশ্য হলো তাদেরকে অবমানিত এবং মুসলিমদের সম্মান ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করা।’
সুলতান আলাউদ্দীন খিলজী বিজ্ঞ ইসলামী পণ্ডিত কাজী মুঘিসুদ্দিনের কাছে উপদেশ চাইলে কাজী এভাবে বর্ণনা দেন:‘আদায়কারী যদি তার (খারাজ দাতার) মুখে থু-থু দিতে চান, তাহলে সে মুখ হা করবে। তার উপর এ চরম অপমান ও আদায়কারী কর্তৃক তার মুথের ভিতরে থু-থু দেওয়ার উদ্দেশ্য হলো এ শ্রেণীর উপর আরোপিত চরম বশ্যতা, ইসলামের গৗরব ও বিশ্বাসের প্রতি মহিমান্যতা এবং মিথ্যা ধর্মের (হিন্দুত্ববাদ) প্রতি অমর্যাদা প্রদর্শন।’
জিজিয়ার হাত হতে মুক্ত হওয়ার একমাত্র উপায় ছিল কলেমা পড়ে ইসলাম গ্রহণ করা। ফিরোজ শাহ তুঘলকের স্মৃতিকথা ‘ফতুয়া-ই-ফিরোজ শাহী’তে উল্লেখ রয়েছে:
‘আমি আমার অবিশ্বাসী প্রজাদেরকে নবির ধর্ম গ্রহণে উৎসাহিত করি। আমি ঘোষণা করি যে, যারা ধর্ম পরিবর্তন করে মুসলমান হবে তারা প্রত্যেকেই জিজিয়া কর থেকে মুক্তি পাবে। সর্বত্র জনগণের মাঝে এ সংবাদ পৌঁছে যায় ও বিপুল সংখ্যক হিন্দু নিজেদেরকে উপস্থাপন করে ইসলামের সম্মানকে স্বীকার করে নেয়। এরূপে তারা দিনের পর দিন সর্বত্র থেকে এগিয়ে আসে ও ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে জিজিয়া থেকে মুক্ত হয়, এবং উপহার ও সম্মানের দ্বারা আনুকূল্য পায়।’ (এদের কারও আপনার পূর্বপুরুষ হলে খুব অবাক হবার কিছু আছে কি যে আপনি কেন একজন মুসলিম ? এদের কেউ আপনার পূর্বপুরুষ হবার সম্ভাবনা কতখানি একবার ভেবে দেখবেন। )
উপরে উল্লেখিত তাফসীর সমূহের তাফসীরকারিগণও এই ব্যাপারে একমত যে জিজিয়া আদায়ের সময়ে জিজিয়া প্রদানকারী অমুসলিমকে অপমান এবং হেনস্থা করতে হবে। আপনি না হয় না জেনে শুধু ইমামদের বিজ্ঞাপন দেখেই জেনে এসেছেন যে ইসলাম শান্তির ধর্ম কিন্তু কখনো ভেবেছেন যে মাদ্রাসার প্রতিটা ছাত্র , আমাদের সমাজের প্রতিটা ইমাম অমুসলিমদের বিষয়ে এই রকম কুৎসিত বর্বর মানসিকতা কিভাবে তাদের অন্তরে লালন করে মুখে ইসলামকে শান্তির ধর্ম বলে বিজ্ঞাপন দেয় ? আল্লাহ কি সবার জন্য পরম করুণাময় অসীম দয়ালু নাকি শুধু মুসলিমদের জন্য?
৭। জিজিয়া প্রথা কতদিন চলবে?
এই সহিহ হাদিস মতে জিজিয়া ততদিন চলবে যতদিন না মারিয়াম পুত্র ঈসা পৃথিবীতে এসে এই কর তুলে না দেয়।
তবে বাস্তবতা একটু ভিন্ন। অটোম্যান সাম্রাজ্যের পতনের পর , আধুনিক বিশ্বে রাষ্ট্রের সংজ্ঞায় আমূল পরিবর্তন হয়, প্রায় একই সময়ে আমাদের উপমহাদেশে জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হয় এবং পৃথিবীর প্রায় সকল দেশ দাস ব্যাবসা, ধর্ম ভিত্তিক বৈষম্য এসব মধ্যযুগীয় বর্বর ধারনা থেকে বের হয়ে আসে। ফলে ১৯৫০ সালের পর থেকে পৃথিবীর সকল মুসলিম দেশে এই কর বিলুপ্ত। তাই বলে আমাদের এই ভেবে হতাশ হবার কিছু নেই যে মুহাম্মদের নবুয়ত মিথ্যা প্রমাণ হয়ে গেছে কিংবা তার কথা সত্যি হয় নি, কিংবা ঈসা নবী আসার আগেই জিজিয়া কর পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে !!! আমরা জানি , মুহাম্মদের ভবিষ্যৎবানী মতে পৃথিবীর বুকে যতদিন আল্লাহর সৈনিকরা থাকবে, যতদিন একদল লোক মুহম্মদের দেখান পথে হকের উপর থাকবে ততদিন কেয়ামত হবে না। বাস্তবেও আসলে তাই ই হয়েছে ! সকল মুসলিম রাষ্ট্রপ্রধানরা যখন কাফেরদের নিন্দা বিদ্রূপের ভয়ে ,যুগের ধ্যান ধারনার সাথে সাথে তাল মেলাতে গিয়ে আল্লাহর বিধান জিজিয়াকে (এবং দাস-প্রথা) তাদের শরিয়া নির্ভর রাস্ট্রসমূহে রহিত করে (মা’দাল্লাহ! ) তাকিয়ার বিধান অনুসরণ করেছে তখন আল্লাহর একদল সাহসী সৈনিকেরা ISIS নাম ধারণ করে কিছু ভূখণ্ড দখল করে সেখানে দাসপ্রথা, দাস কেনাবেচা এবং জিজিয়ার মত বিলুপ্তপ্রায় মানবিক ইসলামী চর্চাগুলকে এখনও বাঁচিয়ে রেখেছে!
৮। মুসলিমদের জাকাত কি অমুসলিমদের জিজিয়া?
আমি সরাসরি এই প্রশ্নের উত্তর না নিয়ে বরং কিছু তুলনামূলক আলোচনা করি ,তারপর এই প্রশ্নের উত্তর বের করার দায়িত্ব আপনার হুশ, আপনার সংজ্ঞা যার জন্য আপনাকে মানুষ বলা হয় , সেটার উপর ছেড়ে দিলাম ।
মুসলমানদের যাকাত দিতে হয় তাদের “উদ্বৃত্ত” সম্পদের উপর। সম্পদের অতিরিক্ত যে অংশ এক বছর বা তার থেকে বেশি সময়ের জন্য উদ্বৃত্ত থাকে তার উপর হিসাব করে যাকাত দিতে হয়। উদ্বৃত্ত সম্পদের পরিমাণ সারে সাত তোলা স্বর্ণ অথবা সারে বাহান্ন তোলা রুপার সমপরিমাণ হলে তবেই তাকে যাকাত দিতে হবে। সারে সাত তোলা স্বর্ণের বর্তমান বাজার মূল্য ৩৭০০ ইউ এস ডলার।
১ তোলা = ১ ভরি = ১১.৬৬৪ গ্রাম
১ গ্রাম স্বর্ণের দাম = ৪২ ডলার।
11.664 * 7.5 * 42 ~ 3700 USD
May 14, 2017Daily Star এর দেওয়া তথ্য অনুসারে আমাদের দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় বছরে ১৬০০ ইউ এস ডলার।
Bangladesh 2016 Politics, Governance and Middle Income Aspirations Realities and Challenges An Empirical Study , – A research by UNDP – এর দেওয়া তথ্য ঃ
আমাদের দেশে মাত্র ১০ % মানুষে যাকাত সীমার উপরে বসবাস করে। তার মধ্যে এদের সবাই যাকাত দিবে না কারণ এদের ১৫ % অমুসলিম । পক্ষান্তরে জিজিয়ার শর্ত এই ১৫ % অমুস্লিমদের ভেতর থেকে নারী শিশু বয়স্ক এবং প্রতিবন্দী বাদ দিলেও তাদের মোট জনগোষ্ঠীর এক তৃতীয়াংশের উপরে বর্তায়। অর্থাৎ আমাদের দেশের মুসলিম জনগোষ্ঠীর প্রতি ১৫ জনে এক জন যাকাত দিবে এবং অমুসলিম জনগোষ্ঠীর প্রতি ১৫ জনে ৫ জন জিজিয়া দিবে।
যাকাতের অর্থ উদ্বৃত্ত সম্পদের ২.৫ ভাগ, জিজিয়া নির্ধারণের প্রক্রিয়া আমরা আগেই দেখেছি।
শরীয়তে যাকাত আদায়ের কারণ হিসাবে বলা হয়েছে “ধনীর উপর দরিদ্রের হোক” । অপরদিকে জিজিয়া আদায়ের উদ্দেশ্য হিসাবে বলা হয়েছে ভিন্ন বিশ্বাসের জন্য তাদের অপমান করা এবং ভিন্ন বিশ্বাসের জন্য তাদের হত্যা না করে তাদের বেঁচে থাকার সুযোগ দেওয়া ।
একজন অমুসলিম দিনমজুরের উপরেও জিজিয়া বর্তায় যদি সে উপার্জনক্ষম হয়, কিন্তু যাকাত শুধুমাত্র “অবস্থাসম্পন্ন ব্যাক্তির উদ্বৃত্ত সম্পদ” এর উপরে।
যাকাত প্রদানকারীকে তার দানশীলতার জন্য সমাজের সবাই ভাল মানুষ হিসাবে জানে, তিনি সবার নিকট প্রশংসিত হয় , জিজিয়া প্রদানকারী অমুসলিম জিজিয়া প্রদান কালে মুলসিম শাসকদের কাছে অপমানিত হয়।
যাকাত প্রদানকারী তার নেক আমলের জন্য আল্লাহর কাছ পরকালে পুরস্কৃত হবে । অপরদিকে জিজিয়া প্রদানকারীকে আল্লাহ অনন্তকাল জাহান্নামের আগুনে পুড়িয়ে শাস্তি দিবে।
যাকাত আদায় কারীকে অন্য কোন শক্তি আক্রমণ করলে মুসলিম সেনারা তাদের বিরুদ্ধে জুদ্ধ করবে , কিন্তু জিজিয়া প্রদানকারীকে যদি অন্য কেউ আক্রমণ করে তবে মুসলিমরা চাইলে তাদের বিরুদ্ধে জুদ্ধ না করে তাদের জিজিয়া তাদের ফিরিয়ে দিতে পারে। (খলীফায়ে রাসেদিনদের ইতিহাস থেকে রেফারেন্স উল্লেখ করা হয়েছে )
৯। জিজিয়া নিয়ে মুসলিমরা কি প্রচার করে?
জিজিয়া সম্পর্কে সকল মুসলিমেরই ধারনা যে এটি যাকাতের মত খুউউউউউউউব সামান্য একটি পরিমাণ সম্পদ যা মুসলিম দেশে অমুস্লিমদের থেকে নেওয়া হয়। অমুসলিমদের উপর যেহেতু যাকাত ফরজ না, তাই তাদের থেকে সমপরিমাণ জিজিয়া নেওয়া হয় যা কিনা গরীবের হক!!!
আপনার তাফসীর কি সেকথা বলে? আপনার ইতিহাস কি বলে? কেন এই মিথ্যাচার? কেন এই সত্য গোপন? কাকে বাঁচাতে?
জিজিয়া নিয়ে মুসলমানরা কি প্রচার করে সেটার যুক্তি খণ্ডন আমার এই লেখার উদ্দেশ্য না। আমার এই লেখার উদ্দেশ্য আমার পাঠকদের নির্ভুল এবং নির্ভরযোগ্য তথ্য দিয়ে সাহায্য করা এবং একটি তুলনামূলক চিত্রের মাধ্যমে তাদের মানবিক চিন্তাধারাকে বিকশিত করা। জিজিয়া নিয়ে মুসলিম ধর্মপ্রচারকদের বিজ্ঞাপন ইউটিউবে গেলেই ভুরি ভুরি পাওয়া যাবে। একজন জনপ্রিয় ইসলাম প্রচারক জাকির নায়েকের জিজিয়া সম্পর্কিত মন্তব্য পাওয়া যাবে এই লিঙ্ক দুটিতে ঃ
খ্যাতিমান এবং প্রসিদ্ধ ইসলামী স্কলার ড: সাব্বির আলীর সাক্ষাতকার ঃ
আরও কিছু লিঙ্ক ঃ
মুসলিম পাঠকদের কাছে অনুরোধ ভিডিও গুলি দেখার পড়ে শুধু তাফসীর সমূহ আরেকবার পড়ে দেখবেন। জাকির নায়েক ভক্তরা একটু খেয়াল করে মিলিয়ে দেখবেন জাকির নায়েক কি বলছেন আর তাফসীর কি বলছে।
এবার দেখি বাংলার দামাল সন্তানেরা, নাস্তিকবিরোধী ইসলামের বীর সৈনিকেরা কিভাবে জবাব দেয় জিজিয়া প্রশ্নের ঃ
- সদালাপ
- জিজিয়া নিয়ে মিথ্যাচার – এবং কিছু কথা
- ইসলামীরাষ্ট্রে অমুসলিমদের মর্যাদা এবং নিরাপত্তাব্যবস্থা !!
১০। একটি তুলনামূলক পর্যালোচনায় মুসলিমদের প্রতিক্রিয়া কি হতে পারে?
মনে করুন ডোনাল্ড ট্রাম্প আইন প্রণয়ন করল যে আমেরিকায় বসবাসরত সকল মুসলিমদের আমেরিকায় থাকতে হলে খ্রিস্টান হতে হবে নতুবা একটা নির্দিষ্ট হারে “অপমানজনক অবস্থায়” জিজিয়া দিতে হবে এবং কেউ জিজিয়া দিতে ব্যার্থ হলে তাকে হয় হত্যা করা হবে নতুবা ওই মুসলিমের স্ত্রী কন্যাদের যৌন দাসী হিসাবে ব্যাবহার করা হবে এবং পরিবারের বাকিদের দাস হিসাবে বিক্রি করা হবে। মুসলিমরা কি বলবেন যে ট্রাম্প তাদের প্রতি খুব সহানুভূতিশীল, তাদের ভিন্ন বিশ্বাসের কারণে তাদের মৃত্যুদন্ড প্রাপ্য ছিল কিন্তু ট্রাম্প তাদের প্রাণে বাঁচার একটা সুযোগ দিয়েছে!!! মুসলিমরা কি বলবেন যে ট্রাম্প অত্যন্ত দয়ালু একজন মানুষ কিংবা সর্বযুগের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব!!! ট্রাম্পের এই কাজের পর একজন মুসলিমের সামনে যখন একজন খ্রিস্টান তাকে সর্বযুগের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামনব বলবে তখন কেমন কাগবে মুসলমানদের ? উন্নত দেশগুলো যখন মুসলিম নারীদের হিজাব পড়তে বাধা দেয়, তখন মুসলিমরা তাদের দূতাবাস ঘেরাও করেন, তাহলে ট্রাম্প আমেরিকায় জিজিয়া চালু করলে , এবং বছরে একবার ঘারের পিছনে চাটি মেরে (অবমানিত অবস্থায়, তাফসীর অনুসারে ) তাদের কাছ থেকে জিজিয়া আদায় করলে মুসলিমরা কি করতেন?
“”জিজিয়া কর””
ইসলামিক রাষ্ট্র=হিন্দু,বৌদ্ধ,খৃষ্টান,মুসলিম ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বীর মানুষ দেশের নাগরিক।
যাকাত=মুসলিমের উপর ফরজ।
জিজিয়া কর=অন্যান্য ধর্মাবলম্বির মানুষের উপর ফরজ।
যাকাত দিবা না!! জাহান্নামের আজাব উপভোগ কর।
জিজিয়া কর দিবা না!!দেশ ছাড়।(নাস্তিকদের ভিত্তিহীন অভিযোগ)
কর প্রদান করা একটি রাষ্ট্রিয় বিধান।
রাষ্ট্রের প্রধান এই বিষয়ে চিন্তা করবে।
আপনি বা আমরা না।
বিশ্বে এমন কোন দেশ পাবেন না, যে দেশের নাগরিক কর প্রদান করে না।কেউ কর না দিলে, কর আদায় করার জন্য আইনানুগ ব্যাবস্হাও গ্রহন করতে পারবে একটি রাষ্ট্র।
কিন্তু,নাস্তিকরা বারবার বলে জিজিয়াকর অমুসলিমদের উপর জোড় করে চাপিয়ে দেয়া হয়েছে এবং জিজিয়া না দিলে দেশত্যাগে বাধ্য করা অমানবিক।
এখন,আমার কথা হলো মুসলিম নাগরিকগন যাকাত প্রদান করবে আর অমুসলিম নাগরিকগন কি করবে??বিনা করে রাষ্ট্রিয় সুযোগ সুবিধা ফ্রিতো ভোগ করবে???যৌক্তিক কোন কারন দেখি না।
জিজিয়া কর।
জিজিয়া (আরবি: جزية ǧizyah আইপিএ: [dʒizja]) হলো ইসলামি রাষ্ট্রে ইসলামি আইনের অনুকূলে স্থায়ীভাবে বসবাসরত অমুসলিমদের জনপ্রতি বাৎসরিক ধার্যকৃত কর।মুসলিম ফকীহগণের অভিমত এই যে, অমুসলিমদের মধ্যে করদাতাকে প্রাপ্তবয়স্ক, স্বাধীন, কর্মক্ষম পুরুষ হতে হবে।মহিলা, শিশু, বৃদ্ধ, প্রতিবন্ধী, উন্মাদ, দাসদের নিস্কৃতি দেয়া হয়েছে।পাশাপাশি মুসতামিনস — অমুসলিম বিদেশী যে অস্থায়ী মুসলিম দেশে আশ্রয় নেয়এবং যে অমুলিমরা সামরিক বাহিনীতে যোগদান করতে তাদের চায়এবং যদি তারা দিতে অসমর্থ তবে তাদের এই কর থেকে নিস্কৃতি দেওয়া হয়েছে।
হাদিসেও জিজিয়া কর সম্পর্কে উল্লেখ আছে, কিন্তু পরিমাণ উল্লেখ নেই।ফকীহগণ এই বিষয়ে একমত যে, পূর্বে মুসলিম শাসকরা বাইজেন্টাইন এবং সাসানীয় সাম্রাজ্যে এটি আদায় করতেন।
ইসলামি ইতিহাসে এর প্রয়োগ বিভিন্ন রকম দেখা যায়। অনেক সময় জিজিয়াকে খারাজ এর সাথে সাধারণ কর হিসাবে আদায় করা হয়েছে।এবং ইসলামি রাজনীতিতে রাজস্ব আদায়ের প্রধান উৎস ছিল।জিজিয়া কর করদাতার সামর্থ্য অনুসারে বাৎসরিকভাবে নির্ধারিত হতো। বিভিন্ন সময় স্থান, কাল ইত্যাদির উপর ভিত্তি করে ভিন্ন সময় ধার্যকৃত কর এর পরিমাণ ভিন্ন হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে কুরআনের সুরা তওবার ২৯ আয়াতে বলা হয়েছে,
“তোমরা লড়াই করো আহলে কিতাবের সেসব লোকের সাথে যারা আল্লাহ ও শেষ দিবসে ঈমান রাখে না এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূল যা হারাম করেছেন তা হারাম মনে করে না, আর সত্য দীন (জীবনব্যবস্থা) গ্রহণ করে না, যতক্ষণ না তারা স্বহস্তে নত হয়ে জিযিয়া দেয়।”[কুরআন 9:29]
উসমানীয় তুরস্কে ১৯শ শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত জিজিয়া বলবৎ ছিল। মুসলমানদের বাধ্যতামূলকভাবে সামরিক বিভাগে যোগদান করতে হতো বলে তার পরিবর্তে অমুসলমানদের ওপর একটি কর ধার্য করা হয়। কিন্তু সকল ধর্মের নাগরিকদের জন্য বাধ্যতামূলক সামরিক পেশা প্রবর্তিত হওয়ার পর এই করেরও বিলোপ হয়। মধ্য যুগে পৃথিবীর অন্যান্য মুসলিম শাসিত দেশেও অমুলমানদের ওপর জিজিয়া কর ধার্য করা হয়। ভারতীয় উপমহাদেশে আকবর এটা রহিত করেন, কিন্তু সম্রাট আওরঙ্গজেবের আমলে এটা পুনঃপ্রবর্তিত হয়।
জিজিয়াকর না দিলে দেশ ত্যাগ করতে হবে না।????
উরওয়া বিন যুবায়ের বিন আওয়াম থেকে হিশাম বিন উরওয়ার মাধ্যমে আবু ইউসুফ বর্ণনা করেছেন, উমার(রা.) সিরিয়া থেকে ফেরার পথে এক স্থানে দেখলেন, কয়েকজন লোককে প্রখর রৌদ্রে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে। তিনি বললেন, ব্যাপার কী? লোকেরা বললো, এদের উপর জিজিয়া অত্যাবশ্যক ছিলো। কিন্তু এরা জিজিয়া পরিশোধ করেনি। তাই তাদেরকে শাস্তি দেয়া হচ্ছে। তিনি বললেন, এরা জিযিয়া পরিশোধ করতে চায় না কেন? লোকেরা বললো, এরা বলছে, এরা কপর্দকহীন। উমার(রা.) বললেন, এদেরকে ছেড়ে দাও। সাধ্যবহির্ভূত বোঝা এদের উপর চাপিয়ো না। আমি রাসুল(ﷺ)কে বলতে শুনেছি, “মানুষকে শাস্তি দিয়ো না। পৃথিবীতে মানুষকে যারা (অন্যায়ভাবে) শাস্তি দেবে, আখিরাতে আল্লাহ তাদেরকে শাস্তি দেবেন।”
(তথ্যসূত্র উইকিপিডিয়া)