যেভাবে জীবনের শুরু: প্রোটনের শক্তি
- মূল প্রবন্ধ: The secret of how life on earth began
- প্রথম ও দ্বিতীয় পর্ব (একসাথে): যেভাবে জীবনের শুরুঃ পৃথিবীতে প্রাণের উৎপত্তি
- তৃতীয় পর্ব: যেভাবে জীবনের শুরুঃ প্রথম স্বয়ম্ভূর খোঁজে
দ্বিতীয় অধ্যায়ে আমরা দেখেছি কীভাবে ঘটেছিল প্রথম প্রাণের বিকাশ এই প্রশ্নে বিজ্ঞানীকুল তিনটি চিন্তাধারায় বিভক্ত হয়ে গিয়েছিলেন। বিজ্ঞানীগণের একপক্ষ মনে করেছিলেন প্রাণের সূচনা ঘটেছিল RNA অণুজীব থেকে। কিন্তু শুধু মতামত দিয়েই তারা ক্ষান্ত ছিলেন না, তারা প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে লাগলেন কীভাবে RNA বা তার সমগোত্রীয় অণুজীব স্বতঃস্ফূর্তভাবে পৃথিবীর প্রথমদিকের পরিবেশে প্রাণ সৃষ্টি করেছিল এবং সেই আদি প্রাণ কীভাবে নিজেরা নিজেদের প্রতিলিপি সৃষ্টি করেছিল। শুরুর দিকে তাদের প্রচেষ্টা যথেষ্ট আশা জাগানিয়া হলেও শেষপর্যন্ত তাদের শ্রম হতাশায় পর্যবসিত হয়। যাইহোক, প্রাণ সৃষ্টির গবেষণা এগিয়ে চলছিল কিন্তু সেই সময়ে আরেক দল বিজ্ঞানী যারা প্রাণের সৃষ্টি রহস্য নিয়ে গবেষণা করছিলেন তারা বুঝতে পারলেন প্রাণ সৃষ্টি হয়েছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন এক উপায়ে।
RNA ঘরানার চিন্তা নির্ভর করে খুব সাধারণ কিছু ধারণার উপর আর সেটা এইযে, কোন জীবিত প্রাণের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো তারা নিজেদের পুনরুৎপাদন করতে সক্ষম। বেশিরভাগ জীববিজ্ঞানী এই ধারণার সাথে একাত্মতা পোষণ করেন। ক্ষুদ্র কোষের ব্যাকটেরিয়া থেকে শুরু করে সুবিশাল নীল তিমি পর্যন্ত সব জীবিত প্রাণীই বংশ বৃদ্ধি করতে তৎপর।
জার্মান বিজ্ঞানী গুন্টার ভাস্টারশাওজার ধারণা করেন প্রথম অণুজীব ছিল বিস্ময়করভাবে নতুন কোন অণুজীব যেটা আমাদের জানাশোনার বাইরে। যাইহোক অনেক ‘প্রাণের উৎস সন্ধানী’ গবেষক বংশবিস্তারই প্রাণীর প্রধান বৈশিষ্ট্য বলে মনে করতেন না। তাদের যুক্তি ছিল বংশ বিস্তারের আগে সেই সকল প্রাণকে প্রথমে টিকে থাকার মত শক্তি সঞ্চয় করতে হবে। তাদেরকে অবশ্যই জীবিত থাকতে হবে। তারা বলেন, “প্রথমেই যদি আপনি পটোল তুলে ফেলেন তাহলে বাচ্চা পয়দা করতে পারবেন না।”
আমরা আমাদের বাঁচিয়ে রাখি খাবার খেয়ে, একইভাবে সবুজ উদ্ভিদ বেঁচে থাকে সূর্যালোক থেকে সালোক সংশ্লেষণের মাধ্যমে শক্তি আহরণ করে। আপনার এরকম চিন্তা করার সুযোগ নেই যে একজন মানুষ নিজের শক্তির যোগানের জন্য পত্রপল্লবিত একটা ওক গাছের শাখায় ঝাঁপিয়ে পড়ছে যেমন ভাবে নেকড়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে সুস্বাদু রসালো মাংসের হাড়ের উপর। কিন্তু আপনি যদি গভীরভাবে চিন্তা করেন তো দেখবেন মানুষ আর নেকড়ে উভয়ই বেঁচে থাকার শক্তি আহরণ করছে একই পদ্ধতিতে।
খাদ্য গ্রহণের এই চলমান ধরণকে বলে বিপাক প্রক্রিয়া। প্রথমেই আপনাকে শক্তি আহরণ করতে হবে যেমন মনে করি, শক্তি সমৃদ্ধ রাসায়নিক উপাদান যেমন চিনি। তখন আপনাকে সেই শক্তি দিয়ে শরীরের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান সৃষ্টি করতে হবে যেমন দেহকোষ। শক্তিকে ত্বরান্বিত করার এই প্রক্রিয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অনেক গবেষক মনে করেন জীবন সৃষ্টির প্রাক্কালে প্রথমে এমনটাই ঘটেছিল।
শুধু খাদ্যগ্রহণ আর বিপাক নির্ভর আদি অণুজীব দেখতে কেমন ছিল? সবচেয়ে সুদূর প্রসারী প্রভাব বিস্তারকারী প্রস্তাবনা দিয়েছিলেন জার্মান রসায়নবিদ গুন্টার ভাস্টারশাওজার। যদিও তিনি পুরোপুরি বিজ্ঞানী নন বরং তিনি রসায়ন বিষয়ে পড়াশোনা শেষ করে প্যাটেন্ট আইন-পেশায় আত্মনিয়োগ করেন। তিনি বলেন, প্রথম অণুজীব কোন কোষ দিয়ে গঠিত ছিল না। তাদের এনজাইম, DNA or RNA বলে কিছু ছিল না। বরং উন্নত অণুজীব যেগুলো দেখতে পাই তাদের DNA, দেহকোষ, মস্তিষ্ক পরবর্তীতে যুক্ত হয়েছে। গুন্টার ভাস্টারশাওজার মনে করেছিলেন আদি পৃথিবীতে আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের ফলে ভূ-গর্ভ থেকে বেরিয়ে এসেছিল গরম পানির স্রোত। লাভা মিশ্রিত সেই পানি ছিল অ্যামোনিয়া গ্যাস, খনিজ উপাদানে সমৃদ্ধ। যখন লাভা মিশ্রিত খনিজ পানি পাথরের উপর দিয়ে প্রবাহিত হলো তখন রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটতে শুরু করলো। বিশেষত, লাভা মিশ্রিত পানির মধ্যে দ্রবীভূত খনিজ উপাদান, ধাতু প্রথম দিকের জৈবকণা গঠনে সাহায্য করেছিল যারা বিভাজন প্রক্রিয়ায় বৃহত্তর জৈবকণায় পরিণত হয়।
অণুজীবের প্রথম বিপাক ক্রিয়ার চক্র সৃষ্টি ছিল জীবন বিকাশের যুগান্তকারী ঘটনা। এই প্রক্রিয়ায় একটা রাসায়নিক উপাদান কয়েকটি ভিন্ন ভিন্ন রাসায়নিক উপাদানে পরিণত হয়। মূল রাসায়নিক উপাদান বিক্রিয়া না করা পর্যন্ত এই প্রক্রিয়া চলতেই থাকে। এই প্রক্রিয়ায় পুরো প্রাকৃতিক উপাদান থেকে অণুজীব শক্তি সঞ্চার করে এবং পুনরায় নতুন চক্র শুরুর সাথে অন্যান্য কাজ করতে শুরু করে। বিপাক চক্রের সাথে জীবন চক্রের কোন মিল না থাকলেও দুইটাই প্রক্রিয়ায় জীবনের মৌলিক উপাদান।
যেসব উপাদানের সমন্বয়ে উন্নত জৈবকণা সৃষ্ট যেমন DNA, জীবদেহের কোষ, মগজ এসবই বিপাক প্রক্রিয়ার রাসায়নিক চক্র থেকে সৃষ্টি হয়েছে। বিপাক প্রক্রিয়া জীবন চক্রের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত না হলেও গুন্টার ভাস্টারশাওজার জীবন সৃষ্টির পূর্ব শর্ত হিসেবে আখ্যায়িত করলেন এবং লিখলেন “বিপাক প্রক্রিয়াকে প্রায় জীবন্ত কর্মকাণ্ড বলা যায়।”
ভাস্টারশাওজার বিপাক প্রক্রিয়াকে জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হিসেবে বর্ণনা দিলেন। পাঠক লক্ষ্য করুন, আপনার শরীরের প্রতিটি কোষ মূলত আণুবীক্ষণিক রাসায়নিক প্রক্রিয়ার কারখানা, যেখানে নিয়মিত এক রসায়ন থেকে অন্য রসায়নে রূপান্তরিত হচ্ছে।
১৯৮০ থেকে ১৯৯০ সালের মধ্যে ভাস্টারশাওজার তার নিজের তত্ত্বের উপর বিস্তারিত কাজ করেছেন। তিনি রীতিমত খাতা-কলমে দেখিয়ে দিলেন ভূমির উপরিভাগের জন্য কোন খনিজ উপাদান ভালো কাজ করে এবং সেখানে কোন রাসায়নিক চক্র বিক্রিয়া করে। তার উদ্ভাবিত তত্ত্ব সমর্থকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হলো।
কিন্তু তার গবেষণা এখন পর্যন্ত তত্ত্বের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। ভাস্টারশাওজারের দরকার ছিল তার তত্ত্বের বাস্তব সম্মত ব্যাখ্যা আবিষ্কার যা তার তত্ত্বকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে। আশার কথা হলো, প্রায় এক দশক আগেই তার তত্ত্বের স্বপক্ষে কিছু আবিষ্কার ঘটে গেছে।
১৯৭৭ সালে ওরেগন স্টেট ইউনিভার্সিটির জ্যাক করলিসের নেতৃত্বে একদল গবেষক প্রশান্ত মহাসাগরের পূর্বপ্রান্তে ১.৫ মাইল গভীর তলদেশে নিমজ্জিত হন। তারা গালাপোগাসের উষ্ণ উর্বর অঞ্চলে জরিপ পরিচালনা করেন যেখানে মহাসাগরে তলদেশের বুক চিরে বেরিয়ে এসেছে দীর্ঘ পাথুরে পাহাড়ের খাঁড়ি। গবেষকদল জানতো পাহাড়ের খাঁড়িগুলো ছিল জীবন্ত আগ্নেয়গিরি। প্রতিটি জ্বালামুখই এক প্রকারের প্রাচীন গরম ঘন তরল উদগীরণের আঁধার।
জ্যাক করলিস এবং তার গবেষকদল দেখতে পেলেন পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে প্রধানত উঞ্চ ঝর্ণাধারা। সেখানে সমুদ্রের তলায় পাথুরে শিলাখণ্ডের অসংখ্য ছিদ্রপথ দিয়ে খনিজ সমৃদ্ধ গরম তরল প্রবাহিত হচ্ছে। অবাক কাণ্ড হলো এইসব গরম তরল জ্বালামুখের আশেপাশে কিছু অদ্ভুত জলজ প্রাণীদের প্রচুর আনাগোনা। সেখানে বিপুল পরিমাণ ঝিনুক, শামুক, টিউব-ওয়ার্ম, কোরালের ঘনবসতি। এই এলাকার পানিতে ব্যাকটেরিয়ায় সয়লাব। উল্লেখিত সব প্রাণীই গরম তরল জ্বালামুখ থেকে উৎসারিত শক্তি ব্যবহার করে বেঁচে আছে।
এই গরম তরল জ্বালামুখ আবিষ্কারকে করলিসের নামে নামকরণ করা হয়। গরম তরল জ্বালামুখের আবিষ্কার তাকে নতুন চিন্তার দিকে টেনে নিয়ে গেল। ১৯৮১ সালে তিনি তত্ত্ব দিলেন চার বিলিয়ন বছর আগের পৃথিবীতেও একই ধরণের গরম তরল জ্বালামুখের অস্তিত্ব ছিল এবং ঠিক সেখানেই প্রাণের সূচনা ঘটেছিল। করলিস তার পেশা জীবনের বাকিটা সময় তার প্রস্তাবিত মতবাদের উপর কাজ করে অতিবাহিত করেছিলেন।
করলিস দাবী করেন গরম তরলের জ্বালামুখ অনেক রাসায়নিকের জটিল যৌগ সৃষ্টি করতে পারে। তিনি বলে, প্রতিটি জ্বালামুখ প্রাচীনকালের গরম স্যুপের থকথকে বস্তু। জটিল যৌগের প্রধান উপাদান ছিল হয়ত চিনি বা শর্করা যার উপর ভিত্তি করে আমরা প্রতিটি সেকেন্ড বেঁচে আছি।
যখন গরম পানির স্রোত পাথরকে প্লাবিত করত তখন প্রচণ্ড তাপ এবং চাপে সরল জৈবকণা ভেঙে জটিল-যৌগ থেকে ক্রমাগত জটিলতর এমাইনো এসিড, নিউক্লিওটায়েড এবং চিনিতে রূপান্তরিত হয়। সমুদ্রের তটরেখা বরাবর যেখানে পানি এতটা গরম নয় যেখানে শর্করা, প্রোটিন এবং ডিএনএ’র মতো প্রাণ বিকাশের আদি আবর্তন শুরু হলো। এরপর পানিটা যখন আবার সমুদ্রে ফিরে যায় এবং তখনো ঠাণ্ডা হতে যথেষ্ট বাকি তখন মোলকিউল একত্রিত হয়ে সরল এককোষী প্রাণের জন্ম হলো। প্রাণের সূচনা কীভাবে আলোচনায় করলিসের এই প্রস্তাবনা অনেক নিখুঁত এবং সাধারণ মানুষের দৃষ্টি আকর্ষিত হয়। কিন্তু ‘কীভাবে প্রাণের সূচনা’ তত্ত্বের উপর ভিত্তি করে স্ট্যানলি মিলারের গবেষণালব্ধ ফলাফল প্রাণের উৎস কি সেটা মানুষকে বোঝাতে ব্যর্থ হয়েছে। ১৯৮৮ সালে মিলার যুক্তি দেখিয়ে একটা আর্টিকেল লিখলেন গরম তরলের জ্বালামুখও অনেক গরম। মিলারের যুক্তি অনুসারে প্রচণ্ড তাপের সময়ে যদি অ্যামাইনো এসিডের রাসায়নিক গঠন শুরু হয় তখন তো সেই তাপের অ্যামাইনো এসিডও ধ্বংস হয়ে যাওয়ার কথা। প্রচণ্ড তাপে অ্যামাইনো এসিডের প্রধান উপাদান চিনি জাতীয় শর্করা বড়জোর কয়েক সেকেন্ড টিকে থাকতে পারবে। তদুপরি এইসব সরল জৈবকণা নিজেদের মাঝে বন্ধন তৈরি করতে পারে না কারণ গরম তরল জ্বালামুখের চারিপাশের পানি এত গরম যে জৈব-কণার বন্ধন মুহূর্তে ভেঙে দেয়।
ঠিক সেই সময়ে প্রাণের উৎস গবেষণার যুদ্ধে যোগ দিলেন ফ্রান্সের গ্রেনোবল বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক প্রফেসর মাইকেল রাসেল। গরম তরলের জ্বালামুখের ধারণা মোটামুটি এখন পর্যন্ত সবচেয়ে কার্যকর তত্ত্ব। মাইকেল রাসেলের কাছে মনে হলো আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখের পরিবেশই ভাস্টারশাওজারের জৈবকণা উৎপন্ন হওয়ার সূতিকাগার। এই অনুপ্রেরণা থেকেই রাসেল প্রাণের উৎস গবেষণার সর্বজন স্বীকৃত তত্ত্ব দাঁড় করিয়ে ফেললেন। রাসেলের তত্ত্ব যদি সঠিক হয় তাহলে প্রাণের বিকাশ ঘটেছে সমুদ্রের তলদেশে। মাইকেল রাসেল তার জীবনের শুরুর দিকে ব্যথানাশক এসপিরিন তৈরিতে, গুরুত্বপূর্ণ খনিজ উপাদান গবেষণায় সময় কাটিয়েছিলেন। এরমধ্যেই ১৯৬০ সালে ঘটে গেল এক অবিস্মরণীয় ঘটনা। এইসময়ে রাসেল একটা আগ্নেয়গিরির সম্ভাব্য অগ্ন্যুৎপাত মোকাবিলাকারী দলের সমন্বয় করছিলেন, যদিও অগ্ন্যুৎপাত মোকাবিলা করার জন্য তার কোন প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ ছিল না। কিন্তু তার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু ছিল সময়ের ফেরে পৃথিবীর ভূপৃষ্ঠ কীভাবে বদলে যায়। ভূতত্ত্বের এই পরিবর্তনের আঙ্গিকেই তিনি প্রাণের উৎস কীভাবে হলো তার তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা দিলেন। ১৯৮০ সালে তিনি অপেক্ষাকৃত কম তাপমাত্রার আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখের পাশ থেকে জীবাশ্ম পেয়ে গেলে্ন যেখানের তাপমাত্রা ছিল ১৫০ সেলসিয়াসের নিচে। অপেক্ষাকৃত কম তাপমাত্রার কারণেই রাসেল যুক্তি দেখালেন জৈব-কণার টিকে থাকার সম্ভাবনা প্রচুর। যদিও মুলার ধারণা করেছিলেন সেখানে জৈব-কণার বেঁচে থাকার সম্ভাবনা প্রচুর। অপেক্ষাকৃত কম তাপমাত্রার জ্বালামুখের কাছে প্রাপ্ত ফসিলে কিছু অদ্ভুত জিনিসের সন্ধান পাওয়া গেল। ফসিলে লোহার আকরিক পাইরাইট এবং সালফার দিয়ে গঠিত ১ মিলিমিটার দীর্ঘ গোলাকার খনিজের উপস্থিতি ছিল। রাসেল তার ল্যাবরেটরিতে ফসিল পরীক্ষা করে দেখতে পেলেন পাইরাইট নিজেই গোলাকার ঘন খনিজ তরলের বুদবুদ তৈরি করতে পারে। তিনি পরামর্শ দিলেন প্রথম জটিল জৈব-কণার গঠিত হয়েছিল এইসব সাধারণ পাইরাইট আকরিকের মধ্যে।
একই সময়ে ভাস্টারশাওজার প্রাণের উৎস গবেষণায় তার ধারণা প্রকাশ করতে লাগলেন। তার মতবাদ ছিল খনিজের উপর প্রবাহিত রাসায়নিক পদার্থ সমৃদ্ধ গরম স্রোতের উপর প্রতিষ্ঠিত। এমনকি তিনি প্রস্তাব করেন যে প্রাণের সূচনায় পাইরাইটের ভূমিকা ছিল। তার মতবাদ আধুনিক বিজ্ঞানের ভুলে যাওয়া মেধাবীদের কাজের উপর প্রতিষ্ঠিত।
রাসেল এখানে দুইয়ে দুইয়ে চার মিলিয়েছেন। তিনি বলেন সমুদ্রের গভীরে গরম তরল জ্বালামুখের চারপাশের সহনীয় গরম পানিতে নরম জেলিসদৃশ বস্তু পাইরাইটের কাঠামো গঠনের জন্য উপযুক্ত উপাদান হিসেবে কাজ করে। ভাস্টারশাওজারের প্রস্তাবিত জৈবকণা সৃষ্টির জন্য পাইরাইট বুদবুদ পূর্বশর্ত। যদি রাসেলের গবেষণা সঠিক হয় তাহলে জীবনের শুরু হয়েছিল সমুদ্রের গভীর তলে এবং সেখানেই প্রথম জৈব-কণার পরিপাকতন্ত্র সৃষ্টি হয়।
মিলারের ঐতিহাসিক গবেষণামূলক পরীক্ষণের ৪০ বছর পরে রাসেল তার গবেষণার সমস্ত অর্জন ১৯৯৩ টেরা এনভায়রনমেন্টাল রিসার্স ইন্সটিটিউট থেকে প্রকাশ করেন। যদিও রাসেলের গবেষণার ফলাফল নিয়ে গণমাধ্যমে তেমন মাতামাতি হলো না কিন্তু প্রাণের উৎস গবেষণা এবং আলোচনায় খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে রইল। ভাস্টারশাওজারের পরিপাক ক্রিয়ার চক্র এবং করলিসের গরম তরলের জ্বালামুখের দৃশ্যত দুইটা ভিন্ন ধারণাকে রাসেল একসাথে সমন্বয় সাধন করেন, যার ফলে বিষয়টা আরও বোধগম্য হলো। রাসেল গবেষণাকে আরও হৃদয়গ্রাহী করতে তার পরীক্ষণের ব্যাখ্যা দেন। তিনি বলেন, কীভাবে প্রথম জৈবকণা শক্তি সঞ্চার করেছিল। অন্যভাবে বলা যায় তিনি দেখান কীভাবে জৈব-কণার পরিপাকক্রিয়া কাজ করে।
১৯৬০ সালের দিকে জৈবরসায়ন বিজ্ঞানী পিটার ডেনিস মিচেল অসুস্থ হয়ে পড়লে এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। তার পরিবর্তে কর্নওয়ালে দূরের এক নিভৃত অঞ্চলে ব্যক্তিগত গবেষণাগার স্থাপন করেন। তখন বিজ্ঞানী সম্প্রদায়ের সংস্পর্শের বাইরে থাকতেন তিনি। তার গবেষণার খরচের বিরাট অংশ আসে একপাল গরুর দুধ বিক্রির টাকা থেকে। অনেক জৈবরসায়ন বিজ্ঞানী যেমন লেসলি ওরগেল, যার RNA সংক্রান্ত কাজ নিয়ে এই বইয়ের দ্বিতীয় অধ্যায়ে আলোচনা করা হয়েছে তিনি মিশেলের গবেষণার কাজকর্মকে হাস্যকর বলে মন্তব্য করেন। কিন্তু এখন আমরা জানি পিটার মিশেল যে প্রক্রিয়া আবিষ্কার করেন পৃথিবীর সমস্ত জীবন্ত প্রাণীকুল সেটাই ব্যবহার করে। দুই দশকেরও কম সময়ের মধ্যে মিচেল চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করলেন; ১৯৭৮ সালে রসায়নে নোবেল পুরষ্কারে ভূষিত হন। মিশেলের নাম হয়ত দৈনন্দিন গৃহস্থালি জীবনে কখনো দেখা পাওয়া যায় বা কিন্তু তার নাম লেখা আছি জীববিজ্ঞানের প্রতিটি পাঠ্যবইতে।
পিটার মিশেল তার পেশাগত জীবন কাটালেন জৈবকণা কীভাবে খাদ্য থেকে শক্তি সঞ্চয় করে তার কারণ অনুসন্ধানের পিছনে। ফলশ্রুতিতে, তার একটাই জিজ্ঞাসা ছিল কীভাবে আমরা প্রতি মুহূর্তে বেঁচে আছি। তিনি জানতেন প্রতিটি দেহকোষ তাদের শক্তি সঞ্চিত রাখে একই মলিকিউলের মধ্যে। যাকে আমরা এডেনোসাইন ট্রাইফসফেট (এটিপি) বলি। ফসফেটের তিনটি রাসায়নিক অণুর মেলবন্ধনে একত্রিত হয়ে আছে এডেনোসাইন। এদের মধ্যে ফসফেটের তৃতীয় অণুটি বেশী শক্তি গ্রহণ করে এটিপি’র সাথে মিলিত হয়। যখন কোন একটা কোষের শক্তি প্রয়োজন হয় – ধরে নিই, যদি মাংসপেশির কোন কাজ করার প্রয়োজন হয় তখন এটিপি থেকে ফসফেটের তৃতীয় অণু ভেঙে যায়, ফলে বাকি দুইটা অণু মিলে এডেনোসাইন ডাইফসফেট (এডিপি) তৈরি হয় এবং শক্তি উৎপাদিত হয়।
মিশেল জানতে চাইলেন প্রাণী দেহের কোষ কীভাবে প্রথম এটিপি তৈরি করেছিল? কীভাবেই বা কোষের শক্তি এডিপি’তে সঞ্চিত হলো? কীভাবে ফসফেটের তৃতীয় অণুটি কোষে যুক্ত ছিল? মিশেল জানতেন, যে এনজাইম এটিপি গঠন করেছে সেটা কোষের পাতলা আবরণের উপরে অবস্থান করে। তাই তিনি প্রস্তাব করেন কোষ এনজাইমের পাতলা আবরণের উপর থেকেই প্রোটন কণা থেকে শক্তি সঞ্চার করে। সুতরাং আবরণের একপাশে থাকে প্রচুর প্রোটন-কণা এবং অপর প্রান্তে হয়ত কিছুই থাকে না। কোষের উভয়দিকে প্রোটন-কণার সমতা আনার জন্য প্রোটন-কণার প্রবাহ তখন আবরণের একপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে আসার চেষ্টা করে। কিন্তু প্রোটনকণাগুলোকে এনজাইম ভেদ করে যেতে হয়। এনজাইমকে অতিক্রম করে যাওয়ার সময় প্রোটন-কণার প্রবাহ এনজাইমকে এটিপি গঠনের প্রয়োজনীয় শক্তি দিয়ে যায়।
মিশেল কোষের শক্তি সঞ্চয়ের ধারণাকে প্রকাশ করেন ১৯৬১ সালে। পর্যাপ্ত প্রমাণাদি নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত এরপরের ১৫ বছর তিনি ব্যয় করেন কোষ কীভাবে কাজ করে ব্যাখ্যা দাঁড় করাতে। এখন আমরা সকলেই জানি প্রতিটি জীব কোষ কীভাবে বেঁচে আছে যেটা মিশেল সর্বপ্রথম আবিষ্কার করেন। ঠিক এই মুহূর্তে আপনার শরীরের প্রতিটি কোষে কোষে একই প্রক্রিয়া চলছে আমৃত্যু। ঠিক যেমন আমরা সবাই জানি ডিএনএ জীবনের মূল উপাদান। যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টা মাইকেল রাসেল উত্থাপন করেন সেটা হলো পিটার মিশেলের প্রোটন-কণা। আমরা আগেই পড়েছি কোষের গায়ে ঝিল্লির মত পাতলা আবরণের একপ্রান্তে প্রচুর প্রোটন থাকে অপর-প্রান্তে প্রোটন সংখ্যায় প্রায় নগণ্য। শক্তি সঞ্চয় করে রাখার জন্য প্রতিটি কোষেরই প্রোটন গ্র্যাডিয়েন্ট (কোন বস্তুর স্তর বা ধাপ) দরকার আছে।
আধুনিক কোষগুলো পাতলা ঝিল্লির মত আবরণের ভিতর দিয়ে প্রোটনের প্রবাহ থেকে গ্র্যাডিয়েন্ট গঠন করে। কিন্তু এর জন্য জটিল প্রাণ-রাসায়নিক প্রক্রিয়া দরকার যা তখন পর্যন্ত অবিকশিত প্রাণে উঁকি দেয়নি। এই পর্যায়ে মাইকেল রাসেল প্রাণ বিকাশের ক্ষেত্রে একটা গুরুত্বপূর্ণ যুক্তির ধাপ অতিক্রম করলেন। তিনি বললেন, প্রাণের সৃষ্টি হয়েছে অবশ্যই প্রাকৃতিক কোন স্থানের প্রোটনের স্তর বিন্যাস থেকে। প্রাকৃতিক সেই স্থানটা হলো গরম তরল প্রবাহের জ্বালামুখের এলাকা। কিন্তু সেই জ্বালামুখ ছিল বিশেষ একধরণের যখন পৃথিবী সবে সদ্যজাত শিশু এবং তার সমুদ্রগুলোর পানি ছিল তীব্র ক্ষারযুক্ত। আমরা জানি, ক্ষার পানিতে প্রচুর প্রোটন-কণা ভাসতে থাকে। প্রোটনের স্তর সৃষ্টির জন্য জ্বালামুখ থেকে প্রবাহিত পানিতে অবশ্যই পরিমাণে অল্প হলেও প্রোটনের উপস্থিতি থাকতে হবে, যাকে আমরা বলব এলকালাইন। জ্যাক করলিসের আবিষ্কৃত গরম তরল প্রবাহের জ্বালামুখ আশানুরূপ কার্যকর ছিল না। তার আবিষ্কৃত জ্বালামুখের এলাকা ছিল খুব উত্তপ্ত আর অত্যধিক ক্ষারযুক্ত। কিন্তু ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটির ওশেনোগ্রাফির অধ্যাপক দেবরাহ কেলি ২০০০ সালে প্রথম এলকালাইন সমৃদ্ধ জ্বালামুখের সন্ধান পান।
কেলিকে বিজ্ঞানী হওয়ার জন্য প্রথমদিকে প্রচণ্ড সংগ্রাম করতে হয়েছে। হাইস্কুলে লেখাপড়া চলাকালীন সময়ে তার বাবা মারা যান ফলে তার কলেজের লেখাপড়ার ব্যয় নির্বাহ করার জন্য তাকে দীর্ঘ সময় কাজ করতে হতো। কিন্তু তার পরিশ্রম সফল হয়েছিল এবং তিনি সমুদ্রের তলদেশের আগ্নেয়গিরি আর উত্তপ্ত তরল প্রবাহের জ্বালামুখের গবেষণায় আকৃষ্ট হন। এই দুইটা আগ্রহের প্রতি ভালবাসা তাকে নিয়ে গেল আটলান্টিক মহাসাগরের অতল গভীরে যেখানে ভূ-পৃষ্ঠ বিচ্ছিন্ন হয়ে সরে যাচ্ছে পরস্পর থেকে দূরে এবং সমুদ্রের তল থেকে জেগে উঠছে পর্বতের খাঁড়ি।
পাহাড়ের খাঁজগুলোতে দেবরাহ কেলি পেয়ে গেলেন উত্তপ্ত পানি প্রবাহের জ্বালামুখের ক্ষেত্র যাকে তিনি “লুপ্ত নগরী” হিসেবে অভিহিত করলেন। এই জ্বালামুখগুলো করলিসের আবিষ্কৃত জ্বালামুখের মত নয়। এখানের জ্বালামুখ দিয়ে প্রবাহিত পানির উষ্ণতা মাত্র ৪০ থেকে ৭৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে এবং পানিতে এলকালাইনের উপস্থিতিও খুব সহনীয় মাত্রায়। সেখানের পানিতে কার্বন মিশ্রিত স্তূপ ক্রমশ খাড়া হয়ে উপরের দিকে প্রবাহিত যেগুলো দেখতে অনেকটা চিমনির সাদা ধোঁয়ার মত। সমুদ্রের তলদেশের পর্বতের খাঁড়ি থেকে উত্থিত সাদা ধোঁয়াকে মনে হচ্ছিল যেন গোলাকার জীবন্ত কোন পাইপ সদৃশ বস্তু। সেই পাইপের চেহারা অদ্ভুত এবং খানিকটা আশ্চর্য যেন মনে হয় ভূতের মত। যদিও এটা ছিল বিভ্রান্তিকর কারণ, এখানেই আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখের এই ঘন তরলেই জন্ম নিচ্ছে অসংখ্য ক্ষুদ্র অণুজীব।
এলকালাইন সমৃদ্ধ আগ্নেয়গিরির এইসব জ্বালামুখই ছিল মাইকেল রাসেলের তত্ত্ব প্রমাণের জন্য উপযুক্ত স্থান। তিনি বুঝতে পারলেন আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখের উত্তপ্ত তরল প্রবাহের এলাকায় “লুপ্ত নগরীতে” জীবনের উৎপত্তি হয়েছিল। কিন্তু সমস্যার এখানেই সমাপ্তি নয়। যেহেতু রাসেল ছিলেন মূলত ভূতাত্ত্বিক সেই কারণেই তার তত্ত্বকে বোধগম্য এবং প্রমাণ করার জন্য কোষ কীভাবে কাজ করে সেটা হাতে দেখানোর মত জীববিজ্ঞানের পর্যাপ্ত জ্ঞান তার ছিল না। সুতরাং রাসেল তার গবেষণা দলে ডাকলেন আমেরিকান জীববিজ্ঞানী উইলিয়াম মার্টিনকে। ইউলিয়াম মার্টিন একজন অতি উৎসাহী গবেষক যিনি তার পেশাজীবনের বেশীরভাগ সময় কাটিয়েছেন জার্মানিতে উদ্ভিদবিজ্ঞান এবং অণুজীববিজ্ঞানের পঠন পাঠনে। বর্তমানে তিনি জার্মানির ডুসেলফর্ফে হাইনরিখ হাইনে ইউনিভার্সিটির মলিকিউলার ইভোল্যুশন ইন্সটিটিউটের প্রধান হিসেবে কর্মরত আছেন। ২০০৩ সালে রাসেল এবং মার্টিন মিলিতভাবে রাসেলের পূর্বের তত্ত্বকে আরও আধুনিকভাবে উপস্থাপনের চেষ্টা করলেন। এখন পর্যন্ত প্রাণের উৎস সন্ধানে যত গবেষণা হয়েছে এবার যেন সেই গবেষণার কঙ্কালে রক্তমাংসের ছোঁয়া লাগল এবং বিজ্ঞানী সমাজে প্রাণের উৎস গবেষণার এযাবৎ কালের অন্যতম গ্রহণযোগ্য তত্ত্ব হিসেবে মর্যাদা পেয়ে গেল।
দেবরাহ কেলিকে ধন্যবাদ, রাসেল এবং মার্টিনের গবেষকদল এখন দেবরাহ কেলির কল্যাণে জানতে পেরেছেন এলকালাইন সমৃদ্ধ পাথরের জ্বালামুখ ছিলো অসংখ্য ছিদ্র বিশিষ্ট চুনাপাথরের স্তর যেখানে দিয়ে বাতাস এবং পানি প্রবাহিত হতে পারত। পাথরের গায়ে ছোট ছোট ছিদ্রে পানি দ্বারা পূর্ণ ছিল। পানি-পূর্ণ এইসব ছোট ছোট ছিদ্র প্রাথমিক কোষের কাজ করত বলে ধারণা করা হচ্ছে। প্রতিটি ছিদ্রে প্রয়োজনীয় রাসায়নিক এবং পাইরাইট খনিজ উপাদান দ্বারা পূর্ণ ছিল। এরসাথে জ্বালামুখের গায়ের যুক্ত ছিল প্রোটন গ্র্যাডিয়েন্ট। এরকম পরিবেশই হলো কোষের বিপাক ক্রিয়া শুরু হওয়ার উপযুক্ত স্থান।
রাসেল এবং মার্টিন বললেন, আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখের পানিতে রাসায়নিক শক্তির বিক্রিয়াতে জীবন যখন সবে যাত্রা শুরু করেছে তখনই আরএনএ অণুজীবের জন্ম প্রক্রিয়া শুরু হয়। এমনকি তখনই তারা ঝিল্লির মত পাতলা আবরণ সৃষ্টি করেছে যাকে আমরা বলতে পারি একটা সত্যিকারের কোষ বা প্রাণের বিকাশ। কোষের জন্ম সম্পন্ন হওয়ার সাথে সাথে কোষ পাথরের ছিদ্র ছেড়ে পানিতে যাত্রা শুরু করে।
রাসেলের গবেষণার কিছু আলোচ্য বিষয় ঘষেমেজে নতুন করে মার্টিন ২০১৬ সালে “প্রথম সর্বজনীন পূর্বপুরুষ” আর্টিকেল প্রকাশ করলে চারিদিকে হইচই পড়ে যায় এবং বিশাল সমর্থন অর্জন করেন। বিলিয়ন বিলিয়ন বছরে আগের সেই অণুজীব থেকেই বর্তমান পৃথিবীর বিদ্যমান সব প্রাণীর জন্ম হয়েছে। আরএনএ তত্ত্ব সমর্থকগোষ্ঠী বললেন, আগ্নেয়গিরিরির জ্বালা মুখ তত্ত্বের দুইটা সীমাবদ্ধতা রয়েছে। একটার হয়ত সম্ভাব্য সমাধান বের করা সম্ভব কিন্তু অন্যটি খুব গুরুতর। কারণ, প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপনের জন্য সম্ভবত আমরা কোনদিনই “প্রথম সর্বজনীন পূর্বপুরুষ” অণুজীবের ফসিল উপস্থাপন করতে পারব না। কিন্তু যদিও আমরা আমাদের ইতিপূর্বের পঠন পাঠন দিয়ে বর্তমানে জীবিত অণুজীব দেখে অনুমান করতে পারি কেমন দেখতে ছিল সেই প্রাচীন অণুজীব আর কেমন ছিল তাদের আচরণ।
আরএনএ তত্ত্ব সমর্থকগোষ্ঠীদের প্রশ্নের জবাবে ইউলিয়াম মার্টিন ১৯৩০টি আধুনিক অণুজীবের ডিএনএ পরীক্ষা করে দেখেন এবং ৩৫৫টি জীন শনাক্ত করে দেখান তাদের সবার একই বৈশিষ্ট্য। আরএনএ তত্ত্ব সমর্থকগোষ্ঠীদের বিতর্কের বিপরীতে প্রমাণস্বরূপ মার্টিন বলেন, ৩৫৫টি জীন বংশ পরম্পরায় একই বৈশিষ্ট্য ধরে রেখেছে এবং ১৯৩০টি অণুজীবের পূর্বপুরুষ “প্রথম সর্বজনীন পূর্বপুরুষ” অণুজীব থেকে উৎসারিত। মাইকেল রাসেল এবং ইউলিয়াম মার্টিনের তত্ত্বানুসারে ৩৫৫টি জীন কিছু প্রোটন গ্র্যাডিয়েন্টের সমৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করে কিন্তু জীন এককভাবে কিছু করে না। তদুপরি, “প্রথম সর্বজনীন পূর্বপুরুষ” অণুজীব মিথেনের মত রাসায়নিক উপাদান এখনো বিদ্যমান। এর থেকে প্রমাণিত হয়, অণুজীব জন্ম নিয়েছিল জীবন্ত আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখের পরিবেশে।
রাসেল এবং মার্টিনের প্রস্তাবিত তত্ত্বের প্রথম সমস্যা হলো তাদের তত্ত্ব শুধু ব্যাখ্যা, সেখানে গবেষণার কোন পরীক্ষালব্ধ প্রমাণ নেই। তাদের আছে শুধু ধাপে ধাপে প্রাণ সৃষ্টির সম্ভাব্য বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ। কিন্তু কোন বিশ্লেষণই ল্যাবরেটরিতে দেখানো সম্ভব নয়। প্রাণের উৎস সন্ধানী বিজ্ঞানী আরমেন মালকিদজানিয়ান বললেন, যেসব বিজ্ঞানীগণ মনে করেছিলেন কোষ নিজেই নিজের প্রতিলিপি তৈরি করতে পারে তারা প্রতিনিয়ত ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষানিরীক্ষার ফলাফল তথ্য আকারে প্রকাশ করে যাচ্ছিলেন। যারা প্রাণের উৎস গবেষণায় বিপাক ক্রিয়া প্রথম শুরু হয়ে হয়েছিল মনে করেন তারা আবার মনে করলেন, অণুজীবের এইসব রসায়ন পানির মধ্যে জন্ম নিতে পারে এটা অসামঞ্জস্যপূর্ণ। রাসেল এবং মার্টিনের গবেষণার এই পর্যায়ে এগিয়ে এলেন মার্টিনের সহকর্মী ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের প্রফেসর নিক লেন। তিনি গবেষণাগারে “ওরিজিন অফ লাইফ রিএক্টর” বানালেন এবং দেখালেন আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখের এলকালাইনের পরিবেশ কেমন ছিল। তিনি দেখালেন অণুজীবের বিপাক ক্রিয়ার চক্র যেটা অণুজীবের আরএনএ’র মত কাজ করে।
দ্বিতীয় সমস্যা হলো আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখের অবস্থান ছিল গভীর সমুদ্রের তলদেশে। ১৯৮৮ সালে মিলার যেমন দেখিয়েছিলেন, অণুজীবের দীর্ঘ শৃঙ্খলে আরএনএ এবং প্রোটিন এনজাইমের সাহায্য ছাড়া গঠিত হতে পারে না। প্রাণের উৎস গবেষণার অনেক বিজ্ঞানীদের কাছেই এই যুক্তি অনেক যুক্তিযুক্ত মনে হলো এবং সেখানে রাসেল এবং মার্টিনের তত্ত্ব প্রায় ধরাশায়ী। আরমেন মালকিদজানিয়ান বললেন, “যদি আপনি রসায়ন বিষয়টা একটু পড়ে থাকেন, তাহলে আপনি গভীর সমুদ্রের তলদেশের আগ্নেয়গিরির গরম ঘন তরল প্রবাহের জ্বালামুখের তত্ত্ব মেনে নিতে পারবেন না করান আপনি জানেন রসায়নে এমন ধারণা অসামঞ্জস্যপূর্ণ।” এত সমালোচনা সত্ত্বেও রাসেল এবং মার্টিনের গবেষকদল তাদের তত্ত্বে অটল থাকলেন। কিন্তু শেষ দশকে ক্রমাগত কয়েকটি অনন্য গবেষণার ফলাফল তৃতীয় আর একটা তত্ত্ব সামনে নিয়ে এলো। তৃতীয় তত্ত্বটি বলছে, আরএনএ বা গরম তরল জ্বালামুখের থেকে প্রানের সৃষ্টি হয়নি প্রাণ সৃষ্টি হয়েছে শূন্য থেকে সৃষ্ট কোন থেকে।