ধর্মনারীবাদস্টিকিহিন্দুধর্মহিন্দুধর্মে নারী

সতীর খোঁজে-হিন্দু শাস্ত্রে সতীদাহ-১ম পর্ব

সতী দিয়েছে তার জীবন সপে! মরণও দিয়েছে সপে!
সতীর বেদিতে,স্বর্গলোকেই সতীর ঠাই হয়।
পৃথিবী সতীর নয়,সতী মানুষ নয়।

প্রাচীনকালে সতীদাহ ‘সতীদাহ’ নামে পরিচিত ছিল না। একে ‘সহমরণ’, ‘সহগমন’, ‘অনুগমন’,’অনুমরণ’ ইত্যাদি বলা হত। স্বামীর মৃত্যুর পর স্বামীর মৃতদেহের সাথে বিধবা পুড়ে মরলে তাকে সহমরণ বলা হত। স্বামী দূরদেশে মারা গেলে অথবা অন্য কোনো কারণে স্বামীর সাথে স্ত্রীকে একসাথে পোড়ানো না গেলে, স্বামীর পাগড়ী বা পাদুকার সাথে স্ত্রীকে পোড়ানো হলে তাকে অনুমরণ বলা হত। সহমৃতা নারীকে সতী বলা হত, কিন্তু এই প্রথাটির নাম প্রাচীনকালে সতী ছিল না। ইউরোপিয়ানরাই সহমরণ প্রথার ‘সতী’ নামকরণ করেন। এই সহমরণের প্রথাটি অনেক প্রাচীন। অনেক হিন্দু শাস্ত্রে সহমরণের দৃষ্টান্ত ও বিধান রয়েছে।

সূচিপত্র

হিন্দুশাস্ত্রে সতীদাহ

ঋগ্বেদে সতীদাহ

ঋগ্বেদে সহমরণের প্রসঙ্গ থাকলেও তার অনুমোদন নেই। ঋগ্বেদ ১০/১৮/৭ এ বলা হচ্ছে,

ইমা নারীরবিধবাঃ সুপত্নীরাঞ্জনেন সর্পিষা সং বিশন্তু।

অনশ্রবোহনমীবাঃ সুরত্না আ রোহন্তু জনয়ো যোনিমগ্রে।। (ঋগ্বেদ ১০/১৮/৭)

অর্থাৎ, এ সকল নারী বৈধব্য দুঃখ অনুভব না করে, মনোমত পতিলাভ করে অঞ্জন ও ঘৃতের সাথে গৃহে প্রবেশ করুন।এ সকল বধূ অশ্রুপাত না করে, রোগে কাতর না হয়ে উত্তম উত্তম রত্নধারণ করে সর্বাগ্রে গৃহে আসুন। (অনুবাদক-রমেশচন্দ্র দত্ত)

একসময় ঋগ্বেদ ১০/১৮/৭ এ ‘অগ্রে’ শব্দের পরিবর্তে ‘অগ্নেঃ’ শব্দ পাঠ করা হত। রামমোহন রায় সহমরণের পক্ষপাতীদের যুক্তি খণ্ডন করার জন্য প্রবর্তক ও নিবর্তকের সম্বাদ নামক গ্রন্থ রচনা করেন। তাতে প্রবর্তকের সম্বাদে প্রবর্তক বলেন, ” …সহমরণ বিষয়ে যে এই ঋগ্বেদের শ্রুতি আছে তাঁহাকে তুমি কিরূপে অপ্রমাণ করিতে পার। যথা। ইমা নারীরবিধবাঃ সুপত্নীরাঞ্জনেন সর্পিষা শম্বিশন্তুনশ্রবা অনমীরাসুরত্না আরোহন্তু যাময়ো যোনিমগ্নেঃ।। ” নিবর্তকের সম্বাদে রামমোহন বলেন, ” এই শ্রুতি এবং ওই পূর্বোক্ত হারীত প্রভৃতির স্মৃতি যাহা তুমি প্রমাণ দিতেছ সে সকল সহমরণের ও অনুমরণের প্রশংসা এবং স্বর্গ ফল প্রদর্শনের দ্বারা কাম্য বোধক হয়। ইহাকে কাম্য না কহিলে তোমারো উপায়নন্তর নাই এবং সহমরণের সংকল্প বাক্যে স্বর্গাদি কামনার প্রয়োগ স্পষ্ট করাইতেছে…” প্রবর্তকের যুক্তি খণ্ডনের সময় রামমোহন কাম্য কর্মের নিন্দা করেন কিন্তু ঋগ্বেদে ১০/১৮/৭ এ ‘অগ্রে’ শব্দের পরিবর্তে ‘অগ্নেঃ’ শব্দের ব্যবহারকে ভুল বলেন নি। অর্থাৎ, সেই সময়েও ‘অগ্নেঃ’ র ব্যবহার প্রচলিত ছিল।

‘অগ্রে’ শব্দের জায়গায় ‘অগ্নেঃ’ শব্দ ব্যবহার করলে ঋকটির অর্থ সম্পূর্ণ বদলে যায়। এর অর্থ হয়-

“এইসকল নারী বৈধব্য ক্লেশ ভোগাপেক্ষা ঘৃত ও অঞ্জন অনুলিপ্ত পতিকে প্রাপ্ত হইয়া উত্তম রত্ন ধারণ পূর্বক অগ্নির মধ্যে আশ্রয় গ্রহণ করুক।” (৩৭)

রমেশচন্দ্র দত্ত বলছেন,

“There is not a word in the above relating to the burning of widows. But a word in it Agre was altered into Agne, and the text was then mistranslated in bengal to justify the modern custom of the burning of the widows.” (৩৭)

অর্থাৎ, উপরে বিধবা পোড়ানো সম্বন্ধে একটি শব্দও নেই। কিন্তু অগ্রে শব্দকে অগ্নেঃ তে পরিবর্তন করে, ঋকটির ভুল অনুবাদ করা হয়েছিল, বঙ্গে বিধবা পোড়ানোর আধুনিক রীতিকে ন্যায্যতা প্রদান করার জন্য।

ঋগ্বেদ ১০/১৮/৮ এ বলা হচ্ছে,

উদীর্ষ্ব নার্ষভি জীবলোকং গতাসুমেতমুপ শেষ এহি।

হস্তগ্রাভস্য দিধিষোস্তবেদং পত্যুর্জনিত্বমভি সং বভূথ।। (ঋগ্বেদ ১০/১৮/৮)

অর্থাৎ, হে নারী সংসারের দিকে ফিরে চল, গাত্রোত্থান কর, তুমি যার নিকট শয়ন করতে যাচ্ছ সে গতাসু অর্থাৎ মৃত হয়েছে। চলে এস। যিনি তোমার পাণিগ্রহণ করে গর্ভাধান করেছিলেন, সে পতির পত্নী হয়ে যা কিছু কর্তব্য ছিল, সকলি তোমার করা হয়েছে।

(অনুবাদক-রমেশচন্দ্র দত্ত, হরফ প্রকাশনী)

নিচে ঋগ্বেদ ১৮/৮/৮ এর একটি ইংরেজি অনুবাদ দেওয়া হল-

Rise, come unto the world of life, O woman: come, he is lifeless by whose side thou liest.
Wifehood with this thy husband was thy portion, who took thy hand and wooed thee as a lover.

(Ralph T.H. Griffith’s Translation)

ঋগ্বেদ ১০/১৮/৭ এ সতীদাহের প্রসঙ্গ না থাকলেও ,ঋগ্বেদ ১০/১৮/৮ এ নারীকে বলতে দেখা যাচ্ছে, “তুমি যার নিকট শয়ন করতে যাচ্ছ সে গতাসু অর্থাৎ মৃত হয়েছে।” এখানে নারীর সহমরণের প্রবৃত্তি লক্ষ্য করা যায়। তবে ঋগ্বেদে তাকে মৃত স্বামীর পাশ থেকে উঠে আসতে বলা হচ্ছে।

অথর্ব বেদে সতীদাহ

অথর্ববেদ ১৮/৩/১ এ বলা হচ্ছে,

ইয়ং নারী পতিলোকং বৃণানা নি পদ্যত উপ ত্বা মর্ত্য প্রেতম্। ধর্মং পুরাণমনুপালয়ন্তী তস্যৈ প্রজাং দ্রবিণোং চেহ ধেহি।। (অথর্ব বেদ ১৮/৩/১)

অর্থাৎ, এ পুরোবর্তিনী স্ত্রী সহধর্মচারিণী বলে পতির অনুষ্ঠিত যাগাদি কর্মের ফলস্বরূপ স্বর্গাদি লোক বরণ করতে চায়। হে মরণশীল মানুষ, এ স্ত্রী ভূলোক থেকে নির্গত তোমার কাছে অনুমরণের জন্য পুরাতন (স্মৃতি পুরাণাদি প্রসিদ্ধ) ধর্ম অনুপালনের জন্য যাচ্ছে। সে অনুমরণে গমনশীল স্ত্রীর জন্য জন্মান্তরেও এ ভূলোক পুত্রপৌত্রাদি ও ধন দাও।

(অথর্ব বেদ সংহিতা- অনুবাদক- শ্রীবিজনবিহারী গোস্বামী, হরফ প্রকাশনী)

অথর্ববেদ ১৮/৩/১ এর ইংরেজি অনুবাদ-

Choosing her husband’s world, O man, this woman lays herself
down beside thy lifeless body.
Preserving faithfully the ancient custom. Bestow upon here both
wealth and offspring.

(griffith’s translation)

অথর্ববেদ ১৮/৩/২ এ বলা হচ্ছে,

উদীষর্ব নার্যভি জীবলোকং গত্যসুমেতমুপ শেষ এহি। হস্তগ্রাভস্য দধিষোস্তবেদং পত্যুর্জনিত্বমভি সং বভূথ।।

অর্থাৎ, হে ধর্ম পত্নী, এ জীবলোকের উদ্দেশে পতির কাছ থেকে উঠে এস। যে মৃত পতির কাছে শয়ন করেছ, সেখানে দৃষ্ট প্রয়োজনের অভাবে তার কাছ থেকে চলে এস। তোমার পাণিগ্রহণকর্তা পতি অপত্যাদিরূপে জন্মলাভ করেছে।

( অথর্ব বেদ সংহিতা- অনুবাদ শ্রীবিজনবিহারী গোস্বামী, হরফ প্রকাশনী)

১৮/৩/২ এর ইংরেজি অনুবাদ-

Rise, come unto the world of life, O woman: come, he is lifeless
by whose side thou liest.
Wifehood with this thy husband was thy portion who took thy
hand and wooed thee as a lover.

(griffith’s translation)

ঋগ্বেদের মতোই অথর্ব বেদে কোনো স্ত্রীকে মৃত স্বামীর সাথে সহমৃতা হওয়ার চেষ্টা করতে দেখা যায়। কিন্তু তাকে এ কাজ করতে বারণও করা হচ্ছে। তবে এও বলা হচ্ছে নারীটি ‘পুরাতন ধর্ম’ পালনের জন্য যাচ্ছে। তাহলে দেখা যায় সহমরণের প্রথাটি অনেক পুরোনো, বেদের থেকেও পুরোনো।

আজকাল হিন্দুরা সতীদাহ বা সহমরণকে কেবলই মুসলমানদের হাত থেকে সম্মান বাঁচানোর জন্য হিন্দু নারীদের পবিত্র আত্মাহুতি বলে দেখাতে চায়। কিন্তু বেদের প্রমাণ হতে দেখা যায়, এ প্রথা বেদের চেয়েও প্রাচীন।

হিন্দুরা বলে, হিন্দুশাস্ত্রে কোথাও সতীদাহ বা সহমরণের নিয়ম নেই। সুতরাং দেখা যাক, তাদের এই দাবী কতটা সত্য!

রামায়ণে সতীদাহ

স্বামী দশরথের মৃত্যুর পর কৌশল্যার সহমৃতা হওয়ার ইচ্ছা দেখা যায় রামায়ণে,যদিও কৌশল্যা সহমৃতা হন না । দশরথের মৃত্যুর পর কৌশল্যাকে বলতে শোনা যায়,

“साहमद्यैव दिष्टान्तम् गमिष्यामि पतिव्रता |
इदम् शरीरमालिङ्ग्य प्रवेक्ष्यामि हुताशनम् || २-६६-१२

অর্থাৎ, আজ আমিও পতিব্রতা হয়ে আমার বিধি নির্দিষ্ট অন্তের সাথে সাক্ষাৎ করবো। স্বামীর এই দেহকে আলিঙ্গন করে, আমি অগ্নিতে প্রবেশ করবো। (৩) (Source )

রামায়ণের যুদ্ধ কাণ্ডে রাবণ যখন সীতাকে রামের মায়ামুণ্ডু দেখিয়েছিল, সীতা তখন রামের সাথে সহমৃতা হবার বাসনা করেছিলেন(৩৯) –

शिरसा मे शिरसः च अस्य कायम् कायेन योजय |
रावण अनुगमिष्यामि गतिम् भर्तुर् महात्मनः || ६-३२-३२

অর্থাৎ, হে রাবণ! আমার মস্তক তাঁর (রামের) মস্তকের সাথে স্পর্শ করিয়ে দাও, আমার শরীর তাঁর শরীরের সাথে স্পর্শ করিয়ে দাও। আমি আমার মহৎ প্রভুর অনুগমন করবো।(source)

বাল্মীকি রামায়ণের উত্তরকাণ্ডে বেদবতী রাবণকে বলেন তার পিতা মারা গেলে, তার মাতা সহমৃতা হয়েছিলেন-

“পরে বলদৃপ্ত দৈত্যরাজ শুম্ভ আমার পিতার এই সুদৃঢ় সংকল্পে যারপরনাই কুপিত হয় এবং একদা রজনীযোগে নিদ্রিতাবস্থায় তাঁহাকে আসিয়া বিনাশ করে। পরে আমার জননী একান্ত শোকাকুল হইয়া পিতার মৃতদেহ আলিঙ্গন পূর্বক জ্বলন্ত চিতায় আরোহণ করেন।”

(হেমচন্দ্র ভট্টাচার্য অনূদিত বাল্মীকি রামায়ণের উত্তরকাণ্ডের ১৭ তম সর্গ)

মহাভারতে সতীদাহ

মহাভারতে পান্ডুর মৃত্যুর পর তার পত্নী মাদ্রী সহমৃতা হন।পান্ডুর মৃত্যুর পরে কুন্তি মাদ্রীকে বলেন,

“ ভদ্রে যাহা হইবার হইয়াছে। এক্ষণে তোমার নিকট এক প্রার্থনা করি, শ্রবণ কর। আমি রাজর্ষির জ্যেষ্ঠা ধর্মপত্নী; সুতরাং শ্রেষ্ঠ ধর্মফল আমারই প্রাপ্য; অতএব আমি পরলোকগত ভর্তার সহগমণ করিব, তুমি এ বিষয়ে আমাকে নিবারণ করিও না, তুমি গাত্রোত্থান কর। অতি সাবধানে এই সকল সন্তানগুলি প্রতিপালন করিও। আমি মহারাজের মৃতদেহ লইয়া চিতারোহন করি।“

মাদ্রী বলেন,

“ আমি স্বামী সহবাসে অদ্যাপি পরিতৃপ্ত হই নাই, অতএব আমিই ইহার সহগমন করিব। অনুগ্রহ করিয়া আমাকে এই বিষয়ে অনুমতি করিতে হইবে। আরও দেখ, মহারাজ আমাতে আসক্ত হইয়া প্রাণত্যাগ করিয়াছেন, তন্নিমিত্ত যমভবনে গমন করিয়া তাহার অভিলাষ পরিপূর্ণ করা আমার প্রধান ধর্ম ও অত্যন্ত অবশ্য কর্তব্য কর্ম। বিশেষত আমি যদি জীবিত থাকিয়া আপনার পুত্রদ্বয়ের ন্যায় তোমার পুত্রগণকে স্নেহ করিতে না পারি, তাহা হইলে অবশ্যই আমাকে ইহকালে লোকনিন্দায় ও পরকালে ঘোরতর নরকে নিপতিত হইতে হইবে। অতএব সহগমন করাই আমার পক্ষে শ্রেয়কল্প। এক্ষণে তোমার নিকট আমার এই ভিক্ষা যে, মহারাজের মৃত দেহের সহিত আমার কলেবর দগ্ধ কর।আমার পুত্রদ্বয়কে আপনার পুত্রগণের ন্যায় স্নেহ ও অপ্রমত্তচিত্তে প্রতিপালন করিও; ইহা ব্যতিত আমার আর কিছুই বক্তব্য নাই।“

এর পর মহাভারতে বলা হচ্ছে, “মদ্ররাজদুহিতা কুন্তিকে এই কথা বলিয়া রাজার মৃতদেহ আলিঙ্গন পূর্বক কলেবর পরিত্যাগ করিলেন।“

(কালিপ্রসন্নের মহাভারত/আদিপর্ব/১২৫ তম অধ্যায়)

আদিপর্বের ১২৬ তম অধ্যায়ে বলা হচ্ছে,

“পতিব্রতা মাদ্রীও পতির লোকান্তরপ্রাপ্তি দর্শনে সাতিশয় দুঃখিত হইয়া তাহার মৃতদেহ আলিঙ্গন পূর্বক কলেবর পরিত্যাগ করিয়া পতিলোক প্রাপ্ত হইয়াছেন।“ (কালিপ্রসন্নের মহাভারত)

কুন্তির একটি কথা বিশেষভাবে লক্ষণীয়- পাণ্ডুর মৃত্যুর পর তার সাথে সহমরণে যাওয়াকে ‘শ্রেষ্ঠ ধর্ম ফল’ হিসাবে বর্ণনা করছেন তিনি। সুতরাং জওহরকে যেমন রাজপুতেরা আজকের যুগেও গৌরবান্বিত করে চলেছে, তেমনি সেযুগেও সতীর চিতায় প্রাণত্যাগ করাকে শ্রেষ্ঠ ধর্মফল হিসাবে দেখানো হত।

“ একদা পাণ্ডু স্বীয় মহিষী মাদ্রীর রূপ লাবণ্যে মোহিত এবং শাপবাক্য বিস্মৃত হইয়া মদনানল নির্বাণ করিবার নিমিত্ত যেমন তাহাকে স্পর্শ করিলেন, তেমনি পঞ্চত্বপ্রাপ্ত হইলেন। তদ্দর্শনে মাদ্রী অত্যন্ত শোকার্ত ও দুঃখিত হইয়া স্বামীর সহগমনে সঙ্কল্প করিলেন। তিনি চিতাগ্নিতে আরোহন করিবার সময় নকুল ও সহদেবকে কুন্তীর হস্তে সমর্পণ করিয়া কহিলেন , ‘ইহাদিগের প্রতি অযত্ন না করিয়া যত্নপূর্বক প্রতিপালন করিবেন; আমি এ জন্মের মত বিদায় হইলাম।“ (কালিপ্রসন্ন সিংহ কর্তৃক অনূদিত মহাভারত/ আদিপর্ব/ ৯৫ অধ্যায়)

মহাভারতের মৌষলপর্বের সপ্তম অধ্যায়ে কৃষ্ণের পিতা বসুদেবের মৃত্যুর পর তার স্ত্রীরা তার সাথে সহমৃতা হন

“পরদিন প্রাতঃকালে প্রবল প্রতাপ মহাত্মা বসুদেব যোগাবলম্বন পূর্বক কলেবর পরিত্যাগ করিয়া উৎকৃষ্ট গতি লাভ করিলেন।তখন তাহার অন্তঃপুর মধ্যে ঘোরতর ক্রন্দন শব্দ সমুত্থিত হইয়া সমুদায় পুরী প্রতিধ্বনিত করিতে লাগিল। কামিনীগণ মাল্য ও আভরণ পরিত্যাগ পূর্বক আলোলয়িতকেশে বক্ষঃস্থলে করাঘাত করিয়া রোদন করিতে লাগিলেন।তখন মহাত্মা অর্জুন সেই মৃতদেহ বহুমুল্য নরযানে আরোপিত করিয়া অন্তঃপুর হইতে বহির্গত হইলেন। দ্বারকাবাসীগণ দুঃখশোকে একান্ত অভিভূত হইয়া তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ গমন করিতে লাগিল। ভৃত্যগণ শ্বেতচ্ছত্র ও যাজকগণ প্রদীপ্ত পাবক লইয়া শিবিকাযানের অগ্রে অগ্রে গমন করিতে আরম্ভ করিলেন।দেবকী, ভদ্রা, রোহিণী ও মদিরা নামে বসুদেবের পত্নীচতুষ্টয় তাহার সহমৃতা হইবার মানসে দিব্য অলঙ্কারে বিভূষিত ও অসংখ্য কামিনীগণে পরিবেষ্টিত হইয়া তাহার অনুগামিনী হইলেন। মহাত্মা অর্জুন চন্দনাদি বিবিধ সুগন্ধী কাষ্ঠ দ্বারা পত্নী সমবেত বসুদেবের দাহকার্য সম্পাদন করিতে লাগিলেন। ঐ সময় সেই প্রজ্জ্বলিত চিতানলের শব্দ সামবেত্তাদিগের বেদাধ্যয়ন ও অন্যান্য মানবগণের রোদনধ্বনি প্রভাবে পরিবর্ধিত হইয়া সেই স্থান প্রতিধ্বনিত করিতে লাগিল। অনন্তর তিনি বজ্র প্রভৃতি যদুবংশীয় কুমারগণ ও কামিনীগণের সহিত সমবেত হইয়া বসুদেবের উদকক্রিয়া সম্পাদন করিলেন।“

(কালিপ্রসন্নসিংহের মহাভারত/মৌষল পর্ব/৭ম অধ্যায়)

মহাভারতে কৃষ্ণের অনেক পত্নী সহমৃ্তা হন।

রাজশেখর বসুর মহাভারত অনুযায়ী,

“কৃত বর্মার পুত্র এবং ভোজ নারীগণকে মার্তিকাবত নগরে এবং সাত্যকির পুত্রকে সরস্বতী নদীর নিকটস্থ প্রদেশে রেখে অর্জুন অবশিষ্ট বালক বৃদ্ধ ও রমণীগণকে ইন্দ্রপ্রস্থে আনলেন।কৃষ্ণের পৌত্র বজ্রকে তিনি ইন্দ্রপ্রস্থের রাজ্য দিলেন। অক্রূরের পত্নীরা প্রব্রজ্যা নিলেন। কৃষ্ণের পত্নী রুক্মিণী,গান্ধারী, শৈব্যা,হৈমবতী ও জাম্ববতী অগ্নিপ্রবেশ করলেন।সত্যভামা ও কৃষ্ণের অন্য পত্নীগণ হিমালয় অতিক্রম করে কলাপ গ্রামে গিয়ে কৃষ্ণের ধ্যান করতে লাগলেন। দ্বারকাবাসী পুরুষগণকে বজ্রের নিকটে রেখে অর্জুন সজল নয়নে ব্যাসদেবের আশ্রমে এলেন।“

(রাজশেখর বসুর মহাভারত, মৌষল পর্ব)

কালিপ্রসন্ন সিংহের মহাভারতে,

“…ইন্দ্রপ্রস্থের রাজ্যভার কৃষ্ণের পৌত্র বজ্রের প্রতি সমর্পিত হইল। ঐ সময় অক্রূরের পত্নীগণ প্রব্রজ্যা গ্রহণে উদ্যত হইলে, বজ্র বারংবার তাহাদিগকে নিষেধ করিতে লাগিলেন; কিন্তু কিছুতেই তাহারা প্রতিনিবৃত্ত হইলেন না। রুক্মিণী,গান্ধারী, শৈব্যা, হৈমবতী ও দেবী জাম্ববতী ইহারা সকলে হুতাশনে প্রবেশ পূর্বক প্রাণত্যাগ করিলেন। সত্যভামা প্রভৃতি কৃষ্ণের অন্যান্য পত্নীগণ তপস্যা করিবার মানসে অরণ্যে প্রবিষ্ট হইয়া ফলমূল ভোজন পূর্বক হিমালয় অতিক্রম করিয়া কলাপ গ্রামে উপস্থিত হইলেন।…”

( কালিপ্রসন্নের মহাভারত/মৌষল পর্ব/ ৭ম অধ্যায়)

মহাভারতের শান্তি পর্বে কপোতের মৃত্যুর পর কপোতিকে আগুনে ঝাপ দিয়ে মারা যেতে দেখা যায়। কপোতির আত্মহত্যার মাধ্যমে মহাভারতে সহমরণের আদর্শকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে(৩১)(৩৭)-

“পতি পরায়ণা কপোতি করুণস্বরে এইরূপে নানাপ্রকার বিলাপ করিয়া পরিশেষে সেই প্রজ্জ্বলিত হুতাশনমধ্যে প্রবেশ করিয়া দেখিল যে, তাহার ভর্তা বিচিত্র মাল্য, পরিধেয় বস্ত্র ও কেয়ূর প্রভৃতি অলঙ্কার সমুদায়ে বিভূষিত হইয়া পুষ্পক রথে অধিরূঢ় হইয়াছে। পুণ্যকর্মপরায়ণ মহাত্মারা তাহার চতুর্দিকে অবস্থান পূর্বক স্তবস্তুতি করিতেছেন। অনন্তর সেই কপোত স্বীয় পত্নীর সহিত সেই বিমানে আরোহণ পূর্বক স্বর্গে গমন করিয়া তত্রত্য দেবগণের নিকট স্বীয় কর্মানুরূপ সম্মানভাজন হইয়া পরমসুখে বিহার করিতে লাগিলেন।”

(কালিপ্রসন্নের মহাভারত/শান্তি পর্ব/ ১৪৮ অধ্যায়)

ধর্মশাস্ত্রে সতীদাহ

পরাশর সংহিতায় সতীদাহ

পরাশর সংহিতার চতুর্থ অধ্যায়ে বলা হচ্ছে,

“ যে পাত্রের সহিত বিবাহের কথাবার্তা স্থির হইয়াছে, তাহার সহিত কন্যার বিবাহ দিতে হইলে, তবে ঐ ভাবী পতি যদি নিরুদ্দেশ হয়, মরিয়া যায়,প্রব্রজ্যা অবলম্বন করে, ক্লীব বলিয়া স্থির হয় বা পতিত হয়, তবে এই পঞ্চ প্রকার আপদে ঐ কন্যার পাত্রান্তরে প্রদান বিহিত। স্বামীর মরনান্তে যে নারী ব্রহ্মচর্য অবলম্বন করেন, তিনি মৃত্যুর পর ব্রহ্মচারীর ন্যায় স্বর্গ লাভ করেন। আর স্বামীর মরণে যিনি সহমৃতা হন, সেই স্ত্রী মানবদেহে যে সার্দ্ধত্রিকোটি সংখ্যক রোম আছে, তাবৎ পরিমিত কাল স্বর্গ ভোগ করিতে থাকেন ব্যালগ্রাহী (সাপুড়ে) যেমন গর্ত মধ্য হইতে, সর্পকে বলপূর্বক টানিয়া আনে, তেমনি সহমৃতা নারী মৃত পতিকে উদ্ধার করিয়া, তৎসহ স্বর্গসুখ ভোগ করেন।

( ঊনবিংশতি সংহিতা/ পরাশর সংহিতা/অধ্যায় ৪/২৬-২৯ |অনুবাদক- শ্রীপঞ্চানন তর্করত্ন)

পরাশর সংহিতার শ্লোকগুলির যে অনুবাদ উপরে দেওয়া হল, এটা ছাড়াও অন্য রকম একটি অনুবাদ রয়েছে। অনুবাদ করেছেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর।সেই অনুবাদে বিদ্যাসাগর দেখিয়েছিলেন, বিধবা বিবাহ হিন্দুশাস্ত্র সম্মত। সেই অনুবাদটি হল-

“নষ্টে মৃতে প্রব্রজিতে ক্লীবে চ পতিতে পতৌ।

পঞ্চস্বাপৎসু নারীণাং পতিরান্যো বিধীয়তে।। ৪/২৬

মৃতে ভর্ত্তরি যা নারী ব্রহ্মচর্য্যে ব্যবস্থিতা।

সা মৃতা লভতে স্বর্গং যথা তে ব্রহ্মচারিণঃ।।৪/২৭

তিস্রঃ কোট্যোহর্দ্ধকোটি ছ যানি লোমানি মানবে।

তাবৎ কালং বসেৎ স্বর্গং ভর্ত্তারং যানুগচ্ছতি।।৪/২৮

অর্থাৎ, স্বামী অনুদ্দেশ হইলে, মরিলে,ক্লীব হইলে, সংসারধর্ম পরিত্যাগ করিলে, অথবা পতিত হইলে, স্ত্রীদিগের পুনর্বার বিবাহ করা শাস্ত্রবিহিত। যে নারী, স্বামীর মৃত্যু হইলে, ব্রহ্মচর্য অবলম্বন করিয়া থাকে, সে দেহান্তে ব্রহ্মচারীদিগের ন্যায়, স্বর্গলাভ করে। মনুষ্য শরীরে যে সার্ধ ত্রিকোটি লোম আছে, যে নারী স্বামীর সহগমন করে, তৎসম কাল স্বর্গে বাস করে।” (৩২)

এর পরে বিদ্যাসাগর মহাশয় বলছেন, “পরাশর কলিযুগের বিধবাদিগের পক্ষে তিন বিধি দিয়াছেন, বিবাহ,ব্রহ্মচর্য ও সহগমন। তন্মধ্যে রাজকীয় আদেশক্রমে, সহগমনের প্রথা রহিত হইয়া গিয়াছে। এক্ষণে বিধবাদিগের পক্ষে দুই মাত্র পথ আছে, বিবাহ ও ব্রহ্মচর্য; ইচ্ছা হয় বিবাহ করিবেক,ইচ্ছা হয় ব্রহ্মচর্য করিবেক। কলিযুগে, ব্রহ্মচর্য অবলম্বন করিয়া, দেহযাত্রা নির্বাহ করা বিধবাদিগের পক্ষে অত্যন্ত কঠিন হইয়া উঠিয়াছে।এই নিমিত্তই ভগবান পরাশর সর্বপ্রথম বিবাহেরই বিধি দিয়াছেন। সে যাহা হউক, স্বামীর অনুদ্দেশ প্রভৃতি পাঁচ প্রকার বৈগুণ্য ঘটিলে, স্ত্রীলোকের পক্ষে বিবাহের স্পষ্ট বিধি প্রদর্শিত হওয়াতে, কলিযুগে সেই সেই অবস্থায়, বিধবার পুনর্বার বিবাহ করা শাস্ত্রসম্মত কর্তব্য কর্ম বলিয়া অবধারিত হইতেছে।” (৩২)

বিশেষত পরাশর স্মৃতির উপরোক্ত শ্লোকগুলির ভিত্তিতেই বিধবা বিবাহ শাস্ত্রসম্মত প্রমাণে সচেষ্ট হয়েছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। কিন্তু তার অনূদিত শ্লোকগুলির মধ্যেও সতীদাহের উল্লেখ পাওয়া যায়।বিদ্যাসাগরের সময়কালে সহমরণ সম্ভব না হওয়ার পিছনে বিদ্যাসাগর যুক্তি দিয়েছেন, “…রাজকীয় আদেশক্রমে, সহগমনের প্রথা রহিত হইয়া গিয়াছে। এক্ষণে বিধবাদিগের পক্ষে দুই মাত্র পথ আছে, বিবাহ ও ব্রহ্মচর্য; ইচ্ছা হয় বিবাহ করিবেক,ইচ্ছা হয় ব্রহ্মচর্য করিবেক।” (৩২)

ব্যাস সংহিতায় সতীদাহ

ব্যাসসংহিতার ২য় অধ্যায়ে বলা হচ্ছে,

“পতিব্রতা স্ত্রী স্বামী প্রবাসে থাকিলে দীনভাবে থাকিবে। মৃত ভর্তার সহিত অগ্নিপ্রবেশ করিবে অথবা আজীবন ব্রহ্মচর্য করিবে।“

( ঊনবিংশতি সংহিতা\ব্যাসসংহিতা | অনুবাদক- পঞ্চানন তর্করত্ন )

দক্ষ সংহিতায় সতীদাহ

দক্ষ সংহিতায় বলা হচ্ছে,

“ ভর্তার মৃত্যু হইলে, যে স্ত্রী স্বামীর চিতা আরোহণ করে সেই স্ত্রী সদাচারসম্পন্না হইবে এবং স্বর্গে দেবগণের পূজ্য হইবে। ব্যালগ্রাহী (সাপুড়ে) যেমত গর্ত হইতে বল দ্বারা সর্পগণকে উদ্ধার করে, সেইরূপ পতিসহগামিনী স্ত্রীর পতি যদ্যপি নরকস্থ থাকে, তাহাকেও নিজ পূণ্যবলে উদ্ধার করিয়া পতির সহিত (স্বর্গলোকে) সহর্ষে কালযাপন করে।“

( দক্ষসংহিতা/ অধ্যায় ৪ | ঊনবিংশতি সংহিতা/দক্ষ সংহিতা- অনুবাদক পঞ্চানন তর্করত্ন )

বিষ্ণু সংহিতায় সতীদাহ

বিষ্ণু সংহিতার ২৫ তম অধ্যায়ে বলা হচ্ছে,

“স্ত্রীলোকের ধর্ম নিরুপিত হইতেছে।ভর্তার সমান ব্রতাচরণ, শ্বশ্রু, শ্বশুর,গুরু, দেবতা ও অতিথির পূজা , গৃহোপকরণ, দ্রব্য সামগ্রীকে বেশ মাজিয়া ঘষিয়া গুছাইয়া রাখা,অমুক্তহস্ততা (অর্থাৎ, অল্পব্যয় করা), ধন-পাত্র সুগোপন করিয়া রাখা, বশিকরণাদি মূলকর্মে অপ্রবৃত্তি। মঙ্গলাচার তৎপরতা, ভর্তা প্রবাসে থাকিলে কেশবিন্যাস না করা, পরগৃহে গমন না করা, দ্বারদেশে বা গবাক্ষে অবস্থান না করা এবং সকল কর্মেই অস্বতন্ত্রতা- (যথাক্রমে) বাল্য, যৌবন ও বার্ধক্যে- পিতা, ভর্তা ও পুত্রের বশে থাকা, ভর্তার (স্বামী) মৃত্যু হইলে ব্রহ্মচর্য কিংবা ভর্তার সহগমন বা অনুগমন (স্ত্রীলোকের ধর্ম)।

(ঊনবিংশতি সংহিতা/বিষ্ণু সংহিতা/২৫ অধ্যায় ।| অনুবাদক পঞ্চানন তর্করত্ন)

JULIUS JOLLY অনূদিত Institutes of Vishnu হতে একই কথা উদ্ধৃত করা হল-

“13.To remain subject, in her infancy, to her father; in her youth, to her husband; and in her old age, to her sons.

14.After the death of her husband, to preserve her chastity, or to ascend the pile after him.” (25/13-14)

অত্রি সংহিতায় সতিদাহ

চিতিভ্রষ্টা তু যা নারী ঋতুভ্রষ্টা চ ব্যাধিতঃ।

প্রাজাপত্যেন শুধ্যেত ব্রাহ্মণান্ তোজয়দ্দেশ।। ২০৯

অর্থাৎ, স্ত্রীলোক সহমরণ বা অনুমরণ করিতে গিয়া চিতা হইতে পতিত হইলে বা রোগ দ্বারা রজোহীন হইলে প্রাজাপত্য ব্রত করিয়া এবং দশজন ব্রাহ্মণ ভোজন করাইয়া শুদ্ধ হইবে।

(ঊনবিংশতি সংহিতা/অত্রি সংহিতা/২০৯ শ্লোক | অনুবাদক- পঞ্চানন তর্করত্ন)

পুরাণে সতীদাহ

অগ্নি পুরাণে সতীদাহ

সাধ্বীস্ত্রীণাং পালনঞ্চ রাজা কুর্য্যাচ্চ ধার্ম্মিকঃ ।

স্ত্রীয়া প্রহৃষ্টয়া ভাব্যং গৃহকার্য্যৈকদক্ষয়া।। ১৯

সুসংস্কৃতোপস্করয়া ব্যয়ে চামুক্তহস্তয়া।

যস্মৈ দদ্যাৎ পিতা ত্বেনাং শুশ্রূষেত্তং পতিং সদা।। ২০

মৃতে ভর্ত্তরি স্বর্যায়াৎ ব্রহ্মচর্য্যে স্থিতাঙ্গনা।

পরবেশ্মরুচির্ন স্যান্ন স্যাৎ কলহশালিনী।। ২১

মণ্ডোনং বর্জ্জয়েন্নারী তথা প্রোষিতভর্ত্তৃকা।

দেবতারাধনপরা তিষ্ঠেদ্ভর্ত্তৃহিতে রতা।। ২২

ধারয়েন্মাঙ্গলার্থায়  কিঞ্চিদাভরণং তথা।

ভয়াগ্নিং যা বিশেন্নারী সাপি স্বর্গমবাপ্নুর্ত্রাৎ।। ২৩

শ্রিয়ঃ সম্পূজনং কার্য্যং গৃহসম্মার্জ্জনাদিকম্।

দ্বাদশ্যাং কার্ত্তিকে বিষ্ণুং গাং সবৎসাং দদেত্তথা।। ২৪

সাবিত্র্যা রক্ষিতে ভর্ত্তা সত্যাচারব্রতেন চ।

সপ্তম্যাং মার্গশীর্ষে তু সিতেহভ্যর্চ্চ্য দিবাকরম্।

পুত্রানাপ্নোতি চ স্ত্রীহ নাত্র কার্য্য বিচারণ।। ২৫

অর্থাৎ, ধার্মিক নরপতি সাধ্বী স্ত্রীর পালন করিবেন। সাধ্বী স্ত্রীর লক্ষণ এই- সর্বদা প্রফুল্ল, গৃহকার্যে অতিমাত্র দক্ষ এবং ব্যয়ে অমুক্তহস্ত হইবে, উপস্কর সকল সুসংস্কৃত করিবে, স্বামীকে সর্বদা সেবা করিবে, স্বামীর মৃত্যু হইলে ব্রহ্মচর্যের অনুষ্ঠান করিবে, পরগৃহবাসে রুচি করিবে না, কলহশীলতা বিসর্জন করিবে, স্বামী প্রবাসস্থ হইলে মণ্ডনবর্জন করিবে, দেতারাধনে তৎপর হইবে, কায়মনে স্বামিহিত সাধন করিবে, মঙ্গলার্থ কিঞ্চিৎ অলঙ্কার ধারণ করিবে। ভর্তাগ্নিতে প্রবেশ করিয়া স্বর্গলাভ করিবে, লক্ষ্মীর পূজা করিবে, গৃহসম্মার্জ্জনাদি করিবে এবং কার্ত্তিকমাসের দ্বাদশীতে বিষ্ণু পূজা ও তদুদ্দেশে সবৎসা গাভী প্রদান করিবে। সাবিত্রী সত্যাচার ব্রতে স্বামীকে রক্ষা করিয়াছিলেন। অগ্রহায়ণ মাসের শুক্ল পক্ষীয় সপ্তমীতে দিবাকরকে অর্চনা করিলে রমণী পুত্রলাভ করে; সুতরাং ইহার অনুষ্ঠানে কিছুমাত্র ইতস্তত করিবে না। ( ২২২ অধ্যায়, ১৯-২৫ শ্লোক ; সম্পাদক- পণ্ডিতপ্রবর শ্রীযুক্ত পঞ্চানন তর্করত্ন ; প্রকাশনী-  নবভারত পাবলিশার্স )

কূর্ম পুরাণে সতীদাহ

… ব্রহ্মঘ্নং বা কৃতঘ্নং বা মহাপাতকদূষিতম্।। ১০৮

ভর্ত্তারমুদ্ধরেন্নারী প্রবিষ্টা সহ পাবকম্।

এতদেব পরং স্ত্রীণাং প্রায়শ্চিত্তং বিদুর্বধাঃ ।। ১০৯

অর্থাৎ, যদি স্বামী ব্রহ্মঘাতি, কৃতঘ্ন, মহাপাপীও হয়, তার মৃত্যুর পর তার স্ত্রী যদি তার সাথে অগ্নিতে প্রবেশ করে , তাহলে সে তার স্বামীকে উদ্ধার করে। বিদ্বানদের মতে, এটা নারীদের পরম প্রায়শ্চিত্ত।

( কূর্ম পুরাণ, উত্তর ভাগ, ৩৪ অধ্যায়, ১০৮-১০৯ ; হিন্দি থেকে বাংলায় অনুবাদিত)  

বিষ্ণু পুরাণে সতীদাহ

বিষ্ণুপুরাণ মতে, দুর্বাসার অভিশাপকে সম্মান জানিয়ে মায়াবী কৃষ্ণ হাঁটুর উপরে পায়ের পাতা স্থাপন করে যোগ অবলম্বন করেন। জরা নামে এক ব্যাধ কৃষ্ণকে হরিণ ভেবে তার দিকে তীর নিক্ষেপ করে। এভাবে কৃষ্ণ মৃত্যুবরণ করেন। (৪) কৃষ্ণের মৃত্যুর পর তার স্ত্রীরা সহমৃতা হন। বিষ্ণু পুরাণ বলছে-

পরাশর উবাচ।

অর্জ্জুনোহপি তদান্বিষ্য কৃষ্ণরামকলেবরে।

সংস্কারং লম্ভয়ামাস তথান্যেষামনুক্রমাৎ।। ১

অষ্টৌ মহিষ্যঃ কথিতা রুক্মিণী প্রমুখাস্তু যাঃ।

উপগুহ্য হরের্দেহং বিবিশুস্তা হুতাশনম্।। ২

রেবতী চৈব রামস্য দেহমাশ্লিষ্য সত্তম।

বিবেশ জ্বলিতং বহ্নিং তৎসঙ্গাহলাদশীতলম্।। ৩

উগ্রসেনস্তু তচ্ছ্রত্বা তথৈবানকদুন্দুভিঃ।

দেবকী রোহিণী চৈব বিশুর্জাতবেদসম্।। ৪

অর্থাৎ, পরাশর বলিলেন- অর্জুনও কৃষ্ণ এবং রামের কলেবরদ্বয় এবং অন্যান্য (প্রধান প্রধান) যাদবগণের দেহসকল অন্বেষণ করিয়া ক্রমানুসারে ঔর্দ্ধদৈহিক সংস্কার করাইলেন। ১

রুক্মিণী-প্রমুখা যে আটটি প্রধানা মহিষী কথিত হইয়াছেন, তাহারা সকলেই হরির দেহ আলিঙ্গন করিয়া অগ্নিতে প্রবেশ করিলেন। ২

হে সাধুত্তম! রেবতীও রামের দেহ আলিঙ্গনপূর্বক রামের অঙ্গস্পর্শ আহ্লাদে শীতলবৎ অনুভূত অগ্নিতে প্রবেশ করিলেন। ৩

এই সকল ব্যাপার শ্রবণ করিয়া উগ্রসেন, রোহিণী, দেবকী ও বসুদেব – ইহারাও অগ্নিতে প্রবেশ করিলেন।  ৪

( পঞ্চম অংশ, ৩৮ অধ্যায় ; সম্পাদক- পণ্ডিতবর শ্রীযুক্ত পঞ্চানন তর্করত্ন )

শতধনু নামে এক রাজা মারা গেলে তার স্ত্রী শৈব্যা তার সাথে সহমৃতা হয়েছিলেন-

শ্রুয়তে চ পুরা খ্যাতো রাজা শতধনুর্ভুবি।

পত্নী চ শৈব্যা তস্যাভুদতিধর্মপরায়ণা।। ৫১

পতিব্রতা মহাভাগা সত্যশৌচদয়ান্বিতা ।

সর্ব্বলক্ষণসম্পন্না বিনয়েন নয়েন চ।। ৫২

কালেন গচ্ছতা রাজা মমারাসৌ সপত্নজিৎ।

অন্বারুরোহ তং দেবী চিতাস্থং ভূপতিং পতিম্।। ৬০

“শুনিয়াছি পূর্বকালে শতধনু নামে পৃথিবীতে বিখ্যাত এক রাজা ছিলেন। অতি ধর্মপরায়ণা শৈবা নাম্নী তাহার এক পত্নী ছিলেন। ঐ শৈব্যা পতিব্রতা মহাভাগ্যবতী সত্যনিষ্ঠা শৌচ পরায়ণা দয়াপরতন্ত্রা সর্বলক্ষণ সম্পন্না ও বিনয়ান্বিতা ছিলেন। … কিছুকাল পরে শত্রুজিৎ রাজা মৃত্যুমুখে পতিত হইলেন। দেবী শৈব্যাও চিতারূঢ় পতির অনুগমন করিলেন।“ (৩য় অংশ, ১৮ অধ্যায় ; সম্পাদক- পণ্ডিতপ্রবর শ্রী পঞ্চানন তর্করত্ন)

“শুনিয়াছি পূর্বকালে শতধনু নামে ভূমণ্ডলে বিখ্যাত এক রাজা ছিলেন। তাহার পত্নীর নাম শৈব্যা। শৈব্যা সাতিশয় ধর্মপরায়ণা, পতিব্রতা, মহাভাগ্যবতী, সত্যনিষ্ঠা, শৌচপরায়ণা, দয়াপরতন্ত্রা, সর্বলক্ষণসম্পন্না ও বিনয়ান্বিতা ছিলেন। … কিছুকাল পরে শত্রুবিজয়ী ভূপাল কলেবর পরিত্যাগ করিলেন। দেবীও সেই ভূপতির চিতায় অন্বারূঢ় হইলেন। “ ( প্রকাশক- শ্রী বরদা প্রসাদ বসাক)

পাষণ্ডের সাথে বার্তালাপ করার ফলে শতধনু রাজা বিভিন্ন পশুযোনিতে ভ্রমণ করে অবশেষে মানুষ রূপে জন্মগ্রহণ করে তার পূর্বজন্মের স্ত্রী শৈব্যাকে বিয়ে করেন। এবারও রাজা যুদ্ধে মারা গেলে তার স্ত্রীও তার সাথে সহমৃতা হন-

রাজ্যং ভুক্ত্বা যথান্যায়ং পালয়িত্বা বসুন্ধরাম্।

তত্যাজ স প্রিয়ান্ প্রাণান্ সংগ্রামে ধর্মতো নৃপঃ।। ৯১

ততশ্চিতাস্থং তং ভূয়ো ভর্ত্তারং সা শুভেক্ষণা।

অন্বারুরোহ বিধিবদ্ যথাপূর্ব্বং মুদা সতী।। ৯২

ততোহবাপ তয়া সার্দ্ধং রাজপুত্র্যা স পার্থিবঃ।

ঐন্দ্রানতীত্য বৈ লোকান্ লোকান্ কামদুহোহক্ষয়ান্।। ৯৩

স্বর্গাক্ষয়ত্বমতুলং দাম্পত্যমতিদুর্ল্লভম।

প্রাপ্তং পুণ্যফলং প্রাপ্য সংশুদ্ধিং তাং দ্বিজোত্তম।। ৯৪

“তিনি রাজ্যভোগ ও পৃথিবী পালন করিয়া ধর্মযুদ্ধে প্রিয় জীবন পরিত্যাগ করিলেন।সুলোচনা সতী রাজকন্যা , আনন্দের সহিত পূর্বের ন্যায় পুনর্বার বিধানানুসারে চিতাশায়ী মৃত পতির অনুগমন করিলেন। ৮৩-৯২ অনন্তর রাজা সেই রাজকন্যার সহিত ইন্দ্রলোক অতিক্রম পূর্বক বিবিধ কামপ্রদ অক্ষয়লোকে গমন করিলেন। হে দ্বিজোত্তম, তিনি পরিশুদ্ধ হইয়া অতুলনীয় অক্ষয় স্বর্গ, দুর্লভ দাম্পত্য সুখ ও পূর্বার্জিত সমুদায় পূণ্যের ফল ভোগ করেন।“

(৩য় অংশ, ১৮ অধ্যায় ; সম্পাদক- পণ্ডিতপ্রবর শ্রী পঞ্চানন তর্করত্ন)

“ তিনি ন্যায়ানুসারে রাজ্য শাসন ও পৃথিবী পালন করিয়া অল্পকাল মধ্যেই ধর্মযুদ্ধে প্রিয় জীবন পরিত্যাগ করিলেন। সুলোচনা সতী রাজকন্যা, প্রীত মনে পূর্বের ন্যায় পুনর্বার যথাবিধানে মৃত পতির চিতায় আরোহণ করিলেন। অনন্তর রাজা সেই রাজকন্যার সহিত ইন্দ্রলোক অতিক্রম পূর্বক বিবিধ কামপ্রদ অক্ষয়লোক প্রাপ্ত হইলেন। দ্বিজোত্তম, তিনি (অশ্বমেধ যজ্ঞে স্নান পূর্বক) পরিশুদ্ধ হইয়া তুলনারহিত অক্ষয় স্বর্গ, অতি দুর্লভ দাম্পত্য সুখ ও পূর্বার্জিত সমুদায় পুণ্যের ফল প্রাপ্ত হন।“ ( প্রকাশক- শ্রী বরদা প্রসাদ বসাক)

গরুড় পুরাণে সহমরণ

নষ্টে মৃতে প্রব্রজিতে ক্লীবে বা পতিতে পতৌ।

পঞ্চস্বাপত্সু নারীণাং পতিরন্যো বিধীয়তে।। ২৮

ভর্ত্রা সহমৃতা নারী রোমাব্দানি বসেদ্দিবি।

শ্বাদিদষ্টস্তু গায়ত্র্যা জপাচ্ছুদ্ধো ভবেন্নরঃ।। ২৯

অর্থাৎ, স্বামী যদি নিরুদ্দেশ হয়, মৃত্যুমুখে পতিত হয় , প্রব্রজ্যা অবলম্বন করে, ক্লীব হয় অথবা পতিত হয়, এই পাঁচ প্রকার বিপদ উপস্থিত হইলে অন্য পাত্রের সহিত কন্যার বিবাহ দেওয়া যাইতে পারে। ২৮

যে রমণী পতির সহিত অনুমৃতা হয়, তাহা হইলে তাহার শরীরে যতগুলি লোম আছে, ততকাল সে পতির সহিত স্বর্গে বাস করে। যদি কাহাকেও কুক্কুর প্রভৃতি দংশন করে , তাহা হইলে গায়ত্রী জপ করিয়া শুদ্ধিলাভ করিতে পারিবে। ২৯ ( পূর্বখণ্ড, ১০৭ অধ্যায় ; অনুবাদক- শ্রীযুক্ত চন্দ্রকুমার তর্কালঙ্কার)

গরুড় পুরাণের অন্য স্থানে আবার বলা হচ্ছে-

“…A woman who has been chaste and faithful to her husband should mount on the pyre after bowing to her (deceased) husband before the funeral rites start. One who gets away from the pyre due to fainting should observe the vow named prajapatya. One who ascends the pyre and follows up her husband stays in heaven for a period equal to the number of hair on the body, three and a half crore. Just as the snake-charmer takes out the snake from the hole so also she takes out her husband from hell and enjoys with him in paradise. She who ascends the pyre goes to heaven. She is praised by the celestial nymphs and enjoys with her husband so long as the fourteen Indras rule in heaven successively. Even if the man has killed a brahmana or a friend or any other person of noble conduct he is purified of sins by his wife who ascends his pyre. A woman who enters fire after the death of her husband prospers in the heaven like Arundhati. Until and unless the woman burns herself after her husband’s death she is never released from the bond of her sex. A woman who follows her husband purifies the three families on her mother’s side, the three families on her father’s side and the three families on her husband’s side.”

অর্থাৎ, ” সতী এবং পতিব্রতা নারীর উচিত মৃত স্বামীকে নমস্কার করে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া শুরু হবার আগে স্বামীর চিতায় আরোহণ করা। যে নারী চিত্তের দৌর্বল্যের কারণে চিতা হতে দূরে সরে যান তার প্রজাপত্য প্রায়শ্চিত্ত করা উচিত। যে নারী চিতায় আরোহণ করে এবং স্বামীর অনুগমন করে, মানুষের শরীরে যে সাড়ে তিন কোটি লোম আছে, তত বছরই তিনি স্বর্গে বাস করেন। সাপুড়ে যেমন গর্ত থেকে সাপকে বের করে আনে তেমনি সেই নারীও তার স্বামীকে নরক থেকে উদ্ধার করেন এবং তার স্বামীর সাথে স্বর্গসুখ ভোগ করেন। যে নারী চিতায় আরোহণ করেন তিনি স্বর্গে যান। স্বর্গের অপ্সরারা তার প্রশংসা করেন এবং স্তসময় ১৪ জন ইন্দ্র স্বর্গে রাজত্ব করেন, ততসময় স্বামীর সাথে তিনি স্বর্গেসুখ ভোগ করেন। এমনকি যদি পুরুষটি ব্রহ্মঘাতিও (ব্রাহ্মণকে হত্যাকারী) হয়, যদি বন্ধু বা মহৎ কোনো ব্যক্তির খুনিও হয়, তার স্ত্রী চিতায় আরোহণ করলে সে পাপমুক্ত হয়। যে নারী স্বামীর মৃত্যুর পর অগ্নিতে প্রবেশ করেন , তিনি স্বর্গে অরুন্ধতীর মত সুখ্যাতি লাভ করেন। যতক্ষণ কোনো নারী তার স্বামীর মৃত্যুর পর নিজেকে দহন না করেন, ততক্ষণ তিনি তার নারীজন্ম থেকে মুক্তি পান না। স্বামীর অনুগমনকারী নারী তার মাতা, পিতা ও স্বামী প্রত্যেকের তিন পুরুষকে পরিশুদ্ধ করেন।”

(Garuda Purana II.4.88-97 | Motilal BanarsiDas Publishers Privet Limited)

গরুড় পুরাণ সারোদ্ধারে সতীদাহ

“ This is for the panchaka burnings ; in other cases he should burn it alone. If the wife is faithful he may burn with her. 34

If the wife is faithful , and intent on ther husbands welfare , and if she wishes to follow him , then she should bathe; 35

Adorn her body with saffron powder , collyrium and beautiful clothes and ornaments ; make gifts to the twice born and to the circle of relatives; 36

Bow to the preceptor; come out of the house; go to a temple and worship Hari with devotion. 37

Then, having dedicated her ornaments there and holding a cocoanut , and having put aside shyness and worldy delusions she should go to the burning-ground. 38

Having there bowed to the sun , and walked around the funeral pyre , she should ascend a bed of flowers and rest her husband on her lap, 39

And, giving the cocoanut to her friends , she should order the burning . The body should be burnt with the thought that this is equal to bathing in the ganges. 40

The pregnant woman should not burn her body with her husband’s . Having been delivered of the child , and having nourished it, she may become ‘faithful’. 41

 When a woman burns her bod with her husband’s, the fire burns her limbs only, but does not afflict her soul. 42

Just as metals when smelted lose their impurity so also the woman burns away her sins in the fire that is like necter. 43

Just as in the ordeals , the truthful, pure righteous man is not burnt, even by a ball of heated iron. 44

Likewise she who has joined her husband is never burnt. her inner soul becomes unified with that of her husband, by death. 45

The woman who does not burn herself in the fire, on her husband’s death, is certainly never released from feminine bodies. 46
Therefore should every effort be made to serve the husband always, by actions, thought and speech , wheather he be dead or living. 47

The woman who ascends the funeral pyre, when her husband is dead , becomes equal to Arundhati and attains the heaven world. 48

There she, with her husband as highest interest, praised by numbers of celestial demsels, rejoices with her husband as long as the fourteen Indras endure. 49

She who goes with her husband purifies three families – her mother’s, her father’s , and that into which she was given. 50

For as many periods as there are hairs on a man – thirty five millions,- she rejoices with her husband , dwelling in heaven. 51

She sports with her beloved in the celestial chariot; and dwells in her husband’s world as long as the sun and moon endure. 52

She is reborn in a stainless family, long-lived. The woman who is faithful obtains the same husband as before. 53

That fool who , on account of momentary pain of burning , surrenders this happiness , is burned until the end of her life by the fire of separation. 54

Therefore, knowing the husband to be Siva , she should burn her body with his. If she be not true Tarksya, then he must burn alone. 55

 (Garuda puran saroddhara, chapter 10, Translated by Ernest Wood and S.V. Subrahmanyam ; Edited by Major B.D. Basu)

এই গ্রন্থের দ্বিতীয় অধ্যায়ে আছে,

“Not knowing my duty I did not serve my husband , nor after his death enter the fire. Having become widowed I performed no austerities ;- O Dweller in the body , make reparation for whatever you have done.”  2/42

ব্রহ্মাণ্ড পুরাণে সতীদাহ

পরশুরামের পিতা জমদগ্নিকে মৃত ভেবে তার মাতা রেণুকা সহমরণের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন-

Renuka of steadfast holy rites, whose body was overwhelmed with sorrow for her husband , called all her sons togather and spoke these words: 35

renuka said:

O my sons , I wish to follow your father who has gone to heaven and who was by nature meritorious . It behoves you all to allow me to do so. 36

The misery of widowhood is unbearable. How can I endure it? I will be heated as I am bereft of my husband. How can I carry my activities thus? 37

Hence I shall follow my beloved husband so that I shall proceed along with him without interruption for ever in the other world. 38

By entering this burning pyre , I will be slightly after a long time, the dear guest of my husband in the world of the pitrs (manes). 39

If you wish to do what is pleasing to me, dear sons nothing else should be expressed by you by taking a united stand against me, except your concurrence and support in this act of my self immolation to fire. 40

After saying these word with firm decision, Renuka decided to follow her husband by entering the fire 41

অর্থাৎ, পবিত্র রীতিনীতির অনুষ্ঠানকারী স্বামির শোকবিহ্বল রেণুকা তার সকল পুত্রদের ডেকে এই কথাগুলো বললেনঃ ৩৫

রেণুকা বললেনঃ

হে পুত্রেরা, আমি তোমাদের স্বর্গীয় মেধাবী পিতার অনুগমণের ইচ্ছা করি। তোমাদের এতে সম্মতি দেওয়া উচিত। ৩৬

বৈধব্যের দুর্গতি অসহনীয়।আমি কিভাবে তা সহ্য করবো? স্বামী ব্যতিত আমি কষ্ট ভোগ করবো। আমি এভাবে কি করে বাঁচবো? ৩৭

তাই আমি আমার প্রিয়তম স্বামীর অনুগমন করবো যাতে আমি তার সাথে অন্য জগতে কোনো বাধা ছাড়াই চিরকাল বাস করতে পারি। ৩৮

এই জ্বলন্ত চিতায় প্রবেশ করে,কিছু দীর্ঘ সময়ের পরে, পিতৃদের জগতে আমি আমার স্বামীর অতিথি হব। ৩৯

হে পুত্রেরা,যদি তোমরা আমার প্রিয় কিছু করতে চাও, তবে আমার বিপক্ষে কিছু বলো না, আগুনে আমার আত্মাহুতিতে তোমাদের সম্মতি ও সমর্থন জানানো ছাড়া।৪০

এই কথাগুলো বলে দৃঢ় সিদ্ধান্তের সাথে রেণুকা অগ্নিতে প্রবেশ করে তার স্বামীর অনুগমণের সিদ্ধান্ত নিলেন ৪১

(2/3/30 ; Translated by- Ganesh Basudeo Tagore; Edited by- Prof.J.L. Shastri; Publisher- Motilal Banarsi das private limited)

পদ্মপুরাণে সতীদাহ

পদ্মপুরাণে এক ব্রাহ্মণ মারা গেলে তার স্ত্রী দুঃখে ভেঙ্গে পড়েন। তখন সেখানে নারদ এসে উপস্থিত হলে সেই স্ত্রীটি নারদের পায়ে লুটিয়ে পড়েন।

”Having raised her, Narada said to the pure one about her dead (husband): ”O innocent one of large eyes, please go to your husband. O you of large eyes, your husband, abandoned by his kinsmen, is dead. O auspicious one, you should not weep. Enter fire (i.e. funeral pyre of your husband). O innocent one of large eyes, please go to your husband. O you of large eyes, your husband abondoned by his kinsmen, is dead.O auspicious one, you should not weep. Enter fire (i.e. funeral pyre of your husband)

The brahmana woman said:

O sage tell me whether i should or should not go, so that the time for entering the fire should not elapse.

Narada said  58-62

That city is at a distance of hundred yojanas from here. The brahmana (i.e. the body of your husband) will be burnt tomorrow.

Avyaya said:

O sage i deserve to go to the lord of my body, who is away.

Hearing her words, Narada said to her: “You sit upon the handle of my lute. I shall go there in a moment.” Saying so he made haste and went there- to the country and abode of the dead brahmana. The sage said to avyaya: “If you will go to (i.e. desire to enter) fire there , then do not weep. O daughter , if you have committed  a sin like enjoying another man (than your husband) then make an expiation to purify that. On entering into the fire your minor sins will perish. Leaving (except) entering the fire i do not see any other (expiation) for women for the appeasement of all sins. 64-69A
(5/106; Translated by- Dr. N.A. Deshpande; Edited by- Dr. G.P. Bhatt ; Motilal Banarsi Das Publicatin)

অর্থাৎ, তাকে উঠিয়ে নারদ সতী নারীটিকে তার মৃত স্বামীর সম্বন্ধে বললেনঃ হে নিষ্পাপ বিশালাক্ষী , দয়াকরে তুমি তোমার স্বামীর কাছে যাও। হে বিশালাক্ষী, জ্ঞাতি কর্তৃক পরিত্যক্ত তোমার স্বামী মারা গিয়েছেন। হে শুভে, তুমি কেঁদো না। তোমার স্বামীর চিতাগ্নিতে প্রবেশ কর।

ব্রাহ্মণ নারীটি বললেনঃ

হে ঋষি, আমার অগ্নিতে প্রবেশ করা উচিত কি অনুচিত বলুন, যাতে অগ্নিতে প্রবেশের সময় পার না হয়ে যায়।

নারদ বললেনঃ ৫৮-৬২

ঐ শহরটি এখান থেকে একশ যোজন দূরে। তোমার স্বামীর মৃতদেহকে কাল দাহ করা হবে।

অভ্যয়া (নারীটি) বললেনঃ

হে মুনি! দূরে স্থিত স্বামীর কাছে আমি যেতে চাই।

তার কথা শুনে নারদ তাকে বললেনঃ “তুমি আমার বীণার হাতলে বস। আমি সেখানে এক মুহূর্তে পৌঁছে যাব।” একথা বলে তিনি দ্রুত মৃত ব্রাহ্মণ যে স্থানে ছিলেন সেখানে উপস্থিত হলেন। মুনি অভ্যয়া কে বললেনঃ” তুমি যদি অগ্নিতে প্রবেশ করতে চাও, তাহলে কেঁদো না।হে কন্যা! যদি তুমি তোমার স্বামী ছাড়া অন্য পুরুষের সাথে সম্ভোগের মত পাপ করে থাকো, তবে শুদ্ধ হবার জন্য এর প্রায়শ্চিত্ত করো। আগুনে প্রবেশের ফলে তোমার ছোটখাটো পাপগুলো বিনষ্ট হয়ে যাবে।আগুনে প্রবেশ ছাড়া মহিলাদের সকল পাপ নিবারণের অন্যকোনো প্রায়শ্চিত্ত আমি দেখি না। 64-69A

নারীটি নারদকে জিজ্ঞেস করে, অগ্নিতে প্রবেশের সময় নারীদের কি কি করা উচিত?

উত্তরে নারদ বলেন,

They have to bathe, sanctify themselves, have to put on ornaments and apply unguents , have to apply sandal (paste) , have to put on flowers, have to have incense, turmeric and sacred rice grains. They have to wear an auspicious thread and apply red lac to their feet. They should give gifts according to their capacity, they should speak agreeable words, and should have a pleasing face. They should listen to (the sound of ) many auspicious musical instruments and songs. When a sin of  (the nature of) infidelity is commited ,then with reference to that old sin (i.e. sin commited previously) , that is said to be an expiation for the appeasement of that sin. Then she should put on the ornaments and offer them to a brahmana. In the absence of such ornaments she should not make the brahmana perform the rite of expiation. In no other way and nowhere, can that sin perish.  70b-75a

(5/106; Translated by- Dr. N.A. Deshpande; Edited by- Dr. G.P. Bhatt ; Motilal Banarsi Das Publicatin)

অর্থাৎ, তাদের স্নান করতে হবে, নিজেদের পবিত্র করতে হবে,অলঙ্কার পরতে হবে, অনুলেপ লাগাতে হবে,চন্দনের প্রলেপ দিতে হবে,ফুল দিয়ে সাজতে হবে, ধূপ, হলুদ এবং পবিত্র চাল রাখতে হবে। তাদের একটি মঙ্গলজনক সূত্র পরিধান করতে হবে, পায়ে লাল লাক্ষা লাগাতে হবে।সাধ্য অনুসারে তারা উপহার দান করবে, তারা সম্মতি সূচক বাক্য উচ্চারণ করবে এবং তারা খুশি মুখে থাকবে। তাদের অনেক শুভ গান -বাজনা শোনা উচিত । অবিশ্বাসের মত পাপ করে থাকলে , প্রায়শ্চিত্তের জন্য সেই পুরোনো পাপের কথা স্বীকার করতে হবে। তারপর তার গয়না পরা উচিত এবং ব্রাহ্মণকে তা দান করা উচিত। অলঙ্কার না থাকলে তার ব্রাহ্মণকে দিয়ে প্রায়শ্চিত্তের অনুষ্ঠান করানো উচিত নয়। অন্য কোনো ভাবে, অন্য কোথাও সেই পাপের স্খালন হতে পারে না।

যাইহোক, কিছু কথোপকথন ও ঘটনার পরে,

85-90. Then having burnt (i .e. consigned to :fire the body of)the brahmana, Narada said to her : “0 Avyayii, go, and enter the :fire if you so desire.’ ‘ Then the chaste lady decorated (herself), and having saluted Narada after going round him three times keeping him to her right, dedicated her mind to Gauri (i.e. Parvati) . Desiring to please Parvati, she separately (i.e. one by one) touched her very :fine auspicious thread, turmeric, so also sacred grains and flowers, garments, musk, sandal, golden comb, various fruits, from presents to her garments-gave all (these) to elderly married women. The chaste woman went three times round the :fire which was, as it were, burning the sky with rows of flames, by keeping it to her right, and stood in front of it. Then with the palms of her hands folded and with a smiling face she said these words :

91-98. O regents of the quarters like Indra, 0 mother Earth,0 Sun, 0 all gods like Dharma (i .e. Yama), hear my words : “If, from (the day of) marriage till today I have, day and night, devoutly served my husband by words, thought, and by acts, and if in the three states (of youth, adulthood and old age) I have not transgressed (in my duties to him) , then truly grant me going with my husband.”

Saying so, she quickly dropped the flower from the tip of her hand (and) entered the blazing fire. Then she saw an aeroplane, which was excellent like the Sun and graced with the music of celestial nymphs. She got into the aeroplane and went to heaven with her husband. Then Yama, having honoured that chaste wife, said to her : “You will have (i.e. live in) heaven eternally; (now) no sin of you remains. .”
(5/106; Translated by- Dr. N.A. Deshpande; Edited by- Dr. G.P. Bhatt ; Motilal Banarsi Das Publicatin)

অর্থাৎ, ব্রাহ্মণটিকে দাহ করার পর ব্রাহ্মণটির স্ত্রীকে নারদ বলেনঃ হে অভ্য়য়া, তোমার এতই ইচ্ছে হলে যাও অগ্নিতে প্রবেশ কর। তারপর সতী নারীটি সাজগোজ করে, নারদকে ডানদিক থেকে তিনবার প্রদক্ষিণ করার পর নমস্কার করে, নিজের মন গৌরিকে সমর্পণ করলেন। পার্বতীকে সন্তুষ্ট করার জন্য , তিনি নিজের মঙ্গলজনক সূত্র, হলুদ, পবিত্র শস্য,ফুল, বস্ত্র,কস্তুরি, চন্দন, চিরুনি, রকমারী ফল আলাদা আলাদা ভাবে স্পর্শ করলেন। উপহার ,বস্ত্র সবই বিবাহিতা বৃদ্ধাকে দিলেন। অগ্নি আকাশকে দগ্ধ করে চলেছিল। সতী নারীটি তিনবার সেই অগ্নিকে তার ডানদিক থেকে প্রদক্ষিণ করলেন এবং তার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। এরপর হাতজোড় করে হাসিমুখে এই কথাগুলো বললেনঃ

হে ইন্দ্রেয় ন্যায় শাসকবৃন্দ, হে পৃথিবী মাতা, হে সূর্য, হে ধর্মের ন্যায় সকল দেবতা, আপনারা আমার কথা শুনুন, “ যদি বিবাহের দিন থেকে আজ অবধি রাতদিন আমি বাক্য, মন ও কর্মের দ্বারা আমার স্বামীর সেবা করে থাকি এবং যদি বাল্য, যৌবন ও বার্ধক্যে আমি আমার কর্তব্য সঠিকভাবে পালন করে থাকি , তবে আমাকে আমার স্বামীর কাছে প্রেরণ করুন। এই কথা বলে তিনি তার হাতের ফুলটি ফেলে দিলেন এবং জ্বলন্ত অগ্নিতে প্রবেশ করলেন।তারপর তিনি সূর্যের মত চমৎকার একটি বিমান দেখলেন। এই বিমানে অপ্সরারা গান গাইছিল। তিনি বিমানে আরোহন করলেন এবং স্বর্গে স্বামীর কাছে চলে গেলেন। তারপর যম সেই সতী নারীকে সম্মান জানিয়ে বললেন, তুমি স্বর্গে চিরকাল থাকবে। তোমার কোনো পাপ অবশিষ্ট নেই…”

পদ্মপুরাণ 6/252/89-90 তে আছে,

“Rukmaputri with Pradyumna, Usa with Aniruddha and all Yadava ladies honoured the bodies of their husbands and entered fire.”

অর্থাৎ, রুক্মিপুত্রী প্রদ্যুম্নের সাথে, ঊষা অনিরুদ্ধের সাথে আগুনে প্রবেশ করলেন। সকল যাদব নারীরা তাদের স্বামীর শরীরকে সম্মান জানালেন এবং আগুনে প্রবেশ করলেন।”

( Translated by- Dr. N.A. Deshpande; Edited by- Dr. G.P. Bhatt ; Motilal Banarsi Das Publicatin)

দেবীভাগবত পুরাণে সতীদাহ-

কদাচিত্তু রহো মাদ্রীং সমালিঙ্গ্য মহীপতিঃ।

মৃতঃ শাপাত্তু মুনিভিঃ সংস্কৃতো হুতভুঙ্মুখে।। ৩৮

মাদ্রী তত্র সতী ভূত্বা প্রবিষ্টা পতিনা সহ।

স্থিতা পুত্রযুতা কুন্তী জ্বলিতে জাতবেদসি।। ৩৯

অর্থাৎ, “অনন্তর কোনো সময়ে পাণ্ডু নির্জনস্থিতা রূপলাবণ্যবতী মাদ্রীরে আলিঙ্গন করিয়া শাপহেতু মৃত্যুমুখে নিপতিত হইল। তখন তত্রস্থিত মুনিগণ অনলে তাহার দেহ সৎকার করিলেন। চিতানল প্রজ্বলিত হইলে পতির সহিত তাহাতে প্রবিষ্ট হইয়া সহমৃতা হইল। কুন্তি পুত্রগণের প্রতিপালনের নিমিত্ত নিবারিত হইয়া চিতানলে প্রবেশ করিল না।“  (ষষ্ঠ স্কন্দ, ২৫ অধ্যায়, ৩৮-৩৯ ; সম্পাদকঃ শ্রীহরিচরণ বসু)

একস্মিন্ সময়ে পাণ্ডুর্মাদ্রীং দৃষ্ট্বাথ নির্জ্জনে।

আশ্রমে চাতিকামার্ত্তো জগ্রাহাগতবৈশসঃ।। ৫৯

মা মা মা মেতি বহুধা নিষিদ্ধোহপি তথা ভৃশম্।

আলিলিঙ্গ প্রিয়াং দৈবাৎ পপাত ধরণীতলে।। ৬০

যথা বৃক্ষগতা বল্লী ছিন্নে পততি বৈ দ্রুমে।

তথা সা পতিতা বালা কুর্ব্বতি রোদনং বহু।। ৬১

প্রত্যাগতা তদা কুন্তী রুদতী বালকাস্তথা।

মুনয়শ্চ মহাভাগাঃ শ্রুত্বা কোলাহলং তদা।। ৬২

মৃতঃ পাণ্ডুস্তদা সর্ব্বে মুনয়ঃ সংশিতব্রতাঃ।

সহাগ্নিভির্ব্বিধিং কৃত্বা গঙ্গাতীরে তদাদহন্।। ৬৩

চক্রে সহৈব গমনং মাদ্রী দত্ত্বা সুতৌ শিশূ।

কুন্ত্যৈ ধর্ম্মং পুরস্কৃত্য সতীনাং সত্যকামতঃ।। ৬৪

অর্থাৎ, “একদিবস পাণ্ডু সেই নির্জন আশ্রমে মদ্ররাজদুহিতাকে একাকিনী দেখিয়া অতিশয় কামার্ত হইয়া পড়িলেন এবং মৃত্যুহস্তে পতিত হইয়াই যেন তাহাকে ধারণ করিলেন। ৫৯

 মহারাজ! আলিঙ্গন করিবেন না করিবেন না বলিয়া মাদ্রী পুনঃ পুনঃ নিষেধ করিলেও দৈববশত তিনি সেই প্রিয় মাদ্রীকে গাঢ়রূপে আলিঙ্গন করিলেন এবং তৎক্ষণাৎ মৃত হইয়া মহীতলে পতিত হইলেন। ৬০

বৃক্ষ ছিন্ন হইলে যেমন তদাশ্রিতা লতাও পতিতা হয় সেইরূপ পাণ্ডুরাজ পতিত হইবামাত্রই মাদ্রীও উচ্চৈঃস্বরে রোদন করিতে করিতে পতিতা হইল। ৬১

সেইসময় কুন্তীও সেইস্থানে আসিয়া ক্রন্দন করিতে আরম্ভ করিলেন , বালকগণও উচ্চৈঃস্বরে কাঁদিতে লাগিল। তখন কঠোর নিয়ম পরায়ণ মহাত্মা মুনিগণ সেই ক্রন্দন কোলাহল শ্রবণ করিয়া পাণ্ডু মৃত হইয়াছে ইহা অবগত হইলেন এবং সকলেই অগ্নির দ্বারা যথাবিধি কার্য সম্পন্ন করিয়া গঙ্গাতীরে তাহাকে দগ্ধ করিলেন। ৬২-৬৩

মাদ্রী নিজের শিশু সন্তান দুইটি কুন্তিকে প্রদান করিয়া সত্যলোক-কামনাপ্রযুক্ত সতীগণের ধর্মকে অগ্রে করিয়া পতির সহিত অনুগমন করিলেন। ৬৪ “ (২য় স্কন্ধ, ষষ্ঠ অধ্যায়;  সম্পাদক- হরিচরণ বসু)

শিবপুরাণে সতীদাহ

20.The young woman, on seeing her husband seized by the demon, was much frightened and implored him with piteous cries. 21. In spite of repeated importunities the man-eating ruthless wicked demon cut off the head of the brahmin sage and devoured it. 22. The distressed, grief-stricken chaste lady lamented much. She gathered the bones of her husband and lighted a funeral pyre. 23. The brahmin lady desirous of entering the pyre in order to follow her husband cursed the Rakshasa king. 24. The chaste lady entered fire after proclaiming “From now onwards if you become united with any woman in sexual embrace you will die.”

অর্থাৎ, ২০.যুবতী নারীটি তার স্বামীকে রাক্ষস এর কাছে বন্দি দেখে ভীষণ ভীত হয়ে পড়েন এবং কাঁদতে কাঁদতে তাকে অনুনয় করেন। ২১. বারবার আকুতি করা সত্ত্বেও নরখেকো নিষ্ঠুর রাক্ষসটি ব্রাহ্মণটির মাথা কেটে তাকে খেয়ে ফেলে।২২. দুর্দশাগ্রস্ত, শোকার্ত পবিত্র নারীটি তীব্র বিলাপ করেন। তিনি তার স্বামীর হাড়গুলোকে জড়ো করেন এবং একটা চিতা প্রস্তুত করেন। ২৩. ব্রাহ্মণ নারীটি তার স্বামীর অনুগমনের জন্য চিতায় প্রবেশের বাসনা করলেন এবং রাক্ষস রাজাকে অভিশাপ দিলেন। ২৪. সতী নারীটি এটা বলার পরে অগ্নিপ্রবেশ করলেন- আজকের পর থেকে তুমি কোনো নারীর সাথে মিলিত হলে, মারা যাবে।

(Siva puranam/Kotirudra samhita/10/20-24| Motilal BanarsiDas Publishers private limited)

শ্রীমদভাগবতে সতীদাহ

চিতিং দারুময়িং চিত্বা তস্যাং পত্যুঃ কলেবরম।

আদিপ্য চানুমরণে বিলপন্তী মনো দধে।। ৪/২৮/৫০

চিতিম্= চিতা ; দারু-ময়িম্= কাঠ দিয়ে তৈরি; চিত্বা= রচনা করে ; তস্যাম= তাতে; পত্যুঃ= পতির ; কলেবরম্= দেহ; আদীপ্য= প্রদীপ্ত করে; চ= ও ; অনুমরণে= সহমরণে; বিলপন্তী= বিলাপ করতে করতে; মনঃ তার মন;  দধে= স্থির করেছিলেন

অনুবাদঃ তারপর তিনি কাঠ দিয়ে চিতা রচনা করে তাতে তার পতির কলেবর প্রদীপ্ত করে বিলাপ করতে করতে তার পতির অনুসরণে সহমরণে কৃতসংকল্প হয়েছিলেন।

তাৎপর্যঃ বৈদিক সমাজে পতিব্রতা স্ত্রীর মৃত স্বামীর অনুগামিনী হয়ে , সহমরণ বরণ করা একটি অতি প্রাচীন প্রথা। ব্রিটিশদের রাজত্বকালেও ভারতবর্ষে এই প্রথাটি প্রচলিত ছিল। তখন অবশ্য পত্নী স্বেচ্ছায় পতির সাথে মরতে চাইত না এবং কখনো কখনো তাদের আত্মীয়রা জোর করে তাদের পুড়িয়ে মারত। বৈদিক প্রথাটি কিন্তু সেইরকম ছিল না। স্ত্রী স্বেচ্ছায় পতির চিতাগ্নীতে প্রবেশ করতেন। ব্রিটিশ সরকার এই প্রথাটিকে অত্যন্ত নিষ্ঠুর বলে মনে করে তা রদ করেছিল কিন্তু ভারতবর্ষের প্রাচীন ইতিহাসে আমরা দেখতে পাই যে, মহারাজ পাণ্ডুর মৃত্যুর পর তার দুই পত্নী মাদ্রী ও কুন্তি বিবেচনা করেছিলেন যে , একজন সহমৃতা হবেন এবং অন্য আরেকজন তাদের শিশু সন্তানদের পালনের জন্য এই পৃথিবীতে থাকবেন। মাদ্রী দাবী করেছিলেন যে, যেহেতু তার কারণে তার পতির মৃত্যু হয়েছে তাই তিনি সহমৃতা হবেন এবং কুন্তি যেন এখানে থেকে তাদের পঞ্চ পুত্রকে পালন করেন। ১৯৩৬ সালেও আমরা এক পতিব্রতা স্ত্রীকে স্বেচ্ছায় পতির চিতাগ্নীতে সহমৃতা হতে দেখেছি।

তা সূচিত করে যে পতিব্রতা স্ত্রীর এইভাবে আচরণ করতে প্রস্তুত থাকা অবশ্য কর্তব্য। তেমনি, গুরুগতপ্রাণ শিষ্য মনে করেন যে, শ্রীগুরুদেবের আদেশ পালনে অক্ষম হওয়ার থেকে শ্রীগুরুদেবের সঙ্গে পরলোকে গমন করা শ্রেয়। পরমেশ্বর ভগবান যেমন ধর্মসংস্থাপন করার জন্য এই পৃথিবীতে আসেন , তেমনি তার প্রতিনিধি শ্রীগুরুদেবও সেই উদ্দেশ্য নিয়েই এখানে আসেন। শিষ্যের কর্তব্য হচ্ছে, শ্রীগুরুদেবের নির্দেশ যথাযথভাবে পালন করার দায়িত্বভার গ্রহণ করা । শিষ্য যদি তা করতে না পারেন, তাহলে শ্রীগুরুদেবের সঙ্গে তার মৃত্যু বরণ করতে তার কৃতসঙ্কল্প হওয়া উচিত অর্থাৎ, ব্যক্তিগত সুখ সুবিধার কথা বিবেচনা না করে শ্রীগুরুদেবের ইচ্ছা পূর্ণ করার জন্য নিজের জীবন পর্যন্ত উৎসর্গ করতে শিষ্যের প্রস্তুত থাকা উচিত। ( অনুবাদক- কৃষ্ণ কৃপাশ্রীমূর্তি শ্রীল অভয়াচরণারবিন্দ ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদ; প্রকাশনী- ভক্তিবেদান্ত বুক ট্রাস্ট)

শ্রীমদ্ভাগবতের ৯/৯/৩২ তম শ্লোকের তাৎপর্যে প্রভুপাদ বলেছেন,

“বৈদিক সংস্কৃতিতে সতী বা সহমরণ প্রথা রয়েছে, যাতে পত্নী মৃত পতির সহমৃতা হন। এই প্রথা অনুসারে পতির মৃত্যু হলে পত্নী স্বেচ্ছায় তার জ্বলন্ত চিতায় প্রবেশ করেন। এই শ্লোকে ব্রাহ্মণপত্নী সেই সংস্কৃতির অন্তর্নিহিত মনোভাব ব্যক্ত করেছেন। পতি বিরহে পত্নী মৃত তুল্যা। তাই বৈদিক সংস্কৃতিতে মেয়ের বিবাহ দেওয়া অবশ্য কর্তব্য বলে বিবেচনা করা হয়েছে। সেই দায়িত্বটি কন্যার পিতার। পিতা কন্যাকে দান করতে পারেন এবং পত্নীর একাধিক পত্নী থাকতে পারে কিন্তু কন্যার বিবাহ দিতেই হবে। এটি বৈদিক সংস্কৃতি। নারীকে সর্বদাই কারো না কারো রক্ষণাবেক্ষণে থাকতে হবে- শৈশবে পিতার , যৌবনে পতির এবং বার্ধক্যে উপযুক্ত পুত্রের তত্ত্বাবধানে তাকে থাকতে হয়। মনুসংহিতায় স্ত্রী স্বাধীনতা অনুমোদিত হয়নি। স্ত্রী স্বাধীনতা মানেই হচ্ছে দুর্দশা। এই যুগে বহু মেয়েরা অবিবাহিত এবং ভ্রান্তভাবে তারা নিজেদের স্বাধীন বলে মনে করছে কিন্তু তাদের জীবন দুঃখ দুর্দশায় পূর্ণ। এখানে ঠিক তার বিপরীত দৃষ্টান্ত আমরা দেখতে পাচ্ছি , যেখানে পতির বিরহে স্ত্রী নিজেকে মৃততুল্যা বলে মনে করছেন।“

শ্রীমদ্ভাগবত ১/১৩/৫৮ অনুসারে, ধৃতরাষ্ট্রের মৃত্যুর পর তার স্ত্রী গান্ধারী সহমৃতা হন-

দহ্যমানেহগ্নিভির্দেহে পত্যুঃ পত্নী সহোটজে।

বহিঃ স্থিতা পতিং সাধ্বী তমগ্নিমনু বেক্ষ্যতি।।

দহ্যমানে= জ্বলন্ত; অগ্নিভিঃ অগ্নির দ্বারা; দেহে= শরীর; পত্যুঃ= পতির ; পত্নী= পত্নী; সহ-উটজে= পর্ণকুটির সহ; বহিঃ= বাইরে; স্থিতা= অবস্থিত; পতিম্= পতির; সাধ্বী= সতী; তম্= সেই; অগ্নিম্= অগ্নিতে; অনু বেক্ষ্যতি= গভীর মনোযোগে দর্শন করতে করতে প্রবিষ্ট হবেন

অনুবাদঃ বাইরে থেকে পর্ণকুটির সহ তার পতির দেহ যোগাগ্নিতে দগ্ধ হতে দেখে পতিব্রতা পত্নী গান্ধারীও সেই অগ্নিতে প্রবেশ করে একাগ্রচিত্তে তার পতির অনুবর্তিনী হবেন।

তাৎপর্যঃ গান্ধারী একজন আদর্শ সাধ্বী নারী, তার পতির নিত্য সহচরি এবং তাই তিনি যখন দেখলেন যে, যোগাগ্নিতে পর্ণকুটিরসহ তার পতির শরীর দগ্ধ হচ্ছে, তখন তিনি হতাশ হয়েছিলেন। তার শতপুত্র হারিয়ে তিনি গৃহত্যাগ করেছিলেন এবং অরণ্যে তিনি দেখলেন যে, তার পরম প্রেমাস্পদ পতিও দগ্ধ হচ্ছেন। এবার তিনি একেবারেই নিঃসঙ্গ বোধ করলেন এবং তাই তিনি তার পতির অগ্নিকুণ্ডে প্রবেশ করে মৃত্যুপথে তার পতির অনুবর্তিনী হলেন।

পতিব্রতা সাধ্বী রমণীর এইভাবে মৃত পতির চিতাগ্নীতে প্রবেশ করাকে বলা হয় সতীপ্রথা এবং কোনো রমণীর পক্ষে এটিকে অতীব গৌরবময় কার্য বলে বিবেচনা করা হয়। পরবর্তীকালে এই সতীপ্রথা এক জঘন্য অপরাধমূলক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল, কারণ অনিচ্ছুক রমণীকেও জোর করে এই পবিত্র অনুষ্ঠান পালনে বাধ্য করা হত। অধঃপতিত যুগে কোনো রমণীর পক্ষে গান্ধারীর এবং পুরাকালের অন্যান্য রমণীর মত পাতিব্রত্য অবলম্বন করে সতী প্রথা অনুসরণ করা সম্ভব নয়।

গান্ধারীর মত সতী নারীর কাছে তার পতির বিরহ-বেদনা অগ্নিতে প্রজ্বলিত হওয়ার থেকেও অধিক দুঃখদায়ক। এই ধরণের কোনো মহিলা স্বেচ্ছায় সতীপ্রথা অবলম্বন করতে পারেন এবং তাতে কারও দণ্ডনীয় বলপ্রয়োগ থাকে না। এই প্রথাটি যখন একটি গতানুগতিক সংস্কারে পরিণত হল এবং এই প্রথা অনুসরণে কোনো মহিলার উপর বলপ্রয়োগ করা হত, বাস্তবিকই এটা তখন দণ্ডনীয় অপরাধে হল এবং তাই রাষ্ট্রের আইনের মাধ্যমে এই প্রথা বন্ধ করা হয়। নারদ মুনির এই ভবিষ্যদ্বাণী মহারাজ যুধিষ্ঠিরকে তার বিধবা পিতৃব্যপত্নীর কাছে যেতে নিরস্ত করেছিল।

 ( অনুবাদক- কৃষ্ণ কৃপাশ্রীমূর্তি শ্রীল অভয়াচরণারবিন্দ ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদ; প্রকাশনী- ভক্তিবেদান্ত বুক ট্রাস্ট)

এবং মিত্রসহং শপ্ত্বা পতিলোকপরায়ণা।

তদস্থীনি সমিদ্ধেহগ্নৌ প্রাস্য ভর্তুর্গতিং গতা।। ৯/৯/৩৬

এবম্= এইভাবে ; মিত্রসহম্= রাজা সৌদাসকে; শপ্ত্বা= অভিশাপ দিয়ে ; পতিলোকপরায়ণা= তার পতির অনুগমন করার বাসনায় ; তৎ-অস্থীনি= তার পতির অস্থি; সমিদ্ধ্বে অগ্নৌ= প্রজ্বলিত অগ্নিতে; প্রাস্য= নিক্ষেপ করে; ভর্তুঃ= তার পতির; গতিম্= গতি; গতা= গমন করেছিলেন

অনুবাদঃ সেই ব্রাহ্মণপত্নী মিত্রসহ নামক রাজা সৌদাসকে এইভাবে অভিশাপ দিয়েছিলেন। তারপর পতির সহগামিনী হওয়ার বাসনায় তিনি তার পতির অস্থি প্রজ্বলিত অগ্নিতে স্থাপনপূর্বক সেই আগুনে স্বয়ং প্রবেশ করে তার পতির গতি প্রাপ্ত হয়েছিলনে।

স্কন্দ পুরাণে সতীদাহ

“অনন্তর রাজা মনোজব অচিরকালমধ্যেই দেহত্যাগ পূর্বক তীর্থমাহাত্ম্যে শিবলোকে প্রয়াণ করিলেন। হে বিপ্রগণ! তাহার পত্নী সুমিত্রা তদীয় দেহ আলিঙ্গন পূর্বক চিতারোহণ করত পতিলোকে গমন করিলেন। “ ( ব্রহ্মখণ্ড, সেতুমাহাত্ম্য,  দ্বাদশ অধ্যায় ; প্রকাশক- শ্রীনটবর চক্রবর্তী)  

“জীবহীন দেহী যেমন ক্ষণমধ্যেই অশুচিত্ব প্রাপ্ত হয়, ভর্তৃহীনা নারীও তেমনি সুস্নাতা হইয়াও অশুচি হইয়া থাকে। বিধবা সমস্ত অমঙ্গল হইতেই অমঙ্গলা। সুতরাং বিধবা দর্শনে কদাচ কোথাও সিদ্ধিলাভ ঘটে না। একমাত্র মাতা ব্যতিত সমস্ত বিধবাই মঙ্গলবর্জিতা; সুতরাং প্রাজ্ঞ ব্যক্তি আশীবিষের ন্যায় তদীয় আশীর্বাদও পরিত্যাগ করিবেন। দ্বিজগণ কন্যার বিবাহ সময়ে তাহাকে এইরূপ বলিবেন যে, স্বামী জীবিত বা মৃত হউক সর্বদাই তাহার সহচরী হইবে। যে নারী সম্পদ হইতে শ্মশান পর্যন্ত প্রফুল্ল চিত্তে স্বামীর অনুগমন করে , তাহার পদে পদে অশ্বমেধযজ্ঞের ফল লাভ হয়। ব্যালগ্রাহী জন যেমন বিল হইতে ব্যালোদ্ধার করে , তেমনি সতী নারী যমদূত হইতে পতিকে উদ্ধার করিয়া স্বর্গে গমন করে। সেই পতিব্রতাকে দেখিয়া যমদূতেরা পলায়ন করে, তপন পরিতপ্ত হন, দহনও দগ্ধ হইয়া থাকেন। এমনকি পতিব্রতার তেজ দেখিয়া সমস্ত তেজই কম্পিত হয়। নিজের লোমসংখ্যা যত পতিব্রতা ততকোটি বৎসর পর্যন্ত ভর্তাসহ রমণ করত স্বর্গ সুখ উপভোগ করিয়া থাকে। যাহাদের গৃহে পতিব্রতা রমণী অবস্থান করেন, সে গৃহের জনক জননীকে ধন্যবাদ এবং পতিব্রতার শ্রীমান পতিও ধন্যবাদার্হ। পতিব্রতার পুণ্যবলে পিতৃ, মাতৃ  ও পতিবংশীয় তিন তিন পুরুষ স্বর্গসুখ ভোগ করিয়া থাকেন।“ ( ব্রহ্মখণ্ড, ধর্মরণ্যাখণ্ড, ৭ম অধ্যায় ; প্রকাশক- শ্রীনটবর চক্রবর্তী)

“সনৎকুমার কহিলেন, হে ব্যাসদেব, যাহার শ্রবণমাত্র সর্বপাপ ক্ষয় হয়, ঐ উত্তম তীর্থ মাহাত্ম্য শ্রবণ করুন- এক দ্বিজাধম দাক্ষিণাত্য দেবল ব্রাহ্মণ ছিল। ঐ দেবল সদা পাপরত, লোভি, কূটসাক্ষী, লম্পট, গুরুদ্রোহী, কিতব, ধূর্ত, গুরুহা, গুরুতল্পগ, হেমহারী, সুরাপায়ী, ব্রহ্মহা, স্বামীদ্রোহী, অভক্ষ্যভক্ষক, বেদ বিবর্জিত, পাপী, সর্বধর্মবহিষ্কৃত, পাপী, অবিশ্বাসী, গর্বী, চোরসঙ্গরত, খল, দেশান্তরগত, মন্দ ও চৌরকার্যনিরত। ঐ পাপাত্মা বহু জন্তু নিহত করিয়াছিল। পাপকারীদের সহিত ঐ দুষ্ট মগধে গমন করে এবং সেখানে গিয়া দেখে , এক ব্রহ্মকর্মরত শুদ্ধসত্ত্ব সাগ্নিক বেদপারগ সংযমী ব্রাহ্মণ শ্বশুর গৃহ হইতে আপনার ভার্যাকে লইয়া যানারোহনে গমন করিতেছেন। তাহা দেখিয়া ঐ পাপাত্মা দেবল তাহাকে নিহত করে। তখন ঐ নিহত ব্রাহ্মণের রূপ লাবণ্যশালিনী পতিব্রতা স্ত্রী স্বীয় ভর্তাকে নিহত দর্শন করিয়া পতিবিরহে দুঃখার্তা ও কাতরা হইয়া তত্রত্য বনমধ্যে কাষ্ঠ আহরণ করিল এবং ঐ কাষ্ঠে চিতা নির্মাণ ও তাহা প্রদীপ্ত করিয়া হৃষ্টমানসে পতির সহিত তাহাতে আরোহণ করিল।“ (  আবন্ত্যখণ্ড, অবন্তীক্ষেত্রমাহাত্ম্য , ৫৩ অধ্যায় ; সম্পাদক- পঞ্চানন তর্করত্ন)

ব্রহ্ম পুরাণে সতীদাহ

ব্রহ্ম পুরাণে কপোত কপোতির উপাখ্যানে কপোত অগ্নিতে ঝাপ দিয়ে মারা গেলে, কপোতিকেও একই কাজ করতে দেখা যায় এবং কপোতির কথায় সহমরণের আদর্শ ফুটে ওঠে। খাঁচায় বদ্ধ কপোতি ব্যাধ লুব্ধককে বলে, “মহাশয়, দয়া করে আমাকে মুক্ত করে দিন। পতিবিহীন এই জীবনে আর কি প্রয়োজন? আমি এখনই এই অগ্নিতে দেহত্যাগ করবো।” ব্যাধ কপোতিকে মুক্ত করে দিলে কপোতি বলে, “সমস্ত অবস্থায় স্বামীর অনুগমন করাই স্ত্রী জাতির ধর্ম। বেদে এবং লোকসমাজে এই পথই প্রশস্ত বলে অভিহিত। পতিব্রতা নারী স্বামীর সাহায্যেই স্বর্গে গমন করে থাকে। যে নারী স্বামীর অনুগমন করে, সে বহুকাল পর্যন্ত স্বর্গে বাস করে।” তারপর সে যখন আগুনে প্রবেশ করল তখন আকাশে জয়ধ্বনি শোনা গেল। সেই পক্ষি দম্পতি সূর্যের মত উজ্জ্বল বিমানে স্বর্গে যেতে যেতে ব্যাধকে বলল- “মহাশয় আমরা দেবলোকে যাচ্ছি। এখন তোমার অনুমতি নিচ্ছি;কারণ তুমি আমাদের অতিথি। তোমার জন্যই আমাদের স্বর্গে যাওয়ার পথ প্রশস্ত হল। তোমাকে আমরা নমস্কার করি।”

(ব্রহ্ম পুরাণ,৮০ তম অধ্যায় ,অনুবাদক-অন্নদাশঙ্কর পাহাড়ী)

বৃহৎ নারদীয় পুরাণে সতীদাহ

“হায়! সেই সমস্ত রোগের গ্রাস হইতে হতভাগ্য বাহু আর নিষ্কৃতি পাইলেন না; অন্তঃসত্ত্বা অতীব দুঃখিনী ভার্যার শোকানল শতগুণে বর্ধিত করিয়া তিনি অবশেষে ঔর্ব্ব মুনির আশ্রম সমীপে ইহলোক হইতে বিদায় গ্রহণ করিলেন।

রাজনন্দিনী ও রাজার গৃহিণী হইয়া রাজমাতা হইবেন বলিয়া যিনি বড় সাধ করিয়াছিলেন , আজি তাহার সকল আশা ফুরাইবার উপক্রম হইল। তিনি পতিগত প্রাণা; পতি জগতে নিন্দনীয় হইলেও তাহার পক্ষে দেবতার তুল্য; রাজ্যসুখে জলাঞ্জলি দিয়াছেন, অতীত সুখের স্মৃতিকে বিসর্জন করিয়াছেন , স্বামীর দুঃখের সময় তাহার চরণ সেবা করিবেন বলিয়া অরণ্যবাসে তাহার অনুগমন করিয়াছেন; এক্ষণে রমণীর শিরোমণি স্বামীধনে বঞ্চিত হইলেন। তবে আর তাহার বাচিয়া সুখ কি? পতির শবদেহ ক্রোড়ে ধারণ পূর্বক অন্তর্বত্নী বাহুপত্নী বনের পশু পক্ষী কুলকে কাঁদাইয়া সেই বিজন অরণ্যমধ্যে একাকিনী হৃদয়বিদারক সুরে বিলাপ করিতে লাগিলেন। এইরূপে কিয়ৎকাল বিলাপ করিয়া তিনি  স্বামীর সহগমনে অভিলাষ করিলেন এবং কাষ্ঠাদি সংগ্রহান্তর একটি চিতা সজ্জিত করিয়া পতির মৃতদেহ তদুপরি স্থাপন করিলেন- পরে স্বয়ং তাহাতে আরোহণ করিতে উদ্যত হইলেন। এমন সময়ে পরমযোগী ঔর্ব্ব মুনি মহৎ সমাধিবলে সমস্ত বিষয় জানিতে পারিয়া ত্বরিত গতিতে সেই চিতার নিকট উপস্থিত হইলেন এবং সহমরণোদ্যতা সতীকে নিবর্তিত করিয়া সস্নেহে কয়েকটি ধর্মমূল কথা বলিলেনঃ- হে সাধ্বী! নিবৃত্ত হও, নিবৃত্ত হও, অতি সাহস করিও না। তোমার গর্ভে রাজচক্রবর্তী রহিয়াছেন, তিনি শত্রুকুল সংহার করিয়া সমস্ত দুঃখ দূর করিবেন। হে পতিব্রতে! যাহারা গর্ভিণী, বালপত্যা , অদৃষ্ট ঋতু অথবা রজঃস্বলা তাহাদের চিতারোহণ করা কর্তব্য নহে। লোকে ব্রহ্মহত্যা করিলে বরং নিষ্কৃতি পাইতে পারে কিন্তু ভ্রূণ হত্যাকারীর কিছুতেই মুক্তি নাই। যাহারা দাম্ভিক, নিন্দুক, নাস্তিক, কৃতঘ্ন অথবা বিশ্বাসঘাতক; যাহারা ভ্রূণ নষ্ট করে অথবা ধর্মে উপেক্ষা করিয়া থাকে, তাহারা কিছুতেই নিষ্কৃতি পায় না। অতএব হে ভাবিনী এই মহাপাপের অনুষ্ঠান তোমার কখনো উচিত নহে।“ ( সপ্তম অধ্যায় ; অনুবাদক- শ্রীযুক্ত বাবু যজ্ঞেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায়)

ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে

ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ অনুসারে পরশুরামের পিতা মারা গেলে তার মাতা রেণুকা মৃত স্বামীর সাথে সহমৃতা হয়েছিলেন। রেণুকাকে ঋষি ভৃগু বলেছিলেন, ” হে পতিব্রতে! তুমি অদ্যই তোমার সেই পূণ্যবান স্বামীর অনুগমন কর; যেহেতু নারীগণ রিতুর চতুর্থ দিবসে স্বামীর কার্যের অধিকারী হয় বটে, কিন্তু দৈব কার্য কিংবা পিতৃকার্য করিতে চতুর্থ দিবসে অধিকারিণী নহে; পঞ্চম দিবসাবধি দৈব ও পিতৃকার্যে স্ত্রীলোকের অধিকারীত্ব হয়। যেরূপ সর্পোপজীবি মনুষ্য বলপূর্বক গর্ত হইতে সর্পগণকে উত্থাপিত করে, সেইরূপ পতিব্রতা রমণী নিজকৃ্ত সুকৃত দ্বারা স্বামী পাপিষ্ঠ হইলেও তাহাকে লইয়া স্বর্গধামে গমন করিতে সমর্থা হয়। চতুর্দশ ইন্দ্র যত কাল পর্যন্ত স্বর্গরাজ্য ভোগ করেন, পতিপ্রাণা সাধ্বী রমণী নিজপতির সহিত সুখভোগ করত তাবৎকাল পর্যন্ত স্বর্গধামে অবস্থিতি করে।” এরপর রেণুকা ভৃগুকে জিজ্ঞেস করেন, ” হে মুনিবর! ভারতবর্ষমধ্যে কোন কোন রমণী স্বামীর সহগমনে অধিকারিণী হয় এবং কোন কোন স্ত্রীলোকইবা স্বামীর সহগমনে অধিকারিণী নহে? হে তপোধন! আমার নিকটে তাহা বিশেষ করিয়া নির্দেশ করুন। ভৃগুমুনি রেণুকাকে বলিলেন, যে নারীর পুত্র বালক, যাঁহার গর্ভলক্ষণ হইয়াছে, যাঁহার ঋতুকাল উপস্থিত হয় নাই, যে স্ত্রী ঋতুমতী, যে স্ত্রী ব্যভিচারিণী, যাহার গলিতকুষ্ঠ প্রভৃতি মহারোগ আছে, যে স্ত্রী পূর্বে স্বামী-শুশ্রুষা-কার্যে পরাঙ্মুখী ছিল, যাহার পতিভক্তি নাই এবং যে স্ত্রী স্বামীর প্রতি সর্বদা কটূ বাক্য প্রয়োগ করে; এ সকল স্ত্রীলোক যদ্যপি ইহলোকে সুখ্যাতিলাভবাসনায় কদাচিৎ স্বামীর সহগমন করে, ইহারা পরলোকগত হইয়াও পরলোকগত স্বামীর নিকট গমনে সমর্থা হয় না। এ সকল স্ত্রীলোকের স্বামী সহগমনে অধিকার নাই। এতদিরিক্ত নারীগণ, চিতাশয়ান পতির চিতার সম্মুখে সংস্কৃত অগ্নি প্রদান করিয়া নিজ কান্তের অনুগমন করিবে। সেই সকল স্ত্রীলোকই পরলোকগতা হইয়া নিজকৃত সুকৃতের ফল সমভিব্যাহারে লইয়া প্রতিজন্মে নিজ স্বামীকে প্রাপ্ত হয়। … পতিব্রতা নারী যে কোন স্থানে বিষ্ণুভক্তিপরায়ণ নিজ কান্তের সহমৃতা হইলেই পরলোকে নিজ পতির সহিত বৈকুন্ঠধামে গমন করিয়া গোলোকপতি বিষ্ণুর সমীপে স্থানপ্রাপ্তি-বিষয়ে অধিকারিণী হয়।”

এসব উপদেশের পর রেণুকা তার মৃত স্বামীর সাথে সহমৃতা হন-

“রেণুকা সতী নিজ পুত্রক পরশুরামকে এরূপ উপদেশ করিয়া তাহাকে পরিত্যাগ পূর্বক তৎক্ষণাৎ চিতারূঢ় মৃত স্বামীর দেহ টানিয়া হৃদয়োপরি স্থাপনান্তে হরিনাম স্মরণ করিতে করিতে নিশ্চেষ্টভাবে চিতায় শয়ন করিলেন। রেণুকা সতী চিতায় শয়ন করিলে পর পরশুরাম ভ্রাতৃগণের সহিত চিতার চতুর্দিকে অগ্নি প্রদান করিয়া ভ্রাতৃগণ ও পিতার শিষ্যবর্গের সহিত বহু বিলাপ করিলেন। রেণুকা সতী নিজ পুত্রকে সম্বোধন করিয়া ‘রাম রাম’ এই শব্দটি উচ্চারণ করিতে করিতে নিজপুতের সম্মুখেই ভস্মাবশেষ হইয়া গেলেন। তখন প্রভুর নাম শ্রবণানন্তর বিষ্ণুদূতগণ তথায় উপস্থিত হইল। তাহারা সকলেই কৃষ্ণ বর্ণ মনোহর চতুর্ভুজ, শঙ্খ, চক্র, গদা এবং পদ্মধারী, বনমালা-পরিশোভিতকণ্ঠ; তাহাঁদিগের মস্তকে কিরীট, কর্ণে কুণ্ডল, পরিধানে কৌশেয় পীতাম্বর। তাহারা রথারোহণপূর্বক সেও চিতাভূমির নিকটে আগমনপূর্বক রেণুকা সতী ও জমদগ্নি মুনিকে রথারূঢ় করাইয়া ব্রহ্মলোকে গমন করত বিষ্ণু সমীপে সমাগত হইল। রেণুকা সতী ও জমদগ্নি মুনি, বিষ্ণুলোকে আনীত হইলে পর বৈকুন্ঠধামে শ্রীহরির নিকটবর্তী স্থানে স্থান প্রাপ্ত হওয়াতে নিয়ত অতীব মঙ্গলকর শ্রীহরির দাস্যকার্য আচরণ করত পরমসুখে অবস্থিতি করিতে লাগিলেন” ( ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ, গণেশখণ্ড, অধ্যায় ২৮ ; অনুবাদ ও সম্পাদনাঃ পণ্ডিতবর শ্রীযুক্ত পঞ্চানন তর্করত্ন; নবভারত পাবলিশার্স)

রঘুনন্দনের শুদ্ধিতত্ত্বম গ্রন্থে সতীদাহ

সহগমন বা অনুগমন- অঙ্গীরা বলিয়াছেন , “ স্বামীর  মৃত্যুর পর যে স্ত্রী চিতানলে আরোহণ করে , সেই অরুন্ধতি সদৃশ পবিত্রাচার সম্পন্না রমণী স্বর্গ লোকে পূজা লাভ করে । যে রমণী স্বামীর অনুগমন করে, সে মনুষ্য শরীরে স্থিত সার্ধ তিনকোটি লোম পরিমিত বৎসর যাবৎ স্বর্গলোকে বাস করে।  সাপুড়ে যেমন গর্ত হইতে সাপ বাহির করে , সেই সাধ্বী স্ত্রীও সেইরূপ স্বীয় ভর্তাকে অধোগতি হইতে  বলপূর্বক উদ্ধার করিয়া তাহার সহিত আনন্দে কালযাপন করে । যে স্ত্রী স্বামীর অনুগমন করে সে নিজের মাতৃকুল, পিতৃকুল এবং যে কুলে প্রদত্ত হয় , অর্থাৎ শ্বশুর কুল, এই তিনকুলকে পবিত্র করে। সেই পতিদেবতা রমণী চতুর্দশ ইন্দ্রের অধিকার কাল অবধি স্বর্গলোকে উৎকৃষ্ট ভোগের সহিত বাস করে।“ মূল বচনে যে ভর্তৃপরমা শব্দটি আছে, তাহার অর্থ ভর্তাই পরম (উপাস্য) যার, অর্থাৎ পতিদেবতা। ব্যাস স্মৃতিতেও এই বচনটি দৃষ্ট হয় , তবে ‘পরা পরমলালসা’ ইহার পরিবর্তে ‘স্তুয়মানাপ্সরোগণৈঃ’ এইরূপ পাঠ করা হইয়াছে। উহার অর্থ ‘অপ্সরাগণ কর্তৃক স্তুয়মানা হইয়া’ । আঙ্গিরস বলিয়াছেন যে, “ ঐ সাধ্বী স্ত্রী , স্বকীয় স্বামী ব্রহ্মঘ্ন, কৃতঘ্ন এবং মিত্রঘ্ন হইলেও তাহাকে পবিত্র করে। ভর্তার মৃত্যুর পর চিতানলে পতন ভিন্ন সাধ্বী রমণীগণের আচরণীয় আর কোন প্রকার ধর্ম নাই। “ উপরিউক্ত অঙ্গিরার বচনে ‘যে স্ত্রী’ এইরূপ কথা বলায় সকলের পক্ষেই যে সহমরণ অবশ্য কর্তব্য এরূপ বুঝাইতেছে না , উহাদ্বারা কোন স্ত্রী ইচ্ছা না হইলে সহমরণ না করিতেও পারে, ইহাই সূচিত হইতেছে। তবে যে আর একটি বচনে ‘অন্যকোনো ধর্ম নাই’ এইরূপ বলা হইয়াছে , উহা সহমরণের স্তুতিবাদ মাত্র। ইহার দ্বারা এরূপ বুঝাইতেছে না যে , ভর্তার মৃত্যুর পর স্ত্রীদিগের একমাত্র সহমরণই কর্তব্য।  কারণ শাস্ত্রে বিধবা স্ত্রীর পক্ষে ব্রহ্মচর্যাদি অপর ধর্মেরও নির্দেশ করা হইয়াছে। তবে সেই সকলের মধ্যে সহমরণই শ্রেষ্ঠ, উহার তুল্য আর কিছুই নাই ; উহার এইরূপ তাৎপর্যই বুঝিতে হইবে। স্ত্রীদিগের সহমরণ ভিন্ন অন্য প্রকার ধর্মও যে আচরণীয় আছে, সেই সম্বন্ধে  বিষ্ণু এইরূপ বলিয়াছেন, যথা- “স্বামীর মৃত্যু হইবার পর (স্ত্রীগণের পক্ষে) ব্রহ্মচর্যের অনুষ্ঠান অথবা তদীয় চিতায় আরোহণ (এই উভয় প্রকার ধর্ম নির্দিষ্ট হইয়াছে)। “ উপরে যে ব্রহ্মচর্যের কথা বলা হইল , তাহার অর্থ- মৈথুন পরিত্যাগ, তাম্বুলাদি ব্যবহার পরিত্যাগ। প্রচেতা ব্রহ্মচর্যব্যবস্থায় এইরূপ কার্য করিতে উপদেশ করিয়াছেন । যথা- “যতি, ব্রহ্মচারী এবং বিধবাগণ তাম্বূল সেবন, অভ্যঞ্জন এবং কাশ্যপাত্রে ভোজন পরিত্যাগ করিবে।“ উক্ত বচনে ‘অভ্যঞ্জন’ কথাটি আছে , তাহা একটি আয়ুর্বেদোক্ত পারিভাষিক শব্দ ,- যাহাকে প্রচলিত ভাষার আভাং করে তেল মাথা বলা হয়। যথা- ‘যেরূপ তৈল মর্দনে মস্তকে ঢালা তেল আপনা আপনি সর্বাঙ্গে অধিক পরিমাণে সংলগ্ন হয় এবং উভয় বাহুকে প্লাবিত করে , তাহার নাম অভ্যঙ্গ এবং যেরূপ তৈল মর্দনে মস্তকে অর্পিত তৈল সর্বাঙ্গে  অল্প মাত্রায় সংলগ্ন হয় এবং উভয় বাহুকে প্লাবিত করে না তাহার নাম ‘তৈল মাখা’, উহা অভ্যঙ্গ হইতে পৃথক।  ২

স্মৃতিতে বলা হইয়াছে ; “বিধবা স্ত্রী একবার মাত্র আহার করিবে , কদাচ দুইবার খাইবে না এবং যে বিধবা হইয়া পর্যঙ্কে শয়ণ করে, সে আপনার পতিকে অধঃপতিত করে । সে (বিধবা) কদাচ গন্ধ দ্রব্যের সম্ভোগ করিবে না এবং প্রত্যহ তেল, কুশ ও উদক দ্বারা ভর্তার তর্পণ করিবে।“ মদন পরিজাতকার বলেন, এই যে বিধবা কর্তৃক তর্পণের কথা বলা হইয়াছে , উহা যে স্থলে মৃত ব্যক্তির পুত্র পৌত্রাদির অভাব  ঘটিবে, সেই স্থলের জন্যই বুঝিতে হইবে। বিধবাগণ বৈশাখ এবং কার্ত্তিক মাসে একটা একটা ব্রতবিশেষের আচরণ করিবে এবং স্নান, দান ও সর্বদা শ্রী বিষ্ণুর নাম জপ করিবে।“ ৩

হারীত সাধ্বীদিগের এইরূপ লক্ষণ করিয়াছেন – “ যে স্ত্রী পতির পীড়ায় আপনাকে পীড়িত বোধ করে, পতির আনন্দে আনন্দিত হয় , পতি বিদেশগত হইলে মলিন ও কৃশ হয় এবং স্বামীর মৃত্যুতে আপনিও মরিয়া যায় তাহাকে পতিব্রতা সাধ্বী বলে।“ কল্পতরুতে এই বচনটিকে ছান্দোগ্য পরিশিষ্টীয় বলিয়া নির্দেশ করা হইয়াছে। সাধ্বীগণের পুণ্যবলে যে জগত অবস্থান করিতেছে একথা মৎস্য পুরাণে বলা হইয়াছে , যথা- “ অতএব মনুষ্যগণ সাধ্বী স্ত্রীদিগকে দেবতার ন্যায় পূজা করিবে , তাহাদের প্রসাদেই রাজা ত্রিজগৎ ধারণ করিতেছেন ।“ মহাভারতে বলা হইয়াছে – “যে সকল স্ত্রী প্রথমে পতিকে ঘৃণার সহিত দর্শন করে অথবা যাহারা পতির প্রতিকূলে বর্তমান হয় , তাহারা সকলেও যদি যথাসময় , কামবশেই হোক, ক্রোধবশেই হোক , অথবা ভয়েতেই হোক সহমরণ করে  তাহলেও পবিত্র হয়।“ পূর্বে যে “সহগামিনী ব্রহ্মঘ্ন পতিকেও উদ্ধার করে “ এইরূপ বলা হইয়াছে, উহা দ্বারা “জন্মান্তরীণ ব্রহ্মহত্যা পাপ বিশিষ্ট পতিকে” এইরূপই বুঝিতে হইবে, কেন না ইহজন্মে ব্রহ্মহত্যাকারীর দাহই নাই।  ৪

ব্রহ্মপুরাণে বলা হইয়াছে- “ স্বামী দেশান্তরে মৃত হইলে , সাধ্বী স্ত্রী তাহার পাদুকাদ্বয় আপনার বক্ষঃস্থলে স্থাপন পূর্বক সম্যক প্রকারে বিশুদ্ধ হইয়া চিতানলে প্রবেশ করিবে।“ ঋগ্বেদের মন্ত্র অনুসারে ঐরূপে অনুমৃতা স্ত্রীর আত্মহত্যা জনিত পাপ হইবে না। ঐরূপে স্বপতির অনুগামিনী স্ত্রীর তিনদিন অশৌচ অতীত হইবার পর শাস্ত্রবিধি অনুসারে শ্রাদ্ধ করিতে হইবে।“ মূল বচনে যে ঋগ্বেদের মন্ত্র বলা হইয়াছে উহা দ্বারা “ এই বিধবা রমণী” ইত্যাদি বক্ষ্যমাণ মন্ত্রই বুঝিতে হইবে।  বিবাদকল্পতরু এবং রত্নাকরে যে বলা হইয়াছে , “অঙ্গীরা এবং ব্রহ্মপুরাণের বচন পর্যালোচনা দ্বারা ইহা জানা যাইতেছে যে , গর্ভবতী এবং বালাপত্যা (শিশু সন্তানযুক্ত) স্ত্রীভিন্ন , নিজের ও স্বামীর মঙ্গল প্রার্থিনী ব্রাহ্মণাদি সকল বর্ণের ভার্যা মাত্রেরই সহমরণে এবং অনুমরণে অধিকার আছে। “ তাহাতে বক্তব্য এই যে , ঐ বাক্যে ব্রাহ্মণী প্রভৃতির যে অনুমরণে অধকার আছে বলা হইয়াছে , উহা অসঙ্গত হইয়াছে । এ সম্বন্ধে মিতাক্ষরায় এবং দেববোধ কৃৎ যাজ্ঞবল্ক্যের টীকায় গৌতমের এইরূপ একটি বচন উদ্ধৃত হইয়াছে , যথা- ব্রাহ্মণী পৃথক চিতায় আরোহণ করিয়া ভর্তার অনুগমন করিবে না।“ অতএব ব্রাহ্মণীদিগের কেবল সহমরণেই অধিকার এবং অপরজাতীয় স্ত্রীদিগের সহমরণ এবং অনুমরণ , এই উভয়েই অধিকার।  কল্পতরু রত্নাকর এবং শুদ্ধিচিন্তামণি প্রভৃতি গ্রন্থে ‘পাদুকাদ্বয়’ এই স্থলে ‘পাদুকাদিকং’ এই পাঠ আছে , সে পাঠ অপপাঠের মধ্যেই গণ্য। কিন্তু বিবেচনা করিয়া দেখিলে ইহাই প্রতীত হয় যে , ‘পাদুকাদ্বয়ের’ দ্বারা এইস্থলে পতি সম্বন্ধীয় দ্রব্য বিশেষেরই উপলক্ষণ করা হইয়াছে মাত্র। কারণ উশনা স্মৃতিতে ব্রাহ্মণী ভিন্ন স্ত্রীদিগের কোনো দ্রব্যবিশেষ না লইয়াও পৃথক চিতারোহণ মাত্র উল্লেখ হইয়াছে। উশনার সেই বচনটি এই- “ ব্রাহ্মণী পৃথক চিতায় আরোহণ করিয়া স্বামীর অনুগমন করিবে না । অপর বর্ণজাত স্ত্রীগণের পক্ষে এই পৃথক চিতায় আরোহণ পূর্বক স্বামীর অনুগমনই স্ত্রীজাতিকর্তব্য শ্রেষ্ঠ ধর্ম বলিয়া শাস্ত্রে কথিত হইয়াছে ।“ মদনপরিজাতকারও এইরূপ মীমাংসা করিয়াছেন। শিষ্টাচারও এইরূপ দৃষ্ট হয়।  ৫

কৃত্যতত্ত্বার্ণবে বৃহন্নারদীয় হইতে নিম্নলিখিত বচনটি উদ্ধৃত হইয়াছে – “ হে কল্যাণি, রাজপুত্রি, যে সকল স্ত্রী বালাপত্যা অর্থাৎ যাহাদের কোলে শিশু সন্তান , যাহারা গর্ভবতী, যাহাদের রজোদর্শন হয় নাই  এবং যাহারা রজঃস্বলা ইহারা চিতারোহণ করে না।“ মূল বচনস্থিত ‘রাজসূতে’ এই পদটি সগর রাজার মাতাকে সম্বোধন করিয়া বলা হইয়াছে। বৃহস্পতি বলেন- “ বালাপত্যা স্ত্রী স্বকীয় কোলের ছেলের পোষণ পরিত্যাগ করিয়া অনুগমন করিবে না, রজঃস্বলা এবং সূতিকাও অনুগমন করিবে না।  গর্ভবতীর পক্ষে আপনার গর্ভ রক্ষা অবশ্য কর্তব্য। “ উপরি উক্ত বৃহস্পতির বচনে বালাপত্যাকে স্বকীয় কোলের ছেলের পোষণ পরিত্যাগ করিয়া অনুগমন করিতে নিষেধ করায় , ঐ বালকের পোষণের ব্যবস্থা যদি অন্যের দ্বারা সম্ভবপর হয়, তাহা হইলে বালাপত্যারও চিতারোহণ শাস্ত্রনিষিদ্ধ হয় না।“  ৬

ব্যাস বলেন, – “ সহগমনে কৃতনিশ্চয়া সাধ্বী  যদি মৃত স্বামীর স্থিতিস্থান হইতে একদিনে যাওয়া যায় , এইরূপ দূরদেশে মাত্র অবস্থান করে , তাহা হইলে স্বামীর মৃত্যু সংবাদ শ্রবণের পর যে পর্যন্ত সেই সাধ্বী মৃত্যুস্থানে আগমন না করে , সে পর্যন্ত শবদেহের দাহ করিবে না। “ ভবিষ্য পুরাণে বলা হইয়াছে  “ হে দ্বিজগণ ! যদি রজঃস্বলা স্ত্রীর তৃতীয় দিনের দিন স্বামীর মৃত্যু হয়, তাহা হইলে  উহার অনুগমনার্থ একরাত্র শবদেহ রক্ষা করিবে ।“ মূল বচনে যে “তস্য” ( উহার) এই কথাটি আছে, তাহার অর্থ স্বামীর।  ভবিষ্য পুরাণে আরও বলা হইয়াছে যে, “ যে স্ত্রী এক চিতায় আরোহণ করিয়া স্বামীর অনুগমন করিবে , স্বামীর ঔর্দ্ধদৈহিক ক্রিয়ার কর্তাই  ঐ স্ত্রীর ঔর্দ্ধদৈহিক ক্রিয়াও করিবে।“ উপরে যে ঔর্দ্ধদৈহিক ক্রিয়ার কথা বলা হইয়াছে , উহাতে পুরকপিণ্ডদানান্ত ক্রিয়াই বুঝিতে হইবে, কারণ তাহলেই “যে  ব্যক্তি  প্রেতের মুখাগ্নি করিবে পুরকপিণ্ড সেই ব্যক্তিই প্রদান করিবে।“ এই বায়ুপুরাণের বচনের সহিত উপরিউক্ত বচনের একবাক্যতা হয় । ব্রহ্মপুরাণে বলা হইয়াছে, “প্রাজ্ঞ ব্যক্তি সেই স্বামীকুলের গৌরবরক্ষাকারিণী স্ত্রীকে যৎকাল স্বামীর চিতায় স্থাপিত করিবেন তৎকালে সহগমণকারিণীগণের যে সকল শ্রেষ্ঠ ধর্ম লাভ হয় তাহা শুনাইয়া দিবেন এবং এই মন্ত্রটি পাঠ করিবেন ‘এইস্থলে যে সকল পবিত্রচরিত্রা পতিব্রতাগণ অবস্থান করিতেছেন তাহারা সকলেই স্বামীর শরীরের সহিত অগ্নিতে প্রবেশ করুন।‘ এই মন্ত্র শুনিয়া যে স্ত্রী ভক্তি ও শ্রদ্ধা সহকারে পিতৃমেধযজ্ঞ করে , সে স্বর্গ লাভ করে, সে স্বর্গ প্রাপ্ত হয়।“ উপরি উক্ত মূল সংস্কৃত বচনে ‘প্রমীতে’ শব্দের অর্থ-  স্বামী মৃত হইলে এবং পিতৃমেধ যজ্ঞ শব্দের অর্থ – চিতাধিরোহণ পাদুকা গ্রহণ পূর্বক অনুমরণ করিলেও ‘সহ ভর্ত্তুঃ শরীরেণ ‘ ( ভর্তার শরীরের সহিত) ইত্যাদি মন্ত্র অবিকলই পাঠ করিতে হইবে, ভর্তার পাদুকার সহিত এইরূপে মন্ত্রের পরিবর্তন করিতে হইবে না ; কারণ অনুমরণের সময় যে পাদুকা গ্রহণের কথা বলা হইয়াছে , ঐ পাদুকাও ‘পতি দেশান্তরে মৃত হইলে ‘ ইত্যাদি বচন দ্বারা , শরীরের প্রতিনিধি রূপেই যে গৃহীত হয় , ইহাই বুঝাইতেছে এবং প্রতিনিধিস্থলে যে , যথাশ্রুত অর্থাৎ মন্ত্রটি প্রথমে যেমন উক্ত হইয়াছে , সেইরূপ পাঠ করিতে হইবে, সেকথা কাত্যায়ণ বলিয়াছেন । যথা, – যথাশ্রুত শব্দের প্রয়োগে কোনোরূপ মতভেদ দৃষ্ট হয় না। “ একথা একাদশীতত্ত্বে বিস্তৃতভাবে আলোচিত হইয়াছে। ৭

কেহ আশঙ্কা করিয়াছিল- আমরা কাশ্যপের একটি বচন দেখিতে পাই , অগ্নিপ্রবিষ্ট, জলপ্রবিষ্ট, ভৃগুপতনে, সংগ্রামে বা দেশান্তরে মৃত ব্যক্তিদিগের এবং জাতদন্ত বালকদিগের মরণে তিন রাত্রের পর শুদ্ধি হইবে। এই কাশ্যপের বচনানুসারে সহমৃতা স্ত্রীরও অগ্নিপ্রবেশে মৃত্যু হওয়ায় ত্রিরাত্র অশৌচ হইবে , কাজে ঐ ত্রিরাত্রাশৌচের মধ্যেই তার পূরক পিণ্ড দান করাইত উচিত হয়? ইহার উত্তরে স্মার্ত বলিতেছেন , “ ন চ বাচ্যম” একথা বলিতে পার না। পূর্বেই এই আপত্তির উত্তর এক প্রকার বলা হইয়াছে , কারণ ব্রহ্মপুরাণের বচনে কেবলমাত্র পৃথক চিতায় আরোহণকারীর পক্ষেই ত্রিরাত্রাশৌচের বিধান করায় , পৃথক চিতারোহণ ভিন্ন স্থলে যে , স্ত্রীর অশৌচ স্বামীর অশৌচের তুল্য হইবে , ইহাই প্রতীত হইতেছে। আরও একটি কথা, যদিও তোমার জেদের অনুরোধে সহমরণে কাশ্যপোক্ত তিনরাত্রিমাত্র অশৌচ স্বীকার করা যায়, তাহইলেও সেই অশৌচ পতির মৃত্যুর জন্য অশৌচের যোগে বৃদ্ধি পাইয়া পতির অশৌচের অন্তদিন অবধি স্থায়ী হইবে। কারণ পূর্বজাত দশাহ অশৌচের মধ্যে যদি আর একটি জনন বা মরণাশৌচ সংঘটিত হয় তাহলে পূর্বোক্ত দশাহ অশৌচের যে কাল পর্যন্ত অন্ত না হয় ব্রাহ্মণ সেই পর্যন্ত অশুচি হইবে।“ এই মনুবচন দ্বারা অশৌচ সঙ্কর ঘটিলে পরজাত অশৌচের যে পূর্বজাত অশৌচের সহিত শেষ হয়, তাহাই প্রতীত হইতেছে । অতএব অশৌচের সঙ্কর হ্রাস হইলে যেমন সেই সঙ্কুচিত অশৌচ কালের মধ্যে সঙ্কলন হিসাব করিয়া পূরকপিণ্ড দান করিতে হয় , সেইরূপ অশৌচ কালের বৃদ্ধি স্থলেও যতকাল অশৌচ থাকিবে , তন্মধ্যে দশপিণ্ড দিতে হইবে।  ৮

এই জন্যই জিকণ প্রণীত অন্ত্যেষ্টিবিধি নামক গ্রন্থে এবং অনুমরণ বিবেক নামক গ্রন্থে ব্যাসের এইরূপ একটি বচন উদ্ধৃত হইয়াছে,  “যে স্ত্রী মৃত পতিকে আলিঙ্গন করিয়া হুতাশনে প্রবেশ করে , পতির পূরক পিণ্ডের ন্যায় ক্রমশ তাহারও পূরক পিণ্ড দান করিতে হইবে। “ বিষ্ণু বলিয়াছেন- “ স্বামীর সহিত একচিতারোহণকারিণী রমণীকে যখন প্রতিদিন স্বামীর সহিত পিণ্ডদান করা হয় , অতএব তাহাকে আত্মঘাতিনী বলা যায় না।“ ঐ মূল বচনে ‘অনু’ শব্দ আছে তাহার অর্থ সহ।  কেননা তাহা হইলে, ” পতিকে আলিঙ্গন করিয়া ইত্যাদি বচনের সহিত এই বচনের একবাক্যতা হয়। অতএব এইরূপ ব্যবস্থা স্থির হইল যে , স্বামীর অশৌচের মধ্যে পৃথক চিতায় আরোহণকারিণীর পূরক পিণ্ড দান করিবে। স্বামীর অশৌচের অন্ত হইলে কিন্তু শ্রাদ্ধ করিবে। কারণ আমরা জিকণ কর্তৃক উদ্ধৃত  পৈঠীনসীর একটি বচন দেখিতে পাই যে , “ অনুমরণকারীর উদ্দেশ্যে তিনদিনেই দশ পিণ্ড দান করিবে এবং স্বামীর অশৌচ অতীত হইলে তাহার শ্রাদ্ধ করিবে।“ শূলপাণি এই বচনটিকে অগ্নিপুরাণীয় বলিয়া স্থির করিয়াছেন। ঐ বচনস্থিত অনু শব্দের পশ্চাৎ অর্থ, অর্থাৎ স্বামীর দাহের পর। কিন্তু স্বামীর মৃত্যুর জন্য অশৌচকাল অতীত হইবার পর যদি কোন স্ত্রী মৃত স্বামীর পাদুকাদি গ্রহণ পূর্বক জ্বলন্ত চিতানলে প্রবেশ করে, তাহলে তাহার পক্ষে ত্রিরাত্র মাত্র অশৌচের ব্যবস্থা থাকায় , তাহার তিন দিনেই পূরক পিণ্ড এবং চতুর্থ দিনে শ্রাদ্ধ করিবে। পূর্বোল্লিখিত ব্রহ্মপুরাণের বচনে ঐরূপই বিধান করা হইয়াছে।  ৯

কিন্তু যে স্থলে স্বামীর যুদ্ধক্ষেত্রে হত হওয়া প্রভৃতি কারণ নিবন্ধন সদ্যঃ শৌচ হইবে অর্থাৎ একদিনেই অশৌচের অপগম হইয়া শুদ্ধি হইবে , সেরূপ স্থলে স্ত্রী যদি ভর্তার অশৌচ কালের মধ্যে ভিন্ন চিতায় আরোহণ করে  তাহলে পৃথক চিতারোহণে মৃতা স্ত্রীর অশৌচ, পূর্বোক্ত ব্রহ্মপুরাণের বচনানুসারে ত্রিরাত্র স্থায়ী হওয়ায় স্বামীর অশৌচ অপেক্ষা বহুকালব্যাপী সুতরাং উহাকে গুরু বলিতে হইবে, কাজেই ঐ স্ত্রীর অশৌচের সহিতই পূর্ব অশৌচ অর্থাৎ স্বামীর অশৌচ অপগত হইবে এবং স্বামীর পূরক পিণ্ডও তিনদিনের দিন দিতে হইবে। কিন্তু যদি সংগ্রামে নিহত প্রভৃতি স্বামীর সহিত স্ত্রী একচিতায় আরোহণ করে , তাহলে স্বামীর অশৌচের নিবৃত্তির সহিতই শুদ্ধি হইবে। পূর্বোল্লিখিত “মৃত পতিকে আলিঙ্গন করিয়া” ইত্যাদি  এবং “স্বামীর সহিত এক চিতারোহণকারিণী রমণীকে”ইত্যাদি বচন দ্বারা এইরূপই স্থির করা হইতেছে এবং অগ্নিপ্রবেশে মৃত ব্যক্তির সুমন্ত যে সদ্যশৌচ বিধান করিয়াছেন তাহাও … খাটিতেছে; সুমন্তুর বচনটি যথা- “ ভৃগুপতনে, অগ্নিপ্রবেশে, জলে ডুবে, যুদ্ধ ক্ষেত্রে, দেশান্তরে, সন্ন্যাস গ্রহণের পর, অনশন ব্রত করিয়া, বজ্রাঘাতে এবং মহাপথ গমনে মৃত ব্যক্তিদিগের উদকক্রিয়া অবশ্য কর্তব্য কিন্তু তাহাদের সদ্যশৌচ হইবে। মূল বচনে যে ভৃগু কথাটি আছে তাহার অর্থ উচ্চদেশ, মহাধ্বনিক শব্দের অর্থ যে ব্যক্তি পুণ্য সঞ্চয়ার্থ হিমালয়াবধিক মহাপথ গমন দ্বারা আপনার মৃত্যুর সম্পাদন করিয়াছে। কেহ বলিয়াছিল হারলতা নামক গ্রন্থে যে “বেদাধ্যাপক, অগ্নিহোত্রী প্রভৃতি একাহাশৌচী ব্যক্তিগণ নিত্যঃ সদ্যশৌচ করিবে।“ এইরূপে সদ্যশৌচের অধিকারী নিশ্চিত হইয়াছে।সুমন্তু কর্তৃক ভৃগু পতনাদিতে মৃত ব্যক্তির সদ্যশৌচের বিধানও তাহাদের সম্বন্ধেই বুঝিতে হইবে। তুমি যে সংগ্রামে নিহত স্বামীর সহিত একচিতাধিরোহণে মৃতার পক্ষে লাগাইতেছ তাহা নহে। স্মার্ত বলিতেছেন- একথা বলিতে পার না, কেননা, সুমন্তুর উক্ত বচনের যে, কেবল মাত্র বেদাধ্যাপকাদিই বিষয় তাহার কোন প্রমাণ নাই অর্থাৎ সুমন্তু বচনের তথাবিধ একাহাশৌচী এবং এইরূপে সহমৃতা এই উভয়ই বিষয়। আরও দেখ, উক্ত বচনটি যখন সামান্যতঃ সকল প্রকার অগ্নিপ্রবেশে মৃত্যু বিষয়ে উক্ত হইয়াছে, ‘এবং মৃত পতিকে আলিঙ্গন করিয়া ইত্যাদি’ বচনান্তরের সহিত উহার অর্থ সমন্বয় ঘটিতেছে, তখন উহাকে একচিতারোহণমৃতাবিষয়কও বলা যাইতে পারে । তাহা না বলিয়া যদি হারলতার বাক্যকে প্রমাণ করিয়া ভৃগুপতনাদিতে মৃত্যু জন্য সদ্যশৌচ কেবল বেদধ্যাপকাদির পক্ষেই বলা হয় , তবে হারলতার আর একটি বাক্য আছে যে ,” কাশ্যপ যে অগ্নি, জল ও সংগ্রামে প্রবিষ্টাদিগের ত্রিরাত্রাশৌচের কথা বলিয়াছেন , উহা প্রমাদবশতঃ অগ্নিতে, জলে বা সংগ্রামে যাহারা মৃত হয় , তাহাদের পক্ষেই বুঝিতে হইবে; ইচ্ছাপূর্বক অগ্নি প্রভৃতিতে প্রবিষ্ট হইয়া মৃত ব্যক্তিদিগের পক্ষে নহে” এই বাক্যানুসারে অনুমৃতাদিগেরও ত্রিরাত্রাশৌচ হইতে পারে না। অতএব কাশ্যপের বাক্যটিকে ব্রহ্মপুরাণে ত্রিরাত্রশৌচ বিষয়ক বচনের সহিত একবিষয়কই বুঝিতে হইবে।

ব্রহ্মপুরাণে যেরূপ চিতানলে প্রবেশস্থলে ত্রিরাত্রশৌচ বিহিত হইয়াছে , কাশ্যপের বচনেও সেইরূপ অগ্নিপ্রবেশে মৃত্যুই অভিপ্রেত বলিতে হইবে , কাজেই সুমন্তুর বাক্যটিকেও সংগ্রাম নিহত স্বামীর সহমরণ বিষয়ক বলিতে হইবে। ১০

( শুদ্ধিতত্ত্বম্ ; লেখকঃ স্মার্ত শ্রীরঘুনন্দন ভট্টাচার্য ; বাংলা অনুবাদকঃ শ্রী হৃষীকেশ শর্মা ; প্রকাশকঃ শ্রী নটবর চক্রবর্তী )

দ্বিতীয় পর্ব পড়ুন…

অজিত কেশকম্বলী II

"মানুষ ছাড়া ক্ষ্যাপারে তুই মূল হারাবি, মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি।"

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *