ধর্ম ও সম্মান রক্ষার্থে হত্যা বা অনারকিলিং
সূচিপত্র
ভূমিকা
সম্মান রক্ষার্থে হত্যা বা অনারকিলিং হল কাউকে নিজের পরিবার বা গোত্রের সম্মানহানির দায়ে ঐ পরিবার বা গোত্রের কোন অভিযুক্ত ব্যক্তি, যাকে সম্মানহানির দায়ে অভিযুক্ত করা হয়েছে, সেই ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গকে হত্যা করা। সহজ কথায়, যার মাধ্যমে বংশের মর্যাদা ক্ষুন্ন হয়েছে মনে হয়, বংশ ও ধর্মীয় সম্মান রক্ষার জন্য, পরিবারের সম্মান রক্ষায় তাকে মেরে ফেলা হয়। এই হত্যার মাধ্যমে হত্যাকারীদের বংশের মর্যাদা এবং ধর্মীয় সম্মানহানির উপযুক্ত প্রতিকার হয়েছে বলে মনে করা হয়। পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় অনারকিলিং প্রচলিত। নারীরা হলো অনারকিলিং এর প্রধান শিকার। পাকিস্তান, জর্ডান, লেবানন, মরোক্কো, সিরিয়ান রিপাবলিক ছাড়া অন্যান্য মধ্যপ্রাচ্যের দেশে এ প্রথা অধিক প্রচলিত। তবে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানীর মত দেশেও অনার কিলিং এর খবর পাওয়া যায়। অনারকিলিং এর পেছনে নির্দিষ্ট কোন ধর্ম যে দায়ী, তা অবশ্যই নয়। হিন্দু মুসলিম অনেক ধর্মের মানুষের মধ্যেই এই ঘটনা পরিলক্ষিত হয়। তবে কিছু ধর্মের মূল ধর্মগ্রন্থগুলোতে এই বিষয়ে সমর্থনসূচক কিছু নির্দেশনা পাওয়া যায়, অথবা বিষয়টিকে কোন না কোন ভাবে লঘু করে দেখা হয়। আমাদের আজকের আলোচনা হচ্ছে, ইসলামে এই বিষয়টিকে উৎসাহ দেয়ার কিংবা এই বিষয়টিকে জাস্টিফাই করার মত কিছু রয়েছে কিনা, তা যাচাই করে দেখা।
লিঙ্গ নির্ভর সম্মানের ধারণা
নারীর সতীত্ব এবং যোনী কেন্দ্রিক সম্মানের ধারণা প্রাগৌতিহাসিক। রক্ষণশীল ধর্মান্ধ সমাজে আজো সেই প্রাগৌতিহাসিক ধারণা লালন পালন করা হয়। নারীর শরীরের ওপর বংশ, পরিবার বা ঐতিহ্যের, কিংবা সামাজিক পবিত্রতা আরোপ করা এবং শরীরে অবস্থিত এই মান সম্মানের ধারণাকে অতি কঠোরভাবে দেখা হয়। প্রয়োজনে মানুষ মেরে হলেও এই সম্মান রক্ষা তখন মূখ্য হয়ে ওঠে। নারীর শরীরের এই তথাকথিত পবিত্রতা নিয়ে মাত্রাতিরিক্ত আদিখ্যেতা একটি পুরুষতান্ত্রিক ধারণা। নারীকে আরো ভালভাবে বোঝানো যে, তোমার শরীর দেখা গেলেই তোমার সম্মান শেষ, তোমার মান মর্যাদা সব শেষ! তুমি কাউকে নিজের পছন্দে ভালবাসলে, প্রেম করলে, পরিবারের অমতে বিয়ে করলে, কারো সাথে ভালবাসার সম্পর্ক তৈরি করলে তখন তাদের কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়।
বেশিরভাগ প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মে নারী মানেই মূলত একটি সেক্স অবজেক্ট। নারী মানেই যে সেক্স নয়, নারীর শরীর মানেই যে সেক্স নয়, এই সাধারণ বোধটুকু রক্ষণশীল সমাজে তৈরি হয় না। যেন একটি নারীর শরীর দেখা গেলে তার মান সম্মান খোয়া যায়, যেন একটি নারী নগ্ন হলে তার খুব অসম্মান হয়, সে প্রেম করলে বংশের অমর্যাদা হয়! আর এই ধারণাগুলোকে যখন ধর্ম সার্টিফাই করে, তখন ভয়াবহ পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটতে পারে। ঈশ্বরের নামে তখন হত্যাকাণ্ড খুব সহজ হয়ে ওঠে। কেউ আর এরকম হত্যাকাণ্ডে অনুশোচনাও করে না।
সম্মান রক্ষার্থে হত্যার কথিত কারণ
যুক্তরাষ্ট্রের এক সমীক্ষায় দেখা যায়, পৃথিবীতে প্রতি বছর অনারকিলিং এর নামে প্রায় ৫০০০ জনকে হত্যা করা হয়। মধ্যপ্রাচ্যের এবং দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ার নারীবাদী সংগঠনের এক হিসাবমতে প্রতি বছর ২০,০০০ এর উপর মেয়েকে অনারকিলিং এর নামে হত্যা করা হয় [1]। তবে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে তথ্য সংগ্রহ কঠিন হওয়ায় সঠিক তথ্য আমরা জানি না, তবে যেসকল তথ্য পাওয়া যায় সেগুলো শুনলে শিউরে উঠতে হয়। মূলত হনার কিলিং ঘটে নিম্নলিখিত কারণগুলো সামনে রেখে –
- পরিবারের অমতে বিয়ে করা
- নিম্নবর্ণ বা মর্যাদার কাউকে বিয়ে করা
- বিবাহ-পূর্ব সম্পর্ক
- বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্ক
- বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্ক আছে বলে সন্দেহ পোষণ করা
- ধর্মীয় বিধি-নিষেধ অবজ্ঞা করা
- সামাজিক বা গোত্রীয় বিধি-নিষেধ অবজ্ঞা করা
অনারকিলিং এর শিকার কয়েকজন
সামিয়া শহীদ
সামিয়া শহীদ নামে এক নারীকে ব্রিটেন থেকে পাকিস্তানে ডেকে এনে নিজ বাড়িতেই খুন করা হয়। পরিবারের কাছে তার অপরাধ ছিল- সে বাড়ির অমতে ব্রিটিশ এক যুবককে বিয়ে করেছিল। তদন্তের দায়িত্বে থাকা এক কর্মকর্তা জানান, শহীদের বাবা এবং পাকিস্তানে তার সাবেক স্বামী মিলেই তাকে হত্যা করেছে। এ ঘটনার পর শহীদের মা এবং বোন পলাতক। অভিযোগ উঠেছে তারাও এ হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকতে পারে। শহীদ হত্যার ঘটনায় দুই জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। তারা হলেন- শহীদের বাবা চৌধুরী মো. শহীদ ও তার সাবেক স্বামী চৌধুরী মো. শাকিল। শহীদকে যে মেরে ফেলা হয়েছে- তা ময়নাতদন্তেও বেরিয়ে এসেছে [2] ।
কান্দিল বেলুচ
মডেল ও অভিনেত্রী কান্দিল বেলুচ খুন হন তারই আপন ভাইয়ের হাতে। পুলিশ কর্তৃক গ্রেপ্তার খুনি ওয়াসিম জানিয়েছেন, পারিবারিক নাম ‘বেলুচ’-এর সম্মান রক্ষার্থেই বোনকে হত্যা করেছেন তিনি। ওয়াসিম-এর ভাষ্যে, সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে নিজেকে খোলামেলাভাবে প্রদর্শন করে পারিবারিক নামের ‘সম্মানহানী’ ঘটাচ্ছিলেন তিনি; যার কারণে কান্দিলকে মেরে ফেলাটা ‘আবশ্যক’ হয়ে পড়েছিল।
রোমেনা আশরাফী এবং রায়হানে আমেরী
১৪ বছর বয়সী রোমেনা আশরাফীই হোক, অথবা সে হোক ২২ বছর বয়সী রায়হানে আমেরী, এদের পরিবারের সদস্যরাই এদের নির্মমভাবে হত্যা করেছে [3]। কখনো আপন বাবা, কিংবা তাদের চাচা, চাচাতো ভাই, আপন ভাই, এমনকি অনেক সময় আপন মা। আত্মীয় স্বজন সবাই মিলেও অনেক সময় হত্যা করা হয় এদের।
শাফিলিয়া আহমেদ
পাকিস্তানী তরুনী শাফিলিয়া ছিল ১৭ বছরের তরুণী। এ লেভেলের তুখোড় মেধাবী ছাত্রী। স্বাধীনচেতা মানুষ ছিল সে, একজন মেয়ে নয়, মানুষ হিসেবে বাঁচতে চেয়েছিল। শাফিলিয়া পছন্দ করত জিন্সের প্যান্ট, টি শার্টসহ ব্রিটেনের নতুন প্রজন্মের সব পছন্দের পোশাক। চুলে রং লাগাতো, নিজের পছন্দ মত, নিজের ইচ্ছামত, পাখির মত মুক্ত হয়ে আকাশে উড়ে বেড়াতে চেয়েছিল। সুন্দরী হবার কারণে বন্ধুরা তাকে ‘অ্যাঞ্জেল’ বা পরী বলে ডাকতো। কিন্তু তার রক্ষণশীল মা বাবা এসব পছন্দ করতেন না। বকাঝকা করতেন। এক পর্যায়ে তারা সিদ্ধান্ত নেন, তাকে কৌশলে পাকিস্তানে নিয়ে সেখানে একটা ধর্মভিরু পরিবারের ছেলের সাথে তার বিয়ে দিয়ে দিবেন, তাতে সব ঠিক হয়ে যাবে। শাফিলিয়া রাজি হলো না। শেষে তার নিজের জন্মদাতা পিতা এবং জন্মদাত্রী মাই তাকে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল! এরকম মানুষের সংখ্যা অনেক, গুণে শেষ করা যাবে না।
ইসলামি শরীয়তের বিধান
মুসলিম প্রধান দেশগুলোতে অনারকিলিং অত্যাধিক রকমের বেশি হওয়ার পরেও, কোন ইসলামের স্কলারই আসলে এর সাথে ইসলামের সম্পর্কের কথা স্বীকার করতে চান না। এই কারণেই, কোরআন এবং হাদিস থেকে জেনে নেয়া প্রয়োজন যে, এই বিষয়ে ইসলামের বিধান কী। কেউ যদি ইসলামের দৃষ্টিতে যা পাপ, সেইরকম কোন কর্ম করতে উদ্যোগী হয়, তাহলে তাদের হত্যা করে পাপটিকে না ঘটতে দেয়া কী কোরআন হাদিসের শিক্ষা, নাকি এই অনার কিলিং এর ঘটনাগুলো শুধুমাত্র গুটিকয়েক ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞ লোকের ভ্রান্ত মতবাদ? আসুন আমরা কোরআন এবং হাদিসে এই বিষয়ে কী বলা রয়েছে, তা পড়ে দেখি।
কোরআনে নিষ্পাপ বালক হত্যা
কোরআনে সূরা কাহফে খিজির নামক একজন ইসলামি মহাপুরুষের একজন নিষ্পাপ বালককে হত্যার ঘটনা বর্ণিত আছে। যুক্তি হিসেবে খিজির উল্লেখ করেন, এই বালকটি বেঁচে থাকলে তার পরিবারের পিতামাতাকে সে কুফরি করে কষ্ট দিতো। অথচ, বালকটি তখনো কোন অপরাধ করে নি, সেই মূহুর্ত পর্যন্ত সে ছিল নিষ্পাপ। ভবিষ্যতে পাপ করবে, তার পিতামাতাকে কষ্ট দেবে, এই কারণেই তাকে হত্যা করা হয়েছিল। [4]
অতঃপর তারা চলতে লাগল। অবশেষে যখন তারা এক বালকের সাক্ষাৎ পেল, তখন সে তাকে হত্যা করল। সে বলল, ‘আপনি নিষ্পাপ ব্যক্তিকে হত্যা করলেন, যে কাউকে হত্যা করেনি? আপনি তো খুবই মন্দ কাজ করলেন’। [5]
‘আর বালকটির বিষয় হল, তার পিতা-মাতা ছিল মুমিন। অতঃপর আমি আশংকা* করলাম যে, সে সীমালংঘন ও কুফরী দ্বারা তাদেরকে অতিষ্ঠ করে তুলবে’। * তাঁর আশংকা নিছক ধারণা ভিত্তিক ছিল না, বরং আল্লাহর পক্ষ থেকে তিনি নিশ্চিত জানতে পেরেছিলেন। [6]
এই বিষয়টি সহিহ হাদিসেও পরিষ্কারভাবে উঠে এসেছে, [7]
সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী)
৪৭। তাকদীর
পরিচ্ছেদঃ ৬. প্রত্যেক শিশু ইসলামী স্বভাবের উপর জন্মানোর মর্মার্থ এবং কাফির ও মুসলিমদের মৃত শিশুর বিধান
৬৬৫৯-(২৯/২৬৬১) আবদুল্লাহ ইবনু মাসলামাহ্ ইবনু কা’নাব (রহঃ) ….. উবাই ইবনু কা’ব (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ নিশ্চয়ই যে ছেলেটিকে খাযির (আঃ) (আল্লাহর আদেশে) হত্যা করেছিলেন তাকে কফিরের স্বভাব দিয়েই সৃষ্টি করা হয়েছিল। যদি সে জীবিত থাকত তাহলে সে তার পিতামাতাকে অবাধ্যতা ও কুফুরী করতে বাধ্য করত। (ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৬৫২৫, ইসলামিক সেন্টার ৬৫৭৬)
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
বর্ণনাকারীঃ উবাই ইবনু কা‘ব (রাঃ)
স্ত্রীকে পরপুরুষের সাথে দেখলে হত্যা
নবী মুহাম্মদের একজন সাহাবীর নাম ছিল সা’দ ইবনু উবাদাহ্। উনি বলেছিলেন, উনার স্ত্রীকে উনি পরপুরুষের সাথে দেখলে ”তাকে আমার তরবারীর ধারালো দিক দিয়ে তার উপর আঘাত হানব”। নিজের সম্মান এবং গৌরব প্রতিষ্ঠার জন্যেই তিনি এরকম বলেছিলেন। তিনি সাক্ষী উপস্থিত কিংবা বিচার প্রক্রিয়া ছাড়াই সরাসরি খুন করে ফেলার কথাই খুব আত্মবিশ্বাসের সাথেই বলেছিলেন। এই কথা মুহাম্মদের কাছে পৌঁছালে উনি সা’দ ইবনু উবাদাহ্ এর খুব প্রশংসা করে বলেছিলেন, সা’দ ইবনু উবাদাহ্ খুবই আত্মমর্যাদা সম্পন্ন মানুষ। [8] [9]
সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী)
২০। লি’আন
পরিচ্ছেদঃ পরিচ্ছেদ নাই
৩৬৫৫-(১৬/…) আবূ বাকর ইবনু আবূ শাইবাহ (রহঃ) ….. আবূ হুরাইরাহ্ (রাযিঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেনঃ সা’দ ইবনু উবাদাহ্ (রাযিঃ) বললেনঃ হে আল্লাহর রসূল! যদি আমি আমার স্ত্রীর সঙ্গে কোন পুরুষকে দেখতে পাই তবে চারজন সাক্ষী উপস্থিত না করা পর্যন্ত আমি কি তাকে ধরব না? রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ হ্যাঁ, পারবে না। তিনি (সা’দ) বললেনঃ এমনটি কিছুতেই হতে পারে না, সে মহান সত্তার কসম! যিনি আপনাকে সত্যসহ প্রেরণ করেছেন, আবশ্য আমি তার (চারজন সাক্ষী উপস্থিত করার) আগেই কাল বিলম্ব না করে তার প্রতি তলোয়ার হানব। তখন রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ তোমরা শোন, তোমাদের নেতা কী বলছেন। নিশ্চয়ই তিনি অতিশয় আত্মমর্যাদার অধিকারী। আর আমি তার চাইতেও অধিকতর আত্মমর্যাদাশীল এবং আল্লাহ আমার চাইতেও অধিক মর্যাদাবান। (ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৩৬২১, ইসলামিক সেন্টার ৩৬২১)
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
বর্ণনাকারীঃ আবূ হুরায়রা (রাঃ)
সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী)
২০। লি’আন
পরিচ্ছেদঃ পরিচ্ছেদ নাই
৩৬৫৬-(১৭/১৪৯৯) উবাইদুল্লাহ ইবনু উমার কাওয়ারীরী ও আবূ কামিল ফুযায়ল ইবনু হুসায়ন জাহদারী (রহঃ) ….. মুগীরাহ শুবাহ (রাযিঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেনঃ সা’দ ইবনু উবাদাহ্ (রাযিঃ) বললেনঃ আমি যদি আমার স্ত্রীর সাথে অন্য কোন পুরুষকে দেখতে পাই তবে নিশ্চয়ই আমি তাকে আমার তরবারীর ধারালো দিক দিয়ে তার উপর আঘাত হানব- পার্শ্ব দিয়ে নয়। এ কথা নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে পৌছল। তিনি বললেনঃ তোমরা কি সাদের আত্মমর্যাদাবোধ সম্পর্কে আশ্চর্য হয়েছ? আল্লাহর কসম! আমি তার চাইতে অধিকতর আত্মমর্যাদাবান। আর আল্লাহ আমার তুলনায় অধিকতর মর্যাদাবান। আল্লাহ তাঁর আত্মমর্যাদার কারণে প্রকাশ্য ও গোপন যাবতীয় অশ্লীল কর্ম হারাম করে দিয়েছেন। আর আল্লাহর তুলনায় অধিক আত্মমর্যাদাসম্পন্ন কেউ নেই এবং আল্লাহর চাইতে অধিকতর ওযর (স্থাপন) পছন্দকারী কেউ নেই।* এ কারণেই আল্লাহ তার নাবী-রসূলদের সুসংবাদদাতা ও ভীতি প্রদর্শনকারীরূপে পাঠিয়েছেন। আল্লাহর চাইতে অধিকতর প্রশংসা পছন্দকারী কেউ নেই। এ কারণে তিনি জান্নাতের ওয়াদা করেছেন। (ইসলামিক ফাউন্ডেশন, ৩৬২২, ইসলামিক সেন্টার ৩৬২২)
* আল্লাহর চেয়ে ওযর পছন্দকারী কেউ নেই। এখানে ‘ওযর’ ক্ষমা করা ও সতর্ক করা অর্থে এসেছে। শাস্তির জন্য পাকড়াও করার পূর্বে আল্লাহ তা’আলা রসূলদেরকে সতর্ক করার জন্য প্রেরণ করেছেন। (তাহকীক। সহীহ মুসলিম, ফুআদ আবদুল বাকী’, ২য় খণ্ড, ৫৭৪ পৃঃ)
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
বর্ণনাকারীঃ শু’বা (রহঃ)
উপরের হাদিস থেকে পরিষ্কার বোঝা যায়, পরপুরুষের সাথে পরিবারের কোন নারী সদস্যকে একসাথে দেখলে, কেউ যদি আত্মমর্যাদা, বংশের সম্মান এবং গৌরব পুনরুদ্ধারের জন্য সেই নারীকে কোন বিচারিক প্রক্রিয়া ছাড়াই সাথে সাথে হত্যা করে, তা নবী মুহাম্মদের কাছে প্রশংসনীয় ছিল। অথচ, সেই পুরুষ যদি এরকম কিছু দেখে থাকে, খুব সহজেই সেই নারীকে তালাক দিতে পারে। কিন্তু সেটি না করে তাকে হত্যা করে ফেলা, এবং নবী নিজে সেই হত্যার ইচ্ছাকে প্রশংসা করা, খুবই মর্মান্তিক ব্যাপার।
নিজের ছেলে খুনের শাস্তি নেই
ইসলামি শরীয়তে নিজের ছেলেকে হত্যা করলে তার জন্য কোন কিসাসের বিধান নেই। অর্থাৎ, পিতা যদি তার সন্তানকে হত্যা করে ফেলে, এর জন্য তার ওপর সমান শাস্তি প্রয়োগ করা হবে না। অর্থাৎ মৃত্যুদণ্ড দেয়া যাবে না। আসুন হাদিসটি পড়ি – [10]
সূনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত)
১৪/ দিয়াত বা রক্তপণ
পরিচ্ছেদঃ ৯. বাবা ছেলেকে খুন করলে তার কিসাস হবে কি না
১৪০০। উমার ইবনুল খাত্তাব (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছিঃ ছেলেকে খুনের অপরাধে বাবাকে হত্যা করা যাবে না।
সহীহ, ইবনু মা-জাহ (২৬৬২)
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
বর্ণনাকারীঃ উমর ইবনুল খাত্তাব (রাঃ)
বিষয়টি আমরা ইসলামী আইনশাস্ত্র থেকেও দেখে নিই, [11]
নারীর নিজে বিবাহ হচ্ছে যিনা
ইসলামি বিধান অনুসারে কোন নারী যদি ওয়ালি বা অভিভাবকের অনুমতি ছাড়া নিজেই পছন্দ করে বিয়ে করে, তার বিবাহ বৈধ বলে গণ্য হবে না, এবং সেই স্বামীর সাথে সহবাসকে ইসলাম যিনা বলে গণ্য করবে। আর যিনার শাস্তি কী তা নিশ্চয়ই আপনারা অবগত আছেন। এই বিষয়ে এই সহিহ হাদিসটি পড়ে নেয়া জরুরি। হাদিসটি পাবেন [12] [13] [14]
গ্রন্থঃ সুনানে ইবনে মাজাহ
অধ্যায়ঃ ৯/ বিবাহ
পাবলিশারঃ তাওহীদ পাবলিকেশন
পরিচ্ছদঃ ৯/১৫. অভিভাবক ছাড়া বিবাহ হয় না।
৪/১৮৮২। আবূ হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ কোন মহিলা অপর কোন মহিলাকে বিবাহ দিবে না এবং কোন মহিলা নিজেকেও বিবাহ দিবে না। কেননা যে নারী স্বউদ্যোগে বিবাহ করে সে যেনাকারিণী।
It was narrated from Abu Hurairah that: the Messenger of Allah said: “No woman should arrange the marriage of another woman, and no woman should arrange her own marriage. The adulteress is the one who arranges her own marriage.”
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
সুনানে ইবনে মাজাহ
৯/ বিবাহ
পরিচ্ছেদঃ ৯/১৫. অভিভাবক ছাড়া বিবাহ হয় না।
১/১৮৭৯। ‘আয়িশাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে নারীকে তার অভিভাবক বিবাহ দেয়নি তার বিবাহ বাতিল, তার বিবাহ বাতিল, তার বিবাহ বাতিল। স্বামী তার সাথে সহবাস করলে তাতে সে মাহরের অধিকারী হবে। তাদের মধ্যে মতবিরোধ হলে সে ক্ষেত্রে যার অভিভাবক নাই, শাসক তার অভিভাবক।
তিরমিযী ১১০২, আবূ দাউদ ২০৮৩, আহমাদ ২৩৮৫১, ২৪৭৯৮, দারেমী ২১৮৪, ইরওয়াহ ১৮৪০, মিশকাত ১৩৩১, সহীহ আবী দাউদ ১৮১৭।
তাহকীক আলবানীঃ সহীহ। উক্ত হাদিসের রাবী সুলায়মান বিন মুসা সম্পর্কে আবু আহমাদ বিন আদী আল-জুরজানী বলেন, তিনি আমার নিকট সত্যবাদী। আবু হাতিম বিন হিব্বান বলেন, তিনি একজন ফকিহ। আহমাদ বিন শু’আয়ব আন-নাসায়ী বলেন, তিনি ফকিহদের একজন তবে হাদিস বর্ণনায় নির্ভরযোগ্য নয়। আল-মিযযী বলেন, তিনি তার যুগে শামের একজন ফকিহ ছিলেন। আতা বিন আবু রাবাহ বলেন, তিনি শামের যুবকদের নেতা ছিলেন। মুহাম্মাদ বিন সা’দ বলেন, তিনি সিকাহ। (তাহযীবুল কামালঃ রাবী নং ২৫৭১, ১২/৯২ নং পৃষ্ঠা)
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
বর্ণনাকারীঃ আয়িশা (রাঃ)
উপসংহার
উপরে ইসলামি শরীয়তের উৎস কোরআন এবং হাদিসে যা সুস্পষ্টভাবে বর্ণিত রয়েছে, সেগুলো উল্লেখ করা হলো। ইসলাম ধর্মের নবী মুহাম্মদ সুষ্পষ্টভাবেই আত্মসম্মান, বংশ বা পরিবারের মর্যাদা রক্ষার জন্য হত্যা করাকে প্রশংসনীয় কাজ বলে উৎসাহিত করে গেছে। যেই হাদিসগুলো এখনো পৃথিবীর বিভিন্ন মাদ্রাসা থেকে শুরু করে ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়ানো হয়। আমি শুধু তথ্যগুলো আপনাদের সামনে উপস্থাপন করলাম, এর থেকে সিদ্ধান্ত নেয়ার দায়িত্ব আপনার। যে, ইসলামে আদৌ অনারকিলিং বা সম্মান রক্ষার্থে হত্যা জায়েজ, নাকি নাজায়েজ।
তথ্যসূত্র
- “Robert Fisk: The crimewave that shames the world“। The Independent। ২০১০-০৯-০৭ [↑]
- Rethinking the term ‘honor killing’ [↑]
- Iran’s police confirmed the fourth case of honor killing in less than a month [↑]
- কোরআন, সূরা কাহফ, আয়াত ৬০-৮০ [↑]
- কোরআন, সূরা কাহফ, আয়াত ৭৪ [↑]
- কোরআন, সূরা কাহফ, আয়াত ৮০ [↑]
- সহীহ মুসলিম, হাদীস একাডেমী, হাদিসঃ ৬৬৫৯ [↑]
- সহীহ মুসলিম, হাদীস একাডেমী, হাদিসঃ ৩৬৫৫ [↑]
- সহীহ মুসলিম, হাদীস একাডেমী, হাদিসঃ ৩৬৫৬ [↑]
- সূনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত), হাদিসঃ ১৪০০ [↑]
- বিধিবদ্ধ ইসলামী আইন, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৫৪, ২৫৫ [↑]
- সুনানে ইবনে মাজাহ, তাওহীদ পাবলিকেশন্স, হাদিসঃ ১৮৮২ [↑]
- সুনানে ইবনে মাজাহ, তাওহীদ পাবলিকেশন্স, হাদিসঃ ১৮৭৯ [↑]
- সুনান ইবনে মা’জাহ গ্রন্থের দ্বিতীয় খণ্ডে [↑]
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত © ২০২৪ "সংশয় - চিন্তার মুক্তির আন্দোলন"
I love the word of Muhammod ( sallahu alyhe wa sallam).
আসিফ ভাই, কোরানের ৬ নং সূরা আল আন- আম এর ১৩৭ ও ১৪০ নম্বর আয়াত উল্লেখযোগ্য।