সহীহ বুখারী কেন মিথ্যাচার (পর্ব ৩ – শেষ পর্ব)
আসলে সহীহ হাদিস কে কেন সহীহ বলা হয়?
আল বুখারী এবং অন্যান্য যারা হাদিস সংগ্রহ করতেন তারা মানুষদের কাছে তাদের হাদিস গ্রহণ যোগ্য করে তোলার জন্য তারা সহীহ হাদীসকে ভুয়া হাদিস থেকে পার্থক্য করার নিয়ম বানিয়েছিলেন। তাদের প্রতিষ্ঠিত নিয়ম অনুযায়ী নির্ভরযোগ্য হাদীস বর্ণনাকারীদের ধারাবাহিক নাম রেকর্ড হাদিসের সত্যতা নিশ্চিত করে । আর তাই আমরা শুনি সে বলেছেন তাকে তিনি বলেছেন ওকে তারপর উনি বলেছেন তাকে তারপর তার থেকে উনি জানতে পেরে বলেছেন নবী মুহাম্মদ বলেছেন ইত্যাদি ইত্যাদি। (নিরপেক্ষভাবে যদি বিষয়টা একটু চিন্তা করেন সহজেই বুঝে ফেলবেন একজন নেতৃস্থানীয় লোকের মৃত্যুর ২০০ বছর পরে এই ধরনের ক্রাইটেরিয়া ব্যবহার করে তার জীবনকালে বলা কথা এবং ঘটনা সমূহের সত্যতা নির্ধারণ কতটা ভিত্তিহীন।)
ঐতিহাসিক এবং প্রাচ্যবিদ Patricia Crone লিখেছেন যে নবী মুহাম্মদের মৃত্যুর পর খুব স্বল্পসংখ্যক হাদিসের সন্ধান পাওয়া যাচ্ছিল। যদিও কেউ কেউ উদ্যোগ নিয়েছিল তা লিখে রাখার জন্য তারপরও তখন হাদিসগুলোর ধারাবাহিক বর্ণনাকারী সন্ধান পাওয়া যাচ্ছিল না- যে কার কাছে থেকে কে শুনে কিভাবে কিভাবে সর্বশেষ বর্ণনাকারীর কাছে হাদীসটি পৌঁছেছিল। এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল নবী মুহাম্মদের মৃত্যুর কিছু পরেই। তাহলে বলুন ২০০ বছর পরে কিভাবে এত হাজার দশেক হাদিস পাওয়া গেল শুধু তাই নয় পাওয়া গেল বিস্তারিত ধারাবাহিক হাদীস বর্ণনা কারীর নাম এবং পরিচয় । সর্বশেষ বর্ণনাকারী বলে দিতে পারল একদম নবীজির মুখনিঃসৃত হবার পর থেকে হাদিসটা কিভাবে কিভাবে কার কার থেকে বর্ণিত হতে হতে তার কাছে এসে পৌঁছালো। আসলে এটিই প্রমাণ বহন করে যে হাদিসগুলো আসলে বানোয়াট এবং সত্য নয়।
হাদিসের গল্প
নবী মুহাম্মদের মৃত্যুর পর প্রথম ১০০ বছর যাবত তিনি কি বলেছেন না বলেছেন এই সম্পর্কে কারো কোন আগ্রহ ছিল না। হাদীসগুলো সংগ্রহে প্রসঙ্গ সর্বপ্রথম উঠে আসতে থাকলো উমাইয়াদ এবং আবাসিদদের দ্বন্দ্ব চলাকালীন সময়ে।
কারণ এই সময় আবাসিদ রা চেষ্টা করেছিল উমাইয়াদদের ক্ষমতা থেকে হটানোর জন্য। তখন একদিকে উমাইয়াদরা আবাসিদদের ভুল ইসলামের অনুসারী হিসেবে অভিযুক্ত করে, অন্যদিকে আবাসিদরা উমাইয়াতদের ভুল ইসলামের অনুসারী দাবি করতে থাকলো। কারণ তারা উমায়াত খলিফাকে পছন্দ করত না। তখন তারা হাদিস প্রচার করত মানুষকে দেখানোর জন্য যে উমায়াতরা যা করছে তা অনৈসলামিক।
আর তাই একে অন্যের সাথে পাল্লা দিয়ে বানোয়াট হাদিস বানানোর চর্চা শুরু হয়ে গেল। উমাইয়াদ সরকারের পক্ষ থেকে Muhammed bin shehab el zohri কে নিয়োগ দেয়া হলো । Abdullah bin marawan এর আরোপিত আইন বলে মানুষকে হাদিস লেখার জন্য বাধ্য করা হত।
দ্রুত ইসলামিক সাম্রাজ্য সম্প্রচারের পেছনে বানোয়াট হাদিস বিশেষভাবে ভুমিকা রেখেছে। ইসলামিক শাসকরা হাদিস বানাত যাতে মানুষকে যুদ্ধে যেতে (জিহাদে যেতে) রাজি করানো যায়। মানুষকে বলা হত কেন জিহাদে বা যুদ্ধে মারা যাওয়ার সবচেয়ে সৌভাগ্যের ঘটনা। আপনি যদি জিহাদে মারা যান তাহলে ৭২ জন কুমারী হুরের সাথে শুইতে পারবেন। একমাত্র জিহাদের ময়দানে যুদ্ধে শহীদ হতে পারলে এই সৌভাগ্য অর্জন করা যেতে পারে।
আরো একটি হাদিসের উদাহরণ এক সময় কুরাইশরা মদিনা কে ঘেরাও করে ফেলল তখন নবীজী মদিনার চারদিকে ট্রেঞ্চ বা খন্দক খুরতে বললেন। এক পর্যায়ে নবী মোহাম্মদ কে একটা বড় পাথরকে ভাঙার জন্য আঘাত করতে হলো । তিনি তিনবার আঘাত করলেন তিনটি আঘাতে আলোর ফুলকি জ্বলে উঠলো। তখন নবী মোহাম্মদ ভবিষ্যৎ দেখতে পেলেন। তিনি বললেন প্রথম আলোর ফুলকি দিয়ে বোঝানো হয়েছে আল্লাহ মুসলমানদের জন্য ইয়েমেন খুলে দেবেন, দ্বিতীয় ঝলকানি টি বুঝিয়েছে আল্লাহ পশ্চিমা দেশগুলি দিয়ে দেবেন, তৃতীয়টি বুঝিয়েছে আল্লাহ পূর্বের দেশ গুলো মুসলমানদের জন্য খুলে দেবেন।
এই হাদিসটা মুসলিম শাসকরা বানিয়েছিলেন কারণ ঐ সমস্ত দেশগুলো তারা দখল করতে চেয়েছিলেন। (বলা বাহুল্য তার জিহাদি সেনাদের নবীজির ভবিষ্যৎবাণীর কথা শুনালে অবশ্যই তা তাদের উৎসাহ উদ্দীপনা বাড়িয়ে দিতো।) এই হাদিসটা যে বানানো তা বোঝা খুবই সহজে কারণ এই একই হাদিসের ঘটনা আরো একবার বর্ণিত হয়েছে অন্যত্র তবে এক্ষেত্রে দখল করবার দেশসমূহ ভিন্ন।
বিভিন্ন সময় এবং বিভিন্ন স্থানের ভিত্তিতে হাদীসকে পরিবর্তন করা হয়েছে।
শুরুর দিকের হাদীস সমূহ ছিল রাজনৈতিক কারণে তারপর হাদিসগুলো মানুষের ব্যক্তিজীবনের জন্য ও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল। মানুষ জানতে আগ্রহী হয়ে উঠলো নবী মোহাম্মদ তার জীবনে কি করেছিলেন। ঘটনা অবশেষে এত দূর গড়াল যে তারা জানতে আগ্রহী হল নবী মোহাম্মদ কোন হাত দিয়ে খেতেন, উনি পেশাব করবার সময় দাঁড়িয়ে করতেন নাকি বসে করতেন – আসলে এই সমস্ত হাদিস গুলো ব্যবহার করা হতো মানুষদের কে নিয়ন্ত্রন করার জন্য। কিছু ইসলামিক শাসকরা হাদিস বানাত যারা খলিফাকে মানতে রাজি হতো না তাদের হত্যা করার জন্য।
কিছু কিছু হাদিস মুসলমান সৈন্যদেরকে সাহায্য করেছে বিরোধীদলের নারীদেরকে যৌনদাসী বানানোর জন্য যাতে তারা তাদের ধর্ষণ করতে পারে। তারপর আপনাকে শুনতে হবে যে এটা সবচেয়ে দয়াময় ধর্মের নমুনা কারণ তাদেরকে হত্যা না করে আপনি কেবল ধর্ষণ করছেন। এটা শুধু বুখারি হাদিস না অন্য যে কোন হাদীস গ্রন্থের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। কারণ তারা সবাই বুখারি হাদিস থেকে কপি করেছে। উদাহরণস্বরূপ মুসলিম বিন হাজ্জাজ যিনি সহীহ মুসলিম হাদিস গ্রন্থ সংকলন করেছেন তিনি বুখারী শরীফ থেকে নিয়ে অনেক একই গল্প পুণবর্ণনা করেছেন। বোঝাই যাচ্ছে যাতে সবাই তাকেও বিশ্বাস করে। তিনি বলেছেন যে তিনিও সমগ্র আরব উপদ্বীপ পরিভ্রমণ করেছেন। মক্কা মদিনা, বসরা, বাগদাদ, কুফা, মিশর, সিরিয়া এবং ফিলিস্তিন পরিভ্রমণ করে প্রায় তিন লক্ষ হাদীস সংগ্রহ করে অবশেষে তা থেকে মাত্র তিন হাজার হাদিস সহীহ হিসাবে চিহ্নিত করে সংকলন করেছেন। তিনি ২ লক্ষ ৯৭ হাজার হাদিস কে ভুল হাদিস হিসেবে বাতিল করে দিয়েছেন। যদিও কেউ নিশ্চিত না যে তিনি আসলেই কতটুকু তার বইতে লিখেছিলেন। কেউ বলে ৩০০০ কেউ বলে ৪০০০। কেউ বলে ৭০০০ কেউ বলে ১২০০০।
বিষয়টা অতি জটিল বলে মনে হয়:
“মানুষের মন কখনো সঠিক কিংবা ভুল নির্ধারণ করতে পারে না। মানুষের মনের অস্তিত্ব আছে যাতে সে জেনে নিতে পারে কোনটাকে আগে থেকেই সঠিক কিংবা ভুল বলা হয়েছে।”
-একজন আরব শেখের (ভিত্তিহীন) মন্তব্য।
ইসলামিক আইনের ব্যবহারশাস্ত্র, শরীয়া, কোরআন, হাদিস এবং তাফসীর এত কিছু দেখার পর আপনি বলবেন “বাদ দেন ভাই এইসব এত কিছু পড়ার সময় নাই – সিদ্ধান্ত নেবার দায়ভার হুজুরদের উপরই ছেড়ে দেই। একটু ভেবে দেখুন বিষয়টা কিন্তু এর চেয়ে সহজ অন্তত আপনি নিশ্চিত থাকতে পারেন বিষয়টা যতটা জটিল দেখাচ্ছে এতটা জটিল না। জটিলতা সব ধর্মে আছে। খ্রিস্টান ধর্ম ও এরকম জটিল অনেক কিছু আছে। কিন্তু কোন কিছু জটিল দেখালেই ধরে নেবার কোন কারণ নাই যে তা আদৌ গুরুত্বপূর্ণ।
হাদিসগুলি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে প্রমানহীন ভিত্তির উপরে। আর তাই এই সব এর উপর বিশ্বাস না করার পেছনে এটাই আপনার সব চেয়ে বড় কারন। তারপরও যদি আপনি বিশ্বাস করতে চান আপনি জেনে রাখুন যে এসব হাদীস গুলো আপনার ধর্মের জন্য ভালো কিছু না। আপনি একজন একবিংশ শতাব্দী ভালো এবং সৎ ব্যক্তি হিসেবে হাদীসগুলোকে পর্যবেক্ষণ করেন তাহলে আপনি বুঝতে পারবেন যে এই হাদিসগুলি আসলে নবী মোহাম্মদের চরিত্রে কালিমা লেপন করেছে। এই হাদিস সমূহে তুলে ধরা হয়েছে অনেক ভয়াবহ এবং রক্তারক্তি, অবাস্তব যৌনতার কাহিনী। হত্যাকাণ্ড খুন খারাপি, আগুনে পোড়ানো, অস্বাভাবিক যৌনতার তারণা এবং সমকামীদের প্রতি ঘৃণা । অর্থাৎ যে বিষয়গুলো কোন সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে আরোপ করা সম্ভব নয় তা চাপিয়ে দেয়া হয়েছে আল্লাহর নবীর বিরুদ্ধে।
হাদিস সমূহের উদ্দেশ্য হাদিস সমূহ ইসলামিক ধর্মীয় শিক্ষার কোন ঐতিহাসিক দলিল হিসাবে রচিত হয়নি। এসব হাদীস রচিত হয়েছিল যাতে ইসলামিক শাসকগণ শাসন করে যেতে পারে । মানুষ কি করতে পারবে বা মানুষ কি করতে পারবে না তা বলে না দিলে ইসলামিক শাসকগণ লোকজনকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারত না। এই জাতীয় গল্পসমূহ যে নবী মোহাম্মদ কাকে হত্যা করেছেন, কার সাথে শুয়েছেন, কোন দাসীর সেক্স করছেন সাথে কোন বউকে ত্যাগ করেছিলেন কারণ তার সাথে তিনি শুতে চাইতেন না, কিংবা এক শিশুকে বিয়ে করেছিলেন। একবার অপকর্মগুলো নবী মুহাম্মদের নামের উপর যদি চাপানো যেত তাহলেই হল, কেউ আর বলতে সাহস করবে না কাজগুলো অন্যায়। কারণ মুসলিম শাসকরা নিজেরাই এগুলো করছিল এবং আরও করে যেতে চাচ্ছিল। ।
সমাজ থেকে ন্যায় এবং অন্যায়ের সুনির্দিষ্ট মাপ কাঠি যাতে ভেঙে না যায় এবং মানুষ নিজেদের মনকে দমিয়ে রেখে যাতে আদিম কালের কিতাবাদি অনুসরণ করতে থাকে।
যাতে বলে দেয়া যায় এই কাজটা করবে, ঐ কাজটা করবে না। এই কারণে তৎকালীন ইসলামিক শাসকরা হাদিসকে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে মানুষকে বিশ্বাস করাতে চেষ্টা করেছিলেন। এইটা গুরুত্বপূর্ণ না যে হাদিস সমূহ অযৌক্তিক, অমানবিক, বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে ভুল বরং এটা গুরুত্বপূর্ণ যে আপনাকে এটা অনুসরণ করতেই হবে। তা না হলে আপনি অবিশ্বাসী এবং আপনি অবিশ্বাসী হলে আপনার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড।
আগের পর্বঃ সহীহ বুখারী কেন মিথ্যাচার (পর্ব ১) সহীহ বুখারী কেন মিথ্যাচার (পর্ব ২)
(Sherif Gaber এর ভিডিও এর ভিত্তিতে )
হাদিসের এই শক্তি না থাকলে তুমি আজ এ্যাডভ্যাটাইজ করতে কার।
তুমি আমার এই লেখা পড়ে আমার মধ্যে এমন কি হাদিসের শক্তি খুঁজে পেলে?
আমি কার বিজ্ঞাপন দিয়েছি এখানে?
ইসলামের নবী কে হাদিসে যেভাবে বর্ণনা দেয়া আছে তার চেয়ে ভাল বলতে চেয়েছি – তোমার এতে কোনো সমস্যা। (এইখানে তুমি তুমি করা নিষেধ, তুমি তুমি বললে তাই আমিও বললাম। )
অসাধারন লেখা, আমিও এমনটি ভাবছিলাম, এই হাদিস নিয়েই মোল্যাদের যত অসভ্য আজ জাতি দেখতে পারতেছে। আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আশা করবো আরো গভীর স্টাডি করে ব্যাপকভাবে হাদিসের ভন্ডামীগুলো জনসমুখে তুলে ধরার জন্য।
আপনাকেও ধন্যবাদ কমেন্টের জন্য । লেখাটা মিশরীয় একটিভিস্ট Sherif Gaber ভিডিও থেকে অনুবাদ করা। শুভেচ্ছা রইল আপনার প্রতিও ।