১৪ই ফেব্রুয়ারি বিশ্ব বেহায়াপনা দিবস?
একবিংশ শতাব্দীতেও ভালোবাসা শব্দটা বাধানিষেধের জঞ্জাল থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি। আটকে আছে নানা অসুস্থ চেতনার বেড়াজালে। ছেলেরা সহজেই বলতে পারে যে সে কটা রিলেশন করেছে আবার এমনও অনেক আছে যারা সেটা প্রকাশ করে না। তবে আমাদের দেশের সমাজব্যবস্থার মতো যেসব সমাজব্যবস্থায় নারীকে পুরুষের ব্যক্তিগত প্রোপার্টি মনে করা হয় সেখানে এমন মেয়েমানুষ খুব কমই দেখা যায় যারা বলতে পারে সে জীবনে এতোটা রিলেশন করেছে। কারন ‘প্রেম করা’ পুরুষের জন্য না হলেও নারীর ক্যারেকটারের সাথে সম্পর্কিত ভাবা হয়ে থাকে। বিয়ের আগে প্রেমের সম্পর্ক থাকলেও বেশিরভাগ পুরুষ বউ হিসেবে এমন নারী আশা করে যার বিয়ের আগে কোনো সম্পর্ক ছিলো নাহ, তাই নারী প্রেম করলে ভবিষ্যৎ স্বামীকে ঠকানো হয় এমন চিন্তাভাবনা থেকেই ‘প্রেম করা’ যতটা না পুরুষের জন্য নেতিবাচক ভাবে দেখা হয় তারচেয়ে অনেক বেশি নেতিবাচক ভাবে দেখা হয় নারীর বেলায়। বিয়ের আগে প্রেমের সম্পর্ক থাকলে শারীরিক সম্পর্কও হতে পারে, শারীরিক সম্পর্ক হয়ে গেলে সে আর সতীসাধ্বী থাকে না। আর নারীকে শুধুই যৌনবস্তু মনে করা সমাজের একজন মানুষের কাছে অসতী নারী মানেই আরেকজনের ব্যবহৃত যৌনবস্তু যা কেউই আপন করে নিতে চায় না। অর্থাৎ, বিয়ের আগে প্রেমের সম্পর্কই নেতিবাচক একটা বিষয় আর যৌন সম্পর্কের কথা তো ভাবাই যায় না। তাছাড়াও পরপুরুষের সাথে একান্ত ব্যক্তিগত সময় কাটানো, পরপুরুষের স্পর্শ ইত্যাদি উদ্ভট সামাজিক ট্যাবু তো আছেই। বিবাহবহির্ভূত প্রেম ভালোবাসা ও যৌনসম্পর্ক সম্পর্কে সমাজের এমন যুক্তিহীন গোঁড়ামিপূর্ণ ধ্যান ধারনার মধ্যেই মানুষ কাউকে ভালবাসে, কারো সাথে একটা সম্পর্ক তৈরি হয়, দেখাসাক্ষাৎ হয়, সুখদুঃখ ভাগাভাগি করা হয়, ছোঁয়াছুঁয়ি হয় এবং সমাজে বিয়ের আগে প্রেম স্বাভাবিক না হওয়ায় তারা বলতে পারে নাহ ‘হ্যা একটা সম্পর্কে আছি’! বলতে পারে না ‘হ্যা আমি একটা সম্পর্কে ছিলাম’! দুইজন মানুষের স্বাভাবিক মেলামেশা দুইজন মানুষের ব্যক্তিগত জীবন যুগ যুগ ধরে নিষিদ্ধ হয়ে আছে সামাজিক ও ধর্মীয় প্রথার কাছে আর সেই দুজন মানুষও ভালোবাসার টানে সামাজিক ও ধর্মীয় রীতিনীতি উপেক্ষা করে এক হয়েও নিজেদের কাছে অপরাধীই হয়ে থাকে। তারা মনে করে মিথ্যা কথা বলার মতো বিবাহবহির্ভূত প্রেমের সম্পর্কও খারাপ। নিষিদ্ধ একটা বিষয় মনে করেই তারা নিজের ভালো লাগার মানুষটির সাথে সম্পর্ক স্থাপন করে। অথচ বিবাহবহির্ভূত প্রেমের সম্পর্ক কোনো নেতিবাচক বিষয় নয় বরং যা দুইজন মানুষের ব্যক্তিগতজীবন যেখানে তৃতীয় ব্যক্তির কোনো কাজ থাকার কথা না এবং সেটা যৌনতার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হবে।
সময়ের সাথে মানুষের চিন্তাজগত বদলেছে, অনেকেই ভালবাসার সম্পর্কগুলো মেনে নিতে শিখেছে, যদিও স্বাধীন যৌনসম্পর্ক সম্পর্কে আজও অধিকাংশ মানুষের ধারণাই একেবারেই নিচের স্তরের। তবুও আমাদের নারীবিদ্বেষী সমাজ যেখানে নারী যত ঘরে থাকে তত ভালো হয় আর যত বাইরে থাকে তত খারাপ হয় সেখানে নারীর বিয়ের আগে তার প্রেমিকের সাথে ঘুরে বেড়াবে, ছোঁয়াছুঁয়ি করবে আর নারীর সেই ব্যক্তিগতজীবনের প্রতি আমাদের বিদ্বেষ থাকবে না সেটা অনেক বেমানান হয়ে যায়। আর সেজন্যই আমরা আমাদের ভেতরকার কাঠমোল্লাকে জীবিত করে বিবাহবহির্ভূত প্রেম ভালবাসাকে বেহায়াপনা বলি বা মনে করি। হ্যা, আসল সমস্যা সেই নারীবিদ্বেষ নামক পুরুষতান্ত্রিক রোগই যা নারীর পরপুরুষের সাথে মেলামেশা ও যৌনসম্পর্ককে বেহায়াপনা ভাবতে শেখায়! আর সেই ভাবনা থেকেই কাঠমোল্লারা বছর ঘুরে আসা বিশ্ব ভালবাসা দিবসকে বিশ্ব বেহায়াপনা দিবস বলে থাকে! ভালোবাসা দিবসে অবিবাহিত নারীপুরুষ মেলামেশা করে, অনেকে যৌনসম্পর্কও করে থাকে আর পরস্পরের সম্মতিসূচক মেলামেশা/যৌনসম্পর্ক, যা কারো ক্ষতি করে না এবং যা কেবলই দুজন মানুষের ব্যক্তিগত ব্যাপার, তা ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের কাছে বেহায়াপনা।
বেহায়াপনার আসলে কোনো মানদণ্ড নেই। আপনার কাছে যা বেহায়াপনা তা যে অন্য সবার কাছেও বেহায়াপনা হবে তার কোনো মানে নেই। আপনার কাছে যা খুব স্বাভাবিক ব্যাপার মনে হয় তা অন্য কারো দৃষ্টিতে বেহায়াপনা হতে পারে।
দুজন নারী-পুরুষের বিবাহবহির্ভূত মেলামেশা/শারীরিক সম্পর্ক একজন ধর্মপ্রাণ মুসলমানের কাছে বেহায়াপনা মনে হয়, কারণ তা তার ছোটবেলা থেকে পেয়ে আসা বিশ্বাসের সাথে যায় না। বিবাহবহির্ভূত মেলামেশা/যৌনসম্পর্ক তার কাছে বেহায়াপনা, কারণ তার ধর্ম, তার সমাজ, তার বেড়ে ওঠার পরিবেশ, তার পরিবার তাকে তাই শিখিয়েছে। বিবাহবহির্ভূত মেলামেশা/যৌনসম্পর্ককে বেহায়াপনা মনে করার যুক্তিযুক্ত কারণ তার কাছে নেই।
ইসলামে যুদ্ধবন্দী নারী বা দাসী ধর্ষন করা জায়েজ, যে কাজ কাঠমোল্লাদের নবী ও তার সাহাবীরাও করেছেন। যুদ্ধবন্দী নারীদের সাথে সংগম মানে পরস্পরের স্বেচ্ছায় ভালবাসার দৈহিক মিলন না! কোনো নারী শত্রুর সাথে স্বেচ্ছায় বিছানায় যায় না, তাকে যেতে বাধ্য হতে হয় বা জোরজবরদস্তির স্বীকার হতে হয়। কোনো নারীকে বন্দী রেখে তার সাথে জোরপূর্বক সংগম করার মতো বর্বরতম এই অপরাধটা শান্তির ধর্মে বৈধ বলে গণ্য। ধর্মান্ধদের কাছে এই বর্বরতম অপরাধকে বেহায়াপনা মনে হয় না। যা করার মাধ্যমে কারো ওপর নিষ্ঠুর নির্যাতন করা হয় তা মুমিন মস্তিষ্কে বেহায়াপনা হয় না। মুমিন মস্তিষ্কে বেহায়াপনা হয় দুইজন মানুষ স্বেচ্ছায় বিবাহবহির্ভূত যৌনসম্পর্ক স্থাপন করলে যে তাদের কথিত শান্তির ধর্মেই বিবাহবহির্ভূত ধর্ষন বৈধ। ধর্ম মানুষের মস্তিষ্ক একটা নির্দিষ্ট মতাদর্শ বা ধারনায় তালাবন্ধ করে রাখে যেখানে বিবেক অর্থহীন হয়ে দাঁড়ায়! সেই মতাদর্শ যদি দাসী ধর্ষনকে ন্যায় ভাবতে শেখায় তাহলে মানুষ সেটাকেই চুপ করে মেনে নেয়। আবার, সেই মতাদর্শ অনুযায়ীই দুজন নারীপুরুষের বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কের মতো ব্যক্তিগত বিষয় হয়ে যায় বেহায়াপনা।
গ্রন্থঃ সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত)
অধ্যায়ঃ ৬/ বিবাহ (كتاب النكاح)
হাদিস নম্বরঃ ২১৫৫৪৫. বন্দী দাসীদের সাথে সঙ্গম করা
২১৫৫। আবূ সাঈদ আল-খুদরী (রাযি.) সূত্রে বর্ণিত। হুনাইনের দিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আওতাসের দিকে একদল সৈন্য পাঠালেন। তারা শত্রুর মুকাবিলায় অবতীর্ণ হয়ে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন এবং তাদের উপর বিজয়ী হয়ে তাদের নারীদেরকে বন্দী করে আনেন। কিন্তু সেই বন্দী নারীদের মুশরিক স্বামীরা বর্তমান থাকায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কতিপয় সাহাবী তাদের সাথে সঙ্গম করাকে গুনাহ মনে করেন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ এ আয়াতটি অবতীর্ণ করলেনঃ ‘‘যে মহিলাদের স্বামী আছে তারা তোমাদের জন্য হারাম। তবে তোমাদের অধিকারভুক্ত দাসী ব্যতীত’’ (সূরা আন-নিসাঃ ২৪) অর্থাৎ যুদ্ধবন্দী দাসী যখন তাদের ইদ্দাতকাল সমাপ্ত করবে তখন তারা তোমাদের জন্য বৈধ।(1)
সহীহ।
(1). মুসলিম, তিরমিযী, আহমাদ। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
মুমিন সমাজ নারী পুরুষের বিবাহবহির্ভূত যৌনসম্পর্ককে পশুদের যৌন জীবনের সাথে তুলনা দেয়। মানে পশুদের মধ্যে বিয়ের কারবার নেই, তাই বিবাহবহির্ভূত যৌনসম্পর্ক মানেই পশু হয়ে যাওয়া। আচ্ছা, মুহাম্মদ যে তার দাসীদের সাথে যৌনসম্পর্ক করেছিলো তা তো বিবাহবহির্ভূতই ছিলো। তারমানে, তাদের মত অনুসারে তাদের নবীই পশুসমাজের সদস্য! তাদের মত অনুসারে, ইসলামে দাসীদের সাথে যৌনসংগম বৈধ হওয়ার অর্থ ইসলাম মুসলমানদের পশু বানিয়ে ছাড়ে। না আমি কাউকে পশু বলছি না, তাদের ভাবনা যদি হয় বিবাহবহির্ভূত যৌনসম্পর্ক পশুদের দ্বারাই মানায় তাহলে তাদের নবীই সবার আগে পশু হয়ে যায়। তবে একটা কথা অবশ্যই বুঝে নিতে হবে, নারী পুরুষের স্বাভাবিক যৌনসম্পর্ক কারো ওপর জুলুম বা অত্যাচার নয়। আর নারীকে দাসী হিসেবে বন্ধী রেখে ধর্ষন করা একজন মানুষের ওপর ভয়াবহ অত্যাচার, নিকৃষ্ট অন্যায় যা পশুসমাজেও দেখা যায় না!
মাঝেমধ্যেই দেখি মৃতশিশুর ছবি দেখিয়ে মানুষ বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কের প্রতি ঘৃনা প্রকাশ করে। ঘৃনা প্রকাশকরা বাচ্চা বেঁচে থাকলেও ঘৃনা প্রকাশ করবে, মরে যেখানেসেখানে পড়ে থাকলেও ঘৃনা প্রকাশ করবে। বেঁচে থাকলেই আপন করে নেওয়ার মতো কজন আছে! বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক থেকে আসা শিশু ও জন্ম দেওয়া মা দুজনই সমাজের চোখে নরকের কীট। নারী চায় না সমাজের চোখে অসতী বা ব্যবহৃত “যৌনবস্তু” হয়ে বেঁচে থাকতে, চায় না তার পেটে আসা শিশু যেনো সেই সমাজের বোঝা হয়ে থাকে। তাই সে বাধ্য হয় পেটে আসা শিশুর মায়া ত্যাগ করতে। সমাজ যদি বিবাহবহির্ভূত শারীরিক সম্পর্ককে স্বাভাবিক ভাবে মেনে নিতে পারতো, বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক থেকে আসা শিশুকে আর দশটা শিশুর মতোই ভালোবাসতো আর মানুষকে তার জন্ম দিয়ে বিচার না করতো, তাহলে হয়তো শিশুর মায়েরা যেখানেসেখানে শিশুকে ফেলে যেতো না। মাথা ব্যাথা হলেই মাথা কেটে ফেলা কোনো সমাধান নয়। কেন মাথা ব্যাথা হলো সেটা বুঝতে হবে, বুঝার ইচ্ছা থাকতে হবে। দায়টা আমাদের আমাদের সমাজের, আগে নিজেদের বদলাতে হবে।
মনে হচ্ছে এই কথাগুলো আমার নিজেরই, কোন কারনে হয়তো মনের ভিতরের এই গুলোকে গুছিয়ে এত সুন্দরভাবে বলতে পারিনি।
খুবই ভাললেগেছে কথাগুলো।
ধন্যবাদ!