আমার বোন বিমান চালাবে, আমার বোন ফুটবল খেলবে! আপনারা কারা?

Print Friendly, PDF & Email

আমাদের চারপাশে এমন অনেক মানুষই আমরা খুঁজে পাই যারা প্রায়শই বলে থাকেন নারীর হাতে ক্ষমতা থাকলে অশান্তি বিরাজ তো করবেই বা নারীর নেতৃত্ব সুফল বয়ে আনে নাহ ইত্যাদি। তাদের বিশ্বাস পুরুষের তুলনায় নারী খুব দূর্বল এবং কম জ্ঞানী তাই নারীর হাতে নেতৃত্ব থাকলে সফলতা আসবে নাহ। নারী ঠিকমতো গাড়ি চালাতে পারবে নাহ, বিমান চালানো নারীর কাজ নয়। এসব কাজ নারী করলে গোলমাল পাকিয়ে ফেলবে, দূর্ঘটনা ঘটিয়ে ফেলবে এরকম বিশ্বাসে তারা বিশ্বাসী। নারী বাহিরের কাজ করবে উঁচু মানের কাজ করবে মাঠে খেলাধুলা করবে সেটা তারা স্বাভাবিক মনে করেন নাহ। মনে করেন বাহিরের কাজ করা মাঠে খেলাধুলা করা সম্পূর্ণ পুরুষের কাজ যা নারীর জন্য শোভনীয় নয়। নারী যদি তা করে তাহলে সে হয়ে যায় উগ্র স্বাধীন, বেহায়া, অভদ্র, অসভ্য! অথচ তারা কখনো ভেবে দেখবে নাহ যে, নারী কি করবে আর কি করবে নাহ সেটা ঠিক করে দেওয়া কতোটা অসভ্যতার মধ্যে পড়ে!

যুগ যুগ ধরে নারীকে পুরুষের সেবাদাসী করে চার দেয়ালের মাঝে আটকে রাখা হয়েছিলো আবার, নারীও নিজেকে আটকে রেখেছিলো। পুরুষ নারীকে শুধু সেবাদাসী ভেবেই এসেছে আবার, নারীও নিজেদের জীবনকে সেরকম ভাবেই মেনে নিয়েছেন এবং সেটাকেই স্বাভাবিক ভেবে এসেছেন। নিজের পায়ে দাঁড়ানো, নিজের ওপর নির্ভরশীল হওয়া, কাজেকর্মে পুরুষের সহযাত্রী হওয়ার ব্যাপার গুলা তারা অস্বাভাবিক মনে করতেন এবং এখনো করেন অধিকাংশই! নারী পুরুষ উভয়ের কাছেই নারীর জীবন সংসারের চার দেয়ালের মধ্যেই উত্তম। পুরুষ শাসিত সমাজের চোখে নারী শুধু পুরুষের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পুরুষের জন্য রান্নাবান্না বাসনকোসন এবং শারীরিক তৃপ্তি দেওয়ার জন্য তৈরি! এসবের বাইরে যেয়ে নিজেকে গড়ে তুলতে চাইলে, নারী পুরুষে বিভক্ত নাহ হয়ে স্বাভাবিক ভাবে মানুষ হয়ে স্বাধীন ভাবে জীবন সাজাতে চাইলেই নারী খারাপ!

কাজকর্ম কি লিঙ্গভেদে বিভক্ত করা যায়? নাহ কাজের কোনো লিঙ্গ নেই। যা মানুষের কাজ তা মানুষই করবে। সেই মানুষ নারীও হতে পারে আবারও পুরুষও হতে পারে। একজন মানুষ কারো অপকার নাহ করে যেভাবে জীবনে চলতে চায় চলতে পারে সেই অধিকার সে রাখে এবং সেখানে বাধা দেওয়ার অধিকার কেউ রাখে নাহ। সেটা জুলুম সেটা অবিচার। পুরুষ যদি নিজের সিদ্ধান্ত নিতে পারে তাহলে একজন নারীও পারে। পুরুষ যদি পারে মাঠে ফুটবল খেলতে তাহলে একজন নারীও মাঠে ফুটবল খেলার অধিকার রাখে। পুরুষ যদি বিমান চালানোর সিদ্ধান্ত নিতে পারে তাহলে একজন নারীও বিমান চালানোর অধিকার রাখে। আবার, নারী যদি রান্নাবাড়া করতে পারে তাহলে পুরুষও রান্নাবাড়া করতে পারে। নারী যদি বাসনকোসন ধুতে পারে তাহলে পুরুষও তা করতে পারে। জীবনের প্রয়োজনে মানুষ কি করবে আর কি করবে নাহ সেটা যে একজন মানুষের সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত ব্যাপার এবং অধিকার এটা অধিকাংশ মানুষ নাহ বুঝা পর্যন্ত আমরা এক অসভ্য জাতির উদাহরণ ছাড়া কিছুই নাহ!

পুরুষের কর্তৃত্বে বিশ্বাসী সমাজে নারী মাত্রই কম বুদ্ধিসম্পন্ন নিচু জাতের এক প্রাণী। সে সারাদিন ঘরে থাকবে, রান্নাবাড়া করবে, স্বামীর দৈহিক চাহিদা মেটাবে এভাবেই নারীকে দেখে তারা স্বস্তি বোধ করে। পুরুষের বশ্যতা থেকে বেরিয়ে এসে নারী স্বনির্ভর হবে, নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নিবে, পুরুষের সহযাত্রী হবে, নেতৃত্ব দিবে তা সহ্য করতে পারে নাহ পুরুষের কর্তৃত্বে বিশ্বাসীরা! সেজন্য তারা চায় নাহ নারী বিমান চালাক, চায় নাহ নারী অফিস আদালতে যাক, চায় নাহ নারী নেতৃত্ব দিক, চায় নাহ মেয়েরা মাঠে ফুটবল খেলুক। নারী স্বাধীনতার প্রতি বিদ্বেষ থেকেই তারা দ্বিধাহীন ভাবে বিমান দূর্ঘটনার মতো ঘটনায় নারীকে সেই দূর্ঘটনার জন্য দায়ী বলে দাবি করে। মেয়েরাও বিমান চালানোর মতো যেকোনো কঠিন কাজ অনায়াসে করতে পারে তা তারা মানতে রাজি নাহ! আচ্ছা সক্ষমতা বা দক্ষতা বা জ্ঞান বুদ্ধি এসব কি লিঙ্গভেদে কমবেশি হয়? মেয়ে হলে কম জ্ঞানী হবে বা ছেলে হলে বেশি জ্ঞানী হবে ব্যাপারটা কি এরকম? তাহলে তো সব পুরুষই কাজেকর্মে জ্ঞান বুদ্ধিতে যেকোনো নারীর চেয়ে এগিয়ে থাকার কথা। বাস্তবে আমরা সেরকম দেখি নাহ কেন? লিঙ্গভেদে মানুষের বোধবুদ্ধি কম বেশি হয় বা নারীর জ্ঞান পুরুষের তুলনায় কম হয় ইত্যাদি বিকারগ্রস্ত মানুষের অদ্ভুত ধারনা ব্যতীত কোনো প্রমাণিত সত্য নয়! সক্ষমতা লিঙ্গভেদে আসে নাহ, তা অর্জন করে নিতে হয়।

সক্ষমতা যদি লিঙ্গভেদেই আসতো তাহলে আজকে ঘরে ঘরে ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার এবং পাইলট থাকার কথা। একজন পুরুষ ডাক্তার যদি রোগী বাঁচাতে ব্যর্থ হয় তাহলে দোষটা কি তার পুরুষ হওয়ায় হবে? যদি সেরকম নাহ হয় তাহলে কেন বিমান দূর্ঘটনার কারণ নারী হবে? তারা বলে, গাড়ি চালানো নারীর কাজ নাহ। নারী গাড়ি চালালে দূর্ঘটনা ঘটবে, বিপদ আসবে! তাহলে কি শত শত সড়ক দূর্ঘটনা ঘটার কারণ ড্রাইভারের পুরুষ হওয়া? তারা বলে, দেশের নেতৃত্ব যদি একজন নারী দেয় তাহলে অশান্তি তো আসবেই! সত্যি কি তাই? তাহলে একজন পুরুষের নেতৃত্বে থাকা দেশেও কেন অশান্তি বিশৃঙ্খলা বিরাজ করে? সেসব দেশে অশান্তি বিরাজ করার কারণ কি সেসব দেশের প্রধান পুরুষ হওয়া? কারণ আর যাইহোক সবকিছুতে নারীকে দায়ী করা নারী বিদ্বেষ থেকেই আসে। নারী বশ্যতা মেনে পায়ের নিচে পড়ে থাকবে নাহ, এগিয়ে যাবে সেটা মূলত সহ্য হয় নাহ। সবকিছুতে প্রিথুলা রশিদদের সহজেই দায়ী করা যায়। মুখ থাকলে সহজেই বলা যায়, হাত থাকলে সহজেই লেখা যায়। কিন্তু ভয়ংকরতম মুহূর্তে নিজের জীবনের কথা নাহ ভেবে দশজনের জীবন বাঁচানোর মতো বীরত্বের কাজ সবাই করতে পারে নাহ। আমি নিশ্চিত যারা বিশ্বাস করে বিমান দূর্ঘটনার কারণ নারী পাইলট তারা কখনো পারবে নাহ এমন ভয়াবহ পরিস্থিতিতে প্রিথুলার মতো মহৎ কাজ করার! কারণ এতো নিচ মনোভাব নিয়ে নিজের জীবনের কথা নাহ ভেবে অন্যের জীবন বাঁচানো যায় নাহ। প্রিথুলা যা করেছে তা সেই বিকারগ্রস্তদের গালে থাপ্পড় হয়ে থাকবে সবসময়!

সেইসাথে থাপ্পড় হয়ে থাকবে কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরীতে চলমান মহিলা ফুটবল টুর্নামেন্ট আয়োজন বন্ধে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করা বাংলাদেশ ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনের নেতাদের মতো কাঠমোল্লাদের গালে! যারা মেয়েদের জীবনে দেয়াল হয়ে দাঁড়ায়, মেয়েদের পায়ে শিকল পড়াতে চায়। মাঠে ফুটবল খেলতে আগ্রহী মেয়েরা কিন্তু নিজেকে গোপনীয় সামগ্রী ভাবে নাহ। তারা নিজেদের মানুষ মনে করেই বাঁচতে চাইছে, উড়তে চাইছে। আর কাঠমোল্লারা উঠে পড়ে লেগেছে তাদের ডানা কেটে দিতে, তাদের জীবন দাসত্বে বন্দি করতে চাইছে। কাঠমোল্লাদের চোখে মেয়েমানুষের বাইরে ফুটবল খেলার অর্থ বেহায়াপনা অথচ ছেলেদের ফুটবল খেলায় কোনোরূপ বেহায়াপনা খুঁজে পান নাহ। কারণ তাদের চিন্তাধারা অনুযায়ী পুরুষই একজন স্বাভাবিক মানুষের জীবন যাপন করতে পারে, নারী তা পারে নাহ। নারীকে থাকতে হবে পুরুষের বানানো নানা নিয়ম মাথায় নিয়ে! কারণ তাদের চিন্তাধারা অনুযায়ী নারী মানুষের পর্যায়ে পড়ে নাহ! মেয়েরা তো ঠিক করে দেয় নাহ কাঠমোল্লারা কিভাবে চলবে আর কিভাবে চলবে নাহ। তাহলে নারীর ব্যক্তিগত জীবনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার নামে জুলুম করার অধিকার এসব কাঠমোল্লারা কোথায় পায়? নারীসমাজ এসব অন্যায় আবদারের প্রতিবাদ জোর গলায় নাহ করলে, তাদের ব্যক্তিগতজীবনের ওপর যারা শাসন করতে চায় তাদের বিরোধিতা নাহ করলে এদেশে নারীসমাজ আরও ঘন অন্ধকারের দিকে যাবে আর তখন খাঁচা থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব হবে নাহ!

Marufur Rahman Khan

Marufur Rahman Khan is an Atheist Blogger from Bangladesh.

2 thoughts on “আমার বোন বিমান চালাবে, আমার বোন ফুটবল খেলবে! আপনারা কারা?

  • April 2, 2018 at 10:08 AM
    Permalink

    খুব ভাল লিখেছেন।

    Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *