নবি মুহাম্মদের ২৩ বছর – আলি দস্তি

Print Friendly, PDF & Email

ইসলামে নারী

তৃতীয় অধ্যায় । রাজনীতি । ইসলামে নারী

‘নারীদের সহৃদয়তার সাথে দেখাশোনা কর! তারা অবরুদ্ধ” এবং তাদের নিজেদের উপর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। হিজরি ৯ সালে (৬৩১ খ্রিস্টাব্দে) মক্কায় নবি মুহাম্মদ বিদায় হজের ভাষণে নারীদের সম্পর্কে এ-উক্তি করেছিলেন। প্রাক-ইসলামি যুগে আরব সমাজে নারীদের স্বাধীন নাগরিকের মর্যাদা ছিল না। পুরুষের অধীন বলে গণ্য করা হত। নারীদের প্রতি প্রায় সব ধরনের অমানবিক আচরণ বৈধ হিসেবে স্বীকৃতি পেত। অন্য যে কোনো অস্থাবর সম্পত্তির (দাস) মতো আরব নারীও কোনো ব্যক্তির উত্তরসূরির হাতে উত্তরাধিকার সূত্রে চলে যেতেন। নতুন মালিক ওই নারীকে কোনো প্রকার দেনমোহর প্রদান করা ছাড়াই নিজের স্ত্রী করে রাখতে পারতো। ওই নারী যদি মালিকের স্ত্রী হতে অস্বীকৃতি জানায় তবে মালিক নারীর সম্পদ দখল নিতে পারতেন। যদি ওই নারী সেটাও না করতেন তবে মালিক আমৃত্যু তাকে আটকে রাখতে পারতো।

সুরা নিসা-এর ১৯ নম্বর আয়াতের মাধ্যমে এই অমানবিক বিধান তুলে দেয়া হয় ; হে বিশ্বাসিগণ! জবরদস্তি করে নারীদেরকে তোমাদের উত্তরাধিকার গণ্য করা তোমাদের জন্য বৈধ নয়। তোমরা তাদেরকে যা দিয়েছ তা থেকে কিছু আত্মসাৎ করার উদ্দেশ্যে তাদের ওপর অত্যাচার করো না। তারা যদি প্রকাশ্যে ব্যভিচার না করে, তবে তোমরা তাদের সাথে সৎভাবে জীবনযাপন করবে। (৪:১৯)। সুরা নিসার ৩৪ নম্বর আয়াতে পুরুষ নারীর রক্ষাকর্তা উক্তিটি সমাজে নারী-পুরুষের অসাম্যের কথা প্রকাশ করে। নারীর তুলনায় পুরুষের উচ্চতর অবস্থানের কথা উক্ত আয়াতের পরের দুই বাক্যে উল্লেখ করেছেন ; কারণ আল্লাহ তাদের এককে অপরের ওপর বিশিষ্টতা দান করেছেন, আর এ এজন্য যে, পুরুষরা তাদের ধনসম্পদ থেকে ব্যয় করে…। তবে ঠিক কোন কারণে আল্লাহ নারী অপেক্ষা পুরুষকে শ্রেয়তর হিসেবে বেছে নিয়েছেন নির্দিষ্ট করে তার ব্যাখ্যা করা হয়নি।

তফসির আল-জালালাইন-এর বক্তব্য অনুযায়ী পুরুষ নারী অপেক্ষা শ্রেয়তর কারণ তাদের বুদ্ধিমত্তা, জ্ঞানের পরিধি, প্রশাসনিক দক্ষতা। আল-জামাখশারি”, আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর আল-বায়দাওয়ি এবং আরও অনেক মুসলিম পণ্ডিত অবশ্য এই বক্তব্যের আরও গভীরে গিয়ে অধিবিদ্যাগত রূপ দিতে চেষ্টা করেছেন। তাঁরা নারীর ওপর পুরুষের কর্তৃত্বকে কোনো বিষয়ের ওপর তার নিয়মের কর্তৃত্বের সাথে তুলনা করেছেন। নবুওতি, ইমামতি, শাসনের অধিকারগুলো একমাত্র পুরুষের জন্য বরাদ্দ রেখেছেন, কারণ তাদের মতে এটা তুলনমূলক বেশি শক্তিশালী, বেশি বুদ্ধিমান ও বেশি বিচক্ষণ। ইসলামি আইনে পুরুষ উত্তরাধিকারসূত্রে নারী অপেক্ষা বেশি সম্পত্তি পায়। একজন পুরুষের সাক্ষ্যও নারীর তুলনায় বেশি গ্রহণযোগ্য। নির্দিষ্ট করে বললে পুরুষের ভাগের প্রাপ্য সম্পত্তি নারীর ভাগের তুলনায় দ্বিগুণ। একইভাবে আদালতেও একজন পুরুষের সাক্ষ্য একজন নারীর সাক্ষ্যের তুলনায় দ্বিগুণ গ্রহণযোগ্য বলে গণ্য করা হয়। জিহাদে অংশগ্রহণ করা বা শুক্রবারের জুমার নামাজে অংশ নেয়াও নারীদের জন্য জায়েজ নয়। তালাক দেয়ার অধিকার শুধুমাত্র স্বামীর রয়েছে; স্ত্রীর এতে কোনো হাত নেই। আরও বিভিন্ন কাজ, যেমন আজান দেয়া, মসজিদে ইমামতি করা, ঘোড়ায় চড়া, তীর-ধনুক চালানো, বড় ধরনের কোনো অপরাধে সাক্ষ্য দেয়া ইত্যাদি শুধু পুরুষদের জন্যই সংরক্ষিত রাখা হয়েছে।

এই পুরুষতান্ত্রিকতার পক্ষের যুক্তিগুলোর দুর্বলতা পাঠকেরা খুব সহজে ধরতে পারবেন। তৎকালীন সামাজিক পরিবেশই ছিল পুরুষের শাসকসুলভ-মনোভাব এবং নারীর নীচু অবস্থানের প্রধান কারণ। বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠানেও নারীকে পুরুষের তুলনায় কম সম্মানের স্থান দেয়া হতো। ইসলামে নারীদের মূল্য উত্তরাধিকার ও সাক্ষ্যে পুরুষের তুলনায় অর্ধেক বলে বিবেচনা করা হয়। এধরনের বৈষম্য শুধুমাত্র ইসলামের জন্য বিচ্ছিন্ন কিছু নয়। বরং নারীজাতির ক্রমাগত অবমাননার ফলাফল। বিষয়গুলো পুরোপুরি পরিষ্কার। ফলে হালকা চালে সাফাই গেয়ে এড়িয়ে যাওয়া যায় না। ইতিহাসের শুরু থেকে সকল আদিম সমাজে পুরুষ জাতি বেঁচে থাকার জন্য সংগ্রামের জন্ম দিয়েছে এবং নারীকে দ্বিতীয় আসনে ঠেলে দিয়েছে। জার্মান দার্শনিক ফ্রেডরিক নিৎসের ভাষায় নারীকে দ্বিতীয় শ্রেণীর মানুষ বলে গণ্য করা হয়েছে। প্রাচীন আরবে এই দ্বিতীয় শ্রেণীর প্রতি বর্বরতা আরও ভয়ঙ্কররূপে ছিল। নবি মুহামদ কোরানের আইন প্রণয়নের মাধ্যমে নারীদের কিছু অধিকার দিয়ে বর্বরতার ধার অনেকটুকু কমিয়ে আনার চেষ্টা করেছিলেন। সুরা নিসার বেশিরভাগ আয়াতেই নারীদের প্রতি বৈষম্য হ্রাস ও আইনি অধিকার বিষয়ে মন্তব্য রয়েছে।

তবে যৌক্তিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিচার করলে ইসলাম বিশেষজ্ঞদের তুলে ধরা বিভিন্ন বক্তব্যে যুক্তির পরিমাণ খুবই সামান্য। মূলত তাদের বক্তব্য প্রাচীন আরবীয় নিয়মকেই নতুন রূপে দাঁড় করানোর চেষ্টা। অবশ্য এর জন্য তাদেরকে খুব বেশি দোষ দেয়া যায় না। কারণ তাদের বক্তব্যের একমাত্র উদ্দেশ্যই হচ্ছে, কিভাবে আল্লাহ নারী অপেক্ষা পুরুষকে বেশি পছন্দ করেন, বা নারী অপেক্ষা পুরুষকে বেশি বিশিষ্টতা দান করেছেন সেই কোরানীয় বক্তব্যের ব্যাখ্যা দেয়া। সুরা নিসার ৩৪নম্বর আয়াতের আরেকটি ব্যাখ্যা আছে, ‘পুরুষ নারীর পিছনে অর্থ ব্যয় করে এটা শুনতে যৌক্তিক মনে হতে পারে। যেহেতু নারীর খরচের দায়িত্ব পুরুষ ঘাড়ে তুলে নিয়েছে, সেহেতু নারী পুরুষের ওপর নির্ভরশীল। এ-কারণে নারী পুরুষের সকল আদেশ-নির্দেশ মানতে বাধ্য। আর এ-কারণে আল-জামাখশারি, আল-বায়দাওয়িসহ অন্যান্য বিশেষজ্ঞ রায় দেন, পুরুষই হলো প্রভু এবং নারী হলো ভৃত্যস্বরূপ। সুরা নিসার উপরোক্ত আয়াতের এই বাক্য থেকে উপসংহার টানা যায় এভাবে: তাই সাধবী স্ত্রীরা অনুগতা এবং যা লোকচক্ষুর অন্তরালে আল্লাহর হেফাজতে তারা তার হেফাজত করে। অর্থাৎ ভাল স্ত্রী তাকে বলা যায় যে তার স্বামীর কথা মেনে চলেন এবং স্বামীর অনুপস্থিতিতে নিজেকে স্বামীর জন্য গচ্ছিত রাখেন। বোঝা যাচ্ছে স্ত্রীরা সবাই তাদের স্বামীর অধীন এবং এ-কথা ভুলে যাওয়া যাবে না।

এতো কিছুর পরও বলা যায় সুরা নিসা অনেক ক্ষেত্রেই নারীকে বেশ কিছু অধিকার দিয়েছে। প্রাচীন আরবীয় নিময়-কানুনের তুলনায় কোরানের বিধি কিভাবে নারীকে সহায়তা করেছে তা সুরা নিসার আয়াতগুলি থেকে বুঝা যায়। একটি উদাহরণ দেয়া যেতে পারে, সুরা নিসার ২০-২১ আয়াতদ্বয়ে রয়েছে পুরুষের প্রতি নির্দেশ : “যদি তোমরা এক স্ত্রীর জায়গায় অন্য স্ত্রী নেওয়া ঠিক কর আর তাদের একজনকে প্রচুর অর্থও দিয়ে থাক তবুও তার থেকে কিছুই নেবে না। তোমরা কি মিথ্যা অপবাদ দিয়ে ও জুলুম করে তা নিয়ে নেবে? কেমন করে তোমরা তা নেবে, যখন তোমরা পরস্পর সহবাস করেছ ও তারা তোমাদের কাছ থেকে শক্ত প্রতিশ্রুতি নিয়েছে? (৪:২০-২১)। স্ত্রীসঙ্গ উপভোগের পর বিবাহের সময় ধার্য দেনমোহর পরিশোধ না করে কোনো পুরুষ তালাক দিয়ে পুনরায় বিয়ে করতে পারবে না। দেনমোহর যা ধরা হয়েছিল তা ওই পুরুষকে পরিশোধ করতেই হবে। তবে এই সুরা নিসায় আবার প্রাচীন আরবের কিছু নারী-বিদ্বেষী নিয়মকে মেনে নেয়া হয়েছে। যেমন সুরা নিসার ওই ৩৪নম্বর আয়াতে শেষ বাক্যে স্বামী কর্তৃক স্ত্রীকে প্রহারের অনুমতি দেয়া হয়েছে: স্ত্রীদের মধ্যে যাদের অবাধ্যতার আশঙ্কা কর তাদেরকে ভালো করে উপদেশ দাও, তারপর তাদের বিছানায় যেয়ো না ও তাদেরকে প্রহার করো। পুরুষেরা তাদের দৈহিক শক্তির কারণে এমন অনাকাঙ্ক্ষিত ও কাপুরুষোচিত কাজ সেই সুপ্রাচীনকাল থেকেই করে আসছে। এমন-কী এই বিংশ শতাব্দীতেও তা সমান তালে চলছে। প্রকৃতপক্ষে কোরানে বর্ণিত এ-বিধান নারীর প্রতি এ নিষ্ঠুরতাকে ধরে রেখেছে।

প্রতিটি সম্প্রদায়ের নিয়মকানুনগুলো তাদের আচার-আচরণ, নৈতিকতাবোধকে প্রতিফলিত করে। সুরা নিসার ৩৪ নম্বর আয়াতকে আমরা সেভাবেই দেখতে পারি যে, প্রাচীন আরবীয়দের কাছে স্বামী ছিল প্রভুর মতো, স্ত্রীকে শারীরিক-মানসিক আঘাত করার সব রকম অধিকার তাদের ছিল। জুবায়ের বিন আল-আওয়ামের চতুর্থ স্ত্রী এবং হজরত আবু বকরের কন্যা আসমাকে একবার বলতে দেখা যায়, জুবায়ের যখন স্ত্রীদের ওপর রেগে যেতেন তখন লাঠি না ভাঙা পর্যন্ত প্রহার করতে থাকতেন। এ-ব্যাপারে ইসলামি আইনে অন্তত কিছু সীমারেখা এবং স্তরবিন্যাস করে দেয়া হয়েছে। প্রথমত সতর্কবাণী প্রদান করা হয়েছে। যৌনমিলনে বাধা প্রদানের ক্ষেত্রে স্ত্রীকে প্রহার করাকে সর্বশেষ বৈধ অস্ত্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। অনেক তফসিরকারক এবং ইসলামি আইন-বিশেষজ্ঞদের মতে স্ত্রীকে প্রহার করা জায়েজ হলেও তা যেন হাড় ভাঙার পর্যায়ে চলে না যায়। তাহলে আবার শারীরিক আঘাতের কারণে ক্ষতিপূরণ দেয়ার দাবি উঠতে পারে। ৩৪নম্বর আয়াত প্রসঙ্গে আল-জামাখশারি মন্তব্য করেছেন: ইসলামবিশেষজ্ঞদের অনেকে অবাধ্য স্ত্রীর প্রাপ্য শাস্তির এই স্তরবিন্যাস মেনে নিতে রাজি নন। তাঁরা একই সাথে তিন ধরনের শাস্তি প্রদানকেই অনুমোদন দিয়েছেন। এধরনের ব্যাখ্যা একমাত্র ইবনে হানবল, ইবনে তায়মিয়ার মতো আরবীয় ধর্মীয় নেতাই দিতেন পারেন। তবে এ-সকল বক্তব্যের অর্থ একদম পরিষ্কার এবং পরবর্তী আয়াতে তা নিশ্চিত করে; আর যদি দুজনের (স্বামীস্ত্রীর) মধ্যে বিরোধ আশঙ্কা কর তবে তোমরা তার (স্বামীর) পরিবার থেকে একজন ও ওর (স্ত্রীর) পরিবার হতে একজন সালিশ নিযুক্ত করবে। যদি তারা উভয়ে নিষ্পত্তি চায় তবে আল্লাহ তাদের মধ্যে ফয়সালার অনুকুল অবস্থা সৃষ্টি করবেন। (৪:৩৫)।

নিকট আত্নীয়ের সাথে বিবাহের নিষেধাজ্ঞা সুরা নিসার ২৩ নম্বর আয়াতে দেখতে পাই। এই বিধানটি ইহুদি আইনেও আছে এবং প্রাচীন আরবের পৌত্তলিক সমাজেও এই নীতি অনুসরণ করা হতো। তবে ব্যতিক্রম হচ্ছে এর পূর্বের আয়াতে, নারীদের মধ্যে তোমাদের পিতৃপুরুষ যাদেরকে বিয়ে করেছে তোমরা তাদেরকে বিয়ে করো না। পূর্বে যা হয়ে গেছে, তা হয়ে গেছে। (৪:২২)। কোরানের এ-রকম বিধান এবং বিশেষ শর্তারোপ থেকে আমরা বুঝতে পারি, ইসলাম-পূর্ব আরবে এমন জঘন্য ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। তবে ২৪ নম্বর আয়াতের বিধান নতুন কিছু নয়। ইসলাম-পূর্ব যুগেও সেটা প্রযোজ্য ছিল। তবে বিস্ময়কর হচ্ছে, এই আয়াতের মাধ্যমে দাসীদেরকেও মালিকদের কাছে হস্তগত করা হয়েছে। অর্থের বিনিময়ে ক্রয় করা, কিংবা যুদ্ধে বন্দী হওয়া দাসীকে কোনো মানবিকতা ও আইনি বাধ্যবাধকতা ছাড়াই বিবাহের জন্য হস্তান্তর করা যায়। এমন কী ওই দাসীর স্বামী জীবিত থাকলেও। ইবনে সাদের* একটি উক্তি রয়েছে: হুনাইনের নিকট আওতাসের যুদ্ধে কয়েকজন নারী বন্দী আমাদের ভাগে পড়ে। যেহেতু ওই নারীদের স্বামী জীবিত ছিল, তাই তাদের সাথে যৌনমিলনে না গিয়ে নবির সাথে আলোচনা করতে গেলাম। তখন এই সুরা নিসার ২৪ নম্বর আয়াত নাজিল হয়: ‘নারীদের মধ্যে তোমাদের ভান হাতের নারী (যুদ্ধবন্দী) ছাড়া সকল বিবাহিত নারী তোমাদের জন্য নিষিদ্ধ। (৪:২৪)। এভাবে ওই যুদ্ধবন্দিনীদের কর্তৃত্ব আমরা পেয়ে গেলাম। আবার একই আয়াতে আমরা নবির মনে নারী অধিকার ও তৎকালীন কুপ্রথা নিয়ে সচেতনতা দেখতে পাই। শেষ তিনটি বাক্যে রয়েছে ; তোমাদের জন্য এ আল্লাহর বিধান। উল্লিখিত নারীরা ছাড়া আর সকলকে ধনসম্পদ দিয়ে বিয়ে করা বৈধ করা হলো, ব্যভিচারের জন্য নয়। তাদের মধ্যে যাদেরকে তোমরা উপভোগ করবে তাদেরকে নির্ধারিত মোহর দেবে। মোহর নির্ধারণের পর কোনো বিষয়ে পরস্পর রাজি হলে তাতে তোমাদের কোনো দোষ নেই। যাদেরকে তোমরা উপভোগ করবে তাদেরকে নির্ধারিত মোহর দেবে- এই ধরনের বক্তব্য থেকে প্রশ্ন ওঠে ইসলামে কি অস্থায়ী বিবাহ (মুতাপ বিবাহ জায়েজ? সুন্নি পণ্ডিতরা বলেন, এমনটা জায়েজ নয়। কারণ এই বক্তব্যগুলো মুসলমানদের মক্কা বিজয়ের পর নাজিল হয়েছিল এবং এর মেয়াদ ছিল মাত্র তিনদিন। শিয়া বিশেষজ্ঞদের মতে, এধরনের বিবাহ ইসলাম অনুযায়ী জায়েজ।

সুরা মুমতাহানা-এর ১০ নম্বর আয়াত থেকে ওই সময়ের নারী-পুরুষের সামাজিক সম্পর্ক বুঝা যায় : হে বিশ্বাসিগণ! বিশ্বাসী নারীরা দেশত্যাগী হয়ে তোমাদের কাছে এলে তোমরা তাদেরকে পরীক্ষা করো। আল্লাহ তাদের বিশ্বাস সম্বন্ধে ভালো করে জানেন। যদি তোমরা জানতে পার যে তারা বিশ্বাসী তবে তাদেরকে অবিশ্বাসীদের কাছে ফেরত পাঠিয়ো না। বিশ্বাসী নারীরা অবিশ্বাসীদের জন্য বৈধ নয়, আর অবিশ্বাসীরা বিশ্বাসী নারীদের জন্য বৈধ নয়। অবিশ্বাসীরা যা খরচ করেছে তা তাদেরকে ফিরিয়ে দিয়ো। তারপর তোমরা তাদেরকে বিয়ে করলে তোমাদের কোনো পাপ হবে না, যদি তোমরা দেনমোহর দাও। তোমরা অবিশ্বাসী নারীদের সাথে দাম্পত্য সম্পর্ক বজায় রেখো না। তোমরা যা খরচ করেছ তা ফেরত চাইবে ও অবিশ্বাসীরা ফেরত চাইবে তারা যা খরচ করেছে। (৬০:১০)। অর্থাৎ কোনো বিবাহিত নারী যদি ইসলাম গ্রহণ করে পালিয়ে যায় তবে তার অবিশ্বাসী স্বামী স্ত্রীর ওপর অধিকার হারিয়ে ফেলে। সে অনুরোধ করলেও মুসলমানরা স্ত্রীকে ওই অমুসলমান ব্যক্তির কাছে ফিরিয়ে দিবেন না। তবে মুসলমানরা ওই ব্যক্তির স্ত্রীর প্রতি তার খরচের ক্ষতিপূরণ অবশ্য দিবেন। একইভাবে কোনো মুসলমানের স্ত্রী যদি অবিশ্বাসী হয়ে যান, তবে ওই ব্যক্তি স্ত্রীকে রাখার জন্য জোর করতে পারবেন না এবং ওই নারীকে তার সম্প্রদায়ের কাছে ক্ষতিপূরণের বিনিময়ে ফেরত পাঠিয়ে দিতে হবে।

স্ত্রীর প্রতি অসুস্থ মানসিকতা থেকে আরবীয়দের পরিবর্তনের জন্য নবির মানবিক চিন্তা চেতনার প্রতিফলন আমরা সুরা বাকারা-এর বিভিন্ন আয়াতে দেখতে পাই। যেমন : যখন তোমরা স্ত্রীদেরকে তালাক দাও এবং তারা ইদ্দতকাল পূর্ণ করে, তখন তাদের যথাবিধি রেখে দেবে বা তাদেরকে ভালোভাবে বিদায় দেবে। তাদেরকে অত্যাচার বা তাদের ওপর বাড়াবাড়ির উদ্দেশ্যে আটক করে রাখবে না। (২:২৩১)। অর্থাৎ যখন কোনো স্বামী তার স্ত্রীকে তালাক দেয়ার কথা উচ্চারণ করে ফেলেন তবে একটি নির্দিষ্ট করতে পারবেন না। আর তাদের বিয়ের পক্ষে বা বিপক্ষের সব সিদ্ধান্তই সমানজনকভাবে এবং দুই পক্ষের আপোসের মাধ্যমে নিতে হবে। দীর্ঘ সময়ের জন্য আটকে রেখে বা কোনো রকম হুমকির মাধ্যমে স্ত্রীর অধিকার খর্ব করা যাবে না। পরবর্তী আয়াতে এমনই নির্দেশ আমরা দেখি তোমরা যখন স্ত্রীদেরকে তালাক দাও আর তারা তাদের ইদ্দতকাল পূর্ণ করতে থাকে তখন তারা যদি পরস্পর সম্মত হয়ে তাদের (পূর্বের) স্বামীদের বিধিমতো বিয়ে করতে চায় তবে তাদেরকে বাধা দেবে না। (২:২৩২)। বলা হয়ে থাকে এই আয়াতটি এসেছে, মাকিল বিন ইয়াসিরের একটি আচরণের কারণে। তিনি তার বোনকে তালাকদাতা স্বামীর সাথে বিয়ে দিতে বাধা দিচ্ছিলেন।

সুরা বাকারা’র একটি কম আলোচিত বিষয়ের প্রতি আমরা এখন আলোকপাত করব। এই আয়াত থেকে আমরা নবি মুহাম্মদের সময়কার সমাজ-ব্যবস্থার এক ঝলক দৃশ্য দেখতে পাই: রজঃস্রাবকালে স্ত্রীসঙ্গ বর্জন করবে, আর যতদিন না তারা পবিত্র হয়, তাদের কাছে (সহবাসের জন্য) যেয়ো না। তারপর যখন তারা পরিশুদ্ধ হবে, তখন তাদের কাছে ঠিক সেইভাবে যাবে যেভাবে আল্লাহ তোমাদেরকে আদেশ দিয়েছেন। (২:২২২)। তফসির আল-জালালাইনের বক্তব্য অনুযায়ী ঠিক সেইভাবে যাবে মানে রজঃস্রাবের পূর্বে যেভাবে স্ত্রীর সঙ্গে মিলিত হতেন, সেটাকে বুঝাচ্ছে। কিন্তু পরবর্তী আয়াতেই আমরা পরস্পর-বিরোধী একটি বক্তব্য দেখতে পাই : তোমাদের স্ত্রীরা তোমাদের শস্যক্ষেত্র। অতএব তোমরা তোমাদের শস্যক্ষেত্রে যেভাবে ইচ্ছা যেতে পার। ’ (২:২২৩)। তফসির আল-জালালাইনে তোমাদের শস্যক্ষেত্রে যেভাবে ইচ্ছা যেতে পার’- কে ব্যাখ্যা করা হয়েছে এভাবে,

‘দাঁড়িয়ে, বসে, শুয়ে, সামনে থেকে, পাশ থেকে, অথবা পিছন থেকে যেভাবে ইচ্ছা যৌনমিলনকে বুঝানো হচ্ছে। এই তফসিরে আরও বলা হয়েছে, এই আয়াত নাজিলের উদ্দেশ্য হচ্ছে সে-সময়ের একটি ইহুদি সংস্কারকে সবার মন থেকে দূর করা। ইহুদি সংস্কার অনুযায়ী, পেছন থেকে সঙ্গম করলে সন্তান ট্যারা চোখের, অথবা বাহাতি হয়ে জন্মায়। জালাল উদ্দিন আল-সুয়তি’র মতে ২২২নম্বর আয়াতের ঠিক সেইভাবে যাবে যেভাবে আল্লাহ তোমাদেরকে আদেশ দিয়েছেন নির্দেশ পরবর্তী আয়াতের মাধ্যমে খারিজ হয়ে গিয়েছে। হজরত ওমরসহ নবির বেশ কয়েকজন সাহাবির আবেদনের ফলে এটি খারিজ হয়েছে। খ্রিস্টান-ইহুদিরা নারীর সাথে পাশ ফিরে মিলনে যেত। মদিনার আনসারেরাও একই প্রথা অবলম্বন করতেন। আর মুহাজিররা কুরাইশ ও অন্যান্য মক্কাবাসীর যৌন-আচরণ অনুসরণ করতেন। তারা নারীদের সাথে বিভিন্নভাবে মিলন করতেন। কখনো নারীদের বুকের ওপর, কখনোবা পিঠের ওপর বসিয়ে। কখনো পেছন থেকে, কখনো সামনে থেকে তাদের সঙ্গিনীর সাথে যৌনমিলন করতেন। কোনো মুহাজির পুরুষ কোনো আনসার নারীকে বিয়ে করলে তার সাথেও এরকম যৌন-আচরণ করতে চাইতেন। কিন্তু আনসার স্ত্রী অস্বীকৃতি জানিয়ে বলতেন, আমরা কেবল পাশ ফিরে শুয়ে থাকি। বিষয়টি নবির কানেও পৌছায় এবং এ-বিষয়ে পুরুষদের করণীয় সম্পর্কে আয়াত নাজিল হয়। আহমদ ইবনে হানবল এবং তিরমিজির মতে আয়াতটির অর্থ হচ্ছে, “সামনে অথবা পিছন থেকে, মাথার উপরে অথবা নিচে রেখে। হজরত ওমর এক সকালে নবির কেমন কাটল?” প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন, গতকাল রাতে আমি আমার পদ্ধতি পরিবর্তন করেছিলাম। কিন্তু আনন্দ পাইনি। এরপর এই আয়াতটি নাজিল হয়।

কোরানের আয়াত এবং ইসলামের শিক্ষা থেকে বোঝা যায় প্রাচীন আরবে নারীদের মর্যাদা অত্যন্ত নিচু ছিল। পুরুষেরা নারীকে অত্যন্ত অমানবিক দৃষ্টিতে বিচার করতেন। যেমন সুরা নুর-এর ৩৩নম্বর আয়াতে আর্থিক লাভের জন্য দাসীদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে দেহ ব্যবসায় বাধ্য করতে নিষেধ করা হয়: তোমাদের দাসীরা সতীত্ব রক্ষা করতে চাইলে, পার্থিব জীবনের টাকাপয়সার লোভে তাদেরকে ব্যভিচারিণী হতে বাধ্য করো না।’ (২৪:৩৩)। প্রচলিত আছে যে, আব্দুল্লাহ বিন উবায় পূর্বে এমন ঘৃণ্য ব্যবসায় নিয়োজিত ছিলেন। উবায় শুধু একমাত্র ব্যক্তি নন, আরব সমাজে দাসীদের যৌনব্যবসায় বাধ্য করে মালিকদের পকেট ভারী করা অত্যন্ত লাভজনক ব্যবসা ছিল; ফলে অনেকেই এ-ব্যবসার সাথে জড়িত ছিলেন। নবির মক্কা বিজয়ের পর মক্কাবাসী নারীদের একটি বড় অংশ ইসলাম গ্রহণের ইচ্ছা প্রকাশ করেন এবং নবির কাছে আনুগত্য প্রকাশ করেন। এ-প্রেক্ষিতে সুরা মুমতাহানা-এর ১২নম্বর আয়াত নাজিল হয়। মক্কাবাসী নারীদের বিশ্বাস ও আচরণের ওপর শর্তারোপ করে ইসলামে দীক্ষিত হবার সুযোগ দেয়া হয় : হে নবি! বিশ্বাসী নারীরা যখন তোমার কাছে আনুগত্যের শপথ করতে এসে বলে যে, তারা আল্লাহর সাথে কাউকে শরিক করবে না, চুরি করবে না, ব্যভিচার করবে না, নিজেদের সন্তানদের হত্যা করবে না, অপরের সন্তানকে স্বামীর ঔরসে আপন গর্ভজাত সন্তান বলে মিথ্যা দাবি করবে না, এবং সৎকাজে তোমাকে অমান্য করবে না, তখন তাদের আনুগত্য গ্রহণ করো আর তাদের জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করো। (৬০:১২)। এই শর্তাবলীর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ইসলামে দীক্ষিত হওয়া সহজবোধ্য এবং সহজে গ্রহণযোগ্য। শুধু পূর্বে পালন করা কুপ্রথাগুলি ত্যাগ করার কথা এখানে বলা হচ্ছে। এছাড়া ইসলামে নারীদের জোরে শব্দ করার ওপর নিষেধ করা হয়। পোশাকের কলার তুলে রাখা, চুল এলোমেলো রাখা ইত্যাদি অভ্যাসও ত্যাগ করার কথা বলে ইসলাম। মক্কা বিজয়ের পর এধরনের শর্তাবলী প্রকাশের পর কুরাইশ নেতা আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দ বিনতে উতবা বলেন, আদর্শ ঘরের কোনো স্বাধীন নারীই ব্যভিচার ও দেহব্যবসায় জড়াতে পারেন না। ’

ইসলামি শিক্ষায় নিষিদ্ধ অন্যতম কুপ্রথা হচ্ছে নারী শিশুদের হত্যা করা। সুরা তাকভির-এর ৮-৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে : ‘জীবন্ত-কবর দেয়া কন্যাকে যখন জিজ্ঞাসা করা হবে, কী দোষে ওকে হত্যা করা হয়েছিল?’(৮১৮-৯)। ইসলাম-পূর্ব আরবে পুত্রসন্তানকে মূল্যবান বিবেচনা করা হতো। পুত্রসন্তান জন্ম হলে সবাই অহংকার করত। কিন্তু কন্যাসন্তানকে বোঝা ও অবমাননাকর মনে করতো। তারা এতোটাই নির্বোধ ছিল যে মানব-জাতির ভবিষ্যত রক্ষায় নারীদের যে প্রয়োজনীতা রয়েছে, সেটা তারা আন্দাজ করতে পারতেন না। সূরা নাহল-এর ৫৮-৫৯ নম্বর আয়াতদ্বয়ে বলা হয়েছে: “ওদের কাউকেও যখন কন্যাসন্তানের সুসংবাদ দেয়া হয় তখন ওদের মুখ কালো হয়ে যায় ও মন ছোট হয়ে যায়। আর যে-খবর সে পায় তার লজ্জায় সে নিজের সম্প্রদায় থেকে নিজেকে লুকিয়ে রাখে। (ভাবে) অপমান সহ্য করে সে ওকে রাখবে? না মাটিতে পুতে ফেলবে? আহ! কী খারাপ ওদের সিদ্ধান্ত (১৬:৫৮-৫৯)।

নারী ও মুহাম্মদ

তৃতীয় অধ্যায় । রাজনীতি । নারী ও মুহাম্মদ

পশ্চিমা পণ্ডিত ইজহাক গোল্ডজিহার বলেছেন, ইসলাম প্রতিষ্ঠাতার কর্মজীবন ও ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে কোরান, হাদিস ও জীবনীগ্রন্থগুলো যেভাবে অকপট ও বিস্তারিত তথ্যসমৃদ্ধ, অন্যান্য ধর্মের পবিত্রগ্রন্থ, ধর্মপ্রচারকের কীর্তিগাঁথা এবং ইতিহাসের বইগুলো সেদিক থেকে সমকক্ষ নয়। গোল্ডজিহার তার অত্যন্ত মূল্যবান বই Le dogme et la loi de l’Islam – slā একটি অধ্যায়ে প্রশংসাসূচক মন্তব্যের মাধ্যমে নারীদের প্রতি নবি মুহাম্মদের ক্রমবর্ধান প্রীতি সম্পর্কে বিশদভাবে নথিভুক্ত ঐতিহাসিক সত্যগুলো তুলেধরেছেন। ইব্রাহিম এবং নুহ ছাড়াও যিশু এবং মুসা নবির জীবন সম্পর্কে আমরা যা জানি তা আসলে জনপ্রিয় কল্পপুরাণে তৈরি কুয়াশার বাতাবরণে ও ধর্মীয় রক্ষণশীলতার ধারণায় আবদ্ধ। নবি মুহামদের জীবন সম্পর্কে কোরানের আয়াত, নির্ভরযোগ্য হাদিস এবং প্রথমদিককার জীবনী-গ্রন্থগুলোতে শতাধিক বর্ণনা রয়েছে যেগুলো পক্ষপাতদুষ্টতার অভিযোগ থেকে মুক্ত। এ-উৎসগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে কোরান, যার আয়াতে সমসাময়িক বিভিন্ন ঘটনাবলী সম্পর্কে তথ্য সরাসরি পাওয়া যায়; এবং আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার সময়কালীন প্রেক্ষাপটসমূহ তফসিরকারকদের মাধ্যমে পরোক্ষভাবে জানা যায়। নবি মুহাম্মদের ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কিত আয়াতগুলোর সংখ্যা লক্ষণীয়ভাবে অনেক বেশি।

কোরানের সকল তফসিরকারক একমত যে, ইহুদিদের দ্বারা নবির নারীসঙ্গ প্রীতির সমালোচনার প্রেক্ষিতে সুরা নিসা-এর ৫৪ নম্বর আয়াত অবতীর্ণ হয়েছিল। ইহুদিদের অভিযোগ ছিল স্ত্রীসঙ্গ গ্রহণ ছাড়া নবির অন্য কোনো কাজ নেই। আয়াতে বলা হয়েছে : “তারা কি ঈর্ষা করে আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে মানুষকে যা-যা দিয়েছেন? কারণ আমি ইব্রাহিমের বংশধরকে তো কিতাব ও হিকমত দিয়েছিলাম, আর তাদেরকে দিয়েছিলাম এক বিশাল রাজ্য। (৪:৫৪)।

আল্লাহ-প্রদত্ত নবুওতির অধিকার এবং অধিক সংখ্যক স্ত্রী থাকার দরুন মুহাম্মদের প্রতি ইহুদিরা ঈর্ষান্বিত ছিল। ইহুদিদের বক্তব্য ছিল, একজন সত্যিকারের নবি এতোবেশিসংখ্যক স্ত্রী গ্রহণ করতে পারেন না। আয়াতের দ্বিতীয় বাক্যে সমালোচকদের বক্তব্যের প্রেক্ষিতে বলা হয়েছে এবং আবশ্যিকভাবে তা দাউদ এবং সলোমনের মতো নবিদের প্রতি ইঙ্গিত করা হচ্ছে। উক্ত নবিদের নিরানব্বইজন করে স্ত্রী ও এক হাজারের মতো হারেমবাসী নারীসঙ্গী থাকার পরেও তাদের দুজনের নবি হিসেবে মর্যাদায় কোনো হানি ঘটেনি। ইসরাইলের সন্তানদের অন্যান্য রাজার কাহিনীর মতো এই ধারণাগুলো কল্পনার সুতোয় বোনা অত্যুক্তি মাত্র।

কোনো কোনো ইউরোপীয় সমালোচকদের মতে, যে ধর্মপ্রচারক পূর্বপুরুষের সংস্কার-বিশ্বাসকে প্রত্যাখান করে, সংশোধন করে নিজস্ব ধর্মপ্রচার করে গিয়েছেন, তার ব্যক্তিত্বের সাথে এরূপ মাত্রাতিরিক্ত নারীসঙ্গপ্রীতি সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। সমালোচক কয়েকজনের মতে, ইসলামের যেসব বিধি-বিধান নারীর মর্যাদা এবং অধিকারের উন্নয়ন ঘটিয়েছে সেগুলো নারীর প্রতি মুহাম্মদের ভালোলাগা থেকেই উৎসারিত হয়েছে।

অবশ্যই একজন মানুষ এবং প্রতিটি মানুষেরই দুর্বল দিক রয়েছে। যৌনচাহিদা মানুষের একটি আবশ্যিক প্রবৃত্তি এবং অন্যদের সম্পর্কে চিন্তা ও যোগাযোগের ক্ষেত্রে তা একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। এটা তখনই তিরস্কারযোগ্য যখন সমাজে ক্ষতিকর আচরণের বিস্তার ঘটায়। অন্যথায় একজন মানুষের ব্যক্তিগত জীবনযাপনের ভালো-মন্দ, শক্তি-দুর্বলতা নিয়ে আলোচনার কোনো অর্থ নেই। খ্রিস্টপূর্ব কাল থেকে সক্রেটিসের ভাবনা এথেন্স থেকে গ্রিসের সর্বত্র এবং পর্যায়ক্রমে সমগ্র মানবজাতির মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছিল। সক্রেটিসের ব্যক্তিগত জীবন কি ঘৃণ্য ছিল, এই প্রশ্নটি গুরুত্ব হারিয়ে ফেলে যদি না তিনি তার জীবনাচরণের মাধ্যমে সমাজের কোনো ক্ষতি সাধন করে থাকেন। অ্যাডলফ হিটলারকে যৌনপ্রবৃত্তির উর্ধ্বে বলা যায় কারণ এদিক থেকে তিনি অক্ষম কিংবা সীমিতভাবে সক্ষম ছিলেন। পক্ষান্তরে তিনি ধ্বংসাত্মক চিন্তাধারা পোষণ করতেন যা পৃথিবীকে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ ও ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিয়েছিল।

নবি মুহামদ নিজেকে একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে বিবেচনা করতেন। তিনি নিজেকে আল্লাহর কাছে সমর্পণ করেছেন। তার জনগণকে পৌত্তলিকতার অন্ধকূপ থেকে উদ্ধারে ব্রত ছিলেন। মুহাম্মদের নারী-প্রীতি কিংবা অনেক স্ত্রী গ্রহণের ঘটনা তার চূড়ান্ত লক্ষ্যের প্রতি যাত্রাকে বাধাগ্রস্ত করেনি কিংবা তা অন্যদের অধিকারকেও ক্ষুন্ন করেনি। মহান নেতাদের কাজের ধরন ও চিন্তাধারাকে সমসাময়িক সামাজিক প্রেক্ষাপট অনুসারে এবং সমাজ ও মানবজাতির কল্যাণে এগুলোর অবদানের ভিত্তিতে পর্যালোচনা করা উচিত। অথচ এরূপ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিবেচনা করলে, মানুষের চিন্তা ও ধর্মীয় স্বাধীনতা হরণের ফলে যারা একমাত্র বাধ্য হয়ে ইসলাম গ্রহণ করেছিল, অথবা বেঁচে থাকার জন্য কতগুলো কঠোর শর্তের ভিত্তিতে নিজেদের সহায়-সম্পদ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিল, তাদের এই বিষয়গুলো নিয়ে তুলনামূলকভাবে প্রশ্ন উত্থাপনের সুযোগ বেশি রয়েছে।

মুসলমানদের বিবেচনাবোধে ভুল ছিল, যদিও তা সম্পূর্ণ ভিন্ন ঘরানার। ইসলামের প্রতিষ্ঠাতাকে মহিমান্বিত করতে গিয়ে মুসলিম পণ্ডিতেরা এমন সব বক্তব্য পেশ করেছেন ও লিখেছেন যা কোরানের স্পষ্টভাবে বোধগম্য আয়াত এবং নির্ভরযোগ্য আদি ঐতিহাসিক তথ্যগুলোর সাথে সাংঘর্ষিক। মিশরীয় গবেষক এবং শিক্ষামন্ত্রী মুহামদ হোসেন হায়কল তার লাইফ অব মুহাম্মদ বইয়ে বিংশ শতাব্দীর জ্ঞানের আলোকে এই বিষয়ে নিরীক্ষা করতে গিয়ে পাশ্চাত্য সমালোচনার প্রতি উষ্মা প্রকাশ করেছেন। এমন-কী বইটির একটি অধ্যায়ে অযাচিতভাবে নবির নারীপ্রীতিকে পুরোপুরি অস্বীকার করেছেন। ওই অধ্যায়ের একটি অনুচ্ছেদ এখানে উল্লেখ করা হলো: “খাদিজার সাথে দীর্ঘ বিশ বছরের দাম্পত্য জীবনে নবি মুহাম্মদ কখনো একাধিক স্ত্রী গ্রহণের ইচ্ছা প্রকাশ করেননি। …এটা খুবই স্বাভাবিক এবং অবশ্যম্ভাবী একটি ব্যাপার। খাদিজা একজন ধনী সন্ত্রান্ত মহিলা ছিলেন। তিনি একজন গরীব, কিন্তু সৎ ও কঠোর পরিশ্রমী কর্মচারীকে বিয়ে করেছিলেন। খাদিজা মুহামদকে নিজ গৃহে জায়গা দিয়েছিলেন, কেননা স্বীয় স্বভাব কিংবা দারিদ্র্যের কারণে মুহাম্মদ অন্যান্য কুরাইশ যুবকের মতো উদাম যৌনতার স্রোতে গা ভাসিয়ে দেননি। এ কারণেই বয়স্ক ও অভিজ্ঞ খাদিজা মনেপ্রাণে নিজের থেকে পনেরো বছরের ছোট স্বামীর যত্ন নিয়েছেন। নিজের অর্থবিত্ত কাজে লাগিয়ে মুহাম্মদকে সচ্ছলভাবে জীবনযাপনে সাহায্য করেছেন যেন মুহামদ তার বাল্যজীবনের দুঃখকষ্ট ও চাচার উপর নির্ভরতার কথা ভুলে থাকতে পারেন। খাদিজার গৃহের নিরিবিলি ও আরামদায়ক পরিবেশে মুহাম্মদ তার দশ-বারো বছর ধরে জমে থাকা চিন্তাভাবনাকে পরিপূর্ণতা দানের সুযোগ পেয়েছেন। খাদিজা নিজে মুহাম্মদের মৌলিক চিন্তাধারার সাথে একমত ছিলেন। কেননা ওয়ারাকা বিন নওফলের চাচাতো বোন হিসেবে তিনিও হানিফদের নন্দনতত্ত্বের প্রতি আগ্রহী ছিলেন”। মুহাম্মদের নবুওতি লাভের পর খাদিজা তার স্বামীর লক্ষের সত্যতা ও স্বগীয় অনুপ্রেরণার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেন এবং সর্বপ্রথম ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হন। উল্লেখ্য খাদিজা মুহাম্মদের চার কন্যা জয়নাব, রোকেয়া, উমে কুলসুম এবং ফাতেমার মাতা ছিলেন”। এই পরিস্থিতিতে খাদিজার জীবদ্দশায় মুহামদ কিভাবে আরেকজন স্ত্রী গ্রহণ করতে পারতেন? কেবল খাদিজার মৃত্যুর পরে মুহাম্মদ আয়েশার পাণিপ্রার্থী হয়েছিলেন। অন্যদিকে আয়েশা যেহেতু সাত বছর বয়সী শিশু ছিলেন সেজন্য আস-সাকরান বিন আমরের বিধবা স্ত্রী সওদাকে বিয়ে করেছিলেন। এরপর হায়কল তার বইয়ে মন্তব্য করেন, ‘সওদার না ছিল রূপ, না ছিল ধনদৌলত। তাঁকে বিয়ে করে নবি মুহাম্মদ আবিসিনীয় একজন মুসলিম অভিবাসীর নিঃসঙ্গ বিধবা স্ত্রীর প্রতি বদান্যতা ও কৃপার কাজ করেছেন।

নবি মুহাম্মদ সওদাকে বিয়ে করেছেন কারণ একজন প্রাপ্তবয়স্ক মহিলা হিসেবে তিনি গৃহকার্যে পারদর্শী এবং চারটি শিশুকন্যাকে দেখাশোনায় সক্ষম-হায়কল এমনটা লিখলে আরও ভালো হতো। যদিও এই বক্তব্যের বিরোধিতার সুযোগ রয়েছে। কারণ নবি মুহাম্মদ প্রথমে আয়েশার কথা চিন্তা করেছিলেন। আয়েশা এতোটা অপ্রাপ্তবয়স্ক ছিলেন যে, তিনি দুবছর অতিক্রান্ত না হওয়া পর্যন্ত বিয়ে করতে পারতেন না। পরবর্তীতে মুহাম্মদ সওদাকে বিয়ে করেন। হতে পারে তিনি স্ত্রীসঙ্গবিহীন জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিলেন না। এমন যুক্তিকে সমালোচনা করার কারণ নেই। সম্ভাব্য আরেকটি কারণ হতে পারে, ওই সময়ে বিয়ের উপযোগী অন্য কোনো মহিলার অনুপস্থিতি। কুরাইশরা মুহাম্মদকে নিজেদের কন্যাদানে অনাগ্রহী ছিলেন। আবার মুসলমানদের বিয়ের উপযোগী কোনো কন্যাসন্তান ছিল না। সময়টা ছিল খাদিজার মৃত্যু-পরবর্তীকালীন দুই বাতিন বছর। নবি তখন মক্কায় অবস্থান করছিলেন। ইয়াসরিব বা মদিনায় অভিবাসনের পর নবি মুহাম্মদের জীবনধারা পাল্টে যায়। তখন নারীদের প্রতি আগ্রহ পূরণের সুযোগ আসে। এই সত্যকে অস্বীকার করার প্রয়োজন নেই। সহীহ বুখারিতে নবি মুহাম্মদের নয় জন স্ত্রী ও দুই জন দাসীর সাথে যৌন সম্পর্ক থাকার কথা স্বীকার করে নেয়া হয়েছে এবং বলা বাহুল্য, সে যুগের নৈতিকতার সাথে ব্যাপারটি বেমানান নয়। কিন্তু তাঁকে সর্বকালের জন্য মানুষের আদর্শ বলে দাবি করলে বিপত্তির সূচনা ঘটে – অনুবাদক ) নবি মুহাম্মদের স্ত্রীদের মোটামুটি একটি পূর্ণ তালিকা নীচে উল্লেখ করা হল :

  • ১. খুয়েলিদ ইবনে আসাদের কন্যা খাদিজা একজন ধনী, সন্ত্রান্ত মহিলা। মুহাম্মদ ছিলেন খাদিজার তৃতীয় স্বামী। খাদিজার গর্ভে নবি মুহাম্মদের প্রথম পুত্র সন্তান কাশেম, দুই বছর অতিক্রান্ত হওয়ার আগে মৃত্যু হয়। এরপর জয়নাব, রোকেয়া, উম্মে কুলসুম এবং ফাতেমা চার কন্যাসন্তানের জন্ম দেন খাদিজা। আত-তাহের নামের আরেকটি পুত্রসন্তান হয় তাদের ঘরে। কিন্তু ওই পুত্র সন্তানটিও শৈশবে মারা যান।
  • ২. জামার কন্যা সওদা। তিনি আবিসিনিয়ায় অভিবাসিত একজন মুসলমানের বিধবা স্ত্রী। মিশরীয় বুদ্ধিজীবী হায়কলের অভিমত, নবি তাঁকে বিয়ে করেছিলেন একজন নিঃসঙ্গ মুসলমান বিধবার প্রতি করুণা হিসেবে। হায়কলের অভিমত উপরে আলোচনা করা হয়েছে।
  • ৩. হজরত আবু বকর আস-সিদ্দিকির কন্যা আয়েশা। সাত বছর বয়সে মুহামদের সাথে তার বিয়ে ঠিক হয় এবং নয় বছর বয়সে তিনি মুহাম্মদের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তাদের দুজনের বয়সের পার্থক্য প্রায় চল্লিশ বছর। হিজরি ১১ সনে (৬৩২ খ্রিস্টাব্দ) যখন মুহাম্মদ মৃত্যুবরণ করেন, তখন আয়েশার বয়স ষোল অথবা সতের। তিনি নবির সবচেয়ে প্রিয় স্ত্রী ছিলেন। হৃদয় থেকে কোরান শিক্ষালাভকারীদের মধ্যে তিনি অন্যতম। নবির বচন ও কর্মের (হাদিস) এবং মুসলমানদের সংস্কৃতি সম্পর্কিত তথ্যেরও একজন গুরুত্বপূর্ণ উৎস তিনি। খলিফা উসমান হত্যাকাণ্ডের পর বিবি আয়েশা আলি বিন আবু তালিবের খলিফা পদে আসীন হওয়ার বিরোধিতা করেছিলেন।আয়েশা হিজরি ৩৬ (৬৫৬ খ্রিস্টাব্দ) সনে আলির বিরুদ্ধে জঙ্গে জামাল বা উটের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেপরাজিত হোন।
  • ৪. মক্কা থেকে মদিনায় অভিবাসী এবং ওহুদের যুদ্ধে আহত হয়ে মৃত্যুবরণকারী একজন মুসলমানের স্ত্রী উমে সালমা।
  • ৫. হজরত ওমর বিন আল-খাত্তাবের কন্যা হাফসা। স্বামী মৃত্যুর পর তারও নবির সাথে বিয়ে হয়। এই বিয়ের একটি প্রায়োগিক দিক রয়েছে বলে ঐতিহাসিকরা মনে করেন।
  • ৬. জাহাশের কন্যা জয়নাব। তিনি নবির পালকপুত্র (মুক্তদাস) জায়েদ বিন আল-হারিসের প্রাক্তন স্ত্রী। জয়নাবের সঙ্গে নবি মুহাম্মদের বিয়েকে অন্যতম ভালোবাসার বন্ধন হিসেবে গণ্য করা হয়। জায়েদ ও জয়নাবের সম্পর্ক নিয়ে একটি দীর্ঘ বর্ণনামূলক কবিতা রয়েছে। জয়নাবের জন্য নবির প্রীতি ও আদর এতোই বেশি ছিল, তাকে আয়েশার একজন প্রতিদ্বন্দীতে পরিণত করে।
  • ৭. মুসতালিক গোত্রের প্রধান আল-হারিস বিন আবু দেরার-এর কন্যা ও মুসাফির বিন সাফওয়ানের প্রাক্তন স্ত্রী জুয়ায়রিয়া। হিজরি ৫৪ (৬২৭ খ্রিস্টাব্দে) সালে বানু-মুসতালিক গোত্রের পরাজয়ের পর জুয়ায়রিয়াকে যুদ্ধবন্দী হিসেবে আটক করা হয় এবং পরবর্তীতে মুসলমান যোদ্ধাদের মধ্যে একজনের গনিমতের মালে হিসেবে জায়গা হয়। জুয়ায়রিয়ার মালিক তাঁকে একটি নির্দিষ্ট মুক্তিপণের বিনিময়ে ছেড়ে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তা ছিল তার সাধ্যের বাইরে। জুয়ায়রিয়া তাই নবি মুহাম্মদের বাড়িতে গিয়ে সাহায্য চাইলেন, নবি যেন মুক্তিপণের পরিমাণ কমাতে মধ্যস্থতার দায়িত্ব নেন। পরবর্তী কাহিনী বিবি আয়েশার বর্ণনা অনুযায়ী, জুয়ায়রিয়ার সৌন্দর্য ও মাধুর্য এমনই ছিল যে, তাঁকে দেখামাত্র সবাই পুলকিত বোধ করত। জুয়ায়রিয়াকে আমার ঘরের দরজার সামনে দেখে আমি বিচলিত বোধ করি। কেননা নিশ্চিত ছিলাম আল্লাহর বান্দা তাঁকে দেখামাত্র পছন্দ করবেন এবং সেটাই হলো। জুয়ায়রিয়া যখন নবির সাথে দেখা করার সুযোগ পেলেন এবং আর্জি ব্যক্ত করলেন, নবি তখন বললেন, তিনি জুয়ায়রিয়ার জন্য আরও ভালো কিছু করবেন- নবি নিজে তার মুক্তিপণ পরিশোধ করবেন এবং পাণিপ্রার্থী হবেন। জুয়ায়রিয়া তা শুনে খুশি হয়ে সম্মতি জানালেন। নবির সাথে জুয়ায়রিয়ার বিয়ের পর মুসলমানরা মুসতালিক গোত্রের বন্দীদের অনেককে ছেড়ে দিলেন। যেহেতু তাঁরা নবি মুহাম্মদের তালাতো ভাইবোন ছিল। আমি অন্য কোনো নারীর কথা জানি না, যে নিজের আত্মীয়-স্বজনদের জন্য এমন সুন্দর পরিণতি ও আশীৰ্বাদ বয়ে নিয়ে এসেছে।’
  • ৮. আবু সুফিয়ানের কন্যা উমে হাবিবা (আরেক নাম রামালা)। তার প্রথম স্বামী উবাদুল্লাহ বিন জাহাশ আবিসিনায় মৃত্যুবরণ করেন।
  • ৯. খায়বারের ইহুদি নেতা কেনানা বিন আবু রাবিয়ার স্ত্রী সাফিয়া। তিনি হোয়ায় বিন আকতাবের কন্যা। খায়বার যুদ্ধে বন্দী হওয়ার পর নবি তাঁকে গনিমতের মাল হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করেন। খায়বার থেকে মদিনায় আসার পরে নবি তাকে বিয়ে করেন।
  • ১০. হেলাল গোত্রের আল-হারিসের কন্যা মায়মুনা। মায়মুনার এক বোনের বিয়ে হয়েছিল আবু সুফিয়ানের সাথে এবং আরেক বোনের সাথে আব্বাস বিন আব্দুল মোতালেবের বিয়ে হয়েছিল। মায়মুনা খালেদ বিন আল-ওয়ালিদের খালা। (খালেদ পরবর্তীতে সিরিয়া দখলে ভূমিকা রাখেন)। কথিত আছে মায়মুনার সাথে নবির বিয়ের পর খালেদ ইসলাম গ্রহণ করেন এবং নবি তাকে কয়েকটি ঘোড়া উপহার দিয়ে বরণ করে নেন।
  • ১১. শোরাইয়ার কন্যা ফাতেমা।
  • ১২. ইয়াজিদের কন্যা হিন্দ (উম্মে সালমা)।
  • ১৩. শাবার কন্যা আসমা ।
  • ১৪. খোজায়মার কন্যা জয়নাব।
  • ১৫. কায়েসের কন্যা হবলা। হাবলার ভাই আল-আশাত বিন কায়েস দক্ষিণ আরবের এক নেতা। তিনি ইরান দখলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।(৭০)
  • ১৬. নোমানের কন্যা আসমা। নবি এই বিয়েকে পূর্ণতা দান করেননি।
  • ১৭. আদ-জাহাকের কন্যা ফাতেমা। এই বিয়েও পূর্ণতা পায়নি।
  • ১৮. মিশরীয় কপটিক খ্রিস্টান ক্রীতদাসী মারিয়া (মেরি দ্য কপ্ট বা মারিয়া কিবতিয়া)। তাঁকে ৬২৮ সালে মিশরের রোমান গভর্নর (ইসলামের ইতিহাসে মিশরের শাসকদের ‘আল-মুকাওকিস”নামে ডাকা হয়) উপহারস্বরূপ দান করেছিলেন নবিকে”। মারিয়ার গর্ভে নবির ইব্রাহিম নামের এক পুত্রসন্তানের জন্ম হয়। কিন্তু শৈশবেই শিশুটির মৃত্যু ঘটে।
  • ১৯. মারিয়ার মতো রায়হানাও কোরানের ভাষায় তোমাদের দক্ষিণ হস্ত যাদের মালিক হয়ে যায় বিভাগের অন্তর্ভুক্ত। অর্থাৎ রায়হানা ছিলেন একজন ক্রীতদাসী। তার সাথে বিয়ের প্রয়োজন ছিল না এবং যৌন সম্পর্ক স্থাপনেও কোনো বাধা ছিল না। তিনি ইহুদি গোত্র বানু-কুরাইজার একজন যুদ্ধবন্দী। যুদ্ধ শেষে তিনি গনিমতের মাল হিসেবে নবির কাছে জায়গা হয়েছিল। কিন্তু তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণে রাজি হননি এবং নবির সাথে কোনো চুক্তিভিত্তিক বিয়েতেও রাজি হননি। শেষে নবির গৃহে একজন গৃহপরিচারিকা হিসেবেই ছিলেন।
  • ২০. দাউস গোত্রের উম্মে শারিক। তিনি সেই চারজন নারীর মধ্যে একজন, যারা নিজেদের নবির কাছে সমর্পণ করেছিলেন। চুক্তিভিত্তিক বিবাহিত নারী এবং অস্থায়ী সঙ্গী ছাড়াও নবির গৃহে আরও কয়েকজন নারী ছিলেন তাঁরা এই শ্রেণিতে পড়েন। চুক্তিভিত্তিক বিবাহিত স্ত্রীর সংখ্যা সর্বোচ্চ চারজন হতে পারে। এ-ধরনের বিয়েতে মোহরানা, সাক্ষীদের উপস্থিতি এবং নারীর পিতা কিংবা অন্য অভিভাবকের সমতির প্রয়োজন রয়েছে। ক্রীতদাসীর সাথে মুসলমানদের যৌনসম্পর্ক স্থাপনে বৈধতা দেয়া হয়েছে, যদি ওই নারীর স্বামী পৌত্তলিক কিংবা অবিশ্বাসী হয়ে থাকেন। আর কেবলমাত্র নবির ক্ষেত্রে নিজেকে সমর্পণকারী কোনো নারীর সাথে নবির বিয়ের বৈধতা দেয়া হয়েছে সুরা আহজাব-এর ৫০ নম্বর আয়াতের শেষ অংশে। নবির কাছে নিজেদেরকে সমর্পণকারী অন্য তিনজন মহিলা হচ্ছেন মায়মুনা, জয়নাব এবং খাওলা।

উমে শারিক যখন নিজেকে নবির কাছে উপহার হিসেবে সমর্পণ করলেন বিবি আয়েশা তখন উদ্বিগ্ন বোধ করলেন। কেননা উমে শারিক ছিলেন খুব সুন্দরী এবং মুহাম্মদ উপহার হিসেবে তৎক্ষণাৎ গ্রহণ করেন। হাদিসে আছে এ- ঘটনায় ঈর্ষা ও অসমান অনুভব করেন বিবি আয়েশা। তিনি বলেন, যে নারী নিজেকে একজন পুরুষের কাছে সমৰ্পিত করে, তার নিজের কী মূল্য থাকতে পারে এ ভেবে আমি আশ্বর্যান্বিত হই। সুরা আহজাবের ৫০ নম্বর আয়াতের শেষাংশ কোনো বিশ্বাসী নারী নবির কাছে নিবেদন করলে আর নবি তাকে বিয়ে করে বৈধ করতে চাইলে সেও বৈধ এই ঘটনার প্রেক্ষিতে অবতীর্ণ হয়েছিল যেখানে উম্মে শারিককে উপহার হিসেবে নবি কর্তৃক গ্রহণকে বৈধতা দেয়া হয়েছে। একথা শুনে আয়েশা রাগান্বিত হয়ে বলেন : আপনার প্রভু আপনার ইচ্ছাকে অনুমোদন দিতে ওহি পাঠাতে খুব একট বিলম্ব করেন না, তা তো দেখতেই পাচ্ছি।

( বুখারি হাদিসের বর্ণনা অনুযায়ী : খাওলা বিনতে হাকিমসহ কয়েকজন বিয়ের জন্য আল্লাহর নবির কাছে নিজেদের সমর্পন করেছিলেন। আয়েশা বললেন, ‘এই মেয়েদের কী লজ্জা-শরম নেই, তাঁরা যেচে এসে পুরুষের কাছে নিজেকে সমর্পণ করছে? এ-সময় সুরা আহজাবের ৫০-৫১ নম্বর আয়াতদ্বয় নাজিল হয়, যেখানে বলা হয়েছে, . . . তুমি ওদের মধ্যে যাকে ইচ্ছা তোমার কাছ থেকে দূরে রাখতে পার ও যাকে ইচ্ছা গ্রহণ করতে পার… (৩৩:৫১)। আয়েশা তখন বলেন, ‘হে আল্লাহর নবি! আপনাকে খুশি করতে আপনার প্রভু তো দেখি খুব একটা দেরি করেন না। দ্রষ্টব্য: বুখারি শরিফ, ভলিউম ৭, বুক ৬২ নম্বর ৪৮ – অনুবাদক)।

তফসির আল-জালালাইনের লেখক মিশরের বিশিষ্ট ইসলামি চিন্তাবিদ জালালউদ্দিন আল-মাহালি ও জালালউদ্দিন আল-সুয়তির ভাষ্য থেকে বিবি আয়েশা ও নবির মনোমালিন্যের বর্ণনা পাওয়া যায়। তাদের ভাষ্য অনুযায়ী উম্মে শারিকের সাথে নবির সম্পর্ক হওয়ার পর এবং সুরা আহজাব-এর ৫০ নম্বর আয়াত অবতীর্ণ হবার পর আয়েশা রূঢ়ভাবে বলে ওঠেন, যে নারী নিজেকে একজন পুরুষের কাছে আগ বাড়িয়ে সমৰ্পিত করে, তার নিজের কী মূল্য থাকতে পারে, এ ভেবে আমি আশ্চর্যান্বিত হই। পরবর্তীতে ৫১ নম্বর আয়াতে আয়েশাকে তিরস্কার করা হয় এবং ওই আয়াত অবতীর্ণ হবার পরেই নবির ইচ্ছাপূরণে প্ৰভু সময়ক্ষেপণ করেন না বলে আয়েশা মন্তব্য করেন। সুরা আহজাব-এর ৫০ নম্বর আয়াতে স্ত্রী ও ক্রীতদাসী গ্রহণে নবির অধিকারের কথা বলা হয়েছে: “হে নবি! আমি তোমার জন্য তোমার স্ত্রীদেরকে বৈধ করেছি যাদেরকে তুমি দেনমোহর দিয়েছ ও বৈধ করেছি তোমার ভান হাতের অধিকারভুক্ত দাসীদেরকে যাদেরকে আমি দান করেছি, এবং বিয়ের জন্য বৈধ করেছি তোমার চাচাতো, করলে আর নবি তাকে বিয়ে করে বৈধ করতে চাইলে সেও বৈধ। এ বিশেষ করে তোমারই জন্য, অন্য বিশ্বাসীদের জন্য নয়…।” (৩৩:৫০)। একই আয়াতে আরও বলা হয়েছে: বিশ্বাসীদের স্ত্রী ও তাদের দাসীদের সম্বন্ধে আমি যা নির্ধারণ করেছি তা আমি জানি। এই আয়াতের শেষাংশ নিয়ে বিবি আয়েশা প্রতিবাদ করলে ৫১ নম্বর আয়াতে সতর্কতা জারি করা হয়, যার মাধ্যমে স্ত্রীর ওপর নবির ক্ষমা চূড়ান্ত এবং অসীম পর্যায়ে উন্নীত করা হয়। এর ফলে স্ত্রীরা নবির কোনো কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদ করার অধিকার থেকে বঞ্চিত হন: তুমি ওদের মধ্যে যাকে ইচ্ছা দূরে রাখতে পার ও যাকে ইচ্ছা গ্রহণ করতে পার, আর তুমি যাকে দূরে রেখেছ তাকে কামনা করলে তোমার কোনো দোষ নেই। এ-বিধান এজন্য যে, এতে ওদেরকে খুশি করা সহজ হবে আর ওরা দুঃখ পাবে না, এবং ওদেরকে তুমি যা দেবে তাতে ওদের প্রত্যেকেই খুশি থাকবে। তোমাদের অন্তরে যা আছে আল্লাহ তা জানেন। আল্লাহ সব জানেন, সহ্য করেন। (৩৩:৫১)।

আল-জামাখশারি তার লেখা কোরানের তফসিরগ্রন্থ “আল-কাশশাফ- এ সুরা আহজাবের ৫১ নম্বর আয়াতের ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তার মতে, “নবির স্ত্রীরা যারা একে অন্যের প্রতি ঈর্ষাপরায়ণ এবং প্রতিদ্বন্দী ছিলেন তারা নিজেরা বেশি করে গনিমতের মালের ভাগ চেয়েছিলেন। (বানু কুরাইজা লোকদের হত্যা করার পর, মুসলমানরা প্রচুর পরিমাণ গনিমতের মাল পেয়েছিলেন। তখন নবির স্ত্রীরা এখান থেকে এক পঞ্চমাংশ ভাগ পাওয়ার আশা করেছিলেন)। বিবি আয়েশাকে উদ্ধৃত করে জামাখশারি বলেন, ৫১ নম্বর আয়াত অবতীর্ণ হবার আগ পর্যন্ত এক মাস নবি তার স্ত্রীদের সঙ্গ ত্যাগ করেন। ওই আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার পর ভীতসন্ত্রস্ত স্ত্রীরা নবিকে তার ইচ্ছানুযায়ী আর্থিক সহায়তা ও ব্যক্তিগত সাহচর্য দেবার কথা বলেন।

অর্থাৎ স্ত্রীদের সাথে নবি কিভাবে আচরণ করবেন তা নির্ধারণে নবির একচ্ছত্র আধিপত্যকে তার স্ত্রীরা স্বীকার করে নিলেন। জামাখশারি সুরা আহজাব-এর ৫১ নম্বর আয়াতের বিস্তারিত ব্যাখ্যায় বলেছেন, এই আয়াত নবিকে তার ইচ্ছামতো সমাজের যেকোনো নারীকে বিয়ে করার আগ্রহ, প্রস্তাব, স্ত্রীরূপে গ্রহণ কিংবা যে কোনো স্ত্রী বা সকল স্ত্রীকে তালাক প্রদানের ক্ষমতা প্রদান করেছে। এছাড়া হাসান বিন আলিকে উদ্ধৃত করে জামাখশারি লিখেছেন, নবি যদি একজন নারীর পাণিগ্রহণের ইচ্ছা প্রকাশ করতেন, তবে অন্য কারো পক্ষে সেই নারীকে স্ত্রীরূপে গ্রহণের ক্ষমতা নেই, যদি না নবি তার মত পরিবর্তন করেন। জামাখশারি আরও লিখেছেন, ওই সময়ে নবির নয়জন স্ত্রী ছিলেন যাদের সবাইকে সমান সঙ্গ দেবার কথা থাকলেও তিনি তা ক্রমানুযায়ী করেননি, কিংবা পাঁচজনকে একেবারেই সঙ্গ দেননি। এই পাঁচজন হচ্ছেন সওদা, জুয়ায়রিয়া, সাফিয়া, মায়মুনা এবং উমে হাবিবা। যাদেরকে অনুগ্রহ করে নিয়মিত সঙ্গ দিয়েছেন তাঁরা হলেন আয়েশা, হাফসা, উমে সালমা এবং জয়নাব। আয়েশাকে আবার উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে, কোনো কোনো দিন এমন হতো যে, নবি আমাদের সবাইকে একে একে না ভেকে, শুধু তাদেরকেই অনুগ্রহ করতেন যাদের পালা আসতো এবং যাদের সাথে তার ওইদিন থাকার কথা। নবি তালাক দিয়ে দিবেন এই ভেবে উদ্বিগ্ন সওদা বিন জামা নবিকে বলছেন, “আমার জন্য সময় বরাদ দেবার প্রয়োজন নেই! আপনার সাথে আমার দাম্পত্য জীবনের আশা আমি পরিত্যাগ করেছি এবং আমার জন্য বরাদ সময় আয়েশাকে অর্পণ করলাম। কিন্তু আমাকে তালাক দিবেন না। কেননা শেষ-বিচারের দিনে আমি আপনার একজন স্ত্রী হিসেবে গণ্য হতে চাই।’

৫১ নম্বর আয়াতের বক্তব্য হচ্ছে, দাম্পত্য অধিকার হারানোর ফলে নবির স্ত্রীরা তুলনামূলকভাবে বেশি খুশি থাকবেন। যদিও স্বগীয় আদেশের মাধ্যমে নবিকে পূর্ণ দায়মুক্তি দেয়া হয়েছে, এবং তার স্ত্রীদেরকে নবির কাছ থেকে যেকোনো পাওনা অধিকার আদায়ে বঞ্চিত করেছে, তথাপি এই বঞ্চনার মাধ্যমে তাদের কল্যাণ সাধিত হয়েছে। এর মাধ্যমে তাদের নিজেদের মধ্যকার প্রতিদ্বন্দিতার অবসান হবে এবং তারা ভবিষ্যতে সুখী হবেন।

হয়তো নবির স্ত্রীরা মানসিকভাবে আঘাত পেয়েছিলেন এবং তাদের আত্মসমানের উপর আঘাত এসেছিল, সেই প্রেক্ষিতে সুরা আহজাব-এর ৫২ নম্বর আয়াতে সান্তনাসূচক বক্তব্য এলো। এই আয়াতের প্রতিটি শব্দে তাদের প্রতি সান্তনা এবং আশ্বাসের বাণী রয়েছে : (মুহামদ!) এরপর তোমার জন্য কোনো নারী বৈধ নয় আর তোমার স্ত্রীদের পরিবর্তে অন্য স্ত্রগ্রহণও বৈধ নয়, যদি ওদের সৌন্দর্য তোমাকে মুগ্ধও করে, তবে তোমার ডান হাতের অধিকারভুক্ত দাসীদের ব্যাপারে এ-বিধান প্রয়োজ্য নয়। আল্লাহ সমস্ত কিছুর ওপর কড়া নজর রাখেন।’

এই আয়াতে তথাপি একটি সমস্যা রয়ে গিয়েছে। যেমন বিবি আয়েশার একটি বক্তব্য সকল হাদিস-সংগ্রহকারক নির্ভরযোগ্যহাদিস হিসেবে উদ্ধৃত করেছেন: “সকল স্ত্রীর অনুমোদন না থাকা অবস্থায় নবি মারা যাননি। অর্থাৎ নবির মৃত্যুর আগে সকল স্ত্রীই তার জন্য অনুমোদিত ছিল। প্রভাবশালী সুন্নি পণ্ডিত ইসমাইল ইবনে কাসির (১৩০০-১৩৭৩ খ্রিস্টাব্দ) তার বিখ্যাত তফসির গ্রন্থে বলেছেন, সুন্নি ধর্মতাত্ত্বিক এবং হাদিস সংগ্রহকারক ইমাম আহমদ ইবনে হানবলের (৭৮০-৮৫৫ খ্রিস্টাব্দ) সংগ্রহে বিবি আয়েশার উদ্ধৃত এই হাদিসটি রয়েছে। এছাড়া মুহাম্মদ ইবনে ইসা আত-তিরমিজি (৮২৪-৮৯২ খ্রিস্টাব্দ) এবং ইমাম আহমদ আন-নাসাইর (৮২৯-৯১৫ খ্রিস্টাব্দ) সংগৃহীত হাদিসেও তা রয়েছে। যেমন : ‘সুনান আন-নাসাই’, (ইংরেজি অনুবাদ) ভলিউম৪, বুক-২৬, হাদিস-৩২০৭ – অনুবাদক) আল-জামাখশারির মতে, সুরা আহজাবের ৫২ নম্বর আয়াতটি ৫০ নম্বর আয়াত দ্বারা বাতিল হয়েছিল। অর্থাৎ হে নবি! আমি তোমার জন্য তোমার স্ত্রীদেরকে বৈধ করেছি… বক্তব্য টিকে গেছে আর (মুহাম্মদ) এরপর তোমার জন্য কোনো নারী বৈধ নয়…’ বক্তব্যটি বাতিল হয়ে গিয়েছে। হজরত আয়েশার উদ্ধৃত হাদিসটিও ৫০ নম্বর আয়াতের সত্যতার দিকে ইঙ্গিত করে। কিন্তু অন্য কিছু না হোক, সামঞ্জস্য বজায় রাখার জন্য হলেও কোরানের কোনো একটি আয়াত বাতিল হলে সেটি থাকবে উপরে, যে আয়াত দ্বারা বাতিল হয়েছে তা থাকবে নীচে। কারণ ভবিষ্যতের সম্ভাব্য কোনো কাজকে বর্তমানের কোনো বক্তব্য দিয়ে সংশোধন করা যায় না, বরং অতীতের কাজকে সংশোধন করা যায় বর্তমানের বক্তব্য দিয়ে। কিন্তু এক্ষেত্রে আমরা দেখি বাতিলকৃত আয়াতটি (৫২নম্বর আয়াত) রয়ে গিয়েছে নীচে আর যে আয়াতটি বাতিল করেছে (৫০ নম্বর আয়াত) এটা অবস্থান করছে উপরে। কোরানের আয়াতের ধারাবাহিকতা সমন্বয়ের ক্ষেত্রে এমন গরমিল হলো কিভাবে? ( আল্লাহ কি নিজে এই গরমিল করেছেন, নাকি নবি-পরবর্তী খলিফাদের কোরান সংকলন কমিটি আয়াত বিন্যাস করতে গিয়ে এই গরমিল করেছেন?- অনুবাদক। জালালউদ্দিন আল-সুয়তিও আল-ইতকান ফি উলুম আল-কোরান নামের বইয়ে কোরানের সমস্যাগুলো নিয়ে একটি নিবন্ধে মত প্রকাশ করেছেন, ‘সুরা আহজাবের এই পূর্ববর্তী আয়াত দ্বারা পরবর্তী আয়াত বাতিল হয়েছে।”

সুরা আহজাবের বিভিন্ন আয়াতে বর্ণিত নবির বিয়ে সম্পর্কিত অধিকারগুলো যখন একের পর এক যোগ হতে থাকে, তখন এগুলো থেকে বিস্ময়কর সুবিধা-প্রাপ্তির বিষয়টিও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। অন্যান্য বিশ্বাসীদের জন্য চারজনে সীমাবদ্ধ থাকলেও নবির জন্য এর চেয়েও বেশি স্ত্রী গ্রহণ করা সম্ভব ছিল। নবির জন্য তার সাথে মদিনায় অভিবাসনকারী কাজিনদের বিয়ে করা অনুমোদিত ছিল, কোনো ধরনের যৌতুক প্রদান কিংবা সাক্ষীর উপস্থিতি ব্যতিরেকে নিজেকে তার কাছে সমর্পণকারী কোনো নারীকে নবি বিয়ে করতে পারতেন। স্ত্রীদের সমঅধিকার প্রদানে কিংবা তা রক্ষায় নবির কোনো বাধ্যবাধকতা ছিল না, তিনি যে কোনো স্ত্রীর সহচর্য স্থগিত কিংবা বাতিল করতে পারতেন। তিনি যদি কোনো নারীর পাণিপ্রার্থী হতেন, তবে অন্য পুরুষদের সেই নারীর পাণিপ্রার্থী হওয়ার আশা পরিত্যাগ করতে হতো; এবং নবির মৃত্যুর পরে অন্য কেউ তার কোনো স্ত্রীকে বিয়ে করার অনুমোদন ছিল না। এছাড়াও নবির কোনো স্ত্রীর বাড়তি ভাতা পাওয়ার দাবি জানানোর অনুমতি ছিল না।

নবিকে ব্যাপক সুবিধা এবং স্বাধীনতা দেবার বিপরীতে তার স্ত্রীগণের ওপর নানা বিধি-নিষেধ আরোপিত হয়েছিল। তারা আর দশজন নারীর মতো থাকতে পারলেন না। তাদেরকে সবসময় লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকতে হবে। তাদেরকে অবশ্যই পর্দার পিছনে থেকে পুরুষের সাথে কথা বলতে হবে। পৌত্তলিক সংস্কৃতির কোনো গয়না পরিধান তাদের জন্য নিষিদ্ধ হলো। ভাতার পরিমাণ যাই হোক না কেন নবির স্ত্রীদের তা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হবে; তাদের পালা যদি না আসে তবে তারা অভিযোগ করতে পারবে না এবং কোনো অবস্থাতেই তাঁরা পুনরায় বিয়ে করতে পারবে না। ৫৩ নম্বর আয়াতের শেষের দিকে সুনির্দিষ্টভাবে মুসলমান পুরুষদের জন্য আরোপিত হয়েছে: . . . তোমাদের কারও পক্ষে আল্লাহর রসুলকে কষ্ট দেয়া তার মৃত্যুর পর তার স্ত্রীদেরকে বিবাহ করা সংগত হবে না। আল্লাহর কাছে এ গুরুতর অপরাধ। ইহুদিদের নীতিশাস্ত্র তালমুদেও ইহুদি-রাজার স্ত্রীদের পুনরায় বিয়ের ওপর একই রকম নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।

আবদুল্লাহ বিন আল-আব্বাসের” বক্তব্য অনুযায়ী, একবার একজন ব্যক্তি নবির একজন স্ত্রীর সাথে দেখা করতে গেল, এবং নবি তাকে পুনরায় এ কাজ করতে নিষেধ করেন। লোকটি প্রতিবাদ করে এই বলে যে, নবির স্ত্রী তার চাচার মেয়ে এবং তাদের দুজনের এ-সাক্ষাতের পেছনে কোনো খারাপ অভিসন্ধি নেই। নবি প্রত্যুত্তর দিলেন, “আমি এ-সম্পর্কে অবগত আছি, কিন্তু আল্লাহ এবং আমার মতো কোনো ঈৰ্ষাপরায়ণ দ্বিতীয়জন নেই। লোকটি ক্রুদ্ধ হয়ে ফিরে যাবার সময় গজগজ করে বলে গেল, তিনি আমাকে আমার চাচাতো বোনের সাথে কথা বলতে নিষেধ করলেন। যাই হোক, নবির মৃত্যুর পর আমি আমার চাচাতো বোনকে বিয়ে করবো। এ-ঘটনার পরই সুরা আহজাবের ৫৩ নম্বর আয়াতটি অবতীর্ণ হয়।

একটি বিষয় মনে রাখা প্রয়োজন যে, এমন কোনো সময় আসেনি যখন নবির গৃহে তার বিশজন স্ত্রী একত্রে অবস্থান করেছেন। তার সমানিত স্ত্রী খাদিজার মৃত্যুর কথা পূবেই বলা হয়েছে। নবির স্ত্রী জয়নাব বিনতে খোজায়মানবির জীবদ্দশায় মৃত্যুবরণ করেন। রায়হানা নামের দাসীরও মৃত্যু হয় নবির জীবদ্দশাতেই। তিনি দুটি বিয়েকে পূর্ণতা প্রদান করেননি। তার মৃত্যুকালে নয়জনের বেশি পূর্ণ স্ত্রী ছিলেন না।

নবির স্ত্রীদের মধ্যে একসময় দুটি প্রতিদ্বন্দী পক্ষের আবির্ভাব ঘটেছিল। একপক্ষে ছিলেন আয়েশা, হাফসা, সওদা এবং সাফিয়া। অন্যপক্ষে জয়নাব বিনতে জাহাশ, উম্মে সালমাসহ আরও তিনজন। নবির কয়েকজন স্ত্রী এমন সব ঘটনায় জড়িয়ে পড়েছিলেন, যেগুলো পরবর্তীতে ইসলামি ইতিহাস এবং সাহিত্যে স্থান পেয়েছে। সবচেয়ে বেশি পরিচিতি পেয়েছে বিবি আয়েশা ও সাফওয়ান বিন আল-মোয়াত্তালকে কেন্দ্র করে ঘটা ঘটনাটি।

হিজরি ৫ সালে (৬২৭ খ্রিস্টাব্দ) বানু-মোসতালিক গোত্রের সাথে লড়াইয়ের সময় হজরত ওমরের একজন ক্রীতদাস ও মদিনার খাজরাজ গোত্রের একজন আনসারের সাথে ঝগড়া বেধে যায়। এই ঘটনায় খাজরাজ গোত্রের একজন নেতা আব্দুল্লাহ বিন উবায় (যাকে মুসলমানরা বিশ্বাসঘাতকদের নেতা বলেই চিনতেন) ক্রুদ্ধ হয়ে তার আনসার সমর্থকদেরকে বললেন, “আমরা নিজেরাই নিজেদের বিপদ ডেকে এনেছি। (মদিনার সবকিছু মুহাজিরদের দখলের চলে যাচ্ছে এমন ইঙ্গিত করে) কথায় আছে, কুকুরকে খাওয়ালেও সে ঠিকই কামড়ায়, এই প্রবাদটি এখন আমাদের ক্ষেত্রে সত্য হয়ে দেখা দিয়েছে। চলুন আমরা সবাই ইয়াসরিবে ফিরে যাই। ওখানে বেশিরভাগ মানুষই আমাদের আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু। এই সংখ্যালঘুদের উৎখাত করতে হবে। নবি এই বক্তব্য শুনে তাড়াতাড়ি মদিনার দিকে যাত্রা করলেন, যাতে আব্দুল্লাহ বিন উবায়ের যে কোনো বিরুদ্ধবাদী কিংবা চক্রান্তের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে পারেন। ফিরতিপথে কয়েকটি সংক্ষিপ্ত বিরতি দিয়ে তিনি দ্রুত চললেন।

এই অভিযানের সময় নবির সাথে ছিলেন বিবি আয়েশা। একটি যাত্রাবিরতিতে বিবি আয়েশা প্রাকৃতিক ক্রিয়া সম্পন্ন করতে মরুভূমির ভেতরে প্রবেশ করলেন। পালকির মধ্যে আসার সময় খেয়াল করলেন, তার পুতির মালাটি হারিয়ে গেছে। খোঁজাখুঁজি করতে দেরি হয়ে যায়। এদিকে বিবি আয়েশার অনুপস্থিতি খেয়াল না থাকায় নবি তার অনুসারীদের নিয়ে স্থান ত্যাগ করলেন। আয়েশা এসে দেখলেন তার হাওদা (হাতি কিংবা উটের পিঠের উপরে বসানো কাপড় ঘেরা বসার স্থান) বহনকারী উটটি অন্যান্য উটের সাথে সেই স্থান ত্যাগ করেছে। বিবি আয়েশা মরুভূমিতে একা পড়ে রইলেন। এরই মধ্যে সাফওয়ান বিন আল-মোয়াত্তাল আয়েশাকে দেখতে পেলেন। সাফওয়ানের দায়িত্ব ছিল মুসলমান সৈনিকদের একটু দূরে থেকে অনুসরণ করা, ভুল করে ফেলে যাওয়া জিনিসপত্র সংগ্রহ করা। মরুভূমির মধ্যে আয়েশাকে একা অবস্থান করতে দেখে চিনতে পারলেন। নিজের উটের পেছনের আসনে বসিয়ে তাকে মদিনায় নিয়ে আসেন। এই ঘটনার কথা গোপন থাকল না।

বিবি আয়েশার প্রতিদ্বন্দী জয়নাবের বোন হামনা এ-ঘটনা শুনে সুযোগ কাজে লাগাতে চাইলেন এবং অভিযোগ করলেন আয়েশা ও সাফওয়ান ব্যভিচারে লিপ্ত। বিখ্যাত কবি হাসান বিন সাবিত ও মেসতা বিন ওসাসা নামের একজন মুহাজির হামনার সাথে কণ্ঠ মেলালেন। অন্যদিকে সুযোগ-সন্ধানী আব্দুল্লাহ বিন উবায় মদিনা শহরে গুজব ছড়িয়ে দিলেন। পরিস্থিতি মোটেও আয়েশার অনুকূলে ছিল না। অভিযানে নবির সঙ্গী হবার পর এই অল্পবয়স্কা ও সুন্দরী নারী নিজেকে আরও দুজন নতুন এবং একই রকম সুন্দরী রমণীর প্রতিপক্ষ হিসেবে আবিষ্কার করলেন। প্রথমজন হলেন জয়নাব বিনতে জাহাশ, যাকে বিয়ে করার জন্য কোরানের আয়াত নাজিল হয়ে নবিকে সুযোগ করে দেয়া হয়েছে। দ্বিতীয়জন হলেন জোয়ায়রিয়া বিন আল-হারিস, যিনি মোসতালিক গোত্রের মুসাফি নামের একজনের প্রাক্তন স্ত্রী। পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে, জোয়ায়রিয়াকে অভিযানের পর বন্দী করা হয় এবং নবি তাকে তার মালিকের কাছ থেকে চারশ দিরহাম মুক্তিপণের বিনিময়ে কিনে নেবার কিছুদিন পরে বিয়ে করেন।

এটা অসম্ভব নয়, প্রতিপক্ষের আবির্ভাবে আয়েশার নারীত্ব এমনই আঘাত পেয়েছিল ও রুষ্ট হয়েছিল যে নবিকে সতর্ক করে তিনি জেনে-শুনে পাপ করেছিলেন কিংবা একটি অভিসারের অবতারণা ঘটিয়েছিলেন। যখন আয়েশার হাওদা উটের উপর তোলা হলো, কেউ লক্ষ্য করল না তা বেশি হালকা, এমনটা ভাবা কষ্টকর। মনে আরও প্রশ্ন জেগে উঠে। বিশ্রাম থেকে যাত্রা শুরুর পূর্বে নবি কেন তার প্রিয়তমা স্ত্রীর হাল-হকিকত জিজ্ঞেস করলেন না। আয়েশা কিভাবে এমন বেখেয়াল হয়ে পড়লেন যে, শতশত মুসলমানদের যাত্রা-প্রস্তুতি তার নজরে পড়ল না? তিনি সময়মত ফিরতে পারলেন না। সাফওয়ান তাকে খুঁজে পাবার আগ পর্যন্ত আয়েশা কিভাবে একা মরুভূমিতে পড়ে রইলেন? যদিও সাফওয়ানের কাজ ছিল অভিযান চলাকালীন সময়ে কিছু দূরত্ব বজায় রেখে একে অনুসরণ করা। যাত্রী ও পশুদের জন্য পরবর্তী যাত্রা বিরতির সময় তার কি অভিযানের যাত্রাবিরতির স্থানে পৌছে যাওয়া উচিত ছিল না? সাফওয়ানের আকস্মিক উদয় হওয়া এবং অভিযান চলে যাবার বেশ কিছু সময় পর আয়েশার উদ্ধার হবার ঘটনাটি তথ্য-প্রমাণ এবং যুক্তির বিচারে ধোপে টিকানো কষ্টকর। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে সাফওয়ানের সাথে যোগসাজশ করেই বিবি আয়েশা পেছনে থেকে গিয়েছিলেন।

সকালে যখন সাফওয়ান আয়েশাকে উটের পিছনের আসনে বসিয়ে শহরে প্রবেশ করলেন, শহরে তখন গুজব ছড়িয়ে পড়েছিল এবং যতই তা ছড়িয়ে পড়ল ততই কুৎসিত আকার ধারণ করল। যেহেতুমদিনা শহরটি অনেক ছোট ছিল, ছোট ছোট বিষয়গুলোও কারো কাছে গোপন থাকে না। প্রশ্ন জাগে, এই ভয়ংকর গুজবের পর কিভাবে বিশ দিন সময় লাগল আয়েশার কাছে পৌছাতে? এবং তা শোনামাত্রই কেন আয়েশা অসুস্থ হয়ে পড়লেন? তিনি অবশ্য অসুস্থতার ভানও করে থাকতে পারেন। অসুস্থতার কারণে আয়েশাকে তার পিতার গৃহে ফিরে যাবার সুযোগ করে দেয়া হয়েছিল। স্বাভাবিক বিচার-বুদ্ধিতে ধারণা করা যায়, তিনি শুরু থেকে এই গুজব সম্পর্কে অবগত ছিলেন এবং তখনই অসুস্থতার ভান করে পিতার গৃহে ফিরে গেলেন যখন নবির কানে গুজবটি পৌছে গিয়েছিল। নবি যখন আয়েশার প্রতি শীতল আচরণ করতে লাগলেন এবং দূরত্ব বজায় রাখতে শুরু করলেন। এতো সব বাহ্যিক উপস্থাপন এবং প্রতিকূল পরিস্থিতির মুখে পড়লেও আয়েশার নির্দোষ হওয়াকে অসম্ভব বলে উড়িয়ে দেয়া যায় না। সম্পূর্ণ ঘটনাকে একটি ছেলেমানুষী ও নারীদের চাতুর্যপূর্ণ নাটক হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে। সম্ভাবনা আরও জোরালো হয় যখন জানা যায় সাফওয়ান বহু আগে থেকে একজন কুখ্যাত নারীবিদ্বেষী লোক ছিলেন।

ঘটনা যাই হোক না কেন, লোকমুখে ছড়িয়ে পড়া এই গুজব নবিকে চরমভাবে বিচলিত করেছিল। তিনি বিশ্বস্ত দুজন সহচর ওসামা বিন জায়েদ ও আলি বিন আবু তালিবের পরামর্শ গ্রহণ করেন। ওসামা দৃঢ়ভাবে মত প্রকাশ করেন, আয়েশা নির্দোষ এবং হজরত আবু বকরের মেয়ে হিসেবে তিনি কোনো অনৈতিক কাজে প্রলুব্ধ হতে পারেন না। অন্যদিকে আলির মত ছিল, নবির বিয়ে করার জন্য মেয়ের অভাব নেই, এবং ওই অভিসার-সম্পর্কিত আসল সত্য ঘটনা সম্ভবত আয়েশার দাসীর কাছ থেকে জানা যাবে। এরপরেই আলি ওই হতভাগ্য দাসীকে বেদম প্রহার করে সত্য উদ্ধারের চেষ্টা করলেন কিন্তু ওই দাসী কিছুই জানতেন না এবং কসম খেয়ে বললেন যে, বিবি আয়েশা নির্দোষ।

নবির মনে তবুও সন্দেহ দানা বেঁধে ছিল। যে কারণে নিজেই আবু বকরের গৃহে আয়েশাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে গেলেন। কিন্তু তিনি কেবল কান্নাভেজা কণ্ঠে আয়েশার নিদোর্য হবার দাবি শুনতে পেলেন। তিনি যখন সেখানে অবস্থান করছিলেন, হঠাৎই একটি স্বগীয় প্রত্যাদেশ নবির কাছে অবতীর্ণ হওয়ায় নবি মূৰ্ছা গেলেন। সবাই তাকে কাপড়ে মুড়ে, মাথার নিচে একটি বালিশ রেখে দিল। তিনি এতটাই ঘৰ্মাক্ত হয়ে গেলেন যে তার আলখাল্লা পুরোটা ঘামে ভিজে গেল। কিছুক্ষণ পর যখন তিনি সুস্থ হয়ে উঠলেন তখনই ২৪ নম্বর সুরা নুর অবতীর্ণ হলো। এই সূরাটি একটি দীর্ঘ অংশে (২-২৬ নম্বর আয়াত) ব্যভিচার এবং ব্যভিচারের মিথ্যা অভিযোগ করার শাস্তি এবং ওই মিথ্যা অভিসারের কাহিনী নিয়ে বক্তব্য রয়েছে। এই আয়াতের মাধ্যমে আয়েশাকে ব্যভিচারের অভিযোগ থেকে দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছে।

আল-জামাখশারির পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী কোরানে এর থেকে অন্য কোনো বিষয়ে এত গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। ২৩ নম্বর আয়াত এর সর্বোত্তম উদাহরণ: “যারা সাধবী, নিরীহ ও বিশ্বাসী নারীর প্রতি অপবাদ আরোপ করে তারা ইহলোক ও পরলোকে অভিশপ্ত এবং তাদের জন্য রয়েছে মহাশাস্তি। ( ২৪:২৩)। মিথ্যা অভিসারের কাহিনীর সমাপ্তি ঘটে তিনজন কুৎসারটনাকারীকে শাস্তি প্রদানের মাধ্যমে। তারা হলেন হামনা, হাসান বিন সাবিত এবং মেসতা। সুরা নুর-এর ৪ নম্বর আয়াত অনুযায়ী তাদের প্রত্যেককে আশিবার বেত্ৰাঘাত করা হয়। পূর্ববর্তী ঘটনার প্রেক্ষিতে এই শাস্তি প্রদান করা হয়, কেননা তারা যখন অপরাধ করেন, তখনও এই আয়াত অবতীর্ণ হয়নি।

নবির জীবনী-গ্রন্থগুলোতে বর্ণিত আরও একটি ঘটনা যা কোরানের আয়াতগুলোতে প্রতিধ্বনিত হয়েছে তা হলো নবির পালক-পুত্র জায়েদ বিন হারিসের স্ত্রী জয়নাব বিনতে জাহাশের প্রতি নবির প্রীতি ও তার সাথে নবির বিবাহ-বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া। জায়েদ একজন যুদ্ধবন্দী, পরে ক্রীতদাস হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। বিবি খাদিজা তাকে ক্রয় করে মুহাম্মদকে উপহার দিয়েছিলেন। পরবর্তীতে নবি তাকে মুক্ত করে দিলেন এবং সমসাময়িক একটি প্রথা অনুযায়ী পালক-পুত্ররূপে গ্রহণ করলেন। প্রাক-ইসলামি যুগের আরব সংস্কৃতিতে পালক সন্তানদের রক্তের সন্তানের সমান অধিকার দেওয়া হতো এবং তাদের ওপর একই বিধিনিষেধ আরোপিত হতো। যেমন উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে এবং আত্মীয়তা ও বিয়ের ক্ষেত্রে পছন্দের ভিন্নতায়। সুরা আহজাব-এর আয়াত ৪৬ এ নিষেধাজ্ঞা আসার পূর্ব পর্যন্ত মুসলমানরা আরবের প্রাচীন প্রথা পালন করতেন। এই বিষয়ে আব্দুল্লাহ বিন ওমর একবার বলেছিলেন, “আমরা যারা নবির সান্নিধ্যে ছিলাম তারা জায়েদকে জায়েদ বিন মুহাম্মদ নামে সম্বোধন করতাম। তিনি শুধু নবির পুত্রই ছিলেন না, নবির জন্য অন্যতম নিবেদিত- প্রাণ এবং দৃঢ়বিশ্বাসী সাহাবিও ছিলেন।

জয়নাবের মায়ের নাম ছিল ওমায়মা, তিনি আবার আব্দুল মোতালেবের কন্যা। অর্থাৎ সম্পর্কে জয়নাব মুহাম্মদের ফুফাতো বোন। নবি নিজেই অনুরোধ করেছিলেন, জয়নাবকে যেন জায়েদের সাথে বিয়ে দেয়া হয়। প্রথমদিকে জয়নাব এবং তার ভাই আব্দুল্লাহ বিয়ের সম্মতি দানে আপত্তি করছিলেন। কারণ জায়েদ ছিলেন একজন মুক্ত ক্রীতদাস। ফলে জায়েদের সাথে তাদের সামাজিক মানমর্যাদার অসাম্য নিয়ে চিন্তিত হয়েছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে সুরা আহজাব-এর ৩৬ নম্বর আয়াত অবতীর্ণ হবার পর তারা সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেন: আল্লাহ ও তার রসুল কোনো বিষয়ে নির্দেশ দিলে কোনো বিশ্বাসী পুরুষ বা নারীর সে-বিষয়ে ভিন্ন সিদ্ধান্তের অধিকার থাকবে না। কেউ আল্লাহ ও তার রসুলকে অমান্য করলে সে স্পষ্টই পথভ্রষ্ট হবে।’ (৩৩৩৬)। এই প্রত্যাদেশের পর জয়নাবের সাথে জায়েদের বিয়ে দেয়া হয়। জয়নাবের প্রতি নবির ভালবাসাবোধ তৈরি হয় আরও পরে। যার সময়কাল এবং পরিস্থিতির বহু বর্ণনা রয়েছে। তফসির আল-জালালাইনের বর্ণনা অনুযায়ী, জায়েদের সাথে বিয়ের পরে জয়নাবের প্রতি নবির দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন আসে: কিছু সময় পর জয়নাবের প্রতি নবির দৃষ্টি পড়ে এবং নবির হৃদয়ে তার প্রতি ভালবাসার বীজ অঙ্কুরিত হয়। ’

সুরা আহজাব-এর ৩৭ নম্বর আয়াতের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে জামাখশারি বলেছেন, জায়েদের সাথে বিয়ের পরই জয়নাবের প্রতি নবির দৃষ্টি পড়ে। জয়নাব নবিকে এতটা বিমোহিত করেছিলেন যে, নবি তার ভালোবাসাবোধ নিয়ে মন্তব্য করেছেন- হৃদয়ে কম্পন সৃষ্টির জন্য আল্লাহর প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা। নবি জয়নাবকে আগেও দেখেছেন। কিন্তু তখন তিনি নবিকে প্রীত করতে পারেননি, বা নবির মধ্যে ভালোবাসাবোধ জাগেনি। না-হলে নবি হয়তো নিজেই তার পাণিপ্রার্থী হতেন। নবির প্রশংসার কথা জেনে জয়নাব জায়েদকে তা অবহিত করেন। জায়েদের মন বলছিল, আল্লাহ তার হৃদয়ে জয়নাবের অবস্থানে একটি অস্বস্তিকর পরিবেশ সৃষ্টি করেছেন। তিনি তাই তাড়াতাড়ি নবির কাছে ছুটে গিয়ে নিজ স্ত্রীকে তালাক দেবার অনুমতি চাইলেন। নবি পুরো ঘটনা জানতে চেয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘জায়েদ জয়নাবকে সন্দেহ করেন কিনা? প্রত্যুত্তরে জায়েদ বললেন, জয়নাবের কাছ থেকে তিনি দয়ালু আচরণই পেয়েছেন, কিন্তু তিনি উদ্বিগ্ন এই কারণে যে, জয়নাব নিজেকে তার থেকে অভিজাত মনে করেন এবং নিজেকে নবির স্ত্রী হবার যোগ্য হিসেবে বিবেচনা করেন। এ-সময় ৩৭ নম্বর আয়াতের সেই শব্দগুলো প্রত্যাদেশ হিসেবে আসলো: ‘তুমি তোমার স্ত্রীকে তোমার কাছে রাখো, আল্লাহকে ভয় করো। এই তাৎপর্যপূর্ণ আয়াতটি নবি মুহাম্মদের সততা এবং জবাবদিহিতার একটি অনন্যসাধারণ উদাহরণ। আয়াতটির সম্পূর্ণ অনুবাদ এখানে দেয়া হল: সারণ করো, আল্লাহ যাকে অনুগ্রহ করেছেন ও তুমিও যাকে অনুগ্রহ করেছ তুমি তাকে বলেছিলে, “তুমি তোমার স্ত্রীকে তোমার কাছে রাখো, আল্লাহকে ভয় করো। তুমি তোমার অন্তরে যা গোপন করেছিলে আল্লাহ তা প্রকাশ করে দিচ্ছেন। তুমি লোকভয় করছিলে, অথচ আল্লাহকেই ভয় করা তোমার পক্ষে অধিকতর সংগত ছিল। তারপর জায়েদ যখন (জয়নাবের সাথে) বিবাহ-সম্পর্ক ছিন্ন করল তখন আমি তাকে তোমার সাথে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ করলাম যাতে বিশ্বাসীদের পোষ্যপুত্ররা নিজ স্ত্রীর সাথে বিবাহসূত্র ছিন্ন করলে সেসব রমণীকে বিয়ে করতে বিশ্বাসীদের কোনো বাধা না হয়। আল্লাহর আদেশ কার্যকর হয়েই থাকে। (৩৩:৩৭)।

এই আয়াতটি যথেষ্ট পরিষ্কার এবং বিশদ ব্যাখ্যার কোনো প্রয়োজন নেই। নবি জয়নাবকে পছন্দ করতেন, কিন্তু জায়েদ যখন নবির সাথে দেখা করে জয়নাবকে তালাক প্রদানের অনুমতি প্রার্থনা করলেন, নবি বিরুদ্ধ-মত দিয়ে জয়নাবের সাথে সংসার চালিয়ে যাবার পরামর্শ দিলেন। জায়েদকে উপদেশ দিয়ে নবি নিজের মনের ইচ্ছা আড়াল করলেন। কিন্তু আল্লাহ নবিকে বললেন যে, লোকে তাকে মন্দ বলবে এই ভয়ে জয়নাবের তালাকের জন্য নিজের সমর্থন প্রকাশে নবি বিরত রয়েছেন। নবির উপদেশ উপেক্ষা করে জায়েদ যখন জয়নাবকে তালাক প্রদান সম্পন্ন করলেন, তাকে বিয়ে করতে আল্লাহ তখন নবিকে অনুমতি দিলেন যেন মুসলমানরা কখনো তাদের পালক-পুত্রের সাবেক স্ত্রীদের বিয়ে করতে কোনো বিধি-নিষেধের সম্মুখীন না হয়।

সম্ভবত জায়েদের সাথে বিয়ের অনুষ্ঠানে জয়নাবের প্রতি নবির দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটে। জয়নাবের আলাদা বসবাস করার কারণে জায়েদ নবির সাথে দেখা করে তালাকের অনুমতি চাওয়ার ঘটনা থেকে বোঝা যায়, খুব বেশি দিন স্থায়ী না হলেও তারা দুইজন একটি স্বাভাবিক দাম্পত্য সম্পর্কে ছিলেন। এমন পরিস্থিতিতে আল-জামাখশারির বর্ণিত ঘটনাবলী ক্রমানুসারে সাজানো যেতে পারে: বিয়ের অনুষ্ঠানে জয়নাবকে একনজর দেখার পর মুহাম্মদ তার সুখানুভূতি প্রকাশ করেন এই বলে, “হৃদয়ে কম্পন সৃষ্টির জন্য আল্লাহর প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা। নবির এ-কথা শুনতে পেয়ে এবং সম্ভবত তার প্রতি নবির দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন দেখে জয়নাব নবির প্রকৃত অনুভূতি সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠলেন। এই অনুভূতি জয়নাবকে প্রেরণা যোগায় এমন একটি লক্ষ্য অর্জনে, যেখানে তিনি কুরাইশ গোত্রের সবচেয়ে সম্রান্ত ব্যক্তির স্ত্রীর মর্যাদা পাবেন। এই আশার বশবর্তী হয়ে এবং যেহেতু জয়নাব কখনো জায়েদকে স্বামী হিসেবে কামনা করেননি, তাই তিনি জায়েদের সাথে শীতল আচরণ করতে শুরু করেন। নিজ লক্ষ্য অর্জনে এতোটা অগ্রসর হলেন যে, নিজের সন্ত্রান্ত পরিচয় নিয়ে দম্ভ প্রকাশ করতে শুরু করলেন। তার প্রতি নবির অনুভূতি নিয়ে গর্ববোধ করা শুরু করলেন। জায়েদ তার নেতা এবং মুক্তিদাতার প্রতি কৃতজ্ঞচিত্তে তৎক্ষণাৎ জয়নাবকে ত্যাগ করার সিদ্ধান্তনিলেন এবং নবির উপদেশ উপেক্ষা করে তালাকের প্রক্রিয়া সম্পন্ন করলেন।

ক্যামব্রিজ তফসিরে’ এক ভিন্নবিবরণ রয়েছে: একদিন আল্লাহর প্রেরিত পুরুষ (আল্লাহর রহমত বর্ষিত হোক তার ওপর) জয়নাবের বাড়িতে জায়েদের সাথে দেখা করতে গেলেন, সেখানে জয়নাবকে একটি চৌবাচ্চায় সুগন্ধি ঢালতে দেখেন। নবি তাকে দেখে প্রীত হলেন এবং জয়নাবকে স্ত্রীরূপে গ্রহণ করার বাসনা জেগে ওঠে। নবিকে দেখে জয়নাব তাকে নিজ হাত দিয়ে স্পর্শ করলেন। নবি তখন বললেন, ‘প্রশংসনীয় সৌষ্ঠব এবং সৌন্দৰ্যদায়িনী! হায় জয়নাব হৃদয়ে কম্পন সৃষ্টির জন্য আল্লাহর প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা!’ এ-কথাটি দুইবার বলে নবি চলে গেলেন। জায়েদ ফেরার পর জয়নাব তাকে ঘটনা খুলে বললেন এবং জানালেন, আপনি আর আমাকে পাবার অধিকার রাখেন না। যান এবং তালাকের অনুমতি চেয়ে আসুন। জায়েদের মনে জয়নাবের প্রতি বিদ্বেষ জেগে ওঠে। তিনি আর জয়নাবকে দৃষ্টিসীমার মাঝে সহ্য করতে পারছিলেন না। তালাক সম্পন্ন হবার পর, নবি জায়েদকে অনুরোধ করেন, জায়েদ যেন জয়নাবের সাথে দেখা করে বলেন, আল্লাহ তাকে নবির স্ত্রী হিসেবে মনোনীত এখন কি প্রয়োজন থাকতে পারে? জায়েদ উত্তর দিলেন, তিনি আল্লাহর রসুলের কাছ থেকে জয়নাবের জন্য একটি বার্তা নিয়ে এসেছেন। সকল প্রশংসা আল্লাহর রসুলের জন্য বলে জয়নাব দরজা খুলে দিলেন। জায়েদ ভেতরে প্রবেশ করা মাত্র জয়নাব কাঁদতে শুরু করলেন। জায়েদ বললেন, ‘এখন কাঁদার সময় নয়। আল্লাহ তোমাকে আমার চেয়েও ভালো একজন স্বামী দিয়েছেন। জয়নাব উত্তর দিলেন, আপনি কিছু মনে নিবেন না! কে সেই স্বামী? জায়েদ যখন জানালেন, আল্লাহর রসুলই সেই ব্যক্তি, জয়নাব তখন মাটিতে মাথা ঠুকে প্রার্থনায় নিমগ্ন হলেন।

অন্য আরেকটি বর্ণনা অনুযায়ী জায়েদ বলেছেন: ‘আমি জয়নাবের গৃহে গিয়ে তাকে রুটি সেঁকতে দেখি। যেহেতু সে শীঘ্রই নবির স্ত্রী হতে যাচ্ছে, নবির প্রতি আমার শ্রদ্ধার কারণে আমি তার দিকে সরাসরি তাকালাম না। আমি তার দিকে পিছু ফিরে জানালাম, নবি জয়নাবের পাণিপ্রার্থী হতে চেয়েছেন।”

তফসির আল-জালালাইনের মতে বিবাহ-বিচ্ছেদের পর পুনরায় বিবাহের জন্য মধ্যবর্তী যে কয়েকটি দিন অপেক্ষা করতে হয়, নবি সেদিনগুলো অপেক্ষা করেন এবং তা শেষ হওয়ার সাথে সাথে নবি কোনো প্রারম্ভিক অনুষ্ঠান ব্যতিরেকে জয়নাবের বাড়িতে উপস্থিত হলেন। সেখানে তাৎক্ষণিকভাবে একটি ভেড়া জবাই করে বিবাহ-ভোজের আয়োজন করা হয়। ভোজের অনুষ্ঠান এবং মানুষের মাঝে রুটি ও মাংস বিতরণের কর্মযজ্ঞ অনেক রাত অবধি চলেছিল। প্রচলিত আছে যে, হজরত ওমর এবং বিবি আয়েশা উভয়েই মন্তব্য করেছেন, সুরা আহজাব-এর ৩৭ নম্বর আয়াতে নবির সততা ও সত্যবাদিতার প্রমাণ পাওয়া যায়। আয়েশা আরও বলেছিলেন, নবি যদি কোনো কিছু লুকিয়ে রাখার ইচ্ছা করতেন, তবে জয়নাবের প্রতি তার মনের ভাবনা কখনো কোরানে উল্লেখ হতো না। যেমন এই আয়াতে বলা হয়েছে, “তুমি তোমার অন্তরে যা গোপন করেছিলে আল্লাহ তা প্রকাশ করে দিচ্ছেন এ শব্দগুলো কখনো অবতীর্ণ হতো না।

শুধুমাত্র কোরানের সুরা আহজাব-ই নয়, কোরানের আরও অনেক সুরা থেকে নবির সততা এবং সত্যবাদিতার পরিচয় পাওয়া যায়। নবি তার মানবিক দুর্বলতা স্বীকারে কুষ্ঠাবোধ করেননি। যদিও মুসলমান রক্ষণশীলরা দীর্ঘদিন ধরে এই সত্যকে স্বীকার করতে চান না, যারা কিনা রাজার থেকেও বেশি রাজকীয় আচরণে প্রলুব্ধ এবং অলৌকিকতার প্রতি চরম আসক্ত। পূর্ববর্তী অধ্যায়ে এ সম্পর্কে সামান্য পরিমাণে আলোকপাত করা হয়েছে। হাদিসের অনেকগুলো স্পষ্ট প্রমাণ ও সুরা আহজাব-এর ৩৭ নম্বর আয়াতের পরিষ্কার অর্থকে অগ্রাহ্য করে ইসলামি পণ্ডিত আল-তাবারি” মন্তব্য করেছেন, তুমি তোমার অন্তরে যা গোপন করেছিলে আল্লাহ তা প্রকাশ করে দিচ্ছেনবাক্যটি নবি মুহামদকে উদ্দেশ্য করে অবতীর্ণ হয়নি। এটা জায়েদকে উদ্দেশ্য করে বলা হয়েছে। জায়েদের মনের মাঝে কোনো কিছু গোপন ছিল!আল-তাবারি এই ভিত্তিহীন ব্যাখ্যাকে গ্রহণযোগ্য করতে গিয়ে অভিযোগ করলেন ; জায়েদের একটি মারাত্মক ব্যাধি ছিল, যার খবর তিনি গোপন করেছিলেন। এই ব্যাধির কারণে তিনি জয়নাবকে তালাক দেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। সমাজের কাছ থেকে তার রোগের খবর গোপন রাখা জায়েদের উদ্দেশ্য ছিল। ৭৬

ফুফাতো বোন। নবি তাঁকে পূর্বেও দেখেছেন এবং বিয়ে করার কোনো ইচ্ছা প্রকাশ করেননি। তিনি তাই জয়নাবকে তালাক না দেবার জন্য জায়েদকে অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু জায়েদ তার পথপ্রদর্শকের উপদেশ অমান্য করে ঠিকই নিজের স্ত্রীকে তালাক দিলেন। পরবর্তীতে পৌত্তলিক-আরবের প্রথা ভঙ্গের জন্য নবি জয়নাবকে বিয়ে করলেন বিশ্বাসীদেরকে দেখানোর জন্য যে, দত্তক গ্রহণের পর দত্তক পুত্রের সাবেক স্ত্রীকে বিয়ের অনুমোদন রয়েছে। জয়নাবকে বিয়ে করার পেছনে এটি একমাত্র কারণ এবং সম্ভবত এ-কারণেই তিনি বিচ্ছেদ-পরবর্তী বিরতি সমাপ্ত হবার পর তাড়াতাড়ি জয়নাবের গৃহে যান এবং বিয়ের উৎসব সম্পন্ন করেন। হায়কলের মতে, নবির বেশিরভাগ বিয়ের পেছনে রাজনৈতিক কারণ রয়েছে কিংবা বিয়েগুলোর মাধ্যমে তার ধর্ম প্রচারে সুবিধা হয়েছে। নিজের এই দৃষ্টিভঙ্গির সমর্থনে তিনি নবির সাথে হজরত ওমর বিন আল-খাত্তাবের মেয়ে হাফসার বিয়ের ঘটনার একটি উদাহরণ টেনেছেন : ‘একদিন ওমর তার স্ত্রীর সাথে একটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করছিলেন। ওমরের স্ত্রী রাগান্বিত ও ঝাঁঝালো ভাষায় তর্ক চালিয়ে যাচ্ছিলেন। ওমর রেগে গিয়ে বললেন, নারীরা জীবনের বিভিন্ন দিক নিয়ে পুরুষের সাথে আলোচনার উপযুক্ত নয়। তাদের মতামত প্রকাশ করারও কোনো প্রয়োজন নেই। তার স্ত্রী প্রত্যুত্তরে বললেন, আপনার কন্যা আল্লাহর রসুলের সাথে এতো বেশি ঝগড়া করে যে, তা-নিয়ে নবি সারাদিনই রেগে থাকেন। স্ত্রীর মুখে এই কথা শুনে ওমর সরাসরি হাফসার বাড়িতে গেলেন তাঁকে জিজ্ঞেস করার জন্য। তিনি হাফসাকে আল্লাহর শাস্তি ও নবির রাগ থেকে সতর্ক হবার কথা বললেন। তিনি আরও বললেন, ‘এই অল্পবয়স্কা মেয়েটিকে (আয়েশা) নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ো না, যে কিনা নিজের সৌন্দর্য এবং তার প্রতি নবির ভালবাসার কারণে দাম্ভিক আচরণ করে! নবি তোমাকে আমার কারণে বিয়ে করেছেন, তোমাকে ভালবাসেন বলে নয়।’

এটা ঠিক যে নবির অনেকগুলো বিয়ের মধ্যে কয়েকটি সম্পন্ন হয়েছিল আতীয়তার সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে ইসলাম-প্রচারের জন্য। হায়কলের মতে, এই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই আলি এবং উসমানকে নবি জামাতা হিসেবে গ্রহণ করেছেন। খালেদ বিন আল-ওয়ালিদ ইসলাম গ্রহণ করে হিজরি ৭ সালে (৬২৯ খ্রিস্টাব্দে) মক্কায় হিজরত করতে যান। কারণ সে-সময় নবি সর্বশেষ স্ত্রী মায়মুনাকে বিয়ে করেছিলেন। মায়মুনা খালেদের খালা ছিলেন এবং নবির দুই চাচা আব্বাস ও হামজার স্ত্রীদের একজনের বোন ছিলেন।

বিবাহ সম্পর্কিত আরেকটি ঘটনা উল্লেখ করা যায়, যা ওই সময়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল এবং কোরানেও এ-সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে। ঘটনার সূত্রপাত, নবি মারিয়া নামের ক্রীতদাসীর সাথে শয়নকক্ষে প্রবেশ করেন। হাফসা তখন আকস্মিকভাবে সেখানে উপস্থিত হোন। নবির দিকে অসমানসূচক ভাষায় চিৎকার করে বলেন, আপনি কেন আপনার দাসীকে নিয়ে আমার বিছানায় শুয়ে আছেন? হাফসাকে সন্তুষ্ট করতে নবি আর কখনো মারিয়াকে স্পর্শ না করার প্রতিজ্ঞা করলেন। ঝড় শান্ত হয় গেলে নবি মত পরিবর্তন করলেন। হয়তো তিনি মারিয়াকে পছন্দ করতেন কিংবা মারিয়া এ-ঘটনায় মনে আঘাত পেয়েছেন এই ভেবে। সুরা তাহরিম-এর প্রথম পাঁচটি আয়াতে নবির তখনকার আচরণ সম্পর্কে ইঙ্গিত করা হয়েছে ; হে নবি আল্লাহ তোমার জন্য যা বৈধ করেছেন কেন তুমি তা নিষিদ্ধ করছ তোমার স্ত্রীদেরকে খুশি করার জন্য? আর আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। আল্লাহ তোমাদের শপথ থেকে মুক্তির ব্যবস্থা করে দিয়েছেন, আল্লাহ তোমাদের সহায়। আর তিনি সর্বজ্ঞ, তত্ত্বজ্ঞানী। (৬৬:১২)। সুরা মায়িদা-এর ৮৯ নম্বর আয়াতের বক্তব্য অনুযায়ী, ভুলবশত বা নিরর্থক শপথ বাতিলের জন্য দশজন গরীবকে মাঝারি ধরনের খাবার দিয়ে, বা কাপড় দিয়ে সহায়তা কিংবা একজন দাসকে অবমুক্ত করা অথবা তিনদিন রোজা থাকার কথা কোরানে বলা হয়েছে। মোকাত্তেল বিন সুলেমানের” একটি হাদিস ভাষ্যে রয়েছে, নবি মারিয়াকে স্পর্শ না করার যে শপথ করেছিলেন,

সুরা মায়িদার নির্দেশ অনুযায়ী একজন দাসকে অবমুক্তকরণের মাধ্যমে সেই শপথ বাতিল করেন; এবং হাসান বিন আলির একটি হাদিস অনুযায়ী সুরা ফাতিহার ২ নম্বর আয়াতের যিনি পরম করুণাময়, পরম দয়াময়’ শব্দগুলো থেকে বোঝা যায় আল্লাহ নবিকে ক্ষমা করে দিয়েছিলেন।

‘(সরণ করো) নবি তার স্ত্রীদের একজনকে গোপনে কিছু বলেছিল। তারপর সেই স্ত্রী তা অন্যকে বলে দেয়, আল্লাহ নবিকে তা জানিয়ে দেন। এ-বিষয়ে নবি সেই স্ত্রীকে কিছু বললও না। নবি যখন তাকে বলল, সে জিজ্ঞেস করল, ‘কে আপনাকে একথা জানাল?’ নবি বলল, “আমাকে জানিয়েছেন তিনি, যিনি সর্বজ্ঞ, যাঁর সব জানা। (৬৬:৩)। এই আয়াত নিয়ে আলোকপাত করা দরকার: নবি হাফসাকে অনুরোধ করেছিলেন, এ- ঘটনা যেন অন্য কেউ জানতে না পারে এবং মারিয়াকে আর তিনি স্পর্শ করবেন না বলে শপথ নিয়েছিলেন। কিন্তু ঘটনাটি বিবি হাফসা বিবি আয়েশাকে বলে ফেলেন। নবি যখন হাফসার সাথে কথা বলেন এবং এও জানান, হাফসার বক্তব্য ফাঁসের কথা ইতিমধ্যে আল্লাহ তাকে জানিয়েছেন। যদিও নবি কতটুকু জানেন তা পরিষ্কার করেননি। হাফসা ভেবে নিলেন, আয়েশা হয়তো নবিকে এ-বিষয়ে অবহিত করেছেন। তিনি যখন জিজ্ঞেস করলেন নবি কিভাবে জানেন, নবি প্রত্যুত্তরে বললেন যে, আল্লাহ তাকে এ সম্পর্কে অবহিত করেছেন। কোরানের প্রতিটি পাঠকই এ-বিষয়ে একমত হবেন যে, মানব-জাতির জন্য সর্বকালের পবিত্র ধর্মগ্রন্থে এ-ধরনের ব্যক্তিগত বিষয়াবলীর অন্তর্ভুক্তি অবশ্যই আমাদেরকে আশ্চর্যজনক ধাঁধার মধ্যে ফেলে দেয়। কোরানের তফসিরকারকদের দেয়া ব্যাখ্যাগুলোও বিস্ময়কর। যেমন ক্যামব্রিজ তফসির-এ বর্ণিত একটি বক্তব্য উল্লেখ করা যেতে পারে: হাফসা যখন আয়েশাকে নবির এই ঘটনা জানালেন এবং আল্লাহ যখন নবিকে হাফসা কর্তৃক এই তথ্য ফাঁসের খবর সম্পর্কে অবহিত করলেন, নবি এর প্রমাণ দেয়ার জন্য হাফসা আয়েশাকে যা বলেছেন তার কিয়দংশ হাফসাকে অবহিত করলেন।”

এ-ধরনের ব্যক্তিগত সাংসারিক বিষয়াবলী, মেয়েলি-কথাবার্তা যা পৃথিবীর যেকোনো সময় যেকোনো প্রান্তে ঘটে থাকতে পারে, তা কিভাবে কোরানের আলোচ্য-সূচিতে জায়গা পেতে পারে? এর মাধ্যমে আল্লাহকে, সমগ্র বিশ্বজগতের সৃষ্টিকর্তাকে ছোট করা হয়নি? আল্লাহকে হাফসার সাথে আয়েশার কথাবার্তার একজন তথ্য-ফাঁসকারী পর্যায়ে নামিয়ে আনেননি? যেকোনো পরিস্থিতিতে, সুরা তাহরিম-এর প্রথম তিনটি আয়াত স্বামী-স্ত্রীর দাম্পত্য-কলহের একটি সাধারণ পরিস্থিতি মাত্র।

পরবর্তী দুটি আয়াতের (৪-৫ নম্বর আয়াত) মাধ্যমে হাফসা এবং আয়েশাকে সতর্ক করে দেয়া হয়েছে। তারা দুজন যদি প্রতিবাদ করতে থাকেন এবং স্ত্রী- স্বরূপ ঈর্ষা প্রকাশ করতে থাকেন তবে তারা নবির বিরাগভাজন হবেন। এজন্য শেষ হাতিয়ার স্বরূপ নবি তাদেরকে তালাক দিতে পারবেন। তোমাদের হৃদয় যা কামনা করেছিল তার জন্য তোমরা দুজন অনুতপ্ত হয়ে আল্লাহর দিকে ফিরে যাও। তোমরা যদি তার (নবির) বিরুদ্ধে একে অপরকে সাহায্য কর, তবে (জেনে রাখো) আল্লাহ তার অভিভাবক; জিবরাইল ও সৎকর্মপরায়ণ বিশ্বাসীরা, আর তার ওপর ফেরেশতারাও, তাকে সাহায্য করবে। (৬৬:৪)। নবি যদি তোমাদের সকলকে তালাক দেয়, তবে তার প্রতিপালক তোমাদের পরিবর্তে হয়তো তোমাদের চেয়ে আরও ভালো স্ত্রী তাকে দেবেন; যারা মুসলমান, বিশ্বাসী, তওবা করে, এবাদত করে, রোজা রাখে, অকুমারী ও কুমারী।’(৬৬৫)। যদিও এই আয়াতগুলোর অর্থ এবং অবতারণার পরিস্থিতি উভয়েই পরিষ্কার, তথাপি কোনো কোনো তফসিরকারক এই আয়াতগুলোকে এমন উদ্ভট উপায়ে ব্যাখ্যা করতে চেয়েছেন, তা অবিশ্বাস্য! পাঠক হিসেবে তা আমাদের মধ্যে শুধু মৃদু হাস্যরসের সৃষ্টি করে। ক্যামব্রিজ তফসির অনুযায়ী এই আয়াতে ব্যবহৃত ইহায়ইবল (বিধবা কিংবা তালাকপ্রাপ্তরা) বলতে মিশরের ফারাও রাজার স্ত্রী আসিয়াকে বোঝানো হয়েছে। কুমারী (আবকার) শব্দ দ্বারা যিশু খ্রিস্টের মাতা মেরিকে বোঝানো হয়েছে। তাদের দুজনই নবি মুহামদকে বিয়ে করার জন্য স্বর্গে অপেক্ষা করে আছেন।

সুরা তাহরিম-এর প্রথম পাঁচটি আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার সম্পূর্ণ আরেকটি ভিন্ন প্রেক্ষাপট জানা যায়। এই ভাষ্য-অনুযায়ী, নবি জয়নাবের বাড়িতে কিছু মধু পান করেছিলেন এবং এতে ঈর্ষান্বিত হয়ে আয়েশা এবং হাফসা নবিকে জিজ্ঞেস করলেন, “আপনার মুখ দিয়ে বাজে গন্ধ আসছে যে। প্রশ্নের আকসিকতায় বিব্রত নবি তখন প্রতিজ্ঞা করলেন, তিনি আর কখনো মধু খাবেন না। পরবর্তীতে (সম্ভবত নিজের প্রতিজ্ঞায় অনুশোচনাবোধ থেকে) এই প্রতিজ্ঞাকে অস্বীকার করে সুরা তাহরিম-এর ১নম্বর আয়াত অবতীর্ণ হয়। তখন থেকে ক্ষতিপূরণ প্রদানপূর্বক প্রতিজ্ঞা ভঙ্গের নিয়ম চালু হয় এবং নবির স্ত্রীদের সতর্ক করা হয় এই বলে যে, তাদেরকে নবি তালাক দিতে বাধ্য হবেন যদি না তারা নিজের মধ্যকার ঈর্ষা এবং প্রতিদ্বন্দিতা বন্ধ করেন। এই ভাষ্যটি স্বীকৃত হাদিস হবার সম্ভাবনা কম, কেননা তা হাফসার জানা তথ্যকে এবং নবির গোপন খবর ফাঁস হবার ঘটনা বেমালুম চেপে গিয়েছে।

——————-

পাদটীকা

৪৪. কোরানের ১০৫ তম সুরা ফিল-এ এই ঘটনার দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। আবিসিনীয়রা এই যুদ্ধে একটি বিশাল রাজকীয় হাতি ব্যবহার করেন। সুরা ফিল-এর ৩-৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, ঝাঁকে ঝাঁকে আবাবিল পাখি কঙ্কর ফেলে আবিসিনীয় বাহিনীকে কুপোকাত করে ফেলে। ইতিহাসবিদ ইকরিমা এবং কোরানের বিশিষ্ট তফসিরকারক আল-তাবারির মতে, কোরানের এই আয়াতগুলো রূপক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে, আসলে যুদ্ধের ময়দানে আবিসিনীয়রা গুটিবসন্তে আক্রান্ত হয়েছিল।

৪৫. ধারণা করা হয়, কোরানের ৩৪ তম সুরা সাবার ১৫-১৬ নম্বর আয়াতদ্বয় এই ঘটনার দিকে ইঙ্গিত করে। প্রত্নতাত্ত্বিক ও শিলালিপির নিদর্শন থেকে জানা গেছে, এই ঘটনা ষষ্ঠ শতাব্দীর মাঝামাঝিতে ঘটেছিল।

৪৬. মক্কা থেকে প্রায় ৫০ মাইল দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত তুলনামূলক বড় শহর। এখানে স্বল্পপরিসরে কৃষিকাজের মাধ্যমে খাদ্যশস্যের চাষ হতো। বাণিজ্যিক কাফেলা ও মরুযাত্রীর ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য এই শহর গুরুত্বপূর্ণ ছিল। পৌত্তলিকদের দেবী আল-লাতের একটি উপাসনালয়ও এখানে ছিল।

৪৭. কোরানে একবার (৩৩:১৩) এই শহরের নাম ইয়াসরিব উল্লেখ করা হয়েছে এবং চারবার আল-মদিনা (৯:১০১, ৯:১২০, ৩৩:৬০, ৬৩:৮) উল্লেখ করা হয়েছে।

8৮. Le dogme et la loi de l’Islam SFFITT :Felix Arin, দ্বতীয় সংস্করণ, প্যারিস ১৯৫৮, পৃ. ৩।

৪৯, উমিয়িন শব্দটিকে অনেকক্ষেত্রে নিরক্ষর হিসেবে ধরা হয়। তবে ক্ষেত্রবিশেষে এবং কোরানের অনেক জায়গায় যাদেরকে ধর্মগ্রন্থ দেয়া হয়নি বলতে বোঝানো হয়েছে।

৫০. সুরা বাকারার ১৯১ নম্বর আয়াতে ফিৎনা শব্দটি যন্ত্রণা প্রদান অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। নৈরাজ্য অর্থে ব্যবহৃত হয়নি।

৫১. ইরানের খোরাসানের তুশ শহরের আবু হামিদ মুহাম্মদ আল-গাজ্জালি (১০৫৮-১১১১ খ্রিস্টাব্দ) একজন অসামান্য মরমী সাধক ও ধর্মবিশারদ ছিলেন। তার সবচেয়ে বহুল পঠিত গ্রন্থগুলো হচ্ছে : ইহিয়া উলুম ঈদ-দ্বিন’ (নীতিনৈতিকতা বিষয়ক গ্রন্থ),

কিমিয়ায়ে সাদাত’, ‘তামফাতুল আল-ফালাসিফা (অধিবিদ্যাবিষয়ক দর্শন) এবং আল-মনকেদ মেন আদ-দালাল (আত্মজৈবনিক)। ইমাম গাজ্জালি যদিও একজন বিশিষ্ট সুন্নি বিশেষজ্ঞ, তবে তার লিখিত রচনাবলী শিয়া মতাবলম্বীদের অনেকেই সমানের চোখে দেখে থাকেন।

৫২. দ্রষ্টব্য : পাদটীকা ২০।

৫৩. দ্রষ্টব্য : পাদটীকা ৬।

৫৪. খুব সম্ভবত নবির রেওয়াজ অনুসরণ করে আব্বাসীয় শাসক এবং পরবর্তী মুসলমান শাসকরা সম্মানসূচক উপহার হিসেবে ‘আলখাল্লা পরিধান করতেন। যদিও প্রাচ্যে এই পোশাকটি ইসলামের প্রচারের অনেক আগে থেকে পরিধান করা হতো। মিশরীয় কবি শরাফ উদ্দিন আল-বুশিরির (১২১২-১২৯৬ খ্রিস্টাব্দ) লিখিত আলখাল্লা গাথা নামে জনপ্রিয় একটি ধর্মীয় কবিতা রয়েছে। কবিতাটা তিনি লিখেছেন পক্ষাঘাতগ্রস্ত অবস্থা থেকে সুস্থ হয়ে ওঠার পর। একদিন কবি স্বপ্নে দেখেন নবি তার দিকে একটি আলখাল্লা ছুড়ে দিচ্ছেন, সেখান থেকে তিনি কবিতা লেখার প্রেরণা লাভ করেন।

৫৫. আলি দস্তি বাক্যটি ব্যবহার করেছেন এভাবে খাবার রান্নার জন্য বসে আছো এমন ভাব প্রদর্শন করিও না।’

৫৬. আরবি হিজাব’শব্দটির মূল অর্থ ঢেকে রাখা’। ‘বোরখা শব্দের অর্থে পর্দা শব্দের ব্যবহার অনেক পরে শুরু হয়েছে।

৫৭. ইসলামি পৌরাণিক কাহিনী অনুযায়ী, আদ্য হচ্ছে একটি প্রাচীন জাতির নাম আর ইরাম হচ্ছে তাদের শহর। অবশ্য ভিন্নমতে ওই গোষ্ঠীর প্রধানের নাম হচ্ছে ইরাম। আল্লাহ প্রেরিত নবি হুদকে অপমান করায় ওই জনগোষ্ঠীকে বন্যা ও অনাবৃষ্টির কবলে পড়তে হয়। ফলে তারা ধ্বংস হয়ে যায়।

৫৮. আরেকটি প্রাচীন জনগোষ্ঠীর নাম হচ্ছে সামুদ। রোমান লেখনীতেও এদের নাম উল্লেখ আছে। তারা পেত্রা নগরীর নাবাতিয়ানদের সমগোত্রীয় ছিল এবং সেমেটিক রচনা ও লিপিতে এখনো তাদের কিছু লেখা অবশিষ্ট খোঁজ পাওয়া যায়। রোমানরা পেত্রা নগরী দখল করার পর তাদের শহর আল-হেইর (হেজাজের উত্তরে অবস্থিত) ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্রে ছিল অনেক দিন ধরে। আল হেরা থেকে উদ্ধার করা পাথরের লিপিতে (পেত্রা থেকে কিছুটা ছোট) সামুদের লেখা রয়েছে। ইসলামি বর্ণনা অনুযায়ী, নবি সালেহকে অস্বীকার করায় সামুদবাসীরা বজ্রাঘাত ও ভূমিকম্পের ফলে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।

৫৯. সাধারণভাবে আরবি ওয়াতাদ’ শব্দের অর্থ কাঠের টুকরোর স্ত্র অথবা তাবু গাঁথার পেরেক বোঝায়। শিবির বা তাবুর অধিপতি কথাটির কোনো সন্তোষজনক ব্যাখ্যা আজ পর্যন্ত কোনো তফসিরকারক বা ইসলামি চিন্তাবিদ দিতে পারেননি।

৬০. আলফ্রেড গিয়োম অনূদিত ইবনে ইসহাকের লাইফ অব মুহাম্মদ, অক্সফোর্ড ১৯৫৫, পৃ. ৬৫১। আলি দস্তি এবং আলফ্রেড গিয়োম উভয়েই আরবি ‘আওয়ান’ শব্দটিকে বন্দী’ বা অবরুদ্ধ’ হিসেবে ব্যবহার করেছেন। আক্ষরিক অর্থে এটি হচ্ছে মধ্যবর্তী’। এক্ষেত্রে সম্ভবত ‘স্বাধীন ও পরাধীনের মধ্যবর্তী কিছু বোঝানো হয়েছে। সুরা বাকারা-এর ৬৮ নম্বর আয়াতে বয়স্ক ও কমবয়সীর মধ্যবর্তী অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। ভিন্নমতে এটি হচ্ছে আরবি ‘আনিয়া’ শব্দের বহুবচন, যার অর্থ হচ্ছে “অক্ষমতায় যন্ত্রণাক্লিষ্ট’।

৬১. মাহমুদ বিন ওমর আল-জামাখশারি (১০৭৫-১১৪৪ খ্রিস্টাব্দ) কোরানের তফসিরসহ বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ বই রচনা করেছেন। তার আল-কাশশাফ’ নামের কোরানের তফসিরসহ আরবি ব্যাকরণ ও আরবি-ফার্সি অভিধানও তিনি রচনা করেছেন। তিনি

ইসলামের যুক্তিবাদী মুতাজিলা দর্শনের প্রতি অনুরক্ত ছিলেন। একই সাথে মানুষের স্বাধীন ইচ্ছা ও কোরানের লৌকিকতায় বিশ্বাসী ছিলেন।

৬২. আব্দুল্লাহ বিন ওমর আল-বায়দাওয়ি আরবিতে কোরানের তফসির রচনা করেছেন। এখনো সুন্নি মুসলমানরা এই তফসির গুরুত্বের সঙ্গে ব্যবহার করেন। আনোয়ার উল-তানজি শিরোনামের এই তফসির গ্রন্থটি আল-জামাখশারির আল-কাশশাফ – কে ভিত্তি করে রচিত তবে মুতাজিলা দর্শনের প্রভাবমুক্ত।

৬৩. বাগদাদে জন্মগ্রহণকারী ইমাম আহমদ বিন হানবল (৭৮০-৮৫৫ খ্রিস্টাব্দ) হাদিসের সংকলন আল-মোসনাদ’- এর রচয়িতা। সংকলনটি শেষ পর্যন্ত হানবলের পুত্র আব্দুল্লাহ সমাপ্ত করেন। ইসলামি ধর্মতত্ত্বের আক্ষরিক ও নৃতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা অনুসরণের তিনি পথিকৃৎ। তিনি হানবলি দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা। আব্বাসীয় শাসনামলে মুতাজিলা মতাদর্শের বিপক্ষে দাঁড়ানোর কারণে নির্যাতনের শিকার হন এবং কারাবাসও করতে হয়। দামেস্ক শহরের নাগরিক আহমদ বিন তায়মিয়া (১২২২-১৩২৮ খ্রিস্টাব্দ) পরবর্তীতে হানবলি মতাদর্শকে প্রসারিত করেন এবং বই রচনা করেন। যা কট্টরপন্থী ওয়াহাবি মতাদর্শ বিকাশে ভূমিকা রেখেছিল।

৬৪. ইরাকের বসরা শহরে জন্মগ্রহণকারী মুহাম্মদ বিন সাদ (৭৮৪-৮৪৫ খ্রিস্টাব্দ) কিতাব আল-তাবাকাত গ্রন্থের রচয়িতা। এই গ্রন্থে নবি ও সাহাবিদের জীবনী এবং ৪২৫০ টি হাদিসের উল্লেখ রয়েছে।

৬৫. আরবি ভাষায় মুতা পরিভাষাটির আক্ষরিক অর্থ হচ্ছে উপভোগ করা। সুরা নিসার ২৪ নম্বর আয়াতে উল্লেখিত যাদেরকে তোমরা উপভোগ করবেশব্দসমষ্টিও একই উৎসের অর্থ প্রকাশ করে।

৬৬. আরবি ইদা”শব্দের অর্থ ‘অপেক্ষার প্রহর’। এটা সেই সময়কালকে বোঝায় যখন কোনো বিধবা বা তালাকপ্রাপ্ত নারীর দ্বিতীয় বিবাহের অনুমতি থাকে না। কারণ এই সময়কালে তার আগের স্বামী কর্তৃক অন্তঃসত্ত্বা হবার সম্ভাবনা থাকে। ইসলামি শাস্ত্র অনুযায়ী, কোনো বিধবার জন্য ইদ্দতকাল হচ্ছে ৪ মাস ১০ দিন, কোনো তালাকপ্রাপ্ত নারীর জন্য ৩ মাস, বিধবা দাসীর জন্য ২ মাস, তালাকপ্রাপ্ত দাসীর জন্য ১.৫ মাস।

৬৭. আব্বাসীয় খলিফার শাসনামলে মুহাম্মদ আত-তিরমিজির (মৃত্যু ২৭৯ হিজরি বা ৮৯২ খ্রিস্টাব্দ) জন্ম পারস্যে। সুন্নি ইসলামের দৃষ্টিতে অন্যতম ছয়টি হাদিস সংকলনের অন্যতম জামি আত-তিরমিজি সংকলনটি করেছেন তিনি। সুন্নি মুসলমানদের কাছে এই হাদিসের স্থান শীর্ষে।

৬৮. হানিফ সম্পর্কে বর্ণনা রয়েছে প্রথম অধ্যায়ে।

৬৯. নবি মুহাম্মদের কন্যা জয়নাবের প্রথম বিয়ে হয়েছিল খাদিজার বোনের ছেলে আবুল-আসের সাথে। রোকেয়া ও উমে কুলসুমের বিয়ে হয়েছিল মুহাম্মদের চাচা আবু লাহাবের দুই পুত্র ওতবা ও ওতাইবার সাথে। আর ফাতেমার বিয়ে হয়েছিল মুহাম্মদের চাচাতো ভাই আলি বিন আবু তালিবের সাথে। ইসলাম প্রচার শুরু করলে নবি মুহাম্মদের সাথে চাচা আবু লাহাবের দ্বন্দু শুরু হয় এবং লাহাব পুত্রদেরকে মুহাম্মদের কন্যাদ্বয়কে তালাক দিতে বাধ্য করেন। পরে রোকেয়ার সাথে বিয়ে হয় হজরত উসমানের। রোকেয়ার মৃত্যুর পর উসমান বিয়ে করেন মুহাম্মদের আরেক কন্যা উম্মে কুলসুমকে।

৭০. এনসাইক্লোপেডিয়া অব ইসলাম”- এ লেখক এইচ. রেকেনডফ মেয়েটির নাম বলেছেন কায়লা। (দ্রষ্টব্য : Encyclopedia of Islam, 2nd ed., Leiden 1960, vol. I, p. 697, article al-Ash’ath) ISIRTFI ডব্লিউ. এম. ওয়াট মেয়েটির নাম বলেছেন

“čFTERTĞii”(Muhammad at Madina, Oxford 1956, p. 397) | উভয় লেখকই উল্লেখ করেছেন, নবি মুহাম্মদের সাথে তার বাগদান সম্পন্ন হয়েছিল কিন্তু মেয়েটি মদিনা পৌছানোর আগেই নবির মৃত্যু ঘটে।

৭১. ইরানের বাদশাহ খশরু-২ পারভেজের সেনারা ৬১৬ খ্রিস্টাব্দে মিশর আক্রমণ করে। ৬২৮ সাল পর্যন্ত মিশরের বিশাল অংশ ইরানের দখলে ছিল। ঐতিহাসিক আল-তাবারি হিস্ট্রি অব দ্যা প্রফেটস এন্ড কিংস (তারিক আল-রসুল ওয়া আল-মুলুক) বইয়ে বলেছেন, ষষ্ঠ হিজরিতে (৬২৭-৬২৮ খ্রিস্টাব্দ) বিশিষ্ট কবি এবং সাহাবি হাসান ইবনে সাবিত মিশর ভ্রমণকালে মিশরের রোমান গভর্নর (আল-মুকাওকিস নামে সম্বোধন করা হয়) নবির জন্য খ্রিস্টান ক্রীতদাসী মারিয়া কিবতিয়া এবং সাবিতকে মারিয়ার বোন শিরিনকে উপহার হিসেবে প্রদান করেন। সম্ভবত ৬২৮ সালের পূর্বে মারিয়া মদিনায় এসে পৌছান।

৭২. নবির চাচাতো ভাই ও আব্বাসীয় খেলাফতের পূর্বপুরুষ আব্দুল্লাহ বিন আল-আব্বাস (ইবনে আব্বাস নামেও পরিচিত) প্রচুর সংখ্যক হাদিস-বক্তা হিসেবে সুপরিচিত। ৬৮৭ খ্রিস্টাব্দে (৬৮ হিজরি) তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

৭৩. দ্বিতীয় খলিফা ওমর ইবনে আল-খাত্তাবের পুত্র আব্দুল্লাহ বিন ওমর (৬১৪-৬৯৩ খ্রিস্টাব্দ)। মুসলমানদের পক্ষে তিনি অসংখ্য যুদ্ধে লড়াই করেছেন। কিন্তু উচ্চপদে দায়িত্ব পালন করতে তিনি সবসময় অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। একজন সৎ ইসলামের জন্য নিবেদিতপ্রাণ এবং অভ্রান্ত হাদিস-বক্তা হিসেবে তিনি সুপরিচিত।

৭৪.দ্রষ্টব্য : পাদটীকা ৪৩।

৭৫. দ্রষ্টব্য ; পাদটীকা ১।

৭৬. প্রথম পক্ষের স্ত্রীর গর্ভে জন্মানো ওসামা নামে এক পুত্রসন্তান ছিল জায়েদের। ৬২৬ সালে জয়নাবকে তালাক দেবার পর তিনি আরও বিয়ে করেন এবং অনেক সন্তানের পিতা হন। মুসলমানদের পক্ষে তিনি অনেক যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। নবি তাঁকে প্রথম সিরিয়া-অভিযানের সেনাপতি হিসেবে নিযুক্ত করেছিলেন। ওই যুদ্ধে (মুতা যুদ্ধ নামে পরিচিত) তিনি মৃত্যুবরণ করেন। জায়েদের তরুণ পুত্র ওসামা ৬৩২ সালের সিরিয়া অভিযানের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। সেনাপতির দায়িত্বে ওসামার নিয়োগ নিয়ে অনেক শীর্ষ সাহাবি অসন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন।

৭৭. আল-জামাখশারি তার বিখ্যাত কোরানের তফসির আল-কাশশাফ – এ (পাদটীকা ৬১ দ্রষ্টব্য) হাদিসটি মোকাত্তেল বিন সুলেমানের বলে উল্লেখ করেছেন। আলি দস্তিও আল-জামাখশারির এই হাদিসটি গ্রহণ করেছেন। (তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. পল প্র্যাকম্যান)।

কোরানে আল্লাহ

নয়টি উজ্জ্বল গম্বুজের (গ্রহ) পাশে আমাদের পৃথিবীটা আসলে মহাসাগরে ভাসমান একটা ক্ষুদ্র পোস্তদানার মত। কিন্তু নিজেকে যখন আমরা সেই পোস্তদানার সাথে তুলনা করি তখন নিজেদেরই আবার হাস্যকর রকম ক্ষুদ্র বলেই প্রতীয়মান হয়।–শাবেস্তারি(৭৮)

আমাদের পৃথিবী যাকে চতুর্দশ শতাব্দীর পারস্যের খ্যাতিমান সুফি কবি মাহমুদ শাবেস্তারি সামান্য একটা পোস্তদানার সাথে তুলনা করেছেন, আসলে এর ওজন ছয় হাজার বিলিয়ন টন, পরিধি ৪০, ০৭৬ কিলোমিটার এবং ভূপৃষ্ঠের মোট ক্ষেত্রফল ৫১০,১০০,০০০ বর্গকিলোমিটার। কিন্তু অন্যান্য গ্রহের তুলনায় পৃথিবী ক্ষুদ্র একটা গ্রহ মাত্র। সূর্যের চারদিকে একবার প্রদক্ষিণ করতে পৃথিবীর ৩৬৫ দিনের সামান্য কিছু বেশি সময় লাগে। সৌরজগতের অন্য ৮টি গ্রহও নির্ধারিত কক্ষপথে প্রদক্ষিণ করছে। সবচেয়ে দূরবর্তী গ্রহ প্লুটো যা তুলনামূলকভাবে অল্প ভরবিশিষ্ট (প্রায় বুধের সমান) এবং এর কক্ষপথ সূর্য থেকে প্রায় ৪.৫ বিলিয়ন থেকে ৭.৫ বিলিয়ন কিলোমিটার পর্যন্ত দূরবর্তী। উল্লেখ্য ১৯৩০ সালের দিকে প্লুটোর আনুষ্ঠানিক নামকরণ হলেও, ২০০৬ সালের ইন্টারন্যাশনাল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিয়নের ২৬তম সাধারণ পরিষদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্লুটো আর আমাদের সৌরজগতের গ্রহ নয়, এটি বামন গ্রহ বলে পরিচিত হবে।-অনুবাদক। প্লুটো থেকে সূর্যের বিশাল দূরত্বকে আমাদের কল্পনার মধ্যে নিয়ে আসার সুবিধার্থে এভাবে ভাবতে পারি, একটি জেট বিমান যদি ঘণ্টায় ১০০০ কিলোমিটার দূরত্ব অতিক্রম করে তবে সূর্য থেকে প্লুটোর দূরত্ব অতিক্রম করতে বিমানটির ৭০০ বছর সময় লাগবে। আবার সূর্যের মহাকর্ষ বলের কার্যকর প্রভাব শুধু প্লুটো পর্যন্ত নয়, বরং তা সূর্য থেকে প্লুটোর দূরত্বের শতগুণ পর্যন্ত বিস্তৃত এবং এই দূরত্ব অতিক্রম করতে জেট বিমানের পূর্বোক্ত গতিতে সত্তর হাজার বছর লাগবে।

আবার সূর্য আমাদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও বিশাল নক্ষত্র হওয়া সত্ত্বেও এটি আকাশ গঙ্গা ছায়াপথের মধ্যম আকৃতির একটি তারকা মাত্র। আকাশ গঙ্গা ছায়াপথকে ফার্সি ভাষায় কাহকাসান (হলুদাভ ফিতা) বলা হয়, কারণ গ্রীষ্মের রাতে মেঘমুক্ত আকাশের দিকে তাকালে একে কিছুটা হলুদাভ ডোরাকাটা দাগের মত দেখায়। আকাশ গঙ্গা ছায়াপথে এখন পর্যন্ত সাত হাজার তারকা চিহ্নিত করা হয়েছে যাদের প্রায় সবারই সূর্যের মত আলাদা গ্রহমণ্ডলী রয়েছে।

মহাসাগরে ভাসমান আমাদের এই পৃথিবী নামক পোস্তদানটির পৃষ্ঠতল মোট ৫১০, ১০০ ০০০ বর্গকিলোমিটার এবং এর আয়তন ১, ০৮২, ৮৪২, ২১০, ০০০ ঘনকিলোমিটার যা সূর্যের তুলনায় অতি ক্ষুদ্র। পৃথিবী থেকে সূর্য কত বড় সেটা আমরা এইভাবে তুলনা করলে বুঝতে পারি, সূর্যকে যদি আমরা একটি ফাঁপা গোলক হিসাবে বিবেচনা করলে তবে এক মিলিয়ন সংখ্যক পৃথিবী গোলকের মধ্যে স্থান করে নিতে পারবে। কেবল সূর্যই আমাদের সৌরজগতের শতকরা ৯৯.৮৬ ভাগ পদার্থ নিয়ে গঠিত আর বাকি ৯টি গ্রহ ০.১৪ ভাগ নিয়ে গঠিত যার মধ্যে পৃথিবী ও তার চাঁদ শতকরা ০.০০১৪ ভাগ পদার্থ নিয়ে গঠিত।

মহাকাশে সূর্যের চেয়ে প্রায় ৫০০ গুণ বড় নক্ষত্রও রয়েছে যেখানে সূর্যের ব্যাস ১, ৩৯২ ০০০ কিলোমিটার ও এবং এর আনুমানিক ভর হচ্ছে ১, ২০০ ০০০, ০০০ বিলিয়ন টন। ইতিমধ্যে উল্লেখ করা হয়েছে মহাকাশের আকাশ-গঙ্গা ছায়াপথের একটি নক্ষত্র হচ্ছে সূর্য। হিসাব করে দেখা গেছে মহাকাশের প্রতিটি ছায়াপথে কমপক্ষে একশ বিলিয়ন করে নক্ষত্র রয়েছে। উন্নত টেলিস্কোপ ও গাণিতিক বিশ্লষণের সাহায্যে পাওয়া তথ্য অনুসারে মহাকাশে আমাদের আকাশ গঙ্গা ছায়াপথসহ প্রায় ১০০ মিলিয়ন ছায়াপথ ছড়িয়ে আছে।

সাধারণত আমাদের চারপাশের দূরত্ব মাপতে যে ধরনের হিসাব ব্যবহার করি, সেভাবে নক্ষত্রদের মধ্যকার দূরত্ব মাপা অনেকের কাছেই অসম্ভব ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায় এবং এর মাধ্যমে সহজে বোধগম্যও হয় না। এ-জন্য মহাকাশে নক্ষত্রদের দূরত্ব মাপতে আলোকবর্ষের হিসাব ব্যবহার করা হয়। সূর্যের আলো প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ৩০০ ০০০ কিলোমিটার দূরত্ব অতিক্রম করে এবং এক বছরে (এক আলোকবর্ষ) আলো প্রায় ৯.৪৬০ বিলিয়ন কিলোমিটার দূরত্ব অতিক্রম করে। মহাকাশের অনেক নক্ষত্রই আমাদের থেকে এত দূরে অবস্থিত যে এগুলো থেকে আলো এসে পৌঁছতে প্রায় শত থেকে হাজার খানেক বছর লেগে যায়।

মহাকাশ সম্পর্কে উপরের এই হিসাব-নিকাশ আমাদেরকে একদম হতবুদ্ধি করে দেয় এবং এর বিশালতা সম্পর্কে এমন একটা অস্পষ্ট ধারণা দেয়। কিন্তু একইসাথে পরিষ্কারভাবে এটাই দেখায় যে, পৃথিবী আসলে বিশাল একটা মহাসাগরে ভাসমান অতি ক্ষুদ্র পোস্তদানা মাত্র। যেকোনো চিন্তাশীল ব্যক্তি যদি মহাবিশ্বের এ বিশালতা উপলব্ধি করতে চায় তবে সে নিজেকে অসহায় মনে করতে বাধ্য। আপাত প্রতীয়মান অসীম মহাবিশ্বের যদি কোনো সীমা থেকেও থাকে তবে সেটা মানুষের এখনও অবোধগম্য। যদি এই অসীম মহাবিশ্বের একটা সীমা থাকেও এবং এর একটা শুরুর কাল থাকে তবে তাও আমাদের কাছে অবোধগম্য বলে মনে হয়। বিশাল এই মহাবিশ্বের স্রষ্টা হিসেবে আমরা যদি এখানে আল্লাহ বা ঈশ্বরকে নিয়ে আসি তবে আমাদেরকে আগেই ধরে নিতে হবে তিনি মহাবিশ্ব থেকে অনেক বড় এবং এর উর্ধ্বে। বিশাল এই মহাকাশের বিস্ময় উদ্রেককর ব্যবস্থার একজন নিয়ন্ত্রক রয়েছেন বলে যদি ধরে নিতে হয় তবে পূর্বেই আমরা ভেবে নেব তিনি অসীম ক্ষমতাধর হবেন। তাই এ ধরনের স্রষ্টা বা নিয়ন্ত্রক আমাদের সীমাবদ্ধ বোধশক্তিরও অতীত হবেন। ত্রয়োদশ শতাব্দীর পারস্যের জনপ্রিয় সুফি সাধক জালালউদ্দিন রুমি যেমনটি বলেছেন : তিনি তাই যা আমাদের জন্য অকল্পনীয়। সাধারণভাবে মানুষ খুব গভীরভাবে চিন্তা করতে পারে না। ধর্মীয় বিশ্বাস নিয়ে নিরীক্ষা করলে দেখা যায় মানুষ সৃষ্টিকর্তাকে তার দৈনন্দিন অভিজ্ঞতার আলোকে একটি বৃহৎ কিছু বলে ধরে নেয়, তাঁর মধ্যে মানুষের মতই আবেগ, দুর্বলতা, আকাঙ্ক্ষা ও উচ্চাভিলাষ রয়েছে।

হাদিসে একটি আরবি লোককথা রয়েছে এবং এটা বাইবেলের পুরাতন নিয়ম (ওল্ড টেস্টামেন্ট) থেকেই এসেছে, তা হল : ঈশ্বর মানুষকে তাঁর নিজের মত করে সৃষ্টি করেছেন। তবে সত্য হচ্ছে এর বিপরীত। স্বয়ং মানুষই ঈশ্বরকে নিজের মত করে সৃষ্টি (বা কল্পনা) করে নিয়েছে। কিছুদিন আগে এবং মুসা ঈশ্বরকে সৃষ্টি করেছেন নামে একটি বুদ্ধিদীপ্ত হাস্যরসাত্মক বই লেখা হয়েছে যা হঠাৎ করেই আমার নজরে আসে। ওল্ড টেস্টামেন্টের এবং ঈশ্বর মানুষ সৃষ্টি করেছেনবাক্যটিকে ব্যবহার করে এ বইতে যুক্তির সাহায্যে দেখানো হয়েছে যে উল্টোটাই সঠিক, ঈশ্বর বরং মুসার কল্পনার ফসল। ওল্ড টেস্টামেন্টে আমরা ঈশ্বরকে দেখতে পাই অত্যন্ত উদ্ধত, রাগী, নির্মম ও প্রশংসা পাওয়ার জন্য উন্মুখ। অগণিত সৃষ্টির মধ্যে তিনি আব্রাহামকে পছন্দ করেছিলেন কারণ তিনি ছিলেন অত্যন্ত বাধ্যগত এবং আব্রাহামের বংশধরদেরকেও ঈশ্বর নির্বাচন করলেন পৃথিবীর অধিপতি হিসাবে।

নুহের পরে আব্রাহামকে সবচেয়ে বেশি বাধ্য এবং বিনীত বান্দা হিসাবে পাওয়ায় ঈশ্বর তাকেই পছন্দ করলেন এবং একই কারণে আব্রাহামের স্ত্রী সারাহকে অন্তঃসত্ত্বা হতে সমর্থ করলেন যাতে বৃদ্ধ বয়সে তিনি ইসহাকের জন্ম দিতে পারেন। ঈশ্বরের পছন্দের লোকদের জনক হওয়ার জন্য ও কেনানে ইসহাকের সাথে বিবাহযোগ্য কোনো রমণী না থাকায় ঈশ্বরের নির্দেশে আব্রাহাম ক্যালডিয়ায় দূত পাঠালেন যিনি ইসহাকের সাথে আব্রাহামের ভ্রাতুষ্পপুত্র রেবেকাকে বিবাহের জন্য বাগদানের অনুরোধ করেছিলেন ও রেবেকাকে ফিলিস্তিনে নিয়ে গিয়েছিলেন। পরে ঈশ্বর ইসরাইলের সন্তানদের কাছ থেকে এ ব্যাপারে প্রতিশ্রুতি পেলেন যে তারা অন্য কারো উপাসনা করবে না এবং এর পরিবর্তে তারা পৃথিবীর শাসনকর্তা হবে। বিশাল এই মহাবিশ্বের প্রতিপালকের সম্পূর্ণ মনোযোগ শুধু সৌরজগতের বা পৃথিবীর প্রতি নিবদ্ধ হয়নি বরং তা কেবল সীমাবদ্ধ ছিল পৃথিবীপৃষ্ঠের অতিক্ষুদ্র একটি অংশের প্রতি, যার নাম ছিল ফিলিস্তিন। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থে যে-সকল নবি-রসুল ও জনপদের ঘটনাবলীর বর্ণনা পাই তার প্রায় সবটাই কেবল স্থানীয়, বিশ্বের অন্যান্য অংশের কোনো উল্লেখ নেই, বিষয়টি নিঃসন্দেহে কৌতুহল উদ্রেককর-অনুবাদক)।

একদা ঈশ্বর সদম ও গমোরাহ শহরের অধিবাসীদের অসদাচারণ ও পাপাচার দেখে এত ক্রুদ্ধ হোন যে তিনি শহরদ্বয় ধ্বংস করার সিদ্ধান্ত নেন। এমনকি ঈশ্বরের প্রিয়পাত্র আব্রাহামের সুপারিশও কাজে আসেনি। ঈশ্বরের নির্দেশে বজ্রপাতে সকল লোক মারা গেল। নারী, পুরুষ, মহিলা, শিশু, দোষী, নির্দোষ কেউই বাদ গেল না। ব্যতিক্রম কেবল ঘটলো আব্রাহামের ভ্রাতুষ্পপুত্র লুতের ক্ষেত্রে, যাকে ঈশ্বরের আদেশে ফেরেশতাগণ এই গণহত্যা থেকে নিরাপদ রেখেছিলেন। সম্পূর্ণ ওল্ড টেস্টামেন্ট জুড়ে ঈশ্বরকে অস্থিরমতি, নির্দয় হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে। বাইবেল থেকে দেখা যায় মুসারও একই রকম স্বৈরতান্ত্রিক মনোবৃত্তি ছিল। ডেভিড ও সলোমনও তাঁদের রাজত্বকালে ইসরাইলিদের শাসনের ক্ষেত্রে একই ধরনের ভাবাদর্শ দ্বারা পরিচালিত হয়েছেন। উরিয়ার স্ত্রী’র (বাথ-সেবা, বাইবেলে বর্ণিত উরিয়ার স্ত্রী। ডেভিড তাঁকে প্ররোচিত করে তাঁর স্বামীকে হত্যা করেন এবং তাঁকে বিয়ে করেন) কাহিনী থেকে দেখা যায়, অন্য মানুষের অধিকারের ব্যাপারে ডেভিডের সমানবোধ খুব সামান্যই ছিল।

কোরানে আল্লাহর সর্বোৎকৃষ্ট ও সদ্বগুণাবলী উল্লেখ করা হয়েছে। তিনি সর্বজ্ঞানী, সর্বশক্তিমান, সর্বদ্রষ্টা, সর্বশ্রোতা, সব অভাব থেকে মুক্ত এবং করুণাময়। শুধু এগুলো নয়, তিনি কর্তৃত্বব্যঞ্জক, ক্রুদ্ধ এবং ছলনাকারী। যেমন সুরা আনফালের ৩০ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে ; বস্তুত আল্লাহর ছলনা সবচেয়ে উত্তম। সুরা আল ইমরানের ৫৪ নম্বর আয়াতেও একই কথা বলা হয়েছে। স্রষ্টার এই গুণাবলী পরস্পর সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। যদি সর্বশক্তিমান স্রষ্টা পূর্ণ সত্তা এবং পরমোৎকর্ষ গুণাবলীসম্পন্ন হয়ে থাকেন তবে তিনি কিভাবে রাগ করা বা প্রতিশোধ নেয়ার মত চরিত্র ধারণ করেন? ( দেখুন সুরা সাজদাহ ; আয়াত ২২)

সুরা জুকরুফ ; আয়াত ৪১ ও ৫৫ ইত্যাদি-অনুবাদক)। যেখানে স্রষ্টা সর্বশক্তিমান সেখানে তাঁর রাগ করা বা ক্ষুব্ধ হওয়ার প্রয়োজন কী যা সরাসরি দুর্বলতাকে নির্দেশ করে? কেন ঈশ্বর ক্রুদ্ধ হবেন এমন নগণ্য মানুষের ওপর, যারা তাদের অজ্ঞতা ও মূর্খতার দরুন সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব ও মহাবিশ্বের উপর কর্তৃত্ব হৃদয়ঙ্গমে অক্ষম? কোরানে যখন আল্লাহ নিজেকে পরম করুণাময়, অসীম দয়ালু বলে অভিহিত করেছেন (১২৯২), তাঁর কি উচিত মানুষকে এই মর্মে হুমকি প্রদান করা যে, কেউ তাঁর সাথে শরিক করলে তা হবে সম্পূর্ণ ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ (৪:১১৬)। তাঁর কি উচিত মানুষকে অনন্তকাল নরকবাসের শাস্তি দেয়া? কোরানে তো আল্লাহ নিজেই বলেছেন তিনি তাঁর বান্দাদের প্রতি অবিবেচক হবেন না (৫০:২৮) অথচ তিনি পাপীদের নরকের উত্তপ্ত আগুনে পতিত করে শাস্তি দেবেন। তিনি বলেন যখনই অবিশ্বাসীদের চামড়া দোজখের আগুনে পুড়ে যাবে তখনই আবার নতুন চামড়া জন্মাবে যাতে তারা অনন্তকাল কঠোর শাস্তি পেতে থাকে (৪:৫৫)। কারো চির-অতৃপ্ত ক্ষোভই কেবল এরকম শাস্তি দিতে প্রলুব্ধ করতে পারে এবং ক্ষোভ নিঃসন্দেহে দুর্বলতার পরিচায়ক। একজন সর্বশক্তিমান সৃষ্টিকর্তার এরকম দুর্বলতা কি থাকতে পারে? কোরানে বলা হয়েছে, পরম সৃষ্টিকর্তা আল্লাহতায়ালা যাকে ইচ্ছা পথ প্রদর্শন করেন আর যাকে ইচ্ছা বিভ্রান্ত করেন (১৮:১৭), আবার এও বলা হয়েছে যারা বিভ্রান্ত হবে তাদেরকে কঠোর শাস্তি প্রদান করা হবে। দ্রষ্টব্য : সুরা বাকারা : আয়াত ১০ ও ৯০; সুরা মায়িদা ; আয়াত ৯৪, সুরা তওবা ; আয়াত ৩৯। ইত্যাদি।- অনুবাদক

কোরানে একদিকে আল্লাহকে সর্বশক্তিমান ও সর্বজ্ঞানী বলে অভিহিত করা হয়েছে অপরদিকে ঠিকই আবার বলা হচ্ছে তাঁর মানুষের সাহায্য প্রয়োজন : মরিয়মের সন্তান ঈসা যখন তার শিষ্যদের বললেন, কে আল্লাহর রাস্তায় আমাকে সাহায্য করবে? তখন শিষ্যরা বলল, আমরা ঈশ্বরের সাহায্যকারী।” (সুরা সাফফ ; আয়াত ১৪)। আমি মানুষের জন্য লোহা নাজিল করেছি যাতে মানুষের জন্য মহাশক্তি ও উপকার রয়েছে যাতে অদৃশ্য আল্লাহ জানতে পারেন কে তাঁকে ও তাঁর রসুলকে সাহায্য করেছে। (সুরা আল হাদিদ ; আয়াত ২৫)।

এসব অভিযোগ গুরুতর। দীর্ঘদিন ধরে ইসলামি পণ্ডিত ও কোরানের ব্যাখ্যাকারকরা এসব অসঙ্গতি দূর করার জন্য বিভিন্ন ব্যাখ্যা হাজির করেছেন। এই প্রবন্ধে দীর্ঘ ২৩ বছর ধরে বিভিন্ন ঘটনা-দুর্ঘটনার পটভূমিকেন্দ্রিক কোরানের কয়েকটি আয়াত নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা হওয়া প্রয়োজন।

হজরত মুহাম্মদের চাচা আবু লাহাব একবার তাঁকে বলেছিলেন : ধ্বংস হও মুহামদ, তুমি কি এজন্য আমাদের আমন্ত্রণ করেছ?” এর জবাবে মহাবিশ্বের সৃষ্টিকর্তা অসীম ক্ষমতাশালী আল্লাহ নগণ্য আবু লাহাবের মাথায় বজ্রপাতের মত নাজিল করলেন সুরা লাহাব (১১১), যা থেকে লাহাবের স্ত্রী উম্মে জামিলও রেহাই পাননি :

‘ধ্বংস হোক আবু লাহাবের দুই হাত আর সে নিজে।
তার ধনসম্পদ ও উপজেন তার কোনো কাজে আসবে না।
সে ভুলবে অগ্নিশিখায়
আর তার জ্বালানিভারাক্রান্ত স্ত্রীও
যার গলায় থাকবে কড়া আঁশের দড়ি।’

( আবু লাহাবের আসল নাম আব্দুল ওজা, তিনি নবি মুহাম্মদের চাচা আবু তালিবের ছোট ভাই। নবির দুই মেয়ে রোকেয়া এবং উমে কুলসুমের সাথে আব্দুল ওজার দুই ছেলে ওতবা ও ওতাইবার বিয়ে হয়েছিল। কিন্তু এই বিয়ে বেশি দিন টিকেনি, উভয়ের মধ্যে তালাক হয়ে যায়। এ-জন্য নবি মুহামদ মনঃক্ষুণ্ণ ছিলেন এবং চাচা আব্দুল ওজার পরিবারের সাথে তাঁর শীতল সম্পর্ক বিরাজ করছিল। ৬১৩ খ্রিস্টাব্দের দিকে একদিন হজরত মুহাম্মদ সাফা পাহাড়ে আরোহণ করে কুরাইশ গোত্রের উদ্দেশ্যে ডাক দিলেন। সে-সময় এভাবে পাহাড়ের উপরে উঠে ডাক দেয়া হত কোনো বিশেষ বিপদের আশংকা হলে। সবাই কাজকর্ম ফেলে সেখানে ছুটে এলে মুহাম্মদ তাদেরকে ইসলামের দাওয়াত দেন। এতে অনেকেই বিরক্ত হন। আব্দুল ওজাও বিরক্ত হয়ে বলেছিলেন : ‘ধ্বংস হও মুহাম্মদ! … তৎক্ষণাৎ ক্ষিপ্ত হয়ে মুহাম্মদও বলেছিলেন, ‘তুমিও ধ্বংস হও, অনির্বাণ শিখায় জ্বলতে থাকো। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে নবি ওহি পেলেন ‘সুরা লাহাব আর চাচা আব্দুল ওজা হয়ে গেলেন আবু লাহাব মানে ‘অগ্নিশিখার পিতা – অনুবাদক) নিজেকে নিয়ে গর্ব করার জন্য আবুল আসাদকে তিরস্কার করা হয় সুরা বালাদে। সুরা হুমাজায় (১০৪) ওয়ালিদ বিন আল-মুগিরা এবং উমাইয়া বিন খালাদের প্রতি একই ধরনের হুমকি দেয়া হয়েছে যারা নবি মুহামদকে নিয়ে নিন্দা এবং নিজেদের সম্পদ নিয়ে গর্ব করত। সুরা কাউসারে আলাস বিন ওয়ায়েলকে কঠোর ভাষায় তিরস্কার করা হয়েছে মুহাম্মদকে লেজকাটা (উত্তরাধিকারহীন) বলে উপহাস করার জন্য। বদরের যুদ্ধের পর কাব বিন আল-আশরাফ নামের জনৈক ইহুদি কবি মক্কায় গিয়ে এ যুদ্ধে হেরে যাওয়া পৌত্তলিকদের প্রতি সমবেদনা জানালে এবং তাদেরকে মুহাম্মদের উপর মর্যাদা দান করলে মহাবিশ্বের পরম স্রষ্টা ক্রুদ্ধ হয়ে কোরানের আয়াত নাজিল করলেন : সুরা নিসা : ৫১-৫৭। সুরা হাশরে আল্লাহ বানু নাজির নামের ইহুদি গোত্র নির্মুল করাকে আনন্দের সাথে সমর্থন করেন। আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস একসময় সুরাটির নাম দিয়েছিলেন সুরা বানু নাজির।

কোরানে আল্লাহ শুধু মুহাম্মদের উদ্দেশ্য-বাস্তবায়নে বাধাদানকারীদের তিরস্কার করেছেন এমন নয়, তিনি বিভিন্ন নারীর সাথে মুহাম্মদের সমস্যায় জড়ানোর বিষয়েও মধ্যস্থতা করেছেন। সূরা আহজাবের ৩৭ নম্বর আয়াতে আল্লাহ মুহামদকে তাঁর পালকপুত্রের স্ত্রীর সাথে বিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করেন। একই সুরার ২৮-২৯ নম্বর আয়াতে বানু-কুরাইজা গোত্রকে হত্যা করে নবির বাহিনী যেসব মাল দখলে নিয়েছিলেন তা থেকে অতিরিক্ত পরিমাণে দাবি করলে নবির স্ত্রীদের তালাকের হুমকি দিয়ে সতর্ক করে দেয়া হয়। হাফসা যখন নবির সাথে মরিয়মের সম্পর্ক নিয়ে অভিযোগ আনেন তখন সুরা তাহরিমের বিভিন্ন আয়াত নাজিল হয়েছে, বিষয়টি পূর্ববর্তী অধ্যায়ে আলোচনা করা হয়েছে। হাফসা ও আয়েশার পারস্পরিক মনোমালিন্য আল্লাহকে প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ করে তোলে, তিনি তাদেরকে সতর্ক করে দেন যেন তাঁরা নবিকে জ্বালাতন বন্ধ করেন ও অনুতপ্ত হন অন্যথায় আল্লাহ, জিবরাইল ও সৎ ঈমানদাররা নবিকে সমর্থন করবে এবং নবি যদি তাঁদেরকে তালাক প্রদান করেন তবে আল্লাহ তাঁদের পরিবর্তে আরও উত্তম স্ত্রী প্রদান করবেন যারা হবেন অনুগত, ইবাদতকারী, রোজা পালনকারী, কতক বিধবা এবং কতক কুমারী (সুরা তাহরিম ; আয়াত ৫)। কোরানের একজন ব্যাখ্যাকারক এই আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেছেন, বিধবা মানে ফেরাউনের স্ত্রী আসিয়াআর কুমারীমানে যিশুর মা মরিয়ম এবং তাঁদের সাথে জান্নাতে নবি মুহাম্মদের বিবাহ সম্পন্ন হবে। অবশ্য কোরানে এই সুরার শেষ আয়াতদ্বয়ে আসিয়া ও মরিয়মের কথা উল্লেখ থাকলেও সরাসরি এ বিষয়ে কিছু বলা হয়নি।

সুরা নূর-এ আয়েশার প্রতি মিথ্যা অপবাদ ও সতী নারীর প্রতি এ ধরনের মিথ্যা অপবাদদানকারীদের প্রতি শাস্তি বিষয়ে বক্তব্য রয়েছে। আয়েশাকে মিথ্যা অপবাদ দেয়ার অভিযোগে বিশিষ্ট সাহাবি ও ওহি লেখক হাসান বিন সাবিত ও হামনা বিন জাহাশকে শাস্তি প্রদান করা হয় এবং আয়েশাকে নির্দোষ ঘোষণা করা হয়।

হিজরি ১ থেকে ১১ হিজরি (৬২২- ৬৩২ খ্রিস্টাব্দ) পর্যন্ত শুধু অসীম মহাবিশ্ব নয় বরং আরবের হেজাজ ও নেজদ অঞ্চল ছাড়া প্রায় সমগ্র বিশ্বকেই ভুলে যাওয়া বা অবজ্ঞা করা হয়েছিল। ঐসব অঞ্চলের লোকেরা আল্লাহকে ভুলে গিয়েছিল এবং ধর্মীয় যুদ্ধে অংশগ্রহণে অনীহা বা শৈথিল্য প্রদর্শন করেছিল। তাদেরকে শাস্তি দেয়ার জন্য দোজখের লেলিহান শিখা দাউ দাউ করে জ্বলছিল আর যারা ভয় ও যুদ্ধলব্ধ গণিমতের মালের প্রতি দৃঢ়তা ও সাহস প্রদর্শন করেছিল তাদের জন্য বেহেশতের তলদেশে নহর প্রস্তুত হচ্ছিল।

নবিকে যখন উপহাস করা হয়েছিল তখন তাঁকে কোরানের আয়াত নাজিল করে সান্তুনা দেয়া হল : “যারা বিদ্রুপ করে তাদের বিরুদ্ধে তোমার জন্য আমিই যথেষ্ট। (সুরা হিজর :৯৫)। সুরা আনফালের পুরোটা জুড়ে দ্বিতীয় হিজরিতে (৬২৪ খ্রিস্টাব্দ) সংঘটিত বদরের যুদ্ধে মহান সৃষ্টিকর্তার গুরুত্বপূর্ণ ও ফলপ্রসু ভূমিকার কথা উল্লেখ রয়েছে। কুরাইশ নেতা আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে দামেস্ক থেকে মক্কার দিকে একটি মালবাহী বাণিজ্যিক কাফেলা যাচ্ছিল। নবি এ খবর জানতে পেরে একদল সাহাবি নিয়ে ওই কাফেলাকে আক্রমণ করতে মদিনায় অপেক্ষা করতে লাগলেন। আবু সুফিয়ান গুপ্তচর মারফত বিষয়টি জানতে পেরে মক্কায় সাহায্যের জন্য খবর পাঠান, তখন আবু জেহেলের বাহিনী মক্কা থেকে কাফেলাকে রক্ষা করতে চলে এল। আবু সুফিয়ান সংঘর্ষ এড়িয়ে সর্তকতার সাথে নিরাপদে কাফেলা নিয়ে মক্কায় চলে যান। নবির বাহিনীর কিছু লোক যারা আবু সুফিয়ানের কাফেলাকে কজা করতে না পেরে হতাশ হয় এবং বদরের মাঠে একটি অনাকাঙ্ক্ষিত যুদ্ধের সমূখীন হয় আৰু জেহেলের বাহিনীর সাথে। যুদ্ধে আৰু জেহেলকে পরাস্ত করে যুদ্ধলব্ধ সম্পদের মালিকানা তারা দাবি করেন। আল্লাহ তাৎক্ষণিকভাবে তাদেরকে সতর্ক করে দেন সুরা আনফালের প্রথম দিকের আয়াতগুলো নাজিল করে। নবম আয়াতে আল্লাহ এই যুদ্ধে এক সহস্র ফেরেশতা দিয়ে সহায়তা করার কথা বলেছেন। দ্বাদশ আয়াতে অবিশ্বাসীদের ঘাড়ে এবং সারা অঙ্গে আঘাত করে হত্যা করতে নির্দেশ দিয়েছেন এবং সপ্তদশ আয়াতে বলছেন : ‘তোমরা তাদেরকে হত্যা করনি, আল্লাহ তাদেরকে হত্যা করেছিলেন, আর তুমি যখন কাঁকর ছুড়েছিলে তখন তুমি ছোড়নি আল্লাহই তা ছুড়েছিলেন। তা ছিল বিশ্বাসীদেরকে ভালো পুরস্কার দেওয়ার জন্য। এ-বক্তব্য দ্বারা বুঝানো হচ্ছে যখন মুহাম্মদ আবু

জেহেলের বাহিনীর দিকে কাঁকর নিক্ষেপ করেছিলেন সেটা আসলে আল্লাহই করেছেন এবং এর মাধ্যমে আবু জেহেলের দল পরাজিত হয়।

যুদ্ধ শেষে প্রথমে যুদ্ধলব্ধ সম্পদের বণ্টন নিয়ে সমস্যা তৈরি হয়। সমস্যা সমাধানে আল্লাহ এই সম্পদের পাঁচ ভাগের এক ভাগ নিজের জন্য এবং রসুলের জন্য বরাদ্দ করেন। তোমাদের গনিমায় এক পঞ্চমাংশ আল্লাহর, রসুলের, পিতৃহীন দরিদ্র ও পথচারীদের জন্য। (৮:৪১)। সৃষ্টিকর্তা যেহেতু গনিমার ভাগ নিতে কখনো আসবেন না, তাই এই অংশটুকু রসুলের ভাগেই থাকবে। এবার আরেকটি সমস্যা তৈরি হল যুদ্ধবন্দীদের নিয়ে। হজরত ওমরের পছন্দ মত একটা আয়াত নাজিল হল : দেশে সম্পূর্ণভাবে শক্রনিপাত না করা পর্যন্ত বন্দী রাখা কোনো নবির পক্ষে সমীচীন নয়।’(৮:৬৭)। একটু পরেই এই সিদ্ধান্ত বদল করে হজরত আবু বকরের পছন্দ মত যুদ্ধবন্দীদের কাছ থেকে মুক্তিপণ আদায়ের মাধ্যমে মুক্তি ব্যবস্থা করে আরেকটি আয়াত নাজিল কাছ থেকে যা নেওয়া হয়েছে তার চেয়ে ভালো কিছু তিনি তোমাদেরকে দেবেন ও তোমাদেরকে ক্ষমা করবেন। আল্লাহ ক্ষমাশীল পরম দয়ালু। (৮:৭০)। উল্লেখ্য বদর যুদ্ধে নবি মুহাম্মদের চাচা আব্দুল বিন আব্বাসও যুদ্ধবন্দী হয়েছিলেন। প্রথম দিকে হজরত ওমরের সিদ্ধান্তানুযায়ী যুদ্ধবন্দীদেরকে মেরে ফেলতে চাইলেও পরে হজরত আবু বকরের পরামর্শানুযায়ী যুদ্ধবন্দীদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ মুক্তিপণ আদায় করে ছেড়ে দেয়া হয়।

সুরা আনফালের সম্পূর্ণটা পৌত্তলিকদের সাথে যুদ্ধ-বিবাদ নিয়ে রচিত হয়েছে। গাতাফান গোত্র কুরাইশদের সাথে মিলিত হয়ে একসাথে মদিনা আক্রমণ করে বসে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আল্লাহ কিভাবে হস্তক্ষেপ করেছিলেন তার বিবরণ রয়েছে সূরা আহজাবের নবম আয়াতে : হে বিশ্বাসিগণ! তোমাদের ওপর আল্লাহর অনুগ্রহের কথা তোমরা সারণ করো, যখন শক্রবাহিনী তোমাদেরকে আক্রমণ করেছিল ও আমি তাদের বিরুদ্ধে এক ঘূর্ণিঝড় ও অদৃশ্য বাহিনী পাঠিয়েছিলাম। তোমরা যা কর আল্লাহ তা দেখেন। (সুরা আহজাব ; আয়াত ৯)। দশম থেকে ত্রয়োদশ আয়াত পর্যন্ত বর্ণিত হয়েছে আল্লাহ কিভাবে এ-যুদ্ধে মুসলমানদের বিরাট সাহায্য করেছিলেন।

ক্যামব্রিজ তফসির’- এ ঘটনাটির বিবরণ এভাবে দেয়া হয়েছে: ‘মহান আল্লাহতায়ালা প্রচণ্ড ঝড় পাঠিয়ে শক্রদলের তাবুগুলোকে উল্টে দিলেন, তাদের আগুনকে নিভিয়ে দিলেন এবং তাদের ঘোড়ার আস্তাবল ধ্বংস করেছিলেন। ফেরেশতারা তখন চিৎকার করে বললেন, আল্লাহ মহান! ইসলামের ইতিহাসে এই যুদ্ধ খন্দক বা পরিখার যুদ্ধ নামে খ্যাত। মক্কা থেকে বিশাল সেনাবাহিনী মদিনা আক্রমণ করতে গেলে পারস্যের নাগরিক সালমান আল-ফার্সির পরামর্শে চারদিকে পরিখা খনন করা হয়। আক্রমণকারী মক্কাবাসীরা পরিখা ডিঙিয়ে আর অগ্রসর হতে না পেরে পরিখার পাশে তাবু ফেলে অপেক্ষা করতে থাকেন। মাসখানেক মদিনা অবরুদ্ধ করে রাখার পর তারা এক মরুঝড়ের কবলে পড়েন।-অনুবাদক ।

কোরানের গভীর বিশ্বাসী তফসিরকারক কখনো প্রশ্ন উত্থাপন করেন না, আল্লাহ ওই ঝড় এক মাস পর না পাঠিয়ে আগে কেন পাঠালেন না? আল্লাহ যদি তা করতেন তবে মদিনার মুসলমানদের সে-সময় পরিখা খননের মত দুঃসাধ্য কাজ করতে হত না এবং দীর্ঘদিন শক্রদ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে গভীর দুশ্চিন্তায় থাকতে হত না। কোনো ভাষ্যকারই প্রশ্ন তোলেননি, ওহুদের যুদ্ধে মুসলমানরা কেন শোচনীয়ভাবে পরাজিত হলেন যেখানে নবির ছোট চাচা হামজা বিন আব্দুল মোতালেবসহ সত্তরজন সাহাবি মৃত্যুবরণ করেন। কেন আল্লাহ তাঁদের সাহায্যার্থে ফেরেশতা পাঠালেন না যেমন পাঠিয়েছিলেন খন্দকের যুদ্ধে? কয়েকজন ফেরেশতা বা গায়েবি কোনো মরুঝড় যদি ওহুদের যুদ্ধে সাহায্য করত তবে নবি পরাজয়ের গ্রানি থেকে মুক্তি পেতেন, পাথরের আঘাত থেকে রক্ষা পেতেন এবং এমন পরিস্থিতিতে পড়তেন না যেখানে হজরত আলি নিজের জীবন বিপন্ন করে তাঁকে একদম শহিদ হয়ে যাওয়া থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন।

কোরানের একাধিক আয়াতে হেজাজের সমসাময়িক সামাজিক অবস্থার বিবরণ পাওয়া যায়। এসব আয়াতে ধর্মীয় আদেশনিষেধের সাথে তৎকালীন বিভিন্ন ঘটনা ও সংঘাতের কথা উল্লেখ রয়েছে। বিভিন্ন বিতর্ক, রটনাকারীদের কুৎসার জবাব, ব্যক্তিগত ঝগড়ায় মধ্যস্থতা, যুদ্ধের জন্য সনির্বন্ধ আহ্বান, মুনাফেকদের নিন্দা, যুদ্ধলব্ধ মাল, নারীর প্রতি নির্দেশ এবং বিরোধীপক্ষ ও অবিশ্বাসীদের মৃত্যুর পর দোজখের আগুনের হুমকি দিয়ে কোরানে শতাধিক আয়াত রয়েছে। নগরের বাসিন্দারা যদি পাপকাজে লিপ্ত থাকে তবে স্রষ্টার ক্রোধে গোটা নগর ধ্বংস হয়ে যেতে পারে, পূর্বে এরকম গজব নাজিল হয়েছিল পুণ্যবানপাপী সবার ওপরে।

কোরানে স্রষ্টার মানবসুলভ গুণাবলী আছে। তিনি খুশি হোন, তিনি ক্রোধান্বিত হোন। তাঁর পছন্দ-অপছন্দ রয়েছে ও তাঁকে সন্তুষ্ট করা সম্ভব। এককথায় মানুষের সব ধরনের মানবীয় গুণাবলী ও স্বভাব স্রষ্টার রয়েছে, যেমন ভালবাসা, রাগ করা, প্রতিহিংসাপরায়ণতা, ষড়যন্ত্র, ছলনা ইত্যাদি। আমরা যদি ধরে নেই বিশাল এই মহাবিশ্বের একজন স্রষ্টা রয়েছেন তবে যৌক্তিকভাবে ধরে নিতে হবে সেই স্রষ্টা আমাদের মতো নগণ্য মানুষের মানবিক বৈশিষ্ট্য ও দুর্বলতা থেকে তিনি মুক্ত। সুতরাং আমরা কোরানের স্রষ্টার বৈশিষ্ট্যাবলী হজরত মুহাম্মদের নিজস্ব চিন্তা প্রসূত বলে ধরে নিতে বাধ্য। আর হজরত মুহাম্মদ নিজেই বলেছেন তিনিও একজন মানুষ মাত্র। আমরা জানি তিনি অন্যান্য মানুষের মত মনে কষ্ট পেতেন, ছেলে হারানোর ব্যথায় কাতর হয়েছেন, ওহুদের যুদ্ধে তাঁর চাচা হামজার বিকৃত লাশ দেখে শোকাতুর হয়ে প্রতিশোধের শপথ নিয়েছেন।

পূর্বে উল্লেখিত বিষয়গুলো পর্যবেক্ষণ করলে প্রশ্ন আসে, কোরানে হজরত মুহাম্মদ ও আল্লাহকে কি আদৌ আলাদা করা সম্ভব নাকি দুজন আসলে এক সত্তা? কোরানের প্রচুর সুরা-আয়াত পর্যালোচনা করলে ঘুরে-ফিরে এই প্রশ্ন সামনে চলে আসে। বিষয়টি পরিষ্কার করার জন্য আরও কয়েকটি প্রসঙ্গ আলোচনা করা দরকার। সকল মুসলমান বিশ্বাস করেন কোরান আল্লাহর বাণী।এই বিশ্বাস কোরানেরই কিছু আয়াতের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠেছে, যেমন: ‘কোরান ওহি, যা প্রত্যাদেশ হয়। (সুরা নজম : আয়াত ৪-৫)। আমি কোরান অবতীর্ণ করেছি কদরের রাত্রে। (সুরা কাদর ; আয়াত ১)। কোরান মুসলমানদের বিশ্বাসের একমাত্র দলিল, যা অবিসংবাদিত, রাজকীয় ও পরম পবিত্র বলে বিবেচিত হয়।

শুরু থেকে কোরানকে এত বেশি মর্যাদাশীল বলে ভাবা শুরু হয় যে (কোরান রচিত হওয়ার) মাত্র একশ’বছরের মধ্যে মুসলিম পণ্ডিতদের কাছে জিজ্ঞাসার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়, কোরান সৃষ্ট নাকি তা আল্লাহর মতই অসৃষ্ট মানে তা কখনো অস্তিত্বহীন ছিল না। এই বিতর্ক চলে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে। কিন্তু কোরান অসৃষ্ট হওয়ার বিষয়টি ইসলামি ধর্মতত্ত্বের মৌলিক নীতিমালার সাথে সাং |

তথাপি আব্বাসীয় খলিফা মুতাসিমের (৮৩৩-৮৪২ খ্রিস্টাব্দ) শাসনামলে সুন্নি ইমাম আহমদ বিন হানবল কোরানের অসৃষ্ট হওয়ার মতবাদকে পরিত্যাগ করা দূরের কথা এ ব্যাপারে তাঁর বিশ্বাস এতই প্রবল ছিল যে তিনি বরং অজ্ঞান হওয়ার আগ পর্যন্ত এজন্য চাবুকের আঘাত সহ্য করে নেন। অর্থাৎ তিনি আবু লাহাবের দুই হাত ধ্বংস হোকআয়াতখানিও আল্লাহর মতই চিরন্তন বলে মনে করতেন। কোরান অসৃষ্ট বিষয়টি ইমাম আহমদ বিন হানবলের মতো ব্যক্তিদের গভীর বিশ্বাসের মূলে রয়েছে কোরানের একাধিক আয়াত। যেমন সুরা বুরুজে বলা হয়েছে : বস্তুত এ হচ্ছে সমানিত কোরান, যা রয়েছে লওহে মাহফুজে (সংরক্ষিত ফলকে)। (৮৫:২১-২২)। লাওহে মাহফুজে সংরক্ষিত কোরান লিখেছিলেন পবিত্র-সম্মানিত ফেরেশতারা। (দেখুন : ৮০ সুরা আবাসা : আয়াত ১৩-১৬) -অনুবাদক

বিশ্বাসের মোহে আবদ্ধ থাকলে কাউকে যুক্তি-প্রমাণ দিয়ে লাভ হয় না। বিষয়টি তাদের জন্যও সত্য, যারা কোরান পড়েছেন। কোরানের প্রথম সূরা ফাতিহা একটি গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ হতে পারে। এই সুরায় সাতটি” আয়াত রয়েছে এবং একে ‘সাত পুনরাবৃত্তি(৮০) বলে। এই সুরার বিশেষ মর্যাদার জন্য একে কোরানের সর্বপ্রথমে স্থান দেয়া হয়েছে। সুরাটির অনুবাদ নিচে দেয়া হল :

‘পরম করুণাময় পরম দয়াময় আল্লাহর নামে
সমস্ত প্রশংসা বিশ্বজগতের প্রতিপালক আল্লাহরই
বিচারদিনের মালিক।
আমরা একমাত্র তোমারই উপাসনা করি তোমারই সাহায্য প্রার্থনা করি
তুমি আমাদেরকে চালিত করে সঠিক পথে
তাদের পথে যাদেরকে তুমি অনুগ্রহ দান করেছ
যারা (তোমার) রোমে পতিত হয়নি, পথভ্রষ্টও হয়নি।’

এই বাক্যগুলো আল্লাহর হতে পারে না। এর বিষয়বস্তু থেকে এটা পরিষ্কার যে, এটি নবির (বা অন্য কোনো ব্যক্তির) রচিত কথামালা, কারণ এখানে আল্লাহর প্রশংসা রয়েছে, আল্লাহর প্রতি প্রণতি ও মিনতি রয়েছে। স্রষ্টা কখনো নিজের প্রতি বলবেন না-আমরা একমাত্র তোমারই উপাসনা করি, তোমারই সাহায্য প্রার্থনা করি। বাক্যের এই বিড়ম্বনা এড়ানো যেত যদি সূরাটির আগে বল (আরবিতে কুল) বা এই বলে প্রার্থনা কর” কথাটি সংযুক্ত থাকত; যেমন রয়েছে সুরা ইখলাস-এর প্রথম আয়াতে (বলো, তিনি আল্লাহ (যিনি) অদ্বিতীয়), সুরা কাফিরুন (বলো, “হে অবিশ্বাসীরা) কিংবা সুরা কাহাফ-এ রয়েছে, বলো, আমি তোমাদের মতোই একজন মানুষ; আমার ওপর প্রত্যাদেশ হয় যে আল্লাহই তোমাদের একমাত্র উপাস্য। ( ১৮:১১০)। এটি যৌক্তিকভাবে অসম্ভব যে, এই বিশ্বচরাচরের স্রষ্টা মহান আল্লাহতায়ালা কখনো বলবেন, আমরা একমাত্র তোমারই উপাসনা করি, তোমারই সাহায্য প্রার্থনা করি। যেহেতু সুরা ফাতিহা কেবলমাত্র আল্লাহর প্রশংসা ও তাঁর প্রতি মিনতি ছাড়া কিছুই নয় তাই ধারণা করা যুক্তিযুক্ত যে এই সুরা আল্লাহর বাণী নয় বরং নবি বা অন্য কারো রচিত প্রার্থনা। বিখ্যাত সাহাবি, কোরানের হাফেজ, হাদিস-বক্তা ও কোরানের অনুলেখক আব্দুল্লাহ বিন মাসুদ সুরা ফাতিহার এই আয়াতকে তাঁর অনুমোদিত কোরানে অন্তর্ভুক্ত করেননি এবং সুরা ফালাক ও সুরা নাসকেও তালিকা থেকে বাদ দিয়েছেন।

সুরা লাহাবকেও এর উদ্যত ভঙ্গির জন্য মহাবিশ্বের মহান প্রতিপালকের বাণী বলে ধরে নেয়া যায় না (যা লাওহে মাহফুজে হজরত মুহাম্মদের জন্মের অনেক আগে অনাদিকাল থেকেই সংরক্ষিত ছিল), যার দ্বারা নবির চাচা আব্দুল ওজাকে জবাব দেয়া হয়েছে। মহাবিশ্বের মহান প্রতিপালকের জন্য শোভনীয় হতে পারে না একজন অজ্ঞ আরব ও তাঁর স্ত্রীকে হিংসামূলক অভিশাপ বর্ষণ করা।

কোরানের কিছু আয়াতের বক্তা আল্লাহ আবার কিছু আয়াতে বক্তা মুহাম্মদ বলে প্রতীয়মান হয়। সুরা নজমের প্রথমে আল্লাহ বলেছেন, তিনি মুহাম্মদের নবুওতিকে অনুমোদন করেছেন : তোমাদের সঙ্গী বিভ্রান্ত নয়, পথভ্রষ্টও নয়। আর সে নিজের ইচ্ছামতো কোনো কথা বলে না। কোরান ওহি, যা তাঁর ওপর অবতীর্ণ হয়। (৫৩:২-৫)। একই সুরার পরের আয়াতগুলো (২১২৮) থেকে মনে হয়, এখানে বক্তা নবি মুহাম্মদ নিজে। যেমন নবি এখানে পৌত্তলিকদের লাত, মানাত ও ওজ্জাকে আল্লাহর কন্যা হিসেবে বিশ্বাস করার নিন্দা করছেন ; তোমরা কি ভেবে দেখেছ লাত ও ওজা সম্বন্ধে, আর তৃতীয়টি মানাত সম্বন্ধে? তোমরা কি মনে কর তোমাদের জন্য পুত্রসন্তান আর আল্লাহর জন্য কন্যাসন্তান? এরকম ভাগ তো অন্যায়। (৫৩:১৯-২২)। এটি আল্লাহর বাণী বলে মনে হয় না, কারণ আল্লাহ নিজেকে প্রশ্ন করতে পারেন না তাঁর কন্যা সন্তান আছে কিনা সে ব্যাপারে। প্রায় চৌদশত বছর আগে আরবের হেজাজ অঞ্চলের সমাজে অনেক কুসংস্কার-কুপ্রথা প্রচলিত ছিল। তাঁরা পুত্রসন্তানের জন্য গর্ববোধ করতো আবার কন্যা সন্তানের জন্য বিব্রতবোধ করতো। কন্যা সন্তান সে-সময়কার সমাজে অনাকাঙ্ক্ষিত ছিল যা কোরানের কিছু আয়াতেও বিবৃত হয়েছে। যেমন সুরা বনি-ইসরাইলে রয়েছে ; তোমাদের প্রতিপালক কি তোমাদের জন্য পুত্রসন্তান ঠিক করেছেন আর তিনি নিজে ফেরেশতাদেরকে কন্যা হিসেবে গ্রহণ করেছেন?’(১৭:৪০)। এই ধরনের প্রশ্ন কেবল নবি মুহাম্মদ দ্বারা উত্থাপিত হতে পারে। কারণ তা আল্লাহর বাণী হলে এরূপ হতে পারতো ; আমি কি তোমাদের জন্য পুত্রসন্তান নির্ধারিত করেছি এবং নিজের জন্য ফেরেশতাদেরকে কন্যারূপে গ্রহণ করেছি? তদুপরি মহাবিশ্বের স্রষ্টা-প্রতিপালকের কাছে লিঙ্গভেদ কোনো গুরুতর বিষয় হতে পারে না, বিধায় তাঁর পক্ষে এরকম আয়াত রচনাও সম্ভব নয়।

কন্যাশিশুর প্রতি কুসংস্কার এখনো বিশ্বব্যাপী বিদ্যমান, এমনকি অনেক সভ্য দেশেও তা বিদ্যমান। প্রাচীন আরবরা পুত্র সন্তান নিয়ে গর্ব করত আবার কেউ কেউ এমন বর্বর ছিল যে কন্যাশিশুকে হত্যা করে ফেলত। এই একবিংশ শতাব্দীতেও ভারতীয় উপমহাদেশের অনেক স্থানে কন্যাশিশু হত্যা বা কন্যাভ্রুণ নষ্ট করে ফেলার প্রবণতা দেখা যায়।-অনুবাদক। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হল প্রাচীন আরবরা আবার ফেরেশতাদের স্ত্রীলিঙ্গ বিশিষ্ট বলে মনে করত। নবি মুহাম্মদ তৎকালীন আরবদের মত পুত্রসন্তান লাভের আশা করতেন। যখন তিনি কোনো নারীকে বিয়ে করেছেন তখন তাঁর গর্ভ থেকে পুত্র সন্তান ভীষণভাবে প্রত্যাশা করতেন। নবির সন্তান কাশেম মারা যাওয়ায় তিনি প্রচণ্ড কষ্ট পেয়েছিলেন, যখন আলাস বিন ওয়ায়েল তাঁকে “লেজকাটা (উত্তরাধিকারহীন) বলে ব্যঙ্গ করতো তখন তিনি বেশ দুঃখ পেতেন (নবিকে তখন সান্তনা দেয়ার জন্য সুরা কাউসার নাজিল হয়)। পরবর্তীতে নবি বেশ আনন্দিত হয়েছিলেন যখন উপপত্নী মরিয়মের (মারিয়া দ্যা কপ্ট) গর্ভে ইব্রাহিম নামের পুত্র সন্তানের জন্ম হয়। কিন্তু মাত্র নয় মাসের মাথায় শিশুটি মারা গেলে বংশের প্রদীপ রক্ষার চিন্তায় ভীষণভাবে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়েছিলেন তিনি। তাই নবি পৌত্তলিকদের জিজ্ঞেস করেছিলেন, “আল্লাহ কি তোমাদের পুত্রসন্তান দিয়ে অনুগ্রহ করেন?”

কোরানে এরকম অসংখ্য আয়াত রয়েছে যেখানে আল্লাহ ও মুহাম্মদের মধ্যে কে আসল বক্তা তা নিয়ে বিভ্রম সৃষ্টি হয়। সুরা বনিইসরাইলের প্রথম আয়াত, যেখানে নবির রাত্রিকালীন ভ্রমণের (মেরাজ) কথা উল্লেখ রয়েছে ; পরম পবিত্র ও মহিমাময় তিনি, যিনি তাঁর দাসকে রাত্রে সফর করিয়েছিলেন তাঁর নির্দশন দেখাবার জন্য মসজিদ-উল-হারাম থেকে মসজিদ-উল-আকসায়-যার চারদিকে আমি পর্যাপ্ত বরকত দান করেছি। তিনি তো সব শোনেন, সব দেখেন।’ (১৭:১)। পরম পবিত্র ও মহিমাময় তিনি, যিনি তাঁর দাসকে রাত্রে সফর করিয়েছিলেন মক্কা থেকে ফিলিস্তিন পর্যন্ত – এধরনের বক্তব্য আল্লাহর উচ্চারিত বাণী হতে পারে না কারণ আল্লাহ নিজেই নিজেকে ধন্যবাদ দিতে পারেন না, এটি মনুষ্যসুলভ বাতুলতা। এটা আল্লাহর প্রতি মুহাম্মদের পক্ষ থেকে প্রশংসাজ্ঞাপন মাত্র। এই আয়াতের পরের অংশ যেখানে দূরবর্তী মসজিদের কথা বলা হয়েছে, যার চারদিকে আমি পর্যাপ্ত বরকত দান করেছি’- এর বক্তা আল্লাহর নিজের বলে মনে হয়, তবে শেষের অংশ তিনি তো সব শোনেন, সব দেখেন-নবি মুহাম্মদের উক্তি বলেই মনে হয়।

এভাবে একই আয়াতে বারেবারে বক্তা পরিবর্তিত হওয়ার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ হচ্ছে সূরা ফাতহ। আল্লাহ তোমার জন্য সুস্পষ্ট বিজয় অবধারিত করেছেন। যাতে আল্লাহ আপনার অতীত ও ভবিষ্যতের ক্রটিগুলো মাফ করবেন…। (৪৮:১-২)। এই আয়াতদ্বয় আল্লাহর বাণী হলে এ-রকম হতে পারতো ; আমি আপনার জন্য সুস্পষ্ট বিজয় অবধারিত করেছি। যাতে আমি আপনার অতীত ও ভবিষ্যতের ক্রটিগুলো মাফ করবো। যদিও এই ধরনের ভাষাগত গোলযোগের কারণ আমরা সহজে ব্যাখ্যা করতে পারি। শুধু এই আয়াতদ্বয় নয়, আরও অনেক আয়াত আছে যা একই ধরনের জটিলতার সৃষ্টি করে। এরকম একটি আয়াত হচ্ছে সুরা আহজাবের ২১ নম্বর আয়াত : তোমাদের মধ্যে যারা আল্লাহ ও পরকালকে ভয় করে এবং আল্লাহকে বেশি করে সারণ করে তাদের জন্য আল্লাহর রসুলের মধ্যে এক উত্তম আদর্শ রয়েছে। সহজেই বলা যায়, এখানে বক্তা আল্লাহ হলে অবশ্যই বাক্যটি এরকম হতো : তোমাদের মধ্যে যারা আমাকে ও পরকালকে বেশি ভয় করে এবং আমাকে বেশি করে সারণ করে তাদের জন্য আমার রসুলের মধ্যে এক উত্তম আদর্শ রয়েছে। সুরা আহজাবের পরের দুটি আয়াতে (২২-২৩) মদিনার মুসলমানদের খন্দকের যুদ্ধে অবিচলতার জন্য। পরের আয়াতে বলা হয়েছে : ‘আল্লাহ তো সত্যবাদিতার জন্য পুরস্কার দেন, আর তাঁর ইচ্ছা হলে তিনি মুনাফিকদের শাস্তি দেন বা ক্ষমা করেন। আল্লাহ তো ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। (৩৩:২৪)। এই আয়াত পরিষ্কারভাবে আল্লাহর বাণী বলে প্রতীয়মান হয় না, বরং বক্তা স্বয়ং নবি মুহাম্মদ। কেননা আল্লাহ বক্তা হলে তা হতো : আমি তো সত্যবাদিতার জন্য পুরস্কার দেই…”।

অষ্টম হিজরিতে (৬৩০ খ্রিস্টাব্দে) যখন রোমানদের বিরুদ্ধে নবির অভিযানের প্রস্তুতিকালে মদিনার একটি গোত্রের প্রধান জাদ বিন কায়েস যুদ্ধে যোগ দিতে অপারগতা জানিয়ে বললেন, “আমাকে ক্ষমা করুন ও প্রলোভন থেকে বাঁচান। রোমান নারীদের দেখে আমি হয়তো তাদের প্রলোভন থেকে নিজেকে সংযত রাখতে পারবো না। এর প্রত্যুত্তরে সুরা তওবার এই আয়াত নাজিল হয় ; আর ওদের মধ্যে এমন লোক আছে যে বলে আমাকে অব্যাহতি দাও আর আমাকে বিশৃঙ্খলায় ফেলো না। সাবধান! ওরাই বিশৃঙ্খলায় পড়ে আছে। আর জাহান্নাম তো অবিশ্বাসীদের ঘিরে রাখবে।’(৯:৪৯)। স্বাভাবিকভাবে এটি নবি মুহাম্মদের বাণী, আল্লাহর বাণী নয়। কারণ নারীলোভী জাদ বিন কায়েস যুদ্ধ থেকে দূরে থাকার জন্য নবি মুহাম্মদের কাছে অব্যাহতি চেয়েছেন, আল্লাহর কাছে নয়। আল্লাহ তাঁর রসুলকে সমর্থন করে ওজর-উত্থাপনকারীদের জন্য দোজখ তৈরি করতে পারেন কিন্তু এ-ধরনের বিষয়ে তিনি এভাবে হস্তক্ষেপ করতে পারেন না।

কোরানে বক্তা হিসেবে আল্লাহ ও নবির মধ্যকার বিভ্রান্তিকে ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করার অবকাশ নেই। মাঝে মাঝে আল্লাহ নবিকে আদেশ দিয়ে বলছেন-বিলো। মাঝে মাঝে কিছু আয়াত পাওয়া যাচ্ছে যেখানে মুহাম্মদ বক্তা হয়ে আল্লাহর প্রশংসা করছেন। কোরানের এই আয়াতগুলি থেকে আভাস পাওয়া যায় নবি মুহাম্মদের অবচেতন মন হয়তো আরবদের নিয়ন্ত্রণ করার জন্য, সুনির্দিষ্ট সামাজিক-রাজনৈতিক কাঠামোর মধ্যে নিয়ে আসার জন্য, বিভিন্ন মানবিক ক্রটি-বিচূতি থেকে নিজেকে রক্ষার জন্য এবং উদ্ভূত বিভিন্ন সমস্যা থেকে উদ্ধার পাওয়ার জন্য ক্রমাগত প্রণোদনা দিত।

কোরানে আল্লাহর ওপর ছলনা বা ষড়যন্ত্রের মতো বৈশিষ্ট্য আরোপিত হওয়ার ভিন্ন কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না। সুরা কলমে রয়েছে : “যারা এই বাণী প্রত্যাখান করে তাদেরকে আমার হাতে ছেড়ে দাও, আমি ধীরে ধীরে ওদেরকে কোনদিকে নিয়ে যাব ওরা তা জানে না। আমি ওদেরকে সময় দিয়ে থাকি। আমার কৌশল অত্যন্ত শক্ত। (৬৮৪৪-৪৫)। সুরা আরাফ-এ রয়েছে : ‘যারা আমার নির্দশনাবলিকে মিথ্যা বলে আমি তাদেরকে ক্রমে ক্রমে এমনভাবে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাই যে, তারা জানতেও পারে না। আমি তাদেরকে সময় দিয়ে থাকি। আমার কৌশল বড়ই নিপুণ। (৭:১৮২-১৮৩)। সুরা আনফালে কুরাইশ-প্রধানদের গোপন সভাকে উদ্দেশ্য করে বলা হয়েছে : “সারণ করো, অবিশ্বাসীরা তোমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছিল তোমাকে বন্দী, হত্যা বা নির্বাসিত করার জন্য। তারা যেমন ছলনা করত, তেমনি আল্লাহও ছলনা করতেন। বস্তুত আল্লাহর ছলনা সবচেয়ে উত্তম। (৮৩০)। উল্লেখ্য এই আয়াতে আরবি শব্দ ইয়ামকুরু ব্যবহৃত হয়েছে, অর্থ হচ্ছে- সে ধোঁকা দিচ্ছে, “ষড়যন্ত্র করছে’ ইত্যাদি। শব্দটি আয়াতে দুইবার উল্লেখ রয়েছে। অনেক কোরান-অনুবাদক কাফেরদের ক্ষেত্রে এই শব্দের অর্থ ষড়যন্ত্র/ছলনা হিসেবে ব্যবহার করেছেন কিন্তু আল্লাহর ক্ষেত্রে এর অর্থ করেছেন ‘পরিকল্পনা করা’, ‘কৌশল করা ইত্যাদি।-অনুবাদক)।

ধূর্তামি বা ছলনাকে বীরত্বের বিকল্প হিসাবে ভাবা সম্ভব, যদি প্রতিপক্ষ বেশ শক্তিশালী হয়। কিন্তু সর্বশক্তিমান আল্লাহ যিনি মহাবিশ্বকে হও বললেই হয়ে যায়; যার হুকুমে মহাবিশ্বের সব কিছু ঘটে তাকে কেন ছলনা, ধূর্তমি, ষড়যন্ত্র বা প্রতারণার আশ্রয় নিতে হবে?এ-ধরনের ছলনার একটি ঐতিহাসিক উদাহরণ হচ্ছে যখন হজরত আলি ও হজরত মুয়াবিয়ার মধ্যে খেলাফত সমস্যার সমাধানে কুরাইশ বংশের আমর ইবনে আল-আস চালাকি করে পরাস্ত করেছিলেন আবু মুসা আল-আশারিকে।”

আল্লাহ ও মুহাম্মদের মধ্যে কোরানে কে আসল বক্তা, তা নিয়ে বিভ্রম তৈরি হয় প্রচুর। যেমন সুরা ইউনুসে রয়েছে : তোমার প্রতিপালক ইচ্ছা করলে পৃথিবীতে যারা আছে সকলেই বিশ্বাস করত। তা হলে কি তুমি বিশ্বাসী হওয়ার জন্য মানুষের ওপর জবরদস্তি করবে?’(১০:৯৯)। এই আয়াতটি নবির সাথে আল্লাহর কথোপকথন মনে হলেও পরের আয়াতেই মনে হয়, নবি পৌত্তলিকদের একরোখা মনোভাবের জন্য নিজেকে সান্তনা দিচ্ছেন এই বলে- আল্লাহর অনুমতি ছাড়া বিশ্বাস করা কারও সাধ্য নেই। আর যারা বোঝে না আল্লাহ তাদেরকে কলুষলিপ্ত করবেন। (১০:১০০)। মহাবিশ্বের স্রষ্টা আল্লাহ কখনো এমন মনোভাব পোষণ করবেন না যে, কিছু লোক তাঁকে বিশ্বাস করুক আর কিছু লোক তাঁকে অবিশ্বাস করুক। পরম স্রষ্টা কখনো রাগ করতে পারেন না কারণ রাগ মানবীয় অনুভূতি দুর্বলতার প্রকাশক এবং রাগের কারণ হচ্ছে কোনো কিছু ব্যক্তি-ইচ্ছার বিপরীত ঘটা। অথচ আল্লাহর জন্য অপছন্দনীয় কিছু হওয়া বা ঘটা সম্ভব নয়। সুরা আহজাবের ২৪ নম্বর আয়াতটিও আল্লাহর নয়, নবি মুহাম্মদের উক্তি বলেই মনে হয় : আল্লাহ তো সত্যবাদিতার জন্য পুরস্কার দেন, আর তাঁর ইচ্ছা হলে তিনি মুনাফিকদেরকে শাস্তি দেন বা ক্ষমা করেন। আল্লাহ তো ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’

আরবরা অস্থিরমতি এবং প্রায়শ পরিবর্তনশীল স্বভাবের ছিল; এবং যেদিকে সুবিধা বেশি সেদিকে পক্ষ নিত। ইসলামের শুরুর দিকে এজন্য মক্কার কিছু মুসলমান হিজরত করেননি। বদর যুদ্ধে আৰু জেহেলের পক্ষে ও নবি মুহাম্মদের বিপক্ষে অবস্থান নেন। গরিব ও অসহায় হওয়া সত্ত্বেও এদের অস্থিরচিত্ততা আল্লাহকে অসন্তুষ্ট করে তোলে। ফলে সুরা নিসার এই আয়াতগুলি নাজিল হয় : “যারা নিজেদের অনিষ্ট করে তাদের প্রাণ নেওয়ার সময় ফেরেশতারা বলে, “তোমরা কী অবস্থায় ছিলে? তারা (ফেরেশতারা) বলে, তোমরা নিজের দেশ ছেড়ে অন্য দেশে বসবাস তো করতে পারতে, আল্লাহর দুনিয়া কি এমন প্রশস্ত ছিল না? এরাই বাস করবে জাহান্নামে, আর বাসস্থান হিসেবে তা কী জঘন্য! তবে যেসব অসহায় পুরুষ, নারী ও শিশু কোনো উপায় অবলম্বন করতে পারে না ও কোনো পথও পায় না, আল্লাহ হয়তো তাদের পাপ ক্ষমা করবেন, কারণ আল্লাহ পাপমোচনকারী ক্ষমাশীল। (৪:৯৭৯৯)। মৃত্যুভয় থাকায় অনেক মুসলমান হিজরতে উৎসাহিত হননি। তাই বারে বারে হিজরতে পুণ্যের কথা ও লোভনীয় প্রস্তাব দেয়া হয়েছে কোরানে ; আর যে-কেউ আল্লাহর পথে দেশত্যাগ করবে সে পৃথিবীতে বহু আশ্রয় ও প্রাচুর্য লাভ করবে। আর যেকেউ আল্লাহ ও রসুলের উদ্দেশ্যে দেশত্যাগী হয়ে বের হয় আর তার মৃত্যু ঘটে তার পুরস্কারের ভার আল্লাহর ওপর। আল্লাহ তো ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। (৪:১০০)। পরম করুণাময়ের কাছ থেকে এ-রকম প্রস্তাব শোভনীয় নয়।-অনুবাদক)।

হিজরতের পূর্বে মক্কায় অবস্থানকালীন সময় আল্লাহর পক্ষ থেকে নবি মুহাম্মদের প্রতি নির্দেশ এসেছিল ; তুমি মানুষকে হিকমত ও সৎ উপদেশ দিয়ে তোমার প্রতিপালকের পথে ডাক দাও ও ওদের সাথে ভালোভাবে আলোচনা করো। তাঁর পথ ছেড়ে যে বিপথে যায় তার সম্বন্ধে তোমার প্রতিপালক ভালো করেই জানেন। আর যে সৎপথে আছে তাও তিনি ভালো করে জানেন। যদি তোমরা শাস্তি দাও, তবে যতখানি অন্যায় তোমাদের প্রতি করা হয় ঠিক ততখানি শাস্তি দেবে। অবশ্য ধৈর্য ধরা ধৈর্যশীলদের জন্য ভালো। (সুরা নাহল ; আয়াত ১২৫-১২৬)। কয়েক বছর পর ইসলাম প্রভাবশালী হয়ে উঠলে মক্কায় বিজয়ী বাহিনীর প্রধান হিসেবে প্রবেশ করেন নবি মুহাম্মদ। নির্দেশ তখন পরিবর্তন হয়ে যায় : তারপর নিষিদ্ধ মাস পার হলে মুশরিকদের যেখানে পাবে হত্যা করবে। তাদেরকে বন্দী করবে, অবরোধ করবে ও তাঁদের জন্য প্রত্যেক ঘাঁটিতে ওত পেতে থাকবে। কিন্তু যদি তারা তওবা করে, নামাজ কায়েম করে ও জাকাত দেয় তবে তাদের পথ ছেড়ে দেবে। আল্লাহ তো ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। (সুরা তওবা । আয়াত ৫)।

মানুষের সীমাবদ্ধতার দরুন সে অসহায় অবস্থায় একভাবে আর সফল হলে অন্যভাবে আচরণ করে। কিন্তু পরম স্রষ্টা যেহেতু সর্বশক্তিমান ও সর্বজ্ঞ তাই তাঁর পক্ষে দুই ধরনের পরিস্থিতিতে ভিন্ন মানসিকতা দেখানোর কারণ অবোধগম্য। হিজরতের প্রথম বছর আল্লাহ কোরানে বললেন : ধর্মে কোনো জবরদস্তি নেই। নিঃসন্দেহে সৎপথ ভ্রান্তপথ থেকে পৃথক হয়ে গেছে। সুতরাং যে তাগুত (অসত্য দেবতা)-কে অস্বীকার করবে ও আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস করবে সে এমন এক শক্ত হাতল ধরবে যা কখনও ভাঙবে না। আল্লাহ সব শোনেন, সব জানেন। (সুরা বাকারা ; আয়াত ২৫৬)। বছরখানিক পরই (নবি রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালীক্ষমতাশালী হলে) আল্লাহ আদেশ দিলেন : “যারা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তোমরাও আল্লাহর পথে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করো। (২:১৯০)। এবং তোমরা আল্লাহর পথে জিহাদ করো। (২:২৪৪)। এবং এই বলে সতর্ক করে দিলেন : “মুসলমানদের মধ্যে যারা অক্ষম নয় অথচ ঘরে বসে থাকে ও যারা আল্লাহর পথে নিজের ধনপ্রাণ দিয়ে জিহাদ করে তারা সমান নয়, যারা নিজেদের ধনপ্রাণ দিয়ে জিহাদ করে আল্লাহ তাদেরকে যারা ঘরে বসে থাকে তাদের ওপর মর্যাদা দিয়েছেন। (২:৯৫) । পূর্বে প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল ধর্মে কোনো জোর-জবরদস্তি নেই আর এখন মুসলমানদেরকে যুদ্ধের জন্য নির্দেশ দেয়া হচ্ছে।

হিজরতের পূর্বে আল্লাহ নৈতিক উপদেশ নাজিল করেছিলেন : “ভালো ও মন্দ দুই-ই সমান নয়। ভালো দিয়ে মন্দকে বাধা দাও। এতে তোমার সাথে যার শক্রতা সে হয়ে যাবে অন্তরঙ্গ বন্ধুর মতো। (সুরা হা-মিম-সিজদা :আয়াত ৩৪)। হিজরতের পর মদিনায় বিপরীতধর্মী আয়াত নাজিল হলো : সুতরাং তোমরা অলস হয়ো না এবং সন্ধির প্রস্তাব করো না, তোমরাই প্রবল আল্লাহ তোমাদের সঙ্গে আছেন, তিনি তোমাদের কর্মফল ক্ষুন্নকরবেন না। (সুরা মুহামদ ; আয়াত ৩৫)।

আচরণ ও কণ্ঠস্বরের এরকম পরিবর্তন স্বাভাবিকভাবে আমাদের মনোযোগ আকর্ষণ করে। আরেকটি প্রণিধানযোগ্য বিষয় হচ্ছে, অগণিত তারকারাজি আর গ্রহমণ্ডলী নিয়ে গঠিত বিশাল মহাবিশ্বের স্রষ্টার কেবলমাত্র আরবের হেজাজ অঞ্চলের লোকদের প্রতি এ ধরনের প্রশ্নের হেতু কী হতে পারে ; তোমরা যে-পানি পান কর, সে-সম্পর্কে কি তোমরা চিন্তা করেছ? তোমরাই কি তা মেঘ থেকে নামিয়ে আনো, না আমি তা বর্ষণ করি? আমি তো ইচ্ছা করলে তা লোনা করে দিতে পারি। তবুও কেন তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর না? (সুরা ওয়াকিয়া ; আয়াত ৬৮-৭০)।

কোরানের একাধিক সুরা পাঠে মনে হতে পারে স্রষ্টা বোধহয় মানুষের ওপর নির্ভরশীল। আর আমি দিয়েছি লোহা, যার মধ্যে রয়েছে প্রচণ্ড শক্তি ও মানুষের জন্য নানা উপকার; আর এটা এজন্য যে, আল্লাহ যেন জানতে পারেন কে না-দেখে তাঁকে ও তাঁর রসূলদেরকে সাহায্য করে। আল্লাহ তো শক্তিধর, পরাক্রমশালী।” (সুরা হাদিদ ; আয়াত ২৫)। এ-আয়াত থেকে মনে হতে পারে মানুষ তরবারি দ্বারা আল্লাহ ও রসুলকে সাহায্য করতে পারে, এই ধরনের দুর্বলতার কারণ কি? সৰ্বশক্তিমানের কেন প্রয়োজন হবে মানুষের সাহায্যের? আর আরেকটি আয়াত আছে এ-রকম : হে বিশ্বাসিগণ! তোমরা সবাই আল্লাহর সাহায্যকারী হয়ে যাও। (সুরা সাফফ ; আয়াত ১৪) এই আয়াতে সাহায্যের আরবি হিসেবে ‘আনসার শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। বলা হয়েছে ‘আনসারাল্লাহমানে আল্লাহর সাহায্যকারী”-অনুবাদক)। আবার কোরানে পঞ্চাশটিরও বেশি আয়াতে আল্লাহ বলেছেন, মানুষকে সঠিক পথে নিয়ে আসা বা ইসলাম ধর্মে আনা তাঁর (আল্লাহর) ইচ্ছার বা পছন্দের ওপর নির্ভরশীল। যেমন : নিশ্চয়ই তারা বিশ্বাস করবে না যাদের বিরুদ্ধে তোমার প্রতিপালকের সিদ্ধান্ত নির্ধারিত হয়ে গেছে। এমনকি ওদের কাছে প্রত্যেকটি নিদর্শন আসলেও, যতক্ষণ না তারা কঠিন শাস্তি প্রত্যক্ষ করবে। (সুরা ইউনুস ; আয়াত ৯৬-৯৭)। আমি ইচ্ছা করলে প্রত্যেক ব্যক্তিকে সৎপথে পরিচালিত করতে পারতাম। কিন্তু আমার একথা অবশ্যই সত্য যে আমি নিশ্চয়ই জিন ও মানুষ উভয় দ্বারা জাহান্নাম পূর্ণ করব।” (সুরা সিজদা : আয়াত ১৩)। যারা আল্লাহও নিদর্শনে বিশ্বাস করে না আল্লাহ তাদেরকে পথনির্দেশ করেন না এবং তাদের জন্য আছে নিদারুণ শাস্তি। (সুরা নাহল ; আয়াত ১০৪)। এ-ধরনের আয়াতগুলো পড়লে মনে হয় আল্লাহ হয়তো নিজেই চাচ্ছেন না সব মানুষ সঠিক পথে বা তাঁর ধর্মে আসুক, আবার যারা সঠিক পথে বা ইসলাম গ্রহণ করেনি তাদের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছেন অনন্তকাল ধরে দোজখের যন্ত্রণাময় শাস্তি। মানুষ সঠিক পথে আসুক তা আল্লাহর ইচ্ছা নয়-বিষয়টি স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে সুরা আনআ’মে : . . . আমি তাদের অন্তরের ওপর আবরণ দিয়েছি যেন তারা তা বুঝতে না পারে। আমি তাদেরকে বধির করেছি। আর তারা সমস্ত নিদর্শন প্রত্যক্ষ করলেও তাতে বিশ্বাস করবে না। (সুরা আন’আম ; আয়াত ২৫)। প্রায় একই ধরনের বক্তব্য আছে সুরা কাহাফে : যখন ওদের কাছে পথের নির্দেশ আসে, তখন কখন ওদের পূর্ববর্তীদের অবস্থা হবে বা কখন শাস্তি এসে পড়বে এই প্রতীক্ষাই ওদেরকে বিশ্বাস করতে ও ওদের প্রতিপালকের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতে বাধা দেয়। ( ১৮:৫৫)। আবার এটাও সত্যি যে, কোরানে প্রায় পঞ্চাশটিরও অধিক আয়াত আছে যেখানে আল্লাহকে বিশ্বাস ও অনুসরণ না করার জন্য মৃত্যুর পর অসীম সময় ধরে ভয়ঙ্কর শাস্তি ভোগের হুমকি দেয়া আছে।

কোরানে বাতিলকৃত ও বাতিলকারী আয়াতের উপস্থিতি রয়েছে।” এগুলোকে যথাক্রমে মানসুখও নাসিখ’বলা হয়। সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমান সৃষ্টিকর্তা এমন কিছু বলবেন বা সিদ্ধান্ত দিবেন যা পরে বাতিল করতে হবে এ-রকম ভাবা অযৌক্তিক। ইসলাম মতে, কোরানের সবগুলো আয়াতই কেয়ামতের আগ পর্যন্ত ক্রিয়াশীল। কিন্তু কোরানে ঠিক এ-ধরনের ঘটনা ঘটেছে একাধিকবার, আল্লাহ কোনো বিষয়ে একটা নির্দেশ দিয়েছেন পরে সে নির্দেশের পরিবর্তন এনেছেন। তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে, যে আয়াতগুলোর নির্দেশ পরিবর্তন হয়ে গেছে সেগুলো কোরান থেকে কেন বাদ দেয়া হয়নি? এগুলোর বর্তমান উপযোগিতা কী?-অনুবাদক)। তফসিরকারক এবং ইসলামি ধর্মতাত্ত্বিক কোরানের কয়েকটি বাতিল আয়াতের তালিকা করেছেন। সিদ্ধান্তের পরিবর্তন কেবল মানুষ বা অন্যকেউ করতে পারে। স্বাভাবিকভাবে মানুষ একসাথে সম্পূর্ণ বাস্তবতাকে আঁচ করতে পারে না। মানুষের চিন্তা কোনো ঘটনার বাহ্যিকরূপ দর্শনে ভ্রান্তির দিকে যেতে পারে কিন্তু তারা অভিজ্ঞতা ও আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে নিজেকে শোধরাতে পারে। সুতরাং মানুষের জন্য এটি বাঞ্ছনীয় যে তারা তাদের অতীত সিদ্ধান্ত ও পরিকল্পনা পরিবর্তন করবে। কিন্তু সর্বশক্তিমান ও সর্বজ্ঞানী স্রষ্টার পক্ষে সিদ্ধান্ত বা নির্দেশনা পরিবর্তন অযৌক্তিক ও বাস্তবতাবিরোধী। হজরত মুহাম্মদের বিরোধীরা এ-ব্যাপারটা নিয়ে তাচ্ছিল্য করেছিলেন যে, তিনি আজ এক ধরনের উপদেশ পান তো পরদিন আবার তা বাতিল করে ফেলেন। এদের এই বক্তব্যের জবাবে আরেকটি আয়াত নাজিল হয় ; আমি কোনো আয়াত রদ করলে বা ভুলে যেতে দিলে তার চেয়ে আরও ভালো বা তার সমতুল্য কোনো আয়াত আনি। তুমি কি জান না যে আল্লাহ সর্ববিষয়ে সর্বশক্তিমান? (সুরা বাকারা : ১০৬)। স্রষ্টা যেহেতু সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী তাই স্পষ্টত তিনি এমন কোনো আয়াত নাজিল করতে পারেন না যা পরবর্তীতে বাতিল করতে হয়। যেহেতু স্রষ্টা সর্বজ্ঞ ও সর্বশক্তিমান তাই তিনি এমন নির্দেশনা দিতে সক্ষম যার পরিবর্তনের প্রয়োজন হয় না। যে কোনো চিন্তাশীল ব্যক্তি যিনি স্রষ্টাকে সর্বশক্তিমান বলে বিশ্বাস করেন তিনি প্রশ্ন তুলতে বাধ্য যে, কেন স্রষ্টা এমন কোনো নির্দেশনা দিবেন যা পরবর্তীতে তাঁর কাছে সঠিক নয় বলে মনে হয়, বিধায় তা প্রত্যাহার করে নেবেন বা পরিবর্তন করবেন।

উপরে প্রদত্ত আয়াতে (২:১০৬) একটা অসংগতি হলো, যেহেতু আল্লাহ সবকিছু করতে সক্ষম তাই তিনি কেন উত্তম আয়াতগুলো আগে নাজিল করেননি? দেখা যায় কোরান নাজিল হওয়ার যুগেও কিছু প্রশ্নকারী লোক তাদের অনড় অবস্থানে ছিল। সুরা নাহলে বলা হয়েছে : ‘আমি যখন এক আয়াতের জায়গায় অন্য এক আয়াত উপস্থিত করি, তখন তারা বলে, “তুমি তো কেবল মিথ্যা বানাও। আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেন তা তিনি ভালো জানেন, কিন্তু ওদের অনেকেই (তা) জানে না।’ ( ১৬:১০১)।

কোরান আল্লাহর বাণী হলে তাতে মানবীয়-বুদ্ধিমত্তার আলামত থাকার কথা নয়। উপরের আয়াতের অসঙ্গতি একদম স্পষ্ট। আল্লাহ জানতেন তিনি কী নাজিল করছেন। তাই এক আয়াত দ্বারা আরেক আয়াতকে প্রতিস্থাপিত করার ব্যাপারটি সন্দেহের সৃষ্টি করে। এমনকি আরবের হেজাজ অঞ্চলের অশিক্ষিত জনগণের মনেও এ প্রশ্নের উদয় হয়েছিল যে, যিনি (আল্লাহ) তার বান্দাদের ব্যাপারে সম্পূর্ণ আবগত, তিনি প্রথমেই তাঁদের (বান্দাদের) জন্য সর্বোত্তম বিধান প্রদান করতে পারেন এবং তাঁকে (আল্লাহ) তাঁর দুর্বল বান্দাদের মতো সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে হত না। এগুলো নিয়ে বিস্তারিত অধ্যয়ন ও গবেষণা থেকে এই উপসংহারে পৌছানো যায় যে, কোরানের আয়াতে এসব অসঙ্গতি আল্লাহ ও নবির মধ্যে পরস্পর মিলেমিশে যাওয়ার কারণেই উদ্ভূত হয়েছে। মুহাম্মদের মনের গভীরে মহাবিশ্বের স্রষ্টা আল্লাহ প্রোথিত ছিলেন এবং তিনি আরবদের পরিচালনার জন্য হয়েছিলেন আল্লাহর তাঁর উভয় ধরনের (আল্লাহ ও নবি) ব্যক্তিত্বের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে।

এ ব্যাপারে হাঙ্গেরীয় বংশোদ্ভূত ইসলাম-বিশেষজ্ঞ ইজহাক গোল্ডজিহারের নিরীক্ষণ বেশ চমৎকার ও সম্পূর্ণ বিবেচনাযোগ্য, যা বর্ণিত হয়েছে তাঁর মূল্যবান বই Le dogme et le loi de l’Islam – AH তৃতীয় অধ্যায়ের শুরুতে। তিনি লিখেছেন : “নবিরা দার্শনিক বা ধর্মতত্ত্ববিদ ছিলেন না। তাদের বোধশক্তি যে বার্তা তাঁদেরকে বহন করতে উদ্বুদ্ধ করত তা পূর্বপরিকল্পনার দ্বারা তৈরি মতবাদ ছিল না এবং তা প্রণালীবদ্ধ করতে সক্ষম কোনো নীতিমালাও ছিল না। ’

নবি মুহাম্মদ যা শিক্ষা দিয়েছেন তা তাঁর অন্তরের অন্তঃস্থল থেকেই নির্গত হয়েছিল এবং জনগণ তাঁর প্রদান করা শিক্ষার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিল। বিশ্বাসীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের আকার নেয়। পরে ধর্মীয় পণ্ডিতরা জনগণের মধ্যেকার বিভিন্ন বিশ্বাসকে সমন্বয় করে একটি সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলেন। ধর্মীয় পণ্ডিতরা ধর্মে কোনো খুঁত বা অসঙ্গতি পেলে বিভিন্নভাবে তা দূর করা বা ব্যাখ্যা দেয়ার ব্যবস্থা করেন। তারা নবি প্রদত্ত প্রতিটি বাণীর একটি গৃঢ় অর্থ কল্পনা বা আবিষ্কার করে নিয়েছেন ও ধরে নিয়েছেন এগুলোর পেছনে কোনো না কোনো যুক্তি রয়েছে। এক কথায় তারা এমন অর্থ ব্যাখ্যা ও ধারণা নিয়ে এসেছিলেন যা স্বয়ং নবির মনে কখনো উদয় হয়নি, এবং সে-সব প্রশ্নের উত্তর ও সমস্যার সমাধান দিয়েছেন যার সমুখীন নবিকেও কখনো হতে হয়নি। ধর্মীয় পণ্ডিতরা তা করেছিলেন একটি ধর্মীয় ও দার্শনিকভিত্তি-সম্পন্ন ব্যবস্থা হিসাবে এবং বিরুদ্ধবাদীভিন্নমতাবলম্বী ও সংশয়বাদীদের জন্য এক অলঙ্ঘনীয় দূর্গ হিসাবে গড়ে তোলার জন্য। তারা নবির নিজস্ব দর্শনের উপর ভিত্তি করেই তা করেছিলেন। এসব উৎসাহী পণ্ডিতরা যে চ্যালেঞ্জের সমুখীন হননি তা নয়, অন্য ধর্মতাত্ত্বিক ও তফসিরকারক নবির কথার প্রচুর ভিন্ন অর্থ ও ব্যাখ্যা করেছেন এবং ভিন্ন ধরনের ধর্মীয় সমাজ গড়ে তুলেছেন। উল্লেখ্য আমরা বিখ্যাত চার সুন্নি মাজহাবের চার ইমামের কথা ধরতে পারি। তাদের সিদ্ধান্ত ও ব্যাখ্যা অনেক ক্ষেত্রে পরস্পরবিরোধী। এছাড়া সুন্নি, আহলে হাদিস, শিয়া, কাদিয়ানি ইত্যাদি বিভিন্ন যুগের ধর্মীয় পণ্ডিতদের স্বতন্ত্র ব্যাখ্যা দেখা যায়।-অনুবাদক)। যদিও পশ্চিমা ইসলামবিশেষজ্ঞ ইজহাক গোল্ডজিহার তাঁর ভাবনাকে সব ধর্মের ক্ষেত্রে একই সাথে প্রকাশ করেছেন তথাপি তাঁর অন্তদৃষ্টি প্রখর হয়েছে ইসলামের প্রাথমিক সময়ের খারিজি”, শিয়া, মরজিতি”, মুতাজিলা” ও আশারিয়া” ইত্যাদি ধর্মীয় গোষ্ঠীর মধ্যে বিরোধকে পর্যবেক্ষণ করার মধ্য দিয়ে। নিজে জন্মসূত্রে ইহুদি হওয়ায় এবং খ্রিস্টান চার্চ সম্পর্কে বিশদ জ্ঞান থাকায় তিনি ইহুদি ও খ্রিস্টানদের মধ্যে একই ধরনের ব্যাপক বিতর্কের বিষয়ে সচেতন ছিলেন। তবে তিনি একইসাথে ইসলামের বিস্তারের ব্যাপারে গভীর পর্যবেক্ষণে আগ্রহী ছিলেন।

আরও কিছু মৌলিক বিষয় নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা এ-অধ্যায়ে যোগ করা যায়। কোরানে এমন অনেক আয়াত আছে যেগুলো বুদ্ধিমান পাঠকের কাছে স্পষ্ট হওয়ার কথা। যেমন: সুরা ফাতেহর দশম আয়াতে বর্ণিত আল্লাহর হাত তাদের হাতের উপরে অর্থাৎ এটাই বুঝাচ্ছে আল্লাহর ক্ষমতা অনেক বেশি। সুরা ফুরকানের ৫৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে : “তারপর তিনি আরশে সমাসীন হন। আরশ শব্দের অর্থ রাজসিংহাসন। যেহেতু আল্লাহর কোনো দেহ নেই তাই তিনি কোনো আসনে বসার কথা নয় বরং তিনি হবেন মহাবিশ্বের সর্বোচ্চ প্রভু। সুরা কিয়ামাতে বলা হয়েছে : “সেদিন কোনো কোনো মানুষের মুখ উজ্জ্বল হবে। তারা তাদের প্রতিপালকের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকবে।’ ( ৭৫:২২-২৩)। এখান থেকে বুঝায় যে, পুণ্যবান নরনারী আল্লাহর প্রতি মনোনিবেশ করবে। কোরানে বারবার একথা পুনরাবৃত্তি হয়েছে যে, আল্লাহ সর্বদ্রষ্টা ও সর্বজ্ঞানী- এ থেকে আমরা বুঝি কোনো কিছুই আল্লাহর অজানা নেই।

অনেক মুসলমান বিশ্বাসের ক্ষেত্রে অনমনীয়। তারা কোরানের যে ব্যাখ্যা হাদিসে আছে শুধু তা-ই গ্রহণ করতে চান এবং মনে করেন ধর্মীয় ব্যাপারে এর বাইরে কোনো যুক্তি বা বিচারবুদ্ধির প্রয়োগ অনুমোদনযোগ্য নয়। তারা উপরে উল্লেখিত কোরানের আয়াতগুলোকে আক্ষরিকভাবে গ্রহণ করেন এবং বিশ্বাস করেন আল্লাহর মানুষের মতই মাথা, মুখ, চোখ, হাত, পা রয়েছে এবং তিনি ঠিক মানুষের মতই অনুভূতিক্ষমতা সম্পন্ন। কারণ কোরানে আল্লাহর শোনা, বলা, দেখা এবং মানবসুলভ বিভিন্ন গুণের কথা উল্লেখ আছে। বাগদাদের একজন ধর্মপ্রচারক আবু মামার আল হুজাইলির (মৃত্যু ২৩৬ হজরি বা ৮৫০ খ্রিস্টাব্দ) মতে কেউ যদি এরকম আক্ষরিক ব্যাখ্যা অবিশ্বাস করে তবে সে কাফের। বিখ্যাত ইমাম আহমদ বিন হানবল কোরানের আক্ষরিক অর্থকেই গ্রহণ করেছেন এবং এর প্রতি আজীবন অবিচল ছিলেন। এই মজহাবের পরবর্তী প্রধান আহমদ বিন তায়মিয়া এ-ব্যাপারে এতোই গভীর বিশ্বাসী ছিলেন যে তিনি মুতাজিলাদের কাফের ও বিশিষ্ট ইসলামি দার্শনিক গাজ্জালিকে ধর্মবিরোধী বলে মনে করতেন। একদিন তিনি দামেস্কর প্রধান মসজিদে (উমাইয়া মসজিদ) উপস্থিত জনগণের উদ্দেশ্যে ধর্মীয় ভাষণ শেষে মিম্বর থেকে নামতে নামতে বলেছিলেন, “আল্লাহ তাঁর সিংহাসন (আরশ) থেকে এভাবে নামবেন যেভাবে আমি নামছি। ”

এই ধরনের রক্ষণশীল মানসিকতাসম্পন্ন ধর্মান্ধরা শুধু মুতাজিলাদের নয় বরং আশারির মতো ধর্মতাত্ত্বিকদেরও অনৈসলামিক বলে মনে করতেন। তারা তাদের সংকীর্ণ ধর্মীয় ব্যাখ্যার ভিন্নব্যাখ্যাকে বিপজ্জনক উদ্ভাবন বলে অভিহিত করতেন। আবু আমর আল কোরেশি ঘোষণা দিয়েছিলেন সুরা শুরা’র ১১ নম্বর আয়াত : কোনোকিছুই তাঁর মতো নয় যা প্রকাশ করছে তা সরাসরি গ্রহণ করা ধর্মবিরুদ্ধ। তাঁর মতে এ আয়াত দ্বারা কেবল বুঝায় আল্লাহর সদৃশ কোনো পরম সত্তা নেই। কারণ আল্লাহর মানুষের মতোই অঙ্গপ্রত্যঙ্গ রয়েছে। আবু আমর আল কোরেশি শেষ বিচার সংক্রান্ত সুরা কলমের একটি আয়াতের কথা বলেছেন ; সেই দারুণ সংকটের দিনে যেদিন ওদেরকে সিজদা করার জন্য ডাকা হবে, ( সেদিন) কিন্তু ওরা তা করতে পারবে না। (৬৮:৪২)। এরপর কোরেশি নিজের উরুতে হাত দিয়ে আঘাত করে বলেছিলেন, “আল্লাহরও ঠিক আমার মত হাতপা রয়েছে।

গোঁড়া ধর্মবাদীদের এ-রকম বিশ্বাস ইসলাম-পূর্ব যুগের আদিম বিশ্বাস ও প্রথার কথা আমাদের সারণ করিয়ে দেয়। আরবদের মধ্যে থেকে হঠাৎ করে জড়বাদী ধারণা, বিমূর্ত চিন্তায় অক্ষমতা, আধ্যাত্মিক নির্লিপ্ততা, উচ্ছঙ্খলা ও একগুঁয়েমি দূর হয়ে গেছে এমন নয়। সর্বোপরি তাদের মন-মানসিকতা ইরানীয়দের মতো কোনো ভিন্ন জাতি দ্বারা প্রভাবিত হয়নি অথবা তারা বিভিন্ন ইসলামি বুদ্ধিবৃত্তিক দল যেমন মুতাজিলা, সুফি, শিয়া, ইখওয়ানুস-সাম এবং বাতেনাইতদের” সংশ্রবে আসেনি।

এটা সুবিদিত যে, মৌলবাদের ধারা আরবীয়দের মধ্য থেকে আগত এবং ইসলামের প্রথম দিকের বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা অ-আরবীয়দের কাছ থেকে এসেছে। মুতাজিলা ও তাদের পরবর্তী চিন্তাবিদরা হয় অ-আরবীয় অথবা এরকম আরবীয় যারা গ্রিক ও ইরানীয় প্রভাবে আদিম সংস্কার থেকে মুক্ত হতে পেরেছিলেন। সবশেষে বলা যায় এসব বিষয় এ অধ্যায়ের প্রথম দিকে দেয়া অভিমতটিকে প্রমাণ করে, ‘মানুষ ঈশ্বরকে নিজের মত করে কল্পনা করে নিয়েছে।’

জিন ও জাদু

চতুর্থ অধ্যায় : অধিবিদ্যা : জিন ও জাদু

জিন মানুষের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ কিন্তু স্বাভাবিক অবস্থায় অদৃশ্য। জিন বিভিন্ন ধরনের হতে পারে, যেমন পুরুষ জিন, স্ত্রী জিন পরী ইত্যাদি। উপকারী জিন যেমন আছে তেমনি অপকারী জিনও রয়েছে। কিছু বিরল ক্ষেত্রে মানুষ জিনকে দেখতে সক্ষম হয় এবং লোকমুখে শোনা যায় কখনো কখনো পরীদের রাণী কোনো এক পুরুষ মানুষের প্রেমে পড়ে যায়, কখনো আবার পুরুষ জিন স্ত্রী মানুষের প্রতি আকৃষ্ট হয়। অনেক সমাজ-সংস্কৃতিতে এ-বিষয়টি লোককথায় রয়েছে-কিছু অশুভ আত্মা আছে যা মানুষের দেহে প্রবেশ করে মৃগী রোগের লক্ষণ সৃষ্টি করে।

একইভাবে জাদুতে বিশ্বাসও দীর্ঘকালব্যাপী বিশ্বময় ছড়িয়ে আছে। অনেকের বিশ্বাস মন্ত্র, মন্ত্রপূত কবচ বা এরকম অন্যান্য কিছু দ্রব্য স্বাভাবিক উপায়ে পাওয়া অসম্ভব এমন কিছু করতে বা পেতে সহায়তা করে, যেমন এগুলো কারো মৃত্যু ঘটাতে পারে, প্রেমে পড়তে বাধ্য করতে পারে, পাগল করে দিতে পারে অথবা একটি মোমের পুতুলের চোখদুটি বিদ্ধ করার মাধ্যমে সাথে সাথে কাউকে অন্ধ করে দিতে পারে। এরকম জড়বুদ্ধিসম্পন্ন বিশ্বাস ইতিহাসের সূচনালগ্ন থেকেই সকল জাতির মধ্যে স্পষ্ট। দুঃখজনকভাবে এগুলো অপেক্ষাকৃত উন্নত জাতির মধ্যেও এখনো বিদ্যমান।

এই দুই ধরনের বিভ্রান্তিমূলক বিশ্বাসকে (জিন ও জাদু) ব্যাখ্যা করা কঠিন নয়। মানুষ উপলব্ধি ক্ষমতাসম্পন্ন এবং কৌতুহলী প্রাণী। মানুষের মন তার চারপাশে ঘটা বিভিন্ন ঘটনার কারণ অনুসন্ধান করে বেড়ায় এবং প্রায়ই প্রকৃত কারণ বের করা তার জন্য কঠিন হয়ে পড়ে। যখন মানুষের দুর্বল মন অজানার-অন্ধকারে হাতড়ে বেড়ায় তখন তা বেশিরভাগ সময় অনুমান ও কল্পনার রাজ্যে চলে যায়। যৌক্তিক চিন্তা করে সমাধান পাওয়া না গেলে মানুষ কল্পনার আশ্রয় নেয়। মানুষ প্রকৃতির কাছে দুর্বল এবং সে প্রায়ই ভয় ও বাসনার উর্ধ্বে যেতে পারে না। উক্ত ব্যাপারগুলো মানুষকে কুসংস্কারের রসাতলে ঠেলে দেয়। একসময় জাদুটোনা, জ্যোতিষশাস্ত্র ইত্যাদির সাহায্যে ভবিষ্যতকথন মানুষের হৃদয়ের অন্ধকারে বাসা বেধেছিল। সপ্তম শতাব্দীর আরবরা কুসংস্কারে নিমজ্জিত থাকার বিষয়টি আশ্চর্যজনক নয়। আশ্চর্যের বিষয় যেটি তা হলো কোরানে উক্ত বিভ্রমদ্বয়ের (জিন ও জাদু) কথা শুধু উল্লেখ করা হয়েছে তাই নয় বরং এগুলোকে বাস্তব বলে অবিহিত করা হয়েছে।

সুরা ফালাক ও সুরা নাস -এর মূল বিষয় জাদুটোনা। বেশির ভাগ তফসিরকারকের মতে, কুরাইশ বংশের পৌত্তলিক লাবিব বিন আসাম নবিকে জাদু করেছিল, যা তাঁর স্বাভাবিক কাজকর্ম চালাতে ব্যাঘাত ঘটায় এবং নবি অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরে জিবরাইল এসে তাঁকে জাদুর বিষয়টি অবহিত করেন। ক্যামব্রিজ তফসিরে রয়েছে, নবি যখন অসুস্থ অবস্থায় ঘুমাচ্ছিলেন তখন স্বপ্নে দেখলেন দুজন ফেরেশতা তাঁর মাথার উপরে এসেছেন এবং একজন অপরজনকে জিজ্ঞেস করছেন- এই লোকটি কেন অসুস্থ হয়েছে ও আর্তনাদ করছে? অন্য ফেরেশতা উত্তর দিলেন-কারণ লাবিব তাঁকে জাদু করেছে, ও যা দিয়ে জাদু করেছে তা দরওয়ান কূপের নিচে আছে। নবি ঘুম থকে উঠে হজরত আলি এবং আমার বিন ইয়াসিরকে (প্রথমদিককার একজন ধর্মান্তরিত মুসলিম) জাদুকৃত বস্তুর সন্ধানে পাঠালেন। তাঁরা কূপ থেকে পানি সরিয়ে ফেললেন এবং ফেরেশতারা যেমন বলেছিলেন সেভাবে কূপের নিচের একটি পাথরের তলদেশ থেকে বস্তুটি উদ্ধার করলেন। বস্তুটি ছিল একটি দড়ি যাতে এগারোটি গিট দেয়া ছিল। তাঁরা এটি নবির কাছে নিয়ে এলেন। এরপর কোরানের সুরা দুটি নাজিল হয় যাতে এগারোটি আয়াত ছিল এবং একেকটি আয়াত পাঠের সাথে একটি করে গিট খুলতে লাগলো। এবং নবি সুস্থ হলেন। তাবারি আরও বর্ণিল বিবরণ দিয়েছেন, অবশ্য তফসির আল-জালালাইনে শুধু বলা হয়েছে এই সুরা দুটির প্রতিটি আয়াত একেকটি গিট খুলেছিল। জামাখশারি জাদুতে বিশ্বাসী ছিলেন না তাই তিনি যুক্তিবাদীদের মতো এই কাহিনী তাঁর ‘কাশশাফ থেকে বাদ দিয়েছিলেন। দ্রষ্টব্য ; বুখারি শরিফ, ভলিউম ৭, বুক ৭১ নম্বর ৬৫৮, ৬৬০-৬৬১ হাদিসে এই জাদুটোনার ঘটনা বর্ণিত হয়েছে।-অনুবাদক।)

কোরানের কোনো তফসিরকারক বা ধর্মতত্ত্ববিদ জিনের অস্তিত্ব নিয়ে সন্দেহ করেননি, কারণ কোরানের দশটিরও অধিক আয়াতে জিনের কথা বলা হয়েছে। জিনকে সৃষ্টি করেছেন ধূম্রহীন অগ্নিশিখা থেকে। (সুরা রহমান ; আয়াত ১৫)। সুরা জিন নামে কোরানের একটি সুরা রয়েছে, এর প্রথম দুই আয়াতে বলা হয়েছে একদল জিন কোরান আবৃত্তি শুনেছে ; বলো, আমি প্রত্যাদেশের মাধ্যমে জেনেছি যে জিনদের একটি (কোরান) শুনেছে ও তাদের সম্প্রদায়ের কাছে গিয়ে বলেছে, আমরা তো এক বিস্ময়কর কোরান শুনেছি, যা সঠিক পথনির্দেশ দেয়। তাই আমরা এতে বিশ্বাস করেছি। আমরা কখনও আমাদের প্রতিপালকের কোনো শরিক করব না। (৭২১-২)। বিশ্বের অন্যান্য আদিম সমাজের মতো প্রাচীন আরবরাও ভাল এবং মন্দ আত্মায় বিশ্বাস করতো। মরুভূমির রুক্ষ আবহাওয়া ও একাকীত্ব তাদের এ-বিশ্বাসকে প্রবল করে তুলত। যখন একজন আরব বসবাসের অযোগ্য ভূতুড়ে জায়গায় একাকী রাত্রি যাপন করত তখন সে ভয় পেয়ে খারাপ জিনের কাছ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য মন্ত্রোচ্চারণ করত। কোরানে এ নিয়ে বলা হয়েছে : . . . কোনো কোনো মানুষ কিছু জিনের শরণ নিত, ফলে ওরা জিনদের অহংকার বাড়িয়ে দিত। ( ৭২:৬)।

যেখানে আদিম সমাজ ও উন্নত সভ্যতার নিম্নস্তরের লোকদের মধ্যে এই ধরনের বিভ্রান্তিকর ও অযৌক্তিক বিষয়ে বিশ্বাসের কারণ সহজেই বোধগম্য, সেখানে আল্লাহর গ্রন্থ কোরানে উক্ত বিষয়গুলো সত্য বলে বর্ণিত হওয়া বিস্ময়কর বটে। অথচ ওই গ্রন্থ তথা ধর্মকে যিনি প্রচার করেছেন তিনি তাঁর এলাকার বহু লোকপ্রথা এবং কুসংস্কারকে প্রত্যাখ্যান করেছেন; তাদের নৈতিকতা ও দৃষ্টিভঙ্গিকে সংস্কার করেছেন। সুরা জিনে যেসব বিষয় আলোচনা করা হয়েছে (যেমন নবির সাথে জিনের যোগাযোগ) তা হয়তো মুহাম্মদ স্বপ্নে দেখেছিলেন। নবি হিসাবে নিযুক্ত হওয়ার সময় তিনি প্রথমবারের মত ফেরেশতাকে দেখতে পেয়েছিলেন-এটা মানসিক উত্তেজনাপ্রসূত অলীক দর্শন ছিল। দূরবর্তী মসজিদে ভ্রমণ (ইসরা ও মেরাজ) স্বপ্নে ঘটেছিল বলে ব্যাখ্যা করা যায়।

আরেকটি সম্ভাবনার কথা বলা যায়। জিনের অস্তিত্বের প্রতি মুহাম্মদের গভীর বিশ্বাস তাঁর কল্পনাবিলাসী মনের ওপর এতই প্রভাব বিস্তার করেছিল যে তিনি মানুষের মতই উপলব্ধিক্ষমতা সম্পন্ন, বৌদ্ধিক চিন্তার অধিকারী ও নৈতিক বোধসম্পন্ন আরেকটি জাতির দর্শন লাভ করেছেন বলে তাঁর মনে হতে লাগলো, যারা এক ঈশ্বর ও পরকালে বিশ্বাসের ব্যাপারে মানুষের মতই বাধ্য ছিল। এখানে প্রশ্ন আসে জিনদের নিজেদের মধ্য থেকে নবি নিয়োগ করা হয়নি কেন? কারণ কোরানের একাধিক আয়াতে (১০:৪৭ ও ১৬:৩৬) স্পষ্ট বলা হয়েছে প্রতিটি জাতি থেকে (যিনি তাদের ভাষায় কথা বলেন ও তাদের অন্তর্ভুক্ত) তাদের নিজস্ব রসুল প্রেরণ করা হয়। তদুপরি সুরা বনি-ইসরাইল বলা হয়েছে : ফেরেশতারা যদি নিশ্চিন্ত হয়ে পৃথিবীতে ঘোরাফেরা করতে পারত তবে আমি আকাশ থেকে এক ফেরেশতাকেই ওদের কাছে রসুল করে পাঠাতাম।” (১৭৯৫)। বিষয়টি এভাবেও ব্যাখ্যা করা যায়, সুরা জিন রূপকার্থে ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন জালালুদ্দিন রুমি বলেছিলেন : আপনি যখন শিশুদের সাথে থাকবেন তখন শিশুসুলভ ভাষা ব্যবহার করতে হবে। সম্ভবত নবি তাঁর লোকদের প্রণোদিত করার মানসে এই কাহিনী তৈরি করেন যে, জিনরা কোরান শুনে এত বেশি প্রভাবিত হয়েছে যে তারা মুসলমান হয়ে গেছে।

ব্যাখ্যা যাই হোক, নবি মুহামদকে দোষারোপ করা যায় না। প্রাচীন গ্রিক দার্শনিকদের অনেকেরই গণিত, প্রাকৃতিক ও সামাজিক বিজ্ঞানে উন্নত ধারণা থাকা সত্ত্বেও সমসাময়িক সাধারণ মানুষের বিশ্বাসকে পরিহার করতে পারেননি, প্রকৃতপক্ষে তারা গ্রিক ধর্মীয় মিথলজির মধ্যে ডুবে ছিল। তবে হ্যাঁ, এখানে একটি উভয় সঙ্কট আছে। মুসলিমরা বিশ্বাস করেন কোরান আল্লাহর কাছ থেকে নবি মুহাম্মদের ওপর অবতীর্ণ হয়েছে এবং কোরানের কোনো অংশ নবি কর্তৃক রচিত বলে অস্বীকার করেন। তদুপরি সুরা

জিন শুরু হয়েছে “বল”আদেশ দিয়ে। আল্লাহ কি আরবের হেজাজ অঞ্চলের লোকদের জিন-পরীতে বিশ্বাসের সাথে একমত? অথবা এগুলোতে বিশ্বাস কি মুহাম্মদের হৃদয়ে প্রোথিত ছিল এবং তাঁর বাণীতে তা চিরন্তন রূপ পেয়েছে?

মহাবিশ্বের সৃষ্টি কাহিনী

চতুর্থ অধ্যায় : অধিবিদ্যা : মহাবিশ্বের সৃষ্টি কাহিনী

বাইবেলের পুরাতন নিয়ম মানুষের চিন্তার ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল। এটি প্রাচীনকালের মানুষের সৃষ্টি ও স্রষ্টা সম্পর্কিত সরল ও অপরিপক্ক ধারণাকে প্রদর্শন করে। বাইবেলের বর্ণনা অনুযায়ী, ঈশ্বর আকাশ ও পৃথিবী ছয় দিনে সৃষ্টি করেন এবং সপ্তম দিনে বিশ্রাম নেন যা সাবাতের দিন নামে পরিচিত। যেহেতু সৃষ্টির আগে সূর্যের অস্তিত্ব ছিল না বিধায় সূর্যস্ত ও সূর্যোদয় ঘটত না তাই পৃথিবী ও আকাশ সৃষ্টির সময়কে দিন (ছয় দিন) ধরে হিসাব করা স্পষ্টত অবান্তর। এছাড়া প্রশ্ন হল, কেন ঈশ্বর মানুষের তৈরি করা সময়ের মাপদণ্ড দিয়ে তাঁর সৃষ্টির সময়কে হিসাব করবেন? কেন তিনি পৃথিবী নামক গ্রহের সময়কে একক ধরে হিসাব করবেন যেখানে অন্যান্য অনেক দূরবর্তী গ্রহ (যেমন নেপচুন) রয়েছে? ঈশ্বর সূর্য ও পৃথিবী সৃষ্টি করার আগের সময়ে দিন ও রাত কিভাবে সংগঠিত হত?

মহাবিশ্বকে ছয় দিনে সৃষ্টি করার ব্যাপারটি কোরানের অন্তত আটবার উল্লেখ করা হয়েছে। (আরবি সিত্তাতি আইয়্যামমানে সরলভাবে ছয় দিন। আইয়্যাম হচ্ছে আরবি ইয়াওম বা দিন-এর বহুবচন। এছাড়া আরশশব্দের অর্থ রাজসিংহাসন। বিভিন্ন আয়াতে (৭:৫৪, ২৫:৫৯, ১১:৭, ২৩:৮৬-৮৭, ১১৬, ৩২:৪) আল্লাহর আরশে আরোহণের কথা উল্লেখ আছে। প্রশ্ন উঠতে পারে কেন নিরাকার স্রষ্টাকে রাজসিংহাসনে আরোহণ করতে হবে? তবে কি মানব-মানসের ধারণার ওপর ভিত্তি করে স্রষ্টার ধারণা তৈরি হয়েছে? কোরানে স্পষ্টভাবে বলা আছে-আল্লাহর সিংহাসন আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টির আগে পানির ওপরে ছিল। উল্লেখ্য আল্লাহর ধারণা ইসলাম-পূর্ব যুগের পৌত্তলিকদের কাছ থেকে এসেছে। আরবের পৌত্তলিকরা আল্লাহকে অন্যতম প্রধান দেবতা মনে করতো। হজরত মুহাম্মদের বাবা যিনি পৌত্তলিক ছিলেন তাঁর নাম ছিল আব্দুল্লাহমানে আল্লাহর দাস’, তাঁর চাচা আবু লাহাবের আসল নাম আব্দুল ওজামানে দেবী ওজার দাস।-অনুবাদক। নিচে এরকম কয়েকটি আয়াত উল্লেখ করা হলো

১. তোমাদের প্রতিপালক আল্লাহ, যিনি আকাশ ও পৃথিবী ছয় দিনে সৃষ্টি করেন, তারপর তিনি আরশে সমাসীন হন। (সুরা ইউনুস :আয়াত ৩)।

২. তোমাদের প্রতিপালক তো আল্লাহ যিনি আকাশ ও পৃথিবী ছয় দিনে সৃষ্টি করেন, তারপর তিনি আরশে সমাসীন হন। (সুরা আরাফ ; আয়াত ৫৪)।

৩. যখন তাঁর আরশ পানির ওপর ছিল তখন তিনিই আকাশ ও পৃথিবী ছয়দিনে সৃষ্টি করেন। (সুরা হুদ ; আয়াত ৭)। এ-আয়াত থেকে জানা যায় ছয় দিনে আসমান ও জমিন সৃষ্টি করার আগে আল্লাহর সিংহাসন পানির ওপরে ছিল অর্থাৎ সিংহাসন ও পানি আসমান ও জমিন সৃষ্টির আগে থেকেই অস্তিত্বশীল ছিল। সুরা ইউনুসের ৩ নম্বর আয়াত এবং সুরা আ’রাফের ৫৪ নম্বর আয়াতে উল্লেখ রয়েছে আল্লাহ আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টির পর তাঁর সিংহাসনে আরোহণ করেছেন। এটা সম্ভবত বাইবেলের বর্ণনার প্রতিধ্বনি যেখানে বলা হয়েছে ঈশ্বর ছয় দিনে সৃষ্টির পর সপ্তম দিনে বিশ্রাম নিয়েছেন। লক্ষণীয় এই আয়াতগুলোর গঠন দেখে মনে হয় তা আল্লাহর বাণী নয় বরং আল্লাহ সম্পর্কে অন্য কোনো ব্যক্তির বক্তব্য। নবির নিজের বক্তব্যও হতে পারে। নিচের আয়াতের বক্তা আল্লাহ :

৪. আমি আকাশ, পৃথিবী এবং দুয়ের মধ্যবর্তী সবকিছু ছয়দিনে সৃষ্টি করেছি। ক্লান্তি আমাকে স্পর্শ করেনি। (সুরা কাফ ; আয়াত ৩৮)। এই আয়াতটি আগের তিন আয়াতের থেকে কিছুটা ভিন্ন যেখানে উল্লেখ করা হয়েছে আল্লাহ ছয়দিনে শুধু আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন তা নয় বরং এর মধ্যে যা আছে সবকিছুই সৃষ্টি করেছেন। এবং এ-ধরনের গুরুকাজ সম্পাদনে কোনোভাবে ক্লান্ত হওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করা হয়েছে। মানুষ বা অন্য প্রাণীরা ক্লান্ত হতে পারে কোনো গুরুকাজ সম্পাদনের ফলে, একজন সর্বশক্তিমান ও চিরঞ্জীব স্রষ্টা ক্লান্ত হওয়ার প্রশ্নই আসে না। তাই ক্লান্তি আমাকে স্পর্শ করেনি কথাটি বিসায়ের সঞ্চার করে ও নিরাকার স্রষ্টার এ-ধরনের পরিচয় জ্ঞাপন বিভিন্ন প্রশ্নের জন্ম দেয়। অবশ্য এই বিবরণ বাইবেলে বর্ণিত ঈশ্বরের সপ্তম দিনে বিশ্রামের ধারণার বিপরীত।

৫. বলো, তোমরা কি তাঁকে অস্বীকার করবে যিনি দুদিনে পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন, আর তোমরা তাঁর সমকক্ষ দাঁড় করাতে চাও?’ (সুরাহা-মিম-সিজদা ; আয়াত ৯)। এখানে বক্তা স্বয়ং আল্লাহ, তিনি সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করছেন দুই দিনে পৃথিবী সৃষ্টির কথা। এই বাক্যটি এরকম ইঙ্গিত করছে যে, আরবের মক্কার লোকেরা দুই দিনে পৃথিবী সৃষ্টি হওয়ার ব্যাপারে অবগত ছিল এবং তাই তাদের উচিত নয় সেই স্রষ্টাকে অস্বীকার করা যিনি মাত্র দুই দিনে এরকম দুষ্কর কার্য সমাধা করেছেন। কিন্তু আরবরা নিশ্চয় এই সৃষ্টির ব্যাপারে জানত না, তা না-হলে তাদেরকে প্রশ্ন করা হত না, কেন তারা স্রষ্টায় বিশ্বাস করে না। যদিও এখানে আল্লাহ বক্তা বলে মনে হয়, তারপরেও এ ধরনের বাণী আল্লাহর জন্য উপযোগী নয়। অসীম জ্ঞানী পরমেশ্বরের উচিত নয় এটি আশা করা যে, পৃথিবী দুই দিনে সৃষ্টি হয়েছে বললেই লোকে তাঁকে বিশ্বাস করে ফেলবে অথবা কিছু আরব দুই দিনে কেউ একজন পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন তা স্বীকার করলেই তাঁকে সবাই বিশ্বাস করে ফেলবে? সুতরাং এ-ধরনের বাক্যও স্ৰষ্টার নয়, অন্য কারো কলপনার ফসল হতে পারে।

৬. তিনি পৃথিবীর উপরিভাগে পর্বতমালা স্থাপন করেছেন ও সেখানে কল্যাণ রেখেছেন, চারদিনের মধ্যে সেখানে মাত্রা অনুযায়ী খাদ্যের ব্যবস্থা করেছেন, সমানভাবে সকলের জন্য, যারা এর সন্ধান করে। (৪১:১০)।

৭. তারপর তিনি আকাশের দিকে মন দিলেন, আর তা ছিল ধোঁয়ার মতো। তারপর তিনি আকাশ ও পৃথিবীকে বললেন, “তোমরা কি দুজনে স্বেচ্ছায় আসবে নাকি অনিচ্ছায়? তারা বলল, “আমরা স্বেচ্ছায় এলাম। (৪১:১১)। সুরা হা-মিম-সিজদাহ এর আয়াতে আল্লাহর আরশের উল্লেখ নেই। এই সুরার ১০-১১ আয়াতে আকাশের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। আরবি ভাষা আনুসারে উক্ত আয়াতে উল্লেখিত আকাশ’ ও ‘পৃথিবী স্ত্রীবাচক বিশেষ্য। বললেন ক্রিয়াপদটিও স্ত্রীবাচক বিশেষ্য এবং দ্বিবচন, কিন্তু আয়াতটির শেষে সংযোজিত বিশেষণ ইচ্ছায় পুরুষবাচক এবং বহুবচন। তাই এই বাক্য-সমষ্টি আরবি ব্যাকরণ অনুসারে সিদ্ধ নয়।

৮. তারপর তিনি আকাশকে দুদিনে সাত-আকাশে পরিণত করলেন আর প্রত্যেক আকাশকে তার কাজ বুঝিয়ে দিলেন। (৪১:১২)। এই আয়াতে অতিরিক্ত দুই দিনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, তা সাত আকাশকে সজ্জিতকরণে ব্যয় হয়েছে। এই দুই দিন ছয় দিনে মহাবিশ্ব সৃষ্টির বিষয়টিকে আট দিনে পরিণত করে এবং কোরানের বিভিন্ন আয়াতে ছয় দিনে সৃষ্টির সাথে বৈপরীত্ব সৃষ্টি করে। এ-ধরনের বিশৃঙ্খলা এসব আয়াতকে আল্লাহর বাণী হিসেবে মেনে নিতে সন্দেহের মধ্যে ফেলে দেয়। আরেকটি উভয়সঙ্কট অবস্থা সৃষ্টি করে সুরা তওবার দিনপঞ্জি সম্পর্কিত আয়াত : ‘আকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্টির দিন থেকেই আল্লাহর বিধানে আল্লাহর কাছে মাসগণনায় মাস বারোটি, তার মধ্যে চারটি মাস (মহরম, রজব, জিলকদ ও জিলহজ) হারাম। এ-ই সুপ্রতিষ্ঠিত বিধান। (৯:৩৬)।

পৃথিবীর মানুষ জানে প্রায় ৩৬৫ দিনে পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘুরে আসে। তারা উপলব্ধি করতে পারে বছরে চারটি ঋতু আছে ও সে অনুযায়ী তাদের কাজকর্মকে সাজিয়ে নেয়। প্রাচীন ব্যবিলনীয়, মিশরীয়, চীনা, ইরানীয় ও গ্রিক সভ্যতার লোকজন সৌরবছর অনুযায়ী তাদের দিন গণনা করত, তারা সূর্যের অবস্থান পর্যবেক্ষণ করে চার ঋতুর প্রত্যেকটির তিন ভাগে ভাগ করে নেয়, ফলে বছরে ১২টি মাস হয়ে যায়। সামান্য গাণিতিক জ্ঞানসম্পন্ন প্রাচীন লোকদের কাছে সূর্যের অবস্থানের সঠিক পর্যবেক্ষণ কঠিন ছিল। তাই তারা হিসাব সহজ করার জন্য চাঁদের বিভিন্ন দশাকে পর্যবেক্ষণ করে মাসের হিসাব তৈরি করতে থাকে। চাঁদ ২৭.৩ দিনে একবার পৃথিবীর চারদিকে ঘুরে আসে এবং ২৯.৫ দিনে পূর্বের দশায় ফিরে আসে। তাই চাঁদের দশা পর্যবেক্ষণ করে মাসের হিসাব করা সূর্যের তুলনায় সহজ ছিল প্রাচীন লোকদের জন্য। এছাড়া মরুময় পরিবেশে চাঁদ পর্যবেক্ষণও সহজতর ছিল।অনুবাদক)। যেহেতু চাঁদের দশার সাথে ঋতু পরিবর্তনের সম্পর্ক নেই তাই চন্দ্রমাস কৃষিকাজের সময় হিসাবের ক্ষেত্রে গুরুত্বহীন যা তখনকার সময় জীবিকা নির্বাহের মূল উৎস ছিল।

আরবের বাসিন্দারা তারিখ হিসাবের ক্ষেত্রে চন্দ্রমাস ব্যবহার করত। যুদ্ধ-কলহ থেকে নিয়মিত বিরতি পাওয়ার উদ্দেশ্যে চারটি মাসকে পবিত্র বলে গণ্য করা হত। এই চার মাস যুদ্ধ নিষিদ্ধ ছিল। কিছু আরবীয় লোক বারোটি চন্দ্রমাসের সমন্বয়ে যে বছর গণনা করত তাকে সৌরবছরের সাথে সমতা বিধানের নিমিত্তে বছর শেষে নতুন বছর গণনা স্থগিত করে পুরনো বছরকে কিছুদিন দীর্ঘায়িত করত। অবশ্য কোরানে দেখা যায়, প্রাচীন আরবরা চন্দ্রবছরকে প্রকৃতির অলঙ্ঘনীয় নিয়ম বলে উল্লেখ রয়েছে। সৌরবছরের সাথে সমতা বিধানের নিমিত্তে বছরের দীর্ঘায়নকে কোরানে নিষিদ্ধ করা হয়েছে : “এই মাস অন্য মাসে পিছিয়ে দিলে তাতে কেবল অবিশ্বাসের মাত্রা বৃদ্ধি করবে। (৯:৩৭)। যে প্রভু প্রাচীন আরবীয় চন্দ্রমাস দ্বারা তারিখ গণনাকে সর্বযুগ ও পৃথিবীর সকল স্থানের জন্য আবশ্যক করে দেন তিনি নিঃসন্দেহে একজন স্থানীয় আরবীয় দেবতা। তিনি এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের স্রষ্টা নন। অথবা তিনি হয়তো স্বয়ং নবি মুহামদ। একইভাবে আরবীয়-প্রথা মক্কায় তীর্থযাত্রাকে মুসলমানদের জন্য ধর্মীয় কর্তব্যে পরিণত করা হয়েছে। সাফামারওয়ায় দৌড়ানোকে ইসলামি-প্রথায় নিয়ে আসা হয়েছে। মানুষের একটি ধর্মীয় প্রথাকে প্রাকৃতিক ঘটনার কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে কোরানে : ‘লোকে তোমাকে নূতন চাঁদ সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করে। বলো, তা মানুষের সময় ও হজের সময়-নির্দেশ করে। ( ২:১৮৯) ।

তফসির আল-জালালাইন-এ আয়াতের ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে এরকম : চাঁদের হ্রাস-বৃদ্ধি এজন্য ঘটে যাতে মানুষ শস্য রোপন ও কাটা, হজ, রোজা রাখা ও রোজা ভঙ্গ করা ইত্যাদি কাজ সম্পন্ন করতে পারে। চাঁদের বিভিন্ন দশা কৃষিকাজের ক্ষেত্রে কোনোরূপ সাহায্য করতে পারে না। চন্দ্রমাসগুলো হজ ও রোজার সময়কে নির্দেশের ক্ষেত্রে ব্যবহারের আদেশ দেয়া হয়েছে,এটি আরবে নিত্যনৈমিত্তিক কাজে ব্যবহার উপযোগী ছিল না। চাঁদের হ্রাস-বৃদ্ধির মূল কারণ হচ্ছে পৃথিবীর চারপাশে এর নিজ কক্ষপথে ঘূর্ণন এবং পৃথিবীর ঘূর্ণনের সাথে সাথে এর অবস্থান পরিবর্তন ও বিভিন্ন সময়ে পৃথিবীর সাথে সূর্যের অবস্থান। বাঁকা চাঁদ ও পূর্ণ চাঁদ হেজাজ ও নেজদ অঞ্চলে আরবদের বাস শুরু করার হাজার বছর আগে থেকে মানুষের কাছে দৃশ্যমান ছিল। এমন কী, যখন মানবজাতির জন্ম হয়নি তখনও চাঁদের এই হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটত। এই মহাবিশ্বের স্রষ্টা বলে কেউ থাকলে নিশ্চয়ই তিনি এ-গুলো সম্পর্কে অবগত থাকার কথা। সুতরাং তিনি এমন কোনো বাক্য উচ্চারণ করবেন না, যা কোনো ঘটনার ফলকে (হজ, রোজা) তার কারণ হিসেবে চিহ্নিত করবে।

আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে : অবিশ্বাসীরা কি ভেবে দেখে না যে, আকাশ ও পৃথিবী ওতপ্রোতভাবে মিশে ছিল? তারপর আমি উভয়কে পৃথক করে দিলাম। (সুরা আম্বিয়া : ৩০)। শুধু অবিশ্বাসী-কাফেররা নয় বরং অন্য কেউই এ-রকম ঘটনা কখনো প্রত্যক্ষ করেনি বা এ-রকম বিষয় ভেবে দেখারও কোনো কারণ ঘটেনি। যারা কাফের নয় তাদের কাছেও আয়াতটি সহজবোধ্য নয়। আকাশ ও পৃথিবী সংযুক্ত ছিল-এরকম বক্তব্য থেকে কেউ কেউ আজকের যুগে বিগব্যাং থিওরির সাথে মিলিয়ে দিতে চান। এই আয়াতে স্পষ্টভাবে পৃথিবীর কথা হয়েছে, কিন্তু পৃথিবীর উদ্ভব ঘটেছে বিগব্যাং-এর প্রায় হাজার কোটি বছর পরে। তাই এই আয়াত বরং আমাদেরকে পৃথিবী-কেন্দ্রিক মহাবিশ্বের ধারণার ইঙ্গিত দেয়।-অনুবাদক)

—————————-

পাদটীকা

৭৮. পারস্যের প্রখ্যাত সুফি কবি মাহমুদ শাবেস্তারি। উত্তর-পশ্চিম ইরানের শহর তাবরিজে তিনি জন্মগ্রহণ করেন ১২৮৮ খ্রিস্টাব্দে এবং মৃত্যুবরণ করেন ১৩৪০ খ্রিস্টাব্দে। আনুমানিক ১৩১১ খ্রিস্টাব্দের দিকে সুফিবাদ নিয়ে তাঁর অনবদ্য কাব্যরচনা গুলশান-ইরাজ ইংরেজিতে অনূদিত হয়েছে লন্ডন থেকে ১৮৮০ foëTo “The Rose-Garden of Mysteries’ শিরোনামে। ইংরেজি SERTT q=I& T°iYT E : Edward Henry Whinfield

৭৯. প্রথম সুরা ফাতিহায় পরম করুণাময় পরম দয়াময় আল্লাহর নামে’বাক্যকে একটি আলাদা আয়াত হিসেবে গণনা করা হয়েছে, অন্য সুরাগুলোর ক্ষেত্রে তা করা হয়নি। সুরা ফাতিহায় আরও ছয়টি ছোট আয়াত রয়েছে।

৮০. আরবি মারহানিশব্দটিকে পুনরাবৃত্তি হিসেবে অনুবাদ করা হয়েছে। এটা একটা অস্পষ্ট অনুবাদ। শব্দটি কোরানের অন্য দুটি আয়াতেও এসেছে; যথা সুরা হিজরের আয়াত ৮৭ সুরা জুমারের আয়াত ২৩। এই অনুবাদ নিয়ে ভিন্নমত রয়েছে। একটি ধারণা মতে, এই শব্দের অর্থ হচ্ছে আয়াতসমূহ দুইবার অবতীর্ণ হয়েছে এবং অন্য ধারণা মতে কিছু আয়াতকে প্রার্থনার সময় বারবার ব্যবহার করার কথা বলা হয়েছে। অবশ্য অন্য আরেকটি মতে, এর অর্থ হচ্ছে প্রশংসা করা।

৮১. কুরাইশ বংশের বানু সাহম গোত্রের আমর ইবনে আল-আস মিশর দখল করে প্রথম শাসক হয়েছিলেন। আবু মুসা আলআশারি ছিলেন ইয়েমেনের বাসিন্দা। পরবর্তীতে বসরার গভর্নর নিযুক্ত হন এবং খুজেস্তান দখল করেন। ৬৫৭ খ্রিস্টাব্দে হজরত আলি ও মুয়াবিয়ার মধ্যে সিরিয়ার সিফিফন প্রান্তরে সংঘটিত যুদ্ধ সমাপ্তির জন্য মধ্যস্থতা করেন আমর ও আশারি। আমর ইবনে আল-আস ছিলেন মুয়াবিয়ার পক্ষে এবং আশারি ছিলেন হজরত আলির পক্ষে। দক্ষিণ জর্দানের নিকটবর্তী শহর পেত্রার কাছে আধরুতে বৈঠকে বসেন আমর এবং আশারি। আমর যুদ্ধ বন্ধের জন্য আলি ও মুয়াবিয়া উভয়কে অযোগ্য ঘোষণা করতে আশারিকে প্ররোচিত করেন এবং আশারিও সেই বক্তব্যে সায় দেন। কিন্তু পরে আমর ইবনে আল-আস মুয়াবিয়ার পক্ষ নিয়ে কেবল আলিকে অযোগ্য ঘোষণা করেন।

৮২. বাতিল হওয়া আয়াতের মধ্যে রয়েছে সুরা বাকারার ২৪০ নম্বর আয়াত। এটি কোরানে বিধবাদের উত্তরাধিকার সম্পর্কিত বিধান। এর স্থলে নাজিল হয়েছে সুরা নিসার ১২ নম্বর আয়াতটি। আবার সুরা নিসার ১৯ নম্বরআয়াতটি বাতিল করে নাজিল হয়েছে সুরা নুরের ২ নম্বর আয়াত। এটি নারীদের ব্যভিচারের সম্পর্কিত কোরানের বিধান। মাদক গ্রহণ সম্পর্কিত বিধান সুরা বাকারার ২১৯ নম্বর আয়াত বাতিল করে প্রতিস্থাপিত হয়েছে সুরা মায়িদার ৯১ নম্বর আয়াত।

৮৩. খলিফার দাবি নিয়ে মধ্যস্থতার চুক্তি অনুমোদন করায় আলির পক্ষ থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নেয় খারিজিরা। ৬৫৭ খ্রিস্টাব্দে আনুষ্ঠানিকভাবে তারা আলির দল থেকে বেরিয়ে পড়ে। খারিজিদের মতে, একজন কালো ক্রীতদাসও যদি সবচেয়ে ধাৰ্মিক মুসলমান হয়, তবে তাকেই ইমামের (মুসলিম সমাজের নেতা) মর্যাদা দেয়া উচিত। আবার যে মুসলমান গুরুতর অপরাধ করে তার ইমান নষ্ট হয়ে যায়, তাকে কৃতকর্মের জন্য ইহজগতেই শাস্তি পেতে হবে। খারিজিদের কিছু গোষ্ঠী এখনো ওমান ও আলজেরিয়ায় বসবাস করে।

৮৪. মরজিতি সম্প্রদায় বিশ্বাস করতেন একজন মুসলমানের ইমানের নিষ্ঠতা কেবলমাত্র আল্লাহই বিচার করতে পারেন। এমন কী মুসলমান অপরাধীদের সাজার জন্য শেষ বিচারের দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করা উচিত অথবা আল্লাহর উপর ছেড়ে দেয়া উচিত। মরজিতি গোষ্ঠী উমাইয়া খলিফাদের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেছিলেন কেননা তাদের মতে, উমাইয়া খলিফারা পাপী হলেও প্রতিষ্ঠিত শাসক ছিলেন।

৮৫. মুতাজিলারা ইসলামের মধ্যে যুক্তিবাদী ধর্মীয়-সম্প্রদায় হিসেবে পরিচিত। মুতাজিলাদের মতে, স্ৰষ্টা বা আল্লাহর কেবল প্রয়োজন রয়েছে বলেই তাঁর অস্তিত্ব রয়েছে। মানুষ স্বাধীন ইচ্ছার অধিকারী এবং কোরান অনাদিকাল থেকে রচিত নয়, মুহাম্মদের জীবনকালে আল্লাহ কর্তৃক কোরান রচিত হয়েছে। আব্বাসীয় খলিফা আল-মামুন (৭৮৬-৮৩৩ খ্রিস্টাব্দ), আল-মুতাসিম বিল্লাহ (৭৯৬-৮৪২ খ্রিস্টাব্দ), এবং তাঁর পুত্র আল-ওয়াতিক (৮১৬-৮৪৭ খ্রিস্টাব্দ) তাঁদের শাসনামলে মুতাজিলাদের ধর্মতত্ত্বের পাশাপাশি যুক্তিবিদ্যা, দর্শন চর্চায় উৎসাহ প্রদান করেন এবং মুতাজিলা-বিরোধী বিচারক ও সরকারি কর্মকর্তাদের ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দিতে শুদ্ধি-অভিযান পরিচালনা করেন। মুতাজিলাদের মধ্যে সর্বশেষ এবং সর্বশ্রেষ্ঠ পণ্ডিত হিসেবে বিবেচনা করা হয় পারস্যের আল-জামাখশারিকে (১০৭৫-১১৪৪? খ্রিস্টাব্দ)।

৮৬. ইরাকের বসরায় জন্মগ্রহণকারী সুন্নি ধর্মতাত্ত্বিক আবুল হাসান আলি ইবনে ইসমাইল আল-আশারির (৮৭৪-৯৩৬ খ্রিস্টাব্দ) অনুসারীদের আশারিয়া বলা হয়। ইসমাইল আল-আশারি তরুণ বয়সে মুতাজিলা মতাদর্শের অনুসারী ছিলেন। ছাত্রজীবনে প্রখ্যাত মুতাজিলা শিক্ষক আল-জুব্বায়-এর ছাত্রও ছিলেন। পরর্তীতে তিনি যুক্তিবাদী দৃষ্টিভঙ্গি ত্যাগ করে সুন্নি ইসলামের রক্ষণশীল মতাদর্শ গ্রহণ করেন। তিনি মানুষের স্বাধীন ইচ্ছা ও বৈজ্ঞানিক কার্যকারণে অবিশ্বাসী হয়ে নিয়তিবাদ এবং আল্লাহ কর্তৃক অবিরাম সৃষ্টিতে বিশ্বাসী হয়ে ওঠেন। যুক্তি ও দর্শনের চর্চাকে তিনি কুফরি বিদ্যা বলে অভিহিত করেন। তাঁর অনুসারীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য

৮৭. কোরানের আয়াত ও ইসলামি আইন-প্রথাসমূহের গৃঢ় অর্থ অনুসন্ধানে নিয়োজিত ব্যক্তিদের হেয় করতে মধ্যযুগে কট্টরপন্থী ইসলামি চিন্তাবিদরা এই পরিভাষাটি ব্যবহার করতেন। যদিও খ্রিস্টীয় দশম শতাব্দীর পূর্বে এই শব্দটি আধ্যাত্মিক সাধক সুফিদের জন্য প্রযোজ্য ছিল। পরবর্তীতে ইসমাইলি শিয়া গোষ্ঠী যেমন পূর্ব আরবের কারমাতি গোষ্ঠী, মিশরের ফাতেমি রাজবংশ, সম্বোধন করা হতো।

পরবর্তী প্রজন্ম

পঞ্চম অধ্যায় : মুহাম্মদের পর : পরবর্তী প্রজন্ম

হিজরি ১১ সালে (আনুমানিক ৮ জুন ৬৩২ খ্রিস্টাব্দ) যে উজ্জ্বল তারকা আরব-জগতে ২৩ বছর ধরে জ্বলজ্বল করছিল তা অবশেষে অস্তমিত হয়ে গেল। মুহাম্মদের মৃত্যুর পর আনসারদের মাঝে প্রবল বিক্ষোভের সৃষ্টি হয় নবির মরদেহ ঠাণ্ডা হবার আগেই বানু সায়েদা সভাকক্ষে আনসাররা জমায়েত হলেন। তাঁরা আওয়াজ তুললেন, “আমাদের জন্য একজন আমির, তোমাদের জন্য আরেক আমির। এর ফলে যা হবার তাই হল। মক্কা থেকে আসা মুহাজির এবং মদিনার স্থানীয় বাসিন্দা যারা ইসলাম গ্রহণ করেন, তাদের মধ্যে বিরোধ চরমে পৌছায়। ইসলামের ইতিহাস পাঠ করলে এটা পরিষ্কার জানা যায় যে, নবির মৃত্যুর পর মুসলমানদের মধ্যে পর্যায়ক্রমিক ক্ষমতার লড়াই দানা বাঁধে। এই ক্ষমতার সংগ্রামে ‘ধর্ম ব্যবহৃত হয়েছে হাতিয়ার হিসেবে।

নবুওতি লাভের পর মুহামদ মক্কায় অবস্থান করেন তের বছর। এরপর তিনি চলে যান মদিনায়। এই তের বছর মুহাম্মদ মূলত আধ্যাত্মিক কাজে ব্যস্ত ছিলেন। এ-সময় কোরানের যে আয়াতগুলি নাজিল হয় তার সবই ছিল ধর্মোপদেশ, পথনির্দেশ এবং উত্তম কাজ করার আবেদন, যাতে করে মক্কাবাসীরা অসৎ কর্ম থেকে বিরত থাকে। মদিনায় হিজরতের পর এ-ধরনের নৈতিকতাভিত্তিক এবং আধ্যাতিকধর্মী আয়াত নাজিল হওয়া কমে যায়। এর বদলে মদিনার আয়াতগুলোতে প্রধানত গুরুত্ব পায় আদেশ-নিষেধ এবং আইন। আল্লাহ এই আয়াতগুলি তখনকার মদিনার মুসলমানদেরকে তাদের শক্রর বিরুদ্ধে সুসংহত ও শক্তিশালী করার জন্য প্রেরণ করেন। ফলে মাদানি আয়াতের মাধ্যমে মুহাম্মদ এক নতুন সমাজের ভিত্তি স্থাপনে সচেষ্ট হন। মদিনার অনুকূল পরিস্থিতির জন্য নবি মুসলমানদের এক নতুন সমাজ সৃষ্টিতে সফল হন।

কোরান এবং মুহাম্মদের জীবনযাপন থেকে এটা পরিষ্কার যে, মক্কা ও মদিনার পরিস্থিতি ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। কিন্তু তা যাই হোক সব কিছুর পিছনে মুহাম্মদের একটি উদ্দেশ্য ছিল, আর তা হল ইসলাম প্রতিষ্ঠা করা। অবশেষে মদিনায় এক ইসলামি রাষ্ট্র সৃষ্টির মাধ্যমে তিনি তাঁর আজন্ম লালিত লক্ষ অর্জন করেন। নবি কৌশলী হয়েছেন, শক্তি প্রয়োগ করেছেন, রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড ঘটেছে, রক্তপাত হয়েছে। এই যাবতীয় কার্যক্রমের মাধ্যমে তিনি তাঁর উদ্দেশ্য পূরণ করেছেন। এ- হলো ইসলাম প্রতিষ্ঠা করা, ইসলামকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। কিন্তু নবির মৃত্যুর পরে ইসলাম প্রতিষ্ঠার উদ্দীপনা অনেকাংশে ধাক্কা খায়। নেতৃত্বের উচ্চাকাঙ্ক্ষা তখন হয়ে ওঠে প্রধান উদ্দেশ্য। তথাপি সবকিছুর মূলে রয়েছে ইসলাম, এবং ইসলাম ছাড়া যে কোনো কিছুই টিকে থাকবে না তাও সবাই বুঝলেন। তাই নবি- পরবর্তী সবাই ইসলামকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে থাকতে সচেষ্ট হলেন। সে জন্য পরবর্তী প্রায় ১২ বছর ইসলামের বিধান এবং নবির রীতিনীতি খুব কড়াকড়িভাবে মেনে চলা হত। এই সময়টা ছিল দুই খলিফার ; যথাক্রমে হজরত আবু বকর (হিজরি ১১ বা ৬৩২ খ্রিস্টাব্দ থেকে হিজরি ১৩ বা ৬৩৪ খ্রিস্টাব্দ) এবং হজরত ওমর (হিজরি ১৩ বা খ্রিস্টাব্দ ৬৩৪ থেকে হিজরি ২৩ বা ৬৪৪ খ্রিস্টাব্দ) । কিন্তু নবির মৃত্যুর পর যত দিন যেতে লাগল তত ইসলামকে হাতিয়ার হিসেবে গণ্য করা হতে লাগল এবং ইসলামের লক্ষ থেকে সবাই দূরে সরে যেতে থাকলেন। ইসলাম ব্যবহৃত হতে থাকল নেতৃত্ব ও শাসন ক্ষমতা দখলের জন্য।

নবি মুহাম্মদ যখন মারা যান তখন মদিনার আনসারদের খাজরাজ গোত্রের নেতা ছিলেন সাদ বিন ওবায়দা। তিনি সমগ্র মুসলিম সমাজের নেতৃত্ব নিতে সচেষ্ট হলেন। কিন্তু ওমর ছিলেন অতিশয় দক্ষ ও কুশলী। তিনি অবিলম্বে আবু বকরকে নেতা ঘোষণা করে সাদ বিন ওবায়দার স্বপ্নকে অস্কুরেই বিনষ্ট করে তাঁকে বিস্মৃতির অতলে পাঠিয়ে দিলেন। আবু বকর নেতা হওয়ার পরও কখনো ভুলে গেলেন না ওমরের ঋণ। তিনি নেতৃত্ব নেবার পরপরই ঘোষণা দিলেন, নেতৃত্ব হচ্ছে নবির উত্তরাধিকারী হওয়া – যার নাম হচ্ছে খেলাফত। আবু বকর সুপারিশ করলেন যে তাঁর পরে খলিফা হবেন ওমর। ওমর খলিফা হবার পর মনে মনে ঠিক করেছিলেন তাঁর মৃত্যুর পর খলিফা হবেন আব্দুর রহমান বিন আউফ। তথাপি ওমর যখন ছুরিকাহত হয়ে মৃত্যুশয্যায় শায়িত, তখন তিনি তাঁর উত্তরাধিকারী মনোনীত করার জন্য ছয় সদস্য বিশিষ্ট একটি পরিষদ গঠন করেন। সেই পরিষদ হজরত উসমানকে খলিফা নির্বাচিত করেন। হিজরি ৩৫ (৬৫৬ খ্রিস্টাব্দ) সালে উসমান আততায়ীদের হাতে খুন হবার পর তাঁর খেলাফতের অবসান ঘটে। সুষ্ঠুভাবে রাজত্ব চালাবার জন্য খলিফা উসমান হজরত আলির কাছে আনুগত্য কামনা করেন। কিন্তু উসমানকে তাঁর পাঁচ বছরের খেলাফতের পুরোটাই কাটাতে হয়েছে গৃহযুদ্ধ সামলাতে। যেমন জামালের যুদ্ধ, সিফিফনের যুদ্ধ এবং নাহরাবানের যুদ্ধ। এ-সময় কুরাইশ বংশের মুয়াবিয়া বিন সুফিয়ান এবং কুরাইশ বংশের বানু শাহম গোত্রের আমর ইবনে আল-আস খলিফা উসমানের শক্র হয়ে পড়েন। তাই উসমানকে রাজত্ব চালানোর পাশাপাশি এই দুই গৃহশক্রকেও মোকাবেলা করতে হয়। শক্ৰদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ-চলাকালীন অবস্থায় হিজরি ৪০ সালে (৬৬১ খ্রিস্টাব্দ) জন্য প্রচণ্ড উন্মাদনা শুরু হয় তার প্রমাণ পাওয়া যায় তৎপরবর্তী অনেক ঘটনার মাঝে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে মুয়াবিয়ার উমাইয়া খেলাফতের পত্তন এবং তাঁর উত্তরাধিকারগণ, হিজরি ৬১ (৬৮০ খ্রিস্টাব্দ) সালে মুয়াবিয়া পুত্র ইয়াজিদের হাতে আলির পুত্র হোসেনের মৃত্যু, হিজরি ৬১ (৬৮০ খ্রিস্টাব্দ) সালে আব্দুল্লাহ বিন জুবায়েরের সাথে যুদ্ধে কাবাকে অপবিত্র করা, হাশেমি গোত্রের প্রবল প্রচারণার মুখে উমাইয়া খেলাফতের পতন এবং আব্বাসিয়াদের খেলাফত দখল, পশ্চিমাঞ্চলে প্রতিদ্বন্দী ফাতেমি বংশের ক্ষমতা দখল, এবং পূর্বাঞ্চলে বিপ্লবী ইসমাইলি আন্দোলন। ইসমাইলি আন্দোলন তুঙ্গে উঠে যখন হিজরি ৬৫৬ (১২৫৮ খ্রিস্টাব্দ) সালে মঙ্গলীয় বাহিনী হালাকু খানের নেতৃত্বে বাগদাদ দখল করে আব্বাসিয়া খেলাফতের পতন ঘটায়।

প্রশ্ন ওঠে নবি মুহাম্মদ আধ্যাতিক ও ধর্মীয় অনুপ্রেরণার ভিত্তিতে যে ইসলামি রাষ্ট্রের গোড়াপত্তন করেন তাঁর মৃত্যুর পর সেই রাষ্ট্র কেমন করে চালানো হল? নবির কি উচিত ছিল না তাঁর উত্তরাধিকার মনোনীত করে যাওয়া, যাতে করে নতুন মুসলিম সমাজ জানতো তাদের প্রধান দায়িত্বসমূহ কী কী হবে? আরও কিছু প্রশ্ন আছে এর সাথে, যেমন নবির সহচরদের কী উচিত ছিল না যেভাবেই হোক নবির উত্তরাধিকারী কে হবে সে- ব্যাপারে একটা সমঝোতায় আসা? যেহেতু নবুওতি হচ্ছে আল্লাহ প্রদত্ত, তাই ভবিষ্যতে মুসলমানদের আধ্যাতিক নেতৃত্ব কী ক্ষমতা দখলে জড়িয়ে পড়বে? নবি যদি নিজেই তাঁর উত্তরাধিকারী ঠিক করে যেতেন তবে কাকে তিনি মনোনীত করতেন? আলি ছিলেন নবির চাচাতো ভাই, একই সাথে তাঁর মেয়ে ফাতেমার স্বামী, এবং হাশেমি গোত্রের প্রথম পুরুষ যিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। এছাড়াও আলি ছিলেন একজন অসীম সাহসী যোদ্ধা ও সুদক্ষ সমরনায়ক। একাধিকবার বিপদে আলি নবির জীবন রক্ষা করেছেন। নবির কি উচিত ছিল না আলিকে তাঁর স্থলাভিষিক্ত মনোনীত করে যাওয়া? আবু বকর ছিলেন উচ্চপদাধিষ্ঠিত। লুকিয়ে মদিনা যাবার পথে মুহাম্মদ একদা গুহায় আশ্রয় নেন। আবু বকরও সেই রাতে মুহাম্মদের সাথে গুহায় থেকেছেন। ইসলামের প্রথম যুগে আবু বকর ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়ে ইসলামের জন্য বয়ে আনেন প্রচুর সমান। এছাড়াও আবু বকর তাঁর সুন্দরী কন্যা আয়েশাকে বিয়ে দিয়েছেন নবির সাথে। মুহাম্মদর কি উচিত ছিল না আবু বকরকে তাঁর উত্তরাধিকারী মনোনীত করে যাওয়া? ওমর ছিলেন এক সুদৃঢ়, একনিষ্ঠ, ও সূক্ষ্ম বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তি। ইসলামের রক্ষাকর্তা হিসেবে ওমর ছিলেন আপোষহীন। রাজনীতিতেও তিনি ছিলেন দক্ষ। নবি কি কখনও চিন্তা করেছিলেন যে ওমরই হবেন তাঁর যোগ্যতম উত্তরাধিকারী? মুহামদ মদিনাতে নবুওতি পালন করলেন দশ বছর। এই সুদীর্ঘ দশ বছরে তিনি কেন উত্তরাধিকারী সম্পর্কে চিন্তাভাবনা করলেন না? যে নবি এত দূরদর্শী এবং রাজনৈতিক বিচক্ষণসম্পন্ন ছিলেন, যিনি শূন্য থেকে নিজের একক প্রচেষ্টায় মদিনাতে মুসলিম- সমাজের ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন আমরা কী চিন্তা করতে পারি সেই নবি উত্তরাধিকারী মনোনয়নের মতো এতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি অবহেলা করে যাবেন? মৃত্যুর আগে নবি ইসলামকে আরব জাতীয়তাবাদ বলে নির্ধারিত করেছিলেন এবং বলে ছিলেন যে আরবে ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো ধর্ম থাকবে না। সেই নবিই কেমন করে তাঁর সদ্যভূমিষ্ঠ ইসলামি রাষ্ট্রের বলাবাহুল্য, এই ধরনের অনেক প্রশ্নই আমাদের মনে জাগে। কিন্তু প্রশ্নগুলোর কোনো উত্তর কোনোদিনও পাওয়া যাবে না। ফলে এ-বিষয়ে আমরা যা যা জানতে পাই তা শুধুমাত্র অনুমান ছাড়া আর কিছু নয়। নবি পরবর্তী ইসলামের যে দ্বন্দু দেখা দিয়েছিল তার প্রধান কারণ হচ্ছে এই উত্তরাধিকারের বিষয়টি।

আমরা হয়তো নিশ্চিতভাবে বলতে পারি নবি তাঁর উত্তরাধিকার নির্ধারণের জন্য কোনো স্থির সিদ্ধান্ত নেননি। কথিত আছে হিজরি ১০ সালে (৬৩২ খ্রিস্টাব্দ) নবি বিদায় হজের পর যখন মদিনায় ফিরছিলেন তখন গাদির আল খুম নামের এক জলাধারের (কেউ কেউ বলেন কৃপ) কাছে যাত্রাবিরতি দেন এবং আলির হাত ধরে বললেন, “আমি যাদের বন্ধ (অভিভাবক) আলিও তাদের বন্ধু ( অভিভাবক) । উল্লেখ্য মাওলা’ শব্দের আক্ষরিক অর্থ হচ্ছে নিকটে আসা, এর আরও দুটি অর্থ রয়েছে, অভিভাবক বন্ধু এবং আশ্রিত ব্যক্তি। শিয়ারা মনে করেন যে ওই বাক্য দ্বারা নবি আলিকে তাঁর স্থলাভিষিক্ত নিয়োজিত করে গিয়েছেন। ( কোনো কোনো মুসলিম পণ্ডিতের তফসিরে (যেমন তফসির

হিসেবে আলিকে মনোনীত করে ছিলেন। কিন্তু উপযুক্ত সময়ের অপেক্ষায় তিনি এ-ঘোষণাটি স্থগিত রেখেছিলেন, যাতে ভুল বোঝাবুঝি না হয়। (*Ră : Saiyid Safdar Hosain, The Early History of Islam, Low Price Publications, Delhi, (First Published 1933), 2006, page 235) । শিয়াদের মধ্যে কেউ কেউ হজরত আলিকে নবির উত্তরাধিকার হিসেবে মনোনয়নের ব্যাপারে সুরা ইনশিরাহ এর ১- ৮ নম্বর আয়াতের দিকে নির্দেশ করেন। যদিও এই সুরায় আলিকে সরাসরি মুহাম্মদের পরবর্তী নেতা হিসেবে ঘোষণা করা হয়নি, শুধুমাত্র নবিকে ভারমুক্ত করার কথা বলা হয়েছে।অনুবাদক) সুন্নিরা অবশ্য তা অস্বীকার করেন। সুন্নিরা বলেন, নবি যদি এই বাক্য বলে থাকেন তবে তা বলেছিলেন ইসলামের প্রতি আলির একনিষ্ঠতা আর সেবার প্রতি প্রশংসা করে। আলি যে ইসলামের একনিষ্ঠ সেবক ছিলেন তা সকল মুসলিমই স্বীকার করেন। এখানে এটাও বলা যেতে পারে যে, আলিকে উদ্দেশ্য করে ওই বাক্যকে যদি নবির উত্তরাধিকারী মনোনয়নের সিদ্ধান্ত বলে ধরা হয় তবে নবি অসুস্থ থাকাকালীন সময় যখন আবু বকরকে নামাজের ইমামতি করতে আদেশ দেন, সেই উদাহরণটাও বলতে হয় নবির সিদ্ধান্ত ছিল যে আবু বকর হবেন তাঁর উত্তরাধিকারী। খেলাফত বিষয়ে সুন্নিদের বক্তব্যকে আপাতদৃষ্টিতে যৌক্তিক মনে হলেও শিয়াদের সাথে এ-বিষয়ে অনেক বিরোধ রয়েছে। সুন্নিরা তাঁদের বক্তব্যের সমর্থনে কোরানের এই আয়াতের উদ্ধৃতি দেন: , , , আজ তোমাদের জন্য তোমাদের ধর্মকে পূর্ণ করলাম ও তোমাদের ওপর আমার অনুগ্রহ সম্পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের ধর্ম মনোনীত করলাম। তবে যদি কেউ ক্ষুধার তাড়নায় বাধ্য হয়, কিন্তু ইচ্ছা করে পাপের দিকে না ঝোঁকে (তার জন্য) আল্লাহ তো ক্ষমাশীল পরম দয়ালু। ( সুরা মায়িদা : আয়াত ৩) ।

সুন্নিরা বলেন যে এই আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ মুহামদের নবুওতির দায়িত্ব সম্পন্ন করেন এবং মুসলমানদের জন্য কোরানের নির্দেশাবলী বাধ্যতামূলক করে দেন। এই মত অনুযায়ী কোরান হচ্ছে নিখুঁত ও পূর্ণাঙ্গ। তাই মুসলমানদের জন্য মুহামদ নির্বাচিত কোনো ঐশ্বরিক ও অভ্রান্ত উত্তরাধিকারীর দরকার নাই, যা শিয়ারা বিশ্বাস করেন। সুন্নিরা আরও বলেন, যে কোনো ব্যক্তি যদি কোরানের আদেশ মানেন এবং নবির আদর্শে চলেন তবে তিনি মুসলিম সমাজের নেতৃত্ব দিতে পারেন। তাই নবির সহচরদের অধিকার আছে যাকে তাঁরা যোগ্য মনে করবেন তাকেই মুসলমানদের নেতা হিসাবে নিয়োগ করবেন। এই নেতাই মুসলিমদের কোরান এবং সুন্নাহর (নবির আচার-ব্যবহার এবং তাঁর উদাহরণ) পথে চালাবেন। সুন্নিদের এই মতবাদ কিছুটা বিশ্বাসযোগ্য হলেও বলতে হবে যে এটা বিগতকালীন ব্যাপারেও প্রযুক্ত – এর উদাহরণ। চার খলিফার আমলে এমন কিছু ঘটনা ঘটে যার ভিত্তিতে সুন্নিদের এই মতবাদ প্রসার পায়। কিন্তু মনোযোগ দিয়ে ইসলামের ইতিহাস অধ্যয়ন করলে বুঝা যাবে যে এ- বক্তব্য সঠিক নয়।

নবির মৃত্যুর সাথে সাথে বানু সায়েদার হলঘরে যে কলহের সূত্রপাত হয়, তা থেকে পরিষ্কার বুঝা যায় যে সবার মনে তখন প্রাধান্য পাচ্ছিল নেতৃত্বের আকাঙ্ক্ষা। তখন দরকার ছিল একজন উত্তরাধিকারীর যে মুসলমানদের কোরান এবং সুন্নাহর রাস্তায় এগিয়ে নিয়ে যাবেন। কিন্তু দুই পক্ষই একজন সুদক্ষ উত্তরাধিকারী নিয়োগে ব্যর্থ হয়। এই কোলাহলপূর্ণ সমাবেশে মদিনার স্থানীয় মুসলমানরা (আনসার) এবং মক্কা থেকে আগত শরণার্থীরা (মুহাজির) এই দুই পক্ষই নেতৃত্বের ব্যাপারে অগ্রাধিকার দাবি করল। আনসারদের দাবি ছিল তাঁরা নবিকে সাহায্য করেছিলেন, আর মক্কার মুহাজিররা দাবি করলেন নবির সাথে তাদের আত্মীয়তার।

এই সভায় উত্তরাধিকারী নির্বাচনের জন্য নবির নিজস্ব গোত্র, হাশেমি গোত্রের কোনো নেতা উপস্থিত ছিলেন না। নবির ভ্রাতুষ্পপুত্র আলি এবং নবির চাচা আল আব্বাস ছিলেন নবির সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ আত্মীয়। এই দুইজন সেই বৈঠকে যোগদান করেননি। মুহাম্মদ তাঁর দশজন সহচরকে (ইসলাম গ্রহণকারী প্রথম দশজন পুরুষ) বেহেশতের নিশ্চয়তা দিয়েছিলেন। বানু সায়েদার বৈঠকে সেই দশজনের মধ্যে আরও দুইজন অনুপস্থিত থাকলেন। তাঁরা হলে তালহা বিন উবায়দুল্লাহ এবং জুবায়ের বিন আওয়াম। তাঁরা ফাতেমা- আলির ঘরে নবির মৃতদেহের সৎকারের ব্যবস্থা করতে ব্যস্ত ছিলেন। এ- সময় আলিকে জানানো হয় বৈঠকে মুহাজিররা জিতেছেন। তাঁদের যুক্তি ছিল, মুহাজিররা নবির আত্মীয়। ওদের উৎস একই গাছ, আর সেই গাছ হচ্ছেন নবি । এ-কথা শুনে আলি বললেন, ‘ওরা গাছের যুক্তি দিয়েছে কিন্তু গাছের ফলের কথা ভুলে গেছে। এই সংবাদ শুনে জুবায়েরও ক্ষেপে উঠলেন। রাগতস্বরে বললেন, ‘এরা যতক্ষণ পর্যন্ত না আলির প্রতি তাঁদের আনুগত্য দিবে ততক্ষণ পর্যন্ত আমার তরবারি কোষবদ্ধ হবে না।

কুরাইশ নেতা আবু সুফিয়ান (মুয়াবিয়ার পিতা) বললেন, “ওহে আবদে মনাফের বংশধরেরা (হাশেমি এবং উমাইয়া গোত্রের সাধারণ উৎস) আজ যে মরুঝড় উঠেছে তা মিষ্টি ভাষায় শান্ত করা যাবে না। তাঁরা আবু বকরের মত নীচুগোত্রের লোককে তোমাদের নেতা নিযুক্ত করেছে। তাঁরা এতোই নীচুজাতের ব্যক্তিকে চায়, তবে আলি অথবা আল- আব্বাসকে সুযোগ দিল না কেন? মুহাম্মদের একসময়কার তীব্র বিরোধী (যিনি যুদ্ধে পরাজিত হয়ে ইসলাম কবুল করেন) আবু সুফিয়ান আলির দিকে মুখ ফিরিয়ে বললেন, আপনি আপনার হাত দিন, আমি আপনার কাছে আমার আনুগত্য জানাব। আপনি চাইলে আমি মদিনা ভরে দিব অশ্বারোহী ও পদাতিক সৈন্য দ্বারা। আবু সুফিয়ানের এই প্রস্তাব আলি প্রত্যাখ্যান করলেন।

নবি এবং ইসলামের প্রতি আলির ছিল অকৃত্রিম ও গভীর অনুরক্তি। এ- জন্য আলির নৈতিকতার মান অন্যান্য আরবের চেয়ে অনেক উপরে। এটা পরিষ্কার যে একমাত্র আলি ব্যতীত বাকি সব বিশিষ্ট কুরাইশ ব্যক্তির লোভ ছিল ক্ষমতা দখলের। এ-বিষয়টি সুদৃঢ়ভাবে প্রতিপন্ন করার জন্য তাবারির ইতিহাস থেকে এবং ইবনে হিশামের নবির জীবনী থেকে কিছু উদ্ধৃতি পুনরায় উল্লেখ করা যেতে পারে। একটি ঘটনা ছিল এ-রকম: নবির অসুস্থতার শেষ দিনে আলি নবির গৃহ থেকে চলে যান। জনসাধারণ আলিকে ঘিরে ধরেন। তাঁরা নবির স্বাস্থ্যের বিষয়ে জানতে চান। আলি উত্তর দিলেন, আল্লাহকে ধন্যবাদ, তিনি সুস্থ হচ্ছেন। তখন আলিকে একপাশে নিয়ে আব্বাস বললেন, আমার মনে হয় তিনি মৃত্যুর পথে। তাঁর মুখে আমি যা দেখেছি সেই দৃশ্য আমি আগেও দেখেছি আব্দুল মোতালেবের ছেলেদের মৃত্যুকালে। আপনি নবির কাছে যান এবং জেনে নিন তাঁর পরে কে তাঁর স্থলাভিষিক্ত হবেন। কর্তৃত্ব যদি আমাদের হাতেই রাখতে হয় তা আমাদের জানা দরকার। আর কর্তৃত্ব যদি অন্যের হাতে বর্তায় তাহলে তাঁর উচিত হবে কাউকে সুপারিশ করা। আলি উত্তরে বললেন, আমি কখনোই এ-ধরনের প্রশ্ন করব না। তিনি যদি এই ব্যাপারটা আড়ালে রাখেন, তাহলে ভবিষ্যতে কেউ আমাদের দিকে তাকাবে না।

এটা অনস্বীকার্য যে প্রথম দুই খলিফার রাজত্ব ভালই চলেছিল। দুজনের ক্ষমতায়ন প্রক্রিয়া যদিও প্রশ্নের উর্ধ্বে নয় এবং তাঁদের ক্ষমতায় আরোহণের বিষয়ে নবির সহচরদের সর্বসম্মত সমর্থন ছিল না, তথাপি সরকার চালানোর নীতিতে তাঁরা কোরান ও নবির সুন্নাহ থেকে বিচ্যুত হননি। হজরত আবু বকর এবং হজরত ওমর সৎ ছিলেন। আলি ছিলেন নবির স্থলাভিষিক্ত হবার জন্য সবচেয়ে যোগ্যতম ব্যক্তি। তথাপি আবু বকর খলিফা হলে আলি ছয় মাস পরে তাঁর আনুগত্য স্বীকার করে নেন। কিন্তু ওমর খলিফার আসনে বসলে তাঁর প্রতি আনুগত্য জানাতে তিনি কোনো দ্বিধা করলেন না। তৃতীয় খলিফা উসমানের সততা প্রশ্নের উর্ধ্বে নয়। উসমান খেলাফতকালে অনেক ক্ষেত্রেই কোরানলঙ্ঘন করেছেন ফলে সমগ্র মুসলিম সমাজে অসন্তোষ ধূমায়িত হয় এবং অচিরেই তা বিদ্রোহের রূপ নেয়।

খলিফা নির্বাচন পরিষদের সমতিক্রমেই উসমান খলিফার পদ দখল করেন, এবং তাঁর প্রতি সাধারণ জনতার সমর্থনও ছিল। তাই উসমানের খেলাফতে কিছুটা গণতন্ত্রের আভাষ পাওয়া যায়। ওমর ছয় সদস্যের এক পরিষদ গঠন করে নির্দেশ দেন তাদের মধ্যে থেকে একজনকে খলিফা মনোনীত করতে, যে তাঁর উত্তরাধিকারী হবেন। এই ছয় সদস্য ছিলেন : আলি, উসমান, তালহা, জুবায়ের, সাদ বিন আবি ওয়াক্কাস এবং আব্দুর রহমান বিন আউফ। আব্দুর রহমান প্রস্তাব দিলেন যে আলি অথবা উসমান খলিফা হবেন। আলি অনিচ্ছা প্রকাশ করলেন। তাই আব্দুর রহমান বিন আউফ উসমানের প্রতি তাঁর আনুগত্য জানালেন। তাঁর দেখাদেখি পরিষদের অন্যান্য সদস্যরাও উসমানের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করলেন। এর তিন দিন পূর্বে জনতার মতামত জানবার জন্য আব্দুর রহমান বিন আউফ এক জনমত যাচাই করেন।

উসমান জনগণের ইচ্ছায় খলিফার আসনে বসলেন। কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই দেখা গেল তাঁর শাসন- দক্ষতার মান নবির আদর্শ থেকে অনেক দূরে। উসমানের বিরুদ্ধে কমপক্ষে পঞ্চাশটি অন্যায়ের অভিযোগ উঠে। এর জন্য মূলত দায়ী ছিলেন তাঁর নিজস্ব গোত্রের আত্মীয়স্বজনরা। ব্যক্তিগতভাবে উসমান ছিলেন বিনয়ী ও সাদাসিধে। কিন্তু উসমানের বড় দুর্বলতা ছিল, তিনি তাঁর নিকট আত্মীয়দের কাকুতিমিনতি বা অনুরোধ উপেক্ষা করতে পারতেন না। খলিফা হিসেবে ওমরের চরিত্রের যে দৃঢ়তা ছিল তার সাথে উসমানের কোনো তুলনা হয় না। ওমর তাঁর সিদ্ধান্তে এতই দৃঢ় থাকতেন যে নবির কোনো সহচর পর্যন্ত ওমরকে তাঁর সিদ্ধান্ত হতে বিচ্যুত করতে পারতেন না।

খলিফা নির্বাচনে আলিই সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন। তিনি খলিফা মনোনয়ন পেলে মদিনার আমজনতা এবং নবির প্রায় সমস্ত সাহাবিরা শুভেচ্ছার সাথে তা গ্রহণ করেন। কিন্তু আলির শাসনকাল ছিল খুব স্বল্প। এই স্বল্পকালে তাঁকে তিনটি গৃহযুদ্ধের মোকাবেলা করতে হয়। আলিকে বেশ কিছু নাশকতামূলক ষড়যন্ত্র ও বিশ্বাসঘাতকতার সমূখীনও হতে হয়। এছাড়াও নবির দুই প্রবীণ সহচর যথা তালহা এবং জুবায়ের আলির প্রতি তাঁদের আনুগত্য প্রত্যাহার করে নেন। আলি যখন এই দুজনকে যথাক্রমে কুফা এবং বসরার শাসনকর্তা নিযুক্ত করতে আপত্তি জানান তখনই তাঁরা আলির বিরুদ্ধে অস্ত্ৰধারণ করেন।

এ- ধরনের প্রায় ভজন খানেক ঘটনার কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। খলিফা নিয়োগে সুন্নি- মতামত নীতিগতভাবে মেনে নিলেও ইতিহাস থেকে দেখা যায়, এটা সর্বাংশে সত্য নয় এবং এই পদ্ধতি মুসলমানদের কোনো উপকারে আসেনি। ক্ষমতা এবং সম্পদের উপর লোভের ফলে কোরান ও সুন্নাহকে বিসর্জন দেয়া হয়েছে।

একটা প্রশ্ন উত্থাপন করা যায়, নবি মুহাম্মদ কি তাঁর উত্তরাধিকারী নির্বাচনের ব্যাপারে অন্য কারো চেয়ে বেশি সক্ষম ছিলেন না? নবি মুহাম্মদ এ-বিষয়ে যে অদ্বিতীয়ভাবে যোগ্যতাসম্পন্ন ছিলেন তা আমরা নিঃসন্দেহে বলতে পারি। কারণ মুহাম্মদ নবুওতির গুণে গুণান্বিত ছাড়াও নৈতিক ও আধ্যাত্মিক জ্ঞানে তাঁর সমসাময়িকদের চেয়ে শীর্ষে ছিলেন। তিনি ছিলেন ইসলামের জন্য নিবেদিত প্রাণ। মানবচরিত্র এবং তাঁর সহচরদের মানসিকতা সম্পর্কে তাঁর ছিল গভীর জ্ঞান। তিনি যখন ক্ষমতার তুঙ্গে, তখন তাঁর সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করার সাহস কারো ছিল না। এতো অবাধ ক্ষমতার অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও নবি তাঁর উত্তরাধিকারী মনোনয়নের বিষয়ে নীরব রইলেন। প্রশ্ন হচ্ছে, কেন তিনি নীরব ছিলেন? তাঁর উত্তরাধিকারী নিয়োগের মতো এতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টিকে তিনি কি চিন্তা-ভাবনায় আনেননি? অথবা তিনি কি জানতেন যে তিনি আরও অনেক দিন বাঁচবেন তাই উত্তরাধিকারী মনোনয়নের সময় আসেনি?

নবির অসুস্থতার সময় বয়স ছিল ৬৩ বছর। এটা তেমন বৃদ্ধ- বয়স নয়। তাঁর অসুস্থতা ছিল অল্পদিনের। এই অসুস্থতাকালীন ঘটনাবলী থেকে মনে হয়, নবি তাঁর অসুস্থতাকে মারাত্মক ভাবেননি। শেষ দিন পর্যন্ত তিনি ভেবেছিলেন কিছুদিনের মধ্যেই সুস্থ হয়ে উঠবেন। তাই হয়তো নবি তাঁর অসুস্থতার প্রথম দিনে স্ত্রীগণকে জানালেন, তিনি আয়েশার গৃহে সেবা-শুশ্রুষা পেতে চান। সেই সময় আয়েশা শিরঃপীড়ায় ভুগছিলেন। তাই রসিকতা করে নবি আয়েশাকে বললেন, ‘তুমি কি আমার আগেই মারা যেতে চাও যাতে করে আমাকে তোমার লাশ ধুতে হয় এবং দাফন করতে হয়?’ আয়েশাও রসিকতা করে জবাব দিলেন, তাহলে তো আপনি নির্বিঘ্নে আমার গৃহেই আপনার অন্যান্য স্ত্রীর সাহচর্য পেতে পারবেন। এ- থেকে বুঝা যায়, নবি ভেবেছিলেন তাঁর অসুখ তেমন মারাত্মক নয়।

এই অনুমানের সমর্থনে আরও কিছু ঘটনার কথা উল্লেখ করা যায়। রোগাক্রান্ত হবার শুরুর দিকে নবি সিরিয়ার খ্রিস্টান- আরবদের আক্রমণ করার জন্য এক সেনাবাহিনী গঠনের কাজে ব্যস্ত ছিলেন। এই আক্রমণকারী বাহিনীর সেনাপতি হিসেবে নবির মুক্তক্রীতদাস ও পালকপুত্র জায়েদ বিন হারিসের পুত্র বিশবছর বয়স্ক ওসামাকে মনোনীত করেন। এই সিদ্ধান্তে মুসলিম সৈন্যদের মাঝে অসন্তোষ দেখা দেয়। কারণ মুহাজির ও আনসারদের মাঝে বেশ কয়েকজন ঝানু সেনানায়ক ছিলেন যারা ওসামার পদটি পাবার জন্যে আগ্রহী ছিলেন। তবে অসন্তোষের খবর পেয়ে নবি ক্রুদ্ধ হোন। মসজিদের বেদিতে দাঁড়িয়ে নবি ঘোষণা দেন, এই ধরনের অসন্তোষ অবাধ্যতারই নামান্তর। তিনি আরও বলেন, ওসামার নিয়োগ সবচেয়ে উত্তম সিদ্ধান্ত। নবির এই ঘোষণা প্রকাশের পর অসন্তোষ- প্রকাশকারীরা চুপ হয়ে যান। এ-ঘটনা হতেও প্রতীয়মান হয় মুহাম্মদ ভেবেছিলেন তাঁর অসুস্থতা সাময়িক এবং আশা করছিলেন দ্রুত সেরে উঠবেন।

এই ঘটনার পক্ষে আরও একটি বিষয়ের উল্লেখ করতে হয়, যা উত্তরাধিকারী নির্ণয়ের চাইতে কোনো অংশে কম গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। তখনও নবি নিজস্ব তত্ত্বাবধানে কোরান সংগ্রহ ও সম্পাদনার কাজে হাত দেননি। কোরান হচ্ছে মুহাম্মদের নবুওতির হুকুমনামা এবং মুসলিমদের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ। মুহাম্মদের মৃত্যুকালে কোরান এককভাবে সংগৃহীত ছিল না। সে- সময় কোরান মুহাম্মদের বিভিন্ন সহচর ও ওহি লেখকদের মাঝে বিক্ষিপ্ত ছিল। মুহাম্মদের মৃত্যুর পর ইসলাম-বিশারদ এবং কোরান বর্ণনাকারীদের মধ্যে প্রচুর তফাৎ দেখা দেয়। এ-সমস্যা সৃষ্টি হত না, যদি মুহামদ তাঁর জীবদ্দশায় কোরান সংকলনের কাজটি সম্পন্ন করে যেতেন। বর্তমানে কোরানের আক্ষরিক ব্যাখ্যা নিয়ে যে সমস্যা আছে, তাও থাকত না। কোরানের যে- সব আয়াত রহিত হয়েছে কিংবা যে- সব আয়াত অন্য আয়াতকে রহিত করেছে সেগুলোকেও সহজে সনাক্ত করা যেত। সর্বোপরি কোরানকে সাজানো যেত সুরা এবং আয়াতের নাজিল হওয়ার কালক্রম অনুযায়ী। প্রচলিত আছে যে, হজরত আলি কালক্রম অনুযায়ী কোরানের একটি সংকলন করেছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে এটি সংরক্ষণ করা হয়নি।

মুহাম্মদের দুইজন ওহি লেখকের অন্যতম ছিলেন জায়েদ বিন সাবিত। কথিত আছে জায়েদ একবার বলেছিলেন : আবু বকর আমাকে ভেকে পাঠালেন এবং বললেন, ‘অনেকদিন যাবত ওমর আমাকে চাপাচাপি করছেন কোরান সংগ্রহ এবং সংকলিত করার জন্য। কিন্তু আমি এ ব্যাপারে নারাজ। কারণ কোরান সংকলন যদি এতোই প্রয়োজনীয় ছিল তবে নবি নিজেই এ ব্যাপারে উদ্যোগী হতেন। কিন্তু ইয়ামামার যুদ্ধে নবির অনেক সহচর মারা গেলেন। এদের অনেকেই কোরানের বিভিন্ন আয়াত মুখস্ত করে রেখেছিলেন। তাঁদের মৃত্যুর সাথে তাঁরা কোরানও নিয়ে গেলেন কবরে। তাই আমি এখন কোরান সংকলনের ব্যাপারে ওমরের সাথে একমত।”

এখানে উল্লেখ করা দরকার যে ওমর কোরান সংকলনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন এবং এ- জন্য খলিফা আবু বকরকে প্ররোচিত করেন। এরপরও কোরান সংকলন করতে অনেক দিন পার হয়। উসমান কোরান সংকলনের জন্য একটি কমিটি করেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই কমিটি যে কোরান সংকলন করেন তা কালক্ৰমানুযায়ী হয়নি। এমন কী এই কমিটি হজরত আলি এবং বিশিষ্ট সাহাবি আব্দুল্লাহ ইবনে মাসুদের কাছে যে কোরান ছিল তা ধর্তব্যেও আনলেন না।

উসমানের কমিটির প্রণীত কোরানের সূরাগুলির দৈর্ঘ্য অনুযায়ী সাজালেন। বেশি দৈর্ঘ্যের সুরাগুলি আগে (সুরা ফাতিহা বাদে) এবং স্বল্প দৈর্ঘ্যের সুরাগুলি শেষে। এ-ধরনের বিন্যাস একেবারে অপ্রয়োজনীয়। কারণ যুক্তি অনুযায়ী মক্কি সুরাগুলি আসা ছিল কোরানের প্রথম দিকে এবং মাদানি সুরাগুলি থাকা উচিত ছিল শেষের দিকে। কিন্তু উসমানের কোরান- সংকলন কমিটি মক্কি সুরার মাঝে মাদানি সুরা আর মাদানি সুরার মাঝে মক্কি সুরা মিলিয়ে কোরানের বিন্যাস করলেন। যাহোক, নবির মৃত্যু হয়েছিল অকস্মাৎ, ফলে তিনি কোরান সংকলন ও সম্পাদনার সময় পাননি।

অনেকের ধারণা, অসুস্থতার শেষের দিন নবি বুঝতে পেরেছিলেন তাঁর অসুখ মারাত্মক। সে দিন ২৮শে সফর হিজরি ১১ অথবা ১৩ই রবিউল আওয়াল, ইংরেজি ৮ই জুন ৬২৩ সন। এ-দিন জ্বরের তীব্রতা বেড়ে গেলে নবি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। যখন জ্ঞান ফিরে আসে তখন তাঁর কাছে পরিষ্কার হল, তাঁর আর বেশি সময় নেই। তাই আশেপাশের সকলকে কাছে আসতে বললেন এবং এক দোয়াত কালি এবং এক খণ্ড কাগজ দেয়ার কথা বললেন : ‘আমি তোমাদের জন্যে কিছু লিখতে চাই (অথবা কাউকে দ্বারা লিখাতে চাই) । এটা করা হলে ভবিষ্যতে তোমরা বিপথে যাবে না। দুর্ভাগ্যবশত নবির শেষ ইচ্ছা পূরণ হয়নি। যারা নবির নিকটে ছিলেন তাঁরা প্রথমে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। তারপর তাঁরা নিজেদের মধ্যেই বচসা শুরু করে দিলেন। উপস্থিত একজন বললেন, তিনি কি ক্রোধান্বিত হয়ে এ- সব বলছেন? তাঁকে কি ভূতে ধরেছে? তাহলে ওঝা নিয়ে আসি। এ- শুনে জয়নাব বিনতে জাহশ এবং কয়েকজন সাহাবি বলে উঠলেন, নবি যা চাইছেন তোমাদের উচিত তা অবিলম্বে নিয়ে আসা। ওমর বললেন :

নিবির জ্বর অত্যধিক। আমাদের জন্যে রয়েছেন আল্লাহ এবং কোরান, এগুলোই আমাদের জন্য যথেষ্ট। অন্যকিছুর দরকার নেই। এভাবে যারা চেয়েছিল নবির লিখিত পথনির্দেশ যাতে তাঁরা ভবিষ্যতে ভুল পথে না যায় এবং যারা চাননি যে তিনি কিছু লিখুন, তারা দুই পক্ষে বিভিক্ত হয়ে তুমুল তর্ক-বিতর্ক শুরু করে দেন। নবি এই বচসা দেখে খুব মর্ম- পীড়িত হলেন। এক সময় তাঁর ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে গেলে দুই পক্ষকেই তাঁর সামনে বাকযুদ্ধ বন্ধ করতে বললেন। কারোই ধারণা ছিল না যে নবি কী লিখতে চাচ্ছিলেন। আর তাছাড়া তিনি অসুস্থ, তাই কারো বোধগম্য ছিল না, কাকে দিয়ে লেখাবেন তাঁর নির্দেশগুলো। তিনি কি তাঁর উত্তরাধিকারীর নাম লিখতে চেয়েছিলেন? এমন কিছু লিখতে চাচ্ছিলেন যা কোরানে ছিল না? অথবা কোরানের কোনো কিছু কি তিনি বাতিল করতে চাচ্ছিলেন? অথবা আরব জাতির প্রগতির জন্য কি কোনো নীতিমালা দিতে চেয়েছিলেন? এই সবই যদি হয় তবে তিনি মৌখিকভাবে তা বললেন না কেন? নবির এই নীরবতা চিরকালের জন্যে এক রহস্য হয়ে থাকবে।

উপরের ঘটনাতে একটি বিতর্কিত বিষয় আছে। ওমর ছিলেন একজন নির্ভীক, দৃঢ় ও অটল মানুষ। ইসলাম ও ইসলামের প্রতিষ্ঠাতার উপর ওমর ছিলেন সম্পূর্ণ নিবেদিত। এহেন ওমর কেন মুহাম্মদের শেষ লিখিত নির্দেশের বিরোধী হলেন আর বললেন কোরানই হবে যথেষ্ট? ওমর কি সত্যিই বিশ্বাস করেছিলেন যে, নবি জ্বরের ঘোরে প্রলাপ বকছেন? ওমর তো বাস্তববাদী, দূরদর্শীসম্পন্ন হিসেবে পরিচিত। সে- জন্যেই কি তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, মুহাম্মদ মৃত্যুর পূর্বে আলিকেই তাঁর উত্তরাধিকারী মনোনীত করতে পারেন? এমন যদি হয়, তবে ওমর ভালভাবেই জানতেন যে আপামর মুসলিম সমাজ নবির ইচ্ছাকেই সম্মান দেখাবে। এবং এর ফলে ওমরের হাতে কোনো ক্ষমতা থাকবে না। খলিফা মনোনয়ন নিয়ে শিয়াদের মধ্যে এ- ধারণাটাই বিদ্যমান। যৌক্তিকভাবে বিচার করলে শিয়াদের এই ধারণা অমূলক নয়। কেননা ওমর কেন নবিকে তাঁর শেষ ইচ্ছে লিখতে দিলেন না তার সঠিক এবং বিশ্বাসযোগ্য কারণ আজ পর্যন্ত কেউ উপস্থাপন করতে পারেননি।

ইসলামের ইতিহাসে ওমর একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি। তিনি ছিলেন নবির প্রিয়, সম্মানিত এবং প্রভাবশালী সাহাবি। রাজনৈতিক বিষয়াবলীতে ওমর ছিলেন শক্তিশালী স্তম্ভ। গভীর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ছাড়াও তিনি মানুষের চরিত্র বিশ্লেষণে ছিলেন দক্ষ। তাঁর দূরদর্শিতাও ছিল অপরিসীম। ফলে ধারণা করা যায়, ওমর পূর্বেই অনেক হিসাব নিকাশ করেছিলেন। তিনি জানতেন নবিকে যদি তাঁর উত্তরাধিকারী মনোনীত করার সুযোগ দেওয়া হয় তবে তা নিঃসন্দেহে হবেন আলি অথবা আবু বকর। এদের মধ্যে আলি ছিলেন হাশেমি গোত্রের সবচেয়ে সমানিত ব্যক্তি। আবার তিনি নবির ভাই, নবির জামাতা, এক নির্ভীক যোদ্ধা এবং ঘনিষ্ঠ ওহি- লেখক। এছাড়া আলির ছিল নিজস্ব মৌলিক চিন্তাধারা। ফলে আলি সহজে অন্য কারো চিন্তা দ্বারা প্রভাবিত হতেন না। আবু বকর ছিলেন ওমরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। মদিনার দশ বছর আবু বকর ও ওমর একে-অপরের সান্নিধ্যের মধ্যে ছিলেন। নবির অন্যান্য সহচরদের চেয়ে আবু বকরের সাথেই ওমর বেশি মেলামেশা করতেন। যে কোনো ব্যাপারে তাঁদের দুজনের থাকত মতের মিল। আলি ও আবু বকর, এই দুজনের মাঝে ওমর অবশ্যই আবু বকরকে বেছে নিবেন মুহাম্মদের উত্তরাধিকারী হিসেবে। আবু বকর ছিলেন ধীর ও শান্ত মেজাজের। আবু বকরের গোত্র প্রভাবশালী ছিল না। তাই ওমর জানতেন, আবু বকর মুহাম্মদের স্থলাভিষিক্ত হলে মূলত তিনিই হবেন আবু বকরের দক্ষিণ হস্ত। আর নবির উত্তরাধিকারী যদি আলি হন তবে আলি পাবেন নবির সহচরদের সম্মান এবং সমগ্র হাশেমি গোত্রের সমর্থন। এই অবস্থায় আলি ওমরকে পাশ কেটে চলবেন, বিষয়টি ওমর ভাল করেই বুঝেছিলেন। ওমর আবু বকরের বয়সের বিষয়েও সজাগ ছিলেন। মুহাম্মদ যখন মৃত্যুবরণ করেন তখন আবু বকরের বয়স ছিল ষাটের উর্ধ্বে। প্রবীণ ব্যক্তি হিসেবে আবু বকর ছিলেন সম্মানিত। আর আলির বয়স ছিল মাত্র বত্রিশ। তাই ওমর জানতেন আবু বকর নেতা হলে শীঘ্র ওমরের হাতে ক্ষমতা চলে আসবে কিন্তু আলি নেতা হলে সেটা হবে না। সংক্ষেপে বলা যায় আবু বকর নবির উত্তরাধিকারী হলে ওমরের রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা পূরণে সহায়তা হবে। এ-দিক দিয়ে চিন্তা করলে বুঝা যায় ওমর কেন নবির শেষ নির্দেশের বিষয়ে অস্বস্তি বোধ করছিলেন। ওমর হয়তো ভেবেছিলেন মুহাম্মদ বোধহয় শেষ ইচ্ছাপত্র লিখে যেতে পারেন; এবং নবির মৃত্যুর পরে শাসনক্ষমতা শুধুমাত্র হাশেমি গোত্রের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে যার ফলে অন্যান্যদের রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা পূরণের পথ রূদ্ধ হয়ে যাবে।

হতে পারে নবির লেখার উদ্দেশ্য উত্তরাধিকারী মনোনীত করা ছিল না। তিনি ভিন্ন কোনো বিষয় নিয়ে চিন্তা করেছিলেন। কিন্তু এটা পরিষ্কার যে ওমর কোনোক্রমেই ঝুঁকি নিতে চাননি। তিনি এই ব্যাপারে আর বৃথা তর্কে যেতে চাননি। ওমর ভেবেছিলেন নবি শেষমেশ উইল করতে পারেন। তাই তিনি নিজের মনের কথা গোপন রেখে বলেছিলেন নবি প্রবল জ্বরের ঘোরে প্রলাপ বলছেন, তাই তাঁর পক্ষে কোরানে কিছু যোগ করার মতো অবস্থা নেই। ওমর আরও বললেন নবির কাছে যত ওহি এসেছে তা সবই এসেছিল যখন তিনি সুস্থ ও ভাল স্বাস্থ্যে ছিলেন। কোরানে যা থাকার সব কিছুই নবি পেয়ে গেছেন সে অবস্থায়, কাজেই নতুন আর কিছু লেখার প্রয়োজন নাই।

জানালেন না কেন? শিয়াদের বিশ্বাস অনুযায়ী, নবির উদ্দেশ্য ছিল আলিকে উত্তরাধিকারী মনোনীত করা। তাই যদি হয় তবে যখন বাহাস শুরু হল এবং যখন ওমর কাগজ-কলম আনতে নিষেধ দিলেন তখন নবি মৌখিকভাবে অথবা অন্য কোনো উপায়ে তাঁর শেষ ইচ্ছেটা জানিয়ে দিতে পারতেন। কিন্তু নবি তা করেননি। এ- সময় নবির কক্ষে অনেক ব্যক্তিই উপস্থিত ছিলেন। ফলে তিনি যা বলতেন তা মুখে মুখে সমগ্র মুসলিম- সমাজে ছড়িয়ে পড়ত। তাহলে কি নবির অন্য কোনো কারণ ছিল যার জন্য তিনি তাঁর শেষ ইচ্ছা প্রকাশ করেননি? আপাতদৃষ্টিতে মনে হবে এই রহস্যের গভীরতা নির্ণয় করা সম্ভব নয়। কিন্তু সেটা সত্য নয়।

একটা বিষয় আমাদের ভুলে যাওয়া উচিত নয়, মুহাম্মদ সারাটা জীবন যা করে এসেছেন তার সব কিছুর পেছনে সর্বদা কোনো না কোনো উদ্দেশ্য কাজ করেছে। তেইশ বছর ধরে তাঁর মনে এক দুর্বার আকাঙ্ক্ষার শিকড় গেড়ে ছিল। এই শিকড় তাঁর মনে- প্রাণে এমনভাবে জড়িয়ে পড়ে যে এই দুর্বার শক্তি তাঁর ব্যক্তিত্বের অঙ্গ হয়ে পড়ে। নবির এই অদম্য উদ্দেশ্য ছিল এক ইসলামি সমাজ প্রতিষ্ঠা করা যার ভিত্তি হতে হবে আরব জাতীয়তাবাদ। নবির ছিল সহজাত জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও মানুষের চরিত্র বুঝার অসাধারণ ক্ষমতা। তাঁর সব সহচরের গুণ ও মেজাজের বৈশিষ্ট্য তিনি খুব ভাল করে জানতেন। নবি খুব ভালভাবে লক্ষ করেছিলেন ওমরের চরিত্রের একাগ্রতা, দূরদর্শিতা, দৃঢ়তা এবং নৈতিকতা। ওমর এবং আবু বকরের ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্বও নবি ভাল করে জানতেন। ইসলামে দীক্ষা নেবার পর থেকে ওমর হয়ে যান নবির সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সহচর। নানা সময়েই ওমর নবিকে প্ররোচিত করেছিলেন সিদ্ধান্ত নেবার জন্য, যা পরিশেষে ইসলামের কল্যাণ বয়ে আনে। আবু বকর ছিলেন মুহাম্মদের বিশ্বস্ত অনুগামী। কিন্তু ওমর সেরকম ছিলেন না। ওমর ছিলেন নিজস্ব ধ্যান- ধারণার ব্যক্তি। অনেক ক্ষেত্রে ওমর তাঁর অভিপ্রায় নবির কাছে উপস্থাপিত করতেন এবং নবি প্রায়ই ওমরের ইচ্ছা ও অভিপ্রায় পূরণ করতেন। মিশরীয় বিশিষ্ট ইসলামি চিন্তাবিদ জালালউদ্দিন আল সুয়তির (১৪৪৫-১৫০৫ খ্রিস্টাব্দ) লেখা “আল-ইতকান ফি উলুম আল- কোরান বইয়ের একটি অধ্যায়ের শিরোনাম হচ্ছে ‘কোরানের সেইসব প্রত্যাদেশ যা সাহাবিদের অভিপ্রায়ে সংযোজিত। কোরানের আয়াতের কয়েকটি এসেছে ওমরের পরামর্শ থেকে। মোজাহেদ বিন জাবর বলেছেন : কোনো বিষয়ে ওমর তাঁর মতামত জানালেন। কিছু পরে তা ওহি হয়ে কোরানে স্থান পেয়ে যেত। এমনকি ওমর নিজেই বলেছেন কোরানের তিনটি আয়াত তাঁর ব্যক্তিগত পরামর্শে কোরানে স্থান পেয়েছে। এই আয়াতগুলি হচ্ছে মুসলিম নারীদের পর্দার ব্যাপারে (সুরা আহজাব ; আয়াত ৫৯) , বদরের যুদ্ধবন্দীদের সম্পর্কে (সুরা আনফাল ; আয়াত ৬৭) , এবং ইব্রাহিমের তৈরি ঘর (কাবা) স্থান সম্পর্কে (সুরা বাকারা ; আয়াত ১২৫) । এ-বিষয়গুলিতে সুন্নাহ-সংকলনকারী, মুহাম্মদের জীবনীকারক, এবং কোরানের তফসিরকারকদের অনেক কিছু বলার আছে। তাঁদের বক্তব্য অনুযায়ী ওমর ব্যক্তি হিসেবে অত্যন্ত বুদ্ধিমান এবং বিজ্ঞ ছিলেন। এজন্য নবি ওমরকে বিশ্বাস করতেন। এ- ধরনের ব্যক্তি নবির ঘনিষ্ঠজনদের মধ্যে পাঁচজনের বেশি ছিলেন না।

মুহাম্মদের এই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য থেকে বুঝা যায়, উদ্দেশ্য ছাড়া তিনি কোনোভাবে কিছু লেখার ইচ্ছা প্রকাশ করতেন না। এমনও হতে পারে নবি মৌখিকভাবে কারো নাম উল্লেখ করলে তা হয়তো ওমর, আবু বকর এবং তাঁদের সহযোগীরা বিরোধিতা করে বসতেন। ফলে নবির জীবদ্দশাতেই ইসলামের অনেক ক্ষতি হয়ে যেত। নবি তাঁর জীবদ্দশায় যে অপরিসীম সমানের অধিকারী হয়েছিলেন তাতে তিনি ইচ্ছামাফিক যেকোনো সঠিক পদক্ষেপ নিতে পারতেন। কিছুদিন পূর্বে নবি ওসামা বিন জায়েদকে সেনাপতি নিয়োগ দেয়ায় অনেক সমালোচনার সম্মুখীন হন। কিন্তু তিনি তীব্র তিরস্কারের সাথে সমালোচকদের মুখ বন্ধ করে দিয়েছিলেন।

কিন্তু মুহাম্মদের মৃত্যুর পর এ-বিষয় অন্যদিকে মোড় নেয়। তাঁর অবর্তমানে কার ক্ষমতা ছিল যে গোত্রে- গোত্রে শক্ৰতার অবসান ঘটাতে পারেন? কে নেতৃত্ব ও ধনদৌলতের প্রতি লোভ লালসার সমাপ্তি ঘটাতে সক্ষম ছিলেন? এক ইসলামি সমাজ গড়া ছিল নবির মুখ্য উদ্দেশ্য। নবি যে এত কষ্ট করে নতুন ইসলামি সমাজের ভিত্তি করলেন সেটার কি হবে? আরবরা কি আবার তাদের পরস্পর দীর্ঘকালব্যাপী হানাহানি ও খুনোখুনিতে মেতে উঠবে? নবির মনে হয়তো এ-ধরনের অনেক চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছিল। তাই তিনি শুধুমাত্র তাঁর ঘরে যারা ছিলেন তাদেরকে চলে যেতে বলে চুপ থাকাটাই শ্রেয় মনে করলেন। এছাড়া আরও অন্যান্য কারণও হয়তো থাকতে পারে, যার জন্য নবি তাঁর কোনো উত্তরাধিকারী মনোনীত করেননি।

আলির যে অনেক গুণ ছিল তা তাঁর শক্রমিত্র উভয়েই একমত। আলি জীবনে কখনো মূর্তিপূজা করেননি। এগার বছর বয়সে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। ইসলাম প্রচারের প্রথমদিকে ওহুদের যুদ্ধে আলি মুহামদকে মারাত্মক বিপদের হাত থেকে রক্ষা করেছেন। পরিখার যুদ্ধে আমর বিন আবদ ওয়াদকে আলি ধরাশায়ী করেন এবং খায়বার যুদ্ধে নাতাত দুর্গে আক্রমণ করেন। হিজরতের আগে রাতে (নবি ও আবু বকর সে- রাত একসাথে গুহায় কাটান) নিহত হবার আশংকা থাকা পরও নবির বিছানায় আলি শুয়ে ছিলেন। নবির সহচরদের মধ্যে আলিই সবচেয়ে বেশি শক্ৰ হত্যা করেছেন। নবির উদাহরণ পালনে অসীম সাহসিকতা, অকপটতা, বাকপটুতা ও নির্ভুলতায় আলি সবার প্রশংসা অর্জন করেছেন। মুহাম্মদের নিজস্ব গোত্র হাশেমিদের কাছে আলি ছিলেন সম্মানিত ব্যক্তি। আলির এতো গুণাবলী থাকা সত্ত্বেও তিনি ছিলেন মুহাম্মদের সহচরদের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ। এমন- কী তিনি ছিলেন মুহাম্মদের চাচাতো ভাই ও জামাতা (নবি তনয়া ফাতেমার স্বামী) । মুহাম্মদ হয়তো ভেবেছিলেন আলিকে তাঁর স্থলাভিষিক্ত করলে আত্মীয়পোষণের অভিযোগ আসতে পারে। ফলে আন্তঃগোত্রীয় ঈর্ষার জন্ম হতে পারে যা মুসলিম সমাজের জন্য ক্ষতিকর হবে।

দুঃখের বিষয় হচ্ছে আলির অনন্য-সব গুণাবলী হয়তো নেতৃত্বের প্রতিযোগিতায় তাঁর অন্তরায় হয়ে দাঁড়াল। অপরিসীম উচ্চাকাঙ্ক্ষী ব্যক্তিদের শাসন করতে দরকার স্থৈর্য, আত্মসংবরণ, এবং মধ্যপন্থী মানসিকতা। নিচুপদের লোকদের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতি মনোযোগ দেয়াও একান্ত কর্তব্য। নবি মুহাম্মদের মাঝে এই গুণাবলী যথেষ্ট ছিল। মক্কা বিজয়ের পর সামান্য কয়েকজন ছাড়া নবি তাঁর বিপক্ষের, সে যতই একগুঁয়ে অথবা জেদি হোক, কাউকে মৃত্যুদণ্ড দেননি। হাওয়াজেন গোত্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অর্জিত গনিমতের সকল মাল নবি কুরাইশ নেতাদের মধ্যে বিতরণ করে দেন। কিন্তু এ- ব্যাপারে আলি ছিলেন অনমনীয়। যে দাবিগুলি তিনি অন্যায্য মনে করতেন তিনি সেগুলিকে কোনোদিন বিবেচনায় আনতেন না। হিজরি ১০ (৬৩১- ২ খ্রিস্টাব্দ) সালে আলি ইয়েমেনে এক সামরিক অভিযানের নেতৃত্ব দেন। তাঁর সৈন্যরা দাবি করেন যুদ্ধে পাওয়া গনিমতের মাল তাদেরকে সাথে সাথে ওই স্থানেই বিতরণ করে দিতে হবে। কিন্তু আলি তাদের এই দাবি অগ্রাহ্য করে সকল মাল নবির কাছে জমা করলেন। পরে নবি ওই যুদ্ধে লব্ধ মাল সকলের মাঝে ন্যায়সঙ্গতভাবে বিতরণ করে দিলেন। সৈন্যরা আলির বিরুদ্ধে নালিশ করলে নবি আলিকে সকল অভিযোগ থেকে মুক্ত করে দিলেন। উসমানের খলিফা হবার সময় উবায়দুল্লাহ বিন ওমর হত্যা করেন হরমুজানকে (এক ইরানি সেনাপতি, তাঁকে যুদ্ধবন্দী হিসাবে মদিনাতে আনা হয় এবং পরে একজন উপদেষ্টা হিসাবে নিয়োগ দেয়া হয়) । উবায়দুল্লাহ সন্দেহ করেছিলেন যে তাঁর পিতা সাবেক খলিফা ওমরের হত্যাকাণ্ডের সাথে হরমুজান জড়িত”। হত্যাকাণ্ডের বিচার শুরু হলে উসমান আলির সাথে পরামর্শ করেন। আলি সাথে সাথে উত্তর দিলেন, ইসলামি আইন অনুযায়ী উবায়দুল্লাহকে এই হত্যার বদলা দিতে হবে। অর্থাৎ উবায়দুল্লাহর সাজা হবে মৃত্যুদণ্ড। উসমান আলির পরামর্শ মানেননি। উবায়দুল্লাহ ছিলেন খলিফা ওমরের দ্বিতীয় পুত্র। উসমান ওমরের এই দ্বিতীয় পুত্রের জীবনরক্ষা করলেন। উবায়দুল্লাহকে দিতে হল হত্যার খেসারত-অর্থাৎ রক্তের মূল্য। এরপর উসমান উবায়দুল্লাহকে ইরাকে পাঠিয়ে দিলেন।

নবি খুব ভাল করেই আলির সদগুণের সাথে পরিচিত ছিলেন। এছাড়াও নবি জানতেন যে আলি কোনো কিছুকে সঠিক মনে করলে সেই ব্যাপারে আপোষহীন থাকতেন। স্বাভাবিকভাবে আলির এই আদর্শবান চরিত্র প্রশংসনীয়। কিন্তু এটা সত্যি অনেক ব্যক্তি ধর্মের লেবাস পরলেও ধনদৌলতের লোভ সামলাতে পারেননি। তাই বাস্তবতা যাচাইয়ে আলির এই আপোষহীন মানসিকতা যথাযোগ্য নয়। আলি যদি নেতৃত্ব নেন তবে এ- সকল লোভী ব্যক্তিরা বিপদ পড়বেন। তাতে সমগ্র মুসলিম সমাজ বিভক্ত হয়ে পড়তে পারে এবং ইসলামের লক্ষ অর্জন করা যাবে না। নবি এ-বিষয়টিতেও সজাগ ছিলেন। আলির রাজত্বকাল ছিল স্বল্পসময়, হিজরি ৩৫, ১৮ জিলহজ থেকে হিজরি ৪০, ১৭ রমজান ( ১৭ জুন ৬৫৬- ২৪ জানুয়ারি ৬৬১) পর্যন্ত। এই সময় যারা নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য ইসলাম গ্রহণ করেছিল তাঁরা প্রমাদ গোনেন। যারা পাপের পথে চলেছিলেন, আলি তাদের সাথে কোনো সমঝোতায় আসতে অস্বীকার করলেন। এমন কী খুব অল্প সময়ের জন্যেও আলি তাদেরকে ছাড় দিতে চাইলেন না। আলির এই অনমনীয় মনোভাবের জন্য সিরিয়ার শাসনকর্তা মুয়াবিয়ার সাথে বিরোধ দেখা দেয়। তালহা এবং জুবায়ের ছিলেন নবির সহচরদের মধ্যে অন্যতম বয়োজ্যেষ্ঠ দুই সাহাবি। নবির এই দুই সাহাবিও আলির বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নিলেন।

সব ঘটনা বিশ্লেষণ করলে একটা ব্যাপার পরিষ্কার যে, নবি তাঁর উত্তরাধিকারী নিয়োগ করার আগেই মারা যান। নবির এই সিদ্ধান্ত তাঁর প্রজ্ঞা এবং দূরদর্শিতারই প্রমাণ করে। অনেক চিন্তাভাবনা করে নবি হয়ত শেষ সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে ক্ষমতার লড়াইয়ে মুসলিম সমাজকে বিভক্ত করা সঠিক হবে না। এই ক্ষমতার লড়াই প্রকৃতির নিয়ম মাফিক চলুক-নবি তাই চাইলেন। এই নিয়মে যে সবচাইতে বলবান সেই টিকে থাকবে, যাতে করে ইসলামও বেঁচে থাকবে।

এ- ঘটনার সাথে আধুনিককালের একটি ঘটনার মিল পাওয়া যায়। রাশিয়ার বলশেভিক পার্টির নেতা লেনিন অসুস্থ হয়ে পড়লে তিনি সোভিয়েত কমিউনিস্ট দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সভায় উপস্থিত হতে পারলেন না। তাই তাঁর বিছানা থেকে তিনি কেন্দ্রীয় কমিটিকে একটা চিঠি পাঠান। সেই চিঠিকে বলা হয় লেনিনের জবানবন্দি। চিঠিতে লেনিন সোভিয়েত বলশেভিক দলের দুই প্রখ্যাত সদস্যের প্রশংসা করলেন। এ-দুই ব্যক্তি ছিলেন স্টালিন এবং ট্রটস্কি। লেনিন লিখলেন এই দুই ব্যক্তি নতুন সরকারের জন্য অপরিহার্য। কিন্তু লেনিন এও আশঙ্কা করলেন যে ভবিষ্যতে দুজনের মাঝে বিরোধ ঘটতে পারে। লেনিন পত্রে এই দুজনের যোগ্যতা ও অযোগ্যতার দিকগুলোও তুলে ধরলেন। কিন্তু উত্তরাধিকারী নির্বাচনের ব্যাপারে চুপ থাকলেন। মনে হয় লেনিনও চাইলেন যে প্রকৃতির নিয়মমাফিক যে যোগ্যতম ব্যক্তি সে-ই বিজয়ী হবে।

ইসলামের পূর্বে আরবরা তাদের নিজ নিজ গোত্র, বংশ অথবা বংশবৃত্তান্ত নিয়ে বড়াই করতেন। তাদের এই দাম্ভিকতার মূলে তাদের কোনো নৈতিক উৎকর্ষতা বা আচরণের সাধারণ মাধুর্য ছিল না। বরং তাদের গর্ব প্রকাশ পেত হত্যাকাণ্ডে শৌর্য দেখানো, লুটতরাজ এবং অন্য গোত্রের নারী অপহরণের মধ্যে। ইসলাম আরবদের এই অসভ্যতার মূলে আঘাত হানে এবং কর্তব্যনিষ্ঠা ও ধাৰ্মিকতাকেই প্রাধান্য দেয়। কিন্তু ইসলামের এই নতুন মানদণ্ড বেশিদিন থাকল না। সত্যি বলতে হিজরি ২৩ (৬৪৪ খ্রিস্টাব্দ) সালে খলিফা ওমরের মৃত্যুর পর ইসলামের নৈতিকতার মানদণ্ডে ফাটল ধরে। উসমানের সময় ধাৰ্মিকতার স্থলে আত্মীয়পোষণ প্রাধান্য পেল। আবুজর গিফারির” এবং আমার বিন ইয়াসিরদের মতো ধর্মপ্রাণ ব্যক্তিরা পেছনে পড়ে রইলেন। এ- স্থানে উসমানের গোত্রের লোকেরা, যেমন মুয়াবিয়া বিন সুফিয়ান এবং হাকাম বিন আবুল আসারা পেলেন শাসনকর্তার পদ।

ইসলামের সবচেয়ে উজ্জ্বল নীতি ছিল মহত্ত্ব এবং ধাৰ্মিকতা। উমাইয়া খেলাফতের সময় (হিজরি ৪১- ১৩২ বা ৬৬১৭৫০ খ্রিস্টাব্দ) ইসলামের এই নীতিগুলিকে সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করা হয়। এর স্থলে প্রাধান্য পায় গোত্র ও জাতিগত দাম্ভিকতা। এই দম্ভ আরও ব্যাপকতা লাভ করে ক্রমে। ফলে শুরু হয় আরব জাতীয়তাবাদের দাবি মেটানোর পালা। এই প্রক্রিয়া শুরু হয় বিজিত জাতি পদানত করে এবং তাদের সম্পদ হরণ করে।

আরবের উষর মরুভূমির বেদুইনরা আক্রমণ শুরু করেন সভ্যজগতের বিশাল এলাকা। মরুভূমির বেদুইনরা দখল করে নিলো সভ্যজগতের শাসন ক্ষমতা এবং হরণ করে এইসব বিজিত দেশগুলির বিশাল ধনসম্পদ। ক্ষমতা- মদমত্ততার দেশগুলিকে নিকৃষ্ট জাতি হিসাবে গণ্য করতে লাগল। আরবরা বিজিত দেশগুলোর জনতাকে অপরিসীম ঘৃণার চোখে দেখল। কখনো তাদেরকে আরবদের সমকক্ষ মনে করত না। এমনকি বিজিত দেশের যারা ইসলাম গ্রহণ করে আরবরা তাদেরকে পর্যন্ত ইসলামের যে সার্বজনীন সৌভ্রাতৃত্বের নীতি আছে তা থেকে বঞ্চিত করল।

কথিত আছে, এক ইরানি মুসলমান হয়ে আরব গোত্র বানু সুলায়ম গোত্রের আশ্রিত হন। সেই ইরানি বানু সুলায়ম গোত্রের এক মহিলাকেও বিবাহ করেন। এ- সংবাদ শোনার পর ওই গোত্রের একজন, মুহামদ বিন বশির মদিনাতে গিয়ে শাসনকর্তা ইব্রাহিম বিন হিশাম বিন আল মুগিরার কাছে ইরানির বিরুদ্ধে নালিশ করেন। মদিনার শাসক এক প্রতিনিধি পাঠালেন। সেই প্রতিনিধি ইরানিকে দুইশত বেত্ৰাঘাত করে মস্তক, মুখ ও ভ্রমুণ্ডণ করে দিল। তারপর ইরানিকে জোরপূর্বক তার স্ত্রীর সাথে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটিয়ে দেয়া হল। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে মুহামদ বিন বশির এক গীতিকবিতা রচনা করেন। গীতিকবিতাটি কিতাব আল- আগানি’ ( Kerab ০LAghani গ্রন্থে সংরক্ষিত আছে। সেই গীতিকাব্যের কয়েকটি লাইন এখানে অনুবাদ করে দেয়া হল :

আপনি কোনো বিদেশির কাছ হতে শাসন ক্ষমতা পাননি।
এই জন্য ওই আশ্ৰিত অনারব পেল দুইশত বেত্ৰাঘাত
এবং তার মাথা মুণ্ডন করা হল।
এই হচ্ছে তার দৃষ্ট্রক্তমূলক শক্তি।
তাদের জন্যে রয়েছে খসরুর কন্যার?
এর পরেও কি ওই আশ্রিত বেশি পেতে চায়?
এই আশ্ৰিতের জন্য কি আছে?
ক্রীতদাসের সাথে ক্রীতদাসীর বিবাহ হয়।

আব্দুল্লাহ বিন কুতায়বা লিখিত ‘আইন আকবর’ গ্রন্থ থেকে আরও একটা তথ্য জানা যায় : এক আরব কাজির কাছে গিয়ে বলেন : “আমার পিতা মারা গেছেন। তাঁর উইলে লেখা আছে তাঁর সম্পত্তি আমার ভ্রাতা, আমার মাতা, আমি এবং এক হাজুন, আমাকে জানান কে কী পরিমাণ সম্পত্তি পাবেন? ( হাজুন একটি আরবি শব্দ, যার অর্থ হচ্ছে ইতর। তৎকালীন সময়ে কোনো অনারব মহিলার গর্ভের সন্তান বোঝাতে তুচ্ছার্থে ব্যবহৃত হত) । কাজি উত্তর দিলেন : এখানে কোনো সমস্যা নাই। প্রত্যেকে পাবে এক তৃতীয়াংশ। আরব ব্যক্তি বললঃ আপনি আমাদের সমস্যা বুঝেননি। আমরা দুই ভাই এবং একজন হাজুন। কাজি উত্তর দিলেন: সম্পত্তিতে প্রত্যেকের সমান অধিকার আছে। আরব ব্যক্তি ক্রুদ্ধ হয়ে বললেন: এক হাজুন কেমন করে আমাদের সমান হয়?’ কাজি বললেন:

‘এ আল্লাহর আদেশ। ’

ইসলামের অতীত শতাব্দী থেকে এ- ধরনের শতশত উদাহরণ পাওয়া যায়। এই উদাহরণগুলি প্রমাণ করে ক্ষমতা দখল ও অন্য জাতির উপর প্রাধান্য বিস্তারের প্রয়োজনে ইসলামকে ব্যবহার করা হয়েছে। কোরানে যেসব ক্ষমাশীল এবং দয়াপূর্ণ আয়াত আছে সেগুলি কোনোদিন মেনে চলার ব্যবস্থা করা হয়নি। পৌত্তলিক আরবে যেভাবে আরবেরা নিজেদের শ্রেষ্ঠত্বের দম্ভ দেখাতেন সেই মানসিকতারই নিশ্চয়তা পাওয়া গেল এ-যুগেও। তথাপি অনারব মুসলিমরা ইসলামের মহান শিক্ষার প্রতি অনুরক্ত থাকেন। তাঁরা সারণ করেন কোরানের এই আয়াতটি তোমাদের মধ্যে সেই আল্লাহর কাছে বেশি মর্যাদাসম্পন্ন যে বেশি সাবধানি। আল্লাহ সবকিছু জানেন, সব খবর রাখেন।’ (সুরা হুজুরাত আয়াত ১৩) । আরবদের দাম্ভিক আচরণের প্রতিক্রিয়া হিসাবে ইরানে শুরু হয় সাংস্কৃতিক পুনরুজ্জীবনের আন্দোলন। জাতীয়তাবাদী- ঘরানার এ গণআন্দোলনকে বলা হয় ‘শোবিয়া আন্দোলন। এ ধরনের আন্দোলনের কোনো প্রয়োজন থাকত না, যদি নবি মুহাম্মদ বিন আবদুল্লাহ যে ইসলাম প্রচার করেছিলেন এবং যে ইসলামের পথ ধরে আবু বকর, ওমর এবং আলি চলেছিলেন, সেই ইসলামের ধারা অব্যাহত থাকত।

7 thoughts on “নবি মুহাম্মদের ২৩ বছর – আলি দস্তি

  • September 19, 2018 at 3:20 AM
    Permalink

    আল্লাহ ছিলেন কাবার মন্দিরের রক্তপিপাসু অপদেবতা ; মুহাম্মদ আল্লাহর মূর্তি ধ্বংস করিয়াছিলেন ; এবং আল্লাহর ভক্তরা কারবালা ময়দানে , মুহাম্মদের বংশ ধ্বংস করিয়াছিল ; সেই আল্লাহর নাম নিয়ে প্রত্যহ তাদের এখনো চেঁচামেচি ;

    Reply
    • October 7, 2018 at 10:42 PM
      Permalink

      Mr Asit, do you really think that only cursing hatred can bring ignorant believers in light ? We have to learn how to make self-criticism.
      2. Now let’s come to the point : and that’s much more effective than cursing . If we carefully notice Muhammad’s life in Mecca , what we learn actually ? He used soft and decent tactics . Again, no spiritual power benefited him or came in work . In 13 years of Mecca, only few influential persons were converted to Islam. Why they converted themselves, that’s a separate and dufferent debate. I can only say for now that those first Converted to Islam were very wise and had a vision of bright future. For them, it was a career. No angel, no miracle or spiritual power came to work in in use except tactics , psychological manipulation or game, I. e, using fear of punishment after life, greed, and helplessness of man . When Muhammad went to Madina, his status changed , became stronger financially by robbery of commerce groups (banijjo kafela), then his language of Quran changed. It was not decent any more.

      Reply
  • January 16, 2022 at 10:38 AM
    Permalink

    When you heard the name prophet Muhammod…say Muhammod (sallahu alyhe wa sallam)

    Reply
  • December 30, 2023 at 2:00 PM
    Permalink

    I have one question to Asif,

    Who invented this law that if anyone leave islam that will create problem of his married life? Is it mentioned in Quran and Hadith? In this case whats your solution?

    A man love his wife most u know that

    Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *