19.আল্লাহ কি ন্যায় বিচারক?

ইসলামী বিশ্বাসে আল্লাহ তাআলাকে চূড়ান্ত ন্যায় বিচারক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। তিনি সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমান, এবং তার জ্ঞানের পরিধি সীমাহীন। কিন্তু অনেক সময় কোরআনের কিছু ঘটনার প্রেক্ষিতে সাধারণ প্রশ্ন জাগে—এই ন্যায় বিচার আসলে কেমন? এমন একটি ঘটনা কোরআনের সূরা বাকারা, আয়াত ৩১-৩২-এ বর্ণিত হয়েছে, যেখানে আদমকে সকল বস্তুর নাম শেখানো হয়েছিল এবং সেই জ্ঞান ফেরেশতাদের ছিল না। এমনকি, ফেরেশতাদের তা শেখানোও হয়নি। আসুন বিষয়টয়ি পর্যালোচনা করে দেখি।

কোরআনের আয়াত

সূরা বাকারা, আয়াত ৩১
এবং তিনি আদাম (আ.)-কে সকল বস্তুর নাম শিক্ষা দিলেন, তারপর সেগুলো ফেরেশতাদের সামনে উপস্থাপন করলেন এবং বললেন, ‘এ বস্তুগুলোর নাম আমাকে বলে দাও, যদি তোমরা সত্যবাদী হও’।
— Taisirul Quran
এবং তিনি আদমকে সমস্ত নাম শিক্ষা দিলেন, অনন্তর তৎসমূদয় মালাইকা/ফেরেশতাদের সামনে উপস্থাপিত করলেন, অতঃপর বললেনঃ যদি তোমরা সত্যবাদী হও তাহলে আমাকে এ সব বস্তুর নামসমূহ বর্ণনা কর।
— Sheikh Mujibur Rahman
আর তিনি আদমকে নামসমূহ সব শিক্ষা দিলেন তারপর তা ফেরেশতাদের সামনে উপস্থাপন করলেন। সুতরাং বললেন, ‘তোমরা আমাকে এগুলোর নাম জানাও, যদি তোমরা সত্যবাদী হও’।
— Rawai Al-bayan
আর তিনি আদমকে যাবতীয় নাম শিক্ষা দিলেন [১] , তারপর সেগুলো [২] ফেরেশ্‌তাদের সামনে উপস্থাপন করে বললেন, ‘ এগুলোর নাম আমাকে বলে দাও, যদি তোমরা সত্যবাদী হও ’।
— Dr. Abu Bakr Muhammad Zakaria

সূরা বাকারা, আয়াত ৩১
তারা বলল, ‘আপনি পবিত্র মহান, আপনি আমাদেরকে যা শিক্ষা দিয়েছেন, তাছাড়া আমাদের কোন জ্ঞানই নেই, নিশ্চয়ই আপনি সর্বজ্ঞ ও প্রজ্ঞাময়’।
— Taisirul Quran
তারা বলেছিলঃ আপনি পরম পবিত্র! আপনি আমাদেরকে যা শিক্ষা দিয়েছেন তদ্ব্যতীত আমাদের কোনই জ্ঞান নেই, নিশ্চয়ই আপনি মহাজ্ঞানী, বিজ্ঞানময়।
— Sheikh Mujibur Rahman
তারা বলল, ‘আপনি পবিত্র মহান। আপনি আমাদেরকে যা শিখিয়েছেন, তা ছাড়া আমাদের কোন জ্ঞান নেই। নিশ্চয় আপনি সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়’।
— Rawai Al-bayan
তারা বলল, ‘ আপনি পবিত্র মহান ! আপনি আমাদেরকে যা শিক্ষা দিয়েছেন তা ছাড়া আমাদের তো কোনো জ্ঞানই নেই। নিশ্চয় আপনিই সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময় ‘।
— Dr. Abu Bakr Muhammad Zakaria

সূরা বাকারা, আয়াত ৩৩
তিনি নির্দেশ করলেন, ‘হে আদাম! এ জিনিসগুলোর নাম তাদেরকে জানিয়ে দাও’। যখন সে এ সকল নাম তাদেরকে বলে দিল, তখন তিনি বললেন, ‘আমি কি তোমাদেরকে বলিনি যে, নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের অদৃশ্য বস্তু সম্পর্কে আমি নিশ্চিতভাবে অবহিত এবং তোমরা যা প্রকাশ কর ও গোপন কর, আমি তাও অবগত’?
— Taisirul Quran
তিনি বলেছিলেনঃ হে আদম! তুমি তাদেরকে ঐ সকলের নামসমূহ বর্ণনা কর; অতঃপর যখন সে তাদেরকে ঐগুলির নামসমূহ বলেছিল তখন তিনি বলেছিলেনঃ আমি কি তোমাদেরকে বলিনি যে, নিশ্চয়ই আমি আসমান ও যমীনের অদৃশ্য বিষয় অবগত আছি এবং তোমরা যা প্রকাশ কর ও যা গোপন কর আমি তাও পরিজ্ঞাত আছি?
— Sheikh Mujibur Rahman
তিনি বললেন, ‘হে আদম, এগুলোর নাম তাদেরকে জানাও’। অতঃপর যখন সে এগুলোর নাম তাদেরকে জানাল, তিনি বললেন, ‘আমি কি তোমাদেরকে বলিনি, নিশ্চয় আমি আসমানসমূহ ও যমীনের গায়েব জানি এবং জানি যা তোমরা প্রকাশ কর এবং যা তোমরা গোপন করতে’?
— Rawai Al-bayan
তিনি বললেন, ‘ হে আদম ! তাদেরকে এসবের নাম বলে দিন ’। অতঃপর তিনি (আদম) তাদেরকে সেসবের নাম বলে দিলে তিনি (আল্লাহ্‌) বললেন, ‘ আমি কি তোমাদের কে বলিনি যে, নিশ্চয় আমি আসমান ও যমীনের গায়েব জানি। আরও জানি যা তোমরা ব্যক্ত কর এবং যা তোমরা গোপন করতে [১]।
— Dr. Abu Bakr Muhammad Zakaria

মূল ঘটনা ও পর্যালোচনা

আল্লাহ আদমকে বিভিন্ন বস্তুর নাম শেখান এবং ফেরেশতাদেরকে একত্র করে সকলকেই বস্তুগুলোর নাম জিজ্ঞেস করেন। স্বাভাবিকভাবেই, ফেরেশতারা উত্তর দিতে ব্যর্থ হয়, কারণ তাদের তো সেগুলো শেখানোই হয়নি। আল্লাহ তাদেরকে তিরস্কারের সুরে বলেন যে, “তোমরা যা জানো না আমি তা জানি।” এখানে প্রশ্ন ওঠে, কিভাবে এই পরীক্ষা ন্যায় সঙ্গত হয় যেখানে আদমকে বস্তুগুলোর নাম শেখানো হয়েছে কিন্তু ফেরেশতাদের শেখানো হয়নি? খুব স্পষ্টভাবেই এই পরীক্ষা ছিল সম্পূর্ণ অবিচার এবং একটি নির্লজ্জ ফাজলামি। কারণ এই বিবরণ পড়লে যেকোন যুক্তিবাদী মানুষের মনেই প্রশ্ন জাগবে, আল্লাহ কি এখানে ন্যায় বিচার করেছেন? এটি তো আসলে এক ধরনের “পক্ষপাতদুষ্ট” শিক্ষাদান ব্যবস্থা, যেখানে শুধু আদমকে বিশেষ জ্ঞান দেওয়া হয়েছে, কিন্তু একই প্রশ্নের পরীক্ষা নেওয়া হচ্ছে ফেরেশতাদের।

এ ধরনের তুলনামূলক পরিস্থিতি উদাহরণ হিসেবে আনা যেতে পারে। যেমন, একটি স্কুলে শিক্ষক শুধুমাত্র একজন ছাত্রকে কোনো প্রাইভেট কোচিং দেন, অন্যদের স্কুলেই পড়ান। প্রাইভেট কোচিং এর সময় শিক্ষক ওই বিশেষ পছন্দের ছাত্রকে এমন এমন বিষয় শেখান, যা তিনি স্কুলে অন্য ছাত্রদের শেখান না। পরীক্ষার সময় দেখা গেল, সেই শিক্ষক বেছে বেছে সেই প্রশ্নগুলোই করেছেন, যা তিনি প্রাইভেট কোচিং-এ ঐ বিশেষ পছন্দের ছাত্রকে শিখিয়েছে, অন্যদের সেই প্রশ্নের উত্তর জানা নেই বা কোন ধারণাও নেই সেগুলোর উত্তর কী। বাকি ছাত্রদের সেই শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করে তাদের একই পরীক্ষা দিলে, স্বাভাবিকভাবেই ঐ বিশেষ ছাত্রটিই পরীক্ষায় পাশ করবে। অন্যরা ফেল করবে।

ইসলামে আল্লাহর জ্ঞানকে সবকিছুর ঊর্ধ্বে ও অসীম বলা হলেও কোরআনের এই আয়াতগুলো কার্যত তার ন্যায়বিচারের ধারণাটি প্রশ্নবিদ্ধ করে ফেলে। ফেরেশতাদের “আপনি যা শিখিয়েছেন, তাছাড়া আমাদের কোনো জ্ঞান নেই” উক্তিটি এক ধরনের নিরীহতা এবং তাদের ক্ষমতাহীনতার প্রকাশ। তাদের আল্লাহর কাছ থেকে ন্যায়বিচারের প্রত্যাশা থাকা সত্ত্বেও তারা নিরীহভাবে বলছে, তাদের তো এগুলো শেখানোই হয়নি। এই উক্তি থেকে মূলত তারা যে আল্লাহর খেয়াল খুশি আর একচ্ছত্র ক্ষমতার বলি, সেটিই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আর আল্লাহর এই ক্ষমতার প্রয়োগ তাকে একজন ন্যায় বিচারক হিসেবে নয়, বরং একজন স্বেচ্ছাচারী শাসক ও ক্ষমতাবান হিসেবে উপস্থাপন করে, যিনি সৃষ্ট জীবদের নিজ ইচ্ছা অনুযায়ী পরিচালনা করেন এবং ক্ষমতা দেখিয়ে তাদের তুচ্ছতাচ্ছিল্য করতে চান বলেই প্রতীয়মান হয়। তিনি কি এখানে প্রকৃতভাবে ন্যায় বিচার করছেন, নাকি তার ক্ষমতার প্রদর্শনী করছেন?

এক্ষেত্রে বলা যায়, ইসলামে ন্যায় বিচারক আল্লাহর যে ধারণা প্রচলিত রয়েছে, তা মূলত কোরআনের এই আয়াতগুলো দ্বারাই বাতিল করে দেয়া যায়, যা নৈতিকতার ধারনা থেকে সম্পূর্ণ বিচ্যুত।

উপসংহার

ইসলামের “ন্যায় বিচারক আল্লাহ” ধারণা অন্ধভাবে বিশ্বাস করতে বলা হলেও, আদম ও ফেরেশতাদের ঘটনার প্রেক্ষিতে তা পক্ষপাতদুষ্টতার পরিচায়ক। এখানে স্পষ্ট যে, আল্লাহ আদমকে জ্ঞান দিয়ে এবং ফেরেশতাদের সেই জ্ঞান না দিয়ে তাদের পরীক্ষা নিয়েছেন। এটি কোনোভাবেই ন্যায় বিচার নয়, বরং এক প্রকার ক্ষমতার অপব্যবহার হিসেবে চিত্রিত করতে হয়।