15.আল্লাহই বজ্রপাত দ্বারা মানুষ মারেন

ভূমিকা

কোরআন ইসলামের অনুসারীদের কাছে একটি পবিত্র গ্রন্থ, যা ঈশ্বরের নির্দেশিকা হিসেবে বিবেচিত। কিন্তু এর বিভিন্ন আয়াতে এমন কিছু বক্তব্য পাওয়া যায়, যা নৈতিকতা, বিজ্ঞান ও যুক্তির দৃষ্টিকোণ থেকে ভয়াবহ কিছু দাবী করে। উদাহরণস্বরূপ, কোরআনের কয়েকটি আয়াতে (যেমন, সূরা রাদ, আয়াত ১৩) উল্লেখ রয়েছে যে, আল্লাহই বজ্রপাত ঘটান এবং তিনি যাকে ইচ্ছা তা দিয়ে আঘাত করেন। অর্থাৎ, বজ্রপাতের মাধ্যমে কারো মৃত্যু হলে সেটি আল্লাহর ইচ্ছারই ফলাফল। এই ঘটনাটি আসলে আল্লাহ পাকই ইচ্ছাকৃতভাবেই ঘটান। এই বক্তব্যে একটি গভীর প্রশ্নের উদ্ভব হয়: যদি আল্লাহই বজ্রপাতের মাধ্যমে মানুষকে আঘাত করে থাকেন, তবে তার ওপর সেই মৃত্যুর নৈতিক দায় বর্তায় কিনা? এবং যদি তাকে দায়ী করা হয়, তবে তিনি কি বিচার ও জবাবদিহিতার ঊর্ধ্বে? তাকে কী এই অপরাধের জন্য মানুষের খুনী হিসেবে আমরা চিহ্নিত করতে পারি?

বজ্রপাতের বৈজ্ঞানিক বাস্তবতা বনাম ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ

যুক্তিবাদী মানুষের মতে, বজ্রপাত একটি প্রাকৃতিক বৈজ্ঞানিক ঘটনা, যা বৈদ্যুতিক চার্জের পরিবর্তন এবং আবহাওয়ার পরিবর্তনের কারণে ঘটে থাকে। বিজ্ঞান অনুযায়ী, বজ্রপাত মূলত বায়ুমণ্ডলে বিদ্যমান বৈদ্যুতিক শক্তি এবং মেঘের মধ্যে বিদ্যুৎ প্রবাহের কারণে ঘটে, যা প্রকৃতির একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। এটি কোন মহাজাগতিক শক্তির ইচ্ছার ফল নয়, বরং বৈজ্ঞানিকভাবে বোধগম্য এবং পরীক্ষিত একটি ঘটনা। আসুন দেখি কোরআন এই বিষয়ে কী বলে, [1]

বজ্রনাদ তাঁরই ভয়ে তাঁর প্রশংসা বর্ণনা করে আর ফেরেশতারাও। তিনি গর্জনকারী বজ্র প্রেরণ করেন আর তা দিয়ে যাকে ইচ্ছে আঘাত করেন, আর তারা আল্লাহ সম্পর্কে বিতন্ডায় লিপ্ত হয়। অথচ তিনি বড়ই শক্তিশালী।
— Taisirul Quran
বজ্র ধ্বনি ও মালাইকা সভয়ে তাঁর সপ্রশংস মহিমা ও পবিত্রতা ঘোষণা করে। তিনি বজ্রপাত ঘটান এবং যাকে ইচ্ছা ওটা দ্বারা আঘাত করেন। তথাপি ওরা আল্লাহ সম্বন্ধে বিতন্ডা করে; যদিও তিনি মহা শক্তিশালী ।
— Sheikh Mujibur Rahman
আর বজ্র তার সপ্রশংস তাসবীহ পাঠ করে এবং ফেরেশতারাও তার ভয়ে। আর তিনি গর্জনকারী বজ্র পাঠান। অতঃপর যাকে ইচ্ছা তা দ্বারা আঘাত করেন এবং তারা আল্লাহ সম্বন্ধে ঝগড়া করতে থাকে। আর তিনি শক্তিতে প্রবল, শাস্তিতে কঠোর।
— Rawai Al-bayan
আর রা’দ তাঁর সপ্রশংস মহিমা ও পবিত্রতা ঘোষণা করে [১] এবং ফেরেশতাগণও তা-ই করে তাঁর ভয়ে। আর তিনি গর্জনকারী বজ্র পাঠান অতঃপর যাকে ইচ্ছে তা দ্বারা আঘাত করেন [২] এবং তারা আল্লাহ্ সম্বন্ধে বিতণ্ডা করে, আর তিনি শক্তিতে প্রবল শাস্তিতে কঠোর [৩]।
— Dr. Abu Bakr Muhammad Zakaria

আসুন তাফসীরে জালালাইন থেকে পড়ি, এই সম্পর্কে কী ব্যাখ্যা বলা আছে, [2]

বজ্রপাত

অন্যদিকে, কোরআনের বক্তব্য অনুযায়ী, আল্লাহ সরাসরি বজ্রপাত নিয়ন্ত্রণ করেন এবং তিনি যাকে ইচ্ছা তা দিয়ে আঘাত করেন। এর মানে দাঁড়ায়, একজন শিশু যদি বজ্রপাতে মারা যায়, তবে সেটিও আল্লাহরই ইচ্ছা। এই দৃষ্টিকোণ থেকে, আল্লাহর ইচ্ছাই প্রকৃত কারণ হিসেবে দাঁড়ায়। এ ধরনের বক্তব্য ইসলামের অনুসারীদের কাছে আল্লাহর পরম ক্ষমতা ও তার ইচ্ছার প্রতিফলন হলেও, এটি যুক্তিবাদী চিন্তা এবং নৈতিকতার ক্ষেত্রে কিছু গুরুতর প্রশ্নের জন্ম দেয়। যেমন ধরুন, একজন ইসলামে বিশ্বাসী মানুষের শিশু সন্তান যদি বজ্রপাতে মৃত্যুবরণ করেন, সেই মুসলিমটি কী এই ঘটনায় আল্লাহর ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটেছে ভেবে খুশি হন, নাকি এরকম একটি ভয়াবহ ঘটনা ঘটায় দুঃখ পান? তিনি কী বজ্রপাতে যেন আর কারো মৃত্যু না ঘটে, সেই বিষয়টি নিশ্চিত করতে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির অবলম্বন করেন, নাকি এগুলো আল্লাহর ইচ্ছা হিসেবে এগুলো ঘটার সুযোগ রেখে দেন? [3]

বজ্রপাত 1

নৈতিক দায়িত্ব এবং বিচারযোগ্যতা: আল্লাহর ভূমিকা

যদি আমরা এই বক্তব্যকে আক্ষরিক অর্থে গ্রহণ করি, তবে আল্লাহকে বজ্রপাতে হওয়া সকল মৃত্যুর জন্য দায়ী করতে হয়। একজন নিরীহ শিশু যদি বজ্রপাতে মারা যায়, তবে তার মৃত্যু কেন ঘটল? কেন একজন সর্বশক্তিমান এবং দয়ালু স্রষ্টা সেই শিশুকে এমন একটি নির্মম মৃত্যুর শিকার করবেন? যদি বলা হয় এটি আল্লাহর ইচ্ছা, তবে এই ইচ্ছার নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে। আল্লাহ কি এই মৃত্যুর জন্য জবাবদিহি করতে প্রস্তুত?

বজ্রপাতে মানুষের মৃত্যু কি স্রেফ আল্লাহর প্রতিশোধ বা পরীক্ষা? যদি আল্লাহ সত্যিই মানুষকে এভাবে আঘাত করেন, তবে এটি কি নৈতিক? যদি আমরা আল্লাহকে একটি ন্যায়বিচারক হিসেবে বিবেচনা করি, তবে কেন তিনি এমন শাস্তি প্রদান করবেন, যার কোনো যৌক্তিকতা বা মানবিকতা নেই? এই প্রশ্নগুলোর সঠিক উত্তর ধর্মীয় বিশ্বাসের গণ্ডিতে পাওয়া প্রায় অসম্ভব। কারণ, স্রষ্টার ইচ্ছাকে প্রশ্ন করা ধর্মীয়ভাবে অশ্রদ্ধার সামিল হলেও, যুক্তির বিচারে এটি একটি মৌলিক প্রশ্ন।

আল্লাহর ইচ্ছা বনাম মানবিক দৃষ্টিকোণ: একটি জটিল বৈপরীত্য

ধর্মীয় বিশ্বাসীরা হয়তো বলবেন, আল্লাহর ইচ্ছা ও শক্তির উপর কোনো প্রশ্ন তোলার অধিকার মানুষের নেই। তার মানে কি এই যে, ক্ষমতার সাথে জবাবদিহিতার একটি সম্পর্ক রয়েছে? যার অনেক ক্ষমতা, সে জবাবদিহিতা থেকে মুক্তি পেয়ে যায়? মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে, একজন শিশু বা কোনো নিরপরাধ ব্যক্তির মৃত্যুতে আমরা শোকাহত হই। আমরা মনে করি, এ ধরনের মৃত্যুকে স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করা যায় না। আমরা এই ধরনের মৃত্যু যেন আরও না ঘটে, তার জন্য বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ব্যবহার করে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেয়ার চেষ্টা করি। তাহলে, সেই ব্যবস্থাগুলো কী আল্লাহদ্রোহ নয়? একজন পরিপুর্ণ ইসলামে বিশ্বাসী মানুষ হিসেবে একজন মুমিনের আল্লাহর ইচ্ছাকে বাধাগ্রন্থ করতে চাওয়া কী উচিত হবে?

উপসংহার: বিশ্বাসের দ্বৈততা ও যুক্তির দ্বন্দ্ব

বজ্রপাতের মতো প্রাকৃতিক ঘটনাকে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে আল্লাহর ইচ্ছা হিসেবে উপস্থাপন করা একটি গুরুতর দার্শনিক, যৌক্তিক ও নৈতিক প্রশ্নের জন্ম দেয়। একদিকে, এটি আল্লাহর ক্ষমতার প্রতি আস্থা প্রকাশ করে, অন্যদিকে, এটি নৈতিক ও মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে চরম অন্যায় এবং অসংগতিপূর্ণ বলে মনে হয়। যদি আল্লাহ নিজেই সমস্ত বজ্রপাতের নিয়ন্ত্রক এবং এর মাধ্যমে মানুষকে আঘাত করেন, তবে আল্লাহর ওপর সেই আঘাতের দায় বর্তায়।

এ কারণে, কোরআনে বর্ণিত বজ্রপাত সংক্রান্ত আয়াতগুলোর যৌক্তিকতা ও নৈতিকতা নিয়ে পুনরায় ভাবা উচিত এবং মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে এ ধরনের বক্তব্যের প্রকৃত উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তোলা উচিত। যদি আল্লাহকে সত্যিই ন্যায়পরায়ণ, দয়ালু এবং নৈতিকতার প্রতীক হিসেবে মেনে নেওয়া হয়, তবে এ ধরনের বক্তব্যের কোন অর্থই থাকে না। অন্যথায়, এটি আল্লাহর ইমেজকে এক ধরনের স্বৈরাচারী এবং অমানবিক শাসকের রূপে পরিণত করে, যা কোনোভাবেই একজন সর্বশক্তিমান ও পূজনীয় সত্তার উপযুক্ত প্রতিচ্ছবি হতে পারে না।

তথ্যসূত্র

  1. সূরা আ রাদ , আয়াত ১৩ []
  2. তাফসীরে জালালাইন, ৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩৪০, ৩৪১ []
  3. জৈন্তাপুরে বজ্রপাতে ৩ শিশুর মৃত্যু []


সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত © ২০২৪ "সংশয় - চিন্তার মুক্তির আন্দোলন"