14.আল্লাহর সাহায্যের প্রয়োজন

ইসলামের মৌলিক বিশ্বাস অনুসারে, আল্লাহ হলেন সর্বশক্তিমান, সর্বজ্ঞানী, এবং সর্বব্যাপী সত্তা। ইসলামে আল্লাহকে সর্বশক্তিমান হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে, যার ক্ষমতা এবং জ্ঞান সীমাহীন এবং যিনি কোনো কিছুতে কারো সাহায্যের প্রয়োজন অনুভব করেন না। তবুও, কোরআনের কিছু আয়াতে এমন বক্তব্য পাওয়া যায় যে, আল্লাহ মানুষের সাহায্য চেয়েছেন, যা ইসলামের মৌলিক আকীদার সাথে মারাত্মকভাবে সাংঘর্ষিক। যেমন, সুরা মুহাম্মাদ-এর ৭ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, “হে মুমিনগণ! তোমরা যদি আল্লাহর সাহায্য করো, তবে তিনিও তোমাদের সাহায্য করবেন এবং তোমাদের পা দৃঢ় রাখবেন।” এখানে “আল্লাহর সাহায্য” করার যে কথা বলা হয়েছে, তা আল্লাহর সর্বশক্তিমান হওয়ার ধারণার সঙ্গে একটি যুক্তিগত বিরোধ তৈরি করে। যদি আল্লাহ সত্যিই সর্বশক্তিমান হন, তাহলে কেন তিনি মানুষের সাহায্যের প্রয়োজন বোধ করবেন?

প্রথমত, আল্লাহর সর্বশক্তিমান হওয়ার ধারণা অনুযায়ী, তিনি নিজেই সবকিছু করতে সক্ষম, এবং তাঁর সৃষ্টিকে পরিচালনা করার জন্য বা কোনকিছুর জন্যেই কোনো সাহায্য বা সহযোগিতার প্রয়োজন নেই। না ফেরেশতার কাছ থেকে, না মানুষের কাছ থেকে, না নবী রাসুলের কাছ থেকে। তার ক্ষমতা যদি সর্বত্র বিস্তৃত থাকে, তাহলে মানুষের সাহায্য সহায়তা ছাড়াই তিনি যা চান তা করতে পারেন। কারো সাহায্য বা সহায়তা শুধুমাত্র তখনই প্রয়োজন, যখন ওই কাজটি সম্পর্কে সাহায্যপ্রার্থীর অপারগতা রয়েছে। যেমন, আমার সুস্থ হৃদপিণ্ড পরিচালনা করতে আমার অন্য কারো সাহায্য প্রয়োজন নেই। আমার সুস্থ হৃদপিণ্ড নিজেই তার কাজ করতে সক্ষম। কিন্তু যদি কখনো এমন পরিস্থিতি আসে যে, আমার হৃদপিণ্ড চলতে কোন বাইরের সাহায্য প্রয়োজন, যেমন অনেক সময় হৃদপিণ্ডের কোন অসুখের জন্য ডাক্তারের সাহায্য হৃদপিণ্ডকে সচল করতে হয়, তা শুধুমাত্র তখনই প্রয়োজন, যখন আমার হৃদপিণ্ড নিজে চলতে অক্ষম। যখন কোরআনে আল্লাহর পক্ষ থেকে সাহায্যের আবেদন করা হয়, তখন প্রশ্ন ওঠে, আল্লাহ কী কাজটি নিজে করতে অক্ষম যে, তার সাহায্যের দরকার হচ্ছে? বা তিনি কেন অন্য কারো উপর নির্ভরশীল হচ্ছেন? এ ধরনের ধারণা ইসলামের মৌলিক বিশ্বাসের সাথে সাংঘর্ষিক, কারণ ইসলামে আল্লাহকে স্বয়ংসম্পূর্ণ ও অনির্ভরশীল সত্তা হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। তার সবকিছু করার ক্ষমতা এবং ক্ষমতার পূর্ণতা ইসলামিক তাওহীদের একটি প্রধান ভিত্তি।

দ্বিতীয়ত, এই ধরনের বক্তব্য নৈতিক এবং ধর্মীয় দিক থেকে মানুষের উপর চাপ সৃষ্টি করে। যদি আল্লাহর সাহায্য না করা হয়, তবে কোরআনের ভাষ্যমতে, মানুষ আল্লাহর অনুগ্রহ বা সাহায্য লাভ করতে সক্ষম হবে না। এটি এক ধরনের দ্বৈত নৈতিকতা তৈরি করে, যেখানে মানুষকে এমন একটি কাজ করতে বলা হচ্ছে যা আসলে আল্লাহর ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা নির্দেশ করে। এই দ্বৈততার ফলে ইসলামিক বিশ্বাসের মৌলিক দিকগুলোর সাথে সাংঘর্ষিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে।

তৃতীয়ত, যদি আল্লাহ সর্বশক্তিমান হয়ে থাকেন এবং সমস্ত কিছুর উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ রাখেন, তাহলে তিনি নিজেই সবকিছু সম্পন্ন করতে পারেন। কিন্তু কোরআনের এই ধরনের বক্তব্যে পরিষ্কার হয়, আল্লাহ তার ইচ্ছাপূরণের জন্য মানুষের সহায়তার প্রয়োজন অনুভব করছেন। এটা আল্লাহর সর্বশক্তিমান সত্তার ধারণার সাথে খাপ খায় না এবং আল্লাহকে একটি অসীম ক্ষমতাশালী সত্তা হিসেবে উপস্থাপিত করার বিশ্বাসের সাথে বিরোধ সৃষ্টি করে।

এখানে সবচেয়ে বড় সাংঘর্ষিক বিষয় হলো, আল্লাহর সর্বশক্তিমান হওয়ার ধারণা এবং তার পক্ষ থেকে মানুষের সাহায্য চাওয়ার মধ্যে একটি অসামঞ্জস্য। কোরআনে আল্লাহকে যেখানে স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং অনির্ভরশীল হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে, সেখানে মানুষের সহযোগিতা চাওয়া তার সেই বৈশিষ্ট্যের বিরুদ্ধে যায়। একজন সর্বশক্তিমান সত্তার পক্ষে মানুষের সহযোগিতা প্রয়োজনীয় হওয়া তার ক্ষমতার সীমাবদ্ধতার ইঙ্গিত দেয়, যা ইসলামের প্রধান বিশ্বাসের সাথে সাংঘর্ষিক।

সূরা মুহাম্মদ, আয়াত ৭
O you who have believed, if you support Allāh, He will support you and plant firmly your feet.
— Saheeh International
O ye who believe! If ye help Allah, He will help you and will make your foothold firm.
— M. Pickthall
হে ঈমানদারগণ! তোমরা যদি আল্লাহকে সাহায্য কর, তিনি তোমাদেরকে সাহায্য করবেন আর তোমাদের পাগুলোকে দৃঢ়প্রতিষ্ঠ করবেন।
— Taisirul Quran
হে মু’মিনগণ! যদি তোমরা আল্লাহকে সাহায্য কর তাহলে আল্লাহ তোমাদেরকে সাহায্য করবেন এবং তোমাদের অবস্থান দৃঢ় করবেন।
— Sheikh Mujibur Rahman
হে মুমিনগণ, যদি তোমরা আল্লাহকে সাহায্য কর তবে আল্লাহও তোমাদেরকে সাহায্য করবেন এবং তোমাদের পা সুদৃঢ় করে দেবেন।
— Rawai Al-bayan
হে মুমিনগণ! যদি তোমরা আল্লাহকে সাহায্য কর, তবে তিনি তোমাদেরকে সাহায্য করবেন এবং তোমাদের পা সমূহ সুদৃঢ় করবেন।
— Dr. Abu Bakr Muhammad Zakaria

আরেকটি আয়াতে বলা হয়েছে, [1] আল্লাহ তাকেই শুধুমাত্র সাহায্য করেন, যে আল্লাহকে সাহায্য করে। পাঠক লক্ষ্য করুন, এই আয়াতটির অনুবাদ করতে গিয়ে কিছু কিছু অনুবাদক মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছেন,

… আল্লাহ অবশ্যই তাকে সাহায্য করেন যে তাঁকে সাহায্য করে, আল্লাহ শক্তিমান, পরাক্রান্ত।
— Taisirul Quran
… নিশ্চয়ই আল্লাহ তাকে সাহায্য করেন যে নিজকে সাহায্য করে; নিশ্চয়ই আল্লাহ শক্তিমান, পরাক্রমশালী।
— Sheikh Mujibur Rahman
… আর আল্লাহ অবশ্যই তাকে সাহায্য করেন, যে তাকে সাহায্য করে। নিশ্চয় আল্লাহ শক্তিমান, পরাক্রমশালী।
— Rawai Al-bayan
… আর নিশ্চয় আল্লাহ্‌ তাকে সাহায্য করেন যে আল্লাহ্‌কে সাহায্য করে [৩]। নিশ্চয় আল্লাহ্‌ শক্তিমান, পরাক্রমশালী।
— Dr. Abu Bakr Muhammad Zakaria

তথ্যসূত্র

  1. সূরা হাজ্ব, আয়াত ৪০ []


সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত © ২০২৪ "সংশয় - চিন্তার মুক্তির আন্দোলন"