02.ফেরাউনের অক্ষত লাশ?

২০১৩ সালে আরব নিউজ নামের একটি ওয়েবসাইটে এই আর্টিকেলটি [1] ছাপা হয়, যার মাধ্যমে এই গুজবটি ছড়িয়ে পড়ে। কোরআনে বলা হয়েছে [2]

আর আমি বনী ইসরাঈলকে সমুদ্র পার করিয়ে নিলাম। আর ফির‘আউন ও তার সৈন্যবাহিনী ঔদ্ধত্য প্রকাশ ও সীমালঙ্ঘনকারী হয়ে তাদের পিছু নিল। অবশেষে যখন সে ডুবে যেতে লাগল, তখন বলল, ‘আমি ঈমান এনেছি যে, সে সত্তা ছাড়া কোন ইলাহ নেই, যার প্রতি বনী ইসরাঈল ঈমান এনেছে। আর আমি মুসলিমদের অন্তর্ভুক্ত’।
‘এখন অথচ ইতঃপূর্বে তুমি নাফরমানী করেছ, আর তুমি ছিলে ফাসাদকারীদের অন্তর্ভুক্ত’।
‘সুতরাং আজ আমি তোমার দেহটি রক্ষা করব, যাতে তুমি তোমার পরবর্তীদের জন্য নিদর্শন হয়ে থাক। আর নিশ্চয় অনেক মানুষ আমার নিদর্শনসমূহের ব্যাপারে গাফেল’।
— Rawai Al-bayan

অর্থাৎ কোরআন শরীফে বলা হয়েছে, ফেরাউন- যে কিনা মুসা নবীর পেছনে ধাওয়া করেছিলেন, এবং আল্লাহর কুদরতে সমুদ্রে ডুবে মারা গিয়েছিলেন, তার লাশ আজ অর্থাৎ সেইদিন সমুদ্রের ভেতরে আল্লাহর কুদরতে অক্ষত থাকবে। কিন্তু কোর আনে যেটি বলাই হয়নি, সেটি দাবী করে বসে আছে ইসলাম প্রচারকগণ! ফেরাউনের একটি ‘মমি’ দেখিয়ে অসংখ্য প্রোপাগান্ডা ভিডিও এবং নিউজ বানানো হয়েছে, যেগুলোতে এটাও দাবী করা হচ্ছে, এই লাশটি উদ্ধার করা হয়েছে সমুদ্র থেকে। যেটি আসলে একটি মমি, যা আবিষ্কার হয়েছে ১৮৮১ সালে, এবং বর্তমানে মিশরের রয়েল মিউজিয়ামে সংরক্ষিত রয়েছে। লাশটির অক্ষত থাকাই নাকি আল্লাহর কুদরতের প্রমাণ! আসুন ইসলামিস্টদের দাবীর একটি নমুনা দেখে নিই,

ফেরাউন কে?

প্রথমেই আমাদের জানা থাকা জরুরি যে, ফেরাউন কে বা কী। ফেরাউন বা ফারাওন কোন একক ব্যক্তি নয়। ফারাও হলো গ্রিক-রোমান কর্তৃক বিজয়ের পূর্ব পর্যন্ত প্রাচীন মিশরীয় রাজবংশের রাজাদের প্রচলিত উপাধি। পুরুষ রাজা, এমনকি ফেরাউন শব্দটা মহিলা শাসকদের ক্ষেত্রেও ব্যবহার করা হত। তাই নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন, ফেরাউন কোন লোক নয়, একটা উপাধি। আমাদের দেশে যেমন এখন রাষ্ট্রপতি। ফেরাউন বা ফারাও শব্দটির আক্ষরিক অর্থ “মহান ঘর” বা “great house”। মিশরের প্রাচীন শাসকদের ফারাও বলা হত। এই আয়াতে কোরআনের ভুলটি হচ্ছে, ফারাও বা ফেরাউনকে একক কোন ব্যক্তি হিসেবে চিহ্নিত করা। ফেরাউন কোনো একক ব্যক্তি নন, বরং বংশানুক্রমে একের পর এক ফারাও মিশরকে শাসন করেছেন। ফেরাউন আর মুসার যেই উপকথা, সেই উপকথা আসলে বিভিন্ন জায়গার আঞ্চলিক উপকথা, যা কয়েকটি প্রধান ধর্মগ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু ঠিক কোন ফেরাউনের কথা বলা হয়েছে, তা নিয়ে ধর্মবিশারদ ঐতিহাসকদের মধ্যে নানা মতভেদ আছে। সেই আলোচনা আরেকদিন করা যাবে।

মমি কী?

মমি হলো একটি মৃতদেহ যা জীবের শরীরের নরম কোষসমষ্টিকে পচে গলে যাওয়া থেকে রক্ষা করে। প্রাচীন মিশরে, উত্তর চিলিতে এবং দক্ষিণ পেরুতে মানুষ মৃতদেহ মমি করার কৌশল জানতো। মিশরের রয়াল জাদুঘরে মোট ২২টি মমি রয়েছে, যেখানে ১৮টি ফারাও, এবং ৪টি অন্য অভিজাতের মমি রয়েছে [3]। এই পর্যন্ত প্রত্নতত্ত্ববিদদের দ্বরা আবিষ্কৃত অনেকগুলো মমিকে অক্ষত বলার কোন উপায় নেই। মমিফিকেশন করার সময়ই লাশের আভ্যন্তরীণ প্রত্যঙ্গ সরিয়ে ফেলা হয়, যেগুলো দ্রুত পচনশীল। সেগুলোকে ক্যানোপিক বয়ামে সংরক্ষণ করা হয়। শরীরে লবণ বা বালি দিয়ে আদ্রর্তা বের করে নেয়ার জন্য ৭০ দিন ফেলে রাখা হয়, এবং সবশেষে তাকে কাপড় নিয়ে আপাদমস্তক মুড়ে দেয়া হয়। পরে তার সামাজিক অবস্থান অনুযায়ী নির্দিষ্ট কফিনে ঢুকিয়ে রাখা হয়। এই প্রক্রিয়াটি একটি প্রাচীন মিশরীয় ধর্মীয় রীতি, এবং এটি বিজ্ঞান অনেক ভালোভাবেই ব্যাখ্যা করতে পারে [4]

সেই প্রাচীনযুগ থেকেই বিভিন্ন সভ্যতায় মমি তৈরির প্রক্রিয়া মানুষের জানা ছিল। যেমন দক্ষিণ আমেরিকার Chinchorro সংস্কৃতিতে লাশকে মমি বানানো হত ব্ল্যাক ম্যাঙ্গানিজ ব্যবহার করে, এবং এই প্রক্রিয়ার বয়স প্রায় ৭,০০০ বছর। উত্তর আমেরিকার নেভাডায় আবিষ্কৃত মমির বয়স ১০ হাজার বছর বলে রেডিওকার্বন ডেটিংয়ের ফলাফল এসেছে [5]। আসুন এবারে দেখে নেয়া যাক, আসলেই এই মমিটি অক্ষত কিনা।

ফেরাউন
মমি বা লাশ

কার মমির কথা বলা হচ্ছে?

১৮৮১ সালে যেই মমিটি পাওয়া যায়, সেই মমিটি দ্বিতীয় রামিসেসের। এই ফেরাউনের জন্ম (প্রায়) খ্রিস্টপূর্ব ১৩০৩; মৃত্যু জুলাই বা আগস্ট ১২১৩ খ্রিস্টপূর্ব; শাসনকাল হচ্ছে, ১২৭৯–১২১৩ খ্রিস্টপূর্ব। উনাকে রামিসেস দ্য গ্রেট বা মহান রামিসেসও বলা হতো। তিনি ছিলেন মিশরের উনবিংশতম রাজবংশের তৃতীয় ফারাও রাজা। ইসলামিস্টদের তৈরি ভিডিওটি খুব ভালভাবে শুনলে দেখবেন, ভিডিওগুলোতে দাবী করা হচ্ছে, এই মমিটি নাকি আবিষ্কার করা হয়েছে সমুদ্র থেকে। যা ডাঁহা মিথ্যা কথা।

বলা হচ্ছে, ফেরাউনের লাশ, যা ১২৩৫ খ্রিস্টপূর্বে সমুদ্রে ডুবে গিয়েছিল, ৩১১৬ বছর সমুদ্রের ভেতরে থাকবার পরেও আল্লাহর কুদরতে লাশটি অক্ষত রয়ে গেছে! এটা ডাঁহা মিথ্যাচার। সত্য হচ্ছে, ৯০ বা ৯১ বছর বয়সে মৃত্যুর পরে এই ফেরাউনের মমি তৈরি করে তা ভ্যালি অব দ্য কিংসের একটি সমাধিতে কবরস্থ করা হয়; পরবর্তীতে তার দেহকে একটি রাজ সংগ্রহশালায় স্থানান্তর করা হয়, যেখানে ১৮৮১ সালে তা আবিষ্কৃত হয়, এবং বর্তমানে এটি কায়রো জাদুঘরে সংরক্ষিত রয়েছে। সত্য হচ্ছে, এই ফেরাউনের এই মমিটি কখনোই সমুদ্রের তলদেশে ছিল না। ইসলামের সাথে মেলাবার জন্য খুব কৌশলে তথ্য বিকৃত করা হয়েছে।

মমি তৈরির প্রক্রিয়া

কয়েকটি ধাপে এই মমি বানানোর প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হতো। প্রথমে মৃতব্যক্তির নাকের মাঝে ছিদ্র করে মাথার ঘিলু ও মগজ বের করা হতো। শরীরের বিভিন্ন পচনশীল অঙ্গ যেমন: ফুসফুস, বৃক্ক, পাকস্থলি ইত্যাদি বের করা হতো। এসব অঙ্গ বের করার পর আবার পেট সেলাই করে দেয়া হতো। এক্ষেত্রে তারা খুব সতর্কতা অবলম্বন করতো। কারণ পেট সেলাই করতে গিয়ে যদি পেটের ভেতর বাতাস ঢুকে যায়, তাহলে মৃতদেহ পচে যাওয়ার আশঙ্কা ছিলো। অতঃপর মৃতদেহ ও বের করা অঙ্গগুলোতে লবণ মেখে শুকানো হতো। যখন সব ভালোভাবে শুকিয়ে যেতো, তখন গামলা গাইন গাছের পদার্থ ও বিভিন্ন প্রকার মসলা মেখে রেখে দেওয়া হতো। চল্লিশ দিন পর লিনেনের কাপড় দ্বারা পুরো শরীর পেঁচিয়ে ফেলা হতো। এরপর তারা মমিগুলোকে সংরক্ষণ করে রাখতো।

সেই মমি করবার লবণকে মরিস বুকাইলি সমুদ্রে থাকা লবণ বলে দাবী করেছেন, এবং প্রচার করেছেন মমিগুলো সমুদ্রের নীচে ছিল। সত্য হচ্ছে, মিশরের মানুষ তাদের মমি করবার কৌশল ব্যবহার করেই এই মমিগুলো বানিয়েছেন। এখানে আল্লাহর কোন কুদরত ছিল না, বা অলৌকিক উপায়ে আল্লাহর মোজেজায় মৃতদেহগুলো অক্ষত রয়ে যায় নি।

মরিস বুকাইলি কে ছিলেন?

মরিস বুকাইলির জন্ম ১৯ জুলাই, ১৯২০ এবং মৃত্যু ১৭ ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৮ সালে। তিনি একজন একজন ফরাসি চিকিৎসক ছিলেন। বুকাইলি ১৯৪৫ থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত মেডিসিন চর্চা করেন এবং গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজির উপর একজন বিশেষজ্ঞ ছিলেন। ১৯৭৩ সালে, বুকাইলি সৌদি আরবের বাদশাহ ফয়সালের পরিবারের চিকিৎসক হিসেবে নিযুক্ত হন। একই সাথে মিশরের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাতের পরিবারের সদস্যরা তার রোগী ছিল। তিনি বাইবেল কোরআন ও বিজ্ঞান বইটির জন্য বিখ্যাত হয়েছেন।

ফেরাউনের লাশটি মরিস বুকাইলির দেখেন ১৯৭৫ সালে, যখন সেই লাশটি মিশরেই ছিল। ফ্রান্সে ফেরার পর মরিস বুকাইলি এই লাশের সাথে কোনো প্রকার গবেষণা কাজে জড়িত ছিলেন বলে কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। এমনকি, মরিস বুকাইলির প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণার কোন ডিগ্রী আছে, প্রাচীন লাশ সম্পর্কে তিনি কোন বিশেষজ্ঞ মতামত দিতে পারেন, এরকম কোন সক্ষমতার প্রমাণও পাওয়া যায়নি। বুকাইলির পরামর্শে ফেরাউনের লাশটি ফ্রান্সে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, তিনি মমিটির অবস্থা শোচনীয় দেখতে পেয়ে ফ্রান্সের বিজ্ঞানীরা একে সাহায্য করতে পারবেন বলে মত দেন। মিশরীয়রা মমিটি দিতে না চাইলে ফরাসী প্রেসিডেন্টের অনুরোধে তারা সেই অনুমতি পান।

ফেরাউনের মমির ফরেনসিক গবেষণার দায়িত্বে ছিলেন Pierre-Fernand Ceccaldi, তিনি তার গবেষণা প্রকাশ করেন ১৯৮৭ সালে, Bulletin de l’Académie de Médecine- জার্নালে, Recherches sur les momies: Ramsès II শিরোনামে [6] এই বিষয়ে মরিস বুকাইলির কোনো গবেষণাপত্রের সন্ধান পাওয়া যায়নি। তিনি কোন ল্যাবরটরিতে এই পরীক্ষা করেছেন, তারও কোন হদিস মেলেনি।

ইসলামিস্টদের দাবী অনুসারে, মরিস বুকাইলি কয়েক ঘন্টা গবেষণার পর ফেরাউনের লাশে লবণের কিছু অবশিষ্টাংশ পান, যার ফলে তিনি দাবী করেন যে, সাগরে ডুবেই ফেরাউনের মৃত্যু হয়েছে। সাগরের লবণই সেই মমির শরীরে পাওয়া গেছে। কিন্তু তার এই দাবীর সপক্ষে তিনি কোন প্রমাণ উপস্থাপন করেননি। বরঞ্চ, এই বিষয়ে সত্যিকারের বিশেষজ্ঞগণ বলেছেন, মমি তৈরিতে লবণের ব্যবহার খুবই সাধারণ ব্যাপার। মমি তৈরি করতে প্রচুর পরিমাণে লবণ ব্যবহার করা হত। লবণ মাংসে এবং চামড়ার আদ্রর্তা টেনে নেয় (যেভাবে শুটকি তৈরি করা হয়ে থাকে)। তার মানে ফেরাউনের লাশে লবণ থাকাটা অস্বাভাবিক নয়, বরং প্রয়োজনীয়ও!

এমনকি, মরিস বুকাইলি এই লাশের গবেষণার সাথে সরাসরি জড়িত ছিলেন এরকমই কোন প্রমাণ মেলে না। এই বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের তৈরি ফরেনসিক রিপোর্টের মতে এই লাশটি যার, সেই দ্বিতীয় রামেসিসের মৃত্যুকালে বয়স হয়েছিল ৯০ অথবা ৯১ তার শরীরের পুরোনো হাড় ভাঙার ক্ষত ছিল, বাতের সমস্যার ইঙ্গিত ছিল। অন্য আরেক গবেষকের মতে তার মৃত্যু হয়েছিল দাঁতের ক্ষয়ের ফলে মুখের সংক্রমণের কারণে। আগ্রহী পাঠকগণ এই বইটি পড়ে দেখতে পারেন, এখানে এই বিষয়ে প্রচুর তথ্য প্রমাণ দেয়া রয়েছে [7]

এই বিষয়ে মিশরীয় প্রত্নতত্ত্ববিদ Zahi Hawass একটি সেমিনারে ফেরাউনের মৃত্যুর কারণ হিসেবে সমুদ্রে ডুবে মৃত্যুকে সন্দেহের চোখে দেখেছেন [8]। তিনি বলেন,

“সিটি স্ক্যান করে জানা সম্ভব নয় যে মমিটি ডুবে মারা গেছে কিনা। এটি প্রমাণ করার একমাত্র হল ফুসফুসে লবণ পাওয়া যায় কি না, কিন্তু ফুসফুস মমির ভিতরে পাওয়া যায় না।

তথ্যসূত্র

  1. The story of Maurice Bucaille’s inspiring conversion to Islam []
  2. কোরআন, সুরা ইউনুস, আয়াত ৯২ []
  3. Egypt’s royal mummies are on the move, and it’s not their first road trip []
  4. Mummification Step by Step []
  5. North America’s Oldest Mummy Sheds Light on Ancient Migrations []
  6. Recherches sur les momies: Ramsès []
  7. The encyclopedia of mummies []
  8. Is Ramses II the Pharaoh of Moses? []


সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত © ২০২৪ "সংশয় - চিন্তার মুক্তির আন্দোলন"