11.ভুল ভবিষ্যতবাণীঃ মদিনায় মহামারী প্রবেশ করবে না

ইসলামের বিভিন্ন হাদিসে বলা হয়েছে যে, মদিনা শহরে মহামারী বা প্লেগের মতো রোগ প্রবেশ করতে পারবে না, এবং এই শহর সব ধরনের মহামারী থেকে সুরক্ষিত থাকবে। নবী মুহাম্মদ -এর সময়কালে এমন দাবির ভিত্তিতে অনেকেই মনে করতেন যে, মদিনা একটি বিশেষ নিরাপদ স্থান, যেখানে আল্লাহর ইচ্ছায় কোন রোগ বা মহামারী আসবে না। কিন্তু বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। ইতিহাসের পৃষ্ঠায় বারবার প্রমাণিত হয়েছে যে, মদিনাতে বহুবার প্লেগ ও অন্যান্য মহামারীর প্রকোপ ছড়িয়ে পড়েছে। এমনকি, উমর ইবনুল খাত্তাবের শাসনামলেও মদিনায় মহামারী ছড়িয়ে পড়েছিল এবং বহু মানুষ এতে মৃত্যুবরণ করেছিল। এই ধরনের ঘটনার ফলে ইসলামের এইসকল মৌলিক বিশ্বাসগুলোর ভিত্তি প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে এবং এটি প্রমাণ করে যে, মদিনায় মহামারী প্রবেশ করবে না—এমন দাবি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন এবং অসত্য।

সাম্প্রতিককালের মহামারী কোভিড-১৯ এর সময়ও মদিনা শহরকে সম্পূর্ণরূপে লকডাউন করতে হয়েছিল এবং জনজীবন স্থবির হয়ে পড়েছিল। এটি প্রমাণ করে যে, মদিনা অন্যান্য শহর থেকে ভিন্ন কিছু নয়, একে পাহারা দেয়া বিশেষ কোন ফেরেশতা বাহিনীও নেই এবং এই শহর মহামারী থেকে মুক্ত নয়। সত্যিকার অর্থে এমন দাবি করার পেছনে কোনো বৈজ্ঞানিক বা বাস্তবভিত্তিক যুক্তি নেই। ধর্মীয় বিশ্বাস এবং আবেগের জায়গা থেকে এমন দাবি করা হয়তো কিছু মানুষের মনে এক ধরণের নিরাপত্তার অনুভূতি এনে দেয়, কিন্তু এই বিশ্বাসের ফলে মানুষের স্বাভাবিক বিচারবুদ্ধি ও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির ওপর চরম আঘাত হানে। মহামারী প্রতিরোধে জনস্বাস্থ্য সুরক্ষার কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের পরিবর্তে যদি মানুষ এমন অমূলক ধারণায় বিশ্বাসী হয়, তবে তা শুধু নিজেদের জীবনকেই ঝুঁকির মধ্যে ফেলবে না, বরং গোটা সমাজকেই বিপদের মুখে ঠেলে দেবে। তাই, এই ধরনের হাস্যকর হাদিসের ওপর ভিত্তি করে বাস্তবতা অস্বীকার না করে, আমাদের উচিত বৈজ্ঞানিক চিন্তাভাবনা এবং প্রমাণের ওপর নির্ভর করে নিজেদের এবং সমাজের সুরক্ষা নিশ্চিত করা।

মদিনা শহরকে মহামারী থেকে সুরক্ষিত বলে বর্ণনা করা ইসলামী হাদিসের এই দাবি শুধু বাস্তবতার সাথেই সাংঘর্ষিক নয়, বরং এটি ধর্মের কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাসের প্রচারও করে। যদি মদিনা সত্যিই মহামারী প্রবেশের জন্য নিষিদ্ধ থাকত, তবে কেন সেখানে ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে প্লেগের মতো ভয়াবহ রোগ ছড়িয়েছে? কেন করোনার মতো মহামারী থেকে রক্ষা পেতে মদিনা শহরকে লকডাউন করতে হয়েছিল? এটি স্পষ্টতই প্রমাণ করে যে, প্রকৃতি ও জীববিজ্ঞানের কোনো নিয়মই কোনো নির্দিষ্ট ধর্মীয় বিশ্বাসের ওপর নির্ভরশীল নয়। রোগ ব্যাধি আল্লাহ বা ফেরেশতাদের তোয়াক্কা করে না। রোগ বা মহামারী কোন ধর্ম, স্থান বা জাতি নির্বিশেষে যে কোন স্থানে ছড়াতে পারে এবং তা প্রতিরোধের জন্য বৈজ্ঞানিক ও চিকিৎসাবিজ্ঞানের ওপর নির্ভর করা ছাড়া আর কোন কার্যকর পন্থা নেই।

আসুন দেখে নিই, ইসলামের এই বিশ্বাসের দলিলগুলো। নবী মুহাম্মদ ঘোষনা করেছিলেন, মদিনা শহরে কোনদিনই মহামারী বা প্লেগ প্রবেশ করবে না [1] [2]

সহীহ বুখারী (ইসলামিক ফাউন্ডেশন)
৬৩/ চিকিৎসা
পরিচ্ছেদঃ ২৩০১. প্লেগ রোগের বর্ণনা
ইসলামিক ফাউন্ডেশন নাম্বারঃ ৫৩২০, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ৫৭৩১
৫৩২০। আবদুল্লাহ ইবনু ইউসূফ (রহঃ) … আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ মদিনা নগরীতে প্রবেশ করতে পারবে না মাসীহ দাজ্জাল, আর না মহামারী।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
বর্ণনাকারীঃ আবূ হুরায়রা (রাঃ)

সহীহ বুখারী (ইসলামিক ফাউন্ডেশন)
৮৬/ জাহ্‌মিয়াদের মতের খণ্ডন ও তাওহীদ প্রসঙ্গ
পরিচ্ছেদঃ ৩১৩৩. আল্লাহ্‌র ইচ্ছা ও চাওয়া। মহান আল্লাহ্‌র বাণীঃ তোমরা ইচ্ছা করবে না যদি না আল্লাহ্‌ ইচ্ছা করেন (৭৬ঃ ৩০)। আল্লাহ্‌ তা’আলার বাণীঃ তুমি যাকে ইচ্ছা ক্ষমতা প্রদান কর (৩ঃ ২৬)। মহান আল্লাহ্‌র বাণীঃ কখনই তুমি কোন বিষয়ে বলবে না, ‘আমি তা আগামী কাল করব, আল্লাহ্‌ ইচ্ছা করলে,’ এ কথা না বলে (১৮ঃ ২৩-২৪)। মহান আল্লাহ্‌র বাণীঃ তুমি যাকে ভালবাস, ইচ্ছা করলেই তাকে সৎপথে আনতে পারবে না। তবে আল্লাহ্‌ যাকে চান তাকে সৎপথে আনয়ন করেন। (২৮ঃ ৫৬)। সাঈদ ইব্নুল মুসাইয়্যাব (রহঃ) তাঁর পিতা মুসাইয়্যাব থেকে বলেন, উপরোক্ত আয়াত আবূ তালিব সম্পর্কে নাযিল হয়েছে। মহান আল্লাহ্‌র বাণীঃ আল্লাহ্‌ তোমাদের জন্য যা সহজ তা চান এবং যা তোমাদের জন্য কষ্টকর তা চান না (২ঃ ১৮৫)
৬৯৬৫। ইসহাক ইবনু আবূ ঈসা (রহঃ) … আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ দাজ্জাল মদিনার উদ্দেশ্যে আসবে, তবে সে ফেরেশতাদেরকে মদিনা পাহারারত দেখতে পাবে। সুতরাং দাজ্জাল ও প্লেগ মদিনার কাছেও আসতে পারবে না ইনশা আল্লাহ।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
বর্ণনাকারীঃ আনাস ইবনু মালিক (রাঃ)

একইসাথে বুখারী শরীফেরই আরেকটি সহিহ হাদিসেই বলা আছে, উমরের আমলেই মদিনায় ছড়িয়ে পরে। হাদিসটি পড়ার সময় লক্ষ্য করুন, উমরকে আমীরুল মুমিনীন সম্বোধন করা হয়েছে, যার অর্থ সময়টি উমরের খিলাফতে [3]

সহীহ বুখারী (ইসলামিক ফাউন্ডেশন)
৪৪/ শাহাদাত
পরিচ্ছেদঃ ১৬৪৭. কারো সততা প্রমাণের ক্ষেত্রে ক’জনের সাক্ষ্য প্রয়োজন
ইসলামিক ফাউন্ডেশন নাম্বারঃ ২৪৬৭, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ২৬৪৩
২৪৬৭। মূসা ইবনু ইসমাঈল (রহঃ) … আবূল আসওয়াদ (রহঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একবার আমি মদিনায় আসলাম, সেখানে তখন মহামারী দেখা দিয়েছিল। এতে ব্যাপক হারে লোক মারা যাচ্ছিল। আমি উমর (রাঃ) এর কাছে বসাছিলাম। এমন সময় একটি জানাযা অতিক্রম করলো এবং তার সম্পর্কে ভালো ধরনের মন্তব্য করা হল। তা শুনে উমর (রাঃ) বললেন, ওয়াজিব হয়ে গেছে। এরপর আরেকটি জানাযা নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল এবং তার সম্পর্কেও ভালো মন্তব্য করা হল। তা শুনে তিনি বললেন, ওয়াজিব হয়ে গেছে। এরপর তৃতীয় জানাযা নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল এবং তার সম্পর্কে খারাপ মন্তব্য করা হল। এবারও তিনি বললেন, ওয়াজিব হয়ে গেছে। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, কি ওয়াজিব হয়ে গেছে, হে আমীরুল মু’মিনীন? তিনি বললেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেমন বলেছিলেন, আমি তেমন বললাম। (তিনি বলেছিলেন) কোন মুসলিম সম্পর্কে চার জন লোক ভাল সাক্ষ্য দিলে আল্লাহ্‌ তাঁকে জান্নাতে দাখিল করবেন। তিনি বললেন, তিনজন সাক্ষ্য দিলেও। আমরা জিজ্ঞাসা করলাম, দু’জন সাক্ষ্য দিলে? তিনি বললেন, দু’জন সাক্ষ্য দিলেও। এরপর আমরা একজনের সাক্ষ্য সম্পর্কে তাকে কিছু জিজ্ঞাসা করিনি।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
বর্ণনাকারীঃ আবুল আসওয়াদ (রহঃ)


তথ্যসূত্র

  1. সহীহ বুখারী, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, হাদিসঃ ৫৩২০ []
  2. সহীহ বুখারী, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, হাদিসঃ ৬৯৬৫ []
  3. সহীহ বুখারী, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, হাদিসঃ ২৪৬৭ []


সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত © ২০২৪ "সংশয় - চিন্তার মুক্তির আন্দোলন"